এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা করো।” নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাস পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই “বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা করো।“ প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের ষষ্ট অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা“ -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।

বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা করো।
রুশ বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জী, মহম্মদ আলি সহ চব্বিশ জন প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের নিয়ে রাশিয়ার তাসখন্দে 1920 খ্রিস্টাব্দের 17 অক্টোবর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলেন, সম্পাদক হন মহম্মদ সিদ্দিকি। তবে ভারতের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় 1925 খ্রিস্টাব্দের 26 ডিসেম্বর উত্তর প্রদেশের কানপুরে, সম্পাদক হন এস. বি. ঘাটে। দু-বার জন্মের জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘দ্বিজ’ বলা হয়।
কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন অন্য মাত্রা লাভ করে। তবে মানবেন্দ্রনাথ রায় কৃষক অপেক্ষা শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন, কারণ জমির প্রতি কৃষকদের লোভকে তিনি পুঁজিবাদী মনোভাব বলে মনে করতেন।
ভারতে বামপন্থী আন্দোলনের লক্ষ ছিল কৃষক ও শ্রমিক শোষণ বন্ধ করা, জমিদারি প্রথার বিলোপ, সাম্যবাদের প্রসার ঘটানো, কৃষক-শ্রমিক শ্রেণিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে শামিল করা এবং ব্রিটিশ অধীনতামুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতা লাভকরা।
বামপন্থীরা শ্রমিক ও কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ‘সোশ্যালিস্ট’, ‘ইনকিলাব’, ‘গণবাণী’, ‘লাঙল’, ‘লেবার কিষান গেজেট’, ‘কীর্তি’ প্রভৃতি প্রকাশ করেন এবং বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নও তৈরি হয়, যেমন – ‘গিরনি-কামগার ইউনিয়ন’।
শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে মাদ্রাজের সমুদ্র তটে 1923 খ্রিস্টাব্দে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের নেতৃত্বে প্রথম মে দিবস পালিত হয়। কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্য ঘটাতে 1928 খ্রিস্টাব্দে কুতুব উদ্দিন আহমেদ, কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্ত সরকার, নলিনী গুপ্ত প্রমুখরা ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টি’ গড়ে তোলেন। এই দলই প্রথম প্রস্তাব গ্রহণ করে-সম্পূর্ণ স্বাধীনতা কংগ্রেসের লক্ষ হওয়া উচিত।
বামপন্থীদের প্রভাবে 1927 খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। 1928 খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রায় 203টি শ্রমিক ধর্মঘট পালিত হয়, যাতে প্রায় পাঁচ লক্ষ শ্রমিক যোগ দেয়। 1929 খ্রিস্টাব্দে বাংলার চটকলগুলিতে শ্রমিকরা সর্বাত্মক ধর্মঘটে নামে এবং দেড় লক্ষ শ্রমিক এতে যোগ দেয়।
বামপন্থীদের ব্যাপক প্রসার, শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে তাদের প্রভাব এবং কল-কারখানায় ক্রমাগত ধর্মঘট ব্রিটিশ সরকারকে আতঙ্কিত করে তোলে। শ্রমিকদের থেকে কমিউনিস্টদের আলাদা করা এবং তাদের দমন করার জন্য সরকার ‘জন নিরাপত্তা বিল’ পাস করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে 33 জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা (1929 খ্রিস্টাব্দে) শুরু করে।
1934 খ্রিস্টাব্দের 23 জুলাই ব্রিটিশ সরকার ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করলে বামপন্থীরা জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলার কর্মপন্থা গ্রহণ করে।
1942 খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে বামপন্থীরা তাতে যোগদান করা থেকে বিরত থাকে। আন্দোলন শুরুর ক্ষেত্রে জাতীয় কংগ্রেসের অহেতুক কালবিলম্বকে তারা মেনে নিতে পারেনি। তাদের মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় ইংল্যান্ড যখন প্রাথমিক ভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল, তখন তাকে আঘাত না করে জাতীয় কংগ্রেস পরোক্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকেই সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিল।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাপতি রশিদ অলির বিচার ও কারাদণ্ডকে কেন্দ্র করে তারা আন্দোলনে নামে এবং 1946 খ্রিস্টাব্দের 12 ফেব্রুয়ারি রশিদ অলি দিবস পালন করে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে বাংলার তেভাগা ও হায়দ্রাবাদের তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলনেও তারা মুখ্য সংগঠকের ভূমিকা নেন।
কমিউনিস্ট পার্টি অখণ্ড ভারতের সমর্থক ছিল। 1947 খ্রিস্টাব্দের দেশভাগকে তারা মেনে নিতে পারেনি। তাদের মতে ক্ষমতার মোহে অন্ধ কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ নিজেদের স্বার্থে দেশভাগ মেনে নিয়েছিল। তারা শ্লোগান তোলে ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতেও নির্যাতিত, নিপীড়িত শ্রমজীবি মানুষের জন্য বামপন্থীরা নিরন্তর সংগ্রামে রত।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
বিংশ শতকের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কবে এবং কোথায় গঠিত হয়?
1. প্রথম গঠন – 1920 সালের 17 অক্টোবর রাশিয়ার তাসখন্দে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জী, মহম্মদ আলি প্রমুখের নেতৃত্বে।
2. ভারতে আনুষ্ঠানিক গঠন – 1925 সালের 26 ডিসেম্বর কানপুরে (সম্পাদক – এস. বি. ঘাটে)।
বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের মূল লক্ষ্য কী ছিল?
বামপন্থীদের মূল লক্ষ্য ছিল –
1. শ্রমিক-কৃষক শোষণ বন্ধ।
2. জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ।
3. সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা।
4. ব্রিটিশ শাসন থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন।
বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীরা শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করতে কী কী পদক্ষেপ নেয়?
বামপন্থীরা শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করতে পদক্ষেপ নেয় –
1. শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন (যেমন – গিরনি-কামগার ইউনিয়ন)।
2. পত্রিকা প্রকাশ – সোশ্যালিস্ট, ইনকিলাব, গণবাণী, লাঙল ইত্যাদি।
3. 1928 সালে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি গঠন।
4. 1923 সালে মাদ্রাজে প্রথম মে দিবস পালন।
বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা কী?
1929 সালে ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট নেতাদের দমনের জন্য 33 জনকে গ্রেপ্তার করে এবং “মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা” শুরু করে।
1942 সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা কী ছিল?
বামপন্থীরা এই আন্দোলনে যোগ দেয়নি, কারণ তারা মনে করত—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ দুর্বল অবস্থায় থাকলেও কংগ্রেস দেরিতে আন্দোলন শুরু করে সুযোগ হারিয়েছে।
তেভাগা ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা কী ছিল?
1. তেভাগা আন্দোলন (বাংলা, 1946 খ্রিস্টাব্দ) – কৃষকরা ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ দাবি করে, বামপন্থীরা নেতৃত্ব দেয়।
2. তেলেঙ্গানা আন্দোলন (হায়দ্রাবাদ, 1946-1951 খ্রিস্টাব্দে) – জমিদারি উচ্ছেদ ও কৃষক স্বাধীনতার লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা নেতৃত্ব দেয়।
বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে দেশভাগ সম্পর্কে বামপন্থীদের অবস্থান কী ছিল?
তারা দেশভাগের বিরোধিতা করে এবং শ্লোগান দেয় — “ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়” (এই স্বাধীনতা মিথ্যা)। তাদের মতে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ক্ষমতার লোভে দেশভাগ মেনে নিয়েছিল।
কমিউনিস্ট পার্টি কেন ‘দ্বিজ’ নামে পরিচিত?
কমিউনিস্ট পার্টি দুইবার গঠিত হওয়ায়— প্রথমবার 1920 সালে তাসখন্দে, দ্বিতীয়বার 1925 সালে কানপুরে।
বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীরা কেন কৃষকদের চেয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে বেশি জোর দিয়েছিল?
মানবেন্দ্রনাথ রায় মনে করতেন, কৃষকদের জমির লোভ “পুঁজিবাদী মানসিকতা” তৈরি করে, তাই শ্রমিকদের সংগঠন।
1934 সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর বামপন্থীরা কী করেছিল?
1934 সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর বামপন্থীরা কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলে।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা করো।” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই “বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা করো।” প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের ষষ্ঠ অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন