মাধ্যমিক ইতিহাস – সংস্কার – বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনামূলক প্রশ্নোত্তর

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাংলাকে কেন্দ্র করে ভারতে ইংরেজ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে। উনিশ শতকে ইংরেজ শাসনের সঙ্গে শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে এবং বাংলায় শিক্ষা, সমাজ ও ধর্মের ক্ষেত্রে সংস্কারের সূচনা করে। এভাবেই বাংলায় নবজাগরণের সৃষ্টি হয়।

Table of Contents

উনিশ শতকের বাংলায় সমাজ ছিল পিছিয়ে পড়া সমাজ। সমসাময়িক সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র ও সাহিত্যে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। বামাবোধিনী, হিন্দু-প্যাট্রিয়ট এবং হুতোম প্যাঁচার নকশা, নীলদর্পণ, গ্রামবার্তা প্রকাশিকা থেকে আমরা উনিশ শতকের সমাজ কেমন ছিল তা জানব।

আজকের এই আর্টিকেল এ আমরা মাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সংস্কার – বৈশিষ্ট ও পর্যালোচনা অধ্যায়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর আলোচনা করবো। এই প্রশ্ন গুলি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক কী?


ভূমিকা – ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টে এদেশের শিক্ষাখাতে প্রতি বছর একলক্ষ টাকা বরাদ্দকরণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু এই টাকা প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে খরচ করা হবে সে সম্পর্কে ১৮২০-র দশকে এক বিতর্ক সৃষ্টি হয়, যা প্রাচ্যশিক্ষা-পাশ্চাত্য শিক্ষা-বিষয়ক দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত।

বিতর্ক – ওই সময়ে যাঁরা প্রাচ্য ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাচর্চার কথা বলেন তাঁরা প্রাচ্যবাদী এবং যাঁরা ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষাচর্চার কথা বলেন তাঁরা পাশ্চাত্যবাদী নামে পরিচিত হন। জেমস প্রিন্সেপ, কোলব্রুক প্রমুখ প্রাচ্যবাদীদের মত ছিল দেশীয় ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো হোক। অন্যদিকে লর্ড মেকলে, চার্লস গ্রান্ট প্রমুখ পাশ্চাত্যবাদীদের উদ্দেশ্য ছিল মূলত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। উল্লেখযোগ্য, ভারতীয়দের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন পাশ্চাত্যবাদী, পক্ষান্তরে রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ ছিলেন প্রাচ্যবাদী।

সরকারী শিক্ষানীতি – ভারতে ইংরেজি শিক্ষা-বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদী-পাশ্চাত্যবাদী বিতর্কে শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীদের মতই সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রসারকে সরকারি নীতি বলে ঘোষণা করেন।

উপসংহার – ভারতের বাংলা প্রদেশে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক শুরু হলেও বোম্বাই প্রদেশসহ অন্যান্য প্রদেশে অনুরূপ বিতর্ক হয়নি। এই স্থানগুলিতে পাশ্চাত্য শিক্ষারীতিই গৃহীত হয়েছিল।

উডের ডেসপ্যাচ সম্পর্কে যা জানো লেখো।

ভূমিকা – ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন হল – ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের মেকলে মিনিট ও ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের উডের ডেসপ্যাচ বা নির্দেশনামা।

উডের ডেসপ্যাচ – ভারতবর্ষের শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড শিক্ষা সংক্রান্ত এক নির্দেশনামা জারি করেন।

সুপারিশ – ভারতের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারের জন্য চার্লস উডের বিভিন্ন সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল – 1. নিম্নতম শ্রেণি থেকে উচ্চতর শ্রেণি পর্যন্ত যথাযথ সমন্বয়মূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন; 2. সরকারি শিক্ষাবিভাগ স্থাপন; 3. প্রত্যেক প্রেসিডেন্সি শহরে (অর্থাৎ-কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ শহরে) একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন; 4. গণশিক্ষা, নারীশিক্ষা, মাতৃভাষার উন্নয়ন এবং শিক্ষক-শিক্ষণ ব্যবস্থার প্রবর্তন; 5. প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের উপযুক্ত ব্যবস্থা প্রবর্তন; 6. সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রদান নীতির প্রবর্তন প্রভৃতি।

প্রভাব – চার্লস উডের এইসব সুপারিশগুলোর ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।

কারণ –

  • চার্লস উড-এর সুপারিশ অনুসারে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারি শিক্ষা বিভাগ খোলা হয়।
  • উডের নির্দেশনামা’র ফলশ্রুতি হিসাবে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল।
  • বহু বিদ্যালয়কে সরকারি অনুদান প্রদান এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলাফল কী হয়েছিল?

ভূমিকা – ভারতে প্রথমে বেসরকারি ও পরে সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা বহুমুখী ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।

ফলাফল – উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবগুলি হল –

যুক্তিবাদের প্রসার – পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে ভারতবাসীর মধ্যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটে এবং যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার প্রতিষ্ঠা হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতে যুক্তিবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়।

পাশ্চাত্যবাদী আদর্শের প্রসার – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতবাসীর একাংশ পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাস, জ্ঞান-বিজ্ঞান, মানবতাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, যুক্তিবাদ প্রভৃতি উচ্চ-আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে।

ধর্ম ও সমাজসংস্কার – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকের শিক্ষিত ভারতীয়রা কুসংস্কারমুক্ত হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, রাজনীতি, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে প্রগতিমূলক চিন্তাভাবনার উন্মেষ হয়। ভারতে নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। ভারতে ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়।

জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ – ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে, যা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিণতি লাভ করেছিল।

উপসংহার – এভাবে দেখা যায় যে, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা প্রথমে সমাজসংস্কারমূলক কাজ এবং পরবর্তীকালে দেশের স্বাধীনতার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তবে পাশ্চাত্য শিক্ষার কয়েকটি কুপ্রভাবও ছিল। যেমন — 1. ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা, 2. বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষায় অবহেলা, 3. অবহেলিত নারীশিক্ষা ও গণশিক্ষা, 4. পরোক্ষভাবে খ্রিস্টধর্মের প্রচার প্রভৃতি।

নারীশিক্ষার প্রসার ও নারী সমাজের উন্নতিতে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা কী ছিল?

ভূমিকা – ঊনবিংশ শতকের একজন পণ্ডিত ও সমাজসংস্কারক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১ খ্রি.)। সারাজীবন ধরে তিনি শিক্ষাবিস্তার ও সমাজসংস্কারে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন

বিদ্যাসাগরের ভূমিকা – বিদ্যাসাগর নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন —

বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা, বিধবাবিবাহ আন্দোলন – বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নির্বর্তন এবং বিধবাবিবাহ প্রবর্তন এবং বিভিন্ন সামাজিক কু-প্রথার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তোলেন। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ হয়।

নারীশিক্ষা বিস্তারে অবদান – নারীশিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। বিশেষ বিদ্যালয় পরিদর্শকের সরকারি পদে থাকার সুযোগে বাংলার বিভিন্ন স্থানে তিনি ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় এবং ১০০টি বাংলা স্কুল স্থাপন করেন। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় তিনি হিন্দু ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

নারীশিক্ষার প্রসার ও নারী সমাজের উন্নতিতে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা কী ছিল ?

সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে অবদান-সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে সংস্কৃত শিক্ষার প্রসারের জন্য এই কলেজের দরজা অ-ব্রাহ্মণ কায়স্থ ছাত্রদের কাছে খুলে দিতেও তিনি কুণ্ঠাবোধ করেননি। মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য কলকাতায় মেট্রোপলিটন কলেজ-এর প্রতিষ্ঠা ছিল বিদ্যাসাগরের অন্যতম কীর্তি। বর্তমানে এই কলেজের নাম বিদ্যাসাগর কলেজ।

গণশিক্ষার প্রসার – গণশিক্ষার প্রসারের জন্য বিদ্যাসাগর মাতৃভাষায় পঠনপাঠনের গুরুত্ব অনুভব করেন। এইজন্য তিনি সহজ-সরল পাঠ্যপুস্তক রচনায় আগ্রহী হন। শিক্ষাবিস্তারের জন্য তিনি বোধোদয়, বর্ণপরিচয়, কথামালা, শকুন্তলা, সীতার বনবাস, ভ্রান্তিবিলাস প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।

উপসংহার – বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার প্রসার ও নারী সমাজের উন্নতির জন্য যুক্তি অপেক্ষা হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের ওপর অধিক নির্ভর করেন। তাই ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁকে ঐতিহ্যবাহী আধুনিককার বলে অভিহিত করেছেন।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠাকে তুমি কীভাবে বিশ্লেষণ করবে?

ভূমিকা – ভারতে ইংরেজ শাসনের একটি বিশেষ দিক ছিল জনস্বাস্থ্য নীতি। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই নীতির প্রথম প্রতিফলন পড়েছিল।

প্রেক্ষাপট – কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা আকস্মিক ছিল না। এর পশ্চাতে দেখা যায় যে,

পরিপূর্ণ শিক্ষাদান – ১৮২০-র দশকে প্রতিষ্ঠিত স্কুল ফর নেটিভ ডক্টরস, সংস্কৃত কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসার চিকিৎসাবিদ্যা বিভাগে ব্যবহারিক অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ ব্যবস্থা ছিল না। এছাড়া ব্যাপক পরিসরে চিকিৎসা প্রদানেরও অভাব ছিল।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠাকে তুমি কীভাবে বিশ্লেষণ করবে ?

কমিটি গঠন – এই বিবিধ অভাব পূরণের জন্য লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক একটি কমিটি গঠন করেন (১৮৩৩ খ্রি.)। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন মি. জে. গ্র্যান্ট এবং অন্যান্য সদস্য ছিলেন জে. সি. সাদারল্যান্ড, সি. জি. সাদারল্যান্ড, এম. জে. ব্রামলি, বাবু রামকমল সেন প্রমুখ। এই কমিটি সংস্কৃত ও আরবি-ফারসির পরিবর্তে ইংরেজির মাধ্যমে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষাদানের সুপারিশ করে।

বেন্টিঙ্কের পদক্ষেপ – লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক উপরোক্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সংস্কৃত কলেজ ও মাদ্রাসার চিকিৎসাবিদ্যার বিভাগ এবং নেটিভ মেডিক্যাল স্কুল বন্ধ করে দেন (১ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৫ খ্রি.)। পাশাপাশি এদেশীয় যুবকদের চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন বিভাগে ইংরেজিতে শিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্যে একটি নতুন মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

উপসংহার – গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে নির্বাচিত ৪৯ জন ছাত্রকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের ক্লাস শুরু হয়। এভাবে ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশ শুরু হয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা – ভারতে শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক্‌চিহ্ন হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা (১৮৫৭ খ্রি.)। এটি উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ অনুযায়ী লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে গঠিত হয়েছিল

প্রতিষ্ঠা – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ছিল এরকম —

ইউনিভারসিটি কমিটি – উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশের ভিত্তিতে লর্ড ডালহৌসির শাসনকালে কলকাতায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত হয় ইউনিভারসিটি কমিটি। এই কমিটির দেওয়া রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (২৪ জানুয়ারি, ১৮৫৭ খ্রি.)।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

প্রশাসন – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে ৪১ জন সিনেট সদস্য নিয়ে গঠিত সিনেট-এর হাতে শিক্ষানীতি রূপায়ণের ভার ন্যস্ত করা হয়। লর্ড ক্যানিং হন প্রথম আচার্য এবং স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল প্রথম উপাচার্য।

বিস্তার – প্রতিষ্ঠাকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এলাকা ছিল লাহোর থেকে বর্তমান মায়ানমারের রেঙ্গুন পর্যন্ত। দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়।

কর্ম শুরু – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-এর প্রথম মিটিং হয় ৩০ জানুয়ারি, ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কাউন্সিল রুম-এ। ক্যামাক স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী অফিস গড়ে ওঠে। অন্যদিকে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ২৪৪ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।

উপসংহার – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষার বিষয়টি পরিপূর্ণতা লাভ করে। তবে প্রতিষ্ঠাকালে এটি উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না, বরং তা ছিল পরীক্ষাগ্রহণকারী কেন্দ্র।

রাজা রামমোহন রায়কে কেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ মনে করা হয়?

ভূমিকা – উনিশ শতকে ভারতের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ছিল কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস। চিন্তার জগতে যুক্তিবাদের অভাব সমাজের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দেয়। ভারতবর্ষের এই সামাজিক পটভূমিতে রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম কুসংস্কার ও কুপ্রথা দূর করে ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনে জাগরণ ঘটাতে সচেষ্ট হন।

রাজা রামমোহন রায়কে কেন ভারতের 'প্রথম আধুনিক মানুষ' মনে করা হয় ?

অবদান – রাজা রামমোহন রায় ধর্মসংস্কার, সমাজসংস্কার প্রভৃতি বহুমুখী কাজে আত্মনিয়োগ করেন, এগুলি হল —

মানবতাবাদী – রাজা রামমোহন রায় ছিলেন উনিশ শতকের প্রথম উল্লেখযোগ্য যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী মানুষ। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের ভারতে ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ।

সমাজসংস্কারক – রামমোহন তাঁর যুক্তিবাদী আধুনিক চিন্তাধারার সাহায্যে সমস্ত বাধাবিঘ্নকে অতিক্রম করে সতীদাহ প্রথা, বহুবিবাহ, বর্ণভেদ প্রথা প্রভৃতি কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়যুক্ত হন।

আধুনিক চিন্তাধারার পথিকৃৎ – উনিশ শতকের ভারতীয় জীবনে ধর্ম, শিক্ষা, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয়ে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী আধুনিক চিন্তাধারার পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। এইসব কারণের জন্য রামমোহন রায়কে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বলা হয়।

উপসংহার – রামমোহন রায়ের কতকগুলি সীমাবদ্ধতা ছিল যেমন — তিনি সমাজ ও ধর্মের কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটাননি। তাই ঐতিহাসিক সালাউদ্দিন আহম্মদ তাঁকে সংযত সংস্কারক বলে অভিহিত করেছেন।

সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা – বাংলা তথা ভারতের সমাজসংস্কার আন্দোলনে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ছিল সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন। মৃত স্বামীর চিতায় তার সদ্যবিধবা জীবন্ত স্ত্রীর সহমরণ সতীদাহ প্রথা নামে পরিচিত।

আন্দোলন – সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন ছিল একটি ব্যাপক আন্দোলন। এর বিভিন্ন দিক হল —

সার্বিক আন্দোলন – প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে সতীদাহ প্রথা চলে আসছিল। এই প্রথা গোঁড়া হিন্দুদের কাছে পবিত্র ও মহান প্রথা হলেও বাস্তবে ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তাই এই প্রথার বিরুদ্ধে উনিশ শতকে কলকাতাসহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন গড়ে ওঠে।

সরকারি নিয়ন্ত্রণ – জোর-জবরদস্তিমূলক উপায়ে সতীদাহ প্রথার ব্যাপকতায় ইংরেজ সরকার চিন্তিত ছিল। তাই ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে একটি আইনের মাধ্যমে গর্ভবতী ও অল্পবয়সি নারীর সতী হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়।

রামমোহনের চেষ্টা – মানবতাবাদী ও যুক্তিবাদী রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলনের সুযোগ্য নেতৃত্ব দেন। প্রচারসভা ও প্রচারপুস্তিকার মাধ্যমে তিনি এই প্রথার বিরোধিতা করেন ও সতীদাহ প্রথাকে অশাস্ত্রীয় বলে প্রমাণ করেন। সরকারের কাছে আবেদনপত্র প্রেরণ করে সরকারি আইনের সাহায্যে এই প্রথা রদে সচেষ্ট হন।

ইংল্যান্ড ও বেন্টিঙ্কের উদ্যোগ – ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইংল্যান্ডের জনগণও তাদের পার্লামেন্টের মাধ্যমে নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য আবেদন জানায়। এছাড়া তৎকালীন বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কও এই প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই তিনি ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সপ্তদশ বিধি নামে আইন প্রবর্তন করে এই প্রথা রদ করেন।

উপসংহার – উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন শুধু রামমোহন রায়ের গড়ে তোলা আন্দোলন ছিল না। তাঁর পূর্বেই গড়ে ওঠা আন্দোলনকে তিনি সাফল্যের পথে এগিয়ে দেন।

ডিরোজিও সম্পর্কে যা জানো লেখো।

ভূমিকা – উনিশ শতকের প্রথমার্ধে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র (১৮০৯-১৮৩১ খ্রি.) নেতৃত্বে বাংলায় এক উগ্র সংস্কারবাদী আন্দোলনের অবতারণা হয় যা নব্যবঙ্গ আন্দোলন নামে পরিচিত।

ডিরোজিও

বাল্যকাল – ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবারে ডিরোজিও-র জন্ম হয়। তিনি হেনরি ড্রামন্ডের কাছে ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে শিক্ষালাভ করেন এবং পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ধারণায় উদ্বুদ্ধ হন।

অধ্যাপনা – ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজের শিক্ষক রূপে যোগ দেন ও কলেজের তরুণ ছাত্র-সম্প্রদায়ের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মতো ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচয় ঘটান।

হিন্দু সমাজের সমালোচনা – তিনি অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে এক সমিতি গঠন করে হিন্দু সমাজের কুসংস্কার, রক্ষণশীলতা ও প্রচলিত কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে কশাঘাত করেন।

কর্মচ্যুতি – ডিরোজিও প্রভাবে তাঁর ছাত্র সম্প্রদায় প্রকাশ্যে হিন্দুধর্মের আচার-ব্যবহার লঙ্ঘন করতে থাকে। এইসব কার্যকলাপের ফলে হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল সমাজপতিরা কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ডিরোজিওর বিরুদ্ধে নালিশ জানালেন, এর ফলে ডিরোজিও কর্মচ্যুত হন (এপ্রিল ১৮৩১)। ওই বছরের শেষে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ডিরোজিও-র মৃত্যু হয়।

উপসংহার – ডিরোজিও তাঁর অনুগামীদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তার বীজ বপন করে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। এছাড়া ডিরোজিও ছিলেন মনেপ্রাণে একজন স্বদেশপ্রেমী। আমার স্বদেশের প্রতি (To India my native land) কবিতায় তিনি মাতৃভূমির বন্দনা করেছেন।

বিধবা বিবাহ আন্দোলন সম্পর্কে যা জানো লেখো।

ভূমিকা – উনিশ শতকে বাংলায় সমাজ সংস্কারগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সতীদাহ প্রথা রদ ও বিধবা বিবাহ আন্দোলন প্রবর্তন।

বিধবা বিবাহ আন্দোলন – বিধবা বিবাহ আন্দোলন অষ্টাদশ শতক থেকেই গড়ে উঠেছিল এবং উনিশ শতকে তা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই আন্দোলনের বিভিন্ন দিক হল —

প্রগতিবাদের চেষ্টা – উনিশ শতকে নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী বিধবা বিবাহের পক্ষে তাদের সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেছিল। আবার ১৮৩০-এর দশকে মতিলাল শীল, হলধর মল্লিক প্রমুখ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বিধবা বিবাহ প্রচলনে সচেষ্ট হন।

পত্রপত্রিকার চেষ্টা – উনিশ শতকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা (যেমন — সমাচার দর্পণ, জ্ঞানান্বেষণ) ও সভা-সমিতিতে বিধবা বিবাহের পক্ষে প্রচার চালানো হয়। সভা-সমিতিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বেথুন সোসাইটি।

বিদ্যাসাগরের চেষ্টা – প্রগতিবাদীদের দ্বারা গড়ে ওঠা বিধবা বিবাহ আন্দোলনকে তীব্র করে তুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি বিধবা-বিবাহকে শাস্ত্রীয় বলে প্রমাণ করতে পরাশর সংহিতা থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরেন এবং বলেন যে, বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। এর পাশাপাশি তিনি বিধবা বিবাহ প্রবর্তন সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের জন্য প্রায় এক হাজার জনের স্বাক্ষর করা আবেদনপত্র প্রেরণ করেন (অক্টোবর, ১৮৫৫ খ্রি.)। বিদ্যাসাগরের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রাজা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে তৎকালীন গোঁড়া হিন্দুরা একজোট হন।

সরকারি উদ্যোগ – বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহের সপক্ষে আবেদনের পাশাপাশি বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধেও অন্তত ১৪টি আবেদনপত্র সরকারের কাছে প্রেরিত হয়েছিল। শেষপর্যন্ত গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং বিধবা বিবাহ আইন পাস করেন (জুলাই, ১৮৫৬ খ্রি.)।

উপসংহার – বিধবা বিবাহ আইন পাস হলে বিদ্যাসাগর শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে কালীমতীদেবী নামের এক বিধবার বিবাহ দেন। আবার নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গেও এক বিধবার বিবাহ দেন।

হুতোম প্যাঁচার নক্শা’য় কীভাবে কলকাতার সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটেছে?

ভূমিকা – উনিশ শতকে বাংলার শহরজীবন ছিল গ্রামজীবন অপেক্ষা পৃথক ধরনের। কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত হুতোম প্যাঁচার নক্‌শা নামক ব্যঙ্গাত্মক রচনা থেকে কলকাতার সমাজ-সংস্কৃতির কথা জানা যায়।

হুতোম প্যাঁচার নক্শা’য় কীভাবে কলকাতার সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটেছে ?

সমাজ-সংস্কৃতি – কলকাতার সমাজ-সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল —

সমাজ বিন্যাস – ইংরেজ শাসনে ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের সূত্র ধরে উনিশ শতকের সমাজবিন্যাসে পরিবর্তন আসে। ইংরেজ শাসনের পূর্বে বাংলায় বড় বড় বংশের (কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্লভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎশেঠ) পতন ঘটে এবং নতুন জাতি ও বংশের (মল্লিক পরিবার, শীল পরিবার) উদ্ভবের কথা জানা যায়।

বাবু সংস্কৃতি – ব্যাবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী এবং গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে আসা জমিদাররা যে বিলাসবহুল এবং দেখনদারি সংস্কৃতির সূচনা করেছিল তা
বাবু সংস্কৃতি নামে পরিচিতি লাভ করে।

পূজাপার্বণ – কলকাতায় ছিল বারো মাসে তেরো পার্বণ, অর্থাৎ চড়কপূজা, নীলষষ্ঠী, রাসলীলা, রথযাত্রা, মাহেশের স্নানযাত্রা, বারোয়ারি দুর্গাপূজা। এইসব পূজাপার্বণে ঢাক- ঢোলের বাদ্য ও কাঁসর ঘন্টার ধ্বনিসহ সমাজ মেতে উঠত

সংস্কৃতি – নীলের ব্রত, গাজন সন্ন্যাসী (চড়কি)-দের শিবের কাছে মাথা দোলানো বা মাথাচালা, যাত্রাগান, বুলবুলের গান, অশ্লীল শব্দযুক্ত আখড়াই গান ছিল সংস্কৃতির অঙ্গ। আবার বাঈজি নাচ ও মদ্যপান সংস্কৃতিও ছিল কলকাতার বাবু সমাজের একটি বিশেষ দিক।

উপসংহার – উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, উনিশ শতকে কলকাতার সমাজজীবনে পরিবর্তন এসেছিল এবং এর মূল কারণ ছিল বাঙালিদের ইংরেজ অনুকরণ ও পাশ্চাত্য শিক্ষা।

ইয়ংবেঙ্গল সম্পর্কে যা জানো লেখো।

ভূমিকা – পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার তরুণ বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যে উগ্র সংস্কারপন্থী আন্দোলন সৃষ্টি করেন তা ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ আন্দোলন নামে পরিচিত। নব্যবঙ্গ আন্দোলনের প্রেরণাদাতা ও প্রাণপুরুষ ছিলেন হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১ খ্রি.)।

নব্যবঙ্গ দলের মূল উদ্দেশ্য – নব্যবঙ্গ দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল — 1. জনসাধারণের মধ্যে যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠা 2. হিন্দুসমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরোধিতা করা এবং 3. আধুনিক ও যুক্তিবাদী পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটানো।

নব্যবঙ্গ দলের কার্যকলাপ – 1. ডিরোজিও-র ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছাত্ররা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সভাসমিতি ও প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে প্রগতিশীল ধ্যানধারণা প্রচার করেন। ডিরোজিওর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। 2. ইয়ংবেঙ্গলের সদস্যরা তাঁদের পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে হিন্দুসমাজের বহুবিবাহ, নারীশিক্ষা, জুরির বিচার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন ও তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দেন।

সমালোচনা – সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র না থাকায় সমাজজীবনে ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। সবচেয়ে বড়ো কথা, দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁরা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করতে আগ্রহী ছিলেন। এই কারণে ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীকে নকল নবীশের দল বলে মন্তব্য করেছেন।

উপসংহার – নানান সমালোচনা সত্ত্বেও ইয়ং বেঙ্গল অনুগামীদের সত্যানুসন্ধানী মনোভাব, দেশাত্মবোধ ও সংস্কৃতি চেতনা উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে সমৃদ্ধ করেছিল।

ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা – রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসভা (১৮২৮ খ্রি.) সমাজ ও ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে রামমোহনের মৃত্যুর পর স্তিমিত ব্রাহ্ম আন্দোলনকে ১৮৪০-এর দশকে পুনরায় উজ্জীবিত করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫ খ্রি.)।

ব্রাহ্মসমাজের উন্নতি – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের উন্নতির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

তত্ত্ববোধিনী সভা গঠন – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে ইতিপূর্বেই তত্ত্ববোধিনী সভা (১৮৩৯ খ্রি.) গঠন করেন। একেশ্বরবাদ ও বেদান্তের বাণী প্রচার এবং সংস্কারমুক্ত ধর্ম-আলোচনা করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্ররূপে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৮৪৩ খ্রি.) প্রকাশ করেন। এর সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। এই পত্রিকায় সমকালীন সামাজিক কুসংস্কার ও গলদের বিরুদ্ধে মতামত প্রচার করা হত। তাছাড়া খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধেও তিনি এই পত্রিকায় লেখনী ধারণ করেন।

সংগঠন – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের নিয়মাবলি, ধর্মাচার পদ্ধতি প্রবর্তন করে ব্রাহ্মসমাজকে একটি সাংগঠনিক রূপ দেন। এভাবে ব্রাহ্মসমাজ একটি পৃথক সংগঠনে পরিণত হয়।

সমাজ উন্নয়ন – দরিদ্র হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার প্রবণতাকে বন্ধ করতে কলকাতায় হিন্দু চ্যারিটেবল ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেন। এর পাশাপাশি হিন্দুধর্মের কুপ্রথার বিরুদ্ধে ও কৃষকদের উন্নতির জন্যও আন্দোলন সংগঠিত করেন।

উপসংহার – এভাবে দেখা যায় যে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজকে একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ে পরিণত করেন ও ব্রাত্মসমাজের আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক আন্দোলনে পরিণত করেন।

ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনে কেশবচন্দ্র সেনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা – রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন ১৮৫০ ও ১৮৬০-এর দশকে কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে চরম আকার ধারণ করে। কেশবচন্দ্র সেনের (১৮৩৮-১৮৮৪ খ্রি.) নেতৃত্বে ব্রাত্মসমাজের ব্যাপ্তি ও জনপ্রিয়তা দুইই বৃদ্ধি পায়।

কেশবচন্দ্র সেন

পদক্ষেপ – কেশবচন্দ্র সেন ব্রাত্মসমাজ আন্দোলনকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে যে সমস্ত পদক্ষেপ করেন তা হল-

কুসংস্কার বিরোধিতা – কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী ও সমাজসংস্কারক। তিনি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

নতুন সমাজ গঠন – কেশবচন্দ্রের দ্বারা প্রচারিত অসবর্ণ বিবাহ, বিধবা বিবাহ, শ্রমিক কল্যাণের আদর্শ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুগামী ব্রাহ্মদের পছন্দ হয়নি। তাই কেশবচন্দ্র ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজ গঠন করেন (১৮৬৬ খ্রি.)।

ভারতীয় সংস্কার সভা গঠন – সমাজ সংস্কার আন্দোলনে গতি ও সংহতি আনতে কেশবচন্দ্র সেন ভারতীয় সংস্কার সভা (১৮৭০ খ্রি.) গঠন করেন। সমাজসংস্কার ও জনগণের নৈতিক উন্নতিসাধনই ছিল এর মূল লক্ষ্য।

নববিধান প্রতিষ্ঠা – ১৮৭০-এর দশকে কেশবচন্দ্র সেন ভক্তিবাদ ও গুরুবাদে আকৃষ্ট হন। তাছাড়া কেশবচন্দ্র সেন ব্রাত্মবিবাহ আইন অমান্য করে নিজের নাবালিকা কন্যার বিবাহ দেন। ফলে শিবনাথ শাস্ত্রী-কেন্দ্রিক ব্রাহ্মগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর বিবাদ দেখা দেয় এবং এর পরিণতিতে কেশবচন্দ্র সেন নববিধান ব্রাহ্মসমাজ (১৮৮০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।

উপসংহার – কেশবচন্দ্র সেন তাঁর সমাজসংস্কারের আদর্শের ভিত্তিতে ব্রাহ্ম আন্দোলনকে বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে জনপ্রিয় করে তোলেন। আবার তাঁর কারণেই ব্রাহ্মসমাজে ভাঙনের সৃষ্টি হয়।

উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকার মূল্যায়ন করো।

ভূমিকা – উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাত্মসমাজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা/ অবদান ছিল –

কুসংস্কারের বিরোধিতা ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রসারের ভূমিকা – ব্রাত্মসমাজ ভারতীয় সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরোধিতা করে জনগণের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

জাতিভেদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা – এই সংস্থাটি হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা করে। হিন্দু ধর্মের নামে অধর্ম ও সামাজিক অত্যাচার প্রতিরোধে ব্রাহ্মসমাজের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।

নারীকল্যাণের ভূমিকা – ভারতীয় নারীদের মধ্যে পর্দা-প্রথার বিলুপ্তিসাধন, বিধবা-বিবাহের আইনসিদ্ধকরণ, বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ, নারীসমাজের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রচলন প্রভৃতি সমাজসংস্কারমূলক কাজকর্মে ব্রাহ্মসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।

জাতীয় সংহতির পথ রচনা – উদারপন্থী ধর্মীয় আদর্শ ও জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ জাতীয় সংহতির পথ রচনা করে।

সমাজসেবা ও জনহিতকর কাজের আদর্শ প্রতিষ্ঠা – সমাজসেবা ও জনহিতকর কাজের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতিষ্ঠা ছিল ব্রাহ্মসমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সময় একদল বাঙালি তরুণকে নিয়ে ত্রাণের যে অনুকরণযোগ্য দৃষ্টান্ত ব্রাত্মসমাজ রেখেছিল, তা পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রধান আদর্শ হয়ে ওঠে।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সমন্বয়বাদী মতাদর্শ বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা – উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন ব্রাহ্মসমাজের মতাদর্শের পাশাপাশি শ্রীরামকৃয়দেবের (১৮৩৬-১৮৮৬ খ্রি.) সমন্বয়বাদী মতাদর্শও ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দিরের পুরোহিত গদাধর চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন ধর্ম সাধনার মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণদেব-এ পরিণত হন।

সমন্বয়বাদী মতাদর্শ – শ্রীরামকৃষ্ণ যেভাবে সমন্বয়বাদী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন তা হল-

ধর্মভাবনা – রামকৃষ্মদেব সব ধরনের ধর্মীয় বিভেদ ও বিদ্বেষ অপচ্ছন্দ করতেন। তিনি প্রচার করেন যে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ মত ও পথ অনুসরণ করে ঈশ্বর সাধনায় নিয়োজিত হতে পারে। তিনি বলেছেন, সাকার নিরাকার একই ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপ, যত মত তত পথ।

মানবতাবাদ – ধর্ম নয় মানুষের মনুষ্যত্বই তাঁর কাছে গুরুত্ব লাভ করে; তাই তাঁর কাছে তাঁর ধর্মমতের একটি বিশেষ দিক হল মানবতাবোধ। তাঁর কাছে জীবসেবা ও মানবসেবা ছিল ঈশ্বরসেবার প্রকারভেদ মাত্র।

আধ্যাত্মিক শান্তি – উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিক্ষিত যুবকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বেকারত্বও বৃদ্ধি পায়। ফলে বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের মনে বেকারজনিত হতাশা বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে তিনি আধ্যাত্মিক শান্তির পথনির্দেশ করেন।

জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা – শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, প্রত্যেক মানুষই হল শক্তির আধার ; তাই তিনি প্রত্যেক মানুষকে সমান মর্যাদাদানের কথা প্রচার করেন। এভাবে সমাজে জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা অনেকটা হ্রাস পায়।

উপসংহার – শ্রীরামকৃয়ের এই সমন্বয়বাদী মতাদর্শ একদিকে যেমন বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যে সংহতিদান করেছিল। তেমনি তা ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুধর্মেও প্রাণসঞ্চার করেছিল।

ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনে স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারা সংক্ষেপে উল্লেখ করো।

উত্তর ভূমিকা – অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন ঊনবিংশ শতকের এক মহান কর্মযোগী, যাঁর মতে মানব সেবাই ধর্মের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। ধর্ম তাঁর কাছে আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্বতা নয়-দরিদ্র ও অজ্ঞ মানুষের সেবাই ছিল তাঁর কাছে প্রকৃত ধর্মের স্বরূপ।

চিন্তাধারা – প্রকাশ্য রাজনীতিতে না নামলেও বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে বিবেকানন্দ তৎকালীন ভারতের দারিদ্র্য, অস্পৃশ্যতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, জাতিভেদ, নারী নির্যাতন, ধর্মীয় বিরোধ প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্র কশাঘাত হেনেছিলেন। তাঁর চিন্তাধারা বিভিন্ন দিকে যেভাবে বাস্তবায়িত হয় তা হল-

স্বামী বিবেকানন্দ

দরিদ্রদের সেবা – ভারতবর্ষের পথে-প্রান্তরে ভ্রমণ করে বিবেকানন্দ দরিদ্র ও অজ্ঞ ভারতবাসীর মধ্যে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ভারতের পর্ণকুটিরের দরিদ্র, কাঙাল, ক্ষুধার্ত জনতা তাঁর কাছে ছিল দরিদ্র নারায়ণ। জীবের মধ্যেই তিনি ভগবান শিবকে প্রত্যক্ষ করে বলেছিলেন — যত্র জীব তত্র শিব।

সমাজমুক্তি – মানবতাবাদী ও সমাজপ্রেমী বিবেকানন্দ আত্মমুক্তি অপেক্ষা সমাজের উন্নতির জন্য বনের বেদান্ত-কে ‘ঘরে আনার কথা বলেন। বেদান্তকে মানবহিতের কাজে ব্যবহারের কথা প্রচার করেন। এভাবেই নব্যবেদান্ত তাঁর ধর্ম সংস্কারের অভিমুখের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা – বিবেকানন্দ ছিলেন একজন জন্মযোদ্ধা সন্ন্যাসী-তবে তাঁর যুদ্ধ ছিল জাতির অশিক্ষা, কুসংস্কার, জাতিভেদ ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। কর্মের মাধ্যমে মানবসেবার আদর্শকেই তিনি তাঁর ধর্ম বলে মনে করতেন। জাতির মধ্যে ত্রাণকার্য, শিক্ষার প্রসার, সুচিকিৎসার প্রসার এবং প্রকৃত মানুষ গড়ার উদ্দেশ্যে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে তারিখে তাঁর উদ্যোগে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। আজও এই সংস্থাটি জনসেবামূলক নানান কাজকর্মে ভারতবর্ষের একটি অগ্রণী প্রতিষ্ঠান।

বাংলার নবজাগরণ ও তার প্রকৃতি আলোচনা করো।

ভূমিকা – উনিশ শতকের গোড়ায় বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রে-এক নবচেতনার সূচনা হয় যা বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত। এই নবজাগরণ ছিল প্রাচ্যবাদ ও পাশ্চাত্যবাদী আদর্শের সংমিশ্রণ।

নবজাগরণের কয়েকটি দিক – বাংলার নবজাগরণের কয়েকটি বিশিষ্ট দিক হল —

অনুসন্ধানী মানসিকতা – পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির অনেকে রক্ষণশীলতা বর্জন করে যুক্তিবাদী হয়ে ওঠেন। ধর্ম ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র যুক্তিবাদের দ্বারা মূল্যায়িত হতে থাকে।

সমাজ ও ধর্মসংস্কার – বাংলার ধর্ম ও সমাজের কুসংস্কারগুলি দূর করে আধুনিক করে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। হিন্দুধর্মের মধ্য থেকেই হিন্দুধর্মের সংস্কারসাধন ছিল নবজাগরণের একটি দিক। আবার সরকারি সাহায্যে সতীদাহ প্রথা রদ ও বিধবা বিবাহ প্রবর্তন সমাজসংস্কারের বিখ্যাত উদাহরণ।

গৌরবময় অতীত পুনরুদ্ধার – প্রাচ্যবাদ চর্চার নীতি এবং ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনে ভারতের অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার করা হয়। সমাজ ও ধর্মসংস্কারের প্রয়োজনে যুক্তিবাদের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় প্রমাণের অনুসন্ধানের থেকে সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চা শুরু হয়।

স্বতন্ত্র নবজাগরণ – বাংলার নবজাগরণ ইটালির নবজাগরণের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বাংলার নবজাগরণের সামাজিক ভিত্তি ছিল উদীয়মান শিক্ষিত পেশাজীবী ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়।

উপসংহার – বাংলার নবজাগরণ মূলত ছিল কলকাতা শহরকেন্দ্রিক, তাই তা সামগ্রিকভাবে বাংলার নবজাগরণ ছিল না। তবে এই নবজাগরণের মাধ্যমে বাংলার ধর্ম ও সমাজে আধুনিকতার সঞ্চার হয়েছিল।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় বাংলার সমাজব্যবস্থার কোন্ কোন্ দিক প্রতিফলিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করো। গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র বিভিন্ন দিক চিহ্নিত করো।

প্রথম অংশ – সমকালীন সংবাদপত্র উনিশ শতকের সমাজের বিভিন্ন দিকের বর্ণনা পাওয়া যায় থেকে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হিন্দু প্যাট্রিয়ট নামক ইংরেজি সংবাদপত্র। এটি থেকে গ্রামীণ সমাজ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা জানা যায়।

সমাজজীবন – হিন্দু প্যাট্রিয়টের বর্ণনা থেকে সমাজজীবনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি এভাবে চিহ্নিত করা যায় –

কৃষিকাজ – গ্রামীণ সমাজে জমিদারদের উপস্থিতি থাকলেও কৃষকেরা আউশ ও আমন চাষের মাধ্যমে সারা বছরের খাদ্যশস্য জোগাড় করত। তবে নীলচাষের ব্যাপক প্রসার ঘটলে কৃষকেরা তাদের আউশ জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য হয়।

অলাভজনক নীলচাষ – কৃষকদের কাছে নীলচাষ ছিল। অলাভজনক। তাই কৃষকরা নীলচাষে অসম্মতি জানায়। অবশ্য যে কৃষক একবার নীলকর সাহেবের কাছ থেকে নীলচাষের জন্য অগ্রিম অর্থ বা দাদন গ্রহণ করেছিল তাদের নীলচাষ থেকে অব্যাহতি ছিল না। শেষ পর্যন্ত নীলচাষিরা নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

আদিবাসী বিদ্রোহ – হিন্দু প্যাট্রিয়ট থেকে বাংলার আদিবাসী সমাজের কথা ও সাঁওতাল বিদ্রোহের কথাও জানা যায়। এই পত্রিকার মতে, জোরপূর্বক সাঁওতালদের বেগার খাটানো, অতিরিক্ত খাজনার দাবি ও অর্থনৈতিক শোষণই ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অবস্থা – উনিশ শতকে খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসল (যেমন – পাট, তুলা, তৈলবীজ, আখ) চাষ ও তা বিদেশে রফতানির কারণে কৃষিপণ্য ও খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পেলে জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বেকারত্ব বৃদ্ধি – শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। এই পত্রিকায় বলা হয় যে, কৃষি ও বাণিজ্য ছাড়া শিক্ষিতদের সামনে আর কোন বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা নেই।

উপসংহার – হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় যেভাবে বাংলার সমাজব্যবস্থা প্রতিফলিত হয়েছিল তা মূলত জাতীয়তাবাদীর দৃষ্টিভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলা। এই পত্রিকার বক্তব্যেও ছিল স্বদেশি মেজাজ।

দ্বিতীয় অংশ – গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামক সাময়িকপত্র থেকেও উনিশ শতকের বাংলার সমাজব্যবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। এই পত্রিকার বিভিন্ন দিক হল-

পত্রিকার প্রকাশ – কুমারখালি বাংলা পাঠশালার প্রধান শিক্ষক হরিনাথ মজুমদার ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রকাশ করেন। এটির মোট ১৯টি ভাগ প্রকাশিত হয়েছিল।

গ্রামবাসীর উপকার – গ্রাম ও গ্রামবাসী প্রজাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও প্রজাদের উপর অত্যাচারের কথা সরকারের কাছে জানানো এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করাই ছিল এই পত্রিকার প্রধান উদ্দেশ্য। প্রজাদের উপর সরকার ও জমিদারদের অত্যাচারের কথা এই পত্রিকা থেকে জানা যায়।

স্থানীয় ইতিহাস – গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় হরিনাথ মজুমদার শাস্তিপুর উলাদি উপনগরের প্রাচীন ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন। এছাড়া তৎকালীন বাংলার মেহেরপুর, চাকদহ ও উলা প্রভৃতি স্থানের দুর্ভিক্ষ ও মহামারির কথাও বর্ণিত হয়েছিল।

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক কী? মেকলে মিনিট কী?

প্রথম অংশ – ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টে এদেশের শিক্ষাখাতে প্রতি বছর একলক্ষ টাকা বরাদ্দকরণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু এই টাকা প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে খরচ করা হবে সে সম্পর্কে ১৮২০-র দশকে এক তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়, যা প্রাচ্য শিক্ষা-পাশ্চাত্য শিক্ষা-বিষয়ক দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত।

বিতর্ক – ওই সময়ে যারা প্রাচ্য ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাচর্চার কথা বলেন তাঁরা প্রাচ্যবাদী এবং যাঁরা ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষাচর্চার কথা বলেন তাঁরা পাশ্চাত্যবাদী নামে পরিচিত হন। জেমস প্রিন্সেপ, কোলব্রুক প্রমুখ প্রাচ্যবাদীদের মত ছিল। দেশীয় ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। অন্যদিকে লর্ড মেকলে, চার্লস গ্রান্ট প্রমুখ পাশ্চাত্যবাদীদের উদ্দেশ্য ছিল মূলত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। ভারতীয়দের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন পাশ্চাত্যবাদী, পক্ষান্তরে রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ ছিলেন প্রাচ্যবাদী। রাজা রামমোহন রায় কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি করেন। ভারতে ইংরেজি শিক্ষা-বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদী- পাশ্চাত্যবাদী বিতর্কে শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীদের মতই সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক মেকলে মিনিট-এর ভিত্তিতে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রসারকে সরকারি নীতি বলে ঘোষণা করেন।

মূল্যায়ণ – ভারতের বাংলা প্রদেশে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক শুরু হলেও বোম্বাই প্রদেশসহ অন্যান্য প্রদেশে অনুরূপ বিতর্ক হয়নি। এই স্থানগুলিতে পাশ্চাত্য শিক্ষারীতিই গৃহীত হয়েছিল। যাইহোক, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্কের অবসানের ফলে ভারতে দ্রুত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে।

দ্বিতীয় অংশ – বড়োলার্ট উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে মেকলে মিনিট ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ। টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাটের পরিষদে আইন সদস্যরূপে যোগ দেন ও পরবর্তীকালে শিক্ষাসভার সভাপতি হন। তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে সচেষ্ট হন এবং ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করেন। তাঁর মতের সমর্থনে যুক্তি দেন যে –

ভারতীয় ভাষার দৈন্যতা – ভারতের ভাষাসমূহ অত্যন্ত ক্ষীণ, দৈন্য ও ঐশ্বর্যহীন। তাই ভারতীয়দের মাতৃভাষাগুলি শিক্ষার বাহনরূপে যথার্থ ভূমিকা পালনে অক্ষম। তিনি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন যে, সমস্ত ভারত ও আরবের যে প্রাচীন সাহিত্য রয়েছে তা ইউরোপীয় ভাষা অপেক্ষা নিকৃষ্টতর।

ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব – তিনি মনে করেন যে, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য হল জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক অফুরন্ত খনি। তাই ইংরেজি ভাষা প্রবর্তিত হলে ভারতে নবজীবনের সূচনা হবে। তাছাড়া ব্রিটিশ প্রশাসনে ইংরেজি ভাষা জানা কর্মচারী নিয়োগ করাও সম্ভব হবে। মেকলে মিনিট প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের নীতি গৃহীত হয়। তাই ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে মেকলে মিনিট ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

বাংলার সরকারি উদ্যোগে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তার কীভাবে হয়েছিল? এর ফলাফল বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা – বাংলায় উনিশ শতকের প্রথমে মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। কিন্তু সামাজিক ও প্রশাসনিক কারণে ভারতে ইংরেজ কোম্পানি ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

ব্রিটিশ শিক্ষানীতি –

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্ট – ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের একটি ধারায় ভারতে জনশিক্ষার জন্য কোম্পানিকে প্রতি বছর অন্তত এক লক্ষ টাকা ব্যয়বরাদ্দ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে কোম্পানির উদ্যোগে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন বা জনশিক্ষা কমিটি গঠিত হয়।

মেকলে মিনিট – গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসনকালে আইন সচিব টমাস ব্যাবিংটন মেকলের উদ্যোগে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ ইংরেজি শিক্ষাকে সরকারি নীতি বলে ঘোষণা করা হলে সরকারি শিক্ষানীতিতে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে (ক) কলকাতায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, (খ) বোম্বাইয়ে এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন (গ) মাদ্রাজে মাদ্রাজ ইউনিভারসিটি হাই স্কুল এবং (ঘ) রুরকি-তে থমসন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হয়।

হাজির ঘোষণা – ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর লর্ড হার্ডিও ঘোষণা করেন যে, এবার থেকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সময় ইংরেজি ভাষায় দক্ষ লোকেরেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এই ঘোষণার পর থেকে মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষায় প্রবল আগ্রহ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি বিদ্যালয় ও তাদের ছাত্র সংখ্যা দুটোই বাড়তে থাকে।

উডের ডেসপ্যাচ – ভারতবর্ষের শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উচ্চ শিক্ষা সংক্রান্ত এক নির্দেশনামা জারি করেন। ভারতের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারের জন্য চার্লস উডের বিভিন্ন সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল – 1. নিম্নতম শ্রেণি থেকে উচ্চতর শ্রেণি পর্যন্ত যথাযথ সমন্বয়মূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন, 2. সরকারি শিক্ষাবিভাগ স্থাপন, 3. প্রত্যেক প্রেসিডেন্সি শহরে (অর্থাৎ-কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ শহরে) একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন।

হান্টার কমিশন – ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হান্টার কমিশন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সরকারি অনুদান সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ করতে সচেষ্ট হয়। প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারের জন্য বেশ কিছু সুপারিশও করে। সরকারি সাহায্যে বিদ্যালয়ে লাইব্রেরি স্থাপন, মেধাবি ছাত্রদের বৃত্তিদান ও স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।

দ্বিতীয় অংশ – উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবগুলি হল –

যুক্তিবাদের প্রসার – পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে ভারতবাসীর মধ্যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটে এবং যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার প্রতিষ্ঠা হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতে যুক্তিবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়।

পাশ্চাত্যবাদী আদর্শের প্রসার – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতবাসীরা পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাস, জ্ঞান-বিজ্ঞান, মানবতাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, যুক্তিবাদ প্রভৃতি উচ্চ আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে।

ধর্ম ও সমাজসংস্কার – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকের শিক্ষিত ভারতীয়রা কুসংস্কারমুক্ত হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, রাজনীতি, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে প্রগতিমূলক চিন্তাভাবনার উন্মেষ হয়। ভারতে নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। ভারতে ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। পরিশেষে বলা যায় যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে, যা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিণতি লাভ করেছিল।

Share via:

মন্তব্য করুন