এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “বিংশ শতকে ভারতে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।” নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাস পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই “বিংশ শতকে ভারতে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।” প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের ষষ্ট অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা“ -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।

বিংশ শতকে ভারতে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।
উনিশ শতকের সূচনায় ভারতে যে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল, তার কোনো অস্তিত্ব ছিলনা। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে মূলত ব্রিটিশ পুঁজির মাধ্যমে ভারতে চা-নীল-বাগিচা, খনি, রেলপথ, ডাক ও তার বিভাগ, চটকল, সুতাকল, লৌহ প্রভৃতি শিল্প গড়ে উঠে, তা থেকেই শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়।
শ্রমিকদের অবস্থা –
শ্রমিকদের অতি স্বল্প বেতনে নানা দুঃসহ পরিস্থিতিতে চরম দুর্দশার মধ্যে কাজ করতে হত। তারা দৈনিক 16 থেকে 18 ঘন্টা কাজ করত। তাদের উপর নানা ধরনের অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণ করা হত। তারা নিয়মিত বেতন পেতনা, দুই থেকে তিন মাস অন্তর তাদের মজুরি দেওয়া হত। শ্রমিকরা নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করত।
স্বদেশী আন্দোলনে শ্রমিকরা –
1905 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হলে, এই আন্দোলনে শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 1905 খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে হাওড়ার বার্ন আয়রন ওয়ার্কার্স এর কর্মীরা স্বদেশী যুগে প্রথম বাংলায় শ্রমিক ধর্মঘট শুরু করে। এটাই ছিল স্বদেশী যুগে বাংলার প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট। 1905 খ্রিস্টাব্দে 21 শে অক্টোবর প্রিন্টার্স এন্ড কম্পোজিটার্স লীগ গড়ে উঠে, যেটি বাংলার প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন। এইভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিক আন্দোলনের গতিবেগ –
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে লখনৌ চুক্তি ও হোমরুল আন্দোলনে শ্রমিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে।
1917 খ্রিস্টাব্দে লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রীক বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্যে সমগ্র বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীকে জাতিয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে।
শ্রমিক আন্দোলন ও জাতীয় কংগ্রেস –
1919 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের অমৃতসর অধিবেশনে ভারতীয় শ্রমিকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মান উন্নয়নে জাতীয় কংগ্রেস সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। চিত্তরঞ্জন দাশ ও লালা লাজপৎ রাই প্রমখ জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম শ্রেণীর নেতারা শ্রমিকদের পাশে এসে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণী-
1921 সালে অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিকরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বস্ত্রশিল্প, পাটশিল্প, রেল, কয়লাখনি, চা- বাগিচার শ্রমিকরা এই আন্দোলনে স্বতস্ফূর্ত ভাবে ধর্মঘটে অবতীর্ণ হয়। আমেদাবাদ,গুজরাট,কলকাতা প্রভৃতি স্থান গুলিতে শ্রমিকরা ব্যাপক ধর্মঘট শুরু করে। এই আন্দোলনে শ্রমিকদের নেতৃত্ব দেন স্বামী বিশ্বানন্দ ও স্বামী দর্শনানন্দ।
ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস পার্টি –
1928 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের সময় ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস পার্টির সারা ভারতে সম্মেলনের ডাক দেয়। এই সম্মেলনে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ পরণের জন্য শ্রেণীসংগ্রাম, বিনা ক্ষতি পরণে জমিদারি বিলোপ, শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি দান, বাক স্বাধীনতা এবং ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের স্বাধীনতা প্রভৃতির পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে। মূলকথা – এসময় কমিউনিস্টদের উদ্যোগে শ্রমিক আন্দোলন শক্তিশালী রূপ ধারণ করে।
আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণী –
1930 খ্রিস্টাব্দে বিশ্বব্যাপী মন্দা, সরকারি নিপীড়ন ও আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকরা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তারা বিভিন্ন স্থানে বস্ত্রকল, গান্ধীজির নেতৃত্বে লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণী –
1942 খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে শ্রমিকরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তারা বিভিন্ন স্থানে যেমন টাটা ইস্পাত কারখানা, আমেদাবাদ এর বস্ত্র কারখানায় সাত দিন থেকে প্রায় তিন মাস ধর্মঘট চালায়। কমিউনিস্টরা এই আন্দোলন থেকে সরে গেলে শ্রমিক শ্রেণী এই আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
শ্রমিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য –
ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো –
- ভারতীয় শ্রমিকরা অশিক্ষিত নিরক্ষর হলেও তাদের আন্দোলন ছিল স্বতস্ফূর্ত।
- শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব শ্রমিকরা দেয়নি শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতারা ছিল এই আন্দোলনের নেতা।
- ভারতীয় শ্রমিকরা সাধারণত শান্তিপূর্ণ ভাবেই তাদের আন্দোলন পরিচালনা করত।
- ইউনিয়ন গুলি ধর্মঘটের আগে গড়ে উঠত এবং ধর্মঘটের শেষে বিলুপ্ত হয়ে যেত।
শ্রমিক আন্দোলনের মূল্যায়ন –
শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব ছিল বহিরাগত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাতে। এইসব নেতারা নিজেদের দলীয় স্বার্থে আন্দোলন পরিচালনা করত। নীতি নির্ধারণ বা আন্দোলনের রণ কৌশল নির্ধারণে শ্রমিকদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সুতরাং অচিরেই এই শ্রমিক আন্দোলন ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা কিভাবে হয়েছিল?
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ পুঁজিবাদী শিল্পায়নের ফলে চা-নীল বাগান, রেলপথ, কয়লা খনি, বস্ত্রশিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। শ্রমিকদের শোষণ ও অমানবিক অবস্থার বিরুদ্ধেই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
স্বদেশী আন্দোলনে শ্রমিকদের ভূমিকা কী ছিল?
1905 সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকরা সক্রিয় অংশ নেয়। হাওড়ার বার্ন আয়রন ওয়ার্কস-এ প্রথম ধর্মঘট হয় এবং 1905 সালে কলকাতায় প্রিন্টার্স এন্ড কম্পোজিটার্স লীগ নামে প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিক আন্দোলনে কী পরিবর্তন আসে?
রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব (1917 খ্রিস্টাব্দ) ও লেনিনের আদর্শ ভারতীয় শ্রমিকদের প্রভাবিত করে। এ সময় শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন জোরদার হয়।
জাতীয় কংগ্রেস শ্রমিক আন্দোলনে কী ভূমিকা পালন করে?
1919 সালে কংগ্রেসের অমৃতসর অধিবেশনে শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়নে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ, লালা লাজপত রাই প্রমুখ নেতারা শ্রমিক আন্দোলনকে সমর্থন করেন।
অসহযোগ আন্দোলনে (1921 খ্রিস্টাব্দ) শ্রমিকরা কীভাবে অংশ নেয়?
আমেদাবাদ, কলকাতা, গুজরাটে বস্ত্রশিল্প, রেলওয়ে ও চা-বাগানের শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। স্বামী বিশ্বানন্দ ও দর্শনানন্দের নেতৃত্বে শ্রমিকরা আন্দোলনে যোগ দেয়।
ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস পার্টি (1928 খ্রিস্টাব্দ) কী ছিল?
এটি কমিউনিস্ট প্রভাবিত একটি সংগঠন যা শ্রমিক ও কৃষকদের স্বার্থে কাজ করত। এরা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, জমিদারি বিলোপ ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারের দাবি তোলে।
আইন অমান্য আন্দোলন (1930 খ্রিস্টাব্দ) ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে (1942 খ্রিস্টাব্দ) শ্রমিকদের ভূমিকা কী ছিল?
1. আইন অমান্য আন্দোলন 1930 সালে লবণ সত্যাগ্রহ ও বস্ত্রকল ধর্মঘটে শ্রমিকরা অংশ নেয়।
2. ভারত ছাড়ো আন্দোলনে 1942 সালে টাটা স্টিল প্ল্যান্ট, আমেদাবাদের বস্ত্রকল প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক ধর্মঘট হয়।
ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য কী ছিল?
ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল –
1. আন্দোলনগুলি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, কিন্তু নেতৃত্ব দিতেন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক নেতারা।
2. বেশিরভাগ আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল।
3. ট্রেড ইউনিয়নগুলি ধর্মঘটের সময় গঠিত হত এবং পরে বিলুপ্ত হয়ে যেত।
শ্রমিক আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল?
শ্রমিক আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাগুলি ছিল –
1. শ্রমিকদের অশিক্ষা ও সংগঠনের অভাব ছিল।
2. নেতৃত্ব বহিরাগত রাজনৈতিক দলগুলির হাতে থাকায় শ্রমিকদের স্বার্থ উপেক্ষিত হত।
3. দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের অভাব ছিল।
শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?
এটি ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে। পরবর্তীতে এটি শ্রমিক অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “বিংশ শতকে ভারতে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই “বিংশ শতকে ভারতে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।” প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের ষষ্ঠ অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন