নবম শ্রেণি – বাংলা – ভাঙার গান (কবিতা) কাজী নজরুল ইসলাম

ভাঙার গান কাজী নজরুল ইসলামের লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা। এটি নবম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটি ভাঙার গান নামে পরিচিত হলেও এটি প্রকৃতপক্ষে বিদ্রোহের গান। কবি নজরুল এ কবিতায় সামন্তবাদ, ধর্মব্যবস্থা, সামাজিক অবিচার, অনাচার, অত্যাচার, শোষণ, বৈষম্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন।

নবম শ্রেণি – বাংলা – ভাঙার গান

কবি পরিচিতি

ভূমিকা – বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতা ও গানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা ছাড়াও সমাজের যাবতীয় অবিচার, অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ করেছেন। সমাজে সাম্যপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন, নারীমুক্তির কথা বলেছেন, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা করেছেন।

জন্ম ও শৈশব – কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ, মঙ্গলবার)। তাঁর বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ, মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। মাত্র আট বছর বয়সে নজরুল তাঁর বাবাকে হারান। ফলে জীবনের শুরু থেকেই তাঁকে কঠোর দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে হয়।

ছাত্রজীবন – গ্রামের মক্তবে তাঁর লেখাপড়া আরম্ভ হয়। দশ বছর বয়সে নিম্নপ্রাথমিক পরীক্ষায় পাস করে তিনি ওই মক্তবেই এক বছর শিক্ষকতা করেন। পরে ঘটনাচক্রে তিনি পূর্ববাংলার ময়মনসিংহের কাজীর-সিমলা গ্রামের নিকটবর্তী দরিরামপুর বিদ্যালয়ে ভরতি হন। কিন্তু সেখানে তিনি বেশিদিন থাকেননি। ফিরে এসে তিনি ভরতি হন বর্ধমান জেলার মাথরুন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে (এই বিদ্যালয়ের প্রকৃত নাম নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউশন)। এই বিদ্যালয় থেকে সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ভরতি হন বর্ধমান জেলার রানিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ উচ্চবিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ে নজরুল অত্যন্ত মেধাবী ছাত্ররূপে পরিচিত ছিলেন। এখান থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। প্রাকৃনির্বাচনি পরীক্ষা দেওয়ার পর ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। নজরুলের প্রথাগত শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি। খুব সম্ভবত অর্থের অভাবই তাঁর বিদ্যালয়জীবনে এত পরিবর্তনের কারণ।

কর্মজীবন – অল্প বয়স থেকেই নজরুল সাধু-সন্ন্যাসী-বাউল-দরবেশদের সঙ্গ পছন্দ করতেন। মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি লেটো – র দলের জন্য গান – কাহিনি রচনা করে অর্থ উপার্জন করেছেন। নিজের লেখা গানে সুরও দিতেন তিনি নিজে। একসময়ে আসানসোলের একটি রুটির দোকানে মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে কাজ করেছেন নজরুল।

ব্যক্তিজীবন – ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে নজরুলের বিবাহ হয়। শুধু কবি হিসেবে নয়, ক্রমে তিনি গায়ক, গীতিকার ও সুরকার হিসেবেও সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। অভিনেতা ও কাহিনিকাররূপে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বোধশক্তিহীন ও নির্বাক হয়ে পড়েন। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো চিকিৎসাতেই তাঁর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হলে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে যান।

সাহিত্যজীবন – ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা – য় তাঁর প্রথম কবিতা মুক্তি প্রকাশিত হয়। এই বছরেই সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী। এরপর থেকে নজরুল লেখালেখির ক্ষেত্রে আরও মনোযোগী হয়ে পড়েন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে নজরুল সেনাবাহিনী ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর বিদ্রোহী কবিতা। এই কবিতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বৃহত্তর পাঠকসমাজে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

কাব্যগ্রন্থ – নজরুলের উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হল — অগ্নিবীণা (১৯২২), দোলনচাঁপা (১৯২৩), বিষের বাঁশি (১৯২৪), ভাঙার গান (১৯২৪), প্রলয়শিখা (১৯২৪), সাম্যবাদী (১৯২৬), সর্বহারা (১৯২৬), ফণিমনসা (১৯২৭), সিন্ধু-হিন্দোল (১৯২৭), ঝিঙেফুল (১৯২৮), জিঞ্জীর (১৯২৮), সন্ধ্যা (১৯২৯) প্রভৃতি।

গল্প-সংকলন – ব্যথার দান (১৯২২), রিক্তের বেদনা, (১৯২৪) এবং শিউলি মালা (১৯৩১) নামে তাঁর তিনটি গল্প – সংকলন আছে।
উপন্যাস – তিনি বাঁধনহারা (১৯২৭), কুহেলিকা (১৯২৭), মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০) প্রভৃতি কয়েকটি উপন্যাস রচনা করেন।
নজরুলের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে নির্বাচিত কবিতা-সংকলনটির নাম সঞ্চিতা। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ধূমকেতু পত্রিকা। এই পত্রিকায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরেন। স্বদেশভাবনা প্রচারের জন্য ব্রিটিশ সরকার কিছুদিনের মধ্যেই পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
সম্মান ও স্বীকৃতি – ভারত সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় কবি – র মর্যাদা দেন এবং তাঁকে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন।

জীবনাবসান – ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট ঢাকায় কবির জীবনাবসান ঘটে এবং সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

উৎস

ভাঙার গান কাব্যগ্রন্থের প্রথম রচনাটির নাম ভাঙার গান। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৬১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে (১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে)। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয় মেদিনীপুরবাসীর উদ্দেশ্যে। কারণ, স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মেদিনীপুরবাসী।
পাঠ্য গানটি অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে রচিত। সুকুমাররঞ্জন দাশের অনুরোধে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত বাঙ্গালির কথা নামক সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য কবি এই গানটি লেখেন এবং এটি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ১১ নভেম্বর ইংরেজ সরকার ভাঙার গান কাব্যগ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করে নেয় ৷

সারসংক্ষেপ

দেশকে স্বাধীন করার জন্য যাঁরা পণ করেছেন তাঁদের কারাগারে বন্দি করছে ইংরেজ সরকার। কবি দেশের তরুণদের কারাগারের লোহার দরজা ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বলেছেন। শৃঙ্খলে আবদ্ধ বিপ্লবীদের জমাটরক্ত লেগে আছে কারাগারের বেদিতে। তরুণ দেশপ্রেমীদের কবি শিবের সঙ্গে তুলনা করে ধ্বংসের ঘোষণাকারী শিঙা বাজাতে বলেছেন। কারাগারের প্রাচীর ভেদ করে ধ্বংসের পতাকা উড়ুক – এটাই কবির ইচ্ছা। কেউ মালিক, কেউ রাজা নয়, আমরা সবাই সমান এবং স্বাধীন — এই মনোভাব নিয়ে গাজনের বাজনা বাজিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার ডাক দিয়েছেন কবি। সত্য হল মুক্ত ও স্বাধীন, তাকে কেউ শাস্তি দিতে পারে না। ইংরেজরা ভগবানকে ফাঁসি দিতে চায় — এমন কথা শুনলে কবির হাসি পায়। কারণ ভগবান অমর, স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও মৃত্যুঞ্জয়ী। ভগবানকে ফাঁসি দেওয়ার মতো সর্বনাশা ভুল ও হীন তথ্য ইংরেজ শাসককে কারা বা কে দেয়? কবি দেশের তরুণদের এই বলে উৎসাহ দিয়েছেন যে তারা যেন খ্যাপা ভোলানাথের মতো প্রলয়দোলা দিয়ে হ্যাঁচকা টানে কারাগারগুলো ভেঙে দেয়। চতুর্থ খলিফা হজরত আলির হাঁকের মতো হায়দারী হাঁক ছেড়ে বিদেশি শাসকের মনে ভয় জাগাতে এবং যুদ্ধের ভেরি কাঁধে তুলে নিতে কবি যুবশক্তিকে ডাক দিয়েছেন। মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার বার্তা দিয়েছেন কবি। কালবৈশাখী ঝড়ের মতো উত্তাল দেশের পরিস্থিতি। এখন চেষ্টা না করে বসে থেকে সময় নষ্ট না করে ভয়ংকর কারাগারের ভিত্তি নাড়িয়ে দিতে হবে। লাথি মেরে ভাঙতে হবে তালা, বন্দিশালাগুলোতে আগুন জ্বালাতে হবে, উপড়ে ফেলতে হবে সমস্ত বন্ধন।

নামকরণ

কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাঙার গান শীর্ষক গানটি যে মূলগ্রন্থে সংকলিত সেটির নামও ভাঙার গান (১৯২৪)। অর্থাৎ কবিতাটি গ্রন্থের নামকবিতা।
শিরোনামের মধ্যে অনেক সময় কোনো সাহিত্যসৃষ্টির সারবস্তুর যে আভাস পাওয়া যায় তা এখানেও আছে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় রচিত এ-গানে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে কারারুদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুক্তি তথা স্বদেশের মুক্তির দৃঢ়সংকল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম পঙ্ক্তিতেই কবি ভাঙার কথা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন —

কারার ওই লৌহ-কপাট/ ভেঙে ফেল, কররে লোপাট

আবার শেষের আগের পঙ্ক্তিতে বলেছেন –

লাথি মার, ভাঙরে তালা!

সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে কারার লৌহকপাট ভেঙে লোপাট করে, তার প্রাচীর ভেদ করে ধ্বংস নিশান ওড়ানোর ডাক দিয়েছেন কবি। তিনি চেয়েছেন ঈশানের মতো প্রলয় বিষাণ বাজিয়ে, ভোলানাথের মতো তাণ্ডবনৃত্যে শাসকের সমস্ত চক্রান্ত ধূলিসাৎ করে দিক নবযুগের নওজোয়ানেরা। বিদ্রোহের আগুনে এই বন্দিশালাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে, শুভ, সুন্দর, স্বাধীন দেশগঠনের জন্যই কবির এই ভাঙার ডাক।
সমগ্র গানটিতে ভাঙার কথা এত প্রবলভাবে আছে বলেই ভাঙার গান শিরোনামটি যথাযথ হয়ে উঠেছে।

কবিতাটি আমাদেরকে ভাঙার মাধ্যমে নতুন সৃষ্টির বার্তা দিয়েছে। এটি আমাদেরকে শিখিয়েছে যে, ভাঙা ছাড়া নতুন কিছু গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাই, ভাঙাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং, ভাঙাকে স্বাগত জানাতে হবে।

Share via:

মন্তব্য করুন