আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ‘বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা‘ প্রবন্ধ রচনাটি নিয়ে আলোচনা করব। মাধ্যমিক বা স্কুল পরীক্ষায় এই রচনাটি প্রায়ই আসে এবং এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা। একবার ভালোভাবে আয়ত্ত করলে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি — যেকোনো ক্লাসের পরীক্ষাতেই তোমরা এই রচনার প্রশ্নের উত্তর সহজেই লিখতে পারবে!

বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা
“তপের প্রভাবে বাঙালী সাধক জড়ের পেয়েছে সাড়া,
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
আমাদের এই নবীন সাধনা শবসাধনার বাড়া।
বিষম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙালী দিয়েছে বিয়া,
মোদের নব্য রসায়ন শুধু গরমিলে মিলাইয়া।”
ভূমিকা – বঙ্গজননী রত্নপ্রসবা। বাংলার মাটি বড়ো উর্বর ও কোমল। দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান সর্বক্ষেত্রেই বাংলার মাটিতে সোনা ফলেছে। জাতীয় ইতিহাসে বাঙালি বৈজ্ঞানিকদের প্রতিভা ও সাধনার শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজনস্বীকৃত। গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বাঙালি বৈজ্ঞানিকদের সাধনা বিশ্বের বিস্ময়।
বাঙালির বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষ – বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে উনবিংশ শতাব্দীকে ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বঙ্গভূমিতে বিজ্ঞানসাধনার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য শিক্ষার অবদান অনস্বীকার্য। 1953 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সর্বসাধারণের শিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কালক্রমে বঙ্গে ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত হল। এই ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম ছিল বিজ্ঞানশিক্ষাদান। 1784 খ্রিস্টাব্দে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যথার্থভাবে বাঙালির বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষ ঘটে। বিজ্ঞানসাধনার কেন্দ্র হিসেবে হিন্দু কলেজ (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ), মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি বৈজ্ঞানিকরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি হল, ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট’, যেটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ; অপরটি হল, ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স’; যেটির প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালিদের অবদান – বাঙালি হিসেবে আন্তর্জাতিক গবেষণার ক্ষেত্রে যাঁদের নাম চিরতরে স্বর্ণাক্ষরে চিহ্নিত হয়ে আছে, তাঁরা হলেন – আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইতিহাসে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু নতুন দিগন্ত রচনা করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বগুলি হল, বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গ সম্পর্কে গবেষণা, জৈব ও অজৈব পদার্থের উত্তেজনার ফলে বৈদ্যুতিক সাড়া বিষয়ক গবেষণা এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর পেশির মধ্যে তুলনামূলক শারীরবিদ্যা বিষয়ক গবেষণা। জগদীশচন্দ্রই বিনা তারে বার্তা প্রেরণের উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি এক মাইল ব্যবধানের মধ্যে বেতারবার্তা পাঠানোর পরীক্ষানিরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন।
আবার রসায়নবিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের অবদান বিশ্বের বিস্ময়। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ নামক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থাপনা। তিনি বিজ্ঞানকে ব্যাবহারিক কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করেছেন। তবে প্রফুল্লচন্দ্রের সবথেকে বড়ো দান ও কৃতিত্ব তাঁর শিক্ষাধারায় নব্য রাসায়নিক গোষ্ঠী সৃষ্টি। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে নীলরতন ধর, প্রিয়রঞ্জন রায়, জ্ঞান রায়, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পারমাণবিক গবেষণার ক্ষেত্রে যাঁর নাম উচ্চারণ না করে পারা যায় না তিনি হলেন মেঘনাদ সাহা। তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি হল কলকাতায় বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র ‘ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’। এ ছাড়া তাঁর বিজ্ঞানচিন্তা ছিল মূলত জ্যোতিঃ-পদার্থবিজ্ঞান সংক্রান্ত।
বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশও রাশিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। রাশিবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে করতে বিজ্ঞান-গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন তিনি। তিনি সারাজীবন সংখ্যায়ন তত্ত্বেই আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
‘পদ্মভূষণ’, ‘দেশিকোত্তম’ প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত সত্যেন্দ্রনাথ বসুও পদার্থবিদ্যার অগ্রগতিতে এক যুগান্তর সূচিত করে বিশ্ববিজ্ঞানের মানচিত্রে পরাধীন ভারতকে এক সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাঙালি বৈজ্ঞানিকবৃন্দ – চিকিৎসাবিজ্ঞানেও বাঙালির অবদান কম নয়। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর ‘কালাজ্বর’ -এর ওষুধ আবিষ্কার, ড. সুবোধ মিত্রের ‘মিত্র অপারেশন’ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রশংসনীয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায় ও ড. রাধাগোবিন্দ রায়ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন।
উপসংহার – বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার কথা বলে শেষ করা যাবে না। তবে পরিতাপের বিষয় অধুনা বাঙালি বৈজ্ঞানিকরা তাঁদের বিজ্ঞানসাধনার ফসল বঙ্গজননীকে উপহার দিতে পারছেন না। এর প্রধান কারণ অর্থ। অধিক পরিমাণে অর্থলাভের আশায় তাঁরা বিদেশে গিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় রত থাকছেন। এ বিষয়ে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া বিদেশে যশ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে নবীন বাঙালি বৈজ্ঞানিকদের স্বদেশমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। তবেই বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বঙ্গজননী আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করতে পারবে।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ‘বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা‘ প্রবন্ধ রচনাটি নিয়ে আলোচনা করেছি। মাধ্যমিক বা স্কুল পরীক্ষায় ‘একটি অচল পয়সার আত্মকথা‘ রচনাটি প্রায়ই আসে এবং এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।





মন্তব্য করুন