মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর

Solution Wbbse

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় “প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর থেকে “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
Contents Show

ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অরণ্যের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপগুলি উল্লেখ করো।

ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অরণ্যের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ভূমিকা –

ভারত ছিল ব্রিটিশ সরকারের একটি উপনিবেশ। ব্রিটিশ সরকার তার ভারত উপনিবেশের অরণ্যগুলির উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য অরণ্য সনদ ও ভারতীয় অরণ্য আইন পাস করে।

ভারতে অরণ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পর্যায় –

ব্রিটিশ সরকার ধাপে ধাপে অরণ্য সনদ ও আইন পাস করে ভারতের অরণ্যের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

  • অরণ্য সনদ (1855 খ্রিস্টাব্দ) – ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি 1855 খ্রিস্টাব্দে অরণ্য সনদ জারি করে ভারতীয় অরণ্যের উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে –
    • ভারতের অরণ্যের কাঠ সংগ্রহ ও কাঠের ব্যাবসার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
    • অরণ্যের মূল্যবান কাঠ, যেমন – শাল, সেগুন প্রভৃতি সরকারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
  • বন বিভাগ প্রতিষ্ঠা (1864 খ্রিস্টাব্দ) – ব্রিটিশ সরকার 1864 খ্রিস্টাব্দের 1 নভেম্বর বন বিভাগ গঠন করে। ডেইট্রিক ব্রান্ডিস নামে একজন জার্মানকে এই বিভাগের ইনস্পেকটর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ব্রান্ডিসের অধীনে এবং সহকারী হিসেবে ক্লেসোরার সহায়তায় ভারতে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত বন ব্যবস্থাপনার সূচনা হয়।
  • ভারতীয় অরণ্য আইন (1865 খ্রিস্টাব্দ) – ব্রিটিশ সরকার 1865 খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভারতীয় অরণ্য আইন পাস করে। এর দ্বারা –
    • ভারতের অরণ্য সম্পদের উপর ভারতীয়দের অধিকার খর্ব করা হয়।
    • ভারতের অরণ্যকে সংরক্ষণের আওতায় এনে ব্রিটিশ সরকার অরণ্যের উপরেও তাদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে।
    • অরণ্যঘেরা সমস্ত ভূমি এই আইনের ফলে সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
  • অরণ্য আইন (1878 খ্রিস্টাব্দ) – ব্রিটিশ সরকার 1878 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় অরণ্য আইন পাস করে অরণ্যের উপর তাদের অধিকার আরও সুদৃঢ় করে।

ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অরণ্যের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উপসংহার –

ব্রিটিশ সরকারের অরণ্য আইনের ফলে ভারতের অরণ্যবাসী আদিবাসী সম্প্রদায় অরণ্যের উপর তাদের চিরাচরিত অধিকার হারিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফলে তারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। অরণ্য আইনের প্রতিক্রিয়ায় সাঁওতাল, মুন্ডা, ভিল প্রমুখ উপজাতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।

ভারতে ব্রিটিশ সরকার প্রচলিত অরণ্য আইনগুলির পরিচয় দাও।

ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পর সরকার অরণ্য আইন পাস করে। এই অরণ্য আইনগুলির ফলে অরণ্যের উপর আদিবাসীদের অধিকার খর্ব হয়। অরণ্যকে –

  1. সংরক্ষিত,
  2. সুরক্ষিত,
  3. গ্রামীণ অরণ্য

– এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়।

ভারতে ব্রিটিশ সরকার প্রচলিত অরণ্য সনদ ও আইনসমূহ –

  • অরণ্য সনদ (1855 খ্রিস্টাব্দ) – লর্ড ডালহৌসি 1855 খ্রিস্টাব্দে অরণ্য সনদ জারি করে ভারতীয়দের অরণ্যের অধিকারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে –
    • অরণ্যের কাঠ সংগ্রহ ও কাঠের ব্যাবসার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
    • অরণ্যের মূল্যবান কাঠ, যেমন – শাল, সেগুন প্রভৃতি সরকারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
  • ভারতীয় অরণ্য আইন (1865 খ্রিস্টাব্দ) – ব্রিটিশ সরকার 1865 খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভারতীয় অরণ্য আইন পাস করে। ফলে –
    • ভারতের অরণ্যের উপর ব্রিটিশ সরকারের অধিকার দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
    • অরণ্যের উপর আদিবাসীদের অধিকার খর্ব করা হয়।
    • সরকার ঘোষণা করে যে, অরণ্যঘেরা সমস্ত অঞ্চল হল সরকারি সম্পত্তি।
  • ভারতীয় অরণ্য আইন (1878 খ্রিস্টাব্দ) – 1878 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয় ভারতীয় অরণ্য আইন পাস করে। এর ফলে ভারতীয় অরণ্যের উপর সরকারের অধিকার আরও সুদৃঢ় হয়।
  • ভারতীয় অরণ্য আইন (1927 খ্রিস্টাব্দ) – 1927 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার অপর একটি অরণ্য আইন পাস করে। এই আইনে অরণ্য বিষয়ক অপরাধ ও তৎসংক্রান্ত শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়।

কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন?

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অরণ্যের উপর তাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন প্রবর্তন করে। ব্রিটিশ সরকার 1855 খ্রিস্টাব্দে ‘অরণ্য সনদ’, 1865 খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’ এবং 1878 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’ পাস করে।

অরণ্য আইন প্রণয়নের কারণসমূহ –

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন প্রবর্তনের পিছনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী তথা ঔপনিবেশিক মানসিকতা ও প্রয়োজনীয়তা সক্রিয় ছিল।

  • অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য – অরণ্য আইন প্রবর্তনের পিছনে ঔপনিবেশিক ও অর্থনৈতিক কারণ ছিল প্রধান। বিশাল ও সম্পদপূর্ণ ভারতীয় বনভূমিকে ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণে এনে ব্রিটিশ অর্থনীতির স্বার্থে তা ব্যবহার করাটাই ছিল অরণ্য আইন প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য।
  • সামরিক উদ্দেশ্য – অরণ্য আইন প্রবর্তনের পিছনে সামরিক কারণ ও পরিপ্রেক্ষিতটিও ছিল উল্লেখযোগ্য। ব্রিটেনের রাজকীয় নৌবাহিনীর জন্য জাহাজ তৈরির প্রয়োজনীয় কাঠের অন্যতম সরবরাহক্ষেত্র ছিল এই ভারতীয় অরণ্য।
  • রেলপথের প্রসার – ভারতে রেলপথের প্রসার অরণ্য আইন চালু করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। গ্যারান্টি প্রথার মাধ্যমে যেসকল রেলওয়ে কোম্পানি ভারতে রেলপথ প্রসারের কাজ করছিল তাদের রেললাইনের স্লিপার ও অন্যান্য অংশ তৈরির জন্য প্রচুর কাঠের প্রয়োজন ছিল। অরণ্য আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সেই প্রয়োজন পরিপূর্ণ হয়েছিল।
  • বিনোদনের লক্ষ্যে – ব্রিটিশ রাজন্যবর্গ, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী এবং তাদের সহযোগী এদেশীয় রাজন্যবর্গের অন্যতম বিনোদন ছিল শিকার করা। এজন্য বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত করে শিকারক্ষেত্রকে নির্বিঘ্ন করে তোলাটাও অরণ্য আইন প্রবর্তনের অন্যতম উদ্দেশ্যরূপে কাজ করেছিল।

অরণ্য আইনের উপসংহার –

সার্বিকভাবে বলা যায়, অরণ্য অঞ্চলের উপর ব্যাপক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে যুক্তিসংগত করে তোলার জন্য ঔপনিবেশিক শাসকবর্গের ব্যাখ্যা ছিল – অজ্ঞ কৃষক ও আদিবাসীদের কবল থেকে অরণ্য সম্পদকে রক্ষা করার জন্যই এই জাতীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কিছু ঐতিহাসিক উপরোক্ত যুক্তিকে মেনে নেওয়ার পক্ষপাতী নন। তাদের বক্তব্য হল যে, অরণ্য সংরক্ষণের পিছনে ব্রিটিশ সরকারের সামরিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যই ছিল প্রধান।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন কীভাবে আদিবাসীদের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়েছিল?

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের ভূমিকা –

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন বলতে বোঝায় ব্রিটিশ সরকার ভারতশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর চালু হওয়া অরণ্য আইনগুলিকে। এক্ষেত্রে দুটি আইনের কথা সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। যথা –

  • 1865 খ্রিস্টাব্দের অরণ্য আইন এবং
  • 1878 খ্রিস্টাব্দের অরণ্য আইন।

বলাবাহুল্য, আইন দুটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তোলে।

অরণ্য আইন ও আদিবাসী সম্প্রদায় –

ব্রিটিশ সরকারের অরণ্যনীতির প্রভাব গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মানুষজনকে বিশেষত আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির উপর দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছিল। যেমন –

  • বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ – ব্রিটিশ সরকারের অরণ্যনীতির ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। অরণ্য অঞ্চলের প্রান্তিক গোষ্ঠীকেও সেটি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
  • দৈনন্দিন কার্যকলাপে ব্যাঘাত – অরণ্য অঞ্চলে আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রথাগতভাবে অরণ্যের গাছ নানা দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকারের আইন অনুযায়ী এই জাতীয় কার্যকলাপ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
  • পশুচারণে ব্যাঘাত – অরণ্য আইন প্রবর্তনের ফলে অরণ্যবাসীদের পশুচারণে ব্যাঘাত ঘটে। কারণ – এই আইনের মাধ্যমে অরণ্য অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে সংরক্ষিত এলাকা এবং এই অঞ্চলে প্রবেশ করাকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়।
  • চাষবাসের ক্ষতি – অরণ্য অঞ্চলের লোকেদের মধ্যে প্রচলিত বিশেষ ধরনের চাষ, যেমন – ঝুম, রেওয়াং ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যায়।
  • বিদ্রোহ – সর্বোপরি, অরণ্য আইনগুলির দ্বারা অরণ্যে বসবাসকারী অধিবাসীদের স্বাধীন জীবনযাপনে ব্যাঘাত ঘটে। ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনগুলির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ারূপে আদিবাসীরা একাধিক বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান ঘটায়।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের প্রতিক্রিয়া সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের ভূমিকা –

ব্রিটিশ সরকার ভারতের অরণ্যগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য 1855 খ্রিস্টাব্দে অরণ্য সনদ, 1864 খ্রিস্টাব্দে বন বিভাগ গঠন, 1865 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় অরণ্য আইন, 1878 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ভারতীয় অরণ্য আইন পাস করে অরণ্যের উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করে। এর ফলে অরণ্যের উপর নির্ভরশীল ভারতের আদিবাসী জনগণ অরণ্যের উপর তাদের একচেটিয়া অধিকার হারিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া –

  • কাঠের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আদিবাসীদের প্রতিক্রিয়া – ব্রিটিশ সরকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবিকার মূল উৎস অরণ্যের উপর বিভিন্নভাবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তারা ভারতের সামগ্রিক বনাঞ্চলকে তিন ধরনের বনভূমিতে ভাগ করে। সংরক্ষিত অরণ্যে কোম্পানির পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এইসব অরণ্যে আদিবাসীদের গাছ কাটা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হয়। সুরক্ষিত অরণ্যে আদিবাসীরা নিজেদের প্রয়োজনীয় কাঠ জোগাড় করতে পারত কিন্তু কাঠ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে পারত না। এর ফলে অরণ্যবাসী আদিবাসীরা রেগে যায়।
  • ঝুমচাষিদের প্রতিক্রিয়া – অরণ্যবাসী আদিবাসীরা কাঠ ছাড়াও বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে জীবিকানির্বাহ করত। ব্রিটিশ সরকার বনজ সম্পদ ব্যবহারের উপর কর আরোপ করে। এর ফলে অরণ্যবাসী কৃষকদের মধ্যে ঝুমচাষিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে আদিবাসী কৃষকগোষ্ঠী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে শুরু করে।
  • বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীদের প্রতিক্রিয়া – ব্রিটিশ সরকার ঝুমচাষ বন্ধ করলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীরা সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।

হায়দরাবাদের বস্তার অঞ্চলের আদিবাসীরা ব্রিটিশ কোম্পানির পুলিশ বাহিনীর আস্তানাগুলিতে আক্রমণ করে।

মহারাষ্ট্রের থানে জেলার উপজাতীয় কৃষকরাও সরকারের বিরুদ্ধে হিংসার আশ্রয় নেয়।

তা ছাড়া ত্রিবাঙ্কুর, উত্তরাখণ্ড, জঙ্গলমহল এলাকায় আদিবাসীরা ব্রিটিশ সরকারের অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা বিভিন্নভাবে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, লুঠ ও বনে আগুন লাগিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। অনেক জায়গায় আদিবাসীরা তাদের এলাকায় বহিরাগত ব্যবসায়ীদের আক্রমণ করে এলাকাছাড়া করেছিল।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের উপসংহার –

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের ফলে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আদিবাসীদের বিরোধ বাঁধে। আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকায় ব্যাঘাত ঘটে। ফলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সংগ্রামে শামিল হয়। উপজাতি আদিবাসী বিদ্রোহগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ ইত্যাদি।

বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব -এর ধারণাগুলি আলোচনা করো।

বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব -এর ভূমিকা –

রাজনৈতিক ইতিহাসে আন্দোলনের বিভিন্ন পরিভাষারূপে বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান, বিপ্লব প্রভৃতি শব্দ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এগুলির মাধ্যমে শোষক ও অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশকে বোঝায়। আপাতদৃষ্টিতে এই শব্দগুলির অর্থ কাছাকাছি হলেও এদের মধ্যে পার্থক্য আছে।

বিদ্রোহ (Revolt) –

ইংরেজিতে Revolt বা বিদ্রোহ বলতে যা বোঝায় তার বিভিন্ন দিক রয়েছে। ‘বিদ্রোহ’ কথাটি ‘বি’ (বিশিষ্টরূপে) ও ‘দ্রোহ’ (হিংসা করা) থেকে এসেছে। তবে সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণকে বিদ্রোহ বলা যেতে পারে। শুধুমাত্র সরকারি ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণকেই বিদ্রোহ বলা হয় না। প্রচলিত প্রথা, প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও রীতিনীতির বিরুদ্ধাচরণকেও বিদ্রোহ বলা হয়ে থাকে। যেমন – সাঁওতাল বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, রংপুর বিদ্রোহ ইত্যাদি।

অভ্যুত্থান (Uprising) –

অভ্যুত্থান (Uprising) বলতে বোঝায় সেই জাতীয় বিদ্রোহকে, যখন ওই বিদ্রোহের পিছনে ব্যাপক জনসমর্থন থাকে। একটি বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থান দীর্ঘদিন ধরে চললে তাকে একটি আন্দোলনের মর্যাদা দেওয়া হয়। যেমন – 1857 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বা ভারতীয় সিপাহিদের সরকারবিরোধী বিদ্রোহকে অভ্যুত্থান বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে 1946 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ভারতীয় সৈন্যরা সরকারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা ইতিহাসে নৌবিদ্রোহ নামে পরিচিত হলেও সেটি যে একধরনের অভ্যুত্থান এ কথা অনস্বীকার্য।

বিপ্লব (Revolution) –

বিপ্লব কথাটি এসেছে ‘বি’ এবং ‘প্লব’ থেকে। ‘বি’ কথার অর্থ বিশেষ এবং ‘প্লব’ কথার অর্থ হল লাফ দেওয়া। বিপ্লব (Revolution) বলতে বোঝায় এমন কোনো ঘটনা বা বিদ্রোহ বা আন্দোলনকে যার ফলে রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়। রাজনৈতিক বিপ্লব প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, যখন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে, তখন তাকে রাজনৈতিক বিপ্লব বলা হয়।

ইতিহাসে বিপ্লবের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল ফরাসি বিপ্লব, যা ফ্রান্সের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। তা ছাড়া ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের কথাও বলা যায়। ভারতের ইতিহাসে সশস্ত্র সংগ্রামীদের বিপ্লবী ও তাদের কার্যাবলিকে বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়।

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সংঘটিত কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলির কারণ কী ছিল?

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সংঘটিত কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহের ভূমিকা –

ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পর প্রায় 100 বছর ধরে (1757-1857 খ্রিস্টাব্দ) ইংরেজ, জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে অনেক কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ হয়েছিল। ওই বিদ্রোহগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহ, ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন, কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রভৃতি।

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সংঘটিত কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহের কারণ –

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কৃষক ও উপজাতিদের বিদ্রোহ ঘোষণার অনেক কারণ ছিল, যথা –

  • অত্যধিক রাজস্ব আদায় – ইংরেজ কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করার পর কৃষকদের কাছ থেকে অত্যধিক হারে রাজস্ব আদায় করতে শুরু করে। ফলে শোষিত কৃষকরা কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
  • সরকারি কর্মচারী ও পুলিশি অত্যাচার – সরকারি কর্মচারী এবং ইংরেজ পুলিশ কারণে-অকারণে কৃষক ও উপজাতিদের উপর অত্যাচার করত। সমকালীন ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় 18 ধরনের অত্যাচারের কথা উল্লিখিত আছে। অত্যাচারের ফলে তারা ইংরেজবিরোধী হয়ে উঠেছিল।
  • জমিদার ও মহাজনদের শোষণ – জমিদার ও মহাজন শ্রেণির শোষণ কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ইংরেজ কোম্পানি ও জমিদারদের বলপূর্বক খাজনা আদায়ের ফলে কৃষকরা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হত এবং মহাজনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে তারা অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হত।
  • বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদনে বাধ্যবাধকতা – ইংরেজ কোম্পানি জোর করে কৃষকদের বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদন করতে বাধ্য করত। এই বাণিজ্যিক ফসলগুলির মধ্যে প্রধান ছিল নীল, তুলো, পাট, আফিম প্রভৃতি। ইংরেজরা খাদ্যশস্য চাষের জমিতে কৃষকদের এই বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদনে বাধ্য করলে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
  • দেশীয় শিল্পের অবক্ষয় – কোম্পানির আমলে দেশীয় শিল্প ধ্বংস হলে দেশীয় শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী ও কারিগররা কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল এবং কৃষক বিদ্রোহে তারাও যোগদান করেছিল।

কুদেতা (Coup de etat) বা সামরিক অভ্যুত্থান কী?

কুদেতা (Coup de etat) বা সামরিক অভ্যুত্থান – ‘Coup de etat’ বলতে বোঝায় সেই পরিস্থিতিকে যখন কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত শাসকগোষ্ঠীকে অপসারিত করা হয়। এই জাতীয় ঘটনাকে ইতিহাসে ‘প্রাসাদ বিপ্লব’ বলা যেতে পারে। কিন্তু এগুলিকে প্রকৃত বিপ্লবের মর্যাদা দেওয়া যায় না। প্রকৃত বিপ্লব হয় তখন যখন রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী ও আমূল পরিবর্তন ঘটে।

ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থা কী?

ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থা – ইংরেজরা ভারতবর্ষে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পর ভারতের চিরাচরিত আইন ও বিচারব্যবস্থা বাতিল করে নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা চালু করে। ভারতীয় সমাজ এই বিদেশি হস্তক্ষেপকে সুনজরে দেখেনি।

খাদ্যাভাব কী?

খাদ্যাভাব – ব্রিটিশ শাসকগণ কৃষকদের আবাদি জমিতে নীল, পাট, তুলো প্রভৃতি চাষে বাধ্য করলে কৃষকরা তীব্র খাদ্যসংকটে পড়ে।

উনিশ শতকের কৃষক-উপজাতি বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?

ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ, জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক ও উপজাতিরা বিদ্রোহ করেছিল। এই বিদ্রোহগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ, ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন প্রভৃতি।

কৃষক-উপজাতি বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য –

  • প্রান্তিক মানুষের অংশগ্রহণ – উনিশ শতকের কৃষক-উপজাতি বিদ্রোহগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সমাজের প্রান্তিক মানুষদের অংশগ্রহণ। ভারতের বিভিন্ন অংশের প্রান্তিক জনগণ তাদের বিভিন্ন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল এইসকল বিদ্রোহগুলির মাধ্যমে।
  • ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা – কৃষক-উপজাতি বিদ্রোহগুলি ছিল ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কৃষক ও উপজাতিরা ব্রিটিশ সরকারের ভূমিরাজস্ব নীতি, অরণ্য নীতি প্রভৃতির ফলে ক্ষুব্ধ হয়েছিল।
  • অসম লড়াই – উনিশ শতকে কৃষক উপজাতিগুলি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে অসম লড়াই-এ অবতীর্ণ হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে জয়ী না হলেও তারা সুদৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিল।
  • জমিদার ও মহাজন শ্রেণির বিরোধিতা – জমিদার ও মহাজন শ্রেণি কৃষক ও উপজাতিদের উপর অকথ্য শোষণ ও অত্যাচার করত। তাই এই সময়ের কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলি ব্রিটিশ বিরোধিতার পাশাপাশি জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হয়েছিল।

চুয়াড় বিদ্রোহের কারণগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে জঙ্গলমহল (মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ধলভূম ও বর্তমান ঘাটশিলা অঞ্চল) অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসীদের ইংরেজ ও ইংরেজ সমর্থকরা ‘চুয়াড়’ বলে অভিহিত করত। কোম্পানি জঙ্গলমহল অঞ্চলে রাজস্ব বৃদ্ধি করলে চুয়াড়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

চুয়াড় বিদ্রোহের কারণসমূহ –

  • উচ্চহারে রাজস্ব আদায় – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে চুয়াড়দের জমির উপর উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করে। ফলে করপ্রদানে অনভ্যস্ত চুয়াড়দের উপর এই অত্যধিক রাজস্ব আরোপ তাদের ক্ষিপ্ত করে তোলে।
  • পাইকান জমি হাতছাড়া – চুয়াড়রা জমিদারদের অধীনে পাইক বা সৈনিকের কাজ করত। বেতনের পরিবর্তে তারা নিষ্কর জমি ভোগ করত। এই সমস্ত জমিকে ‘পাইকান জমি’ বলা হত। কিন্তু ঔপনিবেশিক আইন চালু হলে চুয়াড়রা তাদের পাইকান জমি হারায়। ফলে চুয়াড়দের জীবিকা নির্বাহ দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।
  • সূর্যাস্ত আইন – 1793 খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারগণ বছরের নির্দিষ্ট দিনে সূর্য ডোবার আগে রাজস্ব দিতে না পারলে চুয়াড়দের জমি সরকার কেড়ে নিত। একে ‘সূর্যাস্ত আইন’ বলা হয়। এরপর সরকার নিলামের মাধ্যমে ওই জমিদারি নতুন জমিদারকে প্রদান করত। এর ফলে মেদিনীপুর অঞ্চলের জমিদার ও কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
  • রাজস্ব আদায়কারীদের অত্যাচার – কোম্পানির রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীরা রাজস্ব আদায়ের নামে চুয়াড়দের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু করলে চুয়াড়রা স্থানীয় জমিদারদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।

চুয়াড় বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, মানভূম, ধলভূম অঞ্চলের কৃষক ও উপজাতিরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। 1768 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1799 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় 30 বছর ধরে এই বিদ্রোহ চলেছিল।

চুয়াড় বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য –

চুয়াড় বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • উপজাতি ও কৃষক বিদ্রোহ – চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল উপজাতি ও কৃষক বিদ্রোহ। চুয়াড় অধ্যুষিত এলাকায় ব্রিটিশ সরকারের উচ্চহারে রাজস্ব আদায়ের সিদ্ধান্ত এই বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।
  • ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ – চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশবিরোধী অভ্যুত্থান। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল।
  • জমিদার কৃষক সম্মিলিত বিদ্রোহ – ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে চুয়াড় বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল এই অঞ্চলের জমিদাররা। এই বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন – ঘাটশিলার জমিদার জগন্নাথ সিং ধল, রাইপুরের জমিদার দুর্জন সিংহ প্রমুখ।
  • দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহ – চুয়াড় বিদ্রোহ দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল। এই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল 1768 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এবং শেষ হয়েছিল 1799 খ্রিস্টাব্দে।

চুয়াড় বিদ্রোহের ব্যাপকতা লেখো। ব্রিটিশ সরকার কীভাবে চুয়াড় বিদ্রোহ প্রতিরোধ করে?

চুয়াড় বিদ্রোহের ভূমিকা –

চুয়াড় বা ‘চোয়াড়’ কথাটির অর্থ হল – দুর্বৃত্ত ও নীচ জাতি। 1798-1799 খ্রিস্টাব্দে চুয়াড়রা বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ এবং মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিম অংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাস করত।

চুয়াড় বিদ্রোহের ব্যাপকতা –

1798-1799 খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত চুয়াড় বিদ্রোহে বিদ্রোহী চুয়াড়দের সঙ্গে জমিদারদের পাইকরাও জোট বেঁধেছিল। তারা সমবেতভাবে মেদিনীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ চালায়। বিদ্রোহীরা একে একে কাশিজোড়, বাসুদেবপুর, তমলুক, জলেশ্বর, বলরামপুর, দুবাগড়, রামগড়, শালবনি প্রভৃতি পরগনার উপর আক্রমণ ও লুণ্ঠন চালাতে থাকে। সংক্ষেপে বলা যায়, 1898 খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে সমগ্র মেদিনীপুর জেলায় এমন কোনো স্থান ছিল না যা বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। 1799 খ্রিস্টাব্দে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন অংশ জনশূন্য হয়ে পড়ে। এই পর্বে রায়গড়, বীরভূম, শতপতি, শালবনি প্রভৃতি পরগনায় বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর খণ্ডযুদ্ধ হয়। 1799 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পুরাবিত্রা ও আনন্দিনী নামক দুটি তালুকের এবং 1800 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তমলুকের বাসুদেবপুর অঞ্চলের চাষিরা খাজনা বন্ধ করে বিদ্রোহীদের দলে যোগদান করেছিল।

ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক চুয়াড় বিদ্রোহের প্রতিরোধ –

ব্রিটিশ সরকার চুয়াড় বিদ্রোহ দমনের জন্য বিভিন্ন কূটকৌশল প্রয়োগ করে। তারা বিভেদনীতি প্রয়োগ করে চুয়াড় সর্দার ও পাইকদের পুলিশের কাজে নিযুক্ত করে বিদ্রোহীদের নিস্তেজ করে দেয়। অতঃপর বিদ্রোহী চুয়াড়দের চুয়াড় সর্দারদের অধীনে রাখা হয়। এক-একজন সর্দারের অধীনে 200 থেকে 400 জন চুয়াড়বাসীকে রাখা হয়। এইভাবে অর্থের দ্বারা স্বাধীন চুয়াড়দের ক্রয় করে ব্রিটিশ সরকার চুয়াড় বিদ্রোহ দমন করে।

চুয়াড় বিদ্রোহের গুরুত্ব বা ফলাফল বিশ্লেষণ করো।

1768 খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, মানভূম, ধলভূম অঞ্চলের কৃষক ও উপজাতিরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। 1768 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1799 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় 30 বছর ধরে এই বিদ্রোহ চলেছিল।

চুয়াড় বিদ্রোহের গুরুত্ব/ফলাফল –

  • অন্যান্য বিদ্রোহের পথপ্রদর্শক – চুয়াড় বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের প্রথমদিকে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে চুয়াড়দের বিদ্রোহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্রোহীদের উৎসাহিত করেছিল।
  • জমিদার ও কৃষক ঐক্য – চুয়াড় বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল জমিদাররা। জমিদারদের নেতৃত্বে কৃষকরা ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।
  • বিদ্রোহী জমিদারদের সঙ্গে আপস – ব্রিটিশ সরকার দমনপীড়নের মাধ্যমে চুয়াড় বিদ্রোহ দমন করতে না পেরে বিদ্রোহী জমিদারদের সঙ্গে আপস মীমাংসার পথ বেছে নেয়। ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চলে নিলামের মাধ্যমে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার নীতি ত্যাগ করে।
  • জঙ্গলমহল জেলা গঠন – চুয়াড় বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে 1805 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার 18 নং রেগুলেশন জারি করে উপদ্রুত এলাকাগুলিকে নিয়ে জঙ্গলমহল জেলা গঠন করে। এই জেলার সদর দপ্তর হয় বাঁকুড়া। জঙ্গলমহল জেলার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন হেনরি স্ট্র্যাচি।

পলিগার বিদ্রোহ – টীকা লেখো।

অথবা, পলিগার কারা ছিল? এই বিদ্রোহের কারণ ব্যাখ্যা করো।

পলিগার –

পলিগাররা ছিল তামিলনাড়ু অঞ্চলের ভূসম্পত্তির মালিক। পলিগার নামটি ইংরেজদের দেওয়া। দক্ষিণ ভারতের অন্যতম ব্যতিক্রমী এই বিদ্রোহ ‘পলিগার বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।

পলিগার বিদ্রোহের কারণ –

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাচার, উচ্চহারে ভূমিরাজস্ব সমগ্র ভারতের মতো দক্ষিণ ভারতের মানুষকেও বিদ্রোহে উৎসাহিত করেছিল। 1803 খ্রিস্টাব্দে উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করার প্রতিবাদে দক্ষিণ ভারতের তিনেভেল্লি, কারনল, অনন্তপুর, বেলারি, কুড্ডাপ্পা প্রভৃতি স্থানের পলিগাররা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। পলিগারদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও এই বিদ্রোহে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। পলিগারদের সমাজে যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। ফলে বেশ কয়েক বছর তারা ইংরেজদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখতে সক্ষম হয়।

পলিগার বিদ্রোহের অবসান –

অবশ্য শেষপর্যন্ত ইংরেজদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও দক্ষ সেনাবাহিনীর কাছে তারা পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছিল।

কোল বিদ্রোহ (1831-1832 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, কোল বিদ্রোহ – টীকা লেখো।

কোল বিদ্রোহ –

কোলরা হল বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতি। তারা ইংরেজ, দেশীয় মহাজন, জমিদার বা বহিরাগত ‘দিকু’-দের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছিল, তা ইতিহাসে কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। 1820 খ্রিস্টাব্দে কোলরা প্রথম বিদ্রোহ করে। 1831-1832 খ্রিস্টাব্দে কোল বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে।

কোল বিদ্রোহের কারণ –

কোল বিদ্রোহের কারণগুলি হল –

  • অত্যধিক রাজস্ব আদায় – ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছোটোনাগপুর অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণের পর এই অঞ্চলে বসবাসকারী কোলদের উপর নতুন হারে অতিরিক্ত ভূমিরাজস্ব দাবি করে। এর ফলে কোলরা ক্ষুব্ধ হয়।
  • জমিদার ও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচার – ছোটোনাগপুর অঞ্চলে জমিদার ও মহাজনরা বিভিন্নভাবে কোলদের উপর শোষণ ও অত্যাচার চালায়। কোলরা অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

কোল বিদ্রোহ –

1831 খ্রিস্টাব্দে রাঁচি অঞ্চলে কোল সম্প্রদায়ের কৃষকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ ক্রমে রাঁচি, সিংভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ ও মানভূম -এর পশ্চিম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

বিদ্রোহী কোলরা তিরধনুক, বর্শা, বল্লম, কুড়ুল ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর মুখোমুখি রুখে দাঁড়ায়। তারা ওই অঞ্চলের ইংরেজ কর্মচারী, জমিদার, মহাজন ও অত্যাচারী দিকু ব্যবসায়ীদের আক্রমণ করে। বিদ্রোহীরা তাদের হত্যা করে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।

কোল বিদ্রোহের নেতা –

এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সুই মুন্ডা ও ঝিন্দরাই মানকি প্রমুখ।

কোল বিদ্রোহের দমন –

ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহ দমন করার জন্য কলকাতা, পাটনা, দানাপুর, সম্বলপুর থেকে সৈন্য এনে এই অঞ্চলের বিদ্রোহ দমনের জন্য মোতায়েন করে। আধুনিক অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত ব্রিটিশ গোলন্দাজ বাহিনীর সঙ্গে অসম লড়াইতে কোলরা পরাজিত হয়। নরনারী ও শিশু-সহ অসংখ্য কোল নিহত হয় এবং কোল বিদ্রোহ দমিত হয়।

কোল বিদ্রোহের উপসংহার –

কোল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ব্রিটিশ সরকার ছোটোনাগপুর অঞ্চলে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি নামে একটি নতুন অঞ্চল গঠন করে। এই অঞ্চলে জমিদারদের হাত থেকে জমি গ্রামপ্রধানদের হাতে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করে। ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চলে তাদের আইনকানুন কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

কোল বিদ্রোহের কারণগুলি উল্লেখ করো।

বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলে বসবাসকারী কোলরা জমিদার, মহাজন ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছিল, তা ইতিহাসে কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। 1820 খ্রিস্টাব্দে কোলরা প্রথম বিদ্রোহ করেছিল এবং 1831-1832 খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।

কোল বিদ্রোহের কারণ –

  • অত্যধিক রাজস্ব আদায় – ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছোটোনাগপুর অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণের পর এই অঞ্চলে বসবাসকারী কোলদের উপর অতিরিক্ত ভূমিরাজস্ব আরোপ করে। এতে উপজাতি কোলরা ক্ষুব্ধ হয়।
  • মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচার – ছোটোনাগপুর অঞ্চলের জমিদার ও মহাজনরা বিভিন্নভাবে কোলদের উপর শোষণ ও অত্যাচার চালাত। এই শোষণ ও অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির জন্য কোলরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
  • ব্রিটিশ আইনের প্রবর্তন – কোলরা তাদের নিজস্ব সামাজিক নিয়মে পরিচালিত হত। কোম্পানি তাদের উপর ব্রিটিশ আইন চাপিয়ে দেয়। তাদের ঐতিহ্যগত ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে কোলদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।
  • ইজারাদার ও ঠিকাদারদের শোষণ – এই অঞ্চলের ইজারাদার ও ঠিকাদাররা কোলদের সর্বস্ব কেড়ে নিত ও বিভিন্নভাবে তাদের শোষণ করত। সরকারি রাস্তা তৈরি করার জন্য তাদের বেগার খাটানো হত। এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

কোল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

অথবা, 1831 খ্রিস্টাব্দের কোল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।

কোল বিদ্রোহের ভূমিকা –

কোলরা হল বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী উপজাতি। তারা 1831-1832 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ কর্মচারী, বহিরাগত দিকু, মহাজন, জমিদারদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিল, তা ইতিহাসে কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

কোল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য –

এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • আদিবাসী বা উপজাতি বিদ্রোহ – কোল বিদ্রোহ ছিল আদিবাসী বা উপজাতি বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল আদিবাসী কোলরা।
  • ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ – কোল বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশবিরোধী প্রতিবাদ সংগ্রাম। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছোটোনাগপুর অঞ্চলের অধিকার লাভ করার পর তাদের উপর নতুন ভূমিরাজস্ব নীতি কার্যকর করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কোলরা ব্রিটিশ ও তাদের সহযোগী জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
  • কোলদের চিরাচরিত অধিকার রক্ষার বিদ্রোহ – কোলরা তাদের প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থা অনুসারে নিজেদের পরিচালিত করত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নতুন রাজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা কোলদের উপর প্রয়োগ করলে কোলরা বিক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
  • শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্তির বিদ্রোহ – ছোটোনাগপুরের কোল অধ্যুষিত অঞ্চলে কোম্পানির অধিকার কায়েম হওয়ার পর এই অঞ্চলে জমিদার ও মহাজন শ্রেণির আগমন ঘটে ও তাদের শোষণ শুরু হয়। দীর্ঘদিন ধরে শোষিত ও অত্যাচারিত কোলরা এই অবিচারের হাত থেকে মুক্তি পেতে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

কোল বিদ্রোহের ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলি কী ছিল?

কোল বিদ্রোহের ভূমিকা –

ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পর প্রায় 100 বছর ধরে সরকার, জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার ও শোষণের বিরদ্ধে অনেক কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। কোল বিদ্রোহ ছিল এগুলির মধ্যে অন্যতম। রাঁচি, সিংভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ অঞ্চলে 1820 খ্রিস্টাব্দে কোল বিদ্রোহের সূচনা হয় এবং 1832 খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে।

কোল বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণসমূহ –

বিভিন্ন কারণে কোল বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। যথা –

  • নেতাদের উপযুক্ত দক্ষতার অভাব – বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সুই মুন্ডা প্রমুখ কোলদের সমবেত করে বিদ্রোহের সূচনা করলেও তাদের মধ্যে উপযুক্ত দক্ষতার অভাব ছিল। ফলে এই বিদ্রোহের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • বিদ্রোহের সীমাবদ্ধতা – কোল বিদ্রোহ রাঁচি, সিংভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ, মানভূমের পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর বাইরে অন্যত্র বিদ্রোহের বিশেষ কোনো প্রভাব পড়েনি। তাই বলা যায়, আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতাও ছিল কোল বিদ্রোহের ব্যর্থতার অপর একটি কারণ।
  • আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও রণকৌশলের অভাব – বিদ্রোহ দমনের জন্য ইংরেজরা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী, গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে হাজার হাজার কোল নরনারী ও শিশুদের হত্যা করে। তাদের উন্নত অস্ত্র ও সামরিক বাহিনীর সামনে কোলরা দুর্বল হয়ে যায় ও বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
  • শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সমর্থনের অভাব – কোল বিদ্রোহীরা সমাজের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সমর্থন বা সহযোগিতা পায়নি। ফলে এই আন্দোলন সুসংহত রূপলাভ করতে ব্যর্থ হয়।

কোল বিদ্রোহের ফলাফলগুলি উল্লেখ করো।

ছোটোনাগপুর অঞ্চলে বসবাসকারী কোলরা ইংরেজ, জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা ইতিহাসে কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। 1831-1832 খ্রিস্টাব্দে কোল বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।

কোল বিদ্রোহের ফলাফল –

  • দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেলি গঠন – ব্রিটিশ সরকার উপজাতি কোলদের বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হলেও তাদের নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছিল। সরকার 1834 খ্রিস্টাব্দে কোল উপজাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলি নিয়ে কোলদের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি নামে একটি অঞ্চল গঠন করে।
  • কোলদের স্বাধিকার রক্ষা – কোলদের ঐতিহ্যগত রীতিনীতির উপর হস্তক্ষেপ কোল বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল। তাই ব্রিটিশ সরকার কোলদের নিজস্ব বিষয়ে আর হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করে।
  • বহিরাগতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা – কোলদের শোষণ ও অত্যাচার করত বহিরাগত জমিদার, মহাজন-সহ ‘দিকু’ শ্রেণির মানুষজন। বিদ্রোহের পরবর্তীকালে কোলদের উপর বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
  • ব্রিটিশ আইন রদ – ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে যে, কোলদের এলাকায় আর ব্রিটিশ আইন কার্যকর হবে না। কোলরা তাদের নিজস্ব আইন ও প্রথার দ্বারা পরিচালিত হবে।

1855 খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছিল কেন?

অথবা, সাঁওতালরা দিকু দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল কেন?

সাঁওতালরা বিদ্রোহের ভূমিকা –

সাঁওতালরা হল কঠোর পরিশ্রমী শান্তিপ্রিয় এক কৃষিজীবী আদিবাসী সম্প্রদায়। সাঁওতাল-সহ বিভিন্ন উপজাতির মানুষদের কাছে মহাজন, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, খ্রিস্টান মিশনারি-সহ সকল প্রকার বহিরাগতদের পরিচয় ছিল ‘দিকু’ নামে। 1855-1856 খ্রিস্টাব্দে রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশে ‘দামিন-ই-কোহ’ অঞ্চলের সাঁওতালরা ‘দিকু’-দের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। সাঁওতাল বিদ্রোহ নানা কারণে সংঘটিত হয়েছিল।

1855 খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছিল কেন?

সাঁওতালরা বিদ্রোহের কারণ –

  • অত্যধিক হারে ভূমিরাজস্ব আদায় – দামিন-ই-কোহ অঞ্চলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিযুক্ত জমিদাররা অত্যধিক হারে ভূমিরাজস্ব আদায় করে। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলে 18 বছরে 10 গুণ খাজনা বৃদ্ধি করা হয়। অত্যধিক হারে খাজনা মেটাতে নাজেহাল সাঁওতালরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
  • মহাজনদের শোষণ – কোম্পানির নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় নগদ অর্থে খাজনা দিতে হত। সাঁওতালরা এই নগদ অর্থ সংগ্রহের জন্য মহাজনদের কাছে ঋণ নিত। মহাজনরা সাঁওতালদের ঋণ দেওয়ার সুযোগে শতকরা 50-100 হারে সুদ আদায় করত। তা ছাড়াও তারা নানা কৌশলে সাঁওতালদের শোষণ করত। এতে সাঁওতালরা ক্ষুব্ধ হয়।
  • ইংরেজ কর্মচারী ও ঠিকাদারদের অত্যাচার – লর্ড ডালহৌসি -এর আমলে রাজমহল, রামপুরহাট, ভাগলপুর প্রভৃতি অঞ্চলে রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হয়। ওই অঞ্চলে এই কাজের জন্য বিভিন্ন কর্মচারী ও ঠিকাদারদের আগমন ঘটে। এরা নানাভাবে সাঁওতালদের উপর অত্যাচার করত। এরা নামমাত্র মজুরিতে সাঁওতালদের দিয়ে কাজ করাত। তাদের বাড়ির হাঁস, মুরগি, ছাগল কেড়ে নিত এমনকি নারীদের সম্মানহানিতেও পিছপা হত না। এতে সাঁওতালরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
  • সাঁওতাল সমাজে ব্রিটিশ আইন প্রবর্তন – সাঁওতালরা তাদের প্রচলিত নিজস্ব সামাজিক নিয়মে পরিচালিত হত। ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালদের উপর ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থা কার্যকর করে। ফলে সাঁওতালদের চিরাচরিত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় তারা ক্ষুব্ধ হয়।
  • ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি – বেশি দামে জিনিসপত্র বিক্রি করা, জোর করে দাম না দিয়ে বা স্বল্পমূল্যে খেতের ফসল কেনা, বাটখারাতে কারচুপি করা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ব্যবসায়ীরাও সাঁওতালদের শোষণ করত।

সাঁওতালরা বিদ্রোহের উপসংহার –

এ ছাড়া বহিরাগত বা দিকু-দের দ্বারা সাঁওতাল রমণীদের নির্যাতন ও তাদের প্রতি অসম্মানজনক ব্যবহার, মিশনারিদের দ্বারা ধর্মান্তরিত করার অপচেষ্টা প্রভৃতি কারণেও সাঁওতালরা দিকুদের উপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

সাঁওতাল বিদ্রোহের ভূমিকা –

1855-1856 খ্রিস্টাব্দে দামিন-ই-কোহ অঞ্চলে সাঁওতালরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

সাঁওতাল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য –

সাঁওতাল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • আদিবাসী বা উপজাতি বিদ্রোহ – সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল আদিবাসী বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল আদিবাসী সাঁওতালরা।
  • ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ – দামিন-ই-কোহ অঞ্চলে নতুন ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব নীতি কার্যকর করা হলে সাঁওতালরা ক্ষুব্ধ হয় এবং তারা ব্রিটিশ সরকার ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
  • সাঁওতালদের চিরাচরিত অধিকার রক্ষার বিদ্রোহ – ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন চালু হলে সাঁওতালদের উপরও ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থা কার্যকর হয়। কিন্তু সাঁওতালরা তাদের চিরাচরিত প্রথা অনুসারে পরিচালিত হত। ফলে সাঁওতালদের মধ্যে ব্রিটিশ আইন ও বিচার প্রযুক্ত হলে তারা বিক্ষুব্ধ হয়।
  • শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ – সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল সাঁওতালদের উপর জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মচারীদের শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্তির বিদ্রোহ। প্রকৃতিগতভাবে সাঁওতালরা ছিল সরল ও শান্তিপ্রিয় কৃষিজীবী আদিবাসী সম্প্রদায়। ‘দিকু’-রা এদের উপর শোষণ ও অত্যাচার চালালে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল কী হয়েছিল?

সাঁওতাল বিদ্রোহের ভূমিকা –

সাঁওতালি ভাষায় বিদ্রোহকে বলা হয় ‘হুল’। সুতরাং সাঁওতাল বিদ্রোহকেই ‘সাঁওতাল হুল’ বলা হয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল –

সাঁওতাল বিদ্রোহ (1855-1856 খ্রিস্টাব্দ) ব্যর্থ হলেও এর ফলাফলের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

  • সাঁওতাল পরগনা গঠন – সাঁওতাল বিদ্রোহ দমিত হলেও ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালদের প্রতি নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সরকার সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামে জেলা গঠন করে।
  • সাঁওতালদের বিশেষ অধিকারের স্বীকৃতি – সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলে সাঁওতালদের পৃথক ‘উপজাতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সাঁওতাল গোষ্ঠীপতিদের বিশেষ অধিকার স্বীকার করা হয়। সাঁওতালদের মধ্যে ব্রিটিশ আইন কার্যকর হবে না বলেও সরকার ঘোষণা করে।
  • মহাজনদের শোষণে নিষেধাজ্ঞা জারি – ব্রিটিশ সরকার মহাজনদের সুদের হার নির্দিষ্ট করে দেয়। তা ছাড়া সাঁওতালদের এলাকায় ‘দিকু’ মহাজনদের বসবাস নিষিদ্ধ করে।
  • খ্রিস্টান মিশনারিদের সক্রিয়তা বৃদ্ধি – ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সাঁওতালদের আনুগত্য বৃদ্ধির জন্য সাঁওতালদের এলাকায় খ্রিস্টান মিশনারিদের অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়। সাঁওতালদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নীতি গ্রহণ করা হয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব প্রসঙ্গে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, যদি 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মনে করা হয় তবে সাঁওতাল বিদ্রোহকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত। সুপ্রকাশ রায় বলেছেন যে, সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ‘মহাবিদ্রোহের অগ্রদূতস্বরূপ’।

সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো।

সাঁওতাল বিদ্রোহের ভূমিকা –

ভারতে উপজাতি বিদ্রোহগুলির মধ্যে তীব্রতা ও ব্যাপকতার দিক থেকে সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ। কিন্তু এই বিদ্রোহের প্রকৃতি বা স্বরূপ সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা একমত হতে পারেননি।

সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি –

  • কৃষক বিদ্রোহ – কিছু ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহের আগে সংঘটিত সবচেয়ে ভয়ংকর কৃষক বিদ্রোহ বলে মনে করেছেন। তবে কেবলমাত্র সাঁওতাল কৃষকেরাই নয়, স্থানীয় তেলি, কুমোর, কর্মকার, মুসলিম জোলা ইত্যাদি সম্প্রদায় ও পেশার মানুষও এই বিদ্রোহে যোগ দেয়। এই বিদ্রোহ কেবল জমিদার ও মহাজনবিরোধী ছিল না, বরং তা ছিল স্পষ্টতই ব্রিটিশবিরোধী।
  • ধর্মীয় বিদ্রোহ – আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউ কেউ সাঁওতাল বিদ্রোহকে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া বিদ্রোহ বলে আখ্যা দেন। সিধু-কানু ঘোষণা করেন যে, বিদেশিদের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহ ঈশ্বরের আদেশেই সংঘটিত করা হচ্ছে।
  • সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিদ্রোহ – ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের ফলে যে সাম্রাজ্যবাদী শোষণভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, এই বিদ্রোহ তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
  • গণবিদ্রোহ – ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার সাঁওতাল বিদ্রোহকে গণবিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ডঃ কালীকিংকর দত্তের মতে, বাংলা ও বিহারের ইতিহাসে বিদ্রোহটি নবযুগের সূচনা করে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো।

সাঁওতাল বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

সাঁওতাল বিদ্রোহটি ব্যর্থ হলেও প্রকৃতিগতভাবে এক বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। কারণ – এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়েই পরবর্তীকালে সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারা উদ্যোগী হয়।

মুন্ডা বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, মুন্ডা বিদ্রোহ (1899-1900 খ্রিস্টাব্দ) – টীকা লেখো।

মুন্ডা বিদ্রোহের ভূমিকা –

বর্তমান ঝাড়খণ্ডের ছোটোনাগপুরের রাঁচি ও সিংভূম অঞ্চলে মুন্ডারা বসবাস করত। 1899-1900 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের শোষণ ও অত্যাচারী দিকুদের বিরুদ্ধে মুন্ডারা যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা মুন্ডা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। একে মুন্ডা উলগুলান বলেও অভিহিত করা হয়।

মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ –

মুন্ডা বিদ্রোহের কারণগুলি হল –

  • মুন্ডাদের যৌথ কৃষিব্যবস্থায় ভাঙন – মুন্ডারা জঙ্গল পরিষ্কার চালু করায় মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয়। করে কৃষিকাজ করত। ব্রিটিশ আমলে তাদের যৌথ কৃষিব্যবস্থা বা খুৎকাঠি প্রথার অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যবস্থা।
  • মুন্ডা অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রচলন – মুন্ডারা তাদের নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুন্ডাদের উপর ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রয়োগ করলে মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয় ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

মুন্ডা বিদ্রোহ –

মুন্ডারা ব্রিটিশ কর্মচারী, জমিদার, মহাজন, ধর্মপ্রচারক প্রভৃতি ব্যক্তির উপর বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ হয় এবং ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

  • মুন্ডারা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
  • তারা তাদের এলাকা থেকে অত্যাচারী দিকুদের তাড়িয়ে দেয়।
  • 1899 খ্রিস্টাব্দে বিরসা ও তাঁর অনুগামীরা রাঁচি ও সিংভূম জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও গির্জা আক্রমণ করে।

মুন্ডা বিদ্রোহের নেতা –

মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন বিরসা মুন্ডা।

মুন্ডা বিদ্রোহের দমন –

1899-1900 খ্রিস্টাব্দে মুন্ডা বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করলে ব্রিটিশ সরকার এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে। ব্রিটিশ বাহিনীর দমনপীড়নের ফলে মুন্ডাদের পরাজয় ঘটে। বিরসা বন্দি হন এবং 1900 খ্রিস্টাব্দের 9 জুন বন্দি অবস্থায় বিরসার মৃত্যু হয়।

মুন্ডা বিদ্রোহের উপসংহার –

মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ব্রিটিশ সরকার ছোটোনাগপুর অঞ্চলে প্রজাস্বত্ব আইন (1908 খ্রিস্টাব্দ) পাস করে মুন্ডাদের জমিতে ‘খুৎকাঠি স্বত্ব’ পুনঃপ্রবর্তন করেন। মুন্ডাদের এলাকায় দিকুদের শোষণ ও অত্যাচার নিয়ন্ত্রণ করা হয় ও বেগার প্রথার অবসান ঘটানো হয়। পরবর্তীকালে বিরসার অনুগামীরা বিরসা সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করে।

মুন্ডা বিদ্রোহের কারণগুলি উল্লেখ করো।

ভারতের উপজাতি বিদ্রোহগুলির মধ্যে মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল অন্যতম। মুন্ডারা 1898-1899 খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ –

মুন্ডা বিদ্রোহের কারণগুলি হল –

  • যৌথ কৃষিব্যবস্থায় ভাঙন – মুন্ডারা জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিকাজ করত। ব্রিটিশ আমলে তাদের যৌথ কৃষিব্যবস্থা বা খুৎকাঠি প্রথায় ভাঙন ধরে। সরকার জমিতে ব্যক্তিগত ব্যবস্থা চালু করে। ফলে মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয়।
  • বেগার প্রথা – জমিদার ও মহাজনরা মুন্ডাদের উপর নানা ধরনের কর আরোপ করত। তারা মুন্ডাদের বেত বেগারি বা বিনা মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করত। এর ফলে মুন্ডাদের মধ্যে অসন্তোষ ঘনীভূত হয়।
  • মুন্ডাদের আইন ও বিচারব্যবস্থার পরিবর্তন – মুন্ডাদের নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা ছিল। তারা নিজেদের বিবাদের মীমাংসা নিজেরাই করত। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত আইন ও বিচারব্যবস্থা মুন্ডাদের উপরেও বলবৎ হয়। ফলে মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয়।
  • মুন্ডাদের ধর্মান্তরিতকরণ – ক্যাথলিক, লুথেরান প্রভৃতি খ্রিস্টান মিশনারিরা মুন্ডাদের বিভিন্ন প্রলোভন বা ভয় দেখিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করত। মিশনারিরা মুন্ডাদের চিরাচরিত ঐতিহ্য ও ধর্ম সম্পর্কে নানা ধরনের কুৎসা করত। এতে মুন্ডারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
  • মুন্ডাদের নৈতিক অধঃপতন ঘটানো – বহিরাগত দিকু, মহাজন এবং ঠিকাদার শ্রেণির লোকেরা অর্থ উপার্জনের জন্য মুন্ডাদের এলাকাগুলিতে মদ ও নেশার জিনিস বিক্রি করতে থাকে। এতে মুন্ডাদের মধ্যে চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটে। মুন্ডা নেতারা এই অবক্ষয় ঘটানোর বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়।
  • ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন – ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন দ্বারা মুন্ডাদের কাছ থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে মুন্ডাদের জীবন ও জীবিকা সমস্যায় পড়ে।

বিরসা মুন্ডা বিখ্যাত কেন?

বিরসা মুন্ডা ছিলেন মুন্ডা বিদ্রোহের নেতা। 1899-1900 খ্রিস্টাব্দে ছোটোনাগপুর ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে আদিবাসী মুন্ডারা বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল।

বিরসা মুন্ডার প্রথম জীবন –

বিরসা মুন্ডা 1875 খ্রিস্টাব্দে রাঁচি জেলার উলিহাতু গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সুগান মুন্ডা ছিলেন উলিহাতু গ্রামের একজন ভাগচাষি। বাল্যকালে বিরসা মুন্ডা খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে লেখাপড়া করেন।

মুন্ডা নেতা হিসেবে বিরসার উত্থান –

বিরসা মুন্ডা ধীরে ধীরে মুন্ডাদের নেতায় পরিণত হন। তিনি 1893-1894 খ্রিস্টাব্দে গ্রামের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। 1895 খ্রিস্টাব্দে তিনি ভগবানের দর্শন পেয়েছেন বলে দাবি করেন এবং নিজেকে ‘অবতার’ বলে ঘোষণা করেন। মুন্ডা সমাজে নতুন রীতিনীতির প্রবর্তন করেন বিরসা। যেমন – কুসংস্কারের বিরোধিতা করা, মাদক বর্জন করা, উপবীত ধারণ করা প্রভৃতি।

ব্রিটিশ সরকারবিরোধী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ –

ব্রিটিশ সরকার বিভিন্নভাবে মুন্ডাদের শোষণ ও অত্যাচার করত। বিরসা মুন্ডা এর প্রতিকারের জন্য মুন্ডাদের ঐক্যবদ্ধ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বিদ্রোহীরা রাঁচি, সিংভূম এলাকার গির্জাগুলিতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে এবং অফিস, থানা ও ইংরেজ কর্মচারীদেরও আক্রমণ করে।

আন্দোলনের অবসান –

বিরসা মুন্ডার বিদ্রোহে আতঙ্কিত হয়ে সরকার মুন্ডা বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করে এবং বিরসা মুন্ডাকে বন্দি করে।

বিরসা মুন্ডার মৃত্যু –

বিরসাকে রাঁচি জেলে বন্দি করে রাখা হয়। সেখানে 1900 খ্রিস্টাব্দে মাত্র 25 বছর বয়সে বিরসা মুন্ডার মৃত্যু হয়।

মুন্ডা বিদ্রোহের (1899-1900 খ্রিস্টাব্দ) গুরুত্ব আলোচনা করো।

অথবা, মুন্ডা বিদ্রোহের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো।

মুন্ডা বিদ্রোহের ভূমিকা –

মুন্ডারা 1898-1899 খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী।

মুন্ডা বিদ্রোহের গুরুত্ব –

মুন্ডা বিদ্রোহের গুরুত্ব হল –

  • প্রজাস্বত্ব আইন পাস – মুন্ডা বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ সরকার মুন্ডাদের অভাব-অভিযোগ দূর করতে সচেষ্ট হয়। এজন্য ব্রিটিশ সরকার 1908 খ্রিস্টাব্দে ‘ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন’ (Chotonagpur Tenancy Act, 1908) পাস করে।
  • খুৎকাঠি প্রথার স্বীকৃতি – ছোটোনাগপুরে প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে মুন্ডাদের খুৎকাঠি প্রথা বা জমির যৌথ মালিকানা প্রথাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
  • বেগার প্রথার অবসান – জমিদার, মহাজন ও ঠিকাদাররা মুন্ডাদের বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করত। এই বেগার প্রথা মুন্ডা বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল। ব্রিটিশ সরকার মুন্ডাদের বেগার খাটানোর প্রথাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে।
  • বিরসা সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ – মুন্ডা বিদ্রোহের ফলে মুন্ডাদের মধ্যে বিরসা মুন্ডার ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। বিদ্রোহের পর ‘বিরসা সম্প্রদায়’ (Birsaite) নামে একটি মুন্ডাগোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যারা বিরসা মুন্ডাকে ভগবানের মতো সম্মান করত।
  • মুন্ডাদের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি – মুন্ডা বিদ্রোহের ফলে মুন্ডাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ লক্ষ করা যায়।
  • অন্যান্য উপজাতিদের মধ্যে প্রভাব – মুন্ডা বিদ্রোহের প্রভাব ছোটোনাগপুরের অন্যান্য উপজাতিদের মধ্যেও পড়ে। ওঁরাও-রা তাদের সৃষ্ট কৃষিজমির মালিকানা পাওয়ার জন্য ‘তানাভকৎ’ আন্দোলন শুরু করে।

মুন্ডা বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

মুন্ডা বিদ্রোহের নেতা বিরসা মুন্ডা উপজাতির স্বার্থরক্ষার জন্য যে আদর্শ প্রচার করেন তাতে মুন্ডারা সচেতন হয়ে ওঠে। ডঃ সুমিত সরকার বিরসা মুন্ডাকে একজন পূর্ণ জাতীয়তাবাদী নেতা বলে অভিহিত করেছেন। মুন্ডা বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

মুন্ডা বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।

ছোটোনাগপুরের রাঁচি, সিংভূম অঞ্চলে আদিবাসী মুন্ডারা বসবাস করত। 1899-1900 খ্রিস্টাব্দে মুন্ডারা জমিদার, মহাজন ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিল, তা মুন্ডা বিদ্রোহ বা মুন্ডা উলগুলান নামে পরিচিত। মুন্ডা বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত লক্ষ করা যায়।

মুন্ডা বিদ্রোহের প্রকৃতি –

  • আদিবাসী বিদ্রোহ – মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল একটি আদিবাসী বিদ্রোহ। আদিবাসী মুন্ডাদের দ্বারা এই বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিল।
  • কৃষক বিদ্রোহ – নরহরি কবিরাজ মুন্ডা বিদ্রোহকে ‘কৃষক বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন। আদিবাসী মুন্ডারা জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি তৈরি করত ও চাষ করত। সরকারের ভূমিরাজস্ব নীতি তাদের বিদ্রোহী করে তুলেছিল।
  • ব্রিটিশবিরোধী গণসংগ্রাম – মুন্ডা বিদ্রোহকে অনেকে ব্রিটিশবিরোধী গণসংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। মুন্ডারা তাদের এলাকা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ ঘটাতে চেয়েছিল।
  • ধর্মীয় বিদ্রোহ – মুন্ডাদের এলাকায় খ্রিস্টান মিশনারিরা খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতেন। এর বিরুদ্ধে মুন্ডারা ঐক্যবদ্ধ হয়। অপরদিকে বিরসা মুন্ডা নিজেকে ‘অবতার’ বলে ঘোষণা করে। বিরসা মুন্ডা তাঁর 6000 অনুগামীদের নিয়ে একটি সৈন্যবাহিনী গঠন করেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।

বিরসা মুন্ডা প্রসঙ্গে KS Singh কী বলেছেন?

বিরসা মুন্ডা প্রসঙ্গে KS Singh বলেছেন যে – ‘No hero in Munda folklore has been commemorated in such moving terms as Birsa’.

ভিল বিদ্রোহ (1819 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, ভিল বিদ্রোহ (1891 খ্রিস্টাব্দ) – টীকা লেখো।

ভিল বিদ্রোহের ভূমিকা –

ভিলরা মধ্য ও পশ্চিম ভারতের অধিবাসী। তারা স্বাধীন ও স্বনির্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। ভিলরা 1819 খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন কারণে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

ভিল বিদ্রোহের কারণ –

  • মাড়োয়ারি মহাজনদের শোষণ – ভিলরা তাদের নানা প্রয়োজনে মাড়োয়ারি মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হত। মাড়োয়ারি মহাজনরা তাদের কাছে অত্যন্ত চড়া হারে সুদ আদায় করত। ফলে ভিলরা সর্বস্বান্ত হত।
  • ইংরেজদের খান্দেশ অধিকার – ইংরেজরা 1818 খ্রিস্টাব্দে খান্দেশ অধিকার করে। এই অঞ্চলে ইংরেজদের নিয়মকানুন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ভিলরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

ভিল বিদ্রোহের বিস্তার –

ভিলরা অত্যাচারী ও শোষক মাড়োয়ারি মহাজনদের আক্রমণ করে। তারা মহাজনদের নাক, কান কেটে তাদের এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়। ভিল বিদ্রোহ খান্দেশ, ধার, মালব প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

ভিল বিদ্রোহের নেতা –

গ্রামের ভিল সর্দাররা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল। খান্দেশের ভিল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন শিউরাম। তিনি গ্রামের একজন কামার ছিলেন।

ভিল বিদ্রোহের দমন –

ব্রিটিশ সরকার সর্বশক্তি দিয়ে দমনের চেষ্টা করলেও ভিল বিদ্রোহ 1845 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল।

ভিল বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

ভিল বিদ্রোহ ব্রিটিশ ও মহাজনবিরোধী বিদ্রোহ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই বিদ্রোহ শোষণ থেকে মুক্তিলাভের প্রতিবাদস্বরূপ আদিবাসী আন্দোলনের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।

ভিল বিদ্রোহের কারণগুলি কী ছিল?

ভিল বিদ্রোহের ভূমিকা –

মধ্য ও পশ্চিম ভারতের অধিবাসী ভিলরা স্বাধীন ও স্বনির্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। নানাবিধ কারণে তারা 1819 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ভিল বিদ্রোহ ক্রমশ খান্দেশ, ধার, মালব প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

ভিল বিদ্রোহের কারণসমূহ –

ভিল বিদ্রোহের পশ্চাতে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল, যথা –

  • মাড়োয়ারি মহাজনদের শোষণ – ভিল সম্প্রদায় তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে মাড়োয়ারি মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করত। এই মহাজন শ্রেণি ভিলদের থেকে অত্যন্ত চড়া সুদ আদায় করত। এর ফলে ভিলরা দুর্দশার সম্মুখীন হত।
  • ইংরেজদের খান্দেশ অধিকার – 1818 খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা খান্দেশ অধিকার করে। এই অঞ্চলে ইংরেজদের নিয়মকানুন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভিলরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
  • কোম্পানির আধিপত্য স্থাপন – ভিল অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। এ ছাড়া ভিলদের চিরাচরিত আইন ও বিচারব্যবস্থা বাতিল করে কোম্পানি নিজস্ব বিচারব্যবস্থা চালু করলে ভিলরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
  • ভূমিরাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি – ব্রিটিশ কোম্পানি ভিল অধ্যুষিত এলাকায় ভূমিরাজস্বের পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করলে ভিলরা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (1763-1800 খ্রিস্টাব্দ) – টীকা লেখো।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ভূমিকা –

ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসনে ইংরেজদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী ও ফকিররা 1763 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল, তা ইতিহাসে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত। মুঘল যুগের শেষদিকে ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসী ও ফকিরগণ বাংলা ও বিহার অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করে কৃষির মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করত। কোম্পানির আমলে বিভিন্ন কারণে তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ –

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের কারণগুলি হল –

  • অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় – ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা কৃষিজীবী সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করার ফলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
  • তীর্থকর আরোপ – সন্ন্যাসী ও ফকিররা মাঝে মাঝে দলবদ্ধভাবে নিজ নিজ তীর্থক্ষেত্রে তীর্থ করতে যেত। কোম্পানির আমলে ইংরেজরা তাদের উপর তীর্থকর আরোপ করায় তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ –

বিদ্রোহী সন্ন্যাসী ও ফকিররা কোম্পানির কুঠি, জমিদারের কাছারি, রাজস্ব দপ্তর প্রভৃতির উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন ইংরেজ সেনাপতি ক্যাপটেন এডওয়ার্ডস। এই বিদ্রোহ রংপুর, দিনাজপুর, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বগুড়া প্রভৃতি অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়েছিল।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ –

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ হলেন মজনু শাহ, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, চিরাগ আলি প্রমুখ ব্যক্তিরা।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ব্যর্থতা –

শেষপর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিভেদ, সাংগঠনিক ত্রুটি এবং নেতৃবর্গের অভিজ্ঞতার অভাবের ফলে এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

পরিশেষে বলা যায়, গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এই বিদ্রোহকে ‘পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব’ বলে ব্যঙ্গ করলেও এটি প্রকৃতপক্ষে ছিল একটি কৃষক বিদ্রোহ। লেস্টর হ্যাচিনসন এই প্রসঙ্গে বলেছেন যে, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ছিল ‘শতবর্ষ পরে সংঘটিত বাংলার বিপ্লববাদী আন্দোলনের অগ্রদূত’।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ভূমিকা –

মুঘল আমলের শেষদিকে ভ্রাম্যমান সন্ন্যাসী ও ফকিরগণ বাংলা ও বিহার অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করে কৃষির মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করত। ইংরেজ কোম্পানির রাজত্বে বিভিন্ন কারণে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। 1763 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সন্ন্যাসী ও ফকিররা সরকারবিরোধী যে বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল, তা ইতিহাসে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ –

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের পিছনে একাধিক কারণ দায়ী ছিল। যথা –

  • রাজস্বের চাপ – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উচ্চহারে রাজস্ব বৃদ্ধি করায় কৃষিজীবী সন্ন্যাসী ও ফকিররা করভারে জর্জরিত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া কোম্পানির কর্মচারীরা প্রায়ই ব্যবসায়ী সন্ন্যাসী-ফকিরদের কাছ থেকে রেশম বা রেশমজাত পণ্য বলপূর্বক ছিনিয়ে নিত।
  • ইজারাদারি শোষণ – সন্ন্যাসী-ফকিরদের অধিকাংশই ছিল কৃষিজীবী। অধিক খাজনা আদায়ের জন্য কোম্পানির ইজারাদারদের শোষণ কৃষকদের ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল।
  • তীর্থকর আরোপ – সন্ন্যাসীরা মাঝেমধ্যেই দলবদ্ধভাবে তীর্থে যেত। কোম্পানি সরকার তাদের উপর তীর্থকর ধার্য করে এবং ফকিরদেরও দরগায় যেতে বাধা দেয়।
  • নির্যাতন – সন্ন্যাসী ও ফকিরদের উপর বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হত।
  • জমিদারদের আর্থিক অবস্থার বিপন্নতা – আগে সন্ন্যাসী-ফকিররা জমিদারদের কাছ থেকে যেরকম দান বা অর্থসাহায্য পেতেন, পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার জমিদারদের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপালে জমিদারদের আর্থিক অবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়ে। ফলে তারা আগের মতো সন্ন্যাসীদের অর্থসাহায্য করতে পারতেন না। এতে সন্ন্যাসীদের জীবননির্বাহ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লে তারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ভূমিকা –

1763-1800 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সন্ন্যাসী ও ফকিররা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিল, তা ইতিহাসে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত। বাংলার সন্ন্যাসী ও ফকিরদের অনেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করে কৃষির মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করত। বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সন্ন্যাসী ও ফকিররা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য –

  • কৃষক বিদ্রোহ – সন্ন্যাসী ও ফকিররা ছিলেন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তাদের মধ্যে যারা কৃষির সঙ্গে যুক্ত ছিল ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা তাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
  • দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহ – সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ছিল প্রায় 40 বছর ধরে চলা এক দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ দীর্ঘদিন ধরে বিস্তীর্ণ এলাকার মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত হয়েছিল।
  • বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যোগদান – সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি কৃষকরা হলেও মুঘল সেনাবাহিনী থেকে কর্মচ্যুত সেনারা, যারা কৃষির উপর নির্ভর করে জীবিকানির্বাহ করত, তারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রোহে যোগ দেয়। উত্তর ভারতের মারাঠা সম্প্রদায়ভুক্ত গোঁসাই, শৈব সম্প্রদায়ের নাগা, ভোজপুরি এবং মাদারি সম্প্রদায়ভুক্ত বিভিন্ন ফকিররাও এই বিদ্রোহে যোগদান করেছিল।
  • হিন্দু-মুসলিম ঐক্য – সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অংশগ্রহণকারী বিদ্রোহী ও নেতৃবৃন্দের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষই ছিল।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের উপসংহার –

প্রকৃতিগত বিচারে তাই সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছিল একটি ব্রিটিশবিরোধী কৃষক সংগ্রাম।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণগুলি কী কী?

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ভূমিকা –

বাংলায় 1763 থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘গিরি’ ও ‘দশনামী’ সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী এবং ‘মাদারি’ সম্প্রদায়ভুক্ত ফকিরদের নেতৃত্বে যে কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, তা ইতিহাসে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ঢাকা থেকে এই বিদ্রোহের সূচনা হয়। ক্রমশ বিদ্রোহের আগুন বগুড়া, মালদহ, রংপুর, দিনাজপুর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণসমূহ –

নানাবিধ কারণে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, যথা –

  • অন্তর্দ্বন্দ্ব – সন্ন্যাসী-ফকিরদের মধ্যে পারস্পরিক আত্মকলহের ফলে বিদ্রোহীদের মধ্যেকার একতা নষ্ট হয়ে যায়। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হলে বিদ্রোহের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • সুযোগ্য নেতার অভাব – 1786 খ্রিস্টাব্দে বগুড়া জেলায় ইংরেজ সেনার গুলিতে আহত হয়ে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা মজনু শাহ প্রাণত্যাগ করেন। এরপর মুসা শাহ, ভবানী পাঠক প্রমুখ ব্যক্তিরাও পরাজিত ও নিহত হন। ফলে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উপযুক্ত নেতার অভাবে তা ব্যর্থ হয়।
  • উপযুক্ত রণকৌশলের অভাব – ইংরেজদের উন্নত সামরিক বাহিনী ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে সন্ন্যাসী-ফকিরদের টিকে থাকা ছিল অসম্ভব। শেষপর্যন্ত ইংরেজদের দমননীতির ফলে এই বিদ্রোহের অবসান হয়।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের উপসংহার –

উপরোক্ত কারণগুলির পাশাপাশি নেতৃত্বের দুর্বলতা, সাংগঠনিক শক্তির অভাব, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা প্রভৃতিও সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ব্যর্থতার পথ প্রশস্ত করে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।

1763 থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সন্ন্যাসী ও ফকিররা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিল, তা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত। সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ আছে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি –

  • যাযাবর ও ডাকাতদের উপদ্রব – ওয়ারেন হেস্টিংস সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহকে ‘হিন্দুস্তানের যাযাবর’ ও ‘পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে ওয়ারেন হেস্টিংসের এই মত সঠিক নয় – কারণ সন্ন্যাসী ও ফকিররা তা ছিল না।
  • কৃষক বিদ্রোহ – উইলিয়ম হান্টার, এডওয়ার্ড ও গ্যারাট সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহকে ‘কৃষক বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ – সন্ন্যাসী ও ফকিরদের অনেকে ধর্মচর্চার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিকাজও করত।
  • দেশরক্ষার সংগ্রাম – লেস্টার হ্যাচিনসন সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহকে ব্রিটিশদের হাত থেকে নিজেদের দেশকে রক্ষা করার সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। সন্ন্যাসী ও ফকিরদের উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চল থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করা।
  • ধর্মরক্ষার জন্য বিদ্রোহ – সন্ন্যাসী ও ফকিররা বিদেশি বিধর্মীদের হাত থেকে নিজেদের ধর্মকে রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। কারণ – খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরাও ভারতীয়দের ধর্মকে অবজ্ঞা করত। অপরদিকে সন্ন্যাসী ও ফকিররা নিজেদের ধর্মের মর্যাদারক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।

ওয়াহাবি আন্দোলন – টীকা লেখো।

ওয়াহাবি আন্দোলন –

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল অন্যতম। 1820 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1885 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় 65 বছর ধরে এই আন্দোলন চলেছিল। ভারতে এই আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছিল পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বাংলা, মাদ্রাজ প্রভৃতি অঞ্চলে।

  • ওয়াহাবি আন্দোলনের উৎপত্তি – ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্ভব হয় আরব দেশে। আবদুল ওয়াহাব ছিলেন এই আন্দোলনের প্রবর্তক। তাঁর নাম অনুসারেই এই আন্দোলনের নামকরণ করা হয় ওয়াহাবি।
  • ওয়াহাবি শব্দের অর্থ – ওয়াহাবি শব্দের অর্থ নবজাগরণ।
  • ওয়াহাবি আন্দোলনের লক্ষ্য – এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল –
    • ইসলামধর্মের বিকৃতি দূর করে তার পুনরুজ্জীবন ঘটানো।
    • ‘দার-উল-হারব’ বা বিধর্মীর দেশ ভারতকে ‘দার-উল-ইসলাম’ বা ধর্মরাজ্যে পরিণত করা।
  • ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলন – ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন দিল্লির বিখ্যাত মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (1703-1787 খ্রিস্টাব্দ) এবং তাঁর পুত্র আজিজ। অবশ্য ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদ। তিনি আজিজের সংস্পর্শে এসে ইসলামধর্মের মধ্যে ‘শুদ্ধিকরণ’ আন্দোলন শুরু করেন। তিনি তাঁর গুরু আজিজের মতো ঘোষণা করলেন যে, ইংরেজ-শাসিত ভারত হল ‘দার-উল-হারব’, সুতরাং ইংরেজদের উচ্ছেদ করে একে ‘দার-উল-ইসলাম’ বা ধর্মরাজ্যে পরিণত করতে হবে। তিনি ইংরেজবিরোধী আদর্শ প্রচার করলেও পাঞ্জাবের শিখদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। 1831 খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আহমদ ‘বালাকোটের যুদ্ধে’ শের সিংহের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।
  • ওয়াহাবি আন্দোলনের অবসান – সৈয়দ আহমদের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য শিষ্য এনায়েত আলি ও বিলায়েত আলি ওয়াহাবি আদর্শ প্রচার করেন। 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির ফলে ওয়াহাবি আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

তারিকা-ই-মহম্মদীয়া – টীকা লেখো।

তারিকা-ই-মহম্মদীয়ার ভূমিকা –

তারিকা-ই-মহম্মদীয়া শব্দের অর্থ হল মহানবি মহম্মদ প্রদর্শিত পথ। অষ্টাদশ শতকে মহম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব (1703-1787 খ্রিস্টাব্দ) নামে এক ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর প্রবর্তিত আন্দোলন ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম তারিকা-ই-মহম্মদীয়া।

তারিকা-ই-মহম্মদীয়া আন্দোলনের উদ্দেশ্য –

তারিকা-ই-মহম্মদীয়া আন্দোলনের উদ্দেশ্যগুলি হল নিম্নরূপ –

  • তারিকা-ই-মহম্মদীয়া আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য হল মহম্মদ প্রদর্শিত পথ প্রতিষ্ঠা করা।
  • ইসলাম ধর্মের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কারগুলি দূর করে ইসলাম ধর্মকে নতুনভাবে গড়ে তোলা।
  • ভারতের আন্দোলনকারীরা ব্রিটিশ-শাসিত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ বা ‘বিধর্মীর দেশ’ বা ‘শত্রুর দেশ’ বলে মনে করত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে শত্রুমুক্ত করা।

ভারতে তারিকা-ই-মহম্মদীয়া –

ভারতে তারিকা-ই-মহম্মদীয়া আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যুক্তপ্রদেশের রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহমদ ব্রেলভি। তিনি ভারতে ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তিনি কয়েকবার কলকাতায় এসে তারিকা-ই-মহম্মদীয়ার আদর্শ প্রচার করেন। তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে আন্দোলন পরিচালনা করেন।

বাংলায় তারিকা-ই-মহম্মদীয়া –

বাংলায় তারিকা-ই-মহম্মদীয়া আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন মির নিশার আলি বা তিতুমির। তাঁর নেতৃত্বে এই আন্দোলন চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, মালদহ, ঢাকা, রাজশাহি, ফরিদপুর, যশোহর প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

তারিকা-ই-মহম্মদীয়া আন্দোলনের মূল্যায়ন –

ভারতে তারিকা-ই-মহম্মদীয়া ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তীকালে তা জমিদার ও ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।

ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন দিল্লির বিখ্যাত মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর পুত্র আজিজ। তবে ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহমদ।

ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য –

  • ইসলাম ধর্মের সংস্কার – ‘ওয়াহাবি’ আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল ‘তারিকা-ই-মহম্মদীয়া’ অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মহম্মদ প্রদর্শিত পথ। ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ধর্মের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করে মহম্মদের নির্দেশ অনুসরণ করে ইসলাম ধর্মের সংস্কার করা।
  • ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন – ওয়াহাবি আন্দোলনকারীরা বিধর্মী ইংরেজ-শাসিত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ (শত্রুর দেশ) বলে অভিহিত করত। তাই তারা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে বিধর্মী ইংরেজদের বিতাড়িত করার জন্য আন্দোলন করেছিল।
  • অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ – ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ করা। এই কারণে পাঞ্জাবের অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সৈয়দ আহমদ যুদ্ধ করে পেশোয়ার দখল করেছিলেন এবং বাংলায় তিতুমির পুড়ার জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
  • নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শ – ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল এক সহজসরল জীবনযাত্রা এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের পরিচয় দাও।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন তিতুমির। তিনি বাংলায় ইসলাম ধর্মের সংস্কার আন্দোলন হিসেবে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন। যদিও পরে তা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রসার: তিতুমির 39 বছর বয়সে মক্কায় হজ করতে গিয়ে সৈয়দ আহমদের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি ‘ওয়াহাবি’ আদর্শ গ্রহণ করে বাংলায় তা প্রচার করেন। এই আন্দোলন বাংলার চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, যশোহর, ঢাকা, মালদহ প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

ওয়াহাবিদের উপর অত্যাচার –

জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের হাতে মুসলমান কৃষকরা অত্যাচারিত হয়। তিতুমির অত্যাচারিত কৃষকদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।

ওয়াহাবি আন্দোলনে কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে সংঘর্ষ –

পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তিতুমিরের অনুগামীদের উপর অত্যাচার শুরু করেন। তিতুমিরের শিষ্যদের দাড়ি রাখতে হত। কৃষ্ণদেব রায় ঘোষণা করেন যে, যারা তিতুমিরের শিষ্য হয়ে দাড়ি রাখবে তাদের \(2\frac12\), টাকা করে কর দিতে হবে। এইসব কারণে কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে তিতুমিরের সংঘর্ষ বাঁধে।

ওয়াহাবি আন্দোলনে বাদশাহ ঘোষণা –

তিতুমির বারাসত-বসিরহাট অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘোষণা করে নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে ‘সেনাপতি’ ও মইনুদ্দিন নামে জনৈক ওয়াহাবিকে ‘প্রধানমন্ত্রী’ বলে ঘোষণা করেন। তিনি নারকেলবেড়িয়া গ্রামে বাঁশের কেল্লা তৈরি করে সেখানে তাঁর সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। এই ঘটনা বারাসত বিদ্রোহ নামেও পরিচিত।

ওয়াহাবি আন্দোলনের অবসান –

তিতুমিরের বিদ্রোহ জমিদার, নীলকর ও ইংরেজদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। 1831 খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিঙ্ক তিতুমিরের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। কামানের আঘাতে বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয়। তিতুমির ও তাঁর কয়েকজন অনুগামী যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণত্যাগ করেন।

তারিকা-ই-মহম্মদীয়া কী?

অধ্যাপক গৌতম ভদ্র বলেছেন যে, তিতুমিরের অনুগামীরা নিজেদের বলত ‘হেদায়তী’ (সঠিক পথে পরিচালিত বা নির্দেশিত হওয়া) এবং তাঁর আন্দোলনকে বলা হত ‘তারিকা-ই-মহম্মদীয়া’ বা মহম্মদের পথ।

বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ কী ছিল?

ওয়াহাবি আন্দোলনের ভূমিকা –

আঠারো শতকে মহম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব আরব দেশে ইসলাম ধর্মে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন, তা ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। ভারতে এই আন্দোলন শুরু করেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ, তাঁর পুত্র আজিজ এবং রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদ। বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন তিতুমির।

ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ –

বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণগুলি হল নিম্নরূপ –

  • ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণ করা – বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা তিতুমির ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণ করার জন্য আন্দোলন করেন। তিনি বলেন – একমাত্র আল্লাকে মান্য করতে হবে। ইসলাম-বহির্ভূত সমস্ত সংস্কার পরিত্যাগ করতে হবে।
  • কৃষকদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করা – তিতুমিরের অনুগামীরা জমিদার, নীলকর ও ব্রিটিশ সরকারের শোষণ ও অত্যাচারে জর্জরিত ছিল। তিতুমির কৃষকদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করেন।
  • ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করা – তিতুমির ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করেন। নারকেলবেড়িয়া গ্রামে ‘বাঁশের কেল্লা’ তৈরি করে তিনি স্বাধীন প্রশাসন গড়ে তোলেন।
  • তিতুমিরের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা – বারাসত এলাকায় তিতুমির নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। ‘বাঁশের কেল্লা’ তৈরি করে নারকেলবেড়িয়া গ্রামে তিনি নিজের সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের ভূমিকা –

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন মির নিশার আলি বা তিতুমির। তিনি চব্বিশ পরগনার বারাসত অঞ্চলে এই আন্দোলন করেছিলেন বলে একে বারাসত বিদ্রোহও (1830-1831 খ্রিস্টাব্দ) বলা হয়।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য –

  • ইসলামের পুনরুজ্জীবন বা শুদ্ধিকরণ – ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ইসলাম ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর জন্য। বাংলায় তিতুমির ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণের জন্য তাঁর আদর্শ প্রচার করেছিলেন। বলা হয় –
    • একমাত্র আল্লাকে মান্য করতে হবে। পির, পয়গম্বরদের মান্য করা চলবে না।
    • ইসলাম-বহির্ভূত সংস্কার পরিত্যাগ করতে হবে ইত্যাদি।
  • ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন – বাংলায় তিতুমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। ওয়াহাবি নেতাদের মতো তিতুমিরও ভারতবর্ষকে ‘দার-উল হারব’ বলে মনে করতেন এবং তিনি একে ‘দার-উল-ইসলাম’ বা ‘ইসলামের দেশ’ বা ‘ধর্মের দেশে’ পরিণত করার পরিকল্পনা করেন। এজন্য তারা বিধর্মী ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
  • জমিদার ও নীলকরবিরোধী আন্দোলন – ওয়াহাবিরা অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বাংলায় এই বিদ্রোহের নেতা তিতুমির নিজেকে ‘স্বাধীন বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করে জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করেন। তিনি তাঁর অনুগামীদের নীলচাষ করতেও নিষেধ করেছিলেন।
  • নিম্নবর্গ মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন – বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন শুধুমাত্র মুসলমানদের আন্দোলন ছিল না। এই আন্দোলনে নিম্নবর্গের অনেক হিন্দু প্রজাও সহযোগিতা করেছিল।

বারাসত বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ কী ছিল?

তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন বা বারাসত বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ব্রিটিশ সরকার নিষ্ঠুরভাবে এই বিদ্রোহ দমন করলে বারাসত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।

বারাসত বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ –

বারাসত বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণগুলি হল নিম্নরূপ –

  • প্রাচীনপন্থী আন্দোলন – বারাসত বিদ্রোহ ছিল প্রাচীনপন্থী, সেকেলে ও যুগবিরোধী আদর্শে পরিচালিত একটি আন্দোলন। নতুন ধ্যানধারণার বদলে পুরোনো ধ্যানধারণাকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
  • জনসমর্থনের অভাব – তিতুমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত বারাসত বিদ্রোহে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেনি। নিম্নবর্গের মুসলমানরা বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করলেও উচ্চবিত্ত মুসলমানরা একে সমর্থন করেনি।
  • শিক্ষিত সমাজের সমর্থনের অভাব – বারাসত বিদ্রোহে সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির সমর্থন ছিল না। বরং শিক্ষিত শ্রেণি, অভিজাত ও জমিদাররা ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন করেছিল।
  • ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি – প্রবল ব্রিটিশ শক্তির বিরোধিতা করার মতো অর্থ, অস্ত্রশস্ত্র কিংবা সৈন্যবল কোনোটাই তিতুমিরের ছিল না। ফলে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে অসম সংঘর্ষের দরুন তিতুমির প্রাণ হারান এবং বারাসত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশে ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমিরের নেতৃত্বে ইংরেজবিরোধী বিদ্রোহের গুরুত্ব উল্লেখ করো।

অথবা, বারাসত বিদ্রোহের গুরুত্ব আলোচনা করো।

বাংলাদেশে ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমিরের নেতৃত্বে ইংরেজবিরোধী বিদ্রোহের ভূমিকা –

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মির নিশার আলি বা তিতুমির। তিনি জমিদার, মহাজন, নীলকর ও ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং নিজেকে বারাসত অঞ্চলের ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। এ প্রসঙ্গে ডঃ শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, ইংরেজ আমলে সরকারবিরোধী যেসব আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ঘোর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন।

তিতুমিরের বিদ্রোহের গুরুত্ব –

  • কৃষক বিদ্রোহ – তিতুমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলন ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এটি কৃষক বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। এই বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি ছিল কৃষকরা এবং এই বিদ্রোহ ছিল আসলে ‘ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষক বিদ্রোহ’।
  • ইংরেজবিরোধী বিদ্রোহ – তিতুমির বারাসত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজেকে স্বাধীন ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক প্রেরিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি প্রাণপণ সংগ্রাম করেছিলেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, তিতুমিরের বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো।
  • জমিদার ও নীলকরবিরোধী বিদ্রোহ – অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবদের হাতে নির্যাতিত মানুষদের সংগঠিত করে তিতুমির বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের অত্যাচারের প্রতিবাদ হিসেবে।
  • শ্রেণিসংগ্রাম – তিতুমিরের বারাসত বিদ্রোহ ছিল শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিত হিন্দু ও মুসলমানদের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ। ডঃ রণজিৎ গুহ বলেছেন যে, ‘এই আন্দোলন ছিল নিম্নবর্গের মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন।’

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের চরিত্র বা প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের চরিত্র বা প্রকৃতি –

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন তিতুমির। তিনি চব্বিশ পরগনার বারাসত অঞ্চলে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন। তিতুমিরের নেতৃত্বে সংঘটিত বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ আছে।

  • ধর্মীয় আন্দোলন – ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ইসলাম ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর জন্য। তিতুমির ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণের জন্য প্রচার করেছিলেন – একমাত্র আল্লাকে মান্য করতে হবে। ডঃ অভিজিৎ দত্ত উৎপত্তি ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে এই আন্দোলনকে ‘ধর্মীয় আন্দোলন’ বলেই চিহ্নিত করেছেন।
  • অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন – ডঃ কেয়ামুদ্দিন আহমদ বলেন, তিতুমিরের আন্দোলন ছিল অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও ব্রিটিশ সরকারবিরোধী আন্দোলন। শোষক শ্রেণি ও অত্যাচারীদের বিরুদ্ধেই এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল।
  • ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন – ডঃ শশীভূষণ চৌধুরির মতে, বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল প্রবলভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। তিতুমির বারাসত অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন।
  • কৃষক বিদ্রোহ – ডঃ বিনয়ভূষণ চৌধুরি বলেন, বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি কৃষক বিদ্রোহ। বাংলার শোষিত কৃষকরা জমিদার, নীলকর ও ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করেছিল।

সর্বোপরি বলা যায় যে, ধর্মীয় চেতনা ওয়াহাবি আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। জমিদারদের বিরোধিতা থেকে এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকারের বিরোধিতায় পরিণত হয়েছিল।

ফরাজি আন্দোলনের উপর সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।

ফরাজি আন্দোলনের ভূমিকা –

ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক হলেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ। 1820 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ফরাজি’ নামে এক ধর্মীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে ধর্মসংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ‘ফরাজি’ শব্দটির অর্থ হল ‘ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য’। ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসেবে এই আন্দোলন শুরু হলেও এটি ছিল মূলত কৃষক আন্দোলন।

ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্য –

  • ওয়াহাবি আন্দোলনের মতো এই আন্দোলনেরও লক্ষ্য ছিল ইসলামের পবিত্র আদর্শের পুনরুজ্জীবন।
  • ফরাজিরা ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতকে দার-উল-হারব বলে চিহ্নিত করেছিল এবং এদেশ থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করে ভারতকে দার-উল-ইসলাম-এ পরিণত করতে চেয়েছিল।
  • হাজি শরিয়ৎউল্লাহ অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল জমিদারদের উচ্ছেদ করা।

ফরাজি আন্দোলনের বিস্তার –

শরিয়ৎউল্লাহের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানরা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। অচিরেই বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুরের লক্ষ লক্ষ মুসলিম চাষি, কারিগর ও যুবসম্প্রদায় তাঁর অনুগামী হয়। এরা অত্যাচারী জমিদারদের কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

মহম্মদ মহসিন (দুদু মিঞা) -এর নেতৃত্ব –

হাজি শরিয়ৎউল্লাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন আন্দোলনের পরিচালক হন। তাঁর তত্ত্ব ছিল আরও বৈপ্লবিক। তিনি বলতেন, ‘জমি আল্লাহের দান। সুতরাং, জমির উপর কর ধার্য করার অধিকার কারও নেই।’

সুদক্ষ সংগঠক দুদু মিঞা বাংলাদেশে তাঁর প্রভাবিত অঞ্চলে ফরাজ-ই-খিলাফৎ নামে এক প্রশাসন গড়ে তোলেন। তিনি বাংলাদেশকে কয়েকটি অঞ্চল বা হল্কায় বিভক্ত করে প্রতি হল্কায় একজন করে খলিফা নিযুক্ত করেন, যার দায়িত্ব ছিল ওই হল্কার জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার প্রতিহত করা। দুদু মিঞার নেতৃত্বে ফরাজিরা জমিদার ও নীলকরদের আক্রমণ করে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল।

ফরাজি আন্দোলনের দমন –

সরকার ফরাজি আন্দোলন দমন করার জন্য 1857 খ্রিস্টাব্দে দুদু মিঞাকে গ্রেফতার করে। 1862 খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে এই আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

ফরাজি আন্দোলনের উপসংহার –

ফরাজি আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মীয় থাকলেও এই আন্দোলন ছিল মূলত কৃষক আন্দোলন। ডঃ অভিজিৎ দত্তের মতে, ফরাজি আন্দোলন জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক পূর্ণ রূপ প্রদান করে।

ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্য কী ছিল?

হাজি শরিয়ৎউল্লাহ 1820 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তন করেন। ফরাজি কথার অর্থ ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য।

ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্য –

ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্যগুলি ছিল –

  • ইসলামের আদর্শের পুনরুজ্জীবন – ফরাজি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ইসলাম ধর্ম আচরণের মধ্যে যে কলুষতা প্রবেশ করেছে তা দূর করে ইসলামের পবিত্র আদর্শের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর জন্য। শরিয়ৎউল্লাহ তাঁর অনুগামীদের ইসলামের পবিত্র আদর্শ অনুসরণের কথা বলেন।
  • দার-উল-ইসলাম প্রতিষ্ঠা – ফরাজিরা ব্রিটিশ-শাসিত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ বা শত্রুর দেশ বলে মনে করত। তাদের লক্ষ্য ছিল ভারতকে ‘দার-উল-ইসলামে’ পরিণত করা।
  • জমিদার ও নীলকরদের উচ্ছেদ করা – জমিদার ও নীলকররা বাংলার চাষিদের শোষণ ও অত্যাচার করত। ফরাজিরা বাংলার এই অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল।
  • সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা – ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সমাজে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। দুদু মিঞা ঘোষণা করেছিলেন ‘জমি হল আল্লাহর দান।’ তাই জমির উপর সকলের অধিকার আছে বা এর জন্য কেউ খাজনা নিতে পারে না বলে তারা ঘোষণা করে।

বাংলার ফরাজি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

বাংলায় ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তন করেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ। তাঁর মৃত্যুর পর ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন মহম্মদ মহসিন বা দুদু মিঞা ও তাঁর পুত্র নোয়া মিঞা।

বাংলার ফরাজি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য –

বাংলায় ফরাজি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –

  • ইসলামের পুনরুজ্জীবন বা শুদ্ধিকরণ – ফরাজি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণ করার জন্য। শরিয়ৎউল্লাহ তাঁর অনুগামীদের ইসলামের পবিত্র আদর্শ মেনে চলার কথা বলেছিলেন।
  • জমিদার ও নীলকরবিরোধী আন্দোলন – ফরাজি আন্দোলন জমিদার ও নীলকরবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা জমিদার ও নীলকর সাহেবদের কুঠি আক্রমণ করেছিল।
  • নিম্নবর্গের মানুষের প্রাধান্য – ফরাজি আন্দোলনে নিম্নবর্গের মুসলমান ও হিন্দু কৃষকদের প্রাধান্য ছিল। এই কৃষকরা আবার জমিদার ও নীলকরদের দ্বারা বিভিন্নভাবে শোষিত হত।
  • ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন – ফরাজি আন্দোলনের নেতারা বাংলায় ফরাজি-খিলাফৎ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তারা নিজস্ব আদালত গড়ে তুলেছিলেন। তাদের ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাদের দমনের চেষ্টা করে।

ফরাজি আন্দোলনে হাজি শরিয়ৎউল্লাহ ও মহম্মদ মহসিনের ভূমিকা সংক্ষেপে লেখো।

ফরাজি আন্দোলনে হাজি শরিয়ৎউল্লাহের ভূমিকা –

হাজি শরিয়ৎঊল্লাহ ছিলেন ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।

  • পূর্বজীবন – শরিয়ৎউল্লাহ 1781 খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতার মক্তবে পড়াশোনা করেন এবং আরবি ও ফারসি ভাষা শেখেন। মক্কায় গিয়ে ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও আইন সম্পর্কে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন তিনি।
  • ফরাজি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা – শরিয়ৎউল্লাহ 1820 খ্রিস্টাব্দে ‘ফরাজি’ নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন।
  • আদর্শ প্রচার – শরিয়ৎউল্লাহ প্রতিষ্ঠিত ফরাজি আন্দোলনের আদর্শ ছিল অমুসলমান আদর্শ বর্জন, মুসলিম আদর্শ পালন, জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন প্রভৃতি।

ফরাজি আন্দোলনে মহম্মদ মহসিনের ভূমিকা –

হাজি শরিয়ৎউল্লাহের মৃত্যুর পর ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন বা দুদু মিঞা।

ফরাজি আন্দোলন –

মহম্মদ মহসিনের নেতৃত্বে ফরাজি আন্দোলন ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলন থেকে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। তিনি ঘোষণা করেন যে, জমি আল্লাহর দান, তাই জমিদারের খাজনা আদায়ের অধিকার নেই। তিনি ‘ফরাজি-খিলাফৎ’ নামে একটি দক্ষ সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে ফরাজি আন্দোলনের ব্যাপক প্রসার ঘটে।

দুদু মিঞার কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে জমিদার নীলকর ও ইংরেজ সরকার জোটবদ্ধ হয়। বহুবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। অবশেষে নানা প্রকার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে 1862 খ্রিস্টাব্দের 24 সেপ্টেম্বর দুদু মিঞা মৃত্যুমুখে পতিত হন।

দুদু মিঞা স্মরণীয় কেন?

ফরাজি আন্দোলনের ইতিহাসে দুদু মিঞা অন্যতম স্মরণীয় এক ব্যক্তিত্ব। 1820 খ্রিস্টাব্দে ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তন করেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ।

দুদু মিঞা ও ফরাজি আন্দোলন –

  • আন্দোলনের নেতৃত্ব দান – হাজি শরিয়ৎউল্লাহের মৃত্যুর পর দুদু মিঞা ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলার অত্যাচারিত চাষিরা অত্যাচারী ইংরেজ কর্মচারী, নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে।
  • দুদু মিঞার আহ্বান – ফরাজি আন্দোলনে দুদু মিঞার তত্ত্ব ছিল বৈপ্লবিক। তিনি বলতেন – জমি আল্লাহর দান, তাই জমিদারের খাজনা আদায় করার কোনো অধিকার নেই। তিনি তাঁর সমর্থকদের খাজনা না দেওয়ার জন্য নীলচাষ না করা এবং ইংরেজদের অগ্রাহ্য করার আহ্বান জানান।
  • ফরাজি-খিলাফৎ আন্দোলন – দুদু মিঞা তাঁর প্রভাবিত অঞ্চলে ‘ফরাজি-খিলাফৎ’ নামে একটি প্রশাসন গড়ে তোলেন। এই প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন দুদু মিঞা। তাঁর সাহায্যকারীদের বলা হত খলিফা। তিনি সমস্ত এলাকাকে কয়েকটি হল্কায় বিভক্ত করেন এবং প্রতি হল্কায় একজন করে খলিফা নিযুক্ত করেন। এই খলিফাদের কাজ ছিল কৃষকদের সংগঠিত করা এবং অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।

জমিদার ও নীলকরদের আক্রমণ –

দুদু মিঞা কৃষকদের সংগঠিত করে জমিদার ও নীলকর সাহেবদের আক্রমণ করেন। দুদু মিঞার বাহিনী অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করে।

দুদু মিঞা বন্দিদশা –

দুদু মিঞা বারবার গ্রেফতার হন কিন্তু সাক্ষীর অভাবে প্রতিবারেই মুক্তি পান। অবশেষে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সরকার তাঁকে বন্দি করে।

দুদু মিঞার মৃত্যু –

দীর্ঘকালীন জেলে বন্দি থাকার ফলে দুদু মিঞার শরীর ভেঙে পড়ে। তিনি মুক্তিলাভের পর নানা প্রকার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে 1862 খ্রিস্টাব্দে বাহাদুরপুরে মারা যান।

ফরাজি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি উল্লেখ করো।

অথবা, ফরাজি আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

ফরাজি আন্দোলনের ভূমিকা –

ফরাজি আন্দোলনে দরিদ্র মুসলিম কৃষকশ্রেণি যোগ দিলেও তা শেষপর্যন্ত শ্রেণিসংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়। উইলিয়ম হান্টার এই প্রসঙ্গে বলেছেন – ফরাজি আন্দোলন ছিল একটি শ্রেণিসংঘর্ষ।

ফরাজি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ –

ফরাজি আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল বেশ কয়েকটি কারণে –

  • সংহতির অভাব – সংকীর্ণ ধর্মবোধ দ্বারা এই আন্দোলন পরিচালিত হওয়ায় উদারপন্থী মুসলমান সমাজ এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে। ফলে সংহতির অভাবে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
  • জনবিচ্ছিন্নতা – গণসমর্থনের অভাব ছিল এই আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম একটি কারণ। মুসলমান অভিজাত থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কেউই এই আন্দোলনের প্রতি আগ্রহ দেখাননি।
  • লক্ষ্যহীনতা – কোনো সুস্পষ্ট লক্ষ্য না থাকায় এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল। প্রথমদিকে মুসলমানদের উন্নয়ন, পরবর্তী সময়ে নীলচাষ ও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের লক্ষ্য নিয়ে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল।
  • সীমাবদ্ধতা – এই আন্দোলন একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ ছাড়াও ইংরেজ, নীলকর, জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে অর্থ, লোকবল, যুদ্ধ উপকরণ ও মানসিকতার প্রয়োজন ছিল, তা বিদ্রোহীদের ছিল না।

ফরাজি আন্দোলনের মূল্যায়ন –

ফরাজিদের প্রচেষ্টা পরবর্তী প্রজন্মকে বিদ্রোহের প্রেরণা জুগিয়েছিল। কেবল মুসলমানরাই নয়, হিন্দু কৃষকরাও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।

ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা করো।

উনিশ শতকে বাংলার কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে ফরাজি আন্দোলনের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হাজি শরিয়ৎউল্লাহ 1820 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ফরাজি আন্দোলনের সূচনা করেন। শরিয়ৎউল্লাহর মৃত্যুর পর আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন অর্থাৎ দুদু মিঞা।

ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব –

বাংলার ইতিহাসে ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, যথা –

  • শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন – ফরাজি আন্দোলন ছিল বাংলার দরিদ্র কৃষকদের উপর জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এই আন্দোলনে শুধুমাত্র মুসলমান কৃষকরাই নয়, অনেক হিন্দু কৃষকও অংশগ্রহণ করেছিল।
  • ব্রিটিশ বিতাড়নের প্রেরণা – ফরাজি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা দুদু মিঞার লক্ষ্য ছিল জমিদারি শাসন ও বিদেশি ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ করে স্বাধীন মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। বাংলা থেকে ব্রিটিশ শাসনের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করতে না পারলেও এই আন্দোলন ব্রিটিশ বিতাড়নের প্রেরণা জুগিয়েছিল।
  • রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য – ইসলামের সংস্কারসাধন – এই লক্ষ্য থেকে ফরাজি আন্দোলনের সূচনা হলেও অচিরেই তা রাজনৈতিক চরিত্র লাভ করে। কৃষকদের ক্ষোভ ও অসন্তোষকে কেন্দ্র করে সংঘটিত এই আন্দোলন পূর্ব বাংলার কৃষকদের মধ্যে নবজাগরণের সঞ্চার করেছিল। তাই এ কথা বলা যায়, ফরাজি আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেও বাংলার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে এর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি কী ছিল?

ফরাজি আন্দোলনের ভূমিকা –

ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ। বাংলায় ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসেবে ফরাজি আন্দোলন শুরু হয়। তবে ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে।

ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি –

  • ধর্মীয় আন্দোলন – ‘ফরাজি’ কথার অর্থ হল ‘ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য’। অর্থাৎ, কথাটি এক বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর উদ্দিষ্ট কাজকর্মের অভিমুখ তৈরি করছে। এই দিক থেকে দেখলে আন্দোলনটির প্রকৃতি ছিল ধর্মীয়। হাজি শরিয়ৎউল্লাহ -এর নেতৃত্বে আন্দোলনটি শুরু হয় ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের উদ্দেশ্য নিয়ে।
  • কৃষক বিদ্রোহ – শরিয়ৎউল্লাহ -এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন ওরফে দুদু মিঞার আমলে ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতিতে কিছুটা পরিবর্তন দেখা দেয়। দলে দলে কৃষকশ্রেণির যোগদান এবং নীলচাষ ও অন্যান্য চাষবাসের সমস্যার কারণে আন্দোলনটি কৃষক বিদ্রোহে পরিণত হয়। আন্দোলন সম্পর্কে অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ যথার্থই বলেছেন – ‘a peasant rising in a religious garb’।
  • সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন – দুদু মিঞার পর ফরাজি আন্দোলনের পুনরায় প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটে। দুদু মিঞার পুত্র নোয়া মিঞার আমলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় ফরাজিরা সোচ্চার হয়ে দলে দলে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে দেয়। ঐতিহাসিক বিনয়ভূষণ চৌধুরি বলেছেন, ‘ফরাজি আন্দোলন মূলত প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন হিসেবে দেখা দিলেও শেষ বিচারে কৃষক আন্দোলনের ব্যাপ্তি লাভ করেছিল।’

ফরাজি আন্দোলনের উপসংহার –

ফরাজি আন্দোলন ছিল মূলগতভাবে একটি ধর্মীয় আন্দোলন, তবে আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এই বিদ্রোহকে কৃষক আন্দোলনের পর্যায়ভুক্ত করা হয়।

ভারতে ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের তুলনামূলক আলোচনা করো।

উনিশ শতকে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ইসলাম ধর্মের সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। এই সংস্কার আন্দোলনগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন।

ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের সাদৃশ্য –

ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের মধ্যে সাদৃশ্যগুলি হল –

  • বিদেশি আদর্শ – ভারতে ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন হয়েছিল আরবে ইসলাম ধর্মের সংস্কার আন্দোলনের সূচনার আদর্শের উপর ভিত্তি করে। ভারতীয় সংস্কারকগণ এই আদর্শের সংস্পর্শে এসে ভারতেও অনুরূপ সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন।
  • ইসলাম ধর্মের সংস্কার – ওয়াহাবি ও ফরাজি দুটি আন্দোলনই ছিল ইসলামধর্মের সংস্কার আন্দোলন। আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ধর্মের কুপ্রথা দূর করে শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে এই ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটানো।

ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের বৈসাদৃশ্য –

ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের মধ্যে পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্যগুলি হল –

  • আন্দোলনের বিস্তার – ওয়াহাবি আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ফরাজি আন্দোলন মূলত বাংলাতেই বিস্তারলাভ করেছিল।
  • আন্দোলনের তীব্রতা – ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল সক্রিয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনের নেতা তিতুমির নিজেকে স্বাধীন ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু ফরাজি আন্দোলনের নেতাদের ব্রিটিশবিরোধিতা ততটা তীব্র ছিল না।

নীল বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?

বাংলার নীলচাষিরা 1859 খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের নীলচাষের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ তৎকালীন নদিয়া জেলার চৌগাছা গ্রামে শুরু হয়ে ক্রমে মালদহ, মুরশিদাবাদ, পাবনা, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহের ব্যাপকতার ফলে সরকার নীল কমিশন গঠন করে চাষির দুর্দশা নিরসনের চেষ্টা করে।

নীল বিদ্রোহের কারণ –

নীল বিদ্রোহের কারণগুলি হল নিম্নরূপ –

  • নীলকর সাহেবদের অত্যাচার – নীলকর সাহেবরা নীলচাষ করানোর জন্য চাষিদের উপর অত্যাচার করত। তারা অনিচ্ছুক চাষিদের কুঠিতে আটকে রাখত, প্রহার করত, চাষের সরঞ্জাম লুঠ করত, তাদের ঘরে ও শস্যে আগুন লাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি নানাভাবে তাদের অত্যাচার করত। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নীলচাষিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
  • দাদন প্রথা – নীলকর সাহেবরা চাষিদের নীলচাষ করার জন্য দাদন বা অগ্রিম অর্থ দিত। অভাবের ফলে অনেক চাষি এই অগ্রিম নিতেও বাধ্য হত। তারা প্রতি বিঘায় 2 টাকা অগ্রিম দিয়ে চাষিকে সবচেয়ে ভালো জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। একবার কেউ দাদন নিলে সে আর নীলচাষ না করে বেরিয়ে আসতে পারত না। কোনো চাষি দাদন নিতে না চাইলে তার গোরুবাছুর নীলকুঠিতে আটকে রেখে তাকে দাদন নিতে বাধ্য করা হত।
  • 1830 খ্রিস্টাব্দের পঞ্চম আইন – 1830 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার পঞ্চম ও সপ্তম আইন পাস করে জানায় যে, কোনো চাষি দাদন নিয়ে নীলচাষ না করলে তাদের গ্রেফতার করা হবে ও তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। পরে একাদশ আইন পাস করে বলা হয় যে, নীলকরদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কোনো চাষি নীলচাষ না করলে তাকে বিঘা প্রতি 10 টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই আইনের ফলে নীলচাষিদের উপর অত্যাচার বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে চাষিরা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছিল।
  • নীলচাষিদের প্রতি অবিচার – অত্যাচারিত নীলচাষিরা নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে আইন ও আদালতের শরণাপন্ন হলেও সুবিচার পেত না। কারণ – আইন ছিল নীলকরদের পক্ষে। তা ছাড়া ব্রিটিশ প্রশাসন ও পুলিশও নীলকর সাহেবদের পক্ষে ছিল। ফলে চাষিদের বিদ্রোহ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিল না।

উপরোক্ত কারণগুলির ফলস্বরূপ নীলচাষিরা দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাসের নেতৃত্বে নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে 1859-1860 খ্রিস্টাব্দে বাংলার নীলচাষিরা যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস, দিগম্বর বিশ্বাস, কাদের মোল্লা, রফিক মণ্ডল প্রমুখ।

নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য –

  • নীলকরবিরোধী বিদ্রোহ – নীল বিদ্রোহ ছিল মূলত নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। নীলকর সাহেবরা কৃষকদের উপর অকথ্য অত্যাচার করত এবং তাদের জোর করে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। নীলচাষিরা নীলকর সাহেবদের এই জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।
  • ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ – নীল বিদ্রোহ কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের বিদ্রোহ ছিল না। এই বিদ্রোহ ছিল হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ। বিদ্রোহে অত্যাচারিত হিন্দু ও মুসলমান প্রজারা পরস্পরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল, তাই এই বিদ্রোহ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ।
  • খ্রিস্টান মিশনারিদের সমর্থন – নীল বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিরা বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল। শুধু তাই নয় নীলকরদের অত্যাচারের বিরদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল। রেভারেন্ড জেমস লঙ দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
  • বাঙালি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সমর্থন – বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নীল বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল। উনিশ শতকের বাংলার বিভিন্ন বিদ্রোহগুলির মধ্যে একমাত্র নীল বিদ্রোহই শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছিল। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় নীল চাষিদের সমর্থনে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করতেন। তা ছাড়া, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও নাটকের মাধ্যমে নীল বিদ্রোহকে সমর্থনও জানানো হয়েছিল।

নীল বিদ্রোহের প্রতি বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিক্রিয়া কীভাবে প্রকাশ পেয়েছিল?

নীল বিদ্রোহের ভূমিকা –

বাংলাদেশের ওয়াট টাইলর রূপে প্রসিদ্ধ চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস -এর নেতৃত্বে শুরু হওয়া নীল বিদ্রোহের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল বিদ্রোহীদের প্রতি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অকুণ্ঠ ও সর্বাত্মক সমর্থন। তাঁরা তাঁদের লেখনীর দ্বারা নীল বিদ্রোহের প্রতি জনসমর্থন গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন।

নীল বিদ্রোহের প্রতি বুদ্ধিজীবী সমাজের ভূমিকা –

নীলচাষিদের এই অভূতপূর্ব সংগ্রামের সময় কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশ লোক উদাসীন থাকলেও কয়েকজন দেশপ্রেমিক, হৃদয়বান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নীলচাষিদের পক্ষে কলম ধরেন।

  • হিন্দু প্যাট্রিয়ট – এই প্রসঙ্গে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এই মহাপ্রাণ ব্যক্তি হিন্দু প্যাট্রিয়টের কলমে নীলচাষিদের দুর্দশা এবং নীলকরদের অত্যাচারের সম্পর্কে সুচিন্তিত প্রবন্ধ রচনা করে সরকারের চোখ খুলে দেন। শিশির কুমার ঘোষ গ্রামে গ্রামে ঘুরে নীলচাষিদের উপর অত্যাচারের প্রত্যক্ষ বিবরণ ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় ছাপাতে থাকেন। বস্তুত হরিশচন্দ্রের উদ্যোগেই নীল বিদ্রোহের খবরাখবর বাংলার শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।
  • সোমপ্রকাশ – ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকাও নীলচাষিদের পক্ষে দাঁড়ায়। নীলকরদের দুর্বিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে এই পত্রিকা প্রেরণা জোগায়।
  • নীলদর্পণ – দীনবন্ধু মিত্র তাঁর বিখ্যাত ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনা করে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের একটি মর্মস্পর্শী জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেন। 1860 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ‘নীলদর্পণ’ প্রকাশিত হয়। এই নাটকের ইংরেজি অনুবাদ রেভারেন্ড জেমস লঙ সাহেবের নামে প্রকাশিত হলে তা পড়ে ইংরেজদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেয়। নীলকররা লঙ সাহেবের নামে মানহানির মামলা করলে তাঁর 1000 টাকা জরিমানা হয়। সম্ভবত মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন ‘নীলদর্পণ’ নাটকের আসল ইংরেজি অনুবাদক। লঙ সাহেবের জরিমানার টাকা কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় জমা দেন। এর ফলে নীলকরদের উপরে চাপ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

নীল বিদ্রোহের উপসংহার –

এ ছাড়াও ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’, অক্ষয়কুমার দত্তের ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, মার্শম্যানের ‘সমাচার দর্পণ’, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদকরা নীলচাষিদের উপর অত্যাচারের কথা জনসমক্ষে তুলে ধরেছিলেন।

নীল বিদ্রোহের ফলাফল লেখো।

নীল বিদ্রোহের ভূমিকা –

1859-1860 খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত নীল বিদ্রোহ বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নীল বিদ্রোহের ফলাফল –

এই বিদ্রোহের ফলে নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলি লক্ষ করা যায় –

  • নীল কমিশন গঠন – নীল বিদ্রোহের ব্যাপকতা লক্ষ করে সরকার বাধ্য হয়ে 1860 খ্রিস্টাব্দে নীল কমিশন গঠন করে। এই কমিশন নীলচাষকে নীলচাষিদের ইচ্ছাধীন বলে ঘোষণা করে।
  • পুঁজি বিনিয়োগ পরিবর্তন – নীল বিদ্রোহে এবং সরকারি হস্তক্ষেপে আশঙ্কিত হয়ে নীলকররা নীলচাষ থেকে পুঁজি সরিয়ে নিয়ে তা অন্যত্র বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়।
  • প্রেরণা দান – শিশির কুমার ঘোষ লিখেছেন, নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম দেশের মানুষকে রাজনৈতিক সংঘবদ্ধতার প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাঁর মতে, নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ গণ আন্দোলন। এই বিদ্রোহের দ্বারা বাঙালি জাতির আত্মশক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়।
  • শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির যোগদান – নীল বিদ্রোহকালে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, শিশির কুমার ঘোষ-সহ বহু শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে জনমত গঠনে এগিয়ে এসেছিলেন। এর ফলে কৃষকদের সঙ্গে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির যোগসূত্র গড়ে ওঠে।
  • কৃষকদের সাফল্য – নীল বিদ্রোহের ফলে কৃষকরা নীলচাষ থেকে রেহাই পায়। নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে কৃষকদের এই সাফল্য বাংলার ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

নীল বিদ্রোহের উপসংহার –

নীল বিদ্রোহ হল কৃষক বিদ্রোহের একটি সাফল্যমন্ডিত অধ্যায়। এই বিদ্রোহ থেকে পরবর্তীকালের কৃষক বিদ্রোহগুলি অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল।

নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব আলোচনা করো।

নীল বিদ্রোহের ভূমিকা –

বাংলার নীলচাষিরা 1859 খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব –

কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে বাংলার নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব অপরিসীম।

  • নীল কমিশন গঠন – নীল বিদ্রোহের তীব্রতায় বাংলার ছোটোলাট জে পি গ্রান্ট 1860 খ্রিস্টাব্দের 31 ডিসেম্বর নীল কমিশন (Indigo Commission) গঠন করেন। পাঁচ সদস্যের এই কমিশন তার রিপোর্টে জানায় যে, নীলকরদের বিরুদ্ধে নীলচাষিদের অভিযোগগুলি সত্য।
  • সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহ – সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হলে যে বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যায় বাংলার নিরীহ নীলচাষিদের বিদ্রোহ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ প্রসঙ্গে শিশির কুমার ঘোষ তাঁর অমৃতবাজার পত্রিকায় 1874 খ্রিস্টাব্দের 22 মে লিখেছিলেন – ‘নীল বিদ্রোহ দেশের লোককে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে শিক্ষা দেয়।’
  • স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ – নীল বিদ্রোহ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের বিদ্রোহীরা মানসিকভাবে ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়। তাই এই বিদ্রোহ গণবিদ্রোহে পরিণত হয়েছিল।
  • বাঙালি জাতির মনোবল বৃদ্ধি – নীল বিদ্রোহ ছিল বাঙালির সফল সংঘবদ্ধ আন্দোলন। এই আন্দোলনে জয়লাভ করার ফলে বাঙালি জাতির মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  • শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির সমর্থন লাভ – নীল বিদ্রোহ শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির সমর্থন লাভ করেছিল।

নীল বিদ্রোহের উপসংহার –

নীল বিদ্রোহ ছিল কৃষকদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার সংগ্রাম। এই বিদ্রোহ ছিল সফল সংগঠিত বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের গুরুত্ব প্রসঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, নীল বিদ্রোহ অর্ধমৃত বাঙালির শিরায় স্বাধীনতার উয় শোণিত প্রবাহিত করেছিল।

নীল বিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা করো।

নীল বিদ্রোহের ভূমিকা –

বাংলার নীলচাষিরা 1859 খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। নীল বিদ্রোহ ছিল একটি সফল সংগঠিত বিদ্রোহ।

নীল বিদ্রোহের প্রকৃতি –

নীল বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

  • নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলন – অধ্যাপক চিত্তব্রত পালিত -এর মতে, উনিশ শতকে বাংলার নীল বিদ্রোহ ছিল আসলে জমিদারদের সঙ্গে ইংরেজ নীলকর সাহেবদের সংঘাত। তিনি মনে করেন, নীলকর সাহেবরা গ্রামে আধিপত্য স্থাপন করায় বাঙালি জমিদারদের স্বার্থে আঘাত লাগে। তাদের নির্দেশে চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
  • গণ আন্দোলন – তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক অধ্যাপক পালিতের মত সমর্থন করেন না। বাংলার ছোটোলাট পিটার গ্রান্ট একে ‘লক্ষ লক্ষ লোকের তীব্র অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ’ বলেছেন। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের 60 লক্ষ কৃষক এই বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল। এইভাবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগদান করে এই বিদ্রোহকে প্রকৃত গণবিদ্রোহে পরিণত করে।
  • সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন – অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শিশির কুমার ঘোষ -এর মতে, নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম দেশের মানুষকে সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও রাজনৈতিক আন্দোলনের গুরুত্ব অনুভব করতে শিখিয়েছিল। বস্তুত বাংলাদেশে ব্রিটিশ রাজত্বকালে নীল বিদ্রোহ ছিল প্রথম বিপ্লব। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন হিসেবে নীল বিদ্রোহের রাজনৈতিক তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না।

পাবনার কৃষক বিদ্রোহ (1870 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

1870 -এর দশকে বাংলার পাবনায় কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিল, তা পাবনা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

পাবনা বিদ্রোহের কারণ –

পাবনায় কৃষক বিদ্রোহের পিছনে একাধিক কারণ সক্রিয় ছিল –

  • অতিরিক্ত খাজনা আদায় – 1859 খ্রিস্টাব্দে সরকার দশম আইন (Act X) পাস করে। এই আইনে বলা হয় যে, অকারণে কৃষকের কাছ থেকে জমিদার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে পারবে না। কিন্তু জমিদাররা বিভিন্নভাবে কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করে। তা ছাড়া আরও নানা ধরনের উপকরণ দাবি করা হয়।
  • জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ – 1859 খ্রিস্টাব্দের দশম আইনে কৃষকদের জমির মালিকানা ও পাট্টা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এই আইন ফাঁকি দিয়ে জমিদাররা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করার জন্য জমি থেকে পুরোনো কৃষকদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে। কারণ – ওই জমি নতুন কৃষকদের স্বল্পকালের জন্য দিয়ে বেশি রাজস্ব পাওয়া যেত।
  • জমি জরিপ পদ্ধতি – জমিদারের অনুসৃত নতুন জমি জরিপ পদ্ধতিতে কৃষকের জমির মাপে কারচুপি করে খাজনা বৃদ্ধি করা হয়।
  • মিথ্যা মামলা – জমিদাররা কৃষকদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করত।

পাবনা বিদ্রোহ –

পাবনা অঞ্চলের জমিদাররা অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলে কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়। 1873 খ্রিস্টাব্দে পাবনার ইউসুফজাই পরগনার কৃষকরা একটি ‘রায়তি সমিতি’ গঠন করে। এই সমিতি জমিদারদের বেআইনি খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদ করে। কৃষকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে জমিদারের বিরুদ্ধে মামলা করে। দু-চারটি জায়গায় সামান্য হাঙ্গামা হলেও এই আন্দোলনটি ছিল মূলত আইনের পথে পরিচালিত। এই আন্দোলন ক্রমে ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

পাবনা বিদ্রোহের নেতা –

পাবনা বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন ঈশানচন্দ্র রায় নামে এক তালুকদার। শম্ভুনাথ পাল ও ক্ষুদিমোল্লা নামে দুই জোতদারও এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।

পাবনা বিদ্রোহের অবসান –

পাবনা বিদ্রোহে এই এলাকার শান্তি বিঘ্নিত হয়। ফলে বিদ্রোহীরা জনসমর্থন হারায়। শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে লেফটেন্যান্ট গভর্নর জর্জ ক্যাম্পবেল 1873 খ্রিস্টাব্দে কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য জমিদারদের পরামর্শ দেন। একইসঙ্গে পুলিশের দমনমূলক কার্যকলাপ ও 1873-1874 খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের ফলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।

পাবনা বিদ্রোহের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

পাবনার কৃষকরা 1870 খ্রিস্টাব্দে জমিদারদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিল তা পাবনা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ 1873 খ্রিস্টাব্দে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। বাংলার কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে পাবনা বিদ্রোহ ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

পাবনা বিদ্রোহের তাৎপর্য –

পাবনা কৃষক বিদ্রোহ ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

  • ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ – পাবনার কৃষকদের বিদ্রোহ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে ধর্মের প্রাধান্য ছিল না। জমিদাররা হিন্দু বলে মুসলিম কৃষকরা বিদ্রোহ করেনি – তারা বিদ্রোহ করেছিল জমিদারের খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে।
  • জমিদারবিরোধী বিদ্রোহ – পাবনা বিদ্রোহে বিদ্রোহীরা জমিদারের বিরোধিতা করেছিল, বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করেনি।
  • নিয়মমাফিক বিদ্রোহ – পাবনা বিদ্রোহে কৃষকরা কোনো বৈপ্লবিক দাবি উত্থাপন করেনি। বিদ্রোহী কৃষকরা খাজনা দেওয়া বন্ধ ছাড়া অন্য কোনো প্রতিরোধের পথে যায়নি। অপরদিকে তারা জমিদারদের করা মিথ্যা মামলার মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
  • সীমিত বিদ্রোহ – পাবনা বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও এই বিদ্রোহে ব্রিটিশবিরোধিতা লক্ষ করা যায়নি। বরং বিদ্রোহীরা সরকারকে খাজনা দিতে চায় এবং নিজেদের মহারানির প্রজা বলে দাবি করে।

পাবনা বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র বিশ্লেষণ করো।

1870 -এর দশকে বাংলার পাবনার কৃষক সম্প্রদায় জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এটি ইতিহাসে পাবনা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।

পাবনা বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র –

পাবনা বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র হল নিম্নরূপ –

  • আইনসম্মত পথে পরিচালিত বিদ্রোহ – পাবনার ইউসুফজাই পরগনার কৃষকরা একটি ‘রায়তি সমিতি’ গঠন করে জমিদারদের বেআইনি খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানায়। মূলত আইনসম্মত পথেই এই বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিল।
  • বিদ্রোহের সীমাবদ্ধতা – পাবনা অঞ্চলের জমিদাররা অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলে কৃষকরা প্রতিবাদ জানায়। জমিদারদের বিরুদ্ধে পাবনার কৃষক সম্প্রদায় বিদ্রোহের পথে পা বাড়ালেও প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশবিরোধিতা তাদের মধ্যে দেখা যায়নি।
  • অসাম্প্রদায়িক চরিত্র – বহু ঐতিহাসিক পাবনার বিদ্রোহে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র লক্ষ করেছেন। কারণ এই অঞ্চলের কৃষকরা জমিদারদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, হিন্দু জমিদার বলে বিদ্রোহ করেনি।
  • রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব – পাবনা বিদ্রোহে প্রধানত দু-চারটি জায়গায় সামান্য দাঙ্গাহাঙ্গামা, খাজনা দেওয়া বন্ধ করে প্রতিবাদ জানানো ইত্যাদি ছাড়া বিশেষ কোনো রাজনৈতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি।

উনিশ শতকে ভারতের বিভিন্ন কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলি ব্যর্থ হয়েছিল কেন?

কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলির ব্যর্থতার কারণ –

উনিশ শতকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল কিন্তু সেই সকল বিদ্রোহ কার্যত ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতার পশ্চাতে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল। যেমন –

  • নেতৃত্বে অনৈক্য – উনিশ শতকে সংঘটিত কৃষক আন্দোলনগুলির মধ্যে ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন ছিল অন্যতম। এই দুটি আন্দোলনে ধর্মীয় প্রভাব বেশি লক্ষ করা যায়। যেহেতু মুসলিম ধর্মকে সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রথমদিকে এই দুটি আন্দোলনই পরিচালিত হয়েছিল, সেহেতু পরবর্তীতে অত্যাচারী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে লড়াই করতে গেলে হিন্দু-মুসলিম নেতাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়।
  • পরিকল্পনার অভাব – কোনো আন্দোলন সফল করতে গেলে তার একটি পূর্ব পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। কিন্তু কৃষক বিদ্রোহের নেতারা কোনোরূপ পরিকল্পনা ছাড়াই বিদ্রোহ শুরু করেছিল। ফলে অধিকাংশ বিদ্রোহ মাঝপথে দিশাহারা হয়ে ব্যর্থ হয়।
  • আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা – সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ, রংপুর বিদ্রোহ প্রভৃতি কৃষক বিদ্রোহগুলি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই সকল বিদ্রোহগুলি সর্বভারতীয় রূপ পায়নি, ফলে সরকার ও জমিদার বাহিনী খুব সহজেই বিদ্রোহগুলি দমন করতে পেরেছিল।
  • উন্নত যোগাযোগের অভাব – বিদ্রোহীদের মধ্যে সর্বদা সংযোগ বজায় রাখার জন্য কোনো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ফলে বিদ্রোহ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারেনি।
  • সুদক্ষ নেতার অভাব – বিদ্রোহগুলি পরিচালনার জন্য কোনো সুদক্ষ নেতা ছিল না। ফলে বিদ্রোহগুলি শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যেত।
  • দমনপীড়ন – বিদ্রোহী কৃষক ও উপজাতিদের উপর সরকার ও জমিদারের তীব্র দমনপীড়নই ছিল অধিকাংশ বিদ্রোহের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। অধিকাংশ বিদ্রোহী নেতাকে ফাঁসি ও দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দিয়ে সরকার বিদ্রোহ দমন করেছিল।

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম শতকের কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহের কারণগুলি আলোচনা করো।

ভূমিকা – 

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রবর্তনের শুরু থেকেই কৃষক ও উপজাতিরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে।

বিদ্রোহের কারণ – 

ব্রিটিশ শাসনের প্রথম শতকে কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে হয়েছিল; সেগুলি হল –

অন্যান্য কারণ – 

মুদ্রা অর্থনীতির কুফল, কুটির শিল্পের অবক্ষয়ে চাষির বিকল্প জীবিকার অভাব, মিশনারিদের ধর্মান্তর নীতি, ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে ভারতীয়দের সমস্যা, উপজাতিদের অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, জঙ্গল কেটে বাদ দেওয়া প্রভৃতি নানা কারণেও কৃষক ও উপজাতির মানুষেরা বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।

কোম্পানি প্রবর্তিত চড়া ভূমিরাজস্ব নীতি – 

1765 খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর থেকেই ইংরেজরা অত্যধিক হারে রাজস্ব আদায় শুরু করে। নতুন ভূমিরাজস্ব নীতি ও ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় আমলাদার ও ইজারাদারদের অত্যাচারে কৃষকদের চরম দুরবস্থা দেখা দেয়। ফলে তাঁরা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।

বহুমুখী শোষণ – 

কোম্পানির আমলে ভূমিরাজস্বের চাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকার, জমিদার, মধ্যস্বত্বভোগী ও মহাজনদের মাধ্যমে বহুমুখী শোষণ কৃষক ও উপজাতিদের জীবন বিপর্যস্ত করে তোলে।

রায়ত উচ্ছেদ – 

চিরস্থায়ী, রায়তওয়ারী, মহলওয়ারী বন্দোবস্তের মাধ্যমে রায়তরা জমির অধিকার হারান; উল্টে জমিদার-ইজারাদারদের দ্বারা শোষিত হন। ফলে ভারতের গ্রামীণ জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। কৃষকরা পরিণত হয় ভাড়াটে প্রজায়।

বাণিজ্যিক ফসল চাষ – 

চাষিদের ওপর জোরজুলুম করে ধান, গম প্রভৃতি খাদ্যশস্যের বদলে নীল, আফিম, তুলো, পাট প্রভৃতি অর্থকরী ও বাণিজ্যিক ফসল চাষ করাতে বাধ্য করা হত; যার ফলে মাঝে মাঝে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত।

কোল বিদ্রোহের সূচনা, ব্যাপ্তি ও গুরুত্বকে তুমি কীভাবে বিশ্লেষণ করবে?

ভূমিকা –

ছোটোনাগপুর, সিংভূম, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতি জনগোষ্ঠী কোল নামে পরিচিত। কোলরা আবার হো, মুণ্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। 1832 খ্রিস্টাব্দে রাঁচি জেলায় ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে কোলরা যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। কোল বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন বুদ্ধু ভগৎ, জোয়া ভগৎ, সুই মুন্ডা, ঝিন্দরাই মানদি প্রমুখ।

বিদ্রোহীদের লক্ষ্য –

কোলদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল মহাজন, শস্য ব্যবসায়ী, লবণের কারবারি, মধ্যস্বত্বভোগী, ব্রিটিশ এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু ও মুসলিমরা।

বিদ্রোহের ব্যাপ্তি ও দমন –

রাঁচি, হাজারিবাগ, সিংভূম, পালামৌ প্রভৃতি অঞ্চলে কোল বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিদ্রোহী কোলদের সঙ্গে যোগ দেয় চাষি, কামার, কুমোর, গোয়ালা প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষ। ঘটনাচক্রে এই বিদ্রোহকে অন্যমাত্রা প্রদান করে। ব্রিটিশ সরকার আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর সাহায্যে এই বিদ্রোহ দমন করে।

কোল বিদ্রোহের গুরুত্ব –

মাতৃভূমি রক্ষায় কোলদের অসম লড়াই ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের গুরুত্ব অপরিসীম। এই বিদ্রোহের ফলেই সরকার –

  • কোলদের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি নামক পৃথক এক ভূখণ্ড নির্দিষ্ট করে দেয়।
  • কোলদের জন্য স্বতন্ত্র কিছু নিয়মকানুন চালু হয়; কোল প্রধানদের কেড়ে নেওয়া জমি ফিরিয়ে দেওয়া হয়; জমি হস্তান্তরে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণগুলি আলোচনা করো।

ভূমিকা – 

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভারতে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে যে সমস্ত উপজাতি বিদ্রোহ ঘটে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও রক্তাক্ত বিদ্রোহ ছিল 1855-56 খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ। সিধু ও কানহু নামক দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে 1855 খ্রিস্টাব্দের 30 জুন ভাগনাডিহির মাঠে প্রথম সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়।

কারণ –

নানা কারণে এই নিরীহ সাঁওতালরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন; তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলি হল –

  • খাজনা বৃদ্ধি – বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে বিনা খাজনায় অভ্যস্ত সাঁওতালদের (দামিন-ই-কোহ) জমির ওপর খাজনা ধার্য করা হয়। অল্পসময়ের মধ্যে সেই খাজনা প্রায় দশগুণ  বৃদ্ধি পায় (1837-55 খ্রিঃ), যা সাঁওতালরা মেনে নিতে পারেননি।
  • মহাজন ও ব্যবসায়ীদের কারচুপি – অসাধু মহাজনরা ঋণ প্রদান ও সুদ গ্রহণকালে শোষণ করত। আবার ব্যবসায়ীরা ভুয়ো বাটখারায় (কেনারাম/বেচারাম) মালপত্র কেনাবেচা করে সাঁওতালদের ঠকাত। দীনদরিদ্র সরল সাঁওতালরা এই কারচুপি জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
  • অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া – সাঁওতালরা তাদের চিরাচরিত অরণ্যের অধিকার হারিয়েছিল নতুন ভূমিরাজস্ব নীতির ফলে। অরণ্যের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।
  • প্রশাসনের অসহযোগিতা – সাঁওতালদের প্রতি রেলকর্মচারী ও ঠিকাদারদের অত্যাচার, নীলকরদের জুলুম সংক্রান্ত সাঁওতালদের অভিযোগের কোনো প্রতিকার হত না; কারণ আইন, আদালত, পুলিশ, প্রশাসন কেউই তাদের সহযোগিতা করত না।

মূল্যায়ণ –

এ সমস্ত কারণে সাঁওতালরা মহাজন, ব্যবসায়ী, কোম্পানির কর্মচারী, নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে ও অস্ত্রধারণ করে।

সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব আলোচনা করো।

ভূমিকা – 

1855 খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল বা গুরুত্বকে কখনোই ছোটো করে দেখা হয় না। এই বিদ্রোহের গুরুত্ব হল –

সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব

  • সাঁওতাল পরগনা গঠন – সাঁওতাল বিদ্রোহের অবসান হলে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে সাঁওতালদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড গঠন করা প্রয়োজন। ফলে সরকার একপ্রকার বাধ্য হয়েই সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পৃথক ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামক একটি এলাকা গঠন করে।
  • পৃথক উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি – সরকার সাঁওতালদের একটি পৃথক উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। সাঁওতাল পরগনায় সরকারি কোনো আইন কার্যকরী হবে না বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
  • জমিদারি ও মহাজনি শোষণ হ্রাস – সাঁওতাল পরগণায় তিন (3) বছরের জন্য মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়; জমিদারদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ফলে জমিদার ও মহাজনদের শোষণ সাময়িককালের জন্য হ্রাস পায়।
  • ভবিষ্যৎ আন্দোলনের পথ প্রদর্শক – সাঁওতাল বিদ্রোহীরা তীর-ধনুক, টাঙ্গি, তরবারি সম্বল করে সুশিক্ষিত সরকারি বাহিনীর বন্দুকের সামনে যে বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে, তা পরবর্তী কৃষক বিদ্রোহ তথা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পথনির্দেশ প্রদান করেছিল। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় তাই সাঁওতাল বিদ্রোহকে মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত রূপে চিহ্নিত করেছেন।
  • কর হ্রাস – সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলেই সাঁওতালদের জমির ওপর কর হ্রাস করা হয়। সাঁওতাল পরগণাকে যতদূর সম্ভব ভারতীয় জনস্রোতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়।

উপসংহার –

সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলে শুধুমাত্র সাঁওতালদের মধ্যেই নয়, সামগ্রিকভাবে নিম্নশ্রেণির কৃষকদের মধ্যে স্বাধীনতার যে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে, তা মহাবিদ্রোহের মাধ্যমে দাবানলে পরিণত হয়।

তিতুমিরের বারাসত বিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা করো।

ভূমিকা –

বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রবর্তক তিতুমিরের বিদ্রোহ বারাসত বিদ্রোহ নামে পরিচিত। তিতুমিরের বারাসত বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মধ্যে মত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি তুলে ধরা হল –

তিতুমিরের বারাসত বিদ্রোহের প্রকৃতি

  • সাম্প্রদায়িক আন্দোলন – কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, বারাসত বিদ্রোহ ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ভাবধারার সমান্তরাল আন্দোলন। বারাসত বিদ্রোহকে এইসব ঐতিহাসিক হিন্দুবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
  • মুসলিম শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা – অনেকের মতে এই বিদ্রোহ ছিল কোম্পানির শাসনের পরিবর্তে মুসলিম শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টামাত্র। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, এই আন্দোলন ছিল “মুসলিমদের জন্য, মুসলিমদের দ্বারা এবং মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন” (It was a movement of the Muslims, by the Muslims and for the Muslims)।
  • জাতীয় সংগ্রাম – কোয়ামুদ্দিন আহমদের মতানুসারে, ওয়াহাবিরা বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছিল; কারণ তিতুমিরের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ দেখা দেয়, যেহেতু সে নিজেকে বাদশাহ বলে ঘোষণা করেছেন।
  • শ্রেণিসংগ্রাম – প্রথমদিকে তিতুমির নীলকরদের বিরোধী ছিলেন না, কিন্তু নীলকররা জমিদারদের সমর্থন করলে তারা তিতুমিরের শত্রুতে পরিণত হন। অর্থাৎ এটি ছিল কৃষকদের শ্রেণিসংগ্রাম। নরহরি কবিরাজ তাই তিতুমীরের সংগ্রামকে শ্রেণি সংগ্রাম বলে বর্ণনা করেছেন।
  • অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন – ঐতিহাসিক হান্টার, থনটন প্রমুখের মতে, বিদ্রোহীরা যেমন মুসলমান জমিদারদের আক্রমণ করেছিল, তেমনি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর তারা কোনো অত্যাচার করেননি; তাই এই আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক।
  • অবহেলিত মানুষের অংশগ্রহণ – বারাসত বিদ্রোহে শহরের বিত্তবান অপেক্ষা নিম্নবিত্ত মুসলমানরা বেশি অংশগ্রহণ করেছিল; সেজন্য একে অবহেলিত মানুষের সংগ্রাম বলা যেতে পারে।

উপসংহার –

তিতুমিরের বারাসত বিদ্রোহ কি নিছক ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম, না কৃষকদের শোষণমুক্তির আন্দোলন – ঐতিহাসিকদের উত্তর যাই হোক না কেন, জমিদার, নীলকর সাহেবদের নিত্যনতুন শোষণ, সামাজিক অত্যাচার-নির্যাতন, অর্থনৈতিক শোষণ, ধর্মীয় কলুষতা থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে এই আন্দোলনের গুরুত্বকে কখনই অস্বীকার করা যাবে না।

ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী ছিল?

ভূমিকা –

ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফরাজি আন্দোলন ছিল এই রকমই একটি কৃষক বিদ্রোহ। আরবি ‘ফরাইজ’ শব্দ থেকে ফরাজি আন্দোলনের নামকরণ; তারিখ-ই-মহম্মদীয়া প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য।

উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য –

ফরাজি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল –

  • আদর্শ অনুসরণ – কোরানের পবিত্র আদর্শ অনুসরণ করে চলা, ইসলাম নির্দিষ্ট কর্তব্য ও পবিত্র বিশ্বাস মেনে চলা এবং ইসলামি ভাবধারাকে পুনরুজ্জীবিত করা।
  • কৃষক মুক্তি – অত্যাচারী হিন্দু জমিদারের শোষণ থেকে দরিদ্র কৃষকদের মুক্ত করা। নীলকর ও রক্ষণশীল মুসলমানদের বিরোধিতা করা ও ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ করে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
  • বৈষম্য দূরীকরণ – এই আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা। জমির ওপর সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক বৈষম্য দূর করা।
  • জুম্মা প্রার্থনায় নিষেধ – নামাজ, জুম্মা বা ঈদের প্রার্থনায় আপত্তি করা; কেননা ফরাজিরা মনে করত ইংরেজ অধিকৃত ভারতবর্ষ ছিল ‘দার-উল হারব’ বা ‘বিধর্মীদের দেশ’। এই অবস্থায় ভারতে নামাজ বা ঈদের সময় জুম্মা প্রার্থনা উচিত নয়।

মূল্যায়ণ –

ফরাজি আন্দোলন ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও ক্রমেই তা রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করাই এই আন্দোলনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়; কেননা ফরাজি আন্দোলন কখনই একটি হিন্দুবিরোধী সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছিল না।

ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি আলোচনা করো।

ভূমিকা – 

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলায় ফরাজি আন্দোলন নামে এক মুসলিম সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমদিকে ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও ক্রমেই তা কৃষক আন্দোলনে পরিণত হয়।

প্রকৃতি – 

এই আন্দোলনের প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। এগুলি হল –

  1. ধর্মীয় আন্দোলন – এটি ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। ফরাজি কথাটি ফরাজ থেকে এসেছে, যার অর্থ আল্লাহর আদেশ; অর্থাৎ আল্লাহ তথা হজরত মুহাম্মদের (সাঃ) নির্দেশিত পথ ধরে মুসলিম ধর্মের সংস্কারই ছিল এর লক্ষ্য। ফরাজিরা ইসলামের শুদ্ধিকরণ ও পবিত্রতায় বিশ্বাসী ছিলেন।
  2. সাম্প্রদায়িক আন্দোলন – ঐতিহাসিক বিনয়ভূষণ চৌধুরী দেখিয়েছেন, জমিদার বিরোধিতা থেকে উদ্ভূত হলেও হিন্দুধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি ফরাজিদের অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পেতে থাকে। এই আন্দোলন মূলত মুসলমান সম্প্রদায়ের দ্বারাই পরিচালিত ছিল।
  3. স্বাধীনতার আন্দোলন – আধুনিক ঐতিহাসিক অভিজিৎ দত্ত দেখিয়েছেন, দুদু মিঞা বিদেশি শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা করে। গ্রামাঞ্চলে স্বাধীন সরকার স্থাপন, সেনাবাহিনী গঠন, স্বাধীন কর ও বিচারব্যবস্থা ফরাজি আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ প্রদান করে।
  4. শ্রেণিসংগ্রাম – কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই আন্দোলনকে শ্রেণি সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে-র মতে, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও স্বল্পকালের মধ্যেই তা জমিদার-নীলকর বিরোধী সংগ্রামে পরিণত হয়।
  5. কৃষক আন্দোলন – ঐতিহাসিক নরহরি কবিরাজ দেখিয়েছেন, এই আন্দোলন ছিল মূলত কৃষক আন্দোলন। নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলিম-হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকরাই এতে অংশগ্রহণ করেছিল। দুদু মিঞার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মূলত কৃষকরাই এতে অংশগ্রহণ করেছিল। এটি ছিল একদল কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন।

উপসংহার – 

উইলিয়াম হান্টার বলেন, ফরাজি আন্দোলন ছিল একটি শ্রেণিসংগ্রাম। ঐতিহাসিক হান্টার এই আন্দোলনকে Red Republican বা সাম্যবাদী প্রজাতান্ত্রিক আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। ডঃ আর. সি. মজুমদার বলেন, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব থাকলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের পূর্বমহড়া হিসেবে ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।

ফরাজি ও ওয়াহাবি বৈসাদৃশ্য আলোচনা করো।

ভূমিকা – 

ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে উনিশ শতকে ইসলামি পুনরুজ্জীবনের জন্য যে সমস্ত আন্দোলন হয়েছিল, তার মধ্যে ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পার্থক্য – 

দুটি আন্দোলনের মধ্যে যথেষ্ট মিল থাকলেও উভয় আন্দোলনের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, যেমন –

  1. প্রথমত, ওয়াহাবি আন্দোলন তথা তিতুমিরের আন্দোলন যতটা ইংরেজবিরোধী ছিল, ফরাজি আন্দোলন ততটা ছিল না।
  2. দ্বিতীয়ত, তিতুমির ব্রিটিশ শাসনকে গুরুত্ব না দিয়ে স্বাধীন ওয়াহাবি রাজ্য ঘোষণা করেন; অন্যদিকে দুদু মিঞা খিলাফৎ প্রশাসন নামক একটি স্বশাসিত প্রশাসন গড়ে তোলেন।
  3. তৃতীয়ত, তিতুমির ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদের পক্ষে ছিলেন। অন্যদিকে, দুদু মিঞা সরকারের কাছে এক আর্জিতে জানান যে, জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম; ব্রিটিশ রাজ সম্পর্কে তাদের কোনো বিদ্বেষ নেই।
  4. চতুর্থত, ফরাজি আন্দোলন মূলত বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করেছিল; কিন্তু ওয়াহাবি আন্দোলনের পরিধি ছিল অনেক বিস্তৃত।
  5. পঞ্চমত, ওয়াহাবিদের বলা হত জুম্মাওয়ালা, কেননা তারা নামাজ ও জুম্মা পাঠ করতেন। অন্যদিকে ফরাজিদের বলা হত বে-জুম্মাওয়ালা; কারণ তারা নামাজ ও জুম্মা প্রার্থনা করতেন না। কারণ তাঁদের মতে, ইংরেজ অধিকৃত ভারতবর্ষ ছিল ‘দার-উল-হারব’; সুতরাং এই অবস্থায় ভারতে জুম্মা প্রার্থনা উচিত নয় বলে তাঁরা মনে করতেন।
  6. ষষ্ঠত, ওয়াহাবিরা প্রত্যেক ওয়াহাবিকে সমান মনে করত না; অন্যদিকে ফরাজি মতে সকল ফরাজি ছিল সমান।
  7. সপ্তমত, তিতুমির ও তাঁর অনুগামীরা সৈয়দ আহমদকে গুরু বলে মনে করতেন; কিন্তু ফরাজিরা সৈয়দ আহমদের গুরু শাহ ওয়ালী উল্লাহর মতাবলম্বী ছিল।

মূল্যায়ণ – 

দুটি আন্দোলনের মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও, এই আন্দোলন দুটির হাত ধরেই মুসলমান সমাজের সংস্কার শুরু হয়, যা পরবর্তীকালের আন্দোলনগুলির পথপ্রদর্শক রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে।

ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্যে সাদৃশ্যগুলি আলোচনা করো।

ভূমিকা

ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে উনিশ শতকে ইসলামি পুনরুজ্জীবনের জন্য যে সমস্ত আন্দোলন হয়েছিল, তার মধ্যে ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য থাকলেও উভয় আন্দোলনের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।

ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের সাদৃশ্য

  1. প্রথমত, দুটি আন্দোলনেরই প্রেরণা আসে ভারতের বাইরে থেকে। ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ মক্কা থেকে ফিরে এসে ইসলাম ধর্মের আদিম ও অকৃত্রিম আদর্শে মনোনিবেশ করেন; অন্যদিকে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রবর্তক ইবনে আব্দুল ওয়াহাব, যিনি ছিলেন আরব দেশের ধর্ম সংস্কারক; অর্থাৎ এই আন্দোলনের সূত্রপাতও আরবদেশে।
  2. দ্বিতীয়ত, দুটি আন্দোলনই ছিল ইসলাম ধর্মের পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন। ইসলাম ধর্মের কু-প্রথা দূর করে শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে এই ধর্মের পুনরুজ্জীবন ছিল দুটি আন্দোলনেরই লক্ষ্য।
  3. তৃতীয়ত, আর্থ-সামাজিক দিক থেকে দুটি আন্দোলনই ছিল সামন্ততন্ত্র বিরোধী। দুটি আন্দোলনেই ধর্মীয় জাগরণের মধ্যে আর্থ-সামাজিক শোষণ থেকে মুক্তির পথ খোঁজা হয়েছিল।
  4. চতুর্থত, দুটি আন্দোলনেই পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক প্রভাব ভীষণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। একদিকে তিতুমিরের আন্দোলনে যেমন সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল, তেমনি ফরাজি আন্দোলনের নেতা নোয়া মিঞার আন্দোলনেও একই রকম সাম্প্রদায়িক ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়।
  5. পঞ্চমত, ফরাজি ও ওয়াহাবি দুটি আন্দোলনেই অবতারত্ববাদী ভাব লক্ষ্য করা যায়। দুদু মিঞা ও তিতুমির উভয়ই নিজেদের অলৌকিক শক্তির অধিকারী বলে মনে করতেন।
  6. ষষ্ঠত, দুটি আন্দোলনেই ব্রিটিশবিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। তবে ফরাজি আন্দোলনে ওয়াহাবিদের মতো তীব্র ব্রিটিশবিরোধিতা ছিল না।
  7. সপ্তমত, উভয় আন্দোলনের মধ্যেই নিজেদের মতবাদ-মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য স্বধর্মাবলম্বী মুসলমানদের ওপর জোর-জুলুম করা হয়। বিরোধী মুসলমানদের দমন করার জন্য উভয় আন্দোলনের আন্দোলনকারীরাই সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়।
  8. অষ্টমত, দুটি আন্দোলনেই দরিদ্র কৃষক, জোলা সম্প্রদায়ের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়; যাদের উদ্দেশ্য ছিল শোষণের হাত থেকে মুক্তি।

মূল্যায়ণ

ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হলেও, ব্রিটিশ শাসিত ভারতে দুটি আন্দোলনই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব থাকলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের পূর্বমহড়া হিসেবে ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যদিকে, কেয়ামুদ্দিন আহমেদ বলেন, ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অঙ্গ।


আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় “প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Please Share This Article

Related Posts

সিঙ্গাপুরের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে জলবায়ু ও গোলার্ধ শনাক্ত করো -

সিঙ্গাপুরের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে জলবায়ু ও গোলার্ধ শনাক্ত করো।

বাংলায় ছাপাখানা ও মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কীরূপ অবদান ছিল?

বাংলায় ছাপাখানা ও মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কীরূপ অবদান ছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

তুন্দ্রা জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

About The Author

Solution Wbbse

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

সিঙ্গাপুরের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে জলবায়ু ও গোলার্ধ শনাক্ত করো।

বাংলায় ছাপাখানা ও মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কীরূপ অবদান ছিল?

তুন্দ্রা জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর অবস্থান ও প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী তা আলোচনা করো।