এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।” নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাস পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই “বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।” প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের সপ্তম অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ“ -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
দলিত আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল অবিভক্ত বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলন।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের পরিচিতি –
বাংলার বহু প্রাচীন অধিবাসী চণ্ডালরা 1911 খ্রিস্টাব্দের জনগণনায় ‘নমঃশূদ্র’ নামে পরিচিত পায়। পূর্ববঙ্গের ছয় জেলা-যশোহর, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং ফরিদপুর ছিল নমঃশূদ্রদের আদি বাসস্থান।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক অবস্থান –
পেশাগত দিক থেকে নমঃশূদ্ররা ছিল মূলত কৃষিজীবি এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল কর্মের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সমাজে তারা ছিল অস্পৃশ্য ও অন্ত্যজ। শিক্ষা, সম্পত্তি, মন্দিরে প্রবেশ, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান প্রভৃতি অধিকার থেকে তারা ছিল বঞ্চিত এবং বর্ণহিন্দুদের অবিরাম শোষণ ও অত্যাচারের শিকার।
হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে নমঃশূদ্র আন্দোলন –
পূর্ববঙ্গের নিপীড়িত সম্প্রদায়কে নতুন জীবন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করে তাদের মধ্যে আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদা বোধের জাগরণ ঘটান হরিচাঁদ ঠাকুর। তিনি ‘মতুয়া’ নামে একটি ধর্মীয় সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া আন্দোলন ও মতাদর্শকে আরও জোরদার করে তোলেন।
নৈতিক জীবনাদর্শ প্রচার –
হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁদের অনুগামীদের মধ্যে প্রগতিমূলক আদর্শের প্রচার করেন। নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেন – “যার দল নাই, তার বল নাই।” মতুয়া ধর্মাবলম্বীদের তিনি ‘হাতে কাম ও মুখে নাম’ করার উপদেশ দেন। তিনি তাদের সৎ, সংযমী ও নৈতিক জীবনাদর্শ পালনের উপদেশ দেন।
নমঃশূদ্রদের মধ্যে শিক্ষা সংস্কার –
নমঃশূদ্রদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারকে হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ ঠাকুর সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। গুরুচাঁদ বলেন – “বাঁচি কিংবা মরি তাতে ক্ষতি নাই, গ্রামে গ্রামে পাঠশালা চাই।” তিনি মতুয়াদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার এবং তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নতিতে যত্নবান হন। তাঁর উদ্যোগে বহু সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
নমঃশূদ্র আন্দোলন –
মতুয়া ভাবধারাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্রদের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি, উচ্চবর্ণের শোষণ প্রতিরোধ প্রভৃতির উদ্দেশ্যে আন্দোলন শুরু হয়। হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ ঠাকুরের পৈতৃক ভিটে ওড়াকান্দি হয়ে ওঠে আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র।
পরবর্তীকালে নমঃশূদ্র আন্দোলন –
পরবর্তীকালে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, বিরাটচন্দ্র মণ্ডল প্রমুখের নেতৃত্বে মতুয়া আন্দোলন আরও সংগঠিত রূপ পায় এবং তা ক্রমশ একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ লাভ করে। 1902 খ্রিস্টাব্দে নমঃশূদ্র আন্দোলন সংগঠিত করার লক্ষ্যে আয়োজিত হয় ‘উন্নয়নী সভা’। মতুয়াদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঐক্য সুদৃঢ়করণের লক্ষ্যে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষ্যে উত্তর চব্বিশ পরগণার ঠাকুরনগরে আয়োজিত হয় বাৎসরিক বারুণী মেলা। নমঃশূদ্র আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যে ছিল বাল্য বিবাহ ও বিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহ প্রচলন, জাতিভেদ প্রথার বর্জন, সৎ এবং নৈতিক ভাবে জীবনযাপন করা প্রভৃতি।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের মন্তব্য –
নমঃশূদ্ররা আজও মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে। হরিচাঁদ, গুরুচাদ ঠাকুর মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছে প্রণম্য ব্যক্তিত্ব।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
নমঃশূদ্র আন্দোলন কী?
নমঃশূদ্র আন্দোলন ছিল বাংলার একটি দলিত আন্দোলন, যা নিম্নবর্ণের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত হয়েছিল। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে এই আন্দোলন মতুয়া ধর্ম ও সংস্কৃতির মাধ্যমে সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ ও শিক্ষার প্রসার ঘটায়।
নমঃশূদ্ররা কারা?
নমঃশূদ্ররা বাংলার একটি প্রাচীন দলিত সম্প্রদায়, যাদের আগে ‘চণ্ডাল’ নামে অভিহিত করা হত। 1911 সালের জনগণনায় তারা নিজেদের ‘নমঃশূদ্র’ হিসেবে পরিচয় দেয়। এরা মূলত পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর জেলায় বসবাস করত।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের নেতৃত্ব কে দিয়েছিলেন?
নমঃশূদ্র আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর (1812-1878 খ্রিস্টাব্দ) এবং তার পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর (1846-1937 খ্রিস্টাব্দ)। তারা মতুয়া ধর্ম প্রচার করে নমঃশূদ্রদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ ও শিক্ষার প্রসার ঘটান।
মতুয়া আন্দোলন কী?
মতুয়া আন্দোলন হল নমঃশূদ্র আন্দোলনের ধর্মীয় ও সামাজিক দিক, যা হরিচাঁদ ঠাকুর শুরু করেন। এই আন্দোলনের মূল মন্ত্র ছিল “হাতে কাম, মুখে নাম” (কাজের মাধ্যমে শ্রম ও ঈশ্বরের নাম স্মরণ)। এটি জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা ও বর্ণহিন্দুদের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল?
নমঃশূদ্র আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো ছিল –
1. নমঃশূদ্রদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা।
2. জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা দূর করা।
3. কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন।
4. বাল্যবিবাহ ও মদ্যপান রোধ করে সমাজ সংস্কার করা।
5. রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়ে দলিতদের অধিকার আদায় করা।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা সংস্কার কী ছিল?
গুরুচাঁদ ঠাকুর নমঃশূদ্রদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে বলেছিলেন, “বাঁচি কিংবা মরি তাতে ক্ষতি নাই, গ্রামে গ্রামে পাঠশালা চাই।” তার উদ্যোগে পূর্ববঙ্গে অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নমঃশূদ্ররা শিক্ষার আলো পায়।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের পরবর্তী নেতারা কারা ছিলেন?
পরবর্তীকালে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছিলেন প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল (পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী) এবং বিরাটচন্দ্র মণ্ডল প্রমুখ নেতারা।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের গুরুত্ব কী?
নমঃশূদ্র আন্দোলন বাংলার দলিতদের মধ্যে স্বাবলম্বী হওয়ার চেতনা জাগ্রত করেছিল। এটি শুধু ধর্মীয় আন্দোলনই নয়, বরং একটি সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল, যা পরবর্তীতে ভারত ও বাংলাদেশের দলিত আন্দোলনে প্রভাব ফেলে।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের স্লোগান কী ছিল?
গুরুচাঁদ ঠাকুরের বিখ্যাত স্লোগান ছিল—
“যার দল নাই, তার বল নাই।” (সংগঠনের শক্তির ওপর জোর দিয়ে)
“হাতে কাম, মুখে নাম।” (শ্রম ও ধর্মচর্চার সমন্বয়)
নমঃশূদ্র আন্দোলন বর্তমানে কীভাবে সক্রিয়?
বর্তমানে মতুয়া সম্প্রদায় এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বহন করছে। ঠাকুরনগরে বার্ষিক বারুণী মেলা এবং বিভিন্ন সামাজিক-শিক্ষামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে নমঃশূদ্রদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আজও জীবন্ত রয়েছে।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই “বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।” প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের সপ্তম অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন