মাধ্যমিক ইতিহাস – সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

Solution Wbbse

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় “সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর থেকে “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস - সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
Contents Show

উনিশ শতকে বাংলার সমাজের প্রতিফলন সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র ও সাহিত্যে তুলে ধরতে কারা উদ্যোগী হয়েছিলেন?

উনিশ শতকে বাংলার সমাজচিত্র যাঁরা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে তুলে ধরেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন – উমেশচন্দ্র দত্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হরিনাথ মজুমদার প্রমুখ। অপরদিকে সাহিত্যে সমাজের কথা তুলে ধরেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ।

উমেশচন্দ্র দত্ত –

  • উমেশচন্দ্র দত্ত বামাবোধিনী পত্রিকায় উনিশ শতকের বাংলার সমাজ চিত্র তুলে ধরেছেন।
  • 1863 খ্রিস্টাব্দে বামাবোধিনী পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়।
  • তিনি তাঁর পত্রিকায় তৎকালীন সমাজে নারীদের অবস্থা, নারীশিক্ষা, সামাজিক কুসংস্কার প্রভৃতির কথা প্রকাশ করেছেন।

হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় –

  • হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় উনিশ শতকের বাংলার সমাজজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।
  • 1853 খ্রিস্টাব্দ থেকে এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়।
  • এই পত্রিকা থেকে বিশেষত গ্রামের কৃষক, নীলচাষী, আদিবাসী সাঁওতালদের দুঃখ-দুর্দশা এবং তাদের বিদ্রোহের কথা জানা যায়।

হরিনাথ মজুমদার –

  • হরিনাথ মজুমদারের গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা তৎকালীন বাংলার গ্রামীণ সামাজিক অবস্থা সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
  • 1863 খ্রিস্টাব্দ থেকে এটি প্রকাশিত হয়।
  • এই পত্রিকা থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা, জমিদারদের শোষণ, নারীদের অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায়।

কালীপ্রসন্ন সিংহ –

  • কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতোম প্যাঁচার নকশা গ্রন্থে তৎকালীন কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলের ধনী ও শিক্ষিত বাঙালি সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন।
  • হুতোম প্যাঁচার নকশা 1861 খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়।
  • এই গ্রন্থ থেকে তৎকালীন বাবুসমাজের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানা যায়।

দীনবন্ধু মিত্র –

  • দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ নাটক রচনা করেন।
  • 1860 খ্রিস্টাব্দে ‘নীলদর্পণ’ রচিত হয়।
  • এই গ্রন্থ থেকে গ্রামবাংলার কৃষক ও নীলচাষীদের দুর্দশা, নীলকর সাহেবদের অত্যাচার প্রভৃতি বিষয়ে জানা যায়।

বামাবোধিনী পত্রিকা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বামাবোধিনী পত্রিকার ভূমিকা –

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রকাশিত সাময়িকপত্রগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল ‘বামাবোধিনী সভা’ প্রকাশিত বামাবোধিনী পত্রিকা। এই পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক জীবনের প্রতিফলন পাওয়া যায়।

বামাবোধিনী পত্রিকার প্রকাশ –

ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নারীপ্রগতির অন্যতম প্রবক্তা। মূলত তাঁরই অনুপ্রেরণায় এক দল যুবক 1862-1863 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অন্তঃপুরস্থ মহিলাদের শিক্ষাদানের উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি তাদের প্রয়াসেই 1863 খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ‘বামাবোধিনী সভা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, এই সভারই মুখপত্র ছিল বামাবোধিনী পত্রিকা (আগস্ট, 1863 খ্রিস্টাব্দ)। এই পত্রিকার স্বত্বাধিকারী ও সম্পাদক ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অপর এক নেতা উমেশচন্দ্র দত্ত। বামাবোধিনী পত্রিকা কলকাতা থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হত। উল্লেখ্য, 1877 খ্রিস্টাব্দে ‘বামাবোধিনী সভা’ বন্ধ হলেও বামাবোধিনী পত্রিকাটি টিকে থাকে।

বামাবোধিনী পত্রিকার অবদান –

বামাবোধিনী পত্রিকা উনিশ শতকের নারীদের প্রকৃত অবস্থা নির্ভীকভাবে তুলে ধরেছিল। পত্রিকা তৎকালীন সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও পুরোহিত শ্রেণির প্রাধান্য সম্পর্কে নারীসমাজকে সচেতন করে তোলে। পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ, প্রবন্ধ, কবিতা জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায়। এদেশে শিল্পের বিকাশ হলে কলকারখানাতে কর্মরত মহিলাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ওইসব কর্মরতা মহিলাদের উপর বিভিন্ন অত্যাচার শোষণের বিরুদ্ধে এই পত্রিকা সরব হয়। বামাবোধিনী পত্রিকাই প্রথম নারীশিক্ষার পাঠ্যসূচিতে গণিতের পাশাপাশি ইতিহাস, সাহিত্য, ধাত্রীবিদ্যা, গৃহকর্ম, অঙ্কন ইত্যাদির উপর জোর দেওয়ার কথা বলে।

বামাবোধিনী পত্রিকার সীমাবদ্ধতা –

বামাবোধিনী পত্রিকায় নারীজাতিকে কী ধরণের আচরণ করতে হবে তারজন্য ‘পতিসেবা’, ‘আদর্শ সতী স্ত্রী’ এই জাতীয় রচনা পরিবেশিত হয়। অর্থাৎ এই পত্রিকা স্ত্রীশিক্ষায় উদ্যোগী হলেও এর অপর উদ্দেশ্য ছিল মহিলাদের সুগৃহিণী, আদর্শ পত্নী ও সু-মাতা হতে উৎসাহিত করা।

বামাবোধিনী পত্রিকার মূল্যায়ণ –

প্রকৃতপক্ষে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র প্রভৃতি মনীষীগণ নারী প্রগতির কথা ভেবেছিলেন। তাঁরা এই আন্দোলনের যে ধারার সূচনা করেন, বামাবোধিনী পত্রিকা সেই ধারাটিকেই সমৃদ্ধ করেছিল।

বামাবোধিনী পত্রিকার প্রথম সংখ্যার উপক্রমণিকায় নারীদের শিক্ষা সম্পর্কে কী উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে?

বামাবোধিনী পত্রিকার প্রথম সংখ্যার উপক্রমণিকা থেকে এই পত্রিকার উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় – “পুরুষদের ন্যায় তাহাদের (নারীদের) শিক্ষাবিধান যে নিতান্তই আবশ্যক, তদ্ভিন্ন তাহাদের দুর্দশার অবসান হইবে না, দেশের সম্যক মঙ্গল ও উন্নতির সম্ভাবনা নাই ইহাও অনেকে বুঝিয়েছেন।”

বামাবোধিনী পত্রিকায় উনিশ শতকের বাংলা সমাজের কী প্রতিফলন লক্ষ করা যায়?

অথবা, বামাবোধিনী পত্রিকার আলোকে তৎকালীন সামাজিক চিত্র বিবৃত করো।

বামাবোধিনী পত্রিকা হল নারীদের জন্য প্রকাশিত প্রথম বাংলা মাসিক পত্রিকা। বামাবোধিনী পত্রিকায় সমকালীন বাংলার সমাজের সার্বিক প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।

বামাবোধিনী পত্রিকার প্রকাশকাল ও প্রকাশক –

বামাবোধিনী পত্রিকা 1863 খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। বামাবোধিনী পত্রিকার প্রথম প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত।

বামাবোধিনী পত্রিকার প্রকাশের উদ্দেশ্য –

  • এই পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল সমাজে নারীদের উন্নতিসাধন।
  • নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং
  • সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করা ইত্যাদি।

বামাবোধিনী পত্রিকার সমাজের প্রতিফলন –

  • নারীশিক্ষা – উনিশ শতকের বাংলা সমাজ নারীশিক্ষার বিরোধী ছিল। তখন রক্ষণশীল সমাজ মনে করত শিক্ষিত মহিলারা অশুভ। কিন্তু বামাবোধিনী পত্রিকা তার প্রথম সংখ্যাতেই নারীশিক্ষা প্রসারের দাবি জানিয়েছিল। এই পত্রিকার প্রতি সংখ্যার সূচনাতে তাই লেখা থাকত ‘কন্যাকে পালন করিবেক ও যত্নের সহিত শিক্ষা দিবেক।’
  • সামাজিক কুসংস্কার – বামাবোধিনী পত্রিকা থেকে তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বৈধব্য যন্ত্রণা, কৌলীন্য প্রথা সম্পর্কে জানা যায়। বামাবোধিনী পত্রিকা সমাজে প্রচলিত এই কুসংস্কারগুলির বিরোধিতা করেছিল।
  • নারীদের অবস্থা – বামাবোধিনী পত্রিকা থেকে জানা যায় যে, তৎকালীন সমাজে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। পুরুষশাসিত সমাজে এই নারীরা গৃহের অভ্যন্তরে জীবন কাটাতে বাধ্য হত। সমাজে তাদের বিশেষ অধিকার ও মর্যাদা স্বীকৃত ছিল না।
  • নারীদের বিভিন্ন কার্যকলাপ – বামাবোধিনী পত্রিকায় ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের কথা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এতে নারীদের লেখা গল্প, কবিতা-সহ বিভিন্ন বিষয় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হত।

বামাবোধিনী পত্রিকার উপসংহার –

বোমাবোধিনী পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় লেখা হয়, ‘স্ত্রীলোকদিগের সমুদয় বিষয় লেখা হইবে যাহাতে তাহাদের ভ্রম ও কুসংস্কার সকল দূর হইয়া প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হয়। হয়। বামাবোধিনী পত্রিকার প্রথম সংখ্যার অঙ্গীকার অনেকাংশে সফল হয়েছিল। পরবর্তীকালে বাংলার নারীরা শিক্ষায়, রাজনৈতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাদের কৃতিত্বের সাক্ষ্য রেখেছিল।

উমেশচন্দ্র দত্ত সম্পর্কে কী জান?

উমেশচন্দ্র দত্তের ভূমিকা –

উনবিংশ শতকের সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল নারীকল্যাণ। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত যেসব সাময়িকপত্রে তৎকালীন সমাজের প্রতিফলন ঘটেছে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বামাবোধিনী পত্রিকা। এর সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট ব্রাহ্মনেতা ও সিটি কলেজে অধ্যক্ষ উমেশচন্দ্র দত্ত (1840-1907 খ্রিস্টাব্দ)।

উমেশচন্দ্র দত্তের জীবন বৃত্তান্ত –

1840 খ্রিস্টাব্দে বর্তমান দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মজিলপুর গ্রামে উমেশচন্দ্র দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন শ্রীযুক্ত হরমোহন দত্ত। ভবানীপুরের এক খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল থেকে 1859 খ্রিস্টাব্দে উমেশচন্দ্র এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দারিদ্র্যতার কারণে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েও ডাক্তারি পড়া ছাড়তে বাধ্য হন। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার একজন সমাজ সচেতন ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি।

উমেশচন্দ্র দত্তের ব্রাহ্মসমাজ ও বামাবোধিনী সভা –

1859 খ্রিস্টাব্দে উমেশচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। তিনি ছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের অনুগামী। বহু স্থানীয় মানুষজনের আপত্তি সত্ত্বেও ব্রাহ্মসমাজের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন হরিনাভিতে। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজ বিভাজিত হওয়ার সময়ে তিনি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠায় শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু প্রমুখের সঙ্গে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। উমেশচন্দ্র দত্ত কয়েকজন তরুণ ব্রাত্মকে নিয়ে 1863 খ্রিস্টাব্দে ‘বামাবোধিনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক কুসংস্কারের বিরোধিতা করা, বাঙালি ‘বামা’ অর্থাৎ নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো, নারী সচেতনতা বৃদ্ধি করে তাদের অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের যোগ্য করে তোলা, নারীদের মনের কথা তুলে ধরা, নারীজাতির স্বার্থে বিভিন্ন বইপত্র ও পত্রিকা প্রকাশ করা ইত্যাদি।

উমেশচন্দ্র দত্তের বামাবোধিনী পত্রিকা –

এই উদ্দেশ্যে 1863 খ্রিস্টাব্দের আগস্টে উমেশচন্দ্র দত্ত, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এবং বসন্তকুমার ঘোষের প্রচেষ্টায় ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রায় 60 বছর ধরে 1922 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পত্রিকাটি চলেছিল। এই পত্রিকা সম্পাদনাকালে উমেশচন্দ্র বিশেষভাবে সহযোগিতা পেয়েছিলেন ক্ষেত্রমোহন দত্ত ও বসন্তকুমার দত্তের কাছ থেকে। তিনি দীর্ঘ 44 বছর এই পত্রিকা সম্পাদনার কাজ করেছিলেন। বাঙালি নারী তথা গৃহবধূদের শিক্ষিত করে তোলা, তাদের প্রতি বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে নির্ভীক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও সমাজের পরিবর্তন আনতে নারীদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেওয়া এই পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল।

উমেশচন্দ্র দত্তের অন্যান্য কার্যাবলি –

উমেশচন্দ্র দত্ত শিক্ষকতার কাজে যুক্ত ছিলেন। পরে সিটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন। এরপর সিটি কলেজের অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন। তিনি মানিকতলায় মুক ও বধিরদের উন্নতিকল্পে 1893 খ্রিস্টাব্দে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘বামারচনাবলী’ ও ‘স্ত্রীলোকদের বিদ্যার আবশ্যকতা’।

উমেশচন্দ্র দত্তের উপসংহার –

1907 খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের জন্য তিনি পরিচিত মহলে ‘সাধু’ আখ্যায় ভূষিত হয়েছিলেন। নারীদের জড়তা ও দুরবস্থা কাটাতে উমেশচন্দ্রের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। বামাবোধিনী পত্রিকার প্রভাবে উনিশ শতকের বাংলা ‘বন্দিনী বামামুক্তির যুগ’ হয়ে ওঠে।

বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কবিতার অংশের উদাহরণ দাও।

বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কবিতার অংশ –
“সকলের পিতা যিনি করুণা নিধান।
নর-নারী প্রতি তার করুণা সমান।।
জ্ঞান-ধর্মে উভয়ের দিয়াছেন মন।
নয়ন থাকিতে অন্ধ কেন বামাগণ।।”

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার ভূমিকা –

উনিশ শতকে বাংলায় নীলকর সাহেবরা নীলচাষিদের ওপর যে অকথ্য নিপীড়ন চালাত, তার বিরুদ্ধে বাংলায় প্রবল প্রতিবাদ দেখা দেয়। এরকম একটি প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবে 1853 খ্রিস্টাব্দের 6 জানুয়ারি হিন্দু প্যাট্রিয়ট নামক ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশ ঘটে। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ (1854-1856 খ্রিস্টাব্দ) এবং দ্বিতীয় সম্পাদক ছিলেন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (1856-1861 খ্রিস্টাব্দ)। পরবর্তীকালে এটি দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রথম প্রবর্তক –

পত্রিকাটির প্রথম প্রবর্তক ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন মধুসূদন রায়। তাঁর চিঠি থেকে জানা যায় যে, তাঁর কাছ থেকে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পত্রিকাটির প্রেস ও কাগজের স্বত্ব কিনে নেন। হরিশচন্দ্র ছাড়াও অপর দুজন উল্লেখযোগ্য মালিকরা হলেন যথা- কালীপ্রসন্ন সিংহ ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য –

এই পত্রিকার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল – দেশের স্বার্থ জনগণের কাছে প্রচার এবং প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলির প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন দিকগুলি তুলে ধরা ছাড়াও জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচার করা ছিল এই পত্রিকা প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য। মোট 71 বছর চালু থাকার পর 1924 খ্রিস্টাব্দে এই পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট আধুনিক পত্রিকা –

হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রথম 2 বছর 6 মাস ধরে বিনা পারিশ্রমিকে পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। প্রথম দিকে এই পত্রিকাটি দাম বেশি হওয়ায় এর বিক্রি কমে যাওয়ায় হরিশচন্দ্র আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। তথাপি হরিশচন্দ্র টেলিগ্রাফের মাধ্যমে বিদেশি সংবাদ সংগ্রহের ব্যবস্থা করে হিন্দু প্যাট্রিয়ট-কে একটি ‘আধুনিক পত্রিকায়’ পরিণত করেন। ফলে এই পত্রিকা বিদেশিদের দ্বারা পরিচালিত পত্রিকাগুলিকে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলে দেয়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার উপসংহার –

পরিশেষে বলা যায়, ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা বাংলায় ইংরেজি-শিক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করত। পত্রিকাটি জাতীয়তাবাদ প্রচার করে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করে। সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহের কাহিনি প্রচার করে এই পত্রিকা দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে।

বামাবোধিনী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব উমেশচন্দ্র দত্তের পর কারা পালন করেন? পত্রিকাটির সদর কার্যালয় কোথায় ছিল?

উমেশচন্দ্র দত্তের পর যাঁরা সম্পাদনার কাজ করেছিলেন, তাঁরা হলেন সুকুমার দণ্ড, তারাকুমার কবিরত্ন, সূর্যকুমার চট্টোপাধ্যায়, ক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। পত্রিকার সর্বশেষ সম্পাদক হলেন আনন্দকুমার দত্ত। এই পত্রিকার সদর কার্যালয়টি ছিল 16নং রঘুনাথ স্ট্রিট, শিমুলিয়া, কলকাতা।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলার অর্থনৈতিক জীবনের কী চিত্র পাওয়া যায়?

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলার অর্থনৈতিক জীবনের ভূমিকা –

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলার অর্থনৈতিক জীবনের চিত্র পাওয়ার জন্য সাময়িক পত্রিকা অন্যতম উপাদান। এক্ষেত্রে হিন্দু প্যাট্রিয়ট বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই পত্রিকা থেকে সমকালীন ব্রিটিশ শোষণনীতি এবং বাংলার মানুষের জীবন ও জীবিকার কথা জানা যায়।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলার অর্থনৈতিক জীবনের ব্রিটিশ শোষণ –

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল উপনিবেশগুলিকে শোষণ করা। এই শোষণনীতি লক্ষ করা যায় –

  • চড়া ভূমিরাজস্ব,
  • বাণিজ্যিক ক্ষেত্র এবং
  • ফিনান্স বা অর্থকরী পুঁজির মাধ্যমে।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা এইসব বিষয়গুলির উপর আলোকপাত করেছিল।

  • চড়া ভূমিরাজস্ব – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এসময় বাংলায় প্রচলিত ছিল। এই ব্যবস্থায় জমিদাররা জমির মালিক ছিলেন। সরকার পতিত ও নিষ্কর জমিতেও রাজস্ব ধার্য করেছিল। জমিদাররা রাজস্ব হার বাড়িয়ে দেওয়ার ফলে কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
  • বাণিজ্যিক ক্ষেত্র – 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতের বাজার ইংল্যান্ডের সমস্ত কোম্পানির জন্য উন্মুক্ত হয়। ফলে ইংল্যান্ডের কলকারখানার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ভারত থেকে সংগ্রহ শুরু হয়। অর্থাৎ ভারত একদিকে ইংল্যান্ডের কাঁচামাল রফতানিকারক দেশে এবং অপরদিকে ইংল্যান্ডে উৎপন্ন শিল্পদ্রব্যের বিক্রির বাজারে পরিণত হয়। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের পণ্য আমদানিতে কম শুল্কহার বজায় ছিল।
  • ফিনান্স পুঁজি – বাণিজ্য পুঁজি রূপ বদল করে ফিনান্স বা অর্থকরী পুঁজিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। এই ব্যবস্থায় শোষণের রূপ ছিল ভয়াবহ ও সর্বগ্রাসী। তা হল – নীলচাষ, আফিম চাষ, চা-পাট ও অন্যান্য শিল্প, রেলপথ নির্মাণ প্রভৃতি।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলার অর্থনৈতিক জীবনের মূল্যায়ন –

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাতে জর্জরিত ও শোষিত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইতঃস্তত বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ ঘটে। সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীলচাষিদের আন্দোলন প্রভৃতি ছিল তার বহিঃপ্রকাশ। সিপাহি বিদ্রোহের পিছনে আর্থিক। শোষণ অন্যতম কারণ ছিল। ইংরেজদের চা বাগানে বিহারের কুলিদের পাঠানো হত কম মজুরি ও বেশি শ্রমের বিনিময়ে। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা এই বিষয়গুলির উপর নিবন্ধ প্রকাশ ও প্রচার করে। এর থেকে আমরা সমকালীন বাংলাদেশের আর্থিক জীবনেরও চিত্র পেয়ে থাকি।

গণসংগ্রামের কাহিনি হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় কতটা প্রচারিত হয়?

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার ভূমিকা –

1853 খ্রিস্টাব্দে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। যদিও এই পত্রিকা ইংরেজি ভাষায় প্রচারিত হত, তথাপি সমকালীন গণসংগ্রামের কাহিনিগুলি এই পত্রিকা প্রচার করত। পত্রিকাটিতে জাতীয়তাবাদী মনোভাব প্রকাশিত হয়।

গণসংগ্রাম –

এই সময় বাংলায় কয়েকটি গণসংগ্রাম ঘটে। যথা –

  • সাঁওতাল বিদ্রোহ,
  • সিপাহি বিদ্রোহ,
  • নীলচাষিদের আন্দোলন ইত্যাদি।

সাঁওতাল বিদ্রোহ –

ভারতের আদি অধিবাসী সাঁওতালরা রাজমহলের পার্বত্য অঞ্চলে (দামিন-ই-কোহ) বসবাস করত। বিভিন্ন কারণে 1855 খ্রিস্টাব্দে তারা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়। সাঁওতালদের দলবদ্ধ অভিযান, জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত ব্রিটিশবাহিনীর সঙ্গে তিরধনুক, বর্শা, কুঠার প্রভৃতি সনাতন অস্ত্রসজ্জিত সাঁওতালদের অসম যুদ্ধকাহিনি এই পত্রিকায় লেখা হয়। পরাজিত সাঁওতালদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের নৃশংস আচরণ সহানুভূতির সঙ্গে প্রচার করে এই পত্রিকা।

সিপাহি বিদ্রোহ –

1857 খ্রিস্টাব্দের 29 মার্চ ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে মঙ্গল পাণ্ডে চর্বিমিশ্রিত কার্তুজ ব্যবহারে অসম্মত হয়ে বিদ্রোহ করেন। এই বিদ্রোহের আগুন ক্রমে ভারতের বিভিন্ন সেনাছাউনিতে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশবাহিনী বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হয়। বিদ্রোহী সিপাহি ও ব্রিটিশবাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ হয়। সাধারণ মানুষ সিপাহিদের সঙ্গে যোগ দেয়। এই যুদ্ধ-সংঘর্ষের বিবরণ এই পত্রিকা প্রচার করে।

নীলচাষিদের আন্দোলন –

নীলচাষ বাংলার কৃষকদের জীবনে দুর্দশার সৃষ্টি করেছিল। ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের প্রয়োজনে বাংলার মাটিতে নীলচাষ করা হত। নীলচাষ নীলকর সাহেবদের কাছে লাভজনক হলেও নীলচাষিদের সর্বনাশের কারণ ছিল। এর প্রতিবাদে 1860 খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিভিন্ন স্থানের নীলচাষিরা সংঘবদ্ধভাবে আন্দোলন করে। শেষে তাদের আন্দোলন সফল হয়। এই আন্দোলনের কাহিনি ধারাবাহিকভাবে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার মূল্যায়ন –

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই গণসংগ্রামের কাহিনি প্রচারে উদ্যোগী ছিলেন। পত্রিকা এই কাহিনি প্রচারের প্রেক্ষাপটে জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরে। ভারতীয়দের প্রতি মমত্ববোধ দেখায়। ঔপনিবেশিক শাসনের নির্মম রূপ ফুটিয়ে তোলে। এজন্য পত্রিকাটি বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বাংলায় নীলচাষিদের কল্যাণে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় -এর ভূমিকা কী ছিল?

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার ভূমিকা –

ভারতীয় সাংবাদিকতা ও বঙ্গীয় জাগরণের ইতিহাসে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (1824-1861 খ্রিস্টাব্দ) সম্পাদিত ইংরেজি সংবাদপত্র হিন্দু প্যাট্রিয়ট এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে। সমকালীন বাংলার সমাজের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র এই পত্রিকায় ফুটে উঠেছিল।

হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় -এর মুখ্য ভূমিকা –

হিন্দু প্যাট্রিয়টের সম্পাদক হিসেবে হরিশচন্দ্র মুখ্য ভূমিকা পালন করেন নীল বিদ্রোহের সময় (1859-1860 খ্রিস্টাব্দ)। সিপাহি বিদ্রোহের দু-বছর পর নীল বিদ্রোহের সময় দরিদ্র ও অসহায় নীলচাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিল। হরিশচন্দ্র নীলচাষিদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন এবং তাঁর অনলবর্ষী লেখনীর মাধ্যমে দরিদ্র প্রজাদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের সংবাদ নিয়মিত প্রকাশ করতে থাকেন।

হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় -এর প্রেক্ষাপট –

ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের উন্নতি ঘটে। ক্রমে সমস্ত ইউরোপে তা ছড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় কাপড় রং করার জন্য রঞ্জক হিসেবে নীলের চাহিদা দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। নীলকরদের চাপে বাংলার চাষীরা ধান, পাট, তামাক প্রভৃতি ফসলের চাষ করার পরিবর্তে নীলের চাষ করতে বাধ্য হয় তা না করলে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে হত। ফলে চাষিরা রুখে দাঁড়ায়। এই সময় কয়েকজন দেশপ্রেমিক, হৃদয়বান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ব্যক্তি নীলচাষিদের পক্ষে কলম ধরেন। এঁদের মধ্যে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য।

হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় -এর অবদান –

তিনি ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ -এর পাতায় নীলচাষীদের দুর্দশা এবং নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে সুচিন্তিত প্রবন্ধ রচনা করে সরকারের চোখ খুলে দেন। শিশিরকুমার ঘোষ গ্রামে গ্রামে ঘুরে নীলকর কর্তৃক নীলচাষিদের উপর অত্যাচারের প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ পাঠালে হরিশচন্দ্র তা ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ -এ ছাপাতেন। এর ফলে চাষীদের বিদ্রোহের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ সরকার দমন নীতি পরিহার করে ‘নীল কমিশন’ গঠন করে। নীল কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকার ঘোষণা করে যে, জোরজবরদস্তি করে কাউকে দিয়ে নীলচাষ করানো যাবে না।

হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় -এর মূল্যায়ন –

এইভাবে নীলচাষিদের সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়। নীল আন্দোলন ছিল একটি গণ আন্দোলন। হিন্দু-মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের চাষি ঐক্যবদ্ধভাবে এই সংকটের মোকাবিলা করে। আর তাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা এককথায় চিরস্মরণীয়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার ভূমিকা –

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে যেসব পত্রিকা ভারতবর্ষ তথা বাংলার জাতীয়তাবাদের জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে সেগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল হিন্দু প্যাট্রিয়ট। যার সম্পাদক ছিলেন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় -এর জন্ম ও শৈশব জীবন –

নির্ভীক, সমাজসেবী, সাংবাদিক ও দেশপ্রেমিক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় 1824 খ্রিস্টাব্দে ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন রামধন মুখোপাধ্যায়। দরিদ্র হলেও তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী ছাত্র। ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি দিয়েছিলেন। সংসারের উপকারার্থে স্কুল জীবনেই বিভিন্ন কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অবদান –

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার ও প্রেসের মালিকানা স্বত্ব ছিল মধুসূদন রায়ের নামে। প্রথম ম্যানেজিং এডিটর বা সম্পাদক ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। 1855 খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে হরিশচন্দ্রের বড়ো দাদা ভবানীপুরের হারানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পত্রিকা ও প্রেসের মালিকানা স্বত্ব কিনে নেন। মূলত হরিশচন্দ্র পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন তখন থেকেই।

হরিশচন্দ্র তাঁর পত্রিকায় অত্যন্ত ক্ষুরধার ভাষায় লর্ড ডালহৌসির দেশশাসন নীতি ও হ্যালিডের প্রদেশ শাসন নীতিকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। এই পত্রিকায় সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনে এবং সাধারণ চাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অন্যায় অত্যাচারের তীব্র সমালোচনা করা হয়। নারীশিক্ষা ও হিন্দু বিধবাবিবাহ বিষয়ে পত্রিকা বিশেষ আলোকপাত করে। হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা, বর্ণপ্রথা-সহ নানা ধরণের কুপ্রথার বিরুদ্ধে এই পত্রিকা সরব হয়। চাল, চিনি, তৈলবীজ রফতানির বিরোধিতাও করা হয়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় নীলচাষিদের সাহায্যদান –

হরিশচন্দ্র 1860 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল থেকে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় Indigo Districts বা নীল জেলা নামে একটি নতুন বিভাগ খুলে দরিদ্র নীলচাষিদের উপর ইউরোপীয় নীলকরদের ভয়াবহ অত্যাচারের কাহিনি নির্ভীকভাবে তুলে ধরেছিলেন। দরিদ্র চাষিদের আইনি ও আর্থিক সহায়তা, চিঠিপত্র লিখে দেওয়া প্রভৃতি কল্যাণমূলক কাজে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সীমাবদ্ধতা –

রামগোপাল সান্যাল -এর মতে, হরিশচন্দ্র সিপাহি বিদ্রোহের দিনগুলিতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাতে লর্ড ক্যানিং ও তৎকালীন পার্লামেন্টের সদস্য লর্ড গ্রেনভিল হিন্দু প্যাট্রিয়ট ও তার সম্পাদকের প্রতি প্রসন্ন ও মুগ্ধ হয়েছিলেন।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার উপসংহার –

হরিশচন্দ্র নীলচাষিদের সমর্থনে কাজ করতে গিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করেন, ফলে তিনি ভগ্নস্বাস্থ্যের অধিকারী হন। ইতিমধ্যে, স্ত্রী ও সন্তানদের মৃত্যুতে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তা সত্ত্বেও তিনি হিন্দু প্যাট্রিয়টের কাজ থেকে কখনও ছুটি নেননি। অবশেষে মাত্র 37 বছর বয়সে 1861 খ্রিস্টাব্দের 14 জুন যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

হুতোম প্যাঁচার নকশা – এরকম নামকরণ করা হয়েছিল কেন?

হুতোম প্যাঁচার নকশা হল কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। এটি 1861 খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক সামাজিক নকশা জাতীয় রচনা। এটি তৎকালীন সমাজের ফন্দিফিকির করে অর্থ উপার্জন করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিদ্রূপ করে লেখা।

হুতোম প্যাঁচার নকশা-র নামকরণ –

হুতোম প্যাঁচার নকশা-র রচয়িতা কালীপ্রসন্ন সিংহের ছদ্মনাম ছিল হুতোম প্যাঁচা। নকশা শব্দের অর্থ হল হাস্যরসাত্মক রচনা বা ব্যঙ্গচিত্র। তাই কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর রচিত নকশার নামকরণ করেন হুতোম প্যাঁচার নকশা।

হুতোম প্যাঁচার নকশা-র নামকরণের কারণ –

কালীপ্রসন্ন সিংহের একটি সার্থক রচনা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’। প্যাঁচা নিশাচর পাখি; সে রাতের অন্ধকারে জগতের সব খবর জানে। যেসব মানুষের মানসিকতা দ্বৈধ—সকলের সামনে ভালো, আবার আড়ালে খারাপ, অথবা দিনে ভালো রাতের অন্ধকারে খারাপ—তাদের কুকীর্তি ফাঁস করতে প্যাঁচার জুড়ি নেই। আবার মানুষ হুতোম প্যাঁচার ডাকে ভয় পায়। তাই কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর সমকালের ধনী সমাজের ভণ্ডামি, কপটতা, ও অনাচার প্রকাশ করতে যেসব নকশা লিখেছিলেন, তার নামকরণ করেছিলেন ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’।

নিশাচর পাখি কাকে বলে?

নিশাচর পাখি – যে পাখি রাতে বিচরণ করে। প্যাঁচা রাতে বের হয়।

হুতোম প্যাঁচার নকশা গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কী প্রতিফলন লক্ষ করা যায়?

অথবা, হুতোম প্যাঁচার নকশা গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলার কিরূপ চিত্র পাওয়া যায়?

হুতোম প্যাঁচার নকশা-য় কালীপ্রসন্ন সিংহ তৎকালীন কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলের ধনী ও শিক্ষিত বাঙালি সমাজের তথা বাবুসমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন। এই সমাজ হল বাঙালি সমাজের অগ্রণী অংশ। এরা ব্রিটিশ আমলে অর্থসম্পদে ফুলেফেঁপে উঠেছিল।

হুতোম প্যাঁচার নকশা গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের প্রতিফলন –

সমাজের ধ্বজাধারীদের শ্রেণিবিভাজন –

এই গ্রন্থে যাদের ব্যঙ্গ করা হয়েছে তারা লেখকের নিজের শ্রেণির ও সেই সময়ের সমাজের অগ্রবর্তী ধ্বজাধারী মানুষজন। লেখক তাদের তিন ভাগে ভাগ করেছেন। এরা হলেন –

  • ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরণকারী।
  • ইংরেজি-শিক্ষিত কিন্তু অন্ধ অনুকরণকারী নন এবং
  • ইংরেজি না-জানা গোঁড়া হিন্দু।

অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন –

এই সময়ের সমাজে এই ব্যক্তিদের প্রায় সকলে কমবেশি ফন্দিফিকির করে বা অসৎ উপায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করত। হীনতা, কপটতা যেন তৎকালীন সমাজের স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছিল।

উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন –

এই সময়ে কলকাতা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী শহরতলিতে এক শ্রেণির মানুষ ভ্রষ্টাচারপূর্ণ উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতে শুরু করেছিল।

ধর্মীয় গোঁড়ামি –

এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় তৎকালীন সমাজে হিন্দু, ব্রাহ্ম, খ্রিস্টান সব ধর্মেরই কিছু গোঁড়া প্রকৃতির মানুষ মানবিকতার উপরে ধর্মীয় গোঁড়ামিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। সমাজে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বিধবাবিবাহের পক্ষে ও বিপক্ষে জনমত যে দ্বিধাবিভক্ত ছিল তাও জানা যায়।

কালীপ্রসন্ন সিংহ সম্পর্কে কী জান?

কালীপ্রসন্ন সিংহের ভূমিকা –

উনিশ শতকের বাংলায় কালীপ্রসন্ন সিংহ এক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। 1840 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এক ধনী বনেদি জমিদার বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র 29 (মতান্তরে 30 বছরের) বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাহিত্যচর্চা ও সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে গেছেন।

কালীপ্রসন্ন সিংহের বিদ্যোৎসাহিণী সভা –

কালীপ্রসন্ন সিংহ (1840-1870 খ্রিস্টাব্দ) মাত্র 15 বছর বয়সে 1855 খ্রিস্টাব্দে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে মিলিত হয়ে সাহিত্য পাঠ ও আলোচনা করতেন। বিধবাবিবাহ ও সমাজসংস্কারের সপক্ষে নানা মতামত তাঁরা প্রচার করতেন।

কালীপ্রসন্ন সিংহের সাহিত্য কীর্তি –

কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি। এই গ্রন্থটির প্রথম ভাগ 1861 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় ভাগ-সহ একত্রে বইটি প্রকাশিত হয় 1864 খ্রিস্টাব্দে। গ্রন্থটি সমকালীন কলকাতার ‘বাবু কালচার’ এবং বাংলার সমাজজীবনের এক অসাধারণ ও জীবন্ত দলিল। এ ছাড়া তিনি সতেরো খণ্ডে মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করে বিখ্যাত হয়ে আছেন। ‘পুরাণ সংগ্রহ’ রচনা তাঁর অন্যতম কীর্তি।

নীলদর্পণ নাটক ও তাঁর অবদান –

দীনবন্ধু মিত্র সরকারি কর্মচারী হওয়ায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন। শেষে কেস হলে ইংরেজি অনুবাদ করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন পাদরি রেভারেন্ড লঙ সাহেব। বিচারে লঙ সাহেবের একমাসের কারাদণ্ড ও 1 হাজার টাকা জরিমানা হলে (1861 খ্রিস্টাব্দ) কালীপ্রসন্ন সিংহ জরিমানার সেই টাকা জমা করে দেন।

কালীপ্রসন্ন সিংহের মানবহিতৈষী ব্যক্তিত্ব –

কালীপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন একজন মানবদরদি ব্যক্তি। দুর্দশাগ্রস্থ ও বিপদে থাকা বহু মানুষকে তিনি অকাতরে দান করতেন। 1856 খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ আইন পাস হলে তিনি প্রত্যেক বিধবাবিবাহকারী ব্যক্তিকে 1 হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।

কালীপ্রসন্ন সিংহের আর্থিক সংকট –

সমাজকল্যাণের কাজে অর্থব্যয় এবং অকাতরে দানধ্যান করার ফলে অচিরেই কালীপ্রসন্ন ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ঋণ পরিশোধ করার জন্য কলকাতার বেঙ্গল ক্লাব এবং উড়িষ্যার জমিদারি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। বন্ধু-আত্মীয়পরিজনদের দ্বারা প্রতারিতও হয়েছিলেন তিনি।

কালীপ্রসন্ন সিংহের উপসংহার –

কালীপ্রসন্ন সিংহ 1870 খ্রিস্টাব্দে মাত্র 30 বছর বয়সে মারা যান। তিনি ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলার তৎকালীন সমাজের জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। এর আগে বাংলা গদ্যে নিরঙ্কুশ কথ্যভাষার ব্যবহার দেখা যেত না। বাংলা গদ্যসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে গ্রন্থটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আর এখানেই কালীপ্রসন্নের সার্থকতা।

কত খ্রিস্টাব্দে এই সভা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে গণসম্বর্ধনা প্রদান করে?

1861 খ্রিস্টাব্দে এই সভা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে গণসম্বর্ধনা প্রদান করে।

নীলদর্পণ নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায়?

নীলদর্পণ হল দীনবন্ধু মিত্র রচিত একটি বাংলা নাটক। 1860 খ্রিস্টাব্দে এটি ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। দীনবন্ধু মিত্র ‘কেনচিৎ পথিকেন’ ছদ্মনামে নাটকটি প্রকাশ করেছিলেন। এই নাটকের প্রধান বিষয় ছিল বাংলার নীলচাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার।

নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদ –

রেভারেন্ড জেমস লঙ 1861 খ্রিস্টাব্দে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন। এই অনুবাদের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘বিদ্রোহী’ বলে অভিযুক্ত করে। এজন্য জেমস লঙের এক মাসের কারাদণ্ড ও 1000 টাকা জরিমানা হয়েছিল।

বাংলা সমাজের প্রতিফলন –

  • গ্রামবাংলার কৃষকদের দুর্দশা – ‘নীলদর্পণ’ নাটকে বাংলার কৃষকদের দুর্দশার কথা ফুটে উঠেছে। এই সময় সাধারণ চাষিরা জমি চাষ করে সারা বছরের খাবার জোগাড় করতে পারত না। তারা তাদের দুঃসময়ে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সংসার চালাতে বাধ্য হত। বাংলায় নীলচাষ শুরু হলে তারা নীলকর সাহেবদের কাছ থেকেও দাদন বা অগ্রিম অর্থ নিতে বাধ্য হত।
  • নীলচাষিদের দুর্দশা – নীলকর সাহেবরা বাংলার নীলচাষিদের বিভিন্নভাবে শৌষণ করত। যেমন –
    • অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাষি তার জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য হত।
    • নীলচাষের জন্য চাষিদের আগাম টাকা বা দাদন নিতে বাধ্য করা হত। এই দাদনের পরিমাণ ছিল বিঘা প্রতি 2 টাকা মাত্র।
    • উৎপন্ন নীল কেনার সময় ওজনে বেশি নেওয়া ও দাম কম দেওয়া হত। হত।)
  • চাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার – নীলদর্পণ’ নাটকে চাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের শোষণ ও অত্যাচারের বিবরণ পাওয়া যায়। চাষিরা নীলকর সাহেবদের কথামতো নীলচাষ করতে না চাইলে তাদের বিভিন্নভাবে অত্যাচার করা হত। চাষিদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া, নীলকুঠিতে তাদের গোরুবাছুর এনে বেঁধে রাখা, জমির ফসল নষ্ট করে দেওয়া, নারীদের শ্লীলতাহানি ও চাষিদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হত। গ্রামের অবস্থাপন্ন চাষিরাও নীলকরদের এই অত্যাচার থেকে রেহাই পেত না।
  • তৎকালীন গ্রামসমাজের জীবনযাত্রা ও ভাষা – ‘নীলদর্পণ’ নাটক থেকে তৎকালীন বাংলার গ্রামসমাজের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে পারা যায়। এই নাটকে আঞ্চলিক ভাষার সাবলীল প্রয়োগ হওয়ার ফলে তৎকালীন শহুরে ভাষা ও গ্রামের মানুষের কথ্যভাষা সম্পর্কেও জানা যায়। দীনবন্ধু মিত্র পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা আয়ত্ত করে এই নাটকের চরিত্রগুলিকে মুখের ভাষার ভিত্তিতে জীবন্ত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
  • গ্রামবাংলার চাষিদের প্রতিরোধ – নীলকর সাহেবদের শোষণ ও অত্যাচার নীলচাষিরা নীরবে সহ্য করেনি। তারা নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করেছিল। নাটকে নীলচাষি তোরাপ-এর ভূমিকা ছিল প্রতিবাদী কৃষকের।

নীলদর্পণ নাটকের উপসংহার –

নীলদর্পণ সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য ও সমাজে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। নাটকে তৎকালীন সাধারণ মানুষের জীবনকথা যথার্থভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। অনেকে এই নাটককে বাংলার প্রথম গণনাটক হিসেবে স্বীকার করেন। ‘নীলদর্পণ’ প্রথম বিদেশিশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কথা বলে মানুষের মনে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করেছিল।

জাতীয়তাবাদ বিকাশে নীলদর্পণ নাটকটির ভূমিকা লেখো।

জাতীয়তাবাদ বিকাশে নীলদর্পণ নাটকটির ভূমিকা –

বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার বিকাশে প্রধান উপাদান ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা। এই সূত্রে সাহিত্য, সংবাদপত্র এবং বিশেষ কিছু ঘটনা এদেশীয় মানুষদের এক জাতীয়তার সূত্রে বাঁধতে সাহায্য করে। এই সাহিত্য উপাদানের মধ্যে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি অন্যতম।

নীলকরদের শোষণ –

নীলকর সাহেবরা বাংলার নীলচাষিদের বিভিন্নভাবে শোষণ করত। যেমন –

  • অনিচ্ছাসত্ত্বেও চাষি তার জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য হত।
  • নীলচাষের জন্য চাষিদের আগাম টাকা বা দাদন নিতে বাধ্য করা হত। এই দাদনের পরিমাণ ছিল বিঘা প্রতি 2 টাকা মাত্র।
  • উৎপন্ন নীল কেনার সময় ওজনে বেশি নেওয়া ও দাম কম দেওয়া হত।

নীলকরদের অত্যাচার –

চাষিরা নীলচাষে অনিচ্ছুক হলে নীলকর সাহেবরা বিভিন্নভাবে তাদের উপর অত্যাচার করত। যেমন –

  • চাষির গোরু-ছাগল আটক করা,
  • চাষিদের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া বা আগুন ধরিয়ে দেওয়া,
  • চাষির ছেলেমেয়েদের বন্দি করা ইত্যাদি।

স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন ও আদালতেও নীলকরদের প্রভাব ছিল। তাই নীলচাষিরা অসহায় হয়ে পড়েছিল।

নীলচাষিদের আন্দোলন –

পঞ্চম রেগুলেশন, সপ্তম রেগুলেশন এবং বারাসত-এর ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাপলি ইডেন -এর ঘোষণায় নীলচাষ চাষিদের স্বেচ্ছাধীন হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চাষিরা নীলচাষ করতে অসম্মত হয়। তাদের আন্দোলন ছিল সংঘবদ্ধ এবং অহিংস।

শিক্ষিত শ্রেণির সমর্থন –

নীলকরদের শোষণ, নীলচাষিদের দুর্দশা ও সংঘবদ্ধ আন্দোলন বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হিন্দু প্যাট্রিয়ট, অমৃতবাজার পত্রিকা ইত্যাদি। নীলদর্পণ নাটক এই ঘটনাকে জীবন্ত করে উপস্থাপিত করে। এর ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি নীলচাষিদের প্রতি সহানুভূতি দেখায়। তারা ঔপনিবেশিক শোষণের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারে।

জাতীয়তাবাদ বিকাশে নীলদর্পণ নাটকটির মূল্যায়ন –

দরিদ্র নীলচাষিদের স্থানীয় স্তরের এই আন্দোলন ভারতের জাতীয়তাবাদ গঠনের পথ প্রশস্ত করে। হিন্দু-মুসলিমদের ঐক্য, অহিংস পথে সংঘবদ্ধ আন্দোলন, ইংরেজ বিরোধিতা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। নীলদর্পণ নাটকের মাধ্যমে শিক্ষিত শ্রেণি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়।

নীলদর্পণ নাটকের গুরুত্ব কী?

নীলদর্পণ হল দীনবন্ধু মিত্রের রচিত একটি বিখ্যাত বাংলা নাটক। নীলচাষকে কেন্দ্র করে নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি নিয়ে নীলদর্পণ নাটক রচিত হয়েছিল। বাংলার ইতিহাসে এই নাটকের গুরুত্ব অপরিসীম।

নীলদর্পণ নাটকের গুরুত্ব –

  • নীলচাষিদের দুর্দশা – নীলকর সাহেবরা বাংলার নীলচাষিদের উপর যে অকথ্য অত্যাচার করত নীলদর্পণ নাটকে তা তুলে ধরা হয়।
  • নীলচাষিদের প্রতিরোধ – নীলকরদের শোষণ নীলচাষিরা নীরবে মেনে নেয়নি। তারা প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে। নাটকে নীলচাষি তোরাপের ভূমিকায় তা স্পষ্ট।
  • বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন – নীলকর সাহেবরা নীলচাষিদের উপর যে অত্যাচার করত বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা তার বিরোধিতা করে। নীলদর্পণ নাটক নীলচাষিদের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার সহায়ক হয়েছিল।
  • ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ – নীলদর্পণ নাটক হল প্রথম বাংলা নাটক, যা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং রেভারেন্ড জেমস লঙ তা প্রকাশ করেন।

নীলদর্পণ নাটকের উপসংহার –

নীলদর্পণ নাটক বাঙালিদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে তোলে। এই নাটকের মাধ্যমে বাংলার শিক্ষিত শ্রেণি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়।

দীনবন্ধু মিত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার একজন বিশিষ্ট নাট্যকার, কবি ও ঔপন্যাসিক। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি হল নীলদর্পণ নাটক রচনা।

দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম জীবন –

দীনবন্ধু মিত্র তৎকালীন নদিয়া জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কালাচাঁদ মিত্র। দীনবন্ধু মিত্রের পূর্বনাম ছিল গন্ধর্ব নারায়ণ।

দীনবন্ধু মিত্রের শিক্ষা জীবন –

দীনবন্ধু মিত্র গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। দারিদ্র্যতার জন্য কিছুদিন পাঠগ্রহণের পর তাঁকে কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে হয়।

দীনবন্ধু মিত্রের কর্মজীবন –

1855 খ্রিস্টাব্দে 150 টাকার বেতনে তিনি পাটনায় পোস্টমাস্টারের কাজে নিযুক্ত হন। এই কাজে নদিয়া, ঢাকা-সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়ার ফলে সেই সকল অঞ্চলের নীলচাষিদের শোষণ ও অত্যাচার সম্পর্কে দীনবন্ধু মিত্র জানতে পারেন।

দীনবন্ধু মিত্রের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি –

দীনবন্ধু মিত্রের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি হল নীলদর্পণ নাটক রচনা। বাংলার নীলচাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের শোষণ ও অত্যাচারের কাহিনী নিয়ে ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচিত হয়েছিল। এটি 1860 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। নীলদর্পণ নাটক প্রকাশিত হওয়ার পর জনমানসে এর প্রভাব পড়ে। বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা নীলচাষিদের সমর্থন করে।

দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদ –

নীলদর্পণই প্রথম বাংলা নাটক যা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এরজন্য রেভারেন্ড জেমস লঙ-এর জেল ও জরিমানা হয়।

দীনবন্ধু মিত্রের মৃত্যু –

দীনবন্ধু মিত্র 1873 খ্রিস্টাব্দে 43 বছর বয়সে মারা যান।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার প্রকাশ সম্পর্কে কী জান?

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার ভূমিকা –

উনিশ শতকের বাংলার একটি প্রভাবশালী মাসিক পত্রিকা হল গ্রামবার্তা প্রকাশিকা। গ্রামীণ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার প্রকাশ –

1863 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথমে গিরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে ও পরে 1873 খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালির মথুরানাথ প্রেস নামক ছাপাখানা থেকে পত্রিকা প্রকাশের কাজ চলতে থাকে। এক্ষেত্রে মথুরানাথ মৈত্রেয় হরিনাথকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার অগ্রগতি –

প্রথমে মাসিক পত্রিকা হিসেবে এটি প্রকাশিত হলেও পরে 1864 খ্রিস্টাব্দের জুন-জুলাই মাসে এটি পাক্ষিক ও 1871 খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল-মে মাসে সাপ্তাহিক পত্রিকায় পরিণত হয়।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার সম্পাদক –

এর প্রথম সম্পাদক হলেন হরিনাথ মজুমদার। তাঁর আসল নাম হরচন্দ্র মজুমদার (1833-1896 খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রকাশক এবং বিক্রেতা।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য –

হরিনাথ তাঁর পত্রিকায় গ্রামের নিপীড়িত, অবহেলিত মানুষের কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি মনে করতেন, প্রজাস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন ঘটনা ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিগোচরে আনতে পারলে হয়তো তার প্রতিকার সম্ভব হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই দীর্ঘ 22 বছর ধরে তিনি পত্রিকার কাজ করে গেছেন।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার উপসংহার –

উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাস জানার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মির মুশারফ হোসেন ও জলধর সেন এই পত্রিকায় প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন, তারা তৎকালীন রাজনীতি ও সমাজের ভুলভ্রান্তিগুলি তুলে ধরার পাশাপাশি নীলচাষিদের উপর ব্রিটিশ ও সুদখোর মহাজনদের অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। গ্রামবাংলায় শিক্ষাবিস্তার, শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও অত্যাচারিত অসহায় কৃষককুলকে রক্ষার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল 1 পয়সামূল্যের এই পত্রিকাটি।

গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের বাংলার কী ধরনের সমাজচিত্র পাওয়া যায়?

অথবা, গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় সমকালীন বাংলার সামাজিক জীবন কীভাবে ফুটে উঠেছে?

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার ভূমিকা –

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা হল বাংলা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকা। 1863 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার, যিনি কাঙাল হরিনাথ নামেও পরিচিত ছিলেন। এটি প্রথমে মাসিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হলেও পরে পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়।

গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় তৎকালীন সমাজচিত্র –

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা থেকে সমসাময়িককালের সমাজ সম্পর্কে জানা যায়।

  • সমাজে নারীদের অবস্থা – গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা থেকে সমাজে নারীদের দুরবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। এক শ্রেণির প্রগতিশীল মানুষ নারীশিক্ষার প্রসারে সচেষ্ট ছিলেন। নারীশিক্ষার প্রসারে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
  • জমিদারি শোষণ – এই পত্রিকা গ্রাম্য প্রজাদের উপর জমিদারি শোষণের কথা প্রচার করত। তখন বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু ছিল। জমির মালিক ছিলেন জমিদার। জমির উপর প্রজার স্বত্ব বা অধিকার ছিল না। চড়া রাজস্ব, অতিরিক্ত কর, কারণে-অকারণে জমি থেকে প্রজা উচ্ছেদ করা হত। অভাগা চাষিদের দুর্দশার কাহিনি এই পত্রিকায় ছাপা হত।
  • সুদখোর মহাজনদের শোষণ – গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা থেকে জানা যায়, সমাজে সুদখোর মহাজনদের রমরমা ছিল। তারা চড়া সুদের বিনিময়ে টাকা ধার দিত। গ্রামের অনেক সাধারণ মানুষ মহাজনের কাছে ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিল।
  • নীলকর সাহেবদের অত্যাচার – ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’-য় সমাজে নীলকর সাহেবদের কর্মকাণ্ডজনিত আতঙ্কের চিত্র ধরা পড়েছে। নীলকর সাহেবরা অধিক অর্থ উপার্জনের জন্য চাষিদের দিয়ে জোর করে নীলচাষ করাত। উৎপাদিত নীল তারা চাষিদের কাছ থেকে অল্প দামে কিনে নিত। তবে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে চাষিরা যে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তাও জানা যায় এই পত্রিকা থেকে।
  • শিক্ষাপ্রসার – সেসময় নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা ছিল প্রচুর। এর মধ্যে নারীশিক্ষার হার ছিল অত্যন্ত কম, প্রায় ছিল না বললেই চলে। পত্রিকায় শিক্ষাপ্রসার বিশেষত নারীশিক্ষা প্রসারের উপর গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হয়।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার মূল্যায়ন –

এই পত্রিকাটি সুলভ মূল্যের ছিল। প্রকাশক হরিনাথ মজুমদার ‘কাঙাল হরিনাথ’ নামে পরিচিত ছিলেন। অতি দারিদ্র্যতার মধ্যেও পত্রিকা প্রকাশনার কাজ চালিয়ে যান। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলার সমাজচিত্র এই পত্রিকা থেকে পাওয়া যায়।

কাঙাল হরিনাথ নিজে কিভাবে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার প্রকাশের উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন?

কাঙাল হরিনাথ নিজে এই পত্রিকার প্রকাশের উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন এইভাবে – ‘আমি শুনিলাম, বাংলা সংবাদপত্রের অনুবাদ করিয়া গভর্নমেন্ট তাহার মর্ম অবগত হইতে সঙ্কল্প করিয়াছেন। আমার ইচ্ছা হইল, এই সময় একখানি সংবাদপত্র প্রচার করিয়া, গ্রামবাসী প্রজারা যে যেভাবে অত্যাচারিত হইতেছে, তাহা গভর্নমেন্টের কর্ণগত করিলে, অবশ্যই তাহার প্রতিকার এবং তাহাদিগের নানা প্রকার উপকার সাধিত হইবে সন্দেহ নাই।’ – এই প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পরবর্তীকালে হরিনাথের পৌত্র বিশ্বনাথ মজুমদার জানাচ্ছেন যে, ‘গ্রামের কল্যাণে দেশহিতৈষী শহরে মানুষের দৃষ্টি – আকর্ষণও এই পত্রিকার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।’

হরিনাথ মজুমদার বা কাঙাল হরিনাথ সম্পর্কে কী জান?

কাঙাল হরিনাথের ভূমিকা –

1863 খ্রিস্টাব্দের মে মাসে কাঙাল ফিকিরচাঁদ গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন। কাঙাল ফিকিরচাঁদের প্রকৃত নাম ছিল হরিনাথ মজুমদার (1833-1896 খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান সাংবাদিক, লেখক, গীতিকার ও মানবদরদি সম্পাদক।

কাঙাল হরিনাথের প্রথম জীবন –

1833 খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত নদিয়া জেলার কুমারখালিতে (বর্তমানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় অবস্থিত) হরিনাথ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ শৈশব এবং কৈশোরে তীব্র দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার সঙ্গে কঠোর সংগ্রামের পর স্বশিক্ষিত ও স্বনির্ভর এই মানুষটি বঙ্গীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক অনন্য নজির রেখে গেছেন। দারিদ্র্য ছিল তাঁর ছায়াসঙ্গী। তাই তিনি কাঙাল হরিনাথ নামে পরিচিত।

কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার আবির্ভাব –

1863 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে হরিনাথের সম্পাদনায় এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথমে গিরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে ও পরে 1873 খ্রিস্টাব্দে কুমারখালির মথুরানাথ প্রেস নামক ছাপাখানা থেকে পত্রিকা প্রকাশের কাজ চলতে থাকে। প্রথমে ‘মাসিক’ পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হলেও পরে 1868 খ্রিস্টাব্দের জুন-জুলাই মাসে এটি ‘পাক্ষিক’ ও 1871 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল-মে মাস থেকে এই পত্রিকা ‘সাপ্তাহিকে’ পরিণত হয়। এই পত্রিকায় নিয়মিত সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতির সংবাদের পাশাপাশি ব্রিটিশ, নীলকর সাহেব ও সুদখোর মহাজনদের অত্যাচার ও সমাজের অন্ধকার দিকগুলিকে তুলে ধরা হত।

কাঙাল হরিনাথের শোষণের বিরোধিতা –

কাঙাল হরিনাথ সম্পাদিত ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ছিল সমকালীন বাংলার গ্রামীণ জীবনের যথার্থ দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি। এই পত্রিকায় জমিদার, মহাজন, নীলকর সাহেব ও সরকারের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশিত হত। ফলে অত্যাচারের মাত্রা অনেকটা হ্রাস পেয়েছিল। অন্যদিকে শিক্ষিত সমাজের নজরে খবরগুলি আসাতে ব্রিটিশবিরোধী জনমত গড়ে ওঠে।

কাঙাল হরিনাথের শিক্ষার প্রসার –

এই পত্রিকায় সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, বীরত্বগাথা প্রভৃতি প্রকাশিত হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মির মোশারফ হোসেন, জলধর সেন প্রমুখের রচনা শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছিল। হরিনাথ কয়েকজন বন্ধুর সাহায্যে নিজ গ্রামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

কাঙাল হরিনাথের সাহিত্য ও সংগীত প্রতিভা –

কাঙাল হরিনাথ রচিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘বিজয়বসন্ত’, ‘চারুচরিত্র’, ‘কবিতা কৌমুদী’ প্রভৃতি। লালন ফকির তাঁর পত্রিকার জন্য লেখা পাঠাতেন। হরিনাথ মজুমদারের একটি উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় গান হল ‘হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল পার করো আমারে।’ 1880 খ্রিস্টাব্দে হরিনাথ বাউল সংগীতের দল গঠন করেন, যার নাম ছিল – ‘কাঙাল ফকিরের চাঁদের দল’।

কাঙাল হরিনাথের উপসংহার –

কাঙাল হরিনাথ 1896 খ্রিস্টাব্দের 16 এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল – ‘নদিয়া জেলাবাসী একজন মহান ব্যক্তিত্বকে হারালো।’ ভাগ্যের পরিহাস হল এই যে, হরিনাথ বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ালেও, তাঁর বিপদের দিনে তিনি সমাজের কাউকে পাশে পাননি। একমাত্র লালন ফকির ও তাঁর দল এগিয়ে এসেছিলেন। যাইহোক, গ্রামবার্তা প্রকাশিকা ছিল গ্রামীণ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, আর হরিনাথ ছিলেন গ্রামীণ সাংবাদিকতার জনক।

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিল?

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষার ভূমিকা –

উনিশ শতকে বাংলায় পাঠশালা, টোল, চতুষ্পাঠী, মক্তব ও মাদ্রাসায় সংস্কৃত, আরবি ও ফারসির মাধ্যমে শিক্ষাদান প্রচলিত ছিল। সাধারণত হিন্দু ছাত্ররা পাঠশালা ও টোলে এবং মুসলমান ছাত্ররা মক্তব ও মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করত।

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষার প্রকারভেদ –

বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে দেশীয় শিক্ষা বলতে দুই ধরনের শিক্ষাকে বোঝায়। যথা –

  • হিন্দুদের ঐতিহ্যশালী সংস্কৃত শিক্ষা এবং
  • মুসলিমদের ধর্মাশ্রয়ী আরবি ও ফারসি শিক্ষা।

উনিশ শতকের প্রথম দিকে ফারসি ভাষার মাধ্যমে সরকারি কাজকর্ম চলত। তাই অনেক হিন্দুও ফারসি ভাষা শিখত।

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান –

দেশীয় শিক্ষার জন্য কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। এইসব প্রতিষ্ঠানগুলি মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল। প্রথমত, সংস্কৃত শিক্ষার জন্য ছিল চতুষ্পাঠী ও টোল। পণ্ডিত ও অধ্যাপকরা এখানে শিক্ষাদান করতেন। দ্বিতীয়ত, আরবি ও ফারসি শিক্ষার জন্য ছিল মক্তব ও মাদ্রাসা। মৌলবি ও মৌলানা শ্রেণির পণ্ডিতেরা এখানে শিক্ষাদান করতেন।

উইলিয়ম অ্যাডাম -এর প্রতিবেদন (1835 খ্রিস্টাব্দ) থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে প্রায় 1 লক্ষ পাঠশালা ছিল এবং টোলের সংখ্যা ছিল 1800। মুসলিম অধ্যুষিত প্রতিটি গ্রামের মসজিদের পাশে মক্তব থাকত, উচ্চশিক্ষার জন্য ছিল মাদ্রাসা। বাংলার নবদ্বীপ, বিক্রমপুর সংস্কৃত শিক্ষার জন্য এবং মুরশিদাবাদ, ঢাকা ও পাটনা আরবি-ফারসি শিক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিল। 1781 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মাদ্রাসা, 1784 খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি ও 1791 খ্রিস্টাব্দে বেনারস সংস্কৃত কলেজ চালু হয়।

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা পাঠ্যক্রম –

দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম ছিল না। অক্ষর পরিচয়, লিখতে-পড়তে শেখা, হিসাবপত্র শেখা, ধর্মীয় কাহিনি, মহাকাব্যের কিছু অংশ এগুলিতে পড়ানো হত। বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল সম্বন্ধে এখানে কোনো শিক্ষা দেওয়া হত না। ছাপা বই ছিল না তখন – পুথি ও শ্রুতিনির্ভর ছিল এই শিক্ষা।

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষার মূল্যায়ন –

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষয়িষ্ণু চিত্র পাওয়া যায়। এই পটভূমিতে পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু হলে বাঙালি সমাজ তাকে স্বাগত জানায়। ফলে নবজাগরণের সূচনা হয়।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের প্রথমদিকে ভারতে কী ধরনের দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল?

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের প্রথমদিকে ভারতে দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা –

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে কোম্পানি সরকার রাজ্যবিস্তার ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণে বেশি মনোযোগী হয়েছিল, শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টি পড়েছিল অনেক পরে।

প্রারম্ভিক পর্যায়ে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রবর্তিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ –

  • ব্রিটিশরা ভারতের আগমনকালে ভারতীয়রা দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষালাভ করত। প্রাচীনকাল থেকে আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাদান চলত মক্তব, মাদ্রাসা, টোল প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে।
  • কোম্পানি সরকার দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথমদিকে কোনো হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। কারণ এর ফলে তারা এদেশীয়দের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা করেছিল। অথচ দেশের শাসক হয়ে শিক্ষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করাও ছিল অসম্ভব। তাই শুধুমাত্র দেশীয় শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য তারা সচেষ্ট হয়।
  • লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস 1781 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় মুসলমানদের অনুরোধে গড়ে তোলেন কলকাতা মাদ্রাসা। প্রধানত মুসলিম আইনকানুন এবং আরবি-ফারসি ভাষাশিক্ষা বিস্তারই ছিল কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
  • স্যার উইলিয়ম জোনসের উদ্যোগে প্রাচ্যভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি চর্চার উদ্দেশ্যে 1784 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি।
  • বেনারসে 1791 খ্রিস্টাব্দে জোনাথন ডানকান সংস্কৃত ভাষাশিক্ষার উন্নতির জন্য প্রতিষ্ঠা করেন বেনারস সংস্কৃত কলেজ।
  • এ ছাড়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের প্রাচ্যশিক্ষা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে 1800 খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। 1824 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় সংস্কৃত কলেজ।

ভারতে আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অবদান কী ছিল?

উনিশ শতকের ভারতে একটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ।

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা –

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় 1800 খ্রিস্টাব্দে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লর্ড ওয়েলেসলি।

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হল ভারতে আগত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের ভারতীয় ভাষা ও রীতিনীতি সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা।

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের আধুনিক শিক্ষায় অবদান –

ভারতে আধুনিক শিক্ষায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

  • বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়ন – ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যাপকগণ ভারতীয় সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। ফলে বাংলা গদ্য রচনায় গতি আসে।
  • পুস্তক মুদ্রণ – ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের জন্য অনেক বই ছাপানো হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মানোন্নয়ন ঘটে।
  • প্রাচ্যবিদ্যা চর্চায় – অবদান ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের উদ্যোগে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার বিকাশ ঘটেছিল। এই কলেজ এশিয়াটিক সোসাইটি পুনর্গঠনেও অর্থ সাহায্য করে।

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের উপসংহার –

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ ব্রিটিশ শাসনের সুবিধার্থে যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। এই কলেজের উদ্যোগে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতি হয়েছিল।

ব্রিটিশ সরকার কেন ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগ নেয়?

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের প্রথম দিকে সরকার ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নেয়নি। ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন কারণে উনিশ শতকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগী হয়।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী হওয়ার কারণ –

  • কর্মচারীর প্রয়োজনীয়তা – ভারতে ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবিস্তার ও কাজের ক্ষেত্র বৃদ্ধি পাওয়ায় ইংরেজি জানা কর্মচারীর প্রয়োজন হয়েছিল। এই চাহিদা পূরণের জন্য সরকার পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটায়।
  • সস্তায় শিক্ষিত কর্মচারী নিয়োগ – ব্রিটিশ সরকার ভারতে সস্তায় শিক্ষিত কর্মচারী পাওয়ার জন্য এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিল।
  • ব্রিটিশ সমর্থক শ্রেণি সৃষ্টি – ব্রিটিশরা মনে করেছিল ভারতীয়রা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তারা ব্রিটিশ সরকারের সমর্থক শ্রেণিতে পরিণত হবে। তারা গাত্রবর্ণে ভারতীয় হলেও মানসিকতায় হবে ইংরেজ।
  • ভারতীয়দের উন্নয়ন – অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তি, খ্রিস্টান মিশনারি উন্নত আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করার পক্ষপাতী ছিলেন। ভারতীয় সমাজের প্রচলিত কুসংস্কারে তারা মর্মাহত হয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

প্রাচ্যপন্থী ও পাশ্চাত্যপন্থী কারা?

প্রাচ্যপন্থী ও পাশ্চাত্যপন্থীর ভূমিকা –

বাংলা তথা ভারতে চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। আবার বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য বাংলায় বিশেষত কলকাতায় বেশ কিছু ইংরেজি শিক্ষার স্কুল গড়ে ওঠে। এই দেশীয় ও ইংরেজি শিক্ষার সমর্থকরা দুটি দলে ভাগ হয়ে যান। যথা – প্রাচ্যপন্থী ও পাশ্চাত্যপন্থী।

প্রাচ্যপন্থী ও পাশ্চাত্যপন্থী কারা?

প্রাচ্যপন্থী –

ভারতে যে চিরাচরিত শিক্ষা প্রচলিত ছিল, তা দেশীয় শিক্ষা বা প্রাচ্য শিক্ষা নামেও পরিচিত। এই শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষা।

  • পাঠশালা, চতুষ্পাঠী ও টোলে সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হত। পণ্ডিত ও অধ্যাপকরা এইসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন। প্রায় প্রতি গ্রামেই পাঠশালা ছিল। বাংলাদেশে প্রায় 1400 টোলের কথা জানা যায়। এর মধ্যে নবদ্বীপ ও বিক্রমপুর ছিল বিখ্যাত সংস্কৃত শিক্ষাকেন্দ্র।
  • মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে আরবি ও ফারসি ভাষাশিক্ষার চল ছিল। গ্রামের মসজিদের পাশে মক্তব থাকত। সেখানে মৌলবিরা আরবি ও ফারসি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা দিতেন। উচ্চশিক্ষার জন্য মাদ্রাসা ছিল। ঢাকা, মুরশিদাবাদ, পাটনা আরবি ও ফারসি শিক্ষার কেন্দ্র ছিল। এই দেশীয় শিক্ষার সমর্থকরা প্রাচ্যপন্থী (Orientalist) নামে পরিচিত ছিলেন। এদের নেতা ছিলেন এইচ টি প্রিন্সেপ।

পাশ্চাত্যপন্থী –

কলকাতাকেন্দ্রিক কয়েকটি ইংরেজি স্কুলে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ও গণিতশিক্ষা দেওয়া হত। এই শিক্ষাকে পাশ্চাত্য শিক্ষা বলা হত। এই শিক্ষার সমর্থকরা পরিচিত ছিলেন পাশ্চাত্যপন্থী (Anglicists) নামে। ট্রেভেলিয়ান, মেকলে এদের নেতা ছিলেন।

প্রাচ্যপন্থী ও পাশ্চাত্যপন্থীর মূল্যায়ন –

1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে কোম্পানিকে এদেশে জনশিক্ষার জন্য বার্ষিক 1 লক্ষ টাকা ব্যয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই টাকা পাওয়ার জন্য শিক্ষাবিদরা দুটি দলে বিভক্ত হন। দেশীয় শিক্ষার সমর্থকরা প্রাচ্যপন্থী ও ইংরেজি শিক্ষার সমর্থকরা পাশ্চাত্যপন্থী নামে পরিচিত হন।

মেকলে মিনিট সম্পর্কে আলোচনা করো।

মেকলে মিনিটের ভূমিকা –

থমাস ব্যাবিংটন মেকলে ছিলেন লর্ড উইলিয়ম বেন্টিষ্কের আইনসচিব ও জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি। তাঁর শিক্ষাসংক্রান্ত প্রতিবেদন মেকলে মিনিট নামে পরিচিত।

মেকলে মিনিটের প্রেক্ষাপট –

1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে বলা হয় কোম্পানি ভারতের শিক্ষাখাতে কমপক্ষে 1 লক্ষ টাকা ব্যয় করবে। এ বিষয়ে নীতি নির্ধারণের জন্য জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন গঠিত হয়। জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন বা জনশিক্ষা কমিটি সরকারি অর্থ ব্যয় করা বিষয়ে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী নামে দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়।

মেকলে মিনিট –

জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সভাপতি থমাস ব্যাবিংটন মেকলে পাশ্চাত্য শিক্ষার সপক্ষে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। মেকলের এই বিখ্যাত প্রতিবেদন ‘মেকলে মিনিট’ নামে পরিচিত (1853 খ্রিস্টাব্দ)।

মেকলে মিনিটের বক্তব্য –

মেকলে মিনিটের প্রধান প্রধান বক্তব্যগুলি হল –

  • পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রাচ্যের তুলনায় উৎকৃষ্ট।
  • এ দেশের সমাজ ও সভ্যতা কুসংস্কারচ্ছন্ন ও দুর্নীতিগ্রস্ত, তাই এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু হওয়া উচিত।
  • এদেশে উচ্চশ্রেণির লোকেরা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষিত হবে। পরে তারা তাদের নীচুতলায় তার বিস্তার ঘটাবে। একেই শিক্ষার চুঁইয়ে পড়া নীতি (Downward Filtration Theory) বলা হয়।

মেকলে মিনিটের ফলাফল –

মেকলে মিনিটের ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের সপক্ষে 1853 খ্রিস্টাব্দে সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিওরি (Downward Filtration Theory) – টীকা লেখো।

ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিওরির ভূমিকা –

উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হল ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিওরি বা শিক্ষার চুঁইয়ে পড়া নীতি। জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি থমাস ব্যাবিংটন মেকলে এই তত্ত্বের কথা বলেছিলেন।

ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিওরির পটভূমি –

  • 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতীয় শিক্ষাখাতে 1 লক্ষ টাকা ব্যয় করার কথা বলা হয়। এই টাকা প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য-কোন্ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা হবে তা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়।
  • এই বিরোধের নিষ্পত্তির জন্য জনশিক্ষা কমিটি গঠিত হয়। থমাস ব্যাবিংটন মেকলে জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি হয়ে এই বিরোধের মীমাংসা করেন। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষাখাতে সরকারি অর্থ ব্যয় করার কথা বলেন।

ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিওরি –

মেকলে বলেন যে,উচ্চবর্গের কিছু মানুষ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তা ধীরে ধীরে সমাজের নীচের স্তরে চুঁইয়ে পড়বে। ফলে তারা শিক্ষিত হবে। একইভাবে তারা আবার তার নীচের অংশের মানুষকে শিক্ষিত করবে। পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের এই তত্ত্বই ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিওরি নামে পরিচিত।

ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিওরি তত্ত্বের গুরুত্ব –

ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন তত্ত্বের গুরুত্ব হল –

  • কম খরচে শিক্ষা – এই তত্ত্বের ফলে কম খরচে শিক্ষার প্রসার ঘটানো যাবে।
  • অধিকাংশ মানুষের মধ্যে প্রসার – সমাজের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে।

ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিওরির উপসংহার –

বাস্তবে ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিওরি কার্যকর হয়নি। বরং সমাজে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে ব্যবধানকে আরও প্রকট করে তুলেছিল।

চার্লস উডের প্রতিবেদন – টীকা লেখো।

বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের জন্য 1854 খ্রিস্টাব্দের 19 জুলাই একটি নির্দেশনামা প্রকাশ করেন। এই নির্দেশনামা চার্লস উডের প্রতিবেদন (Wood’s Despatch) নামে খ্যাত।

চার্লস উডের সুপারিশ –

উডের নির্দেশনামা বা প্রতিবেদনের সুপারিশগুলি হল –

  • শিক্ষার প্রসারের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাবিভাগ গঠন করা।
  • কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।
  • সুদক্ষ শিক্ষক তৈরির জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ স্থাপন করা।
  • দেশীয় ভাষার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষা প্রদান করা।
  • নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো।

চার্লস উডের সুপারিশের ফলাফল –

চার্লস উডের নির্দেশনামার ফলে –

  • 1855 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড ডালহৌসি বাংলা, বোম্বাই, পাঞ্জাব প্রভৃতি প্রদেশে শিক্ষাদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

পরিশেষে বলা যায়, ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ইতিহাসে উডের প্রতিবেদনের ফলে 1882 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সারা ভারতে সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা হয় 1363টি, যা 1854 খ্রিস্টাব্দে ছিল মাত্র 169টি। এই সময়ে বেসরকারি উদ্যোগেও বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

খ্রিস্টাব্দসরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা
1854169
18821363

চার্লস উডের প্রতিবেদনের গুরুত্ব –

এ পর্যন্ত ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার গতি ছিল অত্যন্ত ধীর। উডের রিপোর্টের ফলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বহু স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এইজন্য উড -এর নির্দেশনামাকে শিক্ষার মহাসনদ বা ম্যাগনাকার্টা বলা হয়।

হান্টার কমিশন – টীকা লেখো।

অথবা, হান্টার কমিশনের সুপারিশগুলি উল্লেখ করো।

1882 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড রিপন শিক্ষাবিদ স্যার উইলিয়ম হান্টারের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন হান্টার কমিশন নামে পরিচিত।

হান্টার কমিশনের উদ্দেশ্য –

হান্টার কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য ছিল –

  • চার্লস উডের শিক্ষাসংক্রান্ত নির্দেশনামা কতটা কার্যকর হয়েছে তা খতিয়ে দেখা এবং
  • পরবর্তী পর্যায়ের শিক্ষাবিস্তার সম্পর্কে সুপারিশ করা।

হান্টার কমিশনের সুপারিশ –

স্যার উইলিয়ম হান্টার সারা দেশে অনুসন্ধান করে প্রচুর তথ্যসংগ্রহের পর 1883 খ্রিস্টাব্দে তাঁর সুচিন্তিত সুপারিশ পেশ করেন। হান্টার কমিশনের সুপারিশগুলি হল –

  • প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব জেলাবোর্ড ও পৌরসভাগুলির হাতে অর্পণ করা।
  • সরকারি সাহায্যে প্রতিটি বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার (লাইব্রেরি) প্রতিষ্ঠা করা।
  • মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তিপ্রদান করা।
  • শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণের অবসান ও পরিচালনার ভার বেসরকারি সংস্থার হাতে অর্পণ করা।
  • বেসরকারি বিদ্যালয়গুলির অবস্থার উন্নতির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান প্রদান করা।
  • নারীশিক্ষার প্রতি উৎসাহ দান করা প্রভৃতি।

হান্টার কমিশনের ফলাফল –

  • হান্টার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে বড়োলাট লর্ড রিপন প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব পৌরসভা ও স্থানীয় বোর্ডের হাতে ছেড়ে দেন।
  • মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোগ উৎসাহিত হয়। এর ফলে 1883 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1902 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভূত উন্নতি ঘটে।
খ্রিস্টাব্দবিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যাখ্রিস্টাব্দকলেজের সংখ্যা
18822,14,000 জন188272টি
19025,90,000 জন1902191টি

কলেজের ছাত্রসংখ্যা ছিল 23,000 জন।

বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে মিশনারিদের অবদান লেখো।

বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে মিশনারিদের ভূমিকা –

বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হলেও কোম্পানি সরকার এদেশীয় সংস্কৃতিতে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। তাই তারা পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে খুব বেশি উৎসাহ দেখায়নি। কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতিক্রিয়ায় এদেশে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ ঘটতে পারে। স্বাধীনতার দাবি উঠতে পারে। ফলস্বরূপ প্রথম দিকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগত মিশনারিদের উদ্যোগেই এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ঘটে।

বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে চার্লস গ্রান্টের প্রস্তাব –

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী চার্লস গ্রান্ট ‘অবজারভেশন’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন (1792 খ্রিস্টাব্দ)। এই পুস্তিকায় তিনি এদেশে সুসংবদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার কথা বলেন। কোম্পানি তা গ্রাহ্য করেনি।

বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে মিশনারিদের উদ্যোগ –

এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে খ্রিস্টান মিশনারিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এক্ষেত্রে কয়েকটি মিশন অগ্রণী ছিল। যথা –

  • ব্যাপটিস্ট মিশন – 1800 খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে মার্শম্যান, কেরি ও ওয়ার্ড ‘ব্যাপটিস্ট মিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য তাঁরা শ্রীরামপুরে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে 26টি আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল প্রকাশ করেন। তাঁরা দিগদর্শন ও সমাচার দর্পণ পত্রিকা প্রকাশ এবং শ্রীরামপুর বিদ্যালয়, শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন 1818 খ্রিস্টাব্দে। তাঁদের চেষ্টায় মোট 126টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়গুলিতে প্রায় 10,000 জন ছাত্র পড়াশোনা করত।
  • লন্ডন মিশনারি সোসাইটি – এই মিশনারিরা কলকাতা ও বাংলার বিভিন্ন জেলায় বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে চুঁচুড়া, কালনা, বর্ধমান, বহরমপুর, মালদহতে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলি উল্লেখযোগ্য ছিল।
  • স্কটিশ মিশন – আলেকজান্ডার ডাফ -এর স্কটিশ মিশন বাংলাদেশে কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। এগুলি ডাফ স্কুল নামে পরিচিত হয়। এর মধ্যে কলকাতা জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন বিশেষ উল্লেখযোগ্য (1830 খ্রিস্টাব্দে)। এ ছাড়া রবার্ট সে-র উদ্যোগে কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি, মিস কুক, মেরি কার্পেন্টার, লুইস -এর উদ্যোগেও নারীশিক্ষার বিকাশ হয়।
বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে মিশনারিদের অবদান লেখো।

বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে মিশনারিদের মূল্যায়ন –

এভাবে সরকারি সাহায্য ছাড়া মিশনারিরা নিজেদের উদ্যোগে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ঘটায়। খ্রিস্টধর্ম প্রচার তাদের লক্ষ্য ছিল। তাই তাদের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলিতে খ্রিস্টধর্ম সংক্রান্ত শিক্ষা দেওয়া হত। কিন্তু তা ছাড়াও পড়ানো হত ইতিহাস, ভূগোল, ব্যাকরণ ইত্যাদি। এর ফলে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে এদেশীয়রা জানতে পারে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটে।

আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে শ্রীরামপুর ত্রয়ীর অবদান কী ছিল?

শ্রীরামপুর ত্রয়ীর ভূমিকা –

উনিশ শতকের শিক্ষার ইতিহাসে শ্রীরামপুর ত্রয়ীর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা বাংলার শ্রীরামপুর মিশন থেকে শিক্ষাবিস্তারের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন।

শ্রীরামপুর ত্রয়ী –

শ্রীরামপুর ত্রয়ী বলা হয় যে তিন জন খ্রিস্টান মিশনারিদের, তাঁরা হলেন – উইলিয়ম কেরি, মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ড। তাঁরা 1800 খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ‘ব্যাপটিস্ট মিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন।

শ্রীরামপুর ত্রয়ীর অবদান –

শ্রীরামপুর মিশনারিরা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা, দিগদর্শন ও সমাচার দর্পণ পত্রিকা প্রকাশ 26টি আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল অনুবাদ এবং বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

  • ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা – 1800 খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশনারিরা একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
  • পুস্তক ও পত্রিকা প্রকাশ – শ্রীরামপুর ত্রয়ীর উদ্যোগে ‘বাংলা ব্যাকরণ’, ‘অভিধান’, ‘ইতিহাস মালা’ -সহ নানা ধরনের পুস্তক প্রকাশিত হয়। তাঁরা ‘দিগদর্শন’ ও ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।
  • স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা – শ্রীরামপুর মিশনারিরা শ্রীরামপুরে একটি বিদ্যালয় ও শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের চেষ্টায় 126টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

শ্রীরামপুর ত্রয়ীর উপসংহার –

ভারতে আধুনিক শিক্ষা তথা ছাপাখানা ও পত্রিকা প্রকাশের ইতিহাসে শ্রীরামপুর ত্রয়ীর অবদান অবিস্মরণীয়।

বাংলায় তথা ভারতে ইংরেজ কোম্পানির আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে খ্রিস্টান মিশনারি ও প্রগতিশীল ব্যক্তিদের ভূমিকা উল্লেখ করো।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে শাসন প্রতিষ্ঠার সূচনায় রাজ্যবিস্তার ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণে বেশি মনোযোগী হয়েছিল। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টি পড়েছিল বিলম্বে। ভারতে সরকারিভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হয় বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে 1835 খ্রিস্টাব্দে।

উনিশ শতকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা –

ভারতে সরকারি প্রচেষ্টায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনের পূর্বে বেসরকারি উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষার ভিত্তি রচিত হয়। এর দুটি ধারা ছিল –

  • খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টা ও
  • প্রগতিশীল ভারতীয় ও বিদেশিদের প্রচেষ্টা।

খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টা –

খ্রিস্টান মিশনারিগণ পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

  • ব্যাপটিস্ট মিশনারি উইলিয়ম কেরি, মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ড (শ্রীরামপুর ত্রয়ী) 1818 খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
  • বিশপ মিডলটন 1820 খ্রিস্টাব্দে শিবপুরে বিশপস কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
  • স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফ 1830 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন, যা বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ নামে পরিচিত।
  • তা ছাড়া বোম্বাই -এর উইলসন কলেজ (1832 খ্রিস্টাব্দ), মাদ্রাজের খ্রিস্টান কলেজ (1837 খ্রিস্টাব্দ) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
বাংলায় তথা ভারতে ইংরেজ কোম্পানির আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে খ্রিস্টান মিশনারি ও প্রগতিশীল ব্যক্তিদের ভূমিকা উল্লেখ করো।

প্রগতিশীল ভারতীয় ও বিদেশিদের প্রচেষ্টা –

প্রগতিশীল ভারতীয় ও বিদেশিরা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

  • 1815 খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় কলকাতার শুঁড়িপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি ইংরেজি স্কুল।
  • 1817 খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ার, স্যার হাইড ইস্ট, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের প্রচেষ্টায় কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, বর্তমানে যেটি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত।
  • ইংরেজি ভাষায় ভালো পাঠ্যবই রচনার জন্য ডেভিড হেয়ার 1817 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি এবং ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে 1818 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রাধাকান্ত দেব -এর ভূমিকা আলোচনা করো।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রাধাকান্ত দেব -এর ভূমিকা –

রাজা রাধাকান্ত দেব ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ও হিন্দুসমাজের একজন বিশিষ্ট রক্ষণশীল নেতা। রাধাকান্ত দেব একদিকে ছিলেন হিন্দুসমাজের রক্ষণশীলতার প্রতীক, অপরদিকে তিনি ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সমর্থক। আসলে তিনি চেয়েছিলেন “প্রাচ্যবাদী শিক্ষার কাঠামোর মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ”।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রাধাকান্ত দেব -এর ভূমিকা আলোচনা করো।

হিন্দু কলেজ পরিচালনায় সহযোগিতা –

শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে রাধাকান্ত দেব খুবই প্রগতিশীল ও আন্তরিক ছিলেন। 1817 খ্রিস্টাব্দে স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট ও ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাধাকান্ত দেব এই হিন্দু কলেজের পরিচালনা ও ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নেন। তিনি হিন্দু কলেজের পরিচালন সমিতির সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন (1818-1850 খ্রিস্টাব্দ)।

ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি ও ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটির সঙ্গে সহযোগিতা –

1817 খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে ভালো স্কুল পাঠ্যবই তৈরি করার জন্য ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হলে রাধাকান্ত দেব তার অবৈতনিক সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। 1818 খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তাতেও যুক্ত হন।

ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে গোঁড়া হিন্দুদের সন্দেহ ছিল। কিন্তু রাধাকান্ত দেব এর সঙ্গে যুক্ত থাকায় রক্ষণশীল হিন্দুরাও এখান থেকে বই কিনত।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রাধাকান্ত দেব -এর নারীশিক্ষা প্রসারে প্রচেষ্টা –

নারীশিক্ষা প্রসারে রাধাকান্ত দেব আন্তরিকভাবে আগ্রহী ছিলেন।

  • 1812 খ্রিস্টাব্দে ‘স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক’ নামে একটি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। এতে তিনি প্রমাণ করেন যে, নারীশিক্ষা হিন্দু আদর্শ ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী নয়। প্রাচীন ভারতেও হিন্দু নারীরা শিক্ষালাভ করত।
  • তিনি তাঁর পরিবারের মহিলাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইংরেজ শিক্ষিকা নিযুক্ত করেন।
  • 1819 খ্রিস্টাব্দে ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ স্থাপিত হয়। এই স্কুলের ছাত্রীদের নিয়মিত পরীক্ষা দেওয়ার জন্য রাধাকান্ত দেব নিজের বাড়িতে ব্যবস্থা করেছিলেন।
  • তিনি প্রতি বছর তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিজ ভবনে সমবেত করে পুরস্কার দিতেন।

পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় ভূমিকা –

আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যাচর্চার প্রয়োজনে শবব্যবচ্ছেদ আবশ্যিক ছিল। প্রচলিত হিন্দু সমাজ ছিল শবব্যবচ্ছেদের বিরোধী। রাজা রাধাকান্ত দেব কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের হিন্দু ছাত্রদের শবব্যবচ্ছেদের বিষয়ে সমর্থন করেছিলেন।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রাধাকান্ত দেব -এর মূল্যায়ন –

রাধাকান্ত দেব পাশ্চাত্য শিক্ষার বিরোধী ছিলেন না। তবে তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা বা ভারতীয়দের অন্ধভাবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি অনুকরণ করার ঘোর বিরোধী ছিলেন। বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের ফলে সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে যুক্তিবাদী ও উদারনৈতিক ভাবধারা সৃষ্টি হয়েছিল রাধাকান্ত দেব তার কিছুটা কৃতিত্ব অবশ্যই দাবি করতে পারেন।

ডেভিড হেয়ার কেন বিখ্যাত?

অথবা, পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে ডেভিড হেয়ারের ভূমিকা –

ডেভিড হেয়ার ছিলেন স্কটল্যান্ডের অধিবাসী ও একজন জনদরদি মানুষ। তিনি ঘড়ি ব্যবসায়ী হিসেবে ভারতে আসেন। কিন্তু বাংলার মানুষকে তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে, আর দেশে ফিরে যাননি। বাংলার মানুষের কল্যাণের জন্য ও তাদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন।

পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারে ডেভিড হেয়ারের অবদান –

হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা –

ভারতে ডেভিড হেয়ারের প্রথম উল্লেখযোগ্য অবদান হল 1817 খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করা। ডেভিড হেয়ার স্থানীয় জনগণকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা চিন্তা করেন। এ বিষয়ে তিনি কলকাতা সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হাইড ইস্টের সমর্থন আদায় করেন। রাজা রামমোহন রায় ও রাধাকান্ত দেব তাঁকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন। সকলের সহযোগিতায় ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগ সফল হয় এবং 1817 খ্রিস্টাব্দের 20 জানুয়ারি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

ডেভিড হেয়ার কেন বিখ্যাত?

ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা –

1817 খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ার কলকাতায় ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।

ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –
  • ভালো পাঠ্যবই প্রকাশ – বেসরকারি উদ্যোগে অনেক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু ভালো পাঠ্যবই ছিল না। ডেভিড হেয়ার ইংরেজি ও ভারতীয় ভাষায় ভালো পাঠ্যবই প্রকাশ করে এই অভাব দূর করতে চেয়েছিলেন।
  • শিক্ষার প্রসার ঘটানো – ডেভিড হেয়ার অল্প দামে আবার কখনও বিনামূল্যে বই দিয়েছিলেন। আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পাঠ্যবই প্রকাশ করে শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা –

ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে 1818 খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল –

  • কলকাতায় যেসব স্কুল ছিল সেগুলির উন্নতি করা।
  • বিভিন্ন জায়গায় নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে ডেভিড হেয়ারের অন্যান্য অবদান –

  • ডেভিড হেয়ার নারীশিক্ষার বিস্তারে সচেষ্ট ছিলেন।
  • তিনি বিভিন্ন স্কুল ও জ্ঞানচর্চামূলক প্রতিষ্ঠানে প্রচুর অর্থসাহায্য করেন।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে ডেভিড হেয়ারের মূল্যায়ন –

আধুনিক শিক্ষার প্রসারে অসামান্য অবদানের জন্য ডেভিড হেয়ার চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর অবদানের প্রতি সম্মান জানিয়ে অনেক স্কুল ও রাস্তার নামকরণ তাঁর নামে করা হয়েছে, যেমন – হেয়ার স্কুল, হেয়ার স্ট্রিট প্রভৃতি।

উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিংকওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন?

নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিংকওয়াটার বেথুনের ভূমিকা –

জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন ছিলেন একজন ভারতপ্রেমী ব্রিটিশ কর্মচারী। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের জন্য স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় অর্থাৎ বর্তমান বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বাংলার নারীজাগরণের সূত্রপাত করেন। বেথুন কলেজ হল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কলেজ। জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন ‘বেথুন সাহেব’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছেন।

নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিংকওয়াটার বেথুনের স্কুল প্রতিষ্ঠা –

ভারতবর্ষের নারীদের দুঃখ, দুর্দশা ও শিক্ষা সম্পর্কে বেথুন পরিচিত ছিলেন। এই সময় এদেশে নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও রামগোপাল ঘোষ বেথুনকে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সবরকমভাবে সহযোগিতা করেন। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় মির্জাপুরে তাঁর একটি বাড়ি বিদ্যালয়ের জন্য দিতে রাজি হন। 1849 খ্রিস্টাব্দের 7 মে বেথুনের প্রচেষ্টায় একটি বালিকা বিদ্যালয় (হিন্দু ফিমেল স্কুল, পরবর্তীকালের বেথুন স্কুল) প্রতিষ্ঠিত হয়। বেথুন তাঁর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এই স্কুলের জন্য দান করেন।

নারীশিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের যোগদান –

বেথুনের বিদ্যালয়ের খ্যাতি ও মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায় বিদ্যাসাগর তাঁর স্কুলে যোগ দেওয়ার পরে। বেথুনের অনুরোধে বিদ্যাসাগর 1850 খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটির সেক্রেটারি হন।

সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীদের শিক্ষা –

বেথুনের বিদ্যালয়ে রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তি যুক্ত থাকায় এখানে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা শিক্ষালাভের জন্য আসত। অভিভাবকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি ছাত্রীদের ভরতির ব্যবস্থা দেখাশোনা করত।

নারীশিক্ষা বিস্তারের উপসংহার –

1851 খ্রিস্টাব্দের 12 আগস্ট কলকাতায় বেথুন সাহেবের মৃত্যু হয়। তিনি তাঁর বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি, আজকের দিনটিতে একটি বিপ্লবের সূচনা করতে যাচ্ছি…. আমরা সফল হয়েছি এবং আজকে যে আদর্শের বীজ রোপিত হল তা আর কোনোদিন বিফল হবে না।” তাঁর এই বাণী চিরসত্য হয়ে আছে ও থাকবে।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সুফলগুলি আলোচনা করো।

উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাবে ভারতে শিক্ষা, সমাজ, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে গতিশীলতা ও সৃজনশীল উদ্যম পরিলক্ষিত হয়, তাকে ভারতীয় রেনেসাঁ বলে অভিহিত করা হয়।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সুফল –

  • নবযুগের সূচনা – পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ফলে ভারতে নবযুগের সূচনা হয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আলোকপ্রাপ্ত ভারতবাসী আধুনিকতার পথে পা বাড়িয়েছিল। তারা রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিল। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে এক নবচেতনার এবং ভারতে নবযুগের সূচনা হয়েছিল।
  • ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশ – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটেছিল। জাতীয়তাবাদ ও উদারনৈতিক আদর্শে উদ্দীপ্ত ভারতীয়রা নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। আসলে ভারতীয় এবং ইংরেজদের স্বার্থের সংঘাতই জাতীয়তাবাদের উন্মেষের মূল কারণ ছিল।
  • ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির উদ্ভব – পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের ফলে ভারতে ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল। ভারতীয়দের এক অংশ চাকরিলাভের জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। তা ছাড়া অনেকে ইংরেজি শিখে উকিল, ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিকতার পেশায় নিযুক্ত হয়েছিল। ব্যাবসাবাণিজ্যের সুবিধার জন্য ব্যবসায়ীরাও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। বাংলায় ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির মধ্যে ছিল শিক্ষিত চাকরিজীবী, উকিল, ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, ব্যবসায়ী প্রভৃতি পেশার লোকেরা।
  • সমাজসংস্কার আন্দোলন – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে ভারতে সমাজসংস্কার আন্দোলন হয়েছিল। শিক্ষিত সম্প্রদায় ভারতের চিরাচরিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। সমাজ সংস্কারকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও প্রমুখ। এঁরা ভারতীয় সমাজ থেকে সতীদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা দূর করতে এবং বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষা প্রভৃতির প্রসারের জন্য আন্দোলন করেছিলেন।

হিন্দু ফিমেল স্কুল (Hindu Female School) নামে কী স্কুল শুরু হয়? হিন্দু ফিমেল স্কুলের এই ঐতিহাসিক কার্যক্রম শুরু হয় কত খ্রিস্টাব্দে?

হিন্দু ফিমেল স্কুল (Hindu Female School) নামে বেথুন স্কুল শুরু হয়। হিন্দু ফিমেল স্কুলের এই ঐতিহাসিক কার্যক্রম শুরু হয় 1849 খ্রিস্টাব্দের 7 মে সকাল 7 টায়।

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য শিক্ষার ত্রুটিগুলি উল্লেখ করো।

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য শিক্ষার ভূমিকা –

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন হয় তার ফলে সমাজের অগ্রগতি ঘটে। তবে এই শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটিও লক্ষ করা যায়।

পাশ্চাত্য শিক্ষার ত্রুটিসমূহ –

  • ভাষা সমস্যা – ব্রিটিশ আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজি। সাধারণ বাংলাভাষী ছেলেমেয়েদের পক্ষে এই শিক্ষা গ্রহণ করা সহজ ছিল না।
  • উচ্চবর্গের শিক্ষা – পাশ্চাত্য শিক্ষা ছিল সমাজের উচ্চবর্গের মানুষের শিক্ষা। ধনী ও মধ্যবিত্তশ্রেণি এই শিক্ষাগ্রহণে সমর্থ হলেও সমাজের সাধারণ মানুষ ছিল নিরক্ষর।
  • শহরকেন্দ্রিক শিক্ষা – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ছিল শহরকেন্দ্রিক। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে এই শিক্ষার প্রসার ঘটেনি।
  • নারীশিক্ষায় অবহেলা – ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে নারীশিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে সমাজের নারীরা শিক্ষালাভ থেকে বাইরে থেকে গিয়েছিল।

পাশ্চাত্য শিক্ষার উপসংহার –

বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন ত্রুটি থাকলেও পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে এই ত্রুটিগুলি সংশোধন করার প্রচেষ্টাও শুরু হয়েছিল।

উনিশ শতকের বাংলাদেশে নারীশিক্ষা বিস্তারের পথে বাধাগুলি কী ছিল?

উনিশ শতকের বাংলাদেশে নারীশিক্ষা বিস্তারের ভূমিকা –

প্রাচীন ও মধ্যযুগে কয়েকজন বিদুষী নারীর নাম পাওয়া গেলেও নারীশিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান কোনো যুগেই গড়ে ওঠেনি। আধুনিক যুগে অর্থাৎ উনিশ শতকেও একই চিত্র বজায় ছিল। বস্তুত নারীশিক্ষার পথে বিভিন্ন বাধা ছিল।

উনিশ শতকের বাংলাদেশে নারীশিক্ষা বিস্তারের বাধাসমূহ –

উনিশ শতকের বাংলায় নারীশিক্ষার পথে বাধাগুলি হল –

  • অভাব – অভাব, অনটন ছিল নারীশিক্ষা তথা শিক্ষাবিস্তারের পথে প্রধান বাধা। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ ছিল কৃষিজীবী। প্রকৃতিনির্ভর কৃষি উৎপাদন অনিশ্চিত ছিল। খাদ্যের জোগান এবং ভূমিরাজস্ব দিতে তারা নিঃস্ব হয়ে যেত। নারীশিক্ষা তাদের কাছে ছিল কল্পনাতীত।
  • সামাজিক বাধা – এ সময়ে সমাজে কুসংস্কার ছিল প্রবল। জনগণের মধ্যে ধারণা ছিল, নারীরা লেখাপড়া শিখলে অকালে বিধবা হবে। এই কুসংস্কারের জন্য নারীশিক্ষা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
  • বাল্যবিবাহ – বাল্যবিবাহ নারীশিক্ষার পথে অপর একটি প্রধান বাধা ছিল। সেসময় মাত্র 9 বছর বয়সে নারীদের বিবাহ দেওয়া হত। শাস্ত্রের বিধান ছিল, এই বয়সে বিবাহ হলে পূর্বপুরুষদের স্বর্গবাস অক্ষয় হবে।
  • প্রতিষ্ঠান ও উপকরণের অভাব – উনিশ শতকের বাংলায় বেশিরভাগ মানুষ অভাবী হলেও কিছু মানুষ সচ্ছল ছিল। নারীশিক্ষার উপযোগী সামর্থ্যও ছিল তাদের। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, পাঠ্যবই প্রভৃতির অভাবও একটি বড়ো কারণ ছিল।

উনিশ শতকের বাংলাদেশে নারীশিক্ষা বিস্তারের মূল্যায়ন –

ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ সময় দু-একজন নারী শিক্ষালাভ করলেও সাধারণভাবে সমগ্র নারীসমাজ মূলত শিক্ষার আলোর বাইরে থেকে গিয়েছিল।

উনিশ শতকের বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে ইউরোপীয় উদ্যোগের বিবরণ দাও।

নারীশিক্ষা বিস্তারে ইউরোপীয় উদ্যোগের ভূমিকা –

অষ্টাদশ শতক ছিল ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক অন্ধকার যুগ। উনবিংশ শতকে সেই অন্ধকার যুগের অবসান ঘটে। এই সময় থেকে ইউরোপীয় উদ্যোগে নারীশিক্ষার সূচনা হয় এবং প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় আলোড়ন ঘটে।

নারীশিক্ষা বিস্তারে ইউরোপীয় উদ্যোগের মানবতাবাদী আদর্শ –

ইংল্যান্ডের বিভিন্ন মনীষীদের রচনা ব্রিটিশ জনমতকে প্রভাবিত করেছিল। এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন জেমস মিল, বেন্থাম প্রমুখ। সর্বাধিক মানুষের মঙ্গল কামনা বা উপযোগবাদ এসময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁরা পরাধীন ভারতে খ্রিস্ট্রীয়ধর্মের আলোকে শিক্ষাবিস্তারের পক্ষপাতী ছিলেন। বাংলাদেশে নারীশিক্ষা বিস্তারে ইউরোপীয় উদ্যোগ ছিল তারই ফলশ্রুতি।

নারীশিক্ষা বিস্তারে মিশনারিদের উদ্যোগ –

বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে প্রথম উদ্যোগী হন খ্রিস্টান মিশনারিরা। তারা এদেশে নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তা হল –

  • ক্যালকাটা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি – ইংল্যান্ডের মিশনারিরা 1819 খ্রিস্টাব্দে এই সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এদেশীয় বালিকাদের শিক্ষাদান তাদের উদ্দেশ্য ছিল। তারা 6 বছরে 6টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়গুলিতে মোট ছাত্রীসংখ্যা ছিল প্রায় 160 জন। সামাজিক কারণে তথাকথিত ভদ্র বালিকারা এই বিদ্যালয়ে ভরতি হয়নি। সমাজের তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণির বালিকারা এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল।
  • ফরেন স্কুল সোসাইটি – ইংল্যান্ডের এই সমিতি এদেশে নারীশিক্ষায় উদ্যোগী হয়। তারা এজন্য কলকাতা স্কুল সোসাইটির সহযোগিতা গ্রহণ করে। তারা ইংল্যান্ডে চাঁদা তুলে মিস কুক নামে একজন শিক্ষিকাকে কলকাতায় পাঠায়। মিস কুকের চেষ্টায় 30টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ছাত্রীসংখ্যা ছিল প্রায় 685 জন।

নারীশিক্ষা বিস্তারে ব্যক্তিগত উদ্যোগ –

ড্রিংকওয়াটার বেথুন নারীশিক্ষার উদ্দেশ্যে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন (1849 খ্রিস্টাব্দ)। মেরি কার্পেন্টার শিক্ষিকা তৈরির জন্য ফিমেল নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন (1868 খ্রিস্টাব্দ)। মিস ব্রিটন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বালিকাদের শিক্ষা দিতেন। লুইস ও রবসন-পত্নী একইভাবে নারীশিক্ষা বিস্তারে সচেষ্ট ছিলেন।

নারীশিক্ষা বিস্তারে ইউরোপীয় উদ্যোগের মূল্যায়ন –

এই সমস্ত উদ্যোগের ফলে উনিশ শতকের বাংলায় নারীশিক্ষার সূচনা হয় ও গতি আসে। রক্ষণশীল সমাজ নারীশিক্ষার বিরোধিতা করতে থাকে। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা নারীশিক্ষাকে স্বাগত জানায়। সরকারও নারীশিক্ষায় সাহায্য করে। এইভাবে উনিশ শতকের বাংলায় ইউরোপীয় উদ্যোগে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটে।

উনিশ শতকের বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারের দেশীয় উদ্যোগের বিবরণ দাও।

বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারের দেশীয় উদ্যোগের ভূমিকা –

ঋবৈদিক যুগে অনেক বিদুষী নারীর পরিচয় পাওয়া যায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর অধিকার সংকুচিত হয়ে পড়ে। মধ্যযুগে নারীরা চার দেয়ালের মধ্যে বন্দিনি হয়ে থাকত। আধুনিক যুগে অর্থাৎ উনিশ শতকে আধুনিক নারীশিক্ষার সূচনা হয়। নারীসমাজের ইতিহাসে এই ঘটনা ছিল মুক্তি আন্দোলনের সমতুল্য। এই কাজে ইউরোপীয় উদ্যোগের পাশাপাশি দেশীয় উদ্যোগের কথাও সমানভাবে উল্লেখযোগ্য।

বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারের দেশীয় উদ্যোগের আদর্শ –

পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে বাংলায় একটি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে। তারা পাশ্চাত্য মনীষীদের চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তারা নিজ দেশ ও জাতির দুর্দশা উপলব্ধি করেন। এজন্য তারা শিক্ষাপ্রসার, ধর্ম ও সমাজসংস্কারে উদ্যোগী হন। তারা এই সত্য উপলব্ধি করেন যে, সমাজের অর্ধেক অংশ অর্থাৎ নারীদের উন্নতি না হলে সমাজের উন্নতি হবে না।

বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে ব্যক্তিগত উদ্যোগ –

নারীশিক্ষা বিস্তারে এদেশের কিছু ব্যক্তি উদ্যোগী হন। রাজা রামমোহন রায় ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ বলে পরিচিত হলেও নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি কোনও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেননি। পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিক্ষাবিভাগের ইনস্পেকটর থাকাকালীন একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বারাসত -এ কয়েকজন উদ্যোগী হয়ে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে (1849 খ্রিস্টাব্দ)। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অর্থসাহায্য করেন। বিশিষ্ট শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত গৌরীশংকর তর্কবাগীশ নারীশিক্ষার প্রতি সমর্থন জানান।

বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা –

কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ নারীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে প্রগতিশীল পদক্ষেপ নেয়। নারীকল্যাণের জন্য তারা ‘অবলাবান্ধব’ ও ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তারা ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় ভিক্টোরিয়া কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদের পঠনপাঠনেরও ব্যবস্থা করে। ফলে নারীদের উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত হয়।

বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে মূল্যায়ন –

এভাবে পাশ্চাত্য আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের কয়েকজন অগ্রণী ব্যক্তি নারীশিক্ষা প্রসারে সচেষ্ট হন। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক (ব্রাহ্মসমাজ) প্রচেষ্টায় উনিশ শতকের বাংলায় নারীশিক্ষায় গতি আসে। অবলা নারীকে আর গৃহকোণে বন্দিনি থাকতে হয় না। পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডার তাদের সামনে উন্মোচিত হয়। বাংলাদেশে নবজাগরণের পদধ্বনি শোনা যেতে থাকে।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ – টীকা লেখো।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ভূমিকা –

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হল ভারতে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার প্রথম প্রতিষ্ঠান। এটি ভারত তথা এশিয়ার প্রথম ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যার কলেজ।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কমিটি গঠন ও সুপারিশ –

ভারতের বড়োলাট লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক বাংলার চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে চার্লস গ্রান্টের সভাপতিত্বে 1833 খ্রিস্টাব্দে একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা প্রদানের সুপারিশ করে।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা –

কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক 1835 খ্রিস্টাব্দের 28 জানুয়ারি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন ডঃ এম জে ব্রামলি। পরে 1838 খ্রিস্টাব্দে এই কলেজের সঙ্গে হাসপাতাল যুক্ত হয়। এই কলেজ প্রতিষ্ঠায় জমি দান করেন মতিলাল শীল।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি হল –

  • ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যায় দক্ষ করে তোলা।
  • দেশের বিভিন্ন চিকিৎসা ক্ষেত্রে চিকিৎসকের জোগান দেওয়া ইত্যাদি।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পঠন-পাঠন –

এই কলেজে শিক্ষার্থীদের 4 থেকে 6 বছর পর্যন্ত পড়াশোনা করতে হত। এরপর তাদের ডিগ্রি দেওয়া হত।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উপসংহার –

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র এবং চিকিৎসক-শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চিকিৎসাশিক্ষা ও গবেষণার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ভারতবর্ষের চিকিৎসাশিক্ষার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ভারতে পাশ্চাত্য ও আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ভূমিকা আলোচনা করো।

অথবা, এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কিরূপ ভূমিকা ছিল?

ভারতে পাশ্চাত্য ও আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ভূমিকা –

1835 খ্রিস্টাব্দে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন) ভারতে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যা –

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যা শেখানো হত এই এই চিকিৎসাবিদ্যা ছিল প্রচলিত ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার থেকে উন্নত। তাই ভারতে এই চিকিৎসাবিদ্যার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

  • সরকারি সহায়তা – ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার প্রসারে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণ ছিল ব্রিটিশ সরকারের সহায়তা। ব্রিটিশ সরকার পাশ্চাত্যের আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার চর্চার জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রচুর অর্থসাহায্য করেন।
  • খ্যাতনামা ডাক্তার তৈরি – কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ভারতের অনেক খ্যাতনামা ডাক্তার তৈরি করেছে। এই কলেজ থেকে প্রথম ব্যাচে ডাক্তারি পাস করেন উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত প্রমুখ, যাঁরা পরবর্তীকালে বিভিন্ন অঞ্চলে চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
  • হাতেকলমে শিক্ষা – কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষার্থীদের। হাতেকলমে শিক্ষা দিত। এই উদ্দেশ্যে 1836 খ্রিস্টাব্দে এখানে শবব্যবচ্ছেদ করা হয়। এই শবব্যবচ্ছেদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন মধুসূদন গুপ্ত।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উপসংহার –

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর প্রতি বছর আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা লাভ করে বহু ছাত্র দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসকের কাজে যুক্ত হয় এই কলেজ থেকে পাস করার। পর অনেকে আরও বেশি শিক্ষালাভের জন্য বিলেতে ডাক্তারি পড়ার যোগ্যতা অর্জন করে। এককথায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ভারতের। চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা করে।

মধুসূদন গুপ্তের শবব্যবচ্ছেদ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

মধুসূদন গুপ্তের শবব্যবচ্ছেদের ভূমিকা –

বাংলার আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে মধুসূদন গুপ্ত একটি স্মরণীয় নাম। 1836 খ্রিস্টাব্দের 28 অক্টোবর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম শবব্যবচ্ছেদ করে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।

মধুসূদন গুপ্তের শবব্যবচ্ছেদ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

মধুসূদন গুপ্তের পারিবারিক পরিচয় –

মধুসূদন গুপ্ত হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি গ্রামে এক বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভবত 1800 খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতামহ ছিলেন হুগলির নবাব পরিবারের গৃহচিকিৎসক। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হিসেবে তাঁর পরিবারের খুব নামডাক ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। তাঁর পিতার নাম ছিল বলরাম গুপ্ত।

শবব্যবচ্ছেদে মধুসূদন গুপ্ত –

বর্তমান চিকিৎসাশিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হল শবব্যবচ্ছেদ (মড়া কাটা) করে জ্ঞান অর্জন করা। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা হলেও শবব্যবচ্ছেদ করে জ্ঞান অর্জনের পথে হিন্দুধর্মের কুসংস্কার অন্যতম প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

  • 1836 খ্রিস্টাব্দের 28 অক্টোবর মধুসূদন গুপ্ত প্রথম শবব্যবচ্ছেদ করেন। এই ঘটনাটি ভারতের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম সংস্কার ভাঙার ঘটনা।
  • শবব্যবচ্ছেদের সময় মধুসূদনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত, নবীনচন্দ্র মিত্র প্রমুখ ছাত্র।
  • মধুসূদন গুপ্তের হাতে শবব্যবচ্ছেদের ফলে দীর্ঘদিনের কুসংস্কার ও গোঁড়া পণ্ডিতদের বাধানিষেধের বেড়া ভেঙে যায়। ভারত চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন যুগে প্রবেশ করে।

মধুসূদন গুপ্তের মৃত্যু –

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে দীর্ঘদিন কাজ করার পর 1865 খ্রিস্টাব্দের 15 নভেম্বর মধুসূদন গুপ্ত মারা যান।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, উচ্চশিক্ষার বিস্তারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা করো।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা –

স্যার চার্লস উডের নির্দেশনামা (1864 খ্রিস্টাব্দ) অনুসারে ভারতের বড়োলাট লর্ড ক্যানিং -এর আমলে 1857 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। লর্ড ক্যানিং 1857 খ্রিস্টাব্দের 24 জানুয়ারি ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ -এ স্বাক্ষর করেন। এই দিনটি ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হল ভারতের তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি হল –

  • বাংলা প্রেসিডেন্সি তথা ভারতে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
  • নিজ এলাকাভুক্ত বিভিন্ন কলেজের অনুমোদন, পরীক্ষাগ্রহণ ও উপাধি প্রদান করা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা –

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা ছিল লাহোর থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত প্রসারিত। শ্রীলঙ্কাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত ছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা –

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য আচার্য, উপাচার্য ও সেনেট গঠিত হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য ছিলেন ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং এবং প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার জেমস উইলিয়ম কোলভিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি –

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। 1906 খ্রিস্টাব্দে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় উপাচার্য হিসেবে যোগদান করলে এর উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। তাঁর আমলকে ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ’ বলা হয়।

  • 1858 খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও যদুনাথ বোস এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক হন।
  • 1882 খ্রিস্টাব্দে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতক ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ও চন্দ্রমুখী বসু।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপসংহার –

ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন সি ভি রমন, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ। প্রতিষ্ঠার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ লাভ করে।

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের ভূমিকা –

উনিশ শতকের বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলনের জোয়ার এসেছিল। এই সময় রাজা রামমোহন রায় ও তাঁর ব্রাহ্মসমাজ, ডিরোজিও ও তাঁর নব্যবঙ্গ দল এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে সমাজসংস্কার আন্দোলন সাফল্যলাভ করেছিল।

উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য –

উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • নারীদের অবস্থার উন্নতির জন্য আন্দোলন – উনিশ শতকের সমাজসংস্কারের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সমাজে নারীদের অবস্থার উন্নতির জন্য আন্দোলন। সমাজে বাল্যবিবাহ, সতীন কলহ, বৈধব্য জীবনের যন্ত্রণা নারীদের ভোগ করতে হত। তাই সমাজসংস্কারকগণ বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহের পক্ষে আন্দোলন করেছিলেন।
  • কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলন – তৎকালীন সমাজে সতীদাহ, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি বিভিন্ন কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। সমাজসংস্কারকগণ এইসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন।
  • উচ্চশ্রেণির সংস্কার আন্দোলন – উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলন ছিল ব্রাহ্মণ-সহ উচ্চ হিন্দুশ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ। সতীদাহপ্রথা নিম্নবর্গের সমাজে প্রচলিত ছিল না। এমনকী বিধবাবিবাহও ছিল উচ্চবর্গীয় সমাজের প্রচলিত প্রথা।
  • শিক্ষিত সম্প্রদায়ের আন্দোলন – উনিশ শতকের বাংলার সমাজসংস্কারকগণ ছিলেন পাশ্চাত্য ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সম্প্রদায়। রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ সংস্কারক ছিলেন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। তাঁরা তাঁদের মতাদর্শ পুস্তক-পুস্তিকা ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার করেন।
  • শাস্ত্রনির্ভর আন্দোলন – শাস্ত্রনির্ভরতা এই সময়ের আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই সময়ের প্রধান সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগর সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে ও বিধবাবিবাহের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের জন্য শাস্ত্রের উপর নির্ভর করেছিলেন।

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কারের প্রধান উদ্যোক্তা কারা ছিলেন?

উনিশ শতকে বাংলার সমাজে নানান কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। যেমন – বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহ, গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি। অনেক প্রগতিশীল মানুষ এই কুসংস্কারগুলির বিরোধিতা করে সমাজ সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কারে রাজা রামমোহন রায় –

উনিশ শতকে বাংলার প্রধান সমাজসংস্কারক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্য অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর আন্দোলনের ফলে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক 1829 খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এ ছাড়া তিনি সমাজের অন্যান্য কুসংস্কার ও পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলনের পক্ষেও আন্দোলন করেছিলেন।

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কারে কেশবচন্দ্র সেন –

রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তারপর কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কার আন্দোলনে শামিল হন। কেশবচন্দ্র সেন বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে ও অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ, নারী স্বাধীনতা প্রভৃতির সপক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কারে ডিরোজিও –

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ডিরোজিও ও তাঁর ‘নব্যবঙ্গ’ দলের সদস্য প্যারিচাঁদ মিত্র, রামগোপাল ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ি, রসিককৃয় মল্লিক প্রমুখ। তাঁরা হিন্দু সমাজে প্রচলিত সতীদাহপ্রথা, জাতিভেদ প্রথা, মূর্তিপূজা প্রভৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন।

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর –

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার অন্যতম প্রধান সমাজসংস্কারক। তাঁর প্রচেষ্টার ফলে 1856 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্যানিং বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন। এ ছাড়া বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতির বিরুদ্ধে ও নারীশিক্ষার পক্ষে আন্দোলন করেন।

উনিশ শতকের বাংলায় সতীদাহ প্রথাবিরোধী আন্দোলনের বিবরণ দাও।

সতীদাহ প্রথাবিরোধী আন্দোলনের ভূমিকা –

অতি প্রাচীনকাল থেকে ভারতে সতীদাহপ্রথা চালু ছিল। ইংরেজ আমলে মিশনারিদের বিরোধিতা, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতিবেদন, রামমোহন রায়ের আন্দোলন ও সরকারি আইনবলে সতীদাহপ্রথা 1829 খ্রিস্টাব্দে নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়।

সতীদাহপ্রথা –

মৃত স্বামীর সঙ্গে বিধবা স্ত্রীকে একই চিতায় দাহ করার প্রথাকে সতীদাহপ্রথা বলা হত। পূর্ববর্তী সাত এবং পরবর্তী সাত মোট চোদ্দো পুরুষ স্বর্গবাস এবং সামাজিক সম্মানের লোভে অনেকে স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্পত্তি বা অন্য কারণে বিধবাদের সহমরণে বাধ্য করা হত।

সতীদাহপ্রথা বিরোধী আন্দোলন –

সতীদাহের বিরুদ্ধে ইংরেজ রাজত্বকালে অনেক প্রতিবাদ, অনেক প্রতিরোধের চেষ্টা হয়। যেমন –

  • ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়ের বিরোধিতা – বাংলাদেশে কলকাতা, চন্দননগর, হুগলি, শ্রীরামপুরে যথাক্রমে ইংরেজ, ফরাসি, পোর্তুগিজ ও দিনেমারদের বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। ইউরোপীয় বণিকেরা তাদের কেন্দ্রে সতীদাহ নিষিদ্ধ করে।
  • মিশনারি সম্প্রদায়ের বিরোধিতা – খ্রিস্টান মিশনারি সম্প্রদায় মানবতার নামে এই নিষ্ঠুর প্রথার বিরোধিতা করে।
  • সরকারি উদ্যোগ – 1797 খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরের জেলাশাসক সতীদাহ থেকে 9 বছরের এক বিধবাকে রক্ষা করেন। 1813 খ্রিস্টাব্দে এক নির্দেশবলে সন্তানসম্ভবা ও 9 বছরের কম বয়সিদের সতীদাহ নিষিদ্ধ হয়। 1815 খ্রিস্টাব্দের নির্দেশে দুগ্ধপোষ্য শিশু বা 7 বছরের কমবয়সি সন্তানের মা বিধবা হলে তাদের ক্ষেত্রে সতীদাহ নিষিদ্ধ হয়।
  • রামমোহনের আন্দোলন – রক্ষণশীল হিন্দু নেতারা সরকারি নির্দেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানালে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন (1818 খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকা ও পুস্তিকার সাহায্যে সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে প্রচার চালান। হিন্দুশাস্ত্র থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে দেখান যে, সতীদাহপ্রথা অশাস্ত্রীয়। তিনি শ্মশানে ঘুরে ঘুরে বিধবার আত্মীয়দের কাছে সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রচার করেন। এরপর বিশিষ্ট নাগরিকদের স্বাক্ষর-সহ এক আবেদনপত্র বড়োলাট লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক -এর কাছে পাঠান; বেন্টিঙ্ক সপ্তদশ বিধি (Regulation-XVII) পাস করে সতীদাহকে ফৌজদারি অপরাধ বলে ঘোষণা করেন (4 ডিসেম্বর, 1829 খ্রিস্টাব্দ)।

সতীদাহ প্রথাবিরোধী আন্দোলনের পরিণতি –

রক্ষণশীল হিন্দুরা এই আইনের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলে আবেদন করে। রামমোহন ইংল্যান্ডে গিয়ে আইনের পক্ষে সওয়াল করেন এবং জয়ী হন। সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ হয়।

সতীদাহ প্রথাবিরোধী আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা উল্লেখ করো।

সনাতনপন্থী হিন্দুসমাজে মৃত স্বামীর শব দাহ করার সময় একই চিতায় তার বিধবা স্ত্রীকে দাহ করার প্রথাকে সতীদাহপ্রথা বলা হয়। সতীদাহপ্রথাকে সহমরণ প্রথাও বলা হয়। হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণের মধ্যে এই প্রথা চালু ছিল। রাজা রামমোহন রায় এই নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন।

রাজা রামমোহন রায় বিভিন্নভাবে সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। যেমন –

  • গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে,
  • সংবাদপত্রের মাধ্যমে,
  • বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গিয়ে,
  • বিভিন্ন জনের স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনপত্র প্রেরণের মাধ্যমে।

সতীদাহ প্রথাবিরোধী আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা –

গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে –

রাজা রামমোহন রায় গ্রন্থ রচনা করে সতীদাহপ্রথাকে অশাস্ত্রীয় প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। তিনি 1818 খ্রিস্টাব্দে একটি এবং 1819 খ্রিস্টাব্দে আরও একটি গ্রন্থ রচনা করে সতীদাহপ্রথার বিরোধিতা করেন। তিনি মনুসংহিতা ও অন্যান্য শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, হিন্দুধর্মে বিধবাদের সংযমী ও পবিত্র জীবনযাপনের কথা বলা হয়েছে – সতীদাহের কথা বলা হয়নি।

সংবাদপত্রের মাধ্যমে –

রাজা রামমোহন রায় সংবাদপত্রের মাধ্যমে সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য প্রচার করেন। তিনি ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকায় সতীদাহপ্রথার বিরোধিতা করেন।

বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গিয়ে –

রাজা রামমোহন রায় বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গিয়ে সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে প্রচার করেন। এমনকি সতীদাহের ঘটনা ঘটতে চলেছে যে শ্মশানে সেখানে গিয়েও সতীদাহপ্রথার বিরোধিতা করেন।

বিভিন্ন জনের স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনপত্রের মাধ্যমে –

রামমোহন সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন শিক্ষিত মানুষের স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনপত্র সরকারের কাছে পেশ করেছিলেন।

সতীদাহপ্রথা উচ্ছেদ –

রাজা রামমোহন রায়ের আন্দোলনের ফলে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক 1829 খ্রিস্টাব্দে 17 নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন।

রাজা রামমোহন রায়-কে কেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ মনে করা হয়?

উনিশ শতকে ভারতের ধর্ম ও সমাজসংস্কারের ইতিহাসে রাজা রামমোহন রায় -এর নাম চিরস্মরণীয়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় যুক্তিবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে রামমোহন রায় নবভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

রাজা রামমোহন রায়কে প্রথম আধুনিক মানুষ বলার কারণ –

  • পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থনে গৃহীত পদক্ষেপ – রামমোহন ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষার উগ্র সমর্থক। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সরকারি অর্থ ব্যয়ের জন্য অনুরোধ জানান ব্রিটিশ সরকারকে।
  • বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন – রাজা রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 1817 খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দু কলেজ’ এবং 1830 খ্রিস্টাব্দে ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন’ প্রতিষ্ঠায় আলেকজান্ডার ডাফ-কে তিনি বিশেষভাবে সহায়তা করেন।
  • জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা – জাতিভেদ প্রথার প্রবল বিরোধী ছিলেন রামমোহন রায়। তিনি অসবর্ণ বিবাহকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি সমস্ত ধর্মের মানুষের সমন্বয় ঘটাতে তৎপর হয়েছিলেন।
  • সতীদাহপ্রথার অবসান – হিন্দুসমাজে প্রচলিত মর্মান্তিক সতীদাহপ্রথা নিবারণের জন্য রাজা রামমোহন রায় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বড়োলাট বেন্টিঙ্কের কাছে একটি আবেদনপত্র জমা দেন। শেষপর্যন্ত 1829 খ্রিস্টাব্দে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়।

রাজা রামমোহন রায়কে প্রথম আধুনিক মানুষ বলার মূল্যায়ন –

রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে ভারতবর্ষে আধুনিক যুগের সূচনা ঘটেছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও যুক্তিবাদের প্রসারের প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেছিলেন। এ ছাড়া মধ্যযুগীয় জড়তা, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের হাত থেকে ভারতবাসীকে মুক্ত করে নবজাগরণ ঘটাতে তিনি বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই সকল কারণের জন্য রাজা রামমোহন রায়কে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বলে অভিহিত করা হয়।

ডিরোজিও – টীকা লেখো।

উনিশ শতকের বাংলার সমাজ সংস্কারকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। তিনি ইঙ্গ-পোর্তুগিজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও নিজেকে ‘ভারতীয়’ বলেই মনে করতেন।

ডিরোজিও - টীকা লেখো।

ডিরোজিওর প্রথম জীবন –

ডিরোজিও 1809 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছেলেবেলায় স্কটিশ সাহেব ডেভিড ড্রমন্ড প্রতিষ্ঠিত ‘ধর্মতলা আকাডেমি’ -তে শিক্ষালাভ করেন।

ডিরোজিওর শিক্ষকতা –

1826 খ্রিস্টাব্দে মাত্র 17 বছর বয়সে ডিরোজিও হিন্দু কলেজে ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর দেশপ্রেম, যুক্তিবাদ, সত্যের প্রতি নিষ্ঠার জন্য তিনি ছাত্রদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।

ডিরোজিওর ‘নব্যবঙগ’ গোষ্ঠী গঠন –

ডিরোজিও তাঁর অনুগামীদের নিয়ে নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী গঠন করেন। এর উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলেন – রামতনু লাহিড়ি, রামগোপাল ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

ডিরোজিওর কার্যকলাপ –

ডিরোজিও সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সমাজ সংস্কারমূলক মতামত প্রচারের জন্য পার্থেনন পত্রিকাও প্রকাশ করেন। তিনি বাংলার সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, মূর্তিপূজা, নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রভৃতির বিরোধিতা করেন।

ডিরোজিওর হিন্দু কলেজ থেকে বহিষ্কার –

ডিরোজিও ও তাঁর নব্যবঙ্গ দল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে উগ্র প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে তাঁকে হিন্দু কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

ডিরোজিওর মৃত্যু –

ডিরোজিও 1831 খ্রিস্টাব্দে মাত্র 23 বছর বয়সে মারা যান।

ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সমাজ সংস্কারমূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, সমাজসংস্কারে নব্যবঙ্গের অবদান কী ছিল?

ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর ভূমিকা –

পোর্তুগিজ বংশোদ্ভূত তরুণ শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও তৎকালীন সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। তাঁর তরুণ অনুগামীরা ইয়ং বেঙ্গল (Young Bengal) বা নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী নামে পরিচিত। তাঁদের আন্দোলনকে নব্যবঙ্গ আন্দোলন নামে অভিহিত করা হয়।

ডিরোজিও –

ডিরোজিও 1809 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছেলেবেলায় স্কটিশ সাহেব ডেভিড ড্রুমন্ড প্রতিষ্ঠিত স্কুলে শিক্ষালাভ করেন। মাত্র 17 বছর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ডিরোজিওর দেশপ্রেম, যুক্তিবাদ, সত্যের প্রতি নিষ্ঠা তাঁর প্রতি ছাত্রদের আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর আকর্ষণে হিন্দু কলেজের অনেক ছাত্র তাঁর অনুগামী হয়ে উঠেছিল।

নব্যবঙগ গোষ্ঠী –

ডিরোজিওর অনুগামীরা নব্যবঙ্গ বা ডিরোজিয়ান নামে পরিচিত ছিল। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রামতনু লাহিড়ি, রামগোপাল ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ। ডিরোজিওর মৃত্যুর পরও তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী সমাজসংস্কারে ব্রতী ছিল।

ডিরোজিওর কার্যকলাপ –

ডিরোজিও 1828 খ্রিস্টাব্দে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সমিতি গঠন করে হিন্দুসমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অনুগামী যারা তাদের উৎসাহিত করতেন। তিনি পার্থেনন পত্রিকার মাধ্যমে সমিতির মতামত প্রচার করেন।

  • নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের তীব্র সমালোচনা করে।
  • তাঁরা হিন্দুসমাজের রক্ষণশীলতাকে আক্রমণ করার জন্য প্রকাশ্যে ব্রাহ্মণের উপবীত ছিঁড়ে দিতেন, এমনকি নিষিদ্ধ মাংসও খেতেন।
  • তবে তাঁরা কেবলমাত্র অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা প্রকাশ করেই তাঁদের কাজ শেষ করেননি। তাঁরা সমসাময়িক নানা বিষয়ে তাঁদের সুচিন্তিত মতামতও প্রকাশ করেছেন।

ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর মূল্যায়ন –

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর কার্যকলাপ হিন্দুসমাজে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তবে তাঁদের আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ডিরোজিওর মৃত্যুর কিছুকাল পরেই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল কেন?

অথবা, নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা কী ছিল?

হিন্দু কলেজের শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র অনুগামীরা নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী নামে পরিচিত। নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী তৎকালীন সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। কিন্তু তাঁদের আন্দোলন বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ –

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি হল –

  • উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাব – ডিরোজিওর মৃত্যুর পর নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই সময় উপযুক্ত নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতার অভাবে গোষ্ঠীর সদস্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাঁরা অন্যান্য কাজকর্মে যুক্ত হলে আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যায়।
  • উপযুক্ত কর্মসূচির অভাব – সমাজের বৃহত্তর অংশকে প্রভাবিত করার মতো কর্মসূচি নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর ছিল না। তাঁদের অতি উচ্ছ্বাস হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে ক্ষোভ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে। সমাজের প্রগতিশীল অংশও তাঁদের কর্মসূচিতে আকৃষ্ট হয়নি।
  • শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন – নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন ছিল ইংরেজি-শিক্ষিত শহরের তরুণদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আন্দোলনের কোনো প্রভাব পড়েনি।
  • হিন্দুদের প্রতি অন্ধ বিরোধিতা – নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারের বিরোধিতা করতে গিয়ে হিন্দুদের সমস্ত আচার-আচরণের তীব্র বিরোধিতা করে। অন্ধভাবে হিন্দুদের প্রতি বিরোধিতার ফলে হিন্দুসমাজেও তাঁদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়নি, ফলে তাঁদের আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
  • কৃষকদের প্রতি উদাসীনতা – নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকশ্রেণির সমস্যার বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল। ফলে কৃষকশ্রেণি-সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের এই আন্দোলন সম্পর্কে কোনো আগ্রহ ছিল না।

উনিশ শতকের বাংলায় কীভাবে বিধবাবিবাহ আন্দোলন গড়ে ওঠে?

অথবা, বিধবাবিবাহ আন্দোলন – টীকা লেখো।

বিধবাবিবাহ আন্দোলনের ভূমিকা –

অতি প্রাচীনকালে বিধবাবিবাহ প্রচলিত ছিল। পরে ধর্মীয় বিধান ও সমাজ নারীর অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ হয়। নারীর বাল্যবিবাহ এবং পুরুষের বহুবিবাহ চালু হয়। এইসব সামাজিক কুপ্রথা ধর্মের অঙ্গ হিসেবে সমাজে পালিত হতে থাকে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে সচেতন শিক্ষিত শ্রেণি এই কুপ্রথাগুলি দূর করতে সচেষ্ট হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল বিধবাবিবাহ আন্দোলন।

বিধবাবিবাহ আন্দোলনে প্রাথমিক উদ্যোগ –

সতীদাহপ্রথা রদ এবং ব্রাহ্মসমাজে বিধবাবিবাহ চালু হলে হিন্দুসমাজেও বিধবাবিবাহ চালু করার জন্য আন্দোলন শুরু হয়।

  • 1837 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় আইন কমিশন কলকাতা, মাদ্রাজ ও এলাহাবাদের সদর আদালতের বিচারপতিদের কাছে এ বিষয়ে মতামত জানতে চায়। সব বিচারপতিই বাল্যবিধবাদের পুনর্বিবাহের কথা বলেন।
  • কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বংশধর রাজা শ্রীশচন্দ্র বিধবাবিবাহকে শাস্ত্রসম্মত প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। অনেক স্মৃতিশাস্ত্রকার তথ্যপ্রমাণ দিয়েও সামাজিক চাপে পিছিয়ে আসেন। কলকাতার বউবাজারের নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায়, পটলডাঙার শ্যামাচরণ দাস একইভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
  • 1845 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি বিধবাবিবাহের জন্য সচেষ্ট হয়। কিন্তু আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।

বিধবাবিবাহ আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের আন্দোলন –

সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ আন্দোলন শুরু করেন।

  • 1850 খ্রিস্টাব্দে ‘সর্বশুভকরী’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় তিনি বাল্যবিবাহের দোষ নামে একটি নিবন্ধ লেখেন এবং 1854 খ্রিস্টাব্দে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় বিধবাবিবাহের সমর্থনে একটি প্রবন্ধ লেখেন। 1855 খ্রিস্টাব্দে ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেন। 1856 খ্রিস্টাব্দে পুস্তিকার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তিনি পরাশর সংহিতার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। এর ফলে হিন্দুসমাজে এক আলোড়ন শুরু হয়।
  • বিদ্যাসাগর 1000 জন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরযুক্ত বিধবাবিবাহের সপক্ষে একটি আবেদনপত্র ভারত সরকারের কাছে পাঠান। বাংলা ও বাংলার বাইরে বিভিন্ন স্থান থেকে অনুরূপ আবেদন পাঠানো হয়। রক্ষণশীলরা রাধাকান্ত দেব -এর নেতৃত্বে 36,763 জনের স্বাক্ষরবিশিষ্ট একটি বিরোধিতাপত্র সরকারের কাছে পাঠায়। এই সবের পরিপ্রেক্ষিতে বড়োলাট লর্ড ক্যানিং শেষপর্যন্ত 1856 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন।

বিধবাবিবাহ আন্দোলনের ফলাফল –

বিধবাবিবাহ আইন জারি হওয়ার পর বাংলায় প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয় 1856 খ্রিস্টাব্দের 7 ডিসেম্বর। পাত্র ছিলেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও পাত্রী ছিলেন 10 বছরের বাল্যবিধবা কালীমতি দেবী। বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণের সঙ্গে ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার বিবাহ দেন। এরপর 82,000 টাকা ব্যয়ে তিনি 60 জন বিধবার বিবাহ দেন। জনপ্রিয় না হলেও এভাবে হিন্দুসমাজে বিধবাবিবাহ চালু হয়।

বিধবাবিবাহ আন্দোলনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো।

অথবা, বিধবাবিবাহ আন্দোলনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা কী ছিল?

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ হল বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য আন্দোলন। তিনি বলেছেন, ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম।’

বিধবাবিবাহ আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা –

বিদ্যাসাগর বিভিন্নভাবে বিধবাবিবাহ প্রচলনের পক্ষে আন্দোলন করেছিলেন। যেমন –

  • গ্রন্থ রচনা করে,
  • সংবাদপত্রের মাধ্যমে,
  • বিভিন্ন মানুষের স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনপত্র সরকারের কাছে প্রেরণের মাধ্যমে,
  • নানা স্থানে গিয়ে প্রচারের মাধ্যমে।

গ্রন্থ রচনা করে –

বিদ্যাসাগর 1855 খ্রিস্টাব্দে ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। পরে তিনি আরও একটি পুস্তিকা রচনা করে বিধবাবিবাহ প্রচলনের পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। তিনি বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, বিধবাবিবাহ হল শাস্ত্রসম্মত।

সংবাদপত্রের মাধ্যমে –

বিদ্যাসাগর ‘সর্বশুভকরী’ পত্রিকায় বিধবাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। ‘সর্বশুভকরী’ পত্রিকা ছিল বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত ‘সর্বশুভকরী সভা’-র মুখপত্র।

স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনপত্র পেশের মাধ্যমে –

বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের সমর্থনে 1855 খ্রিস্টাব্দে 1000 জন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে এক আবেদনপত্র পাঠান। এই স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রচারের মাধ্যমে –

বিদ্যাসাগর বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিধবাবিবাহের প্রচার ও আয়োজন করে এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন।

বিধবা পুনর্বিবাহ আইন পাস –

বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের ফলে 1856 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই ব্রিটিশ সরকার 15নং রেগুলেশন জারি করে বিধবাদের পুনর্বিবাহ আইনসম্মত বলে ঘোষণা করে।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের কার্যাবলি ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের পরিচয় দাও।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা –

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রধান নেতা। রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর তিনি ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন গতিশীল হয়ে ওঠে।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা –

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর 1839 খ্রিস্টাব্দে সংস্কারমুক্ত ধর্ম আলোচনার জন্য তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভায় তৎকালীন বহু বাঙালি বুদ্ধিজীবী অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামতনু লাহিড়ি, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ এই সভার সদস্য ছিলেন।

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশ –

তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র ছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। এই পত্রিকায় বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি কুপ্রথার বিরুদ্ধে সমালোচনা করা হয়।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন –

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দুসমাজে প্রচলিত নানা ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। তিনি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, নারী স্বাধীনতা প্রভৃতির পক্ষে আন্দোলন করেছিলেন।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের বিস্তার –

দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা, কুমিল্লা, রংপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ব্রাহ্মসমাজের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের উপসংহার –

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনকে এক নতুন চরিত্র দান করেন। তিনি ব্রাত্মবন্ধু সভা, সমাজোন্নয়ন বিধায়নী, সুহৃদ সমিতি প্রভৃতি সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁর আন্দোলনের ফলে ব্রাহ্মসমাজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

সমাজসংস্কার আন্দোলনে কেশবচন্দ্র সেনের অবদান আলোচনা করো।

অথবা, ব্রাহ্ম আন্দোলনে কেশবচন্দ্র সেনের অবদান সম্বন্ধে লেখো।

সমাজসংস্কার আন্দোলনে কেশবচন্দ্র সেনের ভূমিকা –

1857 খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন। তাঁর উদ্যম ও বাগ্মিতার ফলে ব্রাহ্ম আন্দোলন এক নতুন মাত্রা পায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধিতে ভূষিত করেন (1862 খ্রিস্টাব্দ)। কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজের প্রথম অব্রাহ্মণ আচার্য ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ প্রচার করার জন্য ‘দি ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।

সমাজসংস্কার আন্দোলনে কেশবচন্দ্র সেনের অবদান –

কেশবচন্দ্র সেনের উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজের সমাজসংস্কার আন্দোলনে জোয়ার আসে।

  • তিনি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা ও বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনে আন্দোলন করেন।
  • তাঁর আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার 1872 খ্রিস্টাব্দে তিন আইন পাস করে। ফলে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয় ও অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়।
  • তিনি নারীশিক্ষার প্রসার ও নারীদের কল্যাণের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তিনি নারীদের জন্য 1865 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মিকা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
  • তিনি শ্রমিকদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটান ও মদ্যপানের বিরুদ্ধেও প্রচার করেন।

ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের উপসংহার –

ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলে সমাজে নারীদের অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হয়। সমাজে জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, গোঁড়ামি হ্রাস পায় এবং এই কাজে কেশবচন্দ্র সেনের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।

কেশবচন্দ্র সেন কী বৈষ্ণব ছিলেন?

হ্যাঁ, কেশবচন্দ্র সেন বৈষ্ণব ছিলেন।

ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল?

উনিশ শতকের বাংলায় ধর্ম ও সমাজসংস্কারে ব্রাহ্মসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা। পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, আনন্দমোহন বসু প্রমুখের নেতৃত্বে ব্রাহ্ম আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল।

ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের সীমাবদ্ধতা –

ব্রাহ্ম আন্দোলন জনপ্রিয়তা লাভ করলেও তার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। সীমাবদ্ধতাগুলি হল নিম্নরূপ –

  • শিক্ষিত শ্রেণির আন্দোলন – ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন ছিল মূলত শহরের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সমাজের অগণিত নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষ এই আন্দোলনে শামিল হতে পারেনি।
  • শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন – ব্রাহ্মসমাজের ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলন ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। বাংলার গ্রামাঞ্চলে এই আন্দোলনের প্রসার ঘটেনি।
  • নেতৃত্বের মতভেদ – ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের নিজেদের মধ্যে মতভেদ এই আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনের মতভেদ, আবার কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ সদস্যের মতপার্থক্য ব্রাহ্মসমাজের জনপ্রিয়তাকে হ্রাস করে।
  • মতবাদের পরিবর্তন – ব্রাহ্মসমাজে বারবার মতবাদের পরিবর্তন আন্দোলনের ক্ষতি করেছে। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি রচনা করেন। কেশবচন্দ্র সেন পরবর্তীকালে অবতারবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন যা ব্রাহ্মসমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল।

ভারতীয় সমাজে বিভিন্ন সংগঠনের সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রভাব কী ছিল?

ভারতীয় সমাজে বিভিন্ন সংগঠনের সমাজসংস্কার আন্দোলনের ভূমিকা –

ব্রাহ্মসমাজ, প্রার্থনা সমাজ, আর্য সমাজ, আলিগড় আন্দোলন এবং রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ যে সমাজসংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন ভারতীয় সমাজে তার প্রভাব ছিল অপরিসীম।

ভারতীয় সমাজে বিভিন্ন সংগঠনের সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রভাব –

  • সামাজিক কুসংস্কার হ্রাস – সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে সমাজের কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথা, সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি অনেকাংশে দূর। হয়েছিল। অপরদিকে বিধবাবিবাহ ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল।
  • নারীসমাজের উন্নয়ন – সংস্কার আন্দোলনের ফলে বিশেষভাবে নারীসমাজের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল।
  • জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশ – সংস্কার আন্দোলন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ও বৈপ্লবিক আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। বাংলার জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী নেতাদের অনেকে ব্রাহ্মসমাজ এবং পাঞ্জাবের চরমপন্থীরা আর্য সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
  • আধুনিক সমাজ গঠন – সমাজসংস্কার আন্দোলনের ফলে কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক ভারতীয় সমাজ গড়ে উঠেছিল।

ভারতীয় সমাজে বিভিন্ন সংগঠনের সমাজসংস্কার আন্দোলনের উপসংহার –

পরিশেষে বলা যায়, সমাজসংস্কার আন্দোলন সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ছিল না – এই সংস্কার আন্দোলন ছিল শহরকেন্দ্রিক এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উদ্ভবে ও কুসংস্কারমুক্ত মানবতাবাদী চেতনার বিকাশে বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত সমাজসংস্কার আন্দোলনগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

হাজি মহম্মদ মহসিন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, হাজি মহম্মদ মহসিনের অবদান সম্বন্ধে লেখো।

হাজি মহম্মদ মহসিনের ভূমিকা –

হাজি মহম্মদ মহসিন ছিলেন বাংলার একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম ও মহান জনহিতৈষী ব্যক্তি। তিনি বাংলার একজন দানবীর ব্যক্তি হিসেবেও বিখ্যাত হয়ে আছেন। মক্কা, মদিনা, কারবালা ইত্যাদি স্থানে হজ করার পর তাঁর নাম হয় মহম্মদ মহসিন।

হাজি মহম্মদ মহসিন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

হাজি মহম্মদ মহসিনের পরিচয় –

হাজি মহম্মদ মহসিন 1732 খ্রিস্টাব্দে হুগলির এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজি ফয়জুল্লাহ ও মাতার নাম জয়নাম খানম। তাঁর একমাত্র সৎ বোন ছিলেন মন্নুজান খানম।

হাজি মহম্মদ মহসিনের শিক্ষা –

মহম্মদ মহসিন কোরান, হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রে অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করেন এবং মুরশিদাবাদে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন।

হাজি মহম্মদ মহসিনের ভ্রমণ –

তিনি মনে করতেন, ভ্রমণ মানুষের মনের পরিধি বাড়ায়। তাই ইরাক, ইরান, তুরস্ক, আরব প্রভৃতি অনেক দেশ তিনি ভ্রমণ করেন। পবিত্র তীর্থস্থান মক্কা, মদিনা, কুফা, কারবালা-ও ভ্রমণ করেন।

হাজি মহম্মদ মহসিনের সম্পত্তি লাভ –

মহসিন তাঁর পিতার সম্পত্তি ও সৎ বোন মন্নুজান -এর বিপুল সম্পত্তি পান।

হাজি মহম্মদ মহসিনের কার্যাবলি –

তিনি তাঁর বিশাল সম্পত্তি বিভিন্ন সৎ ও উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করেন।

  • মহসিন নিজে সৎ ও ধর্মীয় জীবনযাপন করতেন। তবে পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান পালন করতেন।
  • তিনি বিভিন্ন সৎ কাজে অনেক অর্থ দান করতেন। ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণে অর্থসাহায্যের কারণে শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
  • 1806 খ্রিস্টাব্দে তাঁর সঞ্চিত সম্পদ সৎ কাজে ব্যবহার করার জন্য তিনি একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। তিনি তাঁর সম্পত্তিকে 9 ভাগে ভাগ করেন। এর মধ্যে –
    • 4 ভাগ উন্নয়নমূলক কাজের জন্য,
    • 3 ভাগ ধর্মীয় কর্মের জন্য ও
    • 2 ভাগ তাঁর দ্বারা নিযুক্ত মতাওয়াল্লিদের খরচের জন্য রাখা হয়।

হাজি মহম্মদ মহসিনের মৃত্যু –

1812 খ্রিস্টাব্দে হাজি মহম্মদ মহসিনের মৃত্যু হয়। হুগলির ইমামবাড়ায় তাঁর সমাধিসৌধ নির্মিত হয়।

মহসিন ফান্ড –

তাঁর মৃত্যুর পর সরকার মহসিন ফান্ড তৈরি করে তাঁর সম্পদ সৎ কাজে খরচের ব্যবস্থা করে। তাঁর টাকায় মাদ্রাসা, মসজিদ, স্কুল, হাসপাতাল, ইমামবাড়া, হুগলি মহসিন কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব – টাকা লেখো।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভূমিকা –

কলকাতায় দক্ষিণেশ্বরের দেবী ভবতারিণীর পূজারি ছিলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়। তিনিই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন ঊনবিংশ শতকের আধুনিক ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যুগপুরুষ।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব - টাকা লেখো।
  • যত মত তত পথ – শ্রীরামকৃষ্ণের মতে বৈয়ব, শাক্ত, ইসলাম, খ্রিস্ট সমস্ত পথেই ঈশ্বরকে লাভ করা যায়। তিনি বলেছিলেন, “যত মত তত পথ”। শুধুমাত্র আন্তরিকতাকে অবলম্বন করলেই ঈশ্বরলাভ সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন।
  • মানবসেবার আদর্শ – জীবে দয়া নয় – “শিবজ্ঞানে জীবসেবা”-র আদর্শই তিনি তুলে ধরেছিলেন। জীবজগতের কল্যাণসাধন ছিল তাঁর মানবসেবার মূল কথা।
  • ধর্মের সহজ ব্যাখ্যা – তিনি ইসলাম, খ্রিস্ট, হিন্দু সমস্ত ধর্মেই সিদ্ধিলাভ করেন। তাই তিনি সমস্ত ধর্মের মানুষকেই ঈশ্বরদর্শনের জন্য ধর্মের সহজ পথ দেখিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
  • নারীমুক্তির আদর্শ – নারী ছিল তাঁর কাছে জগন্মাতার প্রতিমূর্তি। নারীর দুর্দশা মোচন ও সমাজে নারীর নেতৃত্বকে তিনি স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মূল্যায়ন –

শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নয়, একজন লোকশিক্ষক হিসেবে শ্রীরামকৃষ্ণের অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁরই কথাকে কাজে পরিণত করেন তাঁর সুযোগ্য শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতের পুনরুত্থানে শ্রীরামকৃষ্ণের অবদান তাই চিরস্মরণীয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বধর্ম সমন্বয় -এর আদর্শ তুলে ধরেন কীভাবে?

অথবা, শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মসমন্বয়ী আদর্শগুলি সংক্ষেপে লেখো।

শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয় -এর ভূমিকা –

খ্রিস্টান মিশনারিদের আক্রমণে হিন্দুসমাজ যখন আক্রান্ত, দলে দলে ইংরেজি-শিক্ষিত যুবকেরা যখন হিন্দুধর্মে শ্রদ্ধা হারিয়ে খ্রিস্ট বা ব্রাহ্মধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছে, সেই সংকটময় মুহূর্তে পরিত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব (1836-1886 খ্রিস্টাব্দ)। দক্ষিণেশ্বরের কালীসাধক এই পুরোহিত বিভিন্ন ধর্ম ও সাধনপদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ‘সর্বধর্মসমন্বয়’ -এর মহান আদর্শ তুলে ধরেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বধর্ম অনুশীলন –

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কালীসাধনা ছেড়ে বিভিন্ন সাধনপদ্ধতি অনুশীলন করেন। এই সাধনপদ্ধতি বিভিন্ন ধর্মমতের ছিল। যেমন –

  • তান্ত্রিক – তিনি এক ভৈরবীর কাছে তন্ত্রসাধনা করেন।
  • বৈষ্ণব – তিনি জটাধারী নামে রামাইত সাধুর কাছে বৈষ্ণবধর্ম চর্চা করেন।
  • বৈদিক মার্গ – তিনি আচার্য তোতাপুরির কাছে বৈদিক মার্গ অনুশীলন করেন এবং সমাধিলাভের পথ খুঁজে পান।
  • ইসলাম – তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত গোবিন্দ রায় -এর কাছ থেকে ইসলাম ধর্মসাধনা শেখেন। সন্ধ্যায় নামাজ পড়েন এবং আল্লামন্ত্র জপ করেন।
  • খ্রিস্ট – তিনি শম্ভুচরণ মল্লিকের কাছ থেকে জিশুখ্রিস্টের জীবনী ও ধর্মমত সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করেন।
  • বৌদ্ধ – তিনি বুদ্ধদেবকে ঈশ্বরের অবতার বলে শ্রদ্ধা ও পূজা করতেন। তিনি বলেন, বৌদ্ধ মতে ও বৈদিক জ্ঞানমার্গে কোনো পার্থক্য নেই।
  • জৈন – তিনি জৈন তীর্থংকরদের এবং বিশেষ করে মহাবীরকে শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর ঘরে বিভিন্ন দেবদেবীর সঙ্গে জিশু ও মহাবীরের একটি পাথরের মূর্তি থাকত। তিনি এইসব ছবি ও মূর্তির সামনে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় ধূপধুনো দিতেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের সমন্বয় –

এইভাবে তিনি বিভিন্ন ধর্ম সম্বন্ধে পরিচয় এবং তাদের সাধনপদ্ধতি ও ফল বুঝতে পারেন। এরপর তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস হয়, সব ধর্মই সত্য – অর্থাৎ যত মত তত পথ।

শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শ –

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের বাণীর মূল কথা হল “শিবজ্ঞানে জীবসেবা”। এজন্য সংসার ত্যাগ করার প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর দেবালয়ে থাকেন না, থাকেন জীবের মধ্যে। জীবসেবাই হল ঈশ্বরসেবা।

শ্রীরামকৃষ্ণের গুরুত্ব –

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের উদার মতাদর্শ সনাতন হিন্দুধর্মকে জাতপাতের বিভেদ ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে হিন্দুধর্ম যেমন প্রাণশক্তি ফিরে পায় তেমনি অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায়, বৈরিতা কমে এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিনাশ ঘটে।

স্বামী বিবেকানন্দ – টীকা লেখো।

শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন নবভারতের রূপকার ও আত্মবিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক। তিনি অধ্যাত্মচেতনা ও দেশপ্রেমকে সমন্বিত করেছিলেন। তিনি পরাধীন ভারতের মানুষকে দেবদেবীদের বাদ দিয়ে ভারতমাতাকে আরাধ্যা দেবীরূপে ভাবতে বলেন। তাঁর ধর্ম ছিল ‘Man making religion’ বা মানুষ তৈরির ধর্ম। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন পথ ও মত অবলম্বন করেন। তাঁর – রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল – বর্তমান ভারত, পরিব্রাজক, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ প্রভৃতি।

স্বামী বিবেকানন্দ - টীকা লেখো।

স্বামী বিবেকানন্দের অবদান –

  • প্রতিষ্ঠাতা – তিনি 1897 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশন, যাকে নবভারতের আনন্দমঠ বলা হয়। 1893 খ্রিস্টাব্দে শিকাগো বিশ্বধর্ম সম্মেলনে অদ্বৈত বেদান্তের জয়গান করে দেশে ফিরে তিনি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল মানবসেবা।
  • কুসংস্কার ও অনাচারের বিরোধিতা – জাতিভেদ, ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক অনাচার, অশিক্ষা, অসাম্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি মানুষকে সোচ্চার হতে বলেছিলেন। তিনি বলতেন, কুসংস্কারহীন সমাজ নতুন দেশগঠনে সহায়তা করবে।
  • সমন্বয়ের আদর্শ – স্বামীজি প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, প্রাচীন ও আধুনিক মতাদর্শ, ধনী-দরিদ্র সবার সহযোগিতায় এক নবভারত গড়তে চেয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন, দেশের প্রকৃত শক্তি হল দেশের শ্রমজীবীরাই।
  • জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত – স্বামীজি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না এলেও স্বাধীনতার একজন উগ্র সমর্থক ছিলেন। ঋষি অরবিন্দ -এর মতে, “বিবেকানন্দই আমাদের জাতীয় জীবনের গঠনকর্তা”।

স্বামী বিবেকানন্দের উপসংহার –

স্বামীজি দেশের মুক্তির জন্য যুবকদের উপর বিশেষভাবে নির্ভর করেছিলেন। অধ্যাপক আর জি প্রধান তাঁকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’ বলে অভিহিত করেছেন।

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের অভিমুখ সম্পর্কে লেখো।

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের ভূমিকা –

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একজন বিখ্যাত ভারতীয় সন্ন্যাসী। তিনি ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রধান শিষ্য। তিনি হিন্দুধর্মকে ভারতে ও ভারতের বাইরে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। ধর্মের নতুন অভিমুখের কথা বলেছিলেন তিনি। তাঁর মতে, মানবজাতির কেবল একটাই ধর্ম হবে, এটা ঠিক নয়। তার পরিবর্তে আমাদের চেষ্টা করা উচিত, যাতে মানুষের নিজের নিজের আদর্শ অভিমুখে চলার পথে সমস্ত বাধা দূর হয়ে যায়।

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্ম –

প্রচলিত মত থেকে স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের অভিমুখ ছিল ভিন্ন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “মানুষের মধ্যে যে দেবত্ব প্রথম থেকেই আছে, তাঁর বিকাশই ধর্ম।” তিনি বলেছেন, পবিত্র আর নিঃস্বার্থ হতে চেষ্টা করো, তার মধ্যেই সমস্ত ধর্ম নিহিত। ধর্ম মানে শুধু মতবাদ নয়, ধর্ম মানে সাধনা। সৎ হওয়া আর সৎ কর্ম করা – এই দুয়ের মধ্যেই মানবধর্ম নিহিত।

  • ধর্মের মূল্য – মানুষ যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় ধর্ম যদি তাকে সাহায্য করতে না পারে, তবে ধর্মের বিশেষ কোনো মূল্য নেই। ধর্মের সাহায্যে মানবজাতির কল্যাণ করতে হলে ধর্মকে এমন হতে হবে যাতে মানুষ যেখানে যে অবস্থায় আছে সেখানেই তার সাহায্য পেতে পারে- দাসত্বে বা পূর্ণ স্বাধীনতায়। ধর্ম মানবজাতিকে সব সময়ে সমানভাবে সাহায্য করতে পারে।
  • ধর্ম সমন্বয় – অতীতে যত ধর্মসম্প্রদায় ছিল স্বামীজি সবগুলিকেই সত্য বলে মনে করতেন। তিনি বলেছেন যে, আমি মুসলমানদের মসজিদে যাব, খ্রিস্টানদের গির্জায় গিয়ে ক্রুশবিদ্ধ প্রভুর সামনে নতজানু হব, বুদ্ধের ও তাঁর ধর্মের শরণ নেব এবং অরণ্যে গিয়ে হিন্দুর পাশে ধ্যানে মগ্ন হব, যাঁরা সকলে জ্যোতি দর্শনে সচেষ্ট। তিনি বলেন, “জগতে বিভিন্ন ধর্মের উপাসনা প্রণালী বিভিন্ন হলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলি এক।”
  • ধর্মের লক্ষ্য ও পথ – বিবেকানন্দের মতে ধর্মের লক্ষ্য হল – ভগবানের সঙ্গে পুনর্মিলন বা দেবত্বে প্রত্যাবর্তন। সাধারণত চার ধরনের মানুষ দেখা যায় – যুক্তিবাদী, ভাবপ্রবণ, রহস্যবাদী এবং কর্মী। এদের প্রত্যেকের জন্যই উপযুক্ত সাধনপথ আছে। দেবত্বে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্য ও পদ্ধতিকে যোগ বলা হয়। যোগ মানে যা ঈশ্বর ও আমাদের প্রকৃত স্বরূপের সঙ্গে সংযোগ ঘটায়। এইরকম যোগ বা যুক্ত হওয়ার পদ্ধতি হল – কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, রাজযোগ ও জ্ঞানযোগ।

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের উপসংহার –

বিবেকানন্দ বলেছেন, প্রত্যেকের উচিত তার উপযুক্ত পথ অনুসরণ করে চলা। তবে এ যুগে কর্মযোগের উপরেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাঁর মতে, ‘Work is Worship’ – কর্মই ধর্ম।

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের আদর্শ ব্যাখ্যা করো।

অথবা, স্বামীজির নব্য বেদান্ত ব্যাখ্যা করো।

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের ভূমিকা –

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত (1863-1902 খ্রিস্টাব্দ)। তিনি পরে বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও গুরুদেব রামকৃষ্ণের শিবজ্ঞানে জীবসেবা এবং যত মত তত পথ – এই বাণী দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। গুরুদেবের এই বাণী ও হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের জন্য বিবেকানন্দ 1893 খ্রিস্টাব্দে শিকাগো বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগ দেন। তাঁর চেষ্টায় হিন্দুধর্মের খ্যাতি বাংলার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, গড়ে ওঠে নব্য বেদান্তবাদ।

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মীয় আদর্শ –

রোমমোহন রায়, দয়ানন্দ সরস্বতীর মতো বিবেকানন্দ সনাতন হিন্দুধর্মের অতীত গরিমায় আপ্লুত ছিলেন। বৈদান্তিক হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান তাঁর কাম্য ছিল। এর পাশাপাশি তিনি পরধর্মসহিষ্ণুতাও দেখান। তিনি চেয়েছিলেন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের রজঃ ও তমঃ গুণের সমন্বয়ে এক নতুন ভারত জেগে উঠুক।

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের আদর্শ ব্যাখ্যা করো।

স্বামী বিবেকানন্দের নব্য বেদান্ত –

আধুনিক বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারগুলি ছিল বেদান্তের প্রতিধ্বনিমাত্র। বেদান্ত জ্ঞান, মূর্তিপূজা, পৌরাণিক কাহিনি, বৌদ্ধ অজ্ঞেয়বাদ, জৈন নিরীশ্বরবাদ সবই হিন্দুধর্মে আছে। অন্য ধর্মে কতকগুলি নিয়ম স্থির করে সকলকে মেনে চলতে বলা হয় বা বাধ্য করা হয়। হিন্দুধর্মে সাপেক্ষকে আশ্রয় করে নিরপেক্ষ তত্ত্বের ধারণা প্রকাশ করা সম্ভব। বিবেকানন্দ জীবদেহ, আত্মা ও পরমাত্মার সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, আত্মা কোনও পদার্থ থেকে সৃষ্ট নয়। বেদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, দেহ নষ্ট হলেও আত্মা নষ্ট হয় না। আত্মা জড় নিয়মে চলে না। আত্মা হল নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্তস্বভাব, অনাদি, অমর ও পূর্ণ। আত্মা ব্রহ্মস্বরূপ, তা পঞ্চভূতে আবদ্ধ। হিন্দুদের অদ্বৈতবাদই ধর্মবিজ্ঞানের চরম সিদ্ধান্ত, মূল শক্তি – অর্থাৎ যে শক্তি থেকে অন্যান্য শক্তির সৃষ্টি হয়েছে, তা আবিষ্কার করাই বিজ্ঞানের লক্ষ্য। অদ্বৈতবাদ পরিবর্তনশীল জগতের কারণ। আত্মা, পরমাত্মা, বহুঈশ্বরবাদ ও দ্বৈতবাদ থেকে অদ্বৈতবাদে পৌঁছোতে হয়।

এই ধর্মীয় ব্যাখ্যার সঙ্গে বিবেকানন্দ মানবসেবার আদর্শ যোগ করেন। তিনি বলেন, বনের বেদান্তকে ঘরে আনতে হবে। জীবনের সঙ্গে বেদান্তকে মেলাতে হবে। জনসেবার আদর্শ ও কর্মযোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এজন্য তিনি পাশ্চাত্যের কর্মযোগ, আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায়, উদ্যম ও নিষ্ঠাকে গ্রহণ এবং তার সঙ্গে ভারতের অধ্যাত্মবাদ ও মানবতাকে যুক্ত করতে বলেন। সমষ্টির মুক্তি ছাড়া ব্যক্তির মুক্তি সম্ভব নয় – এই হল বিবেকানন্দের নব্য বেদান্তবাদ।

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের মূল্যায়ন –

কন্যাকুমারীর শিলাখণ্ডে বসে তিনি চিন্তা করেছিলেন, ব্যক্তিগত মোক্ষলাভের চেয়ে ভারতবাসীর সেবাই চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি বলেন, “Motion is the sign of life”, তাই তাঁর এই নব্য বেদান্তবাদ ছিল বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী যথাযথ। গুরু রামকৃষ্ণের আদর্শ অনুসরণ করে ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’-র জন্য তিনি 1897 খ্রিস্টাব্দে বেলুড়ে ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন।

ভারতীয় জাতীয় জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভারতীয় জাতীয় জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা –

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্য ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি পরে বিবেকানন্দ (1863-1902 খ্রিস্টাব্দ) নামে পরিচিত হন। গুরুদেব রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর গুরুর আদর্শ অনুসরণ করে ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র জন্য তিনি 1897 খ্রিস্টাব্দে বেলুড়মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ও পাশ্চাত্যের দেশভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি উপলব্ধি করেন, ব্যক্তিগত মোক্ষলাভের চেয়ে ভারতবাসীর সামগ্রিক মঙ্গল লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই লক্ষ্যপূরণের জন্য তিনি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

ভারতীয় জাতীয় জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভারতীয় জাতীয় জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের কার্যাবলি –

বিবেকানন্দের চিন্তাধারায় ছিল নতুন ভারত গঠন। নতুন ভারত গঠনের জন্য –

  • তিনি বেলুড় মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। রামকৃষ্ণের শিষ্যমণ্ডলী এই মিশনে কেবল ধর্মচর্চা করতেন না, দীনদরিদ্র ও আর্তের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেন।
  • বিবেকানন্দ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলি হল – বর্তমান ভারত, পরিব্রাজক, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ প্রভৃতি। এই গ্রন্থগুলি শিক্ষিত বাঙালি ও বিপ্লবীদের প্রেরণা জোগায়।
  • তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে নানান বাণী প্রয়োগ করেন। যেমন – ‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত’, ‘অভীঃ’ প্রভৃতি।
  • তিনি আমেরিকার শিকাগো শহরে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেন।

ভারতীয় জাতীয় জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদ –

বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি মানবতাবাদ ও জাতীয়তাবাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। পরাধীন ভারতবাসীর দারিদ্র্য, জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি কুপ্রথা তাঁকে ব্যথিত করে। দেশগঠনের জন্য তিনি যুবসমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেছিলেন, “ওঠো, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছোনো পর্যন্ত থেমো না”। তিনি আরও বলেছিলেন, গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলার দ্বারা ঈশ্বরের কাছাকাছি যাওয়া যায়। “ভুলিও না, দরিদ্র ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী তোমার রক্ত, তোমার ভাই” -এই বাণীর দ্বারা তিনি ভারতবর্ষ থেকে অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ দূর করতে চেয়েছিলেন। কর্মযোগে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন যুবসমাজকে। পরবর্তীকালে তাঁর চিন্তাধারা ও বাণীতে অনেকে উদ্বুদ্ধ হন। তাঁদের মধ্যে সুভাষচন্দ্র বসুর মতো জাতীয় নেতাও ছিলেন।

ভারতীয় জাতীয় জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান –

বিবেকানন্দ তাঁর কার্যাবলি ও বাণী দ্বারা হতাশাগ্রস্ত জাতির শিরায় মাদকতার সঞ্চার করেন। বিবেকানন্দ তাঁর বাণীর মাধ্যমে বাস্তবকে ফুটিয়ে তোলেন। সমাজের সব স্তরের মানুষকে নিয়ে নতুন ভারত গড়ার ডাক দেন।

লালন ফকির সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

লালন ফকির ছিলেন বাউল সাধনার প্রধান গুরু। তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ বাউল গান রচয়িতা ও গায়ক। তিনি প্রায় দুহাজার গান রচনা করেন। তাঁর সহজসরল অথচ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ মর্মস্পর্শী গানগুলি মানবজীবনের আদর্শ ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে।

লালনের পূর্ব পরিচয় –

লালন 1179 বঙ্গাব্দের 1 কার্তিক (1772 খ্রিস্টাব্দে) ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে অনেকে বলেন তাঁর জন্ম হয় কুষ্টিয়া জেলার ভাঁড়রা গ্রামে। জানা যায়, লালন এক কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। লালন একবার তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে বসন্তরোগে আক্রান্ত হন। এই সময় তাঁর সঙ্গীসাথিরা তাঁকে ফেলে রেখে চলে যায়। পরে সিরাজ সাঁই নামে এক মুসলমান ফকির সেবাশুশ্রূষা করে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন।

লালন ফকির সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

লালন ফকিরের বাউল লালন –

লালন সিরাজ সাঁই -এর কাছে বাউলধর্মে দীক্ষা নেন। তিনি ছেউড়িয়ায় বাউল আখড়া তৈরি করে শিষ্য-সহ বসবাস করেন।

লালন ফকিরের গান –

লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তবে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর গান সকল ধর্মের মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয় ছিল। তিনি নিজেই গান লিখতেন, তাতে সুর দিতেন এবং গাইতেন।

তিনি জাতিভেদ প্রথা মানতেন না। তাঁর গান ছিল মর্মস্পর্শী মানবতাবাদী আদর্শে পূর্ণ। তাই তিনি গেয়েছেন –

“সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।
লালন কয় জাতির কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।।”

তাঁর বিখ্যাত গানগুলি হল –

“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।”
“আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে।”

লালনের গান ও দর্শন রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুলের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রভাবিত করেছে। তাঁর গান এতই জনপ্রিয় যে সাধারণ মানুষ, মাঝিমাল্লা সব শ্রেণির মানুষের মুখে এই গান শোনা যায়।

লালন ফকিরের মৃত্যু –

1279 বঙ্গাব্দের 1 কার্তিক (1890 খ্রিস্টাব্দের 17 অক্টোবর) ছেউড়িয়ায় লালনের মৃত্যু হয়। তাঁর ভক্তরা প্রতি বছর দোলপূর্ণিমায় তাঁর মাজারে সমবেত হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। উনিশ শতকের রক্ষণশীল ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যে লালন তাঁর সহজসরল বাউল মতাদর্শের মাধ্যমে জাতিভেদ প্রথার কঠোরতাকে অবলীলায় অস্বীকার করার ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম আচার্য। তিনি নব্য বৈষ্ণববাদের প্রবক্তা ছিলেন।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর জন্ম –

1841 খ্রিস্টাব্দে নদিয়া জেলার দহকুল গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অদ্বৈতাচার্যের বংশধর ছিলেন।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিক্ষা –

বিজয়কৃষ্ণ শান্তিপুরে গোবিন্দ গোস্বামীর টোলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি কলকাতায় সংস্কৃত কলেজেও পড়াশোনা করেন। কিছুদিন তিনি মেডিক্যাল কলেজেও অধ্যয়ন করেছিলেন।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর ব্রাহ্মসমাজে যোগদান –

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহে ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের কাজে তিনি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ান। ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গেও তিনি কাজ করেন। 1863 খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্মসমাজের আচার্য হন। তাঁর উদ্যোগে শান্তিপুর, ময়মনসিংহ, গয়া প্রভৃতি অঞ্চলে ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নব্য বৈষ্ণব আন্দোলন –

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী গয়াতে সাধুদের সংস্পর্শে এসে বৈষ্ণবধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের মতভেদ হয় এবং তিনি 1888 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণবধর্ম সাধনায় মগ্ন হন। তিনি যে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন, তা নব্য বৈষ্ণবধর্ম নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন নব্য বৈষ্ণব আন্দোলনের প্রধান স্থপতি।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নারীজাতির উন্নতি ও নারীশিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি শিক্ষার প্রসার ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মৃত্যু –

1306 বঙ্গাব্দের 22 জৈষ্ঠ (1899 খ্রিস্টাব্দ) তিনি পুরীতে মারা যান। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন – বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপট কী ছিল?

বাংলার নবজাগরণের ভূমিকা –

উনিশ শতকে বাংলায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে, তাকে বাংলার নবজাগরণ বলে গণ্য করা হয়। এই নবজাগরণের উদ্ভব হয়েছিল কলকাতায়। মূলত বাংলার নবজাগরণের সূচনা হয় রাজা রামমোহন রায়ের সময় থেকে এবং এর শেষ ধরা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কালকে।

বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপট –

বাংলার নবজাগরণের পটভূমি রচনায় সহায়ক হয়েছিল –

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ –

গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি 1800 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে দেশীয় পণ্ডিতদের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তাদের ভারতীয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির আদানপ্রদানের জন্য উৎসাহিত করা হয়।

বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপট কী ছিল?

বাংলায় ইউরোপীয় শিক্ষা ও পাঠ্যপুস্তক –

ইউরোপীয়দের প্রচেষ্টায় বাংলায় ইউরোপীয় শিক্ষাপদ্ধতি চালু হয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য ভালো পাঠ্যবই রচনা করা হয়। এজন্য ডেভিড হেয়ার ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দু কলেজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এটি ছিল ইউরোপীয় আদলে উচ্চশিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান।

সংবাদপত্র ও গ্রন্থরচনা –

বাংলার নবজাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ইংরেজি ও বাংলায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র ও গ্রন্থ। বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলনের পর এখানে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় অনেক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় ও বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হয়। এর ফলে বাংলায় শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপট রচিত হয়।

গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা –

গ্রন্থাগার শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা আধুনিক চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ হয়।

বাংলার নবজাগরণের উপসংহার –

ব্রিটিশ আমলে বাংলার বিদ্বজ্জনেরা আধুনিক বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়। তারা ইউরোপীয় ঘটনাবলি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে। এর ফলে বাংলার বিদ্বজ্জনেরাও বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয় এবং বাংলায় নবজাগরণ ঘটে।

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের ভূমিকা –

উনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণ ঘটেছিল। বাংলায় নবজাগরণ ঘটার প্রধান কারণ ছিল – বাংলাতেই প্রথম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলার কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজধানী ও পাশ্চাত্য শিক্ষার কেন্দ্র। একদল বাঙালি এই পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উদারতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত হয়েছিলেন। তারা বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার প্রসার, সমাজসংস্কার, সাহিত্য রচনা ও শিল্পচর্চায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাদেরই প্রচেষ্টার ফল ছিল উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ।

বাংলার নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য –

বাংলার নবজাগরণের ধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • উচ্চশ্রেণির জাগরণ – বাংলার নবজাগরণ উচ্চশিক্ষিত ও সমাজের তথাকথিত উঁচু শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই সম্প্রদায় ছিল মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। এই সম্প্রদায় ‘মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক’ বলেও পরিচিত। এই কারণে অধ্যাপক অনিল শীল উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণকে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেছেন।
  • শহরকেন্দ্রিক জাগরণ – উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক, বিশেষত কলকাতাকেন্দ্রিক। এতে শহরের ধনী ব্যক্তি ও শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করেছিল। এর সঙ্গে গ্রামের সাধারণ মানুষের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না এবং তাদের উপর এর কোনো প্রভাবও পড়েনি।
  • হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধতা – উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময়ের সংস্কার আন্দোলনের প্রচেষ্টা হিন্দুসমাজ ও ধর্মকে অতিক্রম করতে পারেনি। সমাজের একটি বড়ো অংশের মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও তাদের মধ্যে এই সংস্কারের প্রসার ঘটেনি।
  • ব্রিটিশ সরকার-নির্ভর জাগরণ – বাংলার নবজাগরণ ব্রিটিশ শাসননির্ভর ছিল। সমাজ সংস্কারকগণ তাদের সাফল্যের জন্য ব্রিটিশ সরকারের অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছিলেন। তা ছাড়া পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে ব্রিটিশ সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সেই সময় সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষেরা মনে করতেন, এই বিদেশি শাসনের ফলেই ভারতের মঙ্গল সাধিত হবে। এজন্য ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেছেন যে, ইংরেজদের দেওয়া সবচেয়ে বড়ো উপহার হল উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ।

ইটালির রেনেসাঁর সঙ্গে বাংলার রেনেসাঁর সাদৃশ্য কী ছিল?

ইটালির রেনেসাঁর সঙ্গে বাংলার রেনেসাঁর সাদৃশ্য –

ইটালির রেনেসাঁর সঙ্গে বাংলার রেনেসাঁর সাদৃশ্যগুলি হল নিম্নরূপ –

  • প্রথমত – মধ্যযুগীয় অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের হাত থেকে রেনেসাঁর ইটালি ইউরোপকে যেমন প্রথম মুক্তির পথ দেখায় ঠিক তেমনি ভারতের মধ্যযুগের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের হাত থেকে উনিশ শতকের বাংলা মুক্তির পথ দেখায়।
  • দ্বিতীয়ত – ইটালির রেনেসাঁয় ধ্রুপদি সাহিত্য, যথা – গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যের ব্যাপক চর্চা হয়; তেমনি উনিশ শতকে বাংলায় প্রাচ্যবাদীরা ভারতের প্রাচীন সংস্কৃত এবং মধ্যযুগের ফারসি সাহিত্যের চর্চা করেন।
  • তৃতীয়ত – ইটালির রেনেসাঁর মানবতাবাদ আমরা রামমোহন, বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার আন্দোলনের মধ্যে বিকশিত হতে দেখি।
  • চতুর্থত – ইটালির রেনেসাঁতে যে স্বাধীন ও যুক্তিবাদী মানসিকতা দেখা যায়, বাংলায় ডিরোজিও ও তাঁর শিষ্যদের (নব্যবঙ্গ) প্রচলিত কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনেও সেই যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব দেখা যায়।
  • পঞ্চমত – ইটালির নবজাগরণে মেদিচি পরিবারের যে ভূমিকা ছিল, বাংলার নবজাগরণে ঠাকুর পরিবারের সেইরূপ ভূমিকা ছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন।

যাই হোক, রেনেসাঁপ্রসূত যুক্তিবাদ ও বস্তুবাদ থেকে বিজ্ঞানচর্চার প্রচেষ্টা শুরু হয়। এই কারণেই উনিশ শতকের নবজাগরণকে বাংলার রেনেসাঁ বলা হয়ে থাকে।

উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা এবং গুরুত্ব কী ছিল?

উনিশ শতকের নবজাগরণের বেশ কিছু ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল বিশেষ গুরুত্বও।

বাংলার নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা –

  • উচ্চশ্রেণির আন্দোলন – উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণকে অনেকে এলিটিস্ট (Elitist) আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। পণ্ডিতদের মতে, এই আন্দোলন মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিত লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এরা নিজেদের স্বার্থের জন্য ইংরেজ সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকত। এরা নিজেদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থ উপেক্ষা করে বৃহত্তর সমাজের মঙ্গলচিন্তা করেনি। সমাজের বৃহত্তর অংশ ছিল নির্যাতিত কৃষকশ্রেণি।
  • হিন্দুসমাজের আন্দোলন – বাংলার নবজাগরণ অনেকাংশে হিন্দুসমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময়ের সংস্কার-প্রচেষ্টা হিন্দুধর্ম ও সমাজকে অতিক্রম করতে পারেনি। অথচ সমাজের একটা বড়ো অংশ ছিল মুসলমান শ্রেণির মানুষ।
  • শহুরে আন্দোলন – এই নবজাগরণ ছিল শহরের শিক্ষিত, চাকুরিজীবী ও ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে এর কোনো প্রভাব ছিল না।
  • বৈপ্লবিক পরিবর্তনে ব্যর্থ – এই সংস্কার আন্দোলনেও সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়নি। এই সময়ের সংস্কারকরা ধর্ম ও সমাজকে অবিকৃত রেখে কিছু সংস্কার করতে চেয়েছিলেন মাত্র। এমনকি তারা কোম্পানির সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র সম্পর্কেও উদাসীন ছিলেন।

বাংলার নবজাগরণের গুরুত্ব –

কিছু ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলনকে দুর্বল করেছিল। তবে এক্ষেত্রে কিছু সমস্যার কথাও মনে রাখা দরকার। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেছেন, আমাদের নবজাগরণকে আধা-ঔপনিবেশিক ও বৈদেশিক শাসনকাঠামোর মধ্যে বিকাশ লাভ করতে হয়েছিল। তাই এই নবজাগরণ তার পূর্ণ প্রাণশক্তি লাভ করতে পারেনি।

তবে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে, বিশ শতকের জাতীয় আন্দোলনের বীজ উনিশ শতকের নবজাগরণের মধ্যেই নিহিত ছিল। তাই একে নবভারতের অগ্রদূত বলা যায়।


আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় “সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Please Share This Article

Related Posts

মাধ্যমিক ইতিহাস - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – বিষয়সংক্ষেপ

About The Author

Solution Wbbse

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর