যাত্রা – প্রবন্ধ রচনা

Souvick

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ‘যাত্রা‘ প্রবন্ধ রচনাটি নিয়ে আলোচনা করব। মাধ্যমিক বা স্কুল পরীক্ষায় এই রচনাটি প্রায়ই আসে এবং এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা। একবার ভালোভাবে আয়ত্ত করলে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি — যেকোনো ক্লাসের পরীক্ষাতেই তোমরা এই রচনার প্রশ্নের উত্তর সহজেই লিখতে পারবে!

যাত্রা - প্রবন্ধ রচনা

যাত্রা

 “যাত্রার অভিনয়ে দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে একটা গুরুতর ব্যবধান নাই। পরস্পরের বিশ্বাস ও আনুকূল্যের প্রতি নির্ভর করিয়া কাজটা বেশ সহৃদয়তার সহিত সুসম্পন্ন হইয়া উঠে।”

– রবীন্দ্রনাথ

ভূমিকা – ‘যাত্রা’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ দৃশ্যপটহীন চারদিক খোলা মঞ্চে নাটকাভিনয়বিশেষ। আর-একটি প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী যাত্রাকে ফার্স্ট থিয়েটার বলে অভিহিত করা হয়। একদা যা ছিল ভক্তিরসের মাধ্যম সেই যাত্রা কালক্রমে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয়ে আজকের রূপ পরিগ্রহ করেছে।

নামকরণের তাৎপর্য – যাত্রা কথাটি অতি প্রাচীন। প্রাচীনকালে দেবতার উৎসব উপলক্ষ্যে নৃত্য-গীতাদি-সহ শোভাযাত্রা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করত। এই বিশেষ গমনকে বলা হত যাত্রা। গমনার্থক ‘যা’ ধাতু থেকে ‘যাত্রা’ কথাটির উৎপত্তি। এক স্থানে সমবেত হয়ে দেব-উৎসব উপলক্ষ্যে যাত্রানুষ্ঠান অর্থাৎ নৃত্য-গীতাদির অনুষ্ঠান হত। এটা ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গ ছিল। এই ধর্মোৎসব থেকেই যাত্রার উৎপত্তি।

উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ – বৈদিক যুগে দেবতাদের উদ্দেশে নৃত্য-গীতি সহযোগে উৎসব অনুষ্ঠানই হল যাত্রার উৎস বা উদ্ভবের ইতিহাসলব্ধ প্রাচীনতম রূপ। বৌদ্ধযুগেও নাট্যোৎসবের প্রচলন ছিল। মধ্যযুগের বাংলায় ‘নাটগীতি’ নামে নাচ-গান, সংলাপময় এক লোকনাট্যের অনুষ্ঠান হত। সেগুলির বিষয়বস্তু ছিল রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণনির্ভর। সংলাপ রচিত হত পদ্যে। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’, চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এক অর্থে ‘নাটগীতি’। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাসগ্রহণের আগে রুক্মিণীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীকালে বৈষ্ণবধর্মের ব্যাপক প্রভাবে এদেশে কৃষ্ণযাত্রার বহুল প্রচলন হয়েছিল। কালক্রমে রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতির আখ্যান অবলম্বনে যাত্রাপালা রচিত হতে থাকে। যাত্রাভিনয় ক্রমে কালিয়দমন, শখের যাত্রা, অপেরা বা গীতাভিনয় প্রভৃতি স্তর অতিক্রম করে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে।

বৈশিষ্ট্য – যাত্রাভিনয়ে কোনো দৃশ্যপট বা যবনিকার ব্যবহার হয় না। মঞ্চের চারদিক ঘিরে দর্শকগণ বসে। মূল মঞ্চটির চারপাশে লাগোয়া নীচু বেদিতে উপবিষ্ট যন্ত্রবাদকের দল চড়াসুরে যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করে যাত্রাভিনয়ের সূচনা করে। যাত্রার প্রাথমিক পর্যায়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দর্শকদের মাঝেই বসতেন। পরবর্তীকালে দর্শকদের ভিতর দিয়ে গ্রিনরুম মঞ্চের মধ্যে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যাতায়াতের পথের ব্যবস্থা করা হয়। গোড়ায় যাত্রা ছিল গীতাভিনয়; যে কারণে একে যাত্রাগান বলা হত। গানই ছিল মুখ্য। দুটি গানের মাঝখানে ছোটো ছোটো সংলাপের মাধ্যমে মূল ঘটনার খেই ধরিয়ে দেওয়া হত। ক্রমে নাটকের প্রভাবে যাত্রাপালাতেও সংলাপের প্রয়োগ বাড়তে থাকে। ‘বিবেক’ চরিত্রটি যাত্রাপালার এক অপরিহার্য অঙ্গ। উন্মুক্ত স্থানে খালি গলায় হাজার হাজার দর্শককে শোনানোর জন্য যাত্রার সংলাপ উচ্চারণ করতে হত অত্যন্ত উচ্চগ্রামে। যাত্রার আর-একটি বৈশিষ্ট্য হল আবেগবাহুল্য।

রূপান্তর – আধুনিক যাত্রাভিনয়ে নাটকের প্রভাব পড়ায় তার রূপ ও রীতির পরিবর্তন ঘটেছে। যাত্রার বিষয়বস্তু এখন আর নিছক ভক্তিরসে আবদ্ধ নেই। সময়োপযোগী সবরকম বিষয়বস্তু নিয়েই আজ যাত্রাপালা রচিত হচ্ছে। বর্তমান যুগে যাত্রার সময়সীমা সংক্ষিপ্ত হয়েছে। অভিনয়ের দিক থেকেও যাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। পূর্বে যাত্রাপালায় স্ত্রীর ভূমিকায় পুরুষশিল্পী অভিনয় করতেন। এখন স্ত্রীচরিত্রে মহিলা শিল্পী অভিনয় করেন। যাত্রাপালায় এখন আগের মতো গানের আধিক্য নেই। এ ছাড়াও যন্ত্রসংগীত, যান্ত্রিক কলাকৌশল ও অন্যান্য উপকরণের ব্যবহারেও প্রচুর রদবদল ঘটেছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

স্বদেশি যাত্রাপালা – উনিশ শতাব্দীর শুরু থেকে বাংলায় এক বিশেষ ধরনের যাত্রাপালার প্রচলন ঘটে, যাকে বলা হয় স্বদেশি যাত্রাপালা। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনকে প্রসারিত ও উদ্বুদ্ধ করতে এই যাত্রাপালার সূচনা। স্বদেশি যাত্রা রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন চারণকবি মুকুন্দদাস। তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছিল ‘কর্মক্ষেত্র’ পালার কাহিনি ও গীতরচনার জন্য। ব্রিটিশ সরকার স্বদেশি যাত্রা নিষিদ্ধ করে বিশেষ আইন প্রণয়ন করে।

উপসংহার – আধুনিক যুগের চাহিদা মেটাতে অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে কালক্রমে যাত্রাপালায় ঘটেছে বিস্তর পরিবর্তন। এর ফলে যাত্রাশিল্প তার মৌলিক রূপ-আঙ্গিক থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। কিন্তু এই পরিবর্তন এক স্বাভাবিক ব্যাপার। এর সমালোচনা বা বিরোধিতা করা অর্থহীন। মূল বৈশিষ্ট্যগুলি অক্ষুণ্ণ রেখে যাত্রা এক যুগোপযোগী শিল্পমাধ্যম হিসেবে টিকে থাকুক, শুধু তাই নয়, উন্নত হোক, সমৃদ্ধ হোক এই কামনাই আমাদের করা উচিত।


আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ‘যাত্রা’ প্রবন্ধ রচনাটি নিয়ে আলোচনা করেছি। মাধ্যমিক বা স্কুল পরীক্ষায় ‘একটি অচল পয়সার আত্মকথা‘ রচনাটি প্রায়ই আসে এবং এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।

Please Share This Article

Related Posts

ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা - প্রবন্ধ রচনা

ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা – প্রবন্ধ রচনা

একটি নৌকাভ্রমণের অভিজ্ঞতা - প্রবন্ধ রচনা

একটি নৌকাভ্রমণের অভিজ্ঞতা – প্রবন্ধ রচনা

মঙ্গলের মাটিতে কিছুক্ষণ কাটানোর অভিজ্ঞতা - প্রবন্ধ রচনা

মঙ্গলের মাটিতে কিছুক্ষণ কাটানোর অভিজ্ঞতা – প্রবন্ধ রচনা

About The Author

Souvick

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

উদাহরণসহ উদ্ভিদের বিভিন্ন উদ্দীপনায় সাড়া-প্রদানের বিষয়টি সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

সংবেদনশীলতা কাকে বলে? উদ্ভিদের সাড়া প্রদানে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ভূমিকা

ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা – প্রবন্ধ রচনা

একটি নৌকাভ্রমণের অভিজ্ঞতা – প্রবন্ধ রচনা

মঙ্গলের মাটিতে কিছুক্ষণ কাটানোর অভিজ্ঞতা – প্রবন্ধ রচনা