দশম শ্রেণি – বাংলা – আফ্রিকা (কবিতা) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আফ্রিকা মহাদেশের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি ঔপনিবেশিক শক্তিদের লোভ, নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কবিতাটিতে আফ্রিকার বেদনাময় চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

দশম শ্রেণি – বাংলা – আফ্রিকা

কবি পরিচিতি

ভূমিকা – রবীন্দ্রনাথ একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, অভিনেতা, গীতিকার, চিত্রশিল্পী ও প্রাবন্ধিক। তাঁর সৃষ্টি শুধু ভারতীয় সাহিত্যকেই নয়, বিশ্বসাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে।

জন্ম – ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদা দেবী। ঠাকুর পরিবারের শিল্প, সাহিত্য ও সংগীতচর্চার আবহাওয়ার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ বড়ো হয়ে উঠেছিলেন।

ছাত্রজীবন – ওরিয়েন্টাল সেমিনারি‘-তে রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে বালক রবীন্দ্রনাথের মন বসত না। সেজন্য বারবার বিদ্যালয় পরিবর্তন করেও বিদ্যালয়ের পড়া তিনি শেষ করে উঠতে পারেননি। বাড়িতে যোগ্য গৃহশিক্ষকদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবন – ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর আঠারো বছর বয়সে তাঁকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে যশোরের মেয়ে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে পিতার নির্দেশে জমিদারি দেখাশোনার জন্য পদ্মার তীরে সাজাদপুর, শিলাইদহে তিনি কিছুকাল বসবাস করেন। সেকারণে রবীন্দ্রনাথের এই পর্বের সাহিত্যসৃষ্টিতে এ অঞ্চলের গভীর প্রভাব রয়েছে।

কর্মজীবন – সাহিত্যকর্ম ছাড়াও তিনি নানারকম কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিণত হয় ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’– এ। রবীন্দ্রনাথ শুধু সাহিত্য বা শিল্পের চর্চাই করেননি, প্রয়োজনে দেশ ও জাতির স্বার্থে, মানবতাবিরোধী যে-কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদও করেছেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তিনি ইংরেজ সরকারের দেওয়া ‘নাইট‘ উপাধি ত্যাগ করেন।

সাহিত্যজীবন – অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখতে শুরু করেন। ছেলেবেলায় তাঁকে এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘হিন্দুমেলার উপহার‘ কবিতাটি প্রথম রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত কবিতা, যা ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে অমৃতবাজার পত্রিকা-য় বের হয়। প্রথমদিকের কাব্যগ্রন্থ কবিকাহিনী, এরপর প্রভাতসংগীত ও সন্ধ্যাসংগীত। তাঁর লেখা প্রধান কাব্যগ্রন্থগুলি হল মানসী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য, খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতালি, বলাকা, মহুয়া, পুনশ্চ, নবজাতক, জন্মদিনে, শেষ লেখা ইত্যাদি। তাঁর লেখা উপন্যাস বাংলা উপন্যাসের দিকবদল ঘটায়। চোখের বালি, গোরা, চতুরঙ্গ, যোগাযোগ তাঁর লেখা কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস। বাংলা ছোটোগল্প রচনার পথিকৃৎও তিনি। তাঁর লেখা কয়েকটি বিখ্যাত ছোটোগল্প হল ‘পোস্টমাস্টার’, ‘নষ্টনীড়’, ‘দেনাপাওনা’, ‘অতিথি’, ‘ছুটি’ ‘নিশীথে’ ইত্যাদি। চিন্তাশীল প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ অনন্য। চরিত্রপূজা, সাহিত্য, সাহিত্যের পথে, স্বদেশ সমাজ, কালান্তর তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ।

পুরস্কার – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে ডক্টরেট উপাধি প্রদান করে।

জীবনাবসান – ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।

উৎস

আফ্রিকা কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকার, ১৩৪৩-এর চৈত্র সংখ্যায়। পরে এটি পত্রপুট-এর দ্বিতীয় সংস্করণে ১৬ সংখ্যক কবিতা হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং পরে সঞ্চয়িতা-য় স্থান পায়।

সারসংক্ষেপ

রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতা আদিম আফ্রিকার ছায়াঘন সুন্দররূপ বর্ণনার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণে বিপর্যস্ত চিত্রই এঁকেছেন কবি। সৃষ্টির শুরুতেই ভয়ংকর প্রকৃতি আফ্রিকা মহাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে তার আত্মপ্রকাশকে সম্ভব করে তুলেছিল। তৈরি হয়েছিল আদিম অরণ্যে ঢাকা এক নতুন মহাদেশ, যেখানে ভয়ংকরতা আর রহস্যময়তাই ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাকি পৃথিবীর কাছে যেন দুর্বোধ্য ছিল সেই নতুন ভূমিখণ্ড। ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে নিজের অস্তিত্বকে যেন টিকিয়ে রাখতে চাইছিল সে। অন্যদিকে সভ্য পৃথিবীও উপেক্ষার চোখে দেখেছিল রহস্যময় সেই মহাদেশকে, গুরুত্ব পায়নি তার জীবনধারা, সংস্কৃতি।

পরবর্তীকালে আফ্রিকাকে দেখা হল ক্রীতদাস সংগ্রহের বাণিজ্যিক জায়গা হিসেবে। আফ্রিকার গভীর অরণ্যের অন্ধকারের থেকেও সভ্যতার অহংকারে অনেক বেশি অন্ধ মানুষদের আগমন ঘটল আফ্রিকায়। ক্রমশ সভ্য দুনিয়ার মানুষ আফ্রিকার সম্পদের কথা জানতে পারল। উপনিবেশ তৈরি হল সেখানে। আফ্রিকা হয়ে উঠল ইউরোপের উন্নত দেশগুলির চারণভূমি। তাদের বর্বর অমানবিক লুন্ঠন, শোষণ, অত্যাচারে আফ্রিকার মাটি ভিজে গেল রক্তে আর চোখের জলে। সভ্য পৃথিবীর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের বিপরীতে এই রক্তাক্ততা আসলে সভ্যতার অমানবিক কুৎসিত রূপকেই ফুটিয়ে তুলল। এই নির্লজ্জ হিংস্রতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন কবি। তাঁর মনে হয়েছে শোষিত, অপমানিত আফ্রিকার কাছে যুগান্তের কবির ক্ষমা চাওয়া উচিত। কারণ, মানবসভ্যতার শেষ কথাই হল ক্ষমা। আর ক্ষমাই সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী, যা ‘যুগান্তের কবি’-র কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। কবিই হলেন সুন্দরের উপাসক। তাই কবির ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়েই শুভবুদ্ধির প্রকাশ ঘটবে; প্রতিষ্ঠা হবে মানবতার।

নামকরণ

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যের নামকরণের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। নামের মধ্য দিয়ে বিষয়ের ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তোলা তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয়।

আফ্রিকা তাঁর পত্রপুট কাব্যগ্রন্থের স্মরণীয় এক কবিতা। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইটালির সাম্রাজ্যবাদী শাসক মুসোলিনি ইথিওপিয়া আক্রমণ করেন। এই ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি রচিত হয়। কবিতার প্রথম অংশে আফ্রিকার উৎপত্তির ইতিহাসটি বর্ণিত হয়েছে। প্রতিকূল ভৌগোলিক পরিবেশে প্রকৃতির ভয়ংকর রূপকে আপন করে আফ্রিকা নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। সমস্ত বাধাকে জয় করে আফ্রিকা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখল। সভ্য মানুষের কাছে চিরকাল তার মানবরূপ অপরিচিত ছিল। তারপর ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের থাবা পড়ল স্বাধীন আফ্রিকার ওপর। ক্রীতদাসে পরিণত হল হাজার হাজার আফ্রিকাবাসী। লোহার হাতকড়ি পরিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হল অন্যদেশে ঔপনিবেশিক প্রভুদের দাস হিসেবে। সভ্যতার ‘নির্লজ্জ অমানুষতা’ প্রকাশিত হল নিষ্ঠুরভাবে। মানবতার এই চরম অপমানে শেষপর্যন্ত কবি অপমানিত আফ্রিকার পাশে দাঁড়িয়ে যুগান্তের কবিকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। সমগ্র কবিতায় সমকালীন বিশ্বরাজনীতির পটভূমিতে আফ্রিকার লাঞ্ছিত, রক্তাক্ত রূপটিই ফুটে উঠেছে। এই বিচারে কবিতাটির নামকরণ বিষয়কেন্দ্রিক হয়েও ব্যঞ্জনাধর্মী।

“আফ্রিকা” কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম বিখ্যাত কবিতা। এই কবিতাটি ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে একটি জ্বলন্ত প্রতিবাদ। কবিতাটি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

Share via:

মন্তব্য করুন