এখনই আমাদের Telegram Community গ্রুপে যোগ দিন।। এখানে WBBSE বোর্ডের পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির যেকোনো বিষয়ভিত্তিক সমস্যা শেয়ার করতে পারেন এবং একে অপরের সাহায্য করতে পারবেন। এছাড়া, কোনও সমস্যা হলে আমাদের শিক্ষকরা তা সমাধান করে দেবেন।

Telegram Logo Join Our Telegram Community

ষষ্ঠ শ্রেণী – ইতিহাস – ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের ধারা (প্রথম পর্যায় : আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০-১৫০০ অব্দ) – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের তৃতীয় অধ্যায়, ‘ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের ধারা (প্রথম পর্যায় : আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০-১৫০০ অব্দ)’ অধ্যায়ের কিছু রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও সহায়ক। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণী এবং চাকরির পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই আসতে দেখা যায়।

ষষ্ঠ শ্রেণী - ইতিহাস - ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের ধারা
ষষ্ঠ শ্রেণী – ইতিহাস – ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের ধারা
Contents Show

মেহেরগড় সভ্যতার আবিষ্কার, প্রাচীনত্ব ও বিস্তৃতি সম্বন্ধে যা জানো লেখো।

নব্য প্রস্তরযুগে মানুষের জীবনযাত্রার চরিত্র অনেকটাই পালটে যায়। এই সময় মানুষ খাদ্য সংগ্রাহক থেকে খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়। এই পর্বে ভারতীয় উপমহাদেশে মেহেরগড় সভ্যতার আবির্ভাব ঘটেছিল।

মেহেরগড় সভ্যতার আবিষ্কার, প্রাচীনত্ব ও বিস্তৃতি –

  • আবিষ্কার – 1974 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কার করেন। এই সভ্যতা আবিষ্কারে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ রিচার্ড মেডো।
  • প্রাচীনত্ব – সভ্যতাটির ধ্বংসাবশেষ ও ব্যবহৃত নানা দ্রব্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে ঐতিহাসিকেরা ঘোষণা করেন মেহেরগড় সভ্যতাটি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 7000 অব্দে গড়ে উঠেছিল। এই সভ্যতাটির প্রথম স্তরগুলি নব্য প্রস্তরযুগের সমসাময়িক।
  • অবস্থান – বর্তমান পাকিস্তানের বোলান গিরিপথের কাছে ঝোব নদীর তীরে কাচ্ছি সমভূমিতে মেহেরগড় সভ্যতা অবস্থিত ছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন।। মেহেরগড় ছাড়া কিল-গুল-মোহম্মদ, গুমলা, বুরজাহোম, সরাইখোলা, আনজিরা প্রভৃতি ছিল এই সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
  • বিস্তৃতি – আধুনিক ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, বেলুচিস্তানের ঝোব নদী থেকে পশ্চিম ভারতের সিন্ধুনদ পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল জুড়ে মেহেরগড় সভ্যতা প্রায় 500 একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃতি লাভ করেছিল।

মনে রেখো – মেহেরগড় সভ্যতার দ্বিতীয় পর্যায়ে মৃৎপাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলি ছিল আগুনে পোড়ানো। লাল ও কালো রঙের এই মৃৎপাত্রগুলি কুমোরের ঢাকার সাহায্যে তৈরি করা হত।

মেহেরগড় সভ্যতার কী কী নিদর্শন পাওয়া গেছে? এই সভ্যতার পতনের কারণ উল্লেখ করো।

খননকার্যের ফলে মেহেরগড় সভ্যতার নানা নিদর্শন পাওয়া গেছে। প্রথম পর্যায়ে রোদে শুকনো কাঁচা ইট, মৃতদেহের সমাধি প্রভৃতি পাওয়া গেছে।

মেহেরগড় সভ্যতার নিদর্শন –

  • নানা পেশার নিদর্শন – মেহেরগড় সভ্যতার প্রথমদিকে মানুষের জীবিকা ছিল শিকার ও পশুপালন। পরবর্তী সময়ে চাষাবাদ বা কৃষিকাজ ছিল অন্যতম জীবিকা। তাই কৃষিতে ব্যবহৃত পাথরের ছোটো ছোটো হাতিয়ার, কাস্তে, নিড়ানি, কুড়ুল প্রভৃতি পাওয়া গেছে। এছাড়া অন্যান্য পেশায় ব্যবহৃত তামার ছুরি ও বড়শি, হাড়ের সুচ, তুরপুন, ঝিনুক ও পাথরের লকেট, কানপাশা, হাড়ের আংটি, পাথরের শিলনোড়া পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিক সিরিন রত্নাগর মনে করেছেন যে, সুতিবয়ন বিদ্যা মেহেরগড়বাসীর অজানা ছিল না।
  • মৃৎশিল্পের নিদর্শন – মেসোপটেমিয়া থেকে কুমোরের ঘুরন্ত চাকা আনার ফলে সুদৃশ্য ও কারুকার্যময় মৃৎপাত্র মৃৎশিল্পে নতুন মুনশিয়ানার অভিষেক ঘটায়। এর ফলে বহুবর্ণময় মৃৎপাত্র, শস্য রাখার বিশালাকার মাটির জালা, পোড়ামাটির নারীমূর্তি, তামা গলানোর পোড়া মাটির পাত্র পাওয়া গেছে।
মেহেরগডের এর পোড়া মাটির নারী মূর্তি
মেহেরগডের এর পোড়া মাটির নারী মূর্তি

মেহেরগড় সভ্যতার পতনের কারণ –

আনুমানিক 2500 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে মেহেরগড় সভ্যতার। পতন ঘটে বলে অনুমান করা হয়। এর জন্য কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করা যায়। যথা-

  • প্রাকৃতিক বিপর্যয় – প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা জলবায়ুর পরিবর্তন হলে এখানকার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে গমন করে।
  • বহিঃশত্রুর আক্রমণ – বহিঃশত্রুর আক্রমণকে এই সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়।
  • মন্তব্য – তবে ঐতিহাসিকরা একমত যে, মেহেরগড় সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতায় লীন হয়ে গিয়েছিল।

মেহেরগড় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

মেহেরগড় সভ্যতার উত্তরণের প্রায় সাতটি স্তরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলির মাধ্যমে পশুপালকের জীবন থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনে উত্তরণের একটি চিত্র পাওয়া যায়।

মেহেরগড় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য –

  • কৃষি অর্থনীতির বিকাশ – মেহেরগড় সভ্যতার মানুষেরা কৃষির ওপরই প্রধানত বেশি নির্ভরশীল ছিল। এখানকার অধিবাসীরা গম, যব, বার্লি, নানারকম খাদ্যশস্য, কার্পাস, তুলো প্রভৃতির চাষ করত।
  • পশুপালন – প্রাথমিক পর্বে পশুশিকার ও পশুপালনই ছিল মেহেরগড় সভ্যতার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা। এখানে প্রায় বারো ধরনের জন্তুর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে অনেকগুলি আজ লুপ্তপ্রায়। এখানে মোষ ও ষাঁড়ের হাড় পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া ভেড়া, ছাগল, নীলগাই, হরিণ, হাতি, শূকরের হাড় আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • সমাজব্যবস্থা – ঐতিহাসিকদের মতে, মেহেরগড় সভ্যতার সমাজে তিনটি বা চারটি শ্রেণি ছিল। তবে সমাজে ব্রাহ্মণ ও বণিক শ্রেণির প্রাধান্য ছিল অনেক বেশি।
  • হাতিয়ার – এখানকার মানুষেরা ছুরি, বড়শি এবং পাথরের নানা অস্ত্র হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। হাড়ের ছুঁচ, তুরপুন ইত্যাদির পাশাপাশি তারা ধাতুর তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করত।

সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ রচনা করো।

অথবা, সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা কেমন ছিল?

প্রাচীন ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা হল সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা। সিন্ধুনদের অববাহিকায় এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।

সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা –

সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এটি একটি পরিকল্পিত নগর সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে বোঝা যায় যে, এই সভ্যতার নগর পরিকল্পনা বেশ উন্নত স্তরে পৌঁছেছিল।

  • বাড়িঘর – সিন্ধু সভ্যতায় রাস্তার দুইপাশে পরিকল্পিতভাবে একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত বাড়িঘর তৈরি হত। তবে। বড়ো রাস্তার দিকে বাড়িগুলির দরজা-জানালা থাকত না। প্রতি বাড়িতে একটি করে স্নানাগার থাকত।
  • রাস্তাঘাট – সিন্ধু সভ্যতার আর-একটি বৈশিষ্ট্য হল এর চওড়া, সোজা ও পাকা রাস্তাঘাট। মহেন-জো-দারোর প্রধান রাস্তার মাপ ছিল ৩৪ ফুট। রাস্তাগুলি সোজা পূর্ব থেকে পশ্চিমে বা উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত ছিল। মূল রাস্তা থেকে গলিপথগুলি বের হত।
  • পোড়া ইটের ব্যবহার – সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা রোদে শুকোনো ও আগুনে পোড়ানো দুই ধরনের ইটই বাড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করত। এখানে আগুনে পোড়ানো ইটগুলি প্রথমদিকে পাতলা প্রকৃতির হলেও, কিছু ইটের মাপ ছিল 11 ইঞ্চি লম্বা, 52 ইঞ্চি চওড়া ও 20 ইঞ্চি পুরু।
  • পাতকুয়োর ব্যবহার – সিন্ধু সভ্যতায় প্রতিটি বাড়িতে এবং রাস্তার ধারে পাতকুয়োর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মনে করা হয়, ওই পাতকুয়োগুলির জল সিন্ধুবাসীরা পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করত।
সিন্ধু সভ্যতায় ব্যবহৃত পাতকুয়ো
সিন্ধু সভ্যতায় ব্যবহৃত পাতকুয়ো
  • পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা – সিন্ধু সভ্যতায় জলনিকাশির জন্য উন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। নর্দমাগুলি নিয়মিত পরিষ্কার করা এবং ঢেকে রাখার (আধুনিক ম্যানহোল) ব্যবস্থা ছিল। রোমান ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্যতায় এত উন্নত ধরনের পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল না।
  • স্বাস্থ্য সচেতনতা – নাগরিক স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ রেখে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্যেক বাড়িতে শৌচাগার, উন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা, ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা, পরিকল্পিতভাবে বাড়ি তৈরি প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
  • স্নানাগার – মহেন-জো-দারো-তে 180×108 ফুট এলাকার স্নানাগারের মাঝে 39 ফুট লম্বা, 23 ফুট চওড়া 38 ফুট গভীরতা বিশিষ্ট জলাশয় ছিল। এই স্নানাগারটির উপরিভাগে সিঁড়ির মতো ধাপ ছিল এবং পোশাক পরিবর্তনের জন্য পৃথক ঘর ছিল। এখানে নোংরা জল বের করার এবং পরিষ্কার জল প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা ছিল।
  • শস্যাগার – সিন্ধু সভ্যতার প্রত্যেক নগরেই বড়ো বড়ো। শস্যাগার ছিল। হরপ্পাতে ইরাবতী নদীর তীরে একটি বিশাল শস্যাগারের সন্ধান পাওয়া গেছে।
  • নগর দুর্গ – সিন্ধু সভ্যতায় উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা নগর দুর্গের বা সিটাডেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। অনুমান করা হয় এখানে শাসক গোষ্ঠীর বাসগৃহ ও কার্যালয় ছিল।
সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ রচনা করো।
সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ রচনা করো।

জেনে রাখো – সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা সোনার তৈরি বিভিন্ন অলংকার ব্যবহার করত বলে জানা গেছে। রুপোর তৈরি বাসনপত্র ও গহনাও পাওয়া গেছে।

সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক জীবন সম্বন্ধে আলোচনা করো।

ভারতের প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে সিন্ধু সভ্যতা অন্যতম এবং অবশ্যই অনন্য। এর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবন ছিল বেশ আকর্ষণীয়।

সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক জীবন –

  • শ্রেণিবৈষম্য – সিন্ধু সভ্যতার সমাজে শ্রেণিবৈষম্য ছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মত প্রকাশ করেছেন। অধ্যাপক এ ডি পুসলকর সিন্ধু সভ্যতার জনসমাজকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যথা শিক্ষিত সম্প্রদায়, যোদ্ধা, বণিক এবং কর্মকার ও শ্রমিক শ্রেণি। সিন্ধু সভ্যতার দুর্গ ও নগরের পাকাবাড়ির পাশাপাশি ঝুপড়ি জাতীয় সারিবদ্ধ ঘরগুলি সমাজে শ্রেণিবৈষ্যম্যের অস্তিত্বকে চিহ্নিত করে। তবে সামাজিক শ্রেণিগুলির মধ্যে পুরোহিত সম্প্রদায়ের গুরুত্ব ছিল বেশি।
  • কৃষিকর্ম – সিন্ধুবাসীদের সামাজিক জীবনের অনেকটাই আবর্তিত হত কৃষিকর্মের দ্বারা। কোনো সমাজে কৃষি অর্থনীতির বিকাশ না হলে নাগরিক সমাজের বিকাশ ঘটে না। সিন্ধু সভ্যতার জমি সিন্ধুনদের অববাহিকায় অবস্থিত হওয়ায় তা কৃষির বিকাশের অনুকূল ছিল। সিন্ধু সভ্যতার খননকার্যের ফলে পাওয়া নানা তথ্য এবং শস্য রাখার গোলার উপস্থিতি প্রমাণ করে সিন্ধু সভ্যতায় কৃষিকাজ বেশ উন্নত ছিল।
  • পোশাক ও অলংকার – সিন্ধুবাসীদের পোশাক-পরিচ্ছদ, বিলাসদ্রব্য এবং গহনা বেশ উন্নতমানের ছিল। এরা সুতি ও পশম উভয়ধরনের পোশাকই ব্যবহার করত। নারীরা সাধারণত দু-ধরনের পোশাক ব্যবহার করত। অলংকার হিসেবে নূপুর, আংটি, বাজু, হার, বালা, দামি পাথর ব্যবহার। করত। সেই সময় সোনার ব্যবহার হত বলে জানা গেছে।
  • খাদ্য – সিন্ধুবাসীরা খাদ্য হিসেবে বিভিন্ন দ্রব্য গ্রহণ করত। দুধ, খেজুর, গম, যব তারা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। এ ছাড়া মাছ, মাংস তাদের প্রিয় খাবার ছিল।

সিন্ধু সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন সম্বন্ধে লেখো।

সিন্ধু সভ্যতা ছিল ভারত তথা পৃথিবীর একটি প্রাচীনতম সভ্যতা। এই সভ্যতার প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ভিত্তিতে সেযুগের অর্থনীতি সম্পর্কে অনেক কথা জানা যায়।

সিন্ধু সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন

  • কৃষিকাজ ও পশুপালন – সিন্ধুবাসীদের অর্থনৈতিক জীবন প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ হলেও এর পাশাপাশি পশুপালনও গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছিল। গৃহপালিত পশুর মধ্যে ষাঁড়, উট, ছাগল, ভেড়া ছিল অন্যতম।
  • শিল্প – সিন্ধু উপত্যকায় নানা ধরনের শিল্প গড়ে উঠেছিল।। এ সময় বস্ত্রশিল্পের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। এ ছাড়া ইট তৈরি, কাঠের জিনিস তৈরি, নৌকা তৈরি শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছিল। হরপ্পার উজ্জ্বল মৃৎশিল্প উন্নতমানের শিল্পবোধের পরিচয় বহন করে। কারুশিল্প এসময় বেশ উন্নতস্তরে পৌঁছেছিল।
  • ব্যাবসাবাণিজ্য – ব্যাবসাবাণিজ্য ছাড়া নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটে না। সিন্ধু সভ্যতার নগর সংস্কৃতির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ। ছিল তার ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতি। সিন্ধু সভ্যতায় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুই ধরনের বাণিজ্যই চলত। মিশর, মেসোপটেমিয়া, পারস্য প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। লোথাল বন্দরের মাধ্যমে এ সময় বহির্বিশ্বের সঙ্গে সমুদ্র বাণিজ্য চলত।
লোথাল প্রত্নস্থল
লোথাল প্রত্নস্থল
  • ওজন ও পরিমাপক – সিন্ধু সভ্যতায় ওজন ও পরিমাপের বিশুদ্ধতার প্রতি নজর দেওয়া হত। মহেন-জো-দারোর বিভিন্ন স্থানে পাথরের বাটখারা আবিষ্কৃত হয়েছে। অল্প ওজনের ক্ষেত্রে ‘দ্বিগুণন’ পদ্ধতির (যেমন – 2,8,16,32 ইত্যাদি) ব্যবহার ছিল। এখানে দাঁড়িপাল্লার ব্যবহার ছিল বলে জানা গেছে।

জান কি? – মেসোপটেমীয় সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু অধিবাসীদের ব‍্যাবসাবাণিজ্য চলত। মেসোপটেমিয়ার মানুষেরা সিন্ধু সভ্যতাকে সম্ভবত ‘মেলুহা’ বলে উল্লেখ করেছে। উভয় সভ্যতার মধ্যে নানা ধরনের দ্রব্যের ত্যামদানি-রফতানি হত।

সিন্ধু সভ্যতার রাজনৈতিক জীবনের ওপর আলোকপাত করো।

হরপ্পা সভ্যতার রাজনৈতিক জীবন কেমন ছিল তা নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে আজও পৌঁছোনো যায়নি। তবে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে পন্ডিতগণ এ বিষয়ে আলোকপাত করে থাকেন।

সিন্ধু সভ্যতার রাজনৈতিক জীবন

  • কেন্দ্রীয় শাসক – পণ্ডিতগণ মনে করেন, সেখানে যে একটি কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী ও একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিক ডি ডি কোশাম্বির মতে, সেখানে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন গড়ে উঠেছিল। তা না-হলে এমন পরিকল্পিত নগর পরিকল্পনা এবং একই ধরনের ওজন, পরিমাপ ও সিলমোহরের প্রচলন সম্ভব হত না।
  • পুরোহিত রাজা – ঐতিহাসিক মার্টিমার হুইলারের মতে, সিন্ধু উপত্যকা ছিল একটি সাম্রাজ্য। সেখানে খুব সম্ভবত পুরোহিত রাজার শাসন চালু ছিল।
  • পৌরশাসন – অনেকেই মনে করেন সিন্ধু সভ্যতায় কেন্দ্রীভূত পৌরশাসন ব্যবস্থা চালু ছিল। তা না-হলে এমন একটি পরিকল্পিত নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে ওঠা কখনোই সম্ভব হত না। সেখানকার অধিবাসীরা পৌর প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়মকানুন মেনে চলতে বাধ্য থাকত। তাই প্রতিটি নগরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, পয়ঃপ্রণালী সবকিছুই পৌরবিধি মেনে নির্মিত হত।

হরপ্পার ধর্ম সম্পর্কে লেখো।

অথবা, সিন্ধু অধিবাসীদের ধর্মীয় জীবন কেমন ছিল?

অথবা, হরপ্পা সভ্যতার মানুষের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে লেখো।

সিন্ধু সভ্যতায় অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। তারই ভিত্তিতে পণ্ডিতগণ সেযুগের মানুষের ধর্মীয় জীবনের ওপর আলোকপাত করেছেন।

সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম

  • মাতৃদেবীর আরাধনা – সিন্ধু সভ্যতায় বহু মাতৃদেবীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, সিন্ধুবাসীদের ধর্মবিশ্বাসে মাতৃদেবীর প্রাধান্য ছিল। মূর্তি-গুলির গায়ে ধোঁয়ার চিহ্ন দেখে মনে করা হয় যে মূর্তিগুলির সামনে প্রদীপ বা ধূপ জ্বালিয়ে দেবীকে সন্তুষ্ট করে প্রার্থনা করা হত।
  • পশুপতি শিব – সিন্ধু সভ্যতায় আবিষ্কৃত একটি সিলমোহরে হাতি, গন্ডার, মোষ, বাঘ ও হরিণ-এই পাঁচটি পশু পরিবেষ্টিত একটি যোগী পুরুষের অবয়ব লক্ষ করা। গেছে। মূর্তিটির তিনটি মুখ ও মাথায় শিং দেখে পণ্ডিতরা মনে করেন এটি পশুপতি শিব বা আদি শিবের মূর্তি।
  • প্রাকৃতিক শক্তি – সিন্ধু সভ্যতায় বৃক্ষ, অগ্নি প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতারূপে উপাসনা করা হত। এর পাশাপাশি এখানে লিঙ্গ ও যোনি পূজারও প্রচলন ছিল। কালিবঙ্গান ও লোথালে কয়েকটি ‘অগ্নিশালা’ পাওয়া গেছে। এ থেকে এখানে অগ্নিপুজো হত বলে মনে করা হয়। সূর্যের প্রতীকরূপে এখানে স্বস্তিক চিহ্ন (卐) ব্যবহার করা হত।
  • মৃতদেহ সৎকার – সিন্ধু সভ্যতার পারলৌকিক ক্রিয়া দেখে মনে করা হয় সিন্ধুবাসীরা পরলোকে বিশ্বাস করতেন। এখানে মৃতদেহ সমাধি দেওয়া হত। সমাধির ভিতরে গয়না ও মাটির পাত্র রাখা হত। মৃতদেহের মাথা উত্তর দিক করে শুইয়ে রাখা হত।

উপসংহার – ঐতিহাসিক ব্যাসাম মনে করেন যে, সিন্ধু সভ্যতা ধর্মকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছিল। আবার হুইলার ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন।

মনে রেখো – মহেন-জো-দারো বা হরপ্পায় সেভাবে কোনো দেবায়তন ঐতিহাসিকেরা খুঁজে পাননি, কিন্তু নারীমূর্তির প্রাধান্য দেখে মনে করা হয় এখানে মাতৃপুজোর চল ছিল। মূর্তিগুলির সামনে ধূপ, প্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা ছিল বলে মনে করা হয়।

হরপ্পার সমাধিপ্রথা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

হরপ্পা সভ্যতায় মৃতদেহের সৎকার করা হত মূলত সমাধি- প্রথায়। খননকার্যের মাধমে মৃতদেহ সমাধিস্থ করার তিনটি পদ্ধতি লক্ষ করা যায়।

হরপ্পা সভ্যতার সমাধিপ্রধা

সমাধি পদ্ধতি

  • প্রথম পদ্ধতি – এই পদ্ধতিতে মৃতদেহের সঙ্গে তার প্রিয় খাদ্যদ্রব্য, আসবাবপত্র, গয়নাগাটি ইত্যাদিও কবরস্থ করা হত।
  • দ্বিতীয় পদ্ধতি – এই পদ্ধতিতে কেবলমাত্র মৃতদেহকে কবরস্থ করা হত।
  • তৃতীয় পদ্ধতি – মৃতদেহকে ভস্মীভূত করে সেই ভস্ম একটি পাত্রে রেখে তা সমাধিস্থ করা হত।
হরপ্পার সমাধিস্থল
হরপ্পার সমাধিস্থল

সমাধি রীতি

হরপ্পা সভ্যতায় মৃতদেহ সমাধিস্থ করার কতকগুলি বিশেষ রীতি ছিল। যেমন – মৃতদেহকে সাধারণত সমাধিস্থ করার সময় উত্তর থেকে দক্ষিণে শায়িত করার রীতি ছিল। তার সঙ্গে দেওয়া হত গড়ে 15টি পাত্র এবং পশুর সন্ধিস্থলের মাংস। তবে কোনো কোনো অঞ্চলে খননকার্যের মাধ্যমে কয়েকটি যুগ্ম সমাধিও পাওয়া গেছে। যার থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, পাশাপাশি দুটি মৃতদেহকে কখনো-কখনো সমাধিস্থ করার রীতি ছিল। তবে এই ধরনের রীতি একইসঙ্গে প্রিয়জনের মৃত্যু হলে পালন করা হত বলে মনে করা হয়।

বিশ্বের সমকালীন সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সম্পর্ক আলোচনা করো।

অথবা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে হরপ্পা সভ্যতার ভূমিকা আলোচনা করো।

অথবা, এই সভ্যতার বাণিজ্য সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

সিন্ধু সভ্যতা ভারতের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। সিন্ধুনদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা নদীমাতৃক ও নগরকেন্দ্রিক এই সভ্যতার সঙ্গে বিশ্বের সমকালীন অন্যান্য সভ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে মেসোপটেমীয় ও মিশরীয় সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার নিবিড় যোগাযোগ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

বিশ্বের সমকালীন সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সম্পর্ক

সিন্ধু সভ্যতা ও সুমের সভ্যতা

সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সুমের সভ্যতার, বিশেষত পরবর্তীকালের মেসোপটেমিয়া সভ্যতার যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। প্রমাণস্বরূপ বলা যায় –

  • মহেন-জো-দারোর সিলমোহরগুলির সঙ্গে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সিলমোহরগুলির সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।
  • সুমেরের সিলমোহর, খোদাই করা পাত্র, দীপাধার প্রভৃতি সিন্ধু সভ্যতায় আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • উভয় সভ্যতার মধ্যে জলপথে ব্যাবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন জিনিস যেমন মেসোপটেমিয়ায় রফতানি হত, তেমনি মেসোপটেমিয়া থেকে নীলকান্তমণি, মূল্যবান ধাতু সিন্ধু সভ্যতায় আমদানি করা হত।
  • মেসোপটেমিয়ার ‘আক্কাদ’ অঞ্চলে সম্ভবত ভারতীয় বণিকদের উপনিবেশের অস্তিত্ব উভয় সভ্যতার মধ্যে যোগাযোগের প্রমাণ দেয়।
  • সুমেরের বেশ কিছু দলিলে ‘মেলুহা’ নামক একটি জায়গার নাম উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিকদের মতে, ওই জায়গাটি সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চল।

সিন্ধু সভ্যতা ও মিশরীয় সভ্যতা

সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে মিশরীয় সভ্যতার সম্পর্ক ছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। প্রধানত জলপথে ব্যাবসার সূত্র ধরে উভয় সভ্যতার মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। উভয় সভ্যতার মধ্যে যোগাযোগের প্রমাণস্বরূপ বলা যায় –

  • সিন্ধু সভ্যতায় ষাঁড়ের পায়ের আদলে তৈরি পায়া যুক্ত টুল আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • উভয় সভ্যতার দীপধার বা মোমবাতিদানির (Candle stand) মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে।
  • সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত মাতৃকামূর্তি প্রমাণ করে উভয় সভ্যতার মধ্যে যোগাযোগ ছিল।

অন্যান্য সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক

অনেক ঐতিহাসিকের মতে, আমরি ও কুল্লি সভ্যতার সঙ্গেও সিন্ধু সভ্যতার কিছু কিছু বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে। আমরি সভ্যতায় মৃৎপাত্রগুলির সঙ্গে সিন্ধুর মৃৎপাত্রগুলির সাদৃশ্য রয়েছে। সব মিলিয়ে তৎকালীন নদীমাতৃক সভ্যতাগুলির সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে অনুমান করা যায়।

তাম্র-ব্রোঞ্জ/তাম্র-প্রস্তর যুগে উৎপাদন ব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন লক্ষ করা যায়?

নব্য প্রস্তর যুগের পর পৃথিবীতে আসে তাম্র প্রস্তর যুগ। ওই যুগে ব্রোঞ্জ আবিষ্কৃত হওয়ায় উৎপাদন ব্যবস্থায় দারুণ উন্নতি হয়। ফলে মানবসভ্যতারও শ্রীবৃদ্ধি হয়।

তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগে উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন

  • কৃষির উন্নতি – এযুগে তামা ও টিন মিশিয়ে উন্নতমানের ব্রোঞ্জ ধাতু আবিষ্কৃত হয়। ব্রোঞ্জ দিয়ে মানুষ লাঙল, কাস্তে, নিড়ানি, কুড়ুল প্রভৃতি যন্ত্রপাতি তৈরি করে। এর ফলে চাষবাসের উন্নতি হয়। ফসলের উৎপাদন বেড়ে যায়। এইভাবে মানবসভ্যতার দ্রুত উন্নতি ঘটে।
  • শ্রম বিভাজন – এযুগে দ্রব্য উৎপাদন হত শ্রম বিভাজন দ্বারা। অর্থাৎ, এক একজন মানুষ এক একটি বিশেষ পণ্য তৈরি করত। ছুতোররা তৈরি করত কাঠের আসবাব, কুমোররা মাটির পাত্র, কৃষকরা ফলাত ফসল, কামাররা তৈরি করত ধাতব জিনিসপত্র ইত্যাদি। এর ফলে পণ্য উৎপাদন যেমন বাড়ে, তেমনই পণ্যগুলি হত উন্নতমানের। এই উন্নত পণ্যগুলির বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য বণিকরা তাদের নিজস্ব সিলমোহর ব্যবহার করত। যেমনটা করত সিন্ধুসভ্যতার বণিকরা।
  • কৃষির প্রসার – এযুগে চাষবাসের দারুণ প্রসার হয়। ব্রোঞ্জের তৈরি কুড়ুল, কাটারি দিয়ে বনজঙ্গল সাফ করে চাষের জমি বাড়ানো হয়। এযুগে চাষিরা জমিতে জলসেচের ব্যবহার শেখে। তাই জমিতে ফসলের উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে যায়।
  • উপসংহার – তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নতি হয়। জানা যায়, এযুগে সিন্ধুবাসীরা পশ্চিম-এশিয় সভ্যতাগুলির সঙ্গে পণ্য বিনিময় করত। উল্লেখ্য যে, এযুগের মানুষ দ্রব্য কেনাবেচা করত দ্রব্যের বিনিময়ে। কারণ তখন মুদ্রার প্রচলন হয়নি।

সিন্ধু সভ্যতার পতনের বা ধ্বংসের কারণ আলোচনা করো।

অথবা, হরপ্পা সভ্যতা পতনের জন্য কোন্ কোন্ কারণ দায়ী ছিল?

অথবা, হরপ্পা সভ্যতা কেন ধ্বংস হয়েছিল বলে তোমার মনে হয়?

সিন্ধু সভ্যতা ভারতের একটি প্রাচীন ও উন্নত নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। কিন্তু এত উন্নত ও সমৃদ্ধ সভ্যতার যে-ঠিক কী কারণে পতন হয়েছিল তা ঐতিহাসিকদের কাছে আজও রহস্যাবৃত। তবে আনুমানিক 1500 খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার পতন হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ

  • জলবায়ুর পরিবর্তন – সিন্ধু সভ্যতাকে তিলোত্তমার মতো রূপদান করার জন্য ইট আগুনে পোড়ানো হয়েছিল। আর ইট পোড়ানোর জন্য যথেচ্ছভাবে গাছ কাটায় জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছিল। এর ফলে সিন্ধু সভ্যতা একটি মরুপ্রায় অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল।
  • বন্যা – অনেক ঐতিহাসিকের মতে, শেষের দিকে সিন্ধুনদে পলি পড়ায় বন্যা হয়েছিল, যা সিন্ধু সভ্যতার পতনের আর-এক অন্যতম কারণ। সিন্ধুনদে বাঁধ দেওয়া সত্ত্বেও সিন্ধু সভ্যতা সাতবার ধ্বংস হয়েছিল এবং পুনরায় তা নির্মিত হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
  • ভূমিকম্প – জলবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় জানা গেছে যে, হরপ্পায় ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল। তা ছাড়া সিন্ধু সভ্যতায় আবিষ্কৃত মানুষের কঙ্কালগুলি রাস্তায়, স্নানাগারে পড়ে থাকতে দেখে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, এখানে মৃত্যু এসেছিল অতর্কিতে। এই আকস্মিক মৃত্যুর কারণ ভূমিকম্প ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন।
  • জনসংখ্যা বৃদ্ধি – সিন্ধু সভ্যতার প্রথমদিকে বাড়িগুলি পরিকল্পনামাফিকভাবে তৈরি হলেও পরবর্তীকালে বাড়িগুলির ঘিঞ্জি অবস্থান প্রমাণ করে যে, জনসংখ্যার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি ঘটেছিল। ফলে খাদ্যাভাব ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সিন্ধু সভ্যতার পতনকে অনেকখানি ত্বরান্বিত করেছিল।
  • সিন্ধুনদের গতিপথ পরিবর্তন – ঐতিহাসিকদের মতে, সিন্ধুনদ গতিপথ পরিবর্তন করার ফলে জনবসতির মূলকেন্দ্র থেকে সিন্ধুনদের প্রবাহ পথ অনেকদূরে সরে যায়। এর ফলে সিন্ধু সভ্যতার গ্রাম ও শহরাঞ্চলগুলি উয় মরুভূমিতে পরিণত হয়। এই কারণে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়।
  • বহিঃশত্রুর আক্রমণ – সিন্ধু সভ্যতায় আবিষ্কৃত কঙ্কালগুলির অবস্থান, তাতে আঘাতের চিহ্ন, সিন্ধুবাসীদের আত্মরক্ষামূলক অস্ত্রের অনুপস্থিতি প্রভৃতি লক্ষ করে অনেক ঐতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য বহিঃশত্রুর আক্রমণকে দায়ী করেছেন।

তাম্র-প্রস্তর যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

নব্য প্রস্তর যুগের পর পৃথিবীতে তাম্র প্রস্তর যুগ শুরু হয়। এযুগে গড়ে ওঠে এক উন্নত সভ্যতা।

তাম্র-ব্রোঞ্জ কেন বলা হয়/বৈশিষ্ট্য

  • সময় – তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগের সময়কাল ধরা হয় প্রায় ৩ হাজার খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এযুগে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সভ্যতাগুলির মধ্যে ছিল সিন্ধু সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা ইত্যাদি।
  • কেন তাম্র-ব্রোঞ্চ যুগ – এযুগের মানুষ তামা ও টিন মিশিয়ে নতুন একটি ধাতু তৈরি করতে শেখে। তাই এই সভ্যতার নাম তাম্র-ব্রোঞ্জ সভ্যতা। এযুগের মানুষ তামা ও ব্রোঞ্জের তৈরি হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার শুরু করে।
  • বিনিময় প্রথা – এযুগে ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নতি হয়।। এযুগের মানুষ দ্রব্য বিনিময় করে দ্রব্য কিনত। কারণ তখন মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
  • বিভিন্ন পেশা – এযুগে বিভিন্ন পেশার উদ্ভব হয়। যেমন চাষি, কামার, কুমোর, তাঁতি ইত্যাদি।
  • শ্রেণিবিভাগ – এযুগেই প্রথম মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়। এই শ্রেণির মধ্যে ছিল ছোটো ব্যবসায়ী, চিকিৎসক প্রভৃতি। সবার উপরে ছিল ধনী। আর সমাজের নীচে ছিল গরিব শ্রেণি।
  • রাষ্ট্রের ধারণা – এযুগের এক একটি গোষ্ঠী এক একটি জনপদ গড়ে তুলত। এই জনপদগুলিই রাষ্ট্রে পরিণত হয়। গোষ্ঠীর নেতারা হলেন রাজা। তাঁরা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের। মানুষদের নিরাপত্তা দিতেন।

সিন্ধু সভ্যতা খনন করে যে-সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে কীভাবে বলা যায় যে, সিন্ধুবাসীরা যথেষ্ট স্বাস্থ্যসচেতন ছিল?

সিন্ধুবাসীরা যে তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন ছিল তা প্রমাণিত হয় সেখানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি দেখে। যমন –

সিন্ধুবাসীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা –

  • তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাড়িঘর তৈরি করত। ঘরের বায়ু চলাচলের জন্য ঘরের উপরদিকে ঘুলঘুলি রাখা হত।
  • সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত কূপ ও স্নানাগারগুলি দেখে মনে হয় সিন্ধুবাসীরা স্নান পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিল। প্রতিটি বাড়ির উঠোনেই পাওয়া গেছে কূপ। কেবলমাত্র মহেন-জো- দারোতেই 700টি কূপ পাওয়া গেছে।
  • সেসময় তারা এক উন্নত জলনিকাশি ব্যবস্থা অনুসরণ করত।
  • তারা যেখানে-সেখানে আবর্জনা ফেলত না। তার প্রমাণ দেয় প্রতিটি বাড়ির সামনে প্রাপ্ত ডাস্টবিনগুলি।
  • আর্নেস্ট ম্যাকে তাঁর লেখায় সোকপিট বা নিষ্কাশন কূপের উল্লেখ করেছেন যা সিন্ধু সভ্যতার উন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার সূচক।
  • তারা কখনোই নগরনির্মাণ রীতি লঙ্ঘন করত না। রাস্তার দু-ধারে নির্মিত বাড়িঘরগুলিই তার প্রমাণ।

সিন্ধু সভ্যতার পয়ঃপ্রণালী বা নিকাশি ব্যবস্থা কেমন ছিল?

1948 খ্রিস্টাব্দে আর্নেস্ট ম্যাকের লেখা Early Indus Civilization বইতে সিন্ধু সভ্যতার পয়ঃপ্রণালী বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়। এই সভ্যতা ছিল একটি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। এই সভ্যতায় এক উন্নতমানের পয়ঃপ্রণালী বা নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।

  • ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট তৈরির আগেই প্রত্ননগরগুলিতে মূল নর্দমাগুলি তৈরি করা হত। এগুলি তৈরি হত রাস্তার দু-ধারে। এর মূল উপকরণ ছিল পোড়ামাটির ইট। বাড়ির নোংরা জল এই নর্দমাগুলিতে প্রবেশ করত। বাড়ির জলগুলি আসত পোড়ামাটির তৈরি নল দিয়ে। প্রত্যেক নর্দমায় একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর এক-একটি শোষক কূপ থাকত। সেখানে বালি, মাটি গিয়ে জমা হত এবং তা সময়মতো পরিষ্কার হত, যাতে জলনিকাশি ব্যবস্থা ব্যাহত না হয়।
  • বাড়ির স্নানাগারগুলি রাস্তার বড়ো নর্দমার সঙ্গে যুক্ত ছিল। শহরের নর্দমার উপর অনেক ম্যানহোল রাখা হত। এগুলির উপর পাথরের তৈরি ঢাকনা দেওয়া হত। এগুলি খুলে নর্দমাগুলি নিয়মিত পরিষ্কার করা হত।
  • হরপ্পা ও মহেন-জো-দারোতে যে-স্নানাগারটি আবিষ্কৃত হয়েছে সেখানেও জল নিষ্কাশন ও জল প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা ছিল।
  • সিন্ধু সভ্যতার নিকাশি ব্যবস্থায় সমমান নির্ধারণ করা হত ছোটো-বড়ো সমস্ত নগরে। যেমন – লোথালের গৃহবসতিগুলি কাঁচা ইটের হলেও নিকাশি ব্যবস্থা ছিল পোড়ামাটির।

এইসব দেখে ঐতিহাসিক এ এল ব্যাসাম মন্তব্য করেছেন যে, রোমান সভ্যতার আগে অন্য কোনো প্রাচীন সভ্যতায় এত সুদক্ষ পয়ঃপ্রণালী দেখা যায়নি।

হরপ্পা সভ্যতার ঘরবাড়িগুলির বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

অথবা, হরপ্পা সভ্যতার ঘরবাড়ি কীভাবে নির্মিত হত বলে মনে হয়?

সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নকেন্দ্রগুলি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা – উচ্চ শহর ও নিম্ন শহর। প্রতিটি শহরেই ছোটো-বড়ো অনেক ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে।

  • ঘরবাড়িগুলির মূল উপকরণ ছিল পোড়ামাটির ইট, চুন, সুরকি ইত্যাদি।
  • বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাড়িগুলি উঁচু পাটাতনের ওপর তৈরি করা হত।
  • প্রত্যেক বাড়িতে থাকত ছোটো-বড়ো অনেক প্রকোষ্ঠ যেমন-স্নান করার ঘর, সিঁড়িঘর ইত্যাদি।
  • বাড়ির মূল প্রবেশ দরজাটি এমন জায়গায় রাখা হত, যাতে বাড়ির ভিতরকার গোপনীয়তা বজায় থাকে।
  • নীচের তলার ঘরগুলির বাইরের দিকে কোনো জানালা রাখা হত না। তবে ঘরগুলির উপরদিকে পাথরের তৈরি ঝাঁজরি বা ঘুলঘুলি রাখা হত।
  • বাড়ির জল ও স্নানঘরের নোংরা জল নিষ্কাশনের জন্য পোড়ামাটির নল ব্যবহার করা হত।
  • বাড়িগুলি তৈরি হত গ্রিড পদ্ধতিতে।
  • দ্বিতলে ওঠার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিল।

হরপ্পা সভ্যতায় পশুপালন সম্পর্কে আলোচনা করো।

হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা ছিল একটি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। তা সত্ত্বেও হরপ্পা সভ্যতায় সমৃদ্ধ অর্থনীতির মূলভিত্তি ছিল কৃষি। কৃষিকাজের পাশাপাশি হরপ্পা সভ্যতার মানুষ পশুপালনে যথেষ্ট আগ্রহী ছিল।

  • হরপ্পা সভ্যতার মানুষ পশুকে দুটি বিশেষ কাজে লাগাত বলে জানা যায়। যথা – বেশ কয়েকটি পশু, যেমন- গোরু, ভেড়া, শূকরের মাংস হরপ্পাবাসীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। গাধা, উট, বলদের মতো পশুকে মালপত্র পরিবহণের কাজে লাগনো হত। এরা সকলেই ছিল গৃহপালিত পশু।
  • সেসময় কুকুর ছিল হরপ্পাবাসীদের কাছে একটি অন্যতম গৃহপালিত পশু। সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত কুকুরের পোড়ামাটির মূর্তিগুলি ছিল এর প্রমাণস্বরূপ।
  • গৃহপালিত পশু ছাড়াও বাঘ, সিংহ, হাতি, গন্ডার, ভালুক প্রভৃতি বন্যপশুর পোড়ামাটির মূর্তি তৈরি পাওয়া গেছে যা এদের অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে।
  • সিলমোহরেও বেশ কিছু পশুর প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে। তবে সবথেকে বেশি প্রতিকৃতি ছিল বৃষের।
  • পোড়ামাটির তৈরি অশ্বের এক মূর্তি লোথালে আবিষ্কৃত হয়েছে। যা থেকে অনেক পন্ডিতগণ দাবি করেন যে হরপ্পা সভ্যতার মানুষ ঘোড়া সম্পর্কে অবহিত ছিল। কিন্তু সেই দাবির সত্যতা সম্পর্কে আবার অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
  • শুধু গৃহপালিত ও বন্য পশু নয়, বিভিন্ন পাখি ও মাছের অস্তিত্বও এখানে পাওয়া গেছে।
  • হরপ্পার নানান কেন্দ্রে বিভিন্ন পশুর অস্থি পাওয়া গেছে।। তবে হরপ্পাবাসীরা নিজেরাই এসকল পশু শিকার করেছিল নাকি শিকারি সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এইসকল পশুর মাংস জোগাড় করেছিল সে সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব আছে।

হরপ্পা সভ্যতায় এক উন্নত কৃষিব্যবস্থার প্রচলন ছিল। এর পক্ষে তোমার যুক্তি কী?

অথবা, কোন্ কোন্ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে তোমার মনে হয়, সে যুগে এক উন্নত কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন ছিল?

হরপ্পা সভ্যতার কৃষিকাজ সম্পর্কে বিশদ কিছু জানা যায় না, তবে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে পণ্ডিতগণ তখনকার কৃষিজীবনের ওপর কিছুটা আলোকপাত করেছেন।

  • তামা ও ব্রোঞ্জের তৈরি কাস্তে, নিড়ানিজাতীয় অনেক কৃষি সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। যা থেকে অনুমান করা হয়, সিন্ধুবাসীদের একটি অন্যতম জীবিকা ছিল চাষবাস। কালিবঙ্গানে প্রাপ্ত কাঠের লাঙল সেকথাই প্রমাণ করে।
  • জমিতে জলসেচ দেওয়ারও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কারণ সোর্তুগাইতে একটি খাল আবিষ্কৃত হয়েছে। মনে করা হয় কূপের জল তুলে জমিতে সরবরাহ করা হত। এ ছাড়া ধোলাভিরায় একটি জলাধার আবিষ্কৃত হয়েছে, যা চাষের কাজে ব্যবহার করা হত।
হরপ্পা সভ্যতায় এক উন্নত কৃষিব্যবস্থার প্রচলন ছিল। এর পক্ষে তোমার যুক্তি কী
হরপ্পা সভ্যতায় এক উন্নত কৃষিব্যবস্থার প্রচলন ছিল। এর পক্ষে তোমার যুক্তি কী
  • প্রাপ্ত জাঁতাগুলি দেখে অনুমান করা হয়, সে যুগের মানুষ গম যব জাতীয় খাদ্যশস্য তাতে পেষাই করত। এর থেকে মনে করা হয় যে, সে যুগে চাষিরা গম, যব জাতীয় দানাশস্যের চাষ করত।
  • সে যুগে কার্পাস বা তুলোর চাষ হত। সিন্ধুবাসীরা কার্পাসকে সিন্ধম বলত, যা পশ্চিম এশীয় সভ্যদেশগুলিতে রফতানি করা হত।
  • জমি চাষের জন্য কর্ষণ করা হত। কালিবঙ্গানে পুরাতত্ত্ববিদগণ কর্ষিত জমির নিদর্শন পেয়েছেন। এ ছাড়া প্রাপ্ত সিলমোহর ও টেরাকোটা স্থাপত্য দেখে মনে করা হয়, জমি কর্ষণের জন্য হরপ্পাবাসীরা ষাঁড় ব্যবহার করত।
  • জমিতে লাঙল ব্যবহারের সঙ্গে এটিও প্রমাণিত হয় যে দুটি ভিন্ন জাতের শস্য একই জমিতে উৎপন্ন করা হত। কেন-না জমিতে লাঙল দ্বারা পৃথকৃত জমির অংশগুলি পরস্পর সমকোণে অবস্থিত থাকত।

হরপ্পাবাসীরা কী ধরনের মাপ ও বাটখারা ব্যবহার করত বলে মনে হয়?

সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর এখানকার বিভিন্ন প্রত্নকেন্দ্র থেকে বস্তুর মাপ বিষয়ক বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া গেছে। এইসব উপাদানের ভিত্তিতে সে যুগে ব্যবহৃত বিভিন্ন রৈখিক, কিউবিক ও ওজনের মাপ বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়।

  • রৈখিক মাপ – কিছু ধাতব পাত পাওয়া গেছে, যাতে রৈখিক মাপ চিহ্নিত আছে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, সিন্ধুবাসীরা দৈর্ঘ্য মাপার জন্য ফুট মানাঙ্ক ব্যবহার করত। অনেকে মনে করেন যে, সিন্ধুবাসীরা বস্তুর দৈর্ঘ্য। মাপার ক্ষেত্রে তৃতীয় ভগ্নাংশ ও দশমিক পদ্ধতির আশ্রয় নিত।
  • কিউবিক মাপ – ইটগুলি তৈরি হত নির্দিষ্ট মাপে অর্থাৎ 4:2:1 (দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা) অনুপাতে। এর থেকে অনুমান করা হয় যে, তারা বস্তুর আয়তন বোঝাতে ঘনএকক ব্যবহার করত।
  • ভর-এর মাপ – বস্তুর ভর মাপার জন্য তারা দাঁড়িপাল্লা ও বাটখারা ব্যবহার করত। বাটখারাগুলি তৈরি হত নানান আকার ও ওজনের। এগুলি তৈরি হত পাথর দিয়ে। সাধারণত দুয়ের ঘাতবিশিষ্ট (binary) অর্থাৎ 2, 4, 8, 16, 32 ইত্যাদি নানা মাপ ছিল।
  • জ্যামিতিক মাপ – ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সবকিছুরই নির্দিষ্ট মাপ ছিল। যেমন, জানা যায় প্রধান সড়কগুলি 6-10 মিটারের বেশি চওড়া হত এবং তা সমান ও সমান্তরালভাবে গড়ে তোলা হত। পুঁতির হারগুলি সাক্ষ্য দেয় যে, মালাগুলিতে যে দামি পাথর গাঁথা হত তারও নির্দিষ্ট মাপ ছিল।

সিন্ধু সিল বা সিলমোহর সম্পর্কে কী জান?

সিন্ধু উপত্যকায় নরম পাথর, তামা, ব্রোঞ্জ ও পোড়ামাটির তৈরি প্রায় 2 হাজার সিল পাওয়া গেছে। পন্ডিতগণ মনে করেন, এগুলি ব্যবহার করত সিন্ধু বণিকরা। খুব সম্ভবত এগুলি বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করা হত।

  • এক-একজন বণিক এক-এক ধরনের সিল ব্যবহার করত। বণিকরা পণ্যবোঝাই বস্তার ওপর তাদের নির্দিষ্ট সিলগুলির ছাপ দিত।
  • সিলগুলি ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ, সিলমোহরগুলিতে নানা লিপি ও প্রতীকচিহ্ন খোদাই করা হত। অধিকাংশ সিলমোহরই ছিল পোড়ামাটির। এ ছাড়াও হাতির দাঁত ও পাথর দিয়েও সিল তৈরি করা হত।
  • সিলগুলি সাধারণত বর্গাকার বা আয়তাকার হত। তাতে নানা ধরনের চিহ্ন ছাড়াও বিভিন্ন জীবজন্তু (যেমন – ষাঁড়, মহিষ ইত্যাদি) ও দেবতার প্রতিকৃতি খোদাই করা হত। এরূপ একটি সিলে পশুদলবেষ্টিত একটি যোগীমূর্তি পাওয়া গেছে, যাঁকে জন মার্শাল আদি শিবের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
  • এখনও পর্যন্ত সিলগুলিতে ব্যবহৃত লিপিগুলি পাঠোদ্ধার করা যায়নি। ফলে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে অনেক কথা এখনও আমাদের অজানা থেকে গেছে।
  • হরপ্পার কিছু সিলমোহর মেসোপটেমীয়া সভ্যতায় পাওয়া গিয়েছে, যা প্রমাণ করে এই দুই সভ্যতার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক ছিল।
  • সিলমোহরগুলি থেকে আমরা জানতে পারি হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে অন্যান্য সমসাময়িক সভ্যতার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।

সিন্ধু উপত্যকায় যে-সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে তোমার কি মনে হয় সেযুগে শিক্ষার যথেষ্ট প্রচলন ছিল?

অথবা, সিন্ধু উপত্যকায় প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিচয় দাও।

অনুমান করা হয় যে, হরপ্পা সংস্কৃতিতে শিক্ষার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। এই অনুমানের পক্ষে রায় দেয় হরপ্পায় প্রাপ্ত সিলমোহরগুলির ওপর ব্যবহৃত লিপিগুলি। যদিও লিপিবিদগণ এখনও পর্যন্ত এই লিপিগুলির কোনো পাঠোদ্ধার করতে পারেননি।

  • সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি, যেমন – ইটের মাপ, বাটখারা, বাড়ির আকার, রাস্তার নির্দিষ্ট মাপ ইত্যাদি থেকে অনুমান করা যায় যে, গাণিতিক হিসাবে সিন্ধুবাসীরা দক্ষ ছিলেন। উল্লেখ্য যে, বয়ামের সংখ্যা বোঝাতে সিন্ধু চিত্রলিপিতে একটি ও তিনটি বয়ামের চিত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
  • হরপ্পা সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ওজনের পাথরের বাটখারা ও ধাতুনির্মিত দাঁড়িপাল্লা আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • রৈখিক মাপের ক্ষেত্রে ‘কিউবিক’ ও ‘ফুট’ পরিমাপক পদ্ধতি তাদের অজানা ছিল না। উল্লেখ্য যে, ইটের মাপের অনুপাত ছিল 4:2:1 (দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা)।
  • ওজনের ক্ষেত্রে তৃতীয় ভগ্নাংশ ও দশমিক পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হত।
  • দূরবর্তী স্থানে কোনো সামগ্রী পাঠাতে হলে বস্তুর মুখে দড়ি বেঁধে সিলমোহর লাগানো হত। সাধারণ মানুষ নিরক্ষর হলে সিলমোহরের লেখা তারা পড়তে পারত না।
  • হরপ্পা সভ্যতায় শিক্ষার প্রচলন না থাকলে সমগোত্রীয় সমাজ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধরে রাখা সম্ভব হত না।

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের তৃতীয় অধ্যায়, “ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের ধারা (প্রথম পর্যায় : আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০-১৫০০ অব্দ)” অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহায়ক হবে, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ!

Share via:

মন্তব্য করুন