এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন — “ভারতের নগরায়ণের সমস্যাগুলি ব্যাখ্যা করো।” — নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ” -এর “ভারতের জনসংখ্যা” অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি প্রায়ই আসে, তাই এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের নগরায়ণের সমস্যাগুলি ব্যাখ্যা করো।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলির তুলনায় ভারতের নগরায়ণ (36.16%) কম এবং ধীর গতিসম্পন্ন নগরায়ণ ঘটলেও ছোটো ও বড়ো বিভিন্ন শহরে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে একাধিক গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যেমন –
অপরিকল্পিত নগরায়ণ –
সাম্প্রতিককালে ভারতে দ্রুত নগরায়ণ ঘটে চলেছে। 2001 খ্রিস্টাব্দে ভারতে যেখানে মাত্র 1টি মেট্রোপলিটান শহর (কলকাতা) ছিল, সেখানে 2011 খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে হয়েছে 53টি। গ্রামগঞ্জ এবং সেন্সাস শহর থেকে বড়ো শহরমুখী পরিব্রাজনের ফলে শহরতলির ক্ষেত্রমান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহর থেকে নগরের এই দ্রুত বৃদ্ধি প্রায় সর্বত্রই অপরিকল্পিত। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ভারতের প্রচুর কৃষিজমি শহর ও নগরকে গ্রাস করে ফেলেছে। পরিকল্পনার অভাবে রাস্তাঘাট, নিকাশি ব্যবস্থা অপ্রতুল ও বিপর্যস্ত। অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে নগরায়ণের ফলে সরকারি খাস জমিতে ঘিঞ্জি বস্তি গড়ে ওঠা, ফুটপাথ দখল করে পরিবহণ ও যাতায়াতের জটিল সমস্যা তৈরি হয়েছে এবং পরিবহণ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়েছে।
বাসস্থানের সমস্যা –
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বিনোদন, কর্মসংস্থান প্রভৃতির সুযোগ গ্রহণ করার জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষের শহরে বাস করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে তীব্রভাবে বাসস্থানগত সমস্যা তৈরি হয়েছে। দরিদ্র শ্রেণির মানুষ রোজগারের তাগিদে শহরে সরকারি জমিতে, রেললাইন বা সড়কপথের ধারে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে বস্তি অঞ্চল গড়ে তুলেছে। তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করে পরিবেশগত জটিল সমস্যা তৈরি করে।
পরিকাঠামোর অভাব –
- জলনিকাশি সমস্যা – শহরের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় ময়লা ও দূষিত জল নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে নানান সমস্যা তৈরি হয়েছে। ভারতের কোনো শহরের জলনিকাশি ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানসম্মত নয়। দূষিত জল ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশকে দূষিত করে তোলে। ভারতের প্রায় 36% শহরবাসী পয়ঃপ্রণালীর কোনো সুযোগ পায় না।
- পানীয় জলের সমস্যা – ভারতের শহরবাসীরা প্রয়োজনের তুলনায় 10-20% জল কম পেয়ে থাকে। যেমন – দিল্লিতে অধিকাংশ মানুষ দিনে 25 লিটারেরও কম জল পেয়ে থাকে। মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাইতে পানীয় জলের সমস্যা তীব্রতর। পানীয় জলের সংকট মেটাতে গিয়ে ভৌমজলস্তর অনেক নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে এবং আর্সেনিক, ফ্লুওরাইড সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
- বিদ্যুতের সমস্যা – জনসংখ্যা, বিনোদন, কলকারখানা, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে, পরিবহণ ক্ষেত্রে বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় অতিরিক্ত বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। গ্রীষ্মকালে এর চাহিদা থাকলেও বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থা মাঝেমধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
- শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা – উত্তরোত্তর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য (চিকিৎসা) ব্যবস্থার ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্কুলে, কলেজে পছন্দ বা চাহিদা মতো ভরতি হতে না পারার সমস্যা লেগেই থাকে। হাসপাতাল, নার্সিংহোমগুলি রোগীর চাপে অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে।
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা – শহরে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নানারকম বর্জ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্জ্য নিক্ষেপের স্থানাভাব, তার ব্যবস্থাপনা বর্তমানে পৌরনিগমগুলির দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট –
দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অরণ্য ধ্বংস হয়। শিল্প কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। বায়ুদূষণ, জলদূষণ, মৃত্তিকা দূষণের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
পরিবেশগত সমস্যা –
- বায়ুদূষণ – যানবাহন ও চিমনির ধোঁয়া।
- বর্জ্য দূষণ – শিল্প, গৃহস্থালি, প্রতিষ্ঠানগত বর্জ্য।
- শব্দদূষণ।
- জলদূষণ।
- জলাশয় ভরাট।
পৌর সমস্যা –
অতি দ্রুত নগরায়ণের ফলে জনসংখ্যার আধিক্য জনিত কারণে খাদ্যের জোগানে ঘাটতি দেখা যায়। অনাহার ও অপুষ্টির সমস্যা দেখা দেয়। কর্মসংস্থানের বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায় যার ফলস্বরূপ চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও বৃদ্ধদের প্রতি অযত্ন, প্রতারণা, অপহরণ, র্যাগিং, ইভটিজিং, প্রভৃতি ভয়াবহ সমস্যা দেখা যায়।
পৌর সমস্যার ফলাফল –
- চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই।
- মহিলাদের ওপর অত্যাচার।
- অপহরণ, প্রতারণা, ইভটিজিং।
- বয়স্কদের প্রতি অযত্ন।
- নারী-পুরুষ অনুপাত হ্রাস।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
ভারতের নগরায়ণের হার কত এবং এটি ধীরগতির কেন?
ভারতের নগরায়ণের হার 2021 সালের হিসাবে প্রায় 36.16%, যা উন্নত দেশগুলির তুলনায় কম। এটি ধীরগতির কারণ —
1. কৃষিনির্ভর অর্থনীতি (গ্রামীণ জনসংখ্যার বড় অংশ কৃষিকাজে নিযুক্ত)।
2. অপর্যাপ্ত শিল্পায়ন ও পরিকাঠামোর অভাব।
3. গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরের বাধা (কর্মসংস্থান, বাসস্থান ও সুযোগ-সুবিধার অভাব)।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের প্রধান সমস্যাগুলি কী?
অপরিকল্পিত নগরায়ণের প্রধান সমস্যাগুলি হলো –
1. অনিয়ন্ত্রিত শহর সম্প্রসারণ → কৃষিজমি হ্রাস, বস্তি বৃদ্ধি।
2. অপর্যাপ্ত নিকাশি ব্যবস্থা → জলাবদ্ধতা ও দূষণ।
3. যানজট ও পরিবহণ সমস্যা → রাস্তা দখল, ফুটপাথ বেদখল।
4. সরকারি জমিতে অবৈধ বসতি → ঘিঞ্জি বস্তির বিকাশ।
ভারতের শহরগুলিতে বাসস্থানের সমস্যা কেন তীব্র?
ভারতের শহরগুলিতে বাসস্থানের সমস্যা তীব্র হবার কারণ –
1. জনসংখ্যা চাপ → সস্তা বাসস্থানের অভাব।
2. বস্তির বিকাশ → অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, দারিদ্র্য।
3. রিয়েল এস্টেটের দাম বৃদ্ধি → মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য আবাসন সংকট।
ভারতের শহরগুলিতে জলনিকাশি ও পানীয় জলের সমস্যা কী?
জলনিকাশি সমস্যা –
1. 36% শহুরে মানুষ পয়ঃপ্রণালি সুবিধা পায় না।
2. দূষিত জল পরিবেশে মিশে রোগ ছড়ায়।
পানীয় জল সমস্যা –
1. মুম্বাই, দিল্লি, চেন্নাইতে তীব্র সংকট।
2. ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়া → আর্সেনিক ও ফ্লুরাইড দূষণ।
নগরায়ণের ফলে পরিবেশগত সমস্যাগুলি কী?
নগরায়ণের ফলে পরিবেশগত সমস্যাগুলি হলো –
1. বায়ুদূষণ – যানবাহন ও কলকারখানার ধোঁয়া।
2. জলদূষণ – শিল্পবর্জ্য নদীতে মিশ্রণ।
3. শব্দদূষণ – যানবাহন ও নির্মাণকাজ।
4. জলাশয় ভরাট – বন্যা ও জলাবদ্ধতা।
পৌর সমস্যাগুলির সামাজিক প্রভাব কী?
পৌর সমস্যাগুলির সামাজিক প্রভাবগুলি হলো –
1. অপরাধ বৃদ্ধি – চুরি, ডাকাতি, ইভটিজিং।
2. বেকারত্ব – কর্মসংস্থানের অভাবে যুবসমাজ বিপথে যায়।
3. লিঙ্গ অনুপাত হ্রাস – শহরে নারী নিরাপত্তাহীনতা।
4. বৃদ্ধদের অবহেলা – যৌথ পরিবার ব্যবস্থার পতন।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন — “ভারতের নগরায়ণের সমস্যাগুলি ব্যাখ্যা করো।” — নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ” -এর “ভারতের জনসংখ্যা” অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি প্রায়ই আসে, তাই এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন