ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল/গুরুত্ব আলোচনা করো।

Souvick

এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল/গুরুত্ব আলোচনা করো।” নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি নবম শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল/গুরুত্ব আলোচনা করো।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল/গুরুত্ব আলোচনা করো।

তুরস্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্গত জেরুজালেমের গ্রোটোর গির্জার কর্তৃত্ব নিয়ে ল্যাটিন খ্রিস্টান ও গ্রীক খ্রিস্টানদের মধ্যে বিরোধ বাঁধে, এ মতাবস্থায় 1853 খ্রিস্টাব্দে তুর্কি সুলতান রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধে তুরস্কের পক্ষে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া যোগ দিলে 1854 খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ –

ধর্মীয় কারণে এই যুদ্ধের সূচনা হলেও এর পিছনে আরও অনেক কারণ বিদ্যমান ছিল। নীচে ক্রমান্বয়ে সেগুলি আলোচিত হল –

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ –

  1. গ্রোটোর গির্জা নিয়ে বিরোধ – যীশু খ্রীষ্টের স্মৃতি বিজড়িত জেরুজালেমের গ্রোটোর গির্জার কর্তৃত্ব নিয়ে রোমান ও গ্রিক ধর্মযাজকদের মধ্যে বিবাদ ছিল। এই বিবাদে ফ্রান্স রোমান যাজকদের এবং রাশিয়া গ্রিক যাজকদের পক্ষে ছিল।
  2. রুশ তুরস্ক বিরোধ – 1740 খ্রিস্টাব্দে এক চুক্তির দ্বারা তুরস্কের কাছ থেকে ফ্রান্স জেরুজালেমের পবিত্র স্থান এবং রোমান ধর্মযাজকদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেও 1774 খ্রিস্টাব্দের এক চুক্তি দ্বারা রাশিয়া সেই স্থান এবং গ্রিক ধর্মযাজকদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে কিন্তু 1852 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স তার পূর্বতন অধিকার তুরস্কের কাছ থেকে আদায় করে নিলে তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার বিরোধ বাধে।
  3. রাশিয়ার আক্রমণ – রাশিয়া তুরস্কের গ্রিক ধর্মের অনুরাগী প্রজাদের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে তুরস্কের মলডোভিয়া ও ওয়ালাকিয়া প্রদেশ দুটি দখল করে নেয়। ফলে তুরস্ক রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে 1853 খ্রিস্টাব্দে।
  4. ক্রিমিয়ার যুদ্ধ – রুশ-তুর্কি যুদ্ধে তুরস্কের পক্ষে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া যোগ দিলে 1854 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
  5. ভিয়েনা নোট – রাশিয়া মলডোভিয়া ও ওয়ালাকিয়া দখল করলে রুশ প্রভাব বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া ভিয়েনা শহরে সম্মিলিত হয়। তারা আলাপ আলোচনা করে রাশিয়ার কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায়। এই প্রস্তাব “ভিয়েনা নোট ” নামে পরিচিত।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অন্যান্য কারণ –

  1. ইংল্যান্ডের লক্ষ্য – ইংল্যান্ড তুরস্কে রুশ আগ্রাসনের বিরোধী এবং তুরস্কের অখন্ডতা রক্ষার পক্ষপাতী ছিল। কেননা ইংল্যান্ড মনে করত যে, এই অঞ্চলে রাশিয়ার সম্প্রসারণ ঘটলে ব্রিটিশ বাণিজ্যের ক্ষতি হবে এবং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও বিঘ্নিত হবে।
  2. ফ্রান্সের লক্ষ্য – ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে নিজের কৃতিত্ব জাহির ও ফ্রান্সের গৌরব বৃদ্ধি করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন।
  3. অস্ট্রিয়ার লক্ষ্য – অস্ট্রিয়া নিজের নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক স্বার্থের কথা চিন্তা করে তুর্কি অঞ্চলে রাশিয়ার অগ্রগতির বিরোধিতা করছিল।
  4. পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার লক্ষ – পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী কাভ্যুর মনে করেছিলেন যে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধে ইঙ্গ ফরাসি শক্তির সঙ্গে থাকলে তিনি ইতালির ঐক্যের বিষয়ে সহায়তা পাবেন।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল –

বলকান অঞ্চলে রুশ আগ্রাসন এবং এই আগ্রাসন প্রতিরোধে ইঙ্গ ফরাসি শক্তির সক্রিয়তার ফলে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (1854-1856 খ্রিস্টাব্দ) সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত ফলাফল গুলি নীচে হয়। এই যুদ্ধের আলোচনা করা হল –

  1. রুশ আগ্রাসন রোধ – ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের ফলে –
    • বলকান ও কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে রুশ আগ্রাসন ব্যাহত হয়।
    • রাশিয়া তুরস্কের কাছ থেকে দখল করা স্থানগুলি ফিরিয়ে দেয়।
  2. জারতন্ত্রের দুর্বলতা – যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের ফলে জারতন্ত্রের দুর্বলতা প্রকাশ্যে এসে পড়ে। ফলে রাশিয়ায় জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়।
  3. রাশিয়ার সংস্কার – জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনতার ক্ষোভ দূর করার উদ্দেশ্যে রুশ জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার বিভিন্ন উদারনৈতিক সংস্কার চালু করেন যার মধ্যে অন্যতম ছিল ভূমিদাস প্রথার বিলোপ।
  4. তুরস্কের অগ্রগতি –
    • যুদ্ধের পর তুরস্ককে ইউরোপীয় রাষ্ট্রমণ্ডল ও আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনা হয়।
    • বৃহৎ শক্তিগুলি তুরস্কের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।
    • তুরস্ক আধুনিক সংস্কার প্রবর্তনে রাজি হয়।
  5. ফ্রান্সের মর্যাদা বৃদ্ধি – ক্রিমিয়ার যুদ্ধে সক্রিয় উদ্যোগ নিয়ে ফ্রান্স রাশিয়াকে পরাজিত করার ফলে ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক মর্যাদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
  6. ইতালি ও জার্মানির ঐক্য –
    • ইতালির পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া ক্রিমিয়ার যুদ্ধে যোগ দেওয়ায় তারা ইটালির ঐক্যে সহায়তা করে।
    • অস্ট্রো-প্রাশীয় যুদ্ধের সময় রাশিয়া তার মিত্র অস্ট্রিয়ার পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে রাশিয়া জার্মানির ঐক্যের পথ প্রস্তুত করে।
  7. বলকান জাতীয়তাবাদ – ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে এবং তারা স্বাধীনতার দাবি জানায়।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ কখন এবং কেন শুরু হয়?

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ 1854 সালে শুরু হয়, তবে এর সূত্রপাত হয় 1853 সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সংঘাতে। মূল কারণ ছিল জেরুজালেমের “গ্রোটো অব দ্য নেটিভিটি” গির্জার কর্তৃত্ব নিয়ে ল্যাটিন (রোমান ক্যাথলিক) ও গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের মধ্যে বিরোধ। রাশিয়া গ্রিকদের এবং ফ্রান্স রোমান ক্যাথলিকদের সমর্থন করায় সংঘাত তীব্র হয়।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধে কারা জোটবদ্ধ ছিল?

ক্রিমিয়ার যুদ্ধে যারা জোটবদ্ধ ছিল তারা হলেন –
1. তুরস্কের পক্ষে – ব্রিটেন, ফ্রান্স, পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া (ইতালি)।
2. বিপক্ষে – রাশিয়া।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল –
1. জেরুজালেমের পবিত্র স্থানগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাশিয়া ও ফ্রান্সের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
2. রাশিয়া কর্তৃক মলডোভিয়া ও ওয়ালাকিয়া দখল (তুরস্কের অঞ্চল)।
3. তুরস্ক কর্তৃক রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা (1853 সাল)।

ভিয়েনা নোট কী?

1853 সালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া রাশিয়াকে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রস্তাব দেয়, যা “ভিয়েনা নোট” নামে পরিচিত। রাশিয়া এটি প্রত্যাখ্যান করায় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

ব্রিটেন ও ফ্রান্স কেন তুরস্ককে সমর্থন করেছিল?

ব্রিটেন ও ফ্রান্স তুরস্ককে সমর্থন করেছিল কারণ –
1. ব্রিটেন – রাশিয়ার সম্প্রসারণে ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা।
2. ফ্রান্স – সম্রাট নেপোলিয়ন III ফ্রান্সের প্রভাব বৃদ্ধি ও নিজের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া ও পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার ভূমিকা কী ছিল?

ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া ও পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার ভূমিকা ছিল –
1. অস্ট্রিয়া – রাশিয়ার সম্প্রসারণে হুমকি অনুভব করে, কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি।
2. পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া – ইতালীয় ঐক্যের জন্য ব্রিটেন-ফ্রান্সের সমর্থন আদায়ে যুদ্ধে যোগ দেয়।


এই প্রবন্ধে আমরা নবম শ্রেণীর ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – “ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল/গুরুত্ব আলোচনা করো” – নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নটি পাঠ্যপুস্তকের একটি মৌলিক বিষয় এবং পরীক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আশা করি, আলোচনাটি তোমাদের বুঝতে ও পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়ক হয়েছে।

তোমাদের যদি এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকে, তাহলে আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারো; আমরা সাহায্য করার চেষ্টা করব। এছাড়াও, এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি তোমার প্রিয়জন বা সহপাঠীদের সাথে শেয়ার করতে পারো, যাদের এটি কাজে লাগতে পারে।

Categories -
Please Share This Article

Related Posts

নবম শ্রেণী ইতিহাস - প্রাককথন: ইউরোপ ও আধুনিক যুগ

নবম শ্রেণী ইতিহাস – প্রাককথন: ইউরোপ ও আধুনিক যুগ

নবম শ্রেণী ইতিহাস - বিপ্লবী আদর্শ,নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ - বিষয়সংক্ষেপ

নবম শ্রেণী ইতিহাস – বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ – বিষয়সংক্ষেপ

নবম শ্রেণী ইতিহাস - বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ - অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

নবম শ্রেণী ইতিহাস – বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

About The Author

Souvick

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

উচ্চবিভব ও নিম্নবিভব কী? কার্যের ধারণা থেকে তড়িৎবিভবের পরিমাপ কীভাবে করা হয়?

কুলম্বের সূত্রটি বিবৃত করো ও গাণিতিক রূপসহ ব্যাখ্যা করো।

কুলম্ব ও esu -এর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করো।

তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ ও ধাতব পরিবাহীর কাকে বলে? তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ ও ধাতব পরিবাহী মধ্যে পার্থক্য

প্রাথমিক কোশ ও গৌণ কোশ কাকে বলে? প্রাথমিক কোশ ও গৌণ কোশের পার্থক্য