আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের সপ্তম অধ্যায়, ‘অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের প্রথম ভাগ)’ অধ্যায়ের কিছু সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও সহায়ক। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণী এবং চাকরির পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই আসতে দেখা যায়।
ষোড়শ মহাজনপদের আমলে কৃষিকাজ কেমন ছিল?
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহাজনপদগুলি মূলত গড়ে উঠেছিল উত্তর ভারতে। সে যুগে কৃষিকাজ ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা। এখানকার জমি ছিল পলিমাটি সমৃদ্ধ। কারণ উত্তর ভারত ছিল নদীমাতৃক অঞ্চল। সারা বছর নদীতে পর্যাপ্ত জল পাওয়া যেত। তাই কৃষিকাজ ভালোই হত। নানা ঋতুতে বিবিধ ফসল ফলানো হত। কৃষিকাজে লোহার লাঙলের ফলা ব্যবহার শুরু হলে কৃষি উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এইসব ফসলের ক্ষেত্রে ধানই ছিল প্রধান। ওই সময় মগধ অঞ্চলে শালি ধানের ব্যাপক চাষ হত। এ ছাড়া অন্যান্য ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গম, যব ও আখ।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক ও তার পরবর্তী যুগে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কে কী জানো?
প্রাচীন নগরগুলির নাগরিকগণ বিভিন্ন বৃত্তি ও ব্যবসায় নিযুক্ত ছিল। নগরগুলিতে কারিগর ও বণিকের সংখ্যা ছিল যথেষ্ট। পালি গ্রন্থে ছোটো দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের কথা বলা হয়েছে। এ যুগের ধনী বণিকরা শ্রেষ্ঠী নামে পরিচিত ছিল। তারা ব্যাবসাবাণিজ্য করে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠেছিল। এ যুগে ধাতু মুদ্রার প্রচলন ঘটেছিল এবং কালো রঙের মৃৎপাত্র ও লোহার ধাতুমল ছিল প্রধান বাণিজ্যিক পণ্য।
তবে, ব্যাবসাবাণিজ্যে বৈশ্যদের প্রাধান্য ছিল অন্যদের তুলনায় বেশি। শতপথ ব্রাহ্মণে কুসীদ (ঋণ) ও কুসীদিনের (উত্তমর্ণ) উল্লেখ থেকে জানা যায় এ যুগে ব্যাবসাবাণিজ্যে সুদে ঋণ নেওয়ার প্রথা চালু ছিল। পালি সাহিত্যে কার্যাপণ নামক মুদ্রার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের বা প্রাক্ মৌর্যযুগের বণিক ও মুদ্রার পরিচয় দাও।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহাজনপদগুলির উদ্ভবের সময় প্রাচীন ভারতে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। পালি সাহিত্যে বণিক বা বাণিজ্যের কথা বলা হয়েছে। সেখানে স্বার্থবাহ বা ভ্রাম্যমাণ বণিকদের নামোল্লেখ আছে। বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে ঋণ ও সুদের পরিচয় পাওয়া যায় এযুগে। বহুলাংশে ধাতু মুদ্রার প্রচলন ঘটে। পালি সাহিত্যে কার্যাপণ নামক মুদ্রার উল্লেখ আছে।
মহাজনপদের আমলে মুদ্রাব্যবস্থা কেমন ছিল?
মহাজনপদের আমলে বিনিময়ের মাধ্যম ছিল ধাতব মুদ্রা। এসময় কার্যাপণ ছিল বহুল প্রচলিত এক শ্রেণির মুদ্রা। এ যুগে রুপোর তৈরি অনেক মুদ্রাও পাওয়া গেছে। সেগুলি ছিল গোল ও চৌকো। মুদ্রাব্যবস্থার উন্নতি থেকে বোঝা যায় যে, এ যুগে ব্যাবসাবাণিজ্যেরও উন্নতি ঘটেছিল। এ যুগে নানা গিল্ড বা সংঘগুলিও মুদ্রার প্রচলন করেছিল।
মহাজনপদগুলির আমলে নগরের অবস্থা কেমন ছিল?
মহাজনপদগুলির আমলে নগরগুলি গ্রামীণ এলাকার তুলনায় আকারে বড়ো ছিল। নগরে বাস করত শাসক, ব্যাবসাবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত কর্মচারী এবং অন্যান্য ব্যক্তিরা। এদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আসত গ্রাম থেকে। তাই নগরগুলি গড়ে উঠত গ্রামের কাছাকাছি। নগরগুলি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে নানা জীবিকারও প্রচলন হয়। যেমন – ধোপা, নাপিত, চিকিৎসক (বৈদ্য) প্রভৃতি।
প্রাচীন ভারতের নগরায়ণ সম্পর্কে কী জানো?
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে প্রথম নগর দেখা গিয়েছিল হরপ্পা সভ্যতায়। এই সময় নগরের উদ্ভবকে বলা হয় প্রথম নগরায়ণ। খ্রিস্টপূর্ব 600 অব্দ নাগাদ ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বিতীয় নগরায়ণ হয়। এই নগরগুলি গড়ে উঠেছিল উত্তর ভারতে, বিশেষত গঙ্গা উপত্যকায়। বেশিরভাগ মহাজনপদের রাজধানীগুলিই ছিল সেকালের বিখ্যাত নগর।
নগরগুলির অবস্থা – এ যুগের নগরগুলি গ্রামীণ বসতির চাইতে আকারে বড়ো ছিল। শাসনব্যবস্থা ও ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত লোকেরা প্রধানত এইসব নগরে বাস করত। নগরবাসীরা খাদ্য উৎপাদন করত না। ফলে এদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আসত গ্রাম থেকে। নতুন নতুন নগর তৈরির ফলে এইসময়ে নানা জীবিকারও উদ্ভব ঘটেছিল।
জেনে রাখো – মৌর্যযুগের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নগর ছিল হস্তিনাপুর, মাহিম্মতি, মাদুরাই, কাবেরীপট্রিনম, বারাণসী, নাসিক, অবন্তী, সাকেত প্রভৃতি।
মৌর্য যুগে কৃষিব্যবস্থা কীরূপ ছিল?
মৌর্য যুগে কৃষিই ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা। গ্রিক দূত মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। নদীমাতৃক জমি ছিল উর্বর। রাজা ছিলেন জমির প্রকৃত মালিক। রাজার নিজস্ব জমিকে বলা হত সীতা জমি। মৌর্য সম্রাটগণ কৃষির দিকে বিশেষ নজর দিতেন। কারণ জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস ছিল কৃষি। উৎপন্ন 1 ফসলের লর অংশ বাউ অংশ কর ও ভাগ হিসেবে নেওয়া হত। মৌর্য যুগে জমিতে দু-বার ফসল ফলানো হত। জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা করা হত। অর্থশাস্ত্রে সেতুবন্ধ বা জলসেচ প্রকল্প দু-ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা – সহোদক ও আহার্যদক বা কৃত্রিম জলসেচ পদ্ধতি।
মেগাস্থিনিসের চোখে ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে লেখো।
মেগাস্থিনিস ছিলেন গ্রিক শাসক সেলিউকাসের দূত। তিনি মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজদরবারে কিছুদিন ছিলেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ইন্ডিকা নামক গ্রন্থে লিখেছিলেন। এই গ্রন্থ থেকে সমকালীন ভারতবর্ষের সমাজ সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। ইন্ডিকা থেকে জানা যায় পাটলিপুত্রে উন্নত পৌরশাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। 30 জন সদস্য নিয়ে একটি পৌরবোর্ড ছিল। এর অধীন ছিল 5 জন সদস্যবিশিষ্ট 6টি দফতর। এদের কাজ ছিল শিল্প পরিচালনা, বিদেশি অতিথি আপ্যায়ন, ব্যাবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, জন্মমৃত্যুর হিসাবরক্ষা, শুল্ক আদায় করা ইত্যাদি। তাঁর মতে, ভারতীয় জনসমাজ সাতটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা – ব্রাহ্মণ, কৃষক, পশুপালক ও শিকারি, শিল্পী ও ব্যবসায়ী, যোদ্ধা, গুপ্তচর ও সচিব। তিনি বলেছেন সেযুগে দাসপ্রথার প্রচলন ছিল না।
মৌর্য আমলের পোশাক-পরিচ্ছদ কেমন ছিল?
অথবা, মৌর্য আমলের পোশাক- পরিচ্ছদ – টীকা লেখো।
সাধারণভাবে মৌর্য আমলে পুরুষেরা অনেকটা আজকের ধুতি ও চাদরের মতো পোশাক পরিধান করত। মহিলারা পোশাকের উপর চাদর বা ওড়না ব্যবহার করত। অবশ্য ধনী পরিবারের নারী ও পুরুষ দামি পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করত। এসময় পশম ও রেশমের কাপড়ের প্রচলন ছিল। পুরুষেরা অনেকেই মাথায় পাগড়ি পরত। ধনীরা পরত দামি পাথর ও সোনার গয়না।
মৌর্য যুগে নারীজাতির অবস্থা কেমন ছিল?
মৌর্য যুগে নারীর মর্যাদার অবমূল্যায়ন হয়নি। তারা সমাজে বিশেষ মর্যাদা পেত। এর সাক্ষ্য বহন করে অর্থশাস্ত্র। এ যুগে নারীরা যে স্বাধীনতা ভোগ করত। তার প্রমাণ –
- সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা ধর্মপ্রচারের জন্য সিংহল যাত্রা করেন।
- ইন্ডিকা গ্রন্থ থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে একদল নারী রক্ষীর কথা জানা যায়।
- এ যুগে নাবালক পুত্রের অভিভাবক হিসেবে কাজ করতেন রাজমহিষীগণ। যেমন – দক্ষিণে পান্ড্য রাজ্যে নারী শাসকের পরিচয় পাওয়া যায়।
- তা ছাড়া এ যুগে বৌদ্ধ ও জৈন ভিক্ষুণীরা অবাধে চলাফেরা করতে পারত।
মৌর্য যুগে জমিতে জলসেচ ব্যবস্থা কেমন ছিল?
মৌর্য যুগে কৃষিজমিতে জলসেচ ব্যবস্থা ছিল উন্নত। তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক দলিলে।
- মেগাস্থিনিসের বর্ণনা – মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় অ্যাগ্রোনময় নামক একশ্রেণির রাজকর্মচারীর কথা জানা যায় যারা জলসেচ ব্যবস্থার তদারকি করতেন।
- সুদর্শন হ্রদ – গুজরাটে অবস্থিত সুদর্শন হ্রদটি মৌর্য যুগের উন্নত জলসেচ ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়।
- অর্থশাস্ত্র – অর্থশাস্ত্রে খাল দ্বারা জলসেচ করার কথা জানা যায়। সেজন্য মৌর্য রাজারা ‘দু-ভাগ’ নামক একপ্রকার জলকর আদায় করতেন। মৌর্য রাজারা বলি ও ভাগ নামক দু-প্রকার কর ও রাজস্ব আদায় করতেন। রাজস্বের হার ছিল 1/6 বা 1/4 অংশ।
‘স্ত্রীধন’ বলতে কী বোঝায়?
প্রাচীন ভারতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিবাহিত নারীদের সম্পত্তি রাখার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। নারীর সেই সম্পদকেই স্ত্রীধন বলে। মনুসংহিতাতে ছয় ধরনের স্ত্রীধনের উল্লেখ করা হয়েছে অধ্যগ্নি, অধ্যবাহনিক, প্রীতিদত্ত, মাতৃদত্ত, পিতৃদত্ত ও ভ্রাতৃদত্ত। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে চারপ্রকার স্ত্রীধনের উল্লেখ করেছেন। যথা – শুল্ক, অধিবেদনিক, অন্বাধেয়, বন্ধুদত্ত। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে 2000 পণ পর্যন্ত স্ত্রীধন বিবাহিতা রমণী নিজের কাছে রাখতে পারত।
শুল্ক বলতে পাত্রীকে দেওয়া অর্থ অলংকারকে বোঝানো হয়। অধিবেদনিক হল স্বামীর গৃহে যাওয়ার সময় কন্যার প্রাপ্ত উপহার। অন্বাধেয় হল বিবাহের পর প্রাপ্ত উপহার সামগ্রী। বন্দুদত্ত অর্থাৎ বন্ধুদের দ্বারা প্রদত্ত উপহার।
অগ্রহার ব্যবস্থা – টীকা লেখো।
অথবা, অগ্রহার ব্যবস্থা কী? এর ফলে কী হয়েছিল?
গুপ্ত আমলে জমি কিনে ব্রাহ্মণ বা বৌদ্ধ বিহারকে দান করা হত। এই জমিগুলি থেকে কোনো কর আদায় করা হত না। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তরকালে এই ধরনের জমি দানকে বলা হত অগ্রহার ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার ফলে জমির ওপর ব্যক্তির মালিকানা বৃদ্ধি পেয়েছিল। দান হিসেবে প্রাপ্ত এই ধরনের জমিতে কৃষিশ্রমিক নিয়োগ করা হত। ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধরা এই ধরনের জমির আয় থেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের খরচখরচা চালাতেন। অনেক অনাবাদি জমিকেও দান হিসেবে দেওয়া হত। অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে কৃষিকাজ বেড়েছিল।
কুষাণ যুগের বাণিজ্য, অর্থনীতি সম্পর্কে কী জানো?
কুষাণ যুগে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় ভারতীয় বাণিজ্য প্রসারিত হয়। এ যুগে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ঘটলে বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বিখ্যাত সিল্ক রুটের মাধ্যমে চিনের রেশম মধ্য এশিয়ার মধ্যদিয়ে ইরান ও রোমে রফতানি করা হত। কুষাণ রাজারা এখান থেকে প্রচুর শুল্ক আদায় করতেন। মিলিন্দপঞহো গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, মিনান্দারের রাজধানী সাকলে ভারতীয় পণ্য-বস্ত্র, সুগন্ধি ও মণিমুক্তার বাজার গড়ে উঠেছিল। সে যুগে তাম্রলিপ্ত ছিল পূর্ব ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। খ্রিস্টীয় 45 অব্দে আলেকজান্দ্রিয়া, রোম ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন চলত।
প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের জলসেচ ব্যবস্থা সম্পর্কে কী জানো?
প্রাচীন ভারতে দেখা গেছে যে, রাজারা দেশের কৃষির উন্নতির দিকে বিশেষ নজর দিতেন। ফলে গড়ে উঠত জলসেচ ব্যবস্থা। যার সাহায্যে কৃষিজমিতে কৃষকেরা জলসেচ করতে পারত। এই জলসেচ প্রকল্পকে বলা হত সেতু। সেতু আবার দু’রকমের হত। যথা – প্রাকৃতিক জলসেচ পদ্ধতি ও কৃত্রিম জলসেচ পদ্ধতি।
- সেতুর জল ব্যবহার করার জন্য কৃষকদের কর দিতে হত। সেচকার্যে ব্যবহার করা হত একধরনের যন্ত্র। যন্ত্রটি চাকার মতো। তার গায়ে লাগানো থাকত ঘটি। যখন চাকা ঘুরত তখন ঘটিগুলি জলে পূর্ণ হয়ে যেত এবং সেই জল ঘোরার সময় জমিতে পড়ত। এইভাবে বারংবার চাকা ঘুরত আর ঘটিগুলি থেকে জল জমিতে পড়ত।
- চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গুজরাটের কাথিয়াওয়াড়ে একটি হ্রদ বানিয়েছিলেন। তার নাম সুদর্শন হ্রদ। সম্রাট অশোক এই সেচ প্রকল্পটিতে কয়েকটি সেচ খাল যুক্ত করেছিলেন। 150 খ্রিস্টাব্দে এই সেচখালের সংস্কার করেন শকরাজা রুদ্রদামন। এর অনেক পর গুপ্তরাজা স্কন্দগুপ্ত এই হ্রদটি সংস্কার করেন।
প্রাচীন ভারতের কারিগর ও ব্যবসায়ী সংঘের পরিচয় দাও।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ব্যাবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কারিগর ও বণিকদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে শ্রেণি বা গণ।
উদ্দেশ্য
এই শ্রেণিগুলি গঠনের উদ্দেশ্য ছিল – কারিগরদের নিরাপত্তা দেওয়া, জিনিসের গুণমান বজায় রাখা ও দাম ঠিক রাখা।
- কুষাণ যুগে শ্রেণি – কুষাণ যুগে এক-একটি পেশাকে কেন্দ্র করে আলাদা গ্রাম গড়ে ওঠে। শ্রেণি বা সংঘগুলিতে মানুষ তাদের অর্থ আমানত রাখত। এই জমা অর্থের ওপর সুদও দেওয়া হত।
- গুপ্ত যুগে শ্রেণি – গুপ্ত ও তার পরবর্তী যুগে কারিগর ও ব্যবসায়ী শ্রেণিগুলির গুরুত্ব বেড়ে যায়। এগুলির কাজ তদারকির জন্য অনেক কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। এসময় বণিকরা নিজেদের সংঘ গড়ে তোলে। এগুলিকে বলা হত বণিকগ্রাম।
গুপ্ত আমলে সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথা সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
গুপ্ত আমলের সমাজে বর্ণাশ্রম প্রথা চালু থাকলেও তা কঠোরভাবে মানা হত না। এই সমাজে ব্রাহ্মণরা নীচুতলার মানুষকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। একই ধরনের অপরাধের জন্য ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের আলাদা শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। এই আমলে শূদ্ররা কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য করতে পারত। সমাজে সবথেকে খারাপ অবস্থা ছিল চন্ডালদের। তারা গ্রাম বা নগরের মধ্যে থাকতে পারত না। এমনকি ব্রাহ্মণরা তাদের ছোঁয়াছুঁয়ি এড়িয়ে চলত।
গুপ্তোত্তরকালের মেয়েদের সামাজিক অবস্থা কেমন ছিল?
বাৎস্যায়নের কামসূত্র, মৃচ্ছকটিকম নাটক, দশকুমারচরিত সহ বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র থেকে গুপ্তোত্তরকালের মেয়েদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়।
- এইসময়ে মেয়েদের কম বয়সে বিবাহের রীতি চালু ছিল।
- পিতৃদত্ত সম্পত্তি স্ত্রীধনের ওপর পূর্ণ অধিকার ছিল নারীদের।
- এই পর্বে মেয়েদের স্বামী নির্বাচনের অধিকার ছিল।
- গুপ্তোত্তরকালের সমাজে গণিকাবৃত্তি ও দেবদাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
গৌতম বুদ্ধের সময় খুব উন্নত মাটির পাত্র বানানোর যে শিল্প উন্নত হয়েছিল তাকে কী বলা হত? এই মাটির পাত্রের নজির হিসেবে কী কী পাওয়া গেছে?
গৌতম বুদ্ধের সময় ভারতে কুম্ভকারেরা মাটির পাত্র বানাতে এক বিশেষ কৌশল অবলম্বন করত। তারা ভালো মানের মাটি দিয়ে প্রথমে বিভিন্ন পাত্র বানাত। তারপর সেগুলিকে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হত। এরপর সেগুলিকে চুল্লির আগুনে পুড়িয়ে কালো করা হত। এগুলিকে বলা হত উত্তর ভারতের কালো চকচকে মাটির পাত্র।
এই পাত্রগুলির বিভিন্ন নজির বা নিদর্শন পাওয়া গেছে, যেমন – থালা ও বাটি।
ফাসিয়ানের লেখায় ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে কী জানা যায়?
চিনা পর্যটক ফাসিয়ান যখন ভারতবর্ষে আসেন সেসময় মগধের সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। তিনি ফো-কুয়ো-কি নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থ থেকে সমকালীন। ভারতবর্ষের সমাজ তথা সামাজিক জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। সেসময় ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক, নগরের অস্তিত্ব ছিল। এগুলির মধ্যে পাটলিপুত্র ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত। নগরগুলিতে চিকিৎসার জন্য বিনামূল্যে ঔষধ দেওয়া হত এবং চিকিৎসা করা হত। তখন নীচু প্রকৃতির লোকজনদের চন্ডাল বলা হত। এরা নগরের বাইরে বসবাস করত। ভারতের লোকরা খুব অতিথিপরায়ণ ছিল। তারা অতিথিদের সেবাযত্ন করতে সিদ্ধহস্ত ছিল।
কুষাণ যুগের অর্থনীতিতে কী কী দিক দেখা গিয়েছিল?
কুষাণ যুগের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। সেযুগে বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। সেযুগে বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণে কৃষিকাজ ছড়িয়ে পড়েছিল। দাক্ষিণাত্যের কালো মাটিতে ভালো তুলা জন্মাত। কৃষকরা ফসল ফলাতে নানা ধরনের কৃষি সরঞ্জাম ব্যবহার করত। জানা যায়, কুষাণ সাম্রাজ্যের সমস্ত জমি জায়গার মালিক রাষ্ট্র বা রাজারা ছিলেন না।
সেযুগের অর্থনীতির আরেকটি দিক ছিল ব্যাবসাবাণিজ্য। বাণিজ্যের উন্নতিতে জলপথ ও স্থলপথগুলির ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই আমলে কারিগরি শিল্প ও পেশা বৈচিত্র অনেক বেড়েছিল।
চিনা পর্যটক সুয়ান জাং -এর বর্ণনায় ভারতীয় সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে কী জানা যায়?
সুয়ান জাং ছিলেন একজন চিনা পর্যটক। তিনি সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে ভারতে এসেছিলেন। তিনি এদেশে 14 বছর ছিলেন। এদেশকে তিনি ইন-তু বলতেন। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি সি-ইউ-কি নামে একটি গ্রন্থ লেখেন। তা থেকে সমকালীন ভারতবর্ষের সমাজ তথা সামাজিক জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।
- তিনি বলেছেন সেসময় ভারতবর্ষ 5টি ভাগে বিভক্ত ছিল এবং এখানে 80টি রাজ্য ছিল। প্রত্যেক রাজ্যেই একজন করে রাজা ছিলেন। তবে তাঁরা সম্রাটের বড়ো অনুগত ছিলেন।
- তিনি বলেছেন ভারতবর্ষ একটি গরমের দেশ। এখানে নিয়মিত বৃষ্টিপাত হয়। পূর্ব ভারতের জমি ছিল খুবই উর্বর।
- জনগণের মধ্যে জাতিভেদ ছিল
- সমাজে সতীদাহপ্রথার চল ছিল। মেয়েরা শাস্ত্র পড়তে পারত না। বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ ছিল।
- তখন ভারতীয়রা ছিল সৎ, নম্র ও অতিথি-পরায়ণ।
- শহরের ঘরবাড়ি ইট ও টালি দিয়ে তৈরি হত। গ্রামের বাড়িগুলির দেওয়াল মাটি দিয়ে তৈরি হত।
সেতু কী? সেতু কয় প্রকার?
প্রাচীন ভারতে (মৌর্য, গুপ্তযুগে) সরকার অথবা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে জমিতে জলসেচনের ব্যবস্থা করা হত। এই প্রকল্পের আওতায় ছিল জলাধার নির্মাণ অথবা খাল খনন। এই প্রকল্পকেই বলা হত সেতু।
সেতু ছিল দুধরনের, যথা – প্রাকৃতিক সেতু এবং কৃত্রিম সেতু।
কুষাণ যুগে ভারতের দুটি বস্ত্র উৎপাদক কেন্দ্রের নাম লেখো। কুষাণ যুগে অবসর বিনোদনের উপায় কী ছিল?
কুষাণ যুগে ভারতের দুটি বস্ত্র উৎপাদক কেন্দ্র ছিল – বারাণসী ও মথুরা।
কুষাণ যুগের মানুষ নানাভাবে তাদের অবসর সময় কাটাতো। তা ছিল বিনোদনমূলক, যেমন – নাচ, গান ও অভিনয়। এছাড়া জাদু খেলা ও দড়ির কসরত দেখে মানুষ আনন্দ উপভোগ করত। ধনী লোকেরা পাশা খেলত, শিকার অভিযান করত, রথদৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। এছাড়া কুস্তি প্রতিযোগিতা দেখে তারা অবসর সময় কাটাত।
গুপ্তযুগের মুদ্রার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
গুপ্ত যুগে সোনা ও রুপোর মুদ্রার প্রচলন ছিল।
- সেযুগে প্রচলিত অর্থে সোনার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে, যেমন – সমুদ্রগুপ্তের বীণাবাদনরত মুদ্রা।
- গুপ্তমুদ্রায় রাজার চিত্র ছাড়াও বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিকৃতি খোদাই করা হত। এরূপ মুদ্রা হল চন্দ্রগুপ্তের লক্ষ্মীদেবী চিহ্নিত মুদ্রা।
- প্রথমদিকে গুপ্তমুদ্রার ভালো মান ছিল। কিন্তু শেষের দিকে তাতে খাদ মেশানো শুরু হয়েছিল। যা গুপ্ত অর্থনীতির দুর্বলতা স্পষ্ট করে।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের সপ্তম অধ্যায়, “অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের প্রথম ভাগ)” অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহায়ক হবে, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ!