এখনই আমাদের Telegram Community গ্রুপে যোগ দিন।। এখানে WBBSE বোর্ডের পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির যেকোনো বিষয়ভিত্তিক সমস্যা শেয়ার করতে পারেন এবং একে অপরের সাহায্য করতে পারবেন। এছাড়া, কোনও সমস্যা হলে আমাদের শিক্ষকরা তা সমাধান করে দেবেন।

Telegram Logo Join Our Telegram Community

ষষ্ঠ শ্রেণী – ইতিহাস – ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষ (যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতি স্থাপন) – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষ (যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতি স্থাপন)’ অধ্যায়ের কিছু রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও সহায়ক। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণী এবং চাকরির পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই আসতে দেখা যায়।

ষষ্ঠ শ্রেণী ইতিহাস – ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষ
ষষ্ঠ শ্রেণী ইতিহাস – ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষ
Contents Show

পুরানো পাথরের যুগে আদিম মানুষের জীবনযাত্রা কেমন ছিল?

অথবা, পুরানো পাথরের যুগে আদিম মানুষের জীবন কেমন ছিল? তারা কোথায় বাস করত এবং তারা কীভাবে খাদ্য সংগ্রহ করত?

আজ থেকে প্রায় ২০ লাখ বছর আগে পুরানো পাথরের যুগ শুরু হয়েছিল। সেযুগের মানুষের জীবন ছিল খুবই বিপদময় ও কষ্টকর।

আদিম মানুষের জীবনযাত্রা –

জীবজন্তুর মতো – আদিম মানুষ জীবজন্তুর মতোই জঙ্গলে জীবন কাটাত। তাদের ওপর নেমে আসত হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ। এইসব প্রাণীর মুখোমুখি পড়ে প্রাণ হারানো ছিল প্রতিদিনের ঘটনা।

বিপদে ভরা জীবন – আদিম মানুষের অনেকেই কুড়ি বছর বয়স পার হওয়ার আগেই মারা যেত হিংস্র প্রাণীর আক্রমণে, না হয় অসুখে কিংবা অনাহারে।

কষ্টকর জীবন – আদিম মানুষের জীবন ছিল খুবই কষ্টের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন – ঝড়বৃষ্টি, বজ্রপাত, তুষারপাত, ভূমিকম্প প্রভৃতির কাছে মানুষ ছিল শিশুর মতো অসহায়। বরফের যুগেও তারা কষ্ট করে টিকে থাকতে পেরেছিল।

বাসস্থান – আদিম মানুষের প্রথম বাসস্থান ছিল অন্ধকার ও স্যাঁতসেঁতে পাহাড়ের গুহায়। কখনো-কখনো তারা গাছের ডালের কোটরে কিংবা জলাশয়ের ধারে বসবাস করত।

খাবার – আদিম মানুষের বেঁচে থাকার মতো খাবারের সুযোগ ছিল না। তারা বনের ফলমূল ও পশুপাখির কাঁচা মাংস খেয়ে দিন কাটাত।

কঠোর কাজকর্ম – নিজেকে বাঁচাতে এবং খাবার পেতে মানুষ কঠোর পরিশ্রম করত। ধীরে ধীরে মানুষ জমিতে ফসল ফলানো, পশুপালন, পোশাক তৈরি, বসতবাড়ি গড়ে তোলা প্রভৃতি কাজ শুরু করে। সেখানে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছেন, কঠোর কাজকর্মই মানুষকে মানুষ করে তুলেছিল।

আদিম মানুষের কঠোর জীবনযাত্রা
আদিম মানুষের কঠোর জীবনযাত্রা

আদিম মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?

কয়েক লক্ষ বছর আগে প্রকৃতির ধীর পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে আদিম মানুষের উদ্ভব ঘটে। আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে আদিম মানুষের মাথার খুলি, কঙ্কাল, হাড়গোড় প্রভৃতি থেকে ঐতিহাসিকরা বেশ কিছু তথ্য খুঁজে পেয়েছেন।

আদিম মানুষের বৈশিষ্ট্য

  1. পশুর মতো – আদিম মানুষের শরীরের কাঠামো ছিল অনেকটাই পশুর মতো। এরা প্রথম দিকে কোনোক্রমে দাঁড়াতে পারত এবং জবুথবু হয়ে হাঁটত। তাদের হাত ছিল এতটাই লম্বা যে হাঁটুর নিচে ঝুলে থাকত। তারা ইচ্ছামতো আঙুল নাড়াতে পারত না।
  2. এপ থেকে মানুষ – শিম্পাঞ্জি, গোরিলা জাতীয় মানবাকৃতির প্রাণী এপ-এর পরে বিবর্তনের মধ্যদিয়ে কোনোভাবে দাঁড়াতে পারা মানুষের আবির্ভাব ঘটে। এই মতের প্রবক্তা প্রকৃতিবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন।
  3. ভাবের আদানপ্রদান – আদিম মানুষ ভয় ও ক্রোধ প্রকাশ করত মুখ দিয়ে শব্দ করে। এইভাবে তারা একে-অপরের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করত।
  4. আগুনের ব্যবহার – আদিম মানুষ বনে লাগা আগুন (দাবানল) দেখে আগুনের ব্যবহার শিখেছিল। চকমকি জাতীয় পাথরের ঠোকাঠুকি করে তারা প্রথম আগুন জ্বালাতে শিখেছিল।
  5. খাদ্যসংগ্রহ – আদিম মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক। তারা খাবারের খোঁজে বনেজঙ্গলে দলবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়াত। শিকার ও ফলমূল জোগাড় করে তারা খেত।
  6. বাসস্থান – আদিম মানুষ প্রথম দিকে খোলা আকাশের নিচে, কখনও-বা গুহায় থাকত। পরে তারা কৃষিজমির পাশে ও জলাশয়ের ধারে ছোটো-ছোটো বসতি গড়ে তোলে।

জেনে রাখো – আদিমকালে আজকের মতো পৃথিবীর ভূ-প্রাকৃতিক গঠন ছিল না। টারসিয়ারি যুগে পৃথিবীর ভূ-প্রকৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘ পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে আজকের পৃথিবী তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর ভূ-গাঠনিক পরিবর্তন আজও হয়ে চলেছে।

আদিম মানুষের জীবনযাত্রার মান ধীরে ধীরে কীভাবে উন্নত হয়েছিল?

আদিম মানুষের জীবন ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। বনজঙ্গল থেকে খাবার সংগ্রহ করে তাদের বেঁচে থাকতে হত। নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, ধীরে ধীরে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হতে থাকে।

আদিম মানুষের জীবনযাত্রার ক্রমোন্নতি:

  • খাদ্য উৎপাদক – পুরোনো পাথরের যুগে মানুষ শিকার করে, বনের ফলমূল সংগ্রহ করে খাদ্য সংস্থান করত। এক কথায়, তারা ছিল খাদ্য সংগ্রাহক। পরে, নতুন পাথরের যুগে তারা কৃষিকাজ শুরু করে, অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন করতে শেখে। এক কথায়, তারা পরিণত হয় খাদ্য উৎপাদকে।
  • গুহাবাসী থেকে গৃহবাসী – পুরোনো পাথরের যুগে মানুষ খোলা আকাশের নিচে, কখনও-বা পাহাড়ের অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে গুহায় বাস করত। পরে, নতুন পাথরের যুগে তারা কৃষিকাজ শুরু করলে যাযাবর জীবন ত্যাগ করে এবং স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। এভাবে, আদিম মানুষ গুহাবাসী থেকে গৃহবাসীতে পরিণত হয়েছিল।
  • একা থেকে দলবদ্ধ – আদিম মানুষ একা একা বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। এর ফলে, ভয়ানক প্রাণীর আক্রমণে প্রায়ই তারা প্রাণ হারাত। তাছাড়া, খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে মানুষ বিপদে পড়ত। এই অবস্থায়, মানুষ বুঝতে পারে দলবদ্ধভাবে বনে ফলমূল সংগ্রহ ও শিকার করার অনেক সুবিধা রয়েছে। তাই, আদিম মানুষ নিজেকে বাঁচাতে এবং খাবার সংগ্রহ করতে দলবদ্ধ হয়েছিল।

আদিম শিকারি মানুষের সমাজ – গবেষকরা আদিম শিকারি মানুষের সমাজ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, সে সময় সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক, এবং পারিবারিক জীবনে নারীদের কর্তৃত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

গুহাবাসী আদিম মানুষ
গুহাবাসী আদিম মানুষ

জেনে রাখো – তুষার যুগে গোটা পৃথিবী বরফের নীচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। তুষার যুগে কয়েকবার পর্যায়ক্রমে উয় ও শীতল যুগ এসেছে। মোট চারবার তুষার যুগের আবির্ভাব হয়েছিল। এই পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না-পেরে পৃথিবী থেকে বেশ কিছু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। যেমন-ম্যামথ, বিশালাকার পাখি প্রভৃতি।

পুরানো পাথরের যুগ ও নতুন পাথরের যুগের মানুষের জীবনযাত্রার পার্থক্যগুলি উল্লেখ করো।

মানুষের ইতিহাসের একটি বড়ো অংশ হল পাথরের যুগ। এই যুগ প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত, যথা: পুরানো পাথরের যুগ, মাঝের পাথরের যুগ এবং নতুন পাথরের যুগ। ওই যুগগুলিতে আদিম মানুষের জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছিল।

পুরানো ও নতুন পাথরের যুগের মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে পার্থক্য

বাসস্থানজনিত পার্থক্য – পুরানো পাথরের যুগে মানুষের বাসস্থান ছিল খোলা আকাশের নিচে, কখনো-বা পাহাড়ের গুহায়। কিন্তু নতুন পাথরের যুগে মানুষ স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে কৃষিজমির পাশে কিংবা জলাশয়ের ধারে।

খাদ্যজনিত পার্থক্য – পুরানো পাথরের যুগে মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক, অর্থাৎ খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য তারা পশুশিকার ও ফলমূল জোগাড় করত। কিন্তু নতুন পাথরের যুগে মানুষ হয়ে উঠেছিল খাদ্য উৎপাদক। কৃষিকাজ জানার ফলে তারা নানা ধরনের ফসল উৎপাদন করতে শিখেছিল।

হাতিয়ারজনিত পার্থক্য – পুরানো পাথরের যুগে পাথরের তৈরি মানুষের হাতিয়ারগুলি ছিল বড়ো ও ভোঁতা। কিন্তু নতুন পাথরের যুগে মানুষের হাতিয়ার ছিল অনেক মসৃণ, হালকা ও ধারালো।

জীবনযাত্রাজনিত পার্থক্য – পুরানো পাথরের যুগে মানুষের জীবন ছিল খুবই কষ্টের ও বিপদে ভরা। নিজেদের বাঁচাতে ও খাদ্য জোগাড় করতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হত। অন্যদিকে নতুন পাথরের যুগে মানুষ কৃষিকাজ জানার ফলে তাদের জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল।

পুরোনো পাথরের যুগ ও নতুন পাথরের যুগের মানুষের হাতিয়ারগুলির মধ্যে কী ধরনের পার্থক্য দেখা যায়?

লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আদিম মানুষ পাথরের হাতিয়ার তৈরি করেছিল। পুরোনো ও নতুন পাথরের যুগে পাথরের হাতিয়ারগুলির আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

পুরোনো ও নতুন পাথরের যুগের হাতিয়ারের পার্থক্য –

প্রকৃতি – পুরোনো পাথরের যুগের হাতিয়ারগুলি ছিল বড়, ভারী, এবড়োখেবড়ো এবং ভোঁতা। অন্যদিকে, নতুন পাথরের যুগের হাতিয়ারগুলি ছিল অনেক হালকা, ধারালো ও মসৃণ।

হাতল – পুরোনো পাথরের যুগে কোনো কোনো হাতিয়ারকে হাতের মুঠিতে ধরার জন্য পাথরের একদিকে ফুটো করে হাতল লাগানো হত। অন্যদিকে, নতুন পাথরের যুগের অনেক হাতিয়ারই ছিল হাতল লাগানো।

ব্যবহার – পুরোনো পাথরের যুগের হাতিয়ারগুলি মূলত বাঁচার তাগিদে ব্যবহার করা হত। অন্যদিকে, নতুন পাথরের যুগের হাতিয়ারগুলি নিজেকে বাঁচানো ছাড়াও পশু শিকার ও পশুর মাংস কাটার জন্য ব্যবহার করা হত।

হাতিয়ারের নাম – পুরোনো পাথরের যুগের হাতিয়ারের মধ্যে ছিল পাথরের ছুরির ফলা, ছুঁচোলো বর্শা, র‍্যাঁদা, পাথরের দা, হাতকুঠার, কাঠের তিরধনুক প্রভৃতি। অন্যদিকে, নতুন পাথরের যুগের হাতিয়ারগুলির মধ্যে ছিল হাতকুঠার, করাত, কপিকল, চাঁছুনি, কোদাল, কাস্তে, জাঁতা, বড়শি, বাটালি, ছুঁচ প্রভৃতি।

বৈচিত্র্য – পুরোনো পাথরের যুগের হাতিয়ারগুলির অধিকাংশই ছিল প্রায় একই ধরনের। কিন্তু নতুন পাথরের যুগের হাতিয়ারগুলির মধ্যে বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা দেখা যায়।

জান কি? – নতুন পাথরের যুগের শেষ দিকে মানুষ ধাতুর ব্যবহার শেখে। এই যুগকে তাই ধাতুর যুগও বলা হয়। এই ধাতুর যুগের প্রথম দিকে ছিল তাম্র-প্রস্তর যুগ।

নতুন পাথরের যুগে মানুষ কৃষিজ ফসল কীভাবে রক্ষা করত?

নতুন পাথরের যুগে মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন আসে। এ যুগে তারা কৃষিকাজ শেখে। ফলে তাদের যাযাবর জীবন বন্ধ হয়। তারা কৃষিজ ফসল রক্ষা করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

কৃষিজ ফসল রক্ষার উপায় –

কৃষিজ ফসল – এক সময় বন থেকে নিয়ে আসা বীজ থেকে চারাগাছ এবং চারাগাছ থেকে বড়ো গাছ কীভাবে হয়, তার পদ্ধতি মানুষ আয়ত্ত করেছিল। এইভাবে তারা কৃষিকাজ শিখে গম, যব, ধান প্রভৃতি ফসল উৎপাদন করেছিল।

নতুন পাথরের যুগে মানুষ
প্রাচীন যুগে মানুষের কৃষিকাজ

ঘরবাড়ি –

  • জমির পাশে ঘরবাড়ি তৈরি করেছিল।
  • মাটি খুঁড়ে গর্ত করে তার চারপাশে আগাছা, লতাপাতা, ঘাস, ডালপালা প্রভৃতি দিয়ে ঘেরা ঘর তৈরি করেছিল।
  • পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে ঘর তৈরি করেছিল।
  • জলাশয়ের ধারে কিংবা মাটির মধ্যে খুঁটি পুঁতে মাচা তৈরি করে ঘর তৈরি করেছিল। আর এসব ঘরবাড়ি মানুষ তৈরি করেছিল যাতে কৃষিজ ফসল উৎপাদন করা সহজ হয় এবং রক্ষা করা যায়।

নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য লেখো।

প্রকৃতপক্ষে, মধ্য প্রস্তর যুগের পরবর্তী পর্যায়ে নব্য প্রস্তর যুগের আবির্ভাব হয়েছিল। তবে পৃথিবীর সর্বত্র একইসঙ্গে নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা হয়নি। ভারতীয় উপমহাদেশের মেহেরগড়ে নব্য প্রস্তর পর্বের সূচনা হয়েছিল আনুমানিক 7000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য

  • মসৃণ হাতিয়ার – নব্য প্রস্তর যুগে তৈরি পাথরের হাতিয়ারগুলি ছিল বেশ মসৃণ। অর্থাৎ, হাতিয়ারের মসৃণতা ছিল এ যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
  • বয়ন শিল্পের বিকাশ – প্রথম বয়নশিল্প বিকশিত হয়েছিল নব্য প্রস্তর যুগে।
  • বিভিন্ন প্রকার হাতিয়ার – এই যুগের হাতিয়ারগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল হাড়ের তৈরি ছুঁচ, ছোরা, হারপুন প্রভৃতি।
  • মৃৎশিল্পের বিকাশ – এই যুগে মানুষ মাটির তৈরি জিনিস তৈরি করে জীবিকানির্বাহ করত। তারা কুমোরের চাকার সাহায্যে মৃৎপাত্র তৈরি করতে শেখে। এ সময় মৃৎশিল্প বেশ উন্নতমানে পৌঁছেছিল।
  • যাযাবর জীবনযাত্রার অবসান ও কৃষিকাজের উদ্ভব – নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের যাযাবর জীবনযাত্রার অবসান ঘটে। তারা এই সময় থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে এবং প্রয়োজনের তাগিদে কৃষিকাজের উদ্ভাবন করে। এ যুগেই তারা কৃষিকাজের পাশাপাশি পশুপালনেও মনোযোগী হয়।
  • ধাতুর ব্যবহার – নব্য প্রস্তর যুগের শেষের দিকে মানুষ তামা ও ব্রোঞ্জের জিনিস ব্যবহার করতে শুরু করে। মানুষের মধ্যে শিল্পীসত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ এযুগেই হয়েছিল।
  • অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া – মৃতদেহকে সমাধিস্থ করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পূর্ণ করা হত। এই প্রথা এযুগেই প্রথম চালু হয়। এসময় আংশিক ও পূর্ণ উভয় ধরনের সমাধির প্রচলন ছিল।
প্রাচীন যুগের তামা ও ব্রঞ্চের দ্রব্যাদি
প্রাচীন যুগের তামা ও ব্রঞ্চের দ্রব্যাদি

ভীমবেটকা গুহাচিত্র – টীকা লেখো।

অথবা, ভীমবেটকা সম্পর্কে আলোচনা করো।

মধ্যপ্রদেশের ভোপাল থেকে কিছুটা দূরে বিন্ধ্য পর্বতের কাছেই নির্জন জঙ্গলে ভীমবেটকা গুহা অবস্থিত। 1957 খ্রিস্টাব্দে এই গুহার খোঁজ পাওয়া যায়। এখানে প্রাচীন পাথরের যুগের মানুষের বসবাসের সন্ধান পাওয়া যায়।

ভীমবেটকা গুহাচিত্র –

ভীমবেটকা গুহাচিত্র
ভীমবেটকা গুহাচিত্র

পশুপালন – ভীমবেটকা গুহার দেওয়ালে সেই সময়ের মানুষ বিভিন্ন পাখি, মাছ, কাঠবেড়ালির মতো প্রাণীর ছবি এঁকে রং দিয়ে তা ফুটিয়ে তুলেছিল।

পশুশিকার – ভীমবেটকা গুহার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মানুষের পশুশিকারের ছবি। তারা একা অথবা দলবেঁধে শিকার করত। এই শিকারের সময় তারা বিভিন্ন প্রাণীর মুখোশ পরে নিজেকে হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষার উপায় বের করেছিল। কোনো কোনো ছবিতে দেখা যায় শিকারি মানুষের সঙ্গী ছিল কুকুর।

রঙের ব্যবহার – গুহার দেওয়ালে আঁকা ছবিগুলিতে সবুজ ও হলুদ রঙের ব্যবহার হলেও সাদা ও লাল রং বেশি দেখা যায়।

নব্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির বর্ণনা দাও।

অথবা, ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন পাথরের যুগে মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বর্ণনা দাও।

নব্য প্রস্তর যুগে কৃষিকাজ শুরু হয়েছিল। হাতিয়ার ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল এই সময়। মানব জীবনযাত্রায় একটি ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল। ফলে, সেই যুগের মানুষের সংস্কৃতি এক ধাক্কায় অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল।

নব্য প্রস্তর যুগের বিভিন্ন দিক

  • পশুপালন – নব্য প্রস্তর যুগে মানুষেরা পশুশিকারের পাশাপাশি পশুপালন করতে শেখে। কুকুর ছিল মানুষের প্রথম গৃহপালিত পশু। এ ছাড়া গরু, ভেড়া, উট, শূকর, মোষ, ছাগলকেও তারা এই সময় থেকে পালন করতে শুরু করেছিল। তারা এই সমস্ত পশুর দুধ এবং মাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত।
  • কৃষির সূচনা – নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ প্রথম কৃষিকাজের কৌশল উদ্ভাবন করে। কৃষিকাজ শুরু করার ফলে মানুষ এই সময় খাদ্য সংগ্রহকারী থেকে খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়।
  • স্থায়ী বসতির সূচনা – নব্য প্রস্তর যুগে কৃষির আবিষ্কারের পাশাপাশি মানুষ খাদ্য ও বসবাসের উপযোগী জায়গা নির্বাচন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। ফলে, মানুষের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে এবং মানুষ সভ্যতার অগ্রগতির দিকে আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে নতুন পাথরের যুগের গুরুত্ব কী?

মাঝের পাথরের যুগের পর পৃথিবীতে নতুন পাথরের যুগের সূচনা হয়। এর সময়কাল ছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 8000-4000 বছর। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই যুগের গুরুত্ব অপরিসীম।

নব্য প্রস্তর যুগের গুরুত্ব

  • হাতিয়ারগুলির প্রকৃতি – এই যুগে হাতিয়ারগুলি অনেক উন্নত, মসৃণ এবং ছুঁচালো হয়।
  • কৃষির সূত্রপাত ও বিকাশ – এই সময়ে কৃষির সূত্রপাত ও বিকাশ ঘটে।
  • উন্নত পশুপালন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা – পশুপালন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ সময় প্রভূত উন্নতি লক্ষ করা যায়।
  • স্থায়ী বাসস্থান – এ সময় সমাজবদ্ধ এবং পরিবারভুক্ত মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে।
  • ভাষার বিকাশ – এই সময় ভাষার বিকাশ ঘটে।
  • শিল্পকলার বিকাশ – চিত্রের ব্যবহারের ফলে এ সময় শিল্পকলারও বিকাশ ঘটে।

উপসংহার – নব্য প্রস্তর যুগের উপরোক্ত পরিবর্তন মানব-সমাজকে এক উন্নত সভ্যতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়।

পুরাতন প্রস্তর যুগের সঙ্গে নব্য প্রস্তর যুগের পার্থক্য লেখো।

পুরাতন প্রস্তর যুগ ও নব্য প্রস্তর যুগের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা যায়।

পুরাতন ও নব্য প্রস্তর যুগের পার্থক্য

  • সময়কাল সংক্রান্ত – মানব সংস্কৃতির সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পর্ব হল পুরাতন প্রস্তর যুগ। ঠিক কবে এই পর্বের সূচনা হয়েছিল তা বলা খুব কঠিন হলেও সাধারণভাবে বলা যায়, নব্য প্রস্তর যুগ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 8000 থেকে খ্রিস্টপূর্ব 4000 বছর ছিল।
  • মানবগোষ্ঠী – পুরাতন প্রস্তর যুগে হোমো হাবিলিস নামক দক্ষ মানুষের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু নব্য প্রস্তর যুগে হোমো স্যাপিয়েন্স নামক বুদ্ধিমান মানুষের উদ্ভব হয়েছিল।
  • হাতিয়ারদের প্রকৃতি – পুরাতন প্রস্তর যুগে ব্যবহৃত হাতিয়ারগুলির সবটাই ছিল পাথরের তৈরি এবং তা ছিল অমসৃণ। কিন্তু নব্য প্রস্তর যুগে ব্যবহৃত পাথরের হাতিয়ারগুলির পাশাপাশি হাড়, এমনকি শেষ পর্বে ধাতুর দ্বারাও হাতিয়ার তৈরি হয়েছিল। সবথেকে বড়ো কথা হল যে, হাতিয়ারগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর মসৃণতা।
  • প্রত্নক্ষেত্র – পুরাতন প্রস্তর যুগের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে ভারতে কাশ্মীরের পহেলগাঁও-এর নিকটবর্তী সোয়ান উপত্যকায়। নব্য প্রস্তর যুগের নিদর্শন ভারতের মেহেরগড় (বর্তমানে পাকিস্তান) নামক স্থানে পাওয়া গেছে।
  • জীবনযাত্রা – পুরাতন প্রস্তর যুগে মানুষ স্থায়ী বসতি গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের যাযাবর জীবনের অবসান হয় এবং তারা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে।
  • কৃষিকাজ – পুরাতন প্রস্তর যুগে মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে পরিচিত ছিল না এবং তারা ছিল খাদ্য সংগ্রাহকমাত্র। কিন্তু নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ কৃষিকাজ করতে শুরু করে এবং খাদ্য উৎপাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

জেনে রাখো – মাঝের পাথরের যুগে হাতিয়ারগুলি ক্ষুদ্র আকারের ছিল, তাই একে ক্ষুদ্র প্রস্তর যুগ বলা হয়।

প্রাচীন প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির বর্ণনা দাও।

প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক, ফলে তাদের কোনো স্থায়ী বাসস্থানও ছিল না। তবে এই যুগের মানুষেরও সংস্কৃতি ছিল।

প্রাচীন প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি –

  • হাতিয়ার – প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রথম দিকে পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। এই যুগে পাথরের অস্ত্র প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হল হাