এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন — “ভারতের পশ্চিম উপকূল ও পূর্ব উপকূলের প্রধান প্রধান সামুদ্রিক বন্দরের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।” — নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ” -এর “ভারতের পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা” অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি প্রায়ই আসে, তাই এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের পশ্চিম উপকূল ও পূর্ব উপকূলের প্রধান প্রধান সামুদ্রিক বন্দরের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
পশ্চিম উপকূলের বন্দরসমূহ –
- কান্ডালা বন্দর – গুজরাট রাজ্যের কচ্ছ উপসাগরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত কান্ডালা হল ভারতের একমাত্র করমুক্ত বা শুল্কমুক্ত বন্দর। এটি একটি স্বাভাবিক পোতাশ্রয় সম্পন্ন বন্দর। পাঞ্জাব, গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশ এবং মহারাষ্ট্রের উত্তরাংশ এই বন্দরের প্রধান পশ্চাদ্ভূমি (Hinterland)। এখানে প্রধানত ওষুধ, ভেষজ দ্রব্য, তেলজাত দ্রব্য ও খনিজ তেল, সার এবং যন্ত্রপাতি আমদানি হয়। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ক্ষুদ্র ও মধ্যম আঁশযুক্ত তুলা, সিমেন্ট, চিনি, লবণ, জিপসাম এবং রাসায়নিক দ্রব্য উল্লেখযোগ্য।
- মুম্বাই বন্দর – মহারাষ্ট্র রাজ্যের আরব সাগর সংলগ্ন কোঙ্কন উপকূলে অবস্থিত মুম্বাই বন্দর ভারতের প্রবেশদ্বার এবং বৃহত্তম বন্দর হিসেবে পরিচিত। এটিও একটি স্বাভাবিক পোতাশ্রয় যুক্ত বন্দর। এর পশ্চাদ্ভূমি অঞ্চলগুলির মধ্যে রয়েছে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশ, দিল্লি, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং কর্ণাটকের উত্তরাংশ। আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে খনিজ তেল, তেলজাত দ্রব্য, দীর্ঘ আঁশযুক্ত তুলা, রাসায়নিক দ্রব্য, নিউজপ্রিন্ট, ওষুধ এবং যন্ত্রপাতি প্রধান। রপ্তানি পণ্য হিসেবে তুলা, পশম বস্ত্র, কার্পাস বস্ত্র, তামাক, যন্ত্রপাতি, অভ্র, চিনাবাদাম এবং আকরিক লোহা উল্লেখযোগ্য।
- জওহরলাল নেহরু (নহবাশেবা) বন্দর – মহারাষ্ট্রের আরব সাগরের কোঙ্কন উপকূলে অবস্থিত এই বন্দরটি ভারতের সর্বাধুনিক বা হাইটেক বন্দর এবং এটিরও স্বাভাবিক পোতাশ্রয় রয়েছে। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ এবং কর্ণাটকের কিছু অংশ এই বন্দরের জন্য পশ্চাদ্ভূমি হিসেবে কাজ করে। আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে খনিজ তেল, যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক দ্রব্য প্রধান। রপ্তানি পণ্য হিসেবে তুলা, কার্পাস বস্ত্র, চামড়া, তামাক, যন্ত্রপাতি এবং ম্যাঙ্গানিজ উল্লেখযোগ্য।
- মার্মাগাঁও বন্দর – গোয়া রাজ্যের আরব সাগর সংলগ্ন কোঙ্কন উপকূলে অবস্থিত মার্মাগাঁও বন্দরটি একটি স্বাভাবিক পোতাশ্রয় যুক্ত বন্দর। অন্ধ্রপ্রদেশের পশ্চিমাংশ, কর্ণাটকের উত্তরাংশ, মহারাষ্ট্রের দক্ষিণাংশ এবং গোয়া রাজ্য এর পশ্চাদ্ভূমি গঠন করে। এখানে প্রধান আমদানি পণ্য হল খাদ্যশস্য, সার এবং খনিজ তেল। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে চিনি, তুলা, কাজুবাদাম, কফি, ম্যাঙ্গানিজ এবং আকরিক লোহা প্রধান।
- নিউ ম্যাঙ্গালোর বন্দর – কর্ণাটক রাজ্যের আরব সাগরের মালাবার উপকূলে অবস্থিত নিউ ম্যাঙ্গালোর বন্দরটি একটি স্বাভাবিক পোতাশ্রয় যুক্ত বন্দর। সমগ্র মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও কেরলের কিছু অংশ এর পশ্চাদ্ভূমি অঞ্চল। আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে খনিজ তেল, ওষুধ, রাসায়নিক সার এবং যন্ত্রপাতি উল্লেখযোগ্য। কফি, চিনি, রবার, চন্দন কাঠ, মশলা (বিশেষ করে গোলমরিচ), টালি (Cashew Kernels), মাছ এবং আকরিক লোহা হল এর প্রধান রপ্তানি দ্রব্য।
- কোচি বন্দর – কেরল রাজ্যের আরব সাগরের মালাবার উপকূলে অবস্থিত কোচি বন্দরটিকে “আরব সাগরের রানি” বলা হয় এবং এটি একটি স্বাভাবিক পোতাশ্রয় যুক্ত বন্দর। কেরল, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকের কিছু অংশ এর জন্য পশ্চাদ্ভূমি হিসেবে কাজ করে। প্রধান আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে খনিজ তেল, যন্ত্রপাতি, সার এবং ধাতব দ্রব্য। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে নারিকেলজাত বিভিন্ন দ্রব্য, কাজুবাদাম, চা, কফি, মশলা এবং বাগদা চিংড়ি (Tiger Prawns) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পূর্ব উপকূলের বন্দরসমূহ –
নিচে ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণ উপকূলের কয়েকটি প্রধান বন্দরের বিবরণ অনুচ্ছেদ আকারে দেওয়া হল –
- কলকাতা ও হলদিয়া বন্দর – পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত এই নদীবন্দর জোড়াটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমন্বিত ব্যবস্থা। কলকাতা বন্দর একটি কৃত্রিম পোতাশ্রয়যুক্ত বন্দর, অন্যদিকে হলদিয়া বন্দর তার সহযোগী বন্দর হিসেবে স্বাভাবিক পোতাশ্রয়ের সুবিধা প্রদান করে। এই বন্দরদ্বয়ের বিশাল পশ্চাদ্ভূমির মধ্যে পড়েছে নেপাল, ভুটান, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ, অসম, মেঘালয়, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার কিয়দাংশ এবং উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশ। এখানে আমদানিকৃত প্রধান পণ্যের মধ্যে রয়েছে খনিজ তেল, গন্ধক, কাগজ, ধাতব দ্রব্য এবং রাসায়নিক দ্রব্য। রপ্তানি পণ্য হিসেবে কয়লা, অভ্র, ম্যাঙ্গানিজ, চা, তৈলবীজ, চামড়া, লাক্ষা, পাটজাত দ্রব্য এবং মাছজাত দ্রব্য উল্লেখযোগ্য।
- পারাদ্বীপ বন্দর – ওড়িশা রাজ্যের বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলে অবস্থিত পারাদ্বীপ ভারতের গভীরতম বন্দর এবং এটি একটি স্বাভাবিক পোতাশ্রয় যুক্ত বন্দর। এর প্রধান পশ্চাদ্ভূমি অঞ্চল হল ছত্তিশগড়, ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ড। এই বন্দরের মাধ্যমে উঁচু মানের ইস্পাত, চাল, কাঠ এবং রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করা হয়। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে মাছ ও মাছজাত দ্রব্য, কয়লা, আকরিক লোহা এবং ম্যাঙ্গানিজ প্রধান।
- বিশাখাপত্তনম বন্দর – অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলে অবস্থিত বিশাখাপত্তনম একটি স্বাভাবিক পোতাশ্রয় যুক্ত বন্দর। এর পশ্চাদ্ভূমি অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে সমগ্র অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর উত্তরাংশ, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডের পূর্বাংশ। এখানে আমদানিকৃত গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হল খনিজ তেল, রাসায়নিক দ্রব্য এবং লৌহ-ইস্পাত যন্ত্রপাতি। আকরিক লোহা, চিনাবাদাম, হরিতকী, তৈলবীজ, চামড়া এবং মাছ এই বন্দরের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য।
- চেন্নাই ও এন্নোর বন্দর – তামিলনাড়ু রাজ্যের বঙ্গোপসাগরীয় করমণ্ডল উপকূলে অবস্থিত এই বন্দর জুটি। ঐতিহ্যবাহী চেন্নাই বন্দর একটি কৃত্রিম পোতাশ্রয়যুক্ত বন্দর। এন্নোর বন্দর (কাছাকাছি অবস্থিত) আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন এবং চেন্নাইয়ের চাপ কমাতে সহায়ক। এদের পশ্চাদ্ভূমিতে রয়েছে তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অংশ, কর্ণাটকের দক্ষিণাংশ এবং কেরলের পূর্বাংশ। আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে কাগজ, যন্ত্রপাতি, খাদ্যশস্য, খনিজ তেল, রাসায়নিক দ্রব্য এবং ফসফেট সার উল্লেখযোগ্য। কফি, তৈলবীজ, তামাক, ম্যাঙ্গানিজ, কার্পাস বস্ত্র, চামড়া এবং মাছ ও মাছজাত দ্রব্য এখান থেকে রপ্তানি হয়।
- নিউ তুতিকোরিন বন্দর – তামিলনাড়ু রাজ্যের বঙ্গোপসাগরীয় করমণ্ডল উপকূলে অবস্থিত নিউ তুতিকোরিন একটি কৃত্রিম পোতাশ্রয়যুক্ত বন্দর। এর পশ্চাদ্ভূমি মূলত তামিলনাড়ু এবং কেরলের কিছু অংশ। এই বন্দরের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি, কয়লা এবং খনিজ তেল আমদানি করা হয়। তুলা, লবণ, পেঁয়াজ, লঙ্কা, মশলা এবং গবাদিপশু এখানকার প্রধান রপ্তানি পণ্য।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
কান্ডালা বন্দরটি কোথায় অবস্থিত এবং এটি কী কারণে বিশেষ?
কান্ডালা বন্দর গুজরাটের কচ্ছ উপসাগরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এবং এটি ভারতের একমাত্র করমুক্ত (শুল্কমুক্ত) বন্দর।
মুম্বাই বন্দরকে কেন ‘ভারতের প্রবেশদ্বার’ বলা হয়?
মুম্বাই বন্দর ভারতের বৃহত্তম ও সবচেয়ে ব্যস্ত বন্দর, যা আরব সাগরের কোঙ্কন উপকূলে অবস্থিত এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
জওহরলাল নেহেরু (নভসেবা) বন্দরটি কেন হাইটেক বন্দর হিসেবে পরিচিত?
এটি ভারতের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন বন্দর, যেখানে কন্টেইনার পরিচালনার জন্য স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা রয়েছে।
মার্মাগাঁও বন্দর কোন রাজ্যে অবস্থিত এবং এর প্রধান রপ্তানি দ্রব্য কী?
মার্মাগাঁও বন্দর গোয়া রাজ্যে অবস্থিত এবং এটি থেকে প্রধানত আকরিক লোহা, ম্যাঙ্গানিজ ও কাজুবাদাম রপ্তানি হয়।
কোচি বন্দরকে ‘আরব সাগরের রানি’ বলা হয় কেন?
এটি কেরলের মালাবার উপকূলে অবস্থিত এবং এর প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় ও বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে এই উপাধি পেয়েছে।
কলকাতা বন্দর ও হলদিয়া বন্দরের মধ্যে পার্থক্য কী?
কলকাতা বন্দর একটি নদীবন্দর ও কৃত্রিম পোতাশ্রয়যুক্ত, অন্যদিকে হলদিয়া বন্দর হল কলকাতার সহযোগী বন্দর এবং এটি স্বাভাবিক গভীরতা সম্পন্ন।
বিশাখাপত্তনম বন্দরের প্রধান আমদানি ও রপ্তানি দ্রব্য কী?
এখানে প্রধানত খনিজ তেল, যন্ত্রপাতি আমদানি এবং আকরিক লোহা, চিনাবাদাম ও মাছ রপ্তানি হয়।
চেন্নাই বন্দরটি কোন ধরনের বন্দর এবং এর প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
চেন্নাই বন্দর একটি কৃত্রিম পোতাশ্রয়যুক্ত বন্দর এবং এটি দক্ষিণ ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র।
তুতিকোরিন বন্দর থেকে কী কী পণ্য রপ্তানি হয়?
এখান থেকে মূলত লবণ, মশলা, পেঁয়াজ, তুলা ও গবাদি পশু রপ্তানি হয়।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন — “ভারতের পশ্চিম উপকূল ও পূর্ব উপকূলের প্রধান প্রধান সামুদ্রিক বন্দরের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।” — নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ” -এর “ভারতের পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা” অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি প্রায়ই আসে, তাই এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন