আজকের আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের সপ্তম অধ্যায়, “জাতিসংঘ এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ” -এর “বিষয়সংক্ষেপ” নিয়ে আলোচনা করব। এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তু পড়ার সময় অধ্যায়টির কাঠামো ও প্রধান বিষয়াবলি বুঝতে সাহায্য করবে, যা আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, এই সংক্ষিপ্ত বিবেচনা আপনাদের প্রস্তুতি আরও ভালো করতে সাহায্য করবে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (1914 – 1918 খ্রিস্টাব্দ) ভয়াবহ ধ্বংসলীলা এবং নারকীয় হত্যাকাণ্ড মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। এই সময় বিশ্বের শান্তিকামী রাষ্ট্রনেতাগণ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। এর ফলস্বরূপ 1919 খ্রিস্টাব্দের 28 জুন প্যারিস শান্তি সম্মেলনে জাতিসংঘের চুক্তিপত্র গৃহীত হয়। 1920 খ্রিস্টাব্দের 16 জানুয়ারি জাতিসংঘের (League of Nations) প্রথম অধিবেশন বসে।
জাতিসংঘ (League of Nations) –
- প্রতিষ্ঠা – জানুয়ারি, 1920 খ্রিস্টাব্দ।
- সদর দপ্তর – জেনেভা (সুইটজারল্যান্ড)।
- সদস্য রাষ্ট্রসংখ্যা – 42টি (প্রতিষ্ঠাকালে)।
- মহাসচিব (প্রথম) – স্যার এরিক ড্রুমন্ড (Sir Eric Drummond)
- উদ্দেশ্য –
- আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা।
- প্রত্যেক রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে মর্যাদা দেওয়া।
- ন্যায় ও সততার ভিত্তিতে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখা।
- জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নতিসাধন।

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পটভূমি –
1917 খ্রিস্টাব্দের 22 জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) আমেরিকার সিনেটে ‘ওয়ার্ল্ড লিগ ফর পিস’ (World League for Peace) সম্বন্ধে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের কথা বলেছিলেন।
উড্রো উইলসন 1918 খ্রিস্টাব্দের 8 জানুয়ারি তাঁর যে বিখ্যাত ‘চোদ্দো দফা নীতি’ (Fourteen Points) ঘোষণা করেছিলেন তার চতুর্দশতম শর্তে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উল্লিখিত হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে আদর্শবাদী রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের জাতিসংঘ গঠনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব ভার্সাই সন্ধির (1919 খ্রিস্টাব্দ, Treaty of Versailles) প্রথম 26টি অনুচ্ছেদেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
উড্রো উইলসনের চোদ্দো দফা নীতি (Woodrow Wilson’s Fourteen Points) –
1918 খ্রিস্টাব্দে মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন কর্তৃক ঘোষিত চোদ্দোটি নীতি হল –
- Open covenants of peace, openly arrived at, after which there shall be no private international understandings of any kind but diplomacy shall proceed always frankly and in the public view.
- Absolute freedom of navigation upon the seas, outside territorial waters, alike in peace and in war, except as the seas may be closed in whole or in part by international action for the enforcement of international covenants.
- The removal, of all economic barriers and the establishment of equality of trade conditions among all the nations consenting to the peace and associating themselves for its maintenance.
- Adequate guarantees given and taken that national armaments will be reduced to the lowest point consistent with domestic safety.
- Free, open-minded, and absolutely impartial adjustment of all colonial claims, based upon a strict observance of the principle that in determining all such questions of sovereignty the interests of the populations concerned must have equal weight with the equitable claims of the government whose title is to be determined.
- The evacuation of all Russian territory and such a settlement of all questions affecting Russia as will secure the best and freest cooperation of the other nations of the world in obtaining for her an unhampered and unembarrassed opportunity for the independent determination of her own political development and national policy and assure her of a sincere welcome into the society of free nations under institutions of her own choosing; and, more than a welcome, assistance also of every kind that she may need and may herself desire. The treatment accorded Russia by her sister nations in the months to come will be the acid test of their good will, of their comprehension of her needs as distinguished from their own interests, and of their intelligent and unselfish sympathy.
- Belgium, the whole world will agree, must be evacuated and restored, without any attempt to limit the sovereignty which she enjoys in common with all other free nations. No other single act will serve as this will serve to restore confidence among the nations in the laws which they have themselves set and determined for the government of their relations with one another. Without this healing act the whole structure and validity of international law is forever impaired.
- All French territory should be freed and the invaded portions restored, and the wrong done to France by Prussia in 1871 in the matter of Alsace-Lorraine, which has unsettled the peace of the world for nearly fifty years, should be righted, in order that peace may once more be made secure in the interest of all.
- A readjustment of the frontiers of Italy should be effected along clearly recognizable lines of nationality.
- The people of Austria-Hungary, whose place among the nations we wish to see safeguarded and assured, should be accorded the freest opportunity to autonomous development.
- Romania, Serbia, and Montenegro should be evacuated; occupied territories restored; Serbia accorded free and secure access to the sea; and the relations of the several Balkan states to one another determined by friendly counsel along historically established lines of allegiance and nationality; and international guarantees of the political and economic independence and territorial integrity of the several Balkan states should be entered into.
- The Turkish portion of the present Ottoman Empire should be assured a secure sovereignty, but the other nationalities which are now under Turkish rule should be assured an undoubted security of life and an absolutely unmolested opportunity of autonomous development, and the Dardanelles should be permanently opened as a free passage to the ships and commerce of all nations under international guarantees.
- An independent Polish state should be erected which should include the territories inhabited by indisputably Polish populations, which should be assured a free and secure access to the sea, and whose political and economic independence and territorial integrity should be guaranteed by international covenant.
- A general association of nations must be formed under specific covenants for the purpose of affording mutual guarantees of political independence and territorial integrity to great and small states alike.

জাতিসংঘের মহাসচিবগণ (Secretary Generals of League of Nations) –
নাম | কার্যকাল |
জেমস এরিক ড্রুমন্ড (James Eric Drummond), ব্রিটেন | 1 আগস্ট, 1920 – 2 জুলাই, 1933 খ্রিস্টাব্দ। |
জোসেফ অ্যাভেনল (Joseph Avenol), ফ্রান্স | 3 জুলাই, 1933 – 31 আগস্ট, 1940 খ্রিস্টাব্দ। |
শঁ লেসটার (Sean Lester), আয়াল্যান্ড | 31 আগস্ট 1940 – 18 এপ্রিল, 1946 খ্রিস্টাব্দ। |
জাতিসংঘের আদর্শ –
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সম্প্রসারণ (Promotion of International Co-operation) এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা (Achieving of International peace and security) – জাতিসংঘের সনদে এই দুটিকেই প্রধান আদর্শ ও লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
জাতিসংঘ (League of Nations) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার চুক্তিপত্রে তার উদ্দেশ্যের বিশদ বিবরণ উল্লিখিত হয়েছে। জাতিসংঘের সনদে একটি প্রস্তাবনা ও 26টি ধারা ছিল। প্রস্তাবনা অংশে জাতিসংঘের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে –
- পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা।
- প্রত্যেক রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে মর্যাদা প্রদান।
- ন্যায় ও সততার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখা।
- আন্তর্জাতিক আইন, চুক্তি ও বিধিনিষেধের শর্তাবলি মান্য করা।
- মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে অবহেলিত নারী, শিশু ও শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষা করা।
- জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনের প্রচেষ্টা ইত্যাদি।
জাতিসংঘের গঠনতন্ত্র (Structure of League of Nations) –
- সাধারণ সভা (Assembly)
- পরিষদ (Council)
- সচিবালয় (Secretariat)

সাধারণ সভা (Assembly) –
জাতিসংঘের সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্থা ছিল সাধারণ সভা। জাতিসংঘের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের নিয়ে এটি গঠিত হয় অর্থাৎ জাতিপুঞ্জের সকল সদস্য রাষ্ট্রই ছিল সাধারণ সভার সদস্য। প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র 3 জন প্রতিনিধি। পাঠাতে পারত। কিন্তু প্রতি সদস্য রাষ্ট্র ছিল 1টি মাত্র ভোটদানের অধিকারী। প্রতি বছর অন্তত একবার সাধারণ সভার অধিবেশন বসত। এই অধিবেশনে আলোচনার বিষয় ছিল – বিশ্বশান্তি, আন্তর্জাতিক বিরোধ, বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক ও সংখ্যালঘু সমস্যা ইত্যাদি। সাধারণ সভার 2/3 সদস্যের সমর্থন পেলে কোনো নতুন রাষ্ট্র এর সদস্য হতে পারত।
পরিষদ (Council) –
লিগ পরিষদ গঠিত হয়েছিল 5টি স্থায়ী ও 4টি অস্থায়ী অর্থাৎ মোট 9টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে। স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলি ছিল – ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালি, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র বলে বিবেচনা করা হলেও সে জাতিসংঘে যোগদান করেনি। পরবর্তীকালে স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা 6 এবং অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা 9 অর্থাৎ মোট 15টি রাষ্ট্রকে সদস্য করা হয়েছিল। 1926 খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও 1934 খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত রাশিয়া জাতিসংঘের নতুন স্থায়ী সদস্যরূপে। যোগদান করেছিল। বছরে অন্তত 3 বার এই পরিষদের অধিবেশন বসত। লিগ পরিষদের প্রধান কাজ ছিল – আন্তর্জাতিক সমস্যা বিষয়ে আলোচনা ও তার সমাধান করা। কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে পরিষদের সকল সদস্যকে একমত হতে হত।
সচিবালয় (Secretariat) –
জাতিসংঘের সচিবালয় হল আসলে জাতিসংঘের মহাসচিব বা সাধারণ সম্পাদকের দপ্তর। জাতিসংঘের প্রথম মহাসচিব ছিলেন স্যার এরিক ড্রুমন্ড। সচিবালয় কয়েকটি ভাগে বিভক্ত ছিল, যেমন –
- নিরস্ত্রীকরণ,
- স্বাস্থ্য,
- সামাজিক সমস্যা,
- সংখ্যালঘু সমস্যা,
- আইন,
- প্রশাসন ইত্যাদি।
সচিবালয়ের কাজ ছিল – সাধারণ সভা ও লিগ কাউন্সিলের আলোচনার জন্য তথ্যাদি সরবরাহ; বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভিযোগ নথিভুক্ত করা; জরুরি কাগজপত্র সংরক্ষণ ও সভার অধিবেশন আহ্বান। সাধারণভাবে জাতিসংঘের সাফল্য সচিবালয়ের সাফল্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। জাতিসংঘের কেন্দ্রীয় কার্যালয় (প্রধান) ছিল সুইটজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে।
এ ছাড়া জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থাগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল – আন্তর্জাতিক বিচারালয় (Permanent Court of International Justice), আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (International Labour Organisation), যোগাযোগ সংস্থা, স্বাস্থ্য সংস্থা (Health Organisation), বুদ্ধিজীবী সমবায় সংস্থা (International Committee on Intellectual Co-operation) ও স্থায়ী দাসত্ব কমিশন (Permanent Slavery Commission) প্রভৃতি।
আন্তর্জাতিক বিচারালয় (PCIJ) –
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির ব্যাখ্যা ও মীমাংসার জন্য একটি বিচারালয় (PCIJ) ছিল। এর প্রধান কার্যালয় ছিল নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে। এই বিচারালয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের 15 জন বিচারক 9 বছরের মেয়াদে নিযুক্ত হয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (International Labour Organisation/ILO) –
জাতিসংঘের একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থা হল আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার প্রধান কাজ ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের অবস্থার মানোন্নয়ন এবং শ্রমিকরা যাতে শোষিত না হয়, তার দিকে লক্ষ রাখা। এর প্রধান কার্যালয় ছিল সুইটজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে। অনেক সদস্য রাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্য না হলেও বা জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করলেও ILO -র সদস্য ছিল। যেমন – আমেরিকা প্রভৃতি।
এ ছাড়াও জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময়ে নিম্নলিখিত সংস্থাগুলি গঠিত হয় –
- 1920 খ্রিস্টাব্দে যোগাযোগ সংস্থা (International Telecommunication Union),
- 1923 খ্রিস্টাব্দে স্বাস্থ্য সংস্থা (Health Organisation),
- 1926 খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী সমবায় সংস্থা (International Committee on Intellectual Co-operation),
- 1923 খ্রিস্টাব্দে স্থায়ী দাসত্ব কমিশন (Permanent Slavery Commission) গঠিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে বিজয়ী মিত্রশক্তিবর্গ পরাজিত শক্তিসমূহের উপনিবেশগুলি দখলের পর তার প্রশাসনিক দায়িত্ব দেয় জাতিসংঘকে। এর লক্ষ্য ছিল উপনিবেশগুলির জনগণের অবস্থা ও চেতনার মানোন্নয়নের মাধ্যমে তাদের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। এই ব্যবস্থাই ‘অছি’ (Mandate) ব্যবস্থা নামে পরিচিত।

বিভিন্ন নিরস্ত্রীকরণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনসমূহ (World Disarmament Conferences) –
- প্রথম নিরস্ত্রীকরণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন – 1932 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি।
- দ্বিতীয় নিরস্ত্রীকরণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন – 1932 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর।
- তৃতীয় নিরস্ত্রীকরণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন – 1934 খ্রিস্টাব্দ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বশান্তি এবং যুদ্ধের আবহাওয়া থেকে জনগণকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে জাতিসংঘ গঠিত হলেও নানা কারণে এই প্রতিষ্ঠান তার উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়। সূচনা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর 1946 খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের (The League of Nations) বিলুপ্তি ঘটে। জন্ম হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের (The United Nations Organisation)।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (United Nations Organisation) প্রতিষ্ঠার পটভূমি –
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাগণ বিশ্বকে ভয়াবহ যুদ্ধের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য একটি শান্তিকামী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। 1941 খ্রিস্টাব্দের জুন থেকে 1945 খ্রিস্টাব্দের 26 জুন পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা ও সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (U N O) নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 1945 খ্রিস্টাব্দের 24 অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ –
ঘোষণা/সম্মেলন | সময় | প্রতিনিধিত্বকারী দেশসমূহ/ব্যক্তিবর্গ | গুরুত্ব |
লন্ডন ঘোষণাপত্র (The London Declaration) | 1941 খিস্টাব্দ, জুন | ব্রিটেন, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা। | এই ঘোষণাপত্রে প্রথম বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়। |
আটল্যান্টিক সনদ (The Atlantic Charter) | 1941 খ্রিস্টাব্দ, আগস্ট | ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এবং আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বুজভেল্ট। | আন্তর্জাতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান; স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতার অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান; অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংযোগসাধন; প্রত্যেক মানুষকে ভয়মুক্ত স্বাধীন জীবনযাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করার কথা বলা হয়। |
ওয়াশিংটন সম্মেলন (The Washington Declaration) | 1942 খ্রিস্টাব্দ, জানুয়ারি | 26টি দেশ। | শত্রুর বিরুদ্ধে যৌথভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করা এবং পৃথক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর না করার শপথগ্রহণ করা হয়। এই সম্মেলনেই রুজভেল্ট ‘ইউনাইটেড নেশন’ শব্দ দুটির ব্যবহার করেন। |
মস্কো ঘোষণা (The Moscow Declaration) | 1943 খ্রিস্টাব্দ, অক্টোবর | ব্রিটেন, সোভিয়েত রাশিয়া,’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীবর্গ। | বিশ্বের শান্তিকামী জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। |
তেহরান ঘোষণা (Tehran Declaration) | 1943 খ্রিস্টাব্দ, নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর | চার্চিল, রুজভেল্ট এবং স্ট্যালিন। | এই ঘোষণায় একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। |
ডাম্বারটন ওক্স্ সম্মেলন (Dumberton Oaks Conference) | 1944 খ্রিস্টাব্দ, আগস্ট থেকে অক্টোবর | ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া এবং চিন। | একটি নতুন আন্তর্জাতিক শান্তিসংঘ স্থাপনের খসড়া প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ ছাড়াও জাতিপুঞ্জের গঠনকাঠামো ও রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করা হয়। |
ইয়াল্টা সম্মেলন (Yalta Conference) | 1945 খ্রিস্টাব্দ, ফেব্রুয়ারি | চার্চিল, স্ট্যালিন এবং রুজভেল্ট। | জাতিপুঞ্জের সনদের খসড়া নির্মিত হয়। তাতে সদস্যপদ প্রাপ্তির নিয়মাবলিও আলোচিত হয়। |
সানফ্রান্সিসকো সম্মেলন (San Francisco Conference) | 1945 খ্রিস্টাব্দ, এপ্রিল থেকে জুন | 50টি দেশ (পোল্যান্ড একদিন পরে যোগদান করায় সংখ্যা দাঁড়ায় 51)। | সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদে প্রথম স্বাক্ষর করা হয় এবং সকল সদস্য রাষ্ট্রের অনুমোদনের মাধ্যমে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। |
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (The United Nations Organisation) –
- প্রতিষ্ঠা – 24 অক্টোবর, 1945 খ্রিস্টাব্দ।
- সদর দপ্তর – নিউ ইয়র্ক (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
- সদস্য রাষ্ট্রসংখ্যা (বর্তমানে) – 193টি।
- মহাসচিব – অ্যান্টোনিও গুটারেস (Antonio Guterres)
- উদ্দেশ্য –
- আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা।
- বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সৌহার্দ্যস্থাপন।
- মানবাধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা।
- সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান।
- বিভিন্ন রাষ্ট্রের কার্যাবলি সুসংহত করা।
জাতিপুঞ্জের সনদ –
1945 খ্রিস্টাব্দে 25 এপ্রিল থেকে 26 জুন পর্যন্ত আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে বিশ্বের 50টি দেশের (পোল্যান্ড 1 দিন পরে যোগদান করায় সংখ্যা দাঁড়ায় 51) প্রতিনিধিবর্গ জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য, নীতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন এবং 26 জুন এই 51টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে জাতিপুঞ্জের সনদ গৃহীত হয়। সনদ হল জাতিপুঞ্জের সংবিধান। এই সনদে 1টি প্রস্তাবনা, 19টি অধ্যায় এবং 111টি ধারা আছে। সনদে জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য, নীতি ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
24 অক্টোবরকে বলা হয় ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ দিবস’ বা U N O Day।
জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য –
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য হল – বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য –
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের 1নং ধারায় তার উদ্দেশ্যগুলির উল্লেখ রয়েছে।
- আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা – সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রধান উদ্দেশ্য হল আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং এজন্য আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসংবাদের সুষ্ঠু সমাধান করা।
- বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সৌহার্দ্যস্থাপন – ‘সমানাধিকার’ ও ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’ স্বীকার করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি স্থাপন করা।
- মানবাধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা – জাতি-ধর্ম-বর্ণ-স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মানবাধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রকে সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ করা।
- সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান – পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানবতাবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমস্যার সমাধান করা।
- বিভিন্ন রাষ্ট্রের কার্যাবলি সুসংহত করা – উপরোক্ত উদ্দেশ্যগুলি বাস্তবায়িত করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের কার্যাবলি সুসংহত করে সমন্বয় সাধন করা।
বর্তমানেও বিশ্ববাসীর আর্থ-সামাজিক মানোন্নয়ন এবং সর্বপ্রকার বৈষম্য ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রয়াস অব্যাহত আছে।
- সদর দপ্তর – সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদর দপ্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত।
- প্রথম মহাসচিব – সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রথম মহাসচিব ছিলেন নরওয়ের রাজনীতিবিদ ট্রিগভি লি (Trygve Lie)।
- বর্তমান মহাসচিব – সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বর্তমান মহাসচিব হলেন পোর্তুগিজ রাজনীতিবদি অ্যান্টোনিও গুটারেস (Antonio Guterres)।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মহাসচিবগণ (Secretary Generals of United Nations Organisation) –
নাম | কার্যকাল |
ট্রিগভি লি (Trygve Lie), নরওয়ে | 2 ফেব্রুয়ারি, 1946 খ্রিস্টাব্দ – 10 নভেম্বর, 1952 খ্রিস্টাব্দ |
দ্যাগ হ্যামারশিল্ড (Dag HammarskjÖld), সুইডেন | 10 এপ্রিল, 1953 খ্রিস্টাব্দ – 18 সেপ্টেম্বর, 1961 খ্রিস্টাব্দ |
উ থান্ট (U Thant), মায়ানমার | 30 নভেম্বর, 1962 খ্রিস্টাব্দ – 31 ডিসেম্বর, 1971 খ্রিস্টাব্দ |
কুর্ট ওয়াল্ডহেইম (Kurt Waldheim), অস্ট্রিয়া | 1 জানুয়ারি, 1972 খ্রিস্টাব্দ – 31 ডিসেম্বর, 1981 খ্রিস্টাব্দী |
জেভিয়ার পেরেজ দ্য কুয়েলার (Javier Pérez de Cuéllar), পেরু | 1 জানুয়ারি, 1982 খ্রিস্টাব্দ – 31 ডিসেম্বর, 1991 খ্রিস্টাব্দ |
বুৎত্রাস বুৎত্রাস ঘালি (Boutros Boutros Ghali), মিশর | 1 জানুয়ারি, 1922 খ্রিস্টাব্দ – 31 ডিসেম্বর, 1996 খ্রিস্টাব্দ |
কোফি আন্নান (Kofi Annan), ঘানা | 1 জানুয়ারি, 1997 খ্রিস্টাব্দ – 31 ডিসেম্বর, 2006 খ্রিস্টাব্দ |
বান-কি-মুন (Ban-Ki-moon), দক্ষিণ কোরিয়া | 1 জানুয়ারি, 2007 খ্রিস্টাব্দ – 31 ডিসেম্বর, 2016 খ্রিস্টাব্দ |
অ্যান্টোনিও গুটারেস (Antonio Guterres), পোর্তুগাল | 1 জানুয়ারি, 2017 খ্রিস্টাব্দ – বর্তমান |
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের গঠনতন্ত্র (The Organs of United Nations Organisation) –

সাধারণ সভা (General Assembly) –
জাতিপুঞ্জের সনদের 9 থেকে 12নং ধারায় সাধারণ সভা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণ সভার বর্তমান সদস্যসংখ্যা 193। প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্র 5 জন করে প্রতিনিধি সাধারণ সভার অধিবেশনে পাঠাতে পারে। সাধারণ সভায় 1 জন সভাপতি ও 21 জন সহ-সভাপতি থাকেন। সনদে উল্লিখিত যে-কোনো বিষয়, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, নিরস্ত্রীকরণ, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়সমূহ নিয়ে সাধারণ সভা আলোচনা করতে পারে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে সাধারণ সভার অধিবেশন বসে।
নিরাপত্তা পরিষদ (Security Council) –
জাতিপুঞ্জের সনদের পঞ্চম অধ্যায়ে 23 থেকে 32নং ধারায় নিরাপত্তা পরিষদের গঠন ও কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সদস্যসংখ্যা 15। এর মধ্যে স্থায়ী সদস্যের সংখ্যা 5 এবং অস্থায়ী সদস্যের সংখ্যা 10। স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলি হল – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং চিন। 10টি অস্থায়ী সদস্যের মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির জন্য নির্দিষ্ট থাকে 5টি আসন, পশ্চিম ইউরোপ ও অন্যান্য দেশ থেকে 2টি, ল্যাটিন আমেরিকা থেকে 2টি এবং পূর্ব ইউরোপ থেকে 1টি অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান কর্তব্য হল বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (Economic and Social Council) –
জাতিপুঞ্জের সনদের 61 থেকে 72নং ধারায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এর বর্তমান সদস্যসংখ্যা 54। প্রতি বছর 18 জন সদস্য অবসর গ্রহণ করেন এবং 18 জন নতুন সদস্য নির্বাচিত হন। প্রত্যেক সদস্য 3 বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তবে কার্যকাল শেষ হওয়ার পর তাঁরা পুনর্নির্বাচিত হতে পারেন। এই সংস্থার প্রধান কর্তব্য হল – আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সমীক্ষা করে সাধারণ সভা, নিরাপত্তা পরিষদ বা সংশ্লিষ্ট বিশেষ সংস্থাসমূহের কাছে নিজের সুপারিশ পেশ করা।
অছি পরিষদ (Trusteeship Council) –
জাতিপুঞ্জের সনদের 86নং ধারায় বলা হয়েছে অছি পরিষদ নিম্নোক্ত তিন প্রকার সদস্য নিয়ে গঠিত –
- অছি অঞ্চলগুলির প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্র,
- নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যবৃন্দ এবং
- সাধারণ সভা কর্তৃক নির্বাচিত সদস্যগণ।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠার সময় পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের অধিবাসী স্বাধীনতালাভের উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। তাদের স্বায়ত্তশাসন লাভের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাদের কয়েকটি বৃহৎ শক্তির শাসনাধীনে রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৃহৎ বিদেশি শক্তির শাসনাধীনে থেকে যাতে তারা শোষণ ও অত্যাচারমুক্ত হয়ে স্বাধীনতালাভের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে সেই ব্যবস্থা করবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ। সানফ্রান্সিসকো সম্মেলনে ঘোষণা করা হয় যে, স্বাধীনতালাভের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হলে তবেই ওইসব অঞ্চল স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে। এই ব্যবস্থা ‘অছি ব্যবস্থা’ (Trusteeship System) নামে পরিচিত। এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্যই গঠন করা হয়েছিল অছি পরিষদ। তবে বিশ্বের সকল অছি-অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলি বর্তমানে স্বাধীনতা লাভ করায় এই অঙ্গটির বিলুপ্তি ঘটে।
আন্তর্জাতিক বিচারালয় (International Court of Justice) –
সনদের 2নং ধারায় আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে। সনদের 3নং ধারানুসারে 15 জন বিচারপতিকে নিয়ে এই আদালত গঠিত হয়। বিচারপতিগণ 9 বছরের জন্য নির্বাচিত হন। প্রতি 3 বছর অন্তর 5 জন বিচারপতি অবসর গ্রহণ করেন এবং 5 জন নতুন বিচারপতি নিযুক্ত হন। আন্তর্জাতিক আদালত প্রধানত আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইনের ব্যাখ্যা, আন্তর্জাতিক দায়দায়িত্ব লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক দায়িত্বভঙ্গের ক্ষতিপূরণের পরিমাপ নির্ধারণ প্রভৃতি কর্তব্য পালন করে থাকে।
কর্মদপ্তর বা সচিবালয় (Secretariat) –
সনদের 97নং ধারায় বলা হয়েছে, মহাসচিব এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কর্মীবৃন্দকে নিয়ে কর্মদপ্তর বা সচিবালয় গঠিত হবে। মহাসচিব হলেন কর্মদপ্তরের প্রধান। তাঁর অধীনে 8টি বিভাগ এবং প্রতিটি বিভাগে 1 জন করে উপমহাসচিব থাকেন। তাঁদের সাহায্য করার জন্য কয়েকজন সহকারী মহাসচিব থাকেন। জাতিপুঞ্জের প্রথম মহাসচিব ছিলেন ট্রিগভি লি এবং বর্তমান মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুটারেস। মহাসচিবের প্রধান কাজ হল কর্মদপ্তরের কর্মচারীদের নিয়োগ ও অপসারণ, জাতিপুঞ্জের বিভিন্ন বিভাগের বৈঠকের ব্যবস্থা করা ও তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা, সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদের বিভিন্ন অধিবেশনের কর্মসূচি নির্ধারণ করা ইত্যাদি।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাসমূহ (Some Important Agencies of U N O) –
নাম | প্রতিষ্ঠা | সদর দপ্তর এবং প্রধানের নাম | লক্ষ্য |
ILO (International Labour Organisation) | 1919 খ্রিস্টাব্দ | জেনেভা (সুইটজারল্যান্ড), গাই রাইডার (Guy Ryder) | শ্রমসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা, বিশেষত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মানোন্নয়ন এবং সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ কাজের ব্যবস্থা গ্রহণ। |
FAO (Food and Agricultural Organisation) | 16 অক্টোবর, 1945 খ্রিস্টাব্দ | রোম (ইটালি), ডঃ ক্যু দংউ (Dr. Qu Dongyu) | উন্নত এবং অনুন্নত সমস্ত রাষ্ট্রে খাদ্যসংকট দূরীকরণ। |
UNESCO (United Nations Educational, Scientific and Cultural Organisation) | 16 নভেম্বর, 1945 খ্রিস্টাব্দ | প্যারিস (ফ্রান্স), অদ্রে অ্যাজলে (Audrey Azoulay) | শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি এবং সুরক্ষা বজায় রাখা; ন্যায়, আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং প্রাথমিক স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব প্রদান। |
IMF (International Monetary Fund) | 27 ডিসেম্বর, 1945 খ্রিস্টাব্দ | ওয়াশিংটন ডি.সি. (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র), ক্রিস্টালিনা জিওরগিভা (Kristalina Georgieva)। | বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে প্রয়োজনে ঋণ প্রদান করা। |
UNICEF (United Nations Children’s Emergency Fund) | 11 ডিসেম্বর, 1946 খ্রিস্টাব্দ | নিউ ইয়র্ক (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র), হেনরিটা এইচ ফোর (Henrietta H Fore) | শিশু বিকাশ এবং উন্নতি, প্রাথমিক শিক্ষা এবং লিঙ্গসমতা, হিংসা এবং নির্যাতনের হাত থেকে বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রের শিশুদের সুরক্ষা প্রদান। |
WHO (World Health Organisation) | 7 এপ্রিল, 1948 খ্রিস্টাব্দ | জেনেভা (সুইজারল্যান্ড), টেড্রস অ্যাধানম (Tedros Adhanom) | বিভিন্ন ধরনের ব্যাধি বিশেষত সংক্রামক ব্যাধি দূরীকরণে লড়াই, বিশ্বের সমস্ত দেশের জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত শিক্ষার প্রসার ঘটানো। |
জাতিপুঞ্জের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক দিবসের তালিকা –
দিবস | বिষয় |
21 ফেব্রুয়ারি | আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। |
8 মার্চ | আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস। |
7 এপ্রিল | বিশ্ব স্বাস্থ্যদিবস। |
23 এপ্রিল | বিশ্ব পুস্তক তথা কপিরাইট দিবস। |
3 মে | বিশ্ব সংবাদপত্র স্বাধীনতা দিবস। |
5 জুন | বিশ্ব পরিবেশ দিবস। |
11 জুলাই | বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। |
6 আগস্ট | হিরোশিমা দিবস। |
8 সেপ্টেম্বর | আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। |
21 সেপ্টেম্বর | আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস। |
5 অক্টোবর | আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস। |
11 অক্টোবর | আন্তর্জাতিক শিশুকন্যা (Girl-Child) দিবস। |
16 অক্টোবর | বিশ্ব খাদ্য দিবস। |
24 অক্টোবর | সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ দিবস। |
20 নভেম্বর | বিশ্ব শিশু দিবস। |
1 ডিসেম্বর | বিশ্ব এইডস দিবস। |
10 ডিসেম্বর | মানবাধিকার দিবস। |
জাতিপুঞ্জের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক বর্ষতালিকা –
বর্ষ | বিষয় |
1970 | আন্তর্জাতিক শিক্ষাবর্ষ। |
1974 | বিশ্ব জনসংখ্যা বর্ষ। |
1975 | আন্তর্জাতিক মহিলা বর্ষ। |
1979 | আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ। |
1981 | আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী বর্ষ। |
1985 | আন্তর্জাতিক যুবা বর্ষ। |
1986 | আন্তর্জাতিক শান্তি বর্ষ। |
1990 | আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা বর্ষ। |
1994 | আন্তর্জাতিক পরিবার বর্ষ। |
1998 | আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বর্ষ। |
2000 | আন্তর্জাতিক শান্তি-সংস্কৃতি বর্ষ। |
2002 | আন্তর্জাতিক পর্বত বর্ষ। |
2003 | আন্তর্জাতিক স্বাদু জল বর্ষ। |
2005 | আন্তর্জাতিক খেলাধূলা ও শরীরচর্চাবর্ষ। |
2009 | আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা বর্ষ। |
2010 | আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য বর্ষ। |
2011 | আন্তর্জাতিক রসায়ন বর্ষ। |
2013 | আন্তর্জাতিক জল-সহযোগিতা বর্ষ। |
2014 | আন্তর্জাতিক পরিবার গঠন বর্ষ। |
2015 | আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষ। |
2016 | আন্তর্জাতিক ডালশস্য বর্ষ। |
2017 | আন্তর্জাতিক সুস্থায়ী উন্নয়নমূলক পর্যটন বর্ষ। |
2019 | আন্তর্জাতিক দেশীয় ভাষা বর্ষ। |
2020 | আন্তর্জাতিক বৃক্ষস্বাস্থ্য বর্ষ। |
2021 | আন্তর্জাতিক শান্তি ও প্রত্যয় বর্ষ। |
2022 | আন্তর্জাতিক কৃত্রিম মৎস্যচাষ ও জলজ গাছপালা উৎপাদন বা জীবজন্তুর বংশবৃদ্ধির প্রচেষ্টা বর্ষ। |
2023 | আন্তর্জাতিক বাজরা বর্ষ। |
2024 | আন্তর্জাতিক উষ্ট্রশাবক বর্ষ। |
আজকের আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের সপ্তম অধ্যায়, “জাতিসংঘ এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ” -এর “বিষয়সংক্ষেপ” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তু অধ্যয়নের সময় অধ্যায়টির কাঠামো ও প্রধান বিষয়াবলি বুঝতে সাহায্য করবে, যা আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সহায়ক হয়েছে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সহায়তার প্রয়োজন হয়, নিচে মন্তব্য করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত।
মন্তব্য করুন