আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণী ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায় বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদের কিছু ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে। নবম শ্রেণী
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (Napoleon Bonaparte) কীভাবে ফ্রান্সে ক্ষমতালাভ করেন?
ফরাসি বিপ্লব যখন শোচনীয় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল এবং ডিরেক্টরির শাসনের ব্যর্থতা ও ক্রমাগত বৈদেশিক আক্রমণ যখন ফ্রান্সের জনজীবনকে অতিষ্ঠ ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল, সেই জটিল মুহূর্তে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁর অভাবনীয় সামরিক প্রতিভার দ্বারা ফ্রান্সকে রক্ষা করেন এবং ফরাসি জাতির ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
নেপোলিয়নের বাল্যজীবন
জন্ম – নেপোলিয়ন 1769 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট ইতালির অন্তর্গত কর্সিকা দ্বীপের অ্যাজাক্সিও (Ajaccio) শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতা-মাতা – নেপোলিয়নের বাবার নাম কার্লো বোনাপার্ট ও মায়ের নাম লেটিজিয়া বোনাপার্ট।
শিক্ষালাভ ও কর্মজীবন – 16 বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান এবং তাঁরা কঠোর দারিদ্র্যের সম্মুখীন হন। তিনি প্যারিসের সামরিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে 17 বছর বয়সে ফরাসি গোলন্দাজ বাহিনীর সাব-লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন (1785 খ্রি.)।
নেপোলিয়নের উত্থানের সূচনা
নেপোলিয়নের উত্থানের কাহিনি ছিল রোমাঞ্চকর এবং এটি তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। যথা —
প্রথম পর্যায় –
- ব্রিগেডিয়ার পদ লাভ – 1793 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ফ্রান্সের তুলোঁ (Toulon) বন্দর অবরোধ করে। নেপোলিয়ন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলোঁ বন্দর পুনরুদ্ধার করেন। এই সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন।
- মেজর জেনারেল পদ লাভ – 1795 খ্রিস্টাব্দের 5 অক্টোবর রাজতন্ত্রের সমর্থক ও প্রজাতন্ত্রের বিরোধী উচ্ছৃঙ্খল জনতা ন্যাশনাল কনভেনশন আক্রমণ করে। নেপোলিয়ন অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে এই বিশাল জনতার আক্রমণ থেকে ন্যাশনাল কনভেনশনের সদস্যদের রক্ষা করেন। এর পুরস্কারস্বরূপ তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।
- নেপোলিয়নের ইতালি অভিযান – 1795 খ্রিস্টাব্দের 26 অক্টোবর ন্যাশনাল কনভেনশনের শাসন শেষ হয় এবং ডিরেক্টরির শাসন শুরু হয়। এই সময় ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও সার্ডিনিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। নেপোলিয়ন এই শক্তিজোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সসৈন্য ইতালি অভিযান করেন।
সাফল্য
- সার্ডিনিয়া জয় – প্রথমে তিনি সার্ডিনিয়াকে পরাজিত করে সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করেন এবং স্যাভয় ও নিস দখল করেন।
- অস্ট্রিয়া আক্রমণ ও ক্যাম্পো ফর্মিও সন্ধি (Campo Formio Treaty) – তিনি উত্তর ইতালিতে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করেন। অস্ট্রিয়ার সম্রাট তাঁর সঙ্গে ক্যাম্পো ফর্মিওর সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন (1797 খ্রিস্টাব্দের 17 অক্টোবর)।
- ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মিশর অভিযান – এরপর নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মিশর অভিযান করেন। তিনি (1798 খ্রিস্টাব্দের 21 জুলাই) পিরামিডের যুদ্ধে জয়লাভ করলেও নীলনদের যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি নেলসনের হাতে পরাজিত হন। এরপর তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসেন।
দ্বিতীয় পর্যায় –
ডিরেক্টরি শাসনের অবসান ও কনস্যুলেট শাসনের সূচনা – ফ্রান্সের জনগণ ডিরেক্টরি শাসনে (1795-1799 খ্রি.) অসন্তুষ্ট হয়েছিল। এই অবস্থার সুযোগে নেপোলিয়ন সসৈন্য কাউন্সিলে উপস্থিত হন। নেপোলিয়নের অনুগত ডিরেক্টর ও সদস্যগণ আনুষ্ঠানিকভাবে ডিরেক্টরি শাসনের অবসান ঘোষণা করেন। ফলে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফ্রান্সে কনস্যুলেটের শাসনের সূচনা হয় (9 নভেম্বর, 1799 খ্রি.)।
তিনজন কনসালের উপর শাসনক্ষমতা অর্পিত হয়। এর মধ্যে নেপোলিয়ন হলেন সর্বশক্তিমান প্রথম কনসাল।
ফ্রান্সের প্রথম কনসাল হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করে নেপোলিয়ন ফ্রান্স-বিরোধী দ্বিতীয় রাষ্ট্রজোটের আক্রমণ প্রতিহত করেন। এরপর ইতালি, জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশ দখল করেন। এইসব সাফল্যের ফলশ্রুতিরূপে 1802 খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন কাউন্সিল অফ স্টেটের প্রস্তাব অনুসারে চিরজীবনের জন্য প্রথম তথা প্রধান কনসাল পদে অধিষ্ঠিত হন।
তৃতীয় পর্যায়
অবশেষে 1804 খ্রিস্টাব্দে সিনেটের প্রস্তাবমতো গণভোটের মাধ্যমে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট রাজবংশীয় না হয়েও ‘ফরাসি জাতির সম্রাট’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ফরাসি প্রজাতন্ত্র নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফরাসি সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়।
মূল্যায়ন
এইভাবে বোনাপার্ট তৎকালীন ফ্রান্স তথা ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রণনিপুণ সেনাপতি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি এক সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়েও নিজ দক্ষতায় ফ্রান্সের শাসক হয়েছিলেন। 1799 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1814 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ফ্রান্সের ভাগ্যনিয়ন্ত্রা। তাই ঐতিহাসিকগণ তাঁর শাসনকালকে (1799-1814 খ্রি.) ইউরোপের ইতিহাসে ‘নেপোলিয়নের যুগ’ (Age of Napoleon) বলে অভিহিত করেছেন।
নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ সংস্কারগুলির বর্ণনা দাও।
ভূমিকা –
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট 1799 খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘কনসাল’ (Consul) রূপে ফ্রান্সের শাসনভার গ্রহণ করেন। 1804 খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট বলে ঘোষণা করেন এবং 1814 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল তাঁর রাজত্বকাল। তাঁর রাজত্বকালে তিনি সুশাসক, সংস্কারক ও সংগঠক হিসেবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ সংস্কার প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ফিশার (Fisher) বলেছেন যে, তার সংস্কারগুলি গ্রানাইট পাথরের শক্ত ভিত্তির উপর স্থায়ীভাবে নির্মিত (his civilian work in France was built upon granite)। শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা, ফ্রান্সের অর্থনীতি, আইন, বিচার, শিক্ষা প্রভৃতি ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি।
নেপোলিয়নের সংস্কারের উদ্দেশ্য – নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল –
- ফ্রান্সে জনকল্যাণকর কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা
- ফ্রান্সের অর্থনীতি, আইন, বিচার, শিক্ষা প্রভৃতি ব্যবস্থার উন্নয়ন
নেপোলিয়নের সংস্কার –
শাসনতান্ত্রিক সংস্কার – বিপ্লবজনিত কারণে দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সে বিশৃঙ্খলা চলছিল। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ হিসেবে নেপোলিয়ন শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে –
- শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সমগ্র ফ্রান্সকে 83টি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রতিটি প্রদেশের শাসক হিসেবে প্রিফেক্টদের নিয়োগ করেন।
- প্রাদেশিক ও পৌরসভাগুলির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার হ্রাস করা হয়।
- নির্বাচনের মাধ্যমে কর্মচারী নিয়োগের প্রথা বাতিল করে নিজের পছন্দমতো কর্মচারী নিয়োগ শুরু করেন।
অর্থনৈতিক সংস্কার – দেশের অর্থনৈতিক সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। যথা –
- তিনি আর্থিক বিপর্যয়কে সামাল দেওয়ার জন্য 1800 খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা Bank of France প্রতিষ্ঠা করেন।
- ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য তিনি নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ, স্টক এক্সচেঞ্জ গঠন, বন্দরের সংস্কার করেন।
- ফ্রান্সের অর্থব্যবস্থাকে মজবুত করার জন্য সোনা ও রুপোর নতুন মুদ্রা চালু করেন।
- তিনি সরকারি দপ্তরের ব্যয়সংকোচ ও অডিট প্রথা চালু করেন।
- সবাইকে আয়কর প্রদানে বাধ্য করেন।
- নতুন কর না চাপিয়ে পুরোনো কর আদায়ের উপর জোর দেন।
কোড নেপোলিয়ন (আইন ও বিচার সংস্কার) – নেপোলিয়নের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল 2287টি ধারাযুক্ত ‘আইন সংহিতা’ বা ‘কোড নেপোলিয়ন’ (Code Napoleon) সংকলন। নেপোলিয়ন ফ্রান্সের 4 জন বিশিষ্ট আইনবিদের সহায়তায় 4 বছর (1800-1804 খ্রি.) ধরে 84টি অধিবেশনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই ‘আইন সংহিতা’ সংকলন করেন। এই সংহিতা তিন ভাগে বিভক্ত –
- দেওয়ানি আইন
- ফৌজদারি আইন
- বাণিজ্যিক আইন
এই আইন সংহিতা অনুসারে –
- আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়।
- যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়।
- ব্যক্তিস্বাধীনতা স্বীকৃত হয়।
শিক্ষা সংস্কার – নেপোলিয়ন ফ্রান্সের প্রকৃত উন্নতির জন্য শিক্ষাক্ষেত্রেও সংস্কার সাধন করেন –
- তিনি প্রতি কমিউনে (পৌরসভা) একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
- সামরিক শিক্ষাদানের জন্য 29টি লাইসি (Lycee) বা সরকারি আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
- ইঞ্জিনিয়ারিং, চিকিৎসাবিদ্যা, শিক্ষক-শিক্ষণ প্রভৃতি অনেক বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
- ফরাসিদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তিনি 1808 খ্রিস্টাব্দে ‘ইম্পিরিয়াল ইউনিভার্সিটি অফ ফ্রান্স’ (Imperial University of France) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ধর্মীয় সংস্কার – নেপোলিয়ন যে-কোনো মূল্যে পোপের সঙ্গে বিরোধের অবসান চেয়েছিলেন। 1801 খ্রিস্টাব্দে পোপ সপ্তম পায়াসের (Pius VII) সঙ্গে তিনি কনকর্ডাট (Concordat) বা ধর্মমীমাংসা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে বলা হয় –
- গির্জা ও তার বিষয়-সম্পত্তির জাতীয়করণকে পোপ মেনে নেবেন।
- রোমের ক্যাথলিক ধর্ম ও চার্চগুলিকে ফ্রান্সের সরকার স্বীকৃতি দেবে।
- সরকার কর্তৃক মনোনীত যাজকদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবেন পোপ।
- ফ্রান্সের জনগণ ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করবে।
- ফ্রান্স ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পাবে।
অন্যান্য সংস্কার
- নেপোলিয়ন যোগ্য ও গুণী ব্যক্তিকে সম্মানিত করার জন্য ‘লিজিয়ন অফ অনার’ (Legion of Honour) খেতার প্রবর্তন করেন।
- তিনি ফ্রান্সের ‘ল্যুভর মিউজিয়াম’ (Louvre Museum)-কে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মিউজিয়ামে পরিণত করেন।
মূল্যায়ন
সামরিক বিজেতা হিসেবে নেপোলিয়ন যেমন অসামান্য কৃতিত্ব ও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন, তেমনি শাসক হিসেবেও তিনি অনবদ্য নজির রেখেছিলেন। নেপোলিয়ন তাঁর সংস্কার কার্যাবলির দ্বারা বিপ্লব-বিধ্বস্ত ফ্রান্সে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনেন। নানা সংস্কারের মধ্য দিয়ে তিনি ফরাসি বিপ্লবের সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ দুটিকে প্রতিষ্ঠিত করলেও স্বাধীনতাকে অবহেলা করেন।
কোড নেপোলিয়ন (Code Napoleon) বলতে কী বোঝো? কোড নেপোলিয়নের মাধ্যমে নেপোলিয়ন কীভাবে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ রক্ষা করেন?
কোড নেপোলিয়ন (Code Napoleon)
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সংস্কার কর্মসূচিগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ হল ‘কোড নেপোলিয়ন’ (Code Napoleon) বা আইনবিধির প্রবর্তন। তাঁর শাসনকালের পূর্বে ফ্রান্সের নানা স্থানে নানা ধরনের বৈষম্যমূলক ও পরস্পরবিরোধী আইন প্রচলিত ছিল। নেপোলিয়ন সমগ্র ফ্রান্সে একই ধরনের আইন প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে চারজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে নিয়ে একটি পরিষদ গঠন করেন। এই পরিষদের প্রচেষ্টায় দীর্ঘ চার বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে যে আইনবিধি সংকলিত হয়, তা ‘কোড নেপোলিয়ন’ নামে খ্যাত। 2,287টি বিধি সংবলিত এই আইন সংহিতা তিন ভাগে বিভক্ত ছিল –
- দেওয়ানি
- ফৌজদারি
- বাণিজ্যিক আইন
আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের স্বীকৃতি ছিল এই আইন সংহিতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
কোড নেপোলিয়ন ও বিপ্লবের আদর্শ
নেপোলিয়ন প্রাকৃতিক আইন ও রোমান আইনের সমন্বয় সাধন করে কোড নেপোলিয়ন রচনা করেছিলেন।
- এই আইনের ফলে পারিবারিক বন্ধন যেমন দৃঢ় হয়, ঠিক তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্যও প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ব্যক্তি বা পরিবারের বিশেষ অধিকারের পরিবর্তে সকল নাগরিকের সমান মর্যাদা ও সুযোগ লাভের অধিকার স্বীকৃত হয়।
- বংশকৌলীন্যের পরিবর্তে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি প্রদানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে কেবল অভিজাত বংশীয়রাই নয়, নিম্ন সম্প্রদায়ের যোগ্য ব্যক্তিরাও সামাজিক মর্যাদা অর্জন করার সুযোগ ও অধিকার লাভ করে।
- বিপ্লবের ফলে সামন্তপ্রথা লোপ করে যে নতুন ভূমি বন্দোবস্ত চালু করা হয়, কোড নেপোলিয়নে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে সামন্তপ্রথার অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়।
- এ ছাড়া বিচারক্ষেত্রে জুরি ব্যবস্থার প্রবর্তন করে সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিকে আরও সুদৃঢ় করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল কোড নেপোলিয়নে।
কোড নেপোলিয়নের গুরুত্ব
কোড নেপোলিয়নের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
- একই আইন প্রবর্তন – কোড নেপোলিয়ন সমগ্র ফ্রান্সে একই ধরনের আইনব্যবস্থা চালু করে। ফলে ফরাসি প্রশাসন একটি সুবিন্যস্ত রূপ লাভ করে।
- বিপ্লবের আদর্শকে রক্ষা – ফরাসি বিপ্লবকালে যে সমস্ত ঘোষণা ও আইনগত ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল সেগুলি একটি আইনগ্রন্থে সংকলিত হয়। এইভাবে কোড নেপোলিয়নের প্রবর্তন বিপ্লবী আদর্শকে উজ্জীবিত ও রক্ষা করেছিল।
- ‘ফরাসি সমাজের বাইবেল’ হিসেবে স্বীকৃতি – ‘কোড নেপোলিয়ন’ প্রবর্তন ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণি ও কৃষকসহ অধিকাংশ মানুষকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। এইভাবে তা ‘ফরাসি সমাজের বাইবেল’-এ পরিণত হয়।
মন্তব্য
এইভাবে কোড নেপোলিয়নের মাধ্যমে নেপোলিয়ন বিপ্লবের আদর্শগুলিকে বাস্তবায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই আইন সংহিতা কেবল ফ্রান্সেই নয়, ফ্রান্সের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রেও স্বীকৃতি পেয়েছিল। এই আইনের মাধ্যমে সকল মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হলেও এ বিষয়ে যে আন্তরিক প্রয়াস লক্ষ করা গিয়েছিল, তা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
ইউরোপে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য বিস্তারকে কয়টি পর্বে ভাগ করা যায়? ইউরোপে এই সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে লেখো।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের জন্ম হয় 1769 খ্রিস্টাব্দে ভূমধ্যসাগরের কর্সিকা (Corsica) দ্বীপে। তিনি একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করলেও অসামান্য যোগ্যতাবলে একের পর এক পদোন্নতি অর্জন করেন এবং 1799 খ্রিস্টাব্দে ডিরেক্টরি শাসনের অবসান ঘটিয়ে কনসালের শাসন শুরু করেন। 1804 খ্রিস্টাব্দে কনসালের শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন ও নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। নেপোলিয়ন তাঁর শাসনকালে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।
প্রথম পর্ব (1799-1804 খ্রি.)
এই পর্বে নেপোলিয়নের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ছিল ফ্রান্স-বিরোধী ইউরোপীয় শক্তির সমবায়ের বিনাশ। তিনি ইউরোপের দ্বিতীয় শক্তি সমবায়কে পরাজিত করেন। ফলে ইতালি, জার্মানি, হল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার সঙ্গে তিনি মিত্রচুক্তি স্বাক্ষর করেন। 1802 খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডের সঙ্গে অ্যামিয়েন্সের চুক্তি (Treaty of Amiens) স্বাক্ষর করেন। এই পর্বে তিনি দ্বিতীয় শক্তি সমবায়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফরাসিদের কাছে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত হন।
দ্বিতীয় পর্ব (1804-1815 খ্রি.)
এই পর্বে নেপোলিয়ন সম্রাট হিসেবে প্রায় 10 বছর রাজত্ব করেছিলেন। রাজত্বের প্রথমদিকে তিনি অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করেন। প্রায় সমগ্র ইউরোপ তাঁর পদানত হয়। কিন্তু 1805 খ্রিস্টাব্দে ট্রাফালগারের যুদ্ধে (Battle of Trafalgar) ইংরেজ নৌসেনাপতি নেলসনের (Nelson) হাতে নেপোলিয়ন পরাজিত হন। এই পরাজয়ের পর নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ বা কন্টিনেন্টাল সিস্টেম (Continental System) চালু করেন। এই মহাদেশীয় অবরোধের নীতিই নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম কারণরূপে প্রতিভাত হয়।
পোর্তুগাল ও স্পেন জয়
মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা প্রয়োগ করতে গিয়ে নেপোলিয়ন পোর্তুগাল ও স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে তিনি পোর্তুগাল অধিকার করেন। তারপর স্পেন দখল করে নিজের ভাই জোসেফকে স্পেনের সিংহাসনে বসান।
দেশে দেশে নেপোলিয়নবিরোধী সংগ্রাম
নেপোলিয়নের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্পেন ও পোর্তুগাল একসঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এটি উপদ্বীপের যুদ্ধ (Peninsular War) নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হন।
ইংল্যান্ড, রাশিয়া, জার্মানি, অস্ট্রিয়ার বিরোধিতা
উপদ্বীপের যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ে উৎসাহিত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়। তাঁর মস্কো অভিযানও ব্যর্থ হয়। অবশেষে 1815 খ্রিস্টাব্দের 18 জুন ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়ার মিলিত বাহিনীর সঙ্গে ওয়াটারলুর যুদ্ধে (Battle of Waterloo) নেপোলিয়ন চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন। তাঁকে সেন্ট হেলেনা (Saint Helena) দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়। এখানে 1821 খ্রিস্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে বিপ্লবী আদর্শের প্রসার কীভাবে ঘটে?
পরাজিত নেপোলিয়নকে যখন সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয় তখন সেখানে তিনি তাঁর আত্মজীবনী রচনা করেন। আত্মজীবনীতে তিনি বলেছেন, ‘আমি বিপ্লবের সন্তান’ (Child of Revolution)। আবার তিনি এও লিখেছিলেন, ‘আমিই বিপ্লব’ (I am the Revolution)। ঐতিহাসিক সোরেল (Sorel) নেপোলিয়নকে ‘ফরাসি বিপ্লবের মূর্ত প্রতীক’ বলে অভিহিত করেছেন।
বিপ্লবের সন্তান –
নেপোলিয়ন ছিলেন কর্সিকা দ্বীপের এক সাধারণ পরিবারের সন্তান — তিনি রাজপরিবারের সন্তান ছিলেন না। আর ফ্রান্সে রাজপরিবারের সন্তান ছাড়া অন্য কারোর রাজা হওয়ার অধিকার ছিল না। কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে সাম্যের (Equality) আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই ফরাসি বিপ্লবের জন্য নেপোলিয়ন সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়েও ফ্রান্সের সম্রাট হতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ সম্রাট নেপোলিয়ন ছিলেন ‘বিপ্লবের সন্তান’।
বিপ্লবী আদর্শের সম্প্রসারক
নেপোলিয়ন বিভিন্নভাবে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শকে দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
দেশে (ফ্রান্সে) –
- 1791-1794 খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী সরকার যেসব সামন্তকর এবং সামন্তপ্রথা প্রভৃতির বিলোপ করেছিলেন, নেপোলিয়নও তাঁর রাজত্বকালে তা বহাল রেখেছিলেন।
- তিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির নীতিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
- তিনি ‘কোড নেপোলিয়ন’ (Code Napoleon) প্রবর্তন করে আইনের চোখে সকলের সমান অধিকারের নীতি ঘোষণা করেছিলেন।
- তিনি ফরাসি সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেন।
- তিনি রাজতন্ত্রের ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতাকে অস্বীকার করে ফরাসি জনগণের গণভোট প্রথাকে স্বীকৃতি দেন।
বিদেশে –
- নেপোলিয়ন ছিলেন বিপ্লবের তরবারি (Napoleon was the Sword of Revolution)। তিনি ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
- তাঁর আক্রমণে ইউরোপের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রগুলি ভেঙে পড়ে।
- তিনি ইউরোপের সাধারণ জনগণকে সামন্ততান্ত্রিক শাসন ও স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের হাত থেকে মুক্ত করে তাদের সমান অধিকার প্রদান করেন।
- তিনি আইনের সাম্যনীতি এবং কোড নেপোলিয়ন প্রবর্তন করেন।
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য বিপ্লবকে ব্যাহত না করে, বিপ্লবের প্রসার সাধন করেছে। তাই তাঁকে ‘বিপ্লবের সম্প্রসারক’ ও ‘নির্বাহক’ বলা হয়।
নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের সমান্তরাল অবস্থান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ভূমিকা – কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে বসবাসকারী জনসমষ্টির মধ্যে ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি কোনো একটি কারণে গভীর একাত্মবোধের জন্ম হলে এবং সেই ঐক্যবোধের সঙ্গে দেশপ্রেম মিলিত হলে, তাকে ‘জাতীয়তাবাদ’ বলা হয়। ফরাসি বিপ্লবকালে বিপ্লবী বাহিনী ফ্রান্সের বাইরে এই আদর্শ ছড়ানোর যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে তা পরিণতি লাভ করে এবং ইতালি, জার্মানি, স্পেন ও পোল্যান্ডে জাতীয়তাবাদী আদর্শের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে।
ইতালি – নেপোলিয়নের শাসনে ইতালির জনগণের মধ্যে চেতনা ও ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়েছিল। খণ্ড-বিখণ্ড ইতালিতে 1796 খ্রিস্টাব্দে পদার্পণের পর নেপোলিয়ন সেখানে একই ধরনের আইন-কানুন, ভূমি ব্যবস্থা, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার প্রচলন করেন। ভূমিদাসপ্রথা ও বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির বিলোপ, ধর্মকর ও সামন্তকরের অবসান ঘটিয়ে ইতালিবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ঘটান। তাই ম্যাৎসিনি বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও জাতীয় সংহতির সত্তা হয়েছিল তখন থেকেই, যখন ইতালি নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল।’
জার্মানি – 1806 খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়ে ব্যাভারিয়া, ব্যাডেন, স্যাক্সনি, উইটেনবার্গ-সহ মোট 18টি ছোটো ছোটো জার্মান রাজ্য নিয়ে ‘কনফেডারেশন অফ দ্য রাইন’ গঠন করেন। এ ছাড়াও প্রগতিশীল শাসন সংস্কার, অভিজাততন্ত্রের ক্ষমতা বিলোপ, চার্চের সম্পত্তির বাজেয়াপ্তকরণ, ধর্মসহিষ্ণুতা ও কোড নেপোলিয়ন প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি জার্মান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার স্বপ্ন দেখান।
পোল্যান্ড – অনুরূপভাবে 1807 খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া ও রাশিয়ার অধিকৃত পোল্যান্ড নিয়ে ‘গ্র্যান্ড ডাচি অফ ওয়ারশ’ গঠন করেন — যা ছিল পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতির প্রতীক। এ ছাড়াও আইনের চোখে সমতা, ভূমিদাসপ্রথার অবসান প্রভৃতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে নেপোলিয়ন পোল্যান্ডে একটি উদারনৈতিক নতুন সংবিধান চালু করেন এবং দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
বেলজিয়াম, গ্রিস ও ল্যাটিন আমেরিকা – নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আদর্শের সম্পর্কের কারণে প্যান-জার্মান, প্যান-স্লাভ ইত্যাদি ‘অখণ্ড জাতীয়তাবাদী’ ধারণা জন্ম নেয়। বেলজিয়াম ও গ্রিস স্বাধীনতা লাভ করে এবং সুদূর ল্যাটিন আমেরিকাতে জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রসারিত হয়।
মূল্যায়ন – নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদের আদর্শ পাশাপাশি অবস্থান করায় সাধারণ মানুষ তাঁকে মুক্তিদাতা হিসেবে অভিনন্দিত করেছিল। নেপোলিয়নের বিজয়ী বাহিনীর অপ্রতিহত অগ্রগতিতে ইউরোপে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও সামন্তপ্রথার ধ্বংস সাধিত হয়েছিল। এমনকি যে সকল দেশে বিপ্লব দেখা যায়নি সেখানেও তাঁর স্পর্শে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছিল। তাই নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদের আদর্শের পাশাপাশি অবস্থান লক্ষ করে ঐতিহাসিক কার্লটন হেইজ (Cariton Hayes) বলেছেন, ‘নেপোলিয়ন ইউরোপের সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তি।’
নেপোলিয়ন কীভাবে ইউরোপে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন? তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতি সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বিরোধী ছিল কেন?
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সাম্রাজ্যবাদী শাসক। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করার জন্য একাধিকবার বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। বিভিন্ন যুদ্ধে জয়লাভের ফলে তিনি ক্রমশ ইউরোপের ভাগ্যনিয়ন্তা পরিণত হন।
বাটাভীয় প্রজাতন্ত্র
নেপোলিয়ন ইউরোপের যেসব অঞ্চলে তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য হল বাটাভীয় প্রজাতন্ত্র। 1806 খ্রিস্টাব্দে এই প্রজাতন্ত্রের নাম হয় হল্যান্ড। তিনি এখানকার শাসনভার তাঁর ভাই লুই বোনাপার্টের উপর ন্যস্ত করেন। 1810 খ্রিস্টাব্দে হল্যান্ডকে সরাসরি ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ইতালি
নেপোলিয়ন ক্যাম্পো ফোর্মিও এবং প্রেসবার্গের সন্ধির দ্বারা অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে ইতালিতে অস্ট্রিয়ার অধিকৃত অঞ্চলগুলিকে ফ্রান্সের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করেন। উত্তর ইতালির তাস্কানি, পিডমন্ট ও জেনোয়া-কে ফ্রান্সের শাসনাধীনে রেখে সেখানে তাঁর পুত্র ইউজিনকে শাসক হিসেবে নিয়োগ করেন। পোপকে বন্দি করে রোম নগরীকে ফ্রান্সের সঙ্গে যুক্ত করেন।
জার্মানি
নেপোলিয়ন জার্মানিকে সাম্রাজ্যভুক্ত করার পূর্বে জার্মানি অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং সেখানে অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার আধিপত্য বজায় ছিল। নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়াকে যুদ্ধে পরাস্ত করে 1795 খ্রিস্টাব্দে বাসেলের সন্ধি, 1797 খ্রিস্টাব্দে ক্যাম্পো ফোর্মিওর সন্ধি এবং 1801 খ্রিস্টাব্দে লুনেভিলের সন্ধি স্বাক্ষর করে জার্মানিকে পুনর্গঠন করেন। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর জার্মানিবাসী নেপোলিয়নকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়।
রাশিয়া
1807 খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন ফ্রিডল্যান্ডের যুদ্ধে রুশ জার প্রথম আলেকজান্ডারকে পরাস্ত করেন এবং জার প্রথম আলেকজান্ডার টিলসিটের সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এই সন্ধির দ্বারা নেপোলিয়ন কার্যত ইউরোপের একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিণত হন।
সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও বিপ্লবী আদর্শ
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের সম্প্রসারণ ঘটেছিল তাতে সন্দেহ নেই। তবে তিনি সাম্যের আদর্শকে স্বীকার করলেও স্বাধীনতার আদর্শকে অস্বীকার করেন। ঐতিহাসিক ফিশার মনে করেন, মেডেলের দুই পিঠে যেমন দুরকম ছাপ থাকে, ঠিক তেমনি নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্যের মেডেলের একদিক উজ্জ্বল এবং অন্যদিক অন্ধকারময় ছিল। বিজিত দেশগুলিতে নেপোলিয়ন তাঁর সংস্কারের আড়ালে স্বৈরশাসন স্থাপন করেন। যুদ্ধের প্রয়োজনে বিজিত দেশ থেকে সম্পদ লুঠ করেন এবং জনসাধারণকে সেনাদলে যোগ দিতে বাধ্য করেন। নিজ অভিলাষ পূরণ করার জন্য তিনি এইসব দেশগুলির উপর মহাদেশীয় অবরোধ চাপিয়ে দেন।
উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, নেপোলিয়ন সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে বিপ্লবের আদর্শগুলিকে ব্যবহার করেছিলেন, বিপ্লবের আদর্শ প্রচারের জন্য সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করেননি। এই কারণে বিভিন্ন সময়ই তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি এবং বিপ্লবী আদর্শগুলি পরস্পরবিরোধী হয়ে উঠেছে।
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের সঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের সংঘাত কীভাবে ঘটেছিল?
নেপোলিয়ন তাঁর আত্মজীবনীতে নিজেকে ‘বিপ্লবের ধ্বংসকারী’ বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক থমসন ও গ্যারেট (Thomson & Garrett) বলেছেন, নেপোলিয়ন বিভিন্নভাবে ফরাসি বিপ্লবের লক্ষ্য ও নীতি লঙ্ঘন করেন, যে বিপ্লবী আন্দোলন থেকে তাঁর উত্থান। নেপোলিয়নের কার্যাবলির মধ্যেও বিপ্লব বিরোধিতার প্রকাশ লক্ষ করা যায়।
ফ্রান্সে –
- ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান আদর্শ ছিল ‘স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র,’ যা নেপোলিয়নের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। তিনি ফ্রান্সের প্রথম কনসাল হয়ে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন। অন্য দুজন কনসাল ছিলেন তাঁর আজ্ঞাবহ কর্মচারী মাত্র।
- তিনি বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র ও রাজসভার জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব-অনুষ্ঠান পুনরায় প্রবর্তন করেছিলেন। ফরাসি বিপ্লবে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ হয় ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সূত্র ধরে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের কনসাল হন। কিন্তু তিনি নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে বিপ্লবী আদর্শের বিচ্যুতি ঘটান।
- তিনি সরকারি কর্মচারীদের নির্বাচন প্রথার পরিবর্তে মনোনয়ন প্রথা চালু করেন। ফলে তাঁর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বিপ্লবী জেকোবিন দলের প্রজাতন্ত্র ও গণভোটের আদর্শ বিসর্জন দিয়েছিলেন। তিনি বাক্স্বাধীনতা হরণ, বিনা বিচারে গ্রেফতার প্রভৃতির প্রচলন করে বিপ্লবের আদর্শকে জলাঞ্জলি দেন।
বিদেশে –
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ বিস্তার লাভ করেছিল, এ ধারণাও সম্পূর্ণ ঠিক নয়।
- নেপোলিয়ন নববিজিত দেশগুলিতে মধ্যযুগীয় শোষণ ও অসাম্যের অবসান ঘটিয়ে ওইসব অঞ্চলে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে জনমুখী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে রাজতান্ত্রিক শাসন চালু করেন। ওইসব দেশে নিজের ভাই বা আত্মীয়দের শাসন চাপিয়ে দিয়েছিলেন- যা স্বজনপোষণ নীতির পরিচায়ক ও বিপ্লবী আদর্শের পরিপন্থী ছিল।
- তিনি ইউরোপে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর বিজিত দেশে রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসন স্থাপন করেছিলেন।
- নেপোলিয়ন তাঁর বিজিত রাজ্যে জনপ্রিয়তা লাভের জন্য পুরোনো রাজবংশগুলির বিরুদ্ধে জনমতকে কাজে লাগান। তিনি সাধারণ জনগণকে নিজের পক্ষে আনার জন্য বিপ্লবের সাম্যনীতি প্রচার ও প্রয়োগ করেন। কিন্তু তিনি তাঁদের স্বাধীনতা বা গণতান্ত্রিক অধিকার দেননি।
ঐতিহাসিক ডেভিড থমসন (David Thomson) বলেছেন, “নেপোলিয়ন সাম্যের আদর্শকে স্বীকার করলেও স্বাধীনতার আদর্শকে বাতিল করেছিলেন।”
নেপোলিয়ন ইউরোপের পুনর্গঠন কীভাবে করেছিলেন?
অথবা, নেপোলিয়ন ইতালি ও জার্মানির পুনর্গঠন কীভাবে করেছিলেন? ইউরোপে জাতীয়তাবাদ প্রসারে নেপোলিয়নের ভূমিকা কী ছিল?
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কেবলমাত্র রণনিপুণ সেনাপতি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। নেপোলিয়ন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ জয় করে পুরাতনতন্ত্র ধ্বংস করেন এবং ইউরোপের পুনর্গঠন করেন। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ডেভিড থমসন (David Thomson) বলেছেন, যেখানেই নেপোলিয়নের বাহিনী প্রবেশ করেছে সেখানেই পুরাতনতন্ত্রের অবসান ঘটেছে।
নেপোলিয়নের ইউরোপ পুনর্গঠনের লক্ষ্য –
ইউরোপের পুনর্গঠনে নেপোলিয়নের লক্ষ্য ছিল ফ্রান্সের চারপাশে অনুগত রাষ্ট্র সৃষ্টি করা।
নেপোলিয়নের ইউরোপ নবগঠিত রাজ্যের ভিত্তি –
নেপোলিয়ন সৃষ্ট নবগঠিত রাজ্যের প্রধান ভিত্তি ছিল নেপোলিয়নের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য।
ইতালি –
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য পুনর্গঠনের সর্বাধিক ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটেছিল ইতালি ও জার্মানির রাজ্যগুলিতে। নেপোলিয়ন ইতালির পুনর্গঠন করেন। অস্ট্রিয়া ইতালির কয়েকটি অঞ্চল দখল করে রেখেছিল। নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে ওই অঞ্চলগুলিকে ফরাসি আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করেন। নেপোলিয়ন নিজেকে ইতালির রাজা (King of Italy) বলে ঘোষণা করেন। এখানে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর ও জোসেফাইনের পুত্র ইউজিন বুহারনেকে শাসক নিযুক্ত করেন। তিনি পোপকে বন্দি করেন এবং পোপের রাজ্য রোম নগরীকে ফ্রান্সের সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি ইতালির টাসকানি, পিডমন্ট, জেনোয়া প্রভৃতি দখল করে ফ্রান্সের সঙ্গে যুক্ত করেন। নেপোলিয়ন তাঁর ভাই জোসেফকে (Joseph) দক্ষিণ ইতালির রাজা হিসেবে নেপলসের সিংহাসনে বসান।
জার্মানি
নেপোলিয়নের জার্মানি জয় ও তার পুনর্গঠন ছিল চমকপ্রদ। তখন জার্মানি প্রায় 300টি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। নেপোলিয়ন জার্মানি জয় করে 300টি রাজ্যকে পুনর্গঠন করে 39টি রাজ্যে পরিণত করেন।
নেপোলিয়ন জার্মানিকে অস্ট্রিয়ার প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি ব্যাভারিয়া ও তার পাশের অঞ্চল নিয়ে গঠন করেন ব্যাভারিয়া রাজ্য। তিনি উইটেনবার্গ ও ব্যাডেনকে নিয়ে অস্ট্রিয়ার প্রভাবমুক্ত দুটি রাজ্য গঠন করেন।
রাইনের রাষ্ট্রজোট (Confederation of the Rhine)
নেপোলিয়ন ব্যাভারিয়া, উইটেনবার্গ, স্যাক্সনি, ব্যাডেন-সহ দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির অনেকগুলি রাজ্যকে নিয়ে রাইনের রাষ্ট্রজোট বা ‘কনফেডারেশন অফ দ্য রাইন’ গঠন করেছিলেন। প্রথমে 16টি ও পরে 18টি জার্মান রাজ্য নিয়ে কনফেডারেশন অফ দ্য রাইন গঠিত হয়েছিল।
ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্য (Kingdom of Westphalia)
নেপোলিয়ন হ্যানোভার, হেস-ক্যাসেল ও স্যাক্সনি রাজ্যের সমন্বয়ে ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্য গঠন করেন। তাঁর ভাই জেরোম (Jerome) এই রাজ্যের শাসক নিযুক্ত হন।
গ্র্যান্ড ডাচি অফ ওয়ারশ (Grand Duchy of Warsaw)
নেপোলিয়ন প্রাশিয়া ও পোল্যান্ডের অংশ নিয়ে গঠন করেছিলেন ‘গ্র্যান্ড ডাচি অফ ওয়ারশ’ নামক একটি নতুন রাজ্য। এই রাজ্যটিকে স্যাক্সনির রাজার অধীনে রাখা হয়। ইউরোপের পুনর্গঠন করে ইতালি ও জার্মানির ঐক্যের পথ প্রশস্ত করা ছিল নেপোলিয়নের বড়ো কৃতিত্ব।
ইউরোপে জাতীয়তাবাদের প্রসারে নেপোলিয়নের ভূমিকা
কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, ইউরোপের এবং বিশেষ করে জার্মানি ও ইতালির পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে নেপোলিয়ন ওই সকল দেশে জাতীয় ঐক্য স্থাপনের নীতিকে গ্রহণ করেন। নেপোলিয়ন বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলিতে একই ধরনের শাসনব্যবস্থা, করকাঠামো, বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা ও আইনবিধি প্রবর্তন করে পুরাতন ব্যবস্থা ভেঙে দেন। রাজ্যগুলি নেপোলিয়নের অধীনেই জাতীয় সার্বভৌমত্বের স্বাদ অনুভব করতে শেখে। এই জাতীয়তাবোধই একসময় তাদের সাহায্য করেছিল নেপোলিয়নের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে।
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া আলোচনা করো।
ভূমিকা
ফরাসি বিপ্লবের জাতীয়তাবাদী আদর্শ নেপোলিয়নের বিজিত দেশগুলিতে এক জাতীয়তাবাদী আবেগের উন্মেষ ঘটিয়েছিল। ক্রমে জার্মানি, ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশের মানুষ জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের পথে অগ্রসর হয়েছিল। স্থানীয় প্রতিষ্ঠান, দেশীয় রীতিনীতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জাতীয় ভাষার উপর তাঁর আঘাত হেনে, এমনকি বাকস্বাধীনতা হরণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব মেনে না নেওয়া, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ প্রভৃতি স্বৈরতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক নীতি, আদর্শ ও কর্মপন্থা নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।
ফ্রান্সে প্রতিক্রিয়া
ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্য’ নীতির ফলে নেপোলিয়ন সিংহাসনে বসলেও —
- বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, ফরাসি উপনিবেশে ক্রীতদাসপ্রথা পুনঃপ্রবর্তন এবং জাকোবিনদের গণভোট ও প্রজাতন্ত্রের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তিনি ফরাসি জনগণের আস্থা হারিয়েছিলেন।
- তাঁর শিক্ষানীতি ও পোপের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি ছিল বিপ্লবী ভাবধারার বিরোধী।
- তিনি সার্বিক ভোটাধিকার ও গরিবদের জন্য ‘ল অফ মিনিমাম’ ও ‘ল অফ ম্যাক্সিমাম’ পুনঃপ্রবর্তন না করায় সমালোচিত হয়েছিলেন।
- সর্বোপরি, তাঁর বিদেশনীতি, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা, নতুন নতুন সামরিক অভিযানগুলির ব্যয় নির্বাহের জন্য করভার বৃদ্ধি এবং বহু মানুষের মৃত্যুতে ফরাসি বুর্জোয়া ও শিল্পপতিদের পাশাপাশি অসংখ্য সাধারণ মানুষও নেপোলিয়ন বিরোধী মনোভাব পোষণ করেন এবং ‘মুক্তিদাতার’ বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের’ জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে।
জার্মানিতে প্রতিক্রিয়া
প্রাথমিক পর্বে নেপোলিয়নের শাসনকে জার্মান জাতি তথা কিছু দার্শনিক ও সাহিত্যিকগণ ভূয়সী প্রশংসা করলেও তাঁর স্বৈরাচারী শাসনপ্রণালীতে অত্যাচারিত প্রুশিয়ার দেশপ্রেমিক স্টাইন, হিন্ডেনবার্গ প্রমুখ শাসন ও শিক্ষাসংস্কারের মাধ্যমে জার্মান জাতির মনে নবপ্রেরণা সঞ্চার করেন। এমনকি কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্ররা জার্মানির মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেয় এবং শেষ পর্যন্ত জার্মানবাসীরা প্রুশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নেপোলিয়ন বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
আইবেরীয় উপদ্বীপে প্রতিক্রিয়া
আইবেরীয় উপদ্বীপেও নেপোলিয়ন বিরোধী প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ‘উপদ্বীপীয় যুদ্ধ’ এর মাধ্যমে। নেপোলিয়ন 1806 খ্রিস্টাব্দে ‘বার্লিন ডিক্রি’ জারি করে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করলে পর্তুগাল তা মানতে অস্বীকার করে। ফলে নেপোলিয়ন স্পেনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পর্তুগাল দখল করেন (1807 খ্রি.)। পর্তুগাল দখলের পর সামরিক কারণে তিনি স্পেনও দখল করেন (1808 খ্রি.) এবং নিজ ভ্রাতা জোসেফ বোনাপার্টকে সিংহাসনে বসান। ফলে স্পেনের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহর নেপোলিয়নবিরোধী গণ অভ্যুত্থানে উত্তাল হয়ে ওঠে। ক্রমে এই বিদ্রোহ সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেনবাসী ‘জুন্টা’ ও গেরিলাবাহিনী গঠন করে ফ্রান্সের সৈন্যের মোকাবিলা করতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এই বিদ্রোহ ছিল স্পেনীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া।
উপসংহার
স্পেনের বিদ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে পর্তুগালেও নেপোলিয়নবিরোধী বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ইংল্যান্ডের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত স্পেন জয়লাভ করে। ফলে নেপোলিয়নের অপরাজেয় ভাবমূর্তি এই যুদ্ধের ফলে বিনষ্ট হয়। স্পেনের বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত হয়ে অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া, রাশিয়া—সর্বত্রই জনজাগরণ শুরু হয় এবং নেপোলিয়নের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
মহাদেশীয় ব্যবস্থা (Continental System) বলতে কী বোঝায়? নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্য কী ছিল? নেপোলিয়ন কীভাবে মহাদেশীয় ব্যবস্থা প্রয়োগ করেছিলেন?
মহাদেশীয় ব্যবস্থা
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বুঝেছিলেন যে ‘সমুদ্রের রানি’ ইংল্যান্ডকে যুদ্ধে পরাজিত করা সম্ভব নয়। ইংল্যান্ডকে ‘হাতে মারা’ সম্ভব নয় জেনে নেপোলিয়ন তাকে ‘ভাতে মারা’র ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ তিনি ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক ক্ষতি করার চেষ্টা করেন। নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডকে পর্যুদস্ত করার জন্য যে অর্থনৈতিক অবরোধের নীতি গ্রহণ করেন, তাকেই ‘মহাদেশীয় ব্যবস্থা’ বা ‘কন্টিনেন্টাল সিস্টেম’ (Continental System) বলা হয়।
মহাদেশীয় ব্যবস্থা – মূলকথা
ইউরোপের কোনো বন্দরে ইংল্যান্ডের কোনো জাহাজ যেতে পারবে না এবং ইউরোপের কোনো দেশ ইংল্যান্ডের কোনো পণ্য আমদানি করতে পারবে না। এই নির্দেশ অমান্য করলে নেপোলিয়ন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে এই ব্যবস্থায় স্থির করা হয়।
নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্য
নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ডের শিল্প ও বাণিজ্যকে ধ্বংস করা এবং ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। তার উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে দুর্বল করে ইউরোপে ফ্রান্সের প্রভাব বাড়ানো।
ইংল্যান্ডের শিল্প ও বাণিজ্য ধ্বংস করা –
নেপোলিয়ন বুঝেছিলেন, ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক ক্ষমতার মূল উৎস ছিল শিল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্য। ইংল্যান্ড তার বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করত ও ইংল্যান্ডের কারখানায় তৈরি সামগ্রী বিভিন্ন দেশে বিক্রি করত। নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে শিল্প ও বাণিজ্যকে ধ্বংস করার জন্য মহাদেশীয় ব্যবস্থা ঘোষণা করেছিলেন।
ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি –
নেপোলিয়নের উদ্দেশ্য ছিল মহাদেশীয় ব্যবস্থার ফলে ইংল্যান্ড ইউরোপে তার বাজার হারালে ফ্রান্স তা দখল করবে। ফলে ফ্রান্স অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী হবে।
মহাদেশীয় ব্যবস্থার প্রয়োগ –
মহাদেশীয় ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য নেপোলিয়ন বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
বার্লিন ডিক্রি (Berlin Decree) জারি (ফ্রান্স) –
মহাদেশীয় ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য 1806 খ্রিস্টাব্দের ২১ নভেম্বর নেপোলিয়ন “বার্লিন ডিক্রি” জারি করেন। এতে বলা হয় যে –
- ফ্রান্স বা তার মিত্রদেশ বা নিরপেক্ষ দেশের বন্দরে ইংল্যান্ড বা তার উপনিবেশগুলি থেকে আসা কোনো জাহাজকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
- ইংল্যান্ডের কোনো জিনিসপত্র অন্য দেশের জাহাজ মারফত আনা হলেও তা বাজেয়াপ্ত করা হবে।
অর্ডারস ইন কাউন্সিল (Orders-in-Council) (ইংল্যান্ড) –
ইংল্যান্ডের মন্ত্রিসভা বার্লিন ডিক্রির প্রত্যুত্তরে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অর্ডারস-ইন-কাউন্সিল ঘোষণা করে (1807 খ্রি.)। এতে বলা হয় যে –
- ফ্রান্স ও তার মিত্রদেশের বন্দরে কোনো দেশের জাহাজ ঢুকতে পারবে না। এই নির্দেশ অমান্য করলে ইংল্যান্ড ওই জাহাজ ও মালপত্র বাজেয়াপ্ত করবে।
- যদি নিরপেক্ষ কোনো দেশের জাহাজকে নিতান্তই ফ্রান্সে যেতে হয় তবে তাকে ইংল্যান্ডের কোনো বন্দরে এসে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে লাইসেন্স নেওয়ার পর যেতে হবে।
মিলান ডিক্রি (Milan Decree) (ফ্রান্স) –
ইংল্যান্ডের অর্ডারস-ইন-কাউন্সিলের প্রত্যুত্তরে 1807 খ্রিস্টাব্দেই নেপোলিয়ন মিলান ডিক্রি জারি করেন। এতে বলা হয়- কোনো জাহাজ অর্ডারস-ইন-কাউন্সিল অনুসারে ইংল্যান্ডের কাছ থেকে লাইসেন্স নিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে।
ওয়ারশ ডিক্রি (Warsaw Decree) ও ফন্টেনব্লো ডিক্রি (Fontainebleau Decree) (ফ্রান্স) –
নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আরও দুটি ডিক্রি জারি করেন। এতে বলা হয় যে, নির্দেশ অমান্য করলে বাজেয়াপ্ত করা দ্রব্যসামগ্রীতে প্রকাশ্যে আগুন লাগানো হবে।
- মহাদেশীয় ব্যবস্থা সফল করার জন্য নেপোলিয়ন প্রাশিয়া (1806), রাশিয়া (1807) ও অস্ট্রিয়ার (1809) সম্রাটকে বাধ্য করেন।
- ওলন্দাজ বণিকরা এই ব্যবস্থা মানতে না চাইলে নেপোলিয়ন তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠান।
- পোপ কোনো পক্ষে না গিয়ে নিরপেক্ষ থাকার কথা বললে নেপোলিয়ন পোপকে বন্দি করেন।
- এই ব্যবস্থা সফল করার জন্য নেপোলিয়ন পোর্তুগাল ও স্পেন দখল করেন।
- সুইডেন এই ব্যবস্থা না মানতে চাইলে মিত্ররাষ্ট্র রাশিয়া (জার প্রথম আলেকজান্ডার) সুইডেন আক্রমণ করে তাকে এই ব্যবস্থা মানতে বাধ্য করে।
মন্তব্য
পরিশেষে বলা যায়, নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা সাফল্য লাভ করেনি। কারণ এই ব্যবস্থাকে সফল করতে হলে ইংল্যান্ডের চেয়েও শক্তিশালী নৌবাহিনীর প্রয়োজন ছিল কিন্তু তা ফ্রান্সের ছিল না। ঐতিহাসিক লজ বলেছেন, ‘একজন কূটনীতিক হিসেবে নেপোলিয়নের ব্যর্থতার বড়ো প্রমাণ ছিল মহাদেশীয় ব্যবস্থা।’
নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণ সম্পর্কে আলোচনা করো।
1807 খ্রিস্টাব্দে টিলসিটের সন্ধি (Treaty of Tilsit) স্বাক্ষরের পর বিভিন্ন কারণে ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। এর ফলস্বরূপ, 1812 খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেন।
আক্রমণের পটভূমি
রাশিয়ার সঙ্গে নেপোলিয়নের তিক্ততা শুরু হয়েছিল মহাদেশীয় ব্যবস্থা, তুরস্ক, পোল্যান্ড, ওল্ডেনবার্গ প্রভৃতি বিষয়ে। এইরকম উত্তেজনাকর অবস্থায় রাশিয়া নেপোলিয়নকে এক চরমপত্র দিয়ে দাবি করে যে –
- রাশিয়াকে নিরপেক্ষ দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যের সুযোগ দিতে হবে।
- ডানজিগের সেনাবাহিনী হ্রাস করতে হবে ও প্রাশিয়ার দখলদারি ত্যাগ করতে হবে।
নেপোলিয়ন রাশিয়ার এই চরমপত্র প্রত্যাখ্যান করে 1812 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া আক্রমণ করেন।
রাশিয়া আক্রমণ
- সৈন্য সংগ্রহ – রাশিয়া আক্রমণ করার জন্য নেপোলিয়ন হল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, ইটালি সহ ইউরোপের 20টি দেশ থেকে 6 লক্ষ 75 হাজার সৈন্য নিয়ে এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন। একে ‘গ্র্যান্ড আর্মি’ (Grand Army) বা ‘মহতী সেনাদল’ বলা হয়।
- নেপোলিয়নের আক্রমণ – 1812 খ্রিস্টাব্দের 24 জুন নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেন।
- রাশিয়ার পোড়ামাটি নীতি (Scorched Earth Policy) অনুসরণ – নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করলে রুশ সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে ক্রমশ পিছু হটতে থাকে। পিছু হটে যাওয়ার সময় রুশবাহিনী ‘পোড়ামাটি নীতি’ অনুসরণ করে শহর, গ্রাম, বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র সব পুড়িয়ে দিয়ে যায়। পানীয় জলেও বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয় যাতে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী তা ব্যবহার করতে না পারে।
- বোরোডিনোর যুদ্ধ (Battle of Borodino) – রুশবাহিনী 1812 খ্রিস্টাব্দের 7 সেপ্টেম্বর মস্কো থেকে 75 মাইল দূরে বোরোডিনো গ্রামে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়। এই যুদ্ধে নেপোলিয়ন জয়লাভ করলেও তাঁর 30 হাজার সৈন্য প্রাণ হারায়।
- মস্কো দখল – 1812 খ্রিস্টাব্দের 14 সেপ্টেম্বর নেপোলিয়ন বিনা বাধায় রাজধানী মস্কোয় প্রবেশ করেন। কিন্তু তখন মস্কো ছিল জনশূন্য এবং অগ্নিদগ্ধ। তা সত্ত্বেও নেপোলিয়ন মস্কোতে পাঁচ সপ্তাহ অপেক্ষা করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, জার খুব শীঘ্রই দূত পাঠিয়ে তাঁর সঙ্গে শান্তিচুক্তির প্রস্তাব দেবেন।
রাশিয়ার পাল্টা আক্রমণ
জার তখন মস্কো থেকে 300 মাইল দূরে সেন্ট পিটার্সবার্গে অবস্থান করছিলেন। এরপর তিনি নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করেন। ইতিমধ্যে রাশিয়ার আবহাওয়া নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীকে বিধ্বস্ত করে। অক্টোবরের তীব্র শীত, সঙ্গে টাইফাস নামক মারণজ্বরের প্রকোপ নেপোলিয়নের বাহিনীকে ভয়ংকর সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়। এই সময় একদিকে ‘কোসাক’ গেরিলা ও রুশবাহিনীর আক্রমণ এবং অপরদিকে শীত, তুষারপাত ও জ্বরে নেপোলিয়নের অসংখ্য সৈন্য প্রাণ হারান। 19 অক্টোবর তিনি গ্র্যান্ড আর্মির অবশিষ্ট সৈন্যদের দ্রুত দেশে ফেরার নির্দেশ দেন। নেপোলিয়ন মাত্র 50 হাজার সৈন্য ও শোচনীয় ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফ্রান্সে ফিরে আসেন।
নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণ তাঁর সামরিক জীবনের অন্যতম বড় ভুল ছিল। রাশিয়ার কঠোর আবহাওয়া, রুশবাহিনীর প্রতিরোধ এবং নেপোলিয়নের কৌশলগত ভুলের ফলে এই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতা নেপোলিয়নের সামরিক ক্ষমতা এবং ফ্রান্সের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
কী কী কারণে নেপোলিয়নের মস্কো অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল? মস্কো অভিযানের ব্যর্থতা নেপোলিয়নের পতনকে কতটা ত্বরান্বিত করেছিল?
নেপোলিয়ন ও তাঁর ব্যর্থ মস্কো অভিযান
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন 1812 খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে 6 লক্ষাধিক সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন। কিন্তু তাঁর এই অভিযান নানাবিধ কারণে ব্যর্থ হয়েছিল –
- রাশিয়ার পোড়ামাটির নীতি – নেপোলিয়নের ফরাসি বাহিনী মস্কোর অভিমুখে রওনা দিলে রুশবাহিনী ক্রমশ পিছু হটতে থাকে এবং পোড়ামাটির নীতি গ্রহণ করে। এই নীতি অনুসারে রুশবাহিনী পিছু হটার সময় পরিত্যক্ত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শস্যের খেত, পানীয় জল এমনভাবে নষ্ট করতে থাকে যাতে শত্রুবাহিনী সেগুলি ব্যবহার করার সুযোগ না পায়। অক্টোবরের শেষের দিকে খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদির অভাব ফরাসি সেনাদলের মনোবল ভেঙে দেয়।
- রাশিয়ার প্রাকৃতিক অবস্থা – রাশিয়ার প্রাকৃতিক অবস্থাও নেপোলিয়নের মস্কো অভিযানকে ব্যর্থ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। রাশিয়ায় জুলাই মাসের প্রবল বর্ষণ, আগস্টের প্রচণ্ড দাবদাহ, অক্টোবরের তীব্র শীতের কামড় এবং সর্বোপরি টাইফাস নামক জ্বরের প্রকোপ নেপোলিয়নকে ফ্রান্সে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
- রুশবাহিনীর আক্রমণ – অক্টোবরের শেষের দিকে খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদির অভাব এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায় ফরাসি বাহিনী প্রচণ্ড দুর্বিপাকে পড়ে। এইরকম পরিস্থিতিতে গ্র্যান্ড আর্মির অনেক সেনাই রুশ কোসাক গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারায়।
- গুজবের প্রভাব – প্যারিসে মাল্টে নামে এক প্রজাতন্ত্রী সেনাপতি নেপোলিয়নের মৃত্যুসংবাদ রটিয়ে সিংহাসন দখলের চেষ্টা করছে – মস্কোতে অবস্থানকালে এই সংবাদ পেয়ে নেপোলিয়ন সিংহাসন রক্ষার তাগিদে দ্রুত ফ্রান্সে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, কোনো একটি বিশেষ কারণ নয়, বরং একাধিক প্রতিকূল অবস্থা নেপোলিয়নের মস্কো অভিযানকে ব্যর্থ করেছিল।
মস্কো অভিযানের ব্যর্থতা ও নেপোলিয়নের পতন
নেপোলিয়নের মস্কো অভিযানের ব্যর্থতা সমগ্র ইউরোপে নব উন্মাদনা সৃষ্টি করে। নেপোলিয়ন যে অপরাজেয় নন তা প্রমাণিত হলে ইউরোপীয় শক্তিগুলি পুনরায় তাঁর বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়। ইংল্যান্ড, রাশিয়া, প্রুশিয়া চতুর্থ শক্তিজোট গঠন করে নেপোলিয়নের পতন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এ ছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
নেপোলিয়নের পতনের কারণ আলোচনা করো।
অথবা, নেপোলিয়নের পতনের কারণ লেখো।
ভূমিকা
নেপোলিয়ন অসামান্য প্রতিভাবলে একজন সামান্য সৈনিক থেকে ফ্রান্সের শাসক বা সম্রাট হয়েছিলেন। তিনি সমগ্র ইউরোপব্যাপী এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
নেপোলিয়নের পতনের কারণ
- নেপোলিয়নের অপরিমিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা – নেপোলিয়ন ছিলেন অপরিমিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি। তিনি সামরিক শক্তির জোরে যতই সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন ততই তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। তিনি সমগ্র ইউরোপের অধীশ্বর হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এই বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করার মতো রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি তাঁর ছিল না।
- সাম্রাজ্যের দুর্বল ভিত্তি – নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল দুর্বল। সামরিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এই সাম্রাজ্যের প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল না। তা ছাড়া তিনি যুদ্ধের মাধ্যমে যেসব জাতিকে ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত করেন, সেসব জাতিও নেপোলিয়ন ও ফরাসি শাসনকে ঘৃণার চোখে দেখত।
- স্বৈরাচারী শাসন – নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের হাত ধরে ক্ষমতালাভ করেছিলেন। কারণ ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে তিনি ইউরোপে বংশানুক্রমিক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি যে শাসন ইউরোপের উপর চাপিয়েছিলেন, তা ছিল আরও বেশি মাত্রায় স্বৈরাচারী। জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচার করলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদের বিরোধী। ইতালি, স্পেন ও জার্মানিতে তিনি তাঁর পুত্র এবং ভাইদের শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
- মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা – নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডকে দুর্বল করার জন্য মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা ঘোষণা করেছিলেন। এই ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য তিনি বিভিন্ন দেশের উপর বলপ্রয়োগ করতেও পিছপা হননি। ফলে রুষ্ট হয়ে ওইসব দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এবং তাঁর সমস্ত পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করেছিল। তা ছাড়া এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য প্রয়োজনীয় নৌশক্তিও তাঁর ছিল না। তাই এই মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা ছিল নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম কারণ।
- ধর্মীয় বিবাদ – নেপোলিয়নের সঙ্গে পোপ সপ্তম পায়াসের এক ‘ধর্মমীমাংসা চুক্তি’-র ফলে ফ্রান্সে ক্যাথলিক ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে প্রোটেস্ট্যান্টরা ক্ষুব্ধ হয়। আবার পোপ মহাদেশীয় ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করায় নেপোলিয়ন পোপকে বন্দি করেন। এর ফলে সমগ্র ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীরা নেপোলিয়নের উপর ক্ষুব্ধ হয়।
- স্পেন ও মস্কো নীতি – নেপোলিয়ন স্পেনের সিংহাসনে তাঁর ভাই জোসেফকে বসিয়ে স্পেনবাসীর আত্মমর্যাদায় আঘাত করেছিলেন। নেপোলিয়ন স্পেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান করলে স্পেনীয়রা সেই অভিযান ব্যর্থ করে দেয়। নেপোলিয়ন এ সম্পর্কে বলেছিলেন, “স্পেনীয় ক্ষতই আমাকে ধ্বংস করেছে” (The Spanish ulcer ruined me.)। নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম কারণ ছিল দূরবর্তী ও ভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের মস্কো অভিযান। এই অভিযানের সামরিক ব্যর্থতা তাঁর মর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল।
- ইংল্যান্ডের বিরোধিতা – নৌশক্তিতে বলীয়ান ইংল্যান্ডের বিরোধিতা নেপোলিয়নের পতনকে সুনিশ্চিত করেছিল। ইংল্যান্ড নীলনদ ও ট্রাফালগারের যুদ্ধে নেপোলিয়নকে পরাস্ত করে এবং তাঁর মহাদেশীয় অবরোধ প্রতিহত করে। এ ছাড়া ইংল্যান্ড উপদ্বীপের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নেপোলিয়নের শক্তিকে বিধ্বস্ত করেছিল।
- জাতিসমূহের যুদ্ধ – নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতা ইউরোপের দেশগুলিকে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে লড়াইয়ে নামার প্রেরণা জোগায়। ইতালি, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয় এবং চতুর্থ শক্তিজোট (ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, প্রাশিয়া) লিপজিগের বা জাতিসমূহের যুদ্ধে নেপোলিয়নকে পরাজিত করে।
উপসংহার
বহু যুদ্ধে জয়ী দুর্ধর্ষ সামরিক শক্তির অন্যতম অধিকারী নেপোলিয়ন 1814 খ্রিস্টাব্দে পরাজিত হয়ে ভূমধ্যসাগরের এলবা (Elba) দ্বীপে নির্বাসিত হন, কিন্তু পরের বছর তিনি আবার ফ্রান্সে এসে সিংহাসন দখল করেন। শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় দেশগুলির মিলিত আক্রমণে 1815 খ্রিস্টাব্দের 18 জুন ওয়াটারলুর যুদ্ধে (Battle of Waterloo) তিনি চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন এবং আটলান্টিক মহাসাগরের সেন্ট হেলেনা (Saint Helena) দ্বীপে নির্বাসিত হন। অবশেষে 1821 খ্রিস্টাব্দে এই দ্বীপেই নেপোলিয়নের মৃত্যু হয়।
আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণী ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায় বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদের কিছু ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাকে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। এছাড়াও, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন যার এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।