মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

Solution Wbbse

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় “বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর থেকে “ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
Contents Show

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।

আধুনিক যুগে উত্তরণের একটি উপাদান হল আধুনিক শিক্ষা আর আধুনিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান উপাদান হল ছাপাখানা। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে বাংলায় ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হয় এবং উনিশ শতকে বাংলায় বিভিন্নভাবে এই ছাপাখানার বিকাশ ঘটে।

বাংলায় প্রথম ছাপাখানার সূচনা –

কলকাতায় প্রথম 1777 খ্রিস্টাব্দে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা করেন জেমস অগাস্টাস হিকি। প্রথম দিকে হিকির ছাপাখানা থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাপা হত। এই ছাপাখানা থেকে 1780 খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল গেজেট’ (Bengal Gazatte) প্রকাশিত হয়। এটি হিকির গেজেট নামেও পরিচিত। এটি হল ভারতে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র।

বাংলায় ছাপাখানার প্রথম চলনশীল বাংলা হরফ –

প্রারম্ভিক পর্বের বাংলা ছাপাখানার জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন চার্লস উইলকিনস। তাঁর নাম বাংলা চলনশীল বা মুভেবল টাইপ বা সচল হরফের আবিষ্কর্তা হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে। 1778 খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা চার্লস উইলকিনস চুঁচুড়াতে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা ভাষায় তাঁর যথেষ্ট পাণ্ডিত্য ছিল। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের নির্দেশে 1778 খ্রিস্টাব্দে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ (A Grammar Of The Bengal Language) ছাপানোর জন্য তিনি বাংলা হরফ প্রস্তুত করেন। বাংলা হরফ প্রস্তুত করতে তাঁকে সাহায্য করেন পঞ্চানন কর্মকার। এই বাংলা হরফের আবিষ্কার বাংলার ছাপাখানার জগতে এক নবজাগরণের সূচনা করে।

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।

উনিশ শতকে বাংলা ছাপাখানার বিকাশ –

উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক বাংলা ছাপাখানা ও বাংলা বই – এর ক্ষেত্রে স্মরণীয় সময়। এই দশকে শ্রীরামপুর ও কলকাতায় কয়েকটি বিখ্যাত ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রীরামপুর ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক বাংলা পত্রিকা ‘দিগদর্শন’ ও সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা ‘সমাচার দর্পণ’।

বাংলার ছাপাখানার জগতে জোয়ার –

বাংলা ছাপাখানার জগতে জোয়ার আসে উনিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে। কারণ –

  • সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র প্রকাশ – এই সময় থেকে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের প্রকাশনা বৃদ্ধি পায়। এই পত্রপত্রিকা প্রকাশের জন্য কয়েকটি ছাপাখানা স্থাপিত হয়।
  • বই প্রকাশ – স্কুল পাঠ্যবই -এর ক্রমবর্ধমান চাহিদা ছাপাখানা স্থাপনে বিশেষভাবে উৎসাহ দিয়েছিল।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপাখানার বিকাশ –

ছাপাখানার বিকাশে ব্যক্তিগত উদ্যোগের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। অনেকে জাতীয়তাবাদী আদর্শে, আবার অনেকে ব্যাবসায়িক উদ্যোগে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তিগত ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও তাঁর ইউ রায় অ্যান্ড সন্স -এর অবদান উল্লেখযোগ্য। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছাপাখানার বিকাশে প্রসেস ও হাফটোন, ব্লক প্রিন্টিং প্রভৃতি বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। রঙিন মুদ্রণের ক্ষেত্রে ডায়াফর্ম যন্ত্র, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র ইত্যাদি আবিষ্কারের মাধ্যমে মুদ্রণশিল্পে যে গুণগত মানের পরিবর্তন এনেছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

ছাপাখানার ব্যবসায় মধ্যবিত্তশ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা –

বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা ছিল ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। প্রথমপর্বে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠায় ধনী জমিদাররা পৃষ্ঠপোষকতা করলেও কালের ছন্দে মধ্যবিত্তশ্রেণি নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।

যৌথ উদ্যোগে বাংলা ছাপাখানার বিকাশ –

সমষ্টিগত বা যৌথ উদ্যোগেও বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ ঘটেছিল।

  • ব্যাপকভাবে ধর্মীয় মতামত প্রকাশ ও প্রসারের জন্য ছাপাখানা স্থাপন করা হয়েছিল। উনিশ শতকে বিভিন্ন মিশনারি সংস্থা ধর্মপ্রচারের জন্য ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিল।
  • বিভিন্ন কারণে প্রতিষ্ঠিত সভাসমিতি তাদের মতপ্রকাশের ও প্রচারের জন্য ছাপাখানা স্থাপন করেছিল। অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রথমদিকে ছাপাখানা না থাকলেও পরবর্তীকালে তারা ছাপাখানা স্থাপন করেছিল।
  • পত্রপত্রিকা প্রকাশের জন্য যৌথ উদ্যোগে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

বাংলায় ছাপাখানার উপসংহার –

বাংলার ছাপাখানার বিকাশে শিল্পবিস্তারের আদর্শ ও ব্যাবসায়িক উদ্যোগ দুই-ই ছিল। ব্রিটিশ আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ফলে পাঠ্যবই রচনাকে কেন্দ্র করে ছাপাখানার ব্যাপক বিস্তার ঘটে।

বার্নার্ড মেসেনিক কর্তৃক ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ প্রকাশিত হয় কখন এবং হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশের কত মাস পরে?

হিকির বেঙ্গল গেজেট প্রকাশের নয় মাস পর 1780 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বার্নার্ড মেসেনিক নামে এক ব্যবসায়ী ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ প্রকাশ করেন।

সরকারি ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

সরকারি ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা – চার্লস উইলকিনস যে ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন, 1778 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে সেটি সরকারি ছাপাখানায় পরিণত হয়। এই প্রেস থেকে ওয়ারেন হেস্টিংস -এর প্রচেষ্টায় ‘ক্যালকাটা গেজেট’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই ছাপাখানাকে বলা হত অনারেবল কোম্পানির প্রেস। পরে ‘মিলিটারি অরফ্যান সোসাইটিস প্রেস’ ও ‘আলিপুর জেল প্রেস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রেসগুলি থেকেও সরকারি কাগজপত্র ছাপানো হত।

1778 থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতায় কতটি ছাপাখানা ছিল এবং সেগুলোর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি ছাপাখানার সংখ্যা কত ছিল?

1778 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতায় অন্তত 17টি ছাপাখানা ছিল। এর মধ্যে 1টি ছিল সরকারি (অনারেবল কোম্পানির প্রেস) এবং বাকি 16টি বেসরকারি।

1778 থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দের ছাপাখানাগুলোর পরিচালকরা কোন জাতীয়তার ছিলেন?

1778 থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দের সময়ের মধ্যে স্থাপিত প্রেসের পরিচালকরা ছিলেন ইংরেজ।

1800-1850 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত 50 বছরে কলকাতায় কতটি নতুন ছাপাখানা ও পত্রপত্রিকা প্রতিষ্ঠিত হয়?

1800-1850 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম 50 বছরে 122টি ছাপাখানা স্থাপিত হয়েছিল। এই সময় পত্রপত্রিকার সংখ্যা ছিল 97টি।

1800-1850 খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী 50 বছরে (1850-1900) এই সংখ্যাগুলো কী দাঁড়ায়?

1800-1850 খ্রিস্টাব্দের পরের 50 বছরে এই সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে 1126টি ছাপাখানা এবং 1087টি পত্রপত্রিকা-য়।

বাংলা মুদ্রণশিল্পের জনক কাকে বলা হয়?

চার্লস উইলকিনসকে ‘বাংলা মুদ্রণশিল্পের জনক’ বলা হয়।

বাংলার প্রাথমিক পর্যায়ের মুদ্রাকরদের সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

জার্মানির মেইনজ শহরে গুটেনবার্গের ছাপাখানা স্থাপনের পর থেকেই মুদ্রণশিল্পে বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। ভারতে পোর্তুগিজদের সহায়তায় মুদ্রণশিল্পের অগ্রগতি ঘটে। 1772 খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করার পর থেকেই মুদ্রণকার্যের সূত্রপাত হয়। বাংলায় প্রথমদিকে যেসব মুদ্রাকর ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন –

চার্লস উইলকিনস –

1778 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতায় নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড ‘এ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ (A Grammar Of The Bengal Language) গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থটি ছাপানোর জন্য উইলকিনস সর্বপ্রথম শক্ত ইস্পাতের উপর বাংলা হরফগুলি খোদাই করে সঞ্চালনযোগ্য মুদ্রাক্ষর তৈরি করেন। এর মাধ্যমেই আধুনিক বাংলা মুদ্রণের জন্ম হয়।

বাংলার প্রাথমিক পর্যায়ের মুদ্রাকরদের সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

পঞ্চানন কর্মকার –

হ্যালহেড সাহেবের ব্যাকরণ গ্রন্থটিতে প্রথম বাংলা হরফ ব্যবহার করেন চার্লস উইলকিনস। কিন্তু এক্ষেত্রে চার্লস উইলকিনসকে সহযোগিতা করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকার। পঞ্চানন কর্মকারের দক্ষতা ও পরিশ্রম ব্যতীত বাংলা মুদ্রণের প্রসার ও প্রচার কখনোই ঘটত না।

জন অ্যান্ড্রুজ –

ইংল্যান্ড থেকে আগত জন অ্যান্ড্রুজ ছিলেন মূলত পুস্তক ব্যবসায়ী। ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি বই নিয়ে নানা জায়গায় ফেরি করতেন। এই সূত্র ধরেই 1777-1778 খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে এক ছাপাখানা স্থাপন করেন তিনি। এটাই ছিল বাংলার প্রথম ছাপাখানা।

জেমস অগাস্টাস হিকি –

জীবনের প্রথমদিকে জাহাজ ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলেন অগাস্টাস হিকি পরবর্তীকালে ভাগ্য বিপর্যয়ের ফলে পুরোনো ব্যাবসা ছেড়ে দিয়ে কম পুঁজিতে 1777 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রথম কাঠের ছাপাখানা তৈরি করেন। প্রথমদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক বিল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র এখান থেকে ছাপা হত। পরবর্তী সময়ে 1780 খ্রিস্টাব্দে হিকি এই ছাপাখানা থেকে প্রথম ইংরেজি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন, যা হিকির গেজেট বা বেঙ্গল গেজেট নামে পরিচিত।

বাংলার প্রাথমিক পর্যায়ের মুদ্রাকরদের সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

জন জাকারিয়া কেরনিয়ানডার –

বাংলায় প্রথম প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারি হিসেবে সুইডিশ জন জাকারিয়া কেরনিয়ানডার কলকাতায় আসেন। তিনি প্রথম মিশনের ছাপাখানা স্থাপন করেন বাংলা ও উত্তর ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে।

বার্নার্ড মেসেনিক –

ইন্ডিয়া গেজেট পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক ছিলেন বার্নার্ড মেসেনিক। 1780 খ্রিস্টাব্দে বার্নার্ড মেসেনিক ও পিটার রিডের যৌথ প্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ইন্ডিয়া গেজেট প্রকাশিত হয়।

হেরাসিম লেবেডফ –

রুশ পর্যটক ও শিল্পী হেরাসিম লেবেডফ কলকাতায় প্রথম বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করেন। নানা ভারতীয় বই ও তার অনুবাদ প্রকাশনা, মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন ও বাংলা ছাপার হরফ তৈরি প্রভৃতি কাজে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

এ ছাড়াও বাংলা ভাষায় হরফ সংস্কারের মাধ্যমে মুদ্রণের অগ্রগতির জন্য ট্রেভেলিয়ান, জন মারডক, হোরেস হেম্যান উইলসন, পিয়ার্স প্রমুখের নাম ছিল উল্লেখযোগ্য।

বাংলার মুদ্রণের ইতিহাসে জেমস অগাস্টাস হিকির অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো। এ ব্যাপারে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের অবদান আলোচনা করো।

বাংলার মুদ্রণের ভূমিকা –

জার্মানির গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিষ্কার করলে ইউরোপে মুদ্রণ জগতে বিপ্লব ঘটে। এর প্রায় শতবর্ষ পরে পোর্তুগিজদের মাধ্যমে ভারতের গোয়ায় ছাপাখানার প্রচলন হয় (1556 খ্রিস্টাব্দ)। এরও প্রায় 200 বছর পর কলকাতায় ছাপাখানা তৈরি হয়।

হিকির অবদান –

জেমস অগাস্টাস হিকি ছিলেন একজন আইরিশ। ছাপাখানার বিকাশে তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত্ব।

ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা –

প্রথম জীবনে জাহাজ ব্যাবসাতে লিপ্ত অগাস্টাস হিকি প্রচুর লোকসান করেন। প্রচুর ঋণের জন্য তিনি শাস্তির সম্মুখীন হন। এরপর 2000 টাকা সংগ্রহ করে কলকাতায় 1777 খ্রিস্টাব্দে একটি কাঠের ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।

কার্যাবলি –

এই ছাপাখানায় হিকি প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন বিল এবং ব্যাবসাবাণিজ্যের বাট্টা (Discount) সংক্রান্ত কাগজগুলি ছাপাতে থাকেন। কোম্পানির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজকর্মের বিষয়ে হিকির প্রায়ই বিবাদ হওয়ায় কোম্পানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

পত্রিকা প্রকাশ –

হিকি 1780 খ্রিস্টাব্দের 1 জানুয়ারি বেঙ্গল গেজেট নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাটি ছিল বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে প্রথম ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী, লাটসাহেব সকলের কাজকর্মের সমালোচনা ও কেচ্ছাকাহিনি এই পত্রিকায় ছাপা হত। ব্যাবসাবাণিজ্যের সংবাদ এবং কিছু বিজ্ঞাপনও প্রকাশিত হত এই পত্রিকায়। কলকাতার ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা এই পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন।

কিছুকাল পত্রিকা প্রকাশনার পর পত্রিকাটি সরকারের রোষে পড়ে। 1782 খ্রিস্টাব্দের 23 মার্চ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয় হিকির এই প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয় এবং অভিনব। এই পথ ধরে পরে অনেকে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। বহু মানুষের কাছে বই এবং পত্রপত্রিকা পৌঁছে যায়। পেশায় সাংবাদিক না হয়েও জেমস অগাস্টাস হিকি ছিলেন ‘ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক’।

শ্রীরামপুর মিশনারিদের ভূমিকা –

ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা –

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস, চার্চ মিশন প্রেস, বিশপস্ কলেজ প্রেস, আমেরিকান ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। 1800 খ্রিস্টাব্দের 10 জানুয়ারি শ্রীরামপুর ত্রয়ী নামে পরিচিত মার্শম্যান, ওয়ার্ড ও উইলিয়ম কেরি ‘শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তাঁরা প্রথম কাঠের তৈরি মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন। এর ফলে বাংলায় ছাপাখানার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ওয়ার্ড ছিলেন ছাপাখানার কাজে বেশ দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। কেরির পরিচালনায় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস হয়ে উঠেছিল এশিয়ার সর্ববৃহৎ ছাপাখানা। মিশনারিদের উদ্যোগেই বাংলায় প্রথম সাময়িকপত্র ‘দিগদর্শন’ এবং একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হয়।

বাংলার মুদ্রণের ইতিহাসে জেমস অগাস্টাস হিকির অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো। এ ব্যাপারে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের অবদান আলোচনা করো।

পঞ্চানন কর্মকারের ভূমিকা –

শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন 1818 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শুধু বাংলা হরফে 36টি পুস্তক, একটি সংস্কৃত পুস্তক এবং এইসব মুদ্রিত পুস্তকের আরও 12টি সংস্করণ প্রকাশ করে। মিশন প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই উইলিয়ম কেরি বাংলা হরফের অন্যতম কারিগর পঞ্চানন কর্মকারকে শ্রীরামপুর মিশনে নিয়ে আসেন। পঞ্চানন কর্মকার হরফ খোদাই ও ঢালাই -এর কাজে দক্ষ ছিলেন। তাঁর দক্ষতা মিশন প্রেসে যোগদানের আগেই প্রমাণিত হয়েছিল। কেন-না তিনিই 1793 খ্রিস্টাব্দে নতুন বাংলা হরফ তৈরি করেন এবং নিউ টেস্টামেন্ট ছাপার জন্য প্রয়োজনীয় হরফও প্রস্তুত করেন।

গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ভূমিকা –

শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন অপর একজন ব্যক্তিত্ব হলেন মিশন প্রেসের কম্পোজিটর গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। তাঁর সম্পাদনায় ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ প্রকাশিত হয়। তিনি পরে নিজেও ছাপাখানার মালিক হয়েছিলেন।

বাংলার মুদ্রণের ইতিহাসে জেমস অগাস্টাস হিকির অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো। এ ব্যাপারে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের অবদান আলোচনা করো।

মিশন প্রেসের কার্যাবলি –

1800 থেকে 1837 খ্রিস্টাব্দ এই 38 বছরে বাংলা মুদ্রণের ইতিহাসকে পুষ্ট করেছে মিশনের প্রকাশনা। এই মিশন প্রেসের উদ্যোগেই সংস্কৃত থেকে বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল রামায়ণ, মহাভারত, হিতোপদেশ, বত্রিশ সিংহাসন প্রভৃতি। এর সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় ছাপা হয় বিভিন্ন ভাষার বাইবেল ও বিভিন্ন খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থও। কেরির মাধ্যমে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সঙ্গে শ্রীরামপুর মিশনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে একাধিক পুস্তক ছাপাতে দেয়। আবার মিশন প্রকাশিত পুস্তকের অনেকগুলি কিনে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। শ্রীরামপুর মিশন থেকে ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ের উপর বই ছাপা হয়েছিল। উইলিয়ম কেরির পুত্র ফেলিক্স কেরি ছিলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার অন্যতম পথপ্রদর্শক।

শ্রীরামপুর প্রেসের অবদান –

1800 খ্রিস্টাব্দের পর শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগেই বাংলায় মুদ্রিত বইয়ের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এইভাবে শুধুমাত্র যে দেশীয় শিক্ষা প্রসারেই সহায়ক হয়েছিল তা নয়, শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় এমনকি গ্রাম ও পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলিতেও তার প্রভাব অনুভূত হয়েছিল। মূলত উইলিয়ম কেরি এবং তাঁর পুত্র ফেলিক্স কেরির দেখানো পথ ধরেই পরবর্তীকালে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিল।

অ্যারন অ্যাপজন অবদান লেখো।

অ্যারন অ্যাপজন – বিখ্যাত খোদাইকর হিসেবে অ্যারন অ্যাপজনের কৃতিত্ব ছিল। ক্যালকাটা ক্রনিকলের মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

ফ্রান্সিস প্লাউউইন ও ড্যানিয়েল স্টুয়ার্ট কে ছিলেন?

ফ্রান্সিস প্লাউউইন ও ড্যানিয়েল স্টুয়ার্ট – 1784 খ্রিস্টাব্দে আধাসরকারি ইংরেজি সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয় ক্যালকাটা গেজেট। ফ্রান্সিস গ্লাউউইন ছিলেন এর স্বত্বাধিকারী ও প্রকাশক। পরবর্তীকালে এর মালিকানা বদল হয়ে যায়। 1787 খ্রিস্টাব্দ থেকে ড্যানিয়েল স্টুয়ার্ট ছিলেন এর মুদ্রাকর। তখন থেকে ক্যালকাটা গেজেটে বাংলা হরফে ছাপা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হতে থাকে।

মুদ্রণের সঙ্গে শিক্ষাপ্রসারের বিষয়টি পর্যালোচনা করো। মুদ্রণের সঙ্গে জাতীয় চেতনার উন্মেষের বিষয়টি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

মুদ্রণের সঙ্গে শিক্ষাপ্রসারের ভূমিকা –

ছাপাখানার সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছাপা বই পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের সূচনা করে। ছাপাখানা ইউরোপে যেমন নবজাগরণের সূচনা করে, তেমনি বাংলাদেশেও তা নবযুগের জন্ম দেয়।

মুদ্রণের সঙ্গে শিক্ষাপ্রসারের সম্পর্ক –

  • 1813 খ্রিস্টাব্দের কোম্পানির সনদ – ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় মুদ্রণযন্ত্রের বিকাশ শিক্ষাবিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। 1813 খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সনদ আইনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটে এবং কোম্পানি শিক্ষাক্ষেত্রে বাৎসরিক 1 লক্ষ টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিলে ভারতে শিক্ষাবিস্তারে গতি আসে।
  • বেসরকারি উদ্যোগ – সরকারি বিদ্যালয় ও মিশনারিগণ স্থাপিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডেভিড হেয়ার, রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, বিদ্যাসাগর প্রমুখ ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
মুদ্রণের সঙ্গে শিক্ষাপ্রসারের বিষয়টি পর্যালোচনা করো। মুদ্রণের সঙ্গে জাতীয় চেতনার উন্মেষের বিষয়টি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
  • স্কুল বুক সোসাইটির ভূমিকা – শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে আগে হাতে লেখা পুথিপত্র ব্যবহার করা হত। শিক্ষক পুথি (হাতে লেখা খাতা বিশেষ) ধরে পড়াতেন। শিক্ষার্থীরা তা শুনত বা কেউ কেউ লিখে রাখত। সব কিছু মনে রাখা বা লিখে নেওয়া সম্ভব ছিল না। শিক্ষাক্ষেত্রে এই অভাব ও অসুবিধা দূর করে ছাপা বই। ছাপা বইতে বিষয়টি সম্পূর্ণ লেখা থাকত। প্রত্যেক শিক্ষার্থী তা পড়তে পারত। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে পাঠ্যপুস্তকের অভাব একটি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল। 1817 খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ডেভিড হেয়ার ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ স্থাপন করে এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই সোসাইটির মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় ছাত্রদের জন্য পর্যাপ্ত ইংরেজি ও বিভিন্ন ভাষায় প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক রচনা, মুদ্রণ ও স্বল্প বা বিনামূল্যে বিতরণ করা।
  • অনুবাদ সাহিত্যের অবদান – মুদ্রণযন্ত্র পাশ্চাত্যের ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রনীতি, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদির সঙ্গে ভারতবাসীকে পরিচিত হতে সাহায্য করে এবং তা সম্ভব হয় অনুবাদ সাহিত্যের উন্নতির জন্য। ফলে পাশ্চাত্য উদারতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি ধ্যানধারণার সঙ্গে ভারতবাসীর পরিচয়ের ফলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে।
  • শিক্ষিত মনীষীদের ভূমিকা – রামমোহন রায়, রাজা রাধাকান্ত দেব, বিদ্যাসাগর, ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যবৃন্দ তাঁদের চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণার প্রকাশ করেন সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। ফলশ্রুতিতে আপামর জনসাধারণ সামাজিক কুপ্রথা, কুসংস্কার ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
  • গদ্যসাহিত্যের বিকাশসাধন – মুদ্রণ ব্যবস্থার প্রবর্তনকে কেন্দ্র করে বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশের পথ ত্বরান্বিত হয়। পূর্বে বাংলার সাহিত্যে পদ্যরীতি প্রচলিত ছিল। সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকা প্রকাশের দ্বারা গদ্যসাহিত্যের বিকাশ ঘটে।
  • জনগণের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি – সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকার দ্বারা জনগণ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। ভারতীয় তথা বাঙালি জনগণের জ্ঞানের পরিধি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
  • পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে ভারতবাসীর পরিচিতি লাভ – মুদ্রণশিল্পের উন্নতির ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে ভারতবাসী পরিচিত হয়। এই পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে এক নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির উদ্ভব ঘটে, যারা ভারতের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান করতে সহায়তা করেছিল।
  • সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন – মুদ্রণ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার ক্ষেত্রে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, শিক্ষণ পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে নানা রকমের রচনা প্রকাশিত হতে থাকে, যা থেকে শিক্ষা সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন লক্ষিত হয়।
মুদ্রণের সঙ্গে শিক্ষাপ্রসারের বিষয়টি পর্যালোচনা করো। মুদ্রণের সঙ্গে জাতীয় চেতনার উন্মেষের বিষয়টি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

মুদ্রণ ও জাতীয় চেতনার উন্মেষ/মুদ্রণের সঙ্গে জাতীয় চেতনার সম্পর্ক –

এ কথা আগেই বলা হয়েছে যে, বাংলায় ছাপাখানার প্রচলন নবযুগের সূচনা করে।

  • দর্শন – ছাপাখানা কেবল পাঠ্যবই ছাপত না – রাষ্ট্রদর্শন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু বইও এখানে মুদ্রিত হত। মেকিয়াভেলি, হবস, লক, রুশো -এর দর্শনের সঙ্গে এদেশের শিক্ষিত শ্রেণির পরিচিতি ঘটে। থমাস পেইন -এর ‘Age of Reason’ পড়ে তারা যুক্তিবাদ সম্বন্ধে ধারণা লাভ করে। গণতন্ত্র, উদারনীতিবাদ ও জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে এক বলিষ্ঠ ধারণা তৈরি হয়।
  • পত্রপত্রিকা – ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলি জাতীয় চেতনা জাগ্রত করতে সাহায্য করে। ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতীয়দের দুরবস্থা, সামাজিক কুসংস্কার, শিক্ষাপ্রসারের প্রয়োজনীয়তা, বিভিন্ন বিক্ষোভ-বিদ্রোহের কথা, ইংরেজ সরকারের অত্যাচারী শাসন প্রভৃতি সংবাদ ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে সাহায্য করে।

এই কাজে সম্বাদ কৌমুদী, সংবাদ প্রভাকর, বঙ্গদর্শন, সম্বাদ ভাস্কর, হিন্দু, কেশরী, ট্রিবিউন, আখবর, কোহিনুর, আজাদ প্রভৃতি পত্রিকার বিশেষ ভূমিকা ছিল

ছাপাখানা এইভাবে বই প্রকাশনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের চাহিদা মিটিয়ে শিক্ষার প্রসার ঘটায় এবং এর পাশাপাশি পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসীকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো। বাংলায় ছাপাখানার প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো।

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান –

উনিশ শতকের বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে যেসব ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক।

  • বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা – বিদ্যাসাগর মহাশয় ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার যৌথভাবে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দুজনে পরামর্শ করে এর নাম দিয়েছিলেন ‘সংস্কৃত যন্ত্র’। এতে দুজন সমান অংশীদার ছিলেন। 1847 খ্রিস্টাব্দে ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • ছাপাখানার খ্যাতি – কিছুদিনের মধ্যেই ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নামের এই ছাপাখানার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। 1857 খ্রিস্টাব্দের এক হিসাবে দেখা যায় যে, সে বছর সংস্কৃত প্রেস থেকে 84,220 কপি বই ছাপা হয়। মূলত পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজই হত বেশি। স্কুল বুক সোসাইটির রিপোর্ট থেকেও জানা যায় সংস্কৃত প্রেস ছিল খুব উঁচুমানের প্রেস।
  • ছাপাগ্রন্থ – বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সব বই-ই ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ থেকে ছাপা হয়েছে (বেতাল পঞ্চবিংশতির 1ম সংস্করণ ছাড়া)। এই প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘শিশুশিক্ষা’ ও ‘বর্ণপরিচয়’ ছিল জনপ্রিয় দুটি বই।
  • পুস্তক বিক্রেতা হিসেবে বিদ্যাসাগর – বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লেখা বইয়ের যথেষ্ট চাহিদা ছিল। হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ অঞ্চলে তিনি সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটারি নামে একটি বই -এর দোকানও খোলেন।

বাংলায় ছাপাখানার প্রভাব –

বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার প্রভাব ছিল ও সুদূরপ্রসারী। আঠারো শতককে ভারতে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয়। কিন্তু এই শতকেই বাংলায় একাধিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতি বিস্তারের সূত্রে নবজাগরণের প্রেক্ষাপট রচিত হয়। মধ্যযুগের অবসানে আধুনিক যুগ সূচিত হয়।

বাংলায় ছাপাখানার সামাজিক প্রভাব –

ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার সামাজিক প্রভাবগুলি হল নিম্নরূপ –

  • শিক্ষাবিস্তার – ছাপাখানায় বই, পত্রপত্রিকা ছাপা ও প্রকাশিত হয়। পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান, গণতন্ত্র, উদারনীতিবাদ, যুক্তিবাদ, উপযোগবাদ প্রভৃতির ধারণা ছাপা বইয়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
    দেশ-বিদেশের খবরাখবর সংবাদপত্রের মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে। নিজেদের দুরবস্থা, সামাজিক কুসংস্কার সম্বন্ধে সম্যক বোধোদয় হয়।
  • জনমত গঠন – রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও-র শিষ্যমণ্ডলী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীরা তাঁদের মতামত প্রকাশ করেছেন সংবাদপত্রের মাধ্যমে। সামাজিক কুপ্রথা দূর করার লক্ষ্যে তাঁরা জোরালো প্রচার চালান। এই ক্রমাগত প্রচারের ফলে জনমত গড়ে ওঠে, সংস্কার আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়।
  • সাহিত্যরীতি – বাংলা ভাষা মানুষের কথ্যভাষা হিসেবে চালু ছিল। এর আগে বাংলা সাহিত্যকর্ম হিসেবে যা ছিল সেগুলি সংস্কৃতঘেঁষা বাংলায় লেখা হয়েছিল। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পন্ডিতদের বাংলা
    গদ্যরীতির অনুসরণে এসময় বাংলা গদ্য লেখার চল শুরু হয়। রামমোহন রায় বাংলা গদ্যরচনায় স্বকীয় ধারার নজির সৃষ্টি করেন। ফলে বাংলা ভাষার বিকাশে ছাপাখানা বিরাট ভূমিকা পালন করে। বাংলার সমাজে কথ্য বাংলা ও লেখ্য বাংলার দৃষ্টান্ত গড়ে ওঠে।
  • শ্রেণিচরিত্র – বাংলাদেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর নতুন ভূমিব্যবস্থা চালু হয়। জমিদারশ্রেণি গড়ে ওঠে। ব্যাবসাবাণিজ্যের বিকাশের ফলে ব্যবসায়ী ও বণিকশ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ইংরেজি শিক্ষা চালু হয় এবং শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে। সমাজে তারা ‘মধ্যবিত্তশ্রেণি’ নামে পরিচিত হয়। নিজেদের পেশাগত প্রয়োজনে এই শ্রেণি ছাপাখানার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। সমাজের তাদের কাছে বিনিয়োগ ও মুনাফার বিষয় হয়ে ওঠে এই ছাপাখানা।

বাংলায় ছাপাখানার মূল্যায়ন –

এইভাবে ছাপাখানা শিক্ষাবিস্তার, জনমত গঠন, বাংলা ভাষারীতির প্রবর্তন ও শ্রেণিচরিত্র গঠন করে বাংলার সমাজজীবনে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে।

মুদ্রণের ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আলোচনা করো। এই বিষয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবদান কী ছিল?

মুদ্রণের ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ভূমিকা –

উনিশ শতকে শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বইয়ের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। আর এই চাহিদার ফলেই সৃষ্টি হয় ছাপাখানার ব্যাবসায়িক উদ্যোগ। এক শ্রেণির শিক্ষিত বাঙালি ছাপাখানার ব্যাবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে বাংলায় ছাপাখানার ব্যাবসায়িক উদ্যোগের সূচনা হয়।

মুদ্রণের ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা ভূমিকা –

বাংলাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। সেই কারণে ছাপাখানার ব্যাবসা লাভজনক হয়ে ওঠে ও এর প্রসার ঘটে। শিক্ষিত বাঙালিরা এই পেশায় এগিয়ে আসেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

  • ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা – সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার সূত্রে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোদন তর্কালঙ্কার – এর মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং তাঁরা একত্রে সাহিত্য-সাধনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁরা নিজেদের লেখা ছাপানো ও ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে সংস্কৃত যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন 1847 খ্রিস্টাব্দে। বর্ণপরিচয় গ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ এই ছাপাখানা থেকে 1855 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
  • বই ব্যাবসা – কলেজ স্ট্রিটে থাকার সুবাদে সেখানকার বই বাজার সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের বাস্তব ধারণা ও জ্ঞান হয়েছিল। ছাপাখানার ব্যাবসা লাভজনক হওয়ায় তাঁর আয় বেড়ে যায়। তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং বই ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করেন। সেসময় বই ছাপানোর পর তা মজুত রাখাও একটা প্রধান সমস্যা ছিল। বিদ্যাসাগর এজন্য সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটারি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ভাড়ার বদলে অন্যান্য লেখক ও প্রকাশকদের বই জমা রাখার ব্যবস্থাও করেন।
মুদ্রণের ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আলোচনা করো। এই বিষয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবদান কী ছিল?

মুদ্রণের ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ক্ষেত্রে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবদান –

ইউ রায় অ্যান্ড সন্স -এর প্রতিষ্ঠা –

বাংলা তথা সমগ্র ভারতে প্রকাশনার জগতের একটি অবিস্মরণীয় নাম হল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। মুদ্রাকর হিসেবে উপেন্দ্রকিশোরের সাফল্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। 1890 -এর দশকের প্রথমদিকে বাংলায় উন্নত ছাপাখানা থাকা সত্ত্বেও ভালোমানের মুদ্রণ-অলংকরণের অভাব উপেন্দ্রকিশোরকে অন্য ধরনের ছাপাখানা তৈরির জন্য প্রেরণা জুগিয়েছিল। বাংলায় হাফটোন এবং রঙিন ব্লক -এর সূচনা তিনিই করেছিলেন। কাঠের ব্লক ব্যবহার করে তিনি ‘ছেলেদের রামায়ণ’ প্রকাশ করেন। 1895 খ্রিস্টাব্দে তাঁর নিজস্ব মুদ্রণ ও প্রকাশনা সংস্থা ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানি থেকেই ভারতবর্ষে প্রসেস শিল্প বিকাশের সূত্রপাত হয়।

মুদ্রণের ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আলোচনা করো। এই বিষয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবদান কী ছিল?

বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা –

মুদ্রাকর হিসেবে উপেন্দ্রকিশোরের খ্যাতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। ইউ রায় অ্যান্ড সন্স সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উৎকৃষ্ট একটি ছাপাখানায় পরিণত হয়েছিল। ছাপার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য ব্রিটেন থেকে বই ও নানা উপকরণ আনিয়ে তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তিনি ব্লক তৈরির একটি ব্যাবসা শুরু করেন। প্রসেস শিল্পে তাঁর ব্যবহৃত পদ্ধতি ও পরীক্ষানিরীক্ষার বিষয়গুলি ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত ‘পেনরোজ অ্যানুয়াল ভলিউম’ -এ ছাপা হয়। 1896 খ্রিস্টাব্দে অমৃতবাজার পত্রিকায় ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ -এর বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। প্রসেস শিল্পে উপেন্দ্রকিশোরই প্রথম ও শেষ ভারতীয় যিনি মৌলিক অবদান রেখে গিয়েছেন।

সুকুমার রায়ের প্রচেষ্টা –

1911 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ যখন উপেন্দ্রকিশোরের ছাপাখানা বেড়ে উঠছিল তখন তাঁর পুত্র সুকুমার রায় ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ স্কলারশিপ’ নিয়ে লন্ডনে যান। সুকুমার রায় লন্ডনে পিতার উদ্ভাবিত হাফটোন পদ্ধতি প্রদর্শন করেন ও তার কার্যকারিতা প্রমাণ করেন। 1913 খ্রিস্টাব্দে উপেন্দ্রকিশোরের নিজস্ব নকশায় 100 নম্বর গড়পার রোডে তাঁর ছাপাখানা নতুন করে নির্মিত হয়। প্রাথমিকভাবে যদিও হাফটোন পদ্ধতির ছাপাখানা হিসেবে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স শুরু হয়েছিল, কিন্তু শীঘ্রই তা একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা হয়ে ওঠে। এখান থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের লেখা ‘টুনটুনির বই’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। সবশেষে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সন্দেশ পত্রিকা, যা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কৌতুকরসে তরুণ চিত্তে এক নতুন জগৎ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।

মুদ্রণের ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আলোচনা করো। এই বিষয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবদান কী ছিল?

মুদ্রণের ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন –

ছাপাখানার ব্যবসায়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কেবল পার্থিব মুনাফার জন্য যোগ দেননি। ব্যাবসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা নিজেদের লেখা গ্রন্থও ছাপাতেন। ছাপার গুণমান বৃদ্ধির জন্য উপেন্দ্রকিশোর পরীক্ষানিরীক্ষাও করেছিলেন। এভাবে ছাপাখানার ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ক্ষেত্রে এই দুই মহান বাঙালি ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট অবদান রাখেন।

ফোটোগ্রাফির সাহায্য নিয়ে বহুসংখ্যক প্রতিচ্ছবি ছাপার কাজকে কী বলা হয়?

ফোটোগ্রাফির সাহায্য নিয়ে বহুসংখ্যক প্রতিচ্ছবি ছাপার কাজকে প্রসেস ওয়ার্ক বা প্রসেস শিল্প বলা হয়।

ফোটোগ্রাফকে বইতে ছাপার উপযুক্ত ব্লক তৈরি করার প্রযুক্তিটির নাম কী?

ফোটোগ্রাফকে বইতে ছাপার উপযুক্ত ব্লক তৈরি করার প্রযুক্তি হল হাফটোন।

বাংলায় বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনারিদের অবদান সংক্ষেপে লেখো। এই বিষয়ে মহেন্দ্রলাল সরকার কী ভূমিকা গ্রহণ করেন?

বাংলায় বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনারিদের অবদান ভূমিকা –

বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে যাঁকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় তিনি হলেন রাজা রামমোহন রায়। 1823 খ্রিস্টাব্দে লর্ড আমহার্স্টকে লিখিত ঐতিহাসিক চিঠিতে তিনি বলেছিলেন শিক্ষাপ্রসারের মূল উদ্দেশ্য যদি দেশীয় ব্যক্তিদের সার্বিক উন্নতি হয় তাহলে পাশ্চাত্যের গণিত, প্রাকৃতিক দর্শন, রসায়ন শাস্ত্র, শারীরবিদ্যা প্রভৃতি প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানমূলক বিষয়চর্চার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

শ্রীরামপুর মিশনারি উইলিয়ম কেরির অবদান –

বাংলায় বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানমূলক বই ছাপানোর প্রথম কৃতিত্ব দাবি করতে পারে শ্রীরামপুর মিশন। এ বিষয়ে উইলিয়ম কেরির কথা সর্বাগ্রে বলতে হয়। ভারতবর্ষে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। বোটানিক্যাল গার্ডেনের অধ্যক্ষ উইলিয়ম রক্সবার্গ (William Roxburg) -এর সঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে মতবিনিময় করতেন। 1820 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও কেরি বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁর পুত্র ফেলিক্স কেরি প্রথম মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিষয়ে বাংলা গ্রন্থ রচনা করেন। মিশনারিদের দ্বারা প্রকাশিত সমাচার দর্পণের বিভিন্ন প্রবন্ধের মধ্য দিয়েও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বোটানিক্যাল গার্ডেন -এর অধ্যক্ষ রক্সবার্গ বাংলায় 3500টি গাছের একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন, যার সম্পাদনা করেছিলেন কেরি এবং এর নাম দেন হার্টস বেঙ্গলেনসিস। কেরি ফ্লোরা ইন্ডিকা নামক গ্রন্থেরও সম্পাদনা করেছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর সহকারী ছিলেন রক্সবার্গের পরবর্তী বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিদর্শক ওয়াকিল। 1812 খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক রিসার্চেস-এ তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘দ্য স্টেট অফ এগ্রিকালচার ইন দ্য ডিস্ট্রিক্ট অফ দিনাজপুর’ প্রকাশিত হয়। এতে তিনি কৃষির উন্নতির বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

বাংলায় বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনারিদের অবদান সংক্ষেপে লেখো। এই বিষয়ে মহেন্দ্রলাল সরকার কী ভূমিকা গ্রহণ করেন?

শ্রীরামপুর কলেজ –

1818 খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান পড়ানো হত। জন ম্যাক ছিলেন এই কলেজের রসায়নের অধ্যাপক। উদ্ভিদ ও প্রাণীবিজ্ঞানেও তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ছিল।

জন ম্যাকের অবদান –

শ্রীরামপুর মিশনে বিজ্ঞানচর্চার অগ্রগতির মূলে যিনি ছিলেন তিনি হলেন জন ম্যাক। মিশনে বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষাদানের সঙ্গে সঙ্গে তিনি শ্রীরামপুরে একটি গবেষণাগারও গড়ে তোলেন। এটিই ভারতের প্রথম উন্নতমানের গবেষণাগার। তিনি তাঁর নিজস্ব যন্ত্রপাতির সাহায্যে ছাত্রদের পড়াতেন। তাঁর এই প্রচেষ্টা ছিল নিঃসন্দেহে অভিনব। ফলে বহু দূর দূর থেকে ছাত্ররা তাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য আসত। রসায়ন বিষয়ক একটি গ্রন্থ তিনি বাংলা ভাষায় রচনা করেন। এটির নাম ‘রসায়নবিদ্যার সূত্রাবলি’ (Principles of Chemistry)।

বাংলায় বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনারিদের অবদান সংক্ষেপে লেখো। এই বিষয়ে মহেন্দ্রলাল সরকার কী ভূমিকা গ্রহণ করেন?

মহেন্দ্রলাল সরকারের ভূমিকা –

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠা –

বাংলা তথা ভারতের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স’ (IACS) বা ‘ভারতীয় বিজ্ঞানসভা’ (1876 খ্রিস্টাব্দ)। সমগ্র ভারতে এটিই প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আলোচনার অন্যতম প্রতিষ্ঠান। 1863 খ্রিস্টাব্দে তিনি মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় এমডি হিসেবে পরিগণিত হন। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে তাঁর খ্যাতি থাকলেও ধীরে ধীরে হোমিওপ্যাথির সপক্ষে বহু জায়গায় বক্তব্য রাখলে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকদের দ্বারা তিনি সমাজচ্যুত হন। এরপরই তিনি একটি জাতীয় বিজ্ঞান সমিতি গড়ে তোলার কথা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। 1869 খ্রিস্টাব্দে তাঁর সম্পাদিত ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিন (Calcutta Journal of Medicine) নামক মাসিক পত্রিকায় এরূপ একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।

বাংলায় বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনারিদের অবদান সংক্ষেপে লেখো। এই বিষয়ে মহেন্দ্রলাল সরকার কী ভূমিকা গ্রহণ করেন?

মহেন্দ্রলাল সরকারের উদ্দেশ্য –

মহেন্দ্রলালের আশা ছিল IACS একদিন ইংল্যান্ডের রয়‍্যাল ইনস্টিটিউটের মতো বিজ্ঞান গবেষণার একটি উন্নতমানের গবেষণাকেন্দ্রে পরিণত হবে। IACS -এর উদ্দেশ্য ছিল – বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলা, বিজ্ঞানের গবেষণার মান উন্নত করা এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। বৈজ্ঞানিক গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের দিয়ে বিজ্ঞান বিষয়ক জনপ্রিয় বক্তৃতার আয়োজনও তিনি করেছিলেন। ছাত্রমহলে এই জাতীয় বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতাগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

বাংলায় বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনারিদের অবদান সংক্ষেপে লেখো। এই বিষয়ে মহেন্দ্রলাল সরকার কী ভূমিকা গ্রহণ করেন?

বিরোধ ও সহযোগিতা –

ইন্ডিয়ান লিগের রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, মোতিলাল ঘোষ প্রমুখ সদস্যরা বৈষয়িক উন্নতির কাজে ব্যাবহারিক বিজ্ঞানের প্রসারের পরিবর্তে সাধারণ বিজ্ঞানের প্রসারের এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেননি। এই অবস্থায় 1876 খ্রিস্টাব্দে এক সভায় বাগ্মী কেশবচন্দ্র সেন ও পাদরি ইউজিন লাফোঁ-কে মহেন্দ্রলালের পক্ষে সুচিন্তিত ভাষণ দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার তাঁর প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হন এবং অর্থসাহায্যেরও প্রতিশ্রুতি দেন। সরকার 210, বউবাজার স্ট্রিটের একটি বাড়ি 5000 টাকা জামিনের পরিবর্তে ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-কে দেওয়ার কথা বলে। মহেন্দ্রলালের সংকল্প ছিল তাঁর প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ভার দেশবাসী বহন করবে। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে জয়কৃয় মুখার্জি, কমলকৃয় দেব, দিগম্বর মিত্র, যোগেশ্বর সিং, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ সকলে মিলে 1 লক্ষ 40 হাজার টাকা তুলে দেন।

শিক্ষকমণ্ডলী –

এই প্রতিষ্ঠানে পদার্থবিদ্যা পড়াতেন জগদীশচন্দ্র বসু, আলোকবিজ্ঞান পড়াতেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং রসায়নে ছিলেন কানাইলাল দে। 1894 খ্রিস্টাব্দের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রসংখ্যা তিনশোর উপর পৌঁছেছিল। জনগণ ও ছাত্ররা সামান্য প্রবেশমূল্য দিয়ে বক্তৃতাগুলিতে উপস্থিত থাকতে পারত। মহেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর সি ভি রমন, মেঘনাদ সাহা, কে এস কৃষ্ণান প্রমুখ যোগদান করেন। নিঃসন্দেহে মহেন্দ্রলাল সরকারকে ‘জাতীয় বিজ্ঞানচর্চার জনক’ বলা যায়।

বাংলায় বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনারিদের মূল্যায়ন –

এইভাবে পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটে। এই বিজ্ঞানসাধনার লক্ষ্য ছিল জনকল্যাণ তথা সমাজকল্যাণ। সীমিত উদ্যোগ, বিভিন্ন অসুবিধার মধ্যেও ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার যে মহান কাজ শুরু করেছিলেন সেইজন্য তাঁর কাছে দেশবাসী চিরকৃতজ্ঞ।

ম্যাগনাকার্টা কী?

এ জন্য তিনি ‘প্রসপেকটাস’ বা ‘অনুষ্ঠানপত্র’-ও প্রকাশ করেছিলেন। এটি 1870 -এর দশকে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এ প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞানসভা’ প্রবন্ধে তা খানিকটা বর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। এই অনুষ্ঠানপত্রে বিজ্ঞানসভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য জানা যায়। যোগেশচন্দ্র বাগল এই অনুষ্ঠানপত্রটিকে আধুনিক যুগে ভারতীয় বিজ্ঞানসাধনার ‘ম্যাগনাকার্টা’ বলেছেন।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (Indian Association for the Cultivation of Science, IACS, 1876) -এর অবদান লেখো।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (Indian Association for the Cultivation of Science, IACS, 1876) -এর ভূমিকা –

ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় 1876 খ্রিস্টাব্দের 29 জুলাই গড়ে ওঠে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (IACS) বা ভারতীয় বিজ্ঞানসভা। সমগ্র ভারতে এটিই ছিল প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আলোচনামূলক প্রতিষ্ঠান।

মহেন্দ্রলাল সরকারের ভূমিকা –

1863 খ্রিস্টাব্দে মহেন্দ্রলাল সরকার মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় এমডি হিসেবে পরিগণিত হন। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে তাঁর খ্যাতি যথেষ্ট হলেও ক্রমশ তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি হোমিওপ্যাথির সপক্ষে বহু জায়গায় বক্তব্য রাখলে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকরা তাঁকে সমাজচ্যুত করার ব্যাপারে সচেষ্ট হন। এরপর থেকে তিনি একটি জাতীয় বিজ্ঞান সমিতি গড়ে তোলার কথা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন, যেটি ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে। 1869 খ্রিস্টাব্দে তাঁর সম্পাদিত ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিন (Calcutta Journal of Medicine) নামক মাসিক পত্রিকায় এরূপ একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ‘প্রসপেকটাস’ বা ‘অনুষ্ঠানপত্র’ প্রকাশনা করেন, যেটি 1870 খ্রিস্টাব্দের 3 জানুয়ারি হিন্দু প্যাট্রিয়ট-এ প্রকাশিত হয়।

জনপ্রিয়তা ও বিস্তৃতি –

IACS -এর উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং বিজ্ঞানের গবেষণার মানোন্নয়নের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে চলা। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার আশা করেছিলেন যে, এই প্রতিষ্ঠান ইংল্যান্ডের রয়‍্যাল ইনস্টিটিউটের সমমর্যাদাসম্পন্ন হয়ে উঠবে। তাই বৈজ্ঞানিক গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের দিয়ে বিজ্ঞান বিষয়ক জনপ্রিয় বক্তৃতার আয়োজন করেন তিনি। ছাত্রমহলে এই জাতীয় বক্তৃতা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। মহেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর এই প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপ আরও প্রসার লাভ করে। বিংশ শতকের ত্রিশের দশকে সি ভি রমন, মেঘনাদ সাহা ও কে এস কৃষ্ণান -এর সৌজন্যে এর খ্যাতি রয়‍্যাল ইনস্টিটিউটের থেকে কোনো অংশে কম ছিল না। এই বিজ্ঞানীদের মধ্যে স্যার সি ভি রমন বিজ্ঞানে প্রথম ভারতীয় হিসেবে পদার্থবিদ্যায় ‘নোবেল’ পুরস্কার (1930 খ্রিস্টাব্দ) পান।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (Indian Association for the Cultivation of Science, IACS, 1876) -এর অবদান লেখো।

IACS ও পরবর্তী প্রজন্ম –

বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপরেও জোর দেওয়া হয়েছিল। বাংলায় রাজেন্দ্রলাল মিত্র-কে ‘জাতীয় প্রযুক্তিবিদ্যার পথিকৃৎ’ -এর মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। তিনি চেয়েছিলেন, এই সময়কার ছাত্রদের মধ্যে প্রযুক্তিগত শিক্ষার অগ্রগতি ও বিকাশ ঘটাতে। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার যখন তাঁর বিজ্ঞানসভা গড়ে তোলার ব্যাপারে বিশেষ সক্রিয় হয়েছিলেন, সেই সময় ইন্ডিয়ান লিগের সদস্যরা চেয়েছিলেন একটি কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে। এই নিয়ে সিনেট হলে ঐতিহাসিক বিতর্ক শুরু হয়। রাজেন্দ্রলাল মিত্র এবং ফাদার লাফোঁ বিজ্ঞানসভা প্রতিষ্ঠার পক্ষেই রায় দেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, বিজ্ঞানচর্চা ব্যতীত প্রযুক্তিবিদ্যার সেই অর্থে অগ্রগতি সম্ভবপর হয় না। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে যে, হিন্দুমেলাও প্রযুক্তিবিদ্যায় উন্নতির ব্যাপারে বিশেষ সক্রিয় হয়েছিল। এরপর সতীশচন্দ্র মুখার্জি ‘ডন সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘ডন পত্রিকা’ (1902 খ্রিস্টাব্দ) প্রকাশ করেন। তিনি এই পত্রিকায় প্রযুক্তিগত দিক থেকে অগ্রগতির উপরে জোর দেন।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (Indian Association for the Cultivation of Science, IACS, 1876) -এর মূল্যায়ন –

এইভাবে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স গঠনের মাধ্যমে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ঔপনিবেশিক ভারতে বিজ্ঞানচর্চার যে পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিলেন, তা পরবর্তীকালে উন্নত থেকে উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিজ্ঞানসাধনায় তাঁর এই বিপুল অবদানের জন্য ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার-কে ‘জাতীয় বিজ্ঞানচর্চার জনক’ বলে অভিহিত করা হয়।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের ভূমিকা আলোচনা করো।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের ভূমিকা –

বাংলাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সূত্রে বিজ্ঞান শিক্ষার সূচনা হয়। হিন্দু কলেজ (1817 খ্রিস্টাব্দ) ও শ্রীরামপুর কলেজে (1818 খ্রিস্টাব্দ) বিজ্ঞান পড়ানোর ব্যবস্থা হয়। তবে তা ছিল সীমিত অর্থে। এর প্রায় শতবর্ষ পরে বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার জন্য পৃথক একটি কলেজ গড়ে ওঠে, যা কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ নামে পরিচিত হয়।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠা –

1857 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলেও 1914 খ্রিস্টাব্দের আগে সেখানে বিজ্ঞান কলেজ খোলা হয়নি। 1914 খ্রিস্টাব্দের 27 মার্চ ব্রিটিশ সরকারের কোনোরকম সাহায্য ছাড়াই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ (University College of Science and Technology) গড়ে ওঠে। এই বিজ্ঞান কলেজ গড়ে উঠেছিল ব্যারিস্টার স্যার তারকনাথ পালিত ও ব্যারিস্টার স্যার রাসবিহারী ঘোষের আর্থিক সহায়তায়। 92 নম্বর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠান ‘রাসবিহারী শিক্ষাপ্রাঙ্গণ’ নামে পরিচিত হয়। কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, শিশির কুমার মিত্র, বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বিজ্ঞান কলেজকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের ভূমিকা আলোচনা করো।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের পঠনপাঠন –

বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে পদার্থবিদ্যা ও ভৌত রসায়ন বিভাগে কার্যত কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নিজের কলেজের যন্ত্রপাতি কলকাতা বিজ্ঞান কলেজকে দান করেন। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক ক্রুলও কিছু যন্ত্রপাতি ধার দিয়েছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে একটি ‘কনডাক্টিভিটি’ যন্ত্র ধার নেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর 1915 খ্রিস্টাব্দে প্রথম রসায়ন বিভাগ শুরু হলেও বিশুদ্ধ পদার্থবিদ্যা বিভাগের সূচনা হয় 1916 খ্রিস্টাব্দে। 1916 খ্রিস্টাব্দে ফলিত গণিত বিভাগ শুরু হওয়ার পরে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু এখানে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। 1918 এবং 1919 খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাণীবিদ্যা বিভাগ শুরু হয়।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের অগ্রগতি –

রাসবিহারী ঘোষ এবং তারকনাথ পালিত ছাড়াও রানি বাগেশ্বরী এবং গুরুপ্রসাদ সিং এই সংস্থার জন্য প্রভূত অর্থ দান করেছিলেন। এই অর্থ দিয়েই ফলিত গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও উদ্ভিদবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অধ্যাপক পদের সৃষ্টি করা হয়। এ ছাড়া মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। এইভাবে বিজ্ঞান কলেজ মেধাবী বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্রদের বিজ্ঞান গবেষণার এক সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যেসব বিজ্ঞানীদের একত্রিত করেছিলেন তাঁরা বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়টিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার আন্তর্জাতিক খ্যাতিও লাভ করেছিলেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের তৎপরতায় জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি, মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিজ্ঞান কলেজে যোগ দেন। রসায়ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অধীনেই পি সি মিত্র, পি রায়, জে সি ঘোষ প্রমুখ বৈজ্ঞানিক রসায়ন বিভাগের গবেষণার অগ্রগতি ঘটিয়েছিলেন।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের ভূমিকা আলোচনা করো।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের অবদান –

পরাধীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার পরিকাঠামো তৈরিতে ব্রিটিশ সরকার সহযোগিতা না করলেও বঙ্গভঙ্গ ও তার পরবর্তী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে দিকপাল বিজ্ঞানীরা এই কলেজ অলংকৃত করেছিলেন। পদার্থবিদ্যার অন্যতম পথিকৃৎ মেঘনাদ সাহার শ্রেষ্ঠ কীর্তি সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (Saha Institute of Neuclear Physics) ভারতের বিজ্ঞানচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। এইভাবে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ বাংলা তথা সমগ্র ভারতে বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে এক অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের ভূমিকা –

বাংলায় ইংরেজ শাসন ও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। পাশ্চাত্য শিক্ষার সূত্র ধরে এদেশে পেশাগত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কারিগরি শিক্ষার সূচনা হয়। বাংলা তথা ভারতের কারিগরি শিক্ষার বিকাশে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট -এর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের পূর্বকথা –

বাংলায় আধুনিক কারিগরি শিক্ষার বিকাশ ঘটে ব্রিটিশ আমলে। এর আগে ভারতে কারিগরি শিক্ষা ছিল মূলত বংশানুক্রমিক। ভারতে ব্রিটিশদের আগমনের পর প্রয়োজনের তাগিদে কয়েকটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। 1856 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। পরবর্তীকালে 1880 খ্রিস্টাব্দে কলেজটি হাওড়ার শিবপুরে স্থানান্তরিত হয়। এ ছাড়া পুণা ও মাদ্রাজেও কয়েকটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ –

বিংশ শতকে বাংলায় আধুনিক কারিগরি শিক্ষার বিকাশে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন পর্বে 1905 খ্রিস্টাব্দের 16 নভেম্বর পার্ক স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্বদেশি শিক্ষার প্রসারের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। 1906 খ্রিস্টাব্দের 11 মার্চ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে 92 জন সদস্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, রাজা সুবোধ মল্লিক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ।

প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল –

  • স্বদেশি ধাঁচে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা,
  • বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো ইত্যাদি।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান –

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে দুটি প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। যথা –

  • বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল – 1906 খ্রিস্টাব্দের 14 আগস্ট কলকাতার বৌবাজারে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। অরবিন্দ ঘোষ এর প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এখানে কলা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হত। এর উদ্যোগে অনেক জায়গায় স্কুল খোলা হয়।
  • বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (BTI) – 1906 খ্রিস্টাব্দের 25 জুলাই আপার সার্কুলার রোডে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট বা BTI প্রতিষ্ঠিত হয়।

BTI -এর পাঠ্যক্রম – BTI -এর প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন প্রমথনাথ বসু। এতে প্রথমদিকে দু-ধরনের পাঠ্যক্রম চালু করা হয়। একটি তিন বছরের অপরটি চার বছরের পাঠ্যক্রম।

এখানে যেসকল বিষয়ে পাঠ দেওয়া হত তা হল –

  1. যন্ত্রবিজ্ঞান ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রবিজ্ঞান,
  2. ফলিত রসায়ন ও
  3. ভূবিদ্যা।

তবে পাঠ্যক্রমের প্রথমপর্বে পদার্থবিদ্যা, গণিত, ইংরেজি ও চিত্রাঙ্কন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত।

BTI -এর অগ্রগতি – এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন প্রমথ দত্ত, শরৎ বসু, প্রফুল্ল মিত্র, ভূপাল ঘোষ প্রমুখ প্রখ্যাত শিক্ষকগণ। এই প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তারকনাথ পালিত মহাশয়ের। জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রযুক্তিবিদ্যাকে সময়োপযোগী ও আধুনিক করে তোলার জন্য উপযুক্ত পাঠ্যক্রম নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। এই উদ্দেশ্যেই BTI -এর কয়েকজন প্রতিভাবান ছাত্র বিদেশে গিয়ে হাভার্ড, ইয়েল, মিচিগান ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানটি ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এখান থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়।

ছাত্রসংখ্যাবৃদ্ধি – 1908 খ্রিস্টাব্দে BTI -এর ছাত্রসংখ্যা ছিল 124 জন, 1921 খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে হয়েছিল 520 জন।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় – 1924 খ্রিস্টাব্দে যাদবপুরে 100 বিঘা জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তরিত হয়। পরে এটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে বিখ্যাত হয়।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের উপসংহার –

বাংলায় কারিগরি শিক্ষা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ, বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (BTI) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে পথ চলা শুরু করে। বাংলা তথা ভারতের প্রযুক্তিবিদ্যার ইতিহাসে এদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। যদিও সমকালে অনেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে মিস্তিরি তৈরির কারখানা বলে উপহাস করেছেন।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) বা BTI -এর ভূমিকা কী ছিল, তা বিশ্লেষণ করো।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) বা BTI -এর ভূমিকা –

বাংলাদেশে ইংরেজ শাসন ও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাব ছিল সুদুরপ্রসারী। পাশ্চাত্য শিক্ষার সূত্র ধরে এদেশে পেশাগত শিক্ষার জন্য কারিগরি শিক্ষার প্রবর্তন হয়। কিছু সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে। বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে কারিগরি শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা হয়। এক্ষেত্রে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) বা BTI -এর প্রতিষ্ঠা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠা –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময়ে গঠনমূলক স্বদেশি বা আত্মশক্তি পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। এই সময় ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে এক জাতীয়তাবাদী শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়। এই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে 1906 খ্রিস্টাব্দের 1 জুন জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।

BTI -এর প্রতিষ্ঠা –

রাসবিহারী ঘোষ জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সভাপতি এবং আশুতোষ চৌধুরী ও হীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর যুগ্ম সহসভাপতি হন। শুরুতে এই পরিষদ দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠন করে –

  1. সাধারণ বিজ্ঞান এবং কলাবিদ্যার জন্য বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ (Bengal National College) এবং
  2. কারিগরি শিক্ষার জন্য বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute)।

পরিষদের অন্যতম শিক্ষক বিনয়কুমার সরকার এটিকে পুরোদস্তুর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চালানোর পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি নিম্নতম প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে স্নাতকোত্তর অবধি সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষাপ্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, যদিও তা অনুমোদিত হয়নি। এইভাবে সোসাইটি ফর দ্য প্রোমোশন অফ টেকনিক্যাল এডুকেশন (Society for the Promotion of Technical Education বা SPTE) -এর উদ্যোগে 1906 খ্রিস্টাব্দের 25 জুলাই 92, আপার সার্কুলার রোডে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (BTI) প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) বা BTI -এর ভূমিকা কী ছিল, তা বিশ্লেষণ করো।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) বা BTI -এর পাঠক্রম –

BTI -এর প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন প্রমথনাথ বসু। প্রথমদিকে এখানে দু-ধরনের পাঠক্রম চালু হয় –

  1. তিন বছরের অন্তর্বর্তী পাঠক্রম এবং
  2. চার বছরের মাধ্যমিক পাঠক্রম।

অন্তর্বর্তী পাঠক্রমের তিনটি বিষয় ছিল –

  1. যন্ত্রবিজ্ঞান ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রবিজ্ঞান,
  2. ফলিত রসায়ন এবং
  3. ভূবিদ্যা।

এই পাঠক্রমের প্রথম বর্ষে পদার্থবিদ্যা, গণিত, ইংরেজি ও চিত্রাঙ্কন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) বা BTI -এর শিক্ষকমণ্ডলী –

এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রমথ দত্ত, শরৎ বসু, প্রফুল্ল মিত্র, ভূপাল সেন, যোগেশ ঘোষ প্রমুখ বেশ কিছু নামি শিক্ষক। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বেশি অনুদান প্রদান করেন তারকনাথ পালিত। তবে এই প্রতিষ্ঠানের কোনো ছাত্রাবাস ছিল না। 1910 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ক্রমশ ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় 1918 খ্রিস্টাব্দে একটি নতুন কার্যনির্বাহক সমিতি গঠন করা হয়। 1919 খ্রিস্টাব্দে রাওলাট সত্যাগ্রহ এবং 1920 খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনের ফলে জাতীয়তাবাদী কর্মসূচির পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে এই প্রতিষ্ঠানের প্রসারের প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। 1921 খ্রিস্টাব্দে শিল্পবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার পরিধি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) বা BTI -এর অগ্রগতি –

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে সময়োপযোগী করে তোলার জন্য এ বিষয়ে সর্বাধুনিক পাঠ্যক্রম গঠনের উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণ ও প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিয়েছিল। এই একই উদ্দেশ্যে কয়েকজন প্রতিভাবান ছাত্রকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এই সমস্ত ছাত্ররা হার্ভার্ড, ইয়েল এবং মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিল। বঙ্গীয় বিজ্ঞান কলেজ অর্থনৈতিক অভাব ও নানা কারণে বিলুপ্তির পথে চলে গেলেও ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট’ দীর্ঘজীবী হয়। কেন-না যে প্রযুক্তি ও শিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা তৈরি হয়েছিল তা পূরণ করতে পেরেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) বা BTI -এর পত্রিকা প্রকাশ –

এই কলেজ ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল এবং কেমিক্যাল এই তিনটি বিভাগে পঠনপাঠনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছিল। এই সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য তারা একটি পত্রিকাও প্রকাশ করে, যার নাম জার্নাল অফ দ্য কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (Journal of the College of Engineering and Technology)। এই পত্রিকা ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই প্রকাশিত হয়।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) বা BTI -এর প্রসার –

BTI -এর ছাত্রসংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলে। 1908 খ্রিস্টাব্দে যেখানে সংখ্যা ছিল 124 জন, সেখানে 1921 খ্রিস্টাব্দে সংখ্যা দাঁড়ায় 520 জন। এজন্য কলকাতার পুরসভার কাছ থেকে 99 বছরের লিজে যাদবপুরে 100 বিঘা জমি নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি সেখানে স্থানান্তরিত করা হয় 1924 খ্রিস্টাব্দে। 1925 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠান থেকে গড়ে প্রায় 100 জন সুযোগ্য ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হয়, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কারিগরি শিক্ষার বিকাশে নিয়োজিত হয়। 1928 খ্রিস্টাব্দে BTI -এর নতুন নাম হয় ‘কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ (College of Engineering and Technology)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে 1955 খ্রিস্টাব্দে এটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) বা BTI -এর মূল্যায়ন –

এইভাবে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা ও বিজ্ঞান চেতনার প্রসার ঘটে। এক্ষেত্রে উদ্যোগগুলি ছিল সম্পূর্ণরূপে দেশীয়।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ সম্পর্কে আলোচনা করো।

জাতীয় শিক্ষার ভূমিকা –

ব্রিটিশ আমলে বিদেশি শিক্ষানীতির দোষত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অনেকেই অবগত ছিলেন। তাই দেশের পণ্ডিতমহল বিদেশি শিক্ষানীতির বিকল্পরূপে দেশীয় প্রগতিশীল শিক্ষানীতি গড়ে তোলার জন্য উনিশ শতক থেকেই সচেষ্ট ছিলেন। তাদের প্রচেষ্টার ফলে 1906 খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি ধাঁচে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। ‘জাতীয় শিক্ষা’ কথাটি সম্ভবত প্রথম ব্যবহার করেছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর।

জাতীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা –

1906 খ্রিস্টাব্দের 11 মার্চ জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় 92 জন সদস্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গড়ে ওঠে। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন – আশুতোষ চৌধুরী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র মল্লিক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ গুণীজন।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্য হল –

  • স্বদেশি ধাঁচে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা।
  • বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা।
  • বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
  • শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশাত্মবোধক মনোভাব জাগিয়ে তোলা।
  • স্বদেশিমন্ত্রে দীক্ষিত ছাত্রদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ সম্পর্কে আলোচনা করো।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার পটভূমি –

জাতীয় শিক্ষানীতির আদর্শ প্রচার করার জন্য সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তাঁর ‘ডন’ পত্রিকা’-য় জাতীয় শিক্ষানীতির সমর্থনে লেখা প্রকাশ করতেন। উনিশ শতকে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন কোনো সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করেনি। 1905 খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি-বয়কট আন্দোলন জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করেছিল।

  • ছাত্রবিরোধী সার্কুলার ও ছাত্র বহিষ্কার – স্বদেশিমন্ত্রে দীক্ষিত অনেক ছাত্র বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। অনেকে আবার বিদেশি শিক্ষা বর্জন করেছিল। ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনে যোগদানকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কার্লাইল সার্কুলার, লিয়ন সার্কুলার-সহ বিভিন্ন সার্কুলার জারি করে। এতে বলা হয়েছিল ছাত্ররা আন্দোলনে যোগ দিলে স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হবে। ফলস্বরূপ অনেক ছাত্র স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল।
  • জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণে অনুষ্ঠিত সভা – স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত ছাত্রদের দমননীতির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। 1905 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ব্রিটিশ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে একটি সভা আহূত হয়। এই সভায় সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বরা জাতীয় শিক্ষার সপক্ষে বক্তব্য রাখেন।
  • অর্থসাহায্য – জাতীয় শিক্ষার জন্য অনেক ধনী ব্যক্তি অকাতরে অর্থদান করেন। গৌরীপুরের জমিদার ব্রজকিশোর রায়চৌধুরী 5 লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ময়মনসিংহের জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য \(2\frac12\) লক্ষ টাকা ও সুবোধচন্দ্র মল্লিক 1 লক্ষ টাকা দান করেছিলেন।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠন –

পণ্ডিত, জমিদার ও জাতীয়তাবাদী প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আন্তরিক সাহায্য ও সহযোগিতায় 1906 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের পরিচালনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ সম্পর্কে আলোচনা করো।

জাতীয় পরিষদের অধীনস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান –

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের অল্পকালের মধ্যেই কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে এই নিয়ে মতপার্থক্য শুরু হয়। ফলে দুটি প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

  • বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল – 1906 খ্রিস্টাব্দের 14 আগস্ট কলকাতার বৌবাজারে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ (Bengal National College) খোলা হয়। এখানে কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হত। অরবিন্দ ঘোষ এর প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় স্কুল খোলা হয়।
  • বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট – 1906 খ্রিস্টাব্দের 25 জুলাই তারকনাথ পালিত কারিগরি শিক্ষার প্রসারের জন্য বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলায় জাতীয় শিক্ষার বিস্তার –

কলকাতার পর ঢাকা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মালদহ প্রভৃতি স্থানে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। 1908 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় 25টি মাধ্যমিক ও 300টিরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।

বাংলার বাইরে জাতীয় শিক্ষার বিস্তার –

বাংলার বাইরে বোম্বাই, মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব, বেরার প্রভৃতি স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রভাবে 1909 খ্রিস্টাব্দে মসুলিপত্তনমে একটি জাতীয় কলেজ ও অন্ধ্রে একটি জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। 1910 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই জাতীয় শিক্ষার জনপ্রিয়তা বজায় ছিল।

জাতীয় শিক্ষার ব্যর্থতার কারণ –

বিভিন্ন কারণে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ব্যর্থ হয়েছিল।

  • জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও তার অধীনস্থ স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। ফলে জাতীয় শিক্ষার বিস্তার ভারতীয় নেতাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না।
  • সরকারের বিরোধিতার ফলে জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা ছাত্রদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
  • অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় শিক্ষাগ্রহণ অপেক্ষা ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাগ্রহণেই বেশি আগ্রহী ছিল।
  • তা ছাড়া এর পতনের অন্যতম কারণ ছিল সরকারের প্রবল বিরোধিতা ও আর্থিক অনটন।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের গুরুত্ব –

উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও জাতীয় শিক্ষা পরিষদের গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না।

  • জাতীয় শিক্ষা পরিষদ জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।
  • জাতীয় শিক্ষা পরিষদ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিল।
  • রাসবিহারী ঘোষ, তারকনাথ পালিত, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ ব্যক্তিরা শিক্ষাপ্রসারের মহান আদর্শ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, যা উচ্চ প্রশংসার দাবি রাখে।

জাতীয় শিক্ষার মূল্যায়ন –

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রশংসা করে অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেছেন যে, ‘সেদিন যতটা পাওয়া গেল তাই বা উপেক্ষা করি কোন্ যুক্তিতে?’ তাই পরাধীন ভারতে জাতীয় শিক্ষাপ্রসারের এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। তা ছাড়া বর্তমান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরি ছিল এই জাতীয় শিক্ষা পরিষদ।

মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শ বিশ্লেষণ করো।

মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার ভূমিকা –

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তায় প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষা বিষয়ে হাতেকলমে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তার প্রাথমিক ধারণা –

1893 খ্রিস্টাব্দে ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে শিক্ষাভাবনার সূচনা হয়, 1937 খ্রিস্টাব্দে ‘ছাত্রসম্ভাষণ’-এ তার পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রায় 44 বছর ধরে রবীন্দ্রনাথ 23টি প্রবন্ধ, আলোচনা, ভাষণ, অভিভাষণ ও সমালোচনায় শিক্ষার তাত্ত্বিকতা ও প্রয়োগগত সমস্যার কথা সুশৃঙ্খল যুক্তির দ্বারা আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতে, শিশু ও বালকের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হবে তাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি ও কল্পনার বিকাশের সুযোগ দান করা। তিনি প্রাচীন ভারতের আশ্রম ও গুরুকুল প্রথাকে আধুনিক জীবনে আনতে চেয়েছিলেন। তিনি মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং কাজেও তা করে দেখিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, বিজ্ঞান শুধু পরীক্ষাগারের চার দেয়ালের মধ্যে নেই, তার স্থান ক্লাসঘরের বাইরে, হাটে-মাঠে-মাটিতে। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, পল্লিচর্চা ও পল্লিসংগঠন ছাড়া ভারতীয় শিক্ষা অসম্পূর্ণ।

মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয়সাধন –

রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে শিক্ষাদানের উপর গুরুত্ব দিতেন। শিশুর জীবনের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির যোগ তার প্রাণ ও মনের বিকাশের পক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান। প্রকৃতির সংস্পর্শেই শিশুর দেহ-মন সুসংগঠিত হয়। তার পরম সত্তাকে সে নিবিড়ভাবে যাতে অনুধাবন করতে পারে সেজন্য শিশুর সুকোমল বৃত্তিগুলির সুষম বিকাশসাধনের উপর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিক্ষা সমস্যা’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, শিক্ষাপ্রাঙ্গণে অবশ্যই কিছুটা জমি থাকবে যেখানে ছাত্ররা চাষ করবে, গোপালন করবে এবং বাগানের পরিচর্যা করবে। এইভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের অপূর্ব মেলবন্ধনের কথা তিনি বলেছেন।

মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা –

রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবল সমালোচক ছিলেন। 1893 খ্রিস্টাব্দে ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা, পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও জ্ঞানকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করা হয়নি। তিনি সমাজের সমস্ত সমস্যার মূলে অশিক্ষা ও কুশিক্ষাকে দায়ী করেছেন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার কিছু কিছু সমালোচনার পূর্বাভাস দেখতে পাওয়া যায়। যেমন – পাঠ্যপুস্তকের অভাব, একমাত্র ইংরেজি ভাষার মধ্য দিয়েই পাশ্চাত্যের চিন্তাভাবনা ও আদর্শকে বোঝার চেষ্টা প্রভৃতি। তবে তথাকথিত ভদ্রলোকদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের ব্যবধানজনিত সমস্যার বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ বরাবরই উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করতেন যে, ঔপনিবেশিক কাঠামোয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি কার্যত জ্ঞানভিক্ষার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে যা জাতীয় সম্মানবোধকে ক্ষুণ্ণ করে। অনুকরণের বদলে বিভিন্ন ধারার সমন্বয়ের উপরেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষের চারিত্রিক বলিষ্ঠতা, মনের প্রসারতা ও বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। তাই তিনি ঔপনিবেশিক ও প্রথাগত শিক্ষার বিকল্পস্বরূপ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁর এই উপলব্ধি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা ও তার উদ্দেশ্য –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 1919 খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিশ্বভারতী পরিকল্পনা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, যত্র বিশ্বম ভবত্যেকনীড়ম অর্থাৎ যেখানে বিশ্ব একটি নীড়ে পরিণত হবে। এই আদর্শের ভিত্তিতে 1921 খ্রিস্টাব্দের 23 ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রকৃতির সঙ্গে থেকে প্রকৃত শিক্ষালাভে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন। এইজন্য তিনি শান্তিনিকেতনের প্রকৃতির মধ্যে তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতির কাছে থেকে আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশু ও কিশোরদের বড়ো হতে সাহায্য করা। তাই বিশ্বভারতীতে ছাত্রদের ক্লাস হত আকাশ ও গাছের তলায়। মানুষের সঙ্গে শিক্ষার সমন্বয়ের জন্য পল্লিগ্রামের সঙ্গেও শান্তিনিকেতনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। শান্তিনিকেতন লাগোয়ো কিছু গ্রামের মানুষের তৈরি প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রির ও সকলের মিলনের ক্ষেত্র হিসেবে ‘পৌষমেলা’-র আয়োজন করা হয়। এই মেলায় আশপাশের গ্রামের মানুষেরা তাদের ঘরোয়া সামগ্রী, যেমন – মাটির হাঁড়ি, বেতের তৈরি ধামা, কুলো, লোহার তৈরি কড়াই, হাতা প্রভৃতি বিক্রি করে। তা ছাড়া জমিতে উৎপন্ন ফসলও তারা বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। অর্থাৎ বিশ্বভারতীয় শিক্ষা ছিল মানবতাবোধের শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা- যে শিক্ষা আজকের সমাজের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মূল্যায়ন –

যে শিক্ষা মনুষ্যত্ববোধের জন্ম দেয়, সেই শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা – এটাই হল রবীন্দ্র শিক্ষাদর্শনের মূল কথা। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ভাবনা শুধু বাংলা বা ভারতে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এক দিকচিহ্ন হয়ে আছে। তিনি বিশ্বভারতীকে যথার্থই বিশ্বজাতির মহামিলনের ক্ষেত্রে পরিণত করতে পেরেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের কাছে শিক্ষার মূল নীতি কী ছিল?

রবীন্দ্রনাথের কাছে শিক্ষার মূল নীতি ছিল – ‘Education should be in full touch with our complete life-economical, intellectual, sesthetic, social and spiritual.

বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভবের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করো।

বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব বিলম্বিত হলেও তা আকস্মিক ছিল না, কারণ –

  • বিক্ষিপ্ত মুদ্রণ – 1778 খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রায় একশ বছর ধরে বিক্ষিপ্তভাবে বাংলা হরফযুক্ত মুদ্রণের কাজ হয়েছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আতানাসিউস কিরখেরের রচিত চায়না ইলাস্ট্রেটা (1667 খ্রিস্টাব্দ) ও হ্যালহেডের রচিত এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ (1778 খ্রিস্টাব্দ)।
  • প্রশাসনিক প্রয়োজন – 1773 খ্রিস্টাব্দে রেগুলেটিং আইনের মাধ্যমে বাংলায় প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজ শাসনের সূচনা হলে বাংলা ভাষায় আইন বা নির্দেশ দানের প্রয়োজন দেখা দেয়।
  • হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতা – বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলা ভাষায় মুদ্রণের ক্ষেত্রে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, হেস্টিংস নিজ দায়িত্বে সরকারি খরচে এই গ্রন্থটি মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।
  • উইলকিন্সের ভূমিকা – ইংরেজ প্রশাসক চার্লস উইলকিন্স ছিলেন একজন প্রাচ্যপণ্ডিত এবং তিনি ছিলেন বাংলার মুদ্রাক্ষর তৈরিতে অভিজ্ঞ। তিনি হেস্টিংসের অনুরোধে পঞ্চানন কর্মকারের সহযোগিতায় হ্যালহেডের ব্যাকরণ গ্রন্থের বাংলা মুদ্রাক্ষর তৈরি করে দেন।

বাংলায় ছাপাখানা বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় ব্যাখ্যা করো।

ছাপাখানার বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় ছিল 1778-1799 খ্রিস্টাব্দ। এই সময়পর্বে ছাপাখানার বিভিন্ন দিকগুলি হল –

  • হ্যালহেডের ব্যাকরণ – 1778 খ্রিস্টাব্দে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী, ইংরেজদের বাংলা শিক্ষার জন্য ইংরেজি ভাষায় A Grammar of the Bengal Language নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থের মোট পৃষ্ঠার চারভাগের একভাগ অংশে উদাহরণরূপে বাংলা হরফ ব্যবহার করা হয়। এইভাবে প্রথম বাংলা মুদ্রণ বা ছাপার কাজ শুরু হয়।
  • কোম্পানির প্রেস – হুগলির চার্লস উইলকিন্স ও জেমস অগাস্টাস হিকি পরিচালিত অ্যান্ড্রুজের ছাপাখানা ছিল বাংলার প্রথম ছাপাখানা। তবে এই ছাপাখানার সব যন্ত্রপাতি ক্রয় করে সরকারি উদ্যোগে উইলকিন্সের নেতৃত্বে কলকাতায় কোম্পানির প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় (1780 খ্রিস্টাব্দ)।
  • হিকির প্রেস – কোম্পানির প্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে এই প্রেস থেকে হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট নামক সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের প্রথম দশটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পরে অবশ্য হিকি নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
  • অন্যান্য প্রেস – কোম্পানির প্রেসের সমসাময়িক অপর একটি ছাপাখানাও ছিল এবং এটি কলকাতায় 37 নং লারকিন্স লেনে অবস্থিত ছিল। এছাড়া ক্যালকাটা গেজেট প্রেস নামক আধা-সরকারি ছাপাখানা (1784 খ্রিস্টাব্দ), ক্রনিকল প্রেস ও ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানির প্রেস ছিল উল্লেখযোগ্য ছাপাখানা।
  • মূল্যায়ণ – বাংলার প্রাথমিক পর্যায়ের এই ছাপাখানাগুলির উৎপাদন ছিল আইন ও আইনগ্রন্থের অনুবাদ, ব্যাকরণ-অভিধান ও শব্দকোষ এবং সংবাদপত্র ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন।

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কীভাবে ছাপাখানার বিস্তারে সাহায্য করেছিল তা ব্যাখ্যা করো। এ প্রসঙ্গে ছাপাখানার বিস্তারে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদানকে চিহ্নিত করো।

বাংলায় ছাপাখানা ব্যবস্থার উদ্যোগ বিলম্বিত হলেও উনিশ শতকের সূচনায় তা দ্রুত বিকাশলাভ করতে থাকে। এই বিকাশের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস।

মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা –

খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষায় বাইবেল ছাপানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন (1798 খ্রিস্টাব্দ)। কিন্তু তা প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় নিজেই ছাপাখানা প্রবর্তন করে তা ছাপানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠিত হলে (1800 খ্রিস্টাব্দ) কেরি এখানেই শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপন করেন। 1820 খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই এই ছাপাখানা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছাপাখানায় পরিণত হয়।

মিশন প্রেসের উৎপাদন –

শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের উৎপাদনগুলি হল –

  • ধর্ম পুস্তক – প্রাথমিক পর্বে কেরির সহযোগী ছিলেন অভিজ্ঞ ও দক্ষ মুদ্রাকর উইলিয়াম ওয়ার্ড এবং পঞ্চানন কর্মকার। তিনি কলকাতা থেকে সংগৃহীত হরফ এবং কিছু পাটনাই ও বিদেশি কাগজ সহযোগে ছাপার কাজ শুরু করেন। নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম অধ্যায়টির বাংলা অনুবাদ করে কেরি 107 পৃষ্ঠা বিশিষ্ট মঙ্গল সমাচার মথিলুকৃত নামে প্রকাশ করেন। 1801 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে আটশোরও অধিক পৃষ্ঠাযুক্ত ধর্মপুস্তক বা বাংলা বাইবেল প্রকাশ করেন।
  • অন্যান্য বই – শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে রামরাম বসুর রচিত প্রতাপাদিত্য চরিত (হরকরা) ও লিপিমালা (জ্ঞানোদয়) নামক দুটি গ্রন্থ (আগস্ট-সেপ্টেম্বরে, 1800 খ্রিস্টাব্দ) মুদ্রিত হয়। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বত্রিশ সিংহাসন (1802 খ্রিস্টাব্দ), 4 খণ্ডে কাশীরাম দাসের মহাভারত (1801-03) ও 5 খণ্ডে কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ (1802-03) মুদ্রিত হয়। এভাবে 1832 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই প্রেসে 40টি বিভিন্ন ভাষায় 2,12,000 কপি বই মুদ্রিত হয়।
  • পাঠ্যপুস্তক – শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকও মুদ্রিত হয়েছিল। এই সব পুস্তকের রচয়িতা ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু, চণ্ডীচরণ মুন্সী, হরপ্রসাদ রায় প্রমুখ।

মিশন প্রেসের মূল্যায়ণ –

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, ধর্মীয় উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপিত হলেও তার উৎপাদনে ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ও ছিল।

ছাপাখানার বিস্তারে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান –

প্রশাসনিক প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সিভিলিয়ানদের ইংরেজির পাশাপাশি দেশীয় ভাষাতেও শিক্ষাদান করা হত। তাই এরকম শিক্ষাদানের জন্য বাংলায় মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজনীয়তা থেকেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানা ছাড়াও সংস্কৃত প্রেস, হিন্দুস্থানী প্রেস প্রভৃতিতে গ্রন্থ ছাপার বরাত (Order) দিত। এভাবেই বাংলা মুদ্রণ শিল্পে গতির সৃষ্টি হয়।

চার্লস উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকার বিখ্যাত কেন?

চার্লস উইলকিন্স ছিলেন প্রাচ্যবাদী পণ্ডিত। তিনি পঞ্চানন কর্মকারের সহযোগিতায় বাংলা মুদ্রাক্ষর খোদাই এবং অক্ষর ঢালাইয়ের কাজ করেন। তাঁর তৈরি বাংলা মুদ্রাক্ষরের সাহায্যেই হ্যালহেড তাঁর বাংলা ব্যাকরণ বইটিতে উদাহরণরূপে বাংলা মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন। তাই তিনি বাংলার গুটেনবার্গ নামে পরিচিত।

বাংলা মুদ্রাক্ষর তৈরির ক্ষেত্রে উইলকিন্সের সহযোগী ছিলেন হুগলি নিবাসী শিল্পী পঞ্চানন কর্মকার। তাঁর তৈরি মুদ্রাক্ষর হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীকালে 1793 খ্রিস্টাব্দে কর্ণওয়ালিশ কোড-এর বাংলা সংস্করণেও তাঁর তৈরি উন্নত বাংলা মুদ্রাক্ষর ব্যবহার করা হয়। তাঁর প্রচেষ্টাতেই বাংলা হরফ নির্মাণ একটি স্থায়ী শিল্পে পরিণত হয়।

স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে শিক্ষার বিস্তারকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?

উনিশ শতকে খ্রিস্টান মিশনারি, ব্যক্তিগত এবং সরকারি উদ্যোগে শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি ছাপাখানা থেকে উৎপাদিত গ্রন্থসমূহের মাধ্যমেও শিক্ষার বিস্তার ঘটে। ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল বুক সোসাইটির (1817 খ্রিস্টাব্দ) উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষায় স্কুল-পাঠ্য পুস্তক ছাপানো এবং শিক্ষার্থীদের কাছে তা সরবরাহ করা। ডেভিড হেয়ার আমৃত্যু এই কাজে ব্রতী ছিলেন। এর বিভিন্ন দিকগুলি হল —

  • নিজস্ব ছাপাখানা – স্কুল বুক সোসাইটি শিক্ষার বিস্তারের উদ্দেশ্যে কলকাতার সার্কুলার রোডে নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া শ্রীরামপুর মিশন প্রেস সহ অন্যান্য প্রেসেও বই ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিল।
  • বাংলা ভাষার প্রাধান্য – এই সোসাইটি অন্যান্য ভাষায় পুস্তকের পাশাপাশি বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করে। এই সোসাইটি প্রথম চার বছরে (1817-1821 খ্রিস্টাব্দ) বাংলা ভাষায় 19টি বইয়ের 79,750টি কপি মুদ্রণ ও বিতরণের ব্যবস্থা করে।
  • মুদ্রণের মানোন্নয়ন – বাংলা ভাষার উন্নতিসাধন এবং বাংলা মুদ্রণের মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে এই সোসাইটির উদ্যোগ ছিল প্রশ্নাতীত। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ইংরেজি প্রথানুযায়ী যতিচিহ্নের ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা গ্রন্থের মুদ্রণে ছবি, মানচিত্র, নকশার ব্যবহার শুরু করে।
  • জ্ঞানচর্চার প্রসার – এভাবে বাংলার ছাপাখানার ইতিহাসে স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে বাংলায় বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, অভিধান, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তনের ফলে শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের কাছে পাশ্চাত্যের জ্ঞানজগতের দরজা উন্মোচিত হয়।

উনিশ শতকের প্রথম তিন দশকে বাংলার মিশনারি প্রেসগুলির মুদ্রণ ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করো। এই পর্বের অন্যান্য ছাপাখানাগুলির বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করো।

উনিশ শতকের শুরুতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগেও বাংলা ছাপাখানার বিস্তার ঘটেছিল; যেমন —

  • কলকাতার ব্যাপটিস্ট মিশন – শ্রীরামপুর মিশনের নবীন গোষ্ঠী এই মিশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইউ. কেরি, উইলিয়াম পীয়ার্স প্রমুখ কলকাতার সার্কুলার রোডে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন (1818 খ্রিস্টাব্দ)। এই স্কুল বুক সোসাইটির বরাত মতো যেমন বই ছেপেছিল, তেমনি তারা বাংলা মুদ্রণের উন্নতির জন্যও চেষ্টা করেছিল।
  • চার্চ মিশন প্রেস – আমহার্স্ট স্ট্রিটের চার্চ মিশন প্রেস ছিল উল্লেখযোগ্য প্রেস এবং এখানে ছাপা উল্লেখযোগ্য বই হল ইংল্যান্ডে ও আয়ারলন্ডে সংস্থাপিত মণ্ডলীর সাধারণ প্রার্থনা (1822 খ্রিস্টাব্দ)। এই গ্রন্থে ফুলস্টপ সহ বিভিন্ন ইংরেজি যতি-চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছিল।
  • বিশপস্ কলেজ প্রেস – শিবপুরের বিশপস্ কলেজ প্রেস ছিল অপর উল্লেখযোগ্য প্রেস। ধর্মীয় পুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের বই ছাপানো হত। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বই হল মর্টনের বাংলা-ইংরেজি অভিধান (1828 খ্রিস্টাব্দ)।

উনিশ শতকের বাংলার ছাপাখানাগুলির বিভিন্ন দিক –

  • ছাপাখানা – 1820 খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত ছাপাখানাগুলি হল – পটলডাঙ্গার ললুলাল কবির সংস্কৃত যন্ত্র, আড়গুলি লেনে হরচন্দ্র রায়ের ছাপাখানা, শোভাবাজারের বিশ্বনাথ দেবের ছাপাখানা, বাঙ্গালি প্রেস প্রভৃতি। এছাড়া বউবাজারের লেবেন্ডর সাহেবের ছাপাখানা, শ্রীরামপুরের নীলমণি হালদারের ছাপাখানা ছিল বিখ্যাত।
  • উৎপাদন – এই সমস্ত ছাপাখানা থেকে বিভিন্নধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। হিন্দুস্থানী প্রেস থেকে ঔষধসার সংগ্রহ (1819 খ্রিস্টাব্দ), বাঙ্গালি প্রেস থেকে রামমোহন রায়ের কঠোপনিষদ (1817 খ্রিস্টাব্দ), হরচন্দ্র রায়ের আড়গুলি লেনের প্রেস থেকে বিভিন্নরকম ধর্মীয় গ্রন্থ, বিশ্বনাথ দেবের প্রেস থেকে রাধাকান্ত দেবের বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ (1821 খ্রিস্টাব্দ) প্রকাশিত হয়।
  • লিথোগ্রাফের প্রবর্তন – ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপাখানার বিস্তারের একটি দিক ছিল লিথোগ্রাফিক ছাপার প্রবর্তন। এই ধরনের ছাপা ব্যবস্থায় ছবি, নকশা, মানচিত্র আঁকা সম্ভব হয়।
    প্রকাশনার মানোন্নয়ন – ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত ছাপাখানাগুলিতে মুদ্রণ কৌশল ও মুদ্রণের মানোন্নয়ন ঘটানোরও চেষ্টা করা হয়। প্রকাশনায় শোভনতা বৃদ্ধির দিকেও নজর দেওয়া হয়।

ছাপাখানা মুদ্রণের মূল্যায়ণ –

এভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা ছাপাখানাগুলি মুদ্রণের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য সাধন করে এবং বাংলার মুদ্রণ ব্যবস্থা ক্রমশই আধুনিক হয়ে ওঠার পথে যাত্রা শুরু করে।

বাংলার ছাপাখানা মুদ্রণের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান ব্যাখ্যা করো।

বিদ্যাসাগর ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত ও লেখক। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পণ্ডিত বা সেরেস্তাদারের পদে নিযুক্ত হন (29 ডিসেম্বর, 1841)। পরবর্তীকালে তিনি সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করেন (এপ্রিল, 1846 – জুলাই 1847 খ্রিস্টাব্দ)। আবার 1850-এর দশকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন উনিশ শতকের একজন উল্লেখযোগ্য গ্রন্থকার, মুদ্রক ও প্রকাশক।

বাংলার ছাপাখানা মুদ্রণের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান –

প্রাক্-আধুনিক যুগের ছাপাখানার ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের অবদানের বিভিন্ন দিক হল –

  • গ্রন্থকার রূপে – বিদ্যাসাগর নিজে ছিলেন একজন গ্রন্থকার। তিনি তাঁর লেখা বেতাল পঞ্চবিংশতি গ্রন্থটি রোজারিও কোম্পানির ছাপাখানায় ছাপানোর ব্যবস্থা করেন (1847 খ্রিস্টাব্দ)। পরবর্তীকালে তিনি নিজের রচিত অনেক পুস্তক নিজের ছাপাখানাতেই মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।
  • মুদ্রাকর রূপে বিদ্যাসাগর – 1847 খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর তাঁর বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে যৌথভাবে 62 নং আমহার্স্ট স্ট্রিটে সংস্কৃত যন্ত্র নামক একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই ছাপাখানার একক মালিক হন।
  • প্রকাশক – এই ছাপাখানা থেকে বিদ্যাসাগর তাঁর নিজের ও অন্যান্য লেখকের রচিত গ্রন্থ ছাপান ও প্রকাশ করেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ (13 এপ্রিল ও 14 জুন, 1855 খ্রিস্টাব্দ)।
  • পুস্তক বিক্রেতা – উনিশ শতকে বটতলা ও চিনাবাজার এলাকায় বই বাজার গড়ে উঠলেও হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ অঞ্চলে বইয়ের দোকান ছিল না। তাই বিদ্যাসাগর এই অঞ্চলে সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি নামক একটি বইয়ের দোকান খোলেন।

ছাপাখানার ফলাফল বা প্রভাবগুলিকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?

ছাপাখানা প্রবর্তনের ফলে বাংলায় দেখা দেয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব। কারণ ছাপাখানা বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এগুলি হল –

  • বিদ্যার একচেটিয়া অধিকার নষ্ট – ছাপাখানা প্রবর্তনের পূর্বে বাংলার শাস্ত্রবিদ্যা ও জ্ঞান দানের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পুরোহিতরাই ছিলেন একচেটিয়া অধিকারী। ছাপাখানার প্রবর্তনের ফলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পুরোহিতদের এই অধিকার নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে শিক্ষার প্রসার ঘটলে জনগণ ক্রমশই জ্ঞানের অধিকারী হয়ে ওঠে।
  • সমাজ সংস্কার – সমাজ ও ধর্ম সংস্কারের প্রয়োজনে ভারতের প্রাচীন শাস্ত্রগুলির মুদ্রণ বা বাংলায় অনুবাদ-মুদ্রণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আবার বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র, প্রচারপত্র বা পুস্তিকার মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের পক্ষে মতামত গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।
  • বিভিন্ন পেশা – ছাপাখানাকে কেন্দ্র করে বই লেখা ও বই ছাপা, বই প্রকাশ, বই ব্যবসা, বই বাঁধাই-এর মত বিভিন্নধর্মী পেশার উদ্ভব ঘটে। এভাবে মুদ্রণ ব্যবস্থা বাংলার আর্থ-সামাজিক জীবনের ওপরেও প্রভাব বিস্তার করে।

ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে দেশীয় উদ্যোগে কীভাবে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স ও কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় তা ব্যাখ্যা করো।

ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে দেশীয় উদ্যোগে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স –

উনিশ শতকে সরকারি উদ্যোগে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ ঘটলেও তা ছিল অপ্রতুল; তাই বাঙালি তথা ভারতীয়রা নিজ উদ্যোগে বিজ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অগ্রসর হয়। এরূপ একটি প্রতিষ্ঠান হল ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (1876 খ্রিস্টাব্দ)।

  • ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠা – ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা হল – ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের ভক্ত। তিনি এদেশে অনুরূপ বিজ্ঞানচর্চা ও তার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউট ও ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স-এর অনুকরণে একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার কথা প্রচার করেন। অবশেষে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দান ও তাঁর জীবনের সঞ্চিত অর্থের সাহায্যে 1876 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে প্রতিষ্ঠা করেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স।
  • ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য – ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল দ্বিবিধ – প্রথমত, বিজ্ঞানের প্রসার সাধন ও প্রকৃত গবেষণার মাধ্যমে প্রায়োগিক বিজ্ঞানের পরিধির বিস্তার এবং দ্বিতীয়ত, সম্পূর্ণরূপে নিজেদের উদ্যোগে ও তত্ত্বাবধানে স্বাধীনভাবে গবেষণা করাই ছিল এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য।
  • ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব – ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর প্রতিষ্ঠা বিভিন্ন কারণে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ভারত তথা বাংলা বিজ্ঞান গবেষণার জন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লাভ করে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই আধুনিক বিজ্ঞান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গবেষক স্যার সি.ভি. রমন এবং কে.এস. কৃষ্ণান ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সম্পদ।

ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে দেশীয় উদ্যোগে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ –

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা আকস্মিক ছিল না, তা ছিল একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া —

  • তারকনাথ পালিতের উদ্যোগ – বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী তারকনাথ পালিত দেশীয় ব্যক্তিদের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার উন্নতি ও বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে জমি ও টাকা দান করেন (জুন, 1912 খ্রিস্টাব্দ)।
  • আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টা – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সরকারের কাছে এই জমির উপর ল্যাবরেটরি সহ একটি আবাসিক বিজ্ঞান কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সরকার এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।
  • রাসবিহারী ঘোষের উদ্যোগ – সরকার কর্তৃক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে রাসবিহারী ঘোষ উপরোক্ত প্রস্তাবিত বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য 10 লাখ টাকা দান করেন। এই অর্থের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ।
  • কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পঠন-পাঠন – কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠাকালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই কলেজকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ বলে ঘোষণা করেন। এই কলেজের প্রথম এম.এস.সি ব্যাচের ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানেন্দ্র মুখার্জী। আবার কলেজের অধ্যাপকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সি.ভি. রমন, গণেশ প্রসাদ আগারকার।

জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান গবেষণা উল্লেখ করে বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা ব্যাখ্যা করো।

জগদীশচন্দ্র বসুর ভূমিকা –

উনিশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা ও বিজ্ঞান গবেষণার সূচনা হয় এবং এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গবেষক ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু (1858-1937 খ্রিস্টাব্দ)।

জগদীশচন্দ্র বসুর শিক্ষালাভ –

জগদীশচন্দ্র বসু কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় বি. এ. পাস করেন (1879 খ্রিস্টাব্দ)। পরবর্তীকালে তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যার ট্রাইপস ডিগ্রি (অনার্সসহ ডিগ্রি পরীক্ষা) লাভ করেন এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি. পাস করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

জগদীশচন্দ্র বসুর কর্মজীবন ও বিজ্ঞান গবেষণা –

ইংল্যান্ড থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকরূপে যোগদান করেন (1885 খ্রিস্টাব্দ)। এই কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি কলেজের মাত্র 24 বর্গফুট ঘরেই বিজ্ঞান গবেষণাও করতে থাকেন। তাঁর গবেষণার তিনটি পর্যায় ছিল — প্রথম পর্যায়ে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ সম্পর্কে গবেষণা করেন ও বেতার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে জীবনের উৎপত্তি সংক্রান্ত গবেষণা করেন এবং তৃতীয় পর্যায়ে উদ্ভিদ ও প্রাণী সংক্রান্ত গবেষণা করেন। তিনি উদ্ভিদের স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপ ও বৃদ্ধি মাপার জন্য ক্রেস্কোগ্রাফ নামক একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন।

জগদীশচন্দ্র বসুর বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা –

জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ সংক্রান্ত গবেষণায় উদ্ভূত নতুন তত্ত্ব ও তথ্যের কথা ইংল্যান্ডের রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে বক্তৃতার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এরপর তিনি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই সময়েই রয়্যাল সোসাইটির বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা ভারত সরকারের কাছে জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণার জন্য একটি উন্নতমানের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার অনুরোধ জানান। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।

প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণের পর জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর বাড়িতেই ছোটো গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করে গবেষণার কাজ শুরু করেন। এর পাশাপাশি তিনি তাঁর নিজের ও দেশের স্বার্থে একটি বৃহৎ গবেষণাগার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। শেষপর্যন্ত তাঁর নিজস্ব অর্থ ও সংগৃহীত 11 লাখ টাকা অনুদানের অর্থে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন বসু বিজ্ঞান মন্দির (23 নভেম্বর, 1917)।

জগদীশচন্দ্র বসুর মূল্যায়ণ –

এভাবে দেখা যায় যে, জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন একজন সফল বাঙালি বৈজ্ঞানিক এবং উদ্যোগপতি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দির হয়ে ওঠে আধুনিক ভারতের অন্যতম বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠা ও কার্যাবলী ব্যাখ্যা করো। বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকালে জাতীয় শিক্ষা ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (1906 খ্রিস্টাব্দ)। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বাংলার শিক্ষার ইতিহাসে এক বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির সঞ্চার করে।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য 

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের (1906 খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি হল –

  • ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষানীতির বিরোধিতা করা
  • দেশের প্রয়োজনে স্বদেশি ধাঁচে এক বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই শিক্ষাব্যবস্থার দুটি দিক ছিল যথা — সাধারণ বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কার্যাবলী –

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কার্যাবলীর বিভিন্ন দিক হল –

  • ন্যাশনাল কলেজ – সাধারণ বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা শিক্ষার জন্য জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বৌবাজারে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন জাতীয়তাবাদী চরমপন্থী নেতা অরবিন্দ ঘোষ।
  • বিদ্যালয় – জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে ও উৎসাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে (রংপুর, ঢাকা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা প্রভৃতি) জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ব্যর্থতার কারণ –

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ভারতে প্রথমবার জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়; কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ব্যর্থতার কারণগুলি হল –

  • জাতীয় শিক্ষাপরিষদ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে অর্থ সংকটের সম্মুখীন হয়।
  • প্রথম দিকে অনেক শিক্ষক এগিয়ে এলেও বেতনের স্বল্পতার কারণে অনেক শিক্ষক এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেন।
  • চাকরির বাজারে এই প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট ছিল গুরুত্বহীন; তাই এই কলেজে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি।
  • তৎকালীন চরমপন্থী নেতারা এই পরিষদকে স্বীকৃতিও দেয়নি।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠা –

উনিশ শতকে সরকারি উদ্যোগে ভারতে কারিগরি শিক্ষার বিকাশ ছিল সীমিত। বিশ শতকে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ স্থাপিত হলে কারিগরি শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ সূচিত হয়। কিন্তু বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা না কারিগরি শিক্ষার ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে—এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কর্মকর্তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। এই পরিষদের সদস্য তারকনাথ পালিতের উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (জুলাই, 1906 খ্রিস্টাব্দ)।

বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের পাঠ্যক্রম ছিল কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রিক। এখানে তিন বছরের ইন্টারমিডিয়েট ও চার বছরের সেকেন্ডারি বা মাধ্যমিক শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়। সমকালীন শিক্ষক বিনয়কুমার সরকার উপহাস করে এই প্রতিষ্ঠানকে ‘মিস্তিরি তৈরীর কারখানা’ বলে অভিহিত করেন।রা হয়। সমকালীন শিক্ষক বিনয়কুমার সরকার উপহাস করে এই প্রতিষ্ঠানকে মিস্তিরি তৈরীর কারখানা বলে অভিহিত করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী ভাবনার মাধ্যমে কীভাবে প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটেছিল তা ব্যাখ্যা করো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার ভূমিকা –

ভারতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনের জন্য দক্ষ কেরানি তৈরি করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এরূপ শিক্ষাধারার সমালোচনা করেন এবং শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামক এক বিদ্যালয় ও পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী স্থাপন করে এক বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ভাবনা –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল –

  • এরূপ আবাসিক ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করা এবং এভাবে প্রাচীন ভারতের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের গুরু-শিষ্য সম্পর্ককে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
  • প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে এক নতুন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাব্যবস্থা –

রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন বা শিক্ষণ সম্পর্কে কয়েকটি বিষয়ের উপর জোর দেন, যেমন –

  • তিন নীতি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই নতুন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় তিনটি নীতি প্রয়োগ করেন যথা — অবাধ স্বাধীনতা, অবাধ চলাফেরা ও খেলাধুলা। প্রকৃতির সঙ্গে যোগ রেখে মনের চর্চার ওপর গুরুত্ব দেন।
  • সাংস্কৃতিক বিষয় – প্রকৃতি থেকে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার পাশাপাশি এক উন্নত সাংস্কৃতিক বিষয়কে পাঠক্রমে রাখা হয়। এগুলি হল — কলা, নৃত্য, নাটক, সংগীত, অঙ্কন প্রভৃতি। এগুলি শেখানোর জন্য বিষয় বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হয়।
  • কারিগরি শিক্ষা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই বিদ্যালয়ে একই সঙ্গে ব্যক্তি ও সমষ্টির শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী ভাবনা –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে যে সমস্ত আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সেগুলি হল –

  • ভারতীয় আদর্শকে তুলে ধরা – শান্তিনিকেতনকে কেন্দ্র করে ভারতের আদর্শ ও বাণী বিশ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যেই তিনি বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।
  • নিজের কর্তব্য সম্পাদন – রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সাহিত্যিকরূপে বিশ্ববাসীকে যেমন সাহিত্য উপহার দেন, তেমনি তিনি ভারতবাসীর হয়ে বিশ্বকে কিছু প্রদান করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি একজন ভারতীয়রূপে নিজের কর্তব্য সম্পাদনের জন্য বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা ও ভাবনার স্তর –

1918 খ্রিস্টাব্দের 23 ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয় (8 পৌষ, 1325 বঙ্গাব্দ)। এর তিনবছর পর পৌষ উৎসবে বিশ্বভারতী উদ্ঘাটিত হয়। বিশ্বভারতী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার তিনটি স্তর ছিল যথা –

  • ভারত সংস্কৃতি – ভারতের সমগ্ররূপ উপলব্ধি করতে ভারতের নানা সংস্কৃতি (বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন ও মুসলমান) কে তুলে ধরা।
  • বিদ্যা উৎপাদন – তাঁর ভাবনায় প্রকাশিত হয় যে, বিশ্বভারতীর মূল কাজ হবে বিদ্যার উৎপাদন। বিদ্যা বিতরণ হবে গৌণ কাজ। এই উদ্দেশ্যে বিশ্বের মনীষীদের আহ্বান করে বিশ্বভারতীতে তাঁদের আনার কাজ শুরু হয়।
  • উৎপাদন-শিক্ষা – শিক্ষার্থীদের অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, নানা ব্যবহারিক বিদ্যা শিক্ষা ও বিশ্বভারতীর চতুর্দিকে তার প্রয়োগের ব্যবস্থা করাও ছিল তাঁর চিন্তাভাবনার বিভিন্ন দিক। এরই সূত্র ধরে শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠা করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী ভাবনার উপসংহার –

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচলিত শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের পরিবর্তে প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে সচেষ্ট হন। তবে এই শিক্ষা আনন্দপাঠ হলেও ঔপনিবেশিক কাঠামোর তা কার্যকরী শিক্ষা ছিল না।য় সাধন করতে সচেষ্ট হন। তবে এই শিক্ষা আনন্দপাঠ হলেও ঔপনিবেশিক কাঠামোর তা কার্যকরী শিক্ষা ছিল না।


আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় “বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর “ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Please Share This Article

Related Posts

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

About The Author

Solution Wbbse

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিষয়সংক্ষেপ