আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর থেকে “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

বঙ্গভঙ্গ কেন ঘটে?
বঙ্গভঙ্গের ভূমিকা –
উনিশ শতকের প্রথম থেকেই ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বৃহত্তর বাংলাকে বিভক্ত করার চিন্তাভাবনা শুরু করে। এই উদ্দেশ্যে লর্ড কার্জন 1905 খ্রিস্টাব্দে রিজলির সুপারিশ অনুসারে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণা করেন। বাংলা ভাগের পিছনে বড়োলাট লর্ড কার্জনের কিছু যুক্তি ছিল।

বঙ্গভঙ্গের যুক্তি –
আয়তনের বিশালতা –
1905 খ্রিস্টাব্দে বাংলাপ্রদেশের আয়তন ছিল বিশাল। আজকের আসামের অধিকাংশ, বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে সেসময় বাংলাদেশ গঠিত ছিল। ব্রিটিশ ভারতে এত বড়ো রাজ্য আর ছিল না। তাই বাংলা বিভক্ত করে দুটি পৃথক রাজ্য গঠনের কথা বলা হয়।
প্রশাসনিক অসুবিধা –
বাংলাপ্রদেশ আয়তনে বিশাল হওয়ায় প্রশাসনিক অসুবিধা দেখা দেয়। সেসময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। রেলপথ সব জায়গায় ছিল না। ফলে পূর্ব বাংলা, আসাম বা উড়িষ্যার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সমস্যার উপলব্ধিও সম্ভব নয়। এইজন্য পৃথক প্রদেশ গঠনের কথা বলা হয়।
রাজনৈতিক কারণ –
বঙ্গভঙ্গের পিছনে রাজনৈতিক কারণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ, যেমন –
হিন্দু-মুসলমান বিভেদ –
লর্ড কার্জন দেখেন যে, বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু হল কলকাতা। বাংলার পশ্চিম অংশ হিন্দুপ্রধান। আর পূর্ব বাংলা মুসলমানপ্রধান। পূর্ব বাংলাকে মুসলমানপ্রধান প্রদেশে পরিণত করলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা যাবে।

সংখ্যালঘু –
পশ্চিমবাংলাকে বিহার ও উড়িষ্যার সঙ্গে যুক্ত করে হিন্দু বাঙালিদের ভাষা-সংস্কৃতির দিক থেকে সংখ্যালঘু করা যাবে।
ভারতের জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করা –
আসলে কার্জন বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ভারতের জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করতে চেয়েছিলেন। কেন-না তিনি জানতেন সেসময় ভারতের জাতীয়তাবাদের প্রাণকেন্দ্র ছিল বাংলা। সুতরাং সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হলে এই জাতীয়তাবাদ দুর্বল হয়ে পড়বে।
অর্থনৈতিক কারণ –
আসামের চা সহজে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি করা যাবে। এজন্য খরচ কম হবে এবং তা নতুন প্রদেশের উন্নতিতে সহায়ক হবে। এ ছাড়া পূর্ব বাংলার পাটের উপর নির্ভর করে স্থানীয়ভাবে পাটকল গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
পরিণতি –
এই সমস্ত কারণ ও যুক্তিতে বড়োলাট লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 1905 খ্রিস্টাব্দের 19 জুলাই এই সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। 1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়।
বঙ্গভঙ্গের পিছনে লর্ড কার্জনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল?
বঙ্গভঙ্গের পিছনে লর্ড কার্জনের ভূমিকা –
ভারতের বড়োলাট লর্ড কার্জন 1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা কার্যকর করেন। ফলে বাংলা প্রদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়। দুটি প্রদেশেই বাঙালি হিন্দুদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়। কলকাতার গুরুত্ব হ্রাস করে ঢাকা, চট্টগ্রাম-কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বঙ্গভঙ্গের পিছনে লর্ড কার্জনের উদ্দেশ্য –
বঙ্গভঙ্গের পিছনে লর্ড কার্জনের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিম্নে আলোচনা করা হল –
- জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করা – লর্ড কার্জন রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যমণি বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করতে চেয়েছিলেন।
- হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা – হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য লর্ড কার্জন বাংলা ভাগ করেছিলেন। তিনি নবগঠিত পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ইংরেজ সরকারের সমর্থকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের 3 কোটি লোকের মধ্যে হিন্দু ছিল 1 কোটি 20 লক্ষ ও মুসলমান ছিল 1 কোটি 80 লক্ষ।
- বাংলাকে দুর্বল করা – বাংলাকে দুর্বল করার জন্য লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করেছিলেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব রিজলি লিখেছিলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ বাংলা একটি শক্তি। বিভক্ত বাংলা নানা টানাপোড়েনে পর্যুদস্ত হবে।’
- ইংরেজ চা-ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা – লর্ড কার্জন আসামের চা-ব্যবসায়ীদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে বাংলা ভাগ করেছিলেন। কারণ – তাহলে নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে চা-ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
বঙ্গভঙ্গের পিছনে লর্ড কার্জনের উপসংহার –
এইভাবে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা কার্যকর করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার শাসন ও বিভেদনীতির সার্থক প্রয়োগ ঘটায়।
1905 খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রধান ধারাগুলি কী ছিল?
1905 খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের ভূমিকা –
1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর ভারতের বড়োলাট লর্ড কার্জন বাংলা ও বাঙালির জাতীয় ঐক্যকে ধ্বংস করতে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন। এর প্রতিবাদে সমগ্র বাংলা তীব্র আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছিল, যা ইতিহাসে ‘বঙ্গভঙ্গবিরোধী’ বা ‘স্বদেশি আন্দোলন’ নামে পরিচিত।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রধান ধারাসমূহ –
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আপামর বাংলার জনগণ যে প্রতিবাদ আন্দোলনের সূচনা করে সেখানে ‘বয়কট’ ও ‘স্বদেশি’ কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল। এই আন্দোলনের প্রধান ধারাগুলি হল নিম্নরূপ –
- বয়কটের কর্মসূচি গ্রহণ – বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে ‘বয়কট’ নীতির প্রয়োগ করা হয়। বিদেশি দ্রব্য বর্জন করা, বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, খেতাব প্রভৃতি বর্জন করাও ছিল বয়কট আন্দোলনের অন্যতম অঙ্গ। বাংলার ছাত্র, যুবক, নারী, কৃষক, শ্রমিক প্রত্যেকেই বয়কট আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল।
- স্বদেশি চেতনার বিস্তার – ‘স্বদেশি’ হল বয়কট আন্দোলনের পরিপূরক। বিদেশি দ্রব্যের পরিবর্তে স্বদেশি দ্রব্য উৎপাদন, প্রচার ও তার ব্যবহার করার ফলে স্বদেশি আন্দোলন পরিপূর্ণতা লাভ করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে ‘স্বদেশি’-র আদর্শ বিশেষ মাত্রা যুক্ত করেছিল।
- জাতীয় শিক্ষা – বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া শিল্প, সাহিত্য, গান ও কবিতার মাধ্যমেও দেশপ্রেমের ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
- বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী ধারার আবির্ভাব – বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের শেষ পর্বে, যখন এর তীব্রতা অনেকটাই কমে আসছিল, তখন ভারতের রাজনীতিতে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী ধারা বিকশিত হতে শুরু করে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বীর বিপ্লবীদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ শতকে ভারতে কৃষক আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রধান কারণগুলি কী ছিল? এই সময় কোন্ কোন্ কৃষক আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে
বিশ শতকে ভারতে কৃষক আন্দোলনের ভূমিকা –
1920 -এর দশক ভারতবর্ষ তথা বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রকৃতপক্ষে এই সময়কাল ছিল বামপন্থী সংগঠনের স্বর্ণযুগ। গান্ধিজি সর্বভারতীয় গণ আন্দোলনের স্বার্থে কৃষক আন্দোলনের সংযুক্তিকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করতেন। তাই বামপন্থীরা এসময় কংগ্রেসের সঙ্গে সংযোগ বজায় রেখে কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী করতে সচেষ্ট হন।
বিশ শতকে ভারতে কৃষক আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রধান কারণসমূহ –
বিশ শতকে ভারতে কৃষক আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রধান কারণগুলি হল –
- রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি – বিশ শতকে ভারতবর্ষে দরিদ্র কৃষকদের উপর সরকার অত্যধিক পরিমাণে রাজস্বের বোঝা চাপালে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
- কৃষকদের উপর শোষণ ও অত্যাচার – রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদার, মহাজন ও তালুকদাররা যারা সরকারের মদতপুষ্ট ছিল – তারা দরিদ্র কৃষকদের উপর নানাভাবে অত্যাচার চালাত।
- সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ও বঞ্চনার উচ্ছেদ – খাজনার হার বৃদ্ধি, জমি থেকে উচ্ছেদ ও মহাজনি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলনগুলি সংগঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে তারা সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বন্ধনকে শিথিল করতে চেয়েছিল।
কৃষক আন্দোলনের সক্রিয়তা –
বিশ শতকে ভারতবর্ষে যেসকল কৃষক আন্দোলনগুলি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, সেগুলি হল –
- 1905 খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন, 1920 খ্রিস্টাব্দের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, 1930 খ্রিস্টাব্দের আইন অমান্য আন্দোলন ও 1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন।
- এ ছাড়া 1917-1946 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চম্পারণের কৃষক আন্দোলন, খেদা আন্দোলন, বারদৌলি সত্যাগ্রহ, তেভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানার মতো সক্রিয় আন্দোলনও সংগঠিত হয় যা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
- 1934-1937 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট পার্টি যৌথভাবে কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করে। এদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বভারতীয় কিষাণসভা।
বিশ শতকে ভারতে কৃষক আন্দোলনের উপসংহার –
তাই বলা যায়, বিশ শতকে ভারতে সংগঠিত এই কৃষক আন্দোলনগুলি ভারতের জাতীয় আন্দোলনে এক নতুন গতির সঞ্চার করেছিল।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে কেন বাংলার কৃষকরা যোগদান করেনি?
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের ভূমিকা –
1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর বড়োলাট লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করেন। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ এর জন্য দায়ী ছিল। এই ঘটনার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, ইতিহাসে তা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন বা স্বদেশি আন্দোলন নামে পরিচিত। নানা কারণে বাংলার কৃষকেরা এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে।
কৃষকশ্রেণির যোগ না দেওয়ার কারণ –
এই আন্দোলনে কৃষকশ্রেণির যোগ না দেওয়ার কারণগুলি হল –
- কৃষকদের দূরবস্থা – ইংরেজ শাসন বাংলায় প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করা। এর ফলে কৃষকদের উপর প্রবল আর্থিক চাপ পড়ে এবং প্রতিক্রিয়া হিসেবে কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। কৃষকেরা ইংরেজ শোষণের স্বরূপ বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু নিজেদের সমস্যা, দুরবস্থা নিয়ে তারা এতটাই জর্জরিত থাকত যে, কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদানের কথা তারা ভাবত না।
- শ্রেণিবৈষম্য – ইংরেজ আমলে বাংলার সমাজে একটি মধ্যবিত্তশ্রেণি গড়ে ওঠে। এই শ্রেণি গরিব কৃষকের দুঃখে সমব্যথী ছিল না। গরিব কৃষকেরাও মধ্যবিত্তশ্রেণির আন্দোলনে তাই যোগদান করেনি। কৃষকদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের তেমন কোনো যোগাযোগও ছিল না।
- আঞ্চলিকতা – লর্ড কার্জন পূর্ব বাংলা সফরের সময় বলেছিলেন, পূর্ব বাংলা একটি পৃথক প্রদেশ হিসেবে গঠিত হলে এখানকার মানুষের বিশেষত গরিব কৃষকদের উন্নতি হবে। অন্যান্য বিষয়েরও যেমন – পথঘাট, শিক্ষা, শিল্প, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতিরও উন্নতি হবে। এ ছাড়া তিনি ঢাকার নবাব সলিমউল্লাহকে একটি মুসলিম প্রদেশ উপহার দানের কথা বলেন। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করে, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান ও নমঃশূদ্র কৃষক। মুসলমান কৃষকেরা অংশত ধর্মীয় আবেগে, অংশত হিন্দু জমিদারদের অধীনতামুক্ত হওয়ার জন্য বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায়। আর নমঃশূদ্ররা আঞ্চলিক দুর্বলতা ও অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে সরকারি সুযোগসুবিধা পাওয়ার আশায় বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করে।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের মূল্যায়ন –
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জমিদাররা অর্থসাহায্য করে। তাই কৃষকদের খাজনা বন্ধের কর্মসূচি এতে ছিল না। কৃষকদের সংগঠিত করার কোনো চেষ্টাও করা হয়নি। কৃষকদের দুরবস্থা আন্দোলনের নেতাদের প্রভাবিত করেনি। তাই স্বাভাবিকভাবেই কৃষকেরা এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে যায়।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বাংলার নমঃশূদ্ররা অংশগ্রহণ করেনি কেন?
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের ভূমিকা –
1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করেন। এর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়, তা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন নামে পরিচিত। তবে নানা কারণে বাংলার নমঃশূদ্ররা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেনি।
নমঃশূদ্রদের যোগ না দেওয়ার কারণ –
এই আন্দোলনে নমঃশূদ্রদের যোগ না দেওয়ার কারণগুলি হল –
- নেতৃত্বের প্রভাব – বাংলার অন্যতম প্রভাবশালী কৃষক সম্প্রদায় নমঃশূদ্রদের নেতা ছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। তিনি তাঁর অনুগামীদের বুঝিয়েছিলেন যে, বঙ্গভঙ্গ হলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। তা ছাড়া স্বদেশি আন্দোলনেও তাদের কোনো লাভ নেই।
- উচ্চবর্ণের নেতাদের অবজ্ঞা – আসলে উচ্চবর্ণের জাতীয় নেতারা গ্রামবাংলার কৃষক সমাজকে, বিশেষ করে নমঃশূদ্র কৃষকদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সদর্থক ভূমিকা পালন করেননি। ফলে তাদের নেতৃত্বে সংগঠিত বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন বাংলার নমঃশূদ্র কৃষকদের আকৃষ্ট করেনি।
- ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর সদর্থক ভূমিকা – ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী অনগ্রসর শ্রেণির আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। বিশেষ করে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু সুযোগসুবিধা নির্দিষ্ট হওয়ায় পশ্চাৎপদ শ্রেণির মধ্যে কিছু উন্নতি দেখা যায়। তাই স্বদেশি আন্দোলন করে তারা সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করতে চায়নি।
- স্বদেশি নেতাদের প্রতি আস্থাহীনতা – স্বদেশি নেতারা নিজেদের কৃষক প্রতিনিধিরূপে তুলে ধরলেও কৃষকরা তাদের উপর আস্থা রাখতে পারেনি, কেন-না উচ্চবর্ণের হিন্দুদের শোষণে তারা জর্জরিত ছিল।
মূল্যায়ন –
এইসব নানা কারণে বাংলার নমঃশূদ্র কৃষকদের ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে নানা ধরনের সুযোগসুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ফলে তারা তাদের আন্দোলনের অভিমুখও পরিবর্তন করে। শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। স্বভাবতই নমঃশূদ্ররা ‘স্বদেশি’ ও ‘বয়কট’ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল।
বঙ্গভঙ্গ ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যবর্তী সময় কৃষক আন্দোলনের বর্ণনা দাও।
বঙ্গভঙ্গ ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যবর্তী সময় কৃষক আন্দোলনের ভূমিকা –
লর্ড কার্জন বাংলা প্রদেশের জনগণের ঐক্য ধ্বংস করার লক্ষ্যে 1905 খ্রিস্টাব্দে বাংলাকে দু-ভাগে ভাগ করার কথা ঘোষণা করেন। কংগ্রেস বিভিন্ন পুস্তিকা, জনসভা প্রভৃতির মাধ্যমে গণসংযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় শামিল করে অর্থের বিষয় আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো চেষ্টা করেনি। অরবিন্দ ঘোষ-ও মনে করেছিলেন, কৃষকরা খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করলে জমিদাররা হয়তো ক্ষুব্ধ হবে। ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র, সুমিত সরকার প্রমুখও যে, সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির অভাবে কৃষকদের যুক্ত করা যায়নি।
কৃষক আন্দোলন –
তবে বঙ্গভঙ্গ ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যবর্তী সময়কালে বিহারের চম্পারণের নীলচাষিরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। 1907 খ্রিস্টাব্দে লর্ড মিন্টো একটি আইন চালু করলে কৃষকরা অতিরিক্ত জলকর দিতে বাধ্য হয়। লালা লাজপত রায় এবং অজিত সিংহ-ও এতে যোগ দিয়েছিলেন। এর ফলস্বরূপ মিন্টো আইনটি বাতিল করতে বাধ্য হন।
1907 খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় কৃষকদের ক্ষোভ সংক্রান্ত একটি চিঠি প্রকাশিত হলেও আন্দোলনের নেতাদের তা বিশেষ প্রভাবিত করেনি বলে স্বীকার করে নিয়েছেন ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী। আসলে আন্দোলনের নেতারা আর্থিকভাবে জমিদারদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। কংগ্রেসের নেতারা প্রকৃতপক্ষে তাদের শ্রেণিচরিত্রের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি, ফলে কৃষকরাও স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়নি। পরবর্তী পর্যায়ে গান্ধিজি পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনের সময় কৃষক আন্দোলন অনেক বেশি জোরদার হয়ে উঠেছিল।
বঙ্গভঙ্গ ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যবর্তী সময় কৃষক আন্দোলনের মূল্যায়ন –
1917 খ্রিস্টাব্দে ‘তিনকাঠিয়া ব্যবস্থা’-র বিরুদ্ধে চম্পারণের কৃষক বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ সরকার কৃষকস্বার্থে ‘চম্পারণ কৃষি বিল’ পাস করতে বাধ্য হয়। এরপর 1918 খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের খেদা অঞ্চলে কৃষকরা সরকারকে খাজনা দিতে অস্বীকার করে। গান্ধিজির আহ্বানে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রমুখ আন্দোলনে যোগ দেন।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের (1920 খ্রিস্টাব্দ) সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ভূমিকা –
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অহিংস- অসহযোগ আন্দোলন এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। কারণ – জাতীয় কংগ্রেস এই সময় দীর্ঘ 35 বছরের ‘রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি’ বা ‘আবেদন নিবেদন নীতি’ পরিত্যাগ করে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বান জানায়।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের কারণ –
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে স্বায়ত্তশাসন লাভে ব্যর্থ ভারতীয়রা আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।
- দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্যাভাব, বেকারত্ব চরম আকার ধারণ করলে ভারতীয়দের মনে অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হতে থাকে।
- ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত রাওলাট আইন পাস করে বৈপ্লবিক আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিল। এই সকল কারণে ক্ষুব্ধ ভারতীয়রা আন্দোলনে যোগ দেয়।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ –
গান্ধিজি জনগণের মনে পুঞ্জীভূত ব্রিটিশবিরোধী এই ক্ষোভকে বৃহত্তর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার কথা চিন্তা করেন। তিনি 1920 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের পরিকল্পনা পেশ করেন। প্রস্তাব অনুমোদিত হলে গান্ধিজির নেতৃত্বে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি –
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল – ‘স্বরাজ’ অর্জন। সরকারি খেতাব ও উপাধি বর্জন, আইনসভা, বিদেশি দ্রব্য বর্জনের পাশাপাশি স্বদেশি দ্রব্য উৎপাদন, স্বদেশি বিদ্যালয় স্থাপন, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ প্রভৃতি ছিল এই আন্দোলনের প্রধান কর্মসূচি।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের প্রসার ও নেতৃত্ব দান –
গান্ধিজির আহ্বানে দেশবাসী অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, সরকারি চাকুরে, প্রত্যেকেই এই আন্দোলনে যোগদান করে। চিত্তরঞ্জন দাশ, মোতিলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, লালা লাজপত রায় প্রমুখের নেতৃত্বে এই আন্দোলন আরও সুসংগঠিত রূপ পায়।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের প্রত্যাহার –
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করে তখন উত্তরপ্রদেশের (তখনকার যুক্তপ্রদেশ) গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা নামক স্থানে 1922 খ্রিস্টাব্দের 5 ফেব্রুয়ারি শান্তিপূর্ণ নিরস্ত্র মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালালে একদল উত্তেজিত জনতা থানায় অগ্নিসংযোগ করে। এর ফলে 22 জন পুলিশকর্মী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। গান্ধিজি চৌরিচৌরা ঘটনার হিংস্রতায় মর্মাহত হয়ে 25 ফেব্রুয়ারি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের উপসংহার –
অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হলেও প্রথম সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন হিসেবে তা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কৃষক আন্দোলনের পরিচয় দাও।
অসহযোগ আন্দোলনের ভূমিকা –
মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে পরিচালিত প্রথম সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন ছিল অসহযোগ আন্দোলন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দেয়। সামাজিক শ্রেণি হিসেবে কৃষকশ্রেণির যোগদান এই আন্দোলনকে একটি বিশেষ মাত্রা দান করে।
অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ও প্রসার –
এই আন্দোলনের কর্মসূচিতে সালিশি বোর্ড গঠন, চরকা ও খাদির প্রসার, খাজনা বন্ধের কথা ছিল। এগুলি কৃষকদের আকৃষ্ট করে। ফলে আন্দোলন বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
- যুক্তপ্রদেশ – মদনমোহন মালব্য যুক্তপ্রদেশ কিষানসভা (1918 খ্রিস্টাব্দ) এবং বাবা রামচন্দ্র অযোধ্যা কিষানসভা (1920 খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে প্রতাপগড়, রায়বেরিলি, ফৈজাবাদ, সুলতানপুর ও অন্যান্য জেলার কৃষকেরা সংগঠিত হয়। তারা তালুকদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে।
- বিহার – স্বামী বিদ্যানন্দের নেতৃত্বে বিহারের দ্বারভাঙা, মুজাফফরপুর, পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরে প্রবল কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের চাপে জমিদাররা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় বন্ধ করে।
- রাজস্থান – বিজয় সিং পথিক, মানিকলাল ভার্মা, মোতিলাল তেজওয়াত রাজস্থানের কৃষকদের সংগঠিত করে বিজোলিয়া সত্যাগ্রহ করেন। ভিল কৃষকরা খাজনা বন্ধ আন্দোলন করে।
- বাংলা – বাংলার চট্টগ্রামের কৃষকেরা উগ্র আন্দোলন শুরু করে। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় খাজনা বন্ধ আন্দোলন হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ কৃষকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। মেদিনীপুরে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
- অন্যান্য স্থান – আলি মুসালিয়র ও ইয়াকুব হাসানের নেতৃত্বে মোপালা কৃষকেরা, আল্লুরি সীতারাম রাজুর নেতৃত্বে অন্ধ্রের কৃষকেরা, গুন্টুর-পালনাদ ও কুদাপ্পার কৃষকেরাও আন্দোলন করে।

অসহযোগ আন্দোলনের মূল্যায়ন –
মহাত্মা গান্ধি বিহারের চম্পারণে এবং গুজরাটের খেদায় সত্যাগ্রহ আদর্শের যে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন তার সাফল্য এই আন্দোলনে দেখতে পাওয়া যায়। চৌরিচৌরার বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অধিকাংশ স্থানেই কৃষকেরা সংগঠিত আন্দোলন করে দাবি আদায়ে সমর্থ হয়।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন পর্বে (1920-1922 খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় কৃষক আন্দোলনের পরিচয় দাও।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ভূমিকা –
ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে 1920 খ্রিস্টাব্দে লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে (কলকাতায়) মহাত্মা গান্ধি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের পরিকল্পনা পেশ করেন।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন পর্বে বাংলায় কৃষক আন্দোলন –
অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব পাস হওয়ার পর গান্ধিজির নেতৃত্বে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক শ্রেণি হিসেবে কৃষক সমাজের যোগদান আন্দোলনকে বিশেষ মাত্রা দান করে।
- আন্দোলনের প্রসার – অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে সালিশি বোর্ড গঠন, খাজনা বন্ধ, চরকা ও খাদির প্রসার প্রভৃতির কথা বলা হয়। কৃষকরা এগুলির দ্বারা বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়।
- পূর্ববঙ্গের কৃষকদের আন্দোলন – পূর্ববঙ্গের পাবনা, বগুড়া, চট্টগ্রাম, রাজশাহি, রংপুর, কুমিল্লা জেলায় কৃষক আন্দোলনের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এখানকার মুসলিম কৃষকরা যারা খিলাফৎ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল তারা সক্রিয়ভাবে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়।
- বাঁকুড়া, বীরভূম, ঝাড়গ্রামে কৃষকদের আন্দোলন – বীরভূম, বাঁকুড়া ও ঝাড়গ্রামের সাঁওতালদের ভেতর তীব্র উন্মাদনা দেখা দেয়। ঝাড়গ্রামের সাঁওতালরা কংগ্রেস নেতা শৈলজানন্দ সেনের নেতৃত্বে খাজনা প্রদান বন্ধ করে।
- মেদিনীপুরে কৃষকদের আন্দোলন – মেদিনীপুরে কৃষক সম্প্রদায় সক্রিয়ভাবে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে কাঁথি ও তমলুক মহকুমায় ইউনিয়ন বোর্ডবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের উপসংহার –
অসহযোগ আন্দোলন পর্বে সংঘটিত কৃষক আন্দোলন ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে, যেখানে বাংলার কৃষকদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
অসহযোগ আন্দোলনকালে যুক্তপ্রদেশ ও বিহারের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করো।
অসহযোগ আন্দোলনকালে যুক্তপ্রদেশ ও বিহারের কৃষক আন্দোলনের ভূমিকা –
ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলন ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি ও ধর্মীয় সম্প্রদায় এই আন্দোলনে যোগ দেয়। সামাজিক শ্রেণি হিসেবে কৃষকদের যোগদান এই আন্দোলনকে বিশেষ মাত্রা দান করে।
অসহযোগ আন্দোলনকালে যুক্তপ্রদেশ ও বিহারের কৃষক আন্দোলনের কর্মসূচি ও প্রসার –
অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে পঞ্চায়েত এলাকায় সালিশি বোর্ড গঠনের কথা ছিল। চরকা ও খাদির সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছিল। এই কর্মসূচি কৃষকদের আকৃষ্ট করে। তারা অতি উৎসাহী হয়ে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তাদের নেতৃত্বে আন্দোলন বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
- যুক্তপ্রদেশ – এখানে মদনমোহন মালব্যের নেতৃত্বে যুক্তপ্রদেশ কিষানসভা গড়ে ওঠে (1918 খ্রিস্টাব্দ)। তাদের দাবিগুলি কংগ্রেসের কর্মসূচিতে স্থান পেয়েছিল। ফলে প্রতাপগড়, ফৈজাবাদ, রায়বেরিলি ও সুলতানপুর জেলার কৃষকেরা তালুকদারদের শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। পরে বাবা রামচন্দ্র কৃষকদের সংগঠিত করে অযোধ্যা কিষানসভা গড়ে তোলেন 1920 খ্রিস্টাব্দে। চৌরিচৌরার মতো কোথাও কোথাও কৃষক আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে।
- বিহার – বিহারের দ্বারভাঙা, পূর্ণিয়া, মুজফ্ফরপুর, ভাগলপুর প্রভৃতি অঞ্চলে প্রবল কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। চড়া ভূমিরাজস্ব, অতিরিক্ত কর এবং মূল্যবৃদ্ধির জন্য কৃষকেরা অসন্তুষ্ট ছিল। এই পরিস্থিতিতে বিশুবরণ প্রসাদ কৃষকদের সংগঠিত করেন। তিনি ‘স্বামী বিদ্যানন্দ’ নাম নেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁর আন্দোলনের চাপে জমিদাররা নত হয়। অতিরিক্ত কর কমাতে বাধ্য হয়।
অসহযোগ আন্দোলনকালে যুক্তপ্রদেশ ও বিহারের কৃষক আন্দোলনের মূল্যায়ন –
মহাত্মা গান্ধি বিহারের চম্পারণে এবং গুজরাটের খেদা জেলায় সত্যাগ্রহ আদর্শের যে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন তার সাফল্য এই আন্দোলনে পরিলক্ষিত হয়। যুক্তপ্রদেশ ও বিহারে কৃষকেরা সংগঠিত আন্দোলন করে দাবি আদায়ে সমর্থ হয়।
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন প্রধান দুটি কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো।
অসহযোগ আন্দোলনের ভূমিকা –
1920-র দশকে সংগঠিত অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন ছিল ভারতের প্রথম বৃহত্তর গণ আন্দোলন। মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্ব, কৃষকশ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, স্বাদেশিকতাবোধের জাগরণ এই আন্দোলনকে এক অন্য মাত্রা প্রদান করেছিল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই আন্দোলন প্রসার লাভ করে। কৃষকশ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন দুটি প্রধান কৃষক বিদ্রোহ –
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকশ্রেণি নিজেদের দাবিদাওয়া পূরণের জন্য আন্দোলন শুরু করে। এরূপ দুটি আন্দোলন হল – যুক্তপ্রদেশের একা আন্দোলন ও মালাবারের মোপালা বিদ্রোহ।
একা আন্দোলন –
- 1921 খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে সীতাপুর, হরদই, বরাইচ প্রভৃতি জেলায় একা আন্দোলনের সূচনা হয়।
- প্রধানত জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ ও খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও কিষাণসভার কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলন শুরু করে।
- মাদারি পাসির নেতৃত্বে নিম্নবর্গের কৃষকদের এই আন্দোলন ক্রমশ হিংসাত্মক রূপ ধারণ করে। যদিও হিংসাত্মক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশি অত্যাচারে শেষপর্যন্ত এই আন্দোলন ভেঙে যায়। ঐতিহাসিক হবসবম আন্দোলনের হিংসাত্মক রূপ লক্ষ করে একে ‘সামাজিক দস্যুতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
মোপালা বিদ্রোহ –
- মালাবার অঞ্চলে অস্পষ্ট প্রজাস্বত্ব আইন এবং জমিদারদের তীব্র শোষণের বিরুদ্ধে মোপালারা কৃষক বিদ্রোহ গড়ে তোলে।
- মালাবারের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক কৃষক সংগঠন গড়ে ওঠে, এগুলির নেতৃত্বে মোপালা কৃষক বিদ্রোহ সুসংহত ও তীব্র রূপ ধারণ করে।
- সরকারি রিপোর্ট অনুসারে প্রায় 10 হাজার মোপালা গেরিলা যুদ্ধের কৌশলে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়। শেষপর্যন্ত সামরিক আইন জারি করে সরকার এই আন্দোলনের অবসান ঘটায়।
কেরালার মালাবার অঞ্চলের মোপালা বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।
মোপালা বিদ্রোহের ভূমিকা –
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এইসব কৃষক আন্দোলনগুলি কৃষকদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি জাতীয় আন্দোলনকেও শক্তিশালী করেছিল। এরূপ একটি কৃষক আন্দোলন হল মালাবার অঞ্চলে সংগঠিত মোপালা বিদ্রোহ।
মোপালা বিদ্রোহের কারণ –
- মালাবার অঞ্চলের মুসলিম কৃষক সম্প্রদায় ‘মোপালারা’ 1921 খ্রিস্টাব্দে জমিদার শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
- দীর্ঘদিনের অন্যায় ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণ তো ছিলই, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল খলিফাকে তাঁর হৃতরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার ধর্মীয় উন্মাদনা এবং ইংরেজবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ।
মোপালা বিদ্রোহের নেতৃত্ব ও চরিত্র –
- মাধবন নায়ার, গোপাল মেনন, ইয়াকুব হাসান প্রমুখ নেতারা মোপালা বিদ্রোহকে সংগঠিত করেন।
- মোপালা বিদ্রোহ মূলত একটি কৃষক বিদ্রোহ হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তা কার্যত সাম্প্রদায়িক চরিত্র ধারণ করে। বিদ্রোহীরা প্রায় 600 হিন্দুকে হত্যা এবং 2500 হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করে।
- বিদ্রোহীরা জমিদারদের বাড়ি, কাছারি, থানা ও অন্যান্য সরকারি দপ্তরের উপর আক্রমণ চালায়। মালাবারের প্রধান শহরগুলি ব্রিটিশদের হাতে থাকলেও তিন মাস ধরে গ্রামাঞ্চলের পূর্ণ অধিকার ছিল বিদ্রোহীদের হাতে।
মোপালা বিদ্রোহের পরিণতি –
মোপালা বিদ্রোহে প্রায় 10,000 মোপালার মৃত্যুতে গান্ধিজি মর্মাহত হয়েছিলেন। এই আন্দোলন ধীরে ধীরে হিংসাত্মক হয়ে উঠলে ব্রিটিশ সরকার কঠোরভাবে এই আন্দোলনকে দমন করে।
কিষানসভা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল?
কিষানসভা প্রতিষ্ঠার ভূমিকা –
চাষবাস যাদের পেশা তারা অর্থাৎ কৃষিজীবী সম্প্রদায় কিষান বা কৃষক নামে পরিচিত। ভারতের বেশিরভাগ মানুষ হল পেশায় কৃষক বা কিষান। ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর এই শ্রেণি প্রথম বিদ্রোহ করে। বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত এই শ্রেণিকে রাজনীতিতে যুক্ত করার পরিকল্পনা করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
কিষানসভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –
ভারতে কিষানসভা প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। সেগুলি হল –
গৌরবময় ভূমিকা –
বাংলা তথা ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখায় কৃষকশ্রেণি। তারা মাঝে মাঝেই বিক্ষোভ-বিদ্রোহ করে। শোষিত, দরিদ্র এই কৃষকেরা ছিল সংখ্যায় বিপুল। পুলিশ-সৈন্যদের সামনে অসম শক্তিতে তারা লড়াই করে। গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী এই শ্রেণির সমর্থন লাভের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেজন্য তারা কিষানদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করে।
করভার লাঘব –
ভারতে প্রচলিত ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাগুলিতে রাজস্বের হার ছিল চড়া। এর ফলে কৃষকের অবস্থা সংকটজনক হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শস্যহানি হলেও সরকার রাজস্ব আদায় করত। রাজস্ব মকুব করা এবং কৃষকদের কল্যাণের জন্য কয়েকটি আঞ্চলিক আন্দোলন হয়। যেমন – গান্ধিজির নেতৃত্বে চম্পারণ ও খেদা সত্যাগ্রহ, স্বামী বিদ্যানন্দের নেতৃত্বে দ্বারভাঙার কৃষক আন্দোলন, রাজস্থানে জয়নারায়ণ ব্যাসের বিজোলিয়া সত্যাগ্রহ, স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর বিহার কৃষক আন্দোলন প্রভৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উদ্যোগ –
কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক-শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি প্রতিষ্ঠা করে 1927 খ্রিস্টাব্দে। 1929 খ্রিস্টাব্দে বিহার প্রাদেশিক কিষানসভা গঠন করেন স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী। অধ্যাপক এন জি রঙ্গ ‘অন্ধ্র প্রাদেশিক রায়তসভা’ গঠন করেন 1928 খ্রিস্টাব্দে। মদনমোহন মালব্য প্রতিষ্ঠা করেন যুক্তপ্রদেশ কিষানসভা (1918 খ্রিস্টাব্দ)। বাবা রামচন্দ্র ছিলেন অযোধ্যা কিষানসভার প্রতিষ্ঠাতা। এ ছাড়া আলি মুসালিয়র মোপালা কৃষকদের সংগঠিত করেন (1921 খ্রিস্টাব্দ)। পরে এই আঞ্চলিক কৃষক সংগঠনগুলিকে জাতীয় কংগ্রেস প্রভাবিত করে। ফজলুল হক ‘কৃষক-প্রজাদল’ গঠন করেন।
কৃষক কল্যাণ –
কংগ্রেসের নেতৃত্বে বেশিরভাগ কৃষক সংগঠন নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কিষান সংগঠন গড়ে তোলা হয় (1936 খ্রিস্টাব্দ)। জমিদারি প্রথার বিলোপ, রাজস্ব হ্রাস, বেগার প্রথা লোপ, সুদের হার কমানো, অরণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা, পতিত জমি বণ্টন প্রভৃতি দাবি এই সংগঠনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।
মোপালা বিদ্রোহের পরিণতি –
এই সমস্ত কারণ ও উদ্দেশ্য নিয়ে সারা ভারত কিষানসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি হন স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী। ইন্দুলাল যাজ্ঞিক সম্পাদিত ‘কিষান বুলেটিন’ ছিল এর মুখপত্র। সংগঠনটি কংগ্রেসের সহযোগী হয়ে ওঠে এবং জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রেও অবদান রাখে।
কীভাবে কিষান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়?
কিষান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ভূমিকা –
বিশ্বব্যাপী আর্থিক মহামন্দার প্রভাবে ভারতেও আর্থিক সংকট দেখা দেয়। দরিদ্র শ্রমজীবীদের সংকট বাড়ে। বামপন্থী মনোভাবাপন্ন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের একাংশ কৃষক বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের চেষ্টায় আঞ্চলিক কৃষক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। এই চেষ্টার ফলশ্রুতি ছিল কিষান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা।
কিষান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব –
অন্ধ্রের কৃষক নেতা এন জি রঙ্গ, গুজরাটের কৃষক নেতা ইন্দুলাল যাজ্ঞিক, বিহারের জয়প্রকাশ নারায়ণ, বাংলার বামপন্থী কৃষক-শ্রমিক নেতা মুজফ্ফর আহমেদ এবং রামমনোহর লোহিয়া, রাজেশ্বর রাও, আবদুল্লাহ রসুল প্রমুখ এ বিষয়ে সহযোগিতা করেন ও নেতৃত্ব দেন।

কিষান কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা –
1935 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে সাউথ ইন্ডিয়ান ফেডারেশন অফ পেজেন্টস অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল লেবার পার্টি গঠিত হয়। এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এন জি রঙ্গ এবং যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ। এই সম্মেলনে একটি সর্বভারতীয় কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার কথা বলা হয়। 1936 খ্রিস্টাব্দের মিরাট সম্মেলনে সমাজতন্ত্রীরা এই প্রস্তাব সমর্থন করে। এরপরেই 1936 খ্রিস্টাব্দে সারা ভারত কিষানসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। লখনউতে এই সভার প্রথম অধিবেশন হয়। গুজরাটের বিক্ষুব্ধ গান্ধিবাদী নেতা ইন্দুলাল যাজ্ঞিকের সম্পাদনায় কিষানসভার মুখপত্র ‘কিষান বুলেটিন’ প্রকাশিত হয়। বিহারের কৃষক নেতা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী এই অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন।
কিষান কংগ্রেসের দাবিসমূহ –
কিষানসভার দাবিগুলি ছিল –
- খাজনা ও করের 50 শতাংশ হ্রাস।
- কৃষককে জমির স্বত্ব দেওয়া।
- বেগার প্রথার বিলুপ্তি।
- ঋণ ও সুদ মকুব।
- জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ইত্যাদি।
কিষান কংগ্রেসের উদ্দেশ্য –
কিষানসভার এই দাবিগুলি থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, কৃষকদের স্বার্থরক্ষা এবং জমিদার ও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারের হাত থেকে তাদের রক্ষা করাই ছিল এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রকৃত উদ্দেশ্য।
কিষান কংগ্রেসের সংগঠন –
সারা ভারত কিষান কংগ্রেস বিভিন্ন প্রাদেশিক শাখা প্রতিষ্ঠা করে। 1937 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বাঁকুড়ায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার প্রথম সম্মেলন হয়। প্রাদেশিক শাখার নীচে জেলা ও আঞ্চলিক স্তরে শাখা সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া দেশীয় রাজ্যগুলিতেও কিষানসভার শাখা গড়ে ওঠে।
কিষান কংগ্রেসের মূল্যায়ন –
এভাবে সারা ভারতে কিষানসভা গড়ে ওঠে। ফলে কৃষকেরা সংগঠিত আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। কৃষক আন্দোলন এরপর জাতীয় আন্দোলনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। কংগ্রেস এই সভার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে। 1936 খ্রিস্টাব্দের 1 সেপ্টেম্বর পালিত হয় ‘সর্বভারতীয় কিষান দিবস’।
আইন অমান্য আন্দোলনের (1930 খ্রিস্টাব্দ) সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
আইন অমান্য আন্দোলনের ভূমিকা –
মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে পরিচালিত দ্বিতীয় সর্বভারতীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন হল আইন অমান্য আন্দোলন। 1930 খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করে। এদের মধ্যে কৃষকশ্রেণির মানুষ ছিল সংখ্যায় বিপুল।
আইন অমান্য আন্দোলনের কারণ –
আইন অমান্য আন্দোলনের পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল, যথা –
- কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ প্রস্তাব পাস হয় ও 26 জানুয়ারি প্রতীকী ‘স্বাধীনতা দিবস’ পালনের ডাক দেওয়া হয়। এই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন প্রয়োজনীয় ছিল।
- বিশ্ব অর্থনীতিতে মহামন্দা দেখা দিলে ভারতেও তার প্রভাব পড়ে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব প্রভৃতি জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা –
1930 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে গান্ধিজি তাঁর 78 জন অনুগামীসহ গুজরাটের সমুদ্র উপকূলবর্তী ডান্ডি নামক স্থানে যাত্রা করেন। 6 এপ্রিল ডান্ডির সমুদ্রতীরে একমুঠো লবণ তুলে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন। ডান্ডিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করার পর সারা দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচি –
দুটি পর্যায়ে বিভক্ত আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম ছিল –
- লবণ কর অমান্য,
- খাজনা ও অন্যান্য কর বর্জন,
- সরকারি অফিস-আদালত,
- স্কুল-কলেজ বর্জন প্রভৃতি।
আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি ছিল –
- ভূমিরাজস্ব 50 শতাংশ হ্রাস,
- আত্মরক্ষার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অধিকার দান প্রভৃতি।
আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যর্থতা –
ব্রিটিশ সরকারের দমনপীড়ন, বিভেদনীতি ও বিভিন্ন কারণের ফলে আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে। এরপর গান্ধিজি হরিজন আন্দোলনের উপর জোর দেন এবং গণসত্যাগ্রহ প্রত্যাহার করে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ শুরু করেন। 1934 খ্রিস্টাব্দে বিহারে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে ওই বছরেরই 8 মে পাটনায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
আইন অমান্য আন্দোলনের উপসংহার –
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আইন অমান্য আন্দোলন ব্যর্থ হলেও তার গুরুত্ব অপরিসীম। সর্বস্তরের ভারতবাসী এই আন্দোলনে শামিল হয় এবং জাতীয় কংগ্রেস ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ভারতে লবণ সত্যাগ্রহ বা আইন অমান্য আন্দোলন কেন শুরু হয়?
ভারতে লবণ সত্যাগ্রহ বা আইন অমান্য আন্দোলনের ভূমিকা –
গান্ধিজির পরিচালিত সর্বভারতীয় দ্বিতীয় অহিংস আন্দোলন ছিল লবণ সত্যাগ্রহ বা আইন অমান্য আন্দোলন। অসহযোগ আন্দোলনের হঠাৎ সমাপ্তি জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাই গান্ধিজি 1930 খ্রিস্টাব্দে এই গণ আন্দোলনের ডাক দেন।

ভারতে লবণ সত্যাগ্রহ বা আইন অমান্য আন্দোলনের কারণসমূহ –
এই আন্দোলনের বিভিন্ন কারণ ছিল। তা হল –
- পূর্ণ স্বরাজ – কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে (1929 খ্রিস্টাব্দ) ‘পূর্ণ স্বরাজ’ -এর প্রস্তাব পাস হয়। 26 জানুয়ারি দিনটি প্রতীকী স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ফলে জনমানসে বিপুল উদ্দীপনার সঞ্চার হয়।
- সাইমন কমিশন – সাইমন কমিশনবিরোধী বিক্ষোভের সময় বিভিন্ন শহরে ধর্মঘট, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। ভারতীয়রা কমিশনের সঙ্গে কোনোরকম সহযোগিতা করেনি। তাই ইংরেজ সরকার কী ধরনের শাসনসংস্কার করবে সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল।
- সর্বদলীয় সম্মেলনের ব্যর্থতা – ভারত-সচিব লর্ড বার্কেনহেডের বিদ্রূপের জবাবে ভারতীয়রা সর্বদলীয় সম্মেলন করে। নেহরু রিপোর্টে খসড়া সংবিধান পেশ করা হয়। কিন্তু জিন্নার সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল হলে জিন্না সম্মেলন ত্যাগ করেন। ফলে সর্বদলীয় সম্মেলন ব্যর্থ হয়।
- বামপন্থা – 1925 খ্রিস্টাব্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। 1927 খ্রিস্টাব্দে এই পার্টি মজদুর ও কৃষক শাখা, ছাত্র শাখা গড়ে তুলে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে।
- ভগৎ সিং -এর ফাঁসি – লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় বিপ্লবী ভগৎ সিং -এর ফাঁসি হয়। এই ঘটনা দেশের যুবসমাজকে আলোড়িত করে।
- মহামন্দা – 1929 খ্রিস্টাব্দে অর্থনৈতিক জগতে মহামন্দা দেখা দেয়। এর প্রভাবে ভারতের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হয়। নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য লবণের উপরেও সরকার কর বসায়। লবণের ব্যাবসা ইংরেজদের একচেটিয়া হয়ে ওঠে।
- প্রত্যক্ষ কারণ – নানা বিষয়ে গান্ধিজি 11 দফা প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেন। সরকার তা অগ্রাহ্য করে। অগত্যা গান্ধিজি ডান্ডি অভিযান করেন। ডান্ডির সমুদ্র উপকূলে তিনি লবণ আইন ভঙ্গ করলে দেশব্যাপী 1930 খ্রিস্টাব্দের 6 এপ্রিল আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়।
আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কৃষকদের ভূমিকা লেখো।
আইন অমান্য আন্দোলনের ভূমিকা –
অসহযোগ আন্দোলনের পর আইন অমান্য আন্দোলন ছিল গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত দ্বিতীয় সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন। এই আন্দোলন ছিল অহিংস। লবণের মতো নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য আন্দোলনের বিষয় হওয়ায় সর্বশ্রেণির মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দেয়, বিশেষত কৃষকশ্রেণি এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
আইন অমান্য আন্দোলনের কৃষকশ্রেণির ভূমিকা –
লবণ কর বর্জন এবং জমির খাজনা-সহ অন্যান্য কর বর্জন এই আন্দোলনের কর্মসূচিতে ছিল। সেজন্য কৃষকেরা সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয়।
- যুক্তপ্রদেশ – কৃষকদের সমর্থনে এই আন্দোলন যুক্তপ্রদেশে গণ আন্দোলনে পরিণত হয়। রায়বেরিলি, বারাবাঁকি, এলাহাবাদ জেলায় কালকাপ্রসাদ কৃষকদের সংগঠিত করেন। এরপর তিনি জমিদারবিরোধী খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করেন। জওহরলাল নেহরু খাজনা বন্ধের বিষয়টি কংগ্রেস কমিটিতে পাস করিয়ে নেন। জমিদার ও কৃষক উভয় শ্রেণিকেই খাজনা না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
- গুজরাট – এই আন্দোলনের সময় সুরাট জেলার বারদৌলি তালুক, খেদা জেলা, ব্রোচ জেলার জনুসারে খাজনা বন্ধ আন্দোলন হয়। পুলিশি অত্যাচার প্রবল হয়ে উঠলে সেখানকার কৃষকেরা তাদের গবাদিপশু ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে প্রতিবেশী দেশীয় রাজ্য বরোদায় আশ্রয় নেয়। কয়েক মাস কষ্ট ভোগ করে শান্তি ফিরলে তারা নিজ গৃহে ফিরে আসে।
- অন্যান্য রাজ্য – স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে বিহারে, দ্বারকাপ্রসাদ মিশ্রের নেতৃত্বে মধ্যপ্রদেশে, এন জি রঙ্গের নেতৃত্বে অন্ধ্রে, কৃষক সংঘের পরিচালনায় উড়িষ্যায় কৃষক আন্দোলন শুরু হয়।
আইন অমান্য আন্দোলনের কৃষকশ্রেণির মূল্যায়ন –
এইভাবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সীমিতভাবে কৃষক আন্দোলন ঘটে। কৃষকশ্রেণি জাতীয় আন্দোলনের অংশীদার হয়ে ওঠে। জাতীয় কংগ্রেস কৃষকশ্রেণিকে আন্দোলনে শামিল করার জন্য খাজনা বন্ধের কর্মসূচি গ্রহণ করে। ফলে আগামী দিনে কৃষক সভা গঠনের পথ প্রশস্ত হয়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ভূমিকা –
ভারতের জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে গান্ধিজি পরিচালিত শেষ সর্বভারতীয় আন্দোলন ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। 1942 খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে এই আন্দোলন সংঘটিত হওয়ায় এটি আগস্ট আন্দোলন নামেও পরিচিত। গান্ধিজির ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমগ্র ভারতবাসী এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রেক্ষাপট –
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-কে ভারতীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতে পাঠায়। কংগ্রেস সেক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করলেও ক্রিপস তাঁর প্রস্তাবে ভারতকে ‘স্বায়ত্তশাসন’ দেওয়ার কথা বলেন।
- ফলে ক্রিপস প্রস্তাব ব্যর্থ হয় ও মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতি 1942 খ্রিস্টাব্দের 14 জুলাই ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিস্তার –
- ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা দেশ জুড়ে দেখা দেয় হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল। প্রথমে বোম্বাই, আহমেদাবাদ, পুনা, কলকাতা, ঢাকা প্রভৃতি বড়ো বড়ো শহরগুলিতে আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও কয়েকদিনের মধ্যে ভারতবর্ষের গ্রামাঞ্চলেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল।
- বিহার, যুক্তপ্রদেশ, গুজরাট, আসাম প্রভৃতি প্রদেশে কৃষকরা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এই সময় জমিদারদের বিরোধিতা নয়, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ অপশাসনের বিরোধিতাই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার –
‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ৮ আগস্ট মধ্যরাতে গান্ধিজি, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, জহওরলাল নেহরু-সহ অন্যান্য কংগ্রেসি শীর্ষ নেতাদের পুলিশ গ্রেফতার করে। জাতীয় কংগ্রেসকে ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা করা হয়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতা –
- ভারত ছাড়ো আন্দোলন বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয় – প্রকৃতপক্ষে নিরস্ত্র জনগণ ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রবল দমননীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারেনি।
- সরকারি দমননীতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগও এই আন্দোলনের প্রচণ্ড ক্ষতি করে।
- নেতৃত্ব ও সংগঠনের অভাব ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব –
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্যর্থ হলেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
- এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর বহুদিনের চাপা অসন্তোষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়।
- জাতীয় আন্দোলনের অন্যান্য পর্যায়ে শ্রমিক-কৃষকরা শামিল হলেও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তারা যেভাবে এগিয়ে এসেছিল তাতে আন্দোলনের গণচরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন কেন হয়?
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ভূমিকা –
গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত সর্বভারতীয় গণ আন্দোলনের শেষ আন্দোলন ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন (1942 খ্রিস্টাব্দ)। এর আগের অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের চেয়ে এই ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল স্বতন্ত্র। নেতা নেই, সংগঠন নেই তবুও জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ –
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণগুলি হল –
- ক্রিপস মিশন -এর ব্যর্থতা – এসময় জাপান ব্রহ্মদেশ দখল করে ভারতের উপর বিমানহানা চালায়। জাপানি আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সহযোগিতা লাভের জন্য ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে আসেন। কিন্তু ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনা ব্যর্থ হয়। 1942 খ্রিস্টাব্দে ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা দেশবাসীকে হতাশ ও আতঙ্কিত করে।
- ভারত ছাড়ো প্রস্তাব গ্রহণ – ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলে সারা দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় কংগ্রেস কার্যনির্বাহী সমিতি ওয়ার্ধায় ভারত ছাড়ো প্রস্তাব গ্রহণ করে (14 জুলাই, 1942 খ্রিস্টাব্দ)। এই প্রস্তাবে অবিলম্বে ইংরেজদের ভারত ছাড়তে বলা হয়। নতুবা কংগ্রেস প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে বলে জানানো হয়। এরপর কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে (8 আগস্ট, 1942 খ্রিস্টাব্দ) ভারত ছাড়ো প্রস্তাব পাস করা হয়। অহিংসার ভিত্তিতে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হয়। গান্ধিজি জাতির উদ্দেশে ‘হরিজন’ পত্রিকায় লেখেন, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অপর কোনো কিছুতেই ভারতবাসী সন্তুষ্ট হবে না। তিনি আরও বলেন, ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’; অর্থাৎ হয় দেশ স্বাধীন করব নয় মরব (Do or Die) ।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মূল্যায়ন –
এই প্রস্তাব পাসের পর সেই দিনই (8 আগস্ট, 1942 খ্রিস্টাব্দ) রাত্রিতে কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। কংগ্রেসকে বে-আইনি দল বলে ঘোষণা করা হয়। এলাহাবাদে কংগ্রেসের দপ্তর ব্রিটিশ সরকার দখল করে। ফলে পরদিন জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বিহার ও বাংলার কৃষকদের ভূমিকা আলোচনা করো।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ভূমিকা –
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (1942 খ্রিস্টাব্দ) ভারত ছাড়ো আন্দোলন সংগঠিত হয়। গান্ধিজি ও কংগ্রেস পরিচালিত শেষ গণ আন্দোলন ছিল এই ভারত ছাড়ো আন্দোলন। জাতীয় নেতারা কারারুদ্ধ হন এবং কংগ্রেস বে-আইনি বলে ঘোষিত হলেও জনগণ অসীম সাহসে পথে নামে। শুরু হয় ভারত ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো গণ আন্দোলন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বিহার ও বাংলার কৃষকদের ভূমিকা –
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ যোগদান করে। এই আন্দোলনে দেশের কৃষকশ্রেণি বহু অসুবিধা (অজন্মা ও শস্যহানি, খাদ্যাভাব, মূল্যবৃদ্ধি) সত্ত্বেও যোগদান করে।
- বিহার – ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যাপকতা বিহারের কৃষকশ্রেণির মধ্যে দেখা দেয়। সমসাময়িক সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিহারের বিভিন্ন জেলার 80 শতাংশেরও বেশি পুলিশচৌকি জনতা দখল করেছিল। এই জঙ্গিজনতার বেশিরভাগই ছিল কৃষক। এই কৃষক অভ্যুত্থান দ্রুত পশ্চিম বিহারে ছড়িয়ে পড়ে। বেনারসে তা তীব্র হয়ে ওঠে। বালিয়া জেলার 10টি থানাই জনতার দখলে চলে যায়। মধুবনি অঞ্চলের প্রায় 5000 সশস্ত্র জনতা স্থানীয় থানা আক্রমণ করে। সারন জেলায় স্থানীয় জনতা জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।
- বাংলা – ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বাংলার কৃষকেরা অংশ নেয়। মেদিনীপুর জেলার তমলুক, সুতাহাটা, মহিষাদল এবং নন্দীগ্রামের কৃষকেরা বিদ্রোহে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা রাস্তা কেটে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে। স্থানীয় থানায় আক্রমণ চালায়। 73 বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক থানা অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। তমলুকে গঠিত হয় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। এ ছাড়াও বর্ধমান, হুগলি ও অন্যান্য জেলায় সীমিতভাবে কৃষক আন্দোলন হয়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বিহার ও বাংলার কৃষকদের মূল্যায়ন –
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত সংকট, অর্থাভাব ও দুর্দশার জন্য কৃষকশ্রেণি এই আন্দোলনে কম সংখ্যায় যোগদান করে। মুসলিম লিগ, র্যাডিকাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির অংশগ্রহণ কীরূপ ছিল?
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ভূমিকা –
1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল সর্বভারতীয় শেষ গণ অভ্যুত্থান। ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা, জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা, কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি প্রভৃতি কারণে অসন্তুষ্ট ভারতবাসী ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়। কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এই আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি আরও সুদৃঢ় করে তোলে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষকশ্রেণির ভূমিকা –
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ভারতীয় কৃষকশ্রেণি। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের খেতমজুর, বর্গাচাষি, ভূমিহীন কৃষক এই আন্দোলনে যোগ দেয়।
- বাংলায় তমলুক, পটাসপুর, সুতাহাটা, ভগবানগোলা প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা খাজনা বন্ধের মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করে।
- উড়িষ্যার তালচেরে সংরক্ষিত অরণ্যে বলপূর্বক প্রবেশ করে কৃষকশ্রেণি ‘চাষি মল্লারাজ’ নামক স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
- বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে এবং গুজরাটের সুরাট, খান্দেশ, ব্রোচ প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন প্রায় গেরিলা যুদ্ধের আকার নিয়েছিল।
শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা –
কমিউনিস্ট পার্টি ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও শ্রমিকশ্রেণির একটি বড়ো অংশ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল।
- জামশেদপুরের টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানির (TISCO) শ্রমিকরা টানা 13 দিন ধর্মঘট করে।
- বোম্বাই, দিল্লি, লখনউ, কানপুর, আহমেদাবাদ, মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর প্রভৃতি শহরাঞ্চলে কলকারখানার শ্রমিকরা লাগাতার ধর্মঘট-হরতালে শামিল হয়।
- কলকাতা, হাওড়া অঞ্চলের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, বাংলার ট্রাম কোম্পানি এবং উত্তর বাংলার চা-বাগানের শ্রমিকরাও এই আন্দোলনে অংশ নেয়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের উপসংহার –
অতএব এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় রূপ দান করেছিল।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়?
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ভূমিকা –
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বশেষ অধ্যায়। গান্ধিজির উচ্চারিত ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে 1942 খ্রিস্টাব্দের 9 আগস্ট ভোরে আন্দোলনের সূচনা হয়।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ –
তীব্রগতিতে চলা এই আন্দোলন কিছুদিনের মধ্যেই তার গতি হারিয়ে ফেলে ও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এই আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি হল –
- ব্রিটিশের তীব্র দমননীতি – আন্দোলনের শুরু থেকেই ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকারীদের উপর নিষ্ঠুর ও অমানবিক অত্যাচার চালাতে শুরু করে, যে কারণে আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়।
- উপযুক্ত নেতার অভাব – ভারত ছাড়ো আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে গান্ধিজির নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু আন্দোলনের শুরুতেই দেশের প্রথম সারির নেতাদের ও গান্ধিজিকে গ্রেফতার করা হয়। উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ও আন্দোলনকারীদের কোনো সংগঠন, পরিকল্পনা বা কর্মসূচি না থাকায় আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
- কয়েকটি রাজনৈতিক দলের ভূমিকা – মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা, অনুন্নত সম্প্রদায়ের দল প্রভৃতি সংগঠনের বহু মানুষ এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে ছিল। বিভিন্ন সংগঠনের অসহযোগিতার ফলে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ – 1942 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার ফলে মেদিনীপুরের সমুদ্র উপকূলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় ও অগণিত মানুষ মারা যায়। এরপর 1943 খ্রিস্টাব্দে সারা বাংলায় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলির ফলে বিপর্যস্ত মানুষ আন্দোলন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে। ফলে আন্দোলন দুর্বল হয়ে যায়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরবর্তীকালে ভারতের প্রধান প্রধান কৃষক আন্দোলনগুলির উল্লেখ করো।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ভূমিকা –
1942 খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা আগস্ট আন্দোলন ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল, যদিও 1943 খ্রিস্টাব্দের পর এর তীব্রতা অনেকটাই হ্রাস পেতে থাকে। তবে এসময়ও কৃষকদের দাবিদাওয়াকে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরবর্তীকালে সংঘটিত কৃষক আন্দোলনসমূহ –
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কৃষক বিদ্রোহ দেখা গিয়েছিল। যথা –
- বাংলার তেভাগা আন্দোলন – বাংলার দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় সংঘটিত তেভাগা আন্দোলন ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। এখানকার ভাগচাষিরা উৎপন্ন ফসলের 2/3 অংশ পাওয়ার দাবি জানালে ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা’ 1946 খ্রিস্টাব্দে তেভাগা আন্দোলনের ডাক দেয়।
- হায়দরাবাদের তেলেঙ্গানা আন্দোলন – হায়দরাবাদের তেলেঙ্গানা অঞ্চলের ভূস্বামীরা ‘ভেট্টি’ বা ‘বেগার শ্রম’-এর মাধ্যমে কৃষকদের উপর শোষণ চালাত। এই সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্বে কৃষকরা গেরিলা পদ্ধতিতে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। এটি তেলেঙ্গানা আন্দোলন নামে পরিচিত।
- ত্রিবাঙ্কুরে পুন্নাপ্রা-ভায়ালার আন্দোলন – ত্রিবাঙ্কুরের পুন্নাপ্রা- ভায়ালার অঞ্চলে কৃষক ও শ্রমিকরা দেওয়ান-শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এই আন্দোলনের ফলে স্বাধীনোত্তর পর্বে ত্রিবাঙ্কুর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
- বিহারের বখস্ত আন্দোলন – বিহারেও কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এখানকার বখস্ত নামক জমি থেকে প্রজাদের উচ্ছেদ ও চরম শোষণ শুরু হলে কৃষকরা আন্দোলন শুরু করে।
উপসংহার –
এইভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ক্রমশ তা জাতীয় আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়।
তেভাগা আন্দোলনের সূচনা ও পরিণতি আলোচনা করো।
অথবা, তেভাগা আন্দোলন – টীকা লেখো।
তেভাগা আন্দোলনের ভূমিকা –
1946 খ্রিস্টাব্দ থেকে বামপন্থী রাজনীতির লক্ষ্য হয়ে ওঠে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনগুলিকে সংগঠিত করা। এই পর্বের আন্দোলনগুলি ছিল মূলত কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে জঙ্গি কৃষক অসন্তোষ। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলার কৃষক আন্দোলনগুলির মধ্যে এরকমই এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিল তেভাগা আন্দোলন।
তেভাগা আন্দোলনের সূচনা –
- তেভাগা আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি ছিল উৎপন্ন ফসলের 2/3 ভাগ তাদের দিতে হবে।
- ফ্লাউড কমিশনের তেভাগার সুপারিশ কার্যকর করার জন্য বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা 1946 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তেভাগা আন্দোলনের ডাক দেয়।
- 1946 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের গোড়ায় ধান পাকার সময় দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার রামচন্দ্রপুর গ্রাম থেকেই তেভাগা আন্দোলনের সূচনা হয়।
তেভাগা আন্দোলনের বিস্তার –
- বাংলার জলপাইগুড়ি, মালদহ, খুলনা, যশোহর, পাবনা, মেদিনীপুর সর্বত্র এই আন্দোলনের দ্রুত বিস্তার ঘটে।
- তেভাগা আন্দোলনে প্রায় 70 লক্ষ কৃষক, ক্ষেতমজুর ও নারী অংশগ্রহণ করে। কাকদ্বীপের বাতাসী, মহিষাদলের বিমলা মণ্ডল, চারু মজুমদার, অবনী লাহিড়ি প্রমুখের নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল।
তেভাগা আন্দোলনের পরিণতি –
সরকারি দমননীতি সত্ত্বেও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ সংঘবদ্ধভাবে এই আন্দোলনে শামিল হয়। এসময় ফজলুল হক মন্ত্রীসভা তেভাগার দাবিকে স্বীকৃতি দেয়। এর ঠিক পরেই আন্দোলনের গতিময়তা কমে যায়। শেষপর্যন্ত 1950 খ্রিস্টাব্দে বর্গাদার বিল জারি হলে এই আন্দোলনের অবসান ঘটে।
তেভাগা আন্দোলনের গুরুত্ব ও চরিত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
তেভাগা আন্দোলনের ভূমিকা –
1937 খ্রিস্টাব্দে ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টে দেখানো হয় যে, বাংলার বহু কৃষক পরিবারের জমিতে কোনো অধিকার নেই। এই কমিশনের সুবাদে ভাগচাষিরা তিন ভাগের এক ভাগ ফসল জমা দেবে বলে স্থির হয়, যা তেভাগা নামে পরিচিত। কিন্তু জমিদার বা সরকার কেউই এটা মানতে রাজি ছিল না। এই অবস্থায় কমিউনিস্টদের কৃষক সংগঠন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা 1946 খ্রিস্টাব্দে তেভাগা আন্দোলন শুরু করে।
তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব –
উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির দেবীগঞ্জ এলাকায় ‘বুড়িমা’-র নেতৃত্ব প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। এ ছাড়া দিনাজপুরের গৃহবধূ জয়মণি, দীপেশ্বরী, কাকদ্বীপের বাতাসী, মহিষাদলের বিমলা মণ্ডল প্রমুখ মহিলার নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল। তেভাগা আন্দোলন মূলত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। তাই এই আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ ও পরিচালনার ফলে তারা কৃষকশ্রেণির কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শিক্ষিত ও রাজনীতিসচেতন কমিউনিস্টদের প্রভাবে কৃষকরাও দেশের রাজনীতিসচেতন গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
তেভাগা আন্দোলনের গুরুত্ব –
ডি এন ধানাগাড়ে তাঁর ‘পেজেন্ট মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া’ (Peasant Movement in India) গ্রন্থে লিখেছেন, ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এই আন্দোলন এক অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে নারীদের নেতৃত্বের সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়। সাম্প্রদায়িকতার যে কৌশল ব্রিটিশরা এদেশ শাসনে ব্যবহার করেছিল তা এই আন্দোলন ব্যর্থ করে দিয়েছিল। এই আন্দোলন জাতি-ধর্মের গণ্ডি অতিক্রম করে সমস্ত ধরনের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। যদিও এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল তবুও পরবর্তীকালে ভূমিস্বত্ব আইন, বর্গাদারদের অধিকার ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের প্রশ্নে এই আন্দোলনের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
তেভাগা আন্দোলনের চরিত্র –
তেভাগা আন্দোলনের মূল চরিত্র হল যে, এটি সামগ্রিকভাবেই একটি আন্দোলন। এই আন্দোলনের সংগঠকদের মূল দাবি ছিল ফসলের তিন ভাগের দু-ভাগ বর্গাদার বা ভাগচাষিদের প্রাপ্য এবং কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করতে হবে। তেভাগা আন্দোলন -এর সূত্র ধরে ‘টংকা আন্দোলন’ জোরদার করা হয়। ‘টংকা’ বলতে খাজনাকে বোঝানো হত। লাঠি, তির, ধনুক ছিল এই আন্দোলনকারীদের মূল অস্ত্র। একদিকে মহিলারা কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে আন্দোলনকারীদের আক্রমণ সম্পর্কে সচেতন করতেন অন্যদিকে নিজেরাও বঁটি, লাঠি, ঝাঁটা নিয়ে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন।
তেলেঙ্গানা আন্দোলন – টীকা লেখো।
তেলেঙ্গানা আন্দোলনের ভূমিকা –
প্রাক্-স্বাধীনতার যুগে তেলেঙ্গানা অঞ্চলটি ছিল হায়দরাবাদের নিজাম-শাসিত অঞ্চল। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশে এই অঞ্চলের কৃষকদের কোনো স্বাধীন সত্তা ছিল না। এখানকার কৃষিজীবী মানুষের বেশিরভাগ ছিল ‘ভেট্টি’ প্রথার শিকার। ‘ভেট্টি’ বলতে বোঝানো হত বেগার শ্রমকে। এখানকার ভূস্বামীরা, যেমন – জমিদার, জায়গিরদার বা দেশমুখরা বহু সংখ্যক কৃষকদের উপর ‘ভেট্টি’ প্রথার মাধ্যমে শোষণ চালাত। এই পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্বে কৃষকরা গেরিলা প্রতিরোধ শুরু করে। এই প্রতিরোধ তেলেঙ্গানা আন্দোলন নামে পরিচিত।
তেলেঙ্গানা আন্দোলন –
1946 খ্রিস্টাব্দে ডোডি কোমার্যার ঘটনা দিয়ে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সূত্রপাত। ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে, আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড়ো ‘গেরিলা কৃষক যুদ্ধ’। আন্দোলন চলাকালীন কমিউনিস্ট নেতারা রেশন ব্যবস্থার অপব্যবহার, অপরিমিত খাজনা ও ভেট্টি সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য তেলেঙ্গানার গ্রামগুলিতে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলেন। ‘অন্ধ্র মহাসভা’-ও এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তেলেঙ্গানার গ্রামগুলিতে কমিউনিস্টদের বলা হত ‘চিকাটি ডোবালু’ বা ‘রাতের রাজা’। এদের আন্দোলনের দাবি হিসেবে জমিদারদের জমি উদ্ধার, পতিত জমি উদ্ধার, কৃষিমজুরি বৃদ্ধি – এই সবকিছুই যুক্ত হয়েছিল। তাদের এই আন্দোলনের চাপে তেলেঙ্গানার প্রায় 2500টি গ্রামে নিজাম-শাসনের অবসান ঘটে।
তেলেঙ্গানা আন্দোলনেরগুরুত্ব –
তেলেঙ্গানা আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই বিদ্রোহের ফলে সামন্ততান্ত্রিক শোষণের পথ বন্ধ হয়। ভেট্টি প্রথা লোপ পায়। কৃষিমজুরি বৃদ্ধি করা হয় এবং নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। 1951 খ্রিস্টাব্দে তেলেঙ্গানা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এই আন্দোলনের সূত্র ধরেই প্রথম ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের পথ প্রশস্ত হয়।
পুন্নাপ্রা-ভায়ালার সংগ্রাম – টীকা লেখো।
পুন্নাপ্রা-ভায়ালার সংগ্রাম –
1857 খ্রিস্টাব্দে মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্রের দ্বারা যে-সমস্ত দেশীয় রাজ্যকে স্বাধীন রাখা হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল দক্ষিণ ভারতের ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যটি। 1940 -এর দশকে সেখানে রাজতন্ত্রের আড়ালে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু করতে সচেষ্ট হন রামস্বামী আইয়ার। 1946 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ত্রিবাঙ্কুরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এই রাজ্যের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি ছিল নারকেল-ছোবড়া শিল্প। কিন্তু 1946 -এর দশকে এই শিল্পেও অবনতি হতে থাকে। কৃষকরা ক্রমশ চরম নির্যাতনের শিকার হয়। এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট নেতারা ত্রিবাঙ্কুরের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তিশালী-ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন। তারা অনুভব করেছিলেন সংবিধান পরিবর্তন থেকেও বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতির মোকাবিলা জরুরি। মূলত তাদের নেতৃত্বে কৃষক ও শ্রমিকরা দেওয়ান-শাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলিতে পুলিশি নির্যাতন চরমে ওঠে। কৃষক-শ্রমিকরা আলেপ্পিতে ধর্মঘট করে এবং পুন্নাপ্রার পুলিশচৌকিতে সফল আক্রমণ চালায়। এই লড়াইয়ে বহু পুলিশও প্রাণ হারায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ত্রিবাঙ্কুরে সামরিক আইন জারি করা হয়।
পুন্নাপ্রা-ভায়ালার সংগ্রামের মূল্যায়ন –
পুন্নাপ্রা-ভায়ালার সংগ্রামের অন্যতম নেতা কে সি জর্জ এই আন্দোলনকে ‘অমর’ আখ্যা দিয়েছেন। ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলন আজও মানুষের কাছে পবিত্র ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত। কংগ্রেসের ন অনবরত চাপে স্বাধীনোত্তর ভারতে দেশীয় রাজ্য ত্রিবাঙ্কুরকে ভারতের প অন্তর্ভুক্ত করতে তৎপর ও সফল হয়।
বখস্ত আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
অমান্য আন্দোলনের সময় ভারতের কৃষক আন্দোলন আরও বেশি সংগঠিত রূপ ধারণ করেছিল। এই কালপর্বে বিহারের গয়া, মুঙ্গের, পাটনা, ছোটোনাগপুর অঞ্চলে সংঘটিত বখস্ত আন্দোলন ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কৃষক আন্দোলন।
বখস্ত আন্দোলনের সূচনা –
- বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দার দরুন বিহারে বেশ কিছু জমির খাজনা বাকি পড়েছিল। এই অঞ্চলের জমিদাররা জমিগুলি করায়ত্ত করে নিজেদের খাসজমি বা বখস্ত-এ পরিণত করে।
- মহামন্দার সময় খাজনা দিতে না পারায় এই জমিগুলি থেকে প্রজাদের উচ্ছেদ করা হলে তাদের মনে ক্ষোভ জমা হয়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বখস্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
বখস্ত আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান –
বিহারে স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী, স্বামী করিয়ানন্দ শর্মা, যদুনন্দন শর্মা, পঞ্চানন শর্মা ও পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে এই আন্দোলন পরিচালনা করেন। আন্দোলনকারীরা জমিদারি প্রথা ধ্বংসের দাবি জানিয়েছিল। স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী বিহারে কিষাণসভা গঠনের মাধ্যমে বখস্ত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
বখস্ত আন্দোলনের পরিণতি –
সরকারি দমননীতির চাপে শেষপর্যন্ত 1939 খ্রিস্টাব্দে বখস্ত আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বখস্ত আন্দোলনের উপসংহার –
ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে কৃষক আন্দোলনগুলির মধ্যে বখস্ত আন্দোলনের ভূমিকা ছিল নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
একা আন্দোলনের পরিচয় দাও।
একা আন্দোলনের ভূমিকা –
অসহযোগ-খিলাফৎ আন্দোলনের সময় উত্তরপ্রদেশে (তখনকার যুক্তপ্রদেশ) একটি কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা একতা বা একা আন্দোলন নামে পরিচিত। সমাজের নিম্নবর্গের কৃষকরা এই আন্দোলন সংগঠিত করে। এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন মাদারি পাসি। আন্দোলনের চরিত্র উগ্র প্রকৃতির ছিল। সেইজন্য সরকারি দমননীতির কোপে পড়ে আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

একা আন্দোলনের কারণ –
এই আন্দোলনের কারণ ছিল –
- নির্ধারিত খাজনার চেয়ে 50 শতাংশ অতিরিক্ত খাজনা নির্ধারণ।
- খাজনা আদায়কারীদের নিপীড়ন।
- বাটাই বা উৎপন্ন শস্যের বদলে নগদ অর্থে করদান।
- তালুকদারদের অত্যাচার প্রভৃতি।
একা আন্দোলনের প্রসার –
এই সময় অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলন শুরু হয়। এই সুযোগে একা আন্দোলন কংগ্রেসের সমর্থন লাভ করে। হরদই, সীতাপুর, বরাইচ জেলায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
একা আন্দোলনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান –
একা আন্দোলন পরিচালনার সময় আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা মাঝে মাঝে সভা করত। এই সভায় ধর্মীয় আচার-আচরণ ও রীতিনীতি পালন করা হত। একজন পুরোহিত সভায় পৌরোহিত্য করতেন এবং উপস্থিত কৃষকেরা শপথ নিত –
- তারা কেবল সরকার নির্ধারিত খাজনা দেবে, অতিরিক্ত খাজনা দেবে না।
- জমিদার জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করলেও কৃষক জমি ছাড়বে না।
- কৃষকেরা জমিদারদের বেগার শ্রম দেবে না।
- পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত মেনে চলবে ইত্যাদি।
একা আন্দোলনের কার্যকলাপ –
একা আন্দোলনের নেতারা নিজস্ব পথে চলেন। তারা জাতীয় আন্দোলনের নেতাদের পরামর্শ বা নিয়ম মানেননি। মাদারি পাসি জেলাশাসককে হত্যা এবং ইংরেজ শাসকদের বিতাড়িত করার ডাক দেন। ফলে কৃষকেরা দল বেঁধে স্থানীয় জমিদারদের বাড়ি আক্রমণ করে। তারা ইংরেজদেরও আক্রমণ করে। কুমায়ুন অঞ্চলের সংরক্ষিত বনভূমিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
একা আন্দোলনের পরিণতি –
একা আন্দোলন উগ্র হয়ে উঠলে সরকার তা দমন করতে অগ্রসর হয়। 1922 খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে সরকারের নির্মম দমননীতির সাহায্যে মাদারি পাসির একা আন্দোলনের অবসান ঘটে।
একা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী ছিল?
একা আন্দোলনের ভূমিকা –
অসহযোগ-খিলাফৎ আন্দোলনের সময় যুক্তপ্রদেশের হরদই, বরাইচ ও সীতাপুরে নিম্নবর্গের মানুষদের একটি কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলন একা বা একতা আন্দোলন নামে পরিচিত।
একা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যসমূহ –
এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
- কৃষক ঐক্য প্রতিষ্ঠা – এই আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। আন্দোলনরত কৃষকেরা সভায় সমবেত হয়ে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের ঐক্য সুদৃঢ় করত।
- জঙ্গি আন্দোলন – এই আন্দোলন ছিল জঙ্গি প্রকৃতির। আন্দোলনের নেতারা জমিদার ও ইংরেজদের শত্রু বলে মনে করত। তারা ইংরেজ শাসকদের হত্যা ও বিতাড়নের জন্য আন্দোলনরত কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানান। কৃষকেরাও উত্তেজিত হয়ে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটায়।
- কৃষককেন্দ্রিক আন্দোলন – এই আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণভাবে কৃষকশ্রেণির দ্বারা পরিচালিত। কৃষিজীবী ছাড়া সমাজের অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের কথা ভাবা হয়নি।
- নিম্নবর্গের আন্দোলন – এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন মাদারি পাসি। তিনি নিম্নবর্গের মানুষ ছিলেন। তাঁর সহযোগীরাও ছিলেন নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। তাই তাঁর আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিল নিম্নবর্গের কৃষকরা।
একা আন্দোলনের মূল্যায়ন –
কংগ্রেস ও খিলাফৎ আন্দোলনের পরিমণ্ডলে ও সমর্থনে বিস্তৃত এই আন্দোলন নিজস্ব রূপ পরিগ্রহ করে। আন্দোলনের নিজস্ব নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। জাতীয় আন্দোলনের রূপরেখা থেকে এই আন্দোলন দূরে সরে যায়। নিম্নবর্গের কৃষকদের ক্ষোভ নানান হিংসাত্মক ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। ঐতিহাসিক হবসবম এই হিংসাত্মক আচরণকে সামাজিক দস্যুতা বলেছেন।
বারদৌলি সত্যাগ্রহের ঘটনাপ্রবাহ আলোচনা করো।
বারদৌলি সত্যাগ্রহের ভূমিকা –
গুজরাটের সুরাট জেলার একটি তালুক ছিল বারদৌলি। 1928 খ্রিস্টাব্দে এখানে অহিংস পথে সত্যাগ্রহ আদর্শের উপর ভিত্তি করে খাজনা বা রাজস্ব বন্ধ সংক্রান্ত একটি আন্দোলন হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও মহাত্মা গান্ধি।
বারদৌলি সত্যাগ্রহের কারণ –
কংগ্রেস কোথাও কোথাও কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানালেও কখনো জমিদারবিরোধী কৃষক সংগ্রামকে অনুমোদন করেনি। মহাত্মা গান্ধিও যতদিন সম্ভব খাজনা বন্ধের আন্দোলনকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। শেষপর্যন্ত অবশ্য খাজনা বন্ধ আন্দোলনের ক্ষেত্র হিসেবে বারদৌলিকে বেছে নেন। বারদৌলি তালুকে গ্রাম ছিল 137টি। জনসংখ্যা প্রায় 87,000 জন। এখানকার অধিবাসী ছিল কুনবি ও পাতিদার কৃষক-যারা জমির মালিক ছিল। আর কালিপরাজ যারা বংশপরম্পরায় খেতমজুর বা ভাগচাষি, তারা ছিল স্থানীয় জনসংখ্যার প্রায় 60 শতাংশ।
এই সময় তুলোর দাম কমে গিয়েছিল। তবু বোম্বাই সরকার 22 শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি করলে পরিস্থিতি কৃষকদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

বারদৌলি সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব –
গান্ধিজির কিছু কর্মকেন্দ্র এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন – পাতিদার যুবক মণ্ডল, পাতিদার আশ্রম ইত্যাদি। এখানে ‘প্যাটেল বন্ধু’ নামে পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। আর ছিলেন কুনবরজি মেহতা ও কল্যাণজি মেহতা নামে দুই জন নেতা, যারা বল্লভভাই প্যাটেলের কাছে খাজনা বন্ধ আন্দোলনের প্রস্তাব দেন। প্যাটেলও আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে রাজি হন।
বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা –
অতঃপর 1928 খ্রিস্টাব্দে বারদৌলির পাতিদার ও কুনবি কৃষক এবং কালিপরাজ মজুররা একযোগে খাজনা বন্ধ আন্দোলন শুরু করে। সরকার আন্দোলনকারীদের প্রচুর সংখ্যক গবাদিপশু বাজেয়াপ্ত করে, জমি দখল করে। সরকার আন্দোলন ভাঙার জন্য কালিপরাজদের সহজ শর্তে জমি দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। সরকার জাতপাতের বিষয়টি দিয়ে আন্দোলন দুর্বল করার চেষ্টা করে। তখন প্যাটেল ও আঞ্চলিক নেতারা ভজন গান ও ধর্মীয় আবেদনের মাধ্যমে ঐক্য বজায় রাখেন। কালিপরাজদের দেবতা সিলিয়া ও সিমালিয়ার সেবকরূপে গান্ধিজিকে তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া কালিপরাজদের স্বল্প পোশাকের সঙ্গে গান্ধিজির পোশাকের মিল তুলে ধরে তারা। দৈনিক ‘সত্যাগ্রহ’ পত্রিকায় কৃষক ও কৃষিমজুরদের ঐক্য বজায় রাখার উপর জোর দিয়ে প্রচার চালানো হয়।
বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের বিস্তার –
বারদৌলি আন্দোলন একটি জাতীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আহমেদাবাদের কর্মীরা 1 আনা করে মোট 1300 টাকা চাঁদা তোলে। বোম্বাই -এর ব্যবসায়ী সমিতি এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে মধ্যস্থতার চেষ্টা করে; কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। প্রতিবাদে বোম্বাই কাউন্সিলের বণিকসভার প্রতিনিধি লালজি নারায়ণজি পদত্যাগ করেন। এসময় বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন গিরনি-কামগড় ইউনিয়ন বোম্বাইয়ে শিল্প ধর্মঘট করে।
বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের তদন্ত কমিটি –
বারদৌলির সঙ্গে বোম্বাইয়ের আন্দোলন মিশে যাবে এই আশঙ্কা থেকে সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ম্যাক্সওয়েল ব্লুমফিল্ড -এর তদন্ত কমিটি স্বীকার করে যে, বারদৌলির রাজস্ব নির্ধারণ ত্রুটিপূর্ণ। গুজরাটের অন্যান্য অঞ্চলেও যে রাজস্ব বৃদ্ধি করা হয়েছে তা ভ্রান্ত।
বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পরিণতি –
বারদৌলির বর্ধিত রাজস্ব কমিয়ে দেওয়া হয়। সমগ্র গুজরাট ও মহারাষ্ট্র জুড়ে বল্লভভাই প্যাটেল রাজস্ব বিষয়ে একটি অভিযানের পরিকল্পনা করেন। বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ভূমি লিগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকার রাজস্ব সংশোধন মুলতুবি রাখে। খেদায় 1890 খ্রিস্টাব্দের রাজস্ব হার বজায় থাকে। 1940 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আর এখানে রাজস্ব বৃদ্ধি করা হয়নি। এভাবে বারদৌলি সত্যাগ্রহ সফল হয়।
বারদৌলি আন্দোলনের প্রভাব গান্ধিজির উপর কীভাবে পড়েছিল?
অথবা, বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ভূমিকা –
1928 খ্রিস্টাব্দে গুজরাট প্রদেশের সুরাট অঞ্চলের বারদৌলিতে যে কৃষক আন্দোলন হয়েছিল, তা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বারদৌলি সত্যাগ্রহ নামে চিহ্নিত। এই সত্যাগ্রহ মহাত্মা গান্ধির রাজনৈতিক জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দিয়েছিল।
বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত –
1920-1922 খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্থির হয়েছিল যে, গান্ধিজি বারদৌলি থেকে আন্দোলন শুরু করবেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। এমতাবস্থায় 1926 খ্রিস্টাব্দে সরকার বারদৌলি তালুকে 30 শতাংশ খাজনা বৃদ্ধির নির্দেশ দিলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে শুরু হয় বারদৌলি সত্যাগ্রহ।
বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনে গান্ধিজির ভূমিকা –
বারদৌলি সত্যাগ্রহের প্রধান সংগঠক ছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। 1928 খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি বারদৌলিতে এসে আন্দোলন পরিচালনা করার প্রতিশ্রুতি দেন। বারদৌলিতে গান্ধিজির এই অংশগ্রহণ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চৌরিচৌরার ঘটনার (1922 খ্রিস্টাব্দ) সময় থেকে তিনি যে ‘রাজনৈতিক সন্ন্যাস’ যাপন করে আসছিলেন তার অবসান ঘটে।
বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনে মূল্যায়ন –
বারদৌলি কৃষক বিদ্রোহ সফল হয়েছিল। একই সঙ্গে আন্দোলনটি গান্ধিজির মুখরক্ষাও করেছিল। ডঃ সুমিত সরকারের ভাষাতেই তাই বলা যায়- “Gandhian nationalism certainly brought some concrete benefits for the peasant proprietors of Gujarat”।
বারদৌলি সত্যাগ্রহের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
বারদৌলি সত্যাগ্রহের ভূমিকা –
গুজরাটের সুরাট জেলার একটি তালুক হল বারদৌলি। এখানে পাতিদার ও কুনবি কৃষক এবং কালিপরাজ ভূমিদাসরা সংখ্যায় বেশি ছিল। গান্ধিজির অনুগামী কল্যাণজি মেহতা ও কুনবরজি মেহতা এদের সংগঠিত করেন। সরকার এখানে রাজস্ব বৃদ্ধি করলে তার প্রতিবাদে 1928 খ্রিস্টাব্দে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়।
বারদৌলি সত্যাগ্রহের কারণ –
1927 খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই সরকার বারদৌলি তালুকে 22 শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি করে। এসময় তুলোর দাম কমে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলে। পরিস্থিতি কৃষক ও মজুরদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
বারদৌলি সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব –
স্থানীয় গান্ধিবাদী নেতা কল্যাণজি মেহতা ও কুনবরজি মেহতার আমন্ত্রণে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কৃষকদের খাজনা বন্ধের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। গান্ধিজি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন।
বারদৌলি সত্যাগ্রহের আন্দোলনের সূচনা ও প্রত্যাহার –
বারদৌলির পাতিদার কৃষক ও কালিপরাজ ভূমিদাসরা খাজনা বন্ধ আন্দোলন শুরু করেন 1928 খ্রিস্টাব্দে। অহিংসভাবে এই আন্দোলন চলে। সরকার আন্দোলনকারীদের গবাদিপশু ও জমি বাজেয়াপ্ত করে আন্দোলন ভাঙার জন্য চেষ্টা করে; কিন্তু তা ব্যর্থ হয়।
এসময় গিরনি-কামগড় ইউনিয়নের শ্রমিক ধর্মঘট হয়। সরকার আশঙ্কা করে যে, দুটি আন্দোলন মিলে গিয়ে পরিস্থিতি জোরালো হয়ে উঠতে পারে। সরকার এ বিষয়ে পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েও তা প্রত্যাহার করে।
বারদৌলি সত্যাগ্রহের তাৎপর্য –
- জাতীয় পর্যায়ে উন্নীত – বারদৌলি সত্যাগ্রহ একটি আঞ্চলিক আন্দোলন হলেও তা জাতীয় স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
- কংগ্রেসের মনোবল বৃদ্ধি – বারদৌলি সত্যাগ্রহের বিজয় কংগ্রেসকে তার মনোবল ফিরিয়ে দেয়, এলাকার কৃষকদের মধ্যেও কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা বাড়ে।
- সরকারি কর্মচারীদের পুনর্বহাল – যে-সমস্ত গ্রামস্তরের রাজকর্মচারী (পাতিল)-রা সরকারি জুলুমের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিল তাদেরকে পুনর্বহাল করা হয়।
- বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি ফেরত – কৃষকদের বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তি পুনরায় ফেরত দেওয়া হয়।
- গান্ধিজির অবিসংবাদী নেতৃত্ব – অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার স্মৃতি ভুলতে গান্ধিজি ও দেশবাসীকে এই ঘটনা সাহায্য করে। ফলে গান্ধিজি অবিসংবাদী সর্বভারতীয় নেতায় পরিণত হন।
কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে কংগ্রেসের নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল?
কৃষক আন্দোলন ও কংগ্রেস –
সোভিয়েত ইউনিয়নে বলশেভিক বিপ্লবের পর থেকে ভারতেও কৃষক আন্দোলন সুনির্দিষ্ট খাতে বইতে শুরু করে। বিংশ শতাব্দীতেও দেশীয় রাজ্যসমূহে কৃষকদের উপর প্রবল সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচার জারি ছিল। কৃষকশ্রেণি কংগ্রেসি আন্দোলনে হতাশ হয়ে পড়েছিল, কারণ কংগ্রেস দীর্ঘ সময় ধরে কৃষক আন্দোলনে আগ্রহী ছিল না। গান্ধিজিও কৃষক আন্দোলনের বিষয়ে খুব একটা উৎসাহ দেখাননি। এই প্রেক্ষাপটে কমিউনিস্টরা কৃষকদের পাশে দাঁড়ালে সারা দেশেই কৃষকদের মধ্যে বামপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
1936 খ্রিস্টাব্দের পরে কৃষক আন্দোলন –
তবে 1936 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে অবস্থার পরিবর্তন হয়। ওই বছর স্টেট পিপলস কনফারেন্স (State Peoples Conference) -এর অধিবেশনে জওহরলাল নেহরু ভূমিসম্বন্ধীয় দাবিদাওয়া নিয়ে এক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এ ছাড়াও ওই বছরেই তৈরি হয় কিষানসভা। ফলে ভূমিসংস্কারসহ নানাদিকে কৃষকস্বার্থে কাজ শুরু হয়।
কৃষকদের প্রতি উন্নাসিকতা –
আবহমানকাল ধরেই কংগ্রেস কমবেশি কৃষক সম্প্রদায়ের প্রতি উন্নাসিক ছিল। আদি পর্বে বা নরমপন্থীদের সময়ে (1885-1905 খ্রিস্টাব্দ) অধিকাংশ নেতাই বড়ো বড়ো জমিদার হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে তারা কৃষক স্বার্থ নিয়ে মাথা ঘামায়নি।
স্বদেশি যুগ –
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকালেও একই ধারা বজায় ছিল। ফলে কৃষক সম্প্রদায়ের ব্যাপক অংশগ্রহণ ওই আন্দোলনে দেখা যায়নি। কৃষকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘বয়কট’ বা ‘নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ’ -এর মতো সংগ্রামী কৌশলে যোগদান করেনি। 1907 খ্রিস্টাব্দে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ সংক্রান্ত এক প্রবন্ধে অরবিন্দ ঘোষ খাজনা বন্ধের আন্দোলনকে সমর্থন করেননি। কারণ তিনি মনে করেন -এর ফলে দেশপ্রেমিক জমিদার শ্রেণি ক্ষুণ্ণ হবে। এই কারণেই বাংলার কৃষকদের সবচেয়ে বড়ো অংশ নমঃশূদ্ররা স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দেয়নি।
গান্ধিজির কংগ্রেসে যোগদান –
গান্ধিজির কংগ্রেসে যোগদানের পরেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। কৃষক-শ্রমিকদের জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোতে টেনে আনার কোনো কর্মসূচি তাঁর ছিল না। চম্পারণ, খেদা সত্যাগ্রহে তিনি আঞ্চলিকভাবে কৃষক সম্প্রদায়ের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন, সর্বভারতীয় কৃষক সমস্যা নিয়ে তিনি তেমন উৎসাহী ছিলেন না। কেন-না তিনিও জমিদার শ্রেণির বিরোধিতা করতে চাননি।
অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন –
অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনে কৃষকশ্রেণি বড়ো সংখ্যায় যোগ দিলেও কংগ্রেস সেই শক্তিকে সংহত করে রাখতে উদ্যোগী হয়নি। কারণ গান্ধিজি-সহ অনেক কংগ্রেসি নেতাই মনে করতেন, কৃষক সম্প্রদায়কে উৎসাহ দিলে জমিদার শ্রেণি কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে তারা কৃষক বিদ্রোহকে সমর্থন করতেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন –
1942 খ্রিস্টাব্দের আন্দোলনে বিদ্রোহী কৃষকেরা সাধারণ জমিদারবিরোধী সংগ্রামে লিপ্ত হয়নি। তাদের বিরোধিতার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সরকার। কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি না থাকা সত্ত্বেও কৃষক সম্প্রদায় নিজেদের মতো করে আন্দোলন চালিয়ে যায়।
মূল্যায়ন –
কংগ্রেসি নেতৃত্বের এই দীর্ঘ উপেক্ষার পরিপ্রেক্ষিতেই কিষানসভা সংগঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কৃষক আন্দোলন জঙ্গি হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কিষানসভার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে। এর পর থেকেই কিষানসভা ও কৃষক আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে।
বিশ শতকে ভারতে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রধান কারণগুলি কী ছিল? এই পর্বে কোন্ কোন্ সময় শ্রমিক আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে?
বিশ শতকে ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ভূমিকা –
বিশ শতকে ভারতবর্ষে সংঘটিত শ্রমিক আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন পথে পরিচালিত করে। মূলত উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে একাধিক কলকারখানা গড়ে ওঠে এবং শ্রমিকশ্রেণির আবির্ভাব হয়। বিভিন্ন কারণে তারা আন্দোলন শুরু করেছিল।
ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান কারণসমূহ –
বিশ শতকে ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান কারণগুলি হল –
- মজুরি হ্রাস – কারখানাগুলিতে কর্মরত শ্রমিকদের কাজের তুলনায় অতি সামান্য মজুরি দেওয়া হত। বিশেষত নারী ও শিশুশ্রমিকদের মজুরি ছিল খুবই কম যা তাদের আর্থিক দুর্দশা বৃদ্ধি করে।
- নিরাপত্তাহীনতা – অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনোরকম চিকিৎসার সুযোগ ছাড়াই অতি কষ্টে শ্রমিকরা দিনযাপন করত, যার ফলে তাদের মনে অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হতে থাকে।
- সংগঠিত আন্দোলনের সূচনা – ব্রিটিশ শাসনে অত্যাচারিত ও ক্ষুব্ধ এই শ্রমিকশ্রেণি জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়।
বিশ শতকের সক্রিয় শ্রমিক আন্দোলন –
বিশ শতকে ভারতে বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন, 1920 খ্রিস্টাব্দের অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন, 1930 খ্রিস্টাব্দের আইন অমান্য আন্দোলন ও 1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে 1945 খ্রিস্টাব্দে 820টি এবং 1946 খ্রিস্টাব্দে 1629টি শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হয়।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বাংলার শ্রমিকদের ভূমিকা আলোচনা করো।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বাংলার শ্রমিকদের ভূমিকা –
বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে, তা প্রধানত বাংলাতেই প্রবল ছিল। কংগ্রেসের সমর্থন থাকায় মধ্যবিত্তশ্রেণি এই আন্দোলনে যোগদান করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন আঞ্চলিক বিষয় হওয়ায় বা অন্য কারণে শ্রমিকশ্রেণিও এই আন্দোলনে যোগ দেয়।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বাংলার শ্রমিকদের উদ্দেশ্য –
এই আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির যোগদানের উদ্দেশ্য কেবল আর্থিক দাবি বিষয়ে ছিল না, তারা জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। তাদের বোঝানো হয়েছিল, জাতীয় আন্দোলনের সাফল্যের সঙ্গে শ্রমিকদের ভাগ্য জড়িত। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান না ঘটলে শ্রমিকদের মুক্তি ঘটবে না।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বাংলার শ্রমিকদের নেতৃত্ব –
এই সময়ের পেশাদার রাজনীতিকরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন – প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, অপূর্ব কুমার ঘোষ, অশ্বিনী কুমার ব্যানার্জি, প্রেমতোষ বসু এবং অম্বিকাচরণ ব্যানার্জি। তাঁরা সরকারি ছাপাখানা, পাটকল, রেল, বন্দর প্রভৃতি কর্মকেন্দ্রের শ্রমিক ও কর্মচারীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। তাঁদের উৎসাহে শ্রমিকেরা ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে।
শ্রমিক ধর্মঘট –
1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ হয়। এই দিন সারা বাংলার কলকারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট হয়। হাওড়ার বার্ন কোম্পানির 12,000 শ্রমিক ধর্মঘট করে। বাংলার প্রধান শিল্প ছিল পাটশিল্প। এই সময় 37টি পাটকলের মধ্যে 18টিতে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। এর মধ্যে হাওড়ার বাউড়িয়ার ফোর্ট গ্লস্টার পাটকলের ধর্মঘট ছিল উল্লেখযোগ্য। এখানকার শ্রমিকেরা ‘রাখিবন্ধন’ উৎসব পালন করে। তারা ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দেয়।
এই আন্দোলনের সময় কলকাতা ও খিদিরপুরের বন্দর শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে। কলকাতার সরকারি ছাপাখানার কর্মীরা ধর্মঘটে যোগ দেয়। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এদের নিয়ে প্রিন্টারস অ্যান্ড কম্পোজিটার্স লিগ গঠন করেন। চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে রেলকর্মীরা ধর্মঘট করে।
মূল্যায়ন –
এভাবে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি অংশগ্রহণ করে। ধর্মঘটের ফলস্বরূপ অসুবিধা ও সমস্যাকে অগ্রাহ্য করে শ্রমিকেরা সামাজিক শ্রেণি হিসেবে তাদের গুরুত্বের পরিচয় দেয় এবং জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোতের অংশীদার হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্রের মতে, শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে স্বদেশি আন্দোলন ছিল একটি দিকচিহ্ন।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের আগে গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত আহমেদাবাদ সত্যাগ্রহের বর্ণনা দাও।
আহমেদাবাদ সত্যাগ্রহের ভূমিকা –
1915 খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর মহাত্মা গান্ধি সত্যাগ্রহের ভিত্তিতে তিনটি আঞ্চলিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল আহমেদাবাদের শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন, যা আহমেদাবাদ সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত।
আহমেদাবাদ সত্যাগ্রহের কারণ –
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলন ক্রমশ সংগ্রামমুখী চরিত্র গ্রহণ করে। এর কারণ ছিল বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাই, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, বাণিজ্যিক মন্দা ও অবশিল্পায়ন।
- যুদ্ধের খরচ মেটাতে ব্রিটিশ সরকার শ্রমিকদের উপর 50 শতাংশ কর ধার্য করলে শ্রমিকদের সামগ্রিক জীবন শোচনীয় হয়ে পড়ে ও তারা স্বাভাবিকভাবেই সংঘবদ্ধ আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।
আহমেদাবাদ সত্যাগ্রহের পরিণতি –
- আহমেদাবাদের সুতাকল শ্রমিকরা মালিকদের কাছে মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানালে মহাত্মা গান্ধি এসময় শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। কিন্তু মালিকরা রাজি না হওয়ায় গান্ধিজি শ্রমিকদের ধর্মঘট করার পরামর্শ দেন।
- শেষপর্যন্ত শ্রমিকদের ধর্মঘটের চাপে মালিকপক্ষ 35 শতাংশ মজুরি বৃদ্ধিতে রাজি হয়।
আহমেদাবাদ সত্যাগ্রহের উপসংহার –
আহমেদাবাদ সত্যাগ্রহ পরিচালনার মধ্য দিয়ে গান্ধিজির ভারতের রাজনীতিতে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় ও তাঁর নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণির সংঘবদ্ধতা বলিষ্ঠ রূপ লাভ করে।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন পর্বে বাংলায় শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
শ্রমিক আন্দোলনের ভূমিকা –
মহাত্মা গান্ধি পরিচালিত সর্বভারতীয় গণ আন্দোলনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন পর্বে বাংলায় শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রগতি –
1921 খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে সারা দেশব্যাপী অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে বাংলায় এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ে। শ্রমিকশ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যোগ দেয়।
- আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য – শ্রমিকশ্রেণি বিভিন্ন দাবিদাওয়া পূরণের লক্ষ্যে মূলত এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল, যেমন – মজুরি বৃদ্ধি, কাজের সময়সীমা হ্রাস প্রভৃতি।
- নেতৃত্ব প্রদান – অসহযোগ আন্দোলন পর্বে বাংলায় শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, সুরেন্দ্রনাথ হালদার, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত প্রমুখ।
- বাংলার বিভিন্ন স্থানে ধর্মঘট –
- অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ইউরোপীয় মালিকানাধীন পাটকলের শ্রমিকরা ধর্মঘট করে।
- এ ছাড়া হাওড়ার সেন্ট্রাল জুটমিল, গার্ডেনরিচ ক্লাইভ এবং সাউথ ইন্ডিয়ান জুটমিল-এর শ্রমিকেরা বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ধর্মঘট করে।
- স্বামী বিশ্বানন্দ ও স্বামী দর্শনানন্দের নেতৃত্বে রানিগঞ্জ, ঝরিয়া অঞ্চলের কয়লাখনির শ্রমিকেরা সংগঠিত হয়ে ধর্মঘট করে।
- যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত রেলপথ ও জলপথে স্টিমার পরিবহণের কর্মীদের সংগঠিত করেন এবং ধর্মঘট পালিত হয়।
শ্রমিক আন্দোলনের উপসংহার –
1922 খ্রিস্টাব্দের 5 ফেব্রুয়ারি চৌরিচৌরা হত্যাকাণ্ডের পর মর্মাহত গান্ধিজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে শ্রমিক আন্দোলনে ভাটা পড়ে। তবে অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল তা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য।
সাইমন কমিশনবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকদের অবদান কী ছিল?
সাইমন কমিশনবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকদের ভূমিকা –
ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক নীতি ছিল উপনিবেশগুলিকে ধাপে ধাপে স্বায়ত্তশাসনের উপযোগী করে তোলা। এই নীতি অনুসারে অন্যান্য উপনিবেশের মতো ভারতেও শাসনসংস্কার করা হয়। 1919 খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের কার্যকারিতা বিচার করার জন্য সাইমন কমিশন গঠিত হয়। কিছু ত্রুটির জন্য ভারতীয়রা এই কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।
সাইমন কমিশনবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকদের অবদান –
1927 খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে হরতাল পালিত হয়, শ্রমিক সংস্থাগুলি তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
- উদ্দেশ্য – নাগপুরে 1927 খ্রিস্টাব্দে AITUC-র বাৎসরিক অধিবেশনে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে সুসংগঠিত আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়।
- ধর্মঘট পরিচালনা –
- 1928 খ্রিস্টাব্দের 3 ফেব্রুয়ারি বোম্বাই বন্দরে সাইমন কমিশনের সদস্যরা এসে পৌঁছোলে শ্রমিকশ্রেণি ধর্মঘট করে এবং 30 হাজার শ্রমিকের একটি মিছিল বের করে।
- 1927 খ্রিস্টাব্দে বাংলার কমিউনিস্ট নেতা গোপেন চক্রবর্তী, ধরণী গোস্বামীর চেষ্টায় খঙ্গপুরের রেল কারখানায় ধর্মঘট হয়।
- এ ছাড়া 1928 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা কর্পোরেশনে ঝাড়ুদার ও কর্মী ধর্মঘট, চেঙ্গাইল ও বাউড়িয়ার পাটকলে শ্রমিক ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়।
- পরিণতি – সাইমন কমিশনবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা যায়। নিজেদের দাবিদাওয়া অর্জনের সংগ্রামে তারা মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। যদিও ব্রিটিশ সরকার তাদের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনি, উপরন্তু শ্রমিক আন্দোলন বন্ধের জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। শেষপর্যন্ত 1929 খ্রিস্টাব্দে 33 জন কমিউনিস্ট ও শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার তাদের বিরুদ্ধে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা – টীকা লেখো।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার ভূমিকা –
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে 1920-র দশক ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা, সাইমন কমিশনবিরোধী বিক্ষোভ, অন্যদিকে বামপন্থার আবির্ভাব ভারতীয় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে গতির সঞ্চার করেছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকার বামপন্থার অগ্রগতি ও শ্রমিক আন্দোলনকে অঙ্কুরে বিনাশ করার জন্য যে বিবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তার মধ্যে অন্যতম হল 1929 খ্রিস্টাব্দের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট –
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট নিম্নে আলোচনা করা হল –
- শ্রমিক বিক্ষোভ – এসময় প্রধানত বাংলার পাটকল এবং আহমেদাবাদ শিল্পাঞ্চলের সুতাকল শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে ওঠা বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি ধর্মঘট চালায় যা মালিক ও সরকার পক্ষকে চরম বিব্রত করে তুলেছিল।
- ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও প্রভাব – ভারতের কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বাই ও লাহোরে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে উঠলে শ্রমিক ও মজুরদের মধ্যে এই দল প্রভাব বিস্তার করে। শ্রমিকশ্রেণির অবিরাম বিক্ষোভ ব্রিটিশ সরকারকে আতঙ্কিত করে তোলে।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার সূচনা –
- 1929 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বোম্বাইতে শ্রমিকশ্রেণি সাধারণ ধর্মঘট পালন করলে তা কঠোর হাতে দমনের জন্য সরকার নানা দমনমূলক পন্থা অনুসরণ করে।
- সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণের জন্য সমগ্র ভারতের খ্যাতনামা 33 জন কমিউনিস্ট ও শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন মুজফ্ফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, পি সি যোশি প্রমুখ।
- এই ঘটনার ফলে AITUC থেকে বামপন্থী নেতারা বিচ্ছিন্ন হয়ে রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (RTUC) গঠন করে। এর ফলে শ্রমিক আন্দোলন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার উপসংহার –
1929 থেকে 1933 খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ দীর্ঘ চার বছর ধরে মামলা চালিয়েও সরকার কমিউনিস্টদের মনোবলকে ভাঙতে পারেনি। পরোক্ষভাবে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ভারতে বামপন্থার প্রসারে সহায়তা করে।
আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিকদের ক্ষোভের কারণ কী ছিল? এই সময় বাংলায় শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিকদের ক্ষোভের ভূমিকা –
মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে পরিচালিত দ্বিতীয় সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন ছিল আইন অমান্য আন্দোলন। পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলির তুলনায় অংশগ্রহণের দিক থেকে আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক শ্রমিক এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।
আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিকদের ক্ষোভের কারণসমূহ –
আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিকদের ক্ষোভের বিভিন্ন কারণগুলি হল –
- বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দা – 1929 খ্রিস্টাব্দের বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দার প্রভাব ভারতে পড়েছিল। বিশেষত শ্রমিকশ্রেণি এই অর্থনৈতিক মন্দার দ্বারা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও তাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধে।
- দুরবস্থা – শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এর উপর অর্থনৈতিক মহামন্দাজনিত কারণে শিল্পকারখানাগুলি বন্ধ হয়ে গেলে তারা কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে।
বাংলায় শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রগতি –
1930 খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। বাংলার শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকাও ছিল এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
- বালি পাটকলের শ্রমিকেরা এসময় ধর্মঘট করে। হাওড়া স্টেশনের কুলিরা কাজ বন্ধ করে দেয়। অশান্তির আশঙ্কায় সরকার হাওড়া স্টেশনে সৈন্য মোতায়েন করে।
- কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রেলওয়ে ও ট্রাম পরিবহণ শ্রমিকেরা আন্দোলনে যোগ দেয়।
আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করো।
আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা –
গান্ধিজির নেতৃত্বে যে সর্বভারতীয় গণ আন্দোলনগুলি পরিচালিত হয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল লবণ সত্যাগ্রহ বা আইন অমান্য আন্দোলন। তাই লবণের উপর কর বসানোকে কেন্দ্র করে গান্ধিজি আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেন। শ্রমিকেরাও এই আন্দোলনে যোগ দেয়।
আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির শ্রমিক ধর্মঘট –
1930 খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি ডান্ডির বেলাভূমি থেকে একমুঠো লবণ সংগ্রহ করেন। এইভাবে তিনি ইংরেজ সরকারের লবণ আইন ভঙ্গ করেন। এই আইনভঙ্গ ছিল প্রতীকী। এর সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়।
- মহারাষ্ট্র – গান্ধিজির গ্রেফতারের পর মহারাষ্ট্রের শোলাপুরের বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করে (7 মে)। বামপন্থা প্রভাবিত এই শ্রমিকেরা শোলাপুরে সরকারি প্রশাসনকে নিশ্চিহ্ন করে সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে তোলে। সাধারণ মানুষ ধর্মঘটি শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়ায়।
- বাংলা – বাংলাতে সীমিত শ্রমিক আন্দোলন হয়। বালি পাটকলের শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে। হাওড়া স্টেশনের কুলিরা কাজ বন্ধ করে দেয়।
- অন্যান্য রাজ্য – করাচি বন্দরের শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে বন্দর অচল করে দেয়। মাদ্রাজের বাকিংহাম বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে। বিহারের খনিশ্রমিকেরাও ধর্মঘটের পথ অবলম্বন করে।
আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির মূল্যায়ন –
আশা করা গিয়েছিল, বিশ্বমন্দার প্রভাব ভারতের সংগঠিত শ্রমিকদের আন্দোলনে যুক্ত করবে, কিন্তু তা হয়নি। অত্যন্ত সীমিতভাবে শ্রমিকশ্রেণি এই আন্দোলনে যোগ দেয়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করো।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা –
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলনই ছিল ভারতের শেষ গণ আন্দোলন। এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণিও যুক্ত হয়।
শ্রমিক আন্দোলন –
জাতীয় নেতারা গ্রেফতার হলে (8 আগস্ট, 1942) কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা 12 দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন (9 আগস্ট, 1942)। এই কর্মসূচিতে শিল্প ধর্মঘট, রেলপথ ও টেলিযোগাযোগ বন্ধ করা, খাজনা বন্ধ ও সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।
- বোম্বাই – এখানে 9-14 আগস্ট গণবিক্ষোভ ঘটে। শিল্পাঞ্চল ও বন্দর এলাকায় ধর্মঘট হয়। সরকারি প্রশাসন লোপ পায়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার পুলিশ ও সেনা তলব করে।
- গুজরাট – মজদুর মহাজন সংঘের পরিচালনায় আহমেদাবাদ বস্ত্রশিল্পে 1,25,000 শ্রমিক ধর্মঘট করে। এখানকার শ্রমিকেরা আজাদ সরকার নামে একটি সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে তোলে।
- বিহার – টাটা লৌহ-ইস্পাত কারখানার (TISCO) শ্রমিকেরা 10 আগস্ট থেকে টানা 13 দিন ধর্মঘট করে। তারা দাবি জানায়, জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা কাজে যোগ দেবে না। 12 আগস্ট ডালমিয়ানগরে শ্রমিক ধর্মঘট হয়।
- মহীশূর – ব্যাঙ্গালোর শিল্পাঞ্চল ও বিভিন্ন খনি অঞ্চলে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ গুলি চালায়।
- অন্যান্য রাজ্য – এগুলি ছাড়াও দিল্লি, লখনউ, কানপুর, নাগপুর, মাদ্রাজ, টেনালি, রামনাদ, কোয়েম্বাটোর ও কলকাতাতে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। এভাবে শ্রমিকশ্রেণি জাতীয় আন্দোলনের অংশীদার হয়ে ওঠে।
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির ভূমিকা –
ভারতের শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মানুষকে সংগঠিত করে আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির প্রতিষ্ঠা –
বাংলা, বোম্বাই, পাঞ্জাব এবং যুক্তপ্রদেশে প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য 1927 খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি গঠিত হয়।
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির সদস্যবৃন্দ –
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির বাংলা দলের সম্পাদক ছিলেন মুজফ্ফর আহমেদ, পাঞ্জাব শাখার মোহন সিং যোশ, বোম্বাই শাখার এস এস মিরাজকর এবং যুক্তপ্রদেশের সম্পাদক ছিলেন পিসি যোশি। বাংলায় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টিতে বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্ত কুমার সরকার, গোপেন চক্রবর্তী ও ধরণী গোস্বামীর নামও যুক্ত ছিল।
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির কার্যকলাপ –
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির নেতৃত্বে কমিউনিস্ট আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তবে এই দলের কার্যকলাপ শহরে ও শিল্পাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণির কমিউনিস্ট নেতাদের কার্যকলাপ মূলত শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনায় নিয়োজিত হয়েছিল। তাই কমিউনিস্ট আদর্শ শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তবে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি কৃষক আন্দোলনের প্রতি গুরুত্ব না দেওয়ায় কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্যবাদী প্রভাব তেমনভাবে প্রসারিত হয়নি।
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির অবদান –
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি সাম্যবাদী ভাবধারা প্রসারের জন্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশ করেছিল। যেমন – বোম্বাইয়ে ‘ক্রান্তি’, লাহোরে ‘কীর্তি কিষান’, মাদ্রাজে ‘ওয়ার্কার’ ইত্যাদি। এই সকল পত্রপত্রিকার মাধ্যমে সারা ভারতে সাম্যবাদের প্রচার সহজ হয়েছিল।
ওয়ার্কার্স ও পেজেন্টস পার্টি কেন গড়ে উঠেছিল? এর উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি কী ছিল?
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির ভূমিকা –
ভারতে বামপন্থীরা শ্রমজীবী মানুষের শোষণমুক্তির জন্য ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি গঠন করেন। এস এ ডাঙ্গে, মুজফ্ফর আহমেদ, পি সি যোশি এবং মোহন সিং যোশ -এর নেতৃত্বে 1927 খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি (WPP) প্রতিষ্ঠিত হয়।
ওয়ার্কার্স ও পেজেন্টস পার্টি গঠনের কারণ –
ওয়ার্কার্স ও পেজেন্টস পার্টি গঠনের পিছনে বিভিন্ন কারণ সক্রিয় ছিল। যথা –
- বামপন্থী ভাবধারার বিস্তার – 1920 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার তাসখন্দে ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর 1925 খ্রিস্টাব্দে কানপুরে ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’ গড়ে তোলা হয়। ইংরেজ সরকারের দমননীতি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট নেতারা গোপনে তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করতে থাকে। এই সময় তারা শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বামপন্থী মতাদর্শ প্রচার ও তাদের সংগঠিত করার জন্য ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি গঠনের চেষ্টা করেন।
- সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা – ভারতের শ্রমজীবীদের মুক্তি আন্দোলনে বিশেষত পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণিকে সংঘবদ্ধ করার জন্য একটি সংগঠনের প্রয়োজন ছিল। এই কারণে ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’ গঠিত হয়।
- সর্বভারতীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা – শহরের শিল্পশ্রমিক ও গ্রামের কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির প্রতিষ্ঠা এই প্রয়োজনকে বহুলাংশে পূরণ করেছিল।
ওয়ার্কার্স ও পেজেন্টস পার্টির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি –
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ।
- সুসংগঠিত আন্দোলন পরিচালনা – শ্রেণিসংগ্রাম, বিনা ক্ষতিপুরণে জমিদারি প্রথা লোপ, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, সংবাদপত্র ও বাকস্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকারদান প্রভৃতি দাবিদাওয়া তুলে এই সংগঠন শ্রমিক ও কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।
- পত্রপত্রিকার মাধ্যমে প্রচার – ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’ বিভিন্ন আঞ্চলিক পত্রপত্রিকার মাধ্যমে শ্রমজীবীদের মধ্যে প্রচার চালায়। এই সংগঠনের বাংলা শাখার মুখপত্র ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’, মাদ্রাজ শাখার মুখপত্র ‘ওয়ার্কার’ প্রভৃতি কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে বামপন্থী ভাবধারা ও ঐক্যবোধ জাগরণে সাহায্য করে।
কমিউনিস্ট ভাবধারা ও শ্রমিক আন্দোলনের প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কয়েকটি উদ্যোগের উল্লেখ করো।
কমিউনিস্ট ভাবধারা ও শ্রমিক আন্দোলনের ভূমিকা –
বিশের দশকে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্ভব ও কমিউনিস্ট আন্দোলন পরিচালনা ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে এক নতুন ধারার সূত্রপাত করেছিল। শ্রমিক ও কৃষকদের নেতৃত্ব দান করে কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে। তবে কমিউনিস্টদের এই প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধিকে সরকার সুনজরে দেখেনি। কমিউনিস্ট ভাবধারা ও শ্রমিক আন্দোলনের প্রসারের
কমিউনিস্ট ভাবধারা ও শ্রমিক আন্দোলনের প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উদ্যোগসমূহ –
কমিউনিস্ট ভাবধারা ও শ্রমিক আন্দোলনের প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গৃহীত কয়েকটি উদ্যোগ হল –
- জননিরাপত্তা ও শিল্পবিরোধ বিল – ব্রিটিশ সরকার 1928 খ্রিস্টাব্দে জননিরাপত্তা বিল ও শিল্পবিরোধ বিল নামে দুটি দমনমূলক বিলের মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলনের প্রসার রোধ ও শ্রমিক ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
- হুইটলি কমিশন গঠন – শ্রমিক আন্দোলনের প্রসার রোধ করে তা দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সরকার 1929 খ্রিস্টাব্দে হুইটলি কমিশন গঠন করে।
- মিরটি ষড়যন্ত্র মামলা – রুশ বিপ্লব, ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার হলে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। 1929 খ্রিস্টাব্দে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে 33 জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করলে শ্রমিক আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
- কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা – 1934 খ্রিস্টাব্দে শ্রমিক আন্দোলনের পিছনে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন ও সক্রিয়তা লক্ষ করে ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। ফলে শ্রমিক আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
শ্রমিক আন্দোলন ও AITUC – টীকা লেখো।
শ্রমিক আন্দোলন ও AITUC -এর ভূমিকা –
শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে 1920 খ্রিস্টাব্দের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের (AITUC) প্রতিষ্ঠা। 1920 খ্রিস্টাব্দের 30 অক্টোবর বোম্বাই শহরে লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে এর প্রথম অধিবেশন বসে। চমনলাল ছিলেন AITUC -এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক। সারা দেশ থেকে 806 জন প্রতিনিধি এই সমাবেশে যোগ দেন। এই ধরনের একটি সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক।

AITUC -এর নেতৃত্ব –
লালা লাজপত রায় ছাড়াও অন্যান্য যেসকল বিশিষ্ট জাতীয় স্তরের নেতা এই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে মোতিলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, অ্যানি বেসান্ত, জিন্না প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। AITUC -এর মাধ্যমে শ্রমিকরা একটি শক্তিশালী সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এই AITUC -এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার ফলে শ্রমিক আন্দোলনে গতি আসে।

লালা লাজপত রায় ও তাঁর চিন্তাধারা –
সভাপতির ভাষণে লালা লাজপত রায় ভারতের শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি আশা প্রকাশ করতেন যে, যদিও নেতৃত্বের জন্য শ্রমিকরা কিছুদিন বুদ্ধিজীবীদের সাহায্য ও সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল থাকবে, তথাপি শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই নিজেদের নেতা খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে।
পরবর্তী সময়ের নেতৃত্ব –
লালা লাজপত রায় ছাড়াও এই সময় কংগ্রেসের অন্যান্য বিশিষ্ট নেতারাও শ্রমিক আন্দোলন ও AITUC -এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, সি এফ অ্যান্ড্রুজ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু ও সত্যমূর্তি প্রমুখ। AITUC -এর তৃতীয় এবং চতুর্থ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন চিত্তরঞ্জন দাশ। 1922 খ্রিস্টাব্দের বাৎসরিক অধিবেশনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস AITUC -কে স্বাগত জানায় এবং ট্রেড ইউনিয়নের কাজে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন দিকে সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে, দক্ষ কর্মী ও অদক্ষ কর্মীবৃন্দ সবাই এর সদস্য হওয়ার জন্য হাত বাড়াতে থাকে। 1920 খ্রিস্টাব্দে 125টি ইউনিয়ন গড়ে ওঠে এবং নথিবদ্ধ সদস্যসংখ্যা সেই সময় বেড়ে দাঁড়ায় 2,50,000-এ।
মূল্যায়ন –
এইভাবে ভারতে শ্রমিকশ্রেণির বিক্ষোভ আন্দোলন AITUC -এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত হয়েছিল। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে তাই এর অবদান অনস্বীকার্য।
ভারতে শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা আলোচনা করো।
ভারতে শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা –
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই 1920 খ্রিস্টাব্দে শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় সংস্থা অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে বিভিন্ন শিল্পের বিভিন্ন আঞ্চলিক শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল। তবে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শ্রমিক আন্দোলনে গতির সঞ্চার হয়।
কমিউনিস্ট পার্টি –
1920 খ্রিস্টাব্দের 17 অক্টোবর রাশিয়ার তাসখন্দে ভারতীয় বিপ্লবীরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের অনেকে ভারতে এসে লাহোর, বোম্বাই, মাদ্রাজ, কলকাতায় কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। তারা ‘মে দিবস’ পালন করেন। এই ঘটনার মধ্যে ব্রিটিশ সরকার ‘বলশেভিক সংকেত’ দেখতে পায়। এজন্য সরকার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে কমিউনিস্টদের জড়িয়ে দেয়।
শ্রমিক সংগঠন –
1926 খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে মুজফ্ফর আহমেদ ও অন্যান্যরা ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ‘লাঙল’ ও ‘গণবাণী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির শাখা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে (1927 খ্রিস্টাব্দ)। কমিউনিস্টদের চেষ্টায় বোম্বাই-এ গিরনি-কামগড় ইউনিয়ন গড়ে ওঠে (1928 খ্রিস্টাব্দ)। এভাবে কমিউনিস্টরা বিভিন্ন শিল্পের শ্রমিকদের সংগঠিত করতে থাকে।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা –
ব্রিটিশ সরকার 33 জন কমিউনিস্ট ও শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন মুজফ্ফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, এস এস মিরাজকর প্রমুখ। এর ফলে AITUC থেকে বামপন্থী নেতারা বিচ্ছিন্ন হয়ে রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (RTUC) গঠন করে। এর ফলে শ্রমিক আন্দোলন একটু দুর্বল হয়ে পড়ে।
আইন অমান্য আন্দোলন –
আইন অমান্য করে গান্ধিজি গ্রেফতার হলে (6 মে) শ্রমিকেরা তার প্রতিবাদ জানায়। মহারাষ্ট্রের শোলাপুরের বস্ত্রশিল্প শ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করে (7 মে)। শোলাপুরে সরকারি প্রশাসন লোপ পায়। সেখানে সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে ওঠে। স্থানীয় মানুষ ধর্মঘটি শ্রমিকের পাশে এসে দাঁড়ায়। বোম্বাই শিল্পাঞ্চলে গিরনি-কামগড় ইউনিয়ন লাগাতার ধর্মঘট করে। বোম্বাই-এ জি আই পি রেলওয়ে মেনস ইউনিয়ন লাল পতাকা লাগিয়ে রেল পরিবহণ বন্ধ মোকাবিলায় সরকার সেনা তলব করে। করে দেয়। পরিস্থিতি কমিউনিস্টরা আশ্রয় নেয়। আবার শ্রমিক আন্দোলনে গতি আসে।
CSP প্রতিষ্ঠা –
কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি-তে (CSP) 1933 খ্রিস্টাব্দে 946টি এবং 1934 খ্রিস্টাব্দে 159টি ধর্মঘট হয়। 2,00,000 -এর বেশি শ্রমিক তাতে অংশ নেয়।
মূল্যায়ন –
এভাবে কমিউনিস্টরা শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামের হাতিয়ারে পরিণত করে। ব্রিটিশ সরকারকে আতঙ্কিত করে তাদের দাবিদাওয়া আদায়ে সক্ষম হয়।
শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে বামপন্থী নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল?
বামপন্থী আন্দোলনের ভূমিকা –
ভারতে 1920 খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট বা বামপন্থী আন্দোলনের বিকাশ ঘটেছিল। এর ফলে ভারতে এক নবযুগের সূচনা হয়। বিপানচন্দ্র এইজন্য বলেছেন, ‘বামপন্থী গোষ্ঠীর উদ্ভবের ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছিল।
শ্রমিক আন্দোলন ও বামপন্থী নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি –
বামপন্থী বা কমিউনিস্ট রাজনীতি কোনো সময়েই ভারতের জাতীয় আন্দোলনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। তবে শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের জন্য তাদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। মার্কসবাদী ও কমিউনিস্টদের বৃহৎ অংশ কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত থেকে
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে – 1928 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে পুষ্ট করেছিল। ওই বছর কলকাতা কংগ্রেসে কমিউনিস্টদের উদ্যোগে প্রায় 50 হাজার শ্রমিক মিছিল করে। 1929 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সাইমন কমিশনবিরোধী আন্দোলনেও মিছিল ও ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করে তুলেছিলেন বামপন্থী নেতৃবৃন্দ।
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে – সারা পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এদেশেও কমিউনিস্টরা শ্রমিক তথা খেটে খাওয়া মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়। বোম্বাইয়ে ‘নৌবিদ্রোহ’ (1946 খ্রিস্টাব্দ), বাংলায় ‘তেভাগা আন্দোলন’ (1946-1951 খ্রিস্টাব্দ)-এ শ্রমিকশ্রেণি ও কৃষকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছিল কমিউনিস্টরা।
মূল্যায়ন –
শ্রমিকশ্রেণিকে যথার্থ সমাজতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ সর্বদা সজাগ ছিলেন। রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি ভারতীয় শ্রমিকশ্রেণি যাতে অর্থনৈতিক শোষণের কবল থেকেও মুক্তিলাভ করতে পারে সেইজন্য সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর সমাজতান্ত্রিক উপায়ে সংস্কারের জন্য বামপন্থী নেতৃত্ব সক্রিয় ছিল। 1929 খ্রিস্টাব্দের বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দার প্রভাব সমাজতন্ত্রের প্রতি ভারতীয় শ্রমিকদের আকৃষ্ট করে তোলে। সমাজতন্ত্রই যে অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় তা এদেশের শ্রমিকশ্রেণিকে প্রথম বুঝতে শিখিয়েছিল বামপন্থী নেতৃবৃন্দ।
শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে কংগ্রেস ও গান্ধিজির দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল?
শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে কংগ্রেস ও গান্ধিজির ভূমিকা –
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এদেশে ব্রিটিশের হাত ধরে যথার্থ আধুনিক শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। এর মধ্য দিয়ে একদিকে শ্রমিকসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং তার সঙ্গে বেড়ে চলে শ্রমিকের উপর শোষণের মাত্রা। ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এবং সেই দলের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি মহাত্মা গান্ধির ভূমিকা এক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে।
কংগ্রেস ও শ্রমিক আন্দোলন –
কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে গান্ধিজির নীতি ছিল অস্পষ্ট। এ ছাড়াও শ্রমিকশ্রেণির দাবিদাওয়াগুলিকে কংগ্রেসের আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টা কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে দেখা যায়নি। কারণ – নরমপন্থী পর্যায়ে (1885-1905 খ্রিস্টাব্দ) অধিকাংশ কংগ্রেস নেতাই ছিলেন হয় বড়ো জমিদার না হয় শিল্পপতি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা শ্রমিকশ্রেণির বিষয়ে ভাবিত ছিলেন না।
গান্ধিজি ও শ্রমিক আন্দোলন –
ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধিজির অনুপ্রবেশ যে তিনটি আঞ্চলিক সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে হয়েছিল তার একটি ছিল আহমেদাবাদ শিল্পশ্রমিকদের সত্যাগ্রহ। অথচ চিরাচরিতভাবে তিনি শ্রমিকদের আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন না। 1921 খ্রিস্টাব্দে ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় তিনি লেখেন, ‘আমরা ধন বা ধনিকশ্রেণির ধ্বংস চাই না, ধনিক ও শ্রমিকদের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। সহানুভূতি দেখাবার জন্য ধর্মঘট করা মূর্খতা।’ যে কারণেই হোক না কেন, গান্ধিজি চাননি শ্রমিকশ্রেণি মালিকপক্ষের বিরুদ্ধাচরণ করুক।
অহিংস-অসহযোগ, আইন অমান্য, ভারত ছাড়ো – কোনো আন্দোলনেই গান্ধিজি সরাসরি শ্রমিকশ্রেণিকে যুক্ত করতে চাননি। বস্তুত গান্ধিজির জন্যই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী মেলবন্ধন ঘটেনি। ফলে জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে শ্রমিকশ্রেণির মোহভঙ্গ হয়। গান্ধিজি জাতীয় আন্দোলনগুলির আঙিনায় সাধারণ জনগণরূপে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ কামনা করেন, অথচ তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে কংগ্রেসের কর্মসূচির মধ্যে সরাসরি মেলাতে চাননি।
মূল্যায়ন –
গান্ধিজি শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর কাছে গঠনমূলক শ্রমিক সংগঠন কাম্য, জঙ্গি আন্দোলন নয়। শ্রমিক ও শিল্পমালিক – পরস্পরবিরোধী অবস্থানের এই দুই শক্তিকে তিনি মেলাতে চেয়েছিলেন উভয়ের সাধারণ শত্রু ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্বে যতদূর সম্ভব গান্ধিজি আপস মীমাংসার পক্ষপাতী ছিলেন।
নৌবিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব লেখো।
নৌবিদ্রোহের ভূমিকা –
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য আন্দোলন হল ভারতীয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহ।
নৌবিদ্রোহের কারণসমূহ –
ভারতীয় নৌসেনাদের এই বিদ্রোহের পিছনে বেশ কতকগুলি কারণ বিদ্যমান ছিল –
- বর্ণবৈষম্য – ভারতীয় নৌবাহিনীতে প্রবল বর্ণবৈষম্য ছিল। একই কাজে বা পদে নিযুক্ত ইংরেজ নাবিকরা ভারতীয়দের চেয়ে অনেক বেশি বেতন ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা পেত। ফলে ভারতীয় নৌসেনারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
- নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ – সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় নৌসেনাদের অসন্তোষের অন্যতম কারণ ছিল তাদের নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ করা হত। তীব্র প্রতিবাদেও কোনো সুরাহা না হওয়ায় তাদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল।
- আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচার – পরাজিত আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈন্যদের লালকেল্লায় বিচার শুরু হলে দেশের জনগণের সঙ্গে ভারতীয় নৌসেনারাও ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব –
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
- হিন্দু-মুসলিম ঐক্যসাধন – নৌবিদ্রোহ ভারতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিল। হিন্দু-মুসলিম নাবিক, সাধারণ মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের ধারণাকে মজবুত করেছিল এই বিদ্রোহ।
- ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষণা – নৌবিদ্রোহের ফলে যে ভারতের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ত্বরান্বিত হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষণা করে।
- মন্ত্রীমিশনের আগমন – নৌবিদ্রোহের ফলে আতঙ্কিত ইংরেজ সরকার শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের সঙ্গে আলোচনা করতে মন্ত্রীমিশনকে ভারতে পাঠায়। 18 ফেব্রুয়ারি নৌবিদ্রোহ শুরু হয় এবং পরের দিন ভারতে মন্ত্রীমিশন পাঠানোর কথা সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়।
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের উদ্ভব হয় কীভাবে?
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের ভূমিকা –
দাদাভাই নৌরজি তাঁর ‘পভার্টি অ্যান্ড আনব্রিটিশ বুল ইন ইন্ডিয়া’ (Poverty and Unbritish Rule in India) গ্রন্থে বলেন যে, ‘শোষণ বন্ধ না হলে ভারতের দারিদ্র্যমোচন সম্ভব নয়।’ এই তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার বিকাশ দেখা যায় এবং এর ফলে 1920 খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতের রাজনীতিতে বামপন্থী প্রভাব পড়ে। 1930 খ্রিস্টাব্দে এই প্রভাব আরও বেড়ে যায়। কংগ্রেস ও গান্ধিজির উপর অনেকে ক্ষুব্ধ হন। ফলে বামপন্থী মতাদর্শের ভিত্তিতে কয়েকটি দল গড়ে ওঠে। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ছিল এগুলির মধ্যে অন্যতম।
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের কারণ –
এই দল প্রতিষ্ঠার কারণগুলি হল –
- কংগ্রেসের দ্বিতীয় পর্যায়ের (1932-1934 খ্রিস্টাব্দ) আইন অমান্য আন্দোলন, ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি, বিহারের ভূমিকম্পে প্রাণহানি প্রভৃতি বিষয়ে কংগ্রেসের দৃঢ়তার অভাব।
- সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে গান্ধিজি ও তাঁর অনুগামীদের বিরূপ ধারণা।
- গান্ধিজির আন্দোলনের পদ্ধতি সম্বন্ধে বামপন্থীদের বিরূপ মনোভাব।
- কংগ্রেসের বামগোষ্ঠীর শক্তিবৃদ্ধি ইত্যাদি।
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের নেতৃত্ব –
আইন অমান্য আন্দোলনের সময় নাসিক জেলে কংগ্রেসের বামগোষ্ঠীর নেতারা, যেমন – জয়প্রকাশ নারায়ণ, অচ্যুত পট্টবর্ধন, রামমনোহর লোহিয়া, ইউসুফ মেহের আলি, মিনু মাসানি প্রমুখ বন্দি ছিলেন। তাঁদের চেষ্টায় আচার্য নরেন্দ্র দেবের সভাপতিত্বে পাটনায় কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি (CSP) প্রতিষ্ঠিত হয় (এপ্রিল, 1934 খ্রিস্টাব্দ)। পরে এ কে গোপালন, ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ এই দলে যোগ দেন।

কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের কর্মসূচি –
যুক্তপ্রদেশের কংগ্রেস নেতা সম্পূর্ণানন্দ দলের কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। শিল্প-বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, রাজতন্ত্র তথা জমিদারতন্ত্রের বিলোপ, কৃষকদের হাতে জমিবণ্টন, কৃষিঋণ মকুব, কাজের অধিকার ও শ্রমিকের জন্য ন্যায্য মজুরি এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের বিস্তার –
কমিউনিস্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় দলের নেতা-কর্মীরা এই দলকে (CSP) মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে। কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা এই দলে যোগ দেন। পি কে পিল্লাই, এম এ ব্রেলভির নাম এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য। ফলে দক্ষিণ ভারত ও যুক্তপ্রদেশে দলের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের পরিণতি –
দলের তৃতীয় সম্মেলনে (1936 খ্রিস্টাব্দ) সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে কোনো গণ আন্দোলন হয়নি। দলের একাংশ গান্ধিবিরোধী হলেও সবাই তা ছিলেন না। দল সারা ভারতে সংগঠন তৈরি করতে পারেনি। দলের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত ছিল। 1937 খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে দল কংগ্রেসকে সমর্থন করে। ফলে কমিউনিস্টরা দলত্যাগ করে। দলের আদর্শ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। ফলে দলটি অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙে যায়।
কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী প্রবণতা বৃদ্ধির নিদর্শন হিসেবে কংগ্রেসের ত্রিপুরি অধিবেশন গুরুত্বপূর্ণ কেন?
কংগ্রেসের ত্রিপুরি অধিবেশনের ভূমিকা –
1934 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে বোম্বাই-এ অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের প্রতিষ্ঠা কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী শক্তিবৃদ্ধির বিষয়টি প্রমাণ করে। এক্ষেত্রে বলা যায়, কংগ্রেসের ত্রিপুরি অধিবেশন ছিল কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী প্রবণতাবৃদ্ধির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
ত্রিপুরি অধিবেশন –
1938 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন এবং শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলিকে কংগ্রেসের অধীনে এনে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মঞ্চ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এরপর 1939 খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরি কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন এবং বিপক্ষে থাকা গান্ধিজি মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করেন।
কংগ্রেসের ত্রিপুরি অধিবেশনের প্রতিক্রিয়া –
সুভাষচন্দ্র বসুর এই জয়লাভ গান্ধিজি ও দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে অসন্তুষ্ট করে তোলে। কর্মসমিতি গঠন সংক্রান্ত বিষয়ে গান্ধিজির সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর মতপার্থক্য এসময় চরমে ওঠে। শেষপর্যন্ত নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির কলকাতা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু সভাপতির পদে ইস্তফা দিয়ে 1939 খ্রিস্টাব্দের 3 মে বামপন্থী ভাবধারা ও আদর্শের ভিত্তিতে গঠন করেন ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’।
কংগ্রেসের ত্রিপুরি অধিবেশনের উপসংহার –
তাই বলা যায়, ত্রিপুরি অধিবেশনের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী ভাবধারা সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে। যার চরম প্রকাশ ঘটে সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক ফরওয়ার্ড ব্লক দল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
কীভাবে ফরওয়ার্ড ব্লক দলের প্রতিষ্ঠা হয়?
ফরওয়ার্ড ব্লক দলের ভূমিকা –
সুভাষচন্দ্র বসু অসহযোগ আন্দোলনের সময় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। অসহযোগ এবং আইন অমান্য আন্দোলনে গান্ধিজির ভূমিকায় অনেক কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের মতো সুভাষচন্দ্র বসুও ক্ষুব্ধ হন। এই ক্ষোভ বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় এবং শেষে কংগ্রেসের মধ্যে ভাঙন ঘটায়।
কংগ্রেস সভাপতি –
1938 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু সভাপতি নির্বাচিত হন। এক্ষেত্রে তিনি কংগ্রেসের বামগোষ্ঠীর সমর্থন পেয়েছিলেন। পরের বছর 1939 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের ত্রিপুরি অধিবেশনেও তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন (1580-1377 ভোটের ব্যবধানে)। প্রতিপক্ষ ছিলেন গান্ধিজির মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়া। এই ঘটনায় কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়।
ফরওয়ার্ড ব্লক দলের মতভেদ –
কর্মসমিতি গঠনের বিষয়ে গান্ধিজির সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর মতভেদ ঘটে। গান্ধিজি তাঁর মনোনীত সদস্য নিয়ে কর্মসমিতি গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন। গোবিন্দ বল্লভ পন্থ ও অন্যান্য সদস্যরা তা সমর্থন করেন। কাজ চালানো অসম্ভব বুঝে সুভাষচন্দ্র বসু সভাপতি পদে ইস্তফা দেন (29 এপ্রিল, 1939 খ্রিস্টাব্দ)। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ তখন কংগ্রেস সভাপতি হন।
ফরওয়ার্ড ব্লক দলের বহিষ্কার –
কংগ্রেস নেতৃত্ব সুভাষচন্দ্র বসুকে রাজনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত করতে চেয়েছিল। সুভাষচন্দ্র বসু তার বিরুদ্ধে ‘প্রতিবাদ দিবস’ আহ্বান করেন (9 জুলাই, 1939 খ্রিস্টাব্দ)। বল্লভভাই প্যাটেল এজন্য একটি শাস্তিমূলক প্রস্তাব আনেন। তাতে বলা হয়, কংগ্রেস কমিটির আগাম অনুমতি ছাড়া কোনো কংগ্রেসি ব্যক্তিত্বই আইন অমান্য করতে পারবে না। 11 জুলাই সুভাষচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়।

ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন –
এর আগেই কংগ্রেসের বামগোষ্ঠীর নেতা নরিম্যান, হরিবিয়ু কামাথ প্রমুখের সাহায্যে সুভাষচন্দ্র বসু ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (3 মে, 1939 খ্রিস্টাব্দ)। বামসমন্বয় কমিটি গঠনের জন্য তিনি জয়প্রকাশ নারায়ণ ও মানবেন্দ্রনাথ রায়ের কাছে আবেদন জানান। কিন্তু তাঁরা সহযোগিতার বদলে বিরোধিতা করেন।
ফরওয়ার্ড ব্লক দলের কর্মসূচি –
জমিদারি ব্যবস্থা লোপ, কৃষকের হাতে জমিদান, শিল্পের জাতীয়করণ, সাম্রাজ্যবাদের অবসান, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠা ছিল এই দলের অন্যতম লক্ষ্য।
ফরওয়ার্ড ব্লক দলের মূল্যায়ন –
এই দলের শাখা বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও দল তেমন জনসমর্থন পায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, ইটালি, জাপানের সাহায্য নিয়ে ভারত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসানের জন্য নেতাজি দেশত্যাগ করেন। তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করে ভারত অভিযান করেন, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। তবু জাতীয় সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান অনস্বীকার্য।
বামপন্থা কীভাবে শ্রমিক আন্দোলনকে সংগঠিত করেছিল, তা সংক্ষেপে লেখো।
ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলন –
শ্রমিক আন্দোলনের পিছনে বামপন্থী বা কমিউনিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। মূলত 1917 খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের সাফল্যের পরবর্তীকালে ভারতে বামপন্থী রাজনীতি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। 1922 খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে বামপন্থীরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী তৈরি করেছিল। 1925 খ্রিস্টাব্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয়।
শ্রমিক আন্দোলনের প্রবাহধারা –
1920 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় শ্রমিক ইউনিয়নের সংখ্যা ছিল 40; 1922 খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যাটি 75-এ এসে পৌঁছোয়। বোম্বাইতে 1920 খ্রিস্টাব্দে শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল 7টি। 1922 খ্রিস্টাব্দে তা এসে পৌঁছোয় 29টিতে। এই সকল ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের নেতারা।
বামপন্থী নেতৃত্ব –
1926-1928 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলা, বোম্বাই, পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশে ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’ (Workers and Peasants Party, WPP) প্রতিষ্ঠার দ্বারা বামপন্থীরা শ্রমিক আন্দোলনকে সংগঠিত করে তোলেন। এই সময়কার বামপন্থী নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজফ্ফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, পি সি যোশি, বি পি ওয়াদিয়া, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, হেমন্ত বসু প্রমুখ। সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের মতো মার্কসবাদী নেতারা শ্রমিক আন্দোলনে এগিয়ে আসেন।
মার্কসবাদী পত্রিকা –
‘গণবাণী’, ‘শ্রমিক’ (বাংলায়), ‘ক্রান্তি’, ‘সোশ্যালিস্ট’ (বোম্বাই), ‘লেবার কিষান গেজেট’ (মাদ্রাজ), ‘কীর্তি কিষান’ ইত্যাদি কমিউনিস্ট মুখপত্র বা পত্রিকা শ্রমিক আন্দোলনের উদ্ভবের প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল। কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রসারে সরকার চিন্তিত হয়ে শিল্পবিরোধী বিল ও জননিরাপত্তা বিল প্রণয়ন করে, যার উদ্দেশ্য ছিল কমিউনিস্টদের দমন করা।
ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা –
1920 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1935 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ভারতে যে কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে তা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মার্কসবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ সমাজতন্ত্র, কৃষিসংস্কার ও শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়েই চিন্তা করেননি, তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিলোপসাধন।
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট –
কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ভারতের জাতীয় আন্দোলনে গতির সঞ্চার করেছিল –
- রাশিয়ায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা – বিশিষ্ট মার্কসবাদী মানবেন্দ্রনাথ রায় 1920 খ্রিস্টাব্দে মস্কোতে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে রাশিয়া যান। উক্ত বছরের অক্টোবর মাসে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জি, মহম্মদ আলি ও মহম্মদ সাফিক একত্রে রাশিয়ার তাসখন্দে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
- ভারতে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রসার – রাশিয়ার তাসখন্দে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এর বিভিন্ন সদস্য গোপনে ভারতে আসেন এবং ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এসময় লাহোর, মাদ্রাজ, বোম্বাই ও কলকাতায় বিভিন্ন কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এই গোষ্ঠীগুলি কানপুরে এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে 1925 খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করে। মাদ্রাজের বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার ছিলেন এই সম্মেলনের সভাপতি। এ ছাড়া অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন হসরৎ মোহানি এবং সাধারণ সম্পাদক হন সচ্চিদানন্দ বিষুঘাটে।
- নীতি ও আদর্শ – শ্রেণিহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠন, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনগণের আন্দোলনকে সমর্থন, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা, শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘব প্রভৃতি ছিল এই দলের প্রধান নীতি ও আদর্শ।
- শাখা সংগঠন প্রতিষ্ঠা – ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে একাধিক শাখা গড়ে ওঠে। এর মধ্যে মজদুর ও শ্রমিকদের জন্য ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি, গিরনি-কামগড় ইউনিয়ন, ভারতের ছাত্র ফেডারেশন প্রভৃতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির উপসংহার –
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে। তবুও ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
মানবেন্দ্রনাথ রায় কী জন্য বিখ্যাত?
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ভূমিকা –
মানবেন্দ্রনাথ রায় ওরফে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও বামপন্থী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ –
প্রথম জীবনে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। বাংলার বিখ্যাত বিপ্লবী বাঘা যতীন ছিলেন তাঁর বিপ্লবের দীক্ষাগুরু। 1915 খ্রিস্টাব্দে তিনি বিদেশ থেকে অস্ত্র আনতে গিয়েছিলেন এদেশের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রয়োজনে। বাঘা যতীনের প্রভাবেই মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বিপ্লবী মন্ত্রে হাতেখড়ি হয় এবং তিনি যুগান্তর দলে যোগদান করেন।
মেক্সিকো ও আমেরিকায় মানবেন্দ্রনাথ –
বুড়িবালামের যুদ্ধে বাঘা যতীনের মৃত্যু হলে মানবেন্দ্রনাথ প্রথমে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও পরে মেক্সিকোতে যান। সেখানে প্রখ্যাত রুশ বিপ্লবী মিখাইল বোরোদিনের সংস্পর্শে এসে সাম্যবাদী আদর্শে দীক্ষিত হন।
মেক্সিকো ও তাসখন্দে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা –
মিখাইল বোরোদিনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রথমে মেক্সিকোতে একটি কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে 24 জন ভারতীয় বিপ্লবীর সঙ্গে একযোগে রাশিয়ার তাসখন্দে 1920 খ্রিস্টাব্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা করেন।
কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ও মানবেন্দ্রনাথ –
সোভিয়েত রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের পর সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট মতাদর্শগুলিকে সুসংহত ও শক্তিশালী করার জন্য তৈরি হওয়া কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের বা কমিনটার্নের ভারতীয় প্রতিনিধিরূপে মান্যতা লাভ করেন মানবেন্দ্রনাথ। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই কাজে নিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে 1930 খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল থেকে বহিষ্কৃত হন।
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মূল্যায়ন –
একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিকে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায় স্মরণীয় হয়ে আছেন। কংগ্রেসের নেতৃত্বের সঙ্গে মতান্তর ও কংগ্রেস ত্যাগের পর তিনি তৈরি করেন র্যাডিকাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। ভারতে কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রচার এবং গোড়ার দিকের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নীতি ও পদ্ধতি নির্দিষ্টকরণের বিষয়ে মানবেন্দ্রনাথ অগ্রণী ছিলেন। তাই ভারতে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রতি কৃষক শ্রেণির আগ্রহ ছিল না কেন?
ভূমিকা –
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী তথা স্বদেশী আন্দোলন চলাকালীন 1905-08 খ্রিস্টাব্দে মোতিহারি জেলার কৃষক আন্দোলনকে বাদ দিলে আর কোথাও সেরকম কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়নি। নানা কারণে কৃষক শ্রেণি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল।
অনীহার কারণ –
স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি কৃষক শ্রেণির অনীহার কারণগুলি হল —
- কৃষি কর্মসূচীর অভাব – এই আন্দোলনে কোনো কৃষি কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় নি। খাজনা হ্রাস, ভূমিস্বত্ব আইন সংরক্ষণ জাতীয় কোনো দাবি স্বদেশী নেতারা করেননি। এইসব কৃষি কর্মসূচীর অভাবেই কৃষক শ্রেণি স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
- উচ্চবিত্তদের নেতৃত্ব – এই আন্দোলন শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, এই আন্দোলনকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও নেতারা সচেতন-উদাসীনতা দেখিয়েছিলেন।
- জোতদার-জমিদার ঘেঁষানীতি – স্বদেশী নেতাদের ধারণা হয়েছিল যে, উচ্চবিত্ত ও জমিদার শ্রেণির সাহায্যপুষ্ট এই আন্দোলনে কৃষি কর্মসূচী সংযোজন করলে জমিদাররা অসন্তুষ্ট হবেন। তাই তাঁরা জোতদার-জমিদার ঘেঁষা নীতিতেই আস্থা রাখেন।
- দূরদর্শিতার অভাব – ভারত কৃষি প্রধান দেশ এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই কৃষক। এই কৃষক শ্রেণি ব্যতীত কোনো আন্দোলনই যে সফল হতে পারে না — এই চিরন্তন সত্যকে স্বদেশীনেতারা উপেক্ষা করে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। অদূরদর্শিতার কারণেই কৃষক শ্রেণিকে এই আন্দোলনে তাঁরা শামিল করতে পারেননি।
- কৃষকদের প্রতি উদাসীনতা – আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সচেতনভাবেই কৃষক শ্রেণিকে আন্দোলনে শরিক করে নেওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীন ছিলেন।
উপসংহার –
উপরিউক্ত কারণে কৃষক শ্রেণি এই আন্দোলনে যোগদান করেননি। ঐতিহাসিক সুমিত সরকার বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের অসাফল্য ও অস্থায়িত্বের জন্য এই আন্দোলনের প্রতি কৃষক শ্রেণির অনীহার কথা বলেছেন।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের পূর্বে গান্ধীজি পরিচালিত কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও।
ভূমিকা –
1915 খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরেই গান্ধিজি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি। এইসময় মহাত্মা গান্ধি কয়েকটি আঞ্চলিক কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যথা —
- বিহারে চম্পারণ সত্যাগ্রহ এবং
- গুজরাটের খেদা সত্যাগ্রহ।
চম্পারণ সত্যাগ্রহ –
বিহারের চম্পারণ জেলায় নীলচাষীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য 1917 খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি চম্পারণ সত্যাগ্রহ শুরু করেন। চম্পারণে নীলকর সাহেবরা তিনকাঠিয়া প্রথায় কৃষকদের নীলচাষ করতে এবং উৎপাদিত নীল নির্দিষ্ট দামে তাদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করত। এভাবে নীলকর সাহেবরা চাষীদের ওপর অবাধ শোষণ চালাত। কিষাণনেতা রাজকুমার শুক্লার অনুরোধে গান্ধিজি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ, ব্রজকিশোর প্রসাদ, অধ্যাপক কৃপালিনী, মহাদেব দেশাই প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে চম্পারণে যান এবং কৃষকদের নিয়ে চম্পারণ সত্যাগ্রহ শুরু করেন। সরকার এই আন্দোলনের চাপে একটি অনুসন্ধান কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয় — যার অন্যতম সদস্য ছিলেন গান্ধিজি স্বয়ং।
খেদা সত্যাগ্রহ –
গুজরাটের খেদা জেলার কৃষকদের নিয়ে রাজস্ব বৃদ্ধির প্রতিবাদে 1918 খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি খেদা সত্যাগ্রহ শুরু করেন। এখানকার কৃষকরা ধান ও গমচাষের পাশাপাশি তামাক ও তুলোচাষ করত। ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি জনিত কারণে কৃষকরা খাজনা হ্রাসের দাবি তোলেন। সরকার সাড়া না দেওয়ায় গান্ধিজি মোহনলাল পান্ডা, বল্লভভাই প্যাটেল, ইন্দুলাল যাজ্ঞিক প্রমুখ নেতাদের নিয়ে খেদার কৃষকদের একত্রিত করে বয়কট সত্যাগ্রহ শুরু করে। এর ফলে খাজনা দেওয়ার জন্য কৃষকদের ওপর চাপ বন্ধ হয়।
চম্পারণ ও খেদা আন্দোলনের ফল
- গান্ধিজির নেতৃত্বের প্রতি দেশবাসীর আস্থা অর্জন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, চম্পারণের আন্দোলনের ফলে কৃষকদের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং গান্ধিজির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
- এই আন্দোলনের সাফল্য সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে তাঁর উত্থানের পথ প্রশস্ত করে।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
ভূমিকা –
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বা স্বদেশী আন্দোলন (1905-1911 খ্রি.) ছিল ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের সূচনাকাল। এই সময় থেকেই পেশাদার আন্দোলনকারী এবং শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে, যার প্রতিফলন পড়ে স্বদেশী আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশগ্রহণে।
নেতৃবৃন্দ –
বিশ শতকের গোড়া থেকেই লালা লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতারা শ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। স্বদেশী যুগে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য কুসুম রায় চৌধুরী, অপূর্ব কুমার ঘোষ, অশ্বিনী কুমার ব্যানার্জী, প্রেমতোষ বসু আত্মনিয়োগ করেন।
শ্রমিক আন্দোলন –
স্বদেশী আন্দোলনকে উপলক্ষ্য করে জাতীয়তাবাদী নেতাদের নেতৃত্বে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘট শুরু হয়। জাতীয়তাবাদী নেতারা শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দাবির প্রতি সমর্থন জানায়।
- বাংলা – বঙ্গভঙ্গের দিন (16 অক্টোবর, 1905 খ্রিস্টাব্দ) হাওড়ার বার্ন অ্যান্ড কোম্পানির 12 হাজার শ্রমিক বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ধর্মঘট শুরু করে। কলকাতায় প্রিন্টার্স অ্যান্ড কম্পোজিটরস লীগ গঠিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলপথের কর্মীরা চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে আন্দোলনে শামিল হয়। বাংলায় পাটকলগুলিতেও ধর্মঘট চলে।
- তামিলনাড়ু – তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে বাড়তি মজুরির দাবিতে চিদাম্বরম পিল্লাই-এর নেতৃত্বে ধর্মঘট শুরু হয়। চিদাম্বরম পিল্লাই গ্রেপ্তার হলে শ্রমিকরা দাঙ্গা বাধায়।
- বোম্বাই – বোম্বাইও এই আন্দোলন থেকে পিছিয়ে ছিল না। সেখানেও তিলকের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বস্ত্রকলগুলিতে ধর্মঘট শুরু হয়। পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের খণ্ডযুদ্ধ হয়। 1908 খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ে 8 হাজার শ্রমিক ধর্মঘটে শামিল হয়।
- অন্যান্য স্থানে – কানপুর ও আহমেদাবাদেও ধর্মঘটের মাধ্যমে শ্রমিকরা আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। জামালপুরেও রেলওয়ে ওয়ার্কশপে ধর্মঘট শুরু হয়।
উপসংহার –
ঐতিহাসিক বিপিন চন্দ্রের মতে, শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে স্বদেশী আন্দোলন ছিল একটি দিকচিহ্ন। অন্যদিকে ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে, বঙ্গভঙ্গ কালে বাংলায় কোনো যথার্থ রাজনৈতিক ধর্মঘট ঘটেনি।
অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও।
অথবা, অসহযোগ আন্দোলনে কৃষক শ্রেণির অবদান আলোচনা করো।
ভূমিকা –
অসহযোগ আন্দোলন শুধু শহুরে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণিও এই আন্দোলনে শামিল হয়ে অসহযোগ আন্দোলনকে গণ আন্দোলনে পরিণত করে।
অসহযোগ আন্দোলনে কৃষক শ্রেণির অবদান
- বাংলা কৃষকদের ভূমিকা – বাংলার কয়েকটি জেলায় কৃষকরা অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। এর মধ্যে মেদিনীপুর জেলা ছিল অন্যতম। কংগ্রেস নেতা বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে মেদিনীপুরের কৃষকরা সরকারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে এক ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। সরকার দমনপীড়ন চালিয়েও কৃষক ঐক্যকে ভাঙতে পারে নি। বাংলার পাবনা, বগুড়া, বীরভূমের রামপুরহাটে সরকারি জমিজরিপের কাজ বয়কট করা হয়। কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর এবং দিনাজপুরের মুসলিম কৃষকরাও অসহযোগ আন্দোলনে শামিল হয়। দিকু শোষণের বিরুদ্ধে বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রামের আদিবাসীরাও আন্দোলনে যোগ দেয়।
- অযোধ্যা – দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অযোধ্যায় বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয় (১৯২০ খ্রিস্টাব্দ)। ক্রমে তা রায়বেরিলি, প্রতাপগড়, ফৈজাবাদ ও সুলতানপুরে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর অযোধ্যায় ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে মাদারি পাশির নেতৃত্বে এক্কা আন্দোলনেও অসহযোগ সত্যাগ্রহের প্রতি সমর্থন উচ্চারিত হয়েছিল।
- অন্ধ্রপ্রদেশে কৃষক আন্দোলন – অন্ধ্রপ্রদেশের রায়চোটি তালুক (কুড়াপ্পা) ও পালনাড তালুক (গুন্টুর জেলায়) যে সত্যাগ্রহ অনুষ্ঠিত হয়, তাতেও খাজনা হ্রাস ও অরণ্য আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকরা আন্দোলনে সমবেত হয়।
- বিহারে কৃষক আন্দোলন – বিহারে জমিদারদের জুলুম ও বাড়তি খাজনার বিরুদ্ধে কৃষকরা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। দ্বারভাঙ্গা, ভাগলপুর, মুজাফফরপুর, পূর্ণিয়া, মুঙ্গের প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
- কেরালার মালাবার অঞ্চল – অসহযোগ আন্দোলনের সময় খিলাফত ও কংগ্রেস নেতাদের কাছে অনুপ্রেরণা পেয়ে মালাবারের মোপ্লা কৃষকরা কৃষক আন্দোলনের জিগির তোলে।
উপসংহার –
অসহযোগ আন্দোলনের সময় বেশ কিছু কৃষক আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং এগুলির সঙ্গে গান্ধিবাদী জাতীয় আন্দোলনের যোগসূত্র ছিল না।
একা আন্দোলন (1921-22 খ্রিস্টাব্দ) – টীকা লেখো।
1921-22 খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস ও খিলাফত নেতাদের উদ্যোগে এবং মাদারি পাসির নেতৃত্বে হরদৌই, সীতাপুর, বাহরাইচ, বারাবাঁকী জেলায় যে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়, তা একা বা একতা আন্দোলন নামে পরিচিত।
নামকরণ –
এই আন্দোলন একা আন্দোলন নামে পরিচিত — কারণ আন্দোলনকারীরা ঐক্যবদ্ধ (একতা) থাকার জন্য প্রতিজ্ঞাগ্রহণ করে। তবে ধর্মীয় ভাবাবেগও তাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে সাহায্য করেছিল।
একা আন্দোলনের কর্মসূচী/শপথ পাঠ –
কৃষকরা মাটিতে গর্ত করে জল রেখে তাকে গঙ্গাজল বলে মনে করত এবং সেই জল ছুঁয়ে নিম্নোক্ত শপথ গ্রহণ করত:
- জমি বেদখল হলে তারা জমি ছাড়বে না
- রেকর্ডভুক্ত নির্দিষ্ট খাজনা ছাড়া অতিরিক্ত কিছু দেওয়া হবে না
- রসিদ ছাড়া খাজনা দেওয়া হবে না
- বাটাই বা শস্যের ভাগ দ্বারা খাজনা না দিয়ে টাকায় খাজনা দেওয়া হবে
- বেগার প্রথা বন্ধ করা হবে
- গ্রামে সংঘটিত বিবাদ পঞ্চায়েতে মীমাংসা করা হবে
- যে কোনো পরিস্থিতিতে কৃষকদের মধ্যে একতা রক্ষা করতে হবে।
জাতীয় কংগ্রেস ও একা আন্দোলন –
প্রাথমিক পর্যায়ে কংগ্রেস ও খিলাফত নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরবর্তীতে একা আন্দোলন কংগ্রেস নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে পথে চলা শুরু করে। মাদারি পাসি ও অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণির কিষাণ নেতা এই আন্দোলনকে তাঁদের নিজস্ব পথে পরিচালিত করেন। ফলে কংগ্রেস এই আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
একা আন্দোলনে হিংসার প্রকাশ –
একা আন্দোলন ক্রমে হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। কুমায়ুন অঞ্চলের সংরক্ষিত অরণ্য জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। জমিদার ও তালুকদারদের গৃহ আক্রান্ত হয়। ফলে সরকার দমননীতি প্রয়োগ করে একা আন্দোলন দমন করে।
উপসংহার –
পরিশেষে বলা যায় যে, কংগ্রেস ও খিলাফত নেতাদের উদ্যোগেই একা কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয় এবং মাদারি পাসির নেতৃত্বে কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নেয়। এই আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক বিদ্রোহ।ক বিদ্রোহ শুরু হয় এবং মাদারি পার্শির নেতৃত্বে কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নেয়। এই আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক বিদ্রোহ।
আইন অমান্য আন্দোলনে কৃষক শ্রেণির ভূমিকা কী রূপ ছিল?
ভূমিকা –
আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির তেমন উৎসাহ লক্ষ্য করা না গেলেও কৃষকরা বিপুল সংখ্যায় এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে তা পুষিয়ে দেয়। এই সময় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গি কৃষক আন্দোলন দানা বাঁধে। বামপন্থী মনোভাবাপন্ন কংগ্রেসের সমাজতান্ত্রিক নেতারা এই সব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
কৃষক শ্রেণি ও আইন অমান্য আন্দোলন –
ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ কৃষক শ্রেণিকে জঙ্গি আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাদের মধ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চেতনা জাগ্রত হয়। কৃষকদের খাজনা বন্ধকে কংগ্রেসের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আইন অমান্য আন্দোলনে কৃষক শ্রেণির ভূমিকা
- উত্তরপ্রদেশের কিষাণ আন্দোলন – উত্তরপ্রদেশে কিষাণ আন্দোলনের সমর্থন ছাড়া আইন অমান্য আন্দোলনকে গণআন্দোলনে পরিণত করা কঠিন ছিল। সরকারি খাজনা বন্ধ করার মধ্য দিয়েই উত্তরপ্রদেশে কিষাণ আন্দোলন শুরু হয়। জমিদার ও তালুকদারদেরও খাজনা বন্ধ করা হয়। রায়বেরেলি, আগ্রা, বারাবাঁকী প্রভৃতি জেলায় আন্দোলন প্রসারিত হয়। জওহরলাল নেহরু এই কিষাণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
- গুজরাটের কিষাণ আন্দোলন – গুজরাটের সুরাট ও খেদা অঞ্চলের কৃষকরা খাজনা বন্ধ করে দেয়। সরকারি দমননীতি থেকে রক্ষা পেতে তারা প্রতিবেশী বরোদা রাজ্যে আশ্রয় নেয়। বহু কৃষকের জমি নিলামে বিক্রি হয়।
- বাংলার কিষাণ আন্দোলন – বাংলার কিশোরগঞ্জে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। বাংলায় চৌকিদারী কর বন্ধ করা হয়।
- অন্যান্য স্থানে – এছাড়াও পাঞ্জাবে জলসেচ কর ও ভূমিরাজস্ব হ্রাসের দাবি জানানো হয়, বিহারে যদুনন্দন শর্মার নেতৃত্বে কিষাণ আন্দোলন, করা জেলায় খাজনা বন্ধের আন্দোলন প্রভৃতি ছিল আইন অমান্য আন্দোলনের সময় উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলন।
উপসংহার –
আইন অমান্য আন্দোলনে কৃষকদের শামিল করে কংগ্রেসী নেতারা কৃষক আন্দোলনকে সর্বদাই সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখতেন; এভাবে কৃষক আন্দোলনের স্বয়ংক্রিয় ও চরমপন্থী চরিত্র গ্রহণে বাধাদান করেন।
সর্বভারতীয় কিষাণ সভা (1936 খ্রি:) – টীকা লেখো।
বিশ শতকের ত্রিশের দশকে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট দল কিষাণ আন্দোলনগুলি পরিচালনা করে। সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টদের যৌথ প্রচেষ্টায় ফলশ্রুতি হল সর্বভারতীয় বা নিখিল ভারত কিষাণ সভা গঠন।
সর্বভারতীয় কিষাণ সভা গঠন –
অধ্যাপক এন. জি. রঙ্গার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কিষাণ সংগঠনের (1936 খ্রিস্টাব্দ) লখনৌ অধিবেশনে সর্বভারতীয় কিষাণ সভা গঠিত হয়। বিহারের বিখ্যাত কিষাণনেতা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী ছিলেন সর্বভারতীয় কিষাণ সভার প্রথম সভাপতি এবং এন. জি. রঙ্গা ছিলেন প্রথম সাধারণ সম্পাদক। জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাম মনোহর লোহিয়া, ইন্দুলাল যাজ্ঞিক, নাম্বুদ্রিপাদ এই কিষাণ সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সর্বভারতীয় কিষাণ সভা গঠনের উদ্দেশ্য –
ইন্দুলাল যাজ্ঞিক কিষাণ বুলেটিনে এই সভার উদ্দেশ্য ঘোষণা করেন। এই সভার উদ্দেশ্যগুলি হল —
- কৃষকদের অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক অসাম্য দূর করা
- জমিদারী প্রথার বিলোপ
- কৃষিঋণ মকুব বা কৃষকের গৃহীত ঋণ পরিশোধের জন্য বিলম্বিত ব্যবস্থা
- বেগার শ্রমের বিলোপ
- ভূমিহীনদের ভূমিদান
- কৃষকের জমিতে স্থায়ী স্বত্ব প্রদান
- অরণ্যের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।
গুরুত্ব –
সর্বভারতীয় কিষাণ সভা গঠনের মধ্য দিয়ে কৃষক শ্রেণি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ শুরু করে। দেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারতীয় জনগণের বৃহত্তম অংশ শামিল হওয়ার সুযোগ পায়। রুশ ঐতিহাসিক জি. কটোভস্কির মতে, ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে সর্বভারতীয় কিষাণ সভার প্রতিষ্ঠা একটি স্মরণীয় ঘটনা।
উপসংহার –
সর্বভারতীয় কিষাণ সভা গঠনের ফলে কিষাণ আন্দোলনে নবপ্রাণের সঞ্চার ঘটে।
বিশ শতকের 40-এর দশকে সংগঠিত বাংলার তেভাগা আন্দোলনের বিবরণ দাও।
ভূমিকা –
1946 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণ সভার উদ্যোগে এবং কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়।
তেভাগার দাবীসমূহ –
কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণ সভা 1946 খ্রিস্টাব্দে তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। তেভাগার দাবীসমূহগুলি হল —
- উৎপন্ন ফসলের 2/3 ভাগ কৃষকের প্রাপ্য, মালিক পাবে 1/3 অংশ
- জমিতে ভাগচাষীকে দখলিস্বত্ব দিতে হবে
- 12(1/2) শতাংশ এর বেশি সুদ মহাজন বা জমিদাররা দাবী করতে পারবে না
- কোনো কাজে কর (আবওয়াব) আদায় দেওয়া যাবে না
- ফসলের ভাগ নিয়ে রসিদ দিতে হবে
- ভাগচাষীর খামারে ধান তুলতে হবে
- আধি নয়, তেভাগা চাই, কর্জ ধানের সুদ নাই
- 1 মনে 5 সের – এর বেশি সুদ নেওয়া যাবে না।
বিস্তৃতি –
তেভাগা আন্দোলন বাংলার প্রায় সব জেলায় শুরু হয়েছিল। দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কাকদ্বীপ, রংপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি, যশোর ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। খুলনা জেলায় স্লোগান ওঠে, “লাঙল যার, জমি তার”। দিনাজপুরের আদিবাসী কৃষকরা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাংলার প্রায় 60 লক্ষ কৃষক এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই বিদ্রোহের চরিত্রগত স্বাতন্ত্র্য উল্লেখ করে ঐতিহাসিক ড্যানিয়েল থর্নার লিখেছেন, “It was the first consciously attempted revolt by a politicised peasantry in Indian history.”
নেতৃবৃন্দ –
তেভাগা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য নেতা-নেত্রীরা হলেন — গুরুদাস তালুকদার, ভবানী সেন, অবনী রায়, চারু মজুমদার, সমর গাঙ্গুলী, সুশীল সেন, জলপাইগুড়ির রাজবংশী বৃদ্ধা মহিলা বুড়িমা প্রমুখ।
উপসংহার –
সরকারের কঠোর দমননীতি, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, সার্বিক ঐক্যের অভাব ইত্যাদি কারণে আন্দোলন ব্যর্থ হলেও পরবর্তীকালে বর্গাদার আইন, বাংলা ভূমিস্বত্ব আইন, জমিদারী উচ্ছেদ প্রসঙ্গে তেভাগা আন্দোলনের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।স্বত্ব আইন, জমিদারী উচ্ছেদ প্রসঙ্গে তেভাগা আন্দোলনের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।
পুন্নাপ্রা-ভায়লার গণসংগ্রাম (1946 খ্রি:) – টীকা লেখো।
ভূমিকা –
ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের পুন্নাপ্রা-ভায়লার অঞ্চলের কৃষক ও শ্রমিকরা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে 1946 খ্রিস্টাব্দে তীব্র আন্দোলন শুরু করে যা পুন্নাপ্রা-ভায়লার গণসংগ্রাম নামে পরিচিত।
আন্দোলনের কারণ –
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেই ত্রিবাঙ্কুরের হতদরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকরা গণসংগ্রামে শামিল হয়েছিল। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর খাদ্যাভাব ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং রাজার স্বৈরাচারী শাসন ও শোষণে কৃষক ও শ্রমিকদের দুর্দশা চরমে ওঠে। অপরদিকে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই, ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের দেওয়ান কর্তৃক ত্রিবাঙ্কুরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত না করে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে রাখার বাসনা – সেখানকার জনগণকে খেপিয়ে তুলেছিল। জনগণ চেয়েছিল স্বাধীন ভারতের নাগরিক হতে। অথচ দেওয়ান সি. পি. রামস্বামী আয়ার এই রাজ্যটিকে স্বাধীন রাখার জন্য মার্কিন ধাঁচে এক সংবিধান রচনা করেন।
আন্দোলনের নেতৃত্ববর্গ –
বামপন্থী নেতা কে. সি. জর্জ ও টি. ভি. টমাস পুন্নাপ্রা-ভায়লার গণসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁদের নেতৃত্বে স্লোগান ওঠে – “দেওয়ানের শাসন খতম করো”; “স্বাধীন ত্রিবাঙ্কুর ও মার্কিন মডেল আরব সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দাও”।
পুন্নাপ্রার যুদ্ধ –
কমিউনিস্টরা 1946 খ্রিস্টাব্দে মার্কিন মডেলের সংবিধানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার শুরু করেন। তীব্র কমিউনিস্ট-বিরোধী ত্রিবাঙ্কুর সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। কমিউনিস্ট নেতৃত্বে কৃষকরা আত্মরক্ষার তাগিদে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিয়ে প্রতিরোধ শুরু করেন। আলেপ্পি ও শেরতালাইয়ে একটি সাধারণ রাজনৈতিক ধর্মঘট শুরু হয়। পুন্নাপ্রা পুলিশ ফাঁড়ি আক্রান্ত হয়, পুলিশি অত্যাচারও চরমে ওঠে।
ভায়লারের যুদ্ধ –
আলেপ্পি ও শেরতালাইয়ে রাজনৈতিক ধর্মঘটের কারণে – সমগ্র রাজ্যে সামরিক আইন জারি করা হয়। 27 অক্টোবর সেনাবাহিনী প্রায় 800 কমিউনিস্টকে নিধন করে তাদের সদর দপ্তর ভায়লার দখল করে।
ত্রিবাঙ্কুরের ভারত চুক্তি –
ত্রিবাঙ্কুরের দেওয়ান গান্ধিজিকে জানান যে, ত্রিবাঙ্কুর স্বাধীন থাকবে। গান্ধি বিরক্ত হয়ে বলে, “কোনো রাজা যদি বলে যে চিরদিন স্বাধীন ছিল ও ভবিষ্যতে থাকবে তবে সেটা অত্যন্ত ভুল হবে, অশোভন হবে”। এই সময় এক অজ্ঞাত আততায়ীর দ্বারা ছুরিকাহত হয়ে দেওয়ান রামস্বামী আয়ার ত্রিবাঙ্কুরের ভারতভুক্তিতে সম্মত হন।
উপসংহার –
তাই কমিউনিস্টদের কাছে বীর শহীদদের গৌরবময় আত্মবলিদানের আজও এক নাম পুন্নাপ্রা-ভায়লার।
সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস – টীকা লেখো।
ভূমিকা –
1920 খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে শ্রমিকদের সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী সারা ভারতশ্রমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকেই জন্ম নেয় সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC)।
পটভূমি –
1919 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের অমৃতসর অধিবেশনে প্রথম শ্রমিকদের প্রশ্নকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয় এবং প্রতিটি প্রাদেশিক সংগঠনকে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। নাগপুর অধিবেশনে (1920 খ্রি:) ও গয়া অধিবেশনে শ্রমিক আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে পরিচালনার জন্য গঠিত হয় একটি বিশেষ কমিটি।
সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন গঠন –
1920 খ্রিস্টাব্দে 30 অক্টোবর মাদ্রাজে সারা ভারত শ্রমিক সম্মেলনে 18টি শ্রমিক ইউনিয়নের 806 জন প্রতিনিধি যোগদান করে। এর ফলশ্রুতি হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে গঠিত হয় শ্রমিকদের জন্য নিজস্ব সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন (AITUC) সংগঠন। লালা লাজপত রায় এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এবং সম্পাদক ছিলেন দেওয়ান চমনলাল। জোসেফ ব্যাপ্টিস্টা ছিলেন সহসভাপতি।
কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি –
জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের মধ্যে লালা লাজপত রায়, চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ নেতৃবর্গ সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। লাজপত রায় তাঁর ভাষণে সাম্রাজ্যবাদের অশুভ পরিণাম সম্পর্কে মালিকপক্ষকে সতর্ক করেন। 1928 খ্রিস্টাব্দে তিনি সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সংগঠনটিকে কংগ্রেসের কাছাকাছি রাখতে তিনি ইচ্ছুক ছিলেন।
দ্বিতীয় অধিবেশন –
AITUC-র দ্বিতীয় অধিবেশনে দেওয়ান চমনলাল স্বরাজ সম্পর্কিত প্রস্তাব উপস্থাপন করার সময় মন্তব্য করেন যে, “এই স্বরাজ পুঁজিপতিদের জন্য নয়; তা শ্রমিকদের মঙ্গলের জন্যই অর্জন করতে হবে” (It was to be a swaraj not for the capitalist, but for the workers.)।
উপসংহার –
মহাত্মা গান্ধি শ্রমিক সংগঠনের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। তিনি অর্থনৈতিক কারণে পুঁজিপতিদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলারই পক্ষপাতী ছিলেন। কাজেই শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেসের এই জটিল দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিক শ্রেণি কখনো কখনো জাতীয় আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল। তবুও একথা অনস্বীকার্য যে, সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।কার্য যে, সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
ভারতছাড়ো আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির অংশগ্রহণ কীরূপ ছিল?
ভূমিকা –
1942-র ভারতছাড়ো আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং একটি প্রকৃত গণআন্দোলন। এই আন্দোলনে কৃষক শ্রেণি অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিল। সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিক শ্রেণিকে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা যায়নি।
কৃষক শ্রেণির ভূমিকা –
ভারতছাড়ো আন্দোলনে কৃষক সম্প্রদায়ের যোগদান এই আন্দোলনকে জঙ্গি চরিত্রদান করে। কৃষক আন্দোলনের ব্যাপকতার বিভিন্ন দিকগুলি হল —
- আসাম, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানের কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যোগ দেয়।
- বহু স্থানে কৃষকরা সরকারি খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। বাংলার বিভিন্ন জেলায় কৃষক আন্দোলন গণ বিদ্রোহের চরিত্র গ্রহণ করে।
- মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার-গঠনের মাধ্যমে কৃষকরা সমান্তরাল সরকার পরিচালনা করতে থাকে।
শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা –
1942-র ভারতছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে ভারতের কমিউনিস্ট দল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে রাতারাতি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী যুদ্ধের পরিবর্তে জনযুদ্ধ বলে ঘোষণা করে এবং নীতিগত কারণে ভারতছাড়ো আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। ব্যক্তিগত বিবেকের তাড়নায় কোনো কোনো কমিউনিস্টকর্মী ভারতছাড়ো আন্দোলনে বেসরকারিভাবে ব্যক্তিগত সমর্থন জানায়। তারই একটি অংশ ছিল শ্রমিক শ্রেণি।
শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপকতা –
- গান্ধিজি ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ করার প্রতিবাদে বোম্বাই, নাগপুর, আমেদাবাদ প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকরা এক সপ্তাহ ধরে ধর্মঘট ও কর্মবিরতি পালন করে।
- জামশেদপুরে লৌহ-ইস্পাত কারখানায় দুই মাস ধরে ধর্মঘট পালন করা হয়।
উপসংহার –
ব্রিটিশ সরকার ভারতছাড়ো আন্দোলনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। তাই কমিউনিস্ট পরিচালিত শ্রমিক আন্দোলনের ভূমিকা আশাব্যঞ্জক না হলেও কৃষক শ্রেণির অভূতপূর্ব সাড়া শ্রমিক শ্রেণির কিছু অংশের অনীহাকে পুষিয়ে দিয়েছিল। তবে অধ্যাপক আদিত্য মুখার্জী-র মতে, পার্টির লাইন আলাদা হওয়া সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ কমিউনিস্ট কর্মীরা ভারতছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
মানবেন্দ্রনাথ রায় (1886-1954) – টীকা লেখো।
ভূমিকা –
ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য — যিনি এম. এন. রায় (মানবেন্দ্রনাথ রায়) নামেই বেশি পরিচিত। বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়াকালীন 1903 খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান করেন।
তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা –
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বাঘা যতীন-এর নির্দেশে জার্মানির কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে বাটাভিয়ায় যান। সেখান থেকে আমেরিকা হয়ে মেক্সিকোতে পৌঁছান এবং সেখানে মিখাইল বোরোদিন নামে এক বলশেভিক নেতার সংস্পর্শে আসেন ও মার্কসবাদে দীক্ষা নেন। অতঃপর 1920 খ্রিস্টাব্দে লেনিনের আমন্ত্রণে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনে ভারতের পক্ষ থেকে যোগ দেন। এখানেই 1920 খ্রিস্টাব্দের 17 অক্টোবর এম. এন. রায়, অবনী মুখার্জী প্রমুখ নেতাদের নিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে আত্মপ্রকাশ করে। যা পরের বছরই কমিনটার্ন-এর স্বীকৃতি লাভ করে।
ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভূমিকা –
ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের পূর্বেই কিছু বিপ্লবী নিজ প্রচেষ্টায় কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গঠনের চেষ্টা করেন। এম. এন. রায় তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য নলিনীগুপ্ত ও শওকত উসমানীকে ভারতে পাঠান। অসহযোগ আন্দোলনের হতাশাকে কাজে লাগিয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায় ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন জোরদার করার উদ্যোগ নেন।
কমিউনিস্ট আন্দোলন পরিচালনায় রণকৌশল –
ভারতে কমিউনিস্ট দলকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি দ্বিস্তর আন্দোলনের কথা তুলে ধরেন —
- জাতীয় আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে আইনগত ও বৈধভাবে আন্দোলন করা
- গোপনে শ্রমিক-কৃষক সংগঠন দ্বারা দলের নিজস্ব ভিত্তি শক্ত করা।
মূল্যায়ন – মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদ্যোগেই ভারতের নানা প্রান্তে সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী মানুষজনের সহযোগিতায় কমিউনিস্ট পার্টির শাখা গড়ে ওঠে। যার চূড়ান্ত পরিণতি 1925 খ্রিস্টাব্দে কানপুরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা। এই কমিউনিস্ট নেতা 1954 খ্রিস্টাব্দের 25 জানুয়ারি পরলোক গমন করেন।
আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।
আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।
ধন্যবাদ সবাইকে।
মন্তব্য করুন