এখনই আমাদের Telegram Community গ্রুপে যোগ দিন।। এখানে WBBSE বোর্ডের পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির যেকোনো বিষয়ভিত্তিক সমস্যা শেয়ার করতে পারেন এবং একে অপরের সাহায্য করতে পারবেন। এছাড়া, কোনও সমস্যা হলে আমাদের শিক্ষকরা তা সমাধান করে দেবেন।

Telegram Logo Join Our Telegram Community

ষষ্ঠ শ্রেণী – ইতিহাস – খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতীয় উপমহাদেশ (রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ধর্মের বিবর্তন-উত্তর ভারত) – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের পঞ্চম অধ্যায়, ‘খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতীয় উপমহাদেশ (রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ধর্মের বিবর্তন-উত্তর ভারত)’ অধ্যায়ের কিছু রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও সহায়ক। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণী এবং চাকরির পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই আসতে দেখা যায়।

ষষ্ঠ শ্রেণী – ইতিহাস – খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতীয় উপমহাদেশ
ষষ্ঠ শ্রেণী – ইতিহাস – খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতীয় উপমহাদেশ
Contents Show

ষোড়শ মহাজনপদ সম্পর্কে লেখো।

অথবা, ষোড়শ মহাজনপদ – টীকা লেখো।

‘মহাজনপদ’ শব্দের অর্থ বৃহৎ রাজ্য। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে এরূপ 16টি জনপদ বা রাজ্যের উদ্ভব হয়।

অবস্থান – এই জনপদগুলি বর্তমান আফগানিস্তানের কাবুল থেকে দক্ষিণ ভারতের গোদাবরী নদী উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তবে এর অধিকাংশই গড়ে উঠেছিল বর্তমান উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার অথবা গঙ্গা-যমুনা বিধৌত সমভূমিতে। জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যে উত্তর ভারতে এরূপ 16টি রাজ্যে ষোড়শ মহাজনপদের নামোল্লেখ আছে।

ষোড়শ মহাজনপদ – এই 16টি রাজ্য হল-অঙ্গ, মগধ, কাশী, কোশল, অবন্তি, বৎস, বৃজি, মল্ল, চেদি, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস্য, শূরসেন, অস্মক, গান্ধার, কম্বোজ।

বৈশিষ্ট্য –

  • অধিকাংশই মহাজনপদ ছিল রাজতন্ত্রশাসিত। কিছু ছিল গণরাজ্য, যেমন-বৃজি ও মল্ল।
  • মহাজনপদগুলি ছিল পরস্পর বিবদমান।
  • মহাজনপদের শাসকেরা সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবাপন্ন ছিলেন।

পরিণতি –

এই রাজ্যগুলির মধ্যে নানা কারণে লাগাতার দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ লেগেই থাকত। ফলে অনেক রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কোশল, মগধ, বৎস ও অবন্তি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই চারটি মহাজনপদ আবার নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করত। তাদের মধ্যে শেষপর্যন্ত মগধ হয়ে ওঠে সবথেকে বেশি শক্তিশালী। কাবুল থেকে দক্ষিণ ভারতের গোদাবরী নদী উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তবে এর অধিকাংশই গড়ে উঠেছিল বর্তমান উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার অথবা গঙ্গা-যমুনা বিধৌত সমভূমিতে। জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যে উত্তর ভারতে এরূপ 16টি রাজ্যে ষোড়শ মহাজনপদের নামোল্লেখ আছে।

ষোড়শ মহাজনপদের মানচিত্র
ষোড়শ মহাজনপদের মানচিত্র

গুরুত্ব –

এর ফলে ভারতে প্রথম একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্রের সূচনা হয় এবং ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

মগধ রাজ্যের উত্থানের কারণ আলোচনা করো।

অথবা, ষোলটি মহাজনপদের মধ্যে থেকে মগধের সবথেকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার কারণ ব্যাখ্যা করো।

অথবা, “মগধের উত্থান প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য সম্ভব হয়েছিল” – মগধ জনপদটির ভৌগোলিক অবস্থান আলোচনা করে মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বৃহত্তম শক্তি হিসেবে মগধের আত্মপ্রকাশ ঘটে। অন্যান্য 15টি মহাজনপদের তুলনায় মগধের উত্থানের পিছনে তার প্রাকৃতিক পরিবেশ বিশেষ সাহায্য করেছিল।

মগধ রাজ্যের উত্থানের কারণ

  • শক্তিশালী শাসকবৃন্দ – বিম্বিসার, অজাতশত্রু, শিশুনাগ এবং মহাপদ্মনন্দের মত উদ্যমী শাসকবৃন্দের অবদান মগধের অগ্রগতির অন্যতম কারণ ছিল।
  • নদী ও পাহাড়ে ঘেরা – গঙ্গা, চম্পা ও শোন নদী দ্বারা ঘেরা মগধ ছিল নিরাপদ, মগধের প্রথম রাজধানী রাজগৃহ ছিল পাঁচটি পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত। ফলে সে বহিঃশত্রুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেত।
  • হস্তীসংকুল ঘন অরণ্য – মগধের পূর্বাঞ্চল ছিল হস্তীসংকুল ঘন অরণ্য। এই ঘন অরণ্য কোনো শত্রুর পক্ষে ভেদ করা ছিল অসম্ভব।
  • নন্দ রাজার অবদান – অরণ্য থেকে হস্তী সংগ্রহ করে নন্দ রাজারা এক বিপুল রণহস্তী বাহিনী গড়ে তুলেছিল।
  • ঐতিহাসিকদের মত – ঐতিহাসিক এ এল ব্যাসাম এবং রোমিলা থাপার মগধের উত্থানের জন্য গাঙ্গেয় উপত্যকার উর্বরতা এবং সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন।
  • বনজ ও খনিজ সম্পদ – মগধ ছিল বনজ ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধশালী। সেখানে লোহার প্রাচুর্য ছিল। ফলে তার অর্থনীতি ছিল খুবই মজবুত।

বুদ্ধদেব বজ্জিদের কতগুলি নিয়ম মানতে বলেছিলেন? নিয়মগুলি কী কী?

অথবা, বজ্জিদের উন্নতির সাতটি নিয়ম লেখো।

অথবা, বজ্জিদের দেওয়া গৌতম বুদ্ধের উপদেশাবলি লেখো।

বুদ্ধদেব বজ্জিদের সাতটি নিয়ম মেনে চলতে বলেন। কারণ মগধের রাজা অজাতশত্রু একবার বজ্জিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই বিষয়ে গৌতম বুদ্ধের মতামত জানতে বজ্জিদের পক্ষে একজন কর্মচারীকে বুদ্ধের কাছে পাঠানো হয়। বুদ্ধ তখন নিজের শিষ্য আনন্দের সঙ্গে সে বিষয়ে কথাবার্তা বলেন। ওই আলোচনায় বজ্জিদের দেওয়া বুদ্ধের উপদেশের মধ্যে সাতটি নিয়মের কথা ওঠে। বুদ্ধ বলেন, সেই নিয়মগুলি মেনে চললে বজ্জিদের উন্নতি হবে। রাজা অজাতশত্রু বজ্জিদের কোনোভাবেই হারাতে পারবেন না।

বজ্জিদের উন্নতির সাতটি নিয়ম –

  • বজ্জিদের প্রায়ই সভা করে রাজ্য চালাতে হবে।
  • বজ্জিদের সব কাজ সবাই মিলে একজোট হয়ে করতে হবে।
  • বজ্জিদের নিজেদের বানানো আইন অনুসারে চলতে হবে।
  • বজ্জি সমাজে বয়স্ক মানুষদের কথা শুনে চলতে হবে ও তাদের সম্মান করতে হবে।
  • বজ্জি সমাজে নারীদের সবসময় সম্মান করে চলতে হবে।
  • বজ্জিদের এলাকায় অবস্থিত সমস্ত দেবতার মন্দিরের যত্ন নিতে হবে।
  • নিজেদের অঞ্চলে গাছপালা ও পশুপাখিদের ওপর অত্যাচার করা যাবে না।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে নব্যধর্ম (প্রতিবাদী) আন্দোলন কেন হয়েছিল? অথবা, নব্যধর্ম আন্দোলন কেন শুরু হয়েছিল?

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক ছিল এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। কারণ এই সময় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বিরোধী নব্যধর্মের উদ্ভব হয়।

নব্যধর্ম আন্দোলনের কারণ/পটভূমি

  • সামাজিক কারণ – বৈদিক সমাজে বর্ণভেদের সুফল অর্থাৎ বেশি সুযোগসুবিধা ভোগ করত বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণরা। ফলে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের ক্ষোভ জমতে থাকে। শূদ্ররা ছিল সমাজের অবহেলিত শ্রেণি। তারা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য অন্যান্য ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে।
  • রাজনৈতিক কারণ – খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে বেশ কিছু গণরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছিল। এই গণরাজ্যগুলিতে ব্যক্তিস্বাধীনতার সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বর্ণ ও জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা কমে
  • ফলে এই গণরাজ্যগুলি হয়ে ওঠে নব্যধর্ম আন্দোলনের রাজনৈতিক পটভূমি।
  • অর্থনৈতিক কারণ – খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে লোহার তৈরি কৃষি সরঞ্জামের সাহায্য নিয়ে এক নতুন কৃষক শ্রেণির উত্থান ঘটে। এই সময় ব্যাবসাবাণিজ্য করে বৈশ্য শ্রেণি আর্থিক উন্নতি ঘটায়। এই কৃষক ও বণিক সম্প্রদায় মিলিতভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করে। কেন-না ব্রাহ্মণ্য ধর্মে পালিত পশুবলি প্রথায় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হত। বাণিজ্যের জন্য সমুদ্রযাত্রা প্রয়োজন হত। অথচ ব্রাহ্মণ্য ধর্মে সমুদ্রযাত্রাকে পাপ বলে গণ্য করা হত। ব্যাবসা চালাতে গেলে পয়সার লেনদেনে ও সুদে টাকা খাটানো দরকার হত। কিন্তু সুদ নেওয়া ব্রাহ্মণ্য ধর্মে নিন্দার বিষয় ছিল।
  • ধর্মীয় কারণ – খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতবাসীর চিন্তাজগতে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। যাগযজ্ঞ ও আড়ম্বরপূর্ণ আচার – অনুষ্ঠানের পরিবর্তে তারা সৎ চিন্তা ও আচরণের মাধ্যমে ঈশ্বরের করুণালাভে সচেষ্ট হয়। এই চিন্তাধারা নব্যধর্ম আন্দোলনের উত্থান ঘটাতে সাহায্য করে।

প্রতিবাদী বা নব্যধর্ম আন্দোলনের উত্থানে ধর্মীয়, ভাষাগত ও রাজনৈতিক কারণ আলোচনা করো।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে নানা কারণে প্রায় 64টি নব্য ধর্মমতের উদ্ভব হয়। সেই তালিকায় ছিল জৈন, বৌদ্ধ, আজীবিক ধর্ম ইত্যাদি।

প্রতিবাদী বা নব্যধর্ম আন্দোলনের উত্থান

ধর্মীয় কারণ – প্রতিবাদী ধর্ম উত্থানের পিছনে ধর্মীয় কারণগুলি হল নিম্নরূপ –

  • ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কঠোরতা – অনুষ্ঠান সর্বস্বতা, ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞ প্রভৃতির ফলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম জনপ্রিয়তা হারায়। অন্যদিকে সহজ-সরল প্রতিবাদী ধর্মগুলি জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
  • নিম্নবর্ণের ক্ষোভ – নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বৈদিক ধর্ম। পালনের সুযোগ না পেয়ে মনে মনে ক্ষুদ্ধ ছিল, কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে সে সমস্যা ছিল না।
  • ঐতিহাসিক বিবর্তন – ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফলে হিন্দু ধর্মের পর বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান ঘটে।
  • বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাব – বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উদার ধর্মচিন্তা ও ধর্মপ্রচারকদের প্রভাব তথা যুগপোযোগী। ধর্মীয় নির্দেশ এই ধর্মের উত্থানে সাহায্য করেছিল।

ভাষাগত কারণ – বৈদিক আর্যদের প্রধান ভাষা ছিল সংস্কৃত কিন্তু এই ভাষা সাধারণ মানুষের কাছে জটিল ও দুর্বোধ্য বলে মনে হত। অপরদিকে বৌদ্ধ ধর্মের পালি ভাষা সর্বসাধারণের কাছে সহজবোধ্য ছিল।

রাজনৈতিক কারণ – এই সময় রাজার চরম আধিপত্য ও কঠোর নিয়মকানুন জনগণের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। অন্যদিকে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে রাজনৈতিক আদর্শের বদলে গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছিল।

মূল্যায়ন – ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আচারসর্বস্ব রীতিনীতি ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান ঘটেছিল। এই আন্দোলনে জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা ও অহিংসা মূল আদর্শ রূপে প্রকাশ পেয়েছে।

জেনে রাখো – জৈনরা দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। যথা – শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর। বৌদ্ধরাও দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। যথা – হীনযান ও মহাযান।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে প্রতিবাদী ধর্ম বলা যায় কি?

অথবা, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সাদৃশ্য লেখো।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে প্রতিবাদী ধর্ম বলা যায় কিনা তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। অনেকের মতে, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গড়ে উঠেছিল বলে একে প্রতিবাদী ধর্ম বলা উচিত।

প্রতিবাদী ধর্ম হিসেবে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের কিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল। যেমন –

বৌদ্ধ ও জৈনরা বেদের অপৌরুষেয়তা স্বীকার করে না। যাগযজ্ঞাদি, ক্রিয়াকর্মকে তারা মোক্ষের সোপান বলে মনে করে না। হিন্দু বর্ণাশ্রম ও জাতিভেদ উভয় ধর্মই স্বীকার করে না। অপর মত অনুসারে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অনেক মিল লক্ষ করা যায়। যেমন – বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম সম্পূর্ণ বেদ বিরোধী ছিল না এবং এটি নতুন কোনো ধর্মমতও নয়। হিন্দু ধর্মের একটি শাখা ছিল এই ধর্ম। দর্শনের দিক থেকে বিচার করলে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে উপনিষদেরই প্রতিধ্বনি বলা যেতে পারে। সবশেষে উভয় দিক বিচার করে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে প্রতিবাদী ধর্ম বলা যায়।

কেন বৌদ্ধরা হীনযান ও মহাযানে বিভক্ত হয়ে যায়?

জীবনযাপন ও ধর্মীয় আচরণ বিষয়ে বৌদ্ধ সংঘে মতবিরোধ তৈরি হয়। বেশ কিছু সন্ন্যাসী আমিষ খাবার খেতে থাকেন, দামি, ভালো পোশাক পরতে থাকেন। সোনা-রুপো দান হিসেবে নিতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে কিছু সন্ন্যাসী প্রায় পারিবারিক জীবনযাপন শুরু করেন।

বৌদ্ধদের বিভাজন

  • নতুন দল – সংঘের নিয়মনীতি শিথিল হতে থাকে। এর ফলে বৌদ্ধ ধর্মে মহাযান নামে এক নতুন ধরনের দল তৈরি হয়।
  • মূর্তিপুজো – কুষাণ আমল থেকে বুদ্ধের মূর্তিপুজোর চল শুরু হয়। মহাযানরা মূর্তিপুজোর সমর্থক ছিলেন। এর ফলে পুরোনো মতে বিশ্বাসী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা মহাযান মতের বিরোধী হয়ে যান। তাঁরা হীনযান নামে পরিচিত হন।
  • চূড়ান্ত বিভাজন – চতুর্থ বৌদ্ধ মহাসংগীতিতেই হীনযান ও মহাযানরা সম্পূর্ণভাবে আলাদা হয়ে যায়।

ভারতের ইতিহাসে জৈনধর্মের প্রভাব কী পড়েছিল?

ভারতীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মে জৈনধর্মের প্রভাব সুদূরপ্রসারী, কারণ –

  • জৈনদের ইতিবাচক ভূমিকা – খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনমানসে জৈনরা এক ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল। কারণ, জৈনধর্মের সমতার বাণী তৎকালীন সমাজে অবহেলিত মানুষকে দেখিয়েছিল বাঁচার পথ।
  • বর্ণভেদ ও অস্পৃশ্যতা – বর্ণভেদ ও অস্পৃশ্যতা ছিল বৈদিক সমাজের চরম অভিশাপ। এই অভিশাপ নিয়ে বেঁচে ছিল শূদ্রেরা। স্বভাবতই জৈনধর্মের সমতার নীতি মানুষকে দেখায় আলোর পথ।
  • আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব – সংস্কৃত ভাষা বাদ দিয়ে আঞ্চলিক ভাষার প্রাধান্যের ওপর জোর দেয় জৈনধর্ম। ফলে প্রাকৃত ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। এ ছাড়া গুজরাটি, তামিল ও কন্নড় ভাষাতেও জৈনধর্মের আলোচনা হয় যা ভাষাগুলিকে সমৃদ্ধ করে।
  • জৈন দার্শনিকদের আবির্ভাব – এযুগে ভদ্রবাহু, হেমচন্দ্র, সিদ্ধসেন, হরিভদ্রের মতো প্রথিতযশা জৈন দার্শনিক জন্মগ্রহণ করেন, যাঁদের লেখনী ভারতীয় সাহিত্যকে বহুগুণ সমৃদ্ধ করেছিল।
  • স্থাপত্য ও ভাস্কর্যকর্ম – ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যকর্মে জৈনধর্ম ও তার বিষয়বস্তু গভীর প্রেরণা জুগিয়েছিল। এরই প্রভাবে গড়ে উঠেছিল ভারতের প্রাচীন মন্দির, গুহা ও চৈত্যশিল্প, যেমন – উদয়গিরির গুহা, জুনাগড়ের জৈন মন্দির, ইলোরার জৈন মন্দির প্রভৃতি।

মহাবীর জৈনের ধর্মমত ও মূল শিক্ষা কী ছিল?

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ব্রাহ্মণ্যধর্মবিরোধী যেসব ধর্মীয় প্রবক্তা জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে জৈনধর্মের 24তম তীর্থংকর মহাবীর ছিলেন অন্যতম। যিনি জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।

মহাবীরের ধর্মমত ও মূল শিক্ষা

কৈবল্য বা দিব্যজ্ঞান লাভ করার পর মহাবীর ধর্মপ্রচার শুরু করেন। 23তম জৈন তীর্থংকর পার্শ্বনাথের চতুর্যামের সঙ্গে তিনি ব্রহ্মচর্য বা কৃচ্ছসাধন আদর্শ যুক্ত করে ‘পঞ্চ- মহাব্রত’-র আদর্শ প্রচার করেন। তাঁর মতে, বেদ অভ্রান্ত নয়। পশুহত্যা ও যাগযজ্ঞ দ্বারা পরমার্থ লাভ করা সম্ভব নয়। ত্যাগ, সংযম, অনাসক্ত জীবন ও প্রায়শ্চিত্ত দ্বারাই মানুষের মুক্তিলাভ সম্ভব। তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। আত্মার চিরমুক্তির জন্য তিনি 3টি পথ বা ‘ত্রিরত্ন’-র আদর্শ প্রচার করেন। এগুলি হল – সৎ-জ্ঞান, সৎ-আচরণ ও সৎ-বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করতেন পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুতেই প্রাণ আছে। জৈনদের এই বিশ্বাস ‘সর্বপ্রাণবাদ’ নামে খ্যাত। ত্যাগ ও অনাসক্ত জীবনের ব্রতপালনের জন্য তিনি স্বয়ং ‘দিগম্বর’ (বস্ত্রহীন) জীবনযাপন করেন।

জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্মে কী কী মিল ও অমিল তোমার চোখে পড়ে?

অথবা, বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের মধ্যে মিল ও অমিলগুলি লেখো।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে নানাধরনের সাদৃশ্য বা মিল ও বৈসাদৃশ্য বা অমিল দেখা যায়।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে সাদৃশ্য

  • উদ্ভবগত – ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনাচারের প্রতিবাদে বৌদ্ধ ও জৈন। এই দুই ধর্মের উত্থান ঘটে, এ কারণেই এদের প্রতিবাদী। ধর্ম হিসেবে অভিহিত করা হয়। বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মে সহজ-সরল ধর্মীয় মতবাদ প্রচারিত হয়েছিল। উভয় ধর্মই বহুলাংশে হিন্দু দার্শনিক চিন্তা থেকে উদ্ভূত।
  • প্রবর্তকদের মধ্যে সাদৃশ্য – উভয় ধর্মমতই উত্তর ভারতে উদ্ভূত হয়। উভয় ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর ছিলেন ক্ষত্রিয় রাজবংশজাত। উভয় ধর্মই প্রায় সমসাময়িক।
  • পৃষ্ঠপোষকতাগত – উভয় ধর্মেরই প্রধান পৃষ্ঠপোষক শ্রেণি ছিল ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যবর্ণভুক্ত শ্রেষ্ঠীরা।
  • মতবাদগত – উভয় ধর্মই অহিংসার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং জাতিভেদ প্রথা বা অস্পৃশ্যতাকে অস্বীকার করে মানুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে বৌদ্ধ ও জৈন উভয় ধর্মই জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী ছিল। যাগযজ্ঞ, পশুবলি ও বর্ণাশ্রম প্রথার বিরোধী ছিল উভয় ধর্মই।
  • ভাষাগত – মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ উভয়েই ধর্মপ্রচারের জন্যে উচ্চবর্ণের ভাষা সংস্কৃতের পরিবর্তে সর্বসাধারণের বোধগম্য প্রাকৃত ও পালি ভাষা ব্যবহার করেন।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে বৈসাদৃশ্য

বৌদ্ধধর্মজৈনধর্ম
i) বৌদ্ধধর্মে ভোগ ও ত্যাগের মধ্যবর্তী পথ (মজঝিম পন্থা) অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে।জৈন ধর্মে কঠোর কৃচ্ছসাধনের পন্থা অবলম্বনের বিধান দেওয়া হয়েছে। এই ধর্মে ত্যাগ ও কঠোর তপশ্চর্যার পাশাপাশি উপবাসের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
ii) গৌতম বুদ্ধ যে-কোনো জীব বা প্রাণীহত্যারই বিরোধী ছিলেন।জৈন ধর্মে কঠোর অহিংস নীতির কথা বলা হয়েছে। জৈনরা জীবকুলের পাশাপাশি জড়বস্তুতেও প্রাণের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন।
iii) গৌতম বুদ্ধই প্রথম বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন।জৈন ঐতিহ্য অনুসারে মহাবীরের আগে আরও 23 জন তীর্থংকর জৈনধর্ম প্রচার করেছিলেন।
iv) প্রাচীনকালে বৌদ্ধধর্ম ভারতে ও ভারতের বাইরে প্রসার লাভ করেছিল।জৈনধর্ম ভারতের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল।

সিদ্ধার্থ – টীকা লেখো।

অথবা, গৌতম বুদ্ধ – টীকা লেখো।

বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক হলেন বুদ্ধদেব (আনুমানিক 566-1486 খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। প্রথম জীবনে তাঁর নাম ছিল সিদ্ধার্থ ও গৌতম। গৌতম গোত্রে জন্ম হওয়ায় তার নাম হয়েছিল গৌতম। তাঁর পিতা শুদ্ধোদন ছিলেন শাক্যকুলের রাজা, বুদ্ধের মাতার নাম মায়াদেবী।

  • জন্মগ্রহণ – সিদ্ধার্থ আনুমানিক 566 খ্রিস্টপূর্বাব্দে নেপালের অন্তর্গত কপিলাবস্তু রাজ্যের নিকট লুম্বিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শাক্যকুলে জন্মেছিলেন বলে বুদ্ধকে বলা হয় শাক্যসিংহ। জন্মের মাত্র সাতদিন পরই সিদ্ধার্থের মা মায়াদেবীর মৃত্যু হয়। তখন থেকে তাঁকে লালনপালন করেন তাঁর বিমাতা গৌতমী।
  • সংসার জীবন – তাঁর পত্নীর নাম গোপা বা যশোধরা। তাঁর একটি পুত্রসন্তান জন্মায়, তার নাম – রাহুল।
  • সংসার ত্যাগ – অন্তরে ক্রমবর্ধমান বৈরাগ্যের তাড়নায় গৌতম 29 বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করেন। এই ঘটনা ‘মহাভিনিষ্ক্রমণ’ নামে পরিচিত। মুক্তির সন্ধানে দীর্ঘ ছ-বছর নানা স্থানে ঘুরে শেষ পর্যন্ত গৌতম রাজগৃহ এবং পরে গয়ায় উপস্থিত হন।
  • সিদ্ধিলাভ – গয়ায় উরুবিল্ব গ্রামে নৈরঞ্জনা নদীর তীরে। তপস্যায় মগ্ন হন। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে বুদ্ধদেব দিব্যজ্ঞান প্রাপ্ত হন। এই সময় থেকেই গৌতম বুদ্ধ বা জ্ঞানী ও তথাগত (পরম সত্যের যিনি সন্ধান পেয়েছেন) নামে অভিহিত হন। যে-স্থানে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন সেই স্থানের নাম হয় বুদ্ধগয়া এবং যে-বৃক্ষতলে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন তার নাম হয় বোধিবৃক্ষ বা বোধিদ্রুম।
  • ধর্মপ্রবর্তন – দিব্যজ্ঞান লাভের পর তিনি সারনাথে মৃগদারে পাঁচজন ব্যক্তিকে শিষ্যত্ব প্রদান করেন। যাঁরা পঞ্চভিক্ষু নামে পরিচিত হন। এই পাঁচজন ভিক্ষু ছিলেন-কৌন্ডিন্য, অশ্বজিত, বপ্র, মহানামা ও ভদ্রীয়। এই ঘটনা বৌদ্ধধর্মে। ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন’ নামে খ্যাত। মগধরাজ বিম্বিসার ও অজাতশত্রু, কোশলরাজ প্রসেনজিৎ ও তাঁর স্ত্রী মল্লিকা বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
  • দেহত্যাগ – 80 বছর বয়সে তিনি কুশীনগরে দেহত্যাগ করেন, যা বৌদ্ধধর্মে ‘মহাপরিনির্বাণ’ রূপে চিহ্নিত হয়েছে।

ভারতকে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ও গুরুত্ব কীরূপে প্রভাবিত করেছে?

ভারতীয় জনজীবনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব অনস্বীকার্য। বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শ ভারতের সাংস্কৃতিক জগতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব

  • মনে রাখতে হবে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৌদ্ধধর্ম বৈদিক শ্রেণিবৈষম্য, বর্ণবিভেদ ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল। আর সেজন্যই সমাজের সকল শ্রেণির অবহেলিত মানুষ গৌতম বুদ্ধের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল।
  • বুদ্ধের অহিংসা তথা শান্তিবাদী নীতি সর্বপ্রথম ভারতবাসী তথা বিশ্ববাসীকে চমকিত করেছিল। যে শান্তিবাদী আদর্শ আজ সমগ্র বিশ্বের জাতির অনুপ্রেরণা। সম্রাট অশোক ছিলেন বিশ্বের প্রথম নরপতি যিনি যুদ্ধনীতি ত্যাগ করে গৌতম বুদ্ধের অহিংসা মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
  • ধর্মীয় জীবনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বৌদ্ধধর্মকে মূলধন করেই কুষাণ যুগে গান্ধার শিল্পের উন্নতি হয়।
  • বৌদ্ধধর্মকে মূলধন করে প্রাচীন ভারতের নানা স্থানে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য মন্দির ও মঠ, যেগুলি আজও সমাদৃত।
  • বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক-সহ অসংখ্য বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ প্রাচীন ভারতের অমূল্য সম্পদ।
  • গৌতম বুদ্ধের হাত ধরেই ভারতে পালি ও প্রাকৃত ভাষার উন্নতি হয়। যে প্রাকৃত ভাষা থেকে বর্তমান ভারতের অধিকাংশ ভাষার জন্ম হয়েছে।
  • প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত বিভিন্ন বৌদ্ধ সংগীতিগুলির মূল্য অপরিসীম। কারণ এই সমস্ত সংগীতিগুলিতেই উদ্ভব হয় মহাযান ও হীনযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের।

পরিশেষে বলা যায় যে, বৌদ্ধধর্মের মানবতাবোধ ও সাম্যবাদী আদর্শগুলি এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, দেশ-কালের সীমা অতিক্রম করে এই ধর্ম আজ বিশ্বধর্মে পরিণত হয়েছে।

প্রথম চারটি বৌদ্ধ সংগীতির পরিচয় দাও।

অথবা, বৌদ্ধ সংগীতিগুলির গুরুত্ব আলোচনা করো।

গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর, তাঁর আদর্শ এবং মতবাদগুলি নিয়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। বিভিন্ন গ্রুপ এবং ব্যক্তিরা বুদ্ধের শিখানো পথ অনুসরণ করার জন্য নানা ধরনের মতবাদ তৈরি করতে শুরু করে। এই মতপার্থক্য দূর করতে এবং সঠিক ধর্মীয় সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য বৌদ্ধ সম্প্রদায় একাধিক ধর্ম সম্মেলনের (সংগীতির) আয়োজন করেছিল। এগুলি ছিল মূলত ধর্মীয় আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মঞ্চ, যেখানে বিভিন্ন মতবাদ এবং বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছিল।

প্রথম ধর্মসম্মেলন – বুদ্ধের মৃত্যুর পর রাজা অজাতশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায়, তাঁর শিষ্যরা মহাকাশ্যপের নেতৃত্বে রাজগৃহে (আনুমানিক 486 খ্রিস্টপূর্ব) প্রথম বৌদ্ধ ধর্মসম্মেলন বা ‘সংগীতি’ আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে বুদ্ধের শিক্ষাগুলির সঠিক সংকলন করা হয় এবং দুটি প্রধান পিটক (আধার) বা ধর্মগ্রন্থ তৈরি করা হয়। পিটক দুটি হলো বিকুণ্ঠ পিটক (যেখানে বুদ্ধের বাণী এবং আচার্যদের শাসন আলোচনা করা হয়) এবং বিকুণ্ঠ সুত্ত (যেখানে বুদ্ধের উপদেশ এবং শিক্ষাগুলি সংকলিত হয়)।

দ্বিতীয় ধর্মসম্মেলন – প্রথম ধর্মসম্মেলনের একশো বছর পর (আনুমানিক 387 খ্রিস্টপূর্ব), রাজা কালাশোকের শাসনকালে বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ ধর্মসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন যশ। সম্মেলনের ফলে বৌদ্ধধর্ম দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়: থেরবাদ (স্থবিরবাদ) এবং মহাসাংঘিক। থেরবাদীরা মূলত বুদ্ধের প্রাথমিক শিক্ষাকে অনুসরণ করে, যেখানে সমাধান মূলত ব্যক্তিগত আত্মসাধনার দিকে মনোনিবেশ করা হয়। অন্যদিকে, মহাসাংঘিকরা প্রাকৃত ভাষায় বুদ্ধের শিক্ষাগুলি রচনা করতে শুরু করেন এবং তা আরো বিস্তৃত করতে থাকেন। ফলে, পরবর্তীতে এই দুটি শাখা আরও কয়েকটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়—থেরবাদীরা 11টি সম্প্রদায়ে এবং মহাসাংঘিকরা 7টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হন।

তৃতীয় ধর্মসম্মেলন – মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (আনুমানিক 251 খ্রিস্টপূর্ব), মোগলিপুত্ত তিসের নেতৃত্বে তৃতীয় বৌদ্ধ ধর্মসম্মেলন পাটলিপুত্রে অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে থেরবাদীরা প্রাধান্য পায়। তৃতীয় সম্মেলনে মূলত বুদ্ধের শিক্ষা ও মতবাদগুলির বিভিন্ন দিক নিয়ে বিতর্ক করা হয় এবং আলোচনার পর একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলি পরবর্তী সময়ে সারনাথ লিপিতে প্রচারিত হয়, যাতে বৌদ্ধধর্মের মূল শিক্ষা আরও সঠিকভাবে প্রচারিত হয়।

চতুর্থ ধর্মসম্মেলন – বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করার জন্য কুষাণ সম্রাট কনিষ্ক চতুর্থ ধর্মসম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনটি কাশ্মীরের কুন্তলবন বিহারে অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে বৌদ্ধ পণ্ডিত বসুমিত্র সভাপতিত্ব করেন। এই সম্মেলনে হীনযান এবং মহাযান ধর্মের দুই প্রধান শাখায় বৌদ্ধধর্ম বিভক্ত হয়। হীনযান শাখা মূলত ব্যক্তিগত মুক্তির দিকে মনোনিবেশ করে, যেখানে মহাযান শাখা মানুষের বৃহত্তর কল্যাণ এবং আধ্যাত্মিক মুক্তি নিয়ে কাজ করে।

এই ধর্মসম্মেলনগুলি বৌদ্ধধর্মের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং আজও এই সম্মেলনগুলির সিদ্ধান্ত বৌদ্ধধর্মের নীতি ও মূল্যবোধের ভিত্তি হিসেবে গণ্য হয়।

হীনযান ও মহাযান – টীকা লেখো

অথবা, হীনযান ও মহাযান কাদের বলা হয়?

হীনযান এবং মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের দুটি প্রধান সম্প্রদায়। এরা বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন মতবাদ ও অনুশীলন অনুসরণ করে, তবে তাদের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি একে অপর থেকে অনেকটাই আলাদা।

হীনযান (যা “ছোট যান” হিসেবে পরিচিত) মূলত সেই সম্প্রদায়কে বলা হয় যারা বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন রূপ অনুসরণ করে। হীনযান সম্প্রদায়ের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, বুদ্ধের শিক্ষা ব্যক্তিগত মুক্তি অর্জনের জন্য। অর্থাৎ, তারা নিজেকে মুক্তি দানকারী হিসেবে মনে করেন এবং তাদের লক্ষ্য একমাত্র নিজের নির্বাণলাভ। এই মতবাদে পরম ক্ষমতার ধারণা নেই, এবং বুদ্ধকে শুধুমাত্র একজন সর্বজ্ঞ পুরুষ হিসেবে দেখা হয়।

আরেকদিকে, মহাযান (যা “বড় যান” হিসেবে পরিচিত) সম্প্রদায়ের অনুসারীরা নিজেদেরকে শুধুমাত্র নিজের মুক্তির জন্য নয়, বরং সকল প্রাণীর মুক্তির জন্য কাজ করে। মহাযান মতে, বুদ্ধের মত একজন মহাজ্ঞানী এবং বিশাল হৃদয়ের অধিকারী, যিনি শুধু নিজের জন্য নির্বাণ লাভ করেন না, বরং পৃথিবীর সকল জীবের মুক্তির জন্য চেষ্টা করেন। এই সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুযায়ী, বুদ্ধ বহুবার বোধিসত্ত্বরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন, এবং তিনি সকলের মুক্তির জন্য নিবেদিত।

হীনযান ও মহাযানবাদের মধ্যে পার্থক্য লেখো।

হীনযান ও মহাযানবাদের মধ্যে পার্থক্য লেখো –

হীনযানমহাযানবাদ
1. হীনযানপন্থী বৌদ্ধরা অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিল।মহাযানপন্থী বৌদ্ধরা উদার প্রকৃতির ছিল।
2. হীনযানপন্থীরা বৌদ্ধধর্মের নৈতিকতা ও আদর্শের ওপর অধিক গুরুত্ব দিত।কিন্তু মহাযানপন্থীরা ভক্তির ওপর অধিক গুরুত্ব দেয় বা দিত।
3. হীনযানপন্থীদের কথ্যভাষা ছিল পালি।কিন্তু মহাযানপন্থীরা সংস্কৃত ভাষার ওপর জোর দিয়েছিল।
4. হীনযানরা বুদ্ধের মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন না।মহাযানীরা বুদ্ধের মূর্তি গড়ে পূজা করতেন।
5. হীনযানপন্থীরা ব্যক্তিগত মোক্ষলাভে বিশ্বাসী ছিল।কিন্তু মহাযানপন্থীরা ব্যক্তিগত মুক্তি বা মোক্ষলাভের বদলে সকলের মুক্তিলাভের কথা বলত।

মহাজনপদের শাসনব্যবস্থা কেমন ছিল?

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মূলত উত্তর ভারতে 16টি মহাজনপদের উদ্ভব হয়। এগুলিকে একসঙ্গে বলা হয় ষোড়শ মহাজনপদ।

মহাজনপদের শাসনব্যবস্থা

  • রাজতান্ত্রিক কাঠামো – অধিকাংশ জনপদেই রাজতন্ত্রের ধারণা প্রবল ছিল। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কাশী, কোশল, মগধ, গান্ধার ইত্যাদি। এগুলি এক একটি রাজবংশ দ্বারা পরিচালিত হত। যেমনটা জানা যায় মগধের প্রথম শাসক বংশ ছিল হর্যঙ্ক বংশ। রাজারা সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে তাঁদের রাজ্যগুলিকে কতকগুলি ভাগে ভাগ করতেন। তাঁর অধীন থাকত নানা ধরনের মন্ত্রী ও রাজকর্মচারী।
  • অরাজতান্ত্রিক রাজ্য – জনপদগুলির মধ্যে কয়েকটি গণরাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। সেখানে রাজার শাসন ছিল না। এরূপ দুটি রাজ্য ছিল বৃজি ও মল্ল। এগুলিতে মূলত উপজাতির লোকেরাই বসবাস করত। যেমন – শাক্য, ভর্গ, মোরিয়া, বুলি প্রভৃতি। এখানকার সাধারণ মানুষ মিলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করত।

জৈন ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করো।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে যতগুলি ধর্মমতের উদ্ভব হয়, সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল জৈনধর্ম।

জৈনধর্ম সম্পর্কিত নানা বিষয়

  • বিভিন্ন তীর্থঙ্কর – জৈনধর্মে মোট 24 জন তীর্থংকর আবির্ভূত হন। প্রথম তীর্থংকর ছিলেন ঋষভনাথ এবং শেষ তীর্থংকর ছিলেন মহাবীর। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পার্শ্বনাথ ও মহাবীর।
  • পঞ্চমহাব্রত – এই ধর্মের মূল কথা ছিল চতুর্যাম (অর্থাৎ অহিংসা, সত্য কথা বলা, চুরি না করা ও নিজের জন্য কোনো সম্পত্তি না রাখার আদর্শ)। এই আদর্শ প্রচার করেন পার্শ্বনাথ। মহাবীর এই আদর্শগুলির সঙ্গে ব্রহ্মচর্যের আদর্শ যোগ করে পঞ্চমহাব্রতের কথা প্রচার করেন। তিনি বলেন, ত্যাগ, সংযম, অনাসক্ত জীবন ও প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা মানুষের মুক্তি লাভ সম্ভব।
  • ত্রিরত্ন – মহাবীর জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই আত্মার চিরমুক্তির জন্য তিনি 3টি পথ উল্লেখ করেন। সেগুলি হল-সৎ জ্ঞান, সৎ আচরণ ও সৎ বিশ্বাস। এগুলিকে একসঙ্গে বলা হয় ত্রিরত্ন।
  • র্বপ্রাণবাদ – জৈনরা বিশ্বাস করে পৃথিবীর সমস্ত বস্তুতেই প্রাণ আছে। তাই তারা তাদের ক্ষতি করত না। এই মতকে বলা হয় সর্বপ্রাণবাদ।
  • জৈন ধর্মগ্রন্থ – আনুমানিক 300 খ্রিস্টপূর্বাব্দে জৈন দার্শনিক স্থূলভদ্রের অনুপ্রেরণায় পাটলিপুত্রে প্রথম জৈন সংগীতি আহূত হয়। এখানে জৈন ধর্মের মতবাদগুলি 12 টি অঙ্গে সংকলিত করা হয়। একে বলে ‘দ্বাদশ অঙ্গ’। বর্তমানে একে বলা হয় জৈন আগম বা জৈন সিদ্ধান্ত।
  • জৈন দার্শনিক – জৈনধর্মে বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত ও দার্শনিকের আবির্ভাব হয়। যাঁদের হাত ধরে এই ধর্মের প্রসার ঘটে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভদ্রবাহু, হেমচন্দ্র, সিদ্ধ সেন, হরিভদ্র প্রমুখ।
  • গুরুত্ব – জৈনধর্মের হাত ধরে সেযুগে ভারতের অবহেলিত মানুষদের মধ্যে সমতার আদর্শ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তাঁরা ভারতে অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন। এই ধর্মের প্রভাবে ভারতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য ও ভাস্কর্য গড়ে ওঠে।

মহাবীর জৈন – টীকা লেখো।

জৈনধর্মের শ্রেষ্ঠ তীর্থংকর ছিলেন মহাবীর জৈন। তিনি তাঁর মতবাদ প্রচার করে এই ধর্মকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।

  • জীবনী – আনুমানিক 540 খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহাবীর বৈশালীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বনাম ছিল বর্ধমান। 30 বছর বয়সে তিনি সংসার ত্যাগ করেন এবং কঠোর তপস্যা করে কৈবল্য যা সিদ্ধি লাভ করেন। এজন্য তাঁকে জিন ও কেবলিন বলা হয়। এরপর তিনি রিপুজয়ী হন এবং তাঁর নাম হয় মহাবীর।
  • পঞ্চমহাব্রত – এই ধর্মের মূল কথা ছিল চতুর্যাম (অর্থাৎ অহিংসা, সত্য কথা বলা, চুরি না করা ও নিজের জন্য কোনো সম্পত্তি না রাখার আদর্শ)। এই আদর্শ প্রচার করেন পার্শ্বনাথ। মহাবীর এই আদর্শগুলির সঙ্গে ব্রহ্মচর্যের আদর্শ যোগ করে পঞ্চমহাব্রতের কথা প্রচার করেন। তিনি বলেন, ত্যাগ, সংযম, অনাসক্ত জীবন ও প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা মানুষের মুক্তি লাভ সম্ভব।
  • ত্রিরত্ন – মহাবীর জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই আত্মার চিরমুক্তির জন্য তিনি 3টি পথ উল্লেখ করেন। সেগুলি হল-সৎ জ্ঞান, সৎ আচরণ ও সৎ বিশ্বাস। এগুলিকে একসঙ্গে বলা হয় ত্রিরত্ন।
  • শেষজীবন – তিনি টানা 30 বছর ভারতের নানাস্থানে তাঁর মতবাদ প্রচার করেন। আনুমানিক 468 খ্রিস্টপূর্বাব্দে 72 বছর বয়সে পাবা নগরীতে তাঁর দেহাবসান হয়।

জৈনধর্মের মুখ্য শিক্ষা বা উপদেশাবলি সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

জৈনধর্মের মুখ্য শিক্ষা বা উপদেশাবলি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল –

  • সর্বপ্রাণবাদ – জৈনরা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী। এজন্য তারা কোনো জীব, যেমন – গাছ ও কীটপতঙ্গের ক্ষতি করে না, বা তাদের হত্যা করে না। এমনকি তারা সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী। তারা মনে করে, পৃথিবীর সমস্ত বস্তুতেই প্রাণ আছে; তা জড় পদার্থই হোক বা জীবিত পদার্থই হোক।
  • কর্মফলবাদ – জৈনরা কর্মফলবাদ ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। সেজন্য জৈন অবতারগণ আত্মার চিরমুক্তির জন্য তিনটি পথ বা ত্রিরত্নের কথা প্রচার করেন, সেগুলি হল – সৎ-জ্ঞান, সৎ-আচরণ ও সৎ-বিশ্বাস।
  • পঞ্চমহাব্রত – মহাবীর পঞ্চমহাব্রত-র কথা প্রচার করেন। সেগুলি হল – পার্শ্বনাথ-প্রবর্তিত চতুর্যাম (অর্থাৎ, অহিংসা, সত্য, অচৌর্য ও অপরিগ্রহ) এবং তৎ-সহ ব্রহ্মচর্য বা কৃচ্ছসাধনের আদর্শ। তিনি প্রচার করেন ত্যাগ, সংযম, অনাসক্ত জীবন ও প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা মানুষের মুক্তিলাভ সম্ভব।
  • ঈশ্বরবাদ – জৈনরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। তারা বেদ তথা বৈদিক। ধর্মের অনেক আদর্শই উপেক্ষা করে। তারা ব্রাহ্মণ্যধর্মে ব্রাহ্মণ বা পুরোহিতদের কর্তৃত্বের তত্ত্বকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে।

বৌদ্ধধর্মের মূল নীতিগুলি লেখো।

অথবা, বৌদ্ধধর্মের মূলকথা সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করার পর গৌতম বুদ্ধ তাঁর মত ও পথ প্রচার করেন। মানুষকে দুঃখকষ্টের হাত থেকে মুক্তিলাভের উপায় হিসেবে তিনি যে শিক্ষা ও উপদেশ দিয়ে গেছেন তা ‘ ছিল চিরশাশ্বত।

বুদ্ধের মূলনীতি ও শিক্ষা

  • আর্যসত্য – কর্মফলবাদে বিশ্বাসী বুদ্ধ বিশ্বাস করতেন মানুষ তার কৃতকর্মের জন্য ফলভোগ করে, দুঃখ পায়। তাই এই দুঃখকষ্টের হাত থেকে মুক্তিলাভের জন্য তিনি চারটি মহান সত্য উপলব্ধি করেন। এই সত্যগুলি হল – পৃথিবী দুঃখময়, মানুষের কামনা-বাসনা ও আসক্তি থেকেই সৃষ্টি হয় দুঃখ, তা দূর করতে পারলেই মোক্ষ বা নির্বাণ অর্থাৎ, শাশ্বত শান্তি ও চরম মুক্তিলাভ সম্ভব এবং এই মুক্তিলাভের জন্য একটি নির্দিষ্ট মার্গ বা পথ অনুসরণ করতে হবে।
  • অষ্টাঙ্গিক মার্গ – জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী বুদ্ধ বিশ্বাস করতেন, এই দুঃখময় পৃথিবীতে মানুষ বারবার জন্মগ্রহণ করে। তাই এই জন্মচক্রের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তিনি 8টি মার্গ বা পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন। এগুলি হল – সৎ-চিন্তা, সৎ-কর্ম, সৎ-বাক্য, সৎ-জীবিকা, সৎ- চেষ্টা, সৎ-দৃষ্টি, সৎ-সংকল্প ও সৎ সমাধি।
  • মধ্যপন্থা – ভগবান বুদ্ধ মনে করতেন ভোগবিলাস অথবা কঠোর কৃচ্ছসাধন করে মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করা যায় না। তাই তিনি এই মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে মানুষকে একটি নতুন পথের সন্ধান দিয়ে গিয়েছেন, তা হল মধ্যপন্থা বা পালি ভাষায় মজঝিম পতিপদা।
  • পঞ্চশীল – এ ছাড়া তিনি মানুষকে কতকগুলি নৈতিক অনুশাসন পালন করতে বলে গিয়েছিলেন। তা হল, পঞ্চশীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা। পঞ্চশীল ছিল গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত পাঁচটি শীল বা আচরণবিধি, এগুলি হল – ব্যভিচার, মদ্যপান, মিথ্যাভাষণ, পরস্বাপহরণ ও হিংসা থেকে দূরে থাকা।

গৌতম বুদ্ধ প্রচারিত নৈতিক উপদেশগুলি সম্পর্কে কী জান?

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যে ধর্মীয় প্রতিবাদী আন্দোলন সংঘটিত হয় তার মধ্যে কিছু ধর্মমত জন্মান্তর ও কর্মফলবাদে বিশ্বাসী ছিল, যেমনটি ছিল বৌদ্ধধর্ম।

  • গৌতম বুদ্ধের নৈতিক উপদেশ – গৌতম বুদ্ধ জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, মানুষের জন্ম কর্মফল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কর্মফল ভালো হলে মানুষ জন্মান্তরবাদের চক্র থেকে মুক্তিলাভ করে। অর্থাৎ, সে নির্বাণ বা মোক্ষলাভ করে। তবে তা সম্ভব সৎ-কাজের মধ্য দিয়ে। এজন্য গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের 8টি নৈতিক উপদেশ পালনের আহ্বান জানান। এগুলি হল-জীবহত্যা না করা, অন্যের দ্রব্য চুরি না করা, বিবাহ থেকে বিরত থাকা, মিথ্যা কথা না বলা, মদ্যপান না করা, ব্যবহার করা, অলংকার ও প্রসাধনী দ্রব্য না উঁচু বিছানায় শয্যাগ্রহণ না করা এবং অর্থ ও মূল্যবান জিনিস গ্রহণ না করা।
  • উপসংহার – উল্লেখ্য যে, বুদ্ধের প্রথম 5টি নীতি সাধারণত গৃহীদের প্রাপ্য ছিল। তবে তৃতীয় নীতিটি পরিবর্তন করে বলা হয়েছে – আইনানুগ বিবাহের কথা। এ ছাড়া তিনি গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং জীব ও পশুদের প্রতি দয়া দেখানোর ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন।

ত্রিপিটক কী? এতে কী আছে?

বৌদ্ধধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল ত্রিপিটক। এটি পালি ভাষায় লেখা। গৌতম বুদ্ধের দেহাবসানের পর রাজগৃহে অনুষ্ঠিত প্রথম বৌদ্ধ সংগীতিতে এটি সংকলিত ও লিখিত হয় (শেষ পিটকটি বাদে)।

ত্রিপিটক কথার আক্ষরিক অর্থ তিনটি ঝুড়ি। এর 3টি ভাগ, যথা –

  • সুত্তপিটক – এতে গৌতম বুদ্ধের উপদেশাবলি সংকলিত হয়েছে।
  • বিনয়পিটক – এতে বৌদ্ধ সংঘের নিয়ম ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসীদের আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড লেখা হয়েছে।
  • অভিধম্মপিটক – এতে গৌতম বুদ্ধের দর্শন ও আদর্শ লেখা হয়েছে।

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের পঞ্চম অধ্যায়, “খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতীয় উপমহাদেশ (রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ধর্মের বিবর্তন-উত্তর ভারত)” অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহায়ক হবে, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ!

Share via:

মন্তব্য করুন