মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

Solution Wbbse

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের সপ্তম অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” থেকে “রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
Contents Show

বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের ভূমিকা –

বিংশ শতকের ভারতে জাতীয় আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ। এই সময় জাতীয়তাবাদীরা দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিংশ শতকের সূচনায় নারী আন্দোলন (স্বদেশি আন্দোলনে নারী) –

বিংশ শতকের শুরুতে 1905 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে বঙ্গভঙ্গবিরোধী (স্বদেশি-বয়কট) আন্দোলন হয়েছিল তাতে নারীরা অংশগ্রহণ করেন। এই আন্দোলনে যুক্ত নারীরা সামাজিক পীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রামী মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে রাখিবন্ধন উৎসবে মহিলারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ‘অরন্ধন দিবস’ পালন করার আবেদন জানালে নারীরা ঘরে ঘরে অরন্ধন পালন করে। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার দিনে (1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর) আনন্দমোহন বসু হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আপার সার্কুলার রোডে মিলন মন্দির বা ফেডারেশন হলের ভিত্তি স্থাপন করলে নরনারী নির্বিশেষে ভাবাবেগে আপ্লুত হয়।

বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

আন্দোলনের পরবর্তী পর্বে যখন বিদেশি দ্রব্য বর্জন করে স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণের আন্দোলন শুরু হয় তখন বাংলার নারীরা তাতেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন। সরলাদেবী চৌধুরাণী প্রতিষ্ঠিত ‘স্বদেশি ভাণ্ডার’ স্বদেশি দ্রব্য বিপণনের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ নামে স্বদেশি দ্রব্য উৎপাদন সংস্থা এবং ‘বীরাষ্টমী ব্রত’ উদ্যাপন স্বদেশি চেতনা জাগ্রত করতে সাহায্য করেছিল। স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কুমুদিনী মিত্র, লীলাবতী মিত্র, নির্মলা সরকার, হেমাঙ্গিনী দাস, ভগিনী নিবেদিতা প্রমুখ।

তবে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় নারী আন্দোলন মূলত উচ্চবর্ণ, ধনী, বুর্জোয়া, শহুরে নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

1920 -র দশকে নারী আন্দোলন (অসহযোগ আন্দোলনে নারী) –

  • 1920 খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা হয়। গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি বেড়ে যায়।
  • গান্ধিজি তাঁর আন্দোলনে নারীদের জন্য সীমিত কর্মসূচি গ্রহণ করেন। নারীদের স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণ ও বিদেশি দ্রব্য বয়কট করার কথা বলা হয়। নারীরা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
  • এই আন্দোলনে নারীরা পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করেন।
  • 1921 খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স অফ ওয়েলস ভারত ভ্রমণে এলে হাজার হাজার নারী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
  • নারীরা ‘তিলক স্বরাজ তহবিল’-এ টাকা ও গয়না দান করেন। তারা চরকায় সুতো কেটে ও কাপড় বুনে স্বদেশি কর্মসূচি পালন এবং ‘খাদি আন্দোলন’-কে জোরদার করে তোলেন।
  • 1922 খ্রিস্টাব্দে স্টিমার ধর্মঘটে নেলী সেনগুপ্ত নেতৃত্ব দেন।
  • 1927 খ্রিস্টাব্দে লতিকা ঘোষের নেতৃত্বে ও সুভাষচন্দ্র বসুর মা প্রভাবতী বসুর সভাপতিত্বে মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • 1928 খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কলকাতায় স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গঠিত হয়।
  • 1930 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় নারী সত্যাগ্রহ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় ।

1930 -এর দশকে নারী আন্দোলন (আইন অমান্য আন্দোলনে নারী) –

1930 খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বেশিমাত্রায় লক্ষ করা যায়। গান্ধিজির লবণ সত্যাগ্রহে, ডান্ডি অভিযানে হাজার হাজার নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করেন। নারীরা বিভিন্নভাবে আইন অমান্য, সভা-সমাবেশ, পিকেটিং প্রভৃতি ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই পর্বের আন্দোলনে পশ্চিম গোদাবরী ও মহারাষ্ট্রের দেবদাসীরা এবং বাংলার পতিতা মহিলারা নিজেদের গায়ের গয়না ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ত্যাগ করেছিলেন।

‘ভারতের বুলবুল’ নামে পরিচিত সরোজিনী নাইডু 1930 খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ধরসনা লবণগোলা দখল অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। 1930-1932 খ্রিস্টাব্দে ভারতের নানা প্রান্তে যেসব নারী সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাসন্তী দেবী, কমলা নেহরু, আশালতা সেন, ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা, ফুলবাহার বিবি প্রমুখ।

বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

বিপ্লবী আন্দোলনে নারী –

বাংলায় যে বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তাতেও শিক্ষিত নারীরা অংশগ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, সুহাসিনী গাঙ্গুলির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

1940 -এর দশকে নারী আন্দোলন (ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারী) –

1942 খ্রিস্টাব্দে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন হয় তাতে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল আরও বেশি সক্রিয়। অরুণা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালিনি, ঊষা মেহতা সক্রিয়ভাবে এতে অংশগ্রহণ করেন। ঊষা মেহতা গোপনে কংগ্রেসের বেতারকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন।

  • বাংলার মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারে মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এখানে নারী স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে ভগিনী সেনা গঠিত হয়।
  • ‘গান্ধীবুড়ি’ নামে পরিচিত মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক থানা আক্রমণ করার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তা ছাড়া আসামের 10 বছরের কিশোরী কনকলতা বড়ুয়া, পাঞ্জাবের যোগেশ্বরী ফুকোননীর নামও এক্ষেত্রে স্মরণীয় হয়ে আছে।
  • সুভাষচন্দ্র বসু যে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করেছিলেন তাতেও নারীদের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। এই বাহিনীতে ঝাঁসির রানি ব্রিগেডের নেত্রী ছিলেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন। প্রায় 1500 নারী এই বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন।

বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের মূল্যায়ন –

ভারতের জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী আন্দোলনের সর্বক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া তেভাগা, তেলেঙ্গানা আন্দোলনেও নারীরা অংশগ্রহণ করেন। তেভাগা আন্দোলনে নারীরা ‘ঝাঁটা বাহিনী’, ‘বঁটি বাহিনী’ গড়ে তোলেন। নারীদের অংশগ্রহণের ফলে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন গণ আন্দোলনের রূপ ধারণ করে।

বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের ভূমিকা –

উনিশ শতকে মিশনারিদের উদ্যোগে এদেশে নারীদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার সূচনা হয়। ব্রাহ্মনেতাদের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর নারীদের বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথার হাত থেকে রক্ষা করেন। এই উদ্যোগ ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও প্রসারিত হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নারীদের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের কথা প্রচারিত হতে থাকে। ফলে নারী আন্দোলনের প্রসার ঘটে।

নারী আন্দোলনের চরিত্র –

উনিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের যে সূচনা হয়েছিল বিশ শতকে তা পূর্ণতা লাভ করে। এই নারী আন্দোলনের চরিত্র ছিল –

  • উচ্চবর্গীয় – বিশ শতকের নারী আন্দোলন সমাজের উচ্চস্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সমাজে যারা বিত্তবান ছিলেন, পাশ্চাত্য শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছিলেন, তারাই এই আন্দোলনে যোগদান করেন। এইসব নারীরা তাদের শ্রেণিচেতনার বাইরে আসতে পারেননি। দেশের সমগ্র নারীসমাজের কল্যাণের কথা তারা চিন্তা করেননি। নারীদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব লক্ষ করা গেলেও তা ছিল নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ।
  • পর্দাপ্রথা – ভূপালের বেগমেরা পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করে দৃষ্টান্ত গড়ে তোলেন। সমাজের অভিজাত নারীরাও পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করেন। তাদের আন্দোলনের যুক্তি ছিল, নারীকে যদি সামাজিক জীবনের অগ্রগতিতে অংশ নিতে হয়, তাদের সন্তানদের শিক্ষাদানের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয় তাহলে পর্দাপ্রথাকে বিদায় জানাতে হবে।
  • বাল্যবিবাহ – বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় বিধবাবিবাহ আইন পাস (1856 খ্রিস্টাব্দে) এবং বি এম মালবারির চেষ্টায় এজ অফ কনসেন্ট অ্যাক্ট (Age of Consent Act) (1812 খ্রিস্টাব্দে) পাস হলেও বিধবাবিবাহ তেমনভাবে চালু হয়নি বা বাল্যবিবাহও বন্ধ হয়নি। নারী আন্দোলনের ফলে চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেন্ট অ্যাক্ট (Child Marriage Restraint Act) (1929 খ্রিস্টাব্দে) পাস হয়। এর দ্বারা বিবাহের ন্যূনতম বয়স বাড়ানো হয়। ডঃ শুভলক্ষ্মী রেড্ডির চেষ্টায় সরকার 1925 খ্রিস্টাব্দে নারীদের পক্ষে একটি আইন পাস করে।
  • শিক্ষার অধিকার – বিভিন্ন মিশনারি সংস্থা, প্রগতিশীল পারসি সমাজ, অধ্যাপক কার্ভের মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় নারী শিক্ষাপ্রসারে বিশিষ্ট অবদান রাখে। নারীরাও উচ্চশিক্ষার দাবি জানায়। 1917 খ্রিস্টাব্দে সারা দেশে ছাত্রীসংখ্যা ছিল 12,30,000 জন। 1937 খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে হয় 28,90,000 জন।
  • রাজনীতি – বিশ শতকের গণ আন্দোলনগুলিতে নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। পিকেটিং, মিছিলে হাঁটা, কারাবরণ, লাঠি-গুলির আঘাত সহ্য করা সবক্ষেত্রেই মেয়েদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। সরোজিনী নাইডু, অরুণা আসফ আলি, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, নেলী সেনগুপ্ত, বাঈ আম্মান -এর নাম এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এঁদের অনেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খ্যাতিলাভ করেন। সরোজিনী নাইডু নারীর ভোটাধিকারের দাবি জানান।
  • শ্রেণিসংগ্রাম – দরিদ্র, অশিক্ষিত নারীরাও কৃষক-শ্রমিক ধর্মঘটে, পথসভায় ও বিক্ষোভে অংশ নেন। কেউ কেউ কিষানসভা ও ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যাও নিযুক্ত হন।

নারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য –

  • শহরকেন্দ্রিকতা – এই নারী আন্দোলন ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের বেশিরভাগ নারীর সঙ্গে এই আন্দোলনের কোনো যোগ ছিল না।
  • সীমাবদ্ধতা – এই আন্দোলন কেবল নিজ নিজ শ্রেণিস্বার্থে পরিচালিত হয়। দেশের সমগ্র সমাজকে তা সংযুক্ত করতে পারেনি। মুসলিম নারীদের কাছে টানতে পারেনি এই আন্দোলন।
  • পাশ্চাত্যধর্মী – এই আন্দোলন পাশ্চাত্যধর্মী ছিল। এর প্রেরণা, চিন্তাধারা ও আদর্শ দেশজ ছিল না।

নারী আন্দোলনের মূল্যায়ন –

সীমিত শহুরে শ্রেণিস্বার্থে পরিচালিত হলেও এই নারী আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ ভারতের এক অভিনব ঘটনা। এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। নবজাগরণ ও নবভারত গঠনের ক্ষেত্রে এর এক ইতিবাচক অবদান ছিল।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নারীসমাজ কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিল? তাদের আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা কী?

বঙ্গভঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে নারীসমাজের অংশগ্রহণ –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল মূলত ঘরোয়া বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল প্রধানত –

  • স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার করা।
  • বিদেশি জিনিস ও কাচের চুড়ি ভেঙে ফেলা।
  • অরন্ধন দিবস পালন করা।
  • আন্দোলনকারী ও বিপ্লবীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করা।

বঙ্গভঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা –

সেসময় খুব কমসংখ্যক নারী প্রকাশ্য সভাসমিতিতে যোগদান করতেন। নারীরা পাড়ায় বা কারোর বাড়িতে জড়ো হতেন। যেমন – মুরশিদাবাদের কান্দিতে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বাড়িতে সমবেত হয়ে প্রায় 500 মহিলা বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা শুনেছিলেন। তারা বিদেশি দ্রব্য বর্জন, স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার ও অরন্ধনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন।

জাতীয়তাবাদী নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমবেতভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। তারা গ্রাম ও শহরে সর্বত্র চরকার প্রবর্তন, অর্থসংগ্রহ (লক্ষ্মীর ভাণ্ডার) প্রভৃতি কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

  • মা লক্ষ্মীর ধারণার প্রচার – বঙ্গভঙ্গবিরোধী নারীদের আন্দোলনে দেবী লক্ষ্মীকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বলা হয় বঙ্গভঙ্গের জন্য মা লক্ষ্মী দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্য সকল নারীকে চেষ্টা করতে হবে।
  • মায়ের কৌটায় অর্থ ও সম্পদ সংগ্রহ – বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অর্থসংগ্রহের জন্য ‘মায়ের কৌটা’-র কথা বলা হয়। মায়ের কৌটা বলতে বোঝায় প্রতি বাড়িতে একটি করে কৌটা রাখতে হবে, যে কৌটায় প্রতিদিন দেশমায়ের জন্য একমুঠো করে চাল রাখতে হবে। আবার কোনো নারী বেশি অর্থ দান করলে বা কোনো দুঃসাহসিক কাজ করলে তাকে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ উপাধিও দেওয়া হত।
  • বিপ্লবীদের সহায়তা – বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রসার ঘটে। ভগিনী নিবেদিতা বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তিনি সক্রিয়ভাবে বাংলার বিপ্লবী গুপ্তসমিতির (অনুশীলন সমিতি) সঙ্গে যুক্তও ছিলেন। বাংলার যেসব নারীরা বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, গোপন সংবাদ আদানপ্রদান, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা ও অস্ত্র সরবরাহের কাজে সাহায্য করতেন তাঁদের মধ্যে বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী, ঢাকার ব্রহ্মময়ী সেন, ফরিদপুরের সৌদামিনী দেবী, বরিশালের সরোজিনী দেবীর নাম স্মরণীয়।

বঙ্গভঙ্গাবিরোধী আন্দোলনের মূল্যায়ন –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে সব শ্রেণির নারীরা সমানভাবে অংশগ্রহণ করেনি। মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারভুক্ত মেয়েদেরই এই আন্দোলনে যোগদানের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তবে এ কথা বলা যায় যে, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলার নারীসমাজের রাজনৈতিক চেতনা এক উচ্চতর স্তরে উন্নীত হয়েছিল।

বঙ্গভঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে নারীসমাজের সীমাবদ্ধতা –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলার নারীসমাজের রাজনৈতিক চেতনা এক উচ্চতর স্তরে উন্নীত হলেও এই আন্দোলনের কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। যথা –

  • এই আন্দোলনে প্রধানত শহুরে মহিলারা অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তাদের প্রচার বা আবেদন গ্রামের সিংহভাগ নারীর কাছে পৌঁছোয়নি। গ্রামের নারীরা আন্দোলনের উদ্দেশ্য বা কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না।
  • আন্দোলনের কর্মসূচিতে নারীমুক্তির বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে নারীর ভূমিকা আলোচনা করো।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের ভূমিকা –

ঊনবিংশ শতকে বাংলায় তথা ভারতে নারী জাগরণের যে সূচনা হয় বিংশ শতকের শুরুতে তা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি বড়ো ভূমিকা পালন করে। স্বদেশি এবং অসহযোগ আন্দোলনে তার পরিচয় পাওয়া যায়। এমনকি সমাজের প্রান্তিক নারীরাও এই আন্দোলনে পুরুষদের সহযোগিতা করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও শিক্ষিত ছিলেন।

স্বদেশি ও অসহযোগ আন্দোলনে নারীর ভূমিকা –

স্বদেশি আন্দোলন –

1905 খ্রিস্টাব্দে ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন বাংলা প্রদেশকে দ্বিখণ্ডিত করেন। একে বঙ্গভঙ্গ বলা হয়। বাংলার জনগণ বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নারীরা হলেন – সরলাদেবী চৌধুরাণী, কুমুদিনী বসু, লীলাবতী মিত্র, নির্মলা সরকার, হেমাঙ্গিনী দাস প্রমুখ।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের ধরন –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল মূলত ঘরোয়া বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল প্রধানত –

  • স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার করা।
  • বিদেশি জিনিস ও কাচের চুড়ি ভেঙে ফেলা।
  • অরন্ধন দিবস পালন করা।
  • আন্দোলনকারী ও বিপ্লবীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করা।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা –

সেসময় খুব কমসংখ্যক নারী প্রকাশ্য সভাসমিতিতে যোগদান করতেন। নারীরা পাড়ায় বা কারোর বাড়িতে জড়ো হতেন। যেমন- মুরশিদাবাদের কান্দিতে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বাড়িতে সমবেত হয়ে প্রায় 500 মহিলা বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা শুনেছিলেন। তারা বিদেশি দ্রব্য বর্জন, স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার ও অরন্ধনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন।

জাতীয়তাবাদী নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমবেতভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। তারা গ্রাম ও শহরে সর্বত্র চরকার প্রবর্তন, অর্থসংগ্রহ (লক্ষ্মীর ভান্ডার) প্রভৃতি কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

  • মা লক্ষ্মীর ধারণার প্রচার – বঙ্গভঙ্গবিরোধী নারীদের আন্দোলনে দেবী লক্ষ্মীকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বলা হয় বঙ্গভঙ্গের জন্য মা লক্ষ্মী দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্য সকল নারীকে চেষ্টা করতে হবে।
  • মায়ের কৌটায় অর্থ ও সম্পদ সংগ্রহ – বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অর্থসংগ্রহের জন্য ‘মায়ের কৌটা’-র কথা বলা হয়। মায়ের কৌটা বলতে বোঝায় প্রতি বাড়িতে একটি করে কৌটা রাখতে হবে, যে কৌটায় প্রতিদিন দেশমায়ের জন্য একমুঠো করে চাল রাখতে হবে। আবার কোনো নারী বেশি অর্থ দান করলে বা কোনো দুঃসাহসিক কাজ করলে তাকে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ উপাধিও দেওয়া হত।
  • বিপ্লবীদের সহায়তা – বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রসার ঘটে। ভগিনী নিবেদিতা বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তিনি সক্রিয়ভাবে বাংলার বিপ্লবী গুপ্তসমিতির (অনুশীলন সমিতি) সঙ্গে যুক্তও ছিলেন। বাংলার যেসব নারীরা বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, গোপন সংবাদ আদানপ্রদান, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা ও অস্ত্র সরবরাহের কাজে সাহায্য করতেন তাঁদের মধ্যে বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী, ঢাকার ব্রহ্মময়ী সেন, ফরিদপুরের সৌদামিনী দেবী, বরিশালের সরোজিনী দেবীর নাম স্মরণীয়।

অসহযোগ আন্দোলন –

গান্ধিজির নেতৃত্বে সর্বভারতীয় গণ আন্দোলনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলনের কয়েকটি কর্মসূচি নারীদের আকৃষ্ট করেছিল। যেমন- চরকায় সুতো কাটা, বিদেশি পণ্য বর্জন, মাদক বর্জন প্রভৃতি। তাই এই আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।

অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব –

এই আন্দোলন পরিচালনায় কয়েকজন নারী স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব দেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সরোজিনী নাইডু, বাসন্তী দেবী, উর্মিলা দেবী, সুনীতি দেবী, কমলা নেহরু, নেলী সেনগুপ্ত, বাঈ আম্মান, আশালতা সেন, জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলি প্রমুখ।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে নারীর ভূমিকা আলোচনা করো।

অসহযোগ আন্দোলনে সংগঠন –

রাষ্ট্রীয় স্ত্রী সংঘ, নারী কর্মমন্দির, নারী সত্যাগ্রহ সমিতি প্রভৃতি সংগঠন নারীদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল। এই সমস্ত সংগঠন তাদের সদস্যাদের আন্দোলনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে। এ ছাড়া নারীরা বিভিন্ন সভা করে এবং সেখানে বক্তৃতার মাধ্যমে উপস্থিত নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সরোজিনী নাইডু সত্যাগ্রহ সপ্তাহে (6-13 এপ্রিল, 1921 খ্রিস্টাব্দে) এক সভায় নারীদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার কথা বলেন। মৌলানা শওকত আলির মা বাঈ আম্মান আহমেদাবাদ ও লাহোরে মহিলা সম্মেলনে বক্তৃতা দেন। তিনিও এই আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।

অসহযোগ আন্দোলনে কার্যকলাপ –

এই আন্দোলনে বয়কটের মতো কর্মসূচিতে নারীদের সীমিত অংশগ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন গান্ধিজি। কিন্তু নারী নেতৃত্ব আরও বড়ো ভূমিকা পালনের দাবি জানায়। প্রিন্স অফ ওয়েলস -এর বোম্বাই আসার সময় 1000 জন মহিলা সমবেত হয়ে প্রতিবাদ জানান 1921 খ্রিস্টাব্দে। বাসন্তী দেবী, ঊর্মিলা দেবী ও সুনীতি দেবী কলকাতার রাস্তায় বিক্ষোভ দেখিয়ে কারাবরণ করেন। বহু সাধারণ নারী কলকাতা ও মফস্সলে (ঢাকা, বরিশাল ও অন্যান্য স্থানে) পিকেটিং ও বয়কট আন্দোলনে যোগ দেন। অনেকে চরকায় সুতো কাটতে এবং তাঁতে কাপড় বুনতে শুরু করেছিলেন।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে নারীর ভূমিকা আলোচনা করো।

অসহযোগ আন্দোলনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের অবদান –

অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব সাধারণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের উপরেও পড়েছিল। পূর্ব গোদাবরী জেলার দেবদাসীরা তাদের অর্থ ও অলংকার গান্ধিজিকে দান করেন। কলকাতার নিম্নবর্ণের নারীরাও কংগ্রেস তহবিলে প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মূল্যায়ন –

এই আন্দোলনে প্রধানত শহুরে মহিলারা অংশগ্রহণ করেন। তারা বয়কট কর্মসূচিতে ও পথসভায় যোগ দেন। কিন্তু তাদের প্রচার বা আবেদন গ্রামের সিংহভাগ নারীর কাছে পৌঁছোয়নি। তারা আন্দোলনের উদ্দেশ্য বা কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। নারীমুক্তির কোনো কর্মসূচিও তাদের ছিল না। তবুও দীর্ঘদিনের জড়তা ভেঙে নারীদের পথে নামা ভারতীয় রাজনীতির আঙিনায় এক অভিনব ঘটনা ছিল। উপরন্তু এই সময় যে চেতনা সীমিত নারীর মধ্যে সঞ্চারিত হয় আগামী দিনে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে।

আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার বিষয়টি আলোচনা করো। বিশেষত এই আন্দোলনে বাংলার নারীদের ভূমিকা কী ছিল তা লেখো।

আইন অমান্য আন্দোলনের ভূমিকা –

গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত দ্বিতীয় সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন ছিল আইন অমান্য আন্দোলন। এই আন্দোলন লবণ সত্যাগ্রহ নামেও পরিচিত। এই আন্দোলনে সমস্ত সামাজিক শ্রেণি অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।

আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা –

অসহযোগ আন্দোলনের মতো এই আন্দোলনেও নারীসমাজ বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে।

আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের নেতৃত্ব –

এই আন্দোলনে বিভিন্ন নেতাদের পাশাপাশি বহু নেত্রীও ছিলেন। তারা জাতীয় ও আঞ্চলিক স্তরে আন্দোলন পরিচালনা করেন। এঁদের মধ্যে বিশিষ্টরা হলেন – সরোজিনী নাইডু, কমলা নেহরু, স্বরূপ রানি, নেলী সেনগুপ্ত, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, আশালতা সেন, উর্মিবালা পারিয়া, লাবণ্যলতা চন্দ, সুষমা পালিত প্রমুখ।

আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের সংগঠন –

সরোজিনী নাইডুর সভাপতিত্বে রাষ্ট্রীয় স্ত্রী সংঘ বোম্বাইতে বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। দেশ সেবিকা সংঘ নামে আর-একটি নারী সংগঠন গড়ে ওঠে। এই সংগঠনগুলি তাদের সদস্যাদের আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নিতে নির্দেশ দেয়।

আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের কার্যকলাপ –

অধ্যাপক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পলাশি থেকে পার্টিশান’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, নারীদের অংশগ্রহণের দিক থেকে বোম্বাই -এর আন্দোলন ছিল সবচেয়ে সংগঠিত, বাংলার আন্দোলন ছিল সবচেয়ে উগ্র এবং মাদ্রাজের আন্দোলন ছিল সীমিত। জেরাল্ডিন ফোর্বস-ও এই মত সমর্থন করেছেন।

গান্ধিজি 3 এপ্রিল, 1930 খ্রিস্টাব্দে ডান্ডিতে লবণ আইন ভঙ্গ করার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার নারী লবণ আইন ভঙ্গ করেন। দোকানে দোকানে পিকেটিং এবং বিদেশি পণ্য বয়কট আন্দোলন চালান তারা। দিল্লিতে প্রায় 1500 নারী কারাবরণ করেন। 13 এপ্রিল অমৃতসর হত্যাকাণ্ডের বর্ষপূর্তিতে সেখানে আইন অমান্য করা হয়। এক্ষেত্রে অন্যতম নেত্রী ছিলেন অবন্তিকা ভাই গোখেল। এলাহাবাদ, লখনউ, লাহোর-এ আন্দোলনে নারীরা পথে নামেন।

গান্ধিজি সুরাট জেলার ধরসানার সরকারি লবণগোলা দখলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু 1930 খ্রিস্টাব্দের 4 মে তাঁকে গ্রেফতার করা হলে সরোজিনী নাইডু ওই লবণগোলা দখল করেন। কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় 15,000 সত্যাগ্রহী-সহ ওয়াদালা লবণ কারখানায় বিক্ষোভ দেখান।

আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার বিষয়টি আলোচনা করো। বিশেষত এই আন্দোলনে বাংলার নারীদের ভূমিকা কী ছিল তা লেখো।

আইন অমান্য আন্দোলনে বাংলার নারীদের ভূমিকা –

এই আন্দোলন ছিল সর্বভারতীয়। তাই ভারতের অন্যান্য স্থানের মতো বাংলাদেশেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

কলকাতায় প্রধানত নারীরা আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনা করেন। সরলাদেবী, ঊর্মিলা দেবী এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাঁরা পথসভা ও বয়কট কর্মসূচি পালন করেন এবং দলবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। আরামবাগে সরকারি কর আদায়ের চেষ্টাকে সেখানকার নারীরা যৌথভাবে প্রতিরোধ করেন। বাঁকুড়ায় সুষমা পালিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। বাঁকুড়ার ইন্দাস অঞ্চলের নারীরা রাস্তায় শুয়ে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মেদিনীপুরের কেশপুর অঞ্চলে নারী সত্যাগ্রহীদের উপর পুলিশি নিপীড়ন চলে, ঊর্মিবালা পারিয়া শহিদ হন।

একইভাবে বীরভূমে সত্যবালা দেবী, ঢাকায় আশালতা সেন, কুমিল্লায় লাবণ্যলতা চন্দ আইন অমান্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এভাবে বাংলার নারীসমাজ এই আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে।

আইন অমান্য আন্দোলনের মূল্যায়ন –

আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ আগের আন্দোলনগুলিতে নারীদের অংশগ্রহণের তুলনায় বেশি ছিল। পুলিশি নিপীড়নকে অগ্রাহ্য করে নারীরা পথে নামে। এই প্রবণতা নারীদের রাজনৈতিক চেতনা ও দেশাত্মবোধের পরিচায়ক হয়ে ওঠে। ফলে আগামী দিনের আন্দোলনে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে ওঠেন।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা –

1905 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড কার্জন বাংলাকে দ্বিধাবিভক্ত করেন। এর প্রতিবাদে বঙ্গভঙ্গবিরোধী বা স্বদেশি আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে বিপ্লববাদের সূত্রপাত হয়। এই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলা তথা ভারতীয় নারীসমাজও যুক্ত হয়।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারী –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে প্রথাগত নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি বা নরমপন্থা অনুসরণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে কোনো প্রতিকার না পেয়ে বাঙালি যুবসমাজ হতাশ হয়ে পড়ে। তখন তারা দাবি আদায় বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য অস্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। ইংরেজ কর্মকর্তাদের হত্যা করার জন্য তারা বোমা-পিস্তলের ব্যবহার করে। নারীরাও এই কাজে পিছিয়ে ছিলেন না।

ভগিনী নিবেদিতা –

বিপ্লববাদ প্রচারে ভগিনী নিবেদিতা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তিনি ম্যাৎসিনির জীবনীগ্রন্থের একটি কপি অনুশীলন সমিতিকে উপহার দেন। এই গ্রন্থ থেকে বিপ্লবীরা গেরিলা যুদ্ধপদ্ধতি সম্বন্ধে ধারণা লাভ করে। এ ছাড়া ক্রপটকিনের লেখা ‘বিপ্লবীর আত্মকথা’ (Memories of a Revolutionist) এবং ‘রুশ ও ফরাসি কারাগার’ (In Russian and French Prisons) গ্রন্থ দুটিও তিনি বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে উপহার দেন।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের সাহায্যকারী –

বাংলার নারীরা বিভিন্নভাবে বিপ্লবীদের সাহায্য করেন। কুমিল্লায় মৃণালিনী দেবী, মনোরমা দেবী ও হেমপ্রভা দেবী নিজেদের বাড়িতে অস্ত্র মজুত, বিপ্লবীদের আশ্রয়দান ও অস্ত্র সরবরাহের কাজ করতেন। অনুরূপভাবে ফরিদপুরের সৌদামিনী দেবী, বরিশালের সরোজিনী সেন, ঢাকার ব্রহ্মময়ী সেন, বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী নিজ নিজ এলাকায় বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের বিপ্লবী সংগঠন –

কলকাতায় সরলাদেবী চৌধুরাণী বিপ্লবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তিনি নিজ বাড়িতে আখড়া গড়ে তোলেন। একজন প্রশিক্ষক নিয়োগ করে সেখানে বিপ্লবীদের শরীরচর্চা ও অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হত। এ ছাড়া সরলাদেবী ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ ও ‘বীরাষ্টমী ব্রত’ পালন করেন। এভাবে তিনি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।

দীপালি সংঘ –

1923 খ্রিস্টাব্দে লীলা নাগ (রায়) ঢাকায় দীপালি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিসংগ্রামের জন্য নারীদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। এই সংঘে নারীশক্তির জাগরণের জন্য শরীরচর্চা ও অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হত। এর পাশাপাশি নারীদের উচ্চশিক্ষার জন্য উৎসাহও দেওয়া হত। এই সংঘ ঢাকায় একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এর শাখাপ্রশাখা গড়ে তোলা হয়। শাখাগুলিতে একই কার্যক্রম অনুসরণ করা হত।

বিশিষ্ট নারী বিপ্লবী –

গান্ধিজির অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের হঠাৎ সমাপ্তি জনমনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ফলে বিপ্লববাদ আবার জাগ্রত হয়। এই বিপ্লববাদে নারীরাও অংশগ্রহণ করেন।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার –

বাংলা তথা ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার একটি বিশিষ্ট নাম। মানিনী চ্যাটার্জি তাঁর ‘Do & Die’ গ্রন্থে তাঁকে ঝাঁসির রানির পর ‘দ্বিতীয় মহিলা শহিদ’ বলে অভিহিত করেছেন।

প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে ছাত্রী থাকাকালীন বিপ্লববাদের সঙ্গে যুক্ত হন। চট্টগ্রামে সূর্য সেনের বিপ্লবী দল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সংগঠন গড়ে উঠলে প্রীতিলতা এই সংগঠনে যোগদান করেন। তিনি দীপালি সংঘের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম নন্দনকানন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন।

1930 খ্রিস্টাব্দের 28 এপ্রিল বিপ্লবী সূর্য সেনের দলের সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অংশগ্রহণ করেন। পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে তিনি একজনকে নিহত ও কয়েকজনকে আহত করেন। শেষে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ না করার উদ্দেশ্যে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন প্রীতিলতা।

কল্পনা দত্ত –

সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযানের অপর এক নারীবিপ্লবী ছিলেন কল্পনা দত্ত। তিনি বেথুন কলেজের বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন। এসময় তিনি ডিনামাইট ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েন। তারপর সূর্য সেনের সহযোগী হিসেবে ব্রিটিশবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। পরে তিনি গ্রেফতার হন এবং বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

অন্যান্য –

এ ছাড়া বীণা দাস নামে এক ছাত্রী বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করেন এবং কুমিল্লার দুই ছাত্রী শান্তি ও সুনীতি জেলাশাসককে গুলি করে হত্যা করেন।

ঝাঁসির রানি বাহিনীর অভিযান –

1944 খ্রিস্টাব্দে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারত অভিযান করে। আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযানে ঝাঁসির রানি ব্রিগেড অংশগ্রহণ করে। কিন্তু 1945 খ্রিস্টাব্দের প্রর্বল যুদ্ধে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ক্যাপটেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। এই বাহিনীতে প্রায় 1500 জন নারী যোগদান করেছিলেন।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের মূল্যায়ন –

এভাবে নারীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন। ব্যাপ্তিতে সীমিত হলেও প্রকৃতিগতভাবে তা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ছিল। বিপ্লববাদ ইংরেজ শাসকদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছিল। সেই ভীতিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল নারী বিপ্লবীদের দুঃসাহসিক কার্যকলাপ।

স্বদেশি আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা কী ছিল? এই সময়কার সমিতিগুলির কথা আলোচনা করো।

স্বদেশি আন্দোলনের ভূমিকা –

1905 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড কার্জন বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করেন। প্রতিবাদে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন হয়, যা স্বদেশি আন্দোলন নামেও পরিচিত। এই আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিল বাংলার ছাত্রসমাজ। তারা বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। আর এই সময় বিভিন্ন গুপ্ত সমিতিও গড়ে ওঠে।

স্বদেশি আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা কী ছিল? এই সময়কার সমিতিগুলির কথা আলোচনা করো।

স্বদেশি আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা –

স্বদেশি আন্দোলন তখনকার বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

স্বদেশি ও বয়কট –

বাংলার ছাত্রসমাজ এই কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে পথে নামে। বয়কট ছিল বিদেশি পণ্যদ্রব্য বর্জন করার নীতি। ছাত্রসমাজ দল বেঁধে দোকানে দোকানে পিকেটিং করে। তারা দোকানদারদের বিদেশি পণ্যদ্রব্য বিক্রি না করার এবং ক্রেতাদের বিদেশি পণ্যদ্রব্য না কেনার আবেদন জানায়। দোকানের সামনে দীর্ঘকালীন অনশন করে বসে থাকে। ছাত্ররা সরকারি স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিয়ে, পথে পথে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে এবং পথসভা করে।

এ ছাড়া ছাত্ররা দেশীয় কাপড়ের কল থেকে কাপড় কিনে মাথায় করে নিয়ে রজনীকান্তের ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গান গাইতে গাইতে কাপড় বিক্রি করতে পথে নামে।

  • সভা – স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলাদেশে অনেকগুলি রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এইসব সভায় উপস্থিত জনতার একটি বড়ো অংশ ছিল ছাত্রদল। সভার বক্তব্যের দ্বারা তারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় এবং আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
  • সরকারি নিপীড়ন – ছাত্ররাই ছিল স্বদেশি আন্দোলনের মূল শক্তি, তাই তাদের এই আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে একের পর এক জারি করা হয় কার্লাইল সার্কুলার (1905 -এর 10 অক্টোবর), লিয়ন সার্কুলার (1905 -এর 16 অক্টোবর) ও পেডলার সার্কুলার (1905 -এর 21 অক্টোবর)। এইসব সার্কুলার দ্বারা ছাত্রদের স্বদেশি সভাসমিতিতে যোগদান, ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দেওয়া এবং বিদেশি পণ্যাগারের সামনে পিকেটিং করা নিষিদ্ধ করা হয়। বলা হয়, এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে বেত্রাঘাত, বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, এমনকি বিদ্যালয়ের অনুমোদন ও অনুদান বাতিল করা হবে। এরপর সরকার নির্দেশিকা কার্যকর করে। বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের অনুমোদন বাতিল করে বহু ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়।
  • জাতীয় শিক্ষা – সরকারি অনাচারের প্রতিবাদে 1905 খ্রিস্টাব্দের 8 নভেম্বর রংপুরে সর্বপ্রথম ‘জাতীয় বিদ্যালয়’ গড়ে ওঠে। 1906 খ্রিস্টাব্দের 11 মার্চ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় 92 জন সদস্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

স্বদেশি আন্দোলনের সমসাময়িক সমিতিসমূহ –

স্বদেশি আন্দোলনের সময় বেশ কিছু সমিতি কার্যকরী ছিল। সমিতিগুলি হল –

অনুশীলন সমিতি – 1902 খ্রিস্টাব্দে অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অনুশীলন তত্ত্ব’ এই সমিতির আদর্শ ছিল। সতীশচন্দ্র বসু এই সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র এর সভাপতি ছিলেন। বহু ছাত্র এই সমিতির সদস্য ছিল। স্বদেশি আন্দোলনে এই সমিতির অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

স্বদেশি আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা কী ছিল? এই সময়কার সমিতিগুলির কথা আলোচনা করো।
  • যুগান্তর দল – 1906 খ্রিস্টাব্দে এই বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভগিনী নিবেদিতা, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো প্রমুখ মিলে এই সমিতি গড়ে তোলেন। স্বদেশি আন্দোলনের সশস্ত্র ধারায় এই সমিতির অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য।
  • অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি – সরকারি সার্কুলারের বিরুদ্ধে শচীন্দ্রপ্রসাদ বসুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি। এই সমিতির কাজ ছিল কার্লাইল সার্কুলার দ্বারা বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত ছাত্রদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা, দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশি আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করা, বিদেশি পণ্যাগারের সামনে পিকেটিং করা এবং গ্রামে ও শহরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বদেশি দ্রব্য সরবরাহ করা।
  • ডন সোসাইটি – 1902 খ্রিস্টাব্দে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ডন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় শিক্ষার প্রসার ও বয়কট আন্দোলনে স্কুলছুট ছাত্রদের জন্য এই সমিতি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে।
  • অন্যান্য – এ ছাড়া এ যুগে অশ্বিনীকুমার দত্তের স্বদেশবান্ধব সমিতি, স্বদেশ সেবা সমিতি, শক্তি সমিতি এবং আত্মোন্নতি সমিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সমিতিগুলি প্রধানত শরীরচর্চার কেন্দ্র ছিল।

স্বদেশি আন্দোলনে ছাত্রদের মূল্যায়ন –

বাংলার ছাত্রসমাজ ও বিভিন্ন সমিতি এভাবে স্বদেশি যুগে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে। সরকারি নিপীড়ন ভোগ করেও তারা জাতীয়তাবাদ, স্বদেশি ও বয়কটের প্রচারে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু তারা ছিল বাংলার ছাত্রসমাজের এক সীমিত অংশ। এই সমিতিগুলির কার্যকলাপও ছিল সীমিত। তাই বৃহত্তর ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের আন্দোলন তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করো।

অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা –

স্বাধীনতা সংগ্রামের অঙ্গ হিসেবেই ভারতে ছাত্র-আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় সর্বপ্রথম ছাত্র-আন্দোলন সংঘটিত হলেও 1902 -এর দশকে অসহযোগ আন্দোলনকালে ছাত্র-আন্দোলনের পরিধি ও ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরবর্তীকালে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় ছাত্র-আন্দোলন আরও প্রসারিত হয়।

অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ –

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন –

অসহযোগ আন্দোলন –

এই আন্দোলনের অন্যতম কর্মসূচি ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন। আন্দোলনের সূচনার পর বঙ্গবাসী ও বিদ্যাসাগর কলেজের সহস্রাধিক ছাত্র ক্লাস বয়কট করে আন্দোলনকে সমর্থন করে। তাদের দেখাদেখি একে একে রিপন, সিটি, স্কটিশচার্চ কলেজের ছাত্ররাও এই আন্দোলনে শামিল হয়। গান্ধিজি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার জন্য ডিগ্রি লাভ করলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ চরিতার্থ হবে। তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। বাংলাদেশে চিত্তরঞ্জন দাশ ছাত্রদের বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জনে উৎসাহ দেন। বাংলা থেকে ক্রমশ আসাম, বোম্বাই, মাদ্রাজ ও লাহোরের ছাত্ররা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন করে আন্দোলনে শামিল হয়। সরকারি হিসাব থেকে জানা যায়, 52,482 জন ছাত্র কলেজ এবং 12,81,810 জন ছাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় ত্যাগ করে।

অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করো।
আইন অমান্য আন্দোলন –

এই আন্দোলনেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন কর্মসূচি পালন করা হয়। গুজরাটের আহমেদাবাদ, সুরাট ও খেদার স্কুল কলেজের ছাত্ররা এই আন্দোলনে যোগ দেয়। মধ্যপ্রদেশের সমস্ত সরকারি কলেজ, 18টি উচ্চ সরকারি বিদ্যালয় এবং চারটি অ্যাংলো ভার্নাকুলার মিডল স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। বেনারস ও এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে। আসামের কয়েকটি স্কুল ও কলেজের ছাত্ররা আন্দোলনে অংশ নেয়। কলকাতায় ইতিপূর্বে নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি (All Bengal Students’ Association) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (1928 খ্রিস্টাব্দ) এবং এই সমিতির উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন কলেজ ও স্কুলের ছাত্ররা তাদের ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেছিল। অসহযোগ আন্দোলনের চেয়ে এই আন্দোলনে প্রায় তিনগুণ বেশি ছাত্র অংশগ্রহণ করেছিল।

ছাত্রদের অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচি –

অসহযোগ আন্দোলন –

এই আন্দোলনে ছাত্রসমাজ ধর্মঘট ও শোভাযাত্রা করে। আন্দোলনকালে সংগঠিত বিভিন্ন জনসভাতে হাজার হাজার ছাত্র সমবেত হয়। কলকাতার মির্জাপুরে এক ছাত্রসমাবেশে চিত্তরঞ্জন দাশ অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘বাংলার ছাত্রসমাজ – আমি তোমাদের নমস্কার করি’। গান্ধিজিও বলেন, ‘বাংলার ছাত্রসমাজই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে, এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।’ একইভাবে বোম্বাই, মাদ্রাজ ও লাহোরে ছাত্ররা ধর্মঘট ও সভা করে। যুক্তপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামে সীমিত ও স্বল্পস্থায়ী ছাত্র আন্দোলন হয়। প্রিন্স অফ ওয়েলস -এর ভারত সফরের বিরুদ্ধে বোম্বাই -এর ছাত্ররা ধর্মঘট ও প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখায়।

আইন অমান্য আন্দোলন –

আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। বিভিন্ন শহরের ছাত্ররা দোকানে দোকানে পিকেটিং এবং পথে পথে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। যুক্তপ্রদেশেও ছাত্র-বিক্ষোভ প্রবল হয়ে ওঠে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠন বন্ধ হয়ে যায়। আসামের ছাত্ররা আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তারা পথসভার মাধ্যমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই ছাত্র-আন্দোলন দমনের জন্য শিক্ষাবিভাগের অধিকর্তা কানিংহাম এক নির্দেশিকা জারি করেন। ঘোষিত হয়, রাজনৈতিক আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ করা চলবে না। এই নির্দেশিকার পর ছাত্ররা আরও বেশি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন করতে থাকে। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে।

বাংলাদেশেও ছাত্রসমাজ আইন অমান্য আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। কলকাতায় নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি 1930 খ্রিস্টাব্দের 12 মার্চ কলকাতার হাজরা পার্কে বিরাট ছাত্রসমাবেশের আয়োজন করে। এই সমিতি কলকাতার অ্যালবার্ট হলে অপর একটি সমাবেশ করে 1930 খ্রিস্টাব্দের 6 এপ্রিল। এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জে এম সেনগুপ্ত। 1930 খ্রিস্টাব্দের 11 এপ্রিল কলেজ স্কোয়ারেও একটি ছাত্রসমাবেশ আয়োজিত হয়। এখানে ছাত্ররা আইন অমান্য কর্মসূচি পালন করে। পুলিশ আইন অমান্যকারী ছাত্রদের উপর লাঠি চালায়।

এই আন্দোলনে ছাত্রীরাও পিছিয়ে ছিল না। উর্মিলা দেবীর সভাপতিত্বে নারী সত্যাগ্রহ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের ছাত্রীরা আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। শান্তি দাসের বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও অবস্থান-বিক্ষোভ করে। এজন্য পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে।

অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের মূল্যায়ন –

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায়, অসহযোগ আন্দোলনের তুলনায় আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্ররা বেশি সংখ্যায় অংশগ্রহণ করে। তবে অসহযোগ আন্দোলনের সময় মুসলিম ছাত্রদের বিভিন্ন অঞ্চলে বা রাজ্যে যে সাড়া পাওয়া যায় আইন অমান্য আন্দোলনে তা ছিল না বললেই চলে। অনেক বেশি সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিক্ষোভ সমাবেশ ও কারা বরণের সংখ্যাও অসহযোগ আন্দোলনের থেকে আইন অমান্য আন্দোলনে অনেক বেশি ছিল। তবুও বলতে হয়, এই ছাত্ররা ছিল শহুরে এবং তাদের আন্দোলন ছিল সীমিত। ছাত্ররা ছিল আন্দোলনের অংশীদারমাত্র, কোনো দিকনির্দেশক নয়। তারা রাজনৈতিক নেতাদের হাতিয়ার ছিল মাত্র। রাজনৈতিক নেতাদের এই আন্দোলনকে তারা প্রভাবিত করতে পারেনি।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলার ছাত্রদের অংশগ্রহণের প্রকৃতি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ভূমিকা –

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রসমাজ বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে। বিপ্লবীদের স্মৃতিকথা, সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণী বা সরকারি প্রতিবেদন থেকে বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের কথা জানা যায়। যেসব ছাত্র সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান করে, তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছিল, কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের বিপ্লবী দলসমূহ –

বিপ্লববাদ প্রসারে বাংলাদেশে কয়েকটি গুপ্তসমিতির অবদান ছিল। এই সমিতিগুলি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আগে এবং পরে গড়ে ওঠে। এই সমিতিগুলিতে যোগদানের মাধ্যমে বাংলার ছাত্রসমাজ সশস্ত্র বৈপ্লবিক কাজে অংশগ্রহণ করে।

অনুশীলন সমিতি –

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় -এর ‘অনুশীলন তত্ত্ব’ এই বিপ্লবী দলের আদর্শ ছিল। 1902 খ্রিস্টাব্দে সতীশচন্দ্র বসু অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। বহু ছাত্র এই দলের সদস্য ছিল। এখানে শারীরশিক্ষা ও অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হত।

যুগান্তর দল –

ভগিনী নিবেদিতা ও অরবিন্দ ঘোষের উৎসাহে 1906 খ্রিস্টাব্দে যুগান্তর দল প্রতিষ্ঠিত হয়। বারীন্দ্র ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো এই দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এই দল তার সদস্যদের শারীরশিক্ষা ও অস্ত্রশিক্ষা দিত। এখানে বোমা তৈরি করার প্রশিক্ষণও সদস্যদের দেওয়া হত।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলার ছাত্রদের অংশগ্রহণের প্রকৃতি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি –

স্বদেশি আন্দোলনের সময় স্কুলছুট ছাত্রদের সাহায্যের জন্য এই সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় 1905 খ্রিস্টাব্দে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু। ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন নামে এই সমিতির একটি শাখা ছিল। সেখানে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হত।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স –

1905 খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুক্তিসংঘ 1928 খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (BV) নামে পরিচিত হয়। এই দলের কার্যাবলি মুক্তিসংঘের সদস্যদের পরিচালনায় পরবর্তীকালে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।

ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি –

চট্টগ্রামের এক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সূর্য সেন। তিনি 1918 খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে বিপ্লবী দলটি গঠন করেন। এখানে সদস্যদের অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির শিক্ষা দেওয়া হত।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ –

বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা এইসব বিপ্লবী দলে বহুসংখ্যক ছাত্র যোগদান করেছিল। এদের বিভিন্ন দুঃসাহসিক বৈপ্লবিক অভিযানেও ছাত্ররা অংশগ্রহণ করত।

কিংসফোর্ড হত্যা –

স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন কিংসফোর্ড। তিনি খুব অত্যাচারী ছিলেন। বিপ্লবীরা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তাকে মুজফফরপুরে বদলি করা হয়। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে মুজফ্ফরপুর যান। কিন্তু ভুলবশত তাঁরা অন্য এক ইংরেজ ব্যক্তিকে হত্যা করেন। প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করেন। ক্ষুদিরাম বসু ধরা পড়েন এবং বিচারে 1908 খ্রিস্টাব্দে তাঁর ফাঁসি হয়।

লোম্যান হত্যা –

ঢাকা পুলিশের ইনস্পেকটর জেনারেল লোম্যান খুব অত্যাচারী ছিলেন। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সদস্য এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বিনয়কৃষ্ণ বসু তাকে গুলি করে হত্যা করেন।

রাইটার্স অভিযান –

1930 খ্রিস্টাব্দের 8 ডিসেম্বর বাংলার শাসনকেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং-এ অভিযান চালান তিন বিপ্লবী ছাত্র- বিনয়কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত। তাঁরা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সদস্য ছিলেন। তাঁরা কারা বিভাগের কর্তা সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন। আরেক কর্তা ক্রেগকেও গুলি করেন। বিনয় ও বাদল আত্মহত্যা করেন। পরে দীনেশের ফাঁসি হয়।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন –

ছাত্রদের নিয়ে মাস্টারদা সূর্য সেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি গড়ে তোলেন। তিনি এই দলের সাহায্যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন 1930 খ্রিস্টাব্দের 18 এপ্রিল। সরকারি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি জালালাবাদ পাহাড়ে তিন দিন ধরে অসম যুদ্ধ চালিয়ে যান।

অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেটদের হত্যা –

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের তিন সদস্য বিমল দাশগুপ্ত, প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য এবং অনাথবন্ধু পাঁজা তিন ম্যাজিস্ট্রেট যথাক্রমে পেডি (1931 খ্রিস্টাব্দ), ডগলাস (1932 খ্রিস্টাব্দ) এবং বার্জাকে (1932 খ্রিস্টাব্দ) গুলি করে হত্যা করেন।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের মূল্যায়ন –

এইভাবে বাংলার ছাত্রসমাজ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে প্রতিবাদ জানায়। বিপ্লবী আদর্শ তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। ফলে সশস্ত্র প্রতিবাদ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে পরিণত হয়। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ইংরেজ সাহেবকে হত্যা ও বিপ্লবীদের কার্যকলাপে ইংরেজ সরকার সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স -এর বিষয়ে আলোচনা করো। সূর্য সেনের কৃতিত্ব লেখো।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স -এর ভূমিকা –

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সশস্ত্র আন্দোলনের একটি ধারা লক্ষ করা যায়। ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই সশস্ত্র ধারায় বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনের অবদান ছিল লক্ষণীয়। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল ছিল এইরকম একটি আঞ্চলিক সংগঠন। এ ছাড়াও সূর্য সেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে একটি আঞ্চলিক বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। এদের কার্যকলাপ ব্রিটিশ শাসকদের মনে ভীতির সঞ্চার করে।

বেঙাল ভলান্টিয়ার্স দল –

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল ছিল বাংলাদেশের একটি গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি।

  • প্রতিষ্ঠা – বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন আন্দোলন ও গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি গড়ে ওঠে। ঢাকার মুক্তিসংঘ ছিল সেইরকমই একটি বিপ্লবী সমিতি। হেমচন্দ্র ঘোষ 1905 খ্রিস্টাব্দে এই সমিতির প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এই বিপ্লবী সমিতি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স নামে পরিচিত হয়।
  • কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন – 1928 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনের সময় সুভাষচন্দ্র বসু একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গড়ে তোলেন। ঢাকার মুক্তিসংঘের অধিকাংশ সদস্য এই স্বেচ্ছাসেবী দলে যোগ দেন। মেজর সত্য গুপ্ত তাদের সামরিক কায়দায় প্রশিক্ষণ দেন। এই দলের সর্বাধিনায়ক হন সুভাষচন্দ্র বসু। কলকাতা অধিবেশন শেষ হলে এই দল বিপ্লবী সংগঠনে পরিণত হয়।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স -এর কার্যকলাপ –

  • ঢাকা – এই দল ‘অপারেশন ফ্রিডম’ নামে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার মধ্যে ছিল কারাবন্দিদের উপর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিশোধ নেওয়ার কর্মসূচি। এজন্য এই দলের সদস্যরা ইনস্পেকটর জেনারেল অফ পুলিশ লোম্যানকে গুলি করে হত্যা করেন 1930 খ্রিস্টাব্দে।
  • কলকাতা – বিনয়কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করেন 1930 খ্রিস্টাব্দের 8 ডিসেম্বর। তাঁরা কারা বিভাগের অধ্যক্ষ সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন। আরেক সরকারি কর্তা ক্রেগকেও গুলি করেন। এরপর টেগার্ট-এর নেতৃত্বে এক পুলিশবাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে। রাইটার্স বিল্ডিং-এ দু-পক্ষে গুলিবিনিময়ের ঘটনা অলিন্দ যুদ্ধ নামে পরিচিত। বিনয় ও বাদল আত্মহত্যা করলেও দীনেশের আত্মহত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে দীনেশের ফাঁসি হয়।
  • মেদিনীপুর – বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সদস্য বিমল দাশগুপ্ত জেলাশাসক পেডিকে 1931 খ্রিস্টাব্দে হত্যা করেন। প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য জেলাশাসক ডগলাসকে হত্যা করেন 1932 খ্রিস্টাব্দে। অনাথ পাঁজা ও মৃগেন দত্ত জেলাশাসক বার্জকে হত্যা করেন 1930 খ্রিস্টাব্দে।

সূর্য সেনের কৃতিত্ব –

বাংলাদেশের সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যকলাপের ইতিহাসে সূর্য সেনের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি চট্টগ্রামের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এজন্য তিনি ‘মাস্টারদা’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি প্রথমে 1918 খ্রিস্টাব্দে একটি গুপ্ত বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন। এজন্য 1923 খ্রিস্টাব্দে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। বিচারে তিনি মুক্তিলাভ করেন। তারপর চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের নিয়ে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে একটি দল গড়ে তোলেন।

সূর্য সেনের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রাম থেকে ইংরেজ প্রশাসন লোপ করা। তিনি আশা করেছিলেন যে, এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দেশের অন্যান্য স্থানের বিপ্লবীরা ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটাবে। এভাবে ভারতে ইংরেজ রাজত্বের অবসান ঘটবে।

এই লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পরিকল্পনা করেন। 1930 খ্রিস্টাব্দের 18 এপ্রিল রাত্রিতে তাঁর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা সদলবলে পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন এবং অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন। অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। তিনি এখানে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। সূর্য সেন নিজেকে এই সরকারের প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করেন। তারপর ইংরেজ সৈন্যরা পাহাড় ঘিরে ফেললে দু-পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়। এই অসম যুদ্ধে বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধা শহিদ হন। সূর্য সেন-সহ কয়েকজন পালিয়ে যান। কিন্তু পরে সূর্য সেন ধরা পড়েন। বিচারে 1934 খ্রিস্টাব্দের 12 জানুয়ারি মাস্টারদার ফাঁসি হয়।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স -এর বিষয়ে আলোচনা করো। সূর্য সেনের কৃতিত্ব লেখো।

মূল্যায়ন –

ভারতীয় বিপ্লববাদের জনক বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে বিপ্লবের যে আগুন জ্বেলেছিলেন তা ভারতের পূর্বপ্রান্তেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বাঙালি বিপ্লবীরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ইংরেজ সরকার ও তার সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের শক্তি আর বিপ্লবীদের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী জীবন ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা করো।

মাস্টারদা সূর্য সেনের ভূমিকা –

ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের একটি ধারা বিদ্যমান ছিল। এক্ষেত্রে যেসকল বাঙালি বিপ্লবীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সূর্য সেন।

মাস্টারদা সূর্য সেনের পূর্ব সমিতি –

সূর্য সেন 1894 খ্রিস্টাব্দের 22 মার্চ চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রামেই পড়াশোনা করেন এবং চট্টগ্রাম জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। স্কুল শিক্ষক ছিলেন বলে তিনি ‘মাস্টারদা’ নামে অধিক পরিচিত। শিক্ষকতা করার সময় থেকেই তিনি গভীরভাবে বিপ্লবী আদর্শের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী জীবন ও কার্যকলাপ –

  • মাস্টারদার আদর্শ – মাস্টারদা বিশ্বাস করতেন ব্রিটিশদের জোর করে এদেশ থেকে না তাড়ালে তারা কিছুতে ভারত ছেড়ে যাবে না। ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়াতে হলে সশস্ত্র আন্দোলন প্রয়োজন।
  • ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি প্রতিষ্ঠা – সূর্য সেন চট্টগ্রামের যুগান্তর গোষ্ঠীর বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তারা জাতীয় কংগ্রেস -এর গণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন আবার বিপ্লবী ভাবধারায়ও উদ্বুদ্ধ ছিলেন। সূর্য সেন তাদের নিয়ে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন সূর্য সেন, সহ-সভাপতি ছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তী। চট্টগ্রাম শহর সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন গণেশ ঘোষ এবং অনন্ত সিংহ। গ্রামীণ সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন নির্মল সেন।
  • লক্ষ্য – সূর্য সেন ও এই বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল পরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রামে এক সশস্ত্র বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটানো। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে ইংরেজ শাসন লোপ করা এবং চট্টগ্রামকে স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা।
  • চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন – মাস্টারদার পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রাম শহরে ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুঠ করা। পরিকল্পনামতো 1930 খ্রিস্টাব্দের 18 এপ্রিল রাত দশটায় বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ করেন। অস্ত্র লুঠ করার পর বিপ্লবীরা অস্ত্রাগারটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিপ্লবীরা টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, রেল-সহ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই ঘটনাই সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নামে পরিচিত।
  • অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা – এই সময়ে সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রামে একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এই অস্থায়ী বিপ্লবী প্রজাতান্ত্রিক সরকারের রাষ্ট্রপতি হন মাস্টারদা স্বয়ং। একটি বিপ্লবী ইস্তাহার প্রচারের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষিত হয়। তার সঙ্গে ‘গান্ধিজি এসে গেছে’ – এই স্লোগান দেওয়া হয়।
  • জালালাবাদের মুক্তিযুদ্ধ – চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বিপ্লবীরা নিকটবর্তী জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। বিপ্লবীরা টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিল বলে ইংরেজ সরকার চট্টগ্রামের অভ্যুত্থানের খবর সঙ্গে সঙ্গে পায়নি। কয়েকদিন পর চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা একটি রুশ জাহাজের রেডিয়ো বার্তা থেকে সরকার সেই ঘটনার কথা জানতে পারে। তখন ইংরেজবাহিনী জালালাবাদ পাহাড় ঘিরে ফেলে। বিপ্লবী ও ইংরেজ সেনাদের মধ্যে অসম যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমদিকে বিপ্লবীদের গুলিতে 80 জন ইংরেজ সেনা নিহত হয়। তারপর ইংরেজ সৈন্যদের পালটা আক্রমণে 12 জন বিপ্লবী শহিদ হন। কয়েকজন বিপ্লবী গ্রেফতার হন এবং সূর্য সেন পালিয়ে যান।
  • ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ – পলাতক সূর্য সেন ধলঘাট গ্রামে আত্মগোপন করেন। স্থানীয় নন্দন কানন স্কুলের শিক্ষিকা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সূর্য সেনের বিপ্লবী মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে চট্টগ্রাম পাহাড়তলি ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এই আক্রমণে কয়েকজন হতাহত হয় (24 সেপ্টেম্বর, 1932 খ্রিস্টাব্দে)। প্রীতিলতা আত্মহত্যা করেন।
  • মাস্টারদার গ্রেফতার – চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর থেকে ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের ধরার জন্য ব্যাপক তল্লাশি শুরু করে। সূর্য সেনকে ধরার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। অবশেষে 1933 খ্রিস্টাব্দের 17 ফেব্রুয়ারি গৈরলা গ্রামে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
  • মাস্টারদার ফাঁসি – গ্রেফতারের পর মাস্টারদার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। বিচারে তাঁর ফাঁসির সাজা হয়। 1934 খ্রিস্টাব্দের 12 জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্য সেনের ফাঁসি কার্যকর হয়।

মাস্টারদা সূর্য সেনের উপসংহার –

এইভাবে এক কর্মময় বিপ্লবীর জীবনাবসান হয়। বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদের যুদ্ধে যে বীরত্ব দেখিয়েছেন তা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। তিনি ছিলেন ভারতীয় বিপ্লবীদের কাছে মাতৃমুক্তিযজ্ঞে আত্মবলিদানের প্রেরণাস্বরূপ।

বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশের বৈপ্লবিক কার্যকলাপের বিবরণ দাও।

বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশের বৈপ্লবিক ভূমিকা –

বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্নিযুগের তিন জন বিখ্যাত বিপ্লবী হলেন- বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ গুপ্ত। এঁরা বিনয়-বাদল-দীনেশ বা সংক্ষেপে বি-বা-দী নামে বিখ্যাত। এঁদের বিখ্যাত বৈপ্লবিক কার্যকলাপ ছিল মহাকরণ বা রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান, যা ইতিহাসে অলিন্দ যুদ্ধ নামে পরিচিত।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল –

1928 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের সময় সুভাষচন্দ্র বসু এক স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তোলেন। অধিবেশন শেষ হলে হেমচন্দ্র ঘোষ এই বাহিনীর কিছু সদস্য নিয়ে ঢাকায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল গঠন করেন। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা দেশসেবায় নিবেদিত ছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই গোষ্ঠীর সদস্যরা বিপ্লবী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। সূর্য সেন -এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ঘটনায় এই গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রভাবিত হন। তাঁরাও এই ধরনের সশস্ত্র অভিযানের পরিকল্পনা করেন।

বিনয় বসু –

বিনয় -এর প্রকৃত নাম বিনয়কৃষ্ণ বসু। তিনি মিডফোর্ড মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। এই সময় তিনি ঢাকায় বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে আসেন। বিনয় ও তাঁর সহযোদ্ধারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করেন। তাঁরা অত্যাচারী ইনস্পেকটর জেনারেল লোম্যানকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এই সহকর্মীকে দেখতে লোম্যানের মিডফোর্ড হাসপাতালে আসার কথা ছিল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিনয় তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তিনি লোম্যানকে খুব কাছ থেকে গুলি করেন। ঘটনাস্থলেই লোম্যানের মৃত্যু হয় এবং পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট হাডসন গুরুতর আহত হন। এরপর বিনয় ঢাকা থেকে কলকাতায় পালিয়ে আসেন।

বাদল গুপ্ত –

বাদল গুপ্তের আসল নাম সুধীর গুপ্ত। তিনি বিক্রমপুর এলাকার শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্কুলে পড়ার সময় শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের সংস্পর্শে বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত হন। তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগদান করেন।

দীনেশ গুপ্ত –

দীনেশ গুপ্ত বিক্রমপুর এলাকার যশোলং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম ছিল নসু। তিনি গৌরিপুর ও ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করেন। ছেলেবেলা থেকেই নির্ভীক ও সুবক্তা। ছোটো থেকেই তাঁর মনে স্বদেশচেতনা ও ব্রিটিশবিরোধী আদর্শ সঞ্চারিত হয়েছিল। তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে পড়াশোনার জন্য চলে আসেন মেদিনীপুরে।

রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান –

বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশের বিখ্যাত বৈপ্লবিক কাজ হল কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান। বিনয়, বাদল ও দীনেশ 1930 খ্রিস্টাব্দের 8 ডিসেম্বর দুপুর 12টায় কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন। বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল কারা বিভাগের অত্যাচারী ইন্সপেকটর জেনারেল কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা করা। তাঁরা সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন।

অলিন্দ যুদ্ধ –

পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী বিপ্লবীদের উপর পালটা আক্রমণ চালায়। রাইটার্স বিল্ডিং -এর বারান্দায় বা অলিন্দে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বলে, একে অলিন্দ যুদ্ধ বলা হয়।

অলিন্দ যুদ্ধের পরিণতি –

এই ঘটনার পর বিপ্লবীরা গ্রেফতারি এড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বাদল পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বিনয় ও দীনেশ নিজেদের গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বিনয় হাসপাতালে মারা যান। দীনেশ বেঁচে যান এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।

বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশের বৈপ্লবিক উপসংহার –

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশ স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁরা দুঃসাহসিক অভিযান ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই বিপ্লবী ত্রয়ীকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম বদলে বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ (বি-বা-দী বাগ) রাখা হয়েছে।

মহারাষ্ট্রের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের বিবরণ দাও।

মহারাষ্ট্রের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ভূমিকা –

ভারতে দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে মহারাষ্ট্র সবশেষে স্বাধীনতা হারায়। তাই মারাঠাদের মধ্যে স্বাধীনতার আকুতি প্রবল ছিল। বাংলায় অনুশীলন সমিতি নামে বিপ্লবী সমিতি গড়ে ওঠার (1902 খ্রিস্টাব্দে) অনেক আগেই মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড উগ্র রূপ লাভ করে।

  • বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে-র ভূমিকা – মহারাষ্ট্রে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা করেন বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে (1845-1883 খ্রিস্টাব্দে)। মায়ের অসুস্থতার জন্য ছুটি নামঞ্জুর, বোম্বাই প্রেসিডেন্সির দুর্ভিক্ষে বহু মানুষের মৃত্যুর জন্য তিনি উগ্র ইংরেজবিরোধী হয়ে ওঠেন। শয়নে-স্বপনে, নিদ্রায়-জাগরণে ইংরেজনিধন তাঁর লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যপূরণের জন্য তিনি রামেসিস, কোল, ভিল, পাঠান প্রভৃতিদের নিয়ে এক সশস্ত্র দল গঠন করেন। সরকারি কোশাগার লুঠ, ডাক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ করা, জেল ভেঙে বন্দিদের মুক্ত করে দলের সদস্য বৃদ্ধি করা তাঁর অন্যতম লক্ষ্য ছিল। তিনি এইভাবে বৈপ্লবিক কাজ শুরু করেন। কিন্তু ইংরেজ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠায়। কারাগারে যক্ষ্মারোগে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
  • বাল গঙ্গাধর তিলক -এর ভূমিকা – বাসুদেব বলবন্ত ফাদকের অনেক পরে মারাঠাদের মধ্যে চরমপন্থা ও উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচারে বাল গঙ্গাধর তিলক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মহারাষ্ট্রের হিন্দুদের পারিবারিক গণপতি উৎসবকে তিনি সর্বজনীনভাবে পালনের উদ্যোগ নেন (1894 খ্রিস্টাব্দে)। তিনি খ্রিস্টান, ইংরেজ ও মুসলিমদের থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষার আহ্বান জানান। মুসলিম মুঘল শক্তির আগ্রাসন থেকে শিবাজি মহারাষ্ট্র ও মারাঠা জাতিকে রক্ষা করেছিলেন। সেই স্মৃতি জাগিয়ে তোলার জন্য তিলক ‘শিবাজী উৎসব’ পালনের ব্যবস্থা করেন (1895 খ্রিস্টাব্দে)। তা ছাড়া মারহাট্টা ও কেশরী পত্রিকার মাধ্যমে তিনি যুবসমাজের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেন।
  • চাপেকার ভ্রাতৃদ্বয় -এর ভূমিকা – তিলকের নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। এই সময় দামোদর হরি চাপেকর ও বালকৃষ্ণ হরি চাপেকর নামে দুই ভাই পুনা শহরে হিন্দুধর্মের অন্তরায় বিনাশী সংঘ নামে একটি গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন (1895 খ্রিস্টাব্দে)। 1897 খ্রিস্টাব্দে তাঁরা পুনার প্লেগ কমিশনার র‍্যান্ড ও আয়স্টিকে হত্যা করেন। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে এবং বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয়।
  • বাল সমাজ – বিপ্লবী আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে বাল সমাজ নামে একটি গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমিতি বালক ও ছাত্রদের মধ্যে ইংরেজবিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ওয়ার্ধা, নাগপুর, অমরাবতী প্রভৃতি শহরে এই সমিতির শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • আর্যবান্ধব সমাজ – বাল সমাজের পাশাপাশি আর্যবান্ধব সমাজ নামে আরেকটি গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি গড়ে ওঠে। এই সমিতির লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভারত থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো। সমিতির সদস্যদের সামরিক শিক্ষা দেওয়া হত। লাহোর, বরোদা, হায়দরাবাদে সমিতির শাখা খোলা হয়। তিলক, যমুনা লাল বাজাজ, লাজপত রায়, ভাই পরমানন্দ ও বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে এই সমিতির যোগ ছিল। সমিতি সেনা অভ্যুত্থানের একটি চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
  • বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ভূমিকা – মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকর ও তাঁর ভাই গণেশ সাভারকার ‘মিত্রমেলা’ নামে একটি গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন (1899 খ্রিস্টাব্দ)। দেশের তরুণ সমাজকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা, অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া সমিতির লক্ষ্য ছিল। মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে সমিতির বহু শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। আচার্য কৃপালনী, বি জি খের এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাশিয়ার নিহিলিস্ট বিপ্লবীদের কাছে বোমা তৈরির কৌশল শেখার জন্য এই সমিতির কিছু সদস্য প্যারিস যান। সাভারকর লন্ডনে গিয়ে বোমা তৈরির কৌশল ভারতে পাঠান (1906 খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর অনুগামী মদনলাল ধিংড়া ইংল্যান্ডে স্যার কার্জন উইলিকে হত্যা করেন। তাঁর পাঠানো অস্ত্রের সাহায্যে লক্ষণ কানহেরী নাসিকের জেলাশাসক জ্যাকসনকে হত্যা করেন। সরকার এজন্য নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে। লক্ষ্মণ কানহেরীর বিচারে ফাঁসি হয়। এইসব ঘটনায় যুক্ত থাকার অপরাধে সাভারকারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু ছাব্বিশ বছর কারাভোগের পর তিনি মুক্ত হন।
  • রাসবিহারী বসুর ভূমিকা – 1914-1915 খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী আন্দোলনে গতি আসে। তাঁর অন্যতম সহযোগী বিষ্ণু গণেশ পিংলে মীরাট সেনাছাউনিতে হামলার উদ্দেশ্যে বোমা নিয়ে ঢুকে পড়েন। কিন্তু তিনি গ্রেফতার হন। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার বিচারে তাঁর প্রাণদণ্ড হয়।

মহারাষ্ট্রের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের উপসংহার –

জাতীয় রাজনীতিতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার অনেক আগে মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড শুরু হয়। জাতীয় কংগ্রেসের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের তুলনায় বিপ্লববাদ ও চরমপন্থার আবেদন এখানে প্রবল ছিল।

পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের বিবরণ দাও।

পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ভূমিকা –

বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে মহারাষ্ট্রে বিপ্লববাদের যে বীজ বপন করেছিলেন, তা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং পল্লবিত হয়ে পাঞ্জাবে শাখা বিস্তার করে। ইংরেজ সরকারের শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের যুবসমাজের একাংশ গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়।

সাহারানপুর গুপ্ত সমিতি –

1904 খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের সাহারানপুরে প্রবাসী বাঙালি জে এম চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগী যুবকেরা একটি গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। পুলিশি সক্রিয়তায় তাদের কার্যকলাপে অসুবিধা হওয়ায় এই সমিতি বুড়কীতে স্থানান্তরিত হয়। বুড়কী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অনেক ছাত্র এই সমিতিতে যোগদান করে। পরে লালা হরদয়াল, অজিত সিংহ, সুফী অম্বাপ্রসাদ এই সমিতিতে যোগদান করেন। এর ফলে সমিতির সদস্যসংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি সমিতির কার্যকলাপ বিস্তৃত হয়। এই সময় থেকেই পাঞ্জাবে বৈপ্লবিক কার্যকলাপ শুরু হয়।

লালা হরদয়াল, অম্বাপ্রসাদ, অজিত সিংহের ভূমিকা –

লালা হরদয়াল -এর নেতৃত্বে পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপ্লববাদ ছড়িয়ে পড়ে। এইসব অঞ্চলে বিপ্লবী সমিতির বহু শাখা তৈরি হয়। অম্বাপ্রসাদ ও অজিত সিংহ বিপ্লবী মতাদর্শ প্রচারের জন্য ‘ভারতমাতা’ ও ‘বঙ্গের শিয়াল’ নামে রাজদ্রোহমূলক পত্রপত্রিকা প্রকাশ করেন। পাঞ্জাবের যুবসমাজকে ইংরেজ শাসনের বিরোধী করে তোলা তাদের লক্ষ্য ছিল। পাঞ্জাবে বিপ্লববাদে আর্য সমাজের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। অজিত সিংহ এক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মাশ্রয়ী মনোভাব ত্যাগ করে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলেন। এর ফলে আন্দোলনের প্রসার ঘটে কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে। পুলিশের গ্রেফতারি এড়াতে অজিত সিংহ ভারত ছেড়ে পারস্যে পালিয়ে যান। লালা হরদয়াল এই সময় আবার বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ‘বয়কট’ ও ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ -এর ডাক দেন। পুলিশি ব্যবস্থা এড়াতে তিনিও ভারত ত্যাগ করেন (1910 খ্রিস্টাব্দ)। এই সময় রাসবিহারী বসু পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের বিপ্লবীদের সংগঠিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

রাসবিহারী বসুর ভূমিকা –

রাসবিহারী বসুর প্রধান লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীর মধ্যে বিপ্লবী মতবাদ প্রচার করে বিদ্রোহের মানসিকতা তৈরি করা। তিনি অনুভব করেছিলেন এইভাবে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইংরেজদের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া যাবে। তিনি দিল্লিতে তাঁর কর্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। 1912 খ্রিস্টাব্দে দিল্লি ভারতের নতুন রাজধানী হয়। এই উপলক্ষ্যে বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্জ হাতির পিঠে চড়ে রাজপথে শোভাযাত্রায় বের হন। রাসবিহারী বসুর নির্দেশে তাঁর সহযোদ্ধা বসন্ত বিশ্বাস বড়োলাটের উপর বোমা নিক্ষেপ করেন। বড়োলাট প্রাণে বাঁচেন কিন্তু তার ছত্রধর আহত হন (23 ডিসেম্বর, 1912 খ্রিস্টাব্দ)। এরপর পাঞ্জাবের পুলিশ কমিশনার জর্ডনকে হত্যার জন্য রাসবিহারী বসুর নির্দেশে লাহোরের এক উদ্যানে বোমা রাখা হয়। বোমা বিস্ফোরণে একজন চাপরাশি মারা যায়। রাসবিহারী বসু আত্মগোপন করেন। পুলিশ আমির চাঁদ, অবোধবিহারী, বসন্ত বিশ্বাসকে গ্রেফতার করে দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে। বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয় (11 মে, 1915 খ্রিস্টাব্দ)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তার সুযোগ নিয়ে রাসবিহারী বসু এক ব্যাপক সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করেন। আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত গদর দল প্রবাসী শিখদের ইংরেজবিরোধী করে তুলেছিল। গদর দল শিখ সৈন্যদের সাহায্যে ভারতে বিদ্রোহ ঘটাতে সচেষ্ট হয়। তাই কোমাগাতামারু ও তোশামারু জাহাজে করে কয়েক হাজার গদর দলের সদস্য ভারতে আসেন। ইংরেজ সরকার তাদের অনেককে গ্রেফতার করে। অনেককে বিশেষ ট্রেনযোগে পাঞ্জাবে পৌঁছে দেয়। রাসবিহারী বসু ও যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এই গদর দলের সদস্যদের সাহায্যে লাহোর, আম্বালা, ফিরোজপুর, কানপুর, আগ্রা, বেনারস, এলাহাবাদ, ফৈজাবাদ এমনকি সিঙ্গাপুরের ভারতীয় বিশেষত শিখ ও মুসলমান সেনাদের প্রভাবিত করেন। স্থির হয় 1915 খ্রিস্টাব্দের 21 ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত দিনে অভ্যুত্থান ঘটবে। কিন্তু কৃপাল সিংহ এই খবর ইংরেজদের জানিয়ে দেন। ফলে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ব্যাপক গ্রেফতারি শুরু হয়। বন্দি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয় এবং রাসবিহারী বসু ‘পি এন ঠাকুর’ ছদ্মনামে জাপানে পালিয়ে যান।

ভগৎ সিং -এর ভূমিকা –

রুশ বিপ্লবের প্রভাবে ভারতেও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা প্রসার লাভ করে। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের সঙ্গে বিপ্লবী ভাবাদর্শ যুক্ত করে ভগৎ সিংহ ও তাঁর সহযোগীরা হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন (1925 খ্রিস্টাব্দে)। ইতিমধ্যে সাইমন কমিশনবিরোধী বিক্ষোভের সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে লালা লাজপত রায় -এর মৃত্যু ঘটে। ভগৎ সিংহ তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য লাহোরের সহকারী পুলিশ সুপার মি. স্যান্ডার্সকে গুলি করে হত্যা করেন। এরপর ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটান (এপ্রিল, 1929 খ্রিস্টাব্দে)। পুলিশ লাহোর ও সাহারানপুরে বোমা কারখানার সন্ধান পায় এবং তাদের বিরুদ্ধে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে (1929 খ্রিস্টাব্দে) এবং বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয় (23 মার্চ, 1931 খ্রিস্টাব্দে)।

পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের উপসংহার –

পরিশেষে বলা যায়, বিপ্লবীদের অনেক পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও তাঁরা দেশপ্রেম ও ব্রিটিশ বিরোধিতাকে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে দেন।

দলিত আন্দোলনের কারণ কী ছিল?

অথবা, দলিতরা কেন আন্দোলনের পথে গিয়েছিল?

বর্ণবিভক্ত ভারতীয় হিন্দুসমাজে উচ্চবর্ণের দ্বারা শোষিত ও অত্যাচারিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলিত বলে পরিচিত। ‘দলিত’ শব্দটি এসেছে দলন থেকে। হিন্দুসমাজের এই অনগ্রসর, পশ্চাৎপদ শ্রেণি যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সবক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের মানুষদের দ্বারা শোষিত, অত্যাচারিত বা পদদলিত হয়েছে। এই শোষণ ও অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সেইসব পশ্চাৎপদ শ্রেণি দলিত আন্দোলন শুরু করেছিল।

দলিত আন্দোলনের কারণসমূহ –

দলিত আন্দোলনের কারণগুলি হল নিম্নরূপ –

  • উচ্চবর্ণের অত্যাচার – ভারতীয় সমাজের উচ্চবর্ণের লোকেরা বিভিন্নভাবে নিম্নবর্ণের মানুষদের বা দলিতদের শোষণ ও অত্যাচার করত। উচ্চবর্ণের মানুষরা দলিতদের দিয়ে জমি ও বাড়ির বিভিন্ন কাজ করাত। বিনিময়ে তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিত না এবং বিভিন্ন অজুহাতে তাদের শারীরিক নির্যাতন করত।
  • সামাজিক বৈষম্য – সমাজে দলিতদের স্থান ছিল নিম্নস্তরে। তারা বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে বঞ্চনা ও অপমানের শিকার হত। উচ্চবর্ণের লোকেরা তাদের সঙ্গে বিশেষ দূরত্ব বজায় রেখে চলত।
  • ধর্মীয় বৈষম্য – দলিতরা হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মন্দিরে তাদের প্রবেশ করার অধিকার ছিল না। তারা দেবতার পুজোও করতে পারত না। ফলে দলিতদের মধ্যে ধর্মীয় অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করেছিল।
  • শিক্ষাগ্রহণে বঞ্চনা – দলিত পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুলে উচ্চবর্ণের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পড়াশোনার সুযোগ পেত না। অনেকক্ষেত্রে তাদের শিক্ষাগ্রহণকে অশাস্ত্রীয় বলেও ব্যাখ্যা করা হত। আবার অনেকক্ষেত্রে অতি আগ্রহী দলিত সন্তানদের শ্রেণিকক্ষের বাইরে বসে শিক্ষাগ্রহণ করতে হত।
  • জলাশয় ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা – দলিতরা উচ্চবর্ণের মানুষের ব্যবহার করা জলাশয় বিশেষত পুকুর, কুয়ো ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারত না। এইসব জলাশয় থেকে পানীয় জল সংগ্রহের অধিকারও তাদের ছিল না। অধিকাংশ জলাশয় শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের মানুষদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এই জলাশয়গুলি দলিতরা ব্যবহার করে ফেললে তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হত।
  • রাজনৈতিক বঞ্চনা – ভারতে দলিতরা বিপুল সংখ্যায় বসবাস করলেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল অত্যন্ত নগণ্য। দলিতদের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় তারা রাজনৈতিক সুযোগসুবিধা থেকেও ছিল বঞ্চিত।
  • অস্পৃশ্যতা – দলিতরা উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছে ছিল অস্পৃশ্য। তাদের ছোঁয়া লাগলে উচ্চবর্ণের মানুষেরা স্নান করে প্রায়শ্চিত্ত করত। অথচ দলিতদের উৎপাদিত ফসল ও অন্যান্য সামগ্রী তারা ভোগ করতে দ্বিধা করত না।
  • অর্থনৈতিক বঞ্চনা – দলিতরা অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। তারা ছিল যুগ যুগ ধরে শোষিত, বঞ্চিত, আর্থিক দিক থেকে দুর্বল ও দরিদ্র। এই কারণে তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হত। তাদের জীবনযাত্রার মান ছিল অত্যন্ত নিম্ন।

দলিত আন্দোলনের উপসংহার –

ব্রিটিশ আমলে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টায় দলিতদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটে। শিক্ষিত দলিতরা তাদের মর্যাদার উন্নতির জন্য সচেষ্ট হয়। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা বিভিন্ন বৈষম্যের প্রতিবাদে দলিতরা আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।

দলিত সম্প্রদায়ের আন্দোলনের নেতৃত্ব ও আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

দলিত সম্প্রদায়ের আন্দোলনের ভূমিকা –

ভারতীয় হিন্দুসমাজের নিম্নবর্গের মানুষদের একাংশ তাদের উপর যুগ যুগ ধরে হয়ে চলা শোষণ, বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং নিজেদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার দাবিতে বিংশ শতকে আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। ব্রিটিশ সরকারের কূটনীতি বা বদান্যতায় তারা কিছু অধিকার লাভ করে। এই ঘটনা ভারতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। ক্রমে তাদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

দলিত কারা? –

ভারতীয় সমাজে প্রথমে দেহের রঙের ভিত্তিতে আর্য-অনার্যের ভেদাভেদ করা হত। পরে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র – এই চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা চালু হয়। আরও পরে পঞ্চম জাতি নামে একটি শ্রেণিকে চিহ্নিত করা হয়। ক্রমশ এই অনার্য, শূদ্র ও পঞ্চম জাতির মানুষেরা বাকি তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছে অদ্ভুত, অস্পৃশ্য, অন্ত্যজ বলে পরিচিত হয়। এদের মধ্যে পেশা ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন পরিচিতি ছিল। গান্ধিজি এদের নাম দেন হরিজন। ইংরেজরা এদের তফশিলি জাতি ও উপজাতির মর্যাদা দেয়। বি আর আম্বেদকরের নেতৃত্বে এই শ্রেণি নিজেদের দলিত নামকরণ করে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নামে।

প্রতিবাদী আন্দোলন –

নেতৃত্ব –

ভারতে ইংরেজ শাসনের সুফল দলিত শ্রেণির কিছু মানুষ পেয়েছিল। মিশনারিদের উদ্যোগে এদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ঘটে। বিভাজন ও শাসননীতির সুযোগ থাকায় সরকার এই শ্রেণিকে কিছু কাজে (পুলিশ, সৈনিক প্রভৃতি) নিয়োগ করেছিল। ফলে এই শ্রেণির মধ্যে একটি ছোটো আলোকিত শ্রেণি (elite) গড়ে ওঠে। এই আলোকিত শ্রেণিই তাদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে এবং নিজেদের দুরবস্থা সম্বন্ধে তাদের সচেতন করে তোলে।

জ্যোতিরাও ফুলে –

ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত জ্যোতিরাও ফুলে ছিলেন জাতিতে মালি এবং পেশায় কৃষক। তিনি মহারাষ্ট্রের কুনবি, মালি, মাঙ, মাহার প্রভৃতি জাতপাত-বর্ণভেদে জর্জরিত শ্রেণির মধ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালান। তিনি ‘গুলামগিরি’ গ্রন্থে 1873 খ্রিস্টাব্দে জাতিভেদ প্রথা ও অবহেলিতদের দুর্দশার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ‘ব্রাহ্মণচে কসাব’ (ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের স্বরূপ) এবং ‘শ্বেতকার্যচ অসুদ’ (কৃষকদের চাবুক) নামে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ বিষয়ক দুটি গ্রন্থও রচনা করেন তিনি। এ ছাড়া সমাজসংস্কারের জন্য 1873 খ্রিস্টাব্দে সত্যশোধক সমাজ গড়ে তোলেন। পুনাতে তিনি অস্পৃশ্যদের জন্য দুটি ও বালিকাদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিধবাদের কল্যাণের জন্য তিনি বিভিন্ন সাহায্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

দলিত সম্প্রদায়ের আন্দোলনের নেতৃত্ব ও আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
শ্রী নারায়ণ গুরু –

শ্রী নারায়ণ গুরু কেরলের হিন্দুসমাজের অন্ত্যজ এজহাবা সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন। এজহাবা, নাদার ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের মানুষদের দুরবস্থা ও অমর্যাদা দূর করার জন্য ‘এক জাতি, এক বর্ণ, এক ঈশ্বর’ – এই আহ্বান জানিয়ে ধর্মসংস্কারের কাজ শুরু করেন।

সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত শ্রী নারায়ণ গুরু এজহাবাদের জন্য 64টি মন্দির তৈরি করেন। এজহাবাদের মধ্যে থেকেই তিনি পুরোহিত নিয়োগ করেন। মন্দিরগুলি পরিচালনার জন্য তিনি শ্রী নারায়ণ ধর্মপালন যোগম প্রতিষ্ঠা করেন 1903 খ্রিস্টাব্দে। এজহাবা সম্প্রদায়ই পরে 1925 খ্রিস্টাব্দে টি কে মাধবনের নেতৃত্বে হিন্দু মন্দিরে প্রবেশাধিকারের দাবিতে ভাইকম সত্যাগ্রহ করে।

শ্রী নারায়ণ গুরু নিজে একটি বিদ্যালয় পরিচালনা করতেন। তিনি এজহাবাদের শিক্ষাপ্রসারে উদ্যোগী হন। বিবাহ, অন্নপ্রাশন, পারলৌকিক কাজের জন্য ব্যয়সংকোচ করে সেই অর্থে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেন। মাদক বর্জনেরও ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।

বীরেশলিঙ্গম পান্তুলু –

পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বীরেশলিঙ্গম দক্ষিণ ভারতে সমাজসংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। অন্ধ্রের রাজমুন্দ্রি ছিল তাঁর কর্মকেন্দ্র। সংঘ সমাসকরণ সমাজম ছিল তাঁর সংগঠন (1978 খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ‘ব্রাহ্ম বিরাহম’ ও ‘পাড্রায়াগরি পোল্লি’ নামে দুটি নাটক এবং ‘সত্য রাজাচর্য পর্বদেশ যাত্রানু’ নামে ব্যঙ্গরচনা দ্বারা অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ প্রথা, দেবদাসী প্রথা ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে প্রচার করেন। তিনি পিথাপুরমের রাজার সাহায্যে দেবদাসীদের কল্যাণের ব্যবস্থা করেন। বিধবাবিবাহ এবং জনশিক্ষা ও বৃত্তিশিক্ষার ব্যবস্থা করেন।

দলিত সম্প্রদায়ের আন্দোলনের নেতৃত্ব ও আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

রাজনৈতিক আন্দোলন –

শিক্ষাবিস্তার ও সংস্কারের মাধ্যমে অন্ত্যজ শ্রেণির মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়। তারা ক্রমে সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষাবিস্তার, কর্মসংস্থান ও অন্যান্য দাবি জানাতে থাকে। 1916 খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে তারা জাস্টিস পার্টি প্রতিষ্ঠা করে। এরপর 1926 খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে তারা সর্বভারতীয় সম্মেলন করে। এখানে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণি সমিতি (All India Depressed Class Association) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি হন এম সি রাজা। এরপর ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ‘সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির সম্মেলন’ (AIDCC) প্রতিষ্ঠা করেন 1930 খ্রিস্টাব্দে।

আম্বেদকর লন্ডনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড এই বৈঠকে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষণা করেন। এর দ্বারা অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতো অনুন্নত তফশিলি সম্প্রদায়ের আসন সংরক্ষিত হয়। হিন্দুদের বিভাজনের অজুহাতে গান্ধিজি অনশন শুরু করেন। আম্বেদকর দাবি ত্যাগে অসম্মত হন এবং শেষে প্রাপ্ত আসনের দ্বিগুণ লাভের বিনিময়ে 1932 খ্রিস্টাব্দের 24 সেপ্টেম্বর দুই পক্ষে পুনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার সময় আম্বেদকর প্রাপ্ত সুবিধাগুলির সংরক্ষণ করেন।

দলিত সম্প্রদায়ের আন্দোলনের মূল্যায়ন –

এইভাবে দলিত সম্প্রদায় নানা ঘাতপ্রতিঘাত, সংস্কার, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সক্ষম হয়। কলারাম সত্যাগ্রহ, গুরুভায়ুর সত্যাগ্রহ, মতুয়া আন্দোলন প্রভৃতিও ছিল একই ধারার আন্দোলন। অংশত ইংরেজ সরকারের সদিচ্ছায়, অংশত নিজেদের উদ্যোগে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির আনুকূল্যে আন্দোলনগুলি সফলতা লাভ করেছিল।

AIDCC -এর পুরো নাম লেখো।

AIDCC এর পুরো নাম হল – All India Depressed Class Conference.

দলিত আন্দোলন বলতে কী বোঝায়? দলিত আন্দোলনে ডঃ বি আর আম্বেদকরের অবদান আলোচনা করো।

দলিত আন্দোলনের ভূমিকা –

বর্ণবিভক্ত ভারতীয় হিন্দুসমাজে উচ্চবর্ণের দ্বারা শোষিত ও অত্যাচারিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলিত নামে পরিচিত। দলিত শব্দটি এসেছে দলন শব্দ থেকে। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা উচ্চবর্ণের মানুষের দ্বারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সবক্ষেত্রে শোষিত, বঞ্চিত ও পদদলিত হত। এই শোষণ, বঞ্চনা ও অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির জন্য নিম্নবর্ণের হিন্দুরা যে আন্দোলন করে, তা দলিত আন্দোলন নামে পরিচিত।

দলিত আন্দোলনের প্রধান নেতা –

ব্রিটিশ আমলে ভারতে দলিত আন্দোলনের নেতা ছিলেন জ্যোতিরাও ফুলে, শ্রী নারায়ণ গুরু, বীরেশলিঙ্গম পাণ্ডুলু, ডঃ বি আর আম্বেদকর প্রমুখ।

দলিত আন্দোলন –

জ্যোতিরাও ফুলে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি ‘গুলাম গিরি’, ‘ব্রাহ্মণচে কসাব’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করেন। তিনি সমাজসংস্কারের জন্য সত্যশোধক সমাজ গঠন করেন।

  • শ্রী নারায়ণ গুরু দলিতদের মন্দিরে প্রবেশাধিকারের দাবিতে ভাইকম সত্যাগ্রহ শুরু করেন।
  • ডঃ বি আর আম্বেদকর দলিতদের জন্য বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে আন্দোলনে শামিল হন।

দলিত আন্দোলনে ডঃ বি আর আম্বেদকরের অবদান –

বর্ণবিভক্ত ভারতীয় হিন্দুসমাজের নিম্ন সম্প্রদায়ভুক্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দলিত নামে পরিচিত। ‘দলিত’ নামকরণ করেন ডঃ বি আর আম্বেদকর। ‘দলন’ শব্দটি থেকে ‘দলিত’ কথাটি এসেছে। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নতির জন্য আম্বেদকর বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

ডঃ বি আর আম্বেদকরের পরিচিতি –

বাবাসাহেব নামে পরিচিত ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। নৃতত্ত্ববিদ্যা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন ও আইনশাস্ত্রে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। মহারাষ্ট্রের এক অস্পৃশ্য মাহার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা একজন সামরিককর্মী ছিলেন। সেই সূত্রে তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার সুযোগ পান। তাঁর মেধার পরিচয় পেয়ে বরোদার মহারাজা তাঁকে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা পাঠান। শিক্ষাশেষে তিনি বরোদা রাজ্যের সামরিক সচিব ও পরে বোম্বাই -এর সিডেনহাম কলেজে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হন।

দলিত আন্দোলন ও আম্বেদকরের ভূমিকা –

এরপর আম্বেদকর দলিতদের অধিকারের জন্য বিভিন্ন আন্দোলন শুরু করেন। এগুলি হল –

  • দলিত সম্মেলন – ইতিপূর্বে দলিতদের উন্নতির জন্য জাস্টিস পার্টি গঠিত হয়েছিল 1916 খ্রিস্টাব্দে। এই দলের উদ্যোগে 1926 খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে দলিত নেতাদের সম্মেলন হয়। সম্মেলনে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির সমিতি গঠিত হয়। সমিতির সভাপতি হন এম সি রাজা এবং সহ-সভাপতি হন আম্বেদকর।
  • অস্পৃশ্য আন্দোলন – 1927 খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর অস্পৃশ্য আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি ‘বহিষ্কৃত ভারত’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি প্রচার করেন, হিন্দুধর্ম হল নিম্নবর্ণের মানুষদের উপর আধিপত্য স্থাপনকারী একটি ধর্ম। অস্পৃশ্যতার মূল হল ‘মনুস্মৃতি’। এজন্য তিনি 1927 খ্রিস্টাব্দে ‘মনুস্মৃতি’ গ্রন্থ পুড়িয়ে দেন।
  • সত্যাগ্রহ আন্দোলন – তিনি মহারাষ্ট্রের কোলাবা জেলায় অস্পৃশ্যদের পানীয় জল ব্যবহারের দাবিতে মাহার সত্যাগ্রহ করেন 1928 খ্রিস্টাব্দে। কলারাম মন্দিরে প্রবেশের দাবিতে সত্যাগ্রহ করেন 1930 খ্রিস্টাব্দে।
  • সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা – লন্ডনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে আম্বেদকর যোগ দেন। তাঁর চেষ্টায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। গান্ধিজি প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন। পুনা চুক্তির মাধ্যমে 1932 খ্রিস্টাব্দে এই সমস্যার সমাধান করা হয়। স্থির হয় বাঁটোয়ারা নীতি দ্বারা প্রাপ্ত আসনসংখ্যার দ্বিগুণ আসন দিতে হবে এই তফশিলিদের।
  • দল গঠন – 1930 খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস (AIDCC), 1937 খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন শ্রমিক দল (ILP) ও 1942 খ্রিস্টাব্দে নিখিল ভারত তফশিলি সংগঠন (AISCF) প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়।

দলিত আন্দোলনের মূল্যায়ন –

এভাবে আম্বেদকর দলিতদের অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম করেন। কংগ্রেস আম্বেদকরের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে জগজ্জীবন রামকে তুলে ধরে স্বার্থসিদ্ধি করে। আম্বেদকর সংবিধানের খসড়া কমিটির সভাপতিও ছিলেন। ফলত, তিনি সংবিধানে দলিতদের অধিকারগুলি সুরক্ষিত করেন।

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের ভূমিকা –

নমঃশূদ্র হল হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড়ো জনগোষ্ঠী। তাদের আদি বাসস্থান ছিল যশোহর, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং ফরিদপুর – এই ছয়টি জেলায়। 1872-1873 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এই অঞ্চলের এক গ্রামের এক বিশিষ্ট নমঃশূদ্রের মায়ের শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান ছিল। এই অনুষ্ঠানে উঁচু জাতের লোকেরা আসতে অস্বীকার করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নমঃশূদ্ররা তাদের সঙ্গে সমস্ত রকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। উঁচু জাতের ঘরে নমঃশূদ্ররা কেনোরকম কাজ করতে অস্বীকার করে। এই আন্দোলন অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে এরপরে এদের মধ্যে মতুয়া নামে এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। নমঃশূদ্রদের প্রধান ধর্মগুরু ছিলেন শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর পুত্র শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর।

নমঃশূদ্র আন্দোলনের সূচনাপর্ব –

উনিশ শতকের শেষদিকে নমঃশূদ্রদের সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়। নমঃশূদ্ররা 1902 খ্রিস্টাব্দে একটি সমিতি গঠন করে এবং আন্দোলনের প্রচারের জন্য ‘উন্নয়নী সভা’-র আয়োজন করা হয়। তাদের আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যাত্রা-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং প্রতি পরিবার থেকে প্রতি সপ্তাহে ‘মুষ্টি’ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়।

অল ইন্ডিয়া নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন গঠন –

পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার হরিচাঁদ ঠাকুর সমস্ত নিপীড়িত সম্প্রদায়কে নতুন জীবনদর্শনে উদ্বুদ্ধ করে তাদের মধ্যে আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধের বিকাশ ঘটান। তিনি মতুয়া নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া আন্দোলন ও মতাদর্শকে জোরদার করে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে নমঃশূদ্র আন্দোলন আরও এগিয়ে যায় এবং ক্রমশ এক স্পষ্ট রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। 1912 খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন (Bengal Namasudra Association) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্দোলন দলিত নেতা আম্বেদকরের নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় দলিত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়।

নমঃশূদ্রদের সামাজিক আন্দোলন –

নমঃশূদ্ররা তাদের অসম্মানজনক ‘চণ্ডাল’ নামের পরিবর্তে নতুন ‘নমঃশূদ্র’ নামের অনুমোদন চেয়েছিল। 1911 খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে তাদের ‘নমঃশূদ্র’ বলে চিহ্নিত করা হয়।

নমঃশূদ্ররা তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নানা ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতীক গ্রহণ করতে থাকে।

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।
  • তারা নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে দাবি করে এবং তার সপক্ষে প্রমাণ দাখিল করে।
  • তারা ব্রাহ্মণদের মতো উপবীত ধারণ করা শুরু করে।
  • পরিবারের মহিলাদের বাজারে যাওয়া বন্ধ করে।
  • এগারো দিন অশৌচ পালন করে।

আসলে নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের ক্ষমতার প্রতীকগুলিকে অর্থহীন করে দিতে চেয়েছিল। যেমন – উচ্চবর্ণের মতো নমঃশূদ্ররা উপবীত ধারণ করে এক ধরনের সামাজিক প্রতিবাদ শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সমাজের উঁচু-নীচুর বিভেদ দূর করা।

নমঃশূদ্রদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আন্দোলন –

নমঃশূদ্র নেতারা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যও সচেষ্ট হয়েছিলেন। তারা বুঝেছিলেন যে, নমঃশূদ্রদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য শিক্ষা ও চাকরির প্রয়োজন। তাদের চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কারণ ছিল উঁচু জাতের লোকের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতা। অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পক্ষপাতিত্ব চাকরির ক্ষেত্রে নমঃশূদ্র বা দলিতদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল। এজন্য নমঃশূদ্র নেতারা সরকারের কাছে কিছু সুযোগসুবিধা দাবি করেছিল।

নমঃশূদ্রদের রাজনৈতিক বিষয়ে আন্দোলন –

নমঃশূদ্ররা রাজনৈতিক দাবি আদায়ের জন্যও আন্দোলন করে। তারা স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করে। 1917 ও 1918 খ্রিস্টাব্দে দুটি সম্মেলনে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের দাবি তোলে তারা। 1919 খ্রিস্টাব্দের শাসনসংস্কারে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় অনুন্নত শ্রেণির একজন প্রতিনিধি মনোনয়নের নীতি স্বীকৃত হয়। কিন্তু নির্বাচনে নমঃশূদ্র অধ্যুষিত এলাকাগুলি থেকে বর্ণহিন্দু প্রার্থীরাই নির্বাচিত হতেন।

ব্রিটিশ সরকারের প্রতি নমঃশূদ্রদের আস্থা –

নমঃশূদ্ররা তাদের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত। কারণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিকে তারা হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির আন্দোলন বলে মনে করত। তা ছাড়া তারা মনে করত ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা অতীতের শাসন থেকে উন্নত।

এই কারণে তারা স্বদেশি আন্দোলন, হোমরুল আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রভৃতির বিরোধিতা করেছিল। নমঃশূদ্ররা 1932 খ্রিস্টাব্দের ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতিকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু ডঃ আম্বেদকর যখন বাধ্য হয়ে গান্ধিজির সঙ্গে পুনা চুক্তি স্বাক্ষর করেন তখন তারা এর বিরোধিতা করেছিল।

নমঃশূদ্রদের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা –

1937 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নমঃশূদ্ররা কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছিল। কিন্তু 1938 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু 1938 খ্রিস্টাব্দের 13 মার্চ অ্যালবার্ট হলের এক সভায় গুরুচাঁদ ঠাকুরকে ‘অতিমানব’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, গুরুচাঁদ বাংলার হিন্দুসমাজে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছেন। এই সভার তিন দিন পর প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রমুখ নেতা কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা করার নীতি নেন। তাঁরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিডিউলড কাস্ট পার্টি (Independent Scheduled Caste Party) প্রতিষ্ঠা করেন। ঠিক হয়, এই দল কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলবে। গান্ধিজিও নমঃশূদ্র নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তবে সব নমঃশূদ্র নেতাই কংগ্রেসের সঙ্গে এক হওয়ার নীতি মেনে নেননি।

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের মূল্যায়ন –

নমঃশূদ্র আন্দোলন দলিত আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও তা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। নমঃশূদ্ররা তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য তাদের আন্দোলনকে কখনও জাতিভিত্তিক, কখনও সাম্প্রদায়িক, আবার কখনও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথে পরিচালিত করেছিল।

বিংশ শতাব্দী ভারতের ইতিহাসে একটি দ্রুত পরিবর্তনের সময়কাল। এই শতাব্দীতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে এবং দেশটি ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি, ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন অংশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনও দেখা দেয়। এই আন্দোলনগুলি নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার ও স্বার্থের জন্য সংগ্রাম করেছিল।

স্বদেশি আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের চরিত্র ছিল ঘরোয়া – তুমি কি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত? তোমার উত্তরের পক্ষে যুক্তি দাও।

ভূমিকা – 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে পুরুষদের পাশাপাশি বাংলার নারীসমাজও অংশগ্রহণ করে। তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না, বরং তা ছিল সহযোগীর ভূমিকা।

স্বদেশি আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের চরিত্র – 

স্বদেশি আন্দোলনে নারী সমাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, যেমন —

  1. বিভিন্ন কর্মসূচি সম্পাদন – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময় বিদেশি বস্ত্র বর্জন ও পোড়ানো, দেশি কাপড়ের প্রচলন ও অরন্ধন দিবস পালন প্রভৃতি কর্মসূচিতে নারীরা যোগদান করেন।
  2. বিপ্লববাদে সহায়তা – এ ছাড়া বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, গোপনে সংবাদ ও অস্ত্র সরবরাহ ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁরা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। ফরিদপুরে সৌদামিনী দেবী, বরিশালের সরোজিনী দেবী, বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী প্রমুখা বিপ্লবীদের আশ্রয় দেন। তাঁরা গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করার কাজে নিযুক্ত হন। এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেজো পিসিমা ননীবালা দেবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে তিনি গ্রেফতার হন। নির্যাতন চালিয়েও তাঁর কাছ থেকে পুলিশ কোনো গোপন তথ্য আদায় করতে পারেনি।
  3. জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচার – আন্দোলনে সহযোগীর ভূমিকার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। স্বদেশি আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগনি সরলাদেবী চৌধুরানী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ‘ভারতী’ পত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে নারীশক্তিকে উজ্জীবিত করে তোলেন। এ ছাড়া বীরাষ্টমী উৎসব, প্রতাপাদিত্য ব্রত, উদয়াদিত্য ব্রত ইত্যাদি প্রচলন করেন। এই উৎসবগুলিতে বাঙালি যুবকদের লাঠি খেলা, কুস্তি, তরবারি খেলা, শরীরচর্চা ইত্যাদির প্রতি উৎসাহদান করা হত।
  4. অর্থদান – জন্মভূমির উদ্দেশ্যে একমুঠো চাল ধরে রাখার জন্য বাংলার মেয়েদের কাছে মায়ের কৌটো বা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পৌঁছে দেওয়া হয়। কোনো নারী দুঃসাহসিক কাজ করলে বা প্রচুর অর্থ দান করলে তাঁকে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ উপাধি দেওয়া হয়। চারণ কবি মুকুন্দ দাসও বঙ্গনারীকে রেশমি চুড়ি ছাড়ার পরামর্শ দেন।
  5. অরন্ধনের বাস্তবায়ন – স্বদেশি আন্দোলনে শহরাঞ্চলের নারী সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন (1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর) কলকাতার নারী সমাজের একটা বড়ো অংশ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আহ্বানে অরন্ধন পালন করে। তারা উপবাস করে, চরকা কেটে দিনটি অতিবাহিত করেন।
  6. নারী সমাবেশ – 1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর ফেডারেশন হলের ভিত্তি স্থাপনে 500 মহিলা যোগ দেন। মুরশিদাবাদের কান্দিতে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বিষ্ণু প্রাঙ্গণে প্রায় 500 মহিলা সমবেত হন। উপস্থিত নরনারীরা সেদিন সমবেতভাবে বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের শপথ গ্রহণ করেন।
  7. বিশিষ্ট নারীদের অংশগ্রহণ – গ্রাম – শহর সর্বত্র চরকার প্রবর্তন, লক্ষ্মী ভাণ্ডার গড়ে তোলা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে – জাতীয়তাবাদী মহিলারা আন্দোলনকে আরও ব্যাপক করে তোলেন। এ প্রসঙ্গে কুমুদিনী মিত্র, লীলাবতী মিত্র, হেমাঙ্গিনী দাস, নির্মলা সরকার প্রমুখার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
  8. নারীবাহিনী – এই সময় বরিশালের 13 বছরের গৃহবধূ মনোরমা বসু একটি নারীবাহিনী তৈরি করেন। সদর রাস্তায় এই বাহিনী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

উপসংহার – 

এভাবে দেখা যায় যে, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে নারীর অংশগ্রহণ ছিল মূলত ঘরোয়া, অর্থাৎ ঘর থেকেই আন্দোলনে সহযোগিতা। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণও ছিল। এই আন্দোলনে নারীর যোগদান ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। আবার যোগদানকারী নারীদের অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত ছিল কিনা তা বিতর্কিত।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে সরলাদেবী চৌধুরানীর ভূমিকা কী ছিল?

সরলাদেবী চৌধুরানী বঙ্গভঙ্গের পূর্বে ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে নারী জাগরণ ও জাতি জাগরণের ক্ষেত্রে ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর কৃতিত্বের বিভিন্ন দিকগুলি হল —

  1. প্রতাপাদিত্য উৎসব – বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নের পর তিনি 1 বৈশাখ তারিখে প্রতাপাদিত্য উৎসবের প্রচলন করেন। মোগল শাসন বিরোধী বাঙালি বীর প্রতাপাদিত্যের জীবনী পাঠ, কুস্তি ও তলোয়ার, বক্সিং ও লাঠি চালনা ছিল এই উৎসবের অঙ্গ।
  2. জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচার – বঙ্গভঙ্গের পূর্বেই তিনি ‘ভারতী’ নামক পত্রিকায় তার লেখনীর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচার করেন। এর পাশাপাশি তিনি ইংরেজদের হাতে নিগৃহীত ভারতীয়দের তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানানোর ঘটনাও তুলে ধরেন।
  3. নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা – ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের এলাহাবাদ অধিবেশনকালে (1910 খ্রি.) তিনি একটি নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারত-স্ত্রী-মহামণ্ডল’ নামক নারী সংগঠন।

অসহযোগ আন্দোলনে নারী সমাজের যোগদানের প্রকৃতিকে তুমি কীভাবে চিহ্নিত করবে?

অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের দিকগুলি হল —

  1. বয়কট ও স্বদেশি – মহাত্মা গান্ধী প্রাথমিকভাবে নারীদের সীমিত কর্মসূচিতে অর্থাৎ বিদেশি দ্রব্য বয়কট ও স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণের জন্য যোগ দিতে আহ্বান জানান। তাঁর এই আহ্বানে ভারতের হাজার হাজার নারী যোগদান করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে সরোজিনী নাইডু, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ নারীর নাম উল্লেখ্য।
  2. বিক্ষোভ কর্মসূচি – 1921 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ বা ইংল্যান্ডের যুবরাজ ভারত সফরে এলে বোম্বাই ও কলকাতা শহরে নারী বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কংগ্রেস নেতা চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী ও তাঁর বোন উর্মিলা দেবী প্রকাশ্য রাজপথে যুবরাজ বিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করলে তাদের জেলবন্দি করা হয়।
  3. গঠনমূলক কর্মসূচি – শহরের বেশ কয়েকজন নেত্রী গ্রামে গিয়ে অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করার জন্য প্রচার চালান। এ ছাড়া বিভিন্ন গঠনমূলক কর্মসূচি, যেমন — চরকায় সুতো কাটা ও কাপড় বোনার জন্য উৎসাহিত করা হয়।
  4. নারী সংগঠন – অসহযোগ আন্দোলনের পূর্বেই সরোজিনী নাইডুর নেতৃত্বে ‘ভারতীয় মহিলা সমিতি’ গড়ে উঠেছিল। অনুরূপভাবে অসহযোগ আন্দোলনকালে কলকাতায় ‘কর্মমন্দির’, ‘নারী-সত্যাগ্রহ সমিতি’-র মাধ্যমে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরা সভাসমিতি, পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করে।

মূল্যায়ণ – অসহযোগ আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। এই আন্দোলনে মুসলমান নারীদের যোগদান ছিল অত্যন্ত অল্প। তবে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের মধ্যে গঠনমূলক কাজের প্রসার ঘটে।

জাতীয় আন্দোলনে সরোজিনী নাইডু বিখ্যাত কেন?

বিশ শতকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সরোজিনী নাইডু। তিনি বিভিন্ন কারণে বিখ্যাত —

  1. মহিলা সমিতি গঠন – 1915-1918 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন এবং সামাজিক উন্নতি, নারীশক্তির উজ্জীবন ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। 1917 খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতীয় মহিলা সমিতি (WIA – Women’s Indian Association) প্রতিষ্ঠা করেন।
  2. জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ – তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকেই জাতীয় আন্দোলনে যোগদান করেন। অসহযোগ আন্দোলনকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও 1925 খ্রিস্টাব্দে কানপুরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা সভাপতি। আইন অমান্য আন্দোলনকালে তিনি গান্ধিজির ডান্ডি অভিযানে অংশ নেন ও ধরসানা লবণাগার অভিযানে নেতৃত্ব দেন। আবার 1942 খ্রিস্টাব্দের ভারতছাড়ো আন্দোলনকালে তিনি জেলবন্দি হন।
  3. গভর্নররূপে – তিনি 1947-1949 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আগ্রার সংযুক্ত প্রদেশ (ইউনাইটেড প্রভিন্সেস) ও অযোধ্যার গভর্নররূপে শাসনভার পরিচালনা করেন। (ভারতের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল)।

আইন অমান্য আন্দোলনের সময় নারী সমাজের ভূমিকাকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?

অসহযোগ আন্দোলন অপেক্ষা আইন অমান্য আন্দোলনকালে (1930-1934 খ্রি.) তুলনামূলকভাবে নারীর যোগদান ছিল অধিক। গান্ধিজি লবণকে আইন অমান্যের বিষয়ে পরিণত করে নারীদের কাছে এই আন্দোলন আকর্ষণীয় করে তুলতে চেয়েছিলেন।

আইন অমান্য আন্দোলনের সময় নারী সমাজের যোগদান – 

আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের যোগদানের উল্লেখযোগ্য দিক হল —

  1. লবণ আইন ভঙ্গ – ডান্ডিতে মহাত্মা গান্ধির লবণ আইন অমান্য কালে অনেক নারী যোগদান করেন ও লবণ আইন ভঙ্গ করেন। এরপর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে হাজার হাজার নারী লবণ আইন ভঙ্গ শুরু করে দেয়। সরোজিনী নাইডুর নেতৃত্বে ‘ধরসানা লবণাগার অভিযান’ সম্পন্ন হয়।
  2. বিক্ষোভ কর্মসূচি – লবণ আইন ভঙ্গের পাশাপাশি বিদেশি বস্ত্র ও মদের দোকানের সামনে পিকেটিং-এ নারীরা অংশ নেয়। এর পাশাপাশি বোম্বাই, এলাহাবাদ, লাহোর, দিল্লি প্রভৃতি শহরে নারীরা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। এমনকি সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরাও এই বিক্ষোভে অংশ নেয়।
  3. কৃষক নারীদের অংশগ্রহণ – আইন অমান্য আন্দোলনে কৃষক পরিবারের নারীদের অংশগ্রহণ আন্দোলনকে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দেয়। মেদিনীপুরের ঘাটাল, কাঁথি, তমলুক প্রভৃতি স্থানের কৃষক নারীরা পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লবণ প্রস্তুত ও বিক্রয় করে।
  4. নারী সংগঠনের যোগদান – এই আন্দোলনে বিভিন্ন নারী সংগঠন যোগ দিয়েছিল। এদের মধ্যে বোম্বাইয়ের দেশ সেবিকা সংঘ, বাংলার ‘মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ’, কলকাতার ‘ছাত্রী সংঘ’ ছিল উল্লেখযোগ্য।

মূল্যায়ণ – আইন অমান্য আন্দোলনকালে ভারতের নারী সমাজের যোগদানের প্রকৃতি ভারতজুড়ে একইরকম ছিল না। ঐতিহাসিক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, অংশগ্রহণের দিক থেকে বোম্বাইয়ের আন্দোলন ছিল সবচাইতে সংগঠিত, বাংলার আন্দোলন ছিল উগ্র এবং মাদ্রাজের নারীদের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারী আন্দোলন কতটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তা ব্যাখ্যা করো।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন মহাত্মা গান্ধীর নামে পরিচালিত হলেও তা ছিল গান্ধীজির নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত আন্দোলন। উপরন্তু এই আন্দোলনকালে জাতীয় কংগ্রেস দলকে বেআইনি ঘোষণা করে কংগ্রেস নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। তাই ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলন এবং এই আন্দোলনে নারীদের যোগদানও ছিল তুলনামূলকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীর যোগদান –

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের যোগদান আইন অমান্য আন্দোলনের ন্যায় পরিকল্পিত ও কর্মসূচিভিত্তিক ছিল না। তথাপি নারীরা যেভাবে যোগদান করে তা হল –

  1. মধ্যবিত্ত নারীর যোগদান – এই আন্দোলনে স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা যোগদান করেছিল। আবার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারীরা প্রকাশ্য ও গোপন দু’ধরনের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। যেমন – ঊষা মেহতা বোম্বাইয়ে গোপন রেডিয়ো কেন্দ্র গড়ে তুলে গান্ধীজির ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ আদর্শ সহ জাতীয় আদর্শ প্রচার করতেন।
  2. নারীদের সংগঠন – নারীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অরুণা আসফ আলি ও সুচেতা কৃপালিনীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অরুণা আসফ আলি গোপনে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। 1942 খ্রিস্টাব্দের 9 আগস্ট তিনি বোম্বাইয়ের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে (পরবর্তী নাম – অগস্ট ক্রান্তি ময়দান) তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেন।
  3. মাতঙ্গিনী হাজরা – ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। তিনি মেদিনীপুরের তমলুক থানা দখল অভিযানের জন্য গড়ে ওঠা একটি মিছিলের নেতৃত্ব দেন। তিনি পুলিশের গুলিতে আহত হন ও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
  4. ভগিনী সেনা – ভারত ছাড়ো আন্দোলনকালে বাংলার মেদিনীপুরে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গ্রামীণ মহিলারা ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম চালানোর জন্য নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। এইরূপ সংগঠন ‘ভগিনী সেনা’ নামে পরিচিত। ভগিনী সেনার অনেক নারী জেলবন্দি হন ও 84 জনেরও বেশি নারী নির্যাতিতা হন।

মূল্যায়ণ –

এভাবে দেখা যায় যে, ভারত ছাড়ো আন্দোলনকালে বাংলা, বোম্বাই, আসাম, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, কর্ণাটকের হাজার হাজার নারী অংশগ্রহণ করেছিল। এই সমস্ত নারীদের অধিকাংশই কংগ্রেস দলের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত ছিল। তুলনামূলকভাবে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি এই সময় আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছিল। তবে এই আন্দোলনে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন ও কমিউনিস্ট দলের নারী সদস্যদের যোগদান ছিল সীমিত।

ঝাঁসির রানি ব্রিগেডের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করো।

সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে একটি নারীবাহিনী গঠন করেন (1943 খ্রি.); যা ঝাঁসির রানি ব্রিগেড নামে পরিচিত।

ঝাঁসির রানি ব্রিগেডের বৈশিষ্ট্য –

ঝাঁসির রানি ব্রিগেডের বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বা দিককে চিহ্নিত করা যায়, যথা—

  1. নেতৃত্ব – ঝাঁসির রানি ব্রিগেডের প্রধান ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবী আম্মু স্বামীনাথনের কন্যা ডাঃ লক্ষ্মী স্বামীনাথন (পরবর্তী নাম – ডাঃ লক্ষ্মী সায়গল)। তিনি ছিলেন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক।
  2. সেনা সদস্য – এই বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় 1500 এবং এঁরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে এসেছিলেন। এই বাহিনীর সমন্বয়েই গঠিত হয় আজাদ হিন্দ বাহিনীর ‘আত্মাহুতি শাখা’ বা ‘সুইসাইড স্কোয়াড’।
  3. প্রশিক্ষিত বাহিনী – নারী বাহিনীকে যুদ্ধের কলাকৌশলে প্রশিক্ষিত করা হয়। ফলে এই বাহিনী ছিল পূর্ণ প্রশিক্ষিত বাহিনী। 1944 খ্রিস্টাব্দে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ইম্ফল অভিযানে এই বাহিনীকে যুদ্ধে পাঠানো হয়। এভাবে ঝাঁসির রানি ব্রিগেডের নারী সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে এক অনন্য নজির স্থাপন করে।

জাতীয় আন্দোলনে নারীদের যোগদান আলোচনা করো। এই আন্দোলনে নারীদের অবদান কি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল?

ভূমিকা –

প্রথমদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষিত নারীরা মূলত নারীমুক্তি আন্দোলনের শরিক হয়েছিল এবং বিভিন্ন ধর্মীয় রচনা প্রকাশ ও নারী সংগঠন স্থাপনের মাধ্যমে নারী শক্তিকে সংহত করতে সচেষ্ট হয়েছিল। এভাবে সংহত ও জাগরিত নারীশক্তি বিশ শতকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

জাতীয় আন্দোলনে নারী –

বিশ শতকের জাতীয় আন্দোলনগুলিতে নারীদের যোগদান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় –

  1. বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে নারীসমাজের অংশগ্রহণের ধরনগুলি হল-
    • ঘরের অভ্যন্তরে থেকেই নারীরা এই আন্দোলনে যোগ দিত।
    • বিদেশি বস্ত্র বর্জন ও পোড়ানো, দেশি কাপড়ের প্রচলন, অরন্ধন দিবস পালন প্রভৃতি কর্মসূচিতে নারীরা যোগ দিত।
    • বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, গোপনে সংবাদ ও অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমেও নারীরা আন্দোলনে অংশ নিত।
  2. অসহযোগ আন্দোলন – গান্ধীজি পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনগুলিতে নারী সমাজের অংশগ্রহণ অনেক বৃদ্ধি পায়। 1920-1921 খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধীজি প্রাথমিকভাবে মহিলাদের সীমিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার নির্দেশ দেন। এই কর্মসূচির মধ্যে ছিল বিদেশি দ্রব্য বয়কট ও স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণ। কিন্তু ভারতীয় নারীরা এই সময় আরও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। দেশের বহু প্রান্তে তারা পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করেন। 1921 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে হাজার হাজার মহিলা প্রিন্স অফ ওয়েলস্-এর ভারত ভ্রমণের বিরুদ্ধে বোম্বাই ও কলকাতা শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এই সময় মহিলা নেত্রীরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করার জন্য প্রচার চালান।
  3. আইন অমান্য আন্দোলন – 1930 খ্রিস্টাব্দের আইন অমান্য আন্দোলনে মহিলারা অনেক বেশি মাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর গান্ধীজি একটি বিশেষ আহ্বানের মাধ্যমে ভারতীয় নারী সমাজকে আন্দোলনে যোগদান করার জন্য উৎসাহিত করেন (ইয়ং ইন্ডিয়া, 10 এপ্রিল 1930 খ্রি.)। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার নারী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেন। লবণ আইন ভাঙা থেকে শুরু করে বিলাতি কাপড় ও মদের দোকানের সামনে পিকেটিং—এই সমস্ত কর্মসূচিতে তারা সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। বোম্বাই, এলাহাবাদ, লাহোর, দিল্লি প্রভৃতি শহরে মহিলারা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ জানান। বিভিন্ন বিক্ষোভ সমাবেশে সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা বিপুল সংখ্যায় যোগদান করেন। তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানে শুধুমাত্র ইংরেজ সরকারই নয়, রক্ষণশীল পুরুষ সমাজও স্তম্ভিত হয়ে যায়। এমনকি এই আন্দোলনে কৃষক পরিবারের নারীদের সক্রিয় যোগদানও উল্লেখ করার মতো।
  4. ভারত ছাড়ো আন্দোলন – 1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাতীয় সংগ্রামে নারীর ভূমিকা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময় স্কুল-কলেজের ছাত্রীরাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। নারীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অরুণা আসফ আলি ও সুচেতা কৃপালিনীর ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অরুণা আসফ আলি গোপনে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ঊষা মেহতা গোপনে কংগ্রেসের বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করেন। আবার এই আন্দোলনে অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন।
  5. বিপ্লবী আন্দোলন – সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে নারীরা যোগদান করেছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, বীণা দাস প্রমুখ।

মূল্যায়ণ –

ভারতের জাতীয় সংগ্রামে প্রাথমিকভাবে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল পুরুষদের সহযোগী ভূমিকায়। তাঁরা আন্দোলনের স্বতন্ত্র কোনো ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারেননি। আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নারীদের বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না। জাতীয় কংগ্রেস আন্দোলনে নারী সমাজের যোগদানকে অনুমোদন করে, কিন্তু আন্দোলন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের মতামত তেমন করে গ্রহণ করা হয়নি। সরলাদেবী চৌধুরানী হতাশ হয়ে লিখেছিলেন, “কংগ্রেস নারীদের কেবল আইন লঙ্ঘনকারী হিসেবেই চেয়েছিলেন, আইন প্রণেতা হিসেবে নয়।”

স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বে ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণ ব্যাখ্যা করো।

ভূমিকা –

ভারতের জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের যোগদান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। বিবেকানন্দের ‘জাতীয়তাবাদী আদর্শ’ ও বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র ছাত্রসমাজকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতিতে যোগদান করে।

  1. বঙ্গভঙ্গকালে ছাত্র আন্দোলন – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে ছাত্ররা বিভিন্ন প্রতিবাদী সভাসমিতিতে যোগ দেয় এবং বিদেশি পণ্য বয়কট ও স্বদেশি দ্রব্য প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে তারা 75টি শাখার মাধ্যমে স্বদেশি দ্রব্য সামগ্রী বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি তারা সরকারি স্কুল-কলেজ বয়কট করে।
  2. অসহযোগ আন্দোলনকালে ছাত্র আন্দোলন – অসহযোগ আন্দোলনকালে ছাত্ররা –
    • স্থানীয় নেতাদের উদ্যোগে বয়কট কর্মসূচিকে সফল করতে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামে ছাত্ররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি দ্রব্য বয়কট করে।
    • ছাত্রদের অনেকে কংগ্রেস ও খিলাফত স্বেচ্ছাসেবকরূপে চাঁদা সংগ্রহ, গঠনমূলক কাজ ও চরকা ব্যবহারের কর্মসূচি প্রচার করে।
    • বিকল্প জাতীয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষায়তনগুলিতে ছাত্ররা যোগদানের কর্মসূচিও গ্রহণ করে。
  3. আইন অমান্য আন্দোলন – অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রসমাজ যেভাবে স্কুল-কলেজ বয়কট করেছিল, আইন অমান্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এই পর্বে ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ততা ও ব্যাপক বয়কট দেখা যায়নি। গান্ধীজি লাহোর কংগ্রেসে ছাত্রদের স্কুল-কলেজ বয়কটকে অবাস্তব বলে ঘোষণা করেছিলেন। ছাত্রদের জন্য বিকল্প জাতীয় বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা না করে তিনি বিদ্যালয় বয়কট করার পক্ষে সমর্থন জানাননি। ফলত বিক্ষিপ্ত কিছু স্থান ছাড়া আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রসমাজের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ তেমন ছিল না।
  4. ভারত ছাড়ো আন্দোলন – ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে শহরের ছাত্রসমাজ মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। ধর্মঘট, বয়কট ও পিকেটিং-এর মধ্য দিয়ে তারা আন্দোলনকে জোরদার করে তোলে। ছাত্র-যুবদের হাত ধরেই গ্রামাঞ্চলে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনকালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ট্রেনের দখল নেয় এবং এর নাম দেয় ‘আজাদ ট্রেন’। এই ট্রেনে চড়ে তারা উত্তরপ্রদেশের শেরপুর অঞ্চলে পৌঁছায় এবং সেখানের কৃষক আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করে। তাই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ‘আজাদ ট্রেন’ এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল।
  5. বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রসমাজ – বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর নেতৃত্বে সংঘটিত মজফ্ফরপুর ঘটনা, ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তের দিল্লির সংসদভবনে বোমা নিক্ষেপ, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ও বিনয়-বাদল-দীনেশের অলিন্দ যুদ্ধ এবং রশিদ আলি দিবস ছিল বিপ্লবী ছাত্রদের বিপ্লবাত্মক কাজকর্মের উদাহরণ।

মূল্যায়ণ –

জাতীয় আন্দোলনে বিশেষত বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্ররা ছিল ‘স্বনিয়োজিত প্রচারক’। তবে অসহযোগ আন্দোলনকালে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। কিন্তু 1920-র দশকে ছাত্র আন্দোলনের উপর বামপন্থী আদর্শের প্রভাব ও ছাত্রদের স্বার্থযুক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং গান্ধীজি কর্তৃক 1930-র দশকে জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণে নিরুৎসাহ প্রদর্শনের কারণে জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের যোগদান হ্রাস পায়।

1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?

ভারত ছাড়ো আন্দোলন মহাত্মা গান্ধীর নামে পরিচালিত হলেও তা ছিল গান্ধীজির নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত আন্দোলন। উপরন্তু এই আন্দোলনকালে জাতীয় কংগ্রেস দলকে বেআইনি ঘোষণা করে কংগ্রেস নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। তাই ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন এবং এই আন্দোলনে ছাত্রদের যোগদানও ছিল তুলনামূলকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত।

1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ –

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের বিভিন্ন দিকগুলি হল —

  1. শহরাঞ্চলে ছাত্রদের ভূমিকা – ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে শহরের ছাত্রসমাজ মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। ধর্মঘট, বয়কট ও পিকেটিং-এর মধ্য দিয়ে তারা আন্দোলনকে জোরদার করে তোলে। ছাত্র-যুবদের হাত ধরেই গ্রামাঞ্চলে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
  2. গ্রামাঞ্চলে ছাত্রদের ভূমিকা – ভারত ছাড়ো আন্দোলনকালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ট্রেনের দখল নেয় এবং এর নাম দেয় ‘আজাদ ট্রেন’। এই ট্রেনে চড়ে তারা উত্তরপ্রদেশের শেরপুর অঞ্চলে পৌঁছায় এবং সেখানের কৃষক আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করে। তাই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ‘আজাদ ট্রেন’ এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল।
  3. প্রতিবাদ সমাবেশ – বোম্বাই শহরে আন্দোলনের প্রধান প্রধান নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে 9 আগস্ট শিবাজি পার্কে নারী ও ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে এক বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
  4. ছাত্র ও সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ – 1942 খ্রিস্টাব্দের 11 আগস্ট পাটনার সেক্রেটারিয়েট ভবনে জাতীয় পতাকা তোলা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পাটনায় সাতজন ছাত্র মারা যান। এরপর আন্দোলন উগ্র রূপ ধারণ করে। টেলিফোন, টেলিগ্রাফের তার উপড়ে ফেলা হয়। রেলপথ, রাস্তা, সাঁকো ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। সরকার নিষ্ঠুর দমনপীড়নের মাধ্যমে এই আন্দোলন প্রতিহত করতে উদ্যত হয়।

মূল্যায়ণ – এভাবে দেখা যায় যে, ভারতবর্ষের সর্বত্র ছাত্রসমাজ তার সর্বশক্তি নিয়ে এই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। বহু ছাত্র প্রাণ হারান। ছাত্রসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গতি ত্বরান্বিত করেছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

রশিদ আলি দিবসের গুরুত্ব কী ছিল?

1946 খ্রিস্টাব্দের 10 ফেব্রুয়ারি দিল্লির লালকেল্লাতে আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলির বিচার ও তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দান করা হয়। এই ঘটনায় কলকাতা পুনরায় উত্তাল হয়ে ওঠে এবং ছাত্র বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

বিভিন্ন কারণে রশিদ আলি দিবস তাৎপর্যপূর্ণ যেমন

  • এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অহিংস গণ আন্দোলন হিংসাত্মক আন্দোলনে পরিণত হয়।
  • এটি স্থানীয় বা প্রাদেশিক ঘটনার পরিধি ছাড়িয়ে জাতীয় চরিত্র নেয়।
  • এই আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য জোরদার হয়ে ওঠে।
  • রশিদ আলি দিবসের প্রভাবে 13-18 ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকা-সহ বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, মেদিনীপুর প্রভৃতি শহরেও ধর্মঘট পালিত হয়।

দলিত কারা?

ভারতে বর্ণব্যবস্থাযুক্ত সমাজব্যবস্থায় উচ্চবর্ণের দ্বারা নিম্নবর্ণের হিন্দু বা অস্পৃশ্যরা শোষিত ও অত্যাচারিত হত এবং এদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার ছিল না। এরূপ অস্পৃশ্যরাই ঔপনিবেশিক শাসনকালে দলিত নামে পরিচিতি লাভ করে। দলিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মধ্যভারতের মাহার সম্প্রদায়, দক্ষিণ ভারতের ইজাভা ও পুলায়া সম্প্রদায় এবং বাংলার নমঃশূদ্রগণ।

দলিতদের অধিকাংশই ছিল অনগ্রসর হিন্দু ও অস্পৃশ্য। এদের পেশা ছিল আবর্জনা সাফাই ও ঝাড়ু দেওয়া, জুতো তৈরি করা, শবদাহ করা, মৃত গৃহপালিত পশু সৎকার করা প্রভৃতি। অনেকে আবার অন্যের জমিতে মজুর বা মুনিষরূপে কাজ করত, কেউ বা পালকি বাহকরূপে কাজ করত। এরা হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণ (বর্ণহিন্দু) দের দ্বারা বিভিন্নভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিল, যেমন —

  • দলিতরা সর্বসাধারণের ব্যবহার করা জলাশয় বা কুয়ো থেকে পানীয় জল নিতে পারত না
  • হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের অধিকার ছিল না
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভরতি ও শিক্ষাগ্রহণের সমস্যাও ছিল
  • সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ ছিল না।

ভারতে দলিত রাজনীতির উদ্ভবের কারণগুলি ব্যাখ্যা করো।

বিশ শতকে ভারতীয় রাজনীতিতে সম্প্রদায়গত ও জাতিগত বিষয়টি প্রাধান্য লাভ করে। হিন্দু সমাজে বর্ণপ্রথা ও বহুজাতি প্রথাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আর্থসামাজিক অধিকারহীন দলিত সম্প্রদায়ও রাজনীতির বিষয় হয়ে ওঠে।

ভারতে দলিত রাজনীতির উদ্ভবের কারণ –

দলিত রাজনীতির উদ্ভবের কারণগুলি হল –

  1. ব্রাহ্মণ আধিপত্য – মহারাষ্ট্রের মাহার জাতির বিখ্যাত নেতা জ্যোতিবা ফুলে 1870-এর দশকে প্রচার করেন যে, ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী ব্রাহ্মণদের আধিপত্যই হল শূদ্রবর্ণ তথা দলিতদের দুর্দশার মূল কারণ।
  2. ঔপনিবেশিক শাসন – ঔপনিবেশিক শাসনপর্বে হিন্দুসমাজের বর্ণব্যবস্থাকে মান্যতা দেওয়া হয়। 1880-র দশকে জনগণনায় হিন্দুসমাজের প্রচলিত জাতিবিন্যাসকে নথিভুক্ত করে জাতিগত ক্রমোচ্চতাকে স্থায়ী করার চেষ্টা করা হয়। ফলে সেই সময়ের অস্পৃশ্য বা দলিতরা সংঘবদ্ধ হয়ে জাতিগত উন্নয়নের কথা ভাবতে শুরু করে।
  3. শিক্ষার প্রসার – উনিশ শতকের শেষদিকে খ্রিস্টান মিশনারি ও সরকারি উদ্যোগে শিক্ষার বিস্তার ঘটলে দলিতদের কেউ কেউ শিক্ষিত হয় এবং নিজ শ্রেণির সংঘবদ্ধতার বিষয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
  4. দেশীয় রাজ্যগুলির উদ্যোগ – উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে মহীশূর ও কোলহাপুর-এর মতো দেশীয় রাজ্যগুলি অব্রাহ্মণ অস্পৃশ্য মানুষের উন্নতির জন্য সরকারি চাকরিক্ষেত্রে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ প্রথা চালু করে। এভাবে দলিত সম্প্রদায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।

মূল্যায়ণ – উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে দলিতরা সংঘবদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে এবং বিশ শতকের প্রথমে নিজেদের জন্য আর্থসামাজিক অধিকারসহ রাজনৈতিক অধিকার দাবি করে। প্রথমে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার (1919 খ্রি.) এবং পরে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ও পুনা চুক্তির (1932 খ্রি.) মাধ্যমে দলিত সম্প্রদায় রাজনৈতিক অধিকার লাভ করে।

দলিত শ্রেণির উন্নয়নের জন্য শ্রী নারায়ণ গুরুর অবদান ব্যাখ্যা করো।

দলিত শ্রেণির সংহতিসাধন ও উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক পর্বে যেসমস্ত ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শ্রী নারায়ণ গুরু (1856-1928 খ্রি.)। তিনি কেরালার এজাভা নামক দলিত পরিবারের সন্তান ছিলেন।

শ্রী নারায়ণ গুরুর অবদান –

শ্রী নারায়ণ গুরুর সংস্কারগুলি হল —

  1. আত্মবোধ প্রতিষ্ঠা – কেরালার এজাভা শ্রেণি-সহ অন্যান্য অস্পৃশ্যদের মধ্যে আত্মমর্যাদা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সকলশ্রেণির মানুষের জন্য তিনি 60টির বেশি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সকল জাতি ও ধর্মের মানুষের জন্য এই মন্দিরগুলির দরজা খোলা ছিল।
  2. শিক্ষার ওপর গুরুত্বদান – শ্রী নারায়ণ গুরু এজাভা সম্প্রদায়ের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এ ছাড়া তিনি উচ্চবর্ণের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি গ্রহণের মাধ্যমে এজাভাদের সংস্কৃতিকে উন্নত করার ব্যবস্থা করেন।
  3. ভাইকম সত্যাগ্রহ – দক্ষিণ ভারতের ত্রিবাঙ্কুরের ভাইকমে একটি মন্দিরের চারদিকে রাস্তা থাকলেও এজাভা, পুলায়া প্রভৃতি দলিতদের এই মন্দিরে প্রবেশাধিকার বা মন্দিরের রাস্তায় হাঁটার অধিকার ছিল না। তাই শ্রী নারায়ণ গুরু 1924 খ্রিস্টাব্দে এই রাস্তা দলিত-সহ সাধারণ মানুষের ব্যবহার করার দাবিতে আন্দোলন করেন, যা ভাইকম সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত।

দলিতদের মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত আন্দোলনকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?

দক্ষিণ ভারতের কেরালায় এজাভা, পুলায়া প্রভৃতি নিম্নবর্ণের হিন্দু তথা দলিতরা হিন্দু-মন্দিরে প্রবেশ করতে পারত না বা মন্দির সংলগ্ন পথে যাতায়াতের অধিকার পেত না। দলিতদের প্রতি এই অসাম্য ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে শ্রী নারায়ণ গুরু, এন. কুমারন আসান এবং টি. কে. মাধবন বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এভাবে গড়ে ওঠে মন্দিরে প্রবেশাধিকার আন্দোলন।

  1. ভাইকম সত্যাগ্রহ – ভাইকম মন্দিরে প্রবেশ ও মন্দির সংলগ্ন রাস্তায় দলিতদের প্রবেশাধিকারের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে উঠলেও (মার্চ, 1924 খ্রি.) বর্ণহিন্দুদের তীব্র বিরোধিতায় তা সফল হয়নি। ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজার মৃত্যুর পর সেখানের মহারানির কাছে উদারপন্থী বেশ কিছু বর্ণহিন্দু আবেদন করেন। শেষপর্যন্ত মহাত্মা গান্ধি 1925 খ্রিস্টাব্দের মার্চে ত্রিবাঙ্কুরের মহারানি ও রাজকর্মচারীদের সঙ্গে আপসরফার মাধ্যমে মন্দিরের চারপাশের রাস্তায় দলিতদের ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয়।
  2. গুরুবায়ুর মন্দিরে সত্যাগ্রহ – কেরালার গুরুবায়ুর মন্দিরে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকারের দাবিতে কে. কেলাপ্পনের নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ শুরু হয় (21 অক্টোবর, 1931 খ্রি.)। মন্দির কর্তৃপক্ষ ও গোঁড়া হিন্দুরা সত্যাগ্রহী নেতা পি. কৃষ্ণ পিল্লাই এবং এ. কে. গোপালনকে মারধর করে।
  3. অবশেষে 1936 খ্রিস্টাব্দে ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা সরকার নিয়ন্ত্রিত সব মন্দিরগুলিতে সমস্ত হিন্দুদের জন্য প্রবেশাধিকার প্রদান করেন। পরের দুই বছরের মধ্যে কংগ্রেস শাসিত অন্যান্য প্রদেশগুলিতে অবস্থিত মন্দিরগুলিতেও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়।

আম্বেদকরের নেতৃত্বে দলিত আন্দোলন কীভাবে সংগঠিত হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করো।

ভূমিকা –

ভারতে দলিত আন্দোলনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ড. বাবাসাহেব ভীমরাও রামজী আম্বেদকর (1891-1956 খ্রি.) বা সংক্ষেপে বি. আর. আম্বেদকর। তিনি বিশ শতকে দলিতদের মধ্যে গড়ে ওঠা সংহতিকে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করেন।

আম্বেদকর ও দলিত আন্দোলন –

আম্বেদকর নিজে একজন দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত হন –

  1. হিতকারিণী সভা প্রতিষ্ঠা – আম্বেদকর তাঁর অনুগামীদের নিয়ে গঠন করেন ‘বহিষ্কৃত হিতকারিণী সভা’ (1924 খ্রি.)। হিন্দুসমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন বা বহিষ্কৃত অস্পৃশ্যদের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে রক্ষা করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।
  2. নিপীড়িত শ্রেণির সম্মেলন – 1926 খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির নেতাদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ড. আম্বেদকর এই সমিতির সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন।
  3. মনুস্মৃতি দাহ – 1927 খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর সর্বসাধারণের ব্যবহার্য পুকুর থেকে দলিতদের জল তোলার অধিকার নিয়ে বিরাট সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে ‘মনুস্মৃতি’ গ্রন্থ পুড়িয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে আঘাত হানেন।
  4. সংগঠন প্রতিষ্ঠা – 1930 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘স্বাধীন শ্রমিক দল’ (Independant Labour Party) গঠন করেন। প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে আম্বেদকর সরাসরি কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন।
  5. পুনা চুক্তি – সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতিতে দলিতদের পৃথক নির্বাচন বিধি স্বীকৃতি পেলেও গান্ধিজির অনশনের কারণে তা বাধা পায়। শেষপর্যন্ত আম্বেদকর গান্ধির সঙ্গে পুনা চুক্তি (1932 খ্রি.) সম্পাদনের মাধ্যমে দলিতদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা করেন।
  6. সর্বভারতীয় সংগঠন – 1942 খ্রিস্টাব্দে তিনি সর্বভারতীয় তপশিলি সম্প্রদায় ফেডারেশন (AISCF) গঠন করে দলিতদের মধ্যে সর্বভারতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।
  7. শিক্ষা প্রসার – 1945 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘পিপলস এডুকেশন সোসাইটি’ গঠন করে দলিতদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে সচেষ্ট হন।

উপসংহার –

এভাবে বি. আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে দলিতদের উন্নতির জন্য আন্দোলন প্রচেষ্টা জাতীয় কংগ্রেসের কাছে গুরুত্বলাভ করে। স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই কংগ্রেস আম্বেদকরকে সংবিধান খসড়া রচনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করে। আম্বেদকরের নেতৃত্বে রচিত ভারতীয় সংবিধানে অস্পৃশ্যতাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় এবং দলিতদের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ ব্যাখ্যা করো।

ভূমিকা –

উনিশ শতকে ভারতে দলিত সম্প্রদায় যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনের চেষ্টা শুরু করেছিল, সেগুলির মধ্যে বাংলার নমঃশূদ্র বা চণ্ডাল বা মতুয়া আন্দোলন ছিল উল্লেখযোগ্য। পূর্ববাংলার খুলনা, যশোহর, ফরিদপুর ও বরিশালের নমঃশূদ্র কৃষিজীবীদের এই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল 1870-র দশকে এবং ভারতের স্বাধীনতার পরেও তা চলেছিল।

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের উদ্ভব –

নমঃশূদ্র আন্দোলনের উদ্ভবের প্রেক্ষাপটে ছিল আর্থসামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণ –

  1. অর্থনৈতিক কারণ – নমঃশূদ্র অধ্যুষিত এলাকায় উচ্চবর্ণের হিন্দু ও সৈয়দ মুসলমানদের হাতে জমির উপর একচেটিয়া অধিকার ছিল। নমঃশূদ্ররা ছিল প্রান্তিক কৃষিজীবী, ভূমিহীন কৃষক ও মজুর।
  2. সামাজিক বৈষম্য – 1872 খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর-বাখরগঞ্জ অঞ্চলে একজন বিশিষ্ট নমঃশূদ্র গ্রামীণ নেতার মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যোগ দিতে অস্বীকার করলে আন্দোলনের সূচনা হয়।
  3. ধর্মপ্রচারকের ভূমিকা – ধর্মপ্রচারক হরিচাঁদ ঠাকুর (1812-1878) ও গুরুচাঁদ ঠাকুর (1846-1937) নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে ‘মতুয়া’ ধর্মে দীক্ষিত করেন। তাঁরা ব্রাহ্মণ জমিদার ও পুরোহিত শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের বিকাশ –

বিশ শতকে নমঃশূদ্র আন্দোলনের বিকাশ –

  1. নামের স্বীকৃতি – গুরুচাঁদ ঠাকুর চণ্ডালদের নাম পরিবর্তন করে নমঃশূদ্র রাখার দাবি জানান। 1911 খ্রিস্টাব্দের জনগণনায় এই দাবি স্বীকৃত হয়।
  2. সংগঠন স্থাপন – 1912 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বেঙ্গল নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন’। প্রতিটি জেলায় এই সংগঠনের শাখা ছিল।
  3. রাজনৈতিক দাবি – 1917 ও 1918 খ্রিস্টাব্দে দুটি সম্মেলনের মাধ্যমে ‘সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের’ দাবি করে। ফলে 1919 খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারে বঙ্গীয় আইনসভায় অনুন্নত শ্রেণির জন্য আসন সংরক্ষিত হয়।
  4. ব্রিটিশপন্থী অবস্থান – 1919 খ্রিস্টাব্দের সংস্কার আইনে দাবি পূর্ণ না হওয়ায় তারা ক্রমশ ব্রিটিশ সরকারপন্থী হয়। 1932 খ্রিস্টাব্দের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতিকে সমর্থন করে এবং জাতীয় আন্দোলনের বিরোধিতা করে।

পর্যালোচনা – যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে এই আন্দোলন স্বাধীনোত্তর ভারতে পৃথক রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। গণতন্ত্রের প্রচার এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করেছিল। এই আন্দোলনগুলি ভারতীয় সমাজের রূপান্তরের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।


আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের সপ্তম অধ্যায় বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ এর “ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Please Share This Article

Related Posts

শিশির, কুয়াশা প্রভৃতি অধঃক্ষেপণ নয় কেন

অধঃক্ষেপণ কাকে বলে? অধঃক্ষেপণের রূপভেদ গুলি আলোচনা করো।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে টীকা লেখো।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে টীকা লেখো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

About The Author

Solution Wbbse

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

অধঃক্ষেপণ কাকে বলে? অধঃক্ষেপণের রূপভেদ গুলি আলোচনা করো।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে টীকা লেখো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

বিংশ শতকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে কৃষক সমাজ কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিল?