আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) ভূগোলের দ্বিতীয় অধ্যায় “বায়ুমণ্ডল” -এর “বায়ুর চাপ বলয় ও বায়ুপ্রবাহ” বিভাগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ “দীর্ঘধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর” নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) ভূগোল পরীক্ষার জন্য ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

চিত্র সহযোগে পৃথিবীর বায়ুচাপ বলয়গুলির পরিচয় দাও।
অথবা, ভূপৃষ্ঠে কয়টি চাপ বলয় আছে? এগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
পৃথিবীর বায়ুচাপ বলয়
পৃথিবীতে মোট সাতটি বায়ুচাপ বলয় আছে। এদের মধ্যে 3টি নিম্নচাপ বলয় ও 4টি উচ্চচাপ বলয়। এই বায়ুচাপ বলয়গুলি হল –


এই বিভিন্ন প্রকার বায়ুচাপ বলয়গুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনা সারণির মাধ্যমে করা হল –
বায়ুচাপ বলয়গুলির নাম | অবস্থান | সৃষ্টির কারণ |
নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় (অপর নাম নিরক্ষীয় শান্তবলয়) | নিরক্ষরেখার উভয়দিকে 10° অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত। | 1. এই অঞ্চলে সারাবছর সূর্যরশ্মি লম্বভাবে পড়ে বলে বায়ু সারাবছরই উষ্ণ ও হালকা হয়। 2. এখানে জলভাগের পরিমাণ বেশি বলে বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে, ফলে বায়ু হালকা হয়। 3. পৃথিবীর আবর্তন গতিবেগ নিরক্ষীয় অঞ্চলে সর্বাধিক হয় বলে বায়ু উত্তর ও দক্ষিণে বিক্ষিপ্ত হয়, অর্থাৎ বায়ুর ঘনত্ব কমে যায়। ফলস্বরূপ নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। |
কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয় এবং মকরীয় উচ্চচাপ বলয় (অপর নাম উপক্রান্তীয় শান্তবলয়) | নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের উভয়দিকে প্রায় 25° থেকে 35° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত। | 1. নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু ওপরে উঠে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় উচ্চতার প্রভাবে ধীরে ধীরে শীতল ও সংকুচিত হয়ে 25° থেকে 35° অক্ষরেখা বরাবর নীচের দিকে নেমে আসে বলে এই অংশে বায়ুর ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। 2. পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য দুই মেরু অঞ্চল থেকে যে ঠান্ডা ও ভারী বায়ু নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়, তারও কিছু অংশ এই অঞ্চলে নেমে এসে বায়ুর ঘনত্ব বৃদ্ধি করে। |
সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় এবং কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় | দুই মেরুবৃত্ত প্রদেশের নিকটবর্তী অঞ্চলে অর্থাৎ 60° থেকে 70° অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত। | 1. পৃথিবীর আবর্তন বেগ দুই মেরুর তুলনায় মেরুবৃত্ত প্রদেশে অপেক্ষাকৃত বেশি। এজন্য এই অঞ্চলের বায়ু বেশি পরিমাণে বিক্ষিপ্ত হয়। ফলে বায়ুর ঘনত্ব হ্রাস পায়। 2. দুই মেরু অঞ্চল থেকে আগত শীতল ও ভারী বায়ু মেরুবৃত্ত অঞ্চলে পৌঁছালে উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে। আয়তনে বেড়ে যায়। এজন্য দুই মেরুবৃত্ত প্রদেশে বায়ুর ঘনত্ব ও চাপ কম হয়। |
সুমেরু উচ্চচাপ বলয় এবং কুমেরু উচ্চচাপ বলয় | উত্তরমেরু ও দক্ষিণমেরু-সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। | 1. প্রচণ্ড ঠান্ডার জন্য এই অঞ্চলের বায়ু শীতল ও ভারী হয়। 2. বাষ্পীভবন খুব কম হয় বলে বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কম থাকে। 3. পার্শ্ববর্তী মেরুবৃত্ত অঞ্চলের নিম্নচাপ বলয় থেকে ঊর্ধ্বগামী বায়ুর কিছু অংশ শীতল হয়ে এই অংশে নেমে আসে বলে বায়ুর ঘনত্ব ও চাপ বৃদ্ধি পায়। |
বায়ুমণ্ডলে বায়ুর চাপের তারতম্যের কারণগুলি কী কী?
বায়ুচাপের তারতম্যের কারণ –
বায়ুর চাপের তারতম্য যে কারণগুলির জন্য ঘটে, সেগুলি হল –

- উষ্ণতার প্রভাব –
- বায়ু উষ্ণ হলে প্রসারিত হয়। ফলে তার ঘনত্ব কমে যায় অর্থাৎ চাপ হ্রাস পায়। এই কারণে নিরক্ষীয় অঞ্চলে বায়ুর চাপ কম হয়।
- উষ্ণতা কমলে বায়ু সংকুচিত হয়, ফলে তার ঘনত্ব বাড়ে। সুতরাং, চাপও বৃদ্ধি পায়। উভয় মেরু অঞ্চলে অতিরিক্ত ঠান্ডার জন্য বায়ুর চাপ বেশি হয়।
- বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ – জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু শুষ্ক বায়ুর তুলনায় হালকা হয় বলে এর চাপও কম হয়। এজন্য যেসব অঞ্চলের বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে সেখানে বায়ুর চাপ কম হয়।
- উচ্চতার প্রভাব – সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যত ওপরের দিকে ওঠা যায়, বায়ুস্তরের গভীরতা বা বায়ুমণ্ডলীয় ভর ক্রমশ কমে যায় এবং এর ফলে বায়ুর চাপও হ্রাস পায়। এজন্য দুটি স্থানের মধ্যে যেটির উচ্চতা বেশি সেখানে বায়ুর চাপও অপেক্ষাকৃত কম হয়। যেমন – অসমের শিবসাগর ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং প্রায় একই অক্ষাংশে অবস্থিত হলেও বেশি উচ্চতার জন্য দার্জিলিং-এ বায়ুর চাপ শিবসাগরের তুলনায় অনেক কম থাকে।
- পৃথিবীর আবর্তন গতির প্রভাব – পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্যও বায়ুচাপের তারতম্য হয়। যেমন – পৃথিবীর আবর্তনের গতিবেগ দুই মেরুর তুলনায় মেরুবৃত্ত প্রদেশে বেশি বলে মেরুবৃত্ত প্রদেশের বায়ু বেশি পরিমাণে বিক্ষিপ্ত হয়। এর ফলে বায়ুর ঘনত্ব কমে গিয়ে মেরুবৃত্ত প্রদেশে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে।
- স্থলভাগ ও জলভাগের বণ্টন – স্থলভাগ ও জলভাগের বিপরীতধর্মী চরিত্রের প্রভাবেও বায়ুর চাপের তারতম্য হয়। দিনেরবেলা জলভাগ অপেক্ষা স্থলভাগ তাড়াতাড়ি উত্তপ্ত হয়। এর ফলে ভূপৃষ্ঠের বায়ু উত্তপ্ত ও হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায় ও নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। তেমনি রাতেরবেলায় স্থলভাগ দ্রুত তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়ে পড়ে এবং উচ্চচাপ ক্ষেত্র তৈরি করে। এইভাবে স্থলভাগ ও জলভাগের বণ্টনের জন্য চাপের তারতম্য ঘটে।
বায়ুর উষ্ণতা ও চাপের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করো।
বায়ুর উষ্ণতা ও চাপের সম্পর্ক –
বায়ুর উষ্ণতা ও বায়ুর চাপ উভয়ই আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপাদান হলেও উভয়ের মধ্যে এক বিপরীত সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। সেগুলি হল –
- বায়ু যখন উষ্ণ হয় তখন তার আয়তন বাড়ে বা প্রসারিত হয়। বায়ু যখন প্রসারিত হয় তখন তার ঘনত্ব হ্রাস পায়, ফলে চাপও কমে। সুতরাং, বায়ু উষ্ণ হলে তার চাপ কমে। যেমন – নিরক্ষীয় অঞ্চলে সারাবছরই সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয় বলে অঞ্চলটিতে সর্বদাই বায়ুর উষ্ণতা বেশি থাকে। এজন্য এখানকার বায়ু প্রসারিত ও হালকা হয়ে ঊর্ধ্বগামী হয়। এর ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চলের বায়ুমণ্ডলে স্থায়ীভাবে নিম্নচাপ বিরাজ করে, যাকে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় বলা হয়।
- বায়ুর উষ্ণতা কমলে বায়ু সংকুচিত হয়। বায়ু যতই সংকুচিত হয়, ততই তার ঘনত্ব বাড়ে, ফলে চাপও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, বায়ুর উষ্ণতা কমলে বায়ুর চাপ বাড়ে। যেমন – সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলে সূর্যরশ্মি অত্যন্ত তির্যকভাবে পড়ে বলে মেরুদ্বয়ের বায়ু অত্যন্ত শীতল ও সংকুচিত অবস্থায় থাকে। ফলে সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলে বায়ুর ঘনত্ব ও চাপ খুবই বেশি হয় এবং এই অঞ্চল দুটিতে স্থায়ী উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে। একে মেরুদেশীয় উচ্চচাপ বলয় বলা হয়।
- বায়ু উষ্ণ হলে তার জলীয়বাষ্প ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু শুষ্ক বায়ুর তুলনায় হালকা বলে বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেলে বায়ুর চাপ কমে যায়। যেমন – বায়ুতে প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প থাকে বলে বর্ষাকালে বায়ুর চাপও কম হয়। অর্থাৎ বায়ুর উষ্ণতা ও বায়ুর চাপের সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক।

মৌসুমি বায়ুর সাথে জেট বায়ুর সম্পর্ক কীরূপ?
অথবা, মৌসুমি বায়ুর সঙ্গে জেট বায়ুর সম্পর্ক আলোচনা করো।
মৌসুমি বায়ুর সাথে জেট বায়ুর সম্পর্ক
আবহবিদেরা মনে করেন ভারতের জলবায়ুর সাথে জেট বায়ুর একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের ওপর উপক্রান্তীয় জেট বায়ু এবং ক্রান্তীয় পুবালি জেট বায়ুর প্রভাব খুব ভালোভাবেই পড়ে।
বর্ষাকাল –
ক্রান্তীয় পুবালি জেট বায়ু মাসে ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ওই সময় এই বায়ুস্রোত চিনের দক্ষিণ উপকূল থেকে আরম্ভ করে (12° থেকে 15° উত্তর অক্ষাংশ বরাবর) থাইল্যান্ড ও ভারতীয় উপদ্বীপ পেরিয়ে আফ্রিকার পূর্বদিকে সুদান হয়ে প্রায় সাহারায় গিয়ে শেষ হয়। এর মধ্যে পূর্বে মালয়েশিয়া থেকে পশ্চিমে ভারত পর্যন্ত এর গতিবেগ খুব বেশি (ঘণ্টায় 100-200 কিমি) থাকে এবং ক্রমশ পশ্চিমে তা হ্রাস পায়। প্রকৃতপক্ষে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সঠিক সময়ে আগমন ও সক্রিয়তা বহুলাংশে এই ক্রান্তীয় পুবালি জেটের অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। যদি এটি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি উত্তরে সরে যায়, তাহলে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহে ছেদ (Break of Monsoon) ঘটে। এ ছাড়া, বর্ষাকালে ভারতের ওপর নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি এবং সেগুলির তীব্রতার হ্রাসবৃদ্ধি, এই ক্রান্তীয় পুবালি জেটের গতিপ্রকৃতির ওপর অনেকটা নির্ভরশীল।

শীতকাল –
উপক্রান্তীয় পশ্চিমা জেট বায়ু অক্টোবর-নভেম্বর মাস নাগাদ অর্থাৎ, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ফিরে যাবার সময় থেকেই ভারতের ওপর আবির্ভূত হয় এবং তখন থেকে প্রায় মে মাস পর্যন্ত এ দেশের ওপর দিয়েই প্রবাহিত হয়। এই বায়ুস্রোতটি শীতকালে যতই দক্ষিণে সরে আসে, ভারতে শীতের তীব্রতা ততই বাড়ে। ফেব্রুয়ারি মাসে এটি সর্বাধিক দক্ষিণে আসে এবং তারপর ধীরে ধীরে উত্তরে সরে গিয়ে মে মাসে অন্তর্হিত হয়। শীতকালে ভারতের ওপর দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হওয়ার সময় এই বায়ুস্রোতটি হিমালয়ে বাধা পেয়ে দুটি শাখায় ভাগ হয়। একটি শাখা হিমালয়ের উত্তর এবং অপরটি দক্ষিণদিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শেষে আরও পূর্বে গিয়ে মিলিত হয়। হিমালয়ের দক্ষিণের শাখাটি যত শক্তিশালী হয়, ততই উত্তর ভারতে শীত তীব্র হয়, শৈত্যপ্রবাহ দেখা দেয়।

প্রকৃতপক্ষে, ভারতের আবহাওয়া ও জলবায়ুতে জেট বায়ুর প্রভাব সীমাহীন। ভারতীয় ঋতুর স্থায়িত্ব ও তীব্রতা, বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাত, ঋতুপরিবর্তন প্রভৃতি এই জেট বায়ুর অবস্থান ও গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল।
চিত্রসহ ভূপৃষ্ঠের নিয়ত বায়ুগুলির পরিচয় দাও।
নিয়ত বায়ুপ্রবাহ –
পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে 3টি স্থায়ী নিম্নচাপ ও 4টি স্থায়ী উচ্চচাপ বলয় আছে। এই উচ্চচাপ বলয়গুলি থেকে নিম্নচাপ বলয়গুলির দিকে সারাবছর ধরে নিয়মিতভাবে প্রবাহিত বায়ুকে বলা হয় নিয়ত বায়ু।
নিয়ত বায়ু প্রধানত তিন প্রকার –

আয়ন বায়ু –
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে যে দুটি বায়ু সারাবছর নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট পথে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়, তাদের বলা হয় আয়ন বায়ু।
আয়ন বায়ুর শ্রেণিবিভাগ –
আয়ন বায়ু দু-প্রকার –
- উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু – উত্তর গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে আয়ন বায়ু নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় ফেরেল -এর সূত্র অনুসারে ডানদিকে বেঁকে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়। একে বলা হয় উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু।
- দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু – দক্ষিণ গোলার্ধের উপ ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে যে আয়ন বায়ু নিয়মিতভাবে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয় এবং ফেরেল -এর সূত্র অনুসারে বামদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়, তার নাম দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু।
আয়ন বায়ুর বৈশিষ্ট্য –
- উত্তর গোলার্ধে স্থলভাগ বেশি বলে উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ুর গতিবেগ একটু কম, ঘণ্টায় 15-25 কিলোমিটার।
- দক্ষিণ গোলার্ধে জলভাগ বেশি থাকায় দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু ঘণ্টায় 25-35 কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হয়।
- আয়ন বায়ু সাধারণত নিরক্ষরেখার দু-দিকে 0° থেকে 30° অক্ষরেখার মধ্যে সারাবছর প্রবাহিত হয়।
- আয়ন বায়ুর প্রবাহপথে মহাদেশগুলির পশ্চিমদিকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পৃথিবীর বড়ো বড়ো মরুভূমিগুলির (যেমন – সাহারা, থর, কালাহারি, আটাকামা প্রভৃতি) সৃষ্টি হয়েছে।
পশ্চিমা বায়ু –
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে যে দুটি বায়ু দুই মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় (সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্ত) -এর দিকে সারাবছর নির্দিষ্ট পথে নিয়মিতভাবে প্রবাহিত হয়, তাদের বলা হয় পশ্চিমা বায়ু।
পশ্চিমা বায়ুর শ্রেণিবিভাগ –
পশ্চিমা বায়ু দু-প্রকার –
- দক্ষিণ-পশ্চিমা বায়ু – উত্তর গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে পশ্চিমা বায়ু সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার সময় ফেরেল -এর সূত্রানুসারে ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। একে বলা হয় দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু।
- উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু – দক্ষিণ গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে পশ্চিমা বায়ু ফেরেল -এর সূত্রানুসারে বামদিকে বেঁকে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়। এর নাম উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু।
পশ্চিমা বায়ুর বৈশিষ্ট্য –
- পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে এই বায়ু পশ্চিমা বায়ু নামে পরিচিত।
- উভয় গোলার্ধে 30°-60° অক্ষাংশের মধ্যে উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় অভিমুখে পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয়।
- পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে মহাদেশগুলির পশ্চিম অংশে বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
- পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে মহাদেশগুলির পূর্বাংশে বৃষ্টির পরিমাণ ক্রমশ কমে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমির সৃষ্টি হয়েছে।

মেরু বায়ু –
সুমেরু ও কুমেরু উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে যে দুটি বায়ু নিয়মিতভাবে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়, তাদের মেরু বায়ু বলে।
মেরু বায়ুর শ্রেণিবিভাগ –
মেরু বায়ু দু-প্রকার –
- উত্তর-পূর্ব মেরু বায়ু – উত্তর গোলার্ধের মেরু বায়ু সুমেরু দেশীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে ফেরেল -এর সূত্রানুসারে ডানদিকে বেঁকে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়। এর নাম উত্তর-পূর্ব মেরু বায়ু।
- দক্ষিণ-পূর্ব মেরু বায়ু – দক্ষিণ গোলার্ধের মেরু বায়ু কুমেরু দেশীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার সময় ফেরেল -এর সূত্রানুসারে বামদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পূর্ব মেরু বায়ু নামে প্রবাহিত হয়।
মেরু বায়ুর বৈশিষ্ট্য –
- মেরু বায়ু অতিশীতল ও শুষ্ক প্রকৃতির।
- এই বায়ুর প্রভাব বছরের অন্য সময়ের তুলনায় শীতকালে বেশি হয়।
- মেরু বায়ুর প্রভাবে মহাদেশগুলির পূর্ব অংশে তুষারপাত ও সামান্য বৃষ্টিপাত এবং দুই মেরুবৃত্তে ভয়াবহ তুষারঝড়ের সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন প্রকার সাময়িক বায়ুপ্রবাহের পরিচয় দাও।
সাময়িক বায়ুপ্রবাহ –
যেসব বায়ু সাময়িকভাবে চাপের তারতম্যের ফলে বছরের কোনো নির্দিষ্ট সময়ে (বিশেষ ঋতুতে) বা দিনের কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট অঞ্চলে প্রবাহিত হয়, সেইসব বায়ুকে সাময়িক বায়ু বলা হয়।

সাময়িক বায়ুর শ্রেণিবিভাগ
সাময়িক বায়ু প্রধানত তিন প্রকার –
সমুদ্রবায়ু –
জলের তাপগ্রাহীতা স্থলভাগের তুলনায় বেশি হওয়ায় দিনেরবেলা জলভাগ অপেক্ষা স্থলভাগ বেশি উষ্ণ হয়। স্থলভাগের বায়ু হালকা ও প্রসারিত হয়ে ঊর্ধ্বগামী হয়। এর ফলে স্থলভাগের ওপর চাপ হ্রাস পায় এবং জলভাগের ওপর চাপ কিছুটা বৃদ্ধি পায়। তখন জলভাগের ওপর থেকে অপেক্ষাকৃত যে শীতল বায়ু ওই নিম্নচাপ পূরণ করার জন্য স্থলভাগের দিকে ছুটে আসে, তাকে বলা হয় সমুদ্রবায়ু। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে দিনেরবেলায় এই ধরনের বায়ু প্রবাহিত হয়।

স্থলবায়ু –
রাতে স্থলভাগ দ্রুত তাপ বিকিরণ করে শীতল হলেও জলভাগ অপেক্ষাকৃত উষ্ণ থাকে। স্থলভাগে তখন বায়ুর চাপ সামান্য বেশি এবং জলভাগে চাপ সামান্য কম হয়। ওই নিম্নচাপ পূরণ করার জন্য স্থলভাগ থেকে অপেক্ষাকৃত যে শীতল বায়ু জলভাগের দিকে ছুটে যায়, তাকে বলা হয় স্থলবায়ু। এই বায়ু সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে মাঝরাতের পর বিশেষ করে শেষরাতের দিকে ভোরবেলা প্রবলভাবে প্রবাহিত হয়।

ঋতুভিত্তিক বায়ু –
গ্রীষ্ম ও শীত ঋতুতে জলভাগ ও স্থলভাগের মধ্যে বায়ুর উষ্ণতা ও সেই কারণে বায়ুচাপের পার্থক্যের জন্য যথাক্রমে জলভাগ থেকে স্থলভাগের দিকে এবং স্থলভাগ থেকে জলভাগের দিকে যে বায়ু প্রবাহিত হয় সেই বায়ুকে বলা হয় ঋতুভিত্তিক বায়ু। মৌসুমি বায়ু হল এই ধরনের সাময়িক বায়ু বা ঋতুভিত্তিক বায়ু। ভারতে গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বা গ্রীষ্ম মৌসুমি বায়ু এবং শীতকালে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু বা শীত মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়।
আকস্মিক বা অনিয়মিত বায়ু সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, ঘূর্ণবাত ও প্রতীপ ঘূর্ণবাত কী? এগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
আকস্মিক বা অনিয়মিত বায়ু –
যেসব বায়ু হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর হঠাৎই অন্তর্হিত হয়, তাদের আকস্মিক বায়ু বা অনিয়মিত বায়ু বলা হয়।

আকস্মিক বা অনিয়মিত বায়ুর শ্রেণিবিভাগ –
এই বায়ু প্রধানত দু-ধরনের –
ঘূর্ণবাত –
কোনো স্থান হঠাৎ বেশি উত্তপ্ত হলে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। তখন চারিদিক (উচ্চচাপযুক্ত স্থান) থেকে অপেক্ষাকৃত শীতল ও ভারী বায়ু প্রবল বেগে ওই নিম্নচাপযুক্ত কেন্দ্রের দিকে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে আসে। এই বায়ুপ্রবাহকে বলা হয় ঘূর্ণবাত।
ঘূর্ণবাতের বায়ু উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে বা বামাবর্তে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে বা দক্ষিণাবর্তে ঘুরতে ঘুরতে নিম্নচাপযুক্ত কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হয়। গঠন ও উৎসস্থানের পার্থক্য অনুসারে ঘূর্ণবাতকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।

- ক্রান্তীয় অঞ্চলের ঘূর্ণবাত – উভয় গোলার্ধের ক্রান্তীয় অঞ্চলে, বিশেষত 16° অক্ষাংশ থেকে 24° অক্ষাংশের মধ্যে সাগর-মহাসাগরীয় জলভাগের ওপর উষ্ণতা খুব বেশি বেড়ে গেলে মাঝে মাঝে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। এর ফলে তখন চারপাশের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে অপেক্ষাকৃত শীতল ও ভারী বায়ু ওই নিম্নচাপযুক্ত কেন্দ্রের দিকে প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে যায়। নিম্নচাপের কেন্দ্রভাগ উষ্ণ বলে আগত ওই বায়ুও ক্রমশ উষ্ণ হয়ে ওপরে উঠে যায়। এই প্রবল গতিবেগসম্পন্ন নিম্নচাপের কেন্দ্রমুখী ঘূর্ণায়মান ঊর্ধ্বগামী বায়ুপ্রবাহকে বলা হয় ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত। এই প্রকার ঘূর্ণবাত আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোন, দক্ষিণ ও পূর্ব চিন সাগরে টাইফুন, ক্যারিবিয়ান সাগরে হারিকেন নামে পরিচিত।
- নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের ঘূর্ণবাত – নিরক্ষরেখার উভয়দিকে 35° থেকে 65° অক্ষাংশের মধ্যে যখন দুটি বিপরীতধর্মী বায়ু অর্থাৎ একটি উষ্ণ বায়ু এবং অপরটি শীতল বায়ু দু-দিক থেকে ছুটে আসে, তখন দুই বায়ুর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ যখন তীব্র হয়, সংঘর্ষস্থান বা সীমান্ত ক্রমশই সংকুচিত হতে হতে শেষে, শীতল বায়ু ভারী বলে নীচের দিকে নেমে উষ্ণ বায়ুর স্থান দখল করে নেয়। এর ফলে তখন উষ্ণ বায়ু বক্রাকারে শীতল বায়ুর মধ্যে প্রবেশ করে এবং প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ওপরে উঠে যায়। একে নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত বলা হয়।
প্রতীপ ঘূর্ণবাত –
নাতিশীতোষ্ণমণ্ডল ও হিমমণ্ডলে অনেকসময় তীর শৈত্যের জন্য প্রবল উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়। যেহেতু ওই উচ্চচাপের বাইরের দিকে থাকে নিম্নচাপ, তাই ওই উচ্চচাপযুক্ত কেন্দ্র থেকে শীতল ও শুষ্ক বায়ু বাইরের নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবল বেগে কুণ্ডলীর আকারে প্রবাহিত হয়। একে বলা হয় প্রতীপ ঘূর্ণবাত। এই ঘূর্ণবাতের বায়ু উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে অর্থাৎ দক্ষিণাবর্তে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে অর্থাৎ বামাবর্তে ঘুরতে ঘুরতে উচ্চচাপযুক্ত কেন্দ্র থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়। এই বায়ুপ্রবাহের গতি থাকে ঘূর্ণবাতের ঠিক বিপরীত দিকে, অর্থাৎ বহির্মুখী ও নীচের দিকে।
নিয়ত বায়ু বলতে কী বোঝ? যে-কোনো একটি নিয়ত বায়ুপ্রবাহের পরিচয় দাও।
নিয়ত বায়ু
ভূপৃষ্ঠের স্থায়ী উচ্চচাপ ও নিম্নচাপ বলয়গুলি কতকগুলি বায়ু থেকে সারাবছর নিয়মিতভাবে ওইসব উচ্চচাপ বলয় থেকে নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়। এদের বলা হয় নিয়ত বায়ু। ভূপৃষ্ঠে তিন প্রকার নিয়ত বায়ুপ্রবাহ লক্ষ করা যায়। এগুলি হল –
- আয়ন বায়ু,
- পশ্চিমা বায়ু এবং
- মেরু বায়ু।
আয়ন বায়ু
উভয় গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে যে দুটি বায়ু সারাবছর ধরে নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট পথে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়, সেই বায়ু দুটিকে বলা হয় আয়ন বায়ু।
অন্য নাম
‘আয়ন’ কথাটির অর্থ ‘পথ’। আগেকার দিনে নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট পথ ধরে প্রবাহিত এই বায়ুপ্রবাহের সাহায্যে পালতোলা জাহাজে বাণিজ্য করার সুবিধা হত বলে এই বায়ুপ্রবাহকে আয়ন বায়ু বা বাণিজ্য বায়ু বলা হয়।
আয়ন বায়ুর শ্রেণিবিভাগ –
আয়ন বায়ু দু-প্রকার –
- উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু – উত্তর গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে আয়ন বায়ু নিরক্ষীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ছুটে যাওয়ার সময় ফেরেল -এর সূত্রানুসারে একটু ডানদিকে বেঁকে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়। একে উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু বলা হয়।
- দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু – দক্ষিণ গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে আয়ন বায়ু নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে ছুটে যাওয়ার সময় ফেরেল-এর সূত্রানুসারে একটু বামদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে একে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু বলা হয়।
আয়ন বায়ুর বৈশিষ্ট্য –
- উত্তর গোলার্ধে স্থলভাগ বেশি বলে উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ুর গতিবেগ একটু কম, ঘণ্টায় 15-25 কিলোমিটার।
- দক্ষিণ গোলার্ধে জলভাগ বেশি থাকায় দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু ঘণ্টায় 25-35 কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হয়।
- আয়ন বায়ু সাধারণত নিরক্ষরেখার দু-দিকে 0° থেকে 30° অক্ষাংশের মধ্যে সারাবছর প্রবাহিত হয়।
- ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয় বলে এই বায়ুর উষ্ণতা ও জলীয়বাষ্প ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
আয়ন বায়ুর জলবায়ুতে প্রভাব –
- স্থলভাগ থেকে আসার জন্য উত্তর গোলার্ধে এই বায়ু বৃষ্টিপাত ঘটায় না।
- এই বায়ু দক্ষিণ গোলার্ধে সমুদ্রের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে জলীয়বাষ্প শোষণ করে বৃষ্টিপাত ঘটায়।
- দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু যত পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও তত হ্রাস পায়। তাই মহাদেশগুলির পশ্চিমাংশে পৃথিবীর বড়ো বড়ো মরুভূমিগুলির (যেমন – সাহারা, থর, কালাহারি, আটাকামা প্রভৃতি) সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় বায়ু কাকে বলে? কয়েকটি স্থানীয় বায়ুর পরিচয় দাও।
স্থানীয় বায়ু –
স্থানীয় ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে বায়ুর উষ্ণতা ও চাপের পার্থক্যের কারণে ভূপৃষ্ঠের কোনো কোনো স্থানে স্থানীয়ভাবে কতকগুলি বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় কারণে উৎপত্তি হয় বলে এদের স্থানীয় বায়ু বলা হয়। যেমন –

কয়েকটি স্থানীয় বায়ু –
- লু – গ্রীষ্মকালে দিনেরবেলা উত্তর-পশ্চিম ভারতের স্থলভাগ প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়। ওই উত্তপ্ত ভূপৃষ্ঠের সংস্পর্শে এসে বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরের বায়ুও প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে প্রবল বেগে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে প্রবাহিত হয়। এইরূপ প্রচণ্ড উষ্ণ বাতাসকে বলা হয় লু। যেমন – গ্রীষ্মকালে দিল্লিতে, রাজস্থানে লু প্রবাহিত হয়। সন্ধ্যার পর এই বায়ুর তীব্রতা অনেক কমে যায়। তবে প্রচণ্ড উত্তপ্ত এই বায়ুর প্রভাবে মানুষসহ বহু গবাদিপশু মারা যায়।
- ফন – উষ্ণ-আর্দ্র বায়ু পর্বতগাত্র অবলম্বন করে ক্রমশ ওপরে ওঠার সময় শীতল ও ঘনীভূত হয়। এর ফলে পর্বতের প্রতিবাত অঞ্চলে বৃষ্টি ও তুষারপাত হয়। এই বায়ু পর্বত অতিক্রম করে যখন উপত্যকায় নামতে থাকে তখন বায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এইরূপ উষ্ণ ও শুষ্ক উপত্যকা বায়ুই ফন নামে পরিচিত। যেমন – ইউরোপের আল্পস পার্বত্য অঞ্চলের উত্তর ঢালে রাইন নদী-উপত্যকায় এই বায়ু প্রবাহিত হয়। এর ফলে কোনো কোনো সময়ে উপত্যকার উষ্ণতা 24 ঘণ্টার মধ্যে প্রায় 15-20° সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়। তখন উষ্ণ বায়ুর সংস্পর্শে পর্বতের বরফ গলে যায় এবং ওই বরফগলা জলে পার্বত্য উপত্যকায় তৃণভূমির সৃষ্টি হয়।
- চিনুক – উত্তর আমেরিকার রকি পার্বত্য অঞ্চলের পূর্ব ঢাল থেকে যে উষ্ণ ও শুষ্ক বায়ু সমভূমিতে নেমে আসে তার নাম চিনুক। ইংরেজি ‘chinook’ শব্দের অর্থ ‘snow eater’ বা ‘তুষার ভক্ষক’। উত্তর আমেরিকায় শীতকালে এই উষ্ণ ও শুষ্ক বায়ু রকি পর্বতের পাদদেশসহ সমগ্র প্রেইরি অঞ্চলের তুষার গলিয়ে দেয়।
- সিরোক্কো ও খামসিন – গ্রীষ্মকালে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি থেকে একপ্রকার অতি উষ্ণ, শুষ্ক ও ধূলোপূর্ণ বায়ু উৎপন্ন হয়ে ভূমধ্যসাগরের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। এই প্রকার উষ্ণ ও শুষ্ক উপত্যকা বায়ুকে সিসিলিতে সিরোক্কো এবং মিশরে খামসিন বলা হয়।
- কালবৈশাখী – কালবৈশাখী একপ্রকার উষ্ণ ও আর্দ্র স্থানীয় বায়ু। পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে (ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, পশ্চিমবঙ্গ ও অসম) এবং বাংলাদেশে চৈত্র মাস থেকে বৈশাখ মাসের (এপ্রিল-মে মাস) প্রথম দিক পর্যন্ত এই বায়ুপ্রবাহের ফলে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাতের সঙ্গে এক ভীষণ ঝড় ওঠে এবং তাপমাত্রা সাময়িকভাবে কিছুটা হ্রাস পায়। ঝাড়খণ্ডের মালভূমি অঞ্চল এই বায়ুর উৎসস্থল।
- আঁধি – উত্তর-পশ্চিম ভারতের সমভূমি অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে যে উষ্ণ ও শুষ্ক বায়ুর সঙ্গে প্রবল ধূলিঝড় দেখা যায়, তাকে আঁধি বলে। এই বায়ু ঘণ্টায় 70-100 কিমি বেগে প্রবাহিত হতে থাকে।
- মিস্ট্রাল – আল্পস পার্বত্য অঞ্চলে উৎপন্ন এই শীতল বায়ু ফ্রান্সের রোন নদীর উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই বায়ুর প্রভাবে রোন উপত্যকার তাপমাত্রা যথেষ্ট কমে যায়।
- পাম্পেরো – দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পার্বত্য অঞ্চল থেকে যে শীতল ও শুষ্ক বায়ু পম্পাস তৃণভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তার নাম পাম্পেরো।
- বোরা – শীতকালে ইউরোপের আল্পস পর্বত থেকে দক্ষিণ ইটালির অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলের দিকে প্রবাহিত শীতল ও শুষ্ক বায়ুপ্রবাহকে বোরা বলে। এই বায়ুর প্রভাবে অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলের তাপমাত্রা কমে যায়।
- ব্রিকফিল্ডার – গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমি থেকে দক্ষিণ উপকূলের দিকে প্রবাহিত উষ্ণ ও শুষ্ক ধূলোপূর্ণ বায়ুর নাম ব্রিকফিল্ডার।

নিয়ত বায়ু বলতে কী বোঝ? পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহের পরিচয় দাও।
নিয়ত বায়ু –
পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে 3টি স্থায়ী নিম্নচাপ ও 4টি স্থায়ী উচ্চচাপ বলয় আছে। এই উচ্চচাপ বলয়গুলি থেকে নিম্নচাপ বলয়গুলির দিকে সারাবছর ধরে নিয়মিতভাবে প্রবাহিত বায়ুকে বলা হয় নিয়ত বায়ু।
পশ্চিমা বায়ু –
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে দুই মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে সারাবছর নির্দিষ্ট পথে নিয়মিতভাবে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে বলে পশ্চিমা বায়ু।
পশ্চিমা বায়ুর শ্রেণিবিভাগ –
পশ্চিমা বায়ু দু-প্রকার –
- দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু – উত্তর গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে পশ্চিমা বায়ু সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ছুটে যাওয়ার সময় ফেরেল -এর সূত্রানুসারে সামান্য ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। এই বায়ু দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু নামে পরিচিত।
- উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু – দক্ষিণ গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে পশ্চিমা বায়ু কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ছুটে যাওয়ার সময় ফেরেল -এর সূত্রানুসারে সামান্য বাঁদিকে বেঁকে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। এই বায়ু উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য –
- পশ্চিমদিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে এই বায়ু পশ্চিমা বায়ু নামে পরিচিত।
- উভয় গোলার্ধে 30°-60° অক্ষাংশের মধ্যে উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় অভিমুখে পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয়।
- উত্তর গোলার্ধ অপেক্ষা দক্ষিণ গোলার্ধে এই বায়ু অনেক শক্তিশালী ও নির্দিষ্ট অভিমুখে চলাচল করে। দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ দিকে ক্রমশ এই বায়ুর গতিবেগ বাড়তে থাকে। 40°-60° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে পশ্চিমা বায়ু প্রচণ্ড ঝড়ের গতিতে বইতে থাকে। প্রবল বেগে প্রবাহিত হয় বলে এই অক্ষাংশের দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ুর বিভিন্ন নাম রয়েছে | 40°-50° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে এটির নাম গর্জনশীল চল্লিশা, 50°-60° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে এর নাম ভয়ংকর পঞ্চাশিয়া, 60° অক্ষাংশের কাছে এর নাম তীক্ষ্ণ চিৎকারকারী ষাট।
জলবায়ুতে প্রভাব –
- পশ্চিমা বায়ুর দ্বারা প্রভাবিত অঞ্চলে ঘূর্ণবাত ও প্রতীপ ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়। পশ্চিমা বায়ু গ্রীষ্মকালের তুলনায় শীতকালে বেশি শক্তিশালী থাকে। এই কারণে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর শীতকালে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ঝড়ঝঞ্ঝাসংকুল অঞ্চলরূপে পরিচিত।
- পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে মহাদেশগুলির পশ্চিম দিকে বৃষ্টিপাত হয়।
- পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে মহাদেশগুলির পূর্বাংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমির সৃষ্টি হয়েছে।
নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত ও ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের মধ্যে পার্থক্যগুলি আলোচনা করো।
নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত ও ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের মধ্যে পার্থক্যগুলি হল –
বিষয় | নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত | ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত |
অক্ষাংশগত বিস্তৃতি | নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত উভয় গোলার্ধে 30°-65° অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে উৎপত্তি লাভ করে। | ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি হয় 5°-20° উত্তর ও দক্ষিপ অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে। |
সময়কাল | নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের আগমনকাল হল প্রধানত শীতকাল। | ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের আগমন গ্রীষ্মকাল ও শরৎকালে ঘটে। |
স্থায়িত্ব | নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত সচরাচর স্বল্পকালব্যাপী স্থায়ী হয়। | ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের স্থায়িত্বকাল অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। |
ব্যাস | নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের ব্যাস সাধারণত 1000-3000 কিমি পর্যন্ত হয়। | ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের ব্যাস 200-800 কিমি পর্যন্ত হয়। |
বায়ুপ্রাচীর | নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি হয় দুটি ভিন্নধর্মী বায়ুপুঞ্জের মধ্যে বায়ুপ্রাচীর বা সীমান্তের সৃষ্টির ফলে। | ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের ক্ষেত্রে এরূপ কোনো বায়ুপ্রাচীর বা সীমান্ত দেখা যায় না। |
উষ্ণতার বণ্টন | নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের ক্ষেত্রে উষ্ণতার বণ্টন সমান নয়। | ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের ক্ষেত্রে উষ্ণতার বণ্টন সমান। |
বিস্তৃতি | নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করে। অনেক সময় এই প্রকার ঘূর্ণবাত 10 লক্ষ বর্গকিমি স্থান জুড়ে অবস্থান করে। | ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের বিস্তৃতি নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের তুলনায় অনেক কম। |
ধ্বংসসাধন ক্ষমতা | নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের ধ্বংসসাধন ক্ষমতা কম। | ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের ধ্বংসসাধন ক্ষমতা অনেক বেশি। |
বায়ুপ্রবাহ | নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের ক্ষেত্রে উষ্ণ বায়ু ঊর্ধ্বগামী হলেও শীতল বায়ু নিম্নগামী হয়। | ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের ক্ষেত্রে বায়ু সর্বদা ঊর্ধ্বগামী হয়। |
বাতাসের গতিবেগ | ঘণ্টায় মাত্র 30-35 কিমি। | ঘণ্টায় 60-300 কিমি। |
পৃথিবীর বায়ুচাপ বলয়গুলির সঙ্গে নিয়ত বায়ুপ্রবাহের সম্পর্কে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।
অথবা, ভূমণ্ডলীয় বায়ুচাপ বলয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নির্দেশ করে বায়ুপ্রবাহের শ্রেণিবিভাগ করো।
অথবা, পৃথিবীর বিভিন্ন নিয়ত বায়ুপ্রবাহ চাপ বলয়ের সাথে সম্পর্কিত কেন?
বায়ুচাপ বলয়ের সঙ্গে নিয়ত বায়ুপ্রবাহের সম্পর্ক –
ভূপৃষ্ঠে মোট 7টি স্থায়ী বায়ুচাপ বলয় আছে। এর মধ্যে 4টি উচ্চচাপ ও 3টি নিম্নচাপ বলয়। এগুলি হল –
- নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়,
- উত্তর গোলার্ধের উপক্রান্তীয় (কর্কটীয়) উচ্চচাপ বলয়,
- দক্ষিণ গোলার্ধের উপক্রান্তীয় (মকরীয়) উচ্চচাপ বলয়,
- সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়,
- কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়,
- সুমেরু দেশীয় উচ্চচাপ বলয় এবং
- কুমেরু দেশীয় উচ্চচাপ বলয়।
উল্লিখিত স্থায়ী বায়ুচাপ বলয়সমূহ থাকার জন্য ভূপৃষ্ঠে কতকগুলি বায়ুও সারাবছর নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট দিকে (নিম্নচাপ বলয় থেকে উচ্চচাপ বলয় অভিমুখে) প্রবাহিত হয়। এদের বলা হয় নিয়ত বায়ু। নিয়ত বায়ু প্রধানত তিন প্রকার। যেমন –
- আয়ন বায়ু,
- পশ্চিমা বায়ু এবং
- মেরু বায়ু।
‘নিয়ত বায়ুর শ্রেণিবিভাগ’ –
আয়ন বায়ু –
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে যে দুটি বায়ু সারাবছর নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট পথে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়, তাদের বলা হয় আয়ন বায়ু।
আয়ন বায়ুর শ্রেণিবিভাগ –
আয়ন বায়ু দু-প্রকার –
- উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু – উত্তর গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে আয়ন বায়ু নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় ফেরেল -এর সূত্র অনুসারে ডানদিকে বেঁকে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়। একে বলা হয় উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু।
- দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু – দক্ষিণ গোলার্ধের উপ ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে যে আয়ন বায়ু নিয়মিতভাবে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয় এবং ফেরেল -এর সূত্র অনুসারে বামদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়, তার নাম দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু।
আয়ন বায়ুর বৈশিষ্ট্য –
- উত্তর গোলার্ধে স্থলভাগ বেশি বলে উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ুর গতিবেগ একটু কম, ঘণ্টায় 15-25 কিলোমিটার।
- দক্ষিণ গোলার্ধে জলভাগ বেশি থাকায় দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু ঘণ্টায় 25-35 কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হয়।
- আয়ন বায়ু সাধারণত নিরক্ষরেখার দু-দিকে 0° থেকে 30° অক্ষরেখার মধ্যে সারাবছর প্রবাহিত হয়।
- আয়ন বায়ুর প্রবাহপথে মহাদেশগুলির পশ্চিমদিকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পৃথিবীর বড়ো বড়ো মরুভূমিগুলির (যেমন – সাহারা, থর, কালাহারি, আটাকামা প্রভৃতি) সৃষ্টি হয়েছে।
পশ্চিমা বায়ু –
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে যে দুটি বায়ু দুই মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় (সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্ত) -এর দিকে সারাবছর নির্দিষ্ট পথে নিয়মিতভাবে প্রবাহিত হয়, তাদের বলা হয় পশ্চিমা বায়ু।
পশ্চিমা বায়ুর শ্রেণিবিভাগ –
পশ্চিমা বায়ু দু-প্রকার –
- দক্ষিণ-পশ্চিমা বায়ু – উত্তর গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে পশ্চিমা বায়ু সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার সময় ফেরেল -এর সূত্রানুসারে ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। একে বলা হয় দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু।
- উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু – দক্ষিণ গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে পশ্চিমা বায়ু ফেরেল -এর সূত্রানুসারে বামদিকে বেঁকে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়। এর নাম উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু।
পশ্চিমা বায়ুর বৈশিষ্ট্য –
- পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে এই বায়ু পশ্চিমা বায়ু নামে পরিচিত।
- উভয় গোলার্ধে 30°-60° অক্ষাংশের মধ্যে উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় অভিমুখে পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয়।
- পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে মহাদেশগুলির পশ্চিম অংশে বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
- পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে মহাদেশগুলির পূর্বাংশে বৃষ্টির পরিমাণ ক্রমশ কমে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমির সৃষ্টি হয়েছে।
মেরু বায়ু –
সুমেরু ও কুমেরু উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে যে দুটি বায়ু নিয়মিতভাবে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়, তাদের মেরু বায়ু বলে।
মেরু বায়ুর শ্রেণিবিভাগ –
মেরু বায়ু দু-প্রকার –
- উত্তর-পূর্ব মেরু বায়ু – উত্তর গোলার্ধের মেরু বায়ু সুমেরু দেশীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে ফেরেল -এর সূত্রানুসারে ডানদিকে বেঁকে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়। এর নাম উত্তর-পূর্ব মেরু বায়ু।
- দক্ষিণ-পূর্ব মেরু বায়ু – দক্ষিণ গোলার্ধের মেরু বায়ু কুমেরু দেশীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার সময় ফেরেল -এর সূত্রানুসারে বামদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পূর্ব মেরু বায়ু নামে প্রবাহিত হয়।
মেরু বায়ুর বৈশিষ্ট্য –
- মেরু বায়ু অতিশীতল ও শুষ্ক প্রকৃতির।
- এই বায়ুর প্রভাব বছরের অন্য সময়ের তুলনায় শীতকালে বেশি হয়।
- মেরু বায়ুর প্রভাবে মহাদেশগুলির পূর্ব অংশে তুষারপাত ও সামান্য বৃষ্টিপাত এবং দুই মেরুবৃত্তে ভয়াবহ তুষারঝড়ের সৃষ্টি হয়।
আয়ন বায়ু ও পশ্চিমা বায়ুর পার্থক্য নিরূপণ করো।
আয়ন বায়ু ও পশ্চিমা বায়ু উভয়েই নিয়ত বায়ু হলেও উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে –
বিষয় | আয়ন বায়ু | পশ্চিমা বায়ু |
অবস্থান | উভয় গোলার্ধে 5°-25° অক্ষাংশের মধ্যে আয়ন বায়ু প্রবাহিত হয়। | উভয় গোলার্ধে 35°-65° অক্ষাংশের মধ্যে পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয়। |
তাপমণ্ডল | এটি উষ্ণমণ্ডলের নিয়ত বায়ু। | এটি নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলের নিয়ত বায়ু। |
প্রবাহপথ | এই বায়ুটি উভয় গোলার্ধের ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে, অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত উচ্চ অক্ষাংশ থেকে নিম্ন অক্ষাংশে সারা বছর প্রবাহিত হয়। | এই বায়ুটি উভয় গোলার্ধের ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে, অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত নিম্ন অক্ষাংশ থেকে উচ্চ অক্ষাংশে সারাবছর প্রবাহিত হয়। |
প্রবাহের দিক | এটি পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। | এটি পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হয়। |
বায়ু কর্তৃক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ | এই বায়ু ক্রমশ উষ্ণ হয় বলে এর জলীয়বাষ্প ধারণক্ষমতা বেড়ে যায়। এজন্য আয়ন বায়ুর গতিপথে খুব কম বৃষ্টিপাত হয়। | এই বায়ু ক্রমশ শীতল হয় এবং এর জলীয়বাষ্প গ্রহণ ও ধারণক্ষমতা কমে যায়। তাই পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। |
বৃষ্টিপাতের প্রভাব | আয়ন বায়ুর গতিপথে বৃষ্টিপাত কম হয়। তাই মহাদেশের পশ্চিমভাগে বড়ো বড়ো ক্রান্তীয় মরুভূমি সৃষ্টি হয়েছে। | পশ্চিমা বায়ুর গতিপথে মহাদেশের পশ্চিমভাগে যথেষ্ট বৃষ্টিপাত হয়। আর পূর্বভাগে বৃষ্টিপাত কমে যায় বলে নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি সৃষ্টি হয়েছে। |
গতিবেগ | গতিপথে স্থলভাগ বেশি থাকায় এর গতিবেগ বেশ কম (ঘন্টায় গড়ে 25 কিলোমিটার)। তবে উত্তর গোলার্ধে এর গতিবেগ একটু বেশি থাকে। | গতিপথে জলভাগ বেশি থাকায় এর গতিবেগ আয়ন বায়ুর তুলনায় বেশি। দক্ষিণ গোলার্ধে পশ্চিমা বায়ু সর্বোচ্চ ঘণ্টায় 145 কিমিরও বেশি গতিবেগে বয় (তীক্ষ্ম চিৎকারকারী ষাট বায়ু)। |
শ্রেণিবিভাগ | আয়ন বায়ুকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় – উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু এবং দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু। | পশ্চিমা বায়ুকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় – দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু এবং উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু। |
বায়ুপ্রবাহের শ্রেণিবিভাগ করো এবং উদাহরণ দাও।
বায়ুপ্রবাহের শ্রেণিবিভাগ –
ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে যেসব বায়ুপ্রবাহ ঘটে সেগুলিকে প্রধানত চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়, যেমন –

আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) ভূগোলের দ্বিতীয় অধ্যায় “বায়ুমণ্ডল” -এর “বায়ুর চাপ বলয় ও বায়ুপ্রবাহ” বিভাগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ “দীর্ঘধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) ভূগোল পরীক্ষার জন্য ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায় দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। তাছাড়া নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন