আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের সপ্তম অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর থেকে “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।
বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের ভূমিকা –
বিংশ শতকের ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ। বিংশ শতকের শুরু থেকে আন্দোলনের ক্ষমতা যত বেড়েছে নারীদের যোগদানের প্রবণতাও তত বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নয়, আন্দোলনের সবরকম ধারায় নারীরা সমানভাবে এবং স্বচ্ছন্দে অংশগ্রহণ করেছে।
বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য –
- মধ্যবিত্ত হিন্দু নারীদের অংশগ্রহণ – শুরু থেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মধ্যবিত্ত পরিবারভুক্ত হিন্দু নারীরা যোগদান করেছে। তুলনায় আন্দোলনে নিম্নবর্ণের বা দলিত হিন্দু ও মুসলমান নারীদের যোগদান ছিল অনেক কম।
- সহযোগীর ভূমিকায় নারীদের অংশগ্রহণ – জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সহযোগীর ভূমিকায় নারীদের অংশগ্রহণ। এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল – আন্দোলনকারী বা বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়া, দেখাশোনা করা, অস্ত্র সরবরাহ করা, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, সংবাদ আদানপ্রদান করা প্রভৃতি। কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমী চিত্রও লক্ষণীয়।
- স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ – জাতীয় আন্দোলনে নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করেছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলনে গান্ধিজি তাঁর স্বেচ্ছাসেবী দলে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করেননি। কিন্তু তাঁর ডান্ডি অভিযানের সময় হাজার হাজার নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আন্দোলন চলাকালীন নারীদের অংশগ্রহণ আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের প্রবণতা ছিল আরও বেশি।
- বিদেশি নারীদের অংশগ্রহণ – বিংশ শতকের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিদেশি নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা, অ্যানি বেসান্ত, নেলী সেনগুপ্ত প্রমুখ। ভগিনী নিবেদিতা বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অ্যানি বেসান্ত হোমরুল আন্দোলন ও জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম নেত্রী ছিলেন। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তও জন্মসূত্রে বিদেশিনী। তিনিও অ্যানি বেসান্তের মতো কংগ্রেসের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের মূল্যায়ন –
ভারতের মতো দেশে যখন ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত তখন নারী আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ একটি অভিনব ঘটনা ছিল। ভারতে এর প্রভাব ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে সমগ্র নারীসমাজ উপকৃত হয়।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতায় নারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র আলোচনা করো।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতায় নারী আন্দোলনের ভূমিকা –
বিংশ শতকে ভারত তথা বাংলায় নারী জাগরণের যে ধারার সূত্রপাত হয়, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে তার বলিষ্ঠ রূপ প্রকাশিত হয়। ভারতের বড়োলাট লর্ড কার্জন 1905 খ্রিস্টাব্দে বাংলা প্রদেশকে দ্বিখণ্ডিত করে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সমগ্র দেশ জুড়ে যে প্রতিবাদ আন্দোলনের সূচনা হয় সেখানে নারীসমাজের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় নারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র –
বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে নারীজাতির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের নারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
- সহযোগিতামূলক ভূমিকা – বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে নারীদের নারীসমাজ বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, গোপন সংবাদ আদানপ্রদান, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা ও অস্ত্র সরবরাহের কাজে সাহায্য করতেন। মূলত বলা যায়, নারীদের অংশগ্রহণ ছিল এসময় ঘরোয়া বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
- শিক্ষিত হিন্দু নারীর অংশগ্রহণ – বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় স্বদেশি আন্দোলনে প্রধানত মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারভুক্ত মেয়েদের অধিকসংখ্যায় অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। শিক্ষিত নারীদের, যথা – সরলাদেবী চৌধুরাণী, কুমুদিনী বসু, হেমাঙ্গিনী দাস প্রমুখের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনের ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করেছিল।
- পত্রপত্রিকা প্রকাশ – বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় নারী আন্দোলনের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল পত্রপত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে নারীচেতনার জাগরণ। সরলাদেবী চৌধুরাণী সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকা, সরযুবালা দত্ত সম্পাদিত ‘ভারত মহিলা’, ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ এবং 1905 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘অন্তঃপুর’ পত্রিকা নারীদের রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়।
- উগ্র হিন্দুবাদী ধ্যানধারণা প্রকাশ – বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলার নারীসমাজ উগ্র হিন্দুবাদী ধ্যানধারণা প্রচারে উদ্যোগী হয়েছিল। গিরিজাসুন্দরী নারীদের সমবেত করে ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ শোনাতেন।
বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় নারী আন্দোলনের উপসংহার –
এইভাবে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় বাংলার নারীসমাজ দেশমুক্তির সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিল।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা কী ছিল?
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের ভূমিকা –
1905 খ্রিস্টাব্দে ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন বাংলা প্রদেশকে দ্বিখণ্ডিত করেন। একে বঙ্গভঙ্গ বলা হয়। বাংলার জনগণ বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নারীরা হলেন – সরলাদেবী চৌধুরাণী, কুমুদিনী বসু, লীলাবতী মিত্র, নির্মলা সরকার, হেমাঙ্গিনী দাস প্রমুখ।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নারীদের ধরন –
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল মূলত ঘরোয়া বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল প্রধানত –
- স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার করা।
- বিদেশি জিনিস ও কাচের চুড়ি ভেঙে ফেলা।
- অরন্ধন দিবস পালন করা।
- আন্দোলনকারী ও বিপ্লবীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করা।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা –
সেসময় খুব কমসংখ্যক নারী প্রকাশ্য সভাসমিতিতে যোগদান করতেন। নারীরা পাড়ায় বা কারোর বাড়িতে জড়ো হতেন। যেমন – মুরশিদাবাদের কান্দিতে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বাড়িতে সমবেত হয়ে প্রায় 500 মহিলা বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা শুনেছিলেন। তারা বিদেশি দ্রব্য বর্জন, স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার ও অরন্ধনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন।
জাতীয়তাবাদী নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমবেতভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। তারা গ্রাম ও শহরে সর্বত্র চরকার প্রবর্তন, অর্থসংগ্রহ (লক্ষ্মীর ভাণ্ডার) প্রভৃতি কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
- মা লক্ষ্মীর ধারণার প্রচার – বঙ্গভঙ্গবিরোধী নারীদের আন্দোলনে দেবী লক্ষ্মীকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বলা হয় বঙ্গভঙ্গের জন্য মা লক্ষ্মী দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্য সকল নারীকে চেষ্টা করতে হবে।
- মায়ের কৌটা’য় অর্থ ও সম্পদ সংগ্রহ – বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অর্থসংগ্রহের জন্য ‘মায়ের কৌটা’-র কথা বলা হয়। মায়ের কৌটা বলতে বোঝায় প্রতি বাড়িতে একটি করে কৌটা রাখতে হবে, যে কৌটায় প্রতিদিন দেশমায়ের জন্য একমুঠো করে চাল রাখতে হবে। আবার কোনো নারী বেশি অর্থ দান করলে বা কোনো দুঃসাহসিক কাজ করলে তাকে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ উপাধিও দেওয়া হত।
- বিপ্লবীদের সহায়তা – বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রসার ঘটে। ভগিনী নিবেদিতা বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তিনি সক্রিয়ভাবে বাংলার বিপ্লবী গুপ্তসমিতির (অনুশীলন সমিতি) সঙ্গে যুক্তও ছিলেন। বাংলার যেসব নারীরা বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, গোপন সংবাদ আদানপ্রদান, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা ও অস্ত্র সরবরাহের কাজে সাহায্য করতেন তাঁদের মধ্যে বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী, ঢাকার ব্রহ্মময়ী সেন, ফরিদপুরের সৌদামিনী দেবী, বরিশালের সরোজিনী দেবীর নাম স্মরণীয়।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নারীদের মূল্যায়ন –
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে সব শ্রেণির নারীরা সমানভাবে অংশগ্রহণ করেনি। মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারভুক্ত মেয়েদেরই এই আন্দোলনে যোগদানের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তবে এ কথা বলা যায় যে, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলার নারীসমাজের রাজনৈতিক চেতনা এক উচ্চতর স্তরে উন্নীত হয়েছিল।
স্বদেশি আন্দোলনে সরলাদেবী চৌধুরাণীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।
স্বদেশি আন্দোলনের ভূমিকা –
বঙ্গভঙ্গবিরোধী বা স্বদেশি আন্দোলন পরিচালনায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সরলাদেবী চৌধুরাণীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্বদেশি আন্দোলনের সময় বিপ্লববাদ প্রসারেও তাঁর অবদান ছিল।
স্বদেশি আন্দোলনে সরলাদেবী চৌধুরাণীর ভূমিকা –
বাংলার রাজনীতির ক্ষেত্রে এবং সংস্কৃতির বিকাশে কলকাতার ঠাকুরবাড়ির বিশিষ্ট অবদান ছিল। এই ধারার সার্থক উত্তরসূরি ছিলেন সরলাদেবী। স্বদেশি আন্দোলনে নানাভাবে তিনি অবদান রেখেছিলেন –
- প্রচার – তিনি ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন। এই পত্রিকার বিভিন্ন নিবন্ধে তিনি স্বদেশি আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে প্রচার করেন। আন্দোলনের আগেও তিনি বাঙালি নারীদের মানসিক ক্ষেত্র গঠনের জন্য বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী নিবন্ধ প্রকাশ করেন।
- উৎসব পালন – তিনি কয়েকটি উৎসবের আয়োজন করেন। যেমন – বীরাষ্টমী ব্রত, প্রতাপাদিত্য উৎসব প্রভৃতি। বাঙালি যুবকদের হীনম্মন্যতা দূর করে আত্মশক্তিতে উদ্দীপিত করাই ছিল এইসব উৎসবের উদ্দেশ্য। বীরাষ্টমী ব্রতের কর্মসূচি ছিল যুবকদের শরীরচর্চা। পুকুরে সাঁতার কাটা, কুস্তি, ব্যায়াম, লাঠিখেলা প্রভৃতি এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর প্রতাপাদিত্য উৎসব ছিল ধর্মের সঙ্গে বীরপূজা। জাতীয় বীরদের সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠ, বক্তৃতা ইত্যাদি তাদের কর্মসূচির অন্তর্গত ছিল। শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগীকে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়।
- বিপ্লববাদ – সরলাদেবী বিপ্লববাদ প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি নিজ বাড়িতে একটি আখড়া খোলেন। এখানে তিনি প্রফেসার মোর্তাজা নামে একজন প্রশিক্ষককে নিয়োগ করেন। তাঁর সাহায্যে বাঙালি ছাত্র-যুবকদের শারীরশিক্ষা ও অস্ত্রশিক্ষার ব্যবস্থা করেন।
- লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা – বাংলার বিপ্লববাদ প্রসারই ছিল সরলাদেবীর মূল উদ্দেশ্য। এইজন্য বহু অর্থের প্রয়োজন ছিল। অর্থসংগ্রহের জন্য তিনি 1903 খ্রিস্টাব্দে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রতিষ্ঠা করেন। স্বদেশি আন্দোলনের সময় লক্ষ্মীর ভাণ্ডার স্বদেশি তহবিল হয়ে ওঠে। অনেকে এই তহবিলে অর্থ ও অলংকার দান করেন।

স্বদেশি আন্দোলনে সরলাদেবী চৌধুরাণীর মূল্যায়ন –
সরলাদেবী চৌধুরাণী এভাবে একক প্রচেষ্টায় স্বদেশি আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তাঁর এই তৎপরতায় কলকাতার নারীসমাজ ও ছাত্রসমাজ স্বদেশি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
গান্ধিজি নারীসমাজকে রাজনৈতিক আন্দোলনে কেন এবং কীভাবে যুক্ত করেন?
গান্ধিজির রাজনৈতিক আন্দোলনের ভূমিকা –
1915 খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে আসেন। ভারতের রাজনীতিতে শুরু হয় ‘গান্ধি যুগ’। এরপর গান্ধিজির নেতৃত্বে সমগ্র ভারতবর্ষে গণ আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনগুলিতে সমস্ত সামাজিক শ্রেণি অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে সব স্তরের নারীরাও ছিলেন। ফলে আন্দোলনগুলি গণ আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছিল।

গান্ধিজি নারীসমাজকে রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত করার কারণ –
গান্ধিজি দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালনার সময় নারীদের মধ্যে অসীম রাজনৈতিক সম্ভাবনা লক্ষ করেন। এ কথা মনে রেখে তিনি ভারতে গণ আন্দোলন পরিচালনার সময় নারীদের যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এর পিছনে কারণগুলি হল –
- সুশৃঙ্খল – নারীরা প্রকৃতিগতভাবে শৃঙ্খলাপরায়ণা। বিক্ষোভ, সমাবেশ, শোভাযাত্রা বা যে-কোনো কর্মসূচিতে নারীরা শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারেন। তাই আইনভঙ্গের কোনো আশঙ্কা থাকে না। সত্যাগ্রহ আদর্শ পালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত ছিল এই নারীসমাজ।
- আনুগত্য – নারীরা সাধারণত অনুগত প্রকৃতির হয়। পরিবার, সমাজ থেকে তারা এই শিক্ষা পেয়ে এসেছে। তাই যে-কোনো নির্দেশ পালন তাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয়। রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখা জরুরি। তাই নারীসমাজ ক্রমশ আন্দোলনগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
- প্রভাব – পরিবার ও সমাজে নারীজাতির প্রভাব যথেষ্ট। এই নারীসমাজকে রাজনীতিতে যুক্ত করতে পারলে গণ আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হবে এ কথা গান্ধিজি উপলব্ধি করেন।
গান্ধিজি নারীসমাজকে রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত করার পদ্ধতি –
- রাওলাট সত্যাগ্রহ – রাওলাট আইন ও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে 1919 খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি রাওলাট সত্যাগ্রহে নারীদের অংশগ্রহণ করার আবেদন জানান।
- অসহযোগ আন্দোলন – 1921 খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের যোগদানের আবেদন জানান। নারীদের জন্য স্বদেশি ও বয়কট কর্মসূচি নির্দিষ্ট করেন তিনি। কিন্তু নারীরা বৃহত্তর রাজনৈতিক ভূমিকা দাবি করেন। তারা প্রিন্স অফ ওয়েলসের ভারত সফরের বিরুদ্ধে বোম্বাইতে বিক্ষোভ দেখান। কলকাতায় বাসন্তী দেবী, ঊর্মিলা দেবী ও সুনীতি দেবী বিক্ষোভ দেখিয়ে কারাবরণ করেন। তিলক স্বরাজ তহবিলে অনেক নারীরা অর্থ ও অলংকার দান করেন। ‘নারী কর্মমন্দির’, ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং চরকার ব্যবহার চালু হয়।
- আইন অমান্য আন্দোলন – গান্ধিজির লবণ আইন ভঙ্গের সময় হাজার হাজার নারী লবণ তৈরি করে আইন ভঙ্গ করেন। তারা দোকানে দোকানে পিকেটিং-এ অংশ নেন, শোভাযাত্রায় হাঁটেন এবং প্রতিবাদ সভায় যোগ দেন।
গান্ধিজি নারীসমাজকে রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল্যায়ন –
এইভাবে গান্ধিজি ভারতের নারীসমাজকে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। ফলে পরবর্তীকালে বিভিন্ন গণ আন্দোলনে এই নারীসমাজ আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছিল।
অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা কীরকম ছিল?
অসহযোগ আন্দোলনের ভূমিকা –
1920 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। অসহযোগ আন্দোলনের মূল কথা ছিল ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কোনোরকম সহযোগিতা না করা। মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি বেড়ে যায়।
অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের প্রস্তাব গ্রহণ –
1920 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়।
অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের কর্মসূচি –
অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের জন্য নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল সীমিত। এতে নারীদের শুধুমাত্র স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণ ও বিদেশি দ্রব্য বর্জন করার কথা বলা হয়।
অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা –
অসহযোগ আন্দোলনে নারীরা সীমিত কর্মসূচির মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। তারা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
- দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা সভা, মিছিল, পিকেটিং-এ অংশ নেয়।
- 1921 খ্রিস্টাব্দের 17 নভেম্বর ইংল্যান্ডের যুবরাজ বা প্রিন্স অফ ওয়েলস ভারতভ্রমণে এলে হাজার হাজার নারী বোম্বাই শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
- 1921 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে নারীরাও প্রকাশ্যে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে কারারুদ্ধ হন চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী, বোন উর্মিলা দেবী ও ভাইঝি সুনীতি দেবী।
- তারপর উর্মিলা দেবী চিত্তরঞ্জন দাশের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নারী কর্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতায় সভাসমিতিকে ব্রিটিশ সরকার বেআইনি ঘোষণা করলে নারী কর্মমন্দির -এর সদস্যরা আইন অমান্য করার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
- 1922 খ্রিস্টাব্দে স্টিমার ধর্মঘট হলে নেলী সেনগুপ্তর নেতৃত্বে গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে।
- জাতীয় কংগ্রেস তিলক স্বরাজ তহবিল গঠন করে 1 কোটি টাকা আদায় করার কর্মসূচি নেয়। বাংলার নারীরা এই তহবিলে অর্থ ও নিজেদের অলংকার দান করেন।
অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মূল্যায়ন –
অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের যোগদান ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নারীদের যোগদানের ফলে এই আন্দোলন প্রকৃত গণ আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “এই আন্দোলনে সারা দেশ জুড়ে এক অভূতপূর্ব উত্তেজনা পরিলক্ষিত হয়।”
আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো।
আইন অমান্য আন্দোলনের ভূমিকা –
1930 খ্রিস্টাব্দের 12 মার্চ গান্ধিজি 78 জন অনুগামী নিয়ে সবরমতী আশ্রম থেকে 24 দিনে 240 মাইল পথ অতিক্রম করে 5 এপ্রিল গুজরাটের ডান্ডিতে পৌঁছোন। 6 এপ্রিল এখানকার সমুদ্রতীরে গান্ধিজি নিজের হাতে লবণ তৈরি করে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন। গান্ধিজির আহ্বানে অসংখ্য নারী আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের প্রতি গান্ধিজির আহ্বান –
1930 খ্রিস্টাব্দের 10 এপ্রিল গান্ধিজি ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। গান্ধিজির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য নারী এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

আইন অমান্য আন্দোলনে নারী সত্যাগ্রহ সমিতি প্রতিষ্ঠা –
গান্ধিজির ডান্ডি অভিযানের পরদিন 1930 খ্রিস্টাব্দের 13 মার্চ কলকাতায় নেতৃস্থানীয়া নারীরা ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় ভূমিকা –
আইন অমান্য আন্দোলনে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। হাজার হাজার নারী নিজেরাই লবণ তৈরি করে আইন অমান্য করেন।
- ধরসানা লবণগোলা আক্রমণ – গান্ধিজি সুরাট জেলার ধরসানায় সরকারি লবণগোলা দখল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে সরকার 5 মে তাঁকে গ্রেফতার করে। এই সময় সরোজিনী নাইডু প্রায় 2500 জন সত্যাগ্রহীকে নিয়ে ধরসানা অভিযান করেন। এই অভিযানে নিরস্ত্র জনগণের উপর পুলিশের আক্রমণে 2 জন সত্যাগ্রহী মারা যান ও 320 জন সত্যাগ্রহী মারাত্মকভাবে আহত হন।
- সভাসমিতি ও পিকেটিং – নারীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভাসমাবেশ, মিছিল, পিকেটিং, বিদেশি পণ্য বয়কট প্রভৃতি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেন। নারীরা বিভিন্নভাবে সরকারি আইনগুলি অমান্য করেন।
- আন্দোলনের বিস্তার – কলকাতা, দিল্লি, বোম্বাই, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব, এলাহাবাদ, লখনউ ইত্যাদি অঞ্চলে নারীরা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনের অপরাধে দিল্লিতেই প্রায় 1600 নারীকে গ্রেফতার করা হয়।
- আন্দোলনের প্রধান নেতৃবৃন্দ – আইন অমান্য আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়া নারীরা ছিলেন – সরোজিনী নাইডু, বাসন্তী দেবী, কমলা নেহরু, ঊর্মিলা দেবী, সরলাবালা দেবী, লীলা নাগ, রাজকুমারী অমৃত কাউর প্রমুখ। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আইন অমান্য আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন – মেদিনীপুরে মাতঙ্গিনী হাজরা, বাঁকুড়ায় সুষমা পালিত, বীরভূমে সত্যবালা দেবী, ঢাকায় আশালতা সেন প্রমুখ।
আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের মূল্যায়ন –
আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের দিক থেকে বলা যায়, বোম্বাইয়ের আন্দোলন ছিল সংগঠিত, বাংলার আন্দোলন ছিল উগ্র এবং মাদ্রাজের আন্দোলন ছিল সীমিত। বিদেশি সাংবাদিক ব্রেলফোর্ড ও জর্জ স্লোকোম্বর বলেছেন যে, আইন অমান্য আন্দোলনের কোনো অবদান না থাকলেও নারীমুক্তির ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার বলতে কী বোঝো?
অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার – 1922 খ্রিস্টাব্দের 5 ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলায় একটি শোভাযাত্রার উপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে উত্তেজিত জনতা চৌরিচৌরা থানায় অগ্নিসংযোগ করে। এতে 22 জন পুলিশকর্মী পুড়ে মারা যায়। এই চৌরিচৌরা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে 12 ফেব্রুয়ারি জাতীয় কংগ্রেস বারদৌলির সভায় অসহযোগ আন্দোলন বন্ধের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বাংলার নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ভূমিকা –
1942 খ্রিস্টাব্দের 26 এপ্রিল গান্ধিজি ‘হরিজন’ পত্রিকা মারফৎ ব্রিটিশ সরকারকে অবিলম্বে ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলেন। 1942 খ্রিস্টাব্দের 14 জুলাই ওয়ার্ধায়, কংগ্রেস কার্যনির্বাহক কমিটি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। আন্দোলনের নেতৃত্ব গান্ধিজির উপর অর্পিত হয়। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বোম্বাই বৈঠকে বিপুল ভোটে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। 8 আগস্ট গভীর রাতে অধিবেশন শেষ হওয়ার পর গান্ধিজি, বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ-সহ কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক কমিটির সকল সদস্য গ্রেফতার হন এবং পরদিন সেই খবর প্রকাশিত হলে ভারত ছাড়ো আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হয়ে যায়। এই আন্দোলনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা –
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা প্রবল উৎসাহের সঙ্গে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
- অরুণা আসফ আলি ও সুচেতা কৃপালিনি মেয়েদের গোপনে সংগঠিত করার কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সুচেতা কৃপালিনি অহিংস আন্দোলন সংগঠিত করলেও অরুণা আসফ আলি বৈপ্লবিক কাজকর্ম সংগঠিত করেন। অরুণা আসফ আলি কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের শীর্ষস্থানীয়া নেত্রী ছিলেন।
- ঊষা মেহতা গোপনে বেতারকেন্দ্র পরিচালনা করতেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলার নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
- মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের মহিলাদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে মহিলা স্বেচ্ছাসেবিকাদের নিয়ে ভগিনী সেনা গঠন করা হয়।
- 73 বছরের বৃদ্ধা ‘গান্ধিবুড়ি’ নামে পরিচিত মাতঙ্গিনী হাজরা 1942 খ্রিস্টাব্দে তমলুক থানা দখল করার জন্য শোভাযাত্রা পরিচালনা করার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
- বীরভূমে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন নন্দিতা কৃপালিনি, রানি চন্দ, এলা দত্ত, সুনীতা সেন, রামপুরহাটের মায়া ঘোষ, সিউড়ির লাবণ্যপ্রভা দত্ত প্রমুখ।
- তা ছাড়া আসামের 13 বছরের কিশোরী কনকলতা বড়ুয়া, পাঞ্জাবের গৃহবধূ যোগেশ্বরী ফুকোননীর নাম ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বাংলার নারীদের মূল্যায়ন –
ব্রিটিশ সরকার নিষ্ঠুর দমননীতির মাধ্যমে ভারত ছাড়ো আন্দোলন দমন করে। তবে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানে এই আন্দোলন গণ আন্দোলনের রূপ লাভ করেছিল।
মাতঙ্গিনী হাজরা ইতিহাসে স্মরণীয় কেন?
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ভূমিকা –
1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল। এই আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিলেও তার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় নজর কেড়েছিল ভারতীয় নারীরা। গান্ধিজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের শিক্ষিত নারীদের পাশাপাশি সাধারণ নারীসমাজও দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেন।
মাতঙ্গিনী হাজরার ভূমিকা –
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী মাতঙ্গিনী হাজরা। ইতিহাসে তিনি ‘গান্ধিবুড়ি’ নামে বিশেষভাবে স্মরণীয়।
- পূর্ব পরিচয় – 1942 -এর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার জন্ম হয় 1869 খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার এক কৃষক পরিবারে। স্বল্প বয়সে তিনি বিধবা হন।
- আন্দোলনে অংশগ্রহণ – বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে মাতঙ্গিনী হাজরার অংশগ্রহণ ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এসময় 6 মাসের জন্য তিনি কারাবরণও করেছিলেন।
- ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ – 1942 খ্রিস্টাব্দে 73 বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা মেদিনীপুরের তমলুক থানা দখলের জন্য ছয় হাজার নরনারীর এক মিছিলে নেতৃত্ব দান করেন। শহরের প্রান্তে পৌঁছোলে ব্রিটিশ পুলিশের তরফ থেকে মিছিল বন্ধের নির্দেশ আসে। পুলিশি নির্দেশ অমান্য করে এই মিছিল অগ্রসর হলে মাতঙ্গিনী হাজরাকে গুলি করা হয়। তিনবার গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা হাতে নিয়ে তিনি শহীদের মৃত্যুবরণ করেন।
মাতঙ্গিনী হাজরার উপসংহার –
পুলিশি অত্যাচার ও আক্রমণ সহ্য করেও মাতঙ্গিনী হাজরা যেভাবে নির্ভীক চিত্তে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তা ভারতীয় নারীসমাজের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ। এই কারণে তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।
এদেশে বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের কারণ কী ছিল?
বিপ্লবী আন্দোলনের ভূমিকা –
ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হল সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন। বাংলার যুবসমাজ এসময় তাদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য ও ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসন বিতাড়নের উদ্দেশ্যে অস্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। সশস্ত্র বিপ্লবী ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নারীসমাজও বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে।
বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের কারণ –
ভারতবর্ষ তথা বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে নারীসমাজের অংশগ্রহণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর পিছনে নানাবিধ কারণ বিদ্যমান ছিল –
- ব্রিটিশদের অকথ্য নির্যাতন – ভারতবর্ষের মানুষের উপর ব্রিটিশ শাসক ও তাদের সমর্থনপুষ্টদের শোষণ ও মানসিক নির্যাতন সমগ্র উনিশ ও বিশ শতক জুড়ে ক্রমশ তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। নারীদের অধিকার ও মর্যাদায় আঘাত এলে তারাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। এভাবে মহিলারাও সশস্ত্র বিপ্লববাদের পথে পা বাড়ায়।
- রাজনৈতিক প্রভাব – বিশ শতকে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ইতিপূর্বে গান্ধিজির আহ্বানে সাড়া দিয়ে নারীসমাজ ভারতের জাতীয় আন্দোলনগুলিতে যোগদান করতে শুরু করেছিল। ফলে এসময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নারীসমাজ বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয় ও তার প্রত্যক্ষ আন্দোলনে অংশ নেয়।
- প্রচার – এসময় নারীদের রাজনৈতিকভাবে সুসংগঠিত করার জন্য বেশ কিছু সংগঠন গড়ে ওঠে। এই সকল সংগঠনের পত্রপত্রিকাগুলি প্রচার করে যে, নারীদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে 1923 খ্রিস্টাব্দে লীলা নাগের সক্রিয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দীপালি সংঘের কথা বলা যেতে পারে। নারীদের মধ্যে আত্মশক্তির জাগরণ ও বিপ্লবী আদর্শ প্রচারে এই সংগঠনটির অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
- পুরুষ নেতৃবৃন্দের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা – বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ধারায় নারীরা তাদের পুরুষ সহকর্মীদের সহযোগী হিসেবে নেতৃত্ব দেয়। নারীসমাজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, গোপন তথ্যসংগ্রহ ও সশস্ত্র আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করা – এগুলি বিপ্লবী আন্দোলনের গতিবিধির প্রসারে সাহায্য করেছিল।
বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের উপসংহার –
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, শান্তি ঘোষ প্রমুখ নারী বিপ্লবীর ভূমিকা সশস্ত্র বিপ্লববাদের প্রসারে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল। তাই বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীরা কী ধরনের ভূমিকা পালন করে?
অথবা, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের যোগদানের চরিত্র বিশ্লেষণ করো।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ভূমিকা –
1905 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড কার্জন ‘বঙ্গভঙ্গ’ করেন। এর প্রতিবাদে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে এই আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হয়। এই পথে কোনো প্রতিকার না পেয়ে বাঙালি যুবসমাজ হতাশ হয়ে পড়ে। তখন তারা দাবি আদায়ের জন্য অস্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। এই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীরাও অংশগ্রহণ করে।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বিপ্লববাদ প্রচার –
বিপ্লববাদ প্রচারে নারীরাও এগিয়ে আসেন। সরলাদেবী চৌধুরাণী স্বদেশি যুগে যুবক-যুবতীদের নানারকম অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণের জন্য নিজ বাড়িতে একটি আখড়া খোলেন। ভগিনী নিবেদিতার নামও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। বিংশ শতকে বীণা দাস, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বিশিষ্ট নারীদের ভূমিকা –
ভগিনী নিবেদিতা –
বাংলায় বিপ্লববাদ প্রচারে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন ভগিনী নিবেদিতা। তিনি অনুশীলন সমিতিকে (বিপ্লবী সমিতি) ম্যাৎসিনির জীবনীগ্রন্থ উপহার দেন। এই গ্রন্থ থেকে বিপ্লবীরা গেরিলা যুদ্ধপদ্ধতি সম্বন্ধে ধারণা লাভ করে। এ ছাড়া ক্রপটকিন -এর লেখা ‘বিপ্লবীর আত্মকথা’ এবং ‘রুশ ও ফরাসি কারাগার’ গ্রন্থ দুটি বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে উপহার দেন নিবেদিতা। বিপ্লবী গ্রন্থ দেওয়া ছাড়াও তিনি বিভিন্নভাবে অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলকে সাহায্য করেন।
লীলা নাগ ও দীপালি সংঘ –
বিপ্লবী নারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লীলা নাগ। 1923 খ্রিস্টাব্দে তাঁর উদ্যোগে দীপালি সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। 1926 খ্রিস্টাব্দে তিনি দীপালি ছাত্রী সংঘ নামে ভারতের প্রথম ছাত্রীসংগঠনটি তৈরি করেন। বিপ্লবী অনিল রায়ের সংস্পর্শে এসে তিনি বিপ্লবী সমিতি শ্রীসংঘ-এ যোগ দেন।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার –
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ছিলেন ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম মহিলা শহিদ। সূর্য সেনের সংস্পর্শে তিনি সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন। মাস্টারদা সূর্য সেন তাঁকে চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেন। পরিকল্পনামতো 1932 খ্রিস্টাব্দের 24 সেপ্টেম্বর এই তরুণী 7 জন বিপ্লবীর একটি দল নিয়ে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে তিনি আহত হন। তবে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
কল্পনা দত্ত –
1929 খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের খাস্তগীর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পরেই কল্পনা দত্ত চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলে যোগ দেন। যখন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পরিকল্পনা স্থির হয়, তখন তাকে মাটির তলায় রাখা ডিনামাইটের সঙ্গে বৈদ্যুতিন সংযোগ করানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কল্পনা দত্ত গ্রেফতার হন এবং বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের কার্যকলাপ –
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলার নারীরা বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করেন – কখনও বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, কখনও বিপ্লবীদের অস্ত্র সঞ্চয় ও সরবরাহ করা, আবার কখনও সক্রিয়ভাবে বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করা প্রভৃতি।
কুমিল্লার মনোরমা দেবী, মৃণালিনী দেবী ও হেমপ্রভা দেবী নিজেদের বাড়িতে অস্ত্র মজুত করেন, বিপ্লবীদের আশ্রয়দান করেন। ঢাকার ব্রহ্মময়ী সেন, বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী নিজ নিজ এলাকায় অনুরূপ কাজ করতেন। এভাবে বাংলার নারীরা বিপ্লবী আন্দোলনে পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন।
বীণা দাস নামে ডায়োসেশান কলেজের ছাত্রী বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করেন। ফলে তিনি গ্রেফতার হন এবং বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। শান্তি ও সুনীতি নামে কুমিল্লার দুই স্কুলছাত্রী কুমিল্লার জেলাশাসক স্টিভেনসকে গুলি করে হত্যা করেন।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের মূল্যায়ন –
এভাবে পারিবারিক ও সামাজিক বাধা দূর করে সীমিতভাবে হলেও বাংলার নারীরা সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ইতিহাসে লীলা নাগ স্মরণীয় কেন?
ভূমিকা –
বিশ শতকে ভারত তথা বাংলায় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে এক নতুন ধারা সংযোজিত হয়। বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে বাংলায় বিপ্লববাদের সূচনা হয়। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলার নারীসমাজ বীরদর্পে এগিয়ে আসতে থাকে। নারীদের মধ্যে বিপ্লবী ভাবাদর্শ বিস্তারে লীলা নাগের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
লীলা নাগের ভূমিকা –
বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে লীলা নাগ (রায়) -এর ভূমিকা চিরস্মরণীয়।
- পূর্ব পরিচয় – লীলা নাগের জন্ম হয় ঢাকায়। বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার পর বাংলায় বিপ্লববাদী আন্দোলনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। প্রকৃতপক্ষে বাংলার নারীসমাজকে সুসংগঠিত করাই ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
- দীপালি সংঘের প্রতিষ্ঠা – বাংলার নারীসমাজ যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে সশস্ত্র ব্রিটিশবিরোধী মুক্তিসংগ্রামে যোগদান করতে পারে তার জন্য লীলা নাগ 1923 খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় দীপালি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। সশস্ত্র আন্দোলনের উপযুক্ত করে নারীদের গড়ে তোলা, নারীদের মধ্যে আত্মচেতনা ও দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা, উচ্চশিক্ষায় নারীদের উৎসাহদান করা প্রভৃতি ছিল দীপালি সংঘের প্রধান উদ্দেশ্য।
- কার্যকলাপ – নারীদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের উপযোগী করে গড়ে তোলা ও নারীশক্তির জাগরণে লীলা নাগ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি দীপালি সংঘে শরীরচর্চা ও অস্ত্রশিক্ষা প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ছাড়া, মেয়েদের হস্তশিল্প, সৃজনমূলক সামগ্রীর প্রদর্শন করতে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে 1924 খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে দীপালি শিল্প প্রদর্শনী।
- শিক্ষাবিস্তারে ভূমিকা – নারীশিক্ষা বিস্তার ও নারীদের উচ্চশিক্ষা প্রদানে লীলা নাগ বিশেষভাবে উৎসাহিত ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে ঢাকায় একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে এর বহু শাখাপ্রশাখা গড়ে তোলা হয়। তাঁর যোগ্য সহকর্মী রেণুকা সেন ছাত্রীদের জন্য একটি হোস্টেল ও কলকাতায় দীপালি সংঘের এক শাখা স্থাপন করেন।
লীলা নাগের উপসংহার –
লীলা নাগ বাংলার নারীসমাজের মধ্যে জাতীয় চেতনা ও সশস্ত্র বিপ্লববাদী আদর্শ জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই সকল কারণে ইতিহাসে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।
বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী কোন অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন এবং তিনি কিভাবে ইতিহাসে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন?
বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী নিজের বাড়িতে 7টি পিস্তল ও এক বাক্স কার্তুজ লুকিয়ে রেখেছিলেন। এই অপরাধে তাঁর দু-বছর কারাদণ্ড হয়। তিনিই ছিলেন বিপ্লবী কার্যকলাপে যুক্ত প্রথম দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ভারতীয় মহিলা।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে দীপালি সংঘের অবদান লেখো।
দীপালি সংঘের ভূমিকা –
বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলার রাজনীতিতে আলোড়ন ঘটে। বাংলা সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের উর্বরভূমিতে পরিণত হয়। স্বদেশি আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটলেও বিপ্লববাদ ফল্গুধারার মতো বয়ে যেতে থাকে। এই পটভূমিতে বাংলায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে দীপালি সংঘের মতো একটি নারী বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে।
দীপালি সংঘের প্রতিষ্ঠা –
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী লীলা নাগ (রায়) ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে দীপালি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। বিগত দশকের আন্দোলন ও তাতে নারীসমাজের ভূমিকা এবং ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁকে এই সংঘ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে।
দীপালি সংঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –
দীপালি সংঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল –
- নারীদের বিপ্লবী সংগ্রামের জন্য তৈরি করার লক্ষ্যে এবং নারীদের সাহস ও শক্তি বাড়ানোর জন্য এখানে শরীরচর্চা, লাঠিখেলা, অস্ত্রচালনা প্রভৃতির শিক্ষা দেওয়া হত।
- নারীদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। দীপালি সংঘের উদ্যোগে অনেকগুলি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
দীপালি সংঘের কার্যাবলি –
- স্টাডি সার্কেল প্রতিষ্ঠা – দীপালি সংঘের কর্মকর্তারা এই সংঘের কার্যক্রম বিস্তারের জন্য পাড়ায় পাড়ায় স্টাডি সার্কেল গড়ে তোলেন। এই কার্যক্রমে ধারাবাহিকভাবে অনেক স্কুল, শিল্পশিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষার কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
- দীপালি শিল্প প্রদর্শনী – দীপালি সংঘের উদ্যোগে 1924 খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয় দীপালি শিল্প প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনী বাংলার নারীদের সামনে নারী মুক্তিসংগ্রামের নবদিগন্ত উন্মোচন করে।
- দীপালি ছাত্রী সংঘ – 1926 খ্রিস্টাব্দে লীলা নাগ দীপালি ছাত্রী সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল ভারতবর্ষের প্রথম ছাত্রী প্রতিষ্ঠান। এই সংঘের মাধ্যমে ছাত্রীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা হত।
দীপালি সংঘের মূল্যায়ন –
দীপালি সংঘের পতাকাতলে দলে দলে নারীরা সমবেত হয়। লীলা নাগের প্রচেষ্টায় দীপালি সংঘের কার্যকলাপ বাংলা থেকে আসাম পর্যন্ত বিস্তারলাভ করে।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের অবদান কী?
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ভূমিকা –
ব্রিটিশ সরকারবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। 1932 খ্রিস্টাব্দে পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ ও দখল তাঁর অন্যতম প্রধান কীর্তি। তিনি হলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম নারী শহিদ।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্ম –
প্রীতিলতা 1911 খ্রিস্টাব্দের 5 মে চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের শিক্ষা –
চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে পাস করার পর তিনি ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ ও কলকাতার বেথুন কলেজে পড়াশোনা করেন।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বিপ্লবী দলে যোগদান –
ঢাকায় পড়ার সময় তিনি লীলা নাগের দীপালি সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন। দীপালি সংঘে যোগ দিয়ে তিনি লাঠিখেলা, ছোরাখেলার প্রশিক্ষণ নেন। তিনি ছাত্রী সংঘের সদস্যা হন। তারপর মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী দলের প্রথম মহিলা সদস্যা হন তিনি।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বিপ্লবী কার্যকলাপ –
প্রীতিলতা মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেন।
ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ –
চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকে পাহাড়তলি স্টেশনের কাছের এই ইউরোপিয়ান ক্লাবটি ছিল ব্রিটিশদের প্রধান প্রমোদকেন্দ্র। এই ক্লাবের সামনেই লেখা থাকত ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’।
- 1932 খ্রিস্টাব্দের 23 সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা আনুমানিক রাত 10টা 45 মিনিট নাগাদ এই ক্লাব আক্রমণ করে।
- এই ক্লাবঘরে তখন প্রায় 40 জন ইউরোপিয়ান ছিল। বিপ্লবীদের আক্রমণে 1 জন নিহত ও 11 জন আহত হয়।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মৃত্যু –
ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণকালে প্রীতিলতা গুলিবিদ্ধ হন। তিনি তাঁর সঙ্গীদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে বিপ্লবী পরিকল্পনা অনুসারে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মূল্যায়ন –
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম নারী শহিদ হিসেবে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর আত্মবলিদান স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল।
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি কে প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর উদ্দেশ্য কী ছিল?
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি – 1926 খ্রিস্টাব্দে লীলা নাগ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠা আত্মরক্ষা সমিতিনারীরা পুলিনবিহারী দাসের তত্ত্বাবধানে লাঠিখেলা ও অস্ত্রচালনা শিখত। “সিপাহি বিদ্রোহে প্রথম নারী শহিদ ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম নারী শহিদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
1932 খ্রিস্টাব্দে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ সম্পর্কে আলোচনা করো।
ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের ভূমিকা –
বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যকলাপ ভারতবর্ষের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। 1930 খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের পাহাড়তলির ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ ছিল বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
পাহাড়তলির ইউরোপীয় ক্লাব –
চট্টগ্রামে অবস্থিত পাহাড়তলির ইউরোপীয় ক্লাবে সাধারণ ভারতবাসীর প্রবেশের কোনো অধিকার ছিল না। এটি ছিল শ্বেতাঙ্গদের আমোদপ্রমোদ তথা বিনোদনের একটি কেন্দ্র। 1930 খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর মাস্টারদা সূর্য সেন 1932 খ্রিস্টাব্দে পাহাড়তলির ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ –
মাস্টারদা সূর্য সেন ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের মূল দায়িত্বভার অর্পণ করেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের উপর। এই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত অপর নারী বিপ্লবী কল্পনা দত্ত ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের এক সপ্তাহ আগে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। প্রীতিলতার সক্রিয় নেতৃত্বে কালিকিঙ্কর দে, মণি দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী প্রমুখ বিপ্লবী 1932 খ্রিস্টাব্দের 24 সেপ্টেম্বর পাহাড়তলির ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করে। এই দুঃসাহসিক অভিযানে বোমা, পিস্তল প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তাঁরা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন।
ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের পরিণতি –
ক্রমশ পুলিশের প্রবল আক্রমণ ও গুলিবর্ষণে বিপ্লবীরা দিশাহারা হয়ে যায়। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার গুরুতরভাবে আহত হন। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ না করার অভিপ্রায়ে তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
কল্পনা দত্ত সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
কল্পনা দত্তের ভূমিকা –
ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে কল্পনা দত্তের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ছাত্রী সংঘে যোগদান করেন এবং মাস্টারদা সূর্য সেনের অধীনে বিপ্লবী কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ধরা পড়ার পর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
কল্পনা দত্তের জন্ম –
1917 খ্রিস্টাব্দের 27 জুলাই চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর-এ এক সাধারণ পরিবারে কল্পনা দত্ত জন্মগ্রহণ করেন।
কল্পনা দত্তের শিক্ষা –
কল্পনা দত্ত চট্টগ্রাম থেকে ম্যাট্রিক্যুলেশন পাস করেন। পরে তিনি কলকাতায় আসেন এবং বেথুন কলেজে ভরতি হন।
কল্পনা দত্তের বিপ্লবী দলে যোগদান –
বেথুন কলেজে পড়ার সময় তিনি বিভিন্ন রকম বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। পরে তিনি মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে পরিচিত হন এবং মাস্টারদার প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি-র চট্টগ্রাম শাখার সঙ্গে যুক্ত হন।
কল্পনা দত্তের বিপ্লবী কার্যকলাপ –
কল্পনা দত্ত বাংলার বন্দি বিপ্লবীদের মুক্ত করার জন্য এক পরিকল্পনা করেন। তিনি বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের বিচার ও সাজা রুখতে বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি জেল ও কোর্টে ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিপ্লবীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। 1931 খ্রিস্টাব্দে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার জন্য কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনের এক সপ্তাহ আগে কল্পনা দত্ত সেখানে পুরুষের ছদ্মবেশে সমীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। তিনি জেলে বসেই পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ ও প্রীতিলতার আত্মহত্যার খবর শোনেন।
কল্পনা দত্তের গ্রেফতার ও কারাদণ্ড –
কল্পনা দত্ত জামিনে মুক্তি পেয়ে মাস্টারদার নির্দেশে আত্মগোপন করেন। 1933 খ্রিস্টাব্দের 17 ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশরা তাঁদের গোপন আস্তানা ঘিরে ফেলে এবং মাস্টারদা ও তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে ব্রিটিশবাহিনীর যুদ্ধ হয়। কিন্তু এবারেও কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কল্পনা দত্ত পরে আবার সরকারের বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে গিয়ে তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান এবং বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। হয়।
কল্পনা দত্তের মৃত্যু –
1995 খ্রিস্টাব্দের 8 ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু।
কল্পনা দত্তের মূল্যায়ন –
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কল্পনা দত্ত একটি স্মরণীয় নাম। দেশের জন্য তাঁর ত্যাগ স্বীকার ও বৈপ্লবিক কার্যাবলি নারীদের উদ্বুদ্ধ করে।
বীণা দাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
বীণা দাসের ভূমিকা –
বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবের যুগের অগ্নিকন্যা হলেন বীণা দাস। বীণা দাসের দিদি কল্যাণী দাসও বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বীণা দাস সশস্ত্র সংগ্রাম ও অহিংস আন্দোলন – এই দুই ধারার আন্দোলনের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন।
বীণা দাসের জন্ম –
1911 খ্রিস্টাব্দের 24 আগস্ট বাংলার কৃষ্ণনগরে বীণা দাস জন্মগ্রহণ করেন।
বীণা দাসের শিক্ষা –
বীণা দাস খ্রিস্টান মিশনারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পর কলকাতার বেথুন কলেজে ভরতি হন।
বীণা দাসের বিপ্লবী কার্যকলাপ –
বীণা দাস প্রথম জীবনে সাইমন কমিশনবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় পিকেটিং করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। কংগ্রেস দলের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে গান্ধিজির অহিংস আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ব্রিটিশের শোষণ ও অত্যাচারের মাত্রা লক্ষ করে তিনি অহিংস মতবাদ ছেড়ে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।
বীণা দাসের গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যার চেষ্টা –
বীণা দাসের সবচেয়ে বড়ো বিপ্লবী কাজ হল গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যার চেষ্টা করা। 1932 খ্রিস্টাব্দের 6 ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন ভাষণ দিচ্ছিলেন। এই সময় বীণা দাস মঞ্চে জ্যাকসনকে লক্ষ করে গুলি করেন। কিন্তু তাঁর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তিনি 9 বছর মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কিন্তু 7 বছর পর 1939 খ্রিস্টাব্দে তিনি মুক্তি পান।

বীণা দাসের কংগ্রেসের আন্দোলনে যোগদান –
জেল থেকে মুক্তিলাভের পর বীণা দাস আবার জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীশ ভৌমিককে বিবাহ করেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই সময় বীণা দাস আবার কারারুদ্ধ হন এবং তিন বছর পর 1945 খ্রিস্টাব্দে তিনি মুক্তিলাভ করেন।
বীণা দাসের মৃত্যু –
1986 খ্রিস্টাব্দের 26 ডিসেম্বর হরিদ্বারে তাঁর মৃত্যু হয়।
বীণা দাসের মূল্যায়ন –
বীণা দাসের বৈপ্লবিক কার্যাবলি ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। ইংরেজদের ত্রাস এই অগ্নিকন্যা নারী আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনীর ভূমিকা –
1942 খ্রিস্টাব্দে রাসবিহারী বসু সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন। পরে রাসবিহারী বসুর অনুরোধে সুভাষচন্দ্র বসু জাপানে গিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের মধ্যে ঝাঁসির রানি ব্রিগেড নামে একটি নারীবাহিনী ছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের যোগদানের অন্যতম নজির ছিল এই ঝাঁসির রানি ব্রিগেড।
ঝাঁসির রানি ব্রিগেড গঠন –
সুভাষচন্দ্র বসু যখন কংগ্রেসে ছিলেন তখন তিনি নারীদের সামরিক কাজে অংশগ্রহণের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করেছিলেন। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব গ্রহণের পর নারীবাহিনী গঠনে উদ্যোগী হন এবং একটি নারীবাহিনী গঠন করেন। এই নারীবাহিনীর নামকরণ করেন 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের নেত্রী ঝাঁসির রানির (লক্ষ্মীবাঈ) নাম অনুসারে ঝাঁসির রানি ব্রিগেড। এই ব্রিগেডের নেতৃত্বে ছিলেন শ্রীমতী লক্ষ্মী স্বামীনাথন। এই বাহিনীতে প্রায় 1,500 জন নারী যোগদান করেছিলেন।

ঝাঁসির রানি বাহিনীর অভিযান –
1944 খ্রিস্টাব্দে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারত অভিযান করে। আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারড অভিযানে ঝাঁসির রানি ব্রিগেড অংশগ্রহণ করে। কিন্তু 1945 খ্রিস্টাব্দের এবল যুদ্ধে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ক্যাপটেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন।
আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনীর মূল্যায়ন –
অভিযানের সাফল্য বা ব্যর্থতার বিতর্কে না গিয়ে বলা যায়, আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে ভারতের ইতিহাসে এক নজির সৃষ্টি করেছিল। তাঁদের জাতীয়তাবাদী মনোভাব ভারতীয় মহিলাদের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। ভারতীয় নারীদের স্বনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথে ঝাঁসির রানি বাহিনী প্রেরণা জুগিয়েছিল।
বিশ শতকে ভারতে ছাত্র-আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে লেখো।
বিশ শতকে ভারতে ছাত্র-আন্দোলনের ভূমিকা –
বিশ শতকে ভারতে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অপরিহার্য অংশ হিসেবে ছাত্র-আন্দোলনের সূচনা হয়। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রথম ছাত্র-আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্রসমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনগুলির মাধ্যমে ছাত্ররা তাদের রাজনৈতিক দাবিদাওয়া পূরণের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়।
বিশ শতকে ভারতে ছাত্র-আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যসমূহ –
বিশ শতকে ভারতে ছাত্র-আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল –
- জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা – বিশ শতকে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনগুলিতে ছাত্রসমাজের যোগদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত স্বদেশি আন্দোলন, অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন, পিকেটিং, মিছিল-মিটিং প্রভৃতি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ছাত্র-আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
- সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রভাব – ভারতে ছাত্র-আন্দোলনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রভাব। রুশ বিপ্লব ভারতের ছাত্রসমাজকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল এবং পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছাত্র- আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল।
- সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন – ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ভারতীয় ছাত্রসমাজ বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল। বিভিন্ন গুপ্তসমিতিগুলিতে যোগদানের মাধ্যমে বাংলার ছাত্রসমাজ সশস্ত্র বৈপ্লবিক কাজে অংশগ্রহণ করে।
- সমাজসেবামূলক কার্যাবলি – বিশ শতকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা সশস্ত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছাড়াও একাধিক সমাজকল্যাণমূলক কাজে ছাত্রদের সক্রিয় উদ্যোগ ও অংশগ্রহণ ছিল ছাত্র-আন্দোলনের অপর একটি বৈশিষ্ট্য।
বিশ শতকে ভারতে ছাত্র-আন্দোলনের উপসংহার –
এভাবে ভারতবর্ষে সমগ্র বিশ শতক জুড়ে ছাত্র-আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় দেখা গিয়েছিল, যা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে এক বিশিষ্ট মাত্রা প্রদান করেছিল।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা –
ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন বাংলা প্রদেশকে দুটি ছোটো প্রদেশে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। 1905 খ্রিস্টাব্দের 19 জুলাই সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ঘোষিত হয় এবং 1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সমগ্র বাংলা তথা ভারতে যে আন্দোলনের উদ্ভব হয়, তা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন নামে খ্যাত। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে বাংলার বিশিষ্ট জননেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ছাত্ররা ছিল এই আন্দোলনের স্বনিয়োজিত প্রচারক।
স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা –
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন হিসেবে ‘স্বদেশি’ ও ‘বয়কট’ আন্দোলনের সৃষ্টি হয়।
স্বদেশি আন্দোলন –
স্বদেশি বলতে বোঝায় ভারতে (স্বদেশে) প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন ও তার ব্যবহার করা, দেশের রীতিনীতি মেনে চলা ও দেশীয় শিক্ষা গ্রহণ করা।
স্বদেশি আন্দোলনে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বদেশি ভাবধারা প্রচারের জন্য তারা ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’ গান গেয়ে গেয়ে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করে।

বয়কট আন্দোলন –
বয়কট বলতে বোঝায় বিদেশি দ্রব্য, বিদেশি আদবকায়দা ও বিদেশি শিক্ষা বর্জন করা। বয়কট আন্দোলন ছাত্রদের চেষ্টায় এক প্রত্যক্ষ সংগ্রামে পরিণত হয়।
- ছাত্ররা বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন করে এবং বিদেশি কাগজ ও কলমে না লেখার জন্য শপথগ্রহণ করে।
- ছাত্ররা বিদেশি দ্রব্যের দোকানের সামনে (লবণ, কাপড়, চিনি, মদ ও অন্যান্য দ্রব্যের) পিকেটিং করে।
- বিদেশি দ্রব্যে আগুন লাগিয়ে বহ্নি উৎসব পালন করে।
- 1905 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস থেকে কলকাতার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্ররা সভাসমাবেশ শুরু করে। 31 জুলাই কলকাতার সমস্ত কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। 7 আগস্ট কলকাতার টাউন হলে এক ঐতিহাসিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল করে প্রায় 5 হাজার ছাত্র যোগ দেয়।
সরকারি দমননীতি –
ছাত্রদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখার জন্য সরকার নানা দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে। সরকার বিভিন্ন সার্কুলার, যেমন – কার্লাইল সার্কুলার (12 অক্টোবর, 1905), পেডলার সার্কুলার (21 অক্টোবর, 1905) জারি করে। বলা হয়, যেসব ছাত্র স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে যোগ দেবে, এমনকি ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দেবে তাদের স্কুল-কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হবে।
অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি –
ছাত্রবিরোধী সরকারি সার্কুলারের প্রতিবাদে 1905 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ছাত্রনেতা শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি (Anti-Circular Society) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সোসাইটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত আন্দোলনকারী ছাত্রদের শিক্ষালাভের বিকল্প ব্যবস্থা করা।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ –
জাতীয়তাবাদী নেতারা স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত ছাত্রদের সুবিধার্থে 1906 খ্রিস্টাব্দের 11 মার্চ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে 92 জন সদস্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠন করেন।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের মূল্যায়ন –
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন পরবর্তীকালের অন্যান্য ছাত্র-আন্দোলনের পথপ্রদর্শক হয়েছিল।
কার্লাইল সার্কুলার কী?
কার্লাইল সার্কুলারের ভূমিকা –
1905 খ্রিস্টাব্দে ভারতের বড়োলাট লর্ড কার্জন বাংলা দ্বিখণ্ডিত করেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে সংঘটিত বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে বাংলার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। তবে বাংলার ছাত্রসমাজ ছিল এই আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি।
স্বদেশি আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা –
বাংলার ছাত্রসমাজ স্বদেশি আন্দোলনে নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে যোগদান করে। বিদেশি পণ্যদ্রব্য বর্জন, সরকারি স্কুল-কলেজ বয়কট, রাজনৈতিক সভায় অংশগ্রহণ প্রভৃতির মাধ্যমে বাংলার জনসমাজকে তারা উজ্জীবিত করে তোলে।
কার্লাইল সার্কুলার ঘোষণা –
ছাত্রসমাজের এই একনিষ্ঠ ভূমিকা ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করে তোলে। স্বদেশি আন্দোলনের মূল প্রাণশক্তি যেহেতু বাংলার ছাত্রসমাজ, তাই আন্দোলন থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রেখে আন্দোলনকে দুর্বল করাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। সরকার এসময় দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। 1905 খ্রিস্টাব্দের 10 অক্টোবর ছাত্রদের বিরুদ্ধে দমনমূলক কার্লাইল সার্কুলার জারি করা হয়।
কার্লাইল সার্কুলারের বক্তব্য –
কার্লাইল সার্কুলারে বলা হয় –
- সরকারি নির্দেশ অমান্য করলে বা ছাত্ররা যদি স্কুল বা কলেজ পরিত্যাগ করে তাহলে তার সরকারি অনুমোদন বন্ধ করে দেওয়া হবে।
- এসময় বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের অনুমোদন বাতিল করে বহু ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয় ইত্যাদি।
অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি গঠন –
কার্লাইল সার্কুলারের প্রতিবাদে 1905 খ্রিস্টাব্দের 4 নভেম্বর বিশিষ্ট ছাত্রনেতা শচীন্দ্রপ্রসাদ বসুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রদের শিক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা করা এবং স্বদেশি আন্দোলনের প্রচার ও প্রসার ছিল এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য।
অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির ভূমিকা –
1905 খ্রিস্টাব্দের 4 নভেম্বর শচীন্দ্রপ্রসাদ বসুর নেতৃত্বে অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির সম্পাদক ছিলেন শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু ও সভাপতি ছিলেন কৃষ্ণকুমার মিত্র।
অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পটভূমি –
1905 খ্রিস্টাব্দে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের আমলে বাংলা ভাগ (বঙ্গভঙ্গ) করা হয়। এর প্রতিবাদে সারা বাংলা জুড়ে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। বাংলার স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ব্যাপকভাবে এই আন্দোলনে যোগদান করে। সরকার ছাত্রদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখার জন্য ছাত্রবিরোধী বিভিন্ন সার্কুলার জারি করে। যেমন –
- কার্লাইল সার্কুলার (10 অক্টোবর, 1905 খ্রিস্টাব্দ)।
- লিয়ন সার্কুলার (16 অক্টোবর, 1905 খ্রিস্টাব্দ)।
- পেডলার সার্কুলার (21 অক্টোবর, 1905 খ্রিস্টাব্দ) প্রভৃতি।
অ্যান্টি-সার্কুলারগুলির মূল কথা –
ছাত্রবিরোধী এইসব সার্কুলারের মূল বক্তব্য ছিল যেসব ছাত্ররা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করবে তাদের স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হবে। ছাত্রদের ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দেওয়ার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি প্রতিষ্ঠা –
ছাত্রবিরোধী সার্কুলারগুলি প্রয়োগ করে আন্দোলনে যোগদানকারী অনেক ছাত্রকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ ছাত্রনেতা শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু ‘অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন 1905 খ্রিস্টাব্দের 4 নভেম্বর।
অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি –
অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিগুলি হল –
- বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রদের শিক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা করা।
- অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে স্বদেশি দ্রব্য বিক্রির ব্যবস্থা করা।
- স্বদেশি আন্দোলনের প্রচার ও প্রসার এবং বিদেশি দ্রব্য বয়কট করা।
অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির মূল্যায়ন –
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির গুরুত্ব অপরিসীম। এটি ছিল সরকারের ছাত্রবিরোধী বিভিন্ন সার্কুলারের যোগ্য জবাব। অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির মাধ্যমে স্বদেশি আন্দোলন আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে।
অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো।
অসহযোগ আন্দোলনের ভূমিকা –
1920 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। অসহযোগ আন্দোলনের মূল কথা ছিল ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কোনোরূপ সহযোগিতা না করা। গান্ধিজি ঘোষণা করেছিলেন, বিদেশি সরকারের সঙ্গে কোনোরকম সহযোগিতা করা পাপ। অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি –
গান্ধিজি বলেছিলেন, চাষ করার আগে খেত থেকে আগাছা (ইংরেজি শিক্ষা) উপড়ে ফেলা আবশ্যক। অসহযোগ আন্দোলনে দু-ধরনের কর্মসূচি ছিল –
- ইতিবাচক (Positive) বা গঠনমূলক এবং
- নেতিবাচক (Negative) বা ধ্বংসাত্মক।
- ইতিবাচক কর্মসূচির মধ্যে ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, দেশীয় বস্তু বা খদ্দরের ব্যবহার, চরকার ব্যবহার, আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ প্রভৃতি।
- নেতিবাচক কর্মসূচির মধ্যে ছিল স্কুল-কলেজ, সরকারি চাকরি, সরকারি খেতাব, বিদেশি দ্রব্য প্রভৃতি বর্জন করা।
অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা –
অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রদের নেতিবাচক কার্যাবলি –
অসহযোগ আন্দোলনের নেতিবাচক কর্মসূচি সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছিল শিক্ষাক্ষেত্রে। বাংলায় 1921 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে প্রায় 20 জন করে শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষক পদত্যাগ করেছিলেন সরকারি স্কুলগুলি থেকে। ছাত্রদের মধ্যে 11,157 জন ছাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ছাত্রদের এই আন্দোলন বাংলা, বোম্বাই, পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সময় চিত্তরঞ্জন দাশ বলেছিলেন, ‘Education can wait, Swaraj cannot.’
- ছাত্ররা বিদেশি দ্রব্য বয়কটের জন্য প্রচার করে।
- বিদেশি দ্রব্য যেমন – কাপড়, নুন, চিনি, মদ প্রভৃতির দোকানের সামনে পিকেটিং করে।
অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রদের ইতিবাচক কার্যাবলি –
ছাত্ররা অসহযোগ আন্দোলনের ইতিবাচক কর্মসূচি রূপায়ণেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
- ছাত্ররা দেশীয় দ্রব্য ব্যবহারের জন্য প্রচার শুরু করে।
- জাতীয় আন্দোলনে প্রয়োজনীয় অর্থসংগ্রহে সহায়তা করে।
- অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেকগুলি জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল – জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, কাশী বিদ্যাপীঠ, গুজরাট বিদ্যাপীঠ ইত্যাদি। তা ছাড়া বাংলায় 190টি, বিহারে 442টি, বোম্বাই-এ 189টি এবং যুক্তপ্রদেশে 137টি জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
- 1921 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের যুবরাজ প্রিন্স অফ ওয়েলস ভারতে এলে ছাত্ররা কলকাতা শহরে ধর্মঘট পালন করে। ছাত্ররা কালো পতাকা নিয়ে ‘যুবরাজ ফিরে যাও’ ধ্বনি দেয়।
অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রদের মূল্যায়ন –
অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্ররা গান্ধিজি নির্দেশিত অহিংস পথে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। ছাত্রদের যোগদানের ফলে এই আন্দোলন গণচরিত্র লাভ করে।
আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো।
আইন অমান্য আন্দোলনের ভূমিকা –
1930 খ্রিস্টাব্দের 12 মার্চ গান্ধিজি 78 জন অনুগামী নিয়ে সবরমতী আশ্রম থেকে 24 দিনে 241 মাইল পথ অতিক্রম করে 5 এপ্রিল গুজরাটের ডান্ডিতে পৌঁছোন। 6 এপ্রিল ডান্ডির সমুদ্রতটে গান্ধিজি নিজের হাতে লবণ তৈরি করে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন। এরপর সারা দেশে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। এই আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা –
ছাত্ররা বিভিন্নভাবে আইন অমান্য আন্দোলনে শামিল হয়।
- আইন অমান্য আন্দোলনেও ছাত্ররা স্কুল-কলেজ বয়কট করে।
- বিদেশি দ্রব্যের দোকানের সামনে পিকেটিং করে।
- বিদেশি দ্রব্যে অগ্নিসংযোগ করে।
আইন অমান্য আন্দোলনের বিস্তার –
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্ররা আইন অমান্য আন্দোলনে শামিল হয়। বাংলা, গুজরাট, আসাম, যুক্তপ্রদেশ ইত্যাদি অঞ্চলে এই আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা যায়।
- গুজরাটে – গুজরাটের সুরাট, আহমেদাবাদ, খেদা জেলার স্কুল-কলেজের ছাত্ররা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নেয়।
- বাংলায় – কলকাতার ছাত্র ও শিক্ষক সম্প্রদায় আইন অমান্য আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়।
- বরিশালে ছাত্রীরা কলেজের প্রবেশপথে ছাত্র-শিক্ষকদের পথ আটকান। পুলিশ ব্রিটিশ পতাকা (ইউনিয়ন জ্যাক) লাগানো গাড়িতে করে এলে ছাত্রীরা স্লোগান দেয় – ‘up up national flag, down down the Union Jack’।
- মধ্যপ্রদেশে – মধ্যপ্রদেশে স্কুল ও কলেজগুলিতে বয়কট আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। এখানের সব সরকারি কলেজ, 18টি উচ্চ সরকারি বিদ্যালয় এবং 4টি অ্যাংলো-ভার্নাকুলার বিদ্যালয় আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধ থাকে।
- আসামে – আসামের ছাত্র আন্দোলনের চাপে সরকার বিচলিত হয়ে পড়ে। এর প্রতিবাদে প্রায় 3 হাজার ছাত্র স্কুল ছেড়ে ধর্মঘট পালন করে। আসামে সরকারি স্কুল-কলেজে আক্রমণ করা হয়েছিল। সাতটি স্কুলে আগুনও লাগানো হয়েছিল। আসাম থেকে মোট 2373 জনকে গ্রেফতার করা হয়।

আইন অমান্য আন্দোলনের সরকারি দমননীতি –
1930 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1933 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা দমনপীড়ন চলতে থাকে। ছাত্র-যুব সংগঠনগুলি বেআইনি বলে ঘোষিত হয়। নির্দেশ জারি করা হয় যে, ছাত্রদের রাতে বাইরে থাকা যাবে না, তাদের সঙ্গে পরিচয়পত্র রাখতে হবে ইত্যাদি। বিভিন্ন কারণে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীদের স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের মূল্যায়ন –
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আইন অমান্য আন্দোলন ছাত্রদের অংশগ্রহণে ব্যাপক আকার ধারণ করে। ছাত্র আন্দোলন দমন করার জন্য শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তা কানিংহাম একটি নির্দেশিকা জারি করে ছাত্রদের আন্দোলনে যোগদানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ভূমিকা –
1942 খ্রিস্টাব্দের 9 আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিস্তার –
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। বোম্বাই, বাংলা, বিহার, যুক্তপ্রদেশ, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ প্রভৃতি অঞ্চলে আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্রদের ভূমিকা –
- বোম্বাই – জাতীয় নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে 9 আগস্ট বোম্বাই শহরে প্রথমে গোয়ালিয়র ট্যাংক ময়দানে ও পরে শিবাজি পার্কে বিশাল জনসভা হয়। এখানে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- আহমেদাবাদ – আহমেদাবাদে ছাত্রদের নেতৃত্বে হরতাল, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, থানায় আগুন লাগানো ইত্যাদি ঘটনার ফলে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বরোদার ছাত্ররাও স্কুল-কলেজে ধর্মঘট পালন করে।
- বিহার – বিহারের পাটনায় ছাত্র-আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। 11 আগস্ট পাটনার মহাকরণে জাতীয় পতাকা তোলা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ ঘটে। এই সংঘর্ষে 7 জন ছাত্রের মৃত্যু হয়। এরপর বিহারের বিভিন্ন জায়গায় পথ অবরোধ, রেললাইন ও সেতু ধ্বংস করা, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তার ছিঁড়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়।
- যুক্তপ্রদেশ – বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গান্ধিজির ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ বাণী বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে এলাহাবাদ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়েছিল।
- বাংলা – কলকাতার ছাত্ররা স্কুল-কলেজ বয়কট করে। তারা সভাসমিতি, মিটিং-মিছিল, পথ অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচির দ্বারা আন্দোলনে শামিল হয়। 15 আগস্ট ঢাকায় ছাত্ররা ধর্মঘট করে। এই সময় ঢাকায় 5 জন পুলিশের গুলিতে মারা যায়। এর প্রতিবাদে বাংলার স্কুল-কলেজে ধর্মঘট পালিত হয়।
- উড়িষ্যা – উড়িষ্যায় ছাত্র-আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। সরকারি রিপোর্টে উড়িষ্যার ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে ‘পুরোপুরি ছাত্র বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করা হয়।
- মাদ্রাজ – মাদ্রাজের স্কুল-কলেজে ছাত্ররা ধর্মঘট করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের মূল্যায়ন –
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের যোগদান প্রমাণ করেছিল যে, ভারতবাসী স্বাধীনতার জন্য সমস্ত রকম ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। ছাত্রদের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে ভারত ছাড়ো আন্দোলন মূলত ছাত্র-যুব আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের মুক্তির দাবিতে ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।
আজাদ হিন্দ ফৌজের ভূমিকা –
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিচারকে কেন্দ্র করে সংগঠিত গণবিক্ষোভ ছিল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। 1945 খ্রিস্টাব্দের 24 আগস্ট ভারত সরকার ঘোষণা করে যে, দিল্লির লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের বিচার হবে। এই বিচারকে কেন্দ্র করে ভারতে ছাত্র আন্দোলন উত্তাল রূপ ধারণ করে।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের মুক্তির দাবিতে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলন –
দিল্লির লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের বিচার শুরু হলে সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র দেশের মানুষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়। ছাত্রদের ভূমিকা ছিল এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
- ছাত্রদের মিছিল – কলকাতায় কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক, মুসলিম লিগ প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলি সংঘবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করে। 1945 খ্রিস্টাব্দের 21 নভেম্বর কয়েকশো ছাত্র জাতীয় ঐক্যবদ্ধতার প্রতীকরূপে রাজনৈতিক দলের পতাকা হাতে নিয়ে আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তির দাবিতে কলকাতার ধর্মতলা স্ট্রিটে ডালহৌসি স্কোয়ার অবরোধ করে।
- মিছিলে গুলিচালনা – ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ছাত্র-সহ আরও বেশ কিছু ছাত্র আহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলকাতায় গণবিক্ষোভ তীব্রতর রূপ নেয়।
- গুলিচালনার প্রতিবাদে ধর্মঘট – বিক্ষোভকারী ছাত্রদের উপর পুলিশ নির্মমভাবে গুলি চালালে তার প্রতিবাদে ছাত্ররা 22 ও 23 নভেম্বর ধর্মঘটের ডাক দেয়। বাস, ট্রেন, ট্যাক্সিসহ অফিস আদালত বন্ধ থাকে।
- সরকারি রিপোর্ট – আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের বিচারের প্রতিবাদে ছাত্রদের বিক্ষোভ আন্দোলন সরকারি মহলে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন বাংলার ছোটোলাট কেসি বড়োলাট ওয়াভেলকে লিখেছিলেন যে ‘সমগ্র পরিস্থিতি অত্যন্ত বিস্ফোরক ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।’
আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের মুক্তির দাবিতে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলনের উপসংহার –
পরিশেষে বলা যায়, আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের বিচারে প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ছাত্রবিক্ষোভ পরবর্তীকালে আরও বৃহত্তর ছাত্র-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।
রশিদ আলি দিবস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
রশিদ আলি দিবসের ভূমিকা –
রশিদ আলি ছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপটেন। ব্রিটিশ সরকারের সামরিক আদালতে তাঁকে 7 বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার প্রতিবাদে 1946 খ্রিস্টাব্দের 11 থেকে 13 ফেব্রুয়ারি কলকাতায় গণ আন্দোলন হয় এবং 12 ফেব্রুয়ারি দিনটি রশিদ আলি দিবস হিসেবে পালিত হয়।
রশিদ আলি দিবসে কলকাতার আন্দোলন –
ক্যাপটেন রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে কলকাতা গণ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। কমিউনিস্ট দলের ছাত্র সংগঠন, মুসলিম লিগের ছাত্র সংগঠন এবং জাতীয় কংগ্রেস একজোট হয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ লাহিড়ী, মুসলিম লিগের নেতা সুরাবর্দি, গান্ধিবাদী নেতা সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত প্রমুখ। আন্দোলনকারীরা মিটিং, মিছিল, ধর্মঘট প্রভৃতির মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা করেছিল।
রশিদ আলি দিবসে সরকারের দমননীতি –
আন্দোলন দমন করার জন্য সরকার সেনাবাহিনী নিয়োগ করে। আন্দোলকারীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ বাঁধে এবং সরকারি মতে 84 জন নিহত ও 3000 জন আহত হয়; যদিও বেসরকারি মতে নিহতের সংখ্যা ছিল 200-র বেশি।
রশিদ আলি দিবসের মূল্যায়ন –
আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈন্য রশিদ আলির বিচারকে কেন্দ্র করে যে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা ভারতীয় জনমানসে প্রবল উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল। অপরপক্ষে এই আন্দোলন ব্রিটিশ সরকার ও জনগণের মনে ভয়ের সঞ্চার করেছিল এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পটভূমি রচনা করে দিয়েছিল।
বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনে অনুশীলন সমিতির কী ভূমিকা ছিল?
বাংলায় বিপ্লবীদের ভূমিকা –
বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লববাদের প্রসারে গুপ্তসমিতির ভূমিকা ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই গুপ্তসমিতিগুলির মাধ্যমেই মূলত বাংলার ছাত্রসমাজ সশস্ত্র বৈপ্লবিক কাজে অংশগ্রহণ করে। বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন প্রসারে এরকমই এক গুপ্তসমিতি হল অনুশীলন সমিতি।
বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনে অনুশীলন সমিতির ভূমিকা –
বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনায় অনুশীলন সমিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনে অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠা –
1902 খ্রিস্টাব্দের 24 মার্চ সতীশচন্দ্র বসু এবং ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অনুশীলন তত্ত্ব’ -এর আদর্শে অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একই বছরে 108 সি আপার সার্কুলার রোডে অরবিন্দ ঘোষের নির্দেশে যতীন্দ্রনাথ বিপ্লবী গুপ্তসমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এই দুই গুপ্তসমিতি যুক্ত হয়ে অনুশীলন সমিতি নামে খ্যাত হয়।
বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনে অনুশীলন সমিতির উদ্দেশ্য –
- শরীররচর্চা ও লাঠিখেলার মাধ্যমে যুবশক্তির মধ্যে ক্ষাত্রশক্তির উন্মেষ ঘটানো।
- ইংরেজ কর্মচারীদের হত্যার মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করা – সর্বোপরি ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানোই ছিল অনুশীলন সমিতির মূল উদ্দেশ্য।
বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনে অনুশীলন সমিতির কার্যাবলি –
- 1905 খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অনুশীলন সমিতি অধিকতর সক্রিয় হয়ে ওঠে।
- এই দলের সদস্যরা গোপনে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালাতেন। পরবর্তীকালে 1906 খ্রিস্টাব্দে অনুশীলন সমিতির সদস্যদের একাংশ যুগান্তর পত্রিকার মাধ্যমে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রচার করেন এবং যুগান্তর দল নামে পরিচিত হয়।
বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনে অনুশীলন সমিতির উপসংহার –
1909 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সাময়িকভাবে বৈপ্লবিক কাজকর্ম স্থগিত থাকলেও পরবর্তীকালে পুনরায় দলের বিপ্লববাদ সক্রিয় হয়ে ওঠে।
বিপ্লবী আন্দোলনে ক্ষুদিরামের অবদান কী ছিল?
বিপ্লবী আন্দোলনে ক্ষুদিরামের ভূমিকা –
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের বীর অগ্নিসন্তান ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম বিপ্লবী যিনি ফাঁসির মঞ্চে শহিদ হয়েছিলেন। ক্ষুদিরাম বসুর আত্মবলিদান বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করেছিল।
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে ক্ষুদিরাম বসু-র অবদান –
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে ক্ষুদিরাম বসু-র অবদান চিরস্মরণীয়।
- পূর্ব পরিচয় – ক্ষুদিরাম বসু 1889 খ্রিস্টাব্দের 3 ডিসেম্বর মেদিনীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। এখানকার হ্যামিলটন স্কুল ও কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষালাভের পর তিনি বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন এবং যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত হন।
- কিংসফোর্ড হত্যার দায়িত্বলাভ – কিংসফোর্ড ছিলেন কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলার বিপ্লবীদের উপর ভয়ংকর নির্যাতনের নির্দেশ দিতেন। তাঁর নির্মম অত্যাচারের উপযুক্ত শাস্তি হিসেবে বাংলার বিপ্লবীরা তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে কিংসফোর্ড মজফ্ফরপুরে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। মজফ্ফ্ফরপুরে গিয়ে কিংসফোর্ডকে হত্যা করার দায়িত্ব পান বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি।
- কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা – ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি মজফ্ফরপুরে গিয়ে 1908 খ্রিস্টাব্দের 30 এপ্রিল রাত আটটা নাগাদ পরিকল্পনামতো একটি ঘোড়ার গাড়ির উপর বোমা ছোঁড়েন। কিন্তু সেটি কিংসফোর্ডের গাড়ি ছিল না। ভুলবশত কিংসফোর্ডের জায়গায় ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা বোমার আঘাতে মারা যান।
- পরিণতি – ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যার পর প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করেন এবং মজফ্ফ্ফরপুর থেকে 24 মাইল দূরে ওয়াইনি স্টেশনে ক্ষুদিরাম বসু পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। বিচারে 1908 খ্রিস্টাব্দের 11 আগস্ট তাঁর ফাঁসি হয়। ক্ষুদিরাম বসুর এই আত্মবলিদান বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
1920 -এর দশকের শেষদিকে, বিশেষ করে আইন অমান্য আন্দোলনপর্বে বাংলায় সশস্ত্র বৈপ্লবিক কার্যকলাপের পরিচয় দাও।
1920 -এর দশকের শেষদিকের ভূমিকা –
ভারতবর্ষে 1920 ও 1930 -এর দশক ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। অসহযোগ, আইন অমান্য আন্দোলনের পাশাপাশি বাংলায় সশস্ত্র বৈপ্লবিক কার্যকলাপ আলোচ্য কালপর্বকে বিশিষ্টতা প্রদান করেছিল। আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে বিশেষ সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়।
আইন অমান্য আন্দোলনপর্বে বাংলায় সশস্ত্র বৈপ্লবিক কার্যকলাপ –
বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লববাদী কার্যকলাপ আইন অমান্য আন্দোলনের সময় আরও প্রবল আকার ধারণ করেছিল। এসময় সংঘটিত কতকগুলি বৈপ্লবিক কার্যকলাপ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল। যথা –
- চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন – মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে 1930 খ্রিস্টাব্দের 18 এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন আলোচ্য কালপর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে 6 জন বিপ্লবীর একটি দল পুলিশের অস্ত্রাগার লুঠ করে। লোকনাথ বলের নেতৃত্বে 10 জন সদস্যের অপর একটি দল সেনাবাহিনীর অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বিপ্লবীরা জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। 22 এপ্রিল ব্রিটিশ পুলিশ জালালাবাদ পাহাড়ে আক্রমণ চালালে বহু বিপ্লবী নিহত হন ও অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
- পাহাড়তলির ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ – মাস্টারদা সূর্য সেনের অন্যতম অনুগামী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে কালিকিঙ্কর দে, মণি দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী প্রমুখ বিপ্লবীরা 1932 খ্রিস্টাব্দে পাহাড়তলির ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ না করার অভিপ্রায়ে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
- রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান – বিপ্লবী বিনয়-বাদল-দীনেশ মিলিতভাবে 1930 খ্রিস্টাব্দের 8 ডিসেম্বর বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের মূল কেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন। এখানে তাঁদের আক্রমণে কারা বিভাগের ইনস্পেকটর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন নিহত হন। এরপর তাঁরা রাইটার্স বিল্ডিং -এর অলিন্দে এসে গুলি চালাতে থাকেন। নিরাপত্তারক্ষীরাও তাঁদের পালটা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। ইতিহাসে এই ঘটনা অলিন্দ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই ঘটনার পর বিনয় ও দীনেশ নিজেদের গুলি করে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে আহত হন এবং বাদল পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
- গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যার চেষ্টা – বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবের যুগের এক অগ্নিকন্যা হলেন বীণা দাস। 1932 খ্রিস্টাব্দের 6 ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন ভাষণ দিচ্ছিলেন। এই সময় বীণা দাস মঞ্চে জ্যাকসনকে লক্ষ করে গুলি করেন। কিন্তু তাঁর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং ধরা পড়ার পর বিচারে তাঁর 9 বছর মেয়াদের কারাদণ্ড হয়।
আইন অমান্য আন্দোলনপর্বে বাংলায় সশস্ত্র বৈপ্লবিক কার্যকলাপের উপসংহার –
এভাবে আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে বাংলায় বৈপ্লবিক কার্যকলাপ সক্রিয় রূপ ধারণ করে, যা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ভিত্তিকে আরো সুদৃঢ় করতে সাহায্য করেছিল।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের ভূমিকা –
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স হল বাংলার একটি বিপ্লবী গুপ্তসমিতি। 1928 খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। এর অন্যতম সংগঠক ছিলেন মেজর সত্য গুপ্ত। তবে এই দলের সর্বময় নেতা ছিলেন হেমচন্দ্র ঘোষ। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সকে সংক্ষেপে বি ভি (B.V) বলা হত। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই দলের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। এদের মধ্যে মেদিনীপুর শাখাটি ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের প্রধান কর্মীবৃন্দ –
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের প্রধান কর্মীরা সমবেতভাবেই দল পরিচালনা করতেন। হেমচন্দ্র ঘোষ ছাড়া এর অন্যান্য প্রধান কর্মীরা ছিলেন হরিদাস দত্ত, সত্য গুপ্ত, মীরা দত্তগুপ্তা, সত্যরঞ্জন বক্সী প্রমুখ।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্যদের উল্লেখযোগ্য কাজ –
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্যদের উল্লেখযোগ্য কাজগুলি হল –
- বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্তের রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান।
- প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য কর্তৃক ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাসকে হত্যা।
- অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন দত্ত কর্তৃক ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট বার্জকে হত্যার চেষ্টা।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের অন্যান্য বিপ্লবী সদস্য –
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের অন্যান্য বিপ্লবী সদস্যরা হলেন ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়, নির্মলজীবন ঘোষ, নবজীবন ঘোষ প্রমুখ।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের অবসান –
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের বিভিন্ন নেতা ও কর্মী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। জেলে থাকার সময়েই এই দলের নেতারা আলাপ-আলোচনা করে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল ভেঙে দেন। এই উদ্দেশ্যে 1937 খ্রিস্টাব্দে হেমচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে বক্সা ক্যাম্পে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সদস্যরা সমবেত হন। পরবর্তীকালে এই দলের সদস্যরা সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ দলে যোগদান করেন।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের মূল্যায়ন –
বিংশ শতকের প্রথম থেকেই বাংলা বিপ্লবী আন্দোলনের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলই ছিল এর প্রধান চালিকাশক্তি। এই দলের কার্যকলাপ ব্রিটিশ সরকারকে শঙ্কিত করে তুলেছিল।
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে বিনয়-বাদল-দীনেশের ভূমিকা কী ছিল?
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে বিনয়-বাদল-দীনেশের ভূমিকা –
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে অগ্নিযুগের তিন বিখ্যাত বিপ্লবী হলেন – বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত। এঁরা বিনয়-বাদল-দীনেশ বা সংক্ষেপে ‘বি-বা-দী’ নামেও পরিচিত। এঁদের উল্লেখযোগ্য বিপ্লবী কার্যাবলি ছিল মহাকরণ বা রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান।
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে বিনয়-বাদল-দীনেশের পরিচয় –
- বিনয়কৃষ্ণ বসু – বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্য ও মেডিক্যাল ছাত্র বিনয়কৃষ্ণ বসু ঢাকায় পুলিশের ইনস্পেকটর জেনারেল লোম্যানকে হত্যা (1930 খ্রিস্টাব্দের 31 আগস্ট) করার পর ছদ্মবেশে কলকাতায় পালিয়ে আসেন।
- বাদল গুপ্ত – ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে যোগদান করেছিলেন। তিনি ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ (বি ভি) -এর লেফটেন্যান্ট পদপ্রাপ্ত ছিলেন।
- দীনেশ গুপ্ত – বাংলার অন্যতম বিপ্লবী বিনয় ও বাদলের সহযোগী বিপ্লবী ছিলেন দীনেশ গুপ্ত।
রাইটার্স বিল্ডিং (মহাকরণ) অভিযান ও অলিন্দ যুদ্ধ –
বিনয়-বাদল-দীনেশ মিলিতভাবে 1930 খ্রিস্টাব্দের 8 ডিসেম্বর বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের মূল কেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন। এখানে তাঁদের আক্রমণে কারা বিভাগের ইনস্পেকটর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন নিহত হন। বিচার বিভাগের সচিব নেলসন গুলিবিদ্ধ ও চিফ সেক্রেটারি টাউনসেন্ট-সহ অনেকে আহত হন। এরপর তাঁরা রাইটার্স বিল্ডিং -এর অলিন্দে এসে গুলি চালাতে থাকেন। এর মধ্যে নিরাপত্তারক্ষীরাও তাঁদের ঘিরে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এই ঘটনা ইতিহাসে অলিন্দ যুদ্ধ নামে পরিচিত।
অলিন্দ যুদ্ধে বিপ্লবীদের পরিণতি –
এই ঘটনার পর তাঁরা ইংরেজদের হাতে ধরা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিনয় ও দীনেশ নিজেদের গুলি করে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে আহত হন। বাদল পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বিনয় হাসপাতালে মারা যান। দীনেশ গুপ্ত বেঁচে ওঠেন এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয় (1931 খ্রিস্টাব্দের 7 জুলাই)।
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে বিনয়-বাদল-দীনেশের মূল্যায়ন –
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিনয়-বাদল-দীনেশ স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলার এই বিপ্লবী ত্রয়ীকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম বদলে বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ (বি-বা-দী বাগ) রাখা হয়েছে।
মাস্টারদা সূর্য সেন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
মাস্টারদা সূর্য সেনের ভূমিকা –
ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মাস্টারদা সূর্য সেন বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি চট্টগ্রাম জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন বলে ‘মাস্টারদা’ নামে পরিচিত হয়েছেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল 1930 খ্রিস্টাব্দের 18 এপ্রিল চট্টগ্রামের দুটি অস্ত্রাগার লুণ্ঠন।
মাস্টারদা সূর্য সেনের আদর্শ –
মাস্টারদা বিশ্বাস করতেন যে, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ব্রিটিশদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা যাবে।
মাস্টারদা সূর্য সেনের অনুগামী –
মাস্টারদার অনুগামীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, অনন্ত সিং, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত প্রমুখ।
মাস্টারদা সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন –
1930 খ্রিস্টাব্দের 18 এপ্রিল রাত 10টায় গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে 6 জন বিপ্লবীর একটি দল পুলিশের অস্ত্রাগার লুঠ করে। লোকনাথ বলের নেতৃত্বে 10 জন সদস্যের অপর একটি দল সেনাবাহিনীর অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে। বিপ্লবীরা রেলচলাচল, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে চট্টগ্রামে ‘অস্থায়ী স্বাধীন সরকার’ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে।
জালালাবাদের মুক্তিযুদ্ধ –
অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বিপ্লবীরা জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল। 22 এপ্রিল ব্রিটিশ পুলিশ জালালাবাদের পাহাড়ে আক্রমণ চালালে 80 জনের বেশি পুলিশ ও 12 জন বিপ্লবী নিহত হন এবং বিপ্লবীদের অনেকে পালিয়ে যেতেও সক্ষম হন।
মাস্টারদা সূর্য সেনের গ্রেফতার –
তিন বছর আত্মগোপনের পর 1933 খ্রিস্টাব্দের 16 ফেব্রুয়ারি মাস্টারদা গ্রেফতার হন এবং বিচারে 1934 খ্রিস্টাব্দের 12 জানুয়ারি তাঁর ফাঁসি হয়।
মাস্টারদা সূর্য সেনের মূল্যায়ন –
বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদের যুদ্ধে যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন তা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার জালালাবাদের মুক্তিযুদ্ধকে ইংরেজদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রথম দৃষ্টান্ত’ বলে অভিহিত করেছেন।
ভগৎ সিং ইতিহাসে স্মরণীয় কেন?
অথবা, ভগৎ সিং – টীকা লেখো।
ভগৎ সিং -এর ভূমিকা –
ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন ভগৎ সিং। ভগৎ সিং সম্পর্কে পট্টভি সীতারামাইয়া মন্তব্য করেছিলেন ‘ভগৎ সিং ছিলেন সমগ্র দেশে গান্ধিজির মতোই জনপ্রিয় ও সর্বজনবিদিত’।
ভগৎ সিং -এর বিপ্লবী জীবনে প্রবেশ –
বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদের সংস্পর্শে এসে ভগৎ সিং -এর বিপ্লবী জীবনের সূচনা হয়। 1928 খ্রিস্টাব্দে ফিরোজ শাহ কোটলা ময়দানে অন্যান্য বিপ্লবীদের সঙ্গে সমবেত হয়ে তিনি হিন্দুস্তান রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। এই দলেরই নতুন নামকরণ হয় হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন।
ভগৎ সিং -এর বিপ্লবী কার্যকলাপ –
ভগৎ সিং -এর বিপ্লবী কার্যকলাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
- স্যান্ডার্স হত্যা – সাইমন কমিশনবিরোধী মিছিলে পুলিশের লাঠির আঘাতে জননেতা লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর শান্তিবিধানে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট স্যান্ডার্সকে গুলি করে হত্যা করেন (1928 খ্রিস্টাব্দ)।
- কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা নিক্ষেপ – 1929 খ্রিস্টাব্দের 8 এপ্রিল দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় শিল্পবিরোধী বিল ও জনসুরক্ষা বিল নামক দুটি প্রতিক্রিয়াশীল জনবিরোধী বিলের বিরুদ্ধে ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত আইনসভায় বোমা নিক্ষেপ করেন।
- লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা – কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা নিক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত-সহ বেশ কয়েকজন বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। এই মামলার বিচার অনুযায়ী 1931 খ্রিস্টাব্দের 23 মার্চ লাহোর জেলে ভগৎ সিং-এর ফাঁসি হয়।
ভগৎ সিং -এর উপসংহার –
ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রগঠনই ছিল ভগৎ সিং -এর বিপ্লববাদী কার্যকলাপের মূল লক্ষ্য। তাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ভগৎ সিং -এর নাম চিরস্মরণীয়।
বিনায়ক দামোদর সাভারকর সম্পর্কে কী জানো?
বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ভূমিকা –
বিশ শতকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে সশস্ত্র বৈপ্লবিক কার্যকলাপ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। মহারাষ্ট্রও ছিল এসময় সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থল। বিনায়ক দামোদর সাভারকর ছিলেন মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মহারাষ্ট্রে বিপ্লববাদ প্রসারে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ভূমিকা –
ভারতে বিশেষত মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ভূমিকা ছিল সর্বজনবিদিত।
- অভিনব ভারত প্রতিষ্ঠা – বিনায়ক দামোদর সাভারকর বাল্যকাল থেকে বৈপ্লবিক ভাবাদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি 1899 খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে ‘মিত্রমেলা’ গড়ে তোলেন। সশস্ত্র বৈপ্লবিক কার্যাবলির প্রস্তুতির পাশাপাশি এই সমিতির যুবকদের উপযুক্ত সামরিক প্রশিক্ষণও দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। ইটালির জনপ্রিয় নেতা ম্যাৎসিনির ‘ইয়ং ইতালি’ নামক সংগঠনের অনুকরণে গঠিত ‘মিত্রমেলা’-র নাম 1904 খ্রিস্টাব্দে বদলে অভিনব ভারত রাখা হয়।
- লন্ডনে সশস্ত্র বৈপ্লবিক কার্যকলাপ – 1906 খ্রিস্টাব্দে সাভারকর লন্ডনে গিয়ে বিপ্লববাদী কার্যকলাপের সঙ্গে আরও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। লন্ডনে অবস্থিত ইন্ডিয়া হাউসের কাজকর্মের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন এবং এখান থেকে নিয়মিত ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। ভারতীয় বিপ্লবীদের সাহায্যার্থে বোমা তৈরির কলাকৌশল, অস্ত্রসামগ্রী এবং বিপ্লবী সাহিত্য সাভারকর ভারতে পাঠাতেন যা ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনায় বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।
- জ্যাকসনকে হত্যার পরিকল্পনা – বিপ্লবী সাভারকরের সক্রিয় উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় তাঁর অনুগামী ভারতীয় বিপ্লবীরা নাসিকের অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসনকে হত্যার পরিকল্পনা করে। 1909 খ্রিস্টাব্দে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের প্রেরিত অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেই অভিনব ভারতের বিপ্লবীরা জ্যাকসনকে হত্যা করে। মহারাষ্ট্রের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে এটি এক স্মরণীয় অধ্যায়।
- নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা – জ্যাকসন হত্যার সঙ্গে সাভারকরের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ আছে বলে সন্দেহ করে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে এবং শুরু হয় নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা (1910 খ্রিস্টাব্দ)। মামলার রায় অনুযায়ী বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে 26 বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
বিনায়ক দামোদর সাভারকরের উপসংহার –
1924 খ্রিস্টাব্দে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দামোদর সাভারকরের কারামুক্তি ঘটে ও এরপর তিনি হিন্দু মহাসভা-র সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। 1966 খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জীবনাবসান হয়। মহারাষ্ট্র তথা সমগ্র ভারতবর্ষে সশস্ত্র বৈপ্লবিক কার্যকলাপে তাঁর অবদানের জন্য তিনি ইতিহাসে ‘বীর সাভারকর’ নামে পরিচিত হয়ে আছেন।
গদর পার্টি সম্পর্কে কী জানো সংক্ষেপে লেখো।
গদর পার্টির ভূমিকা –
ভারতের ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের ইতিহাসে গদর পার্টির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বিশ শতকে ভারতে একদিকে যেমন বিপ্লবী ভাবধারা তথা আন্দোলনের প্রসার ঘটছিল তেমনি ভারতের বাইরে বিদেশের মাটিতেও বিপ্লবী ভাবাদর্শ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। গদর পার্টির প্রতিষ্ঠা ছিল বিদেশের মাটিতে এই ভাবাদর্শ বিস্তারের এক সার্থক রূপায়ণ।
গদর পার্টির ভূমিকা –
ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে পার্টি-র অবদান অনস্বীকার্য।
- গদর প্রতিষ্ঠা – 1913 খ্রিস্টাব্দে লালা হরদয়াল -এর সক্রিয় উদ্যোগে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে গদর পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের প্রথম সভাপতি হন মোহন সিং ভাকনা এবং সম্পাদকের পদ অলংকৃত করেন লালা হরদয়াল। গদর পার্টি প্রতিষ্ঠার স্বল্পকালের মধ্যেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রায় 15 হাজার স্বাধীনতাকামী প্রবাসী ভারতীয় এই পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন।
- পত্রিকা প্রকাশ – 1913 খ্রিস্টাব্দে গদর পার্টি প্রতিষ্ঠার পর এই পার্টির প্রধান মুখপত্র হিসেবে গদর পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে বিপ্লবী অগ্নিমন্ত্র প্রচারিত হত এই পত্রিকায়। ইংরেজি ‘গদর’ পত্রিকা হিন্দি, উর্দু, গুজরাটি প্রভৃতি ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করে আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে এবং ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দেওয়া হত।
- বিপ্লবী কার্যকলাপের প্রসার – কালক্রমে গদর পার্টি আমেরিকা ও কানাডার প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনা বিকাশে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গদর পার্টির সশস্ত্র বৈপ্লবিক কার্যকলাপ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং পার্টির বহু সদস্য ভারতে প্রত্যাবর্তন করে।
- লালা হরদয়ালের বিরুদ্ধে মামলা – 1914 খ্রিস্টাব্দের 16 মার্চ আমেরিকায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টির অপরাধে মার্কিন সরকার লালা হরদয়াল-কে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে। জামিনে মুক্তিলাভ করে তিনি সুইজারল্যান্ডে চলে যান। এই সময়ে মামলার পর ব্রিটিশ সরকার গদর পার্টি ও পত্রিকাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে।
গদর পার্টির উপসংহার –
এভাবে বিদেশের মাটিতে ও ভারতবর্ষে বিপ্লবী চেতনা বিস্তারে গদর পার্টির অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।
ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি লেখো।
ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলনের ভূমিকা –
ভারতের বিপ্লবীদের ত্যাগ, নিষ্ঠা, আদর্শ, সততা, সংগ্রামী মানসিকতা থাকলেও তারা সম্পূর্ণভাবে সফল হতে পারেনি। মার্কসবাদীদের মতে, গণসংযোগ ও গণবিপ্লব বিষয়ক উদাসীনতাই ছিল বিপ্লবীদের কৌশলগত ত্রুটি।
ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ –
বৈপ্লবিক আন্দোলন যেসব কারণে ব্যর্থ হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল –
- সাংগঠনিক দুর্বলতা – বিপ্লবীদের গুপ্তসমিতি বা সংস্থাগুলির সংগঠন ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এ প্রসঙ্গে অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দল, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স, মুক্তিসংঘ, ছাত্রীসংঘ -এর কথা বলা যায়। এই দুর্বলতা দূর করার উদ্দেশ্যে তারা অনেকসময় বিদেশি শক্তির সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
- মতভেদ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব – বিভিন্ন বিপ্লবী দলগুলির মূল লক্ষ্য এক হলেও কার্যপদ্ধতিগত মতভেদ ছিল। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বিপ্লবী আন্দোলনে ঐক্য ও সংহতির অভাব লক্ষ করা যায়।
- আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা – বিক্ষিপ্তভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় সংঘটিত হওয়ার ফলে বৈপ্লবিক আন্দোলন সফলতা পায়নি। মূলত বাংলা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্রে সম্পূর্ণরূপে বিপ্লবী প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। বিপ্লবী আন্দোলন কখনোই সর্বভারতীয় ও সর্বাত্মক রূপ পায়নি।
- হিন্দুত্বের প্রাধান্য – ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তর থেকে বিপ্লবীরা অংশগ্রহণ করেনি। বিপ্লবীদের শতকরা 90 ভাগই ছিল হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত। হিন্দু বিপ্লবী নেতাদের দ্বারা বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালিত হওয়ায় মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই আন্দোলন থেকে দূরে থাকে।
- গণভিত্তির অভাব – বিপ্লবী আন্দোলনের মূল অংশই ছিল উচ্চবিত্ত, শিক্ষক, কেরানি, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, ডাক্তার শ্রেণির মানুষ। এর পাশাপাশি প্রচুর তরুণ ছাত্র এই বিপ্লবী কার্যকলাপে শামিল হয়। কিন্তু কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণিকে নিয়ে গঠিত সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিপ্লবী আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকায় গণভিত্তি এবং গণচেতনার অভাব দেখা দেয়, যার জন্য বৈপ্লবিক আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলনের মূল্যায়ন –
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার ভারত রক্ষা আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলা-সহ সারা দেশে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করলে বৈপ্লবিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অবদান কী?
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ভূমিকা –
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হল সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলন। ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে বিপ্লবী আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অবদান –
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় ধারা হিসেবে বিপ্লববাদী আন্দোলনের অবদান সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল –
- উচ্চ আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা – স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার – এই উচ্চ আদর্শ প্রতিষ্ঠা ছিল বিপ্লবীদের লক্ষ্য। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনগুলি এই লক্ষ্যপূরণের জন্য বিপ্লবীদের আত্মবলিদানের দৃষ্টান্ত দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন। ফলে দেশবাসী স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপিত হয়ে ওঠে।
- বিপ্লবী আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা – জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী নেতাদের কার্যাবলি জনমানসে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। সরকারের কঠোরতা, বয়কট ও স্বদেশি আন্দোলনের ব্যর্থতা দেশের যুবসমাজকে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। এই প্রেক্ষাপটে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন দেশবাসীর কাছে একান্ত গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
- আন্তর্জাতিকতা – ভারতীয় বিপ্লবীরা কর্মসূত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফলে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন ভারতের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক চরিত্র লাভ করে। এ ছাড়া উপনিবেশবাদের বিরোধিতায় এবং পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত জাতির মুক্তির বাণী এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারত ও ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
- দাবি আদায়ের কৌশল – বিপ্লবীরা তাদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ অবলম্বন করেন। গুপ্তহত্যার মাধ্যমে ব্রিটিশ আমলাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে সরকারি দাবিপূরণে বাধ্য করানোর চেষ্টা করলে আংশিকভাবে তা সফলও হয়।
- প্রেরণা – বিপ্লবীদের কার্যকলাপ পরবর্তী প্রজন্মকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। তাদের আদর্শই পরবর্তীকালে ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সুদৃঢ় রূপদান করেছিল।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের উপসংহার –
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে এই অসীম সাহসী বীর বিপ্লবীদের আত্মদান অমর হয়ে আছে। তাঁদের কার্যকলাপ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁদের অবদান চিরস্মরণীয়।
ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো।
ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের ভূমিকা –
বহু ত্যাগ ও আত্মবিসর্জন সত্ত্বেও বিপ্লবীরা যদিও আশানুরূপ সফলতা পাননি তবু স্বাধীনতা সংগ্রামে সুদূরপ্রসারী প্রভাবের বিচারে বিপ্লবীদের অবদান ব্যর্থও হয়নি। তাই জাতীয় আন্দোলনের গুরুত্বের বিচারে বিপ্লবী অভ্যুত্থানকে অস্বীকার করা যায় না।
ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের গুরুত্ব –
বিভিন্ন কারণে বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ছিল –
- স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য – ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারার লক্ষ্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা অর্জন। বিপ্লবী আন্দোলনেরও মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা লাভ করা। তাই লক্ষ্যের অভিন্নতা থাকায় বলা যায় বিপ্লবী আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনকেই শক্তিশালী করেছিল।
- ব্রিটিশ প্রশাসনের ভীতির কারণ – বিপ্লবীদের বিপ্লববাদী কার্যকলাপ ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সম্ভাবনা তৈরি করতে না পারলেও ব্রিটিশ প্রশাসনের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকবর্গ আত্মরক্ষার জন্য সর্বদা চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন থাকত।
- স্বাধীনতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা – পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার যে কি অমূল্য তা বিপ্লবীরা নিজেদের জীবন উৎসর্গের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন। ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতার মূল্যবোধ জাগাতে বিপ্লবীরা ছিলেন অন্যতম উল্লেখযোগ্য মাধ্যম।
- সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্ভাবক – ভারতে ও ভারতের বাইরে বিপ্লবীরা অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে যেভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তাতে বলা যায়, স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্ভাবক তারাই। গুপ্তহত্যা, গুপ্ত অভিযান, এমনকি সেনাবাহিনীকেও প্রভাবিত করার পন্থা বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংগ্রামেরই পরিচায়ক।
ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের মূল্যায়ন –
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বিভিন্ন ধারা ও মতাদর্শ দ্বারা পরিপুষ্ট ছিল। বিপ্লবীদের আন্দোলন ব্যতীত জাতীয় আন্দোলনের এই ইতিহাস অসম্পূর্ণ। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকার পরিবর্তে আত্মত্যাগ শ্রেয় – দেশপ্রেমের এই শিক্ষা দিয়ে বিপ্লবীরা ভারতবাসীকে জাতীয়তাবোধে উদ্দীপিত করে তুলেছিলেন।
ভারতে দলিতদের সামাজিক অবস্থার বিবরণ দাও।
ভারতে দলিতদের ভূমিকা –
বর্ণবিভক্ত ভারতীয় হিন্দুসমাজের নিম্ন সম্প্রদায়ভুক্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দলিত নামে পরিচিত। শোষণ, নিপীড়ন, অমর্যাদা যাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল সেই দলিত সম্প্রদায়কে গান্ধিজি ‘হরিজন’ নামে আখ্যায়িত করেন। ইংরেজ সরকার তাদের তফশিলি জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে।
ভারতে দলিতদের সামাজিক অবস্থা –
- অস্পৃশ্য – জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশ হিসেবে এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় (কৃষি ও অন্যান্য) বড়ো ভূমিকা থাকলেও এই সম্প্রদায়ের সামাজিক মর্যাদা ছিল না। সমাজে এরা ‘অস্পৃশ্য’ হিসেবে বিবেচিত ছিল। সাধারণের ব্যবহার্য কূপ ও পুষ্করিণী ব্যবহারের অধিকার এই শ্রেণির মানুষদের ছিল না। এদের ছোঁয়া লাগলে উচ্চবর্ণের মানুষদের ‘জাত’ চলে যেত। তাদের আবার প্রায়শ্চিত্ত করতে হত।
- শিক্ষার অভাব – দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার অভাব ছিল। অল্পসংখ্যক মানুষ পাশ্চাত্য শিক্ষালাভ করলেও বেশিরভাগ মানুষ শিক্ষার সুযোগ লাভ করেনি। ফলে সামাজিক অমর্যাদা এবং দুর্ভাগ্যকে তারা স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করত। শিক্ষার অভাবের জন্য তারা চাকরি ও অন্যান্য সরকারি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
- দারিদ্র্য – যুগ যুগ ধরে শোষিত, বঞ্চিত এই সম্প্রদায় আর্থিক দিক থেকে দুর্বল ও দরিদ্র ছিল। শিক্ষার সুযোগ তারা নিতে পারেনি। জীবনযাত্রার মান ছিল খুব নীচু। ঘরবাড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ ভালো ছিল না। অভাব-দারিদ্র্যের কারণে তাদের সামাজিক মর্যাদা আরও নীচে নেমে যায়।
- অমর্যাদা – এই সম্প্রদায় হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের অধিকারী ছিল না। দক্ষিণ ভারতের কেরলে নাদার, এজহাবা সম্প্রদায় এজন্য আন্দোলন করে। ভাইকম সত্যাগ্রহ, গুরুভায়ুর সত্যাগ্রহ, কলারাম সত্যাগ্রহ ছিল এইরকম প্রতিবাদী আন্দোলন। এ ছাড়া বাংলার নমঃশূদ্রদের মতুয়া আন্দোলন ছিল সামাজিক অমর্যাদার বিরুদ্ধে সংঘটিত বিভিন্ন নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিবাদী আন্দোলন।

ভারতে দলিতদের সামাজিক অবস্থার মূল্যায়ন –
পরবর্তীকালে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত কয়েকজন দলিত সমাজসংস্কারকদের উদ্যোগ এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টায় দলিতদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকে। পরে রাজনৈতিক সুযোগ ও অধিকার লাভ করার ফলে তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা ক্রমশ উন্নতি লাভ করে।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের দলিত আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে জ্যোতিরাও ফুলের অবদান কী ছিল?
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের দলিত আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে জ্যোতিরাও ফুলের ভূমিকা –
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের দলিত আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্রের পিছিয়ে পড়া ও নিপীড়িত মানুষের নেতা জ্যোতিরাও ফুলে (1827-1890 খ্রিস্টাব্দ)-র অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
জ্যোতিরাও ফুলের যুক্তিবাদী সংস্কার –
জ্যোতিরাও ফুলে সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের উন্নতি এবং তাদের মধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি যুক্তিগ্রাহ্য প্রতিবাদ ও বক্তব্য দ্বারা মানুষের সামাজিক সমস্যা ও কুসংস্কারগুলি দূর করতে চেয়েছিলেন।
জ্যোতিরাও ফুলের সমাজসংস্কার –
মহারাষ্ট্রের সমাজজীবনে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, কুসংস্কার, বহুবিবাহ, নারীদের দুর্দশার বিরুদ্ধে তিনি সস্ত্রীক (সাবিত্রী বাঈ) জেহাদ ঘোষণা করেন। দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জ্যোতিরাও ফুলে 1873 খ্রিস্টাব্দে সত্যশোধক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।

জ্যোতিরাও ফুলের ব্রাহ্মণ্য শ্রেণির বিরোধিতা –
মহারাষ্ট্রের সমাজজীবনে ব্রাহ্মণ্য শ্রেণির একচেটিয়া আধিপত্যের তিনি তীব্র বিরোধিতা করেন। 1860 খ্রিস্টাব্দে জ্যোতিরাও ফুলে কুনবি, মালি, মাঙ, মাহার প্রভৃতি নিম্নবর্ণের মানুষদের নিয়ে ব্রাহ্মণবিরোধী অভিযান শুরু করেন। তিনি মনে করতেন, শূদ্রদের সামাজিক দাসত্ব বজায় রাখার জন্য ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রগ্রন্থগুলি রচিত এবং হিন্দুধর্মের ইতিহাস হল শূদ্রদের উপর ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ইতিহাস। তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের তীব্র বিরোধিতা করে গুলামগিরি (1973 খ্রিস্টাব্দ), ব্রাহ্মণচে কসাব (পুরোহিততন্ত্রের স্বরূপ), শ্বেতকার্যচ অসুদ (কৃষকদের চাবুক) প্রভৃতি গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যবিরোধী আন্দোলনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
জ্যোতিরাও ফুলের প্রতিষ্ঠিত নিম্নবর্ণের উন্নতি –
জ্যোতিরাও ফুলে প্রতিষ্ঠিত সত্যশোধক সমাজ নিম্নবর্ণ ও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির উদ্দেশ্যে আন্দোলন চালিয়ে যায়। এই সমাজ কর্তৃক প্রকাশিত প্রথম রিপোর্টে বলা হয় যে, ব্রাহ্মণদের দাসত্ব থেকে শূদ্রদের সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যেই এই সংগঠন গড়ে উঠেছে।
জ্যোতিরাও ফুলের মূল্যায়ন –
মহারাষ্ট্র তথা দক্ষিণ ভারতের নিম্নবর্ণের মানুষদের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে জ্যোতিরাও ফুলে অসামান্য অবদানের সাক্ষ্য রাখেন। 1888 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘মহাত্মা’ উপাধিতে ভূষিত হন।
ভাইকম সত্যাগ্রহ – টীকা লেখো।
ভাইকম সত্যাগ্রহের ভূমিকা –
দক্ষিণ ভারতে বিশেষত কেরলে সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যেসকল আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, তার মধ্যে ভাইকম সত্যাগ্রহ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ভাইকম সত্যাগ্রহ –
দলিতদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ত্রিবাঙ্কুরের ভাইকম মন্দির চত্বরে কেশব মেননের নেতৃত্বে এই সত্যাগ্রহের সূচনা হয়।
- ভাইকম সত্যাগ্রহের আন্দোলন পরিচালনা – 1924 খ্রিস্টাব্দের 30 মার্চ দলিত এজহাবারা হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলে। সত্যাগ্রহীদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে মন্দির কর্তৃপক্ষ আগে থেকে মন্দির চত্বর ঘিরে রেখেছিল, যাতে দলিতরা প্রবেশ করতে না পারে। ইংরেজ সরকারও মন্দির কর্তৃপক্ষের পক্ষ সমর্থন করে সত্যাগ্রহীদের বাধা প্রদানের চেষ্টা করে।
- কংগ্রেসের ভূমিকা – দক্ষিণ ভারতে অস্পৃশ্যতার উচ্ছেদের জন্য দলিত সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেখানে কংগ্রেস বর্ণহিন্দুদের মধ্যে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে জনমত জাগরণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। গান্ধিজি নিজে 1925 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ভাইকম পরিদর্শনে যান। দলিত শ্রেণির এই আন্দোলনটি সারা ভারতব্যাপী প্রসারিত হয়। পুলিশ সত্যাগ্রহীদের এই আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে এবং বহু নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
- ভাইকম সত্যাগ্রহের পরিণতি – ভাইকম সত্যাগ্রহের পর দলিত শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা 1930 খ্রিস্টাব্দে কেরলে গুরুভাইয়ুর মন্দির-কে কেন্দ্র করে চরম আকার ধারণ করে। দলিত শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। শেষপর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের পর 1930 খ্রিস্টাব্দে ত্রিবাঙ্কুরের রাজা তিরুনাল বলরাম বর্মা ও তাঁর দেওয়ান সি পি রামস্বামী আয়ার ‘Temple Entry Proclamation’ জারি করে দলিতদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকারকে স্বীকৃতি দেন।
ভাইকম সত্যাগ্রহের উপসংহার –
এভাবে দলিতরা মন্দিরে প্রবেশের অধিকার লাভ করে। কিন্তু আইনগতভাবে ভাইকম সত্যাগ্রহ ও অন্যান্য দলিত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দলিতদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার স্বীকৃত হলেও জাতপাতভিত্তিক সামাজিক অবস্থান এবং উচ্চবর্ণের প্রাধান্যের জন্য দলিতরা অচ্ছুতই থেকে যায়।
দলিত আন্দোলনে ডঃ বি আর আম্বেদকরের ভূমিকা আলোচনা করো।
দলিত আন্দোলনের ভূমিকা –
বর্ণবিভক্ত ভারতীয় হিন্দুসমাজের নিম্ন সম্প্রদায়ভুক্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দলিত নামে পরিচিত। ‘দলিত’ নামকরণ করেন ডঃ বি আর আম্বেদকর। ‘দলন’ শব্দটি থেকে ‘দলিত’ কথাটি এসেছে। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নতির জন্য আম্বেদকর বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
ডঃ বি আর আম্বেদকরের পরিচিতি –
বাবাসাহেব নামে পরিচিত ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। নৃতত্ত্ববিদ্যা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন ও আইনশাস্ত্রে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। মহারাষ্ট্রের এক অস্পৃশ্য মাহার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা একজন সামরিককর্মী ছিলেন। সেই সূত্রে তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার সুযোগ পান। তাঁর মেধার পরিচয় পেয়ে বরোদার মহারাজা তাঁকে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা পাঠান। শিক্ষাশেষে তিনি বরোদা রাজ্যের সামরিক সচিব ও পরে বোম্বাই-এর সিডেনহাম কলেজে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হন।

দলিত আন্দোলন ও আম্বেদকরের ভূমিকা –
এরপর আম্বেদকর দলিতদের অধিকারের জন্য বিভিন্ন আন্দোলন শুরু করেন। এগুলি হল –
- দলিত সম্মেলন – ইতিপূর্বে দলিতদের উন্নতির জন্য জাস্টিস পার্টি গঠিত হয়েছিল 1916 খ্রিস্টাব্দে। এই দলের উদ্যোগে 1926 খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে দলিত নেতাদের সম্মেলন হয়। সম্মেলনে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির সমিতি গঠিত হয়। সমিতির সভাপতি হন এম সি রাজা এবং সহ-সভাপতি হন আম্বেদকর।
- অস্পৃশ্য আন্দোলন – 1927 খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর অস্পৃশ্য আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি ‘বহিষ্কৃত ভারত’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি প্রচার করেন, হিন্দুধর্ম হল নিম্নবর্ণের মানুষদের উপর আধিপত্য স্থাপনকারী একটি ধর্ম। অস্পৃশ্যতার মূল হল মনুস্মৃতি’। এজন্য তিনি 1927 খ্রিস্টাব্দে ‘মনুস্মৃতি’ গ্রন্থ পুড়িয়ে দেন।
- সত্যাগ্রহ আন্দোলন – তিনি মহারাষ্ট্রের কোলাবা জেলায় অস্পৃশ্যদের পানীয় জল ব্যবহারের দাবিতে মাহার সত্যাগ্রহ করেন 1928 খ্রিস্টাব্দে। কলারাম মন্দিরে প্রবেশের দাবিতে সত্যাগ্রহ করেন 1930 খ্রিস্টাব্দে।
- সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা – লন্ডনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে আম্বেদকর যোগ দেন। তাঁর চেষ্টায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। গান্ধিজি প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন। পুনা চুক্তির মাধ্যমে 1932 খ্রিস্টাব্দে এই সমস্যার সমাধান করা হয়। স্থির হয় বাঁটোয়ারা নীতি দ্বারা প্রাপ্ত আসনসংখ্যার দ্বিগুণ আসন দিতে হবে এই তফশিলিদের।
ডঃ বি আর আম্বেদকরের দল গঠন –
1930 খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস (AIDCC), 1937 খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন শ্রমিক দল (ILP) ও 1942 খ্রিস্টাব্দে নিখিল ভারত তফশিলি সংগঠন (AISCF) প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়।
দলিত আন্দোলনে ডঃ বি আর আম্বেদকরের মূল্যায়ন –
এভাবে আম্বেদকর দলিতদের অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম করেন। কংগ্রেস আম্বেদকরের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে জগজ্জীবন রামকে তুলে ধরে স্বার্থসিদ্ধি করে। আম্বেদকর সংবিধানের খসড়া কমিটির সভাপতিও ছিলেন। ফলত, তিনি সংবিধানে দলিতদের অধিকারগুলি সুরক্ষিত করেন।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি – টীকা লেখো।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির ভূমিকা –
ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম হাতিয়ার ও বৈশিষ্ট্য ছিল বিভেদ ও শাসননীতি। আর সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ছিল তারই ফলশ্রুতি।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি –
ভারতে বসবাসকারী হিন্দুদের সঙ্গে মুসলিম, শিখ, অনুন্নত হিন্দু, ভারতীয় খ্রিস্টান, হরিজন প্রভৃতি সম্প্রদায়ের বিভেদ সৃষ্টির দ্বারা ঐক্যে ফাটল ধরানো এবং ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে 1932 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আইনসভায় পৃথক নির্বাচনের যে অধিকার প্রদানের কথা ঘোষণা করেন, সেটি ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি নামে পরিচিত।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতিসমূহ –
1932 খ্রিস্টাব্দে র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড কর্তৃক ঘোষিত সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি-র মূল বক্তব্যগুলি হল –
- স্বার্থ অটুট রাখা – পৃথক নির্বাচন নীতি অনুসরণ করে এই বাঁটোয়ারায় মুসলমান, শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত হয়।
- প্রাদেশিক পরিষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য – এই নীতিতে বলা হয়, এই বাঁটোয়ারা কেবলমাত্র প্রাদেশিক পরিষদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
- পৃথক নির্বাচনি ব্যবস্থা ও সর্বজনীন ভোটাধিকার – শ্রমিক, বণিক, শিল্পপতি, জমিদার, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নির্দিষ্ট আসন ও পৃথক নির্বাচনি এলাকা দান করা হয়, অন্যদিকে সাধারণ নির্বাচনি এলাকায় সকলের ভোটাধিকার নির্দিষ্ট হয়।
- দলিত হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটাধিকার – হরিজন বা তফশিলি হিন্দুরা ‘সংখ্যালঘু’ বলে ঘোষিত হয় এবং তাদের জন্য আসন সংরক্ষিত হয়। পৃথক নির্বাচন ও সাধারণ নির্বাচনি এলাকার জন্য তাদের 2টি ভোটাধিকার দেওয়া হয়।
দলিত আন্দোলন বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্ক নিয়ে একটি টীকা লেখো।
দলিত আন্দোলনের ভূমিকা –
দলিত কথাটি এসেছে ‘দলন’ শব্দ থেকে, যার অর্থ হল দমিয়ে রাখা। সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষ নিম্নবর্ণের যেসব মানুষদের দমিয়ে বা পদদলিত করে রাখে, তাদের দলিত বলা হয়। ডঃ বি আর আম্বেদকর ছিলেন দলিত নেতা। মহাত্মা গান্ধি দলিতদের পক্ষে আন্দোলন করলেও দলিত অধিকার বিষয়ে গান্ধি ও আম্বেদকরের মধ্যে মতপার্থক্য বা বিতর্ক ছিল।
দলিত অধিকারের বিভিন্ন বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্ক –
অস্পৃশ্যতা বিষয়ে বিতর্ক –
আম্বেদকর অস্পৃশ্য হিন্দুদের হিন্দু সমাজ থেকে পৃথক করার কথা বলেন। তিনি অস্পৃশ্যদের জন্য একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর স্বীকৃতি আদায় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধিজি অস্পৃশ্যদের স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর স্বীকৃতি দিতে চাননি। তিনি সমাজ থেকেই অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের চেষ্টা করেছিলেন।
বর্ণব্যবস্থা বিষয়ে বিতর্ক –
আম্বেদকর বর্ণব্যবস্থার বিলোপের পক্ষপাতী ছিলেন। অন্যদিকে গান্ধিজি বর্ণব্যবস্থার সমর্থক ছিলেন। গান্ধিজির মতে, বর্ণব্যবস্থা ভারতীয় জাতির ভিত্তিস্বরূপ। তিনি বর্ণব্যবস্থার বিলোপ না করে এই ব্যবস্থায় সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার চেয়েছিলেন।
পৃথক নির্বাচন বিষয়ে (সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা) বিতর্ক –
আম্বেদকর নিম্নবর্ণের হিন্দু বা দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনের অধিকার দাবি করেছিলেন। 1932 খ্রিস্টাব্দের 17 আগস্ট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড তাঁর ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতিতে দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি মেনে নেন।
কিন্তু গান্ধিজি দলিতদের পৃথক নির্বাচনের বিরোধিতা করেন। তিনি এর বিরুদ্ধে 1932 খ্রিস্টাব্দের 20 সেপ্টেম্বর জেলে অনশন শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত আম্বেদকরকে গান্ধিজির দাবি মেনে নিতে বাধ্য করা হয়।
পুনা চুক্তি –
1932 খ্রিস্টাব্দের 24 সেপ্টেম্বর গান্ধিজি ও আম্বেদকর উভয় পক্ষের মধ্যে ‘পুনা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে –
- দলিতদের পৃথক নির্বাচনের বিষয়টি বাতিল করা হয়।
- কেন্দ্রীয় আইনসভায় দলিতদের জন্য 18 শতাংশ আসন সংরক্ষিত করা হয়।
দলিত অধিকারের বিভিন্ন বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্কের মূল্যায়ন –
দলিত অধিকার বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিরোধের মীমাংসা হয়নি। গান্ধিজি অস্পৃশ্যতা দূর করতে চেয়েছিলেন। অপরদিকে আম্বেদকর দলিতদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সার্বিক উন্নতির জন্য সচেষ্ট ছিলেন।
কোন্ প্রেক্ষাপটে পুনা চুক্তি (1932 খ্রিস্টাব্দ) স্বাক্ষরিত হয়? এই চুক্তিতে কী বলা হয়েছিল?
অথবা, পুনা চুক্তি – টীকা লেখো।
পুনা চুক্তির ভূমিকা –
ভারতবর্ষে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের প্রশ্নে ডঃ বি আর আম্বেদকর ও গান্ধিজি-র মধ্যে প্রবল বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এর ফলশ্রুতি হল পুনা চুক্তি।
পুনা চুক্তির প্রেক্ষাপট –
পুনা চুক্তির প্রেক্ষাপট হল নিম্নরূপ –
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি –
হিন্দু-মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান ঐক্যকে ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্যে র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড 1932 খ্রিস্টাব্দের 16 আগস্ট সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষণা করেন। গান্ধিজি সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির গণতন্ত্রবিরোধী চরিত্রের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানান।
গান্ধিজির অনশন –
র্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের বিভাজন নীতিকে গান্ধিজি একেবারেই সমর্থন করেননি। তিনি এ কথাও ঘোষণা করেছিলেন যে, 1932 খ্রিস্টাব্দের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির মাধ্যমে ধর্ম ও নীতির দিক থেকে হিন্দুদের উপর যে ব্যাপক আঘাত করা হয়, তা তিনি কখনোই মেনে নেবেন না। এ অবস্থায় এই নীতির বিরুদ্ধে জারবেদা জেলে তিনি আমরণ অনশন শুরু করেন।
পুনা চুক্তি স্বাক্ষর –
আমরণ অনশন শুরু করলে গান্ধিজির জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়। এইরূপ পরিস্থিতিতে, অনুন্নত শ্রেণির নেতা বি আর আম্বেদকর এবং বর্ণহিন্দুদের নেতা মদনমোহন মালব্য গান্ধিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমস্যাসমাধানে উদ্যোগী হন। অবশেষে আম্বেদকরের সঙ্গে গান্ধিজি সমঝোতায় আসেন এবং 1932 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে উভয়ের মধ্যে পুনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পুনা চুক্তির শর্তাবলি –
এই চুক্তি দ্বারা -হিন্দুদের মধ্যে বর্ণহিন্দু ও অনুন্নত হিন্দুদের পৃথক নির্বাচনের নীতি পরিত্যাগ করা হয়।কেন্দ্রীয় আইনসভায় দলিতদের জন্য 18 শতাংশ আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় ইত্যাদি।
বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলনের ভূমিকা –
বাংলায় দলিত আন্দোলনের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল নমঃশূদ্র আন্দোলন। বাংলার দলিত জাতিগুলির মধ্যে নমঃশূদ্ররা ছিল সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নমঃশূদ্ররা তাদের ধর্মগুরু শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করে।
বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলনের সূচনা –
নমঃশূদ্র আন্দোলনের সূচনা হয় 1872 খ্রিস্টাব্দে, বাংলার ফরিদপুর জেলার বাখরগঞ্জ অঞ্চলে। এক বিশিষ্ট নমঃশূদ্র নেতার মায়ের শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে উঁচু জাতের লোকেরা আসতে অস্বীকার করে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে নমঃশূদ্ররা উঁচু জাতের লোকের বাড়িতে কাজ করতে অস্বীকার করে। এই ঘটনা নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে।
বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলনের পটভূমি –
বাংলার নমঃশূদ্ররা বিভিন্ন কারণে সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছিল।
- 1916 খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় এবং 1917 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় নমঃশূদ্রদের সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয় যে, নমঃশূদ্ররা হল অধিকাংশই দরিদ্র, কৃষক ও শ্রমজীবী। এরা উঁচু বর্ণের ভূস্বামীদের দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছে।
- হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের ধর্মীয় নেতৃত্ব নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ হতে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলন –
হরিচাঁদ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত মতুয়া ধর্মসম্প্রদায়কে কেন্দ্র করেই নমঃশূদ্রদের সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়। তাদের আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দি গ্রাম। নমঃশূদ্ররা এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য 1902 খ্রিস্টাব্দে একটি সমিতি গঠন করে এবং নিয়মিত ‘উন্নয়নী সভা’র আয়োজন করে। তা ছাড়া যাত্রানুষ্ঠান ও প্রতি পরিবার থেকে ‘মুষ্টি’ সংগ্রহের মাধ্যমেও আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। নমঃশূদ্ররা 1912 খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন (Bengal Namasudra Association) প্রতিষ্ঠা করে পুরোপুরি সংগঠিত হয়ে আন্দোলন পরিচালনা করে।
- নমঃশূদ্ররা তাদের নমঃশূদ্র নামের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দাবি করেছিল। 1911 খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে তাদের নমঃশূদ্র নামকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
- নমঃশূদ্ররা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে কিছু সুযোগসুবিধার দাবি করে এবং এক্ষেত্রে তারা কিছু সুযোগসুবিধা লাভে সক্ষমও হয়।
- রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নমঃশূদ্রদের দাবি ছিল পৃথক নির্বাচন ও স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়ানো। ব্রিটিশ সরকার এক্ষেত্রেও নমঃশূদ্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তাই নমঃশূদ্ররাও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি।
বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলনের মূল্যায়ন –
বাংলার দলিত আন্দোলনের ইতিহাসে নমঃশূদ্র আন্দোলন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠিত নমঃশূদ্র আন্দোলন ভারতের অন্যান্য দলিত আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল।
বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করো।
অথবা, নমঃশূদ্র আন্দোলনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কী ছিল?
বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলনের ভূমিকা –
নমঃশূদ্ররা আদিতে চণ্ডাল নামে পরিচিত ছিল। পূর্ব বাংলার ঢাকা, ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ, যশোহর, খুলনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলার এক বৃহৎ অংশে নমঃশূদ্ররা নিজেদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে আন্দোলনের পথ বেছে নেয়।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য –
- সামাজিক মর্যাদারক্ষার লড়াই – 1872 খ্রিস্টাব্দে কার্যত নমঃশূদ্র আন্দোলনের সূচনা হয়। উচ্চ ব্রাহ্মণশ্রেণি দ্বারা পদে পদে অপমানিত হওয়ায় নমঃশূদ্ররা সিদ্ধান্ত নেয় যে, যতদিন তাদের সামাজিক মর্যাদাকে স্বীকৃতি না দেওয়া হচ্ছে ততদিন তারা উচ্চ জাতিগোষ্ঠীর লোকেদের কোনোরকম পরিষেবা প্রদান করবে না। এরা নিজেদের সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য উচ্চ জাতি ও বর্ণের লোকেদের কিছু কিছু আচার-আচরণ ও প্রথাগুলিকেও আত্মস্থ করার চেষ্টা করে।
- পৃথক জাতি ও ধর্ম গ্রহণের উদ্যোগ – উচ্চবর্ণের হিন্দুদের আচরণে ক্ষুব্ধ নমঃশূদ্ররা নিজেদের পৃথক জাতি হিসেবে ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করে। বিশের দশকে বাংলার নমঃশূদ্ররা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে উদ্যোগী হয় এবং এ ব্যাপারে খ্রিস্টান মিশনারিরাও এগিয়ে আসে।
- মতুয়া মহাসংঘের প্রভাব – ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হয় মতুয়া মহাসংঘ। এই মতুয়া মহাসংঘ তার সহজসরল ভক্তিবাদী মত প্রচার করে বাংলার নমঃশূদ্র সমাজের এক বিরাট অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে পরিপুষ্ট করে।
বিংশ শতকে আন্দোলনের চরিত্র/বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন –
বিংশ শতকের শুরুতে বাংলার নমঃশূদ্রদের আন্দোলনে চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই সময় থেকে তারা সামাজিক ন্যায়বিচারের নামে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতা দাবি করে এবং সেইসঙ্গে তারা ঔপনিবেশিক সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। এই কারণেই নমঃশূদ্ররা বাংলার স্বদেশি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করা থেকে বিরত থাকে।
বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলনের মূল্যায়ন –
পরিশেষে বলা যায়, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের আর্থিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ নমঃশূদ্র আন্দোলন গড়ে উঠলেও পরবর্তীকালে এই আন্দোলনে দুটি ধারা পরিলক্ষিত হয় – একদিকে উচ্চ জাতির হিন্দুদের বিরোধিতা এবং অন্যটি ঔপনিবেশিক সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন।
মতুয়া আন্দোলনের সূচনা কীভাবে হয়েছিল?
মতুয়া আন্দোলনের ভূমিকা –
হিন্দুসমাজের নিম্নবর্ণ সম্প্রদায়ের মানুষ যারা তফশিলি জাতিভুক্ত, তারা প্রথমে চণ্ডাল এবং পরে নমঃশূদ্র নামে পরিচিত হয়। ইংরেজ আমলে পূর্ব বাংলার ফরিদপুর, নোয়াখালি, বরিশাল, ময়মনসিংহ জেলার নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে মতুয়া আন্দোলনের সূচনা হয়।
নমঃশূদ্র আন্দোলন –
ফরিদপুর জেলায় একজন বিশিষ্ট নমঃশূদ্রের মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে গ্রামের উঁচুবর্ণের লোকেরা যোগ দেয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে নমঃশূদ্ররা জোটবদ্ধ হয়ে তাদের সঙ্গে সামাজিক ও আর্থিক সম্পর্ক ছিন্ন করে উঁচুবর্ণের কোনো কাজ করতে অস্বীকার করে। তারা ‘উন্নয়নী সভা’ গঠন এবং ‘পতাকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ ও যাত্রানুষ্ঠানের মাধ্যমে আন্দোলনের প্রচার করে।
মতুয়া আন্দোলন –
ফরিদপুর জেলার প্রভু জগবন্ধু ও হরিচাঁদ ঠাকুর নমঃশূদ্রদের মধ্যে বৈয়বীয় ধারায় ভক্তিবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন। হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর শিষ্যদের ‘মতুয়া’ নামে ডাকতেন। তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর বেঙ্গল নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন (1922 খ্রিস্টাব্দ)।
মতুয়া আন্দোলনের কারণ –
- সামাজিক – এরপর গুরুচাঁদ ঠাকুরের দাবিমতো আদমশুমারিতে ‘চণ্ডাল’ -এর বদলে মতুয়া বা ‘নমঃশূদ্র’ নামে পরিচিত হয় (1911 খ্রিস্টাব্দ)। উচ্চবর্ণের প্রতীকগুলিকে অর্থহীন করার জন্য তারাও উপবীত ধারণ, নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি এবং ব্রাহ্মণদের মতো পারলৌকিক বিধি পালন করে।
- আর্থিক – আর্থিক উন্নতির জন্য তারা শিক্ষা ও চাকরি লাভের উপর জোর দেয়। এ ছাড়া ইংরেজ সরকারের কাছে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা প্রার্থনা করে।
- রাজনৈতিক – 1917 এবং 1918 খ্রিস্টাব্দে দুটি সম্মেলনের মাধ্যমে নমঃশূদ্ররা স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিজেদের প্রতিনিধিত্বের দাবি জানায়। 1919 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় সরকার একজন নমঃশূদ্র প্রতিনিধি মনোনয়নের কথা বলে। এরপর প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ও যোগেন মণ্ডল মতুয়াদের নিয়ে ভিন্ন ধরনের রাজনীতি শুরু করেন। প্রমথরঞ্জন ঠাকুর কংগ্রেসের সঙ্গে এবং যোগেন মণ্ডল মুসলিম লিগের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
মতুয়া আন্দোলনের মূল্যায়ন –
পূর্ব বাংলায় হিন্দুসমাজে নিম্নবর্ণের প্রতি এই বৈষম্যের প্রতিবাদে এই আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু পরে এই আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা লাভ করে এবং ভিন্ন পথে পরিচালিত হয়।
স্বদেশি আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে পুরুষদের পাশাপাশি বাংলার নারীসমাজও অংশগ্রহণ করে। তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না, বরং তা ছিল সহযোগীর ভূমিকা।
স্বদেশি আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের বিভিন্ন দিক – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারী সমাজের অংশগ্রহণের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল —
- কর্মসূচির বাস্তবায়ন – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের একটি কর্মসূচি ছিল বিদেশি দ্রব্য বয়কট ও স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহার। তাই শহরের নারীদের অনেকেই বিদেশি বস্ত্র, চুড়ি বর্জন করে এবং দেশি বস্ত্র ও দ্রব্য ব্যবহার শুরু করে।
- অরন্ধন দিবস পালন – বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিনে (16 অক্টোবর, 1905) কলকাতার নারী সমাজের এক বড়ো অংশ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আহ্বানে ‘অরন্ধন কর্মসূচি’ পালন করে। এভাবে বঙ্গভঙ্গকে নারীরা ‘জাতীয় শোক’ – এর পর্যায়ে উন্নীত করে।
- বিপ্লবী আন্দোলন – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের একটি পর্যায়ে গুপ্ত পথে বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা হয়। বিপ্লবীদের আশ্রয়দান করে, গোপনে সংবাদ ও অস্ত্র সরবরাহ করে বেশ কিছু নারী এই আন্দোলনে অংশ নেয়। এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেজো পিসি ননীবালা দেবীর নাম উল্লেখ্য।
- মতাদর্শ প্রচার – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগনি সরলাদেবী চৌধুরানি ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে নারী শক্তিকে উজ্জীবিত করে তোলেন। এ ছাড়া ‘বীরাষ্টমী ব্রত’, ‘প্রতাপাদিত্য ব্রত’ চালু করেন।
উপসংহার – এভাবে দেখা যায়, বঙ্গভঙ্গকালে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল পরোক্ষ এবং তা ছিল ঘরোয়া অর্থাৎ ঘরে বসেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ।
দীপালি সংঘ – টীকা লেখো।
ভূমিকা – বিশ শতকে ভারতে জাতীয় আন্দোলনে নারী জাতির জাগরণ ও অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যে সমস্ত বিপ্লবী নারী ও সংগঠন বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দীপালি সংঘ।
প্রতিষ্ঠা – বাংলার বিপ্লবী লীলা রায় 1923 খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় দীপালি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংঘ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল —
- নারী শিক্ষার প্রসার ও নারীদের আধুনিক করে তোলা
- বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য নারীদের প্রশিক্ষিত করা।
দীপালি সংঘের কর্মসূচি –
- নারীশিক্ষা – এই সংঘের প্রচেষ্টায় 1928 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ নামক বালিকা বিদ্যালয়সহ 12টি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বয়স্কা শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে।
- দৈহিক প্রশিক্ষণ – ভারতের মুক্তিযুদ্ধের উপযুক্ত যোদ্ধা তৈরির উদ্দেশ্যে মেয়েদের জন্য লাঠিখেলা, শরীরচর্চা ও অস্ত্র চালানোর শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়।
- বৈপ্লবিক আদর্শ সঞ্চার – লীলা রায় তরুণীদের বৈপ্লবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে সংগঠন নির্মাণ, অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় ও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে প্রশিক্ষণ দেন।
উপসংহার – দীপালি সংঘ নারী শিক্ষার প্রসার ও বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলার নারী জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী বাহিনী – টীকা লেখো।
ভূমিকা – বিশ শতকে ভারতীয় নারী জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবী আন্দোলনেও যুক্ত হয়। এমনকি দেশের মুক্তির জন্য আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী বাহিনীর সেনারূপেও যোগ দেয়।
গঠন – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সুভাষচন্দ্র বসু 1943 খ্রিস্টাব্দে আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে ‘ঝাঁসির রানি ব্রিগেড’ নামে একটি নারী বাহিনী গঠন করেন।
বাহিনীর বৈশিষ্ট্য –
- নেতৃত্ব – ডাঃ লক্ষ্মী স্বামীনাথন (পরবর্তী নাম: লক্ষ্মী সায়গল) এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক।
- সেনা সদস্য – বাহিনীতে 1500 সদস্য ছিলেন, যারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন সামাজিক স্তর থেকে আসেন।
- প্রশিক্ষণ – নারী সেনাদের যুদ্ধের কলাকৌশলে পূর্ণ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
- কার্যকলাপ – 1945 খ্রিস্টাব্দে ইম্ফল অভিযানে অংশ নিয়ে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষ সেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেন।
উপসংহার – ঝাঁসির রানি ব্রিগেড নারীদের সামরিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে।
প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু স্মরণীয় কেন?
ভূমিকা – বিংশ শতকের প্রথম ভাগে গুপ্ত বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভূমির মুক্তিসাধনে আত্মত্যাগকারী তরুণ বিপ্লবীদের মধ্যে প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু চিরস্মরণীয়।
মজফ্ফরপুর ঘটনা –
- 1908 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব পান ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী।
- ভুলবশত মজফ্ফরপুরে ইংরেজ ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও কন্যাকে বোমা মেরে হত্যা করেন।
- প্রফুল্ল চাকী পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে আত্মহত্যা করেন।
- ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয় (11 আগস্ট, 1908)।
উপসংহার – মাতৃভূমির জন্য তাঁদের আত্মবলিদান জাতিকে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
ভগৎ সিং – টীকা লেখো।
ভূমিকা – বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বিশিষ্ট বিপ্লবী ভগৎ সিং বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন।
কার্যকলাপ –
- সংগঠন গঠন – 1926 খ্রিস্টাব্দে ‘নৌজওয়ান ভারত সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের (HSRA) সদস্য হন।
- স্যান্ডার্স হত্যা – 1928 খ্রিস্টাব্দে লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধে লাহোরে সহকারী পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন।
- বোমা নিক্ষেপ – 1929 খ্রিস্টাব্দে দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা নিক্ষেপ করে বটুকেশ্বর দত্তসহ গ্রেফতার হন।
- ফাঁসি – লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ড পেয়ে 23 মার্চ, 1931 তারিখে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন।
উপসংহার – তাঁর দেশপ্রেম ও বিপ্লবী আদর্শ ভারতীয় যুবসমাজকে প্রেরণা যুগিয়েছে।
বিনয়, বাদল, দীনেশ স্মরণীয় কেন?
ভূমিকা –
বিংশ শতাব্দীর প্রথমে গান্ধিজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি বাংলার বিপ্লবীরা বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলেন, যার মধ্যে বিনয়-বাদল-দীনেশের রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান ছিল অন্যতম।
বিনয়, বাদল, দীনেশ স্মরণের কারণ –
বিনয়, বাদল, দীনেশ যে কারণে স্মরণীয় তা হল –
- অলিন্দ যুদ্ধ – 1930 সালের 8 ডিসেম্বর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সক্রিয় সদস্য বিপ্লবী বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ প্রবেশ করে কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন। তাঁদের আক্রমণে একাধিক উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারী আহত হন। অতঃপর রাইটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দে লালবাজার থেকে আসা সশস্ত্র পুলিশের বিশাল বাহিনীর সঙ্গে বিপ্লবী বিনয়-বাদল-দীনেশের যুদ্ধ শুরু হয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই যুদ্ধ ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে খ্যাত।
- বিনয় ও বাদলের মৃত্যু – অলিন্দ যুদ্ধকালে পুলিশ এই তিনজন বিপ্লবীকে ঘিরে ফেলে। পালানো অসম্ভব বিবেচনা করে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে তিনজনই আত্মহত্যাকে শ্রেয় বলে মনে করেন। বাদল ‘পটাশিয়াম সায়ানাইড’ নামে সাংঘাতিক বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বিনয় ও দীনেশ পিস্তল দিয়ে নিজেদের মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কয়েকদিন পর হাসপাতালে বিনয় মারা যান।
- দীনেশের ফাঁসি – চিকিৎসকদের চেষ্টায় দীনেশ বেঁচে যান এবং আলিপুর জর্জ কোর্টের ইংরেজ বিচারক গার্লিক-এর আদেশে তাঁর ফাঁসি হয় (7 জুলাই, 1931 খ্রি.)। দীনেশের ফাঁসির এক বছরের মধ্যে বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্যের গুলিতে আলিপুর কোর্টের মধ্যে বিচারপতি গার্লিক নিহত হন।
গুরুত্ব –
বিনয়-বাদল-দীনেশের এই কর্মকাণ্ডের বেশ কয়েকটি গুরুত্ব ছিল ; যেমন –
- তাঁদের দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড ব্রিটিশ শাসকদের উদ্বিগ্ন ও ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে
- তাঁদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ বাংলার মানুষকে নতুন প্রেরণা জোগায়
- পরবর্তীকালে এই তিনজন দুঃসাহসিক বিপ্লবীর নামানুসারে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম রাখা হয় বিনয়-বাদল-দীনেশ (বি-বা-দী) বাগ।
সূর্য সেন স্মরণীয় কেন?
অথবা, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন – টীকা লেখো।
ভূমিকা –
বাংলা তথা ভারতের বিপ্লববাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন চট্টগ্রাম বিদ্রোহের মুখ্য নায়ক ‘মাস্টারদা’ সূর্য সেন। আইন অমান্য আন্দোলনের সময় সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা সমগ্র ভারতবর্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
স্মরণীয় হওয়ার কারণ –
মাস্টারদা সূর্য সেন যে সকল কারণে বিখ্যাত ছিলেন সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
- বিপ্লবী সংগঠন স্থাপন – চট্টগ্রামের শিক্ষক সূর্য সেন তাঁর ছাত্র ও সহযোগীদের নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন।
- চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন – 1930 খ্রিস্টাব্দের 18 এপ্রিল মধ্যরাত্রে অম্বিকা চক্রবর্তী, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ প্রমুখ সঙ্গীকে নিয়ে সূর্য সেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ ও লুঠ করেন।
- স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা – তাঁরা টেলিফোন, টেলিগ্রাফের তার বিচ্ছিন্ন করে চট্টগ্রামে একটি ‘স্বাধীন বিপ্লবী সরকার’ প্রতিষ্ঠা করেন।
- মাস্টারদা সূর্য সেন – এর বিচার ও ফাঁসি – নব প্রতিষ্ঠিত এই সরকার সাময়িকভাবে চট্টগ্রামের ওপর নিজেদের আধিপত্য রাখলেও অবশেষে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পালটা আক্রমণে বিপ্লবীদের পরাজয় ঘটে এবং সূর্য সেন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান। বিচারে সূর্য সেনের ফাঁসি হয় (12 জানুয়ারি, 1934 খ্রি.)। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের এই ঘটনা সমগ্র ভারতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করে।
উপসংহার – সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা ছিল চমকপ্রদ ও প্রশংসনীয়। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে যুক্ত জালালাবাদ চট্টগ্রামের যুদ্ধকে ইংরেজদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রথম দৃষ্টান্ত বলে অভিহিত করেছেন।
রশিদ আলি দিবস – টীকা লেখো।
ভূমিকা –
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বের ঘটনাগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ধৃত আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বিচার। এই বিচার সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়ার একটি দিক হল ‘রশিদ আলি দিবস’।
রশিদ আলি দিবস –
1946 খ্রিস্টাব্দের 10 ফেব্রুয়ারি দিল্লির লালকেল্লাতে আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার ক্যাপটেন রশিদ আলির বিচার হয় ও তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দান করা হয়। এই ঘটনায় কলকাতা পুনরায় উত্তাল হয়ে ওঠে এবং ছাত্র বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই বিক্ষোভের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল—
সাধারণ ধর্মঘট –
বাংলার মুসলিম ছাত্র লিগ 11 ফেব্রুয়ারি, 1946 খ্রিস্টাব্দে সাধারণ ধর্মঘট ডাকে এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও ছাত্রনেতাসহ ছাত্ররা এতে অংশগ্রহণ করে।
ছাত্রসমাবেশ –
কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং অন্তত পাঁচ হাজার ছাত্র ও যুবক এতে অংশ নেওয়ার জন্য মিছিল শুরু করে। মুসলিম ছাত্র লিগ এবং কমিউনিস্ট ও কংগ্রেস ছাত্রনেতা ও দলনেতারা এই মিছিলের নেতৃত্ব দেন। পরের দিনের (12 ফেব্রুয়ারি, 1946) অমৃতবাজার পত্রিকায় এই মিছিলের চিত্র প্রকাশিত হয়েছিল।
সরকারি প্রতিক্রিয়া –
রশিদ আলির বিচারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ছাত্র বিক্ষোভ ও গণবিক্ষোভ দমন করতে ব্রিটিশ সরকার পুলিশ ও সামরিক বাহিনী নিয়োগ করে। পুলিশের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘর্ষে 48 জন নিহত ও প্রায় 300 জন মানুষ আহত হয়। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে 12 ফেব্রুয়ারি কলকাতায় অঘোষিত হরতাল পালিত হয়, যা রশিদ আলি দিবস নামে পরিচিত।
রশিদ আলি দিবসের তাৎপর্য –
বিভিন্ন কারণে রশিদ আলি দিবস তাৎপর্যপূর্ণ যেমন —
- এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অহিংস গণ আন্দোলন হিংসাত্মক আন্দোলনে পরিণত হয়
- এটি স্থানীয় বা প্রাদেশিক ঘটনার পরিধি ছাড়িয়ে জাতীয় চরিত্র নেয়
- এই আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য জোরদার হয়ে ওঠে
- রশিদ আলি দিবসের প্রভাবে 13-18 ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকাসহ বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, মেদিনীপুর প্রভৃতি শহরেও ধর্মঘট পালিত হয়।
দলিত রাজনীতির উদ্ভবের কারণসমূহ বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা –
বিশ শতকে ভারতীয় রাজনীতিতে সম্প্রদায়গত ও জাতিগত বিষয়টি প্রাধান্য লাভ করে। হিন্দু সমাজে বর্ণপ্রথা ও বহুজাতি প্রথাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আর্থসামাজিক অধিকারহীন দলিত সম্প্রদায়ও রাজনীতির বিষয় হয়ে ওঠে।
দলিত রাজনীতির উদ্ভবের কারণ –
দলিত রাজনীতির উদ্ভবের কারণগুলি হল –
- ব্রাহ্মণ আধিপত্য – মহারাষ্ট্রের মালি জাতির বিখ্যাত নেতা জ্যোতিবা ফুলে 1870-এর দশকে প্রচার করেন যে, ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী ব্রাহ্মণদের আধিপত্যই হল শূদ্রবর্ণ তথা দলিতদের দুর্দশার মূল কারণ।
- ঔপনিবেশিক শাসন – ঔপনিবেশিক শাসনপর্বে হিন্দুসমাজের বর্ণব্যবস্থাকে মান্যতা দেওয়া হয়। 1880-র দশকে জনগণনায় হিন্দুসমাজের প্রচলিত জাতিবিন্যাসকে নথিভুক্ত করে জাতিগত ক্রমোচ্চতাকে স্থায়ী করার চেষ্টা করা হয়। ফলে সেই সময়ের অস্পৃশ্য বা দলিতরা সংঘবদ্ধ হয়ে জাতিগত উন্নয়নের কথা ভাবতে শুরু করে।
- শিক্ষার প্রসার – উনিশ শতকের শেষদিকে খ্রিস্টান মিশনারি ও সরকারি উদ্যোগে শিক্ষার বিস্তার ঘটলে দলিতদের কেউ কেউ শিক্ষিত হয় এবং নিজ শ্রেণির সংঘবদ্ধতার বিষয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
- দেশীয় রাজ্যগুলির উদ্যোগ – উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে মহীশূর ও কোলহাপুর-এর মতো দেশীয় রাজ্যগুলি অব্রাহ্মণ ও অস্পৃশ্য মানুষের উন্নতির জন্য সরকারি চাকরিক্ষেত্রে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ প্রথা চালু করে। এভাবে দলিত সম্প্রদায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
উপসংহার –
উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে দলিতরা সংঘবদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে এবং বিশ শতকের প্রথমে নিজেদের জন্য আর্থসামাজিক অধিকারসহ রাজনৈতিক অধিকার দাবি করে। প্রথমে মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার (1919 খ্রি.) এবং পরে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ও পুনা চুক্তির (1932 খ্রি.) মাধ্যমে দলিত সম্প্রদায় রাজনৈতিক অধিকার লাভ করে।
আম্বেদকর প্রাথমিক পর্বের দলিত আন্দোলনের মধ্যে সম্পর্ক চিহ্নিত করো।
ভূমিকা –
ভারতে দলিত আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন ড. বাবাসাহেব ভীমরাও রামজী আম্বেদকর (1891-1956 খ্রি.) বা সংক্ষেপে বি. আর. আম্বেদকর। তিনি ১৯ শতকের শেষার্ধে দলিতদের মধ্যে গড়ে ওঠা সংহতিকে ২০ শতকে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করেন।
আম্বেদকর ও দলিত আন্দোলন –
আম্বেদকর নিজে একজন দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত হন –
- হিতকারিণী সভা প্রতিষ্ঠা – আম্বেদকর তাঁর অনুগামীদের নিয়ে গঠন করেন ‘বহিষ্কৃত হিতকারিণী সভা’ (1924 খ্রি.)। হিন্দুসমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন বা বহিষ্কৃত অস্পৃশ্যদের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে রক্ষা করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।
- নিপীড়িত শ্রেণির সম্মেলন – 1926 খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির নেতাদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন দলিতদের আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে। ড. আম্বেদকর এই সমিতির সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। অচিরেই তিনি সমিতি থেকে ইস্তফা দেন।
- মনুস্মৃতি দাহ – 1927 খ্রি্ষ্টাব্দে আম্বেদকর সর্বসাধারণের ব্যবহার্য পুকুর থেকে দলিতদের জল তোলার অধিকার নিয়ে বিরাট সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে মনুস্মৃতি গ্রন্থ পুড়িয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে আঘাত হানেন।
- সংগঠন প্রতিষ্ঠা – 1930 খ্রিস্টাব্দে তিনি সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস গঠন করেন। প্রতিষ্ঠানের উদবোধনী ভাষণে আম্বেদকর সরাসরি কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে দলিত আন্দোলন আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে।
- পুনা চুক্তি – সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতিতে দলিতদের পৃথক নির্বাচন বিধি স্বীকৃতি পেলেও গান্ধিজির অনশনের কারণে তা বাধা পায়। শেষপর্যন্ত আম্বেদকর গান্ধির সঙ্গে পুনা চুক্তি (1932 খ্রি.) সম্পাদনের মাধ্যমে দলিতদের রাজনৈতিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করেও স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট হন।
উপসংহার –
এভাবে পুনা চুক্তির সময়কাল পর্যন্ত দলিত আন্দোলনের সংগঠনে আম্বেদকরের ভূমিকা ছিল খুব উল্লেখযোগ্য। পুনা চুক্তির পরবর্তীকালে তাঁর উদ্যোগে দলিত অধিকার আন্দোলন আরও এগিয়ে যায়।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা – টীকা লেখো।
ভূমিকা –
ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার সংখ্যালঘু ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মদতদানের নীতি নেয়। এই প্রচেষ্টার পরিণতি ছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ডের ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতি ঘোষণা।
প্রেক্ষাপট –
‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতি ঘোষণার প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হল –
- ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করে তোলা
- হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐক্যে ফাটল ধরানো
- দলিতদের পৃথক স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে তাদের ব্রিটিশ সরকারের অনুগত শ্রেণিতে পরিণত করা
- দলিত নেতা বি. আর. আম্বেদকরের দাবি মতো দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দান করা।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার মূল বক্তব্য –
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারায় ঘোষণা করা হয় যে –
- মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হবে
- হিন্দুসমাজকে বর্ণহিন্দু ও অনুন্নত শ্রেণি (Depressed Classes) তে বিভক্ত করে অনুন্নত শ্রেণির পৃথক নির্বাচন বিধি মেনে চলা হবে।
উপসংহার –
সাংবিধানিক দিক দিয়ে ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতি ছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি। কিন্তু ভারতের জাতীয় নেতাদের কাছে এই নীতি ছিল ব্রিটিশের “বিভাজন ও শাসন নীতির প্রতিফলন। এই বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধি সরব হন ও যারবেদা জেলে অনশন শুরু করেন।
পুনা চুক্তি সম্পর্কে একটি টীকা লেখো।
ভূমিকা –
বিশ শতকের শুরু থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে দলিত সমস্যা গুরুত্ব লাভ করে এবং 1932 খ্রিস্টাব্দের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতিতে তা স্বীকৃতি লাভ করে। দলিতদের রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল পুনা চুক্তি (1932 খ্রি.)।
পুনা চুক্তি –
1932 খ্রিস্টাব্দে অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতা ডঃ বি. আর. আম্বেদকর ও গান্ধিজির মধ্যে ‘পুনা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির শর্তগুলি হল –
- উন্নত ও অনুন্নত হিন্দু সম্প্রদায় যৌথভাবে ভোট দেবে অর্থাৎ অনুন্নত ‘হরিজন’ শ্রেণি – সহ সব হিন্দুদের যৌথ নির্বাচক মণ্ডলীর নীতি স্বীকৃত হবে
- হরিজন সম্প্রদায় হিন্দুসমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ এ কথা স্বীকার করা হবে
- হরিজনদের জন্য আইনসভার আসন সংখ্যার বরাদ্দ দ্বিগুণ করার সঙ্গে সঙ্গে তা সংরক্ষিত করা
- (সরকারি চাকরিতে অনুন্নত শ্রেণির যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব দান করা
- 10 বছর পর সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থার অবসান করা হবে।
পুনা চুক্তির গুরুত্ব –
পুনা চুক্তি অনুসারে –
- অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা বাতিল করা হয়
- হিন্দুদের যৌথ নির্বাচনের সূত্র মেনে নেওয়া হয়
- অনুন্নত শ্রেণির আসন বরাদ্দ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায় এবং
- এই আসনগুলি তাদের জন্য সংরক্ষিত হয়। বস্তুত পুনা চুক্তি গান্ধিজির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে এবং তাঁর প্রচেষ্টায় হিন্দুসমাজে বিভেদনীতি অনুপ্রবেশের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
দলিত অধিকার বিষয়ে গান্ধি ও আম্বেদকরের মধ্যে কী ধরনের মতপার্থক্য ছিল তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – দলিত নেতাদের উদ্যোগে দলিতদের জন্য আর্থসামাজিক অধিকার অর্জন প্রচেষ্টা এবং 1919 খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার দ্বারা দলিতদের অল্পমাত্রায় রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতিদান ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু 1920 ও 1930-এর দশকে দলিত অধিকার বিষয়ে গান্ধি ও আম্বেদকরের মধ্যে মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দলিত অধিকার বিষয়ে গান্ধি ও আম্বেদকরের মধ্যে মতপার্থক্য –
দলিত অধিকার বিষয়ে গান্ধি ও আম্বেদকরের মধ্যে মতপার্থক্যের দিকগুলি হল –
- দৃষ্টিভঙ্গিগত – মহাত্মা গান্ধি মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দলিত সমস্যাকে বিবেচনা করেন এবং সমাজ থেকে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের উপর গুরুত্ব দেন। 1920 খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনকালে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। কিন্তু কয়েক বছর পর আম্বেদকর অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের পাশাপাশি দলিতদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন।
- পদ্ধতিগত – অস্পৃশ্যতা দূরীকরণে গান্ধিজি মূলত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। দলিতদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার বা উচ্চবর্ণের সঙ্গে একত্রে বসে খাওয়ার অধিকারদানের উপর গুরুত্ব দেন। পক্ষান্তরে আম্বেদকর গান্ধিজিকে 1932 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর-এ লিখেছিলেন—“দলিতদের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া, উচ্চবর্ণের সঙ্গে বসে খাওয়া ও এই ধরনের অন্যান্য বিষয়ের প্রতি আমার কোনো উৎসাহ নেই। কারণ এসব সত্ত্বেও আমরা দুর্দশা ভোগ করি। আমি শুধু চাই তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুরबস্থার অবসান ঘটুক।”
- বর্ণাশ্রম সম্পর্কিত – গান্ধিজি হিন্দুসমাজের বর্ণাশ্রম, (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র) ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে বর্ণগুলির মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের উপর গুরুত্ব দেন। কিন্তু আম্বেদকর 1935 খ্রিস্টাব্দে গান্ধির বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা ও বর্ণহিন্দুদের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করেন।
- রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত – 1928 খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী দাবি করেন। 1931 খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করে দলিত শ্রেণির জন্য আইনসভায় আসন সংরক্ষণের দাবি জানান। এরই ভিত্তিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড 1932 খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ ঘোষণা করেন। এর দ্বারা হিন্দুসমাজকে বর্ণহিন্দু ও অনুন্নত শ্রেণি — এই দুই ভাগে ভাগ করে রাজনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি করা হয়। এই বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে গান্ধিজি সরব হন। তিনি যারবেদা জেলে অনশন শুরু করেন।
উপসংহার – সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার মাধ্যমে আম্বেদকর দলিতদের জন্য রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলেও গান্ধিজির সঙ্গে ‘পুনা চুক্তির’ মাধ্যমে সেই অধিকার অনেকটাই হারিয়ে ফেলেন।
বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – পূর্ব বাংলার খুলনা, যশোহর, ফরিদপুর ও বরিশালের প্রান্তিক কৃষিজীবি সম্প্রদায় নমঃশূদ্র’ নামে পরিচিত। সামাজিক দিক থেকে এঁরা ছিল হিন্দুসমাজে অস্পৃশ্য ও অন্ত্যজ। এরূপ সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে তারা যে আন্দোলন গড়ে তোলে তা নমঃশূদ্র আন্দোলন নামে পরিচিত।
বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের উদ্ভব –
নমঃশূদ্র আন্দোলনের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট আলোচনা করলে দেখা যায় –
- সামাজিক বৈষম্য – নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে সামাজিক দিক থেকে পতিত ও অদ্ভুত বলে মনে করা হত। 1872 খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর-বাখরগঞ্জ অঞ্চলে একজন বিশিষ্ট নমঃশূদ্র গ্রামীণ নেতার মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যোগ দিতে অস্বীকার করলে নমঃশূদ্রদের আন্দোলনের সূচনা হয়।
- প্রতিনিধি দল প্রেরণ – 1907 খ্রিস্টাব্দে নমঃশূদ্রদের একটি প্রতিনিধি দল গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আস্থা প্রদর্শন করে তার স্থায়িত্ব কামনা করে। তাদের যুক্তি ছিল যে, ব্রিটিশ জনগণ কোনোরকম বর্ণভিত্তিক সামাজিক কাঠামোয় বিশ্বাসী নয়। তাই ব্রিটিশরাই তাদের সামাজিক বৈষম্যের হাত থেকে মুক্ত করতে পারবে।
- পৃথক সংগঠন প্রতিষ্ঠা – নমঃশূদ্ররা 1908 খ্রিস্টাব্দে নিজেদের জন্য পৃথক সংগঠন গড়ে তোলে। সংগঠনের মুখপত্র ছিল ‘পতাকা’ এবং এই পত্রিকায় নমঃশূদ্র নেতা রায়চরণ বিশ্বাস জাতি ব্যবস্থায় নিজেদের ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীভুক্ত বলে দাবি করেন।
- ধর্মপ্রচারকদের ভূমিকা – ধর্মপ্রচারক প্রভু জগবন্ধু ও হরিচাঁদ ঠাকুর নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে উদার মানবতাবাদী ধর্মীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর শিষ্যদের ‘মতুয়া’ নামে ডাকতেন। তিনি ব্রাহ্মণ জমিদার ও পুরোহিত শ্রেণির অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। নমঃশূদ্রদের মধ্যে আত্মমর্যাদা সৃষ্টি করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাই তিনি তাদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারে বিশেষ উদ্যোগী হন।
উপসংহার – এভাবে নমঃশূদ্রদের মধ্যে সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও নমঃশূদ্ররা ঐক্যবদ্ধ হতে সচেষ্ট হয়। হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষ্যে প্রতি বছর ঠাকুর নগরে বারুণী মেলা আয়োজিত হয়। গুরুচাঁদ ঠাকুর চণ্ডালদের নাম পরিবর্তন করে নমঃশূদ্র রাখার দাবি জানান। 1911 খ্রিস্টাব্দের জনগণনায় এই দাবি স্বীকৃত হয়। পরবর্তীকালে বাংলার নমঃশূদ্রদের নিয়ে ভিন্ন মাত্রার রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।কের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলনগুলি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সমাজ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই আন্দোলনগুলি ভারতের ইতিহাসে একটি অমূল্য সম্পদ।
আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের সপ্তম অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।
আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।
ধন্যবাদ সবাইকে।
মন্তব্য করুন