এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন — “ভারতের নগরায়ণের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়সমূহ আলোচনা করো।” — নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ” -এর “ভারতের জনসংখ্যা” অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি প্রায়ই আসে, তাই এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের নগরায়ণের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়সমূহ আলোচনা করো।
মূলত গ্রাম্য জীবনের তুলনায় শহরের জীবনের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রামবাসীদের পৌর সমাজের প্রতি আকর্ষণ করে। একই সঙ্গে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার কিছু অন্তর্নিহিত অসুবিধা গ্রামবাসীদের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে বসবাস করতে বাধ্য করে। অন্যান্য সকল দেশের মতো ভারতেও শহরে বসবাসের কিছু সুবিধা এবং গ্রাম্য জীবনের কিছু অসুবিধা নগরায়ণকে প্রভাবিত করে থাকে। সুতরাং, যে সমস্ত বিষয়গুলি ভারতে নগরায়ণকে প্রভাবিত করে সেগুলি হল –
কৃষিভূমির সীমিত আয়তন –
ভারতে গ্রামাঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় জনসংখ্যার অত্যধিক চাপে মাথাপিছু কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমশ কমছে। তাই গ্রামবাসীর তুলনায় কৃষিজমির পরিমাণ অতি নগণ্য। আবার গ্রামগুলিতে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। ফলে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব, পুরো বেকারত্ব, অভাব-অনটন প্রভৃতি গ্রামবাসীদের নিত্যসঙ্গী। তাই রুজিরোজগার বা জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে গ্রামবাসীদের শহরমুখী হতে হয়।
মানসিকতার পরিবর্তন –
ভারতের গ্রামাঞ্চলগুলিতে পূর্বের তুলনায় বর্তমান শিক্ষার বিস্তার অনেক বেশি। ফলে শিক্ষিত গ্রামবাসীরাও শহরে গিয়ে শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাবসাবাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করে নিজেদের জীবনযাপন প্রণালীকে উন্নততর করতে সচেষ্ট হচ্ছে।
অবাধ জীবনযাপন –
গ্রাম্যজীবন জাতপাতের অনুশাসনে, বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ। জাতপাতের ভিত্তিতে সামাজিক স্তরবিন্যাসও জটিল। পক্ষান্তরে ভারতের শহরগুলি বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন ধর্মের ও বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মিলনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। শহরে সকল শ্রেণির মানুষের অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত মেলামেশার ফলে জাতপাতের বৈষম্য নেই বললেই চলে। এখানে মানুষজন তাদের গুণগত যোগ্যতার বিচারে সামাজিক সফলতার অবাধ সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। তাই ভারতের গ্রামবাসীগণ আজ শহরমুখী হচ্ছে।
কর্মসংস্থানের সুযোগ –
নগর বা মহানগরগুলিতে অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধার বিশেষ আকর্ষণ গ্রামবাসীদের আকৃষ্ট করে। শহরে বিভিন্ন সংস্থায় এবং অফিসে কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক বেশি। আবার শহরগুলিতে জীবিকার বৈচিত্র্যও আছে। এখানে গুণগত যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থান ঘটে। তাই উন্নততর জীবিকার খোঁজে ভারতের গ্রামাঞ্চলের মানুষজন আজ শহরমুখী হচ্ছে।
শিক্ষার সুযোগ –
উচ্চশিক্ষার সমস্ত সুযোগসুবিধা গ্রামে বসে পাওয়া যায় না। তাই সচেতন গ্রামবাসীগণ বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সবস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করার আশায় শহরে এসে উপস্থিত হন।
রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা –
সাধারণত মহকুমা সদর, জেলা সদর, রাজধানী শহর প্রভৃতি হল বিভিন্ন স্তরের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মূল কেন্দ্র। তাই রাজনৈতিক দিক দিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে এমন রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ বিভিন্ন শহরে এসে বসবাস করেন।
আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা –
শহরের শিল্পকলা ও সংস্কৃতি যেমন গ্রামের সংস্কৃতিমনস্ক শিক্ষিত মানুষকে আকর্ষণ করে তেমনি জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং আমোদ-প্রমোদের বিচিত্র সব ব্যবস্থা শহরে মজুত থাকায় গ্রামের পয়সাওয়ালা বিলাসী মানুষরা শহরে এসে সমবেত হন।
শিল্পায়ন –
শিল্পায়ন ও নগরায়ণ একে অন্যের পরিপুরক। শিল্পায়ন নগরায়ণের বৃদ্ধির হারকে ত্বরান্বিত করে। শিল্পায়নের বৈশিষ্ট্যগুলি কোনো স্থানের আর্থসামাজিক অবস্থাকে এমনভাবে পরিবর্তিত করে যে সেখানে জনবসতির বিবর্তন খুব সহজেই ঘটে ও শহরের বিকাশ ঘটে। যেমন – যে স্থানে শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে সেখানে কাজের জন্য পার্শ্ববর্তী জায়গা থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে, ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন হয়। তা ছাড়াও শিল্প কর্তৃপক্ষ শ্রমিক ও কারখানা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় মানুষদের বসবাসের জন্য জনবসতি এলাকা গড়ে তোলে। এইভাবে সেই অঞ্চল ধীরে ধীরে শহরে পরিণত হয়। যেমন — এই পদ্ধতিতে ছোটোনাগপুরের শিল্পোন্নত স্থানগুলিতে (জামশেদপুর, রাঁচি, বোকারো প্রভৃতি) খুব দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে শহরে পরিণত হয়েছে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
নগরায়ণ বলতে কী বোঝায়?
