আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষ (যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতি স্থাপন)’ অধ্যায়ের অধ্যায় সারসংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণী পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই আসতে দেখা যায়।
আদিম মানুষ প্রথমে যাযাবর জীবনযাপন করত। পশুশিকার করে ফলমূল সংগ্রহ করে তারা খাবার জোগাড় করত। ধীরে ধীরে তারা আগুনের ব্যবহার, চাকার ব্যবহার করতে শিখল। কৃষিকাজ শিখে স্থায়ী বসতি নির্মাণ করল। আদিম মানুষের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল। এই সংস্কৃতি থেকে গড়ে উঠেছিল সভ্যতা।
আদিম মানুষের কথা
অন্যান্য প্রাণীদের থেকে মানুষের চারিত্রিক ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য আলাদা। এই বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে মানুষের লক্ষ লক্ষ বছর সময় লেগেছে। মানব পরিবারের জন্ম হয়েছে এপ থেকে। এপ হল বানর পরিবার। এদের লেজ ছিল না। প্রথমে এরা গাছের ডালে বসবাস করত। আবহাওয়ার পরিবর্তন হতে শুরু করলে গাছপালা কমতে থাকে। তখন খাবারের সন্ধানে এরা মাটিতে নেমে আসে। দুই পায়ে হাঁটার চেষ্টা করে। এইভাবে লক্ষ লক্ষ বছরের চেষ্টায় এদের মধ্যে নানা পরিবর্তন আসে এবং বিবর্তনের মধ্যদিয়ে এপ থেকে মানব পরিবার বা হোমিনিড পরিবারের সৃষ্টি হয়।
আদিম মানুষের নানারকম ভাগ
আদিম মানুষের আবার নানা প্রকারভেদ ছিল। মূলত মস্তিষ্কের আকারের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন প্রকার আদিম মানুষের শ্রেণিবিভাগ করা হয়। যেমন –
অস্ট্রালোপিথেকাস
আজ থেকে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 40-30 লক্ষ বছর আগে এরা পৃথিবীতে এসেছিল। এদের নানা বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন –
- এরা কোনোক্রমে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত।
- শক্ত জিনিসপত্র চিবিয়ে খেত।
- এদের চোয়াল ছিল শক্ত ও সুগঠিত।
- হাতিয়ার হিসেবে তারা পাথর ব্যবহার করত।
হোমো হাবিলিস
আজ থেকে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 26-17 লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে হোমো হাবিলিস বা দক্ষ মানুষের আবির্ভাব হয়েছিল; এদের কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল –
- এরা দলবদ্ধভাবে থাকত এবং শিকার করত।
- এরা সম্ভবত কাঁচা মাংস খেত।
- পাথরকে ভেঙে ধারালো অংশ দিয়ে অস্ত্র বানাত।
হোমো ইরেকটাস
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 20 লক্ষ থেকে 3 লক্ষ 50 হাজার বছর আগে হোমো ইরেকটাস বা দণ্ডায়মান মানুষের জন্ম হয়েছিল। এদের বৈশিষ্ট্য হল –
- এরা সোজাভাবে দাঁড়াতে পারত।
- এরা প্রথম আগুনের ব্যবহার শিখেছিল।
- এরা হাতকুঠার ব্যবহার করত।
হোমো স্যাপিয়েন্স
হোমো স্যাপিয়েন্স বা বুদ্ধিমান মানুষের আবির্ভাব হয়েছিল প্রায় খ্রিস্টপূর্ব 2 লক্ষ 30 হাজার বছর আগে। এদের বৈশিষ্ট্য ছিল –
- এরা পশুর চামড়া পোশাক হিসেবে পরত।
- এরা ছোটো ও ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করত।
- এরা বর্শা জাতীয় অস্ত্র ব্যবহার করত।
বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর তুলনা
মানবপ্রজাতি | আবির্ভাব | হাতিয়ার | বৈশিষ্ট্য | অর্থ |
অস্ট্রালোপিথেকাস | আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 40 লক্ষ থেকে 30 লক্ষ বছর পূর্বে। | গাছের ডাল বা হাতের কাছে পাওয়া পাথর। | এরা দু-পায়ে ভর দিয়ে কোনোরকমে দাঁড়াতে পারত। | ‘দক্ষিণীয় এপ’ (লাতিন শব্দ ‘Austral’ = Southern এবং ‘Pithekos’ = ape অর্থাৎ- Southern ape)। |
হোমো হাবিলিস | আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 26 লক্ষ থেকে 17 লক্ষ বছর পূর্বে। | পাথরকে আঘাত করে ভেঙে তা দিয়ে হাতিয়ার তৈরি করে ব্যবহার করত। | এরা দলবদ্ধভাবে থাকত এবং এরা হাঁটতে পারত। | ‘দক্ষ মানুষ’। |
হোমো ইরেকটাস | আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 20 লক্ষ থেকে 3 লক্ষ 50 হাজার বছর পূর্বে। | স্তরকাটা নুড়ি পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করত। | দু-পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটতে পারত। | ‘দণ্ডায়মান মানুষ’। |
হোমো স্যাপিয়েন্স | আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 2 লক্ষ 30 হাজার বছর পূর্বে। | ছোটো ও ধারালো পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করত। | সোজা হয়ে হাঁটা, দৌড়োনো এবং দুই হাতের ব্যবহারে সমান দক্ষ। | ‘বুদ্ধিমান মানুষ’। |
পাথরের যুগ
আদিম যুগের শুরুতে মানুষ একসময় পাথর দিয়ে তাদের হাতিয়ার তৈরি করত। এই সময়কালকে পাথরের যুগ বা প্রস্তর যুগ বলে। পাথরের যুগকে আবার তিনভাগে ভাগ করা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের এই পর্ব বা যুগগুলি হল –
উপমহাদেশে পুরোনো পাথরের যুগ
ভারতীয় উপমহাদেশে পুরোনো পাথরের যুগের সন্ধান পাওয়া গেছে। মনে করা হয় আফ্রিকা থেকে আদিম মানুষেরা ভারতে এসেছিল। ভারতে এই সময়কার মানুষের হাড়গোড় পাওয়া গেছে।
প্রত্নক্ষেত্র – ভারতীয় উপমহাদেশে পুরোনো পাথরের যুগের সন্ধান পাওয়া গেছে কর্ণাটকের হুন্সগি উপত্যকা ও কুর্নুল, উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের সাংঘাও, মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকাতে।
বৈশিষ্ট্য –
- এই যুগের মানুষেরা ভারী নিরেট পাথর শিকারের কাজে ব্যবহার করত।
- যাযাবর প্রকৃতির এই সমস্ত মানুষেরা গুহা বা খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাত।
- তারা দলবেঁধে পশু শিকার করত, মিলেমিশে খাবার ভাগ করে খেত, পশুর চামড়া ও গাছের ছাল পরত।
- পুরোনো পাথরের যুগের শেষ পর্বে মানুষ ছুরির ব্যবহার শিখেছিল।
উপমহাদেশে মাঝের পাথরের যুগ
ভারতীয় উপমহাদেশে মাঝের পাথরের যুগে আদিম মানুষের জীবনযাত্রা আগের তুলনায় কিছুটা উন্নত ছিল। হাতিয়ারগুলিতেও পরিবর্তন এসেছিল।
প্রত্নক্ষেত্র – ভারতীয় উপমহাদেশে মাঝের পাথরের যুগের চিহ্ন পাওয়া গেছে উত্তরপ্রদেশের মহাদহা, মধ্যপ্রদেশের আদমগড় -এ।
বৈশিষ্ট্য –
- এই যুগের পাথরের অস্ত্রগুলি ছিল ছোটো ও ধারালো।
- মানুষ এই সময় পশুপালন করতে শিখেছিল।
- কুমোরের চাকার ব্যবহার তখনও শুরু হয়নি।
- মাঝের পাথরের যুগের মানুষ শিকার করেই খাবার জোগাড় করত।
উপমহাদেশে নতুন পাথরের যুগ
নতুন পাথরের যুগে হাতিয়ারগুলি আরও উন্নত হয়েছিল। এই সময়ে কৃষিকাজ শেখায় মানুষের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছিল। মানুষ নিজেরা খাদ্য উৎপাদন করতে শিখেছিল।
বৈশিষ্ট্য –
- কৃষিকাজ শেখায় এই সময় মানুষেরা স্থায়ীভাবে বসতি শুরু করে।
- সমাজে কৃষির পাশাপাশি কারিগর শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল।
- কৃষিকাজ যাযাবর জীবন নিশ্চিত করে।
- নানা ধরনের উন্নতমানের পাথরের অস্ত্র এই সময় তৈরি হয়েছিল।
কয়েকটি প্রমাণ
- আফ্রিকার ইথিয়োপিয়ায় হাদার নামক একটি জায়গায় লুসি নামক একটি ছোটো মেয়ের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। কঙ্কালটি ৩২ লক্ষ বছর আগের অস্ট্রালোপিথেকাস পর্যায়ভুক্ত মানুষের।
- কর্ণাটকের গুলবর্গা জেলার হুন্সগি উপত্যকায় ইসলামপুর গ্রামে পুরোনো পাথরের যুগের হাতিয়ার -এর সন্ধান পাওয়া গেছে। হাতকুড়ুল, ছোরা জাতীয় অনেক অস্ত্রশস্ত্র এখান থেকে পাওয়া গেছে।
- স্পেনের আলতামিরা গুহায় গুহাবাসী মানুষের আঁকা একটি বড়ো ষাঁড়ের ছবি আবিষ্কৃত হয়েছে।
- রাজস্থানের বাগোড়ে আদিম বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এখানে শিকার ও পশুপালন দুই-ই চলত।
তিনটি পাথরের যুগ (একনজরে)
যুগ | সময় | হাতিয়ার | বসবাস | খাদ্যাভ্যাস | পোশাক-পরিচ্ছদ | সংস্কৃতি |
পুরোনো পাথরের যুগ | আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 20 লক্ষ বছর থেকে খ্রিস্টপূর্ব 10 হাজার বছর। | বড়ো পাথরের এবড়ো-খেবড়ো হাতিয়ার। | খোলা আকাশের নীচে বা গুহায়। | বনের ফলমূল ও শিকার করা পশুপাখি। | গাছের ছাল ও পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক। | গুহাচিত্র মূলত পশুর প্রতিকৃতি ও শিকারের দৃশ্য। |
মাঝের পাথরের যুগ | আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 10 হাজার থেকে খ্রিস্টপূর্ব 8 হাজার বছর। | পাথরের তৈরি হালকা ও ছোটো, ধারালো হাতিয়ার। | ছোটো ছোটো বসতি তৈরি করে। | শিকারের পাশাপাশি গৃহপালিত পশুর মাংস ও দুধ। | গাছের ছাল ও পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি তুলনামূলক উন্নতমানের পোশাক। | জ্যামিতিক আকারের ত্রিকোণ, চতুষ্কোণ, বৃত্তাকার, চিত্রের ব্যবহার ও মৃৎশিল্পের উদ্ভব। |
নতুন পাথরের যুগ | আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 8 হাজার থেকে খ্রিস্টপূর্ব 4 হাজার বছর। | হাতিয়ার খুবই হালকা ও আগের তুলনায় উন্নত। | স্থায়ী বসতি নির্মাণ। | কৃষিকাজ করতে শেখার ফলে কৃষিজ উৎপাদিত দ্রব্য ও পশুজাত দ্রব্য। | তুলো, ভেড়ার পশম দিয়ে তৈরি পোশাক। | চিত্রে রং -এর ব্যবহার, পাথর কেটে মূর্তি তৈরি, পোড়ামাটির বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি। |
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষ (যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতি স্থাপন)‘ অধ্যায়ের অধ্যায় সারসংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহায়ক হবে, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ!