আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) ভূগোলের তৃতীয় অধ্যায় “বারিমণ্ডল” -এর “সমুদ্রস্রোত” বিভাগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ “সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর” নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) ভূগোল পরীক্ষার জন্য ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

পৃথিবীতে কয়টি ও কী কী মহাসাগর আছে?
পৃথিবীতে পাঁচটি মহাসাগর আছে –
- প্রশান্ত মহাসাগর,
- আটলান্টিক মহাসাগর,
- ভারত মহাসাগর,
- সুমেরু মহাসাগর এবং
- কুমেরু মহাসাগর।
শৈবাল সাগর কাকে বলে?
অথবা, শৈবাল সাগর কী?
পশ্চিমে উপসাগরীয় স্রোত, উত্তরে উত্তর আটলান্টিক স্রোত, পূর্বে ক্যানারি স্রোত এবং দক্ষিণে উত্তর নিরক্ষীয় স্রোতের মধ্যবর্তী অংশে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বিশাল আয়তাকার এলাকা জুড়ে একটি জলাবর্ত বা ঘূর্ণস্রোতের সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এই জলাবর্তের মধ্যাংশ স্রোতবিহীন অর্থাৎ মাঝখানে জলের কোনো দিকেই প্রবাহ থাকে না। ফলে ওই স্রোতবিহীন অঞ্চলে নানারকম আগাছা, শৈবাল ও জলজ উদ্ভিদ জন্মায়। এজন্য ওই অংশের নাম সারগাসো সমুদ্র (sargasso sea) বা শৈবাল সাগর।

উপসাগরীয় স্রোত বলতে কী বোঝ?
আটলান্টিক মহাসাগরে দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের উত্তর শাখা (উষ্ণ) এবং উত্তর নিরক্ষীয় স্রোতের (উষ্ণ) মিলিত ধারা যখন আয়ন বায়ুর প্রভাবে পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে মেক্সিকো উপসাগরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন ওই স্রোতটিকেই উপসাগরীয় স্রোত বলা হয়।
নীল রঙের উষ্ণ এই স্রোতটির উষ্ণতা 27°C, বিস্তার 65 কিলোমিটার, গভীরতা 915 মিটার এবং গতিবেগ ঘণ্টায় গড়ে 8 কিলোমিটার।
সমুদ্রস্রোত কাকে বলে?
সমুদ্রের জলরাশি নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট দিকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রবাহিত হয়। সমুদ্রজলের এই প্রবাহকেই বলে সমুদ্রস্রোত। সমুদ্রস্রোত দু-প্রকার – উষ্ণস্রোত এবং শীতলস্রোত।
হিমপ্রাচীর কী?
উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূল দিয়ে পাশাপাশি প্রবাহিত উত্তরমুখী উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের ঘন নীল জল এবং দক্ষিপমুখী শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের সবুজ জলের মাঝে এক বিভাজন রেখা বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। এই বিভাজন রেখাকে ‘হিমপ্রাচীর’ বলা হয়।
মগ্নচড়া কীভাবে সৃষ্টি হয়?
অথবা, মগ্নচড়া বলতে কী বোঝ?
উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে শীতল স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা হিমশৈল, উষ্ণ স্রোতের সংস্পর্শে গলে যায়। ফলে হিমশৈলের মধ্যে থাকা পাথর, নুড়ি, বালি প্রভৃতি সমুদ্রবক্ষে দীর্ঘকাল ধরে জমতে জমতে উঁচু হয়ে যে নিমগ্ন ভূভাগের সৃষ্টি করে তাকে মগ্নচড়া বলা হয়। যেমন – নিউফাউন্ডল্যান্ড উপকূলের অদূরে গ্র্যান্ড ব্যাংক, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের অদূরে সমুদ্রবক্ষে ডগার্স ব্যাংক প্রভৃতি বিখ্যাত মগ্নচড়ার উদাহরণ।
ল্যাব্রাডর স্রোত কোনটি?
আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তরাংশের একটি শীতল স্রোতের নাম ল্যাব্রাডর স্রোত। সুমেরু মহাসাগর থেকে মেরু বায়ুর প্রভাবে যে শীতল স্রোতটি গ্রিনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূল ধরে (অর্থাৎ কানাডা ও গ্রিনল্যান্ডের মধ্যভাগ দিয়ে) দক্ষিণদিকে এগিয়ে আসে এবং গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণে এসে ল্যাব্রাডর উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল দিয়ে আরও দক্ষিণে প্রবাহিত হয়, তাকেই বলা হয় ল্যাব্রাডর স্রোত।
ব্রাজিল স্রোত কাকে বলে?
আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় মধ্যভাগে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর প্রভাবে পশ্চিমমুখী দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের উৎপত্তি হয়। পশ্চিমদিকে যেতে যেতে এই উষ্ণ দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত ব্রাজিলের সাও রোক (সেন্ট রক) অন্তরীপের কাছে ধাক্কা খেয়ে উত্তর ও দক্ষিণ এই দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। এগুলির মধ্যে দক্ষিণের শাখাটির নাম ব্রাজিল স্রোত।
পেরু স্রোত বা হামবোল্ড স্রোত কী?
প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণাংশে পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে কুমেরু মহাসাগর থেকে একটি শীতল স্রোত উৎপন্ন হয়ে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়। এই স্রোতটি শেষে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উত্তরদিকে যাওয়ার পথে চিলি পেরিয়ে পেরুর উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এরই নাম পেরু স্রোত বা হামবোল্ড স্রোত।
জাপান স্রোত বা কুরোশিয়ো স্রোত কাকে বলে?
দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যভাগে পশ্চিমগামী উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত সৃষ্টি হয়। এই স্রোতটি উত্তরাভিমুখী হয়ে পূর্ব জাপানের উপকূল বরাবর প্রবাহিত হয়। এই স্রোতটিরই নাম জাপান স্রোত বা কুরোশিয়ো স্রোত।
বেঙ্গুয়েলা স্রোত কী?
কুমেরু মহাসাগর থেকে উৎপন্ন শীতল কুমেরু স্রোত আটলান্টিক মহাসাগরের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়। এই স্রোতটি শেষে আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে বাধা পেয়ে উত্তরদিকে বেঁকে যায়। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ধরে প্রবাহিত এই শীতল স্রোতটিরই নাম বেঙ্গুয়েলা স্রোত।
মৌসুমি স্রোত কী?
ভারত মহাসাগরের উত্তরাংশে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গ্রীষ্মকালে ও শীতকালে দুই বিপরীতমুখী মৌসুমি স্রোতের উৎপত্তি হয়।
- গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এই অংশে সমুদ্রস্রোত দক্ষিণাবর্তে প্রবাহিত হয় অর্থাৎ আফ্রিকার পূর্ব উপকূল ধরে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে একটি সমুদ্রস্রোত সুমাত্রা দ্বীপ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়।
- শীতকালে এই স্রোতটি উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঠিক বিপরীত দিকে অর্থাৎ বামাবর্তে প্রবাহিত হয়। যেহেতু ভারত মহাসাগরের উত্তরাংশের সমুদ্রস্রোত এইভাবে মৌসুমি বায়ুর দিক পরিবর্তন অনুসারে নিয়ন্ত্রিত হয় তাই একে মৌসুমি স্রোত বলা হয়।
জায়র বা চক্রগতি বা কুণ্ডলী কী?
ধারণা – প্রতিটি মহাসাগরেই সমুদ্রস্রোতগুলির গতিপথ অনুসরণ করলে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। বৈশিষ্ট্যটি হল জায়র (gyre) বা চক্রগতি অর্থাৎ সমুদ্রের জলরাশির চক্রাকার গতি।
পৃথিবীব্যাপী নিয়ত বায়ুপ্রবাহের চলাচল ও পৃথিবীর আবর্তন গতির প্রভাবে উৎপন্ন কোরিওলিস শক্তির ফলে সমুদ্রের বিপুল পরিমাণ জলরাশি ঘুরতে থাকে। সমুদ্রে জলরাশির এই চক্রাকার গতিকে চক্রগতি বলে। ল্যাটিন শব্দ ‘gyre’ -এর অর্থ গোল বা গোলাকার পথ। তাই জায়র বলতে জলরাশির চক্রগতিকেই বোঝায়।

হিমশৈল বলতে কী বোঝ?
স্থলভাগে তৈরি বরফ মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমুদ্রে বিশাল বা ক্ষুদ্রাকৃতি বরফের চাঁই হিসেবে ভাসমান থাকলে, তাকে হিমশৈল বলে। ওলন্দাজ শব্দ ‘ijsberg’ -এর আক্ষরিক অর্থ হল বরফের পর্বত। এই ধরনের বরফের চাঁই অনেকসময় বিশাল বরফের স্তূপ রূপে সমুদ্রের জলে ভাসতে ভাসতে অগ্রসর হয়। সমুদ্রে ভাসমান হিমশৈলের মোট আয়তনের মাত্র \(\frac1{10}\) ভাগ অংশ জলের ওপরে থাকে।

উদাহরণ – বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিক এরূপ একটি হিমশৈলের আঘাতে সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল।
অন্তঃস্রোত কী?
মেরু প্রদেশের শীতল এবং ভারী সমুদ্রজল সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে উষ্ণমণ্ডলের দিকে প্রবাহিত হয়। একে অন্তঃস্রোত বলে।
বহিঃস্রোত কী?
উষ্ণমণ্ডল থেকে প্রবাহিত স্রোত উষ্ণ এবং হালকা বলে জলের উপরিপৃষ্ঠ দিয়ে শীতল মেরু অঞ্চলের দিকে এগিয়ে যায়। এই স্রোতের নাম পৃষ্ঠস্রোত বা বহিঃস্রোত।
জাপান উপকূলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় কেন?
জাপানের পূর্ব উপকূলে শীতল ওয়াশিয়ো স্রোত ও উষ্ণ কুরোশিয়ো স্রোতের মিলন হয়। শীতল ওয়াশিয়ো স্রোতের বয়ে আনা হিমশৈল এখানে গলে গিয়ে মগ্নচড়া সৃষ্টি করে। এই মগ্নচড়া সন্নিহিত অংশে প্রচুর পরিমাণে প্ল্যাঙ্কটন জন্মায়, যা মাছের প্রধান খাদ্য। একারণে জাপান উপকূলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।
নিউফাউন্ডল্যান্ডের কাছে প্রায়শই ঘনকুয়াশা ও ঝড়ঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয় কেন?
নিউফাউন্ডল্যান্ডের কাছে ঘনকুয়াশা ও ঝড়ঝঞ্ঝা –
নিউফাউন্ডল্যান্ড দ্বীপটি কানাডার পূর্ব উপকূলের কাছেই অবস্থিত। এই দ্বীপটির কাছ দিয়েই উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোত এবং শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত পাশাপাশি বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এর ফলে উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের ওপর সৃষ্ট প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত শীতল ও শুষ্ক বায়ুর সংস্পর্শে এসে সহজেই ঘনীভূত হয় এবং সংলগ্ন অঞ্চলে ঘনকুয়াশার সৃষ্টি করে। এ ছাড়া এই দুই উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোতের ওপর সৃষ্ট দুই বিপরীতধর্মী বায়ু পরস্পর বিপরীতমুখী হওয়ায় এদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং তার ফলে এখনে নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ঘটে, যার পরিণামে নিউফাউন্ডল্যান্ডসহ সংলগ্ন অঞ্চলে প্রায়শই ঝড়ঝঞ্ঝাও হয়।
আটলান্টিক মহাসাগরের দুটি উষ্ণ স্রোতের নাম করো।
আটলাস্টিক মহাসাগরের দুটি উষ্ণ স্রোত –
- উপসাগরীয় স্রোত এবং
- ব্রাজিল স্রোত।
শৈবাল সাগর প্রশান্ত মহাসাগরের কোথায় দেখা যায়?
প্রশান্ত মহাসাগরের শৈবাল সাগর – উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় মধ্যভাগে (নিরক্ষরেখার উত্তরে) কর্কটক্রান্তি রেখার উভয় পাশ জুড়ে এই শৈবাল সাগরটি গড়ে উঠেছে।
প্রশান্ত মহাসাগরের শৈবাল সাগর কোন্ কোন্ স্রোত দ্বারা আবদ্ধ?
প্রশান্ত মহাসাগরের শৈবাল সাগর বেষ্টনকারী সমুদ্রস্রোত – উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় মধ্যভাগে উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত, কুরোশিয়ো বা জাপান স্রোত, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোত এবং ক্যালিফোর্নিয়া স্রোতের আবর্তের মাঝখানে এই শৈবাল সাগরটি অবস্থিত।
আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) ভূগোলের তৃতীয় অধ্যায় “বারিমণ্ডল” -এর “সমুদ্রস্রোত” বিভাগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ “সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) ভূগোল পরীক্ষার জন্য ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায় দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। তাছাড়া নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন