এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভৌতবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ “লেন্স, আলোর বিচ্ছুরণ, মানুষের চোখ ও আলোক তরঙ্গ” নিয়ে আলোচনা করব। এই অংশটি মাধ্যমিক ভৌতবিজ্ঞান পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই “লেন্স, আলোর বিচ্ছুরণ, মানুষের চোখ ও আলোক তরঙ্গ” অংশটি মাধ্যমিক ভৌতবিজ্ঞানের পঞ্চম অধ্যায় “আলো” -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই “লেন্স, আলোর বিচ্ছুরণ, মানুষের চোখ ও আলোক তরঙ্গ” থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।

মাধ্যমিক ভৌতবিজ্ঞান – আলো – লেন্স, আলোর বিচ্ছুরণ, মানুষের চোখ ও আলোক তরঙ্গ
লেন্স –
দুটি বক্রতল অথবা একটি বক্রতল ও একটি সমতল দ্বারা সীমাবদ্ধ স্বচ্ছ প্রতিসারক মাধ্যমকে লেন্স বলা হয়।
বিভিন্ন প্রকার লেন্স –
- উত্তল লেন্স,
- অবতল লেন্স,
- সমতলোত্তল লেন্স ও
- সমতল-অবতল লেন্স।

লেন্সকে একাধিক প্রিজমের সমন্বয় হিসেবে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে উত্তল লেন্স অভিসারী লেন্সের মতো ও অবতল লেন্স অপসারী লেন্সের মতো আচরণ করে।

লেন্স সংক্রান্ত বিভিন্ন রাশি –
1. বক্রতা কেন্দ্র – উত্তল বা অবতল লেন্সের দুটি তল যে দুটি গোলকের অংশ তাদের কেন্দ্রকে বক্রতা কেন্দ্র বলে। [চিত্রে C1 ও C2 হল বক্রতা কেন্দ্র)

2. প্রধান অক্ষ – বক্রতা কেন্দ্রের সংযোজক সরলরেখাকে প্রধান অক্ষ বলে।
3. আলোক কেন্দ্র – লেন্সের কোনো পৃষ্ঠে আপতিত রশ্মি অপর পৃষ্ঠ দিয়ে নির্গত হওয়ার সময় যদি আপতিত রশ্মির সঙ্গে সমান্তরালে নির্গত হয় তাহলে ওই রশ্মি লেন্সের মধ্যে প্রধান অক্ষকে যেখানে ছেদ করে তাকে আলোক কেন্দ্র বলে। [চিত্রে O হল আলোক কেন্দ্র]

আলোক কেন্দ্রগামী রশ্মির কোনো চ্যুতি হয় না।
4. মুখ্য ফোকাস – উত্তল বা অবতল লেন্সে প্রধান অক্ষের সমান্তরাল রশ্মি এসে পড়লে প্রতিসরণের পর তারা প্রধান অক্ষের উপর কোনো বিন্দুতে মিলিত হয় বা কোনো বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয়, সেই বিন্দুকে মুখ্য ফোকাস বলে। আলোক কেন্দ্র ‘O’ এবং মুখ্য ফোকাসের (F) দূরত্ব OF -কে ফোকাস দূরত্ব বলে। উত্তল লেন্সের মুখ্য ফোকাস সদ্ কিন্তু অবতল লেন্সের মুখ্য ফোকাস অসদ্।

6. গৌণ ফোকাস ও ফোকাস তল – প্রধান অক্ষের সঙ্গে লম্বভাবে থাকা যে তলে মুখ্য ফোকাস অবস্থিত তাকে ফোকাস তল বলে।

সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ যারা প্রধান অক্ষের সঙ্গে সমান্তরাল নয়, লেন্সের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করার পর যে বিন্দুতে মিলিত হয় বা যে বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয় তাকে গৌণ ফোকাস বলে।
লেন্স সংক্রান্ত তথ্য –
- লেন্সের ফোকাস দূরত্ব তার উপাদানের প্রতিসরাঙ্ক ও বক্রতল দুটির বক্রতা ব্যাসার্ধের উপর নির্ভরশীল।
- লেন্সের ফোকাস দূরত্বের অন্যোন্যককে তার ক্ষমতা বলে। অর্থাৎ, লেন্সের ক্ষমতা P = \(\frac1f\) এর একক হল m-1 বা ডায়প্টার (D)।
- লেন্সের পারিপার্শ্বিক মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক যদি তার উপাদানের প্রতিসরাঙ্কের তুলনায় বেশি হয় তাহলে লেন্সের প্রকৃতি বিপরীত হয়ে যায়। অর্থাৎ উত্তল লেন্স অবতলের মতো ও অবতল লেন্স উত্তলের মতো আচরণ করে।
- প্রতিবিম্বের উচ্চতা ও বস্তুর উচ্চতার অনুপাতকে রৈখিক বিবর্ধন বলে।
∴
লেন্স দ্বারা প্রতিবিম্ব গঠন –
উত্তল লেন্স দ্বারা প্রতিবিম্ব গঠন –
1.

- বস্তুর অবস্থান – অসীম দূরত্বে, u = বস্তু দূরত্ব = অসীম v = প্রতিবিম্ব দুরত্ব = f
- প্রতিবিম্বের অবস্থান – প্রতিবিম্ব ফোকাসে
- প্রতিবিম্বের প্রকৃতি – সদ, অবশীর্ষ, অতি ক্ষুদ্র
- ব্যবহার – আতশ কাচ বা বিবর্ধক কাচ
2.

- বস্তুর অবস্থান – ফোকাস দূরত্বে u = বস্তু দূরত্ব = f, v = প্রতিবিম্ব দূরত্ব = ∞
- প্রতিবিম্বের অবস্থান – অসীম দূরত্বে
- প্রতিবিম্বের প্রকৃতি – সদ, অবশীর্ষ ও অসীম বিবর্ধিত
- ব্যবহার – স্পেকট্রোমিটারের কলিমোটর
3.

- বস্তুর অবস্থান – F ও 2F -এর মধ্যে f < u < 2f প্রতিবিম্বের অবস্থান – 2F -এর অধিক দূরত্বে v > 2f
- প্রতিবিম্বের প্রকৃতি – সদ, অবশীর্ষ ও বিবর্ধিত (m > 1)
- ব্যবহার – স্নাইড প্রোজেক্টর
4.

- বস্তুর অবস্থান – 2F দূরত্বে u = 2f
- প্রতিবিম্বের অবস্থান – 2F দূরত্বে v = 2f
- প্রতিবিম্বের প্রকৃতি – সদ, অবশীর্ষ, বস্তুর সমান আকারের (m = 1)
- ব্যবহার – পার্থিব দূরবিন
5.

- বস্তুর অবস্থান – 2F -এর অধিক দূরত্বে u > 2f
- প্রতিবিম্বের অবস্থান – F ও 2F -এর মধ্যে f < v < 2f
- প্রতিবিম্বের প্রকৃতি – সদ, অবশীর্ষ, ক্ষুদ্র (m < 1)
- ব্যবহার – ক্যামেরা লেন্স
অবতল লেন্স দ্বারা প্রতিবিম্ব গঠন –
1.

- বস্তুর অবস্থান – অসীম দূরত্বে u = বস্তু দূরত্ব = অসীম
- প্রতিবিম্বের অবস্থান – প্রতিবিম্ব ফোকাসে v = প্রতিবিম্ব দূরত্ব = f
- প্রতিবিম্বের প্রকৃতি – অসদ, সমশীর্ষ, অতি ক্ষুদ্র (m < 1)
- ব্যবহার – গ্যালিলিয়ো দূরবিন
2.

- বস্তুর অবস্থান – আলোক কেন্দ্র ও অসীমের মাঝে
- প্রতিবিম্বের অবস্থান – আলোক কেন্দ্র ও ফোকাসের মাঝে
- প্রতিবিম্বের প্রকৃতি – অসদ, সমশীর্ষ, বস্তুর চেয়ে ছোটো। [অবতল লেন্সে অভিসারী রশ্মি এসে পড়লে প্রতিবিম্ব সদ্ হয়।]
- ব্যবহার – হ্রস্ব দৃষ্টির চোখ
মানুষের চোখ –
মানুষের চোখে উত্তল লেন্স থাকে। আলোকরশ্মি এই লেন্স দ্বারা প্রতিসৃত হয়ে ভিট্রিয়াস হিউমার অতিক্রম করে রেটিনার উপর অবশীর্ষ ও সদ প্রতিবিম্ব গঠন করে। মস্তিষ্ক বিশেষ প্রক্রিয়ায় অবশীর্ষ প্রতিবিম্বকে সোজা দেখতে সাহায্য করে।
- অন্ধবিন্দু – রেটিনার যে স্থানে চক্ষুনার্ভ অক্ষিগোলকে প্রবেশ করে সেই স্থানে আলোর অনুভূতি থাকে না, ফলে এই স্থানে বস্তুর প্রতিবিম্ব গঠিত হলে তাকে দেখা যায় না।
- নিকট বিন্দু – চোখ থেকে সর্বাপেক্ষা নিকটতম যে বিন্দু পর্যন্ত কোনো বস্তুকে স্পষ্টভাবে দেখা যায় সেটিই হল চোখের নিকট বিন্দু। সুস্থ চোখের ক্ষেত্রে এর মান হল 25 cm।
- দূর বিন্দু – চোখ সব থেকে বেশি যে দূরত্ব পর্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখতে পায় তাকে তার দূরবিন্দু বলে। সুস্থ চোখের ক্ষেত্রে এর মান হল অসীম।
ত্রুটি –
দীর্ঘদৃষ্টি বা হাইপারমেট্রোপিয়া – যদি চোখ দূরের জিনিসকে স্পষ্ট দেখতে পায় কিন্তু কাছের জিনিসকে দেখতে না পায় তাহলে সেই ধরনের ত্রুটিকে দীর্ঘদৃষ্টি বলে। এক্ষেত্রে দূরবিন্দু অসীম কিন্তু নিকট বিন্দু 25 cm থাকে না।
প্রতিকার – উপযুক্ত ফোকাস দৈর্ঘ্যের উত্তল লেন্স (ধনাত্মক ক্ষমতা) যুক্ত চশমা ব্যবহার করে এই ত্রুটির প্রতিকার করা যায়।

স্বল্পদৃষ্টি বা হ্রস্বদৃষ্টি বা মায়োপিয়া – যদি চোখ কাছের বস্তুকে স্পষ্ট দেখতে পায় কিন্তু দূরের বস্তুকে দেখতে না পায় তাহলে সেই প্রকার ত্রুটিকে স্বল্পদৃষ্টি বলে। এক্ষেত্রে নিকট বিন্দু 25 cm হয় কিন্তু দূরবিন্দু অসীম হয় না।
প্রতিকার – উপযুক্ত ফোকাস দৈর্ঘ্যের অবতল লেন্স (ঋণাত্মক ক্ষমতাযুক্ত) চশমা ব্যবহার করে এই ত্রুটির প্রতিকার করা হয়।

আলোর বিচ্ছুরণ –
যৌগিক আলোকরশ্মি কোনো প্রতিসারক মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে গেলে বিভিন্ন বর্ণে বিশ্লিষ্ট হয়ে যায়। এই ঘটনাকে আলোর বিচ্ছুরণ বলে।
- প্রিজমের মধ্যে দিয়ে সাদা আলো গেলে তা বিভিন্ন বর্ণে বিশ্লিষ্ট হয়। সর্বাধিক বিচ্যুতি হয় বেগুনি ও সর্বনিম্ন বিচ্যুতি হয় লালের।
- প্রাকৃতিক বিচ্ছুরণের উদাহরণ হল রামধনু।

আলোর বিক্ষেপণ –
আলোক তরঙ্গ অতিক্ষুদ্র বাতাসের অণু বা ধূলিকণার সংস্পর্শে এসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, এই ঘটনাকে আলোর বিক্ষেপণ বলে।
র্যালের মতানুসারে বিক্ষেপিত আলোর তীব্রতা (I), তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (λ) চতুর্থ ঘাতের ব্যস্তানুপাতী অর্থাৎ, \(I\propto\frac1{\lambda^4}\)। সুতরাং, কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বেগুনি বা নীল আলোর বেশি বিক্ষেপণ হয় কিন্তু বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল আলোর বিক্ষেপণ কম হয়।
তড়িৎচুম্বকীয় বর্ণালি –
তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গগুলির গতিবেগ 3 × 108 ms-1 এবং এগুলি মাধ্যম ছাড়াই অগ্রসর হতে পারে। বিভিন্ন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গগুলিকে তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুযায়ী সাজালে তড়িৎচুম্বকীয় বর্ণালি পাওয়া যায়।
কম্পাঙ্কের ঊর্ধ্বক্রমে সাজালে বিভিন্ন তরঙ্গগুলি হল –
- রেডিয়ো তরঙ্গ,
- মাইক্রোওয়েভ,
- অবলোহিত তরঙ্গ,
- দৃশ্যমান তরঙ্গ,
- অতিবেগুনি রশ্মি,
- X-রশ্মি,
- γ-রশ্মি।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভৌতবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ “লেন্স, আলোর বিচ্ছুরণ, মানুষের চোখ ও আলোক তরঙ্গ” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই অংশটি মাধ্যমিক ভৌতবিজ্ঞান পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই “লেন্স, আলোর বিচ্ছুরণ, মানুষের চোখ ও আলোক তরঙ্গ” অংশটি মাধ্যমিক ভৌতবিজ্ঞানের পঞ্চম অধ্যায় “আলো“ -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই “লেন্স, আলোর বিচ্ছুরণ, মানুষের চোখ ও আলোক তরঙ্গ” অংশটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন