আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের অষ্টম অধ্যায়, ‘প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতিচর্চার নানাদিক (শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্প)’ অধ্যায়ের অধ্যায় সারসংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণী এবং চাকরির পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই আসতে দেখা যায়।
শিক্ষাচর্চা
পড়া এবং শোনা একত্রে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অঙ্গ। হরপ্পা সভ্যতার শিক্ষা সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানি না। বৈদিক সভ্যতায় গুরু বলবেন ও শিষ্য শুনবে – এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার বিকাশ ঘটেছিল। প্রাচীনকালে গুরুকুল ব্যবস্থায় শিক্ষা দেওয়া হত। কৃষি, চিকিৎসা, রাজ্যশাসন প্রভৃতি ছিল শিক্ষার বিষয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীরের আবির্ভাবের পর বৌদ্ধবিহার বা সংঘগুলিতে আরও উন্নত ধরনের পড়াশোনা চলত। নালন্দা ও তক্ষশিলা মহাবিহারের পড়াশোনা ভারতের বাইরেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বৈদিক যুগ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান পর্যন্ত ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়ার ভার ছিল গুরু, আচার্য, উপাধ্যায়দের ওপর। সেযুগে কয়েকটি বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল – পাটলিপুত্র, কনৌজ, উজ্জয়িনী, মিথিলা, তাঞ্জোর এবং কল্যাণ প্রভৃতি নগরে।
সাহিত্যচর্চা
ভাষার ব্যবহার থেকেই সাহিত্যের সৃষ্টি। ভাষা দু-ভাবে ব্যবহৃত হয় – মুখের ভাষা এবং লেখার ভাষা। ঋকবৈদিক যুগে ছন্দস বা ছান্দস ভাষায় সকলে কথা বলত। কিন্তু ধীরে ধীরে অঞ্চলভিত্তিতে ভাষার একটা টান লক্ষ করা যায়। তাই ভাষাকে নিয়মে বাঁধে ব্যাকরণ। প্রথম ব্যাকরণ লেখেন পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধ পালি এবং প্রাকৃত ভাষায় তাঁর শিষ্যদের উপদেশ দিতেন। এগুলি ছিল জনসাধারণের ভাষা। এই শতকে ব্যাবসাবাণিজ্যে সফলতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে লেখার প্রয়োজন হয়। সমাজে ব্রাহ্মণরাই যে শ্রেষ্ঠ সেই উদ্দেশ্যে ধর্মশাস্ত্র লেখা শুরু হয়। যেমন – খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের আগেই রামায়ণ রচিত হয় এবং খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে মহাভারত সংকলিত হয়। এর সঙ্গে স্মৃতিশাস্ত্র এবং রাজনীতি নিয়ে লেখা শুরু হয়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এরকম একটি রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ। মৌর্য যুগে ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী ভাষায় লেখা লিপির মাধ্যমে সম্রাট অশোক জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর নির্দেশ দিতেন। আরও কয়েকটি সাহিত্য যেমন – পুরাণ, গল্পকথা, কবিতা সংকলন, চিকিৎসা সাহিত্য লেখা হয়েছিল। এগুলি প্রায় সবই সংস্কৃত ভাষায় লেখা। প্রাচীন ভারতের সাহিত্য রচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কালিদাস, অশ্বঘোষ, দন্ডী, ভাস, শূদ্রক, বিশাখদত্ত প্রমুখ।
বিজ্ঞানচর্চা
প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চা পৃথিবীতে সকলের কাছে আজও সমানভাবে সমাদৃত। এই বিজ্ঞানকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়, যেমন –
চিকিৎসা
ভারতে প্রাচীন চিকিৎসা বলতে বোঝাত গাছ, লতাপাতা থেকে ওষুধ তৈরি করে তা রোগ নিবারণের কাজে ব্যবহার করা। বিশল্যকরণী এইরকম একটি ওষধি গাছ। চরক সংহিতায় প্রায় সাতশো ঔষধি গাছপালার কথা পাওয়া যায়। একটি আদর্শ হাসপাতাল কেমন হওয়া উচিত তার বিবরণও চরক সংহিতায় পাওয়া যায়। বুদ্ধের সময়কালে জীবক ছিলেন একজন বিখ্যাত চিকিৎসক। এ ছাড়া শল্য চিকিৎসায় বিখ্যাত ছিলেন শুশ্রুত।
জ্যোতির্বিজ্ঞান
ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞান অনেকটা জ্যোতিষচর্চার কাজে ব্যবহার করা হত। আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত প্রমুখ বিজ্ঞানীরা গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র, গণিত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেন। পৃথিবীর মধ্যে ভারতের বিজ্ঞানীরা প্রথম দশমিকের ধারণা দেন।
ধাতুবিজ্ঞান
প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন স্থানে ধাতুর অস্ত্রশস্ত্র, মুদ্রা, গয়না ও মূর্তি পাওয়া গেছে। যেগুলির গুণমান উৎকৃষ্ট। ধাতুবিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ – দিল্লির মেহরৌলির লোহার স্তম্ভ।
রসায়ন বিজ্ঞান
আমাদের দেশের মানুষরা রসায়ন চর্চার মাধ্যমে ধাতু গলানোর কাজ করত। এমনকি সুগন্ধি দ্রব্য, খাদ্য তৈরিতে রসায়ন বিজ্ঞানের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
কৃষিবিজ্ঞান
ভারতে সভ্যতার শুরু থেকে কৃষি মানুষের অজানা ছিল না। কৃষি ছিল বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা। তাই বিজ্ঞানের আলোচনায় কৃষি এবং প্রকৃতি স্থান পেয়েছিল। কৃষিপরাশর গ্রন্থে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কৃষির পাশাপাশি প্রাচীন ভারতে পশুপাখি নিয়েও আলোচনা হত।
প্রযুক্তিবিদ্যা
প্রাচীন ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যা জনপ্রিয় ছিল। চিকিৎসকের যন্ত্রপাতি তৈরির কথা শুশ্রুত সংহিতায় বলা হয়েছে। এ ছাড়া ধাতু ও দামি পাথরের পর্যবেক্ষণ করাও বিজ্ঞানের অংশ ছিল।
কারিগরিবিদ্যা
প্রাচীন ভারতে কারিগরি বিজ্ঞানের উন্নতির কথাও জানা যায়। অস্ত্রোপচারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি চিকিৎসকরা নিজেরা তৈরি করতেন না। দক্ষ কারিগরদের ওপর বিশেষ করে কামারের ওপর নির্ভর করতে হত। প্রয়োজনীয় যন্ত্র কেমন হবে তা কারিগরকে বুঝিয়ে দিতে হত। সেইমতো কারিগর যন্ত্র তৈরি করে দিতেন।
স্থাপত্যবিদ্যা
প্রথমদিকে এই ক্ষেত্রটি বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে ধর্মের প্রয়োজনে স্থাপত্য তৈরি করা হত। এগুলি ছিল মন্দির ও মঠ। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে এই ধরনের স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল। অশোকের আমলে পাথরের স্তম্ভ তৈরি হত। অশোকস্তম্ভ দেখতে অনেকটা চকখড়ির মতো।
শিল্পচর্চা
সভ্যতার শুরু থেকেই শিল্পচর্চা প্রাধান্য পেয়েছিল। স্থাপত্য ও ভাস্কর্য রীতি শিল্পচর্চাকে সমৃদ্ধ করেছিল। মৌর্য আমলের শিল্পচর্চায় পাথরের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। শুঙ্গ-কুষাণ-সাতবাহন যুগে স্তূপ, চৈত্য, বিহার বানানো হয়েছিল। শক ও কুষাণ যুগে গন্ধার ও মথুরা শিল্পরীতি ছিল বিখ্যাত। মথুরা রীতির ভাস্কর্যে লাল চুনাপাথরের ব্যবহার ছিল বেশি। অজন্তা গুহাচিত্র, নালন্দা মহাবিহার, চন্দ্রকেতুগড়ের পোড়ামাটির কাজ এবং বাংলার টেরাকোটা শিল্পচর্চায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের সপ্তম অধ্যায়, “প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতিচর্চার নানাদিক (শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্প)” অধ্যায়ের অধ্যায় সারসংক্ষেপ আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়ক হবে, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ!