আজ আমি তোমাদের জন্য নিয়ে এসেছি নবম শ্রেণির বাংলা গল্প ইলিয়াস। এই গল্পটি রচনা করেছেন বিশ্ববিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লিও তলস্তয়। গল্পটিতে একজন ধনী ব্যক্তি ইলিয়াসের জীবনের নানা উত্থান-পতন ও জীবনদর্শন ফুটে উঠেছে।
গল্পের শুরুতে দেখা যায়, ইলিয়াস একজন ধনী ব্যবসায়ী। তার প্রচুর সম্পদ ও লোকজন। সে খুবই অহংকারী ও গর্বময়। সে মনে করে, তার মতো ধনী ও শক্তিশালী মানুষ এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
কিন্তু একদিন ইলিয়াসের জীবনে একটি বড় দুঃখ নেমে আসে। তার ব্যবসায় ধ্বস নামে। সে তার সব সম্পত্তি ও লোকজন হারিয়ে ফেলে। হয়ে পড়ে একজন দরিদ্র মানুষ।
এই দুঃখের সময় ইলিয়াস তার আত্মমর্যাদা ও অহংকার হারিয়ে ফেলে। সে বুঝতে পারে, ধন-সম্পদ আর শক্তিশালী থাকার মধ্যেই মানুষের সুখ নেই।
গল্পের শেষে ইলিয়াস একজন জ্ঞানী ও বিচক্ষণ মানুষ হয়ে ওঠে। সে তার জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা লাভ করে। সে বুঝতে পারে, জীবনের সার্থকতা ধন-সম্পদে নয়, বরং মানবতা ও জ্ঞানে।
ইলিয়াস তো ভাগ্যবান পুরুষ; – কারা, কেন ইলিয়াসকে ভাগ্যবান পুরুষ বলতে চায়? এই উক্তি তুমি সমর্থন কর কি না যুক্তি-সহ লেখো।
ইলিয়াসকে ভাগ্যবান পুরুষ বলার কারণ – লিও তলস্তয়ের ইলিয়াস গল্পে ইলিয়াসের আশেপাশে থাকা লোকজন তার সম্পর্কে মন্তব্যটি করেছিল। ইলিয়াসের বিয়ের পরে যখন তার বাবা মারা গিয়েছিল তখন সে না ধনী, না দরিদ্র। সাতটা ঘোটকী, দুটো গোরু আর কুড়িটা ভেড়া ছিল তার সম্পত্তি। কিন্তু ইলিয়াসের সুপরিচালনা আর তার এবং তার স্ত্রীর কঠোর পরিশ্রমে প্রতি বছরই ইলিয়াসের অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। পঁয়ত্রিশ বছরের পরিশ্রমে ইলিয়াস দুশো ঘোড়া, দেড়শো গোরু-মহিষ আর বারোশো ভেড়ার মালিক হয়। ভাড়াটে মজুররা তার গোরু-ঘোড়ার দেখাশোনা করত। ভাড়াটে মজুরনিরা দুধ দুইত, কুমিস- মাখন-পনির তৈরি করত। ইলিয়াসের নামডাক তখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার আশেপাশের লোকেরা তখনই হিংসায় জ্বলে গিয়ে হয়ে উদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছিল।
আমার মত – ইলিয়াসের উন্নতি হয়েছিল ভাগ্যের জোরে নয়, তার পরিশ্রমের কারণে। চেষ্টা, ইচ্ছাশক্তি এবং লক্ষ্যে স্থির থাকলে যে নিশ্চিতভাবে সাফল্য পাওয়া যায়, তার সার্থক উদাহরণ ইলিয়াস। তাই ভাগ্যকে ইলিয়াসের সাফল্যের ভিত্তি বললে তার পরিশ্রমকেই ছোটো করে দেখানো হয়।
দূর দূরান্তর থেকে অতিথিরা তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। — কার সঙ্গে অতিথিরা দেখা করতে আসে? অতিথিদের দেখা করতে আসার কারণ কী? সে আগত অতিথিদের কীভাবে সেবা করত?
উদ্দিষ্ট ব্যক্তি – লিও তলস্তয় রচিত ইলিয়াস গল্প থেকে নেওয়া উদ্ধৃতাংশে উফা প্রদেশে বসবাসকারী বাস্কির জনগোষ্ঠীভুক্ত ইলিয়াসের সঙ্গে অতিথিদের দেখা করতে আসার কথা বলা হয়েছে।
অতিথিদের দেখা করতে আসার কারণ – ইলিয়াস তার অতি সাধারণ অবস্থা থেকে কঠোর পরিশ্রম এবং ব্যাবসায়িক বুদ্ধির জোরে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। পঁয়ত্রিশ বছরের পরিশ্রমে দুশো ঘোড়া, দেড়শো গোরু-মোষ, বারোশো ভেড়া এবং অসংখ্য মজুরের মনিবে পরিণত হয় ইলিয়াস। তার প্রতিপত্তি প্রতিবেশীদের ঈর্ষার কারণ হয়ে ওঠে। ক্রমে তার সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দূরদূরান্ত থেকে অতিথিরা তার সঙ্গে দেখা করতে আসতে থাকে।
ইলিয়াস কর্তৃক আগত অতিথিদের সেবা – ইলিয়াস ছিল অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ মানুষ। ফলে আগত অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে তাদের ভোজ্য-পানীয় দিয়ে সেবা করত। অতিথিদের জন্য কুমিস, চা, শরবত, মাংস সবসময়ই তৈরি থাকত। অতিথির সংখ্যা অনুযায়ী ভেড়া এবং ঘোটকী মারা হত। বাড়িতে আসা অতিথিদের যথাযথ আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখত না ইলিয়াস।
আসল অবস্থা বুঝে উঠবার আগেই সে একেবারে সর্বহারা হয়ে পড়ল। — সে বলতে কার কথা বোঝানো হয়েছে? সে কীভাবে সর্বহারা হল? তারপর তার কী হল?
অথবা, ফলে ইলিয়াসের সম্পত্তিতে টান পড়ল। — ইলিয়াসের সম্পত্তিতে টান পড়ার কারণ কী? এর ফলে ইলিয়াসের যে পরিণতি হয় তা সংক্ষেপে লেখো।
সের পরিচয় – লিও তলস্তয় রচিত ইলিয়াস গল্প থেকে নেওয়া উদ্ধৃতাংশে সে বলতে বৃদ্ধ ইলিয়াসের কথা বলা হয়েছে।
সর্বহারায় পরিণত হওয়া – দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠার ফলে ইলিয়াস প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ইলিয়াস তার ছোটো পুত্র ও তার মুখরা স্ত্রীকে আলাদা করার সময় একটি বাড়ি ও কিছু পশু দিয়ে দেওয়ায় তার সম্পত্তিতে টান পড়ে। এরপরেই মড়কের ফলে ইলিয়াসের অনেকগুলি ভেড়া মারা যায়। তার ওপর আবার দুর্ভিক্ষের ফলে খাদ্যের অভাবে অনেক গোরু-মোষও মারা যায়। কিরবিজরা তার ভালো ঘোড়াগুলি চুরি করার ফলে ইলিয়াসের অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যায়। সত্তর বছরের বৃদ্ধ ইলিয়াস পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তার পশমের কোট, কম্বল, ঘোড়ার জিন, তাঁবু এবং অবশিষ্ট গৃহপালিত পশুগুলি বিক্রি করে। কিন্তু তাতেও তারা দুর্দশার চরমে পৌঁছে যায়। এইভাবে সে ধীরে ধীরে সর্বহারা হয়ে পড়ে।
পরিণতি – বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী শাম-শেমাগিকে নিয়ে ইলিয়াস এক অপরিচিত ব্যক্তির বাড়িতে কাজ করে দিন কাটাতে থাকে। ছোটো ছেলে দূরদেশে চলে যাওয়ায় এবং একমাত্র মেয়ে মারা যাওয়ায় অসহায় বৃদ্ধ দম্পতিকে সাহায্যের জন্য কেউ ছিল না। এই সময় তাদের এক দয়ালু প্রতিবেশী মহম্মদ শা কাজের বিনিময়ে ইলিয়াস দম্পতিকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় ও খাবার দেয়। ইলিয়াস গ্রীষ্মে মহম্মদের তরমুজের খেতে কাজ করত এবং শীতে গোরু-ঘোড়ার দেখাশোনা করত। তার বৃদ্ধা স্ত্রী শাম-শেমাগি ঘোটকীর দুধ দুইত এবং কুমিস বানানোর কাজ করত। এভাবেই একদা বিত্তশালী ইলিয়াস সম্পত্তি হারিয়ে ভাড়াটে মজুরের কাজ করে দিন চালাতে থাকে।
বৃদ্ধ দম্পতিকে সাহায্য করবার তখন কেউ নেই – বৃদ্ধ দম্পতি বলতে কাদের কথা বোঝানো হয়েছে? তাদের কোন্ পরিস্থিতিতে সাহায্য করার কেউ ছিল না?
বৃদ্ধ দম্পতি -র পরিচয় – লিও তলস্তয় রচিত ইলিয়াস গল্পে বৃদ্ধ দম্পতি বলতে ইলিয়াস ও তার স্ত্রী শাম-শেমাগিকে বোঝানো হয়েছে।
উদ্দিষ্ট পরিস্থিতি – দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সুব্যবস্থাপনার গুণে ইলিয়াস বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। দুশো ঘোড়া, দেড়শো গোরু-মোষ, বারোশো ভেড়া এবং অসংখ্য মজুরের মনিব ইলিয়াসের সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর হঠাৎই ইলিয়াসের বড়ো ছেলে একটি মারামারির ঘটনায় মারা যায়। ছোটো ছেলে এবং তার ঝগড়াটে স্ত্রী ইলিয়াসকে অমান্য করতে শুরু করলে সে তাদের একটা বাড়ি ও কিছু গোরু-ঘোড়া দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। এরপর থেকেই ইলিয়াসের অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। মড়কে ইলিয়াসের অনেকগুলি ভেড়া মারা যায়। দুর্ভিক্ষের ফলে খড়ের অভাবে শীতকালে অনেক গোরু-মোষও না খেতে পেয়ে মরে যায়। কিরবিজরা তার ভালো ঘোড়াগুলি চুরি করে নিয়ে যায়। সত্তর বছর বয়সে ইলিয়াস বাধ্য হয়ে তার পশমের কোট, কম্বল, ঘোড়ার জিন, তাঁবু এবং অবশিষ্ট গৃহপালিত পশুগুলি বিক্রি করে দেয়। তাদের বিতাড়িত পুত্র সেই সময় দূরদেশে ছিল এবং একমাত্র মেয়েও মারা গিয়েছিল। সর্বহারা ও চরম অসহায় বৃদ্ধ দম্পতিকে তখন সাহায্য করার মতো নিজের কেউ ছিল না।
ইলিয়াসের অতিথিবৎ-সলতার কথা স্মরণ করে তার খুব দুঃখ হলো। — কার কথা বলা হয়েছে? সে কী করেছিল? ইলিয়াসের জীবনে তার কী প্রভাব পড়েছিল?
উদ্দিষ্ট ব্যক্তির পরিচয় – ইলিয়াস গল্পে উল্লিখিত অংশে ইলিয়াসের প্রতিবেশী মহম্মদ শা-র কথা বলা হয়েছে।
ইলিয়াসের জীবনে তার প্রভাব – মহম্মদ শা নিজে ধনী না হলেও তার অভাব ছিল না। সে ছিল খুব ভালো লোক। তাই ইলিয়াসের দুরবস্থায় তার খুব দুঃখ হয়। সে ইলিয়াস ও তার স্ত্রীকে নিজের বাড়িতে এসে থাকতে বলে। এর বিনিময়ে ঠিক হয় ইলিয়াস তার ক্ষমতা অনুযায়ী গরমকালে তরমুজ খেতে কাজ করবে। আর শীতকালে গোরু-ঘোড়াদের খাওয়াবে। তার স্ত্রী শাম-শেমাগি ঘোটকীগুলোর দুধ দুইবে এবং কুমিস তৈরি করবে। মহম্মদ শা তাদের দুজনেরই খাওয়াপরার দায়িত্ব নেয়। এ ছাড়াও যদি কিছু লাগে তা দিতে প্রতিশ্রুত হয়।
ইলিয়াসের জীবনে এর প্রভাব – ইলিয়াস এই উদারতার জন্য মহম্মদ শা-কে ধন্যবাদ দিয়েছিল। ভাড়াটে মজুরের মতো কাজ করতে গিয়ে প্রথমদিকে তাদের খুবই কষ্ট হত, কিন্তু ক্রমে সবই সহ্য হয়ে গেল। নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী তারা যত পারত কাজ করত। জীবনের কোনো সময় নিজেরাও মনিব ছিল বলে তারা সব কাজই ভালোভাবে করতে পারত। কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ যে, অর্থ-সম্পত্তিই সুখের ভিত্তি নয়— তা ইলিয়াস এবং তার স্ত্রী এই সময় উপলব্ধি করে। কাজের বাইরে ফাঁকা সময়টা তারা গল্প করার বা ভাবার কাজে লাগাতে পারে। আগের থেকে অনেক দুশ্চিন্তামুক্ত এরকম জীবনেই তারা প্রকৃত সুখ খুঁজে পায়।
ভাগ্য যেন চাকার মতো ঘোরে – কাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে? বক্তার এমন বক্তব্যের কারণ ব্যাখ্যা করো?
উদ্দিষ্ট ব্যক্তি – লিও তলস্তয়ের ইলিয়াস গল্পে মহম্মদ শার বাড়িতে আগত জনৈক অতিথি মহম্মদ শা-কে মন্তব্যটি করলেও মন্তব্যটির উদ্দেশ্য ছিল ইলিয়াস।
এমন বক্তব্যের কারণ – পঁয়ত্রিশ বছরের কঠোর পরিশ্রমে ইলিয়াস এবং তার স্ত্রী প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী হয়। দুশো ঘোড়া, দেড়শো গোরু-মহিষ এবং বারোশো ভেড়া-র মালিক হয় ইলিয়াস। চারপাশে তার প্রচুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেশীরাও তাকে ঈর্ষা করতে শুরু করে। অতিথিরা দূরদূরান্ত থেকে আসতে থাকে এবং ইলিয়াসও উদারভাবে অতিথিসেবা করতে থাকে। কিন্তু নানা কারণে ইলিয়াসের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে। ছেলের সঙ্গে বিবাদে তাকে আলাদা করে দেওয়া, মড়ক, কিরবিজ – দের ঘোড়া চুরির ঘটনা, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি নানা কারণে তার পালিত পশুর সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে।
শেষ অবধি নিজের পশমের কোট, কম্বল ইত্যাদির সঙ্গে অবশিষ্ট গৃহপালিত পশুগুলোকে বিক্রি করে দিয়ে সে সর্বহারা হয়ে পড়ে। তাদের অন্যের বাড়িতে কাজ করে দিন কাটাতে থাকে। এই অবস্থায় প্রতিবেশী মহম্মদ শা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়। ইলিয়াসদের করা সাধ্যমত কাজের বদলে তাদের খাওয়া পরার দায়িত্ব নেয় মহম্মদ শা। অবস্থাপন্ন ইলিয়াসের এই মজুর জীবনে রূপান্তরের পরিপ্রেক্ষিতেই মহম্মদ শা-র বাড়িতে আগত অতিথিরা এই মন্তব্যটি করেছেন।
লোকটির সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি কি? – বক্তা কে? তিনি কার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন? এরপরে কী হল?
বক্তার পরিচয় – লিও তলস্তয় রচিত ইলিয়াস গল্প থেকে নেওয়া উদ্ধৃতাংশটির বক্তা হলেন মহম্মদ শা-র বাড়িতে আগত অতিথি মুসলিম ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি মোল্লাসাহেবের এক আত্মীয়।
উদ্দিষ্ট ব্যক্তি – ওই ব্যক্তি মহম্মদ শা-র বাড়িতে কর্মরত বৃদ্ধ ইলিয়াসের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন।
পরবর্তী ঘটনা – গৃহস্বামী মহম্মদ শা বৃদ্ধ ইলিয়াস ও তার স্ত্রীকে অতিথিদের কাছে নিয়ে আসেন। জনৈক অতিথি ইলিয়াসের কাছে জানতে চান যে অতীতজীবনের সুখসমৃদ্ধির কথা স্মরণ করে এবং বর্তমানের দুরবস্থার কথা ভেবে সে কতটা কাতর ও বিষাদগ্রস্ত। ইলিয়াস প্রত্যুত্তরে হাসিমুখে বলে যে এই বিষয়ে তার স্ত্রীই সম্পূর্ণ সত্য বলতে পারবে। শাম-শেমাগি অতিথিদের জানায় যে পঞ্চাশ বছরের দাম্পত্যজীবনে তাদের অর্থের অভাব না থাকলেও প্রকৃত সুখ ছিল না। তারা সবসময়েই দুশ্চিন্তা ও পাপবোধে জর্জরিত ছিল। সম্পত্তির মোহে তারা ছিল অন্ধ, ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও সুখ-দুঃখের আলোচনার সময় হতনা। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করারও সময় ছিল না।
কিন্তু সর্বহারা হয়ে ভাড়াটে মজুর হিসেবে কাটানো জীবনের দু-বছরেই তারা প্রকৃত সুখ ও শান্তি পেয়েছে। অর্থের তুলনায় মনের সুখ তাদের গভীরভাবে সমৃদ্ধ করেছে। মনের কথা আলোচনা করে এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে তাদের মন প্রকৃত সুখ খুঁজে পেয়েছে। ইলিয়াসও তার স্ত্রীর কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করে।
কিন্তু ওর মধ্যে বিশেষ করে দেখবার কিছু আছে নাকি? — কে, কার কথা বলেছে? তাকে কী উত্তর দেওয়া হয়েছিল? এতে বক্তার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল?
উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদ্বয়ের পরিচয় – ইলিয়াস গল্পের উল্লিখিত অংশে দরজার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া বুড়ো মানুষ অর্থাৎ ইলিয়াসের কথা বলা হয়েছে এবং মন্তব্যটি করেছিলেন মহম্মদ শা-র বাড়িতে আগত অতিথিদের একজন।
প্রত্যুত্তর – দরজার পাশ দিয়ে যে বুড়ো মানুষটি চলে গিয়েছিল তাকে অতিথিরা লক্ষ করেছেন কি না তা মহম্মদ শা জানতে চেয়েছিলেন। একজন অতিথি তাকে না দেখার কথা বলে জানতে চেয়েছিলেন যে, তার মধ্যে বিশেষ কিছু দেখার আছে কি না। উত্তরে মহম্মদ শা জানান যে সে ওই তল্লাটে একসময় সবচেয়ে ধনী ছিল, তার নাম ইলিয়াস। নামটা হয়ত অতিথিরা শুনে থাকবেন। অথচ এখন তার কিছুই নেই, মহম্মদ শা-র বাড়িতে সে আর তার স্ত্রী বর্তমানে মজুরের মতো থাকে।
বক্তার প্রতিক্রিয়া – একজন অতিথি এই কথাবার্তার সময়ে জানান যে লোকটিকে কখনও চোখে না দেখলেও তার নাম তাঁরা শুনেছিলেন, কারণ লোকটির নাম বহুদূর অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল। ইলিয়াসের বর্তমান দুরবস্থার কথা শুনে লোকটি বিস্মিত হন এবং বলেন যে ভাগ্য যেন চাকার মতো ঘোরে, কখনও একজন ওপরে ওঠে তো আর-একজন তলায় পড়ে যায়। অতিথি ব্যক্তিটি বৃদ্ধ ইলিয়াস এখন অত্যন্ত দুঃখী কি না তা মহম্মদ শা-র কাছে জানতে চান এবং তার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জীবন সম্পর্কে তার কাছে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে চান বলে সেই ব্যক্তি জানান।
এই হলো আমার মনের কথা— বক্তা কে? সে কী বলেছিল? বক্তার মনের কথার মধ্য দিয়ে তার কোন্ উপলব্ধি ফুটে উঠেছে?
বক্তার পরিচয় – লিও তলস্তয় রচিত ইলিয়াস গল্প থেকে নেওয়া উদ্ধৃতাংশটির বক্তা হল ইলিয়াসের স্ত্রী শাম-শেমাগি।
বক্তব্য – মহম্মদ শা-র বাড়িতে আগত জনৈক অতিথির প্রশ্নের উত্তরে মনের কথা বলতে গিয়ে শাম-শেমাগি জানায়, তারা দাম্পত্য জীবনের পঞ্চাশ বছরে অর্থের প্রাচুর্য এবং ধনী জীবনযাপনের মধ্যে অন্তরের সুখকে বহু খুঁজেছে। কিন্তু সুখ কখনও তাদের কাছে ধরা দেয়নি। বর্তমানে ভাড়াটে মজুরের কষ্টকর জীবনে মাত্র দু-বছরেই তারা প্রকৃত সুখের সন্ধান পেয়েছে। তাই জীবন থেকে তাদের আর কিছু চাওয়ার নেই।
উপলব্ধি – ধনসম্পত্তি থাকলেও মনে শান্তি ছিল না ইলিয়াস দম্পতির। অর্থ, লোকবল, সম্পত্তি ইত্যাদির প্রাচুর্যের মধ্যেও ছিল দুশ্চিন্তা ও অশান্তি। সম্পত্তি হারিয়ে শাম-শেমাগি প্রকৃত সুখ এবং সত্যের তাৎপর্য বোঝে। তখন ভাড়াটে মজুর হিসেবে কাজের বিনিময়ে অন্ন- বাসস্থান পেলেও স্বামী-স্ত্রীতে একান্তে মনের কথা আলোচনা করতে পারত। ঝগড়া ও দুশ্চিন্তার বদলে মনিবের কাজেই তাদের অধিকাংশ সময় কেটে যেত। মনের কথা আলোচনা বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করারও অবকাশ ছিল। তাই শাম-শেমাগির এই উপলব্ধি হয়, পঞ্চাশ বছরের দাম্পত্য জীবনে প্রকৃত সুখ খুঁজে বেড়ালেও এতদিনে তারা সেই সুখের হদিস পেয়েছে।
ইলিয়াস গল্পে বৃদ্ধ দম্পতির কী কী বিষয়ে দুশ্চিন্তা হত?
দুশ্চিন্তার বিষয় – ইলিয়াস গল্পে ইলিয়াসের স্ত্রী শাম-শেমাগি নিজেদের বর্তমান সর্বহারা জীবনের সঙ্গে অতীতের সম্পন্ন জীবনের তুলনা করতে গিয়ে বলেছে যে, যখন তারা ধনী ছিল তখন ইলিয়াস বা তার মনে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি ছিল না। পরস্পর কথা বলার, মনের কথা ভাবার বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার সময় ছিল না তাদের ৷ অজস্র দুশ্চিন্তা সবসময় ভিড় করে থাকত।
অতিথিরা এলে তাদের উপযুক্ত সমাদর করার জন্য দুশ্চিন্তা, অতিথিরা চলে গেলে মজুরদের দিকে নজর রাখা — যাতে তারা কাজে ফাঁকি না দেয়, অন্যদিকে নিজেদের স্বার্থে এইভাবে নজরদারি পাপ — এ কথা ভেবেও দুশ্চিন্তা হত। আরও দুশ্চিন্তা ছিল যে, নেকড়ে হয়তো ঘোড়ার বাচ্চা বা গোরুর বাছুর নিয়ে গেল কিংবা চোর এসে ঘোড়াগুলোকে নিয়ে সরে পড়ল। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়ে দুশ্চিন্তা হত যে মা-ভেড়া হয়তো ছানাগুলোকে চেপে মেরে ফেলল। ফলে সারারাত তাদের না ঘুমিয়ে কাটত। এক দুশ্চিন্তা থেকে আর এক দুশ্চিন্তায় মন চলে যেত। শীতের দিনে যথেষ্ট খড় মজুত আছে কি না তা নিয়েও দুশ্চিন্তা হত। এ ছাড়া ইলিয়াসের সঙ্গে কাজকর্ম নিয়ে মতবিরোধ হত, ঝগড়া হত। দুশ্চিন্তা এভাবে তাদের যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত, আর সুখ চলে যেত দূরে।
সুখী জীবন কাকে বলে কোনোদিন বুঝিনি। — বক্তা কে? এই প্রসঙ্গে সে কী বলেছে?
বক্তার পরিচয় – লিও তলস্তয় রচিত ইলিয়াস গল্প থেকে নেওয়া উদ্ধৃতাংশটির বক্তা হল ইলিয়াসের বৃদ্ধা স্ত্রী শাম-শেমাগি।
বক্তার মন্তব্য – বিপুল অর্থ ও সম্পত্তির মালিক হয়েও ইলিয়াস দম্পতির পঞ্চাশ বছরের দাম্পত্য জীবনে সুখ ছিল না। অর্থ ছিল ঠিকই, কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মনের কথা আলোচনার সময়টুকুও ছিল না। সময় ছিল না অন্তরের কথা ভাবারও। সবসময়ে দুশ্চিন্তার ফলে ঈশ্বরের প্রার্থনা করার অবকাশও ছিল না। বাড়িতে অতিথিদের যথাযথ আপ্যায়ন, অতিথি বিদায়ের পর মজুরদের ওপর নজরদারি ইত্যাদি কাজেই সময় কেটে যেত তাদের। রাত্রিকালে নেকড়ের মতো বন্য হিংস্র পশু বা চোর যাতে পশু চুরি না করে তা নিয়েও দুশ্চিন্তা ছিল। ভেড়ার ছানাগুলো সুরক্ষিত আছে কি না সেই ভাবনায় ঘুমোতে গিয়ে ঘুমও আসত না। এইসব চিন্তার পাশাপাশি আবার চিন্তা ছিল ভবিষ্যতেরও।
শীতের যথাযথ রসদ মজুত আছে কি না তা নিয়েও ভাবনার শেষ ছিল না। এ ছাড়া মতবিরোধের কারণে ইলিয়াস দম্পতির মধ্যে ঝগড়াও হত। নানান দুশ্চিন্তা, পাপবোধ থেকে মানসিক শান্তি ও সুখ ছিল না তাদের জীবনে। তাই অর্থ-সম্পত্তি থাকলেও শাম-শেমাগি বলেছে সুখী জীবন কাকে বলে কোনোদিন বুঝিনি।
অতিথিরা হেসে উঠল। কার, কোন্ কথা শুনে অতিথিরা হেসে উঠল? অতিথিদের হাসি শুনে ইলিয়াস কী বলেছিল?
উদ্দিষ্ট ব্যক্তি – লিও তলস্তয় রচিত ইলিয়াস গল্পে ইলিয়াসের স্ত্রী শাম-শেমাগির কথা শুনে অতিথিরা হেসে ওঠে।
শাম-শেমাগি অতিথিদের বলে যে, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সম্পদশালী জীবনে সুখের সন্ধান করেও সুখ তারা খুঁজে পায়নি। তাদের জীবনে একান্তে কথা বলার বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার অবকাশ ছিল না। সবসময়ই ভাবনা হত আতিথেয়তা নিয়ে কেউ নিন্দা করবে কি না সে কথা ভেবে। মজুরদের দিকে কড়া নজর দিতেই ইলিয়াস দম্পতির সময় কেটে যেত। কিন্তু শেষবয়সে ভাড়াটে মজুর হিসেবে কাজ করার সময় তারা জীবনের প্রকৃত সত্যকে খুঁজে পেয়েছে। মনের সুখে স্বামী-স্ত্রীর আলাপ-আলোচনা বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার অবকাশও তাদের রয়েছে। পঞ্চাশ বছর ধরে সুখ খুঁজে ফিরলেও প্রকৃত সুখ তাদের জীবনে কখনও আসেনি। অতিথিরা ইলিয়াসপত্নীর বলা এই কথাগুলি শুনেই হেসে ওঠে।
ইলিয়াসের বক্তব্য – অতিথিদের হাসি শুনে ইলিয়াস বলে, এই কথাগুলি কৌতুক বা পরিহাসের নয়। তারা সম্পত্তির মোহে অন্ধ ছিল বলেই নিঃস্ব হয়ে দুঃখ করছিল। সম্পত্তির লোভে মত্ত থাকায় কোনোদিনই তারা প্রকৃত সুখ উপভোগ করেনি। কিন্তু সর্বহারা হওয়ার পর ঈশ্বর তাদের প্রকৃত জীবনসত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। জীবন থেকে পাওয়া এই শিক্ষা ইলিয়াস সকলের কল্যাণের জন্যই তুলে ধরেছে।
আর সে কথা যে আমরা আপনাদের বললাম তা ফুর্তির জন্য নয়, আপনাদের কল্যাণের জন্য। বক্তা কে? বক্তা কখন এ কথা বলেছে? তার এ কথা বলার কারণ কী?
বক্তার পরিচয় – ইলিয়াস গল্প থেকে নেওয়া প্রশ্নোদ্ধৃত মন্তব্যটির বক্তা ইলিয়াস স্বয়ং।
মন্তব্যের সময় – একসময় সমৃদ্ধ ধনী থেকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ইলিয়াস মহম্মদ শা-র বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে কাজ করার সময় প্রকৃত সুখের সন্ধান খুঁজে পেয়েছিল। এর আগে সে ধনী থাকলেও, প্রচুর গোরু-ঘোড়া ইত্যাদির মালিক হলেও, চারপাশে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লেও নানারকম দুশ্চিন্তা তাকে তাড়া করে বেড়াত। এই অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে সে যে আনন্দে এবং সুখে আছে, তা বোঝাতে গিয়ে মহম্মদ শা-র বাড়ির অতিথিদের উদ্দেশ্যে ইলিয়াস আলোচ্য মন্তব্যটি করেছে।
মন্তব্যের কারণ – ইলিয়াসের স্ত্রী শাম-শেমাগি অতিথিদের জানাচ্ছিল, তাদের আগের ধনী জীবনে নয়, বরং বর্তমানের নিঃস্ব জীবনেই তারা প্রকৃত সুখের সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু তার কথা শুনে অতিথিরা হেসে ওঠে। অর্থ-সম্পত্তির মধ্যে নয়, অন্যের বাড়িতে কাজ করে, সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থাতেই যে সুখের সন্ধান পাওয়া যায় — এ কথা সম্ভবত অতিথিদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। কিন্তু ইলিয়াস সবাইকে বোঝাতে চায়, মানুষ অবুঝ থাকে বলেই বিষয়সম্পত্তির দিকে ঝোঁকে; কিন্তু প্রকৃত সুখ পাওয়া যায় ভোগ নয়, ত্যাগের মাধ্যমে। ঈশ্বর তাদের কাছে যে সত্যকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তা সমস্ত মানবজাতির জন্যই প্রয়োজনীয়। মানুষ যত আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করবে, ততই তাদের মঙ্গল। জীবনের এই নিগূঢ় সত্যটা তুলে ধরতেই ইলিয়াস উক্ত মন্তব্যটি করেছিল।
আজ আমরা আলোচনা করেছি নবম শ্রেণির বাংলা গল্প “ইলিয়াস”। এই গল্পে দেখানো হয়েছে, জীবনে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জয়-পরাজয় সবই অবিচ্ছেদ্য। ইলিয়াস এক সময় ছিলেন একজন ধনী ব্যক্তি। কিন্তু তার জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট এসেছে। তার স্ত্রী শাম-শেমাগি তার জীবনের সব দুঃখ-কষ্টে তার পাশে ছিল। ইলিয়াস বুঝতে পেরেছেন যে, জীবনে সুখ-দুঃখ দুটোই থাকবে। তাই দুঃখের সময় সাহস হারাবেন না।