আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের পঞ্চম অধ্যায়, ‘খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতীয় উপমহাদেশ (রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ধর্মের বিবর্তন-উত্তর ভারত)’ অধ্যায়ের কিছু সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও সহায়ক। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণী এবং চাকরির পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই আসতে দেখা যায়।
জনপদ কীভাবে গড়ে ওঠে?
অথবা, জনপদ কাকে বলে?
অথবা, জনপদ – টীকা লেখো।
প্রাচীন ভারতে গ্রামের তুলনায় বড়ো অঞ্চলকে জনপদ বলে। তবে জনপদ গড়ে ওঠার একটি পটভূমিকা আছে। বৈদিক যুগে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ছিল। এইরকম কয়েকটি পরিবার নিয়ে গঠিত হত ‘গ্রাম’। আবার কতকগুলি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠত ‘বিশ’ বা ‘জন’। জন থেকে এসেছে ‘জনপদ’। অর্থাৎ, জনগণ যেখানে পদ বা পা রেখেছে।
পরিবার → গ্রাম → বিশ/জন → জনপদ → মহাজনপদ
জনপদগুলি কীভাবে মহাজনপদে পরিণত হয়?
গ্রামের তুলনায় বৃহৎ অঞ্চলগুলিকে জনপদ বলে। বৈদিক যুগের শেষপর্বে এইরকম বহু জনপদ ছিল।
- জনপদের কিছু রাজারা ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন,
- কিছু রাজারা তাদের সীমানা বাড়াতে থাকেন,
- রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে, এইভাবে জনপদ থেকে মহাজনপদের সৃষ্টি হয়।
ষোড়শ মহাজনপদ কী?
অথবা, ষোড়শ মহাজনপদ – টীকা লেখো।
‘মহাজনপদ’ কথার অর্থ বৃহৎ রাজ্য।
- ষষ্ঠ শতকে বর্তমান আফগানিস্তানের কাবুল থেকে দক্ষিণ ভারতের গোদাবরী নদীর তীর পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষে 16টি বড়ো রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। জনপদের থেকে বৃহৎ এই রাজ্যগুলিকে মহাজনপদ বলা হয়।
- 16টি মহাজনপদ হল-অঙ্গ, মগধ, কাশী, কোশল, অবন্তি, বৎস, বৃজি, মল্ল, চেদি, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস্য, শূরসেন, অস্মক, গান্ধার ও কম্বোজ।
- বেশিরভাগ জনপদই উত্তর ভারতে অবস্থিত ছিল এবং সেগুলি ছিল রাজতান্ত্রিক। রাজ্যগুলির মধ্যে কোনো সদ্ভাব ছিল না। তাদের মধ্যে লাগাতার দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত।
ষোড়শ মহাজনপদগুলির নাম সহজে মনে রাখার জন্য একটি সমাধানসূত্র নীচে দেওয়া হল –
কোচে বসে মম পামসু পরে বক কাকু গাব খায়
কোচে > | ১. কো = কোশল ২. চে = চেদি | বসে > | মম > | ৩. ম = মল্ল ৪. ম = মৎস্য | |
পামসু > | ৫. পা = পাঞ্চাল ৬. ম = মগধ | পরে > | বক > | ৮. ব = বৎস ৯. ক = কম্বোজ | |
কাকু > | ১০. কা = কাশি ১১. কু = কুরু | গাব > | ১২. গা = গান্ধার ১৩. ব = বজ্জি | খায় > | |
এর সঙ্গে ৩টি ‘অ’ যোগ হবে, যথা – | |||||
১৪. অ = অবন্তি ১৬. অ = অস্মক | ১৫. অ = অঙ্গ |
ষোড়শ মহাজনপদ থেকে কীভাবে মগধ সাম্রাজ্যের সূচনা হয়?
অথবা, মগধ সবচেয়ে শক্তিশালী মহাজনপদে পরিণত হয়েছিল কেন?
অথবা, কী কী কারণে মগধ শেষপর্যন্ত বাকি মহাজনপদগুলির থেকে শক্তিশালী হয়ে ওঠে
মগধ সাম্রাজ্যের উত্থানের কারণগুলি নিম্নে দেওয়া হল –
- ভৌগোলিক সুবিধা – মগধের অবস্থান ছিল গঙ্গা, চম্পা, এবং শোন নদীর মাঝে। এই নদীগুলি প্রাকৃতিক সুরক্ষা দিয়েছিল এবং কৃষি ও বাণিজ্যের জন্য সহজ যোগাযোগের পথ তৈরি করেছিল।
- ঘন জঙ্গল – মগধের পূর্ব দিকে ছিল ঘন জঙ্গল, যেখানে প্রচুর হাতি বাস করত। এই হাতি যুদ্ধের সময় শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত।
- প্রাকৃতিক সম্পদ – মগধের মাটি ছিল উর্বর, যা কৃষি উৎপাদনে সহায়ক ছিল। এছাড়াও এখানে লৌহ আকরিক এবং অন্যান্য খনিজ পাওয়া যেত, যা অস্ত্র বানানোর জন্য ব্যবহার করা হতো।
- যোগ্য রাজা – মগধের রাজারা যেমন বিম্বিসার, অজাতশত্রু, এবং মহাপদ্মনন্দ খুবই দক্ষ শাসক ছিলেন। তাদের নেতৃত্বে মগধ দ্রুত একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।
মহাজনপদগুলি শাসনের ক্ষেত্রে রাজার কী ভূমিকা ছিল?
প্রাচীন ভারতে বেশিরভাগ মহাজনপদে রাজাই ছিলেন প্রধান শাসক। তাই মহাজনপদগুলি সাধারণত রাজতান্ত্রিক রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছিল রাজার হাতে। রাজা সাধারণত রাজপরিবারের বংশধর হতেন এবং পিতার পরে সিংহাসনে বসতেন।
রাজাকে শাসনের কাজে সাহায্য করার জন্য একটি বিশেষ পরামর্শদাতা সভা বা মন্ত্রিসভা থাকত। এই সভার সদস্যরা রাজাকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। রাজ্যের সমস্ত কাজ চালানোর জন্য কর আদায় করা হত, অর্থাৎ প্রজারা রাজাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিত। করের টাকায় রাজ্যের সেনাবাহিনী, প্রশাসন, সড়ক নির্মাণ, এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালিত হত।
রাজা ছাড়াও, রাজ্যের শাসনকার্যে রাজকর্মচারীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তারা কর সংগ্রহ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সাধারণ মানুষের সমস্যার সমাধানে কাজ করত। এছাড়া, রাজা তার রাজ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলতেন এবং প্রয়োজন হলে প্রতিবেশী রাজ্যের সাথে যুদ্ধ করতেন।
এভাবে রাজা শুধু শাসকই ছিলেন না, তিনি রাজ্যের শান্তি ও উন্নয়নের জন্য দায়ী একজন নেতা হিসেবেও কাজ করতেন।
ষোড়শ মহাজনপদ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ লেখো।
জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতীয় উপমহাদেশের ষোলোটি মহাজনপদের কথা জানা যায়। এই ষোলোটি মহাজনপদ একত্রে ষোড়শ মহাজনপদ নামে পরিচিত। এই জনপদগুলির অধিকাংশই ছিল রাজতান্ত্রিক। এগুলির মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ প্রায়শই লেগে থাকত। শেষপর্যন্ত চারটি মহাজনপদ হয়ে ওঠে বিশেষ শক্তিশালী। যথা – কোশল, অবন্তি, মগধ, বৎস। এগুলিতেও নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ হত। এই লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত মগধ হয়ে ওঠে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী।
জেনে রাখো – ষোড়শ মহাজনপদ-এর মধ্যে একমাত্র অস্মক ছিল দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত। বাকিগুলি ছিল মধ্য ও উত্তর ভারতে। বৃজি, মাল্ল ছিল এদের মধ্যে প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য। ষোড়শ মহাজনপদের ষোলোটি রাজ্য নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকত। এই দ্বন্দ্বে শেষপর্যন্ত মগধ সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।
মহাজনপদের শাসনব্যবস্থা কেমন ছিল?
অথবা, রাজতান্ত্রিক ও অরাজতান্ত্রিক মহাজনপদ বলতে কী বোঝো?
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মূলত উত্তর ভারতকেন্দ্রিক 16টি মহাজনপদের উদ্ভব হয়। এগুলি ছিল দু’ধরনের, যথা –
- রাজতান্ত্রিক মহাজনপদ –
- এখানে রাজার শাসন থাকত।
- রাজা ছিলেন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী।
- রাজা সাধারণত কোনো রাজবংশ বা অভিজাত পরিবারের সদস্য হতেন।
- শাসনের কাজে রাজাকে সাহায্য করার জন্য একটি সভা বা কাউন্সিল থাকত।
- রাজ্যের প্রশাসনিক কার্যক্রম কর (ট্যাক্স) থেকে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে চালানো হত।
- অরাজতান্ত্রিক মহাজনপদ –
- এই মহাজনপদগুলোতে কোনো রাজা ছিল না।
- এগুলোকে গণরাজ্য বলা হত।
- উদাহরণস্বরূপ – মল্ল, বজ্জি (বৃজি)।
- এখানে বিভিন্ন উপজাতি একসঙ্গে বসবাস করত এবং শাসন পরিচালিত হত সবার মতামতের ভিত্তিতে।
- আলোচনা ও সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালিত হত।
গৌতম বুদ্ধের সময় বজ্জিদের অবস্থা কেমন ছিল?
গৌতম বুদ্ধের সমকালীন বজ্জিদের অবস্থাগুলি নীচে উল্লেখ করা হল –
- গৌতম বুদ্ধের সময় বজ্জিরা একত্রে বসবাস করত। তারা স্বাধীনতা ভোগ করত।
- বজ্জিদের রাজধানী ছিল বৈশালীতে। বৈশালীর পাশাপাশি থাকত লিচ্ছবিরা। গৌতম বুদ্ধ নিজেই বজ্জিদের একজোট হওয়ার নিয়মাবলি ঠিক করে দিয়েছিলেন। ফলে মনে হয় বজ্জিদের লিখিত আইন ছিল।
- বজ্জির অপর নাম বৃজি বা বজ্জি।
বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম উত্থানের কারণ কী?
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানের কারণগুলি হল –
- যাজযজ্ঞ ও পশুবলি – বৈদিক ধর্মের অত্যধিক যাগযজ্ঞ ও পশুবলি প্রথা সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করেছিল। এই শূন্যস্থান পূরণ করেছিল বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম।
- লোহার ব্যবহার – লোহার ব্যবহার যেমন কৃষিকার্যে পরিবর্তন এনেছিল তেমনি লোহার অস্ত্রাদি ক্ষত্রিয়কে শক্তিশালী করেছিল। এই সামাজিক পরিবর্তনকে স্বীকার করেছিল বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম।
- জাতিভেদ প্রথা – জাতিভেদ প্রথার ঘোর বিরোধী ছিল এই দুটি ধর্ম।
- নারীদের সম্মান ও বাণিজ্যের অধিকার – নারীদের সম্মান দান, বাণিজ্যে সকল মানুষের অধিকার দান, সুদগ্রহণ প্রভৃতিকে স্বীকার করেছিল এই দুটি ধর্ম।
জান কি? – জাতিতেদ প্রথার প্রতি বিতৃয়া জৈন ধর্ম অপেক্ষা বৌদ্ধ ধর্মে বেশি তীব্র ছিল, আবার অহিংসা নীতি সমৃদ্ধ জৈনরা, বৌদ্ধদের থেকে বেশি চরমভাবাপন্ন ছিল।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে নতুন ধর্ম বলা যায় কি?
ইউরোপে যেমন ক্যাথোলিক ধর্মের অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ধর্মের জন্ম হয়েছিল, তেমনি ভারতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কাঠিন্য ও ভেদাভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান হয়েছিল। তবে এ কথা বলা যায় যে, এই দুটি ধর্ম সম্পূর্ণ বেদ বিরোধী ছিল না। বেদের অপৌরুষেয়তা এরাও স্বীকার করেছিল। দার্শনিক দিক থেকে বিচার করলে এই দুটি ধর্মকে উপনিষদেরই প্রতিধ্বনি বলা যেতে পারে, তাই একে কোনো নতুন ধর্মমত বলা যায় না।
জেনে রাখো – মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ উভয়েই রাজার সন্তান ছিলেন। উভয়েই কঠোর তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে তারা দুটি ধর্মমতের জন্ম দিয়েছিলেন।
মহাবীর সম্পর্কে যা জানো সংক্ষেপে লেখো।
মহাবীর ছিলেন জৈন ধর্মের প্রবর্তক ও তীর্থংকর। তিনি লিচ্ছবি বংশের ক্ষত্রিয় রাজকুমার ছিলেন। তিরিশ বছর বয়সে তিনি সংসার ত্যাগ করে তপস্যা করেন। দীর্ঘ বারো বছর ধরে তিনি এই তপস্যা করেন। এরপর সর্বজ্ঞানী হন। দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে তিনি জৈন ধর্ম প্রচার করেন। অবশেষে বাহাত্তর বছর বয়সে পাবা নগরে অনশন করেন। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
জান কি? – মহাবীরকে জৈন ধর্মের প্রবর্তক বলে মনে করা হলেও, জৈনরা মনে করেন, তাঁর আগেও তেইশজন তীর্থংকর জৈন ধর্মকে পুষ্ট করেছিলেন। সর্বপ্রথম তীর্থংকর ছিলেন ঋষতনাথ বা আদিনাথ এবং সর্বশেষ তীর্থংকর হলেন মহাবীর।
জৈনধর্মের মূল নীতিগুলি লেখো।
জৈন ধর্মের মূল নীতিগুলি হল চতুর্যাম, পঞ্চমহাব্রত, ত্রিরত্ন, সর্বপ্রাণবাদ প্রভৃতি।
- চতুর্যাম – জৈন ধর্মে চারটি মূলনীতি অবশ্যই মেনে চলতে হত। এগুলিকে বলা হয় চতুর্যাম ব্রত। এগুলি হল – প্রাণী হত্যা না করা, মিথ্যা কথা না বলা, অন্যের জিনিস বলপূর্বক ছিনিয়ে না নেওয়া এবং নিজের জন্য কোনো সম্পত্তি না করা।
- পঞ্চমহাব্রত – মহাবীর এগুলির সঙ্গে যোগ করেন ব্রহ্মচর্য পালনের রীতি। ফলে জৈন ধর্মের নীতি পাঁচটিতে পরিণত হয়। এগুলিকে বলা হয় পঞ্চমহাব্রত।
- ত্রিরত্ন – মহাবীরের মতে সৎ বিশ্বাস, সৎ জ্ঞান ও সৎ আচরণ ‘ত্রিরত্ন’ নামে পরিচিত।
জেনে রাখো – বর্ধমান কৈবল্য বা পরম জ্ঞানের মাধ্যমে সুখ, দুঃখ ও পঞ্চরিপুকে জয় করেছিলেন বলে তাঁকে মহাবীর বলা হয়। মহাবীর একই সঙ্গে সিদ্ধিলাভের পর জিন বা জিতেন্দ্রিয় নামে পরিচিত হন। জিতেন্দ্রিয় শব্দের অর্থ ইন্দ্রিয়কে জয় করা। সেইজন্যই মহাবীরের বা জিনের অনুগামী ও শিষ্যরা জৈন বলে পরিচিত।
পঞ্চমহাব্রত বলতে কী বোঝো?
অথবা, চতুর্যাম কী?
জৈন ধর্মের তীর্থংকর পার্শ্বনাথের ধর্মের মূলমন্ত্র ছিল চারটি। একে বলা হয় চতুর্যাম ব্রত। এগুলি হল অহিংসা, সত্য কথা বলা, অচৌর্য ও অপরিগ্রহ। মহাবীর – এর সঙ্গে আরও একটি ব্রত যোগ করেন। এটি হল ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ জিতেন্দ্রিয়তা। এই পাঁচটি ব্রত একত্রে পঞ্চমহাব্রত নামে পরিচিত।
জৈনধর্মে ত্রিরত্ন কী?
মহাবীর পুনর্জন্ম ও কর্মফল থেকে নিষ্কৃতিলাভের জন্য তিনটি পথের কথা বলেছেন। এগুলি হল সৎ বিশ্বাস, সৎ জ্ঞান ও সৎ আচরণ। একেই জৈন ধর্মে ত্রিরত্ন বলে। এই ত্রিরত্ন – এর সাহায্যে ‘সিদ্ধশিলা’ অর্থাৎ পরম শুদ্ধ আনন্দ বা আত্মার মুক্তিলাভ সম্ভব।
মহাভিনিষ্ক্রমণ কাকে বলে?
গৌতম বুদ্ধ একদিন রাত্রে সন্ন্যাস নেওয়ার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করেন। গৌতমের এই গৃহত্যাগের ঘটনা মহাভিনিষ্ক্রমণ নামে পরিচিত। এরপর দীর্ঘ তপস্যার পর তিনি ‘বুদ্ধত্ব’ লাভ করেন।
কীভাবে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়?
বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম হল বৌদ্ধ ধর্ম। তিনি সারনাথে প্রথম ধর্মপ্রচার করেন। এরপর যান রাজগৃহে। সেখানে মগধের রাজা বিম্বিসার তাঁর শিষ্য হন। বুদ্ধ কোশল রাজ্যে প্রায় দীর্ঘ 21 বছর ধরে ধর্মপ্রচার করেন। অবশেষে কুশিনগরে তিনি মারা যান।
কোন্ ঘটনাকে ধর্মচক্র প্রবর্তন বলা হয়েছে?
অথবা, ধর্মচক্র প্রবর্তন কী?
বোধিলাভের পর বুদ্ধদেব গয়া থেকে বারাণসীর কাছে সারনাথে যান। সেখানে পাঁচজন সঙ্গীর মধ্যে তাঁর উপদেশ । প্রথম প্রচার করেন। এই পাঁচজনই তাঁর প্রথম পাঁচ শিষ্য হয়েছিলেন। তাঁদের কাছে তিনি মানুষের জীবনের দুঃখের কারণগুলি ব্যাখ্যা করেন। পরবর্তী সময়ে এই ঘটনাকে ধর্মচক্র প্রবর্তন বলা হয়েছে।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ কী?
গৌতম বুদ্ধ মনে করতেন মানুষ তার কৃতকর্মের জন্য বারবার পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। এই চক্রের হাত থেকে রক্ষা পেতে তিনি নির্বাণলাভের জন্য মধ্যমপন্থা হিসেবে আটটি পথ নির্দেশ করেছেন। এগুলি হল – সৎ বাক্য, সৎ কর্ম, সৎ চেষ্টা, সৎ সংকল্প, সৎ জীবিকা, সৎ চিন্তা, সৎ দৃষ্টি ও সৎ সমাধি। এগুলি – অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে পরিচিত। মার্গ কথার অর্থ হল পথ। বুদ্ধদেবের আটটি পথকে একত্রে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলে।
বৌদ্ধ সংগীতি – টীকা লেখো।
অথবা, বৌদ্ধধর্ম সংগীতি – টীকা লেখো।
বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধ সংঘে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জীবনযাপন ও ধর্মীয় আচরণ নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়। এই মতবিরোধ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা কোনো একস্থানে সমবেত হতেন। এই মিলিত সমাবেশগুলিই ধর্মসংগীতি বা বৌদ্ধধর্ম সংগীতি নামে পরিচিত। ধর্মসংগীতি। অনেকটা ধর্মসম্মেলনের মতো। মূলত চারটি ধর্মসংগীতির কথা জানা যায়। এরূপ প্রথম বৌদ্ধসংগীতিটি মগধরাজ অজাতশত্রুর সময় রাজগৃহের সন্তপর্ণী গুহায় অনুষ্ঠিত হয়।
ত্রিপিটক – টীকা লেখো।
অথবা, বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান গ্রন্থের নাম কী? এই গ্রন্থ কটি ভাগে বিভক্ত ও কী কী?
বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল ত্রিপিটক। এটি পালি ভাষায় রচিত। এটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। যথা – সুত্তপিটক, বিনয়পিটক ও অভিধম্মপিটক। সুত্তপিটকে গৌতমবুদ্ধ-সহ তাঁর প্রধান শিষ্যদের উপদেশাবলি সংকলিত রয়েছে। বিনয়পিটকে বৌদ্ধসংঘ ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আচার-আচরণ সংক্রান্ত নিয়মাবলি বিধিবদ্ধ আছে। অভিধম্মপিটকে গৌতম বুদ্ধের মূল কয়েকটি উপদেশ আলোচিত হয়েছে। ত্রিপিটকের সংকলনগুলি। প্রথম বৌদ্ধ সংগীতিস্থল রাজগৃহে সংকলিত হয়।
কোন্ সময় সুত্তপিটক ও বিনয়পিটক সংকলিত হয়?
বুদ্ধের মৃত্যুর (আনুমানিক 486 খ্রিস্টপূর্বাব্দে) অনতি-কাল পরেই অজাতশত্রুর শাসনকালে মগধের রাজধানী রাজগৃহে মহাকাশ্যপের সভাপতিত্বে বৌদ্ধদের প্রথম ধর্মসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। ওই প্রথম বৌদ্ধ ধর্মসংগীতিতেই সুত্তপিটক ও বিনয়পিটক সংকলিত হয়।
মজঝিম পন্থা বা মধ্যম পন্থা কী?
অথবা, গৌতম বুদ্ধ কেন মধ্যপন্থার কথা বলেছিলেন?
বুদ্ধদেব তাঁর অনুগামীদের চরমমুক্তি বা নির্বাণলাভের জন্য আর্যসত্যের উপলব্ধির কথা বলেছেন। এ ছাড়া তিনি অষ্টাঙ্গিক মার্গের কথাও বলেছেন। বুদ্ধদেবের মতে, প্রচুর ভোগবিলাস বা কঠোর কৃচ্ছসাধন দ্বারা মানুষের কামনা-বাসনার নিবৃত্তি ঘটাতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন ত্যাগ ও সংযমের। অর্থাৎ বুদ্ধদেবের নির্দেশিত পথ হল সমস্ত কিছুর মাঝামাঝি একটি নির্দেশনা। এটি মজঝিম পন্থা বা মধ্যম পন্থা নামে পরিচিত।
জেনে রাখো – গৌতম বুদ্ধের গৃহত্যাগের ঘটনা ‘মহাভিনিক্ষমণ’ এবং মৃত্যু ‘মহাপরিনির্বাণ’ নামে পরিচিত। বৌদ্ধ ধর্মে, গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর যে – মহাসম্মেলনের আয়োজন করা হত তা বৌদ্ধ সংগীতি নামে পরিচিত। তারতে মোট চারটি বৌদ্ধ সংগীতি আয়োজিত হয়েছিল। রাজগৃহ, বৈশালী, পাটলিপুত্র এবং কাশ্মীর (মতান্তরে জলন্ধরে) -এ এই বৌদ্ধ সংগীতিগুলি আয়োজিত হয়েছিল।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে মিলগুলি কোথায়?
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে নিম্নোক্ত মিলগুলি লক্ষ করা যায়। যেমন –
- উভয় ধর্মের মূল সূত্রগুলি আর্য তথা হিন্দু ধর্ম থেকেই নেওয়া।
- উভয় ধর্মই হিন্দু ধর্মের কর্মফল ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী।
- আবার উভয় ধর্মই বেদের অভ্রান্ততা ও অপৌরুষেয়তা স্বীকার করে না।
- এ ছাড়া উভয় ধর্মই যাগযজ্ঞ, জাতিভেদ ও পশুবলির ঘোরতর বিরোধী।
- বৌদ্ধ ও জৈন উভয় ধর্মমতই দুঃখবাদে বিশ্বাসী এবং পার্থিব সুখভোগে উদাসীন।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে পার্থক্যগুলি কী ছিল?
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে পার্থক্যগুলি নিম্নরূপ –
- জাতিভেদ প্রথা – জাতিভেদ প্রথার প্রতি বিতৃয়া জৈন ধর্ম অপেক্ষা বৌদ্ধ ধর্মেই বেশি তীব্র।
- অহিংসা নীতি – অহিংসা নীতি সম্বন্ধে জৈনগণ অধিক চরমভাবাপন্ন। জৈনগণ প্রকৃতির সমস্ত বস্তুতে প্রাণের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও বৌদ্ধগণ তা করেন না।
- রক্ষণশীল – জৈনগণ অপেক্ষা বৌদ্ধগণ হিন্দু দেবদেবী ও ব্রাহ্মণদের ব্যাপারে বেশি রক্ষণশীল।
- আধ্যাত্মিক শান্তি ও সম্যক জ্ঞানলাভ – সবশেষে জৈন আদর্শ হল কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক শান্তি লাভ করা। অন্যদিকে বৌদ্ধদের আদর্শ হল বুদ্ধদেবের মতো সম্যক জ্ঞানলাভ করে নির্বাণ প্রাপ্তি।
নব্যধর্ম আন্দোলনগুলি কেন নগরকেন্দ্রিক ছিল?
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে নব্যধর্ম আন্দোলনগুলি নগরকেন্দ্রিক ছিল। কারণ –
- সে সময়ে গ্রামের মানুষজন ছিল অশিক্ষিত। সে তুলনায় নগরগুলিতে শিক্ষার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। অনেকেই সংস্কৃত ভাষাচর্চা করত। ফলে ধর্ম বিষয়ে তাদের শিক্ষা দেওয়ার কাজ ছিল সহজ।
- গ্রামের মানুষজন ছিল ধর্মগোঁড়া। তারা ছিল প্রাচীনপন্থী। সে তুলনায় শিক্ষিত নগরবাসীরা ছিল উদার। স্বভাবতই তারা ধর্ম বিষয়ে নতুন চিন্তাভাবনা বোঝা ও তা গ্রহণ করার অবস্থায় ছিল।
- সেযুগে ভারতের নগরগুলি ছিল জনবহুল। ফলে অধিক সংখ্যক মানুষের মধ্যে ধর্মপ্রচার করার সুযোগ ছিল।
তুমি আর্য না অনার্য তা যুক্তি দিয়ে বোঝাও।
আমি নিজেকে একজন অনার্য বলে মনে করি। কারণ আমার গড়ন ও গায়ের রং জানান দেয় যে, আমি একজন অনার্য। আমরা জানি আর্যদের গায়ের রং ছিল ফর্সা। তারা ছিল লম্বা-চওড়া, টিকালো নাক।
কিন্তু এসব শারীরিক গঠনের সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই। আমার গায়ের রং কালো। আমার উচ্চতা কম। তাছাড়া আমি জানি আর্য সংস্কৃতির এসব উত্তর ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
সমাজের কোন্ অংশের মানুষ, কেন নব্যধর্ম আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল?
বৈদিক যুগে সমাজের পিছিয়ে পড়া ও মর্যাদাহীন মানুষরাই খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে নব্যধর্ম আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। সেই তালিকায় ছিল –
- ক্ষত্রিয়রা,
- বৈশ্যরা ও
- শূদ্ররা এবং তৎসহ সমাজের অস্পৃশ্য শ্রেণির মানুষজন।
তারা নব্যধর্ম আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল, কারণ –
- নব্যধর্ম আন্দোলনে (যেমন – বৌদ্ধ ধর্মে) নারী মর্যাদা স্বীকৃত ছিল। ভগবান বুদ্ধ সমাজের অবহেলিত ও মর্যাদাহীন সকল মানুষকে তাঁর চরণে ঠাঁই দিয়েছিলেন।
- এছাড়া তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। সেসময় এই ধর্ম আচারকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিল। যজ্ঞে নিষ্ঠুর গো-বলিদান প্রথাকে তারা সমর্থন করেনি।
- এমনকি ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরাও সেসময় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বিরোধী হয়েছিল। কারণ তারাও ব্রাহ্মণদের শোষণের শিকার হয়েছিল।
গঙ্গা উপত্যকা অঞ্চলে কেন মহাজনপদগুলি শক্তিশালী হয়ে ওঠে?
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মূলত উত্তর ভারতে 16টি মহাজনপদের উদ্ভব হয়। ক্রমে তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর পিছনের কারণগুলি ছিল –
- যোগাযোগ ব্যবস্থা – এই অঞ্চল ছিল নদীমাতৃক। সেখানে ছিল গঙ্গা, যমুনা, শোন, গণ্ডক প্রভৃতি নদী। তাই নদীপথে। এইসব জনপদগুলির স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।
- উর্বর জমি – এই অঞ্চলে গঙ্গা-যমুনা বিধৌত সমভূমি। হওয়ায় সেখানকার জমি ছিল খুবই উর্বর। ফলে সেখানে ভালো ফসল জন্মাত। যা ছিল এখানকার সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি।
- প্রাকৃতিক সম্পদ – এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব ছিল না। সেই তালিকায় ছিল বিভিন্ন বনসম্পদ ও খনিজ সম্পদ। সেই সঙ্গে এখানে ভালো ফসল ফলত। তাই এই জনপদগুলি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী ছিল।
দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর – টীকা লেখো।
অথবা, দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর কাদের বলা হয়?
অথবা, জৈনরা কখন, কীভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়?
অথবা, জৈন ধর্মাবলম্বীদের বিভাজনের কারণ কী ছিল?
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মতো জৈনরাও দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়, যথা – দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর।
- দিগম্বর – চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে মৌর্য সাম্রাজ্যে এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই অবস্থা অবস্থায় জৈন দার্শনিক ভদ্রবাহু ও তাঁর অনুগামীরা দক্ষিণ ভারতে চলে যান। তিনি মহাবীর জৈনের আদর্শ গভীরভাবে অনুসরণ করতেন। তাঁরা ব্যবহারিক জীবনে এতটাই কৃচ্ছসাধন ও ত্যাগের আদর্শ পালন করতেন যে, তাঁরা শরীরে কোনো পোষাক পরিধান করতেন না। সম্ভবত এর পিছনে যে যুক্তি ছিল, তা হল-সামান্য একটি পোশাকও মানুষের মনে লোভ সঞ্চার করতে পারে। তাতে সাধন ভজনে ব্যাঘাত ঘটে। তাই তারা এ বিষয়ে উদাসীন ছিলেন। ফলে ভদ্রবাহুর অনুগামীরা দিগম্বর পথে পরিচিত হয়।
- শ্বেতাম্বর – অন্যদিকে উত্তর ভারতে অবস্থানকারী জৈন পণ্ডিত স্থূলভদ্র ও তাঁর অনুগামীরা সাদা বস্ত্র পরিধান করা শুরু করেন। এরাই শ্বেতাম্বর নামে পরিচিত। এইভাবে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক নাগাদ জৈন ধর্মাবলম্বীরা স্পষ্ট ২টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়।
গণরাজ্যগুলির নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়েছিল কেন?
অথবা, রাজতান্ত্রিক মহাজনপদগুলির সঙ্গে লড়াইয়ে গণরাজ্যগুলি কেন টিকে থাকতে পারেনি?
নানা কারণে ষোড়শ মহাজনপদের অন্তর্গত গণরাজ্যগুলি রাজতান্ত্রিক জনপদগুলির সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারেনি, যেমন –
- রাজতান্ত্রিক রাজ্যগুলি ছিল গণতান্ত্রিক রাজ্যগুলির চেয়ে বেশি শক্তিশালী। এক একটি রাজতান্ত্রিক রাজ্য শক্তিশালী অর্থনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাদের উন্নত কৃষি ও ব্যাবসাবাণিজ্য ছিল। তাদের রাজকোষ ভর্তি থাকত কর বাবদ সংগৃহীত অর্থে। ফলে তারা সেনাবাহিনীর পিছনে প্রচুর অর্থ খরচ করতে পারত।
- সেই তুলনায় গণরাজ্যগুলি সবদিক থেকেই রাজতান্ত্রিক রাজ্যগুলির চেয়ে পিছিয়ে ছিল। অন্যদিকে তারা। পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকত।
- স্বাভাবিকভাবেই রাজতান্ত্রিক রাজ্যগুলির পক্ষে দুর্বল গণরাজ্যগুলি দখল করার কাজ সহজ হয়েছিল।
নব্যধর্ম আন্দোলন ছিল মূলত নগরকেন্দ্রিক-মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো।
অথবা, নব্যধর্ম আন্দোলনগুলি ছিল নগরকেন্দ্রিক, তার কারণগুলি আলোচনা করো।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে নব্যধর্ম আন্দোলনগুলি গড়ে উঠেছিল মূলত নগরগুলিতে। এর প্রধান কারণ ছিল –
- সেসময় নগরগুলিতে নানা ধরনের মানুষ বসবাস করত। তাতে ছিল নানান পেশার মানুষ, যেমন – পুরোহিত, পণ্ডিত, ব্রাহ্মণ, যোদ্ধা, বণিক। ফলে শিক্ষা সচেতন মানুষের মধ্যে নতুন ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করা সহজ ছিল। সেকারণেই গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর নগরে গিয়ে ধর্মপ্রচার করেছিলেন। তাঁদের জীবনের বড়ো অংশ অতিবাহিত হয় নগরে।
- অন্যদিকে সেযুগে গ্রামে বসবাস করত কৃষক ও অন্যান্য পেশার সাধারণ মানুষ। যাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছিল না বললেই চলে। স্বভাবতই প্রচলিত ধর্ম ও ধর্মীয় আচার-আচরণের বাইরে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক জীবন কেমন ছিল?
অথবা, ষোড়শ মহাজনপদের আমলে অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল?
পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষ অধ্যায়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক জীবনে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এযুগে কৃষি-অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্য ও শূদ্রেরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের চোখরাঙানি উপেক্ষা করতে থাকে।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের অর্থনৈতিক জীবন
- খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতের আর্থসামাজিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
- পরবর্তী বৈদিক যুগে লোহার ব্যাপক প্রচলন তথা ভারী লাঙলের ব্যবহার কৃষি অর্থনীতি ও ব্যাবসাবাণিজ্যে দারুণ শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়। সেই সঙ্গে নগরায়ণের পথ প্রশস্ত হয়।
- বৈশ্যেরা ব্যাবসাবাণিজ্য করে বিত্তশালী হয়ে ওঠে।
- অন্যদিকে শূদ্ররাও কৃষিকাজ করে উন্নতি করে।
- ফলে সমাজে ধনবৈষম্য দেখা দেয়। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক পার্থক্য গড়ে ওঠে। এই মতের সমর্থক ড. বি এন মুখার্জি। যদিও এযুগে তেমনভাবে মুদ্রা অর্থনীতি গড়ে ওঠেনি। বিনিময়প্রথা দ্বারা ব্যাবসাবাণিজ্য চলত।
বণিকরা কেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরোধিতা করেছিল?
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৈশ্য বা বণিকরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরোধিতা করেছিল, কারণ –
- ব্রাহ্মণ্য ধর্মে সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ ছিল। ফলে বণিকদের ব্যাবসাবাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল।
- ব্রাহ্মণ্য ধর্মে টাকা লেনদেন, ঋণ দেওয়া ও সুদ নেওয়া পাপ কাজ ছিল।
- এছাড়া বৈশ্যরা ব্যাবসাবাণিজ্য করে বিত্তশালী হলেও তাদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিলনা।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে সামাজিক জীবন কেমন ছিল?
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতীয় সমাজজীবনে নানা পরিবর্তন লক্ষ করা যায় যা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ঐতিহাসিক বিবরণের মাধ্যমে পেয়ে থাকি।
সামাজিক জীবন
- এযুগে তীব্র বর্ণবৈষম্য দেখা দেয়।
- ব্রাহ্মণগণ সমাজের শীর্ষে অবস্থান করত। ক্ষত্রিয়গণ তীব্র ব্রাহ্মণবিরোধী হয়ে পড়ে। তারা ব্রাহ্মণদের দ্বিজত্বের তত্ত্বকে অস্বীকার করে।
- শূদ্রদের অবস্থা ছিল করুণ। তাদের পণ্যের মতো ব্যবহার করা হত।
- এযুগে ক্ষত্রিয়দের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। ফলে শ্রেণিসংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
- নারীর মর্যাদা ভীষণভাবে হ্রাস পায়। ‘ধর্মসূত্রে’ নারীজাতির অসহায়তার কথা উল্লেখ আছে। সমাজে সবর্ণ বিবাহই কাম্য ছিল। বহুবিবাহ, সতীদাহ প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধি বৈদিক সমাজকে ক্ষয়িষ্ণু করে তোলে।
খ্রি.পূ. ষষ্ঠ শতাব্দীকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ বলা হয় কেন?
খ্রি.পূ. ষষ্ঠ শতাব্দীকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ বলা হয়, কারণ –
- এই সময় দ্বিতীয় নগরায়ণের (Second Urbanization) উত্থান ঘটে। ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকায় ব্যাপকভাবে নগর গড়ে ওঠে।
- নগরায়ণ সৃষ্টি করে পর্যাপ্ত ধাতুর চাহিদা। এই সময়ের মানুষ লোহার ব্যবহার জানায় তার চাহিদা আরও বাড়িয়ে তোলে।
- নতুন ধাতুর ব্যবহার মুদ্রার বিকাশকেও ত্বরান্বিত করে। নতুন ধাতুতে তৈরি মুদ্রার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।
বৌদ্ধ ধর্ম – টীকা লেখো।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে প্রায় 64টি প্রতিবাদী ধর্মমতের উদ্ভব হয়। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বৌদ্ধ ধর্ম।
- এই ধর্মমতের প্রবর্তন করেন গৌতম বুদ্ধ।
- তিনি প্রচার করেন মানুষ তার কর্মফলের জন্য বারবার পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। দুঃখকষ্ট পায়। এ সম্পর্কে তিনি চারটি মহান সত্য উপলব্ধি হয়। এগুলিকে বলা হয় আর্যসত্য।
আর্যসত্য – এগুলি হল – পৃথিবী দুঃখময়, মানুষের কামনা-বাসনা থেকেই সৃষ্টি হয় দুঃখ, তা দূর করতে পারলেই মোক্ষ বা মুক্তি লাভ সম্ভব এবং এই মুক্তি পেতে ৮টি পথ অনুসরণ করতে হবে, যাকে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলেছেন।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ – এই 8টি পথ হল – সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম, সৎ বাক্য, সৎ জীবিকা, সৎ চেষ্টা, সৎ দৃষ্টি, সৎ সংকল্প ও সৎ সমাধি। বৌদ্ধধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল ত্রিপিটক। এর 3টি ভাগ, যথা – সুত্তপিটক, বিনয় পিটক ও অভিধম্ম পিটক।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের পঞ্চম অধ্যায়, “খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতীয় উপমহাদেশ (রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ধর্মের বিবর্তন-উত্তর ভারত)” অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহায়ক হবে, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ!