আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়, ‘ইতিহাসের ধারণা’ অধ্যায়ের অধ্যায় সারসংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণী এবং চাকরির পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই আসতে দেখা যায়।
ইতিহাস কী – ইতিহাস হল আদিমকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানুষের কাজকর্ম, ঘটনা এবং পরিবর্তনগুলির ধারাবাহিক বিবরণ। ইতিহাস শুধুমাত্র একটি কাহিনী নয়, বরং এটি মানুষের সমাজ, সভ্যতা এবং তাদের উন্নতির বিবরণ। তবে ইতিহাস রচনা করতে হলে নির্দিষ্ট নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়, যেমন প্রমাণ সংগ্রহ, সাক্ষ্য গ্রহণ এবং যুক্তি প্রতিষ্ঠা। ইতিহাস শুধুমাত্র ঘটনার বিবরণ নয়, বরং তার পিছনে যেসব কারণ এবং ফলাফল রয়েছে, তা-ও বিশ্লেষণ করে।
ইতিহাস ও গল্প – ইতিহাস এবং গল্পের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য আছে। গল্প সাধারণত কল্পনাপ্রসূত হয় এবং এতে প্রমাণের প্রয়োজন হয় না, তবে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রমাণ এবং যুক্তির প্রয়োজন। ইতিহাস শুধুমাত্র ঘটনার বিবরণ নয়, বরং তার পিছনের প্রেক্ষাপট, কারণ এবং ফলাফল সম্পর্কেও বিশদ তথ্য প্রদান করে। প্রমাণের অভাবে ইতিহাসে কিছু ঘটনা গ্রহণযোগ্য হয় না। এজন্য ইতিহাসে তথ্যের সঠিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিহাসের কথা, মানুষের কথা – ইতিহাসের মূল বিষয় হল মানুষের কর্মকাণ্ড এবং তাদের দ্বারা সৃষ্টি হওয়া সমাজ এবং সভ্যতা। ইতিহাসে মানুষের অগ্রগতি যেমন প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে আধুনিক প্রযুক্তির দিকে, তেমনই মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির বিবর্তনও উল্লেখিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, মানুষ কীভাবে বনজঙ্গল থেকে আধুনিক শহরের দিকে উন্নীত হয়েছে, কীভাবে আকাশে পাখির মতো উড়তে শিখেছে, কীভাবে আগুনের ব্যবহার শিখে রান্না শুরু করেছে — এসব সবই ইতিহাসের অংশ। ইতিহাসের উদ্দেশ্য হলো এসব ঘটনা ক্রমানুসারে বিশ্লেষণ করা, যাতে আমরা বুঝতে পারি কোন ঘটনা আগে ঘটেছে এবং কোনটি পরে।
ইতিহাস আর ভূগোল – ইতিহাস এবং ভূগোল দুটো বিষয় একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ভূগোল না জানলে ইতিহাস বুঝতে সমস্যা হতে পারে, কারণ ইতিহাসে মানুষের সমাজ, জীবনযাত্রা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, যোগাযোগের মাধ্যম, ব্যবসাবাণিজ্য, এবং প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের ওপর আলোচনা করা হয়। এসব বিষয় বোঝার জন্য ভূগোলের উপাদান যেমন মাটি, জলবায়ু, এবং প্রাকৃতিক সম্পদ জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস এবং ভূগোল একে অপরের পরিপূরক, কারণ ভূগোল মানব সমাজের গঠন এবং ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে।
ভারতীয় উপমহাদেশের ভূগোল-ইতিহাস – ভারতীয় উপমহাদেশ এক ধরনের ভৌগোলিক অঞ্চল, যা মহাদেশের তুলনায় ছোট হলেও ঐতিহাসিকভাবে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই উপমহাদেশে রয়েছে পাহাড়, নদী, সমতল ভূমি, এবং নানা ধরনের সংস্কৃতি। ভারতবর্ষকে প্রাচীনকালে “উপমহাদেশ” বলা হত। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ভূগোলগত এলাকা ছিল সিন্ধু ও গঙ্গা নদীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণদিকের তিনকোনা অঞ্চল। “ভরত” ছিল এই অঞ্চলের একটি পুরোনো জনগোষ্ঠী, যারা এখানে বসবাস করত, এবং তাদের নামানুসারে ভারতীয় উপমহাদেশকে ভারতবর্ষ বলা হত।
পুরোনো দিনের হিসাবনিকেশ – ইতিহাসে সময় গণনার জন্য নানা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন যুগে আলাদা আলাদা সময় গণনার পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছিল, যেমন প্রস্তর যুগ, তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগ ইত্যাদি। সময়ের একক হিসেবে যুগ (Era) ব্যবহৃত হয়। ইতিহাসে সময় নির্ধারণে খ্রিস্টাব্দ (A.D.) ও তারিখের ব্যবহার করা হয়, তবে পুরোনো দিনের তারিখ গুলি অনুমান করতে হয়। অতএব, সময় বলার ক্ষেত্রে অনেক সময় “আনুমানিক” শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
সাল-তারিখের নানারকম গণনা – দশক (Decade) সাধারণত দশ বছর সময়কাল বোঝাতে দশক শব্দটি ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম দশক বা 1990-এর দশক। শতক (Century) একশত বছরের হিসাব বোঝাতে শতক শব্দটি ব্যবহার হয়। উদাহরণস্বরূপ, অষ্টাদশ শতক (1801-1899)। সহস্রাব্দ (Millennium) এক হাজার বছরের সময়কাল বোঝাতে সহস্রাব্দ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন, প্রথম সহস্রাব্দ (0-1000 খ্রিস্টাব্দ)। খ্রিস্টপূর্বাব্দ (B.C.) যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগের সময়কালকে খ্রিস্টপূর্বাব্দ হিসেবে ধরা হয়। খ্রিস্টাব্দ (A.D.) যিশুখ্রিস্টের জন্ম থেকে যে সময় গণনার সূত্রপাত হয়েছে, তা খ্রিস্টাব্দ নামে পরিচিত। শকাব্দ (Shaka Era) প্রাচীন ভারতের কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক কনিষ্কের সিংহাসন আরোহণের সময়, অর্থাৎ ৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে যে সময় গণনা শুরু হয়, তা শকাব্দ নামে পরিচিত। গুপ্তাব্দ (Gupta Era) প্রাচীন ভারতের গুপ্ত বংশীয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত প্রথমের সিংহাসন আরোহণের সময়, অর্থাৎ 319-320 খ্রিস্টাব্দ থেকে যে সময় গণনা শুরু হয়, তা গুপ্তাব্দ নামে পরিচিত। হর্ষাব্দ (Harsha Era) হর্ষবর্ধনের সিংহাসন আরোহণের সময়, অর্থাৎ 606 খ্রিস্টাব্দ থেকে যে সময় গণনা শুরু হয়, তা হর্ষাব্দ নামে পরিচিত।
বলা, আঁকা, লেখা – মানুষের ভাষা ব্যবহারের ইতিহাস অত্যন্ত দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময়। প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ শব্দ ব্যবহার করতে না পারলেও, অঙ্গভঙ্গি ও ইশারার মাধ্যমে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করত। পরবর্তীতে, গুহার দেয়ালে, পাথরে এবং মাটির উপরে ছবি আঁকতে শিখে তারা যোগাযোগ শুরু করে। পরে ধীরে ধীরে ভাষার মাধ্যমে মানুষের ভাবনার আদান-প্রদান সম্ভব হয়। এই সমস্ত মানবীয় অগ্রগতি হাজার হাজার বছর সময় নিয়ে ঘটেছিল এবং প্রতিটি নতুন যুগে মানুষের চিন্তা-ভাবনা এবং অভ্যন্তরীণ শক্তি নতুন উপায়ে প্রকাশিত হয়েছে।
মাটির ওপরের ইতিহাস ও মাটির নীচের ইতিহাস – ইতিহাস রচনার জন্য বিভিন্ন উপাদান প্রয়োজন হয়। মাটির উপরে যা কিছু প্রমাণ থাকে, তা ইতিহাসের মৌলিক উপাদান। তবে মাটির নিচে থাকা পুরোনো জিনিসপত্র এবং প্রমাণগুলোকে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান বলা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মাটি খুঁড়ে এসব উপাদান খুঁজে বের করে এবং তা ইতিহাস রচনায় ব্যবহৃত হয়। এই প্রাচীন বস্তুগুলিকে “প্রত্নবস্তু” বা “পুরাবস্তু” বলা হয়, যা ইতিহাসের রচনা এবং বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
টুকরোগুলো জুড়তে জুড়তে – ইতিহাস রচনা একটি জিগ-স পাজলের মতো, যেখানে বিভিন্ন টুকরো টুকরো তথ্য একত্রিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরি করা হয়। অনেক সময় ইতিহাসের কিছু অংশ হারিয়ে যায় এবং সেখানে শূন্যস্থান থেকে যায়। এই শূন্যস্থানগুলো পূর্ণ করতে আমাদের একে একে ইতিহাসের অন্যান্য অংশ এবং প্রমাণ সংকলন করতে হয়। এভাবেই ইতিহাসের প্রতিটি অজানা কোণ উন্মোচিত হয় এবং একটি সম্পূর্ণ কাহিনী তৈরি হয়।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান – ইতিহাস রচনার জন্য যেসব তথ্য বা প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়, সেগুলো ইতিহাসের উপাদান বলে পরিচিত। এই উপাদানগুলো বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন লিপিবদ্ধ প্রমাণ, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান, শিল্পকর্ম, স্থাপত্য, এবং মানুষের বর্ণনা। এগুলো সবই ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়, “ইতিহাসের ধারণা” অধ্যায়ের অধ্যায় সারসংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সহায়ক হবে, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত।ধন্যবাদ!