নগরায়ণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে গ্রামীণ জনসংখ্যা ক্রমশ শহরাঞ্চলের দিকে সরে আসে এবং শহরের আকার, জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়।
ভারতে নগরায়ণের প্রধান কারণগুলি কী কী?
ভারতে নগরায়ণের প্রধান কারণগুলি হলো –
1. কৃষিজমির সীমিততা ও গ্রামে বেকারত্ব।
2. কর্মসংস্থানের সুযোগ (শিল্প ও সেবাখাতে চাকরি)।
3. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধার প্রাপ্যতা।
4. উন্নত জীবনযাত্রার আকাঙ্ক্ষা।
5. শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক বিকাশ।
6. গ্রামীণ অঞ্চলে সামাজিক বিধিনিষেধ থেকে মুক্তি।
শিল্পায়ন কীভাবে নগরায়ণকে প্রভাবিত করে?
শিল্পায়নের ফলে কারখানা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। ফলে মানুষ গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি জমায়, যা নগরায়ণকে ত্বরান্বিত করে।
গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের ফলে কী সমস্যা দেখা দেয়?
গ্রাম থেকে শহরে অত্যধিক জনসংখ্যা প্রবেশের ফলে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলি দেখা দেয় –
1. অপরিকল্পিত বসতি (স্লাম এলাকা বৃদ্ধি)।
2. যানজট ও পরিবেশ দূষণ।
3. জল, বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্য সুবিধার অভাব।
4. অপরাধ ও সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি।
নগরায়ণের ইতিবাচক প্রভাবগুলি কী কী?
নগরায়ণের কিছু ইতিবাচক দিক হলো –
1. অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি।
2. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধার উন্নতি।
3. আধুনিক প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির প্রসার।
4. অবকাঠামোগত উন্নয়ন (যেমন — রাস্তা, হাসপাতাল, স্কুল)।
ভারতের কোন রাজ্যগুলিতে নগরায়ণের হার সবচেয়ে বেশি?
ভারতের মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, গুজরাট, কর্ণাটক ও পশ্চিমবঙ্গের মতো শিল্পোন্নত রাজ্যগুলিতে নগরায়ণের হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
নগরায়ণ রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
নগরায়ণের নেতিবাচক প্রভাব কমানোর জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে –
1. গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা (যেমন — কুটিরশিল্প, কৃষি উন্নয়ন)।
2. গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি।
3. গ্রামে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধার উন্নতি।
4. ছোটো শহরগুলির বিকাশ (স্মার্ট সিটি প্রকল্প)।
ভারতে নগরায়ণের ভবিষ্যৎ কী?
ভারতে নগরায়ণের হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। 2050 সালের মধ্যে ভারতের প্রায় 50% জনসংখ্যা শহরে বাস করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তাই শহরগুলির পরিকল্পিত উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন — “ভারতের নগরায়ণের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়সমূহ আলোচনা করো।” — নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ” -এর “ভারতের জনসংখ্যা” অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি প্রায়ই আসে, তাই এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন