মাধ্যমিক ইতিহাস – সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

Rohit Mondal

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় “সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর থেকে “সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
Contents Show

উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের ভারতবাসীর ক্ষোভের কারণ কী ছিল?

ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের ভারতবাসীর ক্ষোভের কারণ –

উনিশ শতকে ভারতবর্ষের বেশিরভাগ অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এর পশ্চাতে নানাবিধ কারণ ছিল। যেমন –

  • অর্থনৈতিক শোষণ – ব্রিটিশদের চরম অর্থনৈতিক শোষণের ফলে ভারতবর্ষের চিরাচরিত অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
  • অতিরিক্ত করের বোঝা – কৃষকদের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা তাদের সর্বস্বান্ত করে দিয়েছিল ফলে ভারতবাসীর মনে অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হতে থাকে।
  • সাম্রাজ্যবাদী নীতি – ঔপনিবেশিক শাসকের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও ভারতীয়দের প্রতি বর্বর আচরণ প্রভৃতির ফলে ভারতবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড ক্যানিং -এর শাসনকালে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহি, রাজা-মহারাজা ও জনগণের অসন্তোষকে কেন্দ্র করে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। নানা কারণে এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ কারণ ছিল – সিপাহিদের মধ্যে এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজের ব্যবহার সংক্রান্ত অসন্তোষ।

এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজ ব্যবহার –

এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজের (টোটা) মোড়কটি দাঁতে কেটে বন্দুকের মধ্যে ভরতে হত। রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, ওই মোড়কটিতে গোরু ও শূকরের চর্বি মাখানো থাকে। ফলে ধর্মচ্যুত হওয়ার ভয়ে হিন্দু ও মুসলমান সিপাহিরা এই কার্তুজ ব্যবহার করতে অসম্মত হয়।

মঙ্গল পাণ্ডে কে ছিলেন?

ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহি, রাজা-মহারাজা ও জনগণের অসন্তোষকে কেন্দ্র করে 1857 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড ক্যানিং -এর শাসনকালে বিদ্রোহের সূচনা হয়। মঙ্গল পাণ্ডে ছিলেন এই বিদ্রোহের প্রথম শহিদ।

মঙ্গল পাণ্ডের ভূমিকা –

মঙ্গল পাণ্ডে ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যারাকপুর সেনানিবাসের 34 নং বেঙ্গল আর্মির সিপাহি। এনফিল্ড রাইফেলের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম সিপাহিরা ধর্মনাশের আশঙ্কা করে এবং মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহের মাধ্যমে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলির নাম লেখো। কোন্ কোন্ ইংরেজ সেনাপতি বিদ্রোহ দমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র –

1857 খ্রিস্টাব্দের ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহের সূচনা হলেও ক্রমশ তা সমগ্র ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলি হল – দিল্লি, আলিগড়, লখনউ, বেরিলি, কানপুর, ঝাঁসি, ফৈজাবাদ, মুলতান, চট্টগ্রাম, ঢাকা প্রভৃতি। বিদ্রোহী সিপাহিরা মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করলেও তাদের সমর্থক ও নেতৃত্বে ছিলেন দেশীয় শাসকবৃন্দ।

ইংরেজ সেনাপতিগণ –

যেসকল ইংরেজ সেনাপতি বিদ্রোহ দমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল তারা হল – আউট্রাম, ক্যাম্পবেল, স্যার জন লরেন্স, হ্যাভলক প্রমুখ।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের নেতা-নেত্রী কারা ছিলেন?

বিভিন্ন নেতা-নেত্রী 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ পরিচালনা করেছিলেন।

বিদ্রোহের নেতা-নেত্রী –

এই বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য নেতা-নেত্রীরা ছিলেন –

  • দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ – সিপাহিরা তাঁকে ‘হিন্দুস্তানের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করে। দিল্লিতে তিনি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
  • লক্ষ্মীবাঈ – ঝাঁসিতে বিদ্রোহের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন রানি লক্ষ্মীবাঈ।
  • অন্যান্য – নানাসাহেব কানপুরে, হজরত মহল লখনউতে, আহমদউল্লাহ ফৈজাবাদে, কুনওয়ার সিং জগদীশপুরে নেতৃত্ব দেন।

লক্ষ্মীবাঈ কেন ভারত ইতিহাসে স্মরণীয়?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ -এর ভূমিকা –

  • লর্ড ডালহৌসি ভারতে স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে বহু দেশীয় রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ঝাঁসি। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
  • রানি লক্ষ্মীবাঈ গোয়ালিয়র দুর্গ জয় করেছিলেন কিন্তু শেষ অবধি 1858 খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। একজন নারী হয়েও ইংরেজদের বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে যেভাবে তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন সেই কারণে ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয়।

নানাসাহেব কে ছিলেন? তিনি কেন স্মরণীয়?

ভারত ইতিহাসে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই বিদ্রোহে দেশীয় রাজন্যবর্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

নানাসাহেবের ভূমিকা –

মারাঠা পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও -এর দত্তকপুত্র ছিলেন নানাসাহেব। 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ চলাকালীন লর্ড ডালহৌসি নানাসাহেবের পেশোয়া পদ বিলুপ্ত করেন এবং তাঁর বার্ষিক বৃত্তি বন্ধ করে দেন।

এর প্রতিবাদে নানাসাহেব বিদ্রোহে যোগদান করেন। কানপুরে নানাসাহেবের পক্ষে তাঁতিয়া তোপি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সাময়িকভাবে তাদের বিতাড়িত করেছিলেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় হিন্দু-মুসলিম মৈত্রীর পরিচয় দাও।

হিন্দু-মুসলিম সিপাহিদের ধর্মনাশের আশঙ্কা থেকে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূচনা হয়।

হিন্দু-মুসলিম মৈত্রী –

  • আজমগড় ঘোষণা – সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের পক্ষ থেকে এই ঘোষণায় ইংরেজ রাজত্বের অবসানের জন্য হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের আবেদন ছিল।
  • দিল্লি ঘোষণা – সম্রাট এই ঘোষণায় দিল্লি ও বেরিলিতে গো-হত্যা বন্ধের আদেশ দেন। এ ছাড়া হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিদ্রোহী সিপাহি ও নেতা-নেত্রীদের সদ্ভাব বজায় ছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনাকে কি ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলা যায়?

অথবা, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলার কারণ কী?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলার কারণ –

বিভিন্ন কারণের জন্য 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সিপাহি বিদ্রোহ বলা হয়। যথা –

  • বিদ্রোহের সূচনা – এই বিদ্রোহ শুরু করেছিল দেশীয় সিপাহিদের একাংশ। বহরমপুর, ব্যারাকপুর, মিরাট, দিল্লি, লখনউ প্রভৃতি সেনানিবাসে বিদ্রোহের সূচনা হয়।
  • নেতৃত্ব – এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব ও প্রাণশক্তি ছিল সিপাহিরা।
  • শাস্তি – বিদ্রোহ শেষে প্রধানত বিদ্রোহী সিপাহিরাই শাস্তিলাভ করে। চার্লস রেক্স, কে ম্যালেসন, স্যার সৈয়দ আহমদ খান একই মত পোষণ করেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে বিদ্রোহী সিপাহিদের ভূমিকা কী ছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে অনেকে সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেন। এই বিদ্রোহে সিপাহিদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা লক্ষ করা যায়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহী সিপাহিদের ভূমিকা –

  • ইতিবাচক – বিদ্রোহী সিপাহিরা স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বহু এলাকায় ইংরেজ প্রশাসনের বিলোপ ঘটায়।
  • নেতিবাচক – তারা অনেক অসামরিক ইংরেজদের হত্যা করে, লুঠপাট চালায় এবং সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে। এই বিদ্রোহের প্রাণশক্তি ছিল বিদ্রোহী সিপাহিরা। কোথাও কোথাও অপ্রীতিকর কাজ করলেও তারাই ছিল বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া’ বলার কারণ কী?

ভারত ইতিহাসে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে রমেশচন্দ্র মজুমদার, তালমিজ খালদুন প্রমুখ ‘সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া’ বলার যুক্তি ও তথ্য –

  • সিংহাসন পুনরুদ্ধার – মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ -এর সম্রাটপদ বিলুপ্ত হয়। লক্ষ্মীবাঈ -এর ঝাঁসি ব্রিটিশরা দখল করে নেয়। পেশোয়ার দত্তকপুত্র নানাসাহেব -এর বৃত্তি বন্ধ করা হয়। হজরত মহল -এর অযোধ্যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এমনকি তালুকদাররাও তাদের জমি হারান।
  • ইংরেজ বিতাড়ন – ইংরেজদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও সামন্ত গোষ্ঠী পাশ্চাত্য সভ্যতার ঘোরতর বিরোধী ছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলে উল্লেখ করেছেন?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলার কারণ –

ইংল্যান্ডের টোরি দলের নেতা ডিসরেলি-সহ সমকালীন বিভিন্ন ইংরেজ ঐতিহাসিক, যেমন – নর্টন, ডাফ, আউট্রাম, হোমস, চার্লস বল প্রমুখ এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলেছেন, কারণ তাদের মতে –

  • ভারতীয় সিপাহিরা এই বিদ্রোহ শুরু করলেও পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন স্থানের মানুষ এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল।
  • ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব প্রমুখ রাজন্যবর্গ, বহু জমিদার ও তালুকদার এই বিদ্রোহে যোগদান করেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা, কেন ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেছেন?

অথবা, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘জাতীয় উত্থান’ বা ‘প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলার কারণ কী?

ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম –

বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর ‘The Indian War of Independence’ গ্রন্থে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর এই মত সমর্থন করেছেন কার্ল মার্কস, সুশোভন সরকার প্রমুখ।

‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করার যুক্তি ও তথ্যসমূহ –

এই বিদ্রোহকে জাতীয় উত্থান বা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলার যুক্তি ও তথ্যগুলি হল –

  • জনগণের অংশগ্রহণ – এই বিদ্রোহে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করে।
  • ব্যাপকতা – এই বিদ্রোহ আঞ্চলিক ছিল না। ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলা যায় না কেন?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ না বলার কারণ –

সুরেন্দ্রনাথ সেন, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ঐতিহাসিক 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ বলতে রাজি নন। তাঁদের মতে –

  • সমস্ত ভারতবাসী এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেনি। বরং অনেক ভারতীয় রাজা, শিখ ও গোর্খা সৈনিক বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ সরকারকে সাহায্য করেছিল।
  • বিদ্রোহীদের কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না। তা ছাড়া 1857 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশলাভ করেনি।

নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকরা 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কীভাবে দেখেছেন?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারত ইতিহাসে সিপাহি বিদ্রোহ নামে পরিচিত। কিন্তু এই বিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সিপাহি ছাড়াও কৃষক, সাধারণ মানুষ, জমিদার, রাজা-রানিরাও এতে অংশগ্রহণ করেন। তাই ভারত ইতিহাসে এই বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকমহলে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকদের অভিমত –

  • নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকগণ, যেমন – অধ্যাপক রণজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র প্রমুখ এই বিদ্রোহের গণচরিত্রের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
  • নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকরা বিদ্রোহে সাধারণ মানুষ তথা নিম্নবর্গের ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কথা বলেছেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের গণচরিত্রের বিবরণ দাও।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কেবল সিপাহিদের বিদ্রোহ ছিল না -এই বিদ্রোহে বহু সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের গণচরিত্র –

  • জমিদার – নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় অযোধ্যার তালুকদাররা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা বিদ্রোহে যোগ দেয়।
  • সাধারণ মানুষ – ইংরেজবিরোধী সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী এবং মুসলিমরা বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।
  • উপজাতি – বিভিন্ন উপজাতিরাও এই বিদ্রোহে যোগদান করে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় গণ অভ্যুত্থানের প্রকৃতি কেমন ছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। ফলে বিদ্রোহ কোথাও কোথাও গণ অভ্যুত্থানের রূপ ধারণ করে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় গণ গণঅভ্যুত্থান –

  • লুঠপাট – জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ী এমনকি ইংরেজদের বাসভবন আক্রমণ ও লুঠপাট চালানোর লক্ষ্যে দলে দলে মানুষ অস্ত্র নিয়ে পথে নামে।
  • হত্যাকাণ্ড – ইংরেজ ও মিশনারিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড চালায়।

তবে গণ অভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্যগুলি সব জায়গায় একইরকম ছিল না। অনেক জায়গায় হত্যাকাণ্ড ঘটেনি -এমন প্রমাণও পাওয়া যায়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ অযোধ্যায় কেন গণবিদ্রোহের রূপ লাভ করে?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ অযোধ্যায় ভিন্ন মাত্রা পায়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ অযোধ্যায় গণবিদ্রোহের কারণ –

  • রাজ্যগ্রাস – লর্ড ডালহৌসি কুশাসনের অভিযোগে অযোধ্যা রাজ্য গ্রাস করেন।
  • নতুন জমি বন্দোবস্ত – এর ফলে তালুকদাররা জমি হারায়।
  • ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণি – বেকার সৈনিক, কর্মচারী এবং শোষিত জনগণ ইংরেজবিরোধী হয়ে ওঠে।

ইংরেজদের অযোধ্যা গ্রাস অযোধ্যাবাসী মেনে নিতে পারেনি। অযোধ্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা দারুণভাবে ইংরেজবিরোধী হয়ে ওঠে। তারা মাত্র 10 দিনে অযোধ্যায় ইংরেজ শাসনের বিলোপ ঘটায়।

1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনার ‘মহাবিদ্রোহ’ নামকরণ কতটা যুক্তিযুক্ত?

ঐতিহাসিকরা 1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনাকে সিপাহি বিদ্রোহ, সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনার মহাবিদ্রোহে ঐতিহাসিকদের মত –

  • সিপাহি বিদ্রোহ – চার্লস রেক্স, কে ম্যালেসন প্রমুখ ইংরেজ ঐতিহাসিক এবং দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রমুখ বিশিষ্ট ভারতীয়দের মতে এটা ছিল সিপাহি বিদ্রোহ।
  • সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া – পি সি যোশি, তালমিজ খালদুন, রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে এটা ছিল সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া।
  • প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম – অধ্যাপক সুশোভন সরকার, সাভারকর, কার্ল মার্কস এই ঘটনাকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।

ঐতিহাসিকদের মতভেদের কারণে এই তিনটি মতের কোনোটিকেও গ্রহণ না করে এই ঘটনাকে মহাবিদ্রোহ বা মহা অভ্যুত্থান বলা যেতে পারে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালিদের মনোভাব কেমন ছিল?

শিক্ষিত বাঙালিরা 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিরোধিতা করে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি মনোভাবের পরিচিতি –

  • বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব – কিশোরীচাঁদ মিত্র, শম্ভুচন্দ্র মুখার্জি, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখের মতে, এটি ছিল মূলত সৈনিকদের বিদ্রোহ। রাজা রাধাকান্ত দেব, কালীপ্রসন্ন সিংহ, হরেন্দ্র ঘোষ বিদ্রোহী সিপাহিদের নিন্দা ও সরকারকে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
  • প্রতিষ্ঠান – হিন্দু ও মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল যথাক্রমে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ও মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন। সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা করার প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানগুলি।

নিজেদের সুযোগসুবিধা লোপ পাবে এই ভয়ে শিক্ষিত বাঙালিরা বিদ্রোহ দমনে উৎসাহী ছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত কী?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকমহলে বিতর্ক রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের বক্তব্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত –

  • ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘The Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, এই বিদ্রোহে জনগণের সমর্থন গণবিদ্রোহের রূপ নেয়নি।
  • তাঁর মতে, এই বিদ্রোহ ছিল ক্ষয়িষ্ণু অভিজাততন্ত্র ও মৃতপ্রায় সামন্তদের ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’।
  • তিনি আরও বলেছেন, বেশ কিছু দেশীয় রাজ্যের রাজা বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল কী ছিল?

বড়োলাট লর্ড ক্যানিং -এর শাসনকালে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিল। ইতিহাসে এই বিদ্রোহের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল –

  • ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটেছিল।
  • স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল করা হয়েছিল।
  • উচ্চ সামরিক পদে ভারতীয়দের সংখ্যা কমিয়ে ইউরোপীয়দের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছিল।
  • ভারতে মুঘল শাসনের অবসান ঘটেছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর সামরিক বিভাগে কী কী পরিবর্তন করা হয়েছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ভারতের সামরিক বিভাগে কয়েকটি পরিবর্তন করা হয়েছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সামরিক সংস্কার –

সামরিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনগুলি হল –

  • সামরিক বিভাগে ইউরোপীয় সৈন্যসংখ্যা বাড়ানো হয়েছিল।
  • ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য পৃথকভাবে শিখ, মারাঠা ও গোর্খা রেজিমেন্ট গঠন করা হয়েছিল।
  • গোলন্দাজ বাহিনীকে সম্পূর্ণ ইউরোপীয় সেনাদের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল।

1858 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন কী?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে ভারতের শাসনভার রাখতে চায়নি। ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির শাসনের পরিবর্তে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য 1858 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন প্রণীত হয়।

1858 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন –

  • এই আইনের মাধ্যমে ভারতের শাসনক্ষমতা মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়।
  • জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতাসম্পন্ন সকল ভারতবাসী সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়।
  • গভর্নর জেনারেলের পরিবর্তে ভাইসরয় পদ তৈরি হয় ইত্যাদি।

মহারানি ভিক্টোরিয়া কর্তৃক নিজ হাতে ভারতের শাসনভার গ্রহণ সম্পর্কে কী জানো?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ দমন করার পর ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় প্রভূত পরিবর্তন করা হয়।

  • ‘ভারতে উন্নত ধরনের শাসন আইন, 1858’ -এর মাধ্যমে ভারতের শাসনক্ষমতা মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়।
  • এসময় গভর্নর জেনারেলের পরিবর্তে ভাইসরয় পদ তৈরি হয়। এই ভাইসরয়ই মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের শাসন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর থেকে ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলকে কেন ‘ভাইসরয়’ বলা হত?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর 1858 খ্রিস্টাব্দের 2 আগস্ট ভারত শাসন আইনের দ্বারা কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে।

‘ভাইসরয়’ পদের সৃষ্টি –

  • 1858 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারত শাসন আইন পাস করে ভারতের শাসনক্ষমতা মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেয়।
  • মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে এসময় গভর্নর জেনারেল পদের নাম পরিবর্তন করে ভাইসরয় পদ সৃষ্টি করা হয়। ভাইসরয় কথার অর্থ রাজপ্রতিনিধি। ভারতের প্রথম ভাইসরয় হল লর্ড ক্যানিং।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর সৃষ্ট ভারত-সচিবের ক্ষমতার স্বরূপ কীরূপ ছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। 1858 খ্রিস্টাব্দের 2 আগস্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারত শাসন আইন পাস করে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ভারত-সচিবের ক্ষমতার স্বরূপ –

  • এই বিদ্রোহের পর ইংল্যান্ডে কোম্পানির ভারত প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়টি সংস্কার করা হয়। এসময় 15 সদস্যবিশিষ্ট ইন্ডিয়া কাউন্সিল গঠিত হয়, যার সভাপতি হন ভারত-সচিব।
  • ভারত-সচিব ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার ভারত বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত একজন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি কাজের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকতেন।

মহারানির ঘোষণাপত্র (1858 খ্রিস্টাব্দ) কী?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ দমনের পর 1858 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার পক্ষ থেকে একটি ঘোষণাপত্র জারি করা হয়।

মহারানির ঘোষণাপত্র –

এলাহাবাদে এক দরবারে (1 নভেম্বর, 1858 খ্রিঃ) লর্ড ক্যানিং এই ঘোষণাপত্রটি পেশ করেন –

  • স্বত্ববিলোপ নীতির অবসান হবে।
  • যোগ্যতা অনুসারে ভারতীয়রা সরকারি পদে নিযুক্ত হতে পারবে।
  • ইংরেজরা আর রাজ্যবিস্তার করবে না।
  • সরকার ভারতীয়দের ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না ইত্যাদি।

ঘোষণাপত্রটি আপাতদৃষ্টিতে উদার প্রকৃতির মনে হলেও বাস্তবে তা ছিল না।

‘মহারানির ঘোষণাপত্র’ -এর (1858 খ্রিঃ) মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ দমনের পর 1858 খ্রিস্টাব্দের 1 নভেম্বর মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্রটি পেশ করা হয়।

‘মহারানির ঘোষণাপত্র’ -এর মূল উদ্দেশ্য –

মহারানির ঘোষণাপত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল-ভারতীয় জনগণকে বিশেষত রাজন্যবর্গকে নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষার আশ্বাস দিয়ে তাদের আনুগত্য অর্জন করা। সেই কারণেই প্রাথমিকভাবে এই ঘোষণাপত্র দ্বারা ভারতীয়দের বহু আশ্বাস দেওয়া হলেও শেষ অবধি কোনোটিই পালন করা হয়নি।

1858 খ্রিস্টাব্দে মহারানির ঘোষণাপত্রে দেশীয় রাজাদের প্রতি কী কী ঘোষণা করা হয়েছিল?

1858 খ্রিস্টাব্দে মহারানির ঘোষণাপত্রে দেশীয় রাজাদের প্রতি ঘোষণা –

1858 খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে এক দরবারে লর্ড ক্যানিং মহারানির ঘোষণাপত্রটি পেশ করেন। দেশীয় রাজাদের প্রতি এই ঘোষণাপত্রে নিম্নলিখিত ঘোষণাগুলি করা হয়েছিল –

  • এই ঘোষণাপত্রে বলা হয় স্বত্ববিলোপ নীতি প্রত্যাহার করা হবে।
  • দেশীয় রাজাদের আশ্বাস দেওয়া হয় যে, তারা দত্তকপুত্র গ্রহণ করতে পারবেন এবং কোম্পানির সঙ্গে তাদের স্বাক্ষরিত সব চুক্তি মেনে চলা হবে।
  • দেশীয় রাজ্যগুলিতে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কোনো দ্বন্দু দেখা দিলে সেক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেলের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।

মহারানির ঘোষণাপত্রে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কী বলা হয়েছিল?

1858 খ্রিস্টাব্দের 1 নভেম্বর মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্রটি পেশ করা হয়। ভারতীয় জনগণকে বিশেষত রাজন্যবর্গকে নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষার আশ্বাস দিয়ে তাদের আনুগত্য অর্জন করাই ছিল এই ঘোষণাপত্রের মূল উদ্দেশ্য।

মহারানির ঘোষণাপত্রে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বলা হয় যে, যোগ্যতা ও গুণ অনুসারে সমস্ত ভারতীয় নাগরিক সরকারি পদে নিযুক্ত হতে পারবে। এক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণগত ভেদ বাধা হবে না। প্রাথমিকভাবে এই ঘোষণাপত্র দ্বারা সরকারি চাকরির বিষয়ে ভারতীয়দের বহু আশ্বাস দেওয়া হলেও শেষ অবধি তা বাস্তবায়িত হয়নি।

মহারানির ঘোষণাপত্রে ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে সরকারের কী ধারণা প্রস্ফুটিত হয়েছিল?

মহারানির ঘোষণাপত্রে ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে ধারণা –

মহারানির ঘোষণাপত্রে ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে সরকারের যেসকল ধারণাগুলি প্রস্ফুটিত হয়েছিল, সেগুলি হল –

  • ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করে যে, ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপই ছিল সিপাহি বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।
  • মহারানির ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে তাই তারা ভারতীয়দের ধর্ম ও সামাজিক ধ্যানধারণায় হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ধর্মপালন ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রজাদের স্বাধীনতা বজায় থাকবে।

‘সভাসমিতির যুগ’ বলতে কী বোঝায়?

উনিশ শতক ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা করে।

সভাসমিতিসমূহ –

বিভিন্ন প্রেসিডেন্সি শহরে এই সময় বহু সভাসমিতি গড়ে ওঠে।

  • কলকাতা – বঙ্গহিতকারী সভা, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, ইন্ডিয়ান লিগ, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি সমিতি গড়ে উঠেছিল।
  • বোম্বাই – বোম্বাই শহরে বোম্বাই নেটিভ অ্যাসোসিয়েশন, জাতীয় কংগ্রেস ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য।
  • মাদ্রাজ – মাদ্রাজে মাদ্রাজ মহাজন সভা ছিল বিশেষ উল্লেখ্য।

এইভাবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সভাসমিতি ও তার শাখা প্রতিষ্ঠার জন্য অনিল শীল উনিশ শতককে ‘সভাসমিতির যুগ’ বলেছেন।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধকে ‘সভাসমিতির যুগ’ বলা হয় কেন?

‘সভাসমিতির যুগ’ বলার কারণ –

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধকে ‘সভাসমিতির যুগ’ বলার কারণগুলি হল –

  • বিভিন্ন সভাসমিতি – পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার এবং রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধির ফলশ্রুতি হিসেবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে বিভিন্ন প্রেসিডেন্সি শহরে বহু সভাসমিতি গড়ে ওঠে। কলকাতার বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা, ভারতসভা; বোম্বাই -এর বোম্বাই নেটিভ অ্যাসোসিয়েশন; মাদ্রাজের মাদ্রাজ মহাজন সভা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
  • সমিতির প্রয়োজনীয়তা – ইংরেজ সরকারের শাসন, কর ও শুল্কনীতি, শোষণ এবং বৈষম্য ক্রমশ প্রকট হতে থাকলে সভাসমিতিগুলি ক্রমশ শ্রেণিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থের বাহক হয়ে ওঠে। এইভাবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সভাসমিতি ও তার শাখা প্রতিষ্ঠার জন্য ডঃ অনিল শীল উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধকে ‘সভাসমিতির যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন।

উনিশ শতকের ভারতে সভাসমিতি গড়ে ওঠার কারণ লেখো।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতি সমাজজীবনে রূপান্তর আনে। গোষ্ঠীস্বার্থ বজায় রাখতে বেশ কিছু সভাসমিতি গড়ে ওঠে।

উনিশ শতকের ভারতে সভাসমিতি গড়ে ওঠার কারণ –

  • স্বার্থরক্ষা – পুঁজিবাদী অর্থনীতির সুবিধা যারা ভোগ করত অর্থাৎ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেদের পেশাগত সুবিধা রক্ষার জন্য সভাসমিতি গড়ে তোলে।
  • সমাজকল্যাণ – বিভিন্ন কুপ্রথা দূরীকরণ, নারীকল্যাণ, শিক্ষাবিস্তার প্রভৃতি প্রগতিশীল কাজের জন্য সভাসমিতি গড়ে ওঠে। পাশ্চাত্য শিক্ষা এদেশের মানুষকে সচেতন করে তোলে। তারা নিজ শ্রেণি এবং সমাজের মঙ্গলের জন্য বিভিন্ন ধরনের সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা করেন।

উনিশ শতকের ভারতে গড়ে ওঠা সভাসমিতি বা রাজনৈতিক সংগঠনগুলির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার এবং রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধির ফলশ্রুতি হিসেবে প্রেসিডেন্সি শহরগুলিতে বহু সভাসমিতি গড়ে ওঠে।

সভাসমিতির বৈশিষ্ট্য –

  • সভাসমিতিগুলির সদস্যদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি।
  • ইংরেজ সরকারের শাসন, কর, শোষণ ও বৈষম্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সভাসমিতিগুলি তখন গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনস্বার্থের কথা ভাবতে শুরু করে।
  • উনিশ শতকে সর্বপ্রথম বাংলায় এই সভাসমিতিগুলি গড়ে ওঠে। সেখান থেকে ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও অনুরূপ সংগঠনের জন্ম হয় ইত্যাদি।

উনিশ শতকের ভারতে সভাসমিতিগুলি কাদের স্বার্থের বাহক ছিল?

উনিশ শতকের রাজনৈতিক সভাসমিতিগুলি বিভিন্ন শ্রেণিস্বার্থের বাহক ছিল।

উনিশ শতকের ভারতে সভাসমিতিসমূহ –

  • বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা – এই সভাটি জমিদার শ্রেণির স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশিষ্ট জমিদার প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালীনাথ রায়চৌধুরী প্রমুখ কলকাতায় এই সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন 1836 খ্রিস্টাব্দে।
  • ভারতসভা – এই সভাটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থের বাহক ছিল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসু এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন (1876 খ্রিঃ)। এই সমস্ত সভাসমিতিগুলি প্রথমে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিস্বার্থে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরে জাতীয় স্বার্থরক্ষাই তাদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

উনিশ শতকের প্রথমে জনসভার গুরুত্ব কী ছিল?

উনিশ শতকে বাংলায় বেশ কিছু রাজনৈতিক সভাসমিতি গড়ে ওঠে। জনমত প্রকাশের জন্য জনসভার গঠন এসময় শুরু হয়।

জনসভার গুরুত্ব –

  • উনিশ শতকের প্রথম থেকেই জনসভার মাধ্যমে সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবিদাওয়া উত্থাপন করা হয়।
  • 1835 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ‘শেরিফ’ টাউন হলে জনসভার আয়োজন করা হয়। এই জনসভায় 15 বছর পর্যন্ত আবশ্যিক শিক্ষার ব্যবস্থা, সরকারি চাকরির ভারতীয়করণ, কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তন প্রভৃতি প্রশাসনিক সংস্কারের দাবি তুলে ধরা হয়।

রাজা রামমোহন রায় -এর রাজনৈতিক চিন্তার পরিচয় দাও।

রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ। রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রেও তিনি পথিকৃৎ ছিলেন।

রাজা রামমোহন রায় -এর রাজনৈতিক চিন্তা –

  • রাজনৈতিক দর্শন – তিনি মেকিয়াভেলি, হবস, লক, রুশো, ব্যোম, টম পেইন -এর দর্শনের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।
  • গণতন্ত্র – তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। বিভিন্ন গণ আন্দোলনের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন ঘটান।
  • সংবাদপত্রের স্বাধীনতা – 1823 খ্রিস্টাব্দের Press Ordinance -এর বিরোধিতা করে তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা করেন। ভারতে রাজনৈতিক চিন্তার পথিকৃৎ হলেও রামমোহন কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী ছিলেন না।

বাংলাদেশের প্রথম দিকের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সমিতি কোনটি ছিল? কারা এই সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন?

বাংলাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার, নতুন ভূমিব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী অর্থনীতি সমাজজীবনে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

রাজনৈতিক সমিতি –

উনিশ শতকের বাংলাদেশে নতুন পরিস্থিতিতে বহু রাজনৈতিক সমিতি গড়ে ওঠে।

  • প্রথম উল্লেখযোগ্য সমিতি – বাংলাদেশের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সমিতি ছিল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা (1836 খ্রিঃ, 8 ডিসেম্বর)।
  • প্রতিষ্ঠাতা – প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রসন্নকুমার ঠাকুর ছিলেন এই সমিতির প্রতিষ্ঠাতা। এরা সবাই জমিদার ছিলেন।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা কেন প্রতিষ্ঠিত হয়?

অথবা, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার উদ্দেশ্য কী ছিল?

বাংলাদেশে ইংরেজ শাসনে নতুন ভূমিব্যবস্থা, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার এবং পরিবর্তিত অর্থনীতি সমাজে সম্পদ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রতিষ্ঠা –

বাংলাদেশের এই নতুন পরিস্থিতিতে জমিদাররা এই সভাটি গড়ে তোলেন।

  • শ্রেণিস্বার্থ – জমিদার শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করা এই সমিতির উদ্দেশ্য ছিল।
  • দাবি পেশ – পতিত জমিতে কর না বসানো, নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত না করা প্রভৃতি দাবি সমিতির মাধ্যমে সরকারের কাছে পেশ করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

ইংল্যান্ডের সভাসমিতির অনুকরণ, বাংলাদেশের সামাজিক সংগঠনের প্রেরণা (ব্রাহ্মসমাজ, বঙ্গহিতকারী সভা), যৌথভাবে দাবি পেশ প্রভৃতি উদ্দেশ্যে 1836 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয়।

কেন বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে ‘রাজনৈতিক সভা’ বলা হয়?

অথবা, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার রাজনৈতিক আদর্শ কী ছিল?

উনিশ শতকের বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক সভা প্রতিষ্ঠিত হয়, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা ছিল তার মধ্যে অন্যতম।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে রাজনৈতিক আদর্শ –

এই সভার কয়েকটি রাজনৈতিক আদর্শ ছিল। তা হল –

  • স্বাধীনতা – এই সভা স্বাধীনতার আদর্শকে সম্মান করত।
  • সমতা – এই সভা ইংল্যান্ডের সম-অধিকার নীতির আদর্শে বিশ্বাসী ছিল। মানুষ মাত্রই সমান – এই মহান আদর্শের সমর্থক ছিল এরা। এই সভা রাজনৈতিক আদর্শ এবং সরকারি সুযোগসুবিধা লাভের গঠনমূলক প্রচেষ্টা চালায়। তাই এই সভাকে ‘রাজনৈতিক সভা’ বলা হয়।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার সীমাবদ্ধতা কী ছিল?

উনিশ শতকে কলকাতা তথা বাংলা প্রেসিডেন্সিতে বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের অনুকরণে এদেশে প্রথম যুগে যে-সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার সীমাবদ্ধতা –

  • ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ রাজনৈতিক আদর্শ এবং সরকারি সুযোগসুবিধা লাভের প্রচেষ্টা চালালেও দেশব্যাপী কোনো সক্রিয় প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।
  • এই সভা বেশিদিন তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়।

কবে, কারা জমিদার সভা প্রতিষ্ঠা করেন?

উনিশ শতকের বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক সভাসমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, জমিদার সভা ছিল তার মধ্যে অন্যতম।

জমিদার সভা প্রতিষ্ঠা –

কলকাতার বিশিষ্ট জমিদাররা নিজেদের স্বার্থে এই সভা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এই সভার নাম হয় ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি।

  • প্রতিষ্ঠাকাল – 1838 খ্রিস্টাব্দের 12 নভেম্বর জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • প্রতিষ্ঠাতা – রাজা রাধাকান্ত দেব, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর এই সভার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?

অথবা, জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার কারণ কী ছিল?

জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

1838 খ্রিস্টাব্দের 12 নভেম্বর জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সভার উদ্দেশ্যগুলি হল –

  • অধিকার রক্ষা – চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদাররা বংশানুক্রমিক অধিকার লাভ করে। এই অধিকার সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজন ছিল।
  • সুবিধা আদায় – চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রাজস্ব বিষয়ে অনেক অস্পষ্টতা ছিল। জমিদাররা সেই সুবিধাকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট ছিলেন।

সভাসমিতির মাধ্যমে যৌথভাবে কোনো দাবি জানালে তা জোরদার হয়। এই ধারণা থেকেই ইংল্যান্ডের অনুকরণে জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়।

জমিদার সভার দাবিসমূহ আলোচনা করো।

1838 খ্রিস্টাব্দের 12 নভেম্বর কলকাতার বিশিষ্ট জমিদাররা মিলিত হয়ে জমিদার সভা গঠন করেছিলেন।

জমিদার সভার দাবিসমূহ –

  • নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত হতে না দেওয়া।
  • ব্রিটিশ ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার।
  • বিচার, পুলিশ ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কার।
  • সুবিধাজনক শর্তে পতিত জমি ইজারাদান প্রভৃতি।

জমিদার সভার দুটি সীমাবদ্ধতা লেখো।

উনিশ শতকের বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক সভাসমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, জমিদার সভা ছিল তার মধ্যে অন্যতম। 1838 খ্রিস্টাব্দের 12 নভেম্বর কলকাতার বিশিষ্ট জমিদাররা মিলিত হয়ে জমিদার সভা গঠন করেন।

জমিদার সভার দুটি সীমাবদ্ধতা –

  • গোষ্ঠীস্বার্থের প্রাধান্য – কলকাতার বিশিষ্ট জমিদাররা নিজেদের স্বার্থে এই সভা প্রতিষ্ঠা করেন, ফলে সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থের প্রাধান্য এখানে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
  • প্রভাব বিস্তারে অক্ষম – ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণের মধ্যে জমিদার সভা বিশেষ কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে রাজনৈতিকভাবে সচেতন একটি শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে। তাদের উদ্যোগে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরকমই একটি রাজনৈতিক সমিতি ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠনের উদ্দেশ্য –

  • 1839 খ্রিস্টাব্দে পাদরি অ্যাডাম এই সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতীয়দের প্রকৃত অবস্থা ব্রিটিশ জনগণকে জানানো এই সমিতির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।
  • এ ছাড়া ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করা, পুলিশ ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কারসাধনের দাবি জানানোও ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

কবে, কারা ভারতসভা প্রতিষ্ঠা করেন?

ভারতসভা –

উনিশ শতকের বাংলাদেশে যেসকল রাজনৈতিক সভাসমিতি গড়ে ওঠে সেগুলি ছিল আঞ্চলিক ও শ্রেণিস্বার্থের বাহক। ভারতসভা ছিল এর ব্যতিক্রম।

  • প্রতিষ্ঠাকাল – 1876 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভা (Indian Association) প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • প্রতিষ্ঠাতা – সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু ও শিবনাথ শাস্ত্রী এই সভার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

জমিদার শ্রেণির সংকীর্ণ স্বার্থরক্ষার বদলে ভারতসভা ভারতবাসীর তথা জাতীয় স্বার্থের রক্ষক হয়ে ওঠে।

‘ভারতসভা’ প্রতিষ্ঠার যে-কোনো দুটি উদ্দেশ্য লেখো।

অথবা, ভারতসভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?

উনিশ শতকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সভাগুলির মধ্যে ভারতসভা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

‘ভারতসভা’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

  • দেশে জনমত গঠন করা।
  • ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা।
  • হিন্দু-মুসলমানের মৈত্রীর প্রসার ঘটানো।
  • রাজনৈতিক আন্দোলনে অশিক্ষিত মানুষদের যোগদানের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।

ভারতসভার কার্যকলাপের বিবরণ দাও।

1876 খ্রিস্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত ভারতসভা (Indian Association) ছিল একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সভা।

ভারতসভার কার্যকলাপ –

  • আই সি এস পরীক্ষার্থীর বয়স হ্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ – ব্রিটিশ সরকার আই সি এস পরীক্ষার বয়সসীমা 21 বছর থেকে কমিয়ে 19 বছর করে। এর প্রতিবাদে ভারতসভা আন্দোলন করে। ফলে ব্রিটিশ সরকার স্ট্যাটুটারি সিভিল সার্ভিস প্রবর্তন করে।
  • ইলবার্ট বিল – লর্ড রিপন বিচারব্যবস্থায় সমতা আনার জন্য ইলবার্ট বিল তৈরি করলে ইংরেজরা তার প্রতিবাদ করে। ভারতসভা বিল -এর সমর্থনে আন্দোলন করে।

ভারতসভার আন্দোলনগুলি জাতীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়েছিল।

সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসার বয়স বাড়ানোর দাবিতে ভারতসভার আন্দোলন সম্পর্কে লেখো।

উনিশ শতকের বাংলাদেশে যেসকল রাজনৈতিক সভাসমিতিগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতসভা। জমিদার শ্রেণির সংকীর্ণ স্বার্থরক্ষার পরিবর্তে ভারতসভার আন্দোলনগুলি জাতীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়েছিল।

সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীর বয়স বাড়ানোর দাবিতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলন –

  • ব্রিটিশ সরকার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়সসীমা 21 বছর থেকে কমিয়ে 19 বছর করলে ভারতসভা এর প্রতিবাদে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আন্দোলন করে।
  • একজন 19 বছরের ভারতীয় ছাত্রের পক্ষে বিদেশে গিয়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসা ছিল কার্যত একটি কঠিন বিষয়। তাই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসার বয়স বাড়ানোর দাবিতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আন্দোলন করেন।

‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন’ (1878 খ্রিঃ) এবং ‘অস্ত্র আইন’ (1878 খ্রিঃ) -এর বিরুদ্ধে ভারতসভার আন্দোলনের পরিচয় দাও।

সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাধারণ ভারতবাসীর স্বার্থে ভারতসভা ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন অবিচারের প্রতিবাদ জানায়।

‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন’ এবং ‘অস্ত্র আইন’ -এর বিরুদ্ধে ভারতসভার আন্দোলন –

  • লর্ড লিটনের সময়কালে 1878 খ্রিস্টাব্দে ‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন’ প্রণীত হয়। এর মাধ্যমে দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
  • একই বছর লর্ড লিটন ‘অস্ত্র আইন’-ও প্রণয়ন করেন। এর মাধ্যমে সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো ভারতীয় আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারবে না বলে উল্লেখ করা হয়।

এই দুই আইনের বিরুদ্ধে ভারতসভা আন্দোলন সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়।

গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয়ের মধ্যে পার্থক্য কী?

ভারতে কোম্পানির রাজত্বকালে ‘বোর্ড অফ কন্ট্রোল কর্তৃক’ নিযুক্ত সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদাধিকারী ছিলেন ‘গভর্নর জেনারেল’। 1833 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ‘বাংলার গভর্নর জেনারেল’ ‘ভারতের গভর্নর জেনারেলে’ পরিণত হন এবং 1858 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।

1858 খ্রিস্টাব্দে ভারতে কোম্পানির রাজত্বের অবসান ঘটে এবং ইংল্যান্ডের মহারানির প্রত্যক্ষ শাসনের সূচনা হয়। মহারানির প্রতিনিধি রূপে ভারতভূমিতে শাসন পরিচালনা করেন ‘ভাইসরয়’, ‘ভাইসরয়’ শব্দের অর্থ ‘রাজপ্রতিনিধি’, তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত হন। 1947 খ্রিস্টাব্দে ভারতে স্বাধীনতা আইনে ‘ভাইসরয়’ পদ বিলুপ্ত হয়।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা ও ভারত সভার মধ্যে দুটি পার্থক্য লেখো।

প্রথমত, উনিশ শতকের সভা-সমিতির যুগে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা ভারত সভার প্রায় চার দশক পূর্বে আবির্ভূত হয়েছিল। বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা উনিশ শতকের প্রথমার্ধে (1836 খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠিত হয়, অন্যদিকে ভারত সভা প্রতিষ্ঠিত হয় উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে (1876 খ্রিস্টাব্দ)।

দ্বিতীয়ত, লর্ড বেন্টিষ্কের পাশ্চাত্য ভাষা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বঙ্গভাষা প্রকাশিকা গড়ে উঠেছিল। এটি ছিল মূলত একটি আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে, ভারত সভা সর্ব ভারতীয় প্রতিষ্ঠান না হলেও এর কার্যাবলি নিঃসন্দেহে ছিল সুবিস্তৃত এবং জাতীয় জীবনের প্রায় সকল দিকের অনুসঙ্গী। ভারত সভা জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাকে দ্রুততর করেছিল।

ইলবার্ট বিল কী?

ইলবার্ট বিল –

ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয় বিচারকরা সাধারণত কোনো ইউরোপীয়দের বিচার করতে পারত না। এই বৈষম্য দূর করে ভারতীয় ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমক্ষমতা দান করার জন্য বড়োেলাট রিপনের আইনসচিব কোর্টনি ইলবার্ট একটি আইনের খসড়া বা বিল প্রস্তুত করেন। এটি ইলবার্ট বিল নামে পরিচিত। ইলবার্ট বিলের মধ্য দিয়ে ভারতীয়রা ইউরোপীয়দের বিচারের পূর্ণ অধিকার লাভ করে। ইংরেজরা এই বিলের চরম প্রতিবাদ করলেও ভারতসভা বিলটির সমর্থনে এগিয়ে আসে।

ইংরেজরা কেন ইলবার্ট বিল মানতে পারেনি?

লর্ড রিপনের শাসনকালে ইলবার্ট বিল -এর পরিকল্পনা গৃহীত হয়। বৈষম্য দূর করে ভারতীয় ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমান ক্ষমতা ও মর্যাদা প্রদানই ছিল ইলবার্ট বিলের প্রধান উদ্দেশ্য।

ইংরেজদের ইলবার্ট বিলের বিরোধিতার কারণ –

কিন্তু ইংরেজরা এই ইলবার্ট বিল মানতে পারেনি। কারণ –

  • ইলবার্ট বিলে ভারতীয় বিচারকরা ইংরেজদের বিচার করতে পারবে এই মত প্রদান করা হয়। ইংরেজরা ভারতীয় বিচারকদের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়নি। এতে তাদের জাত্যভিমানে প্রবল আঘাত লাগে।
  • ইংরেজরা মনে করত তাদের বিচার করার মতো উপযুক্ত দক্ষতা ভারতীয়দের নেই।

ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলন বা ‘শ্বেত বিপ্লব’ কী?

লর্ড রিপনের আইনসচিব কোর্টনি ইলবার্ট ভারতীয় ও ইউরোপীয় বিচারকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করে সমক্ষমতা দান করার জন্য একটি আইনের খসড়া বা বিল প্রস্তুত করেন, এটি ইলবার্ট বিল নামে পরিচিত।

ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলন বা শ্বেত বিপ্লব –

ইউরোপীয়রা এই ইলবার্ট বিলের ঘোরতর বিরোধী ছিল। তারা প্রতিরক্ষা সভা বা ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। এই ঘটনাই ‘শ্বেত বিপ্লব’ বা ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলন নামে পরিচিত।

‘ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ কী?

কোর্টনি ইলবার্ট তাঁর বিল বা আইনের খসড়ার মাধ্যমে ভারতীয় ও ইউরোপীয় বিচারকদের বিচার ক্ষেত্রে সমান ক্ষমতা প্রদান করার পরিকল্পনা করেন। এতে ইউরোপীয়দের জাত্যভিমানে আঘাত লাগে এবং তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।

‘ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ –

ইউরোপীয়রা ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন শুরু করে, কারণ তারা মনে করত ইউরোপীয়দের বিচার করার মতো উপযুক্ত দক্ষতা ও যোগ্যতা ভারতীয়দের নেই। এসময় তারা প্রতিরক্ষা সভা বা ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। শেষপর্যন্ত লর্ড রিপন তাদের কাছে নতিস্বীকার করে আইনের কতকগুলি ধারা সংশোধন করেন।

ইলবার্ট বিল আন্দোলনের ফল কী হয়েছিল?

ইলবার্ট বিলকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয়রা আন্দোলন শুরু করে। তাদের এই আন্দোলনের প্রত্যুত্তরে ভারতীয়রাও প্রতি-আন্দোলন গড়ে তোলে।

ইলবার্ট বিল আন্দোলনের ফলাফল –

  • ইউরোপীয়দের জয় – ইলবার্ট বিল আন্দোলনের ফলে শেষপর্যন্ত লর্ড রিপনকে ইউরোপীয়দের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়।
  • ধারা সংশোধন – ইউরোপীয়দের আন্দোলনের ফলে লর্ড রিপন ইলবার্ট বিলের অনেকগুলি উদারনৈতিক ধারা সংশোধন করতে বাধ্য হন।
  • ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি – ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলনে ইউরোপীয়দের আচরণে ভারতীয়রা অপমানিত বোধ করে এবং তারা একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে।

ইলবার্ট বিল বিতর্ক থেকে ভারতীয়রা কী শিক্ষালাভ করেছিল?

ইলবার্ট বিলে প্রদত্ত ভারতীয় ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমান মর্যাদা ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে ইউরোপীয়রা আন্দোলন শুরু করে। ভারতীয়রাও এর প্রত্যুত্তরে প্রতি-আন্দোলন গড়ে তোলে।

ভারতীয়দের উপলব্ধি –

  • সংঘবদ্ধ আন্দোলনের গুরুত্ব – ইলবার্ট বিল বিতর্কের ফলে ভারতীয়রা উপলব্ধি করে একমাত্র সংঘবদ্ধ আন্দোলনের দ্বারাই ব্রিটিশ সরকারের নিয়মনীতির উপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব।
  • জাতিগত বৈষম্যের নগ্নরূপ – ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের জাতিগত বৈষম্য ও ঘৃণা সম্পর্কে তারা সচেতন হয়।
  • জাতীয় সম্মেলন আহ্বান – ইলবার্ট বিল বিতর্কের ফলেই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে ভারতসভার কী ভূমিকা ছিল?

1876 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল ভারতবাসীর স্বার্থরক্ষার লক্ষ্য নিয়ে ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে ভারতসভার ভূমিকা –

  • হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রচেষ্টা – 1905 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে ভারতসভা হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রীর প্রসার ঘটাতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
  • ‘জাতীয় ভান্ডার’ গঠন – স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার ও তার প্রচার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ভারতসভা একটি জাতীয় ভাণ্ডার গঠন করে।

জাতীয় সম্মেলনের কর্মসূচি কী ছিল?

ভারতীয় জনমতকে সুগঠিতভাবে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় 1883 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করেন। বাংলা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, লাহোর, মিরাট ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে বহু প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগ দেন।

জাতীয় সম্মেলনের কর্মসূচি –

  • ভারতীয় জনগণের বিভিন্ন দাবিদাওয়াগুলি এই সম্মেলনে তুলে ধরা হয়।
  • বিচারব্যবস্থার পৃথকীকরণ, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন, বৃহত্তর কর্মসংস্থান, শিল্প ও কারিগরি শিক্ষা প্রভৃতি কর্মসূচি জাতীয় সম্মেলনে গৃহীত হয়।

কবে, কারা হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠা করেন?

উনিশ শতকের বাংলাদেশে যেসব জাতীয়তাবাদী সভাসমিতি গড়ে ওঠে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হিন্দুমেলা।

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠা –

  • প্রতিষ্ঠাকাল – 1867 খ্রিস্টাব্দে হিন্দুমেলার সূচনা হয়।
  • প্রতিষ্ঠাতা – নবগোপাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু এই মেলার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা ঠাকুরবাড়ির গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগিতা পেয়েছিলেন।

দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলা, কারিগর-শিল্পী ও সাহিত্যিকদের উৎসাহ দেওয়া এবং ঐক্যভাব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই মেলার অবদান অনস্বীকার্য।

হিন্দুমেলা কেন ‘চৈত্রমেলা’ নামে পরিচিত? হিন্দুমেলার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের নাম লেখো।

1867 খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখের উদ্যোগে হিন্দুমেলার সূচনা হয়।

হিন্দুমেলা বা চৈত্রমেলা –

বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে হিন্দুমেলার ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির দিনে এই মেলা অনুষ্ঠিত হত বলে, এটি চৈত্রমেলা নামে পরিচিত ছিল।

হিন্দুমেলার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন ব্যক্তিত্ব –

হিন্দুমেলার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা হলেন নবগোপাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ।

‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠার দুটি উদ্দেশ্য লেখো।

অথবা, হিন্দুমেলার উদ্দেশ্য কী ছিল?

উনিশ শতকের বাংলাদেশে যেসব জাতীয়তাবাদী সভাসমিতি গড়ে ওঠে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হিন্দুমেলা (1867 খ্রিস্টাব্দ)।

‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

  • হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা।
  • প্রত্যেককে আত্মনির্ভর করে তোলা।
  • সর্বভারতীয় চেতনা গড়ে তোলা।
  • দেশীয় শিল্প, সাহিত্যকে উৎসাহদান প্রভৃতি।

হিন্দুমেলার সম্মেলন অনন্য ছিল কেন?

হিন্দুমেলার সম্মেলন –

  • সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘মিলে সব ভারত সন্তান’ গানের মধ্য দিয়ে এই মেলা শুরু হত। এই গান জাতীয় সংগীতের মতো দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলে।
  • মেলার আয়োজকরা ন্যাশনাল পেপারের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের কথা প্রচার করেন।

তাই বলা যায়, স্বল্পকালীন হলেও জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে হিন্দুমেলার সম্মেলন ছিল অনন্য।

হিন্দুমেলার অবদান কী ছিল?

হিন্দুমেলার অবদান –

হিন্দুমেলার অবদানগুলি হল নিম্নরূপ –

  • সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘মিলে সব ভারত সন্তান/গাও ভারতের জয়গান’ সংগীতটি দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলে।
  • বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা উৎসাহ সৃষ্টি করে।
  • মেলায় হস্তশিল্পের প্রদর্শনী শিল্পী-কারিগরদের উৎসাহ দেয়।
  • মেলার আয়োজকদের প্রকাশিত ন্যাশনাল পেপার জাতীয়তাবোধ জাগরণে সাহায্য করে।

এইভাবে হিন্দুমেলা হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

হিন্দুমেলা কেন জনপ্রিয়তা হারায়?

উনিশ শতকের বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী সম্মেলন হিসেবে হিন্দুমেলার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ –

পরবর্তীকালে বিভিন্ন কারণে হিন্দুমেলা জনপ্রিয়তা হারায়। যথা –

  • সংকীর্ণ চরিত্র – হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করতে ও হিন্দুত্ববাদী ধ্যানধারণার উপর হিন্দুমেলায় অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। ফলে এর সংকীর্ণ চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
  • মুসলিম স্বার্থ বিষয়ে উদাসীনতা – ভারতীয় মুসলিম সমাজের দাবিদাওয়া সম্পর্কে হিন্দুমেলায় কোনো গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। এই সকল কারণে হিন্দুমেলার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়।

উনিশ শতকের ভারতে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার কারণ কী?

ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা, শাসন-শোষণ এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতিক্রিয়ায় ভারতে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে।

উনিশ শতকের ভারতে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার কারণসমূহ –

  • রাজস্বভার – ইংরেজ আমলে আগের তুলনায় রাজস্বের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে।
  • শাসন-শোষণ – ইংরেজদের শাসন ও শোষণে ভারতবাসী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
  • পাশ্চাত্য শিক্ষা – পাশ্চাত্যের সাহিত্য, দর্শন, যুক্তিবাদ এদেশের শিক্ষিত শ্রেণিকে প্রভাবিত করে।

এই সমস্ত কারণের প্রভাব ও ফলশ্রুতিতে ভারতে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে।

ভারতে জাতীয়তাবাদ গঠনের ক্ষেত্রে আর্থিক উপাদান কতটা দায়ী ছিল?

উনিশ শতকের ভারতে জাতীয়তাবাদ গঠনের ক্ষেত্রে আর্থিক উপাদান অনেকাংশে দায়ী ছিল।

ভারতে জাতীয়তাবাদ গঠনের ক্ষেত্রে আর্থিক কারণ –

  • কুটিরশিল্পের অবক্ষয় – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য, শুল্কনীতির পরিবর্তন প্রথা, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, রেলপথের প্রসার এদেশের কুটিরশিল্পের পতন ঘটায়।
  • করভার – কৃষিতে ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি, বিভিন্নভাবে এদেশের অর্থসম্পদ ইংল্যান্ডে প্রেরণ, হোমচার্জ প্রভৃতির ফলে ভারতের উপর করভার ও আর্থিক চাপ বাড়ে।

ইংল্যান্ডের অপশাসনই ভারতের দারিদ্র্যের কারণ – এই ধারণা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

ভারতে জাতীয়তাবাদ গঠনের ক্ষেত্রে সামাজিক উপাদান কতটা দায়ী ছিল?

উনিশ শতকের ভারতে জাতীয়তাবাদ গঠনের ক্ষেত্রে সামাজিক উপাদানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

ভারতে জাতীয়তাবাদ গঠনের ক্ষেত্রে সামাজিক উপাদানসমূহ –

  • জাতিগত বৈষম্য – ভারতীয় ও ইংরেজদের মধ্যে জাতিবৈরিতা প্রবল হয়ে ওঠে। ইংরেজরা ভারতীয়দের ঘৃণা করত এবং সামাজিক মেলামেশা এড়িয়ে চলত।
  • সরকারি ক্ষেত্রে বৈষম্য – ইংরেজরা দেশীয় কর্মচারী ও সিপাহিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত। প্রশাসন ও বিচারের ক্ষেত্রেও বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মতো।

শাসক ও শাসিতের দূরত্ব, বৈষম্য, ঘৃণা, সামাজিক বৈরিতা সৃষ্টি করে – যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গঠনে সহায়তা করে।

ভারতে জাতীয়তাবোধের বিকাশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব কী ছিল?

ভারতের জাতীয়তাবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতে জাতীয়তাবোধের বিকাশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব –

  • সাহিত্য-দর্শন – ইংরেজি শিক্ষা, ইউরোপীয় দর্শনের প্রভাবে এদেশে উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্য, নাটক রচিত হয়। এগুলির জাতীয়তাবাদী আবেদন ছিল প্রবল।
  • রাজনীতি – আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব শিক্ষিত ভারতীয়দের মনে রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করে।

এইভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতবাসীর জাতীয়তাবোধ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের ভূমিকা লেখো।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের প্রভাব বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের ভূমিকা –

  • সংবাদপত্রের নাম – ভারতে জাতীয়তাবোধ জাগরণের ক্ষেত্রে যেসব পত্রিকার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল, সেগুলির নাম হল – সমাচার দর্পণ, বেঙ্গল গেজেট, সম্বাদ কৌমুদী, সংবাদ প্রভাকর, সংবাদ ভাস্কর, তত্ত্ববোধিনী, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, পাইওনিয়ার, অমৃতবাজার পত্রিকা, সোমপ্রকাশ, হিন্দু প্রভৃতি।
  • অবদান – এইসব সংবাদপত্রগুলি সরকারি নীতির সমালোচনা, ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবিসমূহ প্রচার করে।

এইসব সংবাদপত্রগুলি জাতীয় জনমানসে ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী জাতীয় চেতনার বিকাশে সহায়তা করেছিল।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে রেলপথের ভূমিকা লেখো।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে রেলপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে রেলপথের ভূমিকা –

  • যোগাযোগ ব্যবস্থা – রেলপথ সারা ভারতবর্ষে সহজ ও দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
  • আঞ্চলিকতা দূরীকরণ – রেলপথ আঞ্চলিকতা, প্রাদেশিকতার সীমানা ভেঙে দেয়। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হয়। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়।

এইভাবে রেলপথ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলে এবং আঞ্চলিকতা দূর করে ভারতবাসীর জাতীয়তাবোধ বিকাশে সাহায্য করে।

ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বৈশিষ্ট্য কী কী?

ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটে ঔপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যে ইংরেজ শাসনাধীনে।

ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বৈশিষ্ট্য –

ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –

  • ঐক্যভাব – সাহিত্য, সংবাদপত্র, সভাসমিতির মাধ্যমে দেশবাসীর মধ্যে ঐক্যভাব গড়ে তোলার আবেদন জানানো হয়।
  • দেশমুক্তির বাণী – বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, সংস্কার আন্দোলন, রাজনৈতিক কার্যকলাপ এবং লেখনীর মাধ্যমে দেশমুক্তির বাণী প্রকাশিত হয়।

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস কীভাবে জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে উদ্দীপ্ত করেছিল?

অথবা, জাতীয়তাবোধ বিকাশে আনন্দমঠের ভূমিকা কী ছিল?

ভারতের জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উপন্যাসটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

আনন্দমঠ উপন্যাস –

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (1176 বঙ্গাব্দ) পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসটি 1882 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।

  • সন্তান দল – সন্তান দলের আদর্শে দেশের যুবসমাজকে দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
  • দেশীয় সংস্কৃতি – উপন্যাসে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
  • বন্দেমাতরম – এই সংগীতটি স্বাদেশিকতার বীজমন্ত্র ছিল। বিপ্লববাদের প্রেরণা ও শক্তি ছিল।

দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ও জাতীয়তাবোধ জাগরণে উপন্যাসটির বিশেষ ভূমিকা ছিল।

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সন্তান দলের লক্ষ্য কী ছিল?

ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বিকাশে বিভিন্ন মনীষীদের লেখনীর প্রভাব রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা দেশাত্মবোধক উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সন্তান দলের লক্ষ্য –

  • বাংলায় মুসলিম রাজশক্তির পতন ও ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। এই সংকটকালে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশমাতার মুক্তির জন্য সন্তান দলের আবির্ভাব ঘটে।
  • ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের মূল চরিত্র সন্তান দলের আদর্শ অনুসরণ করে দেশের যুবসমাজকে দেশমাতার পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

‘বন্দেমাতরম’ সংগীত বিখ্যাত কেন?

বন্দেমাতরম গান ও স্লোগানটি আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত। 1875-1876 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই সংগীতটি রচিত হয়।

‘বন্দেমাতরম’ সংগীতটি বিখ্যাত হওয়ার কারণ –

‘বন্দেমাতরম’ সংগীতটি বিখ্যাত, কারণ –

  • ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসারে বন্দেমাতরম -এর গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালি বিপ্লবীদের প্রেরণা দান করতে বন্দেমাতরম সংগীতের ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
  • বন্দেমাতরম গানটিতে সুর দিয়েছিলেন যদুভট্ট। 1896 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটি গেয়েছিলেন।
  • বন্দেমাতরম গানটি স্বাধীন ভারতে জাতীয় সংগীতের (National Song) মর্যাদা লাভ করেছে।

স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু কী?

ভারতের জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা বর্তমান ভারত গ্রন্থটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু –

সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে রাজশক্তির বর্ণনা, ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্ম, রামকৃষ্ণের বাণী, ভারতীয় জীবনাদর্শ -এই গ্রন্থের মূল বিষয়। বৈদিক যুগ থেকে বর্তমানকাল, ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য থেকে শূদ্র জাগরণ পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের রূপরেখা এই গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে। ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতির বিশ্লেষণমূলক উপস্থিতি গ্রন্থটিকে অনবদ্য করে তুলেছে।

স্বামী বিবেকানন্দ কীভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে ভারতীয় সমাজে শূদ্রের জাগরণ ঘটবেই?

ভারতের জাতীয়তাবোধ জাগরণের ক্ষেত্রে বর্তমান ভারত গ্রন্থটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

  • বৈদিক যুগ থেকে বর্তমানকাল, ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য থেকে শূদ্র জাগরণ পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের রূপরেখা স্বামী বিবেকানন্দ এই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন।
  • বর্তমান ভারত গ্রন্থে তিনি ভবিষ্যদবাণী করে বলেছেন যে, বৈদিক যুগে ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের যেমন প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তেমনি বৈশ্যের পর সমাজে শূদ্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

ভারতে জাতীয়তাবোধ জাগরণে ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটির অবদান লেখো।

স্বামী বিবেকানন্দের লেখা বর্তমান ভারত গ্রন্থটি ভারতের জাতীয়তাবোধ জাগরণে বিশেষ অবদান রেখেছিল।

ভারতে জাতীয়তাবোধ জাগরণে ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটির অবদান –

  • দেশমুক্তির আহ্বান – এই গ্রন্থে বিবেকানন্দ বলেন, ‘হে ভারত ভুলিও না, তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত।’ তিনি দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করেন। দেশের মুক্তির জন্য আত্মোৎসর্গের আদর্শ তুলে ধরে তিনি সবাইকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
  • জাতীয়তার বাণী – বর্তমান ভারত গ্রন্থে এই বাণী এবং অভীঃ ও উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত মন্ত্র দ্বারা স্বামী বিবেকানন্দ ভারতে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করেন এবং হতাশাগ্রস্ত দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেন।

রবীন্দ্রনাথের গোরা চরিত্রের কী বৈশিষ্ট্য ছিল?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গোরা উপন্যাসের মধ্য দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে গঠনমূলক ও সমন্বয়বাদী জাতীয়তাবাদের কথা তুলে ধরেছেন।

গোরা চরিত্রের বৈশিষ্ট্য –

  • হিন্দুত্ববাদের প্রতি আকর্ষণ – বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের মানসলোকের প্রতীকী চরিত্র হল গোরা। আইরিশ যুবক হয়েও হিন্দু পরিবারে লালিত পালিত হওয়ায় সে নিজের বিদেশি সত্তা ভুলে হিন্দুত্ববাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
  • অন্যান্য ধর্মের উপর গুরুত্ব আরোপ – পরবর্তীকালে গোরার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে ও সে সকল ধর্মের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
  • আত্মপ্রতিষ্ঠা ও মানবতাবোধ – আত্মপ্রতিষ্ঠা, অনুসন্ধানী মনোভাব, মানবতাবোধ প্রভৃতি হল গোরা চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের কী ধরনের পরিচয় পাওয়া যায়?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গোরা উপন্যাসটি জাতীয়তাবাদী চেতনায় পূর্ণ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ –

গোরা উপন্যাসে (1910 খ্রিঃ) সমকালীন মধ্যবিত্ত সমাজের মানবতাবোধ, আত্মপ্রতিষ্ঠা, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, অনুসন্ধানী মনোভাব, কৌতূহল ইত্যাদি ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া মধ্যবিত্ত বাঙালিদের দেশাত্মবোধ, ধর্ম, ভাবাবেগ ইত্যাদি মানসিকতার পরিচয় লক্ষণীয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা উপন্যাসটি সমকালীন যুগজীবনের প্রতিচ্ছবি। সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক ভাবধারা, বিক্ষোভ-আন্দোলন, দেশাত্মবোধের স্ফুরণ এখানে চিত্রিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের রাজনৈতিক পটভূমি লেখো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গোরা হল একটি জাতীয়তাবাদী উপন্যাস।

রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের রাজনৈতিক পটভূমি –

1905 খ্রিস্টাব্দে ভারতে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হয়। এই ঘটনার বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলনের সূচনা হয়, যা ছিল হিন্দু বাঙালিদের প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলন। বিক্ষোভ-প্রতিবাদ আন্দোলনের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষ যুক্ত হয়। এই রাজনৈতিক আন্দোলন ও হানাহানির পটভূমিতে ‘গোরা’ উপন্যাসটি রচিত (1910 খ্রিঃ)।

আইরিশ যুবক গোরা এই উপন্যাসের মূল প্রতীকী চরিত্র।

ভারতের ধর্মীয় বিষয়ে গোরার কী উপলব্ধি হয়?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গোরা উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরার বক্তব্য ও কার্যকলাপের মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে গঠনমূলক ও সমন্বয়বাদী জাতীয়তাবাদের কথা তুলে ধরেছেন।

ভারতের ধর্মীয় বিষয়ে গোরার উপলব্ধি –

  • আইরিশ যুবক গোরা হিন্দু পরিবারে লালিতপালিত হয়ে নিজের বিদেশি সত্তা ভুলে গিয়ে বাঙালি হয়ে যায়। প্রথমদিকে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি ইংরেজদের চরম বিদ্বেষ লক্ষ করে গোরা উগ্র হিন্দুত্ববাদে আকৃষ্ট হয়।
  • পরবর্তীকালে গোরা উপলব্ধি করে যে ধর্মীয় পরিচয় মানুষের একমাত্র পরিচয় নয়। এভাবে ধর্মীয় বিষয়ে গোরার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশে ‘গোরা’ উপন্যাসের অবদান লেখো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা উপন্যাসে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রবল রূপে দেখা দিয়েছিল।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশে ‘গোরা’ উপন্যাসের অবদান –

উপন্যাসের মূল চরিত্র আইরিশ যুবক গোরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপন্যাসে সমকালীন যুগজীবনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয় গোরার মধ্য দিয়ে চিত্রিত হয়েছে। গোরার চেতনায় অখণ্ডতাবোধ, দেশপ্রেম নিগূঢ়ভাবে ফুটে উঠেছে।

রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের সূচনা ঘটে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্য দিয়ে আর সমাপ্তি ঘটে ধর্ম ও বিশ্বমানবতার মধ্য দিয়ে।

‘ভারতমাতা’ চিত্রটির ব্যঞ্জনা ব্যক্ত করো।

বিখ্যাত শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতা চিত্রটি গভীর ব্যঞ্জনাময়। চিত্রটি জাতীয়তাবাদী ভাবধারার দ্যোতক।

‘ভারতমাতা’ চিত্রটির ব্যঞ্জনা –

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশমাতার প্রতিমূর্তি হিসেবে একটি নারীর চিত্র এঁকেছেন। তাঁর চারটি হাত। দেবীমূর্তির অনুকরণে প্রথম হাতে শস্য (ধান), দ্বিতীয় হাতে বস্ত্র, তৃতীয় হাতে পুথি, চতুর্থ হাতে জপমালা আছে। এই কাল্পনিক ভারতমাতা নীল আকাশের নীচে সবুজ পৃথিবীর উপর দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জাতীয়তার প্রতীক। বিদেশি শাসনের বন্ধন থেকে তিনি জাতিকে জেগে ওঠার আহ্বান জানাচ্ছেন।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রের নাম করো। ‘ভারতমাতা’র কোন্ বিষয়টি থেকে বোঝা যায় যে, অবনীন্দ্রনাথ তাঁর স্বদেশি ভাবনায় সন্ত্রাসকে স্থান দেননি?

বিখ্যাত শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হল – ভারতমাতা, নির্বাসিত যক্ষ, অভিসারিকা প্রভৃতি।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত ‘ভারতমাতা’র চিত্র –

জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতমাতা চিত্রটির মাধ্যমে বিশ শতকে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটান। ভারতমাতা হলেন গৈরিক বসন পরিহিতা এক দেবী। তাঁর চারটি হাতে ধানের গোছা, সাদা কাপড়, পুথি ও জপমালা থাকলেও কোনো অস্ত্র নেই। এর থেকে বোঝা যায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্বদেশি ভাবনায় সন্ত্রাসকে স্থান দেননি।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ভারতমাতা’ এবং অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’র মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও প্রসারে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের ভারতমাতা ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত ভারতমাতার চিত্রটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

বঙ্কিমচন্দ্রের ভারতমাতা ও অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতার মধ্যে পার্থক্য –

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে পরাধীন ভারতমাতার লাঞ্ছিত রূপ তুলে ধরেছেন কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতা সম্পদে পরিপূর্ণ দেবীমূর্তি, যা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকালে জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল।

ব্যঙ্গচিত্র কেন আঁকা হয়?

শিল্পচর্চার একটি অন্যতম মাধ্যম হল চিত্রকলা। ব্যঙ্গচিত্র তার একটি বিশেষ অঙ্গ।

ব্যঙ্গচিত্র আঁকার কারণ –

বিভিন্ন কারণে ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হয়। যেমন –

  • সমালোচনা – প্রচলিত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি সরস ভঙ্গিতে প্রকাশ করার জন্য ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হয়।
  • সচেতনতা বৃদ্ধি – সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সমস্যা বা ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পর্কে ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা তোলা। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তাঁর অঙ্কিত রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যামূলক ব্যঙ্গচিত্রগুলির মাধ্যমে ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিখ্যাত কেন?

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের একজন সদস্য। তিনি বঙ্গীয় ঘরানার একজন চিত্রকর ও ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছেন।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা –

  • গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তৎকালীন ভারতীয় ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে নানা ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করেন। তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলির মধ্যে অদ্ভুতলোক, বিরূপ বজ্র এবং নব হুল্লোড় প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
  • গগনেন্দ্রনাথ তাঁর শিল্পকলার মাধ্যমে সমাজের নানান বিষয়কে তুলে ধরেছিলেন। প্রবাসী ও মডার্ন রিভিয়ুতে তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলি ছাপা হত।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য কী কী?

ভারতে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে সাহিত্যের মতো চিত্রকলারও বিশেষ অবদান ছিল। শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রগুলি এ বিষয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য –

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রগুলির বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • লিথোগ্রাফ পদ্ধতির প্রয়োগ – গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রগুলি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে অঙ্কিত। তিনি প্রধানত লিথোগ্রাফ পদ্ধতিতে ব্যঙ্গচিত্রগুলি এঁকেছেন।
  • মানসিক আবেগ – গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রগুলির আবেদন বিচারশক্তি সম্বন্ধীয়, আবেগ সংক্রান্ত নয়। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণকে ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে তিনি ফুটিয়ে তোলেন।

দেশের পরাধীনতার মর্মবেদনা ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগাতে চেষ্টা করেন।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে ঔপনিবেশিক সমাজের সমালোচনা করেছিলেন?

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তাঁর অঙ্কিত রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যামূলক ব্যঙ্গচিত্রগুলির মাধ্যমে ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন।

শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা সামাজিক কুসংস্কার নয়; ধর্মীয় গোঁড়ামি, জাতপাত, উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের দ্বিচারিতা, কলকাতার ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের বিলাসিতা, ব্রিটিশ সৈন্যদের নিপীড়ন ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ের উপর গগনেন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্কণ করেন। মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের সমালোচনা করে তিনি আঁকেন ‘State Funeral of H.E. Old Bengal’, যে চিত্রটিতে পাশ্চাত্যের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলার সমাজের ভাঙন ধরা পড়েছে। অন্যদিকে ‘শিক্ষার কারখানা’ নামক চিত্রে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে কটাক্ষ করেছেন তিনি।

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রবাসী ও রিভিয় পত্রিকা দুটিতে গগনেন্দ্রনাথের এই সকল ব্যঙ্গচিত্রগুলি প্রকাশিত হত, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজচেতনা সৃষ্টি। মেকি দেশাত্মবোধের সমালোচনা ও ঔপনিবেশিক নীতির সমালোচনায় তাঁর এই চিত্রগুলির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

সিপাহি বিদ্রোহ কাকে বলে?

1857 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট ক্যানিং-এর শাসনকালে উত্তর ও মধ্যভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় সিপাহিদের (সৈনিক) নেতৃত্বে ও উদ্যোগে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে – যা ইংরেজ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দেয়। এই বিদ্রোহকে সিপাহি বিদ্রোহ বলা হয়।

সিপাহি বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?

এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন ছিল সিপাহি বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ। নতুন ধরনের এই বন্দুকের টোটা সিপাহিদের দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকে ভরতে হত। গুজব রটে যায় যে, এই টোটার মধ্যে গরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত আছে। ধর্মনাশের ভয়ে হিন্দু-মুসলিম সিপাহিরা এই রাইফেল ব্যবহার করতে অস্বীকার করে। কিন্তু ইংরেজরা ভারতীয় সিপাহিদের দাবি না মানলে তারা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ শুরু করে (1857 খ্রিস্টাব্দে)।

1857 খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহকে মহাবিদ্রোহ বলা হয় কেন?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ সিপাহি বিদ্রোহ হিসেবে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা গণবিদ্রোহে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বভাবতই এই বিদ্রোহ শুধু সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাই একে মহাবিদ্রোহ বলা হয়।

1857-র মহাবিদ্রোহ কখন ও কোথায় শুরু হয়?

আনুষ্ঠানিকভাবে 1857 খ্রিস্টাব্দের 29 মার্চ ব্যারাকপুরে মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়। তবে 1857-র 10 মে উত্তরপ্রদেশের মীরাট সেনাছাউনিতে প্রকৃতপক্ষে মহাবিদ্রোহ শুরু হয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলির নাম লেখো।

1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলির নাম হল — মীরাট, লখনউ, কানপুর, ঝাঁসি, দিল্লি, জলন্ধর, আজমগড়, গোয়ালিয়র, জগদীশপুর প্রভৃতি।

কোন্ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিপাহি বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়?

1857 খ্রিস্টাব্দে ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে মঙ্গল পান্ডে নামে এক সেনা চর্বি মিশ্রিত কার্তুজের জন্য ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন ইংরেজ অফিসারকে আক্রমণ করলে বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। এই ঘটনাই সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা ঘটায়।

ঝাঁসির রানি বিখ্যাত কেন?

ঝাঁসি রাজ্য কোম্পানি অধিগ্রহণ করার প্রতিবাদে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই সিপাহি বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি মহাবিদ্রোহের একজন উল্লেখযোগ্য নেত্রী ছিলেন। তিনি যুদ্ধে অসম সাহস ও বীরত্ব দেখান। শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মুখ যুদ্ধে 17 জুন 1858 খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

ঝাঁসির রানি এবং নানাসাহেব কেন মহাবিদ্রোহে যোগদান করেছিলেন?

গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে – ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈকে রাজ্যহারা করেন এবং পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও-এর দত্তকপুত্র নানাসাহেবের রাজন্য ভাতা বন্ধ করে দেন। এসবের প্রতিবাদে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ ও নানাসাহেব মহাবিদ্রোহে যোগদান করেছিলেন।

মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার দুটি কারণ উল্লেখ করো।

মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার দুটি উল্লেখযোগ্য কারণ হল –

  • পরিকল্পনার অভাব: বিদ্রোহ সংগঠন ও প্রসার সাধনের জন্য বিদ্রোহীদের মধ্যে পরিকল্পনার অভাব ছিল। সিপাহি বা জনগণের কাছে বিদ্রোহী নেতারা কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য তুলে ধরতে পারেননি।
  • সীমিত বিস্তৃতি: এই বিদ্রোহ মূলত উত্তর ও মধ্যভারতের দিল্লি, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল। দক্ষিণ ভারতের অংশগ্রহণ ছিল না।

মহাবিদ্রোহের পর থেকে ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলকে কেন ভাইসরয় বলা হত?

1858 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন দ্বারা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারতের শাসনভার সরাসরি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ওপর অর্পিত হয়। এই কারণে মহাবিদ্রোহের পর থেকে ব্রিটিশ প্রতিনিধি হিসেবে ভাইসরয়-এর পদ তৈরি হয় এবং গভর্নর জেনারেলকে ভাইসরয় বা রাজ প্রতিনিধি বলা হত।

1857-র বিদ্রোহ প্রথম কোথায় শুরু হয় ও পরে কোন্ কোন্ স্থানে ছড়িয়ে পড়ে?

1857-র বিদ্রোহ কলকাতার ব্যারাকপুরে শুরু হয় (29 মার্চ) এবং ক্রমে তা মীরাট, বেরিলি, অযোধ্যা, কানপুর, দিল্লি, গোয়ালিয়র, ঝাঁসি, জগদীশপুর, গোরক্ষপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। গোটা উত্তর ভারত ও মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল।

1857-র মহাবিদ্রোহের কয়েকজন নেতা-নেত্রীর নাম উল্লেখ করো।

1857-র মহাবিদ্রোহের কয়েকজন নেতা-নেত্রীর নাম — ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব (পেশোয়ার দত্তকপুত্র), তাঁতিয়া টোপী, কুনওয়ার সিং (বিহার), বখত খান (দিল্লি), বেগম হজরত মহল (অযোধ্যা), মনিরাম দেওয়ান (আসাম) প্রমুখ।

কোন্ কোন্ ইংরেজ সেনাপতি মহাবিদ্রোহ দমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল?

ব্রিটিশ সেনাপতি স্যার জন লরেন্স, স্যার হেনরি লরেন্স, আউটরাম, হ্যাভলক, ক্যাম্পবেল, হিউরোজ, নীল প্রমুখ 1857-র মহাবিদ্রোহ দমনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল।

কাকে Clemency Canning বলা হত?

ভারতের গভর্নর জেনারেল ক্যানিং বিদ্রোহ দমনের পর শত শত বিদ্রোহীকে প্রাণদণ্ড এবং বিদ্রোহীদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেন। তবুও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ইংল্যান্ডের বহু ইংরেজ ব্যঙ্গ করে ক্যানিংকে ‘Clemency Canning’ (দয়ার অবতার) বলত।

1857-র বিদ্রোহের চরিত্র কীরূপ ছিল?

ভারতীয় সিপাহিরা মহাবিদ্রোহ শুরু করলেও উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জনগণও তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছিল। ভারতীয়দের অধিকাংশই মনে প্রাণে ইংরেজ বিতাড়ন চেয়েছিল। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ছিলেন তাদের ঐক্যের প্রতীক। এই সমস্ত কারণে 1857-র বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলাই যুক্তিযুক্ত।

1857-র বিদ্রোহকে কি সিপাহি বিদ্রোহ বলা সংগত?

1857-র বিদ্রোহ শুরু করেছিল ইংরেজ কোম্পানির ভারতীয় সিপাহিরা। কিন্তু পরবর্তীকালে উত্তর ও মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ এলাকার জনগণ ব্যাপকভাবে এই বিদ্রোহে শামিল হয়। এমনকি কয়েকটি স্থানে (যেমন: অযোধ্যা) সিপাহিরা বিদ্রোহ না করলেও জনগণ বিদ্রোহ করেছিল। তাই এই বিদ্রোহকে শুধুমাত্র সিপাহি বিদ্রোহ বলা যায় না।

1857-র বিদ্রোহকে সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বলা হয় কেন?

1857-র বিদ্রোহে কিছু রাজ্যচ্যুত সামন্তরাজা (ঝাঁসির রানি, নানাসাহেব) ও ভূমিচ্যুত জমিদার-তালুকদার নেতৃত্ব দিয়েছিল। এদের লক্ষ্য ছিল হৃত রাজ্য ও জমিদারি পুনরুদ্ধার। সামন্তশ্রেণির এই প্রয়াসকে বামপন্থী চিন্তাবিদ রজনীপাম দত্ত রক্ষণশীল ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলির অভ্যুত্থান বলে উল্লেখ করেছেন।

1857-র বিদ্রোহকে ভারতে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা হয় – কেন?

1857-র বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী বিদ্রোহীরা মনে প্রাণে ইংরেজ বিতাড়ন চেয়েছিল। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক একসঙ্গে লড়েছিল এবং দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে মেনে নিয়েছিল। ইংরেজ-বিরোধী এত ব্যাপক আন্দোলন ভারতে আর হয়নি বলে প্রখ্যাত বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকার এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

1857-র বিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম/জাতীয় বিদ্ৰোহ বলা কতটুকু যুক্তি সংগত?

1857-র বিদ্রোহের স্পষ্ট উদ্দেশ্য ও সর্বভারতীয় চরিত্র না থাকলেও ভারতের এক বৃহদাংশের (উত্তর ও মধ্য ভারত) নানা শ্রেণির জনগণ ও সিপাহিরা একযোগে লড়ে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। এর পাশাপাশি তারা বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহে জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ ও স্পষ্ট উদ্দেশ্য না থাকলেও এই বিদ্রোহ জাতীয় বিদ্রোহের চরিত্রলাভ করেছে।

মহাবিদ্রোহ দমনে সাহায্য করেছিল এমন কয়েকটি দেশীয় শক্তির নাম লেখো।

মহাবিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সাহায্য করেছিল এমন কয়েকটি দেশীয় শক্তির নাম হল – গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া, কাশ্মীরের মহারাজা, হায়দ্রাবাদের নিজাম, যোধপুরের রাজা, গোর্খা নেতা জং বাহাদুর প্রমুখ।

1858 খ্রিস্টাব্দের পর দেশীয় রাজাদের সঙ্গে ইংরেজরা কীরূপ সম্পর্ক গড়ে তোলে?

মহাবিদ্রোহের আগে দেশীয় রাজাদের মনে ইংরেজদের প্রতি যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করার জন্য মহারানির ঘোষণাপত্র (1858)-এ স্বত্ববিলোপ নীতি রদ করা হয় এবং সরকার ভারতে আর রাজ্যবিস্তার করবে না বলে ঘোষণা করে। তা ছাড়া দেশীয় রাজা ও জমিদারদের নানারকম খেতাব (যেমন — রায়বাহাদুর, রায়সাহেব) দান করে সরকারের অনুগত রাখার চেষ্টা করা হয়।

মহাবিদ্রোহের গতিধারার মধ্যে হিন্দু-মুসলমান যে ঐক্যের রূপ ফুটে উঠেছিল তা লেখো।

মহাবিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়েছিল। বস্তুত উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই বিদ্রোহ এত তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এই বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সম্রাট বাহাদুর শাহ-কে ভারতের নেতা বলে স্বীকার করতে আপত্তি করেনি। তিনিই ছিলেন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রতীক। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির অন্যতম দৃষ্টান্তরূপে, যেখানেই বিদ্রোহ সফল হয়, সেখানেই গো-হত্যা বন্ধ করা হয়েছিল।

1857-র মহাবিদ্রোহকে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা যায় না কেন?

প্রখ্যাত বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকার 1857-র মহাবিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদারসুরেন্দ্রনাথ সেন এই মতকে অস্বীকার করে বলেছেন যে:

  • জনগণের অংশগ্রহণ সর্বত্র সমানভাবে ঘটেনি (বাংলা, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব নিরপেক্ষ ছিল),
  • মারাঠা, রাজপুত, শিখ, গোর্খা প্রভৃতি জাতি বিদ্রোহ থেকে দূরে ছিল,
  • সেসময় জাতীয় চেতনার উন্মেষ হয়নি,
  • বিদ্রোহীরা নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থে বিদ্রোহ করেছিল – জাতীয় স্বার্থে নয়।

    এ কারণে এই বিদ্রোহকে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা যায় না।

অযোধ্যায় গণবিদ্রোহের চেহারা কেমন ছিল?

অযোধ্যায় 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে। এখানকার তালুকদারগণ-এর সঙ্গে কৃষকসাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করে এই বিদ্রোহকে গণবিদ্রোহে পরিণত করে। একটি পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, একমাত্র অযোধ্যাতেই ইংরেজদের সঙ্গে সংগ্রামে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ নিহত হয়। তার মধ্যে এক লক্ষ মানুষই ছিল অসামরিক ব্যক্তি। এ থেকেই অযোধ্যার গণবিদ্রোহের স্বরূপ পরিস্ফুটিত হয়।। এ থেকেই অযোধ্যার গণবিদ্রোহের স্বরূপ পরিস্ফুটিত হয় .

মহারানির ঘোষণাপত্র কী?

1857-র মহাবিদ্রোহের পর ভারতের শাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মহারানি ভিক্টোরিয়া ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন। মহারানির প্রতিনিধিস্বরূপ ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত এক দরবারে যে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন (1 নভেম্বর, 1858 খ্রিস্টাব্দ) তা মহারানির ঘোষণাপত্র নামে পরিচিত। এই ঘোষণাপত্রকে ‘ভারতের উদারনৈতিক শাসনের প্রতীক’ বলা হয়।

কে, কবে এবং কোথায় মহারানির ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করেন?

গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং, 1 নভেম্বর 1858 খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে এক দরবারে (মহারানির প্রতিনিধি হিসেবে) মহারানির ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করেন।

ভারত শাসনের ক্ষেত্রে বণিক সুলভ বাণিজ্যিক মনোভাবের পরিবর্তে কীভাবে আধুনিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত ঘটে?

ভারতের শাসন পরিচালনার জন্য ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক সভা ও বোর্ড অব কন্ট্রোলের হাতে যে ক্ষমতা ছিল, তা ভারত সচিব (Secretary of State for India) নামে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার এক সদস্যের তত্ত্বাবধানে 15 জন সদস্য বিশিষ্ট এক পরিষদকে দেওয়া হয়। ভারত সচিব এই পরিষদের আহ্বায়ক হলেন। এইভাবে বণিকসুলভ বাণিজ্যিক মনোভাবের পরিবর্তে আধুনিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত ঘটে।

1858-র ভারত শাসন আইনে কী বলা হয়?

1858-র ভারত শাসন আইনের দ্বারা মহারানি ভিক্টোরিয়া ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারত শাসনের ভার গ্রহণ করেন। ঠিক হয়, একজন ভারত সচিব একটি পরিষদের সাহায্যে ভারতের গভর্নর জেনারেলের শাসন কার্যের তদারক করবেন। এই আইনে বলা হয় যে, আর কোনো দেশীয় রাজ্য গ্রাস করা হবে না এবং যোগ্য ভারতীয়দের উচ্চপদে নিয়োগ করা হবে।

উনিশ শতককে সভাসমিতির যুগ (Age of Association) বলে অভিহিত করা হয় কেন?

জাতীয় চেতনা উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয়দের মধ্যে দেশাত্মবোধের ধারণা জাগ্রত হয় এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য ভারতীয়রা সংঘবদ্ধ আন্দোলনের তাগিদ অনুভব করে। এই উপলব্ধি থেকেই উনিশ শতকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু রাজনৈতিক সভাসমিতি গড়ে ওঠে। এই কারণে অধ্যাপক অনীল শীল উক্ত সময়কালকে সভাসমিতির যুগ বলে অভিহিত করেছেন।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা কবে, কাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে?

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা 1836 খ্রিস্টাব্দে, গৌরীশংকর তর্কবাগীশ, ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত, হরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর এবং টাকির মুনশি কালীনাথ রায়ের উদ্যোগে গড়ে ওঠে।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার লক্ষ্য কী ছিল?

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করাই ছিল এই সভার প্রাথমিক লক্ষ্য। তবে পরবর্তীকালে এই সভা রাজনৈতিক সংস্থায় পরিণত হয়। এই সময় বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ বা কার্যাবলি ভারতবাসীর কতটা হিতসাধন বা ক্ষতি করতে পারে তা পর্যালোচনা করা।

জমিদার সভা কারা, কবে প্রতিষ্ঠা করেন?

রাজা রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের উদ্যোগে 1838 খ্রিস্টাব্দে (12 নভেম্বর) জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়।

জমিদার সভা কেন গঠিত হয়?

জমিদারদের স্বার্থ দেখার পাশাপাশি কৃষক প্রজার স্বার্থ ও দাবি-দাওয়া পূরণের লক্ষ্যে জমিদার সভা গঠিত হয়। তা ছাড়া সরকার যাতে রাজস্ব মুক্ত জমিগুলিকে খাস দখল হিসেবে গ্রহণ করতে না পারে, তার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানোও ছিল এই সভার অন্যতম লক্ষ্য। এই সভাকে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত বলা যায়।

কত খ্রিস্টাব্দে কার নেতৃত্বে এবং কোথায় ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠিত হয়?

1839 খ্রিস্টাব্দে, উইলিয়াম অ্যাডাম-এর নেতৃত্বে ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠিত হয়।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠনের উদ্দেশ্যগুলি ছিল — চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের দাবি জানানোর পাশাপাশি ভারতীয়দের অবস্থার উন্নতি, পুলিশ ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কার সাধনের দাবি জানানো।

বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি কারা, কবে প্রতিষ্ঠা করেন?

ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা টমসন, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ 1843 খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’ গঠন করেন।

বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠনের লক্ষ্য কী ছিল?

সকল শ্রেণির ভারতবাসীর কল্যাণ সাধন এবং তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলিকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠন করা হয়।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন কবে, কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়?

1851 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদার সভা ও বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি মিলিত হয়ে জন্ম নেয় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। এই সমিতি গঠনের উদ্দেশ্য ছিল — শিক্ষা, শাসনসংস্কার, বিচারব্যবস্থা, ভারতবাসীর সম্পদ রক্ষা করা, সরকারি উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ প্রভৃতি দাবি-দাওয়া তুলে ধরা।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি ও প্রথম সম্পাদক কে ছিলেন?

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব এবং প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর।

কাদের উদ্যোগে এবং কী উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান লিগ (1875 খ্রিস্টাব্দ) গঠিত হয়?

শিশিরকুমার ঘোষ, হেমন্তকুমার ঘোষ ও কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ইন্ডিয়ান লিগ (Indian League) গঠিত হয়। ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক সচেতনতা জাগ্রত করাই ছিল এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য।

ভারত সভা কবে, কাদের উদ্যোগে গঠিত হয়?

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের উদ্যোগে 1876 খ্রিস্টাব্দে (26 জুলাই) ভারত সভা গঠিত হয়।

ভারত সভার লক্ষ্যগুলি কী ছিল?

  • দেশে শক্তিশালী জনমত গঠন করা,
  • ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একতাবোধ গড়ে তোলা,
  • হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলা এবং
  • জনগণকে ব্রিটিশবিরোধী গণআন্দোলনে শামিল করা।

কাদের নেতৃত্বে এবং কবে হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠিত হয়?

নবগোপাল মিত্র ও রাজনারায়ণ বসুর যৌথ উদ্যোগে 1867 খ্রিস্টাব্দে হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠিত হয়।

হিন্দুমেলা গঠনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

হিন্দুমেলা গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করে জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করে তোলা। জাতীয়তাবাদী নেতা বিপিনচন্দ্র পালের মতে, নবগোপাল মিত্রের কাছেই আমরা জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রেরণা পেয়েছিলাম। সামাজিক কল্যাণমূলক আদর্শের প্রসার ঘটানো এবং দেশীয় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন ও বিক্রির মাধ্যমে জাতির উন্নতিসাধন করাও ছিল হিন্দুমেলার অন্যতম উদ্দেশ্য।

থিওসোফিক্যাল সোসাইটি সম্বন্ধে কী জানো?

1875 খ্রিস্টাব্দে হেনরি অলকট ও ম্যাডাম ব্লাভাটস্কি নিউইয়র্কে এই সংস্থাটি গড়ে তোলেন এবং 1882 খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের আদিয়ারে এর প্রধান কর্মকেন্দ্র স্থাপন করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ঐতিহ্যবাহী ধর্ম ও সংস্কৃতির পূর্ণ জাগরণ ঘটিয়ে দেশবাসীকে বিদেশি শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা।

প্রাক্-কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশনগুলির নাম লেখো।

প্রাক্-কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশনগুলি হল — পুনা সার্বজনিক সভা (1867 খ্রি.), ভারত সভা (1876 খ্রi.), মাদ্রাজ মহাজন সভা (1884 খ্রি.), বোম্বাই প্রেসিডেন্সি অ্যাসোসিয়েশন (1885 খ্রি.)।

লর্ড লিটন প্রবর্তিত দুটি প্রতিক্রিয়াশীল আইন কী ছিল?

  • ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট বা দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন এবং
  • অস্ত্র আইন (Arms Act)।

ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট (Vernacular Press Act) কবে প্রবর্তন করা হয়? এই আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

1878 খ্রিস্টাব্দে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট প্রবর্তন করা হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির কণ্ঠরোধ করা।

অস্ত্র আইন কবে প্রবর্তন করা হয়? এই আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

1878 খ্রিস্টাব্দে অস্ত্র আইন প্রবর্তন করা হয়। ভারতীয়দের নিরস্ত্র রাখাই ছিল এর মূল লক্ষ্য।

ইলবার্ট বিল কী?

1873 খ্রিস্টাব্দের ফৌজদারি আইন অনুযায়ী কোনো ভারতীয় বিচারক ইউরোপীয়দের বিচার করতে পারতেন না। লর্ড রিপন বিচারব্যবস্থায় জাতিভেদমূলক বৈষম্য দূর করার জন্য তাঁর আইন পরিষদের সদস্য ইলবার্টকে একটি বিল তৈরি করতে বলেন। এতে ভারতীয় বিচারকদের ইউরোপীয় বিচারকদের সমান ক্ষমতা দিয়ে ইলবার্ট যে বিল রচনা করেন (1883 খ্রিস্টাব্দে) তা ইলবার্ট বিল নামে পরিচিত।

ইংরেজরা কেন ইলবার্ট বিল মানতে পারল না?

লর্ড রিপন ভারতীয় বিচারকদের হাতে ইউরোপীয়দের বিচার করার ক্ষমতা দিয়ে ইলবার্ট বিল আনেন। কিন্তু ইউরোপীয়রা এই বিল মানতে রাজি ছিলেন না, কারণ ভারতীয়দের কাছে বিচার প্রার্থী হতে তাদের আত্মাভিমানে আঘাত লাগত। তাই তারা ইলবার্ট বিল মানতে অস্বীকার করে।

ইলবার্ট বিল আন্দোলনের ফল কী হয়েছিল?

ভারত ও ইংল্যান্ডে ইউরোপীয়রা ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে লর্ড রিপন এর কিছু পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। স্বভাবতই ইলবার্ট বিল আন্দোলন প্রমাণ করে যে, আন্দোলন না করলে কোনো কিছু আদায় করা যায় না। এই আন্দোলনের ফলে ভারতীয়রা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কনফারেন্স বা জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন।

ইলবার্ট বিল বিতর্ক থেকে ভারতীয়রা কী শিক্ষালাভ করেছিল?

  • ইংরেজ শাসনের প্রতি ভারতীয়দের মোহভঙ্গ ঘটে,
  • ইংরেজ শাসনের বৈষম্যমূলক চরিত্র সম্পর্কে ভারতীয়রা সচেতন হয়ে ওঠে এবং
  • তারা সংঘবদ্ধ আন্দোলনের শিক্ষালাভ করে।

ভারত সভা কোন্ কোন্ ব্রিটিশ আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল?

ভারত সভা সিভিল সার্ভিস আইন, সংবাদপত্র আইন, অস্ত্র আইন, ইলবার্ট বিল প্রভৃতি পক্ষপাতমূলক ব্রিটিশ আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল।

জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝ?

জাতীয়তাবাদ হল একটি ভাবগত ধারণা। ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি যে-কোনো একটি কারণে যখন একটি দেশের আপামর জনসমাজের মধ্যে গভীর একাত্মবোধ জন্মায় এবং এই জনসমাজের প্রত্যেক অংশ যখন একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার বলে মনে করে, তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সঙ্গে দেশপ্রেম মিলিত হয়ে একটি রাজনৈতিক আদর্শ গড়ে ওঠে — যা জাতীয়তাবাদ নামে পরিচিত।

ঊনবিংশ শতকের প্রথমে জনসভার গুরুত্ব কী ছিল?

ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে জনমত প্রকাশের জন্য জনসভার আয়োজন শুরু হয়। জনসভার মাধ্যমে নানা প্রশাসনিক সংস্কারের দাবি তুলে ধরা হয়, যেমন — 15 বছর বয়স পর্যন্ত আবশ্যিক শিক্ষার ব্যবস্থা, সরকারি চাকুরির ভারতীয়করণ, কারিগরি শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি।

কে, কোথায় এবং কবে সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন?

ভারতীয় জনমতকে সুগঠিত ও জোরদার করার উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় 1883 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয় সম্মেলন (National Conference) আহ্বান করেন।

জাতীয় সম্মেলন (National Conference) কেন আহ্বান করা হয়েছিল?

ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের সাফল্যে ভারতীয় নেতারা উপলব্ধি করেন যে, একমাত্র সংঘবদ্ধ আন্দোলনের দ্বারাই ব্রিটিশ সরকারের নীতিকে প্রভাবিত করা সম্ভব হতে পারে। তাই ভারতীয় জনগণকে সংঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন গড়ে তোলার জন্য 1883 খ্রিস্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। এই সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই সম্মেলনকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পূর্বসূরি বলা হয়।

জাতীয় সম্মেলনের কর্মসূচিগুলি কী কী ছিল?

জাতীয় সম্মেলনে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে ভারতবাসীর দাবিগুলিকে তুলে ধরা হয়। আইন সভায় ভারতীয় প্রতিনিধি গ্রহণ, বিচারবিভাগ থেকে শাসনবিভাগের পৃথকীকরণ, অস্ত্র আইনের রহিতকরণ, সামরিক ও প্রশাসনিক বিভাগের সংস্কার প্রভৃতি জাতীয় দাবিমূলক প্রস্তাব এই সম্মেলনে গৃহীত হয়।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কবে প্রতিষ্ঠিত হয়? এর প্রথম সভাপতি কে ছিলেন?

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা ছিল সভা-সমিতি যুগের চরম পর্যায়। যার অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে 1885 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আত্মপ্রকাশ করে। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন বাঙালি ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

আনন্দমঠ কে রচনা করেন? এই গ্রন্থের মূল উপদেশ কী?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আনন্দমঠ রচনা করেন। এই গ্রন্থের মূল উপদেশ হল – স্বদেশপ্রেমই হল শ্রেষ্ঠ ধর্ম।

সংঘবদ্ধতা ভারতীয় সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। প্রাচীন ভারত থেকেই সংঘবদ্ধতার ঐতিহ্য চলে আসছে। আধুনিক বিশ্বে সংঘবদ্ধতার গুরুত্ব আরও বেড়েছে। তাই ভারতের উচিত সংঘবদ্ধতাকে আরও শক্তিশালী করা।


আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় “সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর “সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Please Share This Article

Related Posts

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিষয়সংক্ষেপ

About The Author

Rohit Mondal

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর