মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

Solution Wbbse

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর থেকে “ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
Contents Show

ব্রিটিশ আমলে বিশ শতকের ভারতে কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

ব্রিটিশ আমলে বিশ শতকের ভারতে কৃষক আন্দোলনের ভূমিকা –

ব্রিটিশ আমলে বিশ শতকে ভারতের কৃষকরা বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এই সময় জাতীয় রাজনীতি কৃষক আন্দোলনগুলিকে প্রভাবিত করে। ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে কৃষকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় কৃষক আন্দোলন –

1905 খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন বা স্বদেশি আন্দোলন হয়। এই বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে কৃষকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি। কারণ –

  • আন্দোলনে কৃষিভিত্তিক কর্মসূচি ছিল না।
  • পূর্ববঙ্গের মুসলমান কৃষকরা বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করে।

অসহযোগ আন্দোলনের সময় কৃষক আন্দোলন –

1920-1922 খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয়। এই আন্দোলনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।

  • বাংলায় আন্দোলন – বাংলার মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, পাবনা, রংপুর প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
  • বিহারে আন্দোলন – বিহারের ভাগলপুর, মুজফ্ফরপুর, দ্বারভাঙ্গা, মধুবনি প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা অসহযোগ আন্দোলনের সময় খাজনা বন্ধ আন্দোলনে শামিল হয়। বিহারে কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন স্বামী বিদ্যানন্দ।
  • যুক্তপ্রদেশে আন্দোলন – যুক্তপ্রদেশের হরদই, বারাবাঁকি, রায়বেরিলি, প্রতাপগড় প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা আন্দোলনে শামিল হয়। একা আন্দোলনে কৃষকরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

এ ছাড়াও গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব অঞ্চলেও কৃষকরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কৃষক আন্দোলন –

1930-1934 খ্রিস্টাব্দে পরিচালিত আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কৃষকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মহাত্মা গান্ধি।

  • বাংলায় আন্দোলন – বাংলার মেদিনীপুরের কাঁথি, মহিষাদল প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষকরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
  • যুক্তপ্রদেশে আন্দোলন – যুক্তপ্রদেশের রায়বেরিলি, আগ্রা, লখনউ, বারাবাঁকি, প্রতাপগড় প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক।
  • বিহারে আন্দোলন – আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বিহারের কৃষকরা জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবি করে। স্বামী সহজানন্দের নেতৃত্বে কিষানসভা গঠিত হয়।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কৃষক আন্দোলন –

1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল এক স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন। এই আন্দোলনেও কৃষকরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

  • বাংলায় আন্দোলন – ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মেদিনীপুর, দিনাজপুর, বালুরঘাট প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা খাজনা বন্ধ আন্দোলনে শামিল হয়।
  • বিহারে আন্দোলন – বিহারের ভাগলপুর, মুজফ্ফরপুর, পূর্ণিয়া, সাঁওতাল পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এখানের 80 শতাংশ থানা আন্দোলনকারীদের দখলে চলে আসে।
  • গুজরাটে আন্দোলন – গুজরাটের সুরাট, খান্দেশ, ব্রোচ প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা রেল অবরোধ ও সরকারি দপ্তর আক্রমণ করে।
  • উড়িষ্যায় আন্দোলন – উড়িষ্যার তালচের অঞ্চলের কৃষকরা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

ব্রিটিশ আমলে বিশ শতকের ভারতে কৃষক আন্দোলনের উপসংহার –

বিশ শতকের ভারতে কৃষকরা জাতীয় আন্দোলনগুলিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে তাদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করেছিল। জাতীয় নেতৃবৃন্দের অনেকে কৃষকদের দাবিদাওয়াকে সমর্থন করলেও অনেকে জমিদারদের বিরোধী কর্মসূচি গ্রহণে অনীহা দেখায়। ফলে সবক্ষেত্রে কৃষক আন্দোলন সমান গতিতে এগোতে পারেনি।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের ভূমিকা –

1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর বড়োলাট লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করেন। এই ঘটনার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ আন্দোলন হয়। ইতিহাসে তা স্বদেশি বা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন নামে পরিচিত। মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক এই আন্দোলনে মধ্যবিত্তশ্রেণি অংশগ্রহণ করে। কৃষকশ্রেণি এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে কৃষকশ্রেণির ভূমিকা –

কৃষকশ্রেণির দূরবস্থা –

ইংরেজ শাসন বাংলাদেশে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করা। এই রাজস্ব আদায়ের ফলে কৃষকদের উপর প্রবল আর্থিক চাপ পড়ে। তাই এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে উনিশ শতকে মাঝে মাঝে কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। কেন-না শোষণের বিরুদ্ধে এসময় কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। সেই কৃষকরা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়তা দেখায়নি।

কৃষকশ্রেণির অনীহা –

এসময় সমাজে মধ্যবিত্তশ্রেণি ছিল উদীয়মান শ্রেণি। পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভ করে এই শ্রেণি সরকারি চাকরি লাভ করে। বিভিন্ন পেশার মানুষ, যেমন – চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক, করণিক সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজদের চালু করা পুঁজিবাদী আর্থিক ব্যবস্থার সুফল এই শ্রেণি ভোগ করত। যেমন – জমিদারি থেকে ব্যাবসাবাণিজ্য করে তাদের অনেকে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ গরিব কৃষকের সঙ্গে এই শ্রেণির ব্যবধান প্রকট ছিল। গরিব কৃষকদের দুঃখে যেমন এই মধ্যবিত্তরা সমব্যথী বা সহমর্মী ছিল না, তেমনি মধ্যবিত্তশ্রেণির আহূত আন্দোলনে কৃষকশ্রেণির যোগদানের প্রবণতাও ছিল কম।

বঙ্গভঙ্গের ঘটনায় কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীদের মক্কেল কমে যাওয়ায়, সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় এবং কলকাতাবাসী জমিদারদের পূর্ব বাংলার জমি হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় মূলত এই মধ্যবিত্তশ্রেণি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল।

কৃষকশ্রেণির আঞ্চলিকতা –

লর্ড কার্জন পূর্ব বাংলা সফরের সময় বলেছিলেন, পূর্ব বাংলা একটি পৃথক প্রদেশ হিসেবে গঠিত হলে এখানকার মানুষের বিশেষত গরিব কৃষকদের উন্নতি হবে। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়েও, যেমন – পথঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও উন্নতি হবে। এ ছাড়া তিনি ঢাকায় সলিমউল্লাহকে একটি মুসলিম প্রদেশ উপহার দেওয়ার কথা বলেন। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করে, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান ও নমঃশূদ্র কৃষক। মুসলমান কৃষকেরা অংশত ধর্মীয় আবেগে, অংশত হিন্দু জমিদারদের অধীনতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করেছিল। অপরদিকে নমঃশূদ্ররা অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে সরকারি সুযোগ পাওয়ার আশায় বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায়।

কৃষকশ্রেণির নেতৃত্বের ত্রুটি –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল মধ্যবিত্তশ্রেণির হাতে। বাংলাদেশে অরবিন্দ ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশ্বিনীকুমার দত্ত ও ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বোম্বাই-এ তিলক, যোশি, পরাঞ্জপে এবং মাদ্রাজে চিদাম্বরম পিল্লাই, আনন্দ চালু এবং সুব্রহ্মণ্য আয়ার ছিলেন এই আন্দোলনের প্রধান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। পাঞ্জাবে লালা লাজপত রায়, জয়পাল প্রমুখ নেতারা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

কৃষক স্বার্থে কর্মসূচির অভাব –

এইসব নেতারা তাদের শ্রেণিচরিত্রের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। গণ আন্দোলনে সাধারণ মানুষের যে ভূমিকা থাকতে পারে সে-কথা তারা মনে করতেন না। যদিও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই মনোভাবের ব্যতিক্রমী ছিলেন, তথাপি তাঁর আন্দোলনেও কোনো কৃষককে তিনি শামিল করতে পারেননি। গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে এইসব নেতাদের যোগাযোগ ছিল না। কৃষকদের দুর্দশা দূর করার কথা তারা চিন্তা করতেন না। অধ্যাপক সুমিত সরকার মনে করেন, মধ্যবিত্তশ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনে কৃষক সম্প্রদায়কে শামিল করানো যায়নি, কারণ ছিল ‘সুনির্দিষ্ট কৃষিভিত্তিক কর্মসূচি’-র অভাব।

সামগ্রিকভাবে কৃষকদের প্রতিক্রিয়া –

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ই পূর্ববঙ্গে, বিশেষ করে ময়মনসিংহ, কুমিল্লা প্রভৃতি স্থানে পরপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিয়েছিল। অন্যদিকে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী এই দাঙ্গার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে স্থানীয় হিন্দু জমিদার ও ইজারাদারদের বয়কটের নামে দরিদ্র মুসলমানদের উপর অত্যাচারকে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এই দাঙ্গার নেপথ্যে গ্রামবাংলার সম্পত্তি ও কৃষকদের সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না। কেন-না ময়মনসিংহে প্রতিবাদী জনতার আক্রমণের লক্ষ্য ছিল হিন্দু জমিদার ও মহাজনরা। পূর্ববঙ্গের জমিদাররা অধিকাংশ হিন্দু এবং কৃষকরা বেশিরভাগই মুসলমান হওয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রকট হয়ে উঠেছিল। বোধহয় এইসব কারণেই কংগ্রেসের নেতৃত্বে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বড়ো কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়নি। ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে জনবিচ্ছিন্নতা থেকেই ব্যক্তিহত্যার রাজনীতির সূচনা হয়।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে কৃষকশ্রেণির মূল্যায়ন –

অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে, স্বদেশি আন্দোলনের নেতারা খাজনা বন্ধের মতো কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেননি। কারণ – এই আন্দোলনের নেতারা জমিদারদের অর্থের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। অমলেশ ত্রিপাঠীও এই মত স্বীকার করেছেন। 1907 খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় কৃষকদের ক্ষোভ সংক্রান্ত এক দীর্ঘ চিঠি প্রকাশিত হলেও আন্দোলনের নেতাদের তা প্রভাবিত করেনি। তাই কৃষকেরা স্বাভাবিকভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে গ্রামীণ ও শহুরে সমাজের ব্যবধান এবং হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের কারণ সম্পর্কে কী মত প্রকাশ করেন? ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে “শনি ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না”—এই মন্তব্যের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করুন

1907-1908 খ্রিস্টাব্দে ‘স্বদেশী সমাজ’ শীর্ষক প্রবন্ধগুলিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রামীণ সমাজ ও শহুরে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ব্যবধানের কথা বলেছিলেন। 1908 খ্রিস্টাব্দে পাবনায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনের ভাষণে তিনি হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের কারণ অনুসন্ধান করে একে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর ‘divide and rule policy’-র কারণপ্রসূত বলে বলেননি। বরং ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে তিনি মন্তব্য করেন – ‘শনি ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না।’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (1914-1918 খ্রিস্টাব্দ) পরবর্তীকালে ভারতে কৃষক আন্দোলনগুলির পরিচয় দাও।

অথবা, ভারতের কৃষক আন্দোলনগুলির পর্যালোচনা করো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভূমিকা –

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারায় অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি নিজেদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে পৃথকভাবে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলনেও শামিল হয়েছিল অসংখ্য কৃষক। এইসব কৃষক আন্দোলনগুলি কৃষকদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি জাতীয় আন্দোলনকেও শক্তিশালী করেছিল।

ভারতের বিভিন্ন স্থানের কৃষক আন্দোলনের পরিচয় –

বাংলা –

1920-1921 খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলার মেদিনীপুরের তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে কৃষকরা ইউনিয়ন বোর্ড বয়কট করে। এ ছাড়াও তারা চৌকিদারি কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পাবনা, বগুড়া, বীরভূমে জমি জরিপ করে খাজনা নির্ধারণের কাজে স্থানীয় কৃষকরা বাধা দেয়। কুমিল্লা, রাজশাহি, রংপুর, দিনাজপুরে কৃষকরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (1914-1918 খ্রিস্টাব্দ) পরবর্তীকালে ভারতে কৃষক আন্দোলনগুলির পরিচয় দাও।

1930 খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে বাঁকুড়া জেলায় খাজনা বন্ধের আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। বাংলার কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল বেঙ্গল ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি এবং ফজলুল হক ও আক্রম খাঁ -এর উদ্যোগে গঠিত কৃষক প্রজা পার্টি।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বাংলার মেদিনীপুরের কৃষকরা জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে। 1942 খ্রিস্টাব্দের 17 ডিসেম্বর তমলুকে আন্দোলনকারীরা একটি সমান্তরাল সরকার গড়ে তোলে। এর নাম হয় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার।

বিহার –

বিহারেও একের পর এক কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। স্বামী বিদ্যানন্দের নেতৃত্বে দ্বারভাঙা, মুজফ্ফরপুর, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া, মুঙ্গেরের কৃষকরা কর দেওয়া বন্ধ করে। বিহার কিষান সভা ও সারা ভারত কিষান সভার প্রতিষ্ঠাতা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী বিহারে বেশ কিছু কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে 1938-1939 খ্রিস্টাব্দে বখস্ত ভূমি আন্দোলন’ তীব্রতর হয়। আগস্ট আন্দোলনের সময় মধুবনি অঞ্চলে প্রায় 5000 জনতা সশস্ত্র অবস্থায় থানা আক্রমণ করে। এদের মধ্যে সিংহভাগই ছিল কৃষক।

যুক্তপ্রদেশ –

যুক্তপ্রদেশে বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে প্রতাপগড়, রায়বেরিলি, সুলতানপুর ও ফৈজাবাদের কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে (1920 খ্রিস্টাব্দ)। এই কৃষকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে জওহরলাল নেহরু গঠন করেন যুক্তপ্রদেশ কিষান সভা।

একা আন্দোলন –

1921 খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে যুক্তপ্রদেশের সীতাপুর, বরাইচ, হরদই, বারাবাঁকি প্রভৃতি জেলায় কৃষক আন্দোলনের সূচনা হয়। যুক্তপ্রদেশে ছিল তালুকদারদের প্রাধান্য। তারা যেমন খুশি খাজনা আদায় করত। জমি থেকে চাষিদের যখন খুশি উচ্ছেদ করত। এর প্রতিবাদেই কংগ্রেস ও কিষানসভার কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলন করে। এই ঐক্য বা একতা থেকেই আন্দোলনটি একা আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। খিলাফতি নেতারাও এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। শুরুতে অবশ্য কংগ্রেসি ও খিলাফতি নেতারাই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ক্রমশ আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ গ্রহণ করলে তারা আন্দোলন থেকে সরে আসেন। অতঃপর এই আন্দোলনে মাদারি পাসির নেতৃত্বে কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নেয়। কিন্তু হিংসাত্মক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশি অত্যাচারে এই আন্দোলন ভেঙে যায়। ঐতিহাসিক হবসবম এই আন্দোলনের হিংসাত্মক রূপকে সামাজিক দস্যুতা (Social banditry) বলে চিহ্নিত করেছেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (1914-1918 খ্রিস্টাব্দ) পরবর্তীকালে ভারতে কৃষক আন্দোলনগুলির পরিচয় দাও।

মালাবার – মোপালা বিদ্রোহ –

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন মালাবার অঞ্চলে যে কৃষক বিদ্রোহ ঘটে, তার নাম মোপালা বিদ্রোহ। অস্পষ্ট প্রজাস্বত্ব আইন এবং জমিদারদের তীব্র শোষণের বিরুদ্ধে মোপালারা কৃষক বিদ্রোহ গড়ে তোলে। মালাবারের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক কৃষক সংগঠন গড়ে ওঠে। এই সংগঠনগুলির নেতৃত্বে মোপালা কৃষক বিদ্রোহ সুসংহত ও তীব্র রূপ ধারণ করে। 1921 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে মোপালা নেতা ইয়াকুব হাসান গ্রেফতার হলে মোপালাদের মধ্যে যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় তার ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে। তারা সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে, এমনকি পুলিশচৌকি আক্রমণ করে। সরকারি রিপোর্ট অনুসারে প্রায় 10 হাজার মোপালা গেরিলা যুদ্ধের কৌশলে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়। শেষের দিকে এই বিদ্রোহ সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়। শেষপর্যন্ত সামরিক আইন জারি করে সরকার এই আন্দোলনের অবসান ঘটায়।

অন্ধ্রপ্রদেশ – রাম্পা বিদ্রোহ –

অসহযোগ আন্দোলনের সময় অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষ্ণা, গুন্টুর ও গোদাবরী জেলার কৃষক ও আদিবাসীরা আন্দোলন করেছিল। অন্ধ্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃষক বিদ্রোহ হল উত্তর গোদাবরী অঞ্চলে আল্লুরি সীতারাম রাজু পরিচালিত রাম্পা বিদ্রোহ (1922-1924 খ্রিস্টাব্দ)। এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী কৃষকরা গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ শুরু করে। মহাজনদের শোষণ ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা সরব হয়। অরণ্য আইনের মাধ্যমে সরকার তাদের অরণ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে এবং রাস্তা তৈরির কাজে বেগার খাটালে এই বিদ্রোহ ঘটে। 1924 খ্রিস্টাব্দের 6 মে আল্লুরি সীতারাম রাজু ধরা পড়লে রাম্পা বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।

গুজরাট – বারদৌলি কৃষক সত্যাগ্রহ –

1928 খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুরাট জেলার অন্তর্গত বারদৌলির কৃষকরা জমিদারের অনাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে, যা বারদৌলি সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত। এই কৃষক সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। বারদৌলিতে সরকার শতকরা 30 ভাগ রাজস্ব বৃদ্ধির নির্দেশ দিলে সর্দার প্যাটেল হিন্দু কৃষকদের গীতা ও মুসলিম কৃষকদের কোরান ছুঁইয়ে খাজনা না দেওয়ার শপথ গ্রহণ করান। আন্দোলনের তীব্রতায় শেষপর্যন্ত সরকার তদন্ত কমিশন নিয়োগ করে কৃষকদের সঙ্গে মীমাংসায় বসতে বাধ্য হয় এবং বারদৌলি কৃষক আন্দোলন সাফল্য পায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল্যায়ন –

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন অংশে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলনগুলিকে সুসংহত রূপ দেওয়া ও ঐক্যবদ্ধ করে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় একাধিক কিষানসভা। এই লক্ষ্যে কংগ্রেসের সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্টরা মিলে প্রতিষ্ঠা করে সারা ভারত কিষান কংগ্রেস (1936 খ্রিস্টাব্দ); পরে যার নাম হয় সারা ভারত কিষানসভা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মূলত কৃষক আন্দোলনের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে কংগ্রেস ও বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দ।

অসহযোগ আন্দোলনকালে কোন্ কোন্ অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে? একা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?

অসহযোগ আন্দোলনের ভূমিকা –

ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে সামাজিক শ্রেণি হিসেবে হিন্দু ও মুসলিম কৃষকদের যোগদান আন্দোলনকে একটি বিশেষ মাত্রা দান করে।

অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি –

অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব পাস হয় কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে (ডিসেম্বর, 1920 খ্রিস্টাব্দ)। এই আন্দোলনের দু-ধরনের কর্মসূচি ছিল – ইতিবাচক এবং নেতিবাচক। ইতিবাচক কর্মসূচির মধ্যে ছিল – দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, শিল্পের প্রসার, সালিশি বোর্ড গঠন, চরকা ও খাদির ব্যবহার, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা, মাদক ব্যবহার ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, স্বরাজ তহবিল গঠন (1 কোটি টাকার) প্রভৃতি। আর নেতিবাচক কর্মসূচি ছিল – সরকারি চাকরি, অনুষ্ঠান, সরকারি স্কুল-কলেজ, আদালত, আইনসভা ত্যাগ ও বিদেশি পণ্য বর্জন প্রভৃতি।

কৃষক আন্দোলনের প্রসার –

অসহযোগ আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসার লাভ করে। সেই সকল অঞ্চলের কৃষকেরা এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করে।

গুজরাট –

গান্ধিজির আঞ্চলিক আন্দোলনে সত্যাগ্রহ আদর্শের পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্র ছিল গুজরাটের খেদা জেলা। সত্যাগ্রহ আদর্শ তিনি পুনরায় বারদৌলিতে প্রয়োগ করেন। সেখানে সতর্কভাবে খাজনা বন্ধের ডাক দেওয়া হয়। এখানকার পাতিদার শ্রেণির কৃষক কালিপরাজ ও উজালিপরাজদের সংগঠিত করা হয়। কুনবি-পাতিদাররাই ছিল জমির স্বত্বাধিকারী রায়তদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। এখানে প্রতি 30 বছর অন্তর খাজনার পরিমাণ বাড়ানো হত। 1927 খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই সরকার 22% খাজনা বৃদ্ধির ঘোষণা করলে গুজরাটের কংগ্রেস নেতা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল -এর নেতৃত্বে 1928 খ্রিস্টাব্দে খাজনা বন্ধ আন্দোলন শুরু হয়। সরকার আন্দোলনরত চাষিদের গোরুবাছুর, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে থাকে। শুরু হয় পুলিশি নির্যাতন, কিন্তু আন্দোলন থামানো যায়নি। শেষপর্যন্ত 1929 খ্রিস্টাব্দের 16 জুলাই সরকার খাজনা বৃদ্ধি স্থগিত রাখার ঘোষণা করে।

যুক্তপ্রদেশ –

এখানে মদনমোহন মালব্যের নেতৃত্বে যুক্তপ্রদেশ কিষানসভা গড়ে ওঠে 1918 খ্রিস্টাব্দে। তাদের দাবিগুলি কংগ্রেসের কর্মসূচিতে স্থান পেয়েছিল। ফলে প্রতাপগড়, ফৈজাবাদ, রায়বেরিলি ও সুলতানপুর জেলার কৃষকেরা তালুকদারদের শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়। বাবা রামচন্দ্র কৃষকদের সংগঠিত করেন এবং 1920 খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যা কিষানসভা গড়ে তোলেন। 1921 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে এই আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ নেয়। তাই গান্ধিজি এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকেন। শেষপর্যন্ত সরকার বাবা রামচন্দ্রকে গ্রেফতার করে।

অসহযোগ আন্দোলনকালে কোন্ কোন্ অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে? একা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?

বিহার –

বিহারের দ্বারভাঙা, মুজফ্ফরপুর, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে প্রবল কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। চড়া ভূমিরাজস্ব, অতিরিক্ত কর এবং মূল্যবৃদ্ধির জন্য কৃষকেরা অসন্তুষ্ট ছিল। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববরণ প্রসাদ কৃষকদের সংগঠিত করেন। তিনি স্বামী বিদ্যানন্দ নামগ্রহণ করেন। তাঁর আন্দোলনের চাপে জমিদাররা নত হয়।

রাজস্থান –

অসহযোগ আন্দোলনের সময় রাজস্থানের কৃষকরাও বিদ্রোহে যোগদান করে। বিজয় সিং পথিক এবং মানিকলাল ভার্মা রাজস্থানে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা করেন। মোতিলাল তেজওয়াত উদয়পুরের ভিল উপজাতিদের সংগঠিত করেন। জয়নারায়ণ ব্যাস মাড়ওয়ার অঞ্চলে খাজনা বন্ধের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

অন্যান্য অঞ্চল –

ইয়াকুব হাসানের নেতৃত্বে মালাবারের মোপালা কৃষকেরা, আল্লুরি সীতারাম রাজুর নেতৃত্বে গোদাবরী অঞ্চলের রাম্পা বিদ্রোহীরা, বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে মেদিনীপুরের কৃষকেরা এই আন্দোলনে যোগ দেয়। এ ছাড়া গুন্টুর, কুদাপ্পা ইত্যাদি অঞ্চলেও কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

একা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য –

অসহযোগ আন্দোলনের সময় যুক্তপ্রদেশে ‘একা’ বা ‘একতা আন্দোলন’ শুরু হয়। এর বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল –

  • কৃষক ঐক্য প্রতিষ্ঠা – এই আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। কয়েকটি শপথপাঠের মাধ্যমে এই ঐক্য দৃঢ় করা হয়।
  • জঙ্গি আন্দোলন – এই আন্দোলন ছিল জঙ্গি প্রকৃতির। জমিদার ইংরেজদের এরা চরম শত্রু বলে মনে করত। এই আন্দোলনে কৃষকদের কাছে তাদের হত্যা করার আহ্বান জানানো হয়।
  • কৃষককেন্দ্রিক – এই আন্দোলন ছিল কৃষককেন্দ্রিক। কৃষক ছাড়া অন্যান্য সামাজিক শ্রেণির কথা এখানে ভাবা হয়নি।
  • নিম্নবর্গের আন্দোলন – এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন মাদারি পাসি। তিনি নিম্নবর্গের মানুষ ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনে নিম্নবর্গের মানুষেরাই যোগ দিয়েছিল।

মূল্যায়ন –

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, বিক্ষিপ্ত হলেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কৃষক সম্প্রদায় এই আন্দোলনে যোগদান করে। এক্ষেত্রে যতটা ব্রিটিশবিরোধী তার চেয়েও বেশি স্থানীয় জমিদারবিরোধী মনোভাব কৃষকদের মধ্যে লক্ষ করা যায়।

কৃষক আন্দোলনে বাবা রামচন্দ্রের অবদান আলোচনা করো।

অথবা, বাবা রামচন্দ্র কীভাবে কিষান আন্দোলনকে সংগঠিত করেছিলেন তা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

কৃষক আন্দোলনের ভূমিকা –

1920-র দশকের গোড়ায় মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে যে অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, কৃষকদেরও তা স্পর্শ করেছিল। গান্ধিজির আশা ছিল গ্রাম পুনর্গঠন ও গ্রামোন্নয়ন এবং চরকা ও খাদি আন্দোলনের মাধ্যমে গ্রামবাসীরা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করুক। তিনি বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উপর। যুক্তপ্রদেশের প্রতাপগড়, রায়বেরিলি, সুলতানপুর, ফৈজাবাদে কৃষকরা শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছিল ঝিঙ্গুড়ি সিং এবং দুর্গাপাল সিং নামের স্থানীয় দুই কৃষক নেতার নেতৃত্বে। তবে বাবা রামচন্দ্র নামের একজন সন্ন্যাসী যুক্তপ্রদেশের কৃষক আন্দোলনে (1920-1921 খ্রিস্টাব্দ) নতুন এক গতির সঞ্চার করেন।

বাবা রামচন্দ্রের পরিচিতি –

মহারাষ্ট্রনিবাসী ব্রাহ্মণ বাবা রামচন্দ্র 13 বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন এবং ফিজি দ্বীপে শ্রমিকের জীবনযাপন করার পর 1909 খ্রিস্টাব্দে যুক্তপ্রদেশের ফৈজাবাদে ফিরে আসেন। তাঁর কাজ ছিল গ্রামে গ্রামে ঘুরে রামায়ণ গান পরিবেশন করা। 1920 খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে তিনি জৌনপুর ও প্রতাপগড় থেকে কয়েকজন কৃষককে সঙ্গে নিয়ে এলাহাবাদে গৌরীশঙ্কর মিশ্র ও জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড –

ধর্মীয় আবেদনের সঙ্গে সঙ্গে বাবা রামচন্দ্র জাতপাতের জিগির তোলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ‘কুর্মী ক্ষত্রিয় সভা’ গঠন করেন। তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জোরজবরদস্তিমূলক কর আদায় বন্ধ করা বা করের পরিমাণ হ্রাস, বেগার প্রথার অবসান, বেদখলি জমি চাষ করতে অস্বীকার, অত্যাচারী ভূস্বামীদের সামাজিকভাবে বয়কট করা ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই তালুকদাররা এই কৃষক আন্দোলনকে ভালো নজরে দেখেনি।

বাবা রামচন্দ্রের কৃষক আন্দোলন ও কংগ্রেস –

1921 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে এবং হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। বিদ্রোহী কৃষকরা তালুকদারদের বাড়ি, ফসলের গোলা, হাটবাজার লুঠ করতে থাকে। গান্ধিজি বিদ্রোহী কৃষকদের এই কাজকে সমর্থন করেননি। সরকার বাবা রামচন্দ্রকে গ্রেফতার করলে কংগ্রেসি নেতারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

মিথ্যা মামলায় বাবা রামচন্দ্র –

বাবা রামচন্দ্রকে চুরির দায়ে গ্রেফতার করা হলে প্রতাপগড় জেলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য চার-পাঁচ হাজার কৃষক জমায়েত হয়। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। এই সময় একটা গুজব রটে যায় যে, বাবা রামচন্দ্রের মুক্তির জন্য স্বয়ং গান্ধিজি আসছেন। এর ফলে কৃষকদের মধ্যে চরম উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা দেয়। প্রায় 60,000 কৃষকের জমায়েত হয়। এই পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয় এবং বাবা রামচন্দ্র মুক্তিলাভ করেন। এই সময় কংগ্রেসে অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে যুক্তপ্রদেশ কিষানসভা ভেঙে যায় এবং 1920 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রতাপগড়ে অযোধ্যা কিষানসভা নামে অপর একটি কিষানসভা গড়ে ওঠে। জওহরলাল নেহরু, বাবা রামচন্দ্র মিশ্র, দেওনারায়ণ পাণ্ডে, কেদারনাথ প্রমুখ নেতা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের তৎপরতায় 300টি কিষানসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে অযোধ্যা কিষানসভা অযোধ্যায় যে বিশাল সমাবেশ আহ্বান করেছিল তাতে প্রায় 1 লক্ষ কৃষক যোগ দেয়। কিষানসভা আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এই প্রতিষ্ঠানে উঁচু ও নীচু – উভয় জাতের কৃষকেরই ঠাঁই হয়েছিল।

মূল্যায়ন –

যুক্তপ্রদেশের কিষানসভা আন্দোলন কিন্তু শেষপর্যন্ত শান্তিপূর্ণ থাকেনি। বস্তুত এইসব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল স্থানীয় এলাকার সাধু, সন্ন্যাসী এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত বিক্ষুব্ধ কিছু মানুষ। সরকারকে অবশ্য এই আন্দোলন দমন করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। ব্যাপক ধরপাকড় করে ও লাঠি-গুলি চালিয়ে এই আন্দোলন ধ্বংস করা হয়। সরকার সংশোধিত অযোধ্যা আইন তৈরি করে প্রজাদের ক্ষোভের কিছুটা উপশম করার চেষ্টা করেছিল। তাতে প্রজারা খুব বেশি উপকৃত না হলেও তাদের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছিল।

যুক্তপ্রদেশ ও গুজরাটে আইন অমান্য আন্দোলনকালে কৃষক বিদ্রোহ কী ধরনের হয়ে উঠেছিল? বারদৌলি সত্যাগ্রহের তাৎপর্য আলোচনা করো।

ভূমিকা –

অসহযোগ আন্দোলনের পর আইন অমান্য আন্দোলন ছিল গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত দ্বিতীয় সর্বভারতীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন। গান্ধিজির আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিল সাধারণ মানুষ, বিশেষত কৃষক ও হরিজন শ্রেণি। তাই এই আন্দোলনেও কৃষকশ্রেণি গান্ধিজির আহ্বানে সাড়া দেয়।

কর্মসূচি –

1930 খ্রিস্টাব্দের 16 ফেব্রুয়ারি কংগ্রেসের সবরমতী অধিবেশনে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রস্তাব পাস হয়। এই আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল – লবণ কর অমান্য, খাজনাসহ অন্যান্য কর বর্জন, সরকারি আইন অমান্য, অফিস-আদালত বর্জন, স্কুল-কলেজ বর্জন প্রভৃতি।

আন্দোলনের প্রসার –

1929 খ্রিস্টাব্দে ‘পূর্ণ স্বরাজ প্রস্তাব’ পাস, 26 জানুয়ারি প্রতীকী স্বাধীনতা দিবস পালন এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য লবণের মতো বিষয়কে কেন্দ্র করে আন্দোলনের আহ্বান, সর্বোপরি গান্ধিজির নেতৃত্ব আন্দোলনের প্রসার ঘটায়। কৃষকশ্রেণি বিভিন্ন অসুবিধা সত্ত্বেও এই আন্দোলনে যোগ দেয়।

যুক্তপ্রদেশ –

কৃষকদের সমর্থনে যুক্তপ্রদেশের আইন অমান্য আন্দোলন গণ আন্দোলনে পরিণত হয়। কালকাপ্রসাদ নামে এক ব্যক্তি রায়বেরিলি, বারাবাঁকি, এলাহাবাদ জেলায় কৃষকদের সংগঠিত করেন। তাদের নিয়ে তিনি জমিদারবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। জমিদার ও কৃষক উভয় শ্রেণিকেই খাজনা না দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। জমিদাররা সরকারের অনুগত ছিল। তাই আন্দোলনটি জমিদারবিরোধীও হয়ে ওঠে। ফলে আন্দোলন থামাতে সরকার দমননীতির আশ্রয় নেয়।

এই অবস্থায় জওহরলাল নেহরু কৃষকদের খাজনা বন্ধের বিষয়টি কংগ্রেস কমিটিতে পাস করিয়ে নেন। এরপর কৃষক আন্দোলন আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে।

গুজরাট –

গান্ধিজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সার্থক প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয় গুজরাটের বারদৌলি তালুকে। এই আন্দোলনের সময় খেদা জেলা এবং ব্রোচ জেলায় খাজনা বন্ধের আন্দোলন বেশ প্রবল হয়ে ওঠে। পুলিশি অত্যাচার প্রবল হয়ে উঠলে সেখানকার কৃষকেরা তাদের গৃহপালিত গোরু, মোষ, অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে প্রতিবেশী দেশীয় রাজ্য বরোদায় চলে যায়। এখানে তারা খোলা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে শুরু করে। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তাদের উৎসাহ দিতে থাকেন। শেষে 1931 খ্রিস্টাব্দে শান্তি ফিরে আসে। সত্যাগ্রহীরা আবার নিজ নিজ জায়গায় ফিরে যায়।

অন্যান্য অঞ্চল –

দ্বারকাপ্রসাদ মিশ্র ও গোবিন্দ দাস বণিকের নেতৃত্বে মধ্যপ্রদেশে, স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে বিহারে, এন জি রঙ্গের নেতৃত্বে অন্ধ্রে, কৃষক সংঘের পরিচালনায় উড়িষ্যায় কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ‘

বারদৌলি সত্যাগ্রহের তাৎপর্য –

বারদৌলি সত্যাগ্রহের পটভূমি –

গুজরাটের সুরাট জেলার একটি তালুক হল বারদৌলি। এখানে পাতিদার কৃষকরা সংখ্যায় বেশি ছিল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এদের সংগঠিত করে সত্যাগ্রহ আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন।

যুক্তপ্রদেশ ও গুজরাটে আইন অমান্য আন্দোলনকালে কৃষক বিদ্রোহ কী ধরনের হয়ে উঠেছিল? বারদৌলি সত্যাগ্রহের তাৎপর্য আলোচনা করো।

বারদৌলি সত্যাগ্রহের কারণ –

1927 খ্রিস্টাব্দে সরকার এখানে প্রথমে 30 শতাংশ ও পরে 22 শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি করে। কংগ্রেস এর প্রতিবাদ জানায়। এসময় তুলোর দাম কমে গিয়েছিল। দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে বারদৌলি সত্যাগ্রহ শুরু হয়।

বারদৌলি সত্যাগ্রহের ফল –

বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হলে সরকার আন্দোলনরত চাষিদের গোরুবাছুর ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। সমানে চলতে থাকে পুলিশি নির্যাতন। বোম্বাই -এর কাপড়ের কারখানাগুলিতে সেসময় ধর্মঘট চলছিল। এতে সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং রাজস্ব বৃদ্ধি স্থগিত রাখে।

বারদৌলি সত্যাগ্রহের তাৎপর্য –

  • বারদৌলি সত্যাগ্রহ একটি আঞ্চলিক ঘটনা হলেও ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’, ‘নবজীবন’ ও অন্যান্য পত্রিকার মাধ্যমে এর খবর প্রকাশিত হতে থাকে। ফলে এই সত্যাগ্রহ আন্দোলনটি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রচার লাভ করে। দেশবাসী এই আন্দোলনের ফলাফল ও গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখে।
  • সরকার রাজস্ব হার কমালে আন্দোলন সফল হয়। এই ঘটনা সারা ভারতের কৃষক আন্দোলনের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
  • বারদৌলি সত্যাগ্রহ অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা ভুলতে দেশবাসীকে সাহায্য করে।
  • বারদৌলি সত্যাগ্রহ ছিল অহিংস এবং তা ব্যাপক গণসমর্থন পেয়েছিল। গান্ধিজির সত্যাগ্রহ আদর্শের সফল প্রয়োগ হওয়ায় গান্ধিজি অবিসংবাদী সর্বভারতীয় নেতায় পরিণত হন।
  • কৃষকদের মধ্যে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনকালে বিহার ও বাংলা-সহ অন্যান্য আন্দোলনের বিস্তার কেমন ছিল?

ভূমিকা –

গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত সর্বভারতীয় গণ আন্দোলনগুলির মধ্যে শেষ আন্দোলন ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন (1942 খ্রিস্টাব্দ)। বিগত আন্দোলনগুলির মতো এই আন্দোলনেও সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করে। এদের মধ্যে কৃষকশ্রেণির মানুষ ছিলেন সংখ্যায় বিপুল।

পরিস্থিতি –

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অগ্রগতি, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সংকট, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, অজন্মা, খাদ্যসংকট, ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা ভারতে এক হতাশাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এই অবস্থায় কংগ্রেসের ওয়ার্ধা অধিবেশনে (14 জুলাই) ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং বোম্বাই অধিবেশনে (7-8 আগস্ট) তা অনুমোদিত হয়। ওইদিন রাতে সরকার কংগ্রেস নেতাদের গ্রেফতার করলে পরদিন (9 আগস্ট) থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়। ডঃ সুমিত সরকার লিখেছেন, “ঝড়ের চারটি মূল কেন্দ্র ছিল – বিহার, পূর্ব যুক্তপ্রদেশ, মেদিনীপুর ও উড়িষ্যা এবং মহারাষ্ট্র কর্ণাটক।”

আন্দোলনের বিস্তার –

স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে এই আন্দোলন ছিল শহরকেন্দ্রিক; পরে তা গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে সব স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে কৃষকদের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সময়ের কৃষক আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল বিহার ও বাংলা।

বিহার –

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যাপকতা দেখা যায় বিহারে। 1930 -এর দশক থেকেই বিহারে সহজানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত কিষানসভার প্রভাব নানাভাবে বাড়তে থাকে। কিষানসভার অধিকাংশ সদস্য ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেয়। এই আন্দোলন দমন করার ক্ষেত্রে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ইংরেজদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আন্দোলনকারীদের প্রভাবে পাটনা শহরে আকাশপথ ছাড়া যোগাযোগের কোনো উপায় ছিল না। এই আন্দোলন যুক্তপ্রদেশ ও পশ্চিম বিহার সন্নিহিত অঞ্চলের আজমগড়, সারন, বালিয়া প্রভৃতি জেলায় শুরু হলেও পূর্ব বিহারের হাজারিবাগ জেলায় প্রবল আকার ধারণ করে। সমসাময়িক সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিহারের জঙ্গি জনতার অধিকাংশই ছিল কৃষক। এই কৃষক অভ্যুত্থান দ্রুত পশ্চিম বিহারে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর বেনারসে তা তীব্র হয়ে ওঠে। বালিয়া জেলার 10টি থানাই জনতার দখলে চলে যায়। মধুবনি অঞ্চলের প্রায় 5000 সশস্ত্র জনতা স্থানীয় থানা আক্রমণ করে। সারন জেলায় জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষকেরা অভ্যুত্থান ঘটায়। সরকারি দমননীতির সাহায্যে অতি কষ্টে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও মাঝে মাঝে কৃষকদের সশস্ত্র আক্রমণ চলতে থাকে।

বাংলা –

1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছিল। এক্ষেত্রে অগ্রণী ছিল বাংলাদেশের মেদিনীপুর জেলা। 1942 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় উপকূল অঞ্চলকে বিধ্বস্ত করে দেয়। ব্যাপক শস্যহানির ফলে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সময় ব্রিটিশ সরকারের ‘ডিনায়েল নীতি’ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। সরকার এই অঞ্চল থেকে চাল সংগ্রহ করতে শুরু করে এবং যুদ্ধের জন্য মজুত করে অথবা ব্রিটেনে তা রপ্তানি করে। ফলে এখানকার মানুষের খাদ্যাভাব প্রবল হয়ে ওঠে।

তমলুক শহরে এর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়। 29 সেপ্টেম্বর পরিকল্পিতভাবে তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা এবং নন্দীগ্রামের কৃষকেরা রাস্তা কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারপর একে একে স্থানীয় থানাগুলির উপর আক্রমণ চালায়। পিছাবনি এলাকায় পুলিশের গুলির সামনেও কৃষকেরা অটল থাকে। মাতঙ্গিনী হাজরা পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন। কৃষকেরা জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে।

1942 খ্রিস্টাব্দের 17 ডিসেম্বর তমলুকের আন্দোলনকারীরা (অধিকাংশই কৃষক) একটি সমান্তরাল সরকার গড়ে তোলে। এর নাম হয় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সুশীল ধাড়া, সতীশ সামন্ত, কুমুদিনী ডাকুয়া এই সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেন। 1944 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই জাতীয় সরকারের অস্তিত্ব ছিল। সরকার প্রচণ্ড দমননীতির সাহায্যে এই গণ অভ্যুত্থানের অবসান ঘটায়। কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন না থাকলেও কমিউনিস্ট দলের শাখা সংগঠন কৃষকসভার বহু সদস্য মেদিনীপুরের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

এ ছাড়াও বাংলার বর্ধমান, হুগলি ও অন্যান্য জেলাতেও বিক্ষিপ্তভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলন হয়। সেখানে কৃষকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনকালে বিহার ও বাংলা-সহ অন্যান্য আন্দোলনের বিস্তার কেমন ছিল?

অন্যান্য রাজ্য –

মহারাষ্ট্রের সাতারা অঞ্চলে কৃষক-শ্রমিকেরা ‘সাতারা প্রতি সরকার’ গঠন করে (ফেব্রুয়ারি, 1943 খ্রিস্টাব্দ)। উড়িষ্যার | তালচের অঞ্চলে কৃষক অভ্যুত্থান ঘটে। সেখানেও সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বালেশ্বর অঞ্চলের কৃষকেরা ‘স্বরাজ পঞ্চায়েত’ গড়ে তোলে। বাসুদেবপুর, কটক, কোরাপুট অঞ্চলে খাজনা বন্ধের আন্দোলন হয়।

মূল্যায়ন –

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষকশ্রেণি বিপুল সংখ্যায় যোগ দিয়েছিল। যেহেতু এই আন্দোলনটি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল এবং জাতীয় পর্যায়ের কোনো নেতৃত্ব ছিল না; সেহেতু স্থানীয় নেতৃত্বের ভূমিকাই প্রধান হয়ে ওঠে। কৃষকশ্রেণি সব জায়গায় অহিংস ছিল না। বিভিন্ন জায়গায় তারা সশস্ত্র হয়ে থানা আক্রমণ করে। কৃষকেরা শুধুমাত্র জমিদারবিরোধী ছিল না, তারা ব্রিটিশদেরও বিরোধিতা করে। যে-সমস্ত জমিদার ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য দেখায় কেবল সেইসব জমিদাররা কৃষকদের আক্রমণের শিকার হয়। এভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষকশ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভারতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করো।

শ্রমিক আন্দোলনের ভূমিকা –

প্রাচীনকাল থেকে ভারতে শ্রমিকশ্রেণির অস্তিত্ব থাকলেও ব্রিটিশ আমলে আধুনিক শিল্প প্রতিষ্ঠা বা ফিনান্স পুঁজির বিকাশ হলে শ্রমিকশ্রেণির উদ্ভব ঘটে। মজুরি বৃদ্ধি, কাজের সময়সীমা হ্রাস ইত্যাদি দাবির কারণে তারা প্রথমে ধর্মঘট শুরু করে এবং পরে আঞ্চলিক ও সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলে। পৃথক শ্রেণি হিসেবে শ্রমিকেরা আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকে।

আধুনিক শিল্প ও শ্রমিকশ্রেণি –

ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার বাতিল হলে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা এদেশে ‘ফিনান্স পুঁজি’ বিনিয়োগ করে। নীল, চা, কফি প্রভৃতি বাগিচা শিল্পের পাশাপাশি পাট, সুতো, বস্ত্রশিল্প ও লৌহ-ইস্পাত শিল্প গড়ে তোলে। এসময় খনিশিল্পের বিকাশ ঘটে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় রেলপথ। ফলে এক আধুনিক শিল্পব্যবস্থা এবং তার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকশ্রেণির উত্থান ঘটে।

শ্রমিকশ্রেণির দুরবস্থা –

এই শ্রমিকদের বেতন খুব কম ছিল। তাদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হত। তাদের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কাজের সময় ছিল গড়ে 12 ঘণ্টা। নারী ও শিশুশ্রমিকদের মজুরি খুব কম ছিল। তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা ছিল না।

কারখানা আইন –

সরকার শ্রমিককল্যাণের জন্য কয়েকটি কারখানা আইন পাস করে। যেমন – 14 বছরের কমবয়স্ক শ্রমিকদের নিয়োগ না করা, নারী ও শিশুশ্রমিকদের কাজের সময় হ্রাস করা, কারখানার বিপজ্জনক যন্ত্রপাতি নিরাপদে রাখা, কারখানা পরিদর্শক নিয়োগ করা প্রভৃতি। তবে এই সকল বিধান থাকলেও শ্রমিকেরা তার কোনো সুফল পায়নি। রাজনৈতিক নেতারা ইউরোপীয় মালিকানাধীন শিল্পের শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও দেশীয় শিল্পের শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন।

বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের উদ্ভব –

ক্রমে শ্রমিকেরা সংগঠিত হতে থাকে। 1899 খ্রিস্টাব্দে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ের (GIPR) সিগন্যাল কর্মীরা ধর্মঘট করে। বিচ্ছিন্নভাবে আরও ধর্মঘট হয়। কিছু মানবতাবাদী নেতা (বি পি ওয়াদিয়া, দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ, বাতিস্তা) শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা করেন। এন এম যোশি ইংল্যান্ডের অনুকরণে ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সচেষ্ট হন। চিত্তরঞ্জন দাশ, লালা লাজপত রায়, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় আন্দোলনে শ্রমিকদের যুক্ত করতে সচেষ্ট হন। গান্ধিজিও স্বতন্ত্র ধারায় শ্রমিকদের সংগঠিত করতে মজদুর মহাজন সংঘ ও আহমেদাবাদ শ্রমিক সমিতি গড়ে তোলেন। এরপর লালা লাজপত রায় -এর সভাপতিত্বে 1920 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AII India Trade Union Congress) বা AITUC।

শ্রমিক আন্দোলন –

AITUC-র শাখা বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। BPTUC-র উদ্যোগে বাংলার পাটকলে 137টি এবং কয়লাখনিতে 196টি ধর্মঘট হয় (1921 খ্রিস্টাব্দ)। ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে ধর্মঘট হয় 1922 খ্রিস্টাব্দে। আহমেদাবাদের বস্ত্রশিল্পে এবং মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়নের নেতৃত্বে মাদ্রাজ বস্ত্রশিল্পেও ধর্মঘট হয়। বোম্বাই শিল্পাঞ্চলে গিরনি-কামগড় ইউনিয়নও ব্যাপক ধর্মঘটে শামিল হয় 1928 খ্রিস্টাব্দে।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা –

রুশ বিপ্লব, ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার হলে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। 1929 খ্রিস্টাব্দে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে 33 জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করলে শ্রমিক আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

ভারতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করো।

AITUC-র ভাঙন –

শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্টদের বর্ধিত প্রভাব শ্রমিক সংগঠন AITUC -তে প্রতিফলিত হয়। ফলে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে কমিউনিস্টদের মতভেদ ঘটে। পরিণামে AITUC ভেঙে রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (Red Trade Union Congress) গড়ে ওঠে (1932 খ্রিস্টাব্দে)। পরে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চেষ্টায় পুনরায় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

CSP প্রতিষ্ঠা –

1934 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি (CSP) প্রতিষ্ঠিত হলে শ্রমিক আন্দোলনে গতি আসে। বিশ্বমন্দার প্রভাব কমতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার এসময় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করলে শ্রমিক আন্দোলন আবার দুর্বল হয়ে পড়ে।

মূল্যায়ন –

এইভাবে পৃথক শ্রেণি হিসেবে শ্রমিকেরা নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয়। দাবি আদায়ের জন্য তারা ধর্মঘট করে। সরকার যদিও শ্রমিককল্যাণের জন্য কারখানা আইন, হুইটলি কমিশন গঠন করেছিল, তথাপি প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থাও (Trade Dispute Bill, Public Safety Bill) বজায় ছিল। ভারতের স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বিংশ শতকের ভারতে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

বিংশ শতকের ভারতে শ্রমিকরা বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এই সময় জাতীয় রাজনীতি শ্রমিক আন্দোলনগুলিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলন –

1905 খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন পরিচালিত হয়। এই আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

  • শ্রমিকরা স্বদেশি দ্রব্য উৎপাদনে তৎপর হয়ে ওঠে। অপরদিকে বয়কট আন্দোলনেও শামিল হয় তারা।
  • রাঁধুনিরা রান্নায় বিদেশি দ্রব্য ব্যবহার করতে অস্বীকার করে, মুচিরা বিদেশি জুতো সারাতে, ধোপারা বিদেশি কাপড় কাচতে অস্বীকার করে।
  • কলকাতা ও খিদিরপুরের বন্দর শ্রমিকরা, রেল শ্রমিকরা, ছাপাখানার কর্মীরা ধর্মঘটে শামিল হয়।
  • তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনের বস্ত্র শ্রমিকরা, বিহার ও রাওয়ালপিন্ডির রেল শ্রমিকরা ধর্মঘট করে।

অসহযোগ আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলন –

1920-1922 খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয়। এই আন্দোলনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

  • অসহযোগ আন্দোলনের সময় 1920-1921 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় 137টি শ্রমিক ধর্মঘট হয়। এতে প্রায় 1 লক্ষ 86 হাজার শ্রমিক অংশগ্রহণ করে। হাওড়ার জুটমিল শ্রমিকরা, রানিগঞ্জ, ঝরিয়ার কয়লাখনির শ্রমিকরা, কলকাতার বন্দর শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘট করে।
  • আসামের চা শ্রমিকরা, মাদ্রাজের বস্ত্র শ্রমিকরা এবং কর্ণাটকের বস্ত্র শ্রমিকরা ধর্মঘটে শামিল হয়।

আইন অমান্য আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলন –

1930-1934 খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মহাত্মা গান্ধি।

  • মহারাষ্ট্রের শোলাপুর ও বোম্বাই -এর শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। বোম্বাইয়ে 4 ফেব্রুয়ারি 20 হাজার শ্রমিক ধর্মঘটে শামিল হয়।
  • কলকাতার পরিবহণ শ্রমিক, হাওড়ার কুলি ও বালির পাটকল শ্রমিকরা ধর্মঘট করে।
  • মাদ্রাজ, বিহার ও করাচিতেও শ্রমিকরা ধর্মঘটে শামিল হয়।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলন –

1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল একটি স্বতঃস্ফূর্ত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকদের আন্দোলন থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক শ্রমিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে শামিল হয়।

  • বোম্বাই শহরে 9-14 আগস্ট ব্যাপক গণবিক্ষোভ ঘটে।।
  • গুজরাটের আহমেদাবাদের প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক ধর্মঘটে শামিল হয়।
  • বিহারের জামসেদপুর-সহ দিল্লি, লখনউ, কানপুর, নাগপুর, কলকাতার শ্রমিকরাও ধর্মঘট করে।

উপসংহার –

শ্রমিকশ্রেণির অংশগ্রহণের ফলে ভারতের জাতীয় আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছিল। শ্রমিকশ্রেণির উপর কমিউনিস্ট পার্টি বেশি প্রভাব বিস্তার করার ফলে সরকার কমিউনিস্টদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। তাই কমিউনিস্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ব্রিটিশ সরকার শ্রমিক আন্দোলনে রাশ টানতে চেয়েছিল।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করো।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী বা স্বদেশি আন্দোলন প্রধানত বাংলাদেশে হলেও সারা ভারতে তা ছড়িয়ে পড়ে। কংগ্রেসের সমর্থন থাকায় এই আন্দোলনে মধ্যবিত্তশ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করে। তার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্ব –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এই সময় পেশাদারি রাজনীতিকদের পাশাপাশি শিল্প ধর্মঘটের মাধ্যমে শ্রমিকদের সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী, অপূর্ব কুমার ঘোষ, অশ্বিনী কুমার ব্যানার্জি, প্রেমতোষ বসু, অম্বিকাচরণ ব্যানার্জি প্রমুখ শ্রমিক সংগঠনের কাজ করেন। তাঁরা সরকারি ছাপাখানা, রেল, পাটকলের শ্রমিকদের সংগঠিত করেন এবং ধর্মঘটে উৎসাহ দেন।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির উদ্দেশ্য –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণিও অংশ নেয়। তাদের উদ্দেশ্য কেবল আর্থিক দাবি সংক্রান্ত ছিল না, বরং তারা জাতীয় রাজনীতির অংশীদার ছিল। শ্রমিকদের বোঝানো হয়েছিল, জাতীয় আন্দোলনের সাফল্যের সঙ্গে তাদের ভাগ্যও জড়িত। উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদের অবসান না ঘটলে তাদেরও মুক্তি সম্ভবপর হবে না।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ধর্মঘট –

বাংলা –

1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকরের দিন সারা বাংলার কলকারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট পালিত হয়। হাওড়ার বার্ন কোম্পানির 12,500 শ্রমিক ধর্মঘট করে। তারা ‘বন্দেমাতরম’ গান গাইতে গাইতে পরস্পরের হাতে রাখি পরিয়ে দিলে কারখানার কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। শ্রমিকেরা সেই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ধর্মঘট চালিয়ে যায়।

বাংলার প্রধান শিল্প ছিল পাটশিল্প। এসময় 37টি পাটকলের মধ্যে 18টিতে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। হাওড়ার ফোর্ট গ্লস্টার পাটকলের ধর্মঘট বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এখানকার শ্রমিকেরাও রাখিবন্ধন পালন করে এবং ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দেয়।

স্বদেশি আন্দোলনের সময় কলকাতা ও খিদিরপুরের বন্দর শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে। কলকাতার সরকারি ছাপাখানার কর্মীরাও ধর্মঘটে যোগ দেয়। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এই কর্মীদের নিয়ে প্রিন্টার্স অ্যান্ড কম্পোজিটার্স লিগ (21 অক্টোবর, 1905 খ্রিস্টাব্দ) গড়ে তোলেন। চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে রেলকর্মীরা ধর্মঘট করে।

অন্যান্য রাজ্য –

তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করে। চিদাম্বরম পিল্লাই গ্রেফতার হলে শ্রমিকেরা দাঙ্গা শুরু করে। পাঞ্জাবের রাওয়ালপিণ্ডিতে অস্ত্র ও রেল ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার শ্রমিকেরা এই সময় ধর্মঘট করে। বিহারের জামালপুরের রেল কারখানার শ্রমিকেরাও এই সময় ধর্মঘটে শামিল হয়। শ্রমিকেরা জঙ্গি হয়ে উঠলে পুলিশ গুলি চালায়। মহারাষ্ট্রে বিদেশি মালিকানাধীন বস্ত্রশিল্পে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। অশান্তি ও গোলযোগের অভিযোগে বাল গঙ্গাধর তিলকের কারাদণ্ড হয়। এর প্রতিবাদে বোম্বাই -এর বস্ত্রশিল্প শ্রমিকেরা 6 দিনব্যাপী গণরাজনৈতিক ধর্মঘটের ডাক দেয় ও তা পালন করে।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করো।

মূল্যায়ন –

এভাবে শ্রমিকশ্রেণি বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। স্বদেশি আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলন কেবলমানে অর্থনৈতিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, শ্রমিকরা ব্যাপকতর রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও অংশ নিচ্ছিল। ফলে আগের মতো অসংগঠিত বিক্ষোভের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদীদের সমর্থনে সংগঠিত ধর্মঘট শ্রমিক আন্দোলনকে ব্যাপকতর রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করে। কিন্তু 1908 খ্রিস্টাব্দের পর জাতীয় আন্দোলনে ভাটার টান দেখা দিলে শ্রমিক আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে পড়ে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের গতিবৃদ্ধির কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন ঘটনার জন্য ভারতে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের কারণ –

ভারতে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের গতিবৃদ্ধির কারণগুলি হল নিম্নরূপ –

  • গান্ধিজির আবির্ভাব – গান্ধিজি 1918 খ্রিস্টাব্দের 15 মার্চ আহমেদাবাদে মিলমজুরদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আহমেদাবাদ সত্যাগ্রহ শুরু করেন। তাঁর মধ্যস্থতায় মালিকপক্ষ শ্রমিকদের 35 শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়।
  • রাওলাট সত্যাগ্রহ – ভারতবাসীর জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার 1919 খ্রিস্টাব্দে কুখ্যাত ‘রাওলাট আইন’ পাস করে। এই আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভ আন্দোলন ও হরতালে শ্রমিকেরা বিপুল সংখ্যায় যোগদান করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের গতিবৃদ্ধির কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।
  • শ্রমিক সংগঠন – আলোচ্য পর্বে বেশ কিছু শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে, যেগুলি শ্রমিকশ্রেণির আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল। যেমন – 1918 খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে বি পি ওয়াদিয়ার উদ্যোগে মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন গঠিত হয়, যেটি শ্রমিকশ্রেণিকে আত্মবলে বলীয়ান করে তুলেছিল।
  • জাতীয় কংগ্রেসের গুরুত্ব – বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময়ে জাতীয় কংগ্রেস শ্রমিকশ্রেণির থেকে দূরে থাকলেও 1918 খ্রিস্টাব্দে যখন শ্রমিকশ্রেণির জোরালো উত্থান হয় কংগ্রেসের পক্ষে তখন আর শ্রমিকদের উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। জাতীয় কংগ্রেস 1919 খ্রিস্টাব্দে অমৃতসরের অধিবেশনে প্রথম শ্রমিকদের সমস্যাগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতিকল্পে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের জন্য প্রাদেশিক কমিটিগুলিকে আহ্বান জানায়। 1920 খ্রিস্টাব্দের 31 অক্টোবর শ্রমিকদের নিজস্ব সর্বভারতীয় সংগঠন নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC) গঠিত হয়। এই সংগঠনের বার্ষিক সম্মেলনে জাতীয় নেতৃবৃন্দ অংশ নিতেন। এইভাবে শ্রমিকশ্রেণি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকে।
  • অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলন – অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। উভয় আন্দোলনের নেতারা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন।
  • কমিউনিস্টদের ভূমিকা – অসহযোগ আন্দোলনের পর থেকেই কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণির সেইরূপ সম্পর্ক না থাকার কারণে যে শূন্যস্থান সৃষ্টি হয়, তা পূরণে বামপন্থী তথা কমিউনিস্টরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। স্বদেশি ও বিদেশি শিল্প নির্বিশেষে শ্রমিকদের সংগঠনেও জঙ্গি আন্দোলন পরিচালনায় কমিউনিস্টরা অত্যন্ত নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছিলেন। 1925 খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। 1923-1928 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলা, বোম্বাই, পাঞ্জাব ও যুক্তপ্রদেশে ‘শ্রমিক ও কৃষক পার্টি’ প্রতিষ্ঠিত করে তারা সক্রিয়ভাবে শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, কোনো একটি নির্দিষ্ট উপাদান নয়, বরং একাধিক উপাদান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের গতিবৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল।

অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করো।

অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা –

উনবিংশ শতকের ভারতে শ্রমিকশ্রেণি এক আলাদা সামাজিক শ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন ও একটি সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় সংগঠন (AITUC) গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন মতাদর্শ থাকলেও শ্রমিকশ্রেণির উপর কংগ্রেসের প্রভাবই ছিল বেশি। তা ছাড়া গান্ধিজির আঞ্চলিক সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রভাব শ্রমিকশ্রেণির উপর পড়েছিল। তাই অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির পরিস্থিতি –

অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় 1921 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। এর আগে পাঞ্জাবে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল (13 এপ্রিল, 1919 খ্রিস্টাব্দ)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সৈন্যবাহিনীতে বেকারত্ব, শ্রমিকদের বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যসংকট পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছিল। ব্রিটিশ সরকার এই সময় দমনমূলক ‘রাওলাট আইন’ পাস করলে দেশবাসী চরম অসন্তুষ্ট হয়। শ্রমিকশ্রেণির উপর এর প্রভাব পড়ে।

অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিক ধর্মঘট –

1921 খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে সারা দেশব্যাপী অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। শ্রমিকশ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয়। কারণ গান্ধিজির উপর শ্রমিকশ্রেণির আস্থা ছিল। সুমিত সরকারের দেওয়া এক হিসাব থেকে জানা যায়, 1921 খ্রিস্টাব্দে মোট 396টি শিল্পশ্রমিক ধর্মঘট হয়েছিল। এই ধর্মঘটগুলিতে মোট 6,00,351 জন শ্রমিক অংশগ্রহণ করে। এর ফলে মোট 69,94,426টি শ্রমদিবস নষ্ট হয়।

অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করো।

বাংলাদেশ –

বাংলার প্রধান শিল্প ছিল পাটকল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে মন্দার কারণে পাটকলগুলিতে উৎপাদন হ্রাস, শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস অব্যাহত থাকে। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে বাংলায় ইউরোপীয় মালিকানাধীন পাটকলের শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে। 1921 খ্রিস্টাব্দে পাটশিল্পে মোট 137 বার ধর্মঘট হয়। 1,86,479 জন শ্রমিক এই ধর্মঘটে অংশ নেয়। কর্তৃপক্ষ এইজন্য শ্রমিকদের জরিমানা ধার্য করে ও মজুরি বন্ধ করে দেয়। এর প্রতিবাদে হাওড়ার সেন্ট্রাল জুটমিল, গার্ডেনরিচ ক্লাইভ এবং সাউথ ইন্ডিয়ান জুটমিল -এর শ্রমিকেরা বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ধর্মঘট করে।

স্বামী বিশ্বানন্দ ও স্বামী দর্শনানন্দের নেতৃত্বে রানিগঞ্জ, ঝরিয়া অঞ্চলের কয়লাখনির শ্রমিকেরা সংগঠিত হয়ে সেখানে ধর্মঘট করে। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত রেলপথ ও জলপথে স্টিমার পরিবহণের কর্মীদের সংগঠিত করেন এবং ধর্মঘট পালিত হয়। 1921 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠে। 5000 শ্রমিক গান্ধিটুপি পরে কাজ করতে গেলে ইংরেজ সুপারভাইজার শ্রমিকদের টুপি খোলার নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশের প্রতিবাদে শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে।

অন্যান্য রাজ্য –

অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ আসামেও পৌঁছেছিল। এখানকার চা বাগানের শ্রমিকেরা অধিকাংশই ছিলেন বিহারের অধিবাসী। তারা গান্ধিজির আহূত আন্দোলনে যোগদানের জন্য চা বাগান ছেড়ে বিহারে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন চা বাগানের মালিকপক্ষের ইন্ধনে পুলিশ শ্রমিকদের উপর নির্যাতন চালায়। মাদ্রাজে ইংরেজ মালিকানাধীন বাকিংহাম এবং কর্ণাটকে টেক্সটাইল মিল -এর শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে (22 অক্টোবর, 1921 খ্রিস্টাব্দ)। থিরু ভিকা ছিলেন এখানকার কংগ্রেস নেতা। তিনি ধর্মঘটি শ্রমিকদের সমর্থন করেন।

মূল্যায়ন –

যদিও গান্ধিজি শ্রমিক ধর্মঘটকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে চাননি এবং তিনি লিখেছিলেন, ‘ধর্মঘট অহিংস অসহযোগের পরিকল্পনার আওতায় পড়ে না’, তথাপি অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে কংগ্রেসি নেতারা শ্রমিক ধর্মঘটের আয়োজন করে। শ্রমিকশ্রেণি তাদের শ্রেণিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এই আন্দোলনে কৃষকশ্রেণি কোথাও কোথাও হিংসাত্মক হয়ে উঠলেও শ্রমিকেরা তা হয়নি। গান্ধিজির মতাদর্শের প্রতি তারা যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করেছিল।

আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা লেখো।

আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা –

গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত দ্বিতীয় সর্বভারতীয় অহিংস গণ আন্দোলন ছিল লবণ সত্যাগ্রহ বা আইন অমান্য আন্দোলন। এই আন্দোলনের দুটি পর্যায় ছিল। প্রথম পর্যায়টি সংগঠিত হয়েছিল 1930-1931 খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয়টি 1932-1934 খ্রিস্টাব্দে। এই আন্দোলন বিস্তৃতির দিক থেকে অসহযোগ আন্দোলনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির পরিস্থিতি –

অসহযোগ আন্দোলনের আগে যেমন ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করেছিল তেমনি আইন অমান্য আন্দোলনের আগেও আর্থিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ছিল। যেমন – 1929 খ্রিস্টাব্দের বিশ্ব আর্থিক মহামন্দার ভয়াবহ প্রভাব ভারতেও পড়েছিল। সাইমন কমিশন বর্জন, সর্বদলীয় সম্মেলনের ব্যর্থতা, স্বরাজ গঠনের আদর্শ গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ের জন্য রাজনৈতিক দোলাচল সৃষ্টি হয়।

আইন অমান্য আন্দোলনের শ্রমিক ধর্মঘট –

1930 খ্রিস্টাব্দের 6 এপ্রিল গান্ধিজি ডান্ডির বেলাভূমি থেকে একমুঠো লবণ সংগ্রহ করে ইংরেজ সরকারের লবণ আইন ভঙ্গ করেন। এই ঘটনাটি ছিল প্রতীকী। এরপর দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়।

মহারাষ্ট্র –

লবণ সত্যাগ্রহের জন্য সরকার গান্ধিজিকে গ্রেফতার করে। এই সংবাদে মহারাষ্ট্রের শোলাপুরে বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকেরা 7 মে থেকে ধর্মঘট আরম্ভ করে। সাধারণ মানুষ ধর্মঘটি শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায়। তারা যৌথভাবে পুলিশের থানা, আদালত ভবন, পৌরসভা ভবন এবং মদের দোকানগুলিতে আক্রমণ চালায়। শোলাপুরে কিছুকাল সরকারি প্রশাসন বিলুপ্ত হয়। সেখানে জনতার সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে ওঠে। নানা জায়গায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

বোম্বাইতেও আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকেরা অংশগ্রহণ করে। 1930 খ্রিস্টাব্দের 4 ফেব্রুয়ারি প্রায় 20,000 শ্রমিক ধর্মঘট করে। এই শ্রমিকদের একটা বড়ো অংশ ছিল গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ের কর্মী। গান্ধিজি লবণ সত্যাগ্রহ শুরু করলে রেলকর্মীরাও আন্দোলনে যোগ দেয়। তারা রেললাইনের উপর লাল পতাকা লাগিয়ে শুয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পুলিশ গুলি চালায়। ব্যাপক দমন পীড়নের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি 6 জুলাই ‘গান্ধি দিবস’ পালন করে।

বাংলা –

গান্ধিজির গ্রেফতারের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ে। শ্রমিকশ্রেণি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বালি পাটকলের শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে। হাওড়া স্টেশনের কুলিরা কাজ বন্ধ করে দেয়। অশান্তির আশঙ্কায় সরকার হাওড়া স্টেশনে সৈন্য মোতায়েন করে। কলকাতার পরিবহণ শ্রমিকেরা আন্দোলনে যোগ দেয়। তারাও ধর্মঘট করে।

অন্যান্য রাজ্য –

করাচি বন্দরের শ্রমিকেরাও এই আন্দোলনে যোগ দেয়। মাদ্রাজের শ্রমিকেরা ইউরোপীয় মালিকানাধীন বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্পে ধর্মঘট করে এবং কাজ বন্ধ রাখে। বিহারের খনিজ শিল্পশ্রমিকেরা সীমিতভাবে এই আন্দোলনে যোগদান করে।

শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা –

1931 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1936 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা কমে আসে। 1932-1934 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রমিকরা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিল। 1937 খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠিত হলে শ্রমিকশ্রেণি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। কেন-না এসময় থেকে কমিউনিস্টরা আবার জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরে আসে। শ্রমিক আন্দোলনের উপর বামপন্থীদের প্রভাব এসময় থেকে আবার বাড়তে থাকে।

মূল্যায়ন –

আশা করা গিয়েছিল, অসহযোগ আন্দোলনের তুলনায় এই আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকেরা বেশি সংখ্যায় যোগ দেবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। পরিস্থিতি ধর্মঘটের অনুকূল থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকশ্রেণি এই আন্দোলনে আগ্রহ দেখায়নি। এর কারণ হিসেবে সুমিত সরকার বলেছেন, গান্ধিজির 11 দফা দাবিতে ও সাধারণভাবে কংগ্রেসের নীতিতে শ্রমিকশ্রেণির অভিযোগগুলিকে উপেক্ষা করা হয়। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় কমিউনিস্ট নেতারা কারারুদ্ধ থাকায় এই দলের শ্রমিক সংগঠনগুলি আন্দোলনে যোগ দেয়নি। গান্ধি-আরউইন চুক্তি আন্দোলনকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। ফলে গান্ধিজির উপর থেকে শ্রমিকশ্রেণি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করো।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা –

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ভারত ছাড়ো আন্দোলন একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। গান্ধিজি পরিচালিত শেষ গণ আন্দোলন ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। যদিও এই আন্দোলন শুরুর আগেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, তথাপি এর কর্মসূচি ও নীতি তিনিই নির্ধারণ করেছিলেন। স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলনে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি যুক্ত হয়। শ্রমিকেরাও এই আন্দোলনে যোগদান করে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করো।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির কর্মসূচি –

1942 খ্রিস্টাব্দের 8 আগস্ট বোম্বাই অধিবেশন থেকে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। পরদিন (9 আগস্ট) কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা 12 দফা কর্মসূচির একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে। এই প্রস্তাবে গান্ধিবাদী সত্যাগ্রহ, শিল্প ধর্মঘট, রেলপথ ও টেলিগ্রাফ লাইন আক্রমণ, খাজনা বন্ধ ও কর না দেওয়া, সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির কথা বলা হয়।

বোম্বাই –

বোম্বাই শহরে গণবিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন শুরু হয়। 9 থেকে 14 আগস্ট শহরে ব্যাপক গণবিক্ষোভ ঘটে। শ্রমিকশ্রেণি এই বিক্ষোভে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বোম্বাই শিল্পাঞ্চল এবং বন্দর এলাকায় সরকারি প্রশাসন লোপ পায়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ গুলি চালায়। বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত হয়। গুজরাট: এই আন্দোলনে গুজরাটের শ্রমিকেরাও অংশ নেয়। আহমেদাবাদে বস্ত্রশিল্পের প্রায় 1,25,000 শ্রমিক মজদুর মহাজন সংঘের নেতৃত্বে ধর্মঘট শুরু করে। আহমেদাবাদে আজাদ সরকার বা সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে ওঠে। শিল্পপতিরা ধর্মঘট ভাঙতে উৎসাহ দেখায়নি। ফলে তিনমাস ধরে শ্রমিক ধর্মঘট চলতে থাকে। এই ধর্মঘটে শ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির কোনো দাবি জানায়নি।

বিহার –

তৎকালীন বিহারের জামসেদপুরে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি (TISCO)-র প্রায় 30,000 শ্রমিক 10 আগস্ট ধর্মঘট শুরু করে। এই ধর্মঘট 13 দিন ধরে চলে। শ্রমিকেরা দাবি জানিয়েছিল যে, জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা ধর্মঘট চালিয়ে যাবে। এর ফলশ্রুতিতে 12 আগস্ট ডালমিয়ানগরে শ্রমিক ধর্মঘট হয়।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করো।

মহীশূর –

ব্যাঙ্গালোর শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকেরা ধর্মঘটের মাধ্যমে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। তাদের পাশে দাঁড়ায় ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ। রাজ্যের বিভিন্ন খনিগুলিতেও শ্রমিক ধর্মঘট হয়। এই ধর্মঘটের মোকাবিলার জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী গুলি চালায়। বহু শ্রমিক আহত হয় ও মারা যায়।

অন্যান্য রাজ্য –

ভারতের অন্যান্য রাজ্যের বিভিন্ন শহরে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – দিল্লি, লখনউ, কানপুর, নাগপুর, মাদ্রাজ, টেনালি, রামনাদ, কোয়েম্বাটোর, কলকাতা ইত্যাদি। এখানকার শ্রমিক ধর্মঘটগুলি স্বল্পস্থায়ী হয়। কারণ – জাতীয় চেতনার সঙ্গে তাদের পেশাগত স্বার্থ জড়িত ছিল।

1945-1947 খ্রিস্টাব্দে শ্রমিক আন্দোলন –

1945 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1947 খ্রিস্টাব্দ সময়কালে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন পর্বের উন্মেষ ঘটে। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকদের বিচারকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে উত্তাল গণ আন্দোলন হয়েছিল শ্রমিকরাও সেই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। 1945 খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে বোম্বাই ও কলকাতায় বন্দর শ্রমিকরা ইন্দোনেশিয়াগামী জাহাজগুলিতে মাল বোঝাই করতে অস্বীকার করে। 1946 খ্রিস্টাব্দে নৌসেনাদের বিদ্রোহের সমর্থনে বোম্বাই -এর শ্রমিকদের ধর্মঘট ও হরতাল বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির মূল্যায়ন –

ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলন। হতাশা ও অনাগত আশঙ্কা থেকে এই আন্দোলন ইংরেজদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এই আন্দোলন ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক। শহরকেন্দ্রিক শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকেরা এই আন্দোলনে যোগদান করলেও গ্রামীণ কুটিরশিল্পের শিল্পী-কারিগররা এই আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, র‍্যাডিকাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। তাই এই দলগুলির শ্রমিক সংগঠনগুলিও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদান থেকে বিরত ছিল। যুদ্ধ চলাকালীন উৎপাদন ব্যাহত না করার দিকে সরকারের দৃষ্টি ছিল। তাই নিষ্ঠুর দমননীতির প্রয়োগ করা হয়। তবুও এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে শ্রমিকশ্রেণি নিজেদের জাতীয়তাবোধের পরিচয় দিয়েছিল।

শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বামপন্থী মতাদর্শের প্রসারে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির ভূমিকা আলোচনা করো।

অথবা, ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির ভূমিকা –

মানবসভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসের সমান্তরালে শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাসও বিদ্যমান। শোষিত, নিপীড়িত মানুষেরা যুগে যুগে বিক্ষোভ-বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে। শিল্পবিপ্লবের পর মার্কসীয় ব্যাখ্যা তাদের শোষণমুক্তির দিশা দেখায় ও শ্রেণিসংগ্রামের প্রেরণা জোগায়। ভারতেও বামপন্থীরা শ্রমজীবী মানুষের শোষণমুক্তির জন্য ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি গঠন করে। এই দল তার লক্ষ্যে পৌঁছোনোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে।

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির প্রতিষ্ঠা –

1920 খ্রিস্টাব্দের 17 অক্টোবর রাশিয়ার তাসখন্দে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর 1925 খ্রিস্টাব্দে কানপুরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলা হয়। ইংরেজ সরকারের দমননীতি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট নেতারা গোপনে তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করতে থাকেন। এই সময় তারা শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বামপন্থী মতাদর্শ প্রচার ও তাদের সংগঠিত করার জন্য ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি (WPP) গঠনের চেষ্টা করেন।

বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, 1926 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষ্ণনগরে ডা. নরেশ সেনগুপ্তের সভাপতিত্বে নিখিল বঙ্গ পেজেন্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলি একটি সমাবেশ করে। এস এ ডাঙ্গে, মুজফ্ফর আহমেদ, পি সি যোশি এবং মোহন সিং যোশ -এর নেতৃত্বে 1927 খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি (WPP) প্রতিষ্ঠিত হয়। 1927 ও 1928 খ্রিস্টাব্দে এই পার্টি অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির শাখা সংগঠন –

এরপর বিভিন্ন রাজ্যে এর শাখা সংগঠন গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। বাংলায় লেবার স্বরাজ পার্টি পেজেন্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টি ইন বেঙ্গল নামে পরিচিত হয়। বাংলা শাখার সম্পাদক ছিলেন মুজফ্ফর আহমেদ। এ ছাড়া কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্ত কুমার সরকার, গোপেন চক্রবর্তী, ধরণী গোস্বামী এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এদের প্রকাশিত প্রথম বাংলা মুখপত্র ছিল ‘লাঙ্গল’, পরে ‘গণবাণী’ প্রকাশিত হয়।

বোম্বাই -এর শাখা সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন এস এস মিরাজকর। এই দলের মুখপত্র ছিল ‘ক্রান্তি’। যুক্তপ্রদেশের শাখা সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন পূর্ণচন্দ্র যোশি। এখানে দলীয় মুখপত্র ছিল ‘অসন্তিকারী’। পাঞ্জাব শাখার সম্পাদক ছিলেন মোহন সিং যোশ। এখানে দলীয় মুখপত্র ছিল ‘কীর্তি কিষান’ এবং ‘ইনকিলাব’। মাদ্রাজে দলের সম্পাদক ছিলেন সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার। এদের দলীয় মুখপত্র ছিল ‘ওয়ার্কার’।

1928 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় সারা ভারত ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি-র এক সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে আর এস নিম্বকারকে সর্বভারতীয় সম্পাদক মনোনীত করা হয়। বোম্বাই-এ বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন গিরনি-কামগড় ইউনিয়ন (GKU) গড়ে তোলার ব্যবস্থা হয়।

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির কর্মসূচি –

শ্রেণিসংগ্রাম, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা লোপ, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, সংবাদপত্র ও বাকস্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকারদান প্রভৃতি দাবি তোলা হয়।

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির কার্যকলাপ –

এইসব শাখা সংগঠন এবং আঞ্চলিক পত্রপত্রিকার মাধ্যমে শ্রমজীবীদের মধ্যে প্রচারের কাজ চলে। বামপন্থী চিন্তাধারা তাদের প্রভাবিত করে। শ্রমজীবীরা বুঝতে পারে তারা আলাদা একটা সামাজিক শ্রেণি। তাদের মধ্যে এক ঐক্যভাব গড়ে ওঠে। শোষকশ্রেণিকে তারা চিনতে পারে। নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য তারা যৌথভাবে আলোচনা শুরু করে। শিল্পাঞ্চলে ক্রমশ তারা সংগঠিত হয়ে ওঠে। সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন AITUC-তে বামপন্থী প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন ধর্মঘটে শ্রমিকরা সক্রিয়ভাবে যোগদান করে।

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির মূল্যায়ন –

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে ভারতের শ্রমজীবীদের মুক্তি আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সংগঠন গঠনমূলক ভূমিকা পালন করলেও এই সংগঠন ছিল শহরকেন্দ্রিক, তাই শহরের শিল্পশ্রমিকেরা এর আওতায় এসেছিল। গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে তারা নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তুলতে না পারায় কৃষকেরা সংগঠিত হতে পারেনি। এই সংগঠনের হাত ধরে কমিউনিস্ট পার্টি তার সংগঠন বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়।

1920 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1935 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বামপন্থী আন্দোলনের গতিধারা আলোচনা করো। বামপন্থী আন্দোলনের ব্যর্থতা সম্পর্কে লেখো।

বামপন্থী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট –

1920 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1935 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে যে কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, তা ভারতের জাতীয় আন্দোলনে এক নতুন ধারার সূত্রপাত করেছিল। কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ ও নিষ্ঠাবান কমিউনিস্ট নেতার প্রেরণা, উদ্যম ও স্বার্থত্যাগ আমাদের সশ্রদ্ধ প্রশংসার দাবি রাখে। মনে রাখা দরকার যে, মার্কসবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এরা কেবল সমাজতন্ত্র, কৃষিসংস্কার ও শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়েই চিন্তা করেননি; এদের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদ। ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ ছিল এদের অন্যতম লক্ষ্য। কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী খিলাফৎ নেতা মৌলানা হসরৎ মোহানি আহমেদাবাদ কংগ্রেসে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে একটি সংশোধনী প্রস্তাব তোলেন। তাঁকে সমর্থন করেন কমিউনিস্টপন্থী বিপ্লবী স্বামী কুমারনন্দ। গান্ধিজির বিরোধিতায় এই সংশোধনী প্রস্তাব অবশ্য শেষপর্যন্ত বহু ভোটে পরাজিত হয়।

বামপন্থী আন্দোলনের গয়া কংগ্রেস ও বামপন্থা –

1922 খ্রিস্টাব্দে গয়া কংগ্রেসে মাদ্রাজের কমিউনিস্ট নেতা সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার বলেন – ‘আমি একজন কমিউনিস্ট। আমরা এখনই চাই ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা, তারপর সমাজতন্ত্র।’ কমিনটার্নের চতুর্থ বিশ্ব কংগ্রেসও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে। কিন্তু আদর্শ, উৎসাহ ও উদ্দীপনার ঘাটতি না থাকলেও এই আন্দোলন কতটা সফল হয়েছিল তা বিবেচনাযোগ্য। বস্তুত এই আন্দোলনে শ্রমিক ও কৃষকদের বড়ো কোনো লাভ হয়নি। তাদের অবস্থার উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতিও হয়নি।

1920 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1935 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বামপন্থী আন্দোলনের গতিধারা আলোচনা করো। বামপন্থী আন্দোলনের ব্যর্থতা সম্পর্কে লেখো।

বামপন্থার ব্যার্থতা –

সামগ্রিকভাবে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যর্থতার দুটি মূল কারণ ছিল উল্লেখযোগ্য –

  • বিদেশি প্রভাবের বাহুল্য – এই আন্দোলনের প্রেরণা, এমনকি তার কর্মসূচি ও পদ্ধতিও এসেছিল বিদেশ থেকে। বিপ্লবের আদর্শকে কমিউনিস্ট নেতারা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কমিনটার্নের নির্দেশ তারা মেনে চলতেন। অর্থাৎ এই আন্দোলনের শিকড় ভারতের মাটিতে নিহিত ছিল না। সম্পূর্ণরূপে বিদেশি আদর্শ ও নীতির উপর নির্ভরশীল কোনো আন্দোলন কখনোই পুরোপুরি সফল হতে পারে না। ভারতীয় পরিস্থিতির সঙ্গে যে রাশিয়ার পরিস্থিতির অনেক তফাত ছিল, তা নিয়ে তারা খুব একটা ভাবনাচিন্তা করেননি। ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষকদের প্রতি ঠিক কী ধরনের নীতি অনুসরণ করা উচিত, তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা করা হয়নি। ভারতীয় পরিস্থিতির জটিলতা তারা তলিয়ে দেখেননি। ফলে অনেকসময় তাদের নীতি ও কার্যকলাপে অসংগতি ও স্ববিরোধিতা লক্ষণীয়। ধানাগড়ে অবশ্য এই ধরনের দুর্বলতার জন্য কোনো ব্যক্তিবিশেষকে দায়ী না করে ভারতীয় পরিস্থিতির জটিলতাকে দায়ী করেছেন।
  • কমিউনিস্ট আন্দোলনের শ্রেণিচরিত্র – ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যর্থতার দ্বিতীয় কারণ হল এর সংকীর্ণ শ্রেণিচরিত্র। এই আন্দোলন ছিল শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণির আন্দোলন। অর্থাৎ এই আন্দোলনের নেতারা সবাই ছিলেন মধ্যবিত্তশ্রেণির মানুষ। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় যারা ধরা পড়েছিলেন, তারা প্রত্যেকেই ছিলেন মধ্যবিত্তশ্রেণির প্রতিনিধি। শ্রমিক-কৃষক দলের সদস্যদেরও বেশিরভাগ ছিলেন মধ্যবিত্তশ্রেণির। সাধারণ শ্রমিকদের প্রায় কেউই এই দলের সদস্য ছিলেন না। বাংলা ও পাঞ্জাবে কিছু কিছু কৃষক সদস্য থাকলেও বোম্বাইতে এই দল ছিল পুরোপুরি একটি পেটি বুর্জোয়া দল। দলের সদস্য ও নেতারা অবশ্য শ্রমিক ও কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। কিন্তু তা ছিল অনেকটাই বাইরের ব্যাপার। আন্তরিকতাপূর্ণ ঘরোয়া সম্পর্কের অবকাশ বা সুযোগ কোনোটাই এখানে ছিল না। আসলে যাদের জন্য ও যাদের নিয়ে এই আন্দোলন, তারাই ছিল উপেক্ষিত।

বামপন্থী আন্দোলনের মূল্যায়ন –

সংক্ষেপে বলতে গেলে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি সমাজের একেবারে নীচুতলায় প্রবেশ করতে পারেনি। সাধারণ মানুষের কাছে গান্ধিজি যতটা কাছের মানুষ ছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তা কোনোদিনই হয়ে উঠতে পারেননি।

বামপন্থার বিকাশে এম এন রায়ের অবদান লেখো।

বামপন্থার বিকাশে এম এন রায়ের ভূমিকা –

1917 খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের সাফল্য আন্তর্জাতিক স্তরে একটা আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। এই ঘটনা ভারতেও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। 1920-র দশক থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থী সাম্যবাদী মতাদর্শের প্রভাব ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। এদেশে বামপন্থী ভাবধারা ও আন্দোলন প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এম এন রায়।

এম এন রায়ের বামপন্থী মতাদর্শ –

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা ও অবদান সম্পর্কে বিতর্কের অন্ত নেই। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মত ও পথ কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছে। তবে কংগ্রেসের জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বোস প্রমুখ প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ বামপন্থী আন্দোলন দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।

বামপন্থার বিকাশে মানবেন্দ্রনাথ রায় –

ভারতে সাম্যবাদী আন্দোলনের জনক ছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে মানবেন্দ্রনাথ রায়। এই দ্বিতীয় নামেই তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন। প্রথমে মানবেন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলার অনুশীলন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। 1915 খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারত ত্যাগ করেন, উদ্দেশ্য ছিল জার্মানি থেকে অস্ত্রসংগ্রহ। বিভিন্ন দেশ ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং সেখানে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এখানেই নরেন্দ্রনাথ ‘মানবেন্দ্রনাথ’ নামগ্রহণ করেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে তিনি মেক্সিকো যান এবং সেখানেই তিনি মার্কসবাদে দীক্ষিত হন। মেক্সিকোতে থাকাকালীন তিনি 1919 খ্রিস্টাব্দে মিখাইল বোরোদিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি 1920 খ্রিস্টাব্দে লেনিনের আমন্ত্রণে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে যোগদান করার জন্য রাশিয়া যান। এই সমাবেশে ঔপনিবেশিক দুনিয়ায় বিপ্লব সফল করার জন্য কমিউনিস্টরা কী ভূমিকা গ্রহণ করবে, সেই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে তাঁর সঙ্গে লেনিনের তীব্র মতভেদ দেখা দেয়।

বামপন্থার বিকাশে এম এন রায়ের অবদান লেখো।

এই কংগ্রেসে লেনিন ‘উপনিবেশগুলির আশুকর্তব্য’ বা Colonial Thesis নামক খসড়া পেশ করেন, যাতে ভারতের ক্ষেত্রে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ বলতে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বের কথা বলা হয়। মানবেন্দ্রনাথ এর বিরোধিতা করে একটি পরিপূরক তত্ত্ব পেশ করেন। শেষপর্যন্ত অবশ্য লেনিন কিছুটা হলেও তাঁর সঙ্গে সহমত হন। ফলে পরিমার্জিত ‘ঔপনিবেশিক তত্ত্ব’ উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দিকনির্দেশিকা হয়ে ওঠে।

বামপন্থার বিকাশে এম এন রায়ের প্রতিষ্ঠা –

1920 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জি ও খিলাফৎ নেতা মহম্মদ আলি ও মহম্মদ সাফিক একত্রে রাশিয়ার তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু 1921 খ্রিস্টাব্দের গোড়ায় আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে তাঁদের ভারতে প্রবেশের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অতঃপর 1922 খ্রিস্টাব্দে মানবেন্দ্রনাথ রায় বার্লিনে আসেন এবং সেখান থেকে ‘Vanguard of Indian Independence’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই সময়েই তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘India in Transition” প্রকাশিত হয়। এই সময় যে-সমস্ত প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন, তাঁদের মধ্যে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও বরকতউল্লাহ -এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বামপন্থায় এম এন রায়ের প্রভাব –

সাম্যবাদী আন্দোলনের সূচনা ভারতের বাইরে হলেও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে মানবেন্দ্রনাথ অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। তিনি নলিনী গুপ্ত ও শওকত ওসমানিকে ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য ভারতে পাঠান। 1921 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় একটি কমিউনিস্ট গোষ্ঠী স্থাপিত হয়। এর দায়িত্বে ছিলেন মুজফ্ফর আহমেদ। কলকাতার মতো বোম্বাইতেও একটি কমিউনিস্ট গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ডাঙ্গে, নিম্বকার, নাদকার্ণি, দেশপাণ্ডে, জোগলেকার প্রমুখ নেতারা গান্ধিবাদী নেতৃত্বে হতাশ হয়ে মার্কসবাদের দিকে ঝোঁকেন। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন অন্যতম পথিকৃৎ হলেন এস এ ডাঙ্গে। পশ্চিম ভারতের কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন অগ্রগণ্য। 1921 খ্রিস্টাব্দে ডাঙ্গে ‘গান্ধি বনাম লেনিন’ নামে ইংরেজিতে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। এই পুস্তিকায় তিনি গান্ধি ও লেনিনের মধ্যে তুলনা করে গান্ধির আন্দোলন পদ্ধতির কঠোর সমালোচনা করেন। 1922 খ্রিস্টাব্দে তিনি বোম্বাই শহরে ‘Socialist’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ক্রমশ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কমিউনিস্ট আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

বামপন্থার বিকাশে এম এন রায়ের অবদান লেখো।

এম এন রায় -এর সংযোগবার্তা –

1922 খ্রিস্টাব্দের 2 নভেম্বর মানবেন্দ্রনাথ রায় ডাঙ্গেকে একটি চিঠি লিখে আন্দোলনের পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানান। তিনি চান আন্দোলন পরিচালিত হবে দুটি স্তরে। তাঁর মতে, প্রথম স্তরে যে আন্দোলন পরিচালিত হবে, তার চরিত্র হবে জাতীয়তাবাদী, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা হবে এর কর্মসূচি। অপর কাজটি চলবে গোপনে ও কিছুটা বে-আইনি পথে। এর কাজ হবে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে সাম্যবাদী বাণী ও আদর্শ প্রচার করে বিপ্লবের জন্য তাদের তৈরি করা। বস্তুত এই ধরনের প্রস্তাব এর আগেই ডাঙ্গে তাঁর Socialist পত্রিকার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। 1922 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1928 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের মত ও পথ নিয়ে সমালোচনা করলেও জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে যোগদানকারী সদস্যদের মধ্যে কমিউনিস্ট কর্মসূচি প্রচারের উদ্দেশ্যে এম এন রায় ইস্তাহার রচনা করতেন। এমনকি গান্ধিজির সমালোচনা করা হলেও সাধারণ অত্যাচারিত মানুষের প্রতি তাঁর গভীর মমতার কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। কংগ্রেসের জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ডাঙ্গে, সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার ও জোগলেকারের হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল।

বামপন্থার প্রসার –

কমিউনিস্টদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি অবশ্যই সরকার সুনজরে দেখেনি। মানবেন্দ্রনাথ রায় যেসব কমিউনিস্টকে ভারতে সাম্যবাদী আদর্শ প্রচারের জন্য বা সংগঠন কার্যে নিযুক্ত করার জন্য ভারতে পাঠিয়েছিলেন, তাদের অনেককেই ভারতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। এদের পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়, সেই মামলা 1922 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1927 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। 1924 খ্রিস্টাব্দের মে মাসে মুজফফর আহমেদ, ডাঙ্গে, শওকৎ উসমানি ও নলিনী গুপ্তকে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে কারারুদ্ধ করা হয়। এইসব ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলন থমকে দাঁড়ায়নি।

কানপুরে কমিউনিস্ট পার্টির সূচনা –

1925 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কানপুরে কমিউনিস্ট পার্টির একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। কানপুর সম্মেলনেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় বলে মনে করা হয়। এই সময় ভারতে কয়েকটি শ্রমিক-কৃষক সংগঠনের জন্ম হয়। 1924-1926 খ্রিস্টাব্দে মুজফ্ফর আহমেদ বাংলায় Peasants and Workers Party গঠন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কুতুবউদ্দিন আহমেদ এবং একদা চিত্তরঞ্জনের সচিব হেমন্ত কুমার সরকার।

বামপন্থার বিকাশে এম এন রায়ের মূল্যায়ন –

একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায় স্মরণীয় হয়ে আছেন। কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতান্তর ও কংগ্রেস ত্যাগের পর তিনি তৈরি করেন র‍্যাডিকাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। ভারতে কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রচার এবং গোড়ার দিকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নীতি-পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন মানবেন্দ্রনাথ। কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে তাই তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

বামপন্থার বিকাশে ধানাগড়ের বক্তব্য কী?

এ প্রসঙ্গে ধানাগড়ের বক্তব্য হল – “Action failed to keep pace with words and WPP’S (Workers and Peasants Party) activities evoked little response from the peasantry.”

মানবেন্দ্রনাথ রায় রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে কোনগুলি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ?

মানবেন্দ্রনাথ রায় রচিত গ্রন্থাবলি – কেবল কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা ও আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করা নয়, মানবেন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থও রচনা করেন, যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন’, ‘ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা’, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন’, ‘নব মানবতাবাদ: একটি ইস্তেহার’ প্রভৃতি।

বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা করো।

1917 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের জাতীয়তাবাদী ও শ্রমিকশ্রেণির নেতারাও এই সাম্যবাদী আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিংশ শতকের ভারতে বামপন্থী গোষ্ঠীর উদ্ভব ও উপনিবেশবিরোধী বামপন্থী আন্দোলন লক্ষ করা যায়।

বামপন্থী দল প্রতিষ্ঠা –

  • রাশিয়ার তাসখন্দে 1920 খ্রিস্টাব্দের 17 অক্টোবর মানবেন্দ্রনাথ রায় 24 জন প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।
  • ভারতের কানপুরে 1925 খ্রিস্টাব্দের 26 ডিসেম্বর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এস বি ঘাটে।

উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা –

উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের বিস্তার –

রাশিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবে ভারতে বামপন্থী আন্দোলনের প্রসার ঘটে। কলকাতায় মুজফ্ফ্ফর আহমেদ, বোম্বাই-এ এস এ ডাঙ্গে, মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের নেতৃত্বে বামপন্থী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। তাঁরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশ করে বামপন্থী ভাবধারার প্রসার ঘটাতে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ধূমকেতু, ক্রান্তি, ইনকিলাব প্রভৃতি।

সরকারি দমননীতি –

সরকার ভারতে বামপন্থী আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য প্রথম থেকে দমননীতি গ্রহণ করে। 1922 খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে। এই সময় ভারতের প্রথম কমিউনিস্টবিরোধী মামলা বা ‘পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা’ শুরু হয়। 1924 খ্রিস্টাব্দে মুজফ্ফর আহমেদ-কে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। এই মামলায় জড়িয়ে বামপন্থী নেতা এস এ ডাঙ্গে, নলিনী গুপ্তকে-ও জেলে পাঠানো হয়।

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’ প্রতিষ্ঠা –

কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থে কাজ করার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম, কুতুবউদ্দিন আহমেদ, হেমন্ত কুমার সরকার 1925 খ্রিস্টাব্দের 1 নভেম্বর কলকাতায় দ্য লেবার স্বরাজ পার্টি অফ দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। 1928 খ্রিস্টাব্দে এই দলের নাম হয় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা –

শ্রমিক ধর্মঘটে ও বামপন্থীদের কার্যকলাপে আতঙ্কিত হয়ে 1928 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার শিল্পবিরোধ বিল ও জননিরাপত্তা বিল উত্থাপন করে। 1929 খ্রিস্টাব্দে 33 জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে শুরু হয় মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন – মুজফ্ফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, ধরণী গোস্বামী প্রমুখ।

কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধকরণ –

ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট পার্টি-কে পুনরায় সুসংহত করার প্রয়াস বন্ধ করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি ও তার শাখা সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে।

পরবর্তী কার্যকলাপ –

নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও কমিউনিস্ট পার্টি তার প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকে। 1937 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে শ্রমিক দলের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে।

1941 খ্রিস্টাব্দে জার্মানির রাশিয়া আক্রমণকালে কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন করে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল। যুদ্ধকালীন সময় ও তার পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি তার অভাবনীয় প্রভাব বৃদ্ধি করে।

ভারতে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে উপসংহার –

বিশ শতকের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে জাতীয় কংগ্রেসের ব্যাপক প্রভাবের ফলে কমিউনিস্টদের প্রভাব ততটা প্রতিভাত হয়নি।

ভারত ইতিহাসে বামপন্থীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

ভারত ইতিহাসে বামপন্থীদের ভূমিকা –

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় দল, আঞ্চলিক দল, উপজাতি গোষ্ঠী, ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং বহু ব্যক্তিবিশেষের অবদান ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির উপর চাপ সৃষ্টি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ। ঔপনিবেশিক সরকার তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য শোষক ও অনুগত শ্রেণি সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু বিভিন্ন উপাদানের প্রভাবে ভারতে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রাম শুরু হয়। দেরিতে হলেও বামপন্থীরা এই আন্দোলন সমর্থন করে এবং এতে অংশগ্রহণ করে।

ভারত ইতিহাসে বামপন্থীদের কমিউনিস্ট পার্টি –

রাশিয়ার তাসখন্দে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এর বিভিন্ন সদস্য গোপনে ভারতে আসে। তারপর তারা লাহোর, মাদ্রাজ, বোম্বাই, কলকাতায় বিভিন্ন কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে তোলে। এই গোষ্ঠীগুলি কানপুরে এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করে (1925 খ্রিস্টাব্দ)। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার, অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন হসরৎ মোহানি এবং সাধারণ সম্পাদক হন সচ্চিদানন্দ বিষ্ণুঘাটে।

নীতি ও আদর্শ –

শ্রেণিহীন ও শোষণহীন সমাজ গঠন, উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনগণের আন্দোলনকে সমর্থন, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা, জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘব প্রভৃতি এই দলের নীতি, আদর্শ এবং কর্মসূচি ছিল।

ভারত ইতিহাসে বামপন্থীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

শাখা সংগঠন –

কমিউনিস্ট পার্টি বিভিন্ন শাখা সংগঠন গড়ে তোলে। মজুর ও শ্রমিকদের জন্য ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি (WPP), গিরনি-কামগড় ইউনিয়ন, কৃষক সভা প্রভৃতি এবং ছাত্রদের জন্য ভারতের ছাত্র ফেডারেশন গঠন করে।

স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা –

কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই দল ব্রিটিশ সরকারের রোষে পড়ে। তবুও ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে এই দল সীমিত শক্তি নিয়েই পথে নামে।

সাইমন কমিশনের বিরোধিতা –

ভারতের শাসনসংস্কারের জন্য সাইমন কমিশন ভারতে আসে। জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট দল কমিশনকে বয়কট করে। এই উপলক্ষ্যে বিভিন্ন শহরের রাজপথে শোভাযাত্রা, প্রতিবাদ সভা সংগঠিত হয়। এক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ বিশেষ উদ্যোগ নেয়। এই প্রতিবাদী ছাত্ররা ভারতের ছাত্র ফেডারেশন (SFI) গড়ে তোলে।

ভারত ইতিহাসে বামপন্থীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

সাইমন কমিশন বোম্বাই বন্দরে পৌঁছোলে (3 ফেব্রুয়ারি, 1828 খ্রিস্টাব্দ) কমিউনিস্ট দলের শ্রমিক সংগঠনের উদ্যোগে 30,000 শ্রমিক পথে নামে। সর্বাত্মক ধর্মঘট করে ‘সাইমন গো ব্যাক’ এবং ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ ধ্বনি দেয়।

পূর্ণ স্বরাজ প্রস্তাব –

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতীয় কংগ্রেসের চরম লক্ষ্য ছিল স্বায়ত্তশাসন বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস লাভ করা। অসহযোগ আন্দোলনের পর স্বরাজ্য দল প্রতিষ্ঠিত হলেও তাদের লক্ষ্য একই থাকে। বামপন্থী নেতা হসরৎ মোহানির উদ্যোগেই কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে (1928 খ্রিস্টাব্দ) প্রথম পূর্ণ স্বরাজ বা স্বাধীনতার দাবি ওঠে। পরে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে (1929 খ্রিস্টাব্দ) তা গৃহীত হয়।

কমিউনিস্ট দলের বিপ্লবী সংগঠন (HSRA) সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভগৎ সিং -এর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা কেন্দ্রীয় আইনসভায় ট্রেড ডিসপিউট বিল এবং পাবলিক সেফটি বিল পাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বোমা বিস্ফোরণ করে, অত্যাচারী পুলিশ সুপার স্ট্যান্ডার্সকে হত্যা করে। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি দেওয়া হয়।

আইন অমান্য আন্দোলন –

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় 33 জন দলের নেতা কারাবন্দি হওয়ায় দল দুর্বল হয়ে পড়ে। তবুও বোম্বাই-এ রেলওয়ে মেনস ইউনিয়ন -এর সদস্যরা লাল পতাকা নিয়ে ধর্মঘট করে। শোলাপুরে বস্ত্রশিল্প শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে এবং সমান্তরাল সরকার গড়ে তোলে। সরকার কমিউনিস্ট দলকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে।

CSP প্রতিষ্ঠা –

আচার্য নরেন্দ্র দেব, জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি (CSP) প্রতিষ্ঠিত হয় 1934 খ্রিস্টাব্দে। কমিউনিস্ট দলের নেতা-কর্মীরা এই দলে মিশে গিয়ে দলের কর্মসূচিকে প্রভাবিত করে।

র‍্যাডিকাল পার্টি –

এম এন রায় এই দল প্রতিষ্ঠা করলে কমিউনিস্টরা তাঁকে সমর্থন জানায়।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন –

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ফ্রন্টে রাশিয়ার মিত্র ছিল ইংল্যান্ড। তাই কমিউনিস্ট দল ইংল্যান্ডের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে। শ্রমিক ধর্মঘট বন্ধ রাখে এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। তবুও কলকাতা ট্রাম পরিবহণ কর্মীরা ধর্মঘট করে এই আন্দোলনকে সমর্থন জানায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে গণ আন্দোলন –

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভারতে অভূতপূর্ব গণ আন্দোলন শুরু হয়। বাংলায় বর্গাচাষিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তেভাগা আন্দোলন ও কেরলে ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যে পুন্নাপ্রা-ভায়লার আন্দোলন সংগঠিত হয়। অন্যদিকে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনা অফিসারদের বিচার শুরু হলে রশিদ আলি দিবস পালন, ভারতীয় নৌবাহিনীর ‘তলোয়ার’ জাহাজে ভারতীয় নাবিকদের বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ ভূমিকা দেখা যায়। এ ছাড়া তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও এই পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভারত ইতিহাসে বামপন্থীদের মূল্যায়ন –

বহু বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কমিউনিস্টরা শ্রেণিসংগ্রামের চরিত্র বজায় রাখে। তারা তাদের নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। কমিনটার্নের নির্দেশ ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কোনো কোনো কার্যক্রম সমালোচিত হয়। কিন্তু তাদের কার্যকলাপ যে জাতীয়তাবাদী ছিল – এ কথা স্বীকার করতেই হয়।

বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থী প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ কী?

বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থী প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে।

প্রেক্ষাপট – 

জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থী প্রবণতা বৃদ্ধির কারণগুলি হল —

  • রুশ বিপ্লবের প্রভাব ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রসার
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক মন্দা
  • শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষের অভাব-অনটনে কংগ্রেস নেতৃত্বের (প্রচলিত ধারার) উদাসীনতা ও জাতীয় আন্দোলনের প্রতি মোহভঙ্গ
  • কমিউনিস্ট কার্যকলাপের প্রভাব
  • জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর বামপন্থী চিন্তাধারা প্রভৃতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব।

এই সমস্ত কারণে জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থী প্রবণতা বাড়তে থাকে। এমনকি কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও একটি বামপন্থী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে।

বামপন্থী প্রবণতা – 

ভারতে বামপন্থী প্রবণতার বিভিন্ন দিকগুলি হল —

  1. কমিউনিস্ট পার্টি – 1925 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় কমিউনিস্টদের উদ্যোগে কানপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। এই পার্টি শ্রমিক ও কৃষকদের আন্দোলন সংগঠিত করার মাধ্যমে জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল।
  2. কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল গঠন – কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী প্রবণতাকে সুসংবদ্ধ রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে 1934 খ্রিস্টাব্দে আচার্য নরেন্দ্রদেব, জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাম মনোহর লোহিয়া, অচ্যুত পটবর্ধন, ইউসুফ মেহের আলি প্রমুখের নেতৃত্বে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসের ভিতরে বামপন্থী শক্তিকে সুদৃঢ় করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা।
  3. কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ – 1934 খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টি অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় কমিউনিস্টরা প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালাতে পারেনি। তাই পরবর্তীকালে তারা জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথভাবে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার কর্মপন্থা গ্রহণ করে।
  4. কৃষক সভা – এই সময় কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠনের আহ্বান করলে নিখিল ভারত কৃষক সভা ও নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসে (AITUC) কমিউনিস্ট দলের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ভারতে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা কী?

1929 খ্রিস্টাব্দের 20 মার্চ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে 32 জন কমিউনিস্ট ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাঁদের বিরুদ্ধে যে মামলা রুজু করা হয়, তা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা নামে খ্যাত।

প্রেক্ষাপট – 

ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা, কমিউনিস্ট পার্টি গঠন এবং শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক সচেতনতার ফলে 1927 খ্রিস্টাব্দ থেকে শ্রমিক আন্দোলন জঙ্গী চরিত্র ধারণ করে। 1928 খ্রিস্টাব্দে এস.এ. ডাঙ্গে, এস.ভি. ঘাটে, মুজাফ্ফর আহমেদ, মিরাজকর প্রমুখ শ্রমিক নেতার নেতৃত্বে বোম্বাই গিরনি কামগার ইউনিয়নের অধীনে 1,50,000 লক্ষাধিক শ্রমিক ছয় মাস ব্যাপী বোম্বাইয়ের বস্ত্রকলগুলিতে ধর্মঘট চালায়। এই আন্দোলন দমনের হাতিয়ার হিসেবে পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট এবং ট্রেড ডিসপিউটস অ্যাক্ট (এপ্রিল 1929 খ্রিস্টাব্দ) প্রণয়ন করা হয়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া।

প্রতিক্রিয়া – 

1928 খ্রিস্টাব্দে AITUC-র (নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস) ঝরিয়া অধিবেশনে এই আইনের তীব্র নিন্দা করা হয়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিশ্বমিত্র পত্রিকা এই বিলটিকে ধিক্কার জানায়। গণবাণী পত্রিকায় লেখা হয়, বিলটি শ্রমিকের চিরন্তন দাসত্বের সূচনা করছে।

নেতাদের গ্রেপ্তার – 

1929 খ্রিস্টাব্দের 20 মার্চ পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট এবং ট্রেড ডিসপিউটস অ্যাক্ট-এর অধীনে 32 জন শ্রমিক ও কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- মুজাফ্ফর আহমেদ, এস.ভি. ঘাটে, এস.এ. ডাঙ্গে, পি.সি. যোশী, মিরাজকর, ধরনী গোস্বামী, গঙ্গাধর অধিকারী, শৌকত উসমানী, ফিলিপ স্প্র্যাট প্রমুখ।

পরিণতি – 

দীর্ঘ সাড়ে চার বছর (1929-1933) মামলা চলার পর মোট 27 জন বন্দীর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ হয় (অনেকে নির্দোষ প্রমাণিত হন বা পরে মুক্তি পান)। 1933 খ্রিস্টাব্দের 3 আগস্ট এই মামলার রায় ঘোষিত হয়। ব্রিটেনের লেবার পার্টি এই মামলার রায়কে Judicial Scandal (বিচারিক কেলেঙ্কারি) বলে নিন্দা করে।

বিশ শতকের কিষাণ আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থীদের সম্পর্ক আলোচনা করো।

ভূমিকা – 

বিশ শতকের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যে কিষাণ আন্দোলনগুলি ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছিল – যেগুলির ওপর জাতীয় কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব ছিল। কিন্তু চল্লিশের দশকে এই কিষাণ আন্দোলনের চরিত্র বদল ঘটে। এই সময় থেকে কিষাণ আন্দোলনগুলি কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে।

কিষাণ আন্দোলনের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক –

  • কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে দ্বিমুখী নীতি – জাতীয় কংগ্রেস কৃষক আন্দোলনকে জাতীয় সংগ্রামের মূল স্রোতের সঙ্গে বেঁধে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। কৃষকদের জন্য এবং কৃষকদের নেতৃত্বে কোনোরকম শ্রেণি সংগ্রাম গড়ে তোলার ইচ্ছা কংগ্রেস নেতাদের ছিল না।
  • কৃষক আন্দোলনের নিয়ন্ত্রক – কৃষক আন্দোলনে সামান্যতম হিংসার প্রকাশ পেলে বা জঙ্গি আকার ধারণ করলে কংগ্রেস কৃষকদের উৎসাহ-উদ্দীপনার রাশ টেনে ধরে তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করত। এর ফলে ভারতের কৃষক আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
  • গান্ধিজির চিন্তাধারা – অনেকে মনে করেন, জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্ব নিয়ে মাথা না ঘামালেও গান্ধি কৃষকদের দরদি বন্ধু ছিলেন। তিনি শ্রেণি সংগ্রামের পরিবর্তে শ্রেণি সহযোগিতার কথাই বলতেন। তাই শ্রেণি সংগ্রামের পথ এড়িয়ে গ্রাম পুনর্গঠন ও খাদি আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষকদের স্বনির্ভর করে তুলতে চেয়েছিলেন।
  • গান্ধিজির প্রতি কৃষকদের আস্থা – কৃষকরা গান্ধিজিকে মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে বরণ করেছিল। তিনি ছিলেন তাদের কাছে পরিত্রাতা বা অবতার। কৃষকরা অন্তর থেকে বিশ্বাস করত যে, ইংরেজ শাসনের অবসানের পর ভারতে গান্ধিরাজ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তাদের দুঃখের দিন শেষ হবে। গান্ধিজিকে না দেখলেও তাঁর নামের জাদু কৃষকদের সম্মোহিত করেছিল। এজন্য গান্ধিজি পরিচালিত আন্দোলনগুলিতে কৃষকদের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল।

মূল্যায়ণ – 

কংগ্রেস কিষাণ আন্দোলনকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করত। কৃষক আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বপ্রণোদিত ধারাকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করত। কিন্তু কংগ্রেসি নেতাদের আপোষ নীতি ও অহিংসা নীতি কৃষক সমাজকে কংগ্রেসের প্রতি বিমুখ করেছিল। গান্ধিবাদী বাবা রামচন্দ্র কংগ্রেসি নীতিতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত লেনিন ও রাশিয়ার প্রশংসা করতে থাকেন।

কিষাণ আন্দোলনের সঙ্গে বামপন্থীদের সম্পর্ক –

কংগ্রেসি আন্দোলনে হতাশ হয়েই অনেক কৃষক নেতা বামপন্থীদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তবে কমিউনিস্টদের পক্ষে কৃষকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করা কঠিন কাজ ছিল।

  • শ্রেণি সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রতিবন্ধকতা – আদিবাসী কৃষক, বর্গাদার, দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে কমিউনিস্টদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। কিন্তু আঞ্চলিক বৈষম্য, ধর্মীয় বিভেদ, জাতিভেদ প্রথা অর্থাৎ গ্রামীণ সমাজের কাঠামোগত জটিলতা শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে তোলার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। তাছাড়া সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি-প্রভাবিত কমিন্টার্নের নির্দেশে ভারতীয় কমিউনিস্টদের কর্মবিধি নিয়ন্ত্রিত হত বলে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত না। উপরন্তু কৃষকদের মধ্যে সাম্যবাদী মতাদর্শ প্রচার করা হলেও কৃষক শ্রেণি থেকে কোনো কৃষক নেতার আবির্ভাব ঘটেনি।
  • কৃষকদের ওপর কমিউনিস্টদের প্রভাব – বাংলা ও বিহারে কিষাণ সভার ওপর কমিউনিস্টদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। এই সব অঞ্চলে কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের কিষাণ আন্দোলনের বিকল্প হিসেবে নিজেদের একটি ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল – যা কংগ্রেসের কাছে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণে 1937 খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেস তাদের কর্মীদের কিষাণ সভার কার্যাবলী থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছিল। 1938 খ্রিস্টাব্দে বল্লভভাই প্যাটেল বলেন, “Comrade Lenin was not born in this country and we do not want a Lenin here. We want Gandhi and Ramchandra.”
  • বিশ্বযুদ্ধোত্তর কৃষক আন্দোলন নেতৃত্ব – বিশ শতকের চল্লিশের দশকে কিষাণ আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি কমিউনিস্টদের হাতে চলে যায়। স্বাধীনতার প্রাক্কালে যেসব কৃষক আন্দোলন (যেমন- তেভাগা, তেলেঙ্গানা, পুন্নাপ্রা-ভায়লার) সংগঠিত হয়েছিল, সেগুলি কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন পরিচালিত হয়েছিল।

মূল্যায়ণ – 

পরিশেষে বলা যায় যে, কৃষক আন্দোলনকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষকদের অনেকেই কিষাণ সভা ও কংগ্রেসের সদস্যপদ গ্রহণ করেছিল – যা আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী ও মজবুত করতে সাহায্য করেছিল।

বিশ শতকের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদলের সম্পর্ক আলোচনা করো।

ভূমিকা – সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে নতুন ধারার সংযোজন ছিল—শ্রমিক আন্দোলন। 20-এর দশকে শ্রমিক আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ কংগ্রেসের হাতে ছিল। কালের বিবর্তনে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি শ্রমিক আন্দোলনে প্রভাব বিস্তার করে। রুশ বিপ্লব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা, এবং শ্রমিকদের মধ্যে বামপন্থী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটায়।

শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি – প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া ও আন্দোলন সম্পর্কে কংগ্রেসের মনোভাব নেতিবাচক ছিল। কংগ্রেস চায়নি যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন দুর্বল হোক। জাতীয় আন্দোলন অব্যাহত রাখতে দেশীয় শিল্পপতিদের সমর্থন ও আর্থিক সহযোগিতা অপরিহার্য ছিল। তাই শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে শিল্পপতিদের সমর্থন হারাতে কংগ্রেস নারাজ ছিল। অন্যদিকে, শ্রমিক শ্রেণির কাছে স্বাধীনতার চেয়ে নিজেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই প্রাধান্য পেয়েছিল।

শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে গান্ধিজির দৃষ্টিভঙ্গি – কংগ্রেসের অবিসংবাদী নেতা গান্ধিজি 1918 খ্রিস্টাব্দে আমেদাবাদে সূতাকল শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে অনশন সত্যাগ্রহ শুরু করেন। মালিকপক্ষ মজুরি 35% বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। এই সাফল্যে শ্রমিকদের কাছে গান্ধিজির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। তবে এটিই ছিল তাঁর পরিচালিত প্রথম ও শেষ শ্রমিক আন্দোলন। পরবর্তীতে তিনি শ্রমিক আন্দোলনে অনাগ্রহী ছিলেন। গান্ধিজি শ্রেণি সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন না; বরং বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সহযোগিতা ও সহাবস্থানের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলতেন, “Labour should not be allowed to be a pawn in the political chessboard.”

AITUC গঠন – 1919 ও 1920 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের অমৃতসর ও গয়া অধিবেশনে শ্রমিক সংগঠন গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলস্বরূপ, 1920 সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে AITUC (অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস) গঠিত হয়। লালা লাজপত রায় এর প্রথম সভাপতি হন। গান্ধিজি এই সংগঠন গঠনে সহযোগিতা করেননি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় (1920-22) কংগ্রেস শ্রমিকদের দাবির সমর্থনে এগিয়ে আসে। 1928 খ্রিস্টাব্দে জওহরলাল নেহরুর AITUC-এর সভাপতি নির্বাচন শ্রমিক আন্দোলনকে কংগ্রেসের কাছাকাছি নিয়ে আসে।

বামপন্থী ও শ্রমিক আন্দোলন – কংগ্রেস শ্রমিকদের খুশি করতে গিয়ে শিল্পপতিদের বিরাগভাজন হতে চায়নি। কিন্তু কমিউনিস্ট নেতাদের এই ভাবনা ছিল না। তবে কমিউনিস্টদের সংকীর্ণ নীতি কখনো কখনো শ্রমিক স্বার্থের পরিপন্থী ছিল।

বামপন্থী আদর্শের প্রতি শ্রমিকদের ঝোঁক – রুশ বিপ্লব (1917), প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা, এবং জাতীয় আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা শ্রমিক শ্রেণিকে কমিউনিস্ট আদর্শের দিকে আকর্ষিত করে। কমিউনিস্টদের ঘোষিত নীতিই ছিল শ্রেণি সংগ্রাম।

শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট প্রভাব – অসহযোগ আন্দোলন-পরবর্তী কালে শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রসার ঘটে। কমিউনিস্ট নেতারা রাজনৈতিক দাবির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন। তাঁদের নেতৃত্বে গিরনি কামগার ইউনিয়ন (বোম্বাই) সহ নানা শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে, যা সম্পূর্ণরূপে কমিউনিস্ট প্রভাবাধীন ছিল।

মূল্যায়ণ – শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনায় শ্রমিকরা কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ মতভেদ এবং কমিউনিস্টদের পরিবর্তনশীল নীতি শ্রমিক আন্দোলনকে কখনো কখনো বিপথগামী করত।

কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্র প্রসারে জওহরলাল নেহরুর ভূমিকা আলোচনা করো।

প্রথম অংশ – বিশ শতকের 30-এর দশক থেকে কংগ্রেসে বামপন্থী চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। জওহরলাল নেহরু ছিলেন এর মূল প্রবক্তা। 1929 খ্রিস্টাব্দে লাহোর অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি নিজেকে “সমাজতন্ত্রী” ঘোষণা করেন। গান্ধিজি মন্তব্য করেন, “Jawahar is a confirmed socialist.”

জওহরলালের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার উৎস – 1926-27 খ্রিস্টাব্দে ইউরোপ সফরকালে তিনি বামপন্থী চিন্তাবিদ ও কর্মীদের সংস্পর্শে আসেন। 1927 খ্রিস্টাব্দে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। এই সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চিন্তাধারা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

জওহরলাল নেহরুর সমাজতান্ত্রিক কার্যধারা – 1933 খ্রিস্টাব্দে ‘ভারত কোন পথ’ প্রবন্ধে তিনি শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের কথা বলেন এবং সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে পুঁজিবাদের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে 1934 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল গঠিত হয়। তবে তিনি মনে করতেন ভারতে সমাজতন্ত্র স্থানীয় পরিস্থিতির ভিত্তিতে গড়ে উঠবে। তিনি এই দলের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, কিন্তু কখনো সদস্য হননি।
1936 খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, “বিশ্বের ও ভারতের সমস্যা সমাধানের একমাত্র চাবিকাঠি হল সমাজতন্ত্র।” অচ্যুত পটবর্ধন, জয়প্রকাশ নারায়ণ ও নরেন্দ্র দেবকে কার্যকরী সমিতিতে অন্তর্ভুক্ত করে বামপন্থী প্রভাব বৃদ্ধি করেন। 1935 খ্রিস্টাব্দের ব্রিটিশ প্রস্তাবিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও মন্ত্রীত্ব গ্রহণের তিনি বিরোধিতা করেন, কারণ এতে কংগ্রেসের “সংগ্রামী চরিত্র” ক্ষুণ্ণ হবে।

গান্ধি-নেহরু বিতর্ক কী?

গান্ধি-নেহরু বিরোধ – গান্ধিজি চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্রীদের হাতে কংগ্রেসের দায়িত্ব দিয়ে নেহরুর ভাবোচ্ছাস নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ভারতীয় সমাজতন্ত্রের প্রভাব খর্ব করতে। কিন্তু তা সফল হয়নি। ফলস্বরূপ, রাজেন্দ্র প্রসাদ, জে.বি. কৃপালনী, বল্লভভাই প্যাটেল ও রাজাগোপালাচারী প্রমুখ দক্ষিণপন্থী নেতারা ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। গান্ধি-নেহরুর মতপার্থক্য ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস ইস্যুতে বিদ্যমান ছিল, কিন্তু লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে গান্ধির নির্দেশে নেহরুর সভাপতিত্ব ও সমাজতান্ত্রিক বক্তব্য গান্ধিজিকে অসন্তুষ্ট করে। গান্ধিজি স্পষ্ট বলেন, “জওহরের পথ আমার পথ নয়,” এবং শ্রেণি সংগ্রামের বিরোধিতা করার ঘোষণা দেন।

নেহরুর আত্মসমর্পণ – নেহরু উপলব্ধি করেছিলেন যে গান্ধিজিই কংগ্রেসের প্রাণশক্তি। বামপন্থী অবস্থান বজায় রাখার চেয়ে গান্ধির ছত্রছায়ায় থাকাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ গান্ধির সমর্থন হারানো রাজনৈতিক মৃত্যুর সমান। ফলে তিনি সম্পূর্ণভাবে গান্ধিজির নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

সমাজতন্ত্র প্রসারে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান বর্ণনা করো।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বিকাশের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সমাজতান্ত্রিক ভাবনার প্রতি অবিচল থাকতে গিয়ে কংগ্রেস থেকে তাঁকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। আসলে ঘরে-বাইরে তিনি ছিলেন আপোষহীন সংগ্রামী নায়ক।

সুভাষের সমাজতান্ত্রিক ভাবনার উৎস – স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাচেতনা, ত্যাগ ও সেবার আদর্শ সুভাষচন্দ্রকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। বিবেকানন্দের মতোই সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, ভারতবাসীর বড় অভিশাপ হল দারিদ্র্য এবং এই দারিদ্র্যের মূল কারণ ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ। তিনি মনে করতেন, সমাজতন্ত্রের উদ্ভব কার্ল মার্কস থেকে হয়নি, তার শিকড় নিহিত ছিল ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে।

সুভাষচন্দ্রের সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা – তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি সম্পদের সুষম বণ্টন ও সামাজিক অসাম্য দূর করার কথা বলেছিলেন। সুভাষচন্দ্র নিজেকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী বলেছেন। তিনি চেয়েছিলেন, ভারতবর্ষের নিজস্ব সমাজতন্ত্র গড়ে উঠুক তার নিজের ভূগোল ও ইতিহাসের ভিত্তিতে—যা সমন্বয় সাধিত সমাজতন্ত্র গঠনে সহায়তা করবে। লাহোরে অনুষ্ঠিত ছাত্র সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, এই স্বাধীনতার লক্ষ্য কেবল রাজনৈতিক বন্দিদশা থেকে মুক্তি নয়; এর লক্ষ্য সম্পদের সমবণ্টন, জাতিভেদ প্রথার অবসান ও সামগ্রিক সাম্যের প্রতিষ্ঠা। এই স্বাধীনতার লক্ষ্য সাম্প্রদায়িকতার অবসান এবং ধর্মীয় সহনশীলতার বাতাবরণ তৈরি করা। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য তিনি ইয়ং ইতালি দলের আদর্শে ভারতের ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি নানা স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

হরিপুরা কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচন – কংগ্রেসের বামপন্থী গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে 1938 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস সভাপতির পদে আসীন করা হয়। সুভাষচন্দ্র বামপন্থী মনোভাব এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী মানসিকতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। গান্ধিজির আপোষমুখী মনোভাবের তিনি ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। মত ও পথের তীব্র সংঘাত সত্ত্বেও গান্ধিজি সুভাষকে সভাপতি করার প্রস্তাব দেন। অনেকে বলেন, বামপন্থীদের চাপ ও সুভাষের প্রতি অবহেলার প্রতিদান হিসেবে গান্ধিজি তাঁকে সভাপতি পদে মনোনীত করেছিলেন।

গান্ধি-সুভাষ বিরোধের সূত্রপাত – হরিপুরা অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্র গঠন (1935-এর ভারতশাসন আইনানুযায়ী) ও মন্ত্রীসভা গঠনের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলিকে কংগ্রেসের অধীনে এনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মঞ্চ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। সুভাষচন্দ্র ভারতে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের কর্মপন্থাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানান এবং সোভিয়েত রাশিয়ার ধাঁচে ভারতের পুনর্গঠনের জন্য প্ল্যানিং কমিশন গঠনের কথা বলেন। সভাপতি রূপে সুভাষের কার্যাবলি ও চিন্তাধারা গান্ধিজি অনুমোদন করতে পারলেন না। রাশিয়ার অনুকরণে প্ল্যানিং কমিশন গঠন করার প্রস্তাবও গান্ধি মেনে নিতে পারলেন না। এইরূপ নানা প্রশ্নে গান্ধি-সুভাষের মতপার্থক্য প্রকট হয়ে উঠতে লাগল।

কংগ্রেস থেকে সুভাষচন্দ্র বসুকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল কেন?

ত্রিপুরি অধিবেশন ও সুভাষচন্দ্র – 1939 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের ত্রিপুরি অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বারের জন্য সভাপতি পদে প্রার্থী হলে গান্ধিজি আপত্তি জানান। এতদিন পর্যন্ত গান্ধিজিই কংগ্রেস সভাপতি মনোনীত করতেন এবং কারোর কোনো আপত্তি উঠত না। গান্ধিজি ত্রিপুরি কংগ্রেসে মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে সভাপতি মনোনীত করেন। কিন্তু তিনি রাজি না হওয়ায় পট্টভি সীতারামাইয়াকে প্রার্থী মনোনীত করা হয়। মনোনয়ন প্রত্যাহারের ব্যাপারে কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতির অনুরোধ সত্ত্বেও সুভাষ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। 29 জানুয়ারি 1939 খ্রিস্টাব্দে এই নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র 203 টি ভোটের ব্যবধানে (সুভাষের পক্ষে 1580 এবং বিপক্ষে 1377) গান্ধি-মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করেন।

প্রতিক্রিয়া – সুভাষচন্দ্রের বিজয়লাভে গান্ধিজি ও তাঁর অনুগত দক্ষিণপন্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

সভাপতির পদে ইস্তফা – সুভাষচন্দ্র জানতেন যে, সংগঠন চালানোর জন্য গান্ধিজির নেতৃত্ব ও সহযোগিতা আবশ্যিক। কিন্তু সুভাষের প্রতি গান্ধিজির অনমনীয় মনোভাব তাঁকে হতাশ করে। হতাশ সুভাষ মন্তব্য করেন, “আমি যখন দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষটির আস্থা হারিয়েছি, তখন আমার আর সভাপতি থেকে কাজ নেই।” অতঃপর 29 এপ্রিল 1939 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদে ইস্তফা দেন।

ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন – অতঃপর 3 মে 1939 খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই ফরওয়ার্ড ব্লক নামে এক নতুন দল গঠন করেন। সুভাষচন্দ্র নিজেই এই দলের সভাপতি হন। তিনি বামপন্থীদের সংঘবদ্ধ করার জন্য কংগ্রেসের উপদল হিসেবে ফরওয়ার্ড ব্লককে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল, কমিউনিস্ট পার্টি ও মানবেন্দ্রনাথ রায়ের গোষ্ঠী — কেউই তাঁর সাথে এক সঙ্গে চলতে রাজি হল না।

কংগ্রেস থেকে বহিঃস্কার – সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ এনে 11 আগস্ট 1939 খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্রকে তিন বছরের জন্য কংগ্রেসের কোনো পদ গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এভাবেই কংগ্রেসের রাজনীতি থেকে সুভাষচন্দ্রের চিরবিদায় ঘটে। তিনি আর কোনো দিন কংগ্রেসে ফিরে আসেননি। এভাবেই শেষ পর্যন্ত বামপন্থী ঐক্যের স্বপ্ন মরীচিকার মতো মিলিয়ে যায়।

বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণের চরিত্র বিশ্লেষণ করো।

অথবা, বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী দলগুলির ভূমিকা আলোচনা করো।

ভূমিকা – ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল এই পার্টি। তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আবর্তিত হত। তাই জাতীয় আন্দোলনে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণিকে শামিল করার মহান কৃতিত্বের দাবিদার ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি।

লেনিনের ঔপনিবেশিক চিন্তাধারা – 1920 খ্রিস্টাব্দে কমিন্টার্নের (তৃতীয় আন্তর্জাতিকের) দ্বিতীয় কংগ্রেসে লেনিন পরামর্শ দেন যে, ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে স্বাধীনতালাভের জন্য যে জাতীয় আন্দোলন চলছে, কমিউনিস্টদের উচিত এই আন্দোলনে শামিল হওয়া। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত কমিন্টার্নের নির্দেশে ভারতীয় কমিউনিস্টদের কর্মপদ্ধতি পরিচালিত হত। তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। চতুর্থ ও পঞ্চম কমিন্টার্নের অধিবেশনেও কমিউনিস্টদের সমাজতান্ত্রিক চরিত্র বজায় রেখে জাতীয় আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সপ্তম কমিন্টার্ন (1935 খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত এই ধারা বজায় ছিল।

কমিউনিস্টদের দ্বিস্তর কৌশল – এম. এন. রায় অত্যন্ত সুচতুরভাবে দলের দুটি ভাবমূর্তি গঠনের কৌশলের কথা বলেন। একটি হল – জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোতে যোগদান দ্বারা আইনগত ও বৈধভাবে আন্দোলন করা। অপরটি হল গোপনে শ্রমিক-কৃষক সংগঠন দ্বারা দলের নিজস্ব ভিত্তি শক্ত করা।

বামপন্থীদের ভূমিকা – উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের অংশগ্রহণের বিভিন্ন দিকগুলি হল—

সাইমন কমিশনবিরোধী আন্দোলন – 1928 খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন ভারতে এলে কংগ্রেসের তরফে যে ব্যাপক বিক্ষোভ কর্মসূচি নেওয়া হয়, তাতে বামপন্থীরা অংশ নেয়। এর পাশাপাশি কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শিল্প-শ্রমিকদের ধর্মঘট ইংরেজ সরকারকে বিপাকে ফেলেছিল। এভাবে কমিউনিস্টরা নিজেদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তুলে ধরে।

পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি – কমিউনিস্ট দলের সদস্যরা জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে উপস্থিত থেকে 1926 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্রমাগত পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে এসেছিল — যা 1929 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে পূর্ণতা পায়।

চরিত্রগত বদল – একদিকে লেনিনের মৃত্যু (1924), অপরদিকে এম. এন. রায়ের পরিবর্তে ভারত বিষয়ক ব্র্যাডলির (Bradley) দায়িত্ব গ্রহণ জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণে চরিত্রগত বদল ঘটায়। কংগ্রেসের জনপ্রিয় নেতাদের প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিয়ে সোভিয়েত ধাঁচে বিপ্লব সংঘটিত করার দিবাস্বপ্ন দেখা শুরু করে কমিউনিস্টরা। এর ফলে জাতীয় আন্দোলনে যোগদানে কমিউনিস্টরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়।

ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠন – 1934 খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট দল বেআইনি ঘোষিত হয়। এই পরিস্থিতিতে 1936 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কমিউনিস্টদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে রাজি হয়। ব্র্যাডলিও কমিউনিস্টদের জাতীয় কংগ্রেসে যোগদানের নির্দেশ দেন। এই পর্বে ইউরোপ জুড়ে বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় এবং ফ্যাসিবাদের উত্থানে কমিন্টার্ন বিচলিত হয়ে পড়ে। কমিন্টার্নের তরফ থেকে কমিউনিস্টদের ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।

নৌবিদ্রোহে অংশগ্রহণ – 1946 খ্রিস্টাব্দে নৌবিদ্রোহে একমাত্র কমিউনিস্টরাই সমর্থন জানিয়েছিল। কমিউনিস্ট নেতা ডাঃ গঙ্গাধর অধিকারী এক বিবৃতির মাধ্যমে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে এই বিদ্রোহে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে আহ্বান জানান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতীয় কমিউনিস্ট – বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় (1939) কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদ এবং যুদ্ধের বিরোধিতা করলেও যুদ্ধে রাশিয়ার যোগদান (1941) সমস্ত ভাবনাকে এলোমেলো করে দেয়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধকে কমিউনিস্টরা রাতারাতি জনযুদ্ধ আখ্যা দেয়। সমাজতন্ত্রের পিতৃভূমি সোভিয়েত রাশিয়া নাৎসি জার্মানির দ্বারা আক্রান্ত হলে ভারতীয় কমিউনিস্ট দল সোভিয়েত রাশিয়ার মিত্র ব্রিটেনকে সমর্থন জানায়। যুদ্ধরত ব্রিটিশ সরকারকে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে।

বিশ্বযুদ্ধোত্তর কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব – বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বাংলার তেভাগা আন্দোলন বা তেলেঙ্গানা সংগ্রামের কাহিনির সঙ্গে কমিউনিস্টরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালনায় এই আন্দোলনগুলি পরিচালিত হয়েছিল।

মূল্যায়ণ – ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে কমিউনিস্টরা সংহতিপূর্ণ কাজ করেছিল। ক্ষমতা হস্তান্তরের ঠিক আগে দেশীয় রাজ্যগুলির রাজারা (যেমন- ত্রিবাঙ্কুর) ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যে চক্রান্ত শুরু করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে কমিউনিস্টরা দেশীয় রাজ্যসমূহের ভারতভুক্তির কাজটি সহজ করে দিয়েছিল। তবে কখনো কখনো এরা উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে চরিত্রগত বদল ঘটিয়েছিল।

1925 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1947 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ বর্ণনা করো।

রুশ বিপ্লবের পর থেকেই ভারতে কমিউনিস্ট আদর্শের বিস্তার ঘটতে থাকে। রুশ বিপ্লবের সাফল্য ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে নতুন ভাবনার দিকে চালিত করে। যার ফলশ্রুতিতে ভারতেও বামপন্থী চিন্তাধারার আনাগোনা শুরু হয়।

কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা – 

রাশিয়ার তাসখন্দে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশানালের দ্বিতীয় অধিবেশনে পরাধীন দেশগুলির স্বাধীনতার প্রশ্নে গুরুত্ব দেওয়া হলে ভারতবাসীও সাম্যবাদী আন্দোলনের শরিক হওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং অপরাপর কতিপয় প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী 17 অক্টোবর, 1920 খ্রিস্টাব্দে এখানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করে। এ প্রসঙ্গে খিলাফত নেতাদেরও ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

ভারতে কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর বিস্তার – 

এদিকে ভারতে বহু নিবেদিত শ্রমিক, কর্মী ও বিপ্লবী নিজ নিজ ইচ্ছায় কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এঁদের মধ্যে বাংলায় মুজফ্ফর আহমদ, বোম্বাইয়ে এস. এ. ডাঙ্গে, মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার, লাহোরে গোলাম হোসেন উল্লেখযোগ্য। এঁরা গান্ধী-নীতিতে আস্থা হারিয়ে মার্কসবাদে আস্থা জ্ঞাপন করেন। এঁদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এম. এন. রায় নলিনীগুপ্ত ও শওকত উসমানীকে ভারতে পাঠান।

কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা – 

ভারতে কমিউনিস্ট আদর্শকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়ার জন্য কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মিথ্যা মামলা সাজানো হয়। শওকত উসমানী, নলিনী গুপ্ত, মুজফ্ফর আহমদ, এস. এ. ডাঙ্গে প্রমুখের বিরুদ্ধে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। এর ফলে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্দোলন জোর ধাক্কা খায়।

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা – 

ভারতের কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য 1925 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ভারতের সমস্ত কমিউনিস্ট গোষ্ঠী কানপুরে এক সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট সম্মেলনে মিলিত হয়। এখানে জন্মলাভ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন জানকীপ্রসাদ বাগের হাট্টা এবং এস. ভি. ঘাটে।

কার্যকলাপ – 

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপের বিভিন্ন দিককে এভাবে চিহ্নিত করা যায়—

  • ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস পার্টি গঠন – কংগ্রেসের সমাজতন্ত্রী ব্যক্তি এবং কমিউনিস্টদের প্রচেষ্টায় 1928 খ্রিস্টাব্দে বাংলা, বোম্বাই, পাঞ্জাব ও যুক্তপ্রদেশে গঠিত হয় ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস পার্টি। 1928 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় এই সংগঠনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বভারতীয় সম্পাদক হন এন. আর. নিম্বকার। এই সময় বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা কমিউনিস্ট আদর্শ প্রচারে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। এগুলির মধ্যে বাংলার ‘লাঙল’, বোম্বাইয়ের ‘ক্রান্তি’, লাহোরের ‘কীর্তি’ ও ‘কিষাণ’, ‘ইনকিলাব’, মাদ্রাজের ‘দ্য ওয়ার্কার’ উল্লেখযোগ্য। শ্রমিক আন্দোলনে এই সংগঠন সাফল্য পেলেও কৃষক আন্দোলনে তেমন কোনো দিশা দেখাতে পারে নি।
  • মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা – শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকলে ব্রিটিশরা বিচলিত হয়ে পড়ে। এইরূপ পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট তৎপরতা দমনের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার করে 32 জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা রুজু করা হয়— যা মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা বলে খ্যাত। সাড়ে 4 বছর ব্যাপী এই মামলা চলার পর 27 জনের দীর্ঘমেয়াদি দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
  • কমিউনিস্টদের অগ্রগতি – কমিউনিস্টদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা কমিউনিস্ট আন্দোলনকে খানিকটা পিছিয়ে দেয়। কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়। তবে 7ম কমিন্টার্নের নির্দেশে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন বেশ উজ্জীবিত হয়। এই সময় জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর মতো সমাজতন্ত্রী নেতার আবির্ভাব এবং কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে তাঁদের নির্বাচন কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথ মসৃণ করে।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট প্রসার – 20 শতকের 30-এর দশকে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনগুলি বামপন্থী ঘেঁষা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলা ও বিহারে কৃষক আন্দোলনে কমিউনিস্টরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। 2য় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে কমিউনিস্ট দল যুদ্ধবিরোধী জঙ্গী আন্দোলন শুরু করে। ইতিমধ্যে 1942 খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট দলের ওপর বেআইনি তকমা তুলে নেওয়া হয় এবং কমিউনিস্টরা জাতীয় আন্দোলনের চরিত্র বদল করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধকে জনযুদ্ধ আখ্যা দিয়ে ব্রিটিশদের প্রতি সহযোগিতার নীতি নেয়। এই সময় থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র প্রভৃতি কমিউনিস্ট গণসংগঠনগুলি ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।

মূল্যায়ণ –

1925 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আত্মপ্রকাশ করলেও 2য় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এই দল কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নি। এর অন্যতম কারণ ছিল— ভারতীয় পরিস্থিতির সঙ্গে রাশিয়ার পার্থক্য। তবুও নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্যে এই দল ভারতের আপামর জনমানসে ছাপ ফেলাতে পেরেছিল— এটাই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।


আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায় “বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর “ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Please Share This Article

Related Posts

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে কৃষক সমাজ কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিল?

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে কৃষক সমাজ কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিল?

কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল সম্পর্কে টীকা লেখো।

কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল সম্পর্কে টীকা লেখো।

সারা ভারত কিষান সভা কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?

সারা ভারত কিষান সভা কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?

About The Author

Solution Wbbse

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে কৃষক সমাজ কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিল?

কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল সম্পর্কে টীকা লেখো।

সারা ভারত কিষান সভা কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?

বারদৌলি সত্যাগ্রহের প্রতি জাতীয় কংগ্রেসের কীরূপ মনোভাব ছিল?

‘একা’ আন্দোলন সম্পর্কে টীকা লেখো।