এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘ভারতের স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম’/জাতীয় বিদ্রোহ বলা কতটা যুক্তিযুক্ত?” নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাস পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই “1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘ভারতের স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম’/জাতীয় বিদ্রোহ বলা কতটা যুক্তিযুক্ত?“ প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের চতুর্থ অধ্যায় “সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা“ -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘ভারতের স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম’/জাতীয় বিদ্রোহ বলা কতটা যুক্তিযুক্ত?
1857 খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের বুকে ঘটে যাওয়া বহুচর্চিত বিদ্রোহটির প্রকৃতি বা চরিত্র নির্ধারণে এর সার্ধ-শতবৎসর অতিক্রান্তেও কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভবপর হয়নি। স্বভাবতই তাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক মহলে উঠে এসেছে নানান পরস্পর বিরোধী ব্যাখ্যা।
স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম –
স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রামের প্রবক্তা –
প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকার তাঁর ‘Indian War of Independence’ গ্রন্থে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেছেন। পাশাপাশি কার্ল মার্কস, সুশোভন সরকার, হীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয় সংগ্রাম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
মূল বক্তব্য –
এদের বক্তব্যের মূল নির্যাস হলো, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহেই প্রথম জাতি-ধর্ম-বর্ণ-পেশা-শ্রেণি নির্বিশেষে আপামর ভারতবাসী একই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে, একই শত্রুর মোকাবিলায় শামিল হয়েছিল। ভারত থেকে অত্যাচারী ইংরেজ শাসনের উৎপাটন ছিল তাদের সাধারণ লক্ষ। তাদের মতে, সিপাইদের দ্বারা বিদ্রোহের সূচনা হলেও অচিরেই এর বিপুল বিস্তার, জনগণের বিপুল সমর্থন ও অংশগ্রহণ, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, বিদ্রোহ দমনে সরকারের ব্যাপক যুদ্ধ পরিচালনা প্রভৃতি এই বিদ্রোহকে গণসংগ্রামের চরিত্র দান করেছে। তাঁরা দেখিয়েছেন, দেশের উত্তর, মধ্য এবং উত্তর-পশ্চিম অংশে, বিশেষত অযোধ্যা, দিল্লি, রোহিলখণ্ড প্রভৃতি অঞ্চলে এই বিদ্রোহ কার্যত গণসংগ্রামের রূপ নিয়েছিল। মার্কসের পরিভাষায় – ‘(জন বুল) যাকে সেনা বিদ্রোহ মনে করছেন, সেটা আসলে জাতীয় বিদ্রোহ।’
সমালোচনা –
চার্লস রেকস্, স্যার জন লরেন্স, দাদাভাই নৌরজি, দুর্গাদাস ব্যানার্জি প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ এই বিদ্রোহকে ‘ভারতের স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম’ আখ্যা দিতে নারাজ। এদের মতে, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ মুখ্যত ছিল একটি ‘সিপাই বিদ্রোহ’। সিপাইদের অসন্তোষ থেকেই বিদ্রোহের সূচনা ও প্রসার। অসামরিক লোকেদের অংশ-গ্রহণ ছিল নগন্য এবং মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলার অবনতির সুযোগ নিয়েছিলেন মাত্র। দেশীয় রাজাদের অনেকেই, এমনকি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজও আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। আবার শিখ, গোর্খা প্রভৃতি যোদ্ধা জাতি ভারতে পুনরায় ‘মোগল শাসনের দুর্দিন’ ফিরে আসার আশঙ্কায় সরাসরি বিদ্রোহ দমনে সরকারকে সাহায্য করেছিল।
অন্যদিকে ডঃ রজনীপাম দত্ত, আর. সি. মজুমদার প্রমুখ মার্কসবাদী ঐতিহাসিকগণ এই বিদ্রোহকে ‘সামন্ত বিদ্রোহ’ আখ্যা দিয়েছেন। এঁদের মতে, গদিচ্যুত ও রাজ্যচ্যুত সমান্তরাজারা (যথা – নানাসাহেব, তাঁতিয়া টোপি, লক্ষ্মীবাই প্রমুখ) নিজ নিজ স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে নিজ নিজ অঞ্চলে জনগণকে খেপিয়ে তুলে বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন। ডঃ মজুমদার এই বিদ্রোহকে ‘ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত তন্ত্র ও মৃতপ্রায় সামন্ত শ্রেণির মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বীর সাভারকারের বক্তব্যকে খণ্ডন করে তিনি স্পষ্টতই লিখেছেন – “The ‘First National War of Independence’ is neither ‘first’ nor ‘national’ nor ‘the war of independence”.
মন্তব্য –
বস্তুতপক্ষে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কোনো ঐতিহাসিকের নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক. বক্তব্য মেনে পরিচালিত হয়নি। গতির আবেগে বিদ্রোহ সমস্ত তত্ত্বকেই সংমিশ্রিত করেছিল। তাই ঐতিহাসিক C.A. Bayly কে উদ্ধৃত করেই আলোচনার ইতি টানা যায় – “The Indian Rebellion of 1857 was not one movement…it was many.”
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলার বিরোধিতা কেন করা হয়?
প্রবক্তা – চার্লস রেকস, স্যার জন লরেন্স, দাদাভাই নৌরজি, আর. সি. মজুমদার প্রমুখ।
যুক্তি – 1. এটি মূলত সিপাহিদের বিদ্রোহ ছিল, সাধারণ জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ সীমিত ছিল।
2. অনেক ভারতীয় (শিখ, গোর্খা, বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত) ব্রিটিশদের পক্ষে লড়াই করেছিল।
3. বিদ্রোহের কোনো সুসংগঠিত জাতীয় নেতৃত্ব বা পরিকল্পনা ছিল না।
1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ কেন?
বিদ্রোহের কারণ, অংশগ্রহণকারী ও লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক একে গণআন্দোলন বললেও অন্যরা একে সৈন্য বা সামন্তবিদ্রোহ বলে থাকেন। C.A. Bayly-র মতে, এটি একক আন্দোলন নয়, বরং বিভিন্ন বিদ্রোহের সমষ্টি ছিল।
1857 সালের বিদ্রোহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?
1857 সালের বিদ্রোহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব –
1. এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বড় প্রতিরোধ ছিল।
2. পরবর্তী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণা দিয়েছিল, যদিও তাৎক্ষণিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল।
3. এর ফলে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা ও নীতিতে বড় রদবদল ঘটে (যেমন – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শেষ হয়ে ব্রিটিশ রাজত্ব শুরু)।
1857 সালের বিদ্রোহকে ‘সামন্ত বিদ্রোহ’ বলা হয় কেন?
প্রবক্তা – চার্লস রেকস, স্যার জন লরেন্স, দাদাভাই নৌরজি, আর. সি. মজুমদার প্রমুখ।
যুক্তি – 1. এটি মূলত সিপাহিদের বিদ্রোহ ছিল, সাধারণ জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ সীমিত ছিল।
2. অনেক ভারতীয় (শিখ, গোর্খা, বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত) ব্রিটিশদের পক্ষে লড়াই করেছিল।
3. বিদ্রোহের কোনো সুসংগঠিত জাতীয় নেতৃত্ব বা পরিকল্পনা ছিল না।
1857 সালের বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ কী?
1857 সালের বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ –
1. সমন্বয়হীনতা – কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিল না।
2. সীমিত অংশগ্রহণ – দক্ষিণ ভারত, বাংলা, পাঞ্জাব (শিখ ও গোর্খারা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল) অংশ নেয়নি।
3. প্রযুক্তিগত পিছিয়ে থাকা – ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রের কাছে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়।
1857 সালের বিদ্রোহের ঐতিহাসিক তাৎপর্য কী?
1857 সালের বিদ্রোহের ঐতিহাসিক তাৎপর্য –
1. ব্রিটিশ শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পায়, ভারত শাসন আইন 1858 পাস করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শেষ হয় এবং সরাসরি ব্রিটিশ রাজত্ব শুরু হয়।
2. পরবর্তী স্বাধীনতা আন্দোলনের (কংগ্রেস, বিপ্লবী আন্দোলন) জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘ভারতের স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম’/জাতীয় বিদ্রোহ বলা কতটা যুক্তিযুক্ত?” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই “1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘ভারতের স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম’/জাতীয় বিদ্রোহ বলা কতটা যুক্তিযুক্ত?” প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের চতুর্থ অধ্যায় “সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা” -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।