মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

Solution Wbbse

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় “প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর থেকে “ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
Contents Show

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন বলতে কী বোঝো? এই অরণ্য আইন প্রবর্তনের উদ্দেশ্য আলোচনা করো।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন –

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের শাসন কায়েম করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রকার আইন কার্যকর করেছিল – যার মধ্যে অন্যতম ছিল অরণ্য আইন। ভারতীয় অরণ্য অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার 1855 খ্রিস্টাব্দে ‘অরণ্য সনদ’ পাস করে। এর দ্বারা সরকার কাঠ সংগ্রহ ও ব্যাবসার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। পরবর্তীকালে 1864 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার বন বিভাগ গঠন করে। এরপর 1865 খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভারতীয় অরণ্য আইন পাস হয়।

দ্বিতীয় অরণ্য আইন –

ঔপনিবেশিক সরকার ভারতে 1878 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বার যে আইন পাস করে, তা 1878 খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় অরণ্য আইন (Indian Forest Act, 1878) নামে পরিচিত।

ঔপনিবেশিক অরণ্যের শ্রেণিবিভাগ –

1878 খ্রিস্টাব্দের আইন অনুযায়ী অরণ্য অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় – সংরক্ষিত (Reserved), সুরক্ষিত (Protected) এবং শ্রেণি বহির্ভূত অরণ্য (Unclassified Forest)। প্রথম ধরনে অরণ্য অঞ্চলের পরিচালনা এবং অরণ্য সম্পদের উপর পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে নির্ধারিত কিছু বৃক্ষ কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, পশুচারণ ইত্যাদি কতকগুলি প্রথাগত অধিকার বজায় রাখা হয়।

ঔপনিবেশিক আইন প্রবর্তনের উদ্দেশ্য –

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন প্রবর্তনের পিছনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী তথা ঔপনিবেশিক মানসিকতা ও প্রয়োজনীয়তা সক্রিয় ছিল।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন বলতে কী বোঝো? এই অরণ্য আইন প্রবর্তনের উদ্দেশ্য আলোচনা করো।
  • অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য – অরণ্য আইন প্রবর্তনের পিছনে ঔপনিবেশিক ও অর্থনৈতিক কারণ ছিল প্রধান। বিশাল ও সম্পদপূর্ণ ভারতীয় বনভূমিকে ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণে এনে ব্রিটিশ অর্থনীতির স্বার্থে তা ব্যবহার করাটাই ছিল অরণ্য আইন প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য।
  • সামরিক উদ্দেশ্য – অরণ্য আইন প্রবর্তনের পিছনে সামরিক কারণ ও পরিপ্রেক্ষিতটিও ছিল উল্লেখযোগ্য। ব্রিটেনের রাজকীয় নৌবাহিনীর জন্য জাহাজ তৈরির প্রয়োজনীয় কাঠের অন্যতম সরবরাহক্ষেত্র ছিল এই ভারতীয় অরণ্য।
  • রেলপথের প্রসার – ভারতে রেলপথের প্রসার অরণ্য আইন চালু করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। গ্যারান্টি প্রথার মাধ্যমে যেসকল রেলওয়ে কোম্পানি ভারতে রেলপথ প্রসারের কাজ করছিল তাদের রেললাইনের স্লিপার ও অন্যান্য অংশ তৈরির জন্য প্রচুর কাঠের প্রয়োজন ছিল। অরণ্য আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সেই প্রয়োজন পরিপূর্ণ হয়েছিল।
  • বিনোদনের লক্ষ্যে – ব্রিটিশ রাজন্যবর্গ, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী এবং তাদের সহযোগী এদেশীয় রাজন্যবর্গের অন্যতম বিনোদন ছিল শিকার করা। এজন্য বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত করে শিকারক্ষেত্রকে নির্বিঘ্ন করে তোলাটাও অরণ্য আইন প্রবর্তনের অন্যতম উদ্দেশ্যরূপে কাজ করেছিল।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের উপসংহার –

সার্বিকভাবে বলা যায়, অরণ্য অঞ্চলের উপর ব্যাপক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে যুক্তিসংগত করে তোলার জন্য ঔপনিবেশিক শাসকবর্গের ব্যাখ্যা ছিল – অজ্ঞ কৃষক ও আদিবাসীদের কবল থেকে অরণ্য সম্পদকে রক্ষা করার জন্যই এই জাতীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কিছু ঐতিহাসিক উপরোক্ত যুক্তিকে মেনে নেওয়ার পক্ষপাতী নন। তাদের বক্তব্য হল যে, অরণ্য সংরক্ষণের পিছনে ব্রিটিশ সরকারের সামরিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যই ছিল প্রধান।

1878 থেকে 1890 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংরক্ষিত অরণ্যের আয়তন কত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল? ব্রিটিশ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এই সময়ে ভারতের মোট ভূমির কত অংশ নিয়ন্ত্রণ করত?

1878 খ্রিস্টাব্দে সংরক্ষিত অরণ্যের আয়তন ছিল 14,000 বর্গমাইল, যা 1890 খ্রিস্টাব্দে বেড়ে দাঁড়ায় 56,000 বর্গমাইলে। এইভাবে ব্রিটিশ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট ভারতীয় ভূখণ্ডের 1/5 অংশের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন ও সে বিষয়ে আদিবাসী জনগণের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের ভূমিকা –

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্যপূরণের জন্য অরণ্য আইন প্রবর্তন করলে অরণ্য অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়ে। এরই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আদিবাসীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

কোম্পানির অরণ্যের প্রয়োজনীয়তা –

  • জাহাজ নির্মাণ – কোম্পানি জাহাজ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠ অরণ্য থেকে সংগ্রহ করত।
  • রেলের স্লিপার তৈরি – 1853 খ্রিস্টাব্দে ভারতে রেলপথ নির্মাণের সূচনা হয়। তখন লোহার তৈরি রেললাইন পাতার সময় লোহার লাইনের নীচে কাঠের স্লিপার বিছিয়ে দেওয়া হত। তাই রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রচুর কাঠের প্রয়োজন হয়।

ঔপনিবেশিক অরণ্য বিষয়ক আইন পাস –

  • 1855 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ডালহৌসি এক বিবৃতি প্রকাশ করে অরণ্য সংরক্ষণের কথা বলেন। একে ভারতীয় বনসম্পদের সনদ বলে অভিহিত করা হয়।
  • 1856 খ্রিস্টাব্দে মহাবনপরিদর্শক নিযুক্ত হন ডেইট্রিক ব্রানডিস।
  • 1864 খ্রিস্টাব্দে ভারতে সর্বপ্রথম বন বিভাগ (Forest Department) প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • 1865 খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভারতীয় অরণ্য আইন (Indian Forest Act) পাস হয়।
  • 1878 খ্রিস্টাব্দে পূর্বের আইনকে আরও কঠোর করে দ্বিতীয় ভারতীয় অরণ্য আইন পাস করা হয়।

অরণ্য আইন পাস করে ভারতীয় বনভূমির উপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনে আদিবাসী জনগণের প্রতিক্রিয়া –

আদিবাসীরা বেশিরভাগ অরণ্য অঞ্চলের অধিবাসী। তারা অরণ্যের উপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল ছিল। অরণ্যের কাঠ সংগ্রহ, ফলমূল সংগ্রহ ও পশুশিকার করে তারা জীবন কাটাত। ব্রিটিশ সরকার অরণ্য আইন পাস করে অরণ্যের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলে তারা চিরাচরিত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। উপজাতিদের মধ্যে শিকারী ও ঝুমচাষিরা বিপন্ন হয়ে পড়ে।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন ও সে বিষয়ে আদিবাসী জনগণের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনে আদিবাসী জনগণের বিদ্রোহ –

সরকারের অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা প্রতিবাদ ও বিদ্রোহে শামিল হয়।

আদিবাসীদের উপর অরণ্য আইনের প্রভাব –

আদিবাসীদের উপর অরণ্য আইনের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর।

  • অরণ্য আইনের ফলে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আদিবাসীদের বিরোধ বাঁধে।
  • আদিবাসীদের চিরাচরিত জীবন ও জীবিকায় ব্যাঘাত ঘটে।
  • আদিবাসীরা সংঘবদ্ধ হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শামিল হয়।

ঔপনিবেশিক ভারতে আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহগুলির পরিচয় দাও।

ঔপনিবেশিক ভারতে আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহের ভূমিকা –

ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পর প্রায় 100 বছর ধরে ব্রিটিশ, জমিদার ও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনেক উপজাতি ও কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল। এই সকল বিদ্রোহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – চুয়াড় বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ, ভিল বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ ইত্যাদি।

ঔপনিবেশিক ভারতে বিভিন্ন আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহ –

  • চুয়াড় বিদ্রোহ – আদিবাসী চুয়াড় জনগোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ ও বাঁকুড়া জেলার মেদিনী পশ্চিম অংশে বসবাস করত। তারা কৃষিকাজ ও পশুশিকারের পাশাপাশি স্থানীয় জমিদারদের অধীনে পাইকের কাজ করত। এর বিনিময়ে কিছু নিষ্কর জমি ভোগ করার অধিকার। তারা পেয়েছিল। এমতাবস্থায় ব্রিটিশ কোম্পানি করের বোঝা বাড়িয়ে দিলে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে 1767-1768 খ্রিস্টাব্দ থেকে ব্রিটিশ সরকার ও তার সহযোগী জমিদারদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ শুরু হয়, তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। 1798-1799 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ মেদিনীপুর, বাঁকুড়া অঞ্চলে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। চুয়াড় বিদ্রোহের নেতা ছিলেন দুর্জন সিংহ, রানি শিরোমণি, জগন্নাথ সিং ধল, অচল সিংহ প্রমুখ। ব্রিটিশ সরকারের প্রচণ্ড দমনপীড়নের ফলে চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।
  • কোল বিদ্রোহ – কোলরা হল বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলে বসবাসকারী এক উপজাতি। তারা ইংরেজ, মহাজন ও বহিরাগত দিকুদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিল, তা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। 1820 খ্রিস্টাব্দে কোলরা প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তবে 1832 খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কোল বিদ্রোহের নেতা ছিলেন – বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুন্ডা প্রমুখ। ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহীদের উপর তীব্র দমননীতি প্রয়োগ করে এবং বহু আদিবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করলে বিদ্রোহ ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে যায়।
  • সাঁওতাল বিদ্রোহ – সাঁওতালরা হল কঠোর পরিশ্রমী, শান্তিপ্রিয় ও কৃষিজীবী সম্প্রদায়। আদিবাসী সাঁওতালরা পালামৌ, মানভূম, রাঁচি, হাজারিবাগ, বীরভূম, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ বনভূমি অঞ্চলে বসবাস করত। ইংরেজরা তাদের উপর বিপুল পরিমাণ রাজস্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়। মহাজনরা সাঁওতালদের চড়া সুদে ঋণ দিত এবং কম মজুরি দিয়ে বিভিন্ন পরিশ্রমসাধ্য কাজ করাত। খ্রিস্টান মিশনারিরাও তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করত। এ ছাড়া নীলকর সাহেবরাও তাদের খাদ্যশস্যের পরিবর্তে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। ফলে রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশ বা ‘দামিন-ই-কোহ’ অঞ্চলে 1855-1856 খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালরা যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন – সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখ। তবে এই বিদ্রোহ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। সরকার সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় সুদের হার বেঁধে দেয় এবং সাঁওতালদের জন্য পৃথক সাঁওতাল পরগনা গঠন করা হয়। সেখানে মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।
  • মুন্ডা বিদ্রোহ – আদিবাসী মুন্ডারা ছোটোনাগপুর ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে বসবাস করত। এই সমস্ত অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকার মুন্ডাদের প্রচলিত ‘খুৎকাঠি’ প্রথা বাতিল করে ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠা করে। এর প্রতিবাদে 1899-1900 খ্রিস্টাব্দে মুন্ডারা ইংরেজ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা মুন্ডা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। মুন্ডা বিদ্রোহের নেতা ছিলেন বিরসা মুন্ডা। তাঁকে ‘ধরতি আবা’ বলা হত। বিদ্রোহের পরবর্তীকালে মুন্ডাদের খুৎকাঠি প্রথা কিছুটা স্বীকৃতি লাভ করে এবং তাদের বেগার খাটানো বন্ধ হয়।
  • ভিল বিদ্রোহ – ভারতের উপজাতি সম্প্রদায়ের অপর একটি শাখা ভিল জাতি বসবাস করত গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের খান্দেশ অঞ্চলে। তারা কঠোর পরিশ্রম করে সেখানকার পাথুরে জমিতে ফসল ফলাত। 1818 খ্রিস্টাব্দের পর এই সমস্ত অঞ্চলে ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা চালু হলে ভিলদের উপর রাজস্বের বোঝা বহুগুণ বেড়ে যায়। তারা চরম শোষণ, অত্যাচার ও দুর্দশার শিকার হয়। ফলে 1819 খ্রিস্টাব্দে ভিলরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিলেন শিউরাম।
  • সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ – সুলতানি আমল থেকেই উত্তর ভারতের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু সন্ন্যাসী ও ফকির বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন অংশে তীর্থভ্রমণে আসত। ফিরে যাওয়ার সময় তারা ভূস্বামীদের কাছ থেকে অনুদান লাভ করত। অনেকেই এই সমস্ত অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। কৃষিকাজই ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। 1763 থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সন্ন্যাসী ও ফকিররা ইংরেজ কোম্পানি ও তাদের সহযোগী জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ সংগঠিত করেছিল, তা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, মজনু শাহ, মুসা শাহ প্রমুখ।
  • ওয়াহাবি আন্দোলন – ‘ওয়াহাবি’ কথার অর্থ নবজাগরণ। আরবদেশে আবদুল ওয়াহাব ইসলাম ধর্মের সংস্কারের জন্য যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন তিতুমির। তিতুমির 1831 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার, জমিদার, মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহ বারাসত বিদ্রোহ নামেও পরিচিত।
  • ফরাজি আন্দোলন – ‘ফরাজি’ কথার অর্থ ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য। ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাজি শরিয়ঊল্লাহ। এই আন্দোলন বাংলার ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোহর প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। শরিয়ৎউল্লাহ-র পর দুদু মিঞা ও নোয়া মিঞা এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।
  • নীল বিদ্রোহ – বাংলায় কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে নীল বিদ্রোহের নাম চিরস্মরণীয়। নীলকররা সীমাহীন শোষণ, অত্যাচার ও পীড়নের মাধ্যমে দরিদ্র কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করত। কৃষকরা খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে পারত না। নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার ক্ষুব্ধ কৃষকরা 1859 খ্রিস্টাব্দে যে বিদ্রোহ শুরু করে, তা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের চৌগাছা গ্রামের দিগম্বর বিশ্বাস ও বিয়ুচরণ বিশ্বাস নীল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। বিদ্রোহ ক্রমে যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর, মুরশিদাবাদ, রাজশাহী, মালদহ প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।

ঔপনিবেশিক ভারতে আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহের উপসহার –

ক্যাথলিন গফ উপরোক্ত বিদ্রোহগুলিকে ‘হারিয়ে যাওয়া অধিকারের পুনরুদ্ধারমূলক বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন। কোম্পানি এবং তাদের সহযোগী জমিদার ও মহাজনরা আদিবাসী ও কৃষকদের চিরাচরিত অধিকারগুলি হরণ করার ফলেই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। কোনো কোনো বিদ্রোহ ধর্মাশ্রয়ী হলেও তাদের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসন ও শোষণের অবসান।

মেদিনীপুরের চুয়াড় বিদ্রোহ (1798-1799 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

চুয়াড় বিদ্রোহের ভূমিকা –

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ধলভূম ও বর্তমান ঘাটশিলা অঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল গঠিত ছিল। এই জঙ্গলমহলের অধিকাংশ অধিবাসীদের ইংরেজ ও ইংরেজ সমর্থকরা চুয়াড় বলে অভিহিত করত। কোম্পানি জঙ্গলমহল অঞ্চলে রাজস্ব বৃদ্ধি করলে চুয়াড়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। 1768 খ্রিস্টাব্দে ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিং ধল প্রথম চুয়াড়দের নিয়ে খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করেন। দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ হয়েছিল 1798 থেকে 1799 খ্রিস্টাব্দ সময়কালে।

চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ –

চুয়াড় বিদ্রোহের কারণগুলি হল –

  • উচ্চহারে রাজস্ব আদায় – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে চুয়াড়দের জমির উপর উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করে। ফলে করপ্রদানে অনভ্যস্ত চুয়াড়দের উপর এই অত্যধিক রাজস্ব আরোপ তাদের ক্ষিপ্ত করে তোলে।
  • পাইকান জমি হাতছাড়া – চুয়াড়রা জমিদারদের অধীনে পাইক বা সৈনিকের কাজ করত। বেতনের পরিবর্তে তারা নিষ্কর জমি ভোগ করত। এই সমস্ত জমিকে ‘পাইকান জমি’ বলা হত। কিন্তু ঔপনিবেশিক আইন চালু হলে চুয়াড়রা তাদের পাইকান জমি হারায়। ফলে চুয়াড়দের জীবিকা নির্বাহ দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।
  • সূর্যাস্ত আইন – 1793 খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারগণ বছরের নির্দিষ্ট দিনে সূর্য ডোবার আগে রাজস্ব দিতে না পারলে চুয়াড়দের জমি সরকার কেড়ে নিত। একে ‘সূর্যাস্ত আইন’ বলা হয়। এরপর সরকার নিলামের মাধ্যমে ওই জমিদারি নতুন জমিদারকে প্রদান করত। এর ফলে মেদিনীপুর অঞ্চলের জমিদার ও কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
  • রাজস্ব আদায়কারীদের অত্যাচার – কোম্পানির রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীরা রাজস্ব আদায়ের নামে চুয়াড়দের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু করলে চুয়াড়রা স্থানীয় জমিদারদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।

চুয়াড় বিদ্রোহের বিস্তার –

উপরোক্ত কারণগুলির জন্য আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চুয়াড়রা ইংরেজদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। 1798 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে মেদিনীপুরের রাইপুর পরগনায়। এই চুয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন রাইপুরের জমিদার দুর্জন সিং। দুর্জন সিং ঠিক সময় রাজস্ব প্রদান করতে না পারার জন্য কোম্পানি রাইপুরের জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে এবং তাদের অনুগত এক জমিদারকে তা প্রদান করে। ক্ষমতাচ্যুত দুর্জন সিং তার অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

  • দুর্জন সিং -এর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা রাইপুর পরগনার বিভিন্ন গ্রামে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
  • বিদ্রোহীরা মেদিনীপুর লুঠ করে ও হত্যালীলা চালায়।
  • 1798 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে গোবর্ধন দিকপতি নামে এক বিদ্রোহী চন্দ্রকোনায় প্রবেশ করে লুঠপাট চালায়।
  • অপরদিকে দুর্জন সিং -এর অনুগত লাল সিং ও মোহন সিং নামে দুজন নেতা মেদিনীপুর অঞ্চলে ব্যাপক লুঠপাট চালায়।

চুয়াড় বিদ্রোহের দমন –

  • পুলিশবাহিনী মোতায়েন – চুয়াড় বিদ্রোহ দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার 1799 খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশবাহিনী মোতায়েন করে।
  • থানা গঠন – এইসব উপদ্রুত অঞ্চলে থানা প্রতিষ্ঠা করে তাদের হাতে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশি ব্যবস্থার উপরে জমিদারদের স্থাপন করা হয়।
  • বিদ্রোহীদের সঙ্গে আপস – পুলিশ দিয়ে চুয়াড় বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে সরকার জমিদারদের সঙ্গে সমঝোতা করে। তাদের উপর নামমাত্র রাজস্ব ধার্য হয়। তা ছাড়া স্থানীয় সর্দারদের পাইকান জমিগুলিকে করমুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়।

চুয়াড় বিদ্রোহের ফলাফল/গুরুত্ব –

  • বিদ্রোহী জমিদারদের সঙ্গে আপস – ব্রিটিশ সরকার সেনাবাহিনীর সাহায্যে চুয়াড় বিদ্রোহ দমন করতে না পেরে বিদ্রোহী জমিদারদের সঙ্গে আপস মীমাংসার পথ বেছে নেয়।
  • নিলাম নীতি ত্যাগ – ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চলে নিলামের মাধ্যমে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার নীতি ত্যাগ করে।
  • জঙ্গলমহল জেলা গঠন – 1805 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার 18 নং রেগুলেশন জারি করে উপদ্রুত অঞ্চলগুলিকে নিয়ে জঙ্গলমহল জেলা গঠন করে। এই জেলার সদর দপ্তর হয় বাঁকুড়া। জঙ্গলমহল জেলার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন হেনরি স্ট্র্যাচি।

কোল বিদ্রোহ (1831-1832 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

কোল বিদ্রোহের ভূমিকা –

কোলরা হল বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলে বসবাসকারী এক উপজাতি। তারা ইংরেজ, মহাজন বা বহিরাগত দিকু-দের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছিল, তা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। 1820 খ্রিস্টাব্দে কোলরা প্রথম বিদ্রোহ করে। তবে 1832 খ্রিস্টাব্দে কোল বিদ্রোহ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল।

কোল বিদ্রোহের কারণ –

  • ইংরেজ কোম্পানি জমিদার ও ইজারাদারদের মাধ্যমে কোলদের কাছ থেকে অত্যধিক হারে রাজস্ব আদায় শুরু করেছিল।
  • জমিদার ও মহাজনরা বিভিন্নভাবে প্রতারণা করে কোলদের অর্থ শোষণ করত ও অত্যাচার করত।
  • ইংরেজ কোম্পানি কোলদের উপর নতুন রাজস্বনীতি, আইন, বিচার প্রভৃতি প্রয়োগ করলে তাদের চিরাচরিত সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়।
  • মদ ছিল কোলদের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু। মদের উপর উঁচু হারে কর বসানো হলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

কোল বিদ্রোহের সূচনা –

কোলদের উপর শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিবাদে বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সুই মুন্ডা ও ঝিন্দরাই মানকি কোলদের সমবেত করতে থাকেন। 1831 খ্রিস্টাব্দে রাঁচি জেলায় মুন্ডা ও ওঁরাও সম্প্রদায়ের কৃষকরা সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। রাঁচি, সিংভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ ও মানভূমের পশ্চিম অঞ্চল কোল বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কোলরা ছিল ভয়ানক সাহসী। তারা তিরধনুক, কুড়ুল হাতে ইংরেজদের মুখোমুখি হয়েছিল। বিদ্রোহীরা সীমাহীন নিষ্ঠুরতার আশ্রয় গ্রহণ করে। জোতদার, জমিদার, শস্য ব্যবসায়ী, মহাজন, ইংরেজ কর্মচারী এমনকি আদিবাসী নয় এমন কোনো মানুষ-ও তাদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বিদ্রোহীরা এদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল।

কোল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য –

কোল বিদ্রোহের একাধিক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। যথা –

  • কোলরা এই বিদ্রোহ গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল। যেমন – আম গাছের শাখা গ্রামে গ্রামে পাঠানো হত। যুদ্ধের জন্য তির বিলি করা হত।
  • বিদ্রোহীদের হাতে ধৃত মহাজনদের দেবতার সামনে নিয়ে গিয়ে বলি দেওয়া হত।
  • বিদ্রোহীরা সীমাহীন নিষ্ঠুরতার আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।
  • তারা ব্রিটিশ সরকারকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে।
  • গণসমর্থন ছিল এই বিদ্রোহের শক্তির প্রধান উৎস।

কোল বিদ্রোহের দমন –

বিদ্রোহ দমনের জন্য ইংরেজরা কলকাতা, পাটনা, দানাপুর ও সম্বলপুর থেকে সৈন্য এনেছিল। আধুনিক অস্ত্র এবং গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে হাজার হাজার কোল নরনারী ও শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করে 1833 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার কোল বিদ্রোহ দমন করেছিল।

কোল বিদ্রোহের ফলাফল –

কোল বিদ্রোহের ফলে একদিকে যেমন ছোটোনাগপুরে সরকার এক নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে, নাম দেওয়া হয় দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি; অন্যদিকে তেমনি জমি জরিপ করিয়ে সেখানে ভূমি বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করে। জমিদারদের হাত থেকে গ্রামপ্রধানদের হাতে জমি ফেরত দেওয়া হয় এবং জমিদাররা যাতে পুনরায় জমি দখল করতে না পারে তার ব্যবস্থাও করা হয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহ (1855-1856 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, ঔপনিবেশিক ভারতে সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব আলোচনা করো।

সাঁওতাল বিদ্রোহের ভূমিকা –

সাঁওতালরা হল কঠোর পরিশ্রমী, শান্তিপ্রিয় এক কৃষিজীবী আদিবাসী সম্প্রদায়। তারা বীরভূম, মানভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, মুরশিদাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করত। ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব নীতির চাপে তারা রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশে বনভূমি পরিষ্কার করে বসবাস ও চাষবাস শুরু করে। তাদের এই অঞ্চলকে ‘দামিন-ই-কোহ’ (পাহাড়ের প্রান্তদেশ) বলা হয়। 1855 খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলের সাঁওতালরা বিভিন্ন কারণে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ –

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণগুলি হল নিম্নরূপ –

  • সাঁওতালদের জমি হরণ – সাঁওতালরা কঠোর পরিশ্রম করে দামিন-ই-কোহ অঞ্চলের পাথুরে ও জঙ্গলাকীর্ণ জমিকে চাষযোগ্য জমিতে পরিণত করে। তাদের এই জমিগুলি জমিদার, ইজারাদার ও মহাজনরা নানা অজুহাতে দখল করতে থাকে। ফলে সাঁওতালদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
  • অত্যধিক হারে রাজস্ব আদায় – ব্রিটিশ কোম্পানির সহযোগী জমিদাররা সাঁওতালদের কাছ থেকে অত্যধিক হারে ভূমিরাজস্ব আদায় করত। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলে 18 বছরের মধ্যে 10 গুণ খাজনা বৃদ্ধি করা হয়। তা ছাড়া জমিদার ও তাদের কর্মচারীরা নানা ধরনের উপশুল্ক আদায় করত। এই সব কর মেটাতে সাঁওতালরা নাজেহাল হয়ে যেত।
  • মহাজনদের শোষণ – নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় নগদ অর্থে খাজনা দিতে হত। সাঁওতালরা নগদ অর্থের জন্য মহাজনদের কাছে ফসল বিক্রি করতে এবং ঋণ নিতে বাধ্য হত। মহাজনরা ঋণ দেওয়ার সুযোগে 50% থেকে 500% হারে সুদ আদায় করত। এইভাবে সাঁওতালদের নানারকম কৌশলে শোষণ করত মহাজনরা।
  • ইংরেজ কর্মচারী ও ঠিকাদারদের অত্যাচার – লর্ড ডালহৌসির আমলে রাজমহল, রামপুরহাট, ভাগলপুর প্রভৃতি অঞ্চলে রেললাইনের কাজ শুরু হয়। এর জন্য এই অঞ্চলে বিভিন্ন কর্মচারী ও ঠিকাদাররা আসে। তারা নানাভাবে সাঁওতালদের উপর অত্যাচার করত। নামমাত্র মজুরিতে কাজ করানো, সাঁওতালদের হাঁস, মুরগি, ছাগল কেড়ে নেওয়া, এমনকি নারীদের সম্মানহানিতেও তারা পিছপা হত না। ফলে সাঁওতালরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
  • বহিরাগত ব্যবসায়ীদের শোষণ – বহিরাগত কিছু ব্যবসায়ী সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দোকান খুলে বসে। তারা সাঁওতালদের সরলতার সুযোগে ‘কেনারাম’ ও ‘বেচারাম’ নামক ভুয়ো বাটখারার দ্বারা কম ওজনে মালপত্র ক্রয়বিক্রয়ের মাধ্যমে দরিদ্র সাঁওতালদের প্রতারণা করে।
  • সাঁওতাল সমাজে ব্রিটিশ আইন প্রবর্তন – সাঁওতালরা তাদের নিজস্ব নিয়মে চলত। বাংলার ছোটোলাট ফ্রেডারিক হ্যালিডের নির্দেশে সাঁওতালদের মধ্যে ব্রিটিশ আইন কার্যকর করা হয়। এর ফলে তাদের চিরাচরিত উপজাতীয় সংগঠন ভেঙে পড়ায় তারা ক্ষুব্ধ হয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহ (1855-1856 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

সাঁওতাল বিদ্রোহ –

সাঁওতালরা মহাজন, জমিদার ও সরকারি কর্মচারীদের মিলিত শোষণ ও অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ হয়ে 1855 খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। 1855 খ্রিস্টাব্দের 30 জুন ভগনাডিহির মাঠে 10 হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়ে সিধু (সিধো) ও কানু (কানহো)-র নেতৃত্বে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। বিদ্রোহী সাঁওতালদের আক্রমণে কুখ্যাত মহাজন কেনারাম ভগত ও দিঘি থানার অত্যাচারী দারোগা মহেশলাল দত্ত খুন হন। বিদ্রোহীরা বহু নীলকুঠি ও রেলবাংলো ধ্বংস এবং অত্যাচারী জমিদার ও মহাজনদের হত্যা করেছিল।

সাঁওতাল বিদ্রোহের দমন –

আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে লাঠি, টাঙ্গি, বল্লম, তিরধনুক নিয়ে যুদ্ধ করে শেষপর্যন্ত সাঁওতালরা পরাজিত হয়েছিল। ইংরেজ সৈন্য 23 হাজার বিদ্রোহীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। ইংরেজরা সিধু, কানু-সহ অন্যান্য বীর সাঁওতাল নেতাদের ফাঁসি দিয়েছিল, বহু বিদ্রোহীদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল এবং তাদের গ্রামগুলি ধ্বংস করে দিয়েছিল। এভাবে ইংরেজরা 1856 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই সাঁওতাল বিদ্রোহ দমন করেছিল।

সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব –

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী।

  • ইংরেজ সরকার সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রামগুলিকে নিয়ে সাঁওতাল পরগনা গঠন করেছিল।
  • সাঁওতালদের ‘উপজাতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
  • এই অঞ্চলে বাঙালি মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিল সরকার এবং সুদের হারও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল।

সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব প্রসঙ্গে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “যদি 1857-র মহাবিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মনে করা হয়, তবে সাঁওতাল বিদ্রোহকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত।”

মুন্ডা বিদ্রোহের (1899-1900 খ্রিস্টাব্দ) কারণ কী ছিল? এই বিদ্রোহ সম্পর্কে লেখো।

মুন্ডা বিদ্রোহের ভূমিকা –

ভারতের উপজাতি বিদ্রোহগুলির মধ্যে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল অন্যতম উল্লেখযোগ্য। বর্তমান ঝাড়খণ্ডের রাঁচি-সিংভূম অঞ্চলে মুন্ডারা বসবাস করত। 1899-1900 খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ উলগুলান (প্রবল বিক্ষোভ) নামে পরিচিত।

মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ –

মুন্ডা বিদ্রোহের কারণগুলি হল –

  • যৌথ কৃষিব্যবস্থায় ভাঙন – মুন্ডারা জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিকাজ করত। ব্রিটিশ আমলে তাদের যৌথ কৃষিব্যবস্থা বা খুৎকাঠি প্রথায় ভাঙন ধরে। সরকার জমিতে ব্যক্তিগত ব্যবস্থা চালু করে। ফলে মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয়।
  • বেগার প্রথা – জমিদার ও মহাজনরা মুন্ডাদের উপর নানা ধরনের কর আরোপ করত। তারা মুন্ডাদের বেত বেগারি বা বিনা মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করত। এর ফলে মুন্ডাদের মধ্যে অসন্তোষ ঘনীভূত হয়।
  • মুন্ডাদের আইন ও বিচারব্যবস্থার পরিবর্তন – মুন্ডাদের নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা ছিল। তারা নিজেদের বিবাদের মীমাংসা নিজেরাই করত। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত আইন ও বিচারব্যবস্থা মুন্ডাদের উপরেও বলবৎ হয়। ফলে মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয়।
  • মুন্ডাদের ধর্মান্তরিতকরণ – ক্যাথলিক, লুথেরান প্রভৃতি খ্রিস্টান মিশনারিরা মুন্ডাদের বিভিন্ন প্রলোভন বা ভয় দেখিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করত। মিশনারিরা মুন্ডাদের চিরাচরিত ঐতিহ্য ও ধর্ম সম্পর্কে নানা ধরনের কুৎসা করত। এতে মুন্ডারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
  • মুন্ডাদের নৈতিক অধঃপতন ঘটানো – বহিরাগত দিকু, মহাজন এবং ঠিকাদার শ্রেণির লোকেরা অর্থ উপার্জনের জন্য মুন্ডাদের এলাকাগুলিতে মদ ও নেশার জিনিস বিক্রি করতে থাকে। এতে মুন্ডাদের মধ্যে চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটে। মুন্ডা নেতারা এই অবক্ষয় ঘটানোর বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়।
  • ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন – ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন দ্বারা মুন্ডাদের কাছ থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে মুন্ডাদের জীবন ও জীবিকা সমস্যায় পড়ে।

মুন্ডা বিদ্রোহী কার্যকলাপের ধারা –

বিদ্রোহী মুন্ডাদের আগ্রাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জমিদার ও মহাজন শ্রেণির গৃহ ও কাছারিগুলি। ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ-র মতে, মুন্ডারা পরিকল্পিতভাবে শত্রুপক্ষকে চিহ্নিত করে তাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। বিদ্রোহী কৃষকদের মধ্যে এইরূপ একটি ধারণা ছিল যে, জমিদার ও ভূস্বামী শ্রেণির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি আত্মস্থ করতে পারলে তারাও অনুরূপ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠবে।

বিরসার নেতৃত্বে বিদ্রোহের সূচনা –

রাঁচির উলিহাতু গ্রামের এক ভাগচাষি সুগান মুন্ডার পুত্র ছিলেন বিরসা মুন্ডা। মাত্র 21 বছর বয়সে বিরসা এক নতুন ধর্মদর্শনের উদ্ভাবন করতে গিয়ে নিজেকে ‘ধরতি আবা’ বা ‘ধরণীর পিতা’ বলে ঘোষণা করেন। স্বাধীন মুন্ডারাজ্য প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিদেশিদের বহিষ্কার ও খাজনা বন্ধের আহ্বান জানান। বিরসা 6000 মুন্ডাকে নিয়ে একটি সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর গয়া মুন্ডা সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিরসা ও তাঁর অনুচরেরা 1899 খ্রিস্টাব্দের 24 ডিসেম্বর রাঁচি ও সিংভূম জেলায় গির্জা, থানা, অফিস আক্রমণ করে ধ্বংস করেন। কিছুদিন বাদে 1900 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে। শেষপর্যন্ত ইংরেজ বাহিনীর আক্রমণে সাহসী মুন্ডাদের পরাজয় ঘটে। বিরসা বন্দি হন এবং জেলেই 1900 খ্রিস্টাব্দের 9 জুন তাঁর মৃত্যু হয়।

মুন্ডা বিদ্রোহের (1899-1900 খ্রিস্টাব্দ) কারণ কী ছিল? এই বিদ্রোহ সম্পর্কে লেখো।

মুন্ডা বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য –

মুন্ডা বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • এই বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল দিকুদের বিতাড়ন, ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং বিরসার শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
  • গোপন সমাবেশ, আলোচনা, সমবেত প্রার্থনা ইত্যাদির মাধ্যমে মুন্ডা বিদ্রোহের বাণী ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
  • মুন্ডাদের অনুগত অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রতি কোনো বৈরী মনোভাব প্রকাশ করা হয়নি।

মুন্ডা বিদ্রোহের গুরুত্ব –

মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।

  • ব্রিটিশ সরকার ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন (1908 খ্রিস্টাব্দ) পাস করে মুন্ডাদের জমিতে খুৎকাঠি স্বত্ব পুনঃপ্রবর্তন করে।
  • বেত বেগারি প্রথা নিষিদ্ধ হয়।
  • এই বিদ্রোহের ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এর প্রভাবেই ছোটোনাগপুরের ওঁরাও সম্প্রদায় তানাভকৎ আন্দোলন শুরু করে।

তবে অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে, মুন্ডা বিদ্রোহের আসল গুরুত্ব হল বিরসার নেতৃত্বে মুন্ডাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ।

রংপুর বিদ্রোহের (1783 খ্রিস্টাব্দ) কারণ, বিস্তার ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, রংপুর বিদ্রোহ – টীকা লেখো।

রংপুর বিদ্রোহের ভূমিকা –

1783 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলার রংপুরের কৃষকরা ইজারাদার দেবী সিংহের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা রংপুর বিদ্রোহ নামে পরিচিত। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ বলেছেন যে, 1783 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ছিল একটি সফল কৃষক অভ্যুত্থান। রংপুর বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন নুরুলউদ্দিন।

রংপুর বিদ্রোহের কারণ –

রংপুর বিদ্রোহের পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল –

  • ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচার – 1780 খ্রিস্টাব্দে দিনাজপুরের রাজা হন নাবালক রাধানাথ সিংহ। বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস দেবী সিংহ নামে এক ব্যক্তিকে তাঁর দেওয়ান নিযুক্ত করেন। দেবী সিংহ বার্ষিক 16 লক্ষ টাকার বিনিময়ে দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগনার ইজারা নেন। এরপর ইজারাদার হয়ে দেবী সিংহ স্থানীয় জমিদার ও কৃষকদের উপর অত্যধিক হারে রাজস্ব ধার্য করে। তার অত্যাচারে ওই অঞ্চলের প্রজারা জর্জরিত হয়ে ওঠে।
  • জমিদারি বাজেয়াপ্ত – নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব দিতে না পারার জন্য অনেক জমিদারের জমিদারি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এজন্য জয়দুর্গা চৌধুরাণী, বামনডাঙার জমিদার জগদীশ্বরী চৌধুরাণী, টেপাগ্রামের জমিদার-সহ অনেক জমিদারের জমিদারি বাজেয়াপ্ত হয়।
  • মহাজনদের শোষণ – দরিদ্র কৃষকরা রাজস্ব দেওয়ার জন্য বা বিভিন্ন প্রয়োজনে মহাজনের কাছে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে বাধ্য হত। মহাজনরাও এই সুযোগে কৃষকদের শোষণ করত।

রংপুর বিদ্রোহের বিস্তার –

বিদ্রোহ প্রথমে শুরু হয় রংপুরের টেপা, তিমলা, ফতেপুর, রুজিরহাট প্রভৃতি অঞ্চলে। বিদ্রোহীরা তাদের মধ্য থেকে নুরুলউদ্দিনকে ‘নবাব’ বলে এবং দয়ারাম শীল নামে আর-এক ব্যক্তিকে ‘নবাবের দেওয়ান’রূপে ঘোষণা করে। হিন্দু-মুসলিম সকল কৃষকই ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করে। তাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম দ্রুত দিনাজপুর ও কোচবিহার জেলাতেও বিস্তার লাভ করে।

রংপুর বিদ্রোহের দমন –

এমতাবস্থায় বিদ্রোহ দমনে ইংরেজরা দ্রুত দিনাজপুর ও কোচবিহার জেলাতেও বিস্তার লাভ করে। সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয়। নুরুলউদ্দিন আহত হয়ে বন্দি হন, পরে মৃত্যুবরণ করেন। দয়ারাম শীলও নিহত হন। শেষপর্যন্ত বিদ্রোহীদের উপর প্রচণ্ড অত্যাচার চালিয়ে 1783 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়।

রংপুর বিদ্রোহের গুরুত্ব –

রংপুর বিদ্রোহ দমিত হলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

  • ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ – রংপুর বিদ্রোহ একটি আঞ্চলিক বিদ্রোহ হিসেবে শুরু হলেও এটি ক্রমশ ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহে পরিণত হয়।
  • ইজারাদারি প্রথার কুফলগুলির প্রকাশ – ইজারাদারি প্রথা যে কত ভয়ংকর হতে পারে এই বিদ্রোহের ফলে তা প্রকাশ পেয়েছিল।
  • শোষকদের নগ্নরূপের প্রকাশ – এই বিদ্রোহের ফলে জমিদার, মহাজন, ইজারাদার, সরকারি কর্মচারীদের কৃষক-শোষণের রূপ প্রকাশিত হয়েছিল।
  • হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের মিলিত বিদ্রোহ – রংপুর বিদ্রোহ ছিল নির্যাতিত হিন্দু ও মুসলমান প্রজাদের মিলিত আন্দোলন। ঐতিহাসিক নরহরি কবিরাজও রংপুর বিদ্রোহকে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ (1763-1800 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের ভূমিকা –

মুঘল যুগের শেষদিকে ভারতের বিভিন্ন ভ্রাম্যমান সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায় বাংলা ও বিহারের নানা অংশে স্থায়ীভাবে বসবাস করত। 1763 থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘গিরি’ ও ‘দশনামী’ সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী এবং ‘মাদারি’ সম্প্রদায়ভুক্ত ফকিরদের নেতৃত্বে যে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল, তা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের ব্যাপ্তিকাল ছিল 1763 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দ।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ –

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের পিছনে একাধিক কারণ দায়ী ছিল। যথা –

  • রাজস্বের চাপ – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উচ্চহারে রাজস্ব বৃদ্ধি করায় কৃষিজীবী সন্ন্যাসী ও ফকিররা করভারে জর্জরিত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া কোম্পানির কর্মচারীরা প্রায়ই ব্যবসায়ী সন্ন্যাসী-ফকিরদের কাছ থেকে রেশম বা রেশমজাত পণ্য বলপূর্বক ছিনিয়ে নিত।
  • ইজারাদারি শোষণ – সন্ন্যাসী-ফকিরদের অধিকাংশই ছিল কৃষিজীবী। অধিক খাজনা আদায়ের জন্য কোম্পানির ইজারাদারদের শোষণ কৃষকদের ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল।
  • তীর্থকর আরোপ – সন্ন্যাসীরা মাঝেমধ্যেই দলবদ্ধভাবে তীর্থে যেত। কোম্পানি সরকার তাদের উপর তীর্থকর ধার্য করে এবং ফকিরদেরও দরগায় যেতে বাধা দেয়।
  • নির্যাতন – সন্ন্যাসী ও ফকিরদের উপর বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হত।
  • জমিদারদের আর্থিক অবস্থার বিপন্নতা – আগে সন্ন্যাসী-ফকিররা জমিদারদের কাছ থেকে যেরকম দান বা অর্থসাহায্য পেতেন, পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার জমিদারদের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপালে জমিদারদের আর্থিক অবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়ে। ফলে তারা আগের মতো সন্ন্যাসীদের অর্থসাহায্য করতে পারতেন না। এতে সন্ন্যাসীদের জীবননির্বাহ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লে তারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের বিদ্রোহের সূচনা –

1763 খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সন্ন্যাসীরা প্রথম ইংরেজ কুঠির উপর আঘাত করে। 1763 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বিদ্রোহীরা এই কুঠিকে তাদের অধিকারে রেখেছিল। তবে ওই মাসের শেষের দিকে ক্যাপটেন গ্রান্টের নেতৃত্বে একদল ইংরেজ সেনা এই কুঠি পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। 1763 খ্রিস্টাব্দে দিনহাটার সন্ন্যাসী নায়ক রামানন্দ গোঁসাই -এর বাহিনীর সঙ্গে লেফটেন্যান্ট মরিসনের বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বিদ্রোহীরা পরাস্ত হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের উপর আক্রমণ করে এবং মরিসনের সৈন্যবাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয়।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের বিস্তার –

ঢাকা থেকে এই বিদ্রোহ শুরু হয় এবং এরপর রাজশাহির রামপুর কুঠি আক্রান্ত হয়। এই বিদ্রোহ দাবানলের মতো বগুড়া, মালদহ, রংপুর, দিনাজপুর, কোচবিহার, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।

1776 খ্রিস্টাব্দ থেকে সন্ন্যাসী-ফকিরদের মধ্যে আত্মকলহের ফলে বিদ্রোহীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর সন্ন্যাসী-ফকিরেরা পৃথক পৃথকভাবে ইংরেজদের বাধা দেয়। 1786 খ্রিস্টাব্দে বগুড়া জেলায় মঞ্জুরার যুদ্ধে ইংরেজ সেনার গুলিতে আহত হয়ে মজনু শাহ প্রাণত্যাগ করেন। মজনু শাহের পর মুসা শাহ ফকিরদের সংঘবদ্ধ করে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ইংরেজ বাহিনীর আক্রমণে তিনিও পরাস্ত হন। এরপর ভবানী পাঠক সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দেন। 1787 খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে জলযুদ্ধে ভবানী পাঠক পরাজিত ও নিহত হন। তাঁর শিষ্যা দেবী চৌধুরাণী কিছু সময় ধরে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু তিনিও পরাজিত হন।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ (1763-1800 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের অবসান –

ইংরেজদের দমননীতির ফলে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের অবসান হয়। নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং সন্ন্যাসী-ফকিরদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদের ফলেই সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। 1800 খ্রিস্টাব্দ থেকে ইংরেজি সরকারি নথিপত্রে আর উল্লেখ পাওয়া যায় না। এইভাবে ভারতের প্রথম কৃষক বিদ্রোহের অবসান ঘটে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

বড়োলাট ওয়ারেন হেস্টিংস প্রমুখ রাজপুরুষরা এই বিদ্রোহকে হিন্দুস্তানের যাযাবর, পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই মত সত্য নয়। কারণ – বিদ্রোহীদের অনেকক্ষেত্রেই শোষিত কৃষকগণ সাহায্য করেছিল। কেবল লুণ্ঠনকারী হলে তারা এই সাহায্য পেত না। সরকারি ও বেসরকারি দলিল থেকে জানা যায় যে, এই বিদ্রোহ ছিল বাংলা ও বিহারের কৃষকশ্রেণির বিদ্রোহ। ঐতিহাসিক উইলিয়ম হান্টার-ই সর্বপ্রথম সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ বলেন (The Annals of Rural Bengal-Hunter)। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড ও গ্যারেট-ও একে কৃষক বিদ্রোহ বলেছেন। সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কাহিনি অবলম্বনে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস আনন্দমঠ রচনা করেন, যা ছিল বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা।

ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল? তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

ওয়াহাবি আন্দোলন –

ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন দিল্লির বিখ্যাত মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর পুত্র আজিজ। তবে ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহমদ এবং বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিতুমির।

ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য –

  • ইসলাম ধর্মের সংস্কার – ‘ওয়াহাবি’ আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল ‘তারিকা-ই-মহম্মদীয়া’ অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মহম্মদ প্রদর্শিত পথ। ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ধর্মের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করে মহম্মদের নির্দেশ অনুসরণ করে ইসলাম ধর্মের সংস্কার করা।
  • ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন – ওয়াহাবি আন্দোলনকারীরা বিধর্মী ইংরেজ-শাসিত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ (শত্রুর দেশ) বলে অভিহিত করত। তাই তারা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে বিধর্মী ইংরেজদের বিতাড়িত করার জন্য আন্দোলন করেছিল।
  • অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ – ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ করা। এই কারণে পাঞ্জাবের অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সৈয়দ আহমদ যুদ্ধ করে পেশোয়ার দখল করেছিলেন এবং বাংলায় তিতুমির পুড়ার জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
  • নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শ – ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল এক সহজসরল জীবনযাত্রা এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন –

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মির নিশার আলি, যিনি তিতুমির নামে অধিক পরিচিত। তিতুমির 24 পরগনা জেলার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত হায়দারপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মক্কায় হজ করতে গিয়ে সৈয়দ আহমদের সংস্পর্শে আসেন এবং দেশে ফিরে ইসলাম ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন কৃষক আন্দোলন-এ পরিণত হয়েছিল। বারাসত অঞ্চলে তিতুমিরের এই আন্দোলন বারাসত বিদ্রোহ নামেও পরিচিত।

ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল? তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

তিতুমিরের আন্দোলনের মূল কথা –

তিতুমিরের আন্দোলনের মূল কথা ছিল –

  • একমাত্র আল্লাহকে মান্য করতে হবে।
  • মুসলমানদের ইসলাম ধর্মবহির্ভূত সংস্কার পরিত্যাগ করতে হবে।
  • অনুগামীদের দাড়ি রাখতে হবে।
  • অত্যাচারী জমিদারদের রাজস্ব দাবির বিরোধিতা করতে হবে।

তিতুমিরের বিরুদ্ধে জমিদারদের প্রতিক্রিয়া –

তিতুমিরের প্রভাবে 24 পরগনা, নদিয়া, মালদহ, রাজশাহি, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করলে জমিদার, নীলকর সাহেব ও মুসলমান মোল্লারা তিতুমিরের বিরোধিতা করে। পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তিতুমিরের অনুগামীদের দমন করার জন্য দাড়ির উপর \(2\frac12\) টাকা কর ধার্য করেছিলেন। ফলে জমিদারের সঙ্গে তিতুমিরের অনুগামীদের সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল।

বারাসত বিদ্রোহ –

তিতুমির বারাসতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজেকে স্বাধীন ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন ও মইনুদ্দিন নামে এক অনুগামীকে প্রধানমন্ত্রী এবং ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার পরিকল্পনা করেন। তিনি নারকেলবেড়িয়ার সদর দপ্তরে ‘বাঁশের কেল্লা’ নির্মাণ করে ওই অঞ্চলের জমিদারদের কাছে রাজস্ব দাবি করেন। এটি ইতিহাসে বারাসত বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

বারাসত বিদ্রোহের অবসান –

তিতুমিরের বিরুদ্ধে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবরা গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিষ্কের শরণাপন্ন হলে লর্ড বেন্টিঙ্ক তিতুমিরের বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে তিতুমিরের বাহিনীর অসম যুদ্ধে তিতুমির ও তাঁর বহু অনুগামী মৃত্যুবরণ করেন। ফলে বারাসত বিদ্রোহের অবসান ঘটে।

ওয়াহাবি আন্দোলনের উপসংহার –

ধর্মীয় চেতনা ওয়াহাবি আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। জমিদারদের বিরোধিতা থেকে এই আন্দোলন শেষপর্যন্ত ইংরেজ সরকারের বিরোধিতায় পরিণত হয়েছিল।

বাংলাদেশে ওয়াহাবি আন্দোলন এবং তার চরিত্র বিশ্লেষণ করো।

ওয়াহাবি আন্দোলন –

ওয়াহাবি কথাটির অর্থ হল ‘নবজাগরণ’। আরব দেশে আবদুল ওয়াহাব (1703-1787 খ্রিস্টাব্দ) নামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইসলাম ধর্মের সংস্কারের জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায় ওয়াহাবি নামে পরিচিত।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন –

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন তিতুমির। ধর্মীয় উদ্দেশ্যে মক্কায় গিয়ে তিতুমির ওয়াহাবিদের দ্বারা প্রভাবিত হন। রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে। মক্কা থেকে ফিরে এসে তিতুমির বারাসত সংলগ্ন অঞ্চলে প্রচার শুরু করেন। শুরুতে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়বাদী কিছু ধর্মীয় আচার-আচরণ ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন। 1830 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলন সুস্পষ্টভাবে জমিদারবিরোধী রূপ পরিগ্রহণ করে।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য –

সূচনা, প্রসার ও অবসানের ক্ষেত্রে ওয়াহাবি আন্দোলন নানান বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। যথা –

  • দাড়ির উপর কর – বারাসত অঞ্চলের পুড়া গ্রামের জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ওয়াহাবিদের দাড়ির উপর \(2\frac12\) টাকা হারে কর ধার্য করলে তাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দেয়। তিতুমিরের অনুগামীরা কৃষ্ণদেব রায়ের বাসভবন আক্রমণ করে এবং ব্যাপক লুঠপাট চালায়।
  • নীলকরবিরোধী আন্দোলন – তিতুমিরের বিদ্রোহ শুরুতে রাজস্ব সংগ্রহকারী জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। স্বল্পকালের মধ্যেই নীলকররা তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তা ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়। ছোটো ছোটো কৃষকদের নিয়ে মূল বিদ্রোহী বাহিনী গড়ে উঠেছিল, তবে এদের সঙ্গে কর্মচ্যুত তাঁতিরাও যোগদান করে। প্রথম জীবনে জমিদারদের অধীনে কাজ করায় জমিদারদের শোষণ সম্পর্কে তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল।

ওয়াহাবি আন্দোলনের সংগঠন (1830 খ্রিস্টাব্দ) –

তিতুমির ঘোষণা করেন যে, বারাসত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের অবসান হয়েছে। তিতুমির নিজেকে ‘স্বাধীন বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। মইনুদ্দিন নামে জনৈক ওয়াহাবি প্রধানমন্ত্রী এবং নিজ ভাগ্নে গোলাম মাসুম তিতুমিরের সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। বারাসতের নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি ‘বাঁশের কেল্লা’ তৈরি করেন। তিতুমির টাকি, গোবরডাঙা প্রভৃতি স্থানের জমিদারদের কাছ থেকে কর দাবি করতে শুরু করেন। এই ঘটনা বারাসত বিদ্রোহ নামে পরিচিত হয়। এরপর তিতুমির ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন।

ওয়াহাবি আন্দোলনের অবসান –

  • বাঁশের কেল্লা ধ্বংস – জমিদার ও কুঠিয়ালরা সরকারের কাছে প্রতিকার প্রার্থনা করে আবেদন জানালে তিতুমিরের সঙ্গে সরকারের প্রত্যক্ষ সংঘাতের সূত্রপাত হয়। গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিষ্কের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ সেনাবাহিনীর আক্রমণে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা গুঁড়িয়ে যায়।
  • তিতুমিরের মৃত্যু – তিতুমির গোড়ার দিকে জয়লাভ করলেও পরে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে 1831 খ্রিস্টাব্দের 19 নভেম্বর তিনি নিহত হন। তাঁর বহু অনুচর নিহত ও বন্দি হন। বারাসত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। তিতুমিরের ব্যর্থতা অবশ্যই অস্বাভাবিক ছিল না। প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় এবং দুর্বল সংগঠন নিয়ে প্রতাপশালী ব্রিটিশদের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষে তিতুমিরের সাফল্যের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।

ওয়াহাবি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ –

তিতুমিরের আন্দোলনের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হল – এই আন্দোলনে সব শ্রেণির কৃষককে শামিল করা যায়নি। এ ছাড়াও ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল – ওয়াহাবিদের সঙ্গে অন্যান্য কৃষক সম্প্রদায়ের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আসলে জমিদারদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে ওয়াহাবি-বিরোধী মুসলমানরাও যেমন যোগদান করেনি, তেমনি ক্রমশ আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করায় হিন্দু কৃষকেরাও এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে। কিন্তু ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই আন্দোলনের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

ওয়াহাবি আন্দোলনের চরিত্র –

ডঃ কুয়েমুদ্দিন আহমদ মনে করেন, এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম একত্রে অংশগ্রহণ করে এবং এতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো ভূমিকা ছিল না। আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য ছিল ভারত থেকে ব্রিটিশশক্তির বিতাড়ন।

উইলিয়ম হান্টারের মতে, তিতুমিরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল কৃষকশ্রেণির একটি শ্রেণিসংগ্রাম। তবে ঐতিহাসিক ডঃ শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, জমিদার শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে আরম্ভ হলেও শেষপর্যন্ত এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক চরিত্র নেয়। মোট কথা তিতুমিরের আন্দোলন ছিল স্থানীয় জমিদার, নীলকর ও ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন।

ডঃ বিনয় চৌধুরীর মতে, তিতুমির জমিদারি প্রভুত্বের বিরুদ্ধেই মূলত সংগ্রাম করেন। জমিদাররা বেশিরভাগ হিন্দু ছিলেন বলেই তিনি জমিদারদের ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করতে চান। ডব্লু সি স্মিথ-ও তিতুমিরের আন্দোলনকে কৃষক বিদ্রোহ হিসেবেই দেখেছেন।

ডঃ অভিজিৎ দত্ত অবশ্য বলেন যে, তিতুমিরের আন্দোলন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় দিক দিয়ে মিশ্র চরিত্রবিশিষ্ট ছিল। কেনেথ ডব্লু জোনস তিতুমিরের আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, তিতুমিরের আন্দোলন ধর্ম ও অর্থনীতিকে এমনভাবে মিশ্রিত করেছিল, যার দরুন তাঁকে হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সংঘাতে অবতীর্ণ হতে হয়।

ফরাজি আন্দোলনের উপর একটি নিবন্ধ লেখো।

ফরাজি আন্দোলন –

বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে যেসকল বিদ্রোহ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম হল ফরাজি আন্দোলন। 1818 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1906 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলেছিল।

ফরাজি আন্দোলনের উপর একটি নিবন্ধ লেখো।

ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা –

ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ। 1781 খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের অন্তর্গত ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কোরান ও ইসলামি ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষালাভ করার উদ্দেশ্যে তিনি মক্কায় যান এবং সেখানে ওয়াহাবি আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হন। প্রায় 20 বছর বিদেশে থেকে ইসলামীয় ধর্মতত্ত্বে পাণ্ডিত্য অর্জন করে 1818 খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। 1820 খ্রিস্টাব্দে তিনি ফরাজি নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন এবং ধর্মসংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

ফরাজি আন্দোলনের আদর্শ ও লক্ষ্য –

ফরাজি একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য। শরিয়ৎউল্লাহ ঘোষণা করেন যে, ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে ইসলামবিরোধী নানা কুসংস্কার ও দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সে কারণে তিনি কোরানের নির্দেশ পালন করে ইসলাম ধর্মের সংস্কারসাধনের কথা বলেন। ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও অচিরেই এই আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। তিনি ঘোষণা করেন, ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতবর্ষ দার-উল-হারব বা শত্রুর দেশে পরিণত হয়েছে। তাঁর মতে, এই দেশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বাসযোগ্য নয়। শুদ্ধ ইসলামিক রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি সকলকে আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মুসলিম চাষি, কারিগর ও তাঁতি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি তাঁর শিষ্যদের জমিদার ও নীলকরদের শোষণের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টাও করেছিলেন।

দুদু মিঞা ও ফরাজি আন্দোলন –

শরিয়ৎউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন ওরফে দুদু মিঞা আন্দোলনের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল জমিদারি শাসন ও বিদেশি ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ করে স্বাধীন মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ঘোষণা করেন, সকল মানুষই সমান, আল্লাহর সৃষ্ট পৃথিবীতে কর ধার্যের অধিকার কারও নেই। তাঁর নির্দেশে মুসলমান প্রজারা জমিদারদের কর দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।

ফরাজি আন্দোলনের বিস্তার –

দুদু মিঞার নেতৃত্বে এই আন্দোলন ফরিদপুর ও ঢাকা থেকে বাখরগঞ্জ, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোহর ও দক্ষিণ 24 পরগনার ব্যাপক অঞ্চলে বিস্তৃত হয়।

ফরাজি আন্দোলনে জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ সরকারের সঙ্গে বিরোধ –

দুদু মিঞার কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ সরকার জোটবদ্ধ হয়। তারা একাধিকবার দুদু মিঞাকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করে। 1857 খ্রিস্টাব্দে শেষবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। দীর্ঘ কারাবাসের ফলে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। অবশেষে নানাপ্রকার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে 1862 খ্রিস্টাব্দের 24 সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।

ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব –

ফরাজি আন্দোলন তার লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হলেও একেবারে গুরুত্বহীন ছিল না। জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা প্রচার করে দুদু মিঞা কৃষকদের নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ছাড়া ফরাজি আন্দোলনে বাংলার কৃষকসমাজে এক সংগ্রামী ঐতিহ্য রেখে গিয়েছে। ফরাজি আন্দোলনে তাদের জোটবদ্ধতার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পরবর্তীকালে পাবনার কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে যার প্রতিফলন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

ফরাজি আন্দোলনের কারণ আলোচনা করো। এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো।

উনিশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা প্রভৃতি স্থানে হাজি শরিয়ৎউল্লাহ-র নেতৃত্বে ইসলামের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ইসলাম ধর্মকে কঠোরভাবে মেনে চলার লক্ষ্যে ‘ফরাইজ’ বা ‘অবশ্য পালনীয় কর্তব্য’ পালনের জন্য শুরু হওয়া এই গণ আন্দোলন ফরাজি আন্দোলন নামে পরিচিত।

ফরাজি আন্দোলনের কারণ আলোচনা করো। এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো।

ফরাজি আন্দোলনের কারণ –

ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াজনিত আন্দোলনগুলির মধ্যে ফরাজি আন্দোলন ছিল একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হাজি শরিয়ৎউল্লাহ, তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন ওরফে দুদু মিঞা এবং তাঁর পুত্র নোয়া মিঞা পরিচালিত এই আন্দোলন ছিল মূলত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই নানান কারণে তা সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।

  • ইসলাম ধর্মের শুদ্ধতা রক্ষা করে প্রয়োজনীয় সংস্কারসাধন করা তথা সামাজিক কুসংস্কারগুলি দূর করে ইসলাম ধর্মের বিশ্বজনীন আবেদন প্রতিষ্ঠা করার জন্য ফরাজি আন্দোলন শুরু হয়।
  • মুঘল শাসন বা মুসলমান শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে শত্রুদের দেশ বা ‘দার-উল-হারব’-এ পরিণত করেছে। এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে শরিয়ৎউল্লাহ ঘোষণা করেন যে, ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করে ‘ইসলামের পবিত্র দেশ’ বা ‘দার-উল-ইসলাম’-এ পরিণত করতে হবে।
  • ইংরেজ সমর্থনপুষ্ট নীলকর এবং জমিদার শ্রেণির শোষণ ও অত্যাচারের অবসান ঘটানো ছিল ফরাজি আন্দোলনের অপর এক উদ্দেশ্য।

ফরাজি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য –

ফরাজি আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • এটি ছিল ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের জন্য কৃষক সম্প্রদায়ের আন্দোলন, যার কেন্দ্রীভবন ঘটেছিল পূর্ব বাংলার ফরিদপুর অঞ্চলে।
  • ফরাজি আন্দোলনের জনক ছিলেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ। জমিদারদের হাতে উৎখাত হওয়া প্রজা, বেকার, কারিগরশ্রেণির মানুষজন তাঁর অনুগামী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছিল।
  • মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কারগুলির সমালোচনা করা এবং সেগুলি যে ইসলাম ধর্মবিরোধী তা বোঝানোর মধ্য দিয়ে ফরাজি আন্দোলন শুরু হয়। শরিয়ঊল্লাহ -এর মতে, ইসলামধর্মে সবাই সমান। সেখানে ‘পীর’ (প্রভু) এবং ‘মুরিদ’ (দাস) দুটি শব্দই পরিত্যাজ্য। এর বদলে তিনি ‘ওস্তাদ’ ও ‘শাকরেদ’ শব্দ দুটিকে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতেন।
  • ফরাজি অনুগামীদের নিয়ে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল ‘ফরাজ-ই-খিলাফৎ’ নামক এক স্বাধীন প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
  • দুদু মিঞার আমলে 1840 খ্রিস্টাব্দ থেকে ফরাজি আন্দোলন অধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বাহাদুরপুরকে কেন্দ্র করে তিনি ‘ফরাজ-ই-খিলাফৎ’-কে আরও সুসংগঠিত করেন। ঘোষণা করেন, তিনিই পূর্ববঙ্গের প্রকৃত শাসক বা খলিফা। নীলকর এবং জমিদার সম্প্রদায় তাঁর বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থনা করে।
  • দুদু মিঞার আমলে ফরাজি আন্দোলন গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। তবে 1847 খ্রিস্টাব্দে দুদু মিঞার গ্রেফতার হওয়া এবং 3 বছর বন্দি জীবনযাপনের পর তাঁর মৃত্যু ফরাজি আন্দোলনকে গতিহীন করে দেয়।

ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব –

  • কৃষকদের মধ্যে নবজাগরণের সঞ্চার – ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, পূর্ব বাংলার কৃষকদের মধ্যে নবজাগরণের সঞ্চার করেছিল এই আন্দোলন। ধর্মীয় রং -এর ছোঁয়া লাগলেও এই আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল কৃষকদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
  • হিন্দু কৃষকদের অংশগ্রহণ – শুধু মুসলমান কৃষকরাই নয়, অনেক হিন্দু কৃষকও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
  • রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য – ধর্মীয় সংস্কারের লক্ষ্য থেকে এই আন্দোলন শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল।
  • ব্রিটিশ বিতাড়নের প্রেরণা – ফরাজি আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ করতে না পারলেও বাংলা থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়নের প্রেরণা জুগিয়েছিল।

পাগলপন্থী বিদ্রোহ (প্রথম পর্ব, 1824-1827 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

পাগলপন্থী আন্দোলনের ভূমিকা –

ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর পরগনায় ফকির করিম শাহের পুত্র টিপু শাহের নেতৃত্বে 1824 খ্রিস্টাব্দে যে জমিদার ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন পরিচালিত হয়, তা পাগলপন্থী আন্দোলন নামে পরিচিত। করিম শাহ ছিলেন ‘পাগলপন্থী’ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সহজসরলভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা করতেন। তিনি বলতেন, সব মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি; সুতরাং সবাই সমান ও পরস্পরের ভাই। তাঁর প্রচারের ফলে বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়েছিল।

পাগলপন্থী বিদ্রোহের কারণ –

বিভিন্ন কারণে পাগলপন্থী সম্প্রদায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল –

  • ব্রিটিশ শাসনরীতি – বাংলায় ব্রিটিশ শাসন চালু হলে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার চিরাচরিত প্রথা ও রীতিনীতি অচল হয়ে যায়।
  • করের হার বৃদ্ধি – ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব নীতি চালু হওয়ার ফলে করের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়।
  • জমিদারি শোষণ – নির্দিষ্ট ভূমিরাজস্ব ছাড়াও জমিদারগণ নানারকম বাড়তি কর বা আবওয়াব আদায় করত। জমিদারের চাহিদা মেটাতে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে যেত।
  • ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের চাপ – ইঙ্গ-ব্রক্স যুদ্ধের সময় কোম্পানির ব্যয় বৃদ্ধি ঘটলে এখানকার কৃষকদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায় করা হয়।

পাগলপন্থী আন্দোলন

1813 খ্রিস্টাব্দে করিম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু শাহ পাগলপন্থীদের নেতা হন। তাঁর নেতৃত্বে পাগলপন্থী আন্দোলন সরাসরি জমিদারবিরোধী ও ব্রিটিশ সরকারবিরোধী কৃষক বিদ্রোহের রূপ নেয়।

  • কৃষকেরা জমিদারদের কর দেওয়া বন্ধ করে।
  • টিপু শাহের নামে স্বল্প পরিমাণে কর আদায় শুরু করে।
  • বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ সরকারের সব নিয়ম-নির্দেশ অগ্রাহ্য করতে থাকে। থানায় অগ্নিসংযোগ করে, শহরে লুঠপাট শুরু করে এবং ময়মনসিংহের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটকেও ঘেরাও করে রাখে।

ফলে সরকারের সঙ্গে পাগলপন্থীদের লড়াই শুরু হয়। শেষপর্যন্ত টিপুর বাহিনী পরাজিত হয় ও টিপু 1824 খ্রিস্টাব্দের 7 ডিসেম্বর বন্দি হন। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর 1825 খ্রিস্টাব্দে আবার তিনি বন্দি হন। বিচারে তিনি 25 বছরের শাস্তি পান এবং 1852 খ্রিস্টাব্দে জেলখানাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

পাগলপন্থী আন্দোলনের গুরুত্ব –

পাগলপন্থী বিদ্রোহ প্রকৃতিগতভাবে ছিল এক কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

  • কিছুদিনের জন্য শেরপুর অঞ্চলে পাগলপন্থীদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • এই বিদ্রোহে অত্যাচারিত কৃষকদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল।
  • এই বিদ্রোহ জমিদার ও ব্রিটিশবিরোধী পরবর্তী বিদ্রোহগুলিকে প্রভাবিত করেছিল।

নীলচাষের পদ্ধতি কেমন ছিল? নীল বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?

নীলচাষের পদ্ধতি –

নীলকরদের দুরকম নীলচাষের জমি ছিল। যথা – এলাকা চাষ বা নিজ আবাদি চাষ এবং বেএলাকা চাষ বা রায়তি আবাদ। প্রথম ধরনের জমি ছিল নীলকরদের জমিদারির খাসজমি। এই জমিতে নীলের চাষ করতে নীলকরদের নগদ টাকা খরচ করে দূর থেকে শ্রমিক ভাড়া করে আনতে হত। নীল কমিশনের হিসাব অনুসারে নিজ এলাকা বা নিজ আবাদি 10 হাজার বিঘা জমিতে নীলচাষের জন্য নীলকরের খরচ পড়ত \(2\frac12\) লক্ষ টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংক ফেল করার পর নীলকরদের মূলধনে টান পড়ে। সুতরাং বেএলাকা বা রায়তি চাষের জন্য নীলকররা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বেএলাকা বা রায়তের জমিতে নীলচাষ করতে নীলকরের যৎসামান্য খরচ লাগত। কারণ এই জমি ছিল রায়তের, নীলকরকে এই জমি কিনত হত না।

দ্বিতীয়ত, রায়ত তার নিজ খরচায় নীলচাষ করত। নীলকর বিঘা প্রতি মাত্র 2 টাকা অগ্রিম বা দাদন দিত। সুতরাং নীল কমিশনের হিসাব অনুযায়ী 10 হাজার বিঘা রায়তি জমিতে নীলের চাষের জন্য নীলকরের খরচ পড়ত মাত্র 20 হাজার টাকা। এর ফলে নীলকর সর্বদাই চেষ্টা করত রায়তকে তার নিজ জমিতে ধানের বদলে নীলচাষে বাধ্য করার জন্য। ফলে 1859 খ্রিস্টাব্দে বাংলার নীলচাষিরা নীলচাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহই নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

নীলচাষের পদ্ধতি কেমন ছিল? নীল বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?

নীল বিদ্রোহের কারণ –

নীল বিদ্রোহের পিছনে একাধিক কারণ সক্রিয় ছিল। যথা –

  • নীলকরদের অত্যাচার – নীলকররা নীলচাষিদের নানাভাবে অত্যাচার করে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। অনিচ্ছুক চাষিদের প্রহার করা, আটকে রাখা, স্ত্রী-কন্যার সম্মানহানি করা, চাষের সরঞ্জাম লুঠ করা, ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া প্রভৃতি নানাভাবে চাষিদের অত্যাচার করত। চাষিরা অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
  • দাদন প্রথা – নীলকররা চাষিদের দাদন বা অগ্রিম অর্থ দিত। অভাবের সময় চাষিরা অগ্রিম নিত। প্রতি বিঘায় 2 টাকা অগ্রিম দিয়ে চাষির সবচেয়ে ভালো জমিতে নীলচাষ করাতে বাধ্য করত। একবার কেউ দাদন নিলে সে আর নীলচাষের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না।
  • প্রতারণা ও কারচুপি – নীলকররা নীলচাষিদের বিভিন্নভাবে প্রতারিত করত। নীল কেনার সময় নীলের ওজন কম দেখাত, কম দামে নীল বিক্রি করতে বাধ্য করত; তা ছাড়া জোর করে বিভিন্নভাবে অর্থ আদায় করত।
  • পঞ্চম আইন – 1830 খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক পঞ্চম আইন পাস করে ঘোষণা করেন যে, কোনো চাষি দাদন নিয়ে নীলচাষ না করলে তাকে গ্রেফতার করা হবে ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর ফলে নীলচাষিদের উপর অত্যাচার অনেক বেড়েছিল।
  • অবিচার – অত্যাচারিত নীলচাষিরা আদালতে গিয়েও সুবিচার পেত না। আইন ছিল নীলকরদের স্বার্থরক্ষার জন্য, চাষিদের জন্য নয়। তা ছাড়া পুলিশ, প্রশাসন সবই ছিল নীলকরদের পক্ষে।
  • পত্রপত্রিকার প্রভাব – নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা সে সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও লেখায় প্রকাশিত হয়েছে। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা এবং দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।

উপরোক্ত কারণগুলির ফলস্বরূপ নীলচাষিরা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

নীল বিদ্রোহ কবে এবং কাদের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল? বিদ্রোহটির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

নীলচাষ ভারতের একটি প্রাচীন চাষ। বাংলার নীলচাষিরা 1859 খ্রিস্টাব্দে নীলচাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

  • নীল বিদ্রোহের প্রথম সূচনা হয় তৎকালীন নদিয়া জেলার চৌগাছা গ্রামে। ক্রমে এই বিদ্রোহ বর্ধমান, বাঁকুড়া, মালদহ, মুরশিদাবাদ, দিনাজপুর, পাবনা, ফরিদপুর, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
  • নীল বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস, দিগম্বর বিশ্বাস, কাদের মোল্লা, রফিক মণ্ডল প্রমুখ ব্যক্তিরা।
নীল বিদ্রোহ কবে এবং কাদের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল? বিদ্রোহটির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য –

ইংরেজ আমলে যেসব কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল, তার মধ্যে নীল বিদ্রোহ ছিল নানাদিক থেকে উল্লেখযোগ্য। এই বিদ্রোহে এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল যা অন্যান্য বিদ্রোহগুলিতে দেখা যায় না। যেমন –

  • নীলকরবিরোধী বিদ্রোহ – নীল বিদ্রোহ ছিল নীলকরবিরোধী বিদ্রোহ – এটি অন্যান্য বিদ্রোহের মতো জমিদার বা মহাজনবিরোধী বিদ্রোহ ছিল না। নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার ও জোরজবরদস্তির বিরুদ্ধে নীলচাষিরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল নীলচাষ প্রথার পুরোপুরি অবসান ঘটানো।
  • কৃষকদের কঠোর মনোভাব – নীল বিদ্রোহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষকদের কঠোর মনোভাব। এই বিদ্রোহে কৃষকরা দৃঢ়তার সঙ্গে মনস্থির করেছিল যে, মরব তবু নীলচাষ করব না। শেষপর্যন্ত বিদ্রোহী কৃষকরা বাংলা থেকে নীলচাষ বন্ধ করেছিল।
  • আন্দোলনে প্রথম ধর্মঘটের প্রয়োগ – এল নটরাজন বলেছেন, নীলচাষ করতে অস্বীকার করে বাংলার কৃষকরা ভারতের ইতিহাসে প্রথম ধর্মঘটের নজির সৃষ্টি করে। ভারতে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে এই ঘটনা ছিল অভিনব।
  • ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ – ওয়াহাবি, ফরাজি, সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ধর্ম। কিন্তু নীল বিদ্রোহে তা ছিল না। নীল বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষকদের অধিকার রক্ষার বিদ্রোহ। নীল বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।
  • বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিদের সমর্থন – নীল বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিরা বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল। তারা নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল। জেমস লঙ ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এজন্য তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল।
নীল বিদ্রোহ কবে এবং কাদের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল? বিদ্রোহটির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

নীল বিদ্রোহের উপসংহার –

পরিশেষে বলা যায়, নীল বিদ্রোহ বাঙালি সমাজে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নীলচাষিদের বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় নীলচাষিদের সমর্থনে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করতেন। তা ছাড়া অন্যান্য পত্রপত্রিকা ও নাটকে যেভাবে নীল বিদ্রোহকে সমর্থন করা হয়েছিল তা ছিল অভূতপূর্ব।

এল নটরাজনের একটি প্রবন্ধ লেখো।

এল নটরাজনের একটি প্রবন্ধ হল – ‘Indigo Cultivators Strike-1860’

সাঁওতাল হুল ও নীল বিদ্রোহের একটি তুলনামূলক আলোচনা করো।

সাঁওতাল হুল –

1855-1856 খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক শাসক, জমিদার, মহাজন, ইজারাদারদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাঁওতালরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সাঁওতালরা বিশ্বাস করত, জমিতে যে প্রথম ফসল ফলাবে জমি তার প্রাপ্য। এই নিয়ম মেনে তারা মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, মানভূম, ছোটোনাগপুর প্রভৃতি অঞ্চলের জমি হাসিল করে সেগুলিকে প্রথম শ্রেণির কৃষিজমিতে পরিণত করে। কিন্তু কোম্পানি তাদের দাবি নস্যাৎ করে এই সকল জমিতে জমিদারি বন্দোবস্ত করলে সাঁওতালরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

নীল বিদ্রোহ –

1859-1860 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে কৃষকেরা নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই আন্দোলনে বঙ্গদেশের প্রায় 60 লক্ষাধিক কৃষক যোগদান করেছিল। নদিয়া, খুলনা, যশোহর, ফরিদপুর, চব্বিশ পরগনা, পাবনা প্রভৃতি জেলায় প্রায় প্রতিটি গ্রামের কৃষক সম্প্রদায়ই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।

উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে উভয় বিদ্রোহের বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। যেমন –

সাঁওতাল হুল ও নীল বিদ্রোহের বৈসাদৃশ্য –

  • বিরোধী গোষ্ঠী – সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়েছিল সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সঙ্গে জমিদার, মহাজন, ইজারাদার, ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে। অন্যদিকে নীল বিদ্রোহ হয়েছিল নীলচাষিদের সঙ্গে নীলকর সাহেবদের।
  • গণ অভ্যুত্থান – সাঁওতাল বিদ্রোহে কেবলমাত্র সাঁওতাল সম্প্রদায়ের আদিবাসী গোষ্ঠী ও বিরোধী গোষ্ঠী ছিল। কিন্তু নীল বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রায় 60 লক্ষ কৃষক অংশগ্রহণ করেছিল। এর ফলে নীল বিদ্রোহ গণ আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল।
  • বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন – সাঁওতাল বিদ্রোহে সাঁওতালরা বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন লাভ করতে পারেনি। কিন্তু নীল বিদ্রোহে বাংলার নীলচাষিগণ সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার প্রমুখ বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়।
  • বিদ্রোহ কবলিত স্থান – সাঁওতাল বিদ্রোহ মূলত বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, মানভূম, ছোটোনাগপুর প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। অন্যদিকে নীল বিদ্রোহ নদিয়া, খুলনা, যশোহর, ফরিদপুর, চব্বিশ পরগনা, পাবনা প্রভৃতি অঞ্চলে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।
  • সাফল্য – সাঁওতাল বিদ্রোহ তার লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হয়। কারণ স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য গঠিত হয়নি। তবে নীল বিদ্রোহ তার লক্ষ্যপূরণে সক্ষম হয়েছিল। কারণ এই বিদ্রোহের ফলে নীলচাষ স্বেচ্ছাধীন বলে ঘোষিত হয়।

উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, উভয় বিদ্রোহই বিরোধী গোষ্ঠীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল এবং পরবর্তী কৃষক আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।

ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন উপজাতি বিদ্রোহের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করো।

ভূমিকা – 

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম 100 বৎসরে নানা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ হয়েছে কোম্পানির সরকারকে। কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে কোল, ভীল, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি উপজাতিদের বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহগুলি ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

কারণ – 

উপজাতিদের বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল –

  • ঔপনিবেশিক ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা।
  • পরদেশি মহাজন, বণিক, জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠীর শোষণ।
  • কোম্পানি কর্তৃক সমস্ত বনাঞ্চল খাস জমিতে পরিণত করে বনসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠোর করলে উপজাতিদের মধ্যে গভীর অসন্তোষের সৃষ্টি হয়; যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিদ্রোহের মাধ্যমে।

বিদ্রোহ – 

উপজাতি বিদ্রোহগুলির মধ্যে চুয়াড়, কোল, সাঁওতাল ও মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল উল্লেখযোগ্য; যেগুলি অতিসংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

চুয়াড় বিদ্রোহ – 

ব্রিটিশ কোম্পানির সীমাহীন অর্থনৈতিক শোষণ, অত্যাচার ও নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম জেলার চুয়াড়রা যে বিদ্রোহের সূচনা করে, তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। প্রায় 30 বছর ধরে এই বিদ্রোহ চলে। বিভিন্ন সময়ে এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব প্রদান করেন জগন্নাথ সিংহ, ধল, বাদশার শ্যামগঞ্জন, মাধব সিংহ, দুরজন সিংহ প্রমুখ (দুরজন সিংহের নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহ সবচেয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করে)। কোম্পানির সেনাবাহিনী নির্মম দমননীতির দ্বারা এই বিদ্রোহ দমন করে।

কোল বিদ্রোহ – 

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যেসব আদিবাসী বিদ্রোহ ঘটে, তার অন্যতম কোল বিদ্রোহ (1831-32 খ্রিঃ)। রাচি, হাজারিবাগ, সিংভূম, পালামৌ প্রভৃতি অঞ্চলে বুদ্ধ ভগৎ, জোয়া ভগৎ, ঝিন্দরাই মানকি, সুইমু হোরো প্রমুখের নেতৃত্বে 1832 খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করলে ক্যাপ্টেন উইলকিনসনের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশবাহিনী বহু কোল উপজাতির নরনারীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এই বিদ্রোহ দমন করেন।

সাঁওতাল বিদ্রোহ – 

কোম্পানির শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য আদিবাসী ও উপজাতিদের দ্বারা সংঘটিত বিদ্রোহগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপজাতি বিদ্রোহ হল 1855-56 খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ। 1855 খ্রিস্টাব্দের 30 জুন প্রায় 10,000 সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে জমায়েত হয়ে সিধু-কানহুর নেতৃত্বে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা করে। ক্রমশ এই বিদ্রোহ ব্যাপ্তি লাভ করে।

মুন্ডা বিদ্রোহ – 

1899 খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডারা যে বিদ্রোহ করেছিল, তা মুন্ডা বিদ্রোহ (উলগুলান) নামে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এটিই ছিল শেষ গুরুত্বপূর্ণ উপজাতি বিদ্রোহ। 1899-1900 খ্রিস্টাব্দে মুন্ডা বিদ্রোহ রাচি, হাজারিবাগ, সিংভূমের পার্বত্য অঞ্চলে প্রসার লাভ করে। ব্রিটিশ সরকার তীব্র দমননীতি চালিয়ে বিরসা মুন্ডাকে গ্রেপ্তার করে এই বিদ্রোহ দমন করেন।

মূল্যায়ণ – 

চুয়াড়, কোল, সাঁওতাল, মুন্ডা এবং অন্যান্য উপজাতি বিদ্রোহগুলি ব্যর্থ হয়ে গেলেও, পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি তৈরির ক্ষেত্রে এইসব আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। পরাধীন ভারতবর্ষে উপজাতি বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ ও বীরত্ব পরবর্তী প্রজন্মের বিপ্লবীদের কাছে আলোর দিশারী হয়ে উঠেছিল।

চুয়াড় বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভূমিকা – 

ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কোম্পানির সীমাহীন অর্থনৈতিক শোষণ, অত্যাচার, নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে মেদিনীপুর, বীরভূম, বাঁকুড়া, ঘাটশিলায় চুয়াড় উপজাতির কৃষকরা 1768 থেকে 1832 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় 7 বার যে বিদ্রোহ করেছিল তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। 1798 খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরে শুরু হওয়া চুয়াড় বিদ্রোহ, দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ – 

চুয়াড় বিদ্রোহের কারণগুলি হল –

  • জমি দখল – কৃষিকাজ ও পশুপালন চুয়াড়দের প্রধান জীবিকা ছিল। বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পর কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চলের জমিদারদের ওপর অত্যন্ত চড়া হারে ভূমিরাজস্ব ধার্য করে। এর বিরুদ্ধে জমিদাররা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তাদের পাইক চুয়াড়রাও সমগ্র জঙ্গলমহল জুড়ে বিদ্রোহ করে।
  • জীবিকা সমস্যা – সরকার কর্তৃক নিষ্কর জমি দখল চুয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। কেননা চুয়াড়দের অধিকাংশ জমি ছিল দখলকৃত জমি। কোম্পানি জমি দখল করে নিলে তারা জীবিকাহীন হয়ে পড়ে।
  • রাজস্ববৃদ্ধি – চুয়াড়দের অধীনে থাকা জমিতে সরকার রাজস্ব বৃদ্ধি করলে চুয়াড়রা ক্ষিপ্ত হয়। কোম্পানি নিযুক্ত রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের সীমাহীন অত্যাচার এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

চুয়াড় বিদ্রোহের নানা পর্যায় ও নেতৃত্ব – 

চুয়াড় সম্প্রদায়ের মানুষেরা 1768 থেকে 1832 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে 7 বার বিদ্রোহ করেছিল তার মধ্যে 1798-99 খ্রিস্টাব্দে দুর্জন সিংহ ও অচল সিংহের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ বড় আকার ধারণ করে।

বিদ্রোহের দমন – 

1799 খ্রিস্টাব্দে দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে ফলে মেদিনীপুরের শান্তি বিঘ্নিত হলে লর্ড ওয়েলেসলি দুটি সেনাদলের সাহায্যে সাড়াশি অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহীদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। বহু চুয়াড় বিদ্রোহীকে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। বিদ্রোহীদের গ্রেপ্তার করে তাদের ঘাঁটিগুলি জ্বালিয়ে, সেনাবাহিনী তাণ্ডব চালিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে এই বিদ্রোহ দমন করে।
অন্যদিকে বিভাজন নীতির আশ্রয় নিয়ে চুয়াড় ও পাইকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং জমিদারদের নানাভাবে আশ্বস্ত করে কৌশলে চুয়াড় বিদ্রোহের অবসান ঘটায়।

গুরুত্ব – 

চুয়াড় বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জমিদার ও তার অনুচরবর্গ এবং কৃষকদের বিদ্রোহ হলেও এই বিদ্রোহের প্রাণশক্তি ছিল নিপীড়িত কৃষক যাঁরা সমাজের নিম্ন বর্গের মানুষ। তাঁরা বুঝেছিল যে, জমিদারদের নিপীড়িতদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া অপেক্ষা ব্রিটিশ শাসনের অবসান বেশি জরুরি।

উপসংহার – 

জমিদার ও কৃষকরা মিলিত হয়ে এই বিদ্রোহ সংগঠিত করেছিল যা অত্যন্ত বিরল ঘটনা। বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ ও ন্যায্য অধিকার রক্ষার সংগ্রাম পরবর্তীকালে যে আরো বৃহত্তর সংগ্রামের দিশারী ছিল। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ বলেছেন যে চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল নিম্নশ্রেণির মানুষদের এক স্বতঃস্ফূর্ত অথচ ব্যাপক বিদ্রোহ।

সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ভূমিকা – 

ব্রিটিশ অনুসৃত ভূমি ব্যবস্থায় বিশেষত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কয়েক শতাব্দীর অধিকারভুক্ত জমি কোম্পানির হাতে চলে যায়। তখন সাঁওতালরা হাজারিবাগ মানভূম থেকে রাজমহলের পার্বত্য সমতল ভূমিতে এসে সেখানে জঙ্গলাবৃত অঞ্চল পরিষ্কার করে বসবাস ও কৃষিকাজ শুরু করে। অঞ্চলটির নাম হয় দামিন-ই কোহ বা মুক্ত অঞ্চল। স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এখানে তারা মুক্ত জীবন ভোগ করবে। সেখানে তারা জমিদার, মহাজন, বহিরাগত ব্যবসায়ী ও ইংরেজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। 1855 খ্রিস্টাব্দে বিহারের রাজমহল থেকে বাংলার মুরশিদাবাদ অবধি অঞ্চলে সাঁওতাল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়।

লক্ষ্য – 

সাঁওতাল বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল সাঁওতাল রাজ প্রতিষ্ঠা। বহিরাগত দিকুদের উচ্ছেদ, জমিদারি অত্যাচার ও ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদই ছিল সাঁওতালদের লক্ষ্য।

বিদ্রোহের শুরু – 

1855 খ্রিস্টাব্দের 30 জুন সিধু-কানহুর নেতৃত্বে প্রায় 10,000 সাঁওতাল নরনারী ভাগনাডিহির মাঠে জমায়েত হয়ে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা নেন। অত্যাচারী দারগা মহেশলাল দত্তকে হত্যার মাধ্যমে এই বিদ্রোহ শুরু হয়।

বিদ্রোহের নেতৃত্ব ও ব্যাপ্তি – 

বিদ্রোহীরা সিধু, কানহু, চাঁদ, ভৈরব, কালো প্রামাণিকের নেতৃত্বে মহাজনদের আড়ৎ, বণিকদের বাড়ি, নীলকুঠি ও জমিদারের কাছারী আক্রমণ করে। রেলস্টেশন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে। এভাবে রাজমহল থেকে মুরশিদাবাদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সবশেষে বিদ্রোহীরা তীর, ধনুক, বল্লম সম্বল করে কলকাতা দখলের উদ্দেশ্যে দল বেঁধে বেড়িয়ে পড়ে। মুরশিদাবাদ, বীরভূমে প্রদুর্ভাব ও সাঁওতাল পরগণার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজবাহিনী পরাস্ত হয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত ইংরেজ কোম্পানি প্রচণ্ড দমন পীড়নের মাধ্যমে এই বিদ্রোহ দমন করে (1856 খ্রিঃ)।

সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি – 

প্রশাসনের সমর্থক ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা একে নিছক বর্বরদের স্থানীয় বিদ্রোহ ও আদিম ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ বলেছেন। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকরা একে দেশীয় শোষণ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক গণসংগ্রাম তথা শ্রমজীবীদের প্রতিরোধ হিসেবে দেখেছেন।

ফলাফল – 

এই বিদ্রোহের ফলে –

  • সরকার সাঁওতাল পরগণা নামে একটি স্বতন্ত্র সংরক্ষিত এলাকা সৃষ্টি করে সেখানে সাঁওতালদের আইন-কানুন চালু করে।
  • সাঁওতালদের উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং মিশনারি ছাড়া সমতলের লোকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়।
  • সাঁওতাল মোড়লদের ক্ষমতা স্বীকার করা হয়। সর্বত্র একই ধরনের ওজন বিধি চালু হয়।

উপসংহার – 

শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সাঁওতাল বিদ্রোহের মধ্যে ছিল সুসংঘবদ্ধ রাজনৈতিক চেতনার উপকরণ। একইসঙ্গে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় সামন্ততান্ত্রিক মহাজন, বণিকদের যৌথ শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে সাঁওতাল সমাজ যে সশস্ত্র আন্দোলন করেছিল, তা অভূতপূর্ব। ব্যাপ্তিতে ক্ষুদ্র ও বিক্ষিপ্ত হলেও সাঁওতাল বিদ্রোহের মধ্যে শোনা গিয়েছিল প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পদধ্বনি। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় তাই সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত’ বলেছেন।

ওয়াহাবি আন্দোলনের ওপর একটি প্রবন্ধ লেখো।

ভূমিকা – 

উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী কুসংস্কার দূর করে মুহাম্মদ প্রদর্শিত পথে ইসলামকে নতুন রূপে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। এরপর রায়বেরেলীর সৈয়দ আহমদ ভারতে প্রকৃত অর্থে ওয়াহাবি আদর্শে শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করেন। শীঘ্রই তা ব্রিটিশ বিরোধী হয়ে ওঠে। বাংলার তিতুমীরের নেতৃত্বে এই আন্দোলন ধর্মীয়, আর্থ-সামাজিক ও শেষে ব্রিটিশ বিরোধী রূপ পরিগ্রহ করে।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য – 

ইসলামের শুদ্ধিকরণ ও ইসলামধর্মের কুসংস্কার দূর করে তারিখ-ই-মুহাম্মদিয়া প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। ক্রমেই তা ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এছাড়াও এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল অত্যাচারী সামন্তদের শোষণ থেকে কৃষকদের মুক্ত করা, নিম্নবর্গের মানুষদের আর্থিক সংকট থেকে মুক্ত করা এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন ও সরকারি উচ্চপদগুলিতে ইংরেজদের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরোধিতা করা।

ওয়াহাবি আন্দোলনে সৈয়দ আহমদের ভূমিকা – 

শাহ ওয়ালিউল্লাহ ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করলেও এই আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়বেরেলীর সৈয়দ আহমদ (1766-1831 খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ভারতের নানা স্থানে বিশেষ করে কলকাতায় আবদুল ওয়াহাবের বাণী প্রচার করেন। পাটনায় ওয়াহাবিদের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করেন। চার খলিফা বা আঞ্চলিক শাসকদের মাধ্যমে ভারতে এর সংগঠন বিস্তৃত হয়। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জিহাদের মাধ্যমে তিনি ভারতকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করতে চান। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে তার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। 1831 খ্রিস্টাব্দে শিখদের বিরুদ্ধে বালাকোটের যুদ্ধে তার মৃত্যু হয়।

বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন – 

বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন তিতুমীর। মহাজন, জমিদার, নীলকর ও তাদের সহযোগী ইংরেজদের অত্যাচার ও দমননীতির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান। নারিকেলবেড়িয়ায় বাঁশের কেল্লায় সদর দপ্তর স্থাপন করে আশপাশের জমিদারদের কাছে কর দাবি করেন। ইংরেজ শাসনের অবসানের কথা ঘোষণা করে নিজেকে বাদশাহ রূপে তুলে ধরেন। শেষপর্যন্ত ইংরেজ সেনাবাহিনীর দমনে বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয় ও তিনি বীরের মতো প্রাণ বিসর্জন দেন, যা ইতিহাসে ‘বারাসত বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত।

ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রসার – 

ওয়াহাবি আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল বিহারের পাটনা। ইনায়েত আলী ফরিদপুর, নদিয়া, রাজশাহী ও পাটনায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। বারাসত, যশোহর, ঢাকা, ফরিদপুর, রাঘবগঞ্জ, নদিয়া, পাবনা, রংপুর, নোয়াখালি, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা ও শ্রীহট্টে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।

ওয়াহাবি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ – 

এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ব্যর্থতার কারণগুলি হল –

  • গঠনমূলক কর্মসূচির অভাব
  • উপযুক্ত সংগঠনের অভাব
  • ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও ক্রমশ রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ
  • হিন্দু সমাজের সমর্থন না পাওয়া
  • আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব
  • অভিজাত শ্রেণির সাহায্য না পাওয়া
  • সরকারের দমননীতি ও বিভেদ নীতি

ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃতি বা চরিত্র – 

তিতুমীরের জীবনীকার বিহারীলাল সরকারের মতে, বহু হিন্দু তিতুমীরের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। আবার বহু মুসলিম ভূস্বামীরাও ওয়াহাবিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। সুতরাং তিতুমীরের সংগ্রাম ধর্মকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও ক্রমশ তা সংকীর্ণ ধর্মীয় সীমারেখা অতিক্রম করে দরিদ্র মানুষের জমিদার ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবাদী সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে।

ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব – 

পরবর্তী আন্দোলনগুলির উপর ওয়াহাবি আন্দোলনের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। এই আন্দোলনের হাত ধরেই সর্বপ্রথম মুসলিম সমাজের সংস্কার শুরু হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মতাদর্শ গড়ে তুলে এটি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে, যা আগামী দিনের পথপ্রদর্শক হয়েছিল।

ফরাজি আন্দোলনের ওপর একটি প্রবন্ধ রচনা করো।

ভূমিকা – 

ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফরাজি আন্দোলন হল এইরূপ একটি কৃষক বিদ্রোহ।

আন্দোলনের উৎপত্তি – 

পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর নিবাসী হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক। তিনি মুসলিম ধর্ম সংস্কার রূপে এই আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষকে দার-উল-হারব বলে অভিহিত করেন। তিনি ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম আদর্শের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে বাংলাদেশকে ‘দার-উল-ইসলাম’-এ পরিণত করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন কৃষক বিদ্রোহের চরিত্র নেয়।

আদর্শ – 

এই আন্দোলনের মূল আদর্শ ছিল –

  • ইসলাম-বিরোধী সকল আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি ও কুসংস্কার বর্জন
  • ইসলামের সাম্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠা
  • ভারতবর্ষকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করা

উদ্দেশ্য –

কুরআনের পবিত্র আদর্শ অনুসরণ, ইসলামীয় ভাবধারার পুনরুজ্জীবন, জমিদারদের শোষণ থেকে কৃষকদের মুক্ত করা, ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ করে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা, জমিদার-মহাজনের বিরোধিতা এবং সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এই আন্দোলনের লক্ষ্য। শরীয়তুল্লাহর প্রভাবে শুধুমাত্র মুসলিম কৃষকরাই নয়, বহু হিন্দুও ফরাজি আন্দোলনকে সমর্থন করে। এভাবে ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা প্রভৃতি জেলায় এই আন্দোলন বিস্তার লাভ করে।

দুদু মিয়ার ভূমিকা – 

1837 খ্রিস্টাব্দে শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিঞা (মুহাম্মদ মহসীন) 1860 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি বাহাদুরপুরে প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে লাঠিয়াল ও গুপ্তচর বাহিনী গঠন করেন। তাঁর প্রভাবাধীন এলাকাকে কয়েকটি হালকায় বিভক্ত করে খলিফা নিয়োগ করেন। জমিদার-নীলকরদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে ফরাজি আন্দোলনকে ধর্মীয় আন্দোলন থেকে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে উন্নীত করেন।

দমন ও পতন – 

আতঙ্কিত জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের চাপে 1838, 1841 ও 1857 খ্রিস্টাব্দে দুদু মিঞাকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রমাণাভাবে মুক্তি পান। 1860 খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হলে ফরাজি আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। দুদু মিঞার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নোয়া মিঞা ধর্মীয় আদর্শকে প্রাধান্য দিলে আন্দোলনের গুরুত্ব হ্রাস পায়।

প্রকৃতি – 

ফরাজি আন্দোলন ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও ক্রমশ তা জমিদার-বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। অধিকাংশ জমিদারই ছিল হিন্দু। তবুও বলা যায় যে ফরাজি আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছিল না, কারণ এতে মুসলমান কৃষকদের পাশাপাশি বহু হিন্দু কৃষকও শামিল হয়েছিল। তাই এই আন্দোলনকে হিন্দু-বিরোধী না বলে নিপীড়িত কৃষকদের মুক্তি আন্দোলন বলা শ্রেয়।

ব্যর্থতার কারণ – 

দুদু মিঞার মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব, সাধারণ লোককে জোরপূর্বক দলভুক্ত করা, জোরপূর্বক অর্থ আদায় এবং সরকারি দমননীতি প্রভৃতি কারণে ফরাজি আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

গুরুত্ব – 

ফরাজি আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও ব্রিটিশ-বিরোধী কৃষক আন্দোলন হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দোলনে কেবল মুসলমানরাই নয়, হিন্দু কৃষকরাও যুক্ত হয়েছিলেন। ড. অভিজিৎ দত্তের মতে, ফরাজিরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ করতে না পারলেও বাংলা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ কামনা করেছিল।ৎ দত্ত বলেছেন, ফরাজিরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ করতে না পারলেও বাংলা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ কামনা করেছিল।

নীলবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।

ভূমিকা – 

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নীলচাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অমানুষিক অত্যাচার ও নির্মম শোষণের বিরুদ্ধে নীলচাষিদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনকে নীলবিদ্রোহ বলা হয়।

নীলচাষ ও নীলকুঠির খন্ডচিত্র
নীলচাষ ও নীলকুঠির খন্ডচিত্র

নীলবিদ্রোহের কারণ –

  • নীলচাষের পদ্ধতি – নীলকররা জমিদারদের মোটা টাকা দিয়ে দীর্ঘদিনের জন্য জমি ভাড়া নিয়ে ভাড়াটিয়া শ্রমিকদের দিয়ে নীলচাষ করাত। একে বলা হত ‘এলাকা চাষ’। এই চাষে সমস্যা ছিল— গরিব চাষিদের নিরক্ষতার সুযোগ নিয়ে খুব কম টাকা দাদন দিয়ে বেশি টাকার চুক্তি করে তাদের দিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করা হত।
  • নীলকর সাহেবদের অত্যাচার – নীলকররাই ছিল কৃষকদের প্রধান প্রতিপক্ষ। নীলকরদের অত্যাচার, লুণ্ঠন, শোষণ, দৌরাত্ম্য, ব্যভিচার ও লাম্পট্য ছিল এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।
  • নীলকরদের সরকারি সমর্থন – 1833 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে শ্বেতাঙ্গদের জমি কেনার অধিকার দেওয়া হয়। তারও আগে সরকার দাদন প্রথাকে সমর্থন জানালে তীব্র জনরোষের সৃষ্টি হয়। একাদশ আইনে দাদন গ্রহণকারী কৃষকদের নীলচাষ করতে বাধ্য করা হত।
  • দস্তুরি প্রথা ও নীলের কম দাম প্রদান – নীল দেওয়ার সময় দাদনের কিস্তি ও সুদের টাকা নীলকররা কেটে রাখত। একে বলা হত দস্তুরি প্রথা। রায়তদের উৎপাদিত নীলের দাম দেওয়া হত 2 টাকা 8 আনা, অথচ সেই নীলের বাজার দর ছিল 10 টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি নীলে কৃষকদের 7 টাকা 8 আনা ঠকানো হত।
  • পঞ্চম আইন – লর্ড বেন্টিঙ্ক 1830 খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম আইন পাস করেন। এই আইনে বলা হয়— দাদন নিয়ে নীলচাষ না করলে তা বেআইনি বলে গণ্য হবে এবং অপরাধীকে জেল দেওয়া হবে।
  • পক্ষপাতদুষ্ট বিচারব্যবস্থা – নীলকরদের বিরুদ্ধে সরকারি আদালতে নালিশ করার উপায় ছিল না। নালিশ করলেও শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটরা স্বজাতীয় শ্বেতাঙ্গ নীলকরদের প্রতি পক্ষপাত দেখাতেন। মফস্বলে ভারতীয় বিচারকরা শ্বেতাঙ্গ নীলকরদের বিচার করতে পারতেন না।
  • অন্যান্য কারণ – এছাড়াও নীলকরদের নিষ্ঠুরতা, তাদের তৈরি লাঠিয়াল, পাইক, বরকন্দাজ বাহিনীর অত্যাচার, নীলচাষিদের বন্দি করে খাদ্য ও জল বন্ধ করে দেওয়া— এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

নীল বিদ্রোহের ফলাফল –

  • নীল কমিশন গঠন – 1860 খ্রিস্টাব্দে নীল কমিশন গঠিত হয়। 1868 খ্রিস্টাব্দে অষ্টম আইন দ্বারা ‘নীলচুক্তি আইন’ রদ করে নীলচাষকে চাষিদের ইচ্ছাধীন করা হয়। নীলকররা নীলচাষ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। কৃষকদের জয় প্রতিষ্ঠিত হয়, বাঙালি জাতির মনোবল বৃদ্ধি পায়, পরোক্ষভাবে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়।
  • মহাজনদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা – ব্লেয়ার ক্লিং (Blair Kling) তাঁর Blue Mutiny গ্রন্থে দেখান যে, নীলকর সাহেবদের পতনের ফলে নিম্নবঙ্গের কর্তৃত্ব সুদখোর মহাজনদের হাতে চলে যায়। ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী এই মতের অসারতা প্রমাণ করেছেন।
  • কৃষক ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ঐক্য – নীল বিদ্রোহের ফলেই বাংলায় কৃষক, জমিদার ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল – “এই বিদ্রোহ বাঙালির শিরায় স্বাধীনতার উষ্ণ শোণিত প্রবাহিত করে।” লর্ড ক্যানিং মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) থেকেও নীলবিদ্রোহকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন।
  • জাতীয় প্রভাব – নীলবিদ্রোহের সাফল্যে বাংলার কৃষককুল অসাধারণ নৈতিক শক্তিলাভ করে। 1858 খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির শাসনের অবসানের পর নীলবিদ্রোহ ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ গণবিদ্রোহ। অমৃতবাজার পত্রিকায় শিশিরকুমার ঘোষ লেখেন – “নীলবিদ্রোহই সর্বপ্রথম ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল।”

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় “প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর “ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Categories -
Please Share This Article

Related Posts

মাধ্যমিক ইতিহাস - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

About The Author

Solution Wbbse

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

সিঙ্গাপুরের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে জলবায়ু ও গোলার্ধ শনাক্ত করো।

বাংলায় ছাপাখানা ও মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কীরূপ অবদান ছিল?

তুন্দ্রা জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর অবস্থান ও প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী তা আলোচনা করো।