কবি পরিচিতি
ভূমিকা – জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, তাঁর কাব্য বর্ণনাবহুল, তাঁর বর্ণনা চিত্রবহুল এবং তাঁর চিত্র বর্ণবহুল। সমালোচকদের মতে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং জনপ্রিয় কবি হলেন জীবনানন্দ দাশ।
জন্ম ও শৈশব – ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালের এক বৈদ্য পরিবারে জীবনানন্দের জন্ম হয়। জীবনানন্দের বাবার নাম সত্যানন্দ দাশ এবং মা কুসুমকুমারী দেবী। তিন ভাইবোনের মধ্যে জীবনানন্দ ছিলেন সবথেকে বড়ো। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন বরিশালে ব্রহ্মসমাজ আন্দোলনের অন্যতম হোতা এবং সমাজসংস্কারক। সর্বানন্দই নিজের পরিবারের পদবি থেকে গুপ্ত শব্দটিকে বর্জন করেন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ ছিলেন একজন শিক্ষক, প্রাবন্ধিক এবং ব্রহ্মবাদী নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক। জীবনানন্দের মা ছিলেন সেই যুগের খ্যাতনামা কবি। তাঁর বিখ্যাত কবিতা আদর্শ ছেলে, যার কয়েকটি পঙ্ক্তি আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে — আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে। ফলে বলাই বাহুল্য যে, জীবনানন্দ এক সাহিত্যিক পরিমণ্ডলেই তাঁর শৈশব কাটিয়েছেন।
ছাত্রজীবন – জীবনানন্দ দাশের পিতা খুব ছোটোবেলায় স্কুলে ভরতির বিরোধী ছিলেন। তাই জীবনানন্দের প্রাথমিক শিক্ষা হয় তাঁর মায়ের কাছেই। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে, নয় বছর বয়সে জীবনানন্দকে বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে ফিফ্থ গ্রেডে ভরতি করা হয়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। বরাবর মেধাবী ছাত্র জীবনানন্দ দাশ ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইনটারমিডিয়েট পাস করার পর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন। এই কলেজ থেকেই ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বিএ পাস করেন। ১৯২১ – এ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ইংরেজিতে এমএ পাস করেন।
কর্মজীবন – ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ কলকাতার সিটি কলেজে শিক্ষকতা করতে শুরু করেন। ১৯২৭-এ তাঁর এই চাকরিটি চলে যায়। এরপর কিছুদিন তিনি বাগেরহাট পিসি কলেজে এবং তারপর দিল্লির রামযশ কলেজে পড়ান। আবার তিনি বরিশালে ফিরে যান। ১৯৩০-এ লাবণ্যপ্রভা গুপ্তর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৯৩৫-এ তিনি বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। বছর দশেক পর তিনি আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯৫০-এ খড়গপুর কলেজে পড়াতে শুরু করেন কিন্তু এই চাকরিটিও তাঁকে ছাড়তে হয়। এরপর বেহালার বড়িশা কলেজ এবং সবশেষে হাওড়া গার্লস কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন।
সাহিত্যজীবন – জীবনানন্দ যে বছর বিএ পাস করেন সেই বছর অর্থাৎ ১৯১৯-এ ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তাঁর প্রথম কবিতা বর্ষ আবাহন প্রকাশিত হয়। ১৯২৭-এ প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক। এরপর একে-একে প্রকাশিত হয় তাঁর ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)। জীবনানন্দের রূপসী বাংলা এবং বেলা অবেলা কালবেলা কাব্যগ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর। তিনি কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছিলেন, যেমন —বাসমতীর উপাখ্যান, জীবনপ্রণালী, কারুবাসনা, ইত্যাদি। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্পগুলি হল একঘেয়ে জীবন, বৃত্তের মতো, চাকরি নেই, কুয়াশার ভিতর মৃত্যুর সময় ইত্যাদি। তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ, কবিতার আত্মা ও শরীর, রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সম্মান ও স্বীকৃতি – জীবনানন্দের মৃত্যুর পর ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে মরণোত্তর সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার প্রদান করেন।
জীবনাবসান – ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ অক্টোবর জীবনানন্দ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের কাছে ট্রামের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন। অনুরাগীদের প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও ২২ অক্টোবর মধ্যরাতে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে কবির মৃত্যু হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাকে বলেছিলেন চিত্ররূপময়। তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরেও দুই বাংলার বাঙালির কাছে তাঁর কবিতা সমানভাবে জনপ্রিয় ৷
উৎস
আকাশে সাতটি তারা কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। কবি এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করে যান আবহমান বাংলা, বাঙালি – কে। এই কাব্যগ্রন্থটি কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্থের ছয় সংখ্যক কবিতা। এই গ্রন্থের অন্তর্গত কবিতাগুলির নামকরণ কবি নিজে করে যাননি। আকাশে সাতটি তারা কবিতাটি চতুর্দশপদী অর্থাৎ চোদ্দো পঙ্ক্তির কবিতা হলেও একে সনেট বলা যাবে না। সনেটের বাঁধাধরা বৈশিষ্ট্যগুলিকে এই কবিতায় কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়নি। কবিতাটি কবির মনের আবেগ ও কল্পনার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ।
সারসংক্ষেপ
একজন শিল্পী যেমন রং-তুলিতে ছবি আঁকেন তেমনই জীবনানন্দ দাশ যেন কলমের আঁচড়ে শব্দের ছবি আঁকতেন। শব্দ নির্বাচনের গুণে তাঁর কবিতাকে শরীরের পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়েই যেন অনুভব করা যায়।
আকাশে সাতটি তারা কবিতাটিতে জীবনানন্দ বাংলার এক শান্ত সন্ধ্যার ছবি এঁকেছেন। একসঙ্গে যখন সাতটি তারার কথা বলা হয় তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কবি সপ্তর্ষিমণ্ডলের কথাই বলেছেন। সূর্যাস্তের আভায় পাকা কামরাঙা ফলের মতো লাল টুকটুকে মেঘ যখন দিগন্তরেখায় সাগরজলে ডুবে গেছে মনে হয় তখন ঢেউয়ের রং-ও হয়ে ওঠে লাল। কবির মনে হয় যেন এক মৃত মনিয়া পাখির রক্তে লাল হয়ে উঠেছে জল।
সূর্যের শেষ আভাটুকুও মিলিয়ে যায়, রাতের নিবিড় আঁধার নামার আগে দিনরাত্রির সন্ধিক্ষণে আসে বাংলার শান্ত নীল সন্ধ্যা। কবির মনে হয় যেন এক এলোকেশী মেয়ে দেখা দিয়েছে আকাশে। কবির কল্পনার সেই মেয়েটি আসলে সন্ধ্যাকালীন বাংলার রূপ। মাটির বুকে ধীরে ধীরে নেমে আসা অন্ধকার যেন তার কালো চুলের রাশি। কবির মুগ্ধ চোখের সামনে আঁধার ঘনিয়ে সে তার চুলের স্পর্শ অনুভব করায় কবিকে। কবি যেমন করে বাংলার মুখ দেখেছেন তেমন করে আর কেউ দেখেনি। পৃথিবীর কোনো পথ অর্থাৎ কোনো স্থানেই প্রকৃতির এমন মোহময়ী রূপ তিনি দেখেনি। সেই এলোকেশীর চুলের স্পর্শে হিজল-কাঁঠাল-জামের পাতা ছুঁয়ে নামে রাত্রি। রূপসি বাংলার সন্ধ্যার যে মধুর গন্ধ তা পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
ধান গাছ, কলমি শাক, হাঁসের ভেজা পালক, শরের মৃদু গন্ধ, পুকুরের সোঁদা গন্ধ, মাছের আঁশটে গন্ধ, কিশোরী মেয়ের চালধোয়া ভিজে ঠান্ডা হাতের গন্ধ, কিশোরের পায়ে দলা সুগন্ধি মুথাঘাসের গন্ধ আর বট ফলের হালকা গন্ধ মিলেমিশে তৈরি করে বাংলার সন্ধ্যার আমেজ৷ এই সহজসরল গ্রাম্য প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যেই কবি খুঁজে পান তাঁর রূপসি বাংলাকে।
নামকরণ
যে – কোনো সাহিত্যকর্মের মতোই কবিতার নামকরণও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবিতার ক্ষেত্রে সাধারণত বিষয়বস্তু অনুসারে অথবা ভাব বা ব্যঞ্জনা অনুযায়ী নামকরণ হয়ে থাকে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থটি কবির। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছিল। কবি এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির নামকরণ করেননি। কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি অনুসারে আকাশে সাতটি তারা নামটি সংকলকদের দেওয়া।
আকাশে সাতটি তারা কবিতাটিতে কবি দিনের একটি বিশেষ সময় সন্ধ্যাকে বেছে নিয়েছেন। কবির চোখে তাঁর অতি প্রিয় রূপসি বাংলা সন্ধ্যার সময় যে রূপে ধরা দিয়েছে তাকেই তিনি কাব্যিক ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন।
সবে যখন সূর্য অস্ত গিয়ে আকাশে দেখা দিয়েছে সপ্তর্ষিমণ্ডল তখন অস্তরাগের শেষ আভায় কামরাঙার মতো লাল মেঘ বিলীন হয় সাগরজলে। কবির মনে হয় এক এলোকেশী কন্যা যেন দেখা দিয়েছে বাংলার সান্ধ্য নীল আকাশে। মাটির বুকে ধীরে ধীরে নেমে আসা অন্ধকার যেন সেই মেয়ের ছড়িয়ে পড়া কালো চুলের রাশি। কবি তাঁর চোখ-মুখ-নাক অর্থাৎ তাঁর প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেন সেই ঘনিয়ে আসা অন্ধকারকে। তাঁর মনে হয় পৃথিবীর কোনো পথ বা অঞ্চল প্রকৃতির এমন মোহময়ী সৌন্দর্য দেখেনি। হিজল-কাঁঠাল- জামের পাতা চুঁইয়ে নামা রাত্রি যেন সেই রূপসির চুলের আদরমাখা স্পর্শ। শুধু চোখ বা ত্বক দিয়ে নয় কবি ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়েও অনুভব করেন সন্ধ্যাকে। পরিবেশের অনেক রকমের গন্ধ মিলেমিশে তৈরি হয়। সন্ধ্যার এক বিশেষ গন্ধ। ধান গাছ, কলমি শাক, জলে ভেজা হাঁসের পালক, শর ইত্যাদির মৃদু গন্ধ, পুকুরের সোঁদা গন্ধ, মাছের আঁশটে গন্ধ, কিশোরী মেয়ের চালধোয়া ভিজে ঠান্ডা হাতের গন্ধ, কিশোরের পায়ে দলা মুথাঘাসের গন্ধ আর বট ফলের হালকা গন্ধ মিশে তৈরি হয় বাংলার একান্ত নিজস্ব সন্ধ্যার মধুর শীতল গন্ধ। এইভাবে কবি বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শ দিয়ে অনুভব করেন বাংলাকে।
আকাশে সাতটি তারা যখন ফুটে ওঠে সেই সময় অর্থাৎ সন্ধ্যাই এই কবিতার মূল বিষয়বস্তু। আকাশে সাতটি তারা নামটি সেই বিষয়বস্তুরই ইঙ্গিত দেয়। সেদিক থেকে বলা যায় কবিতাটির নামকরণ যথাযথ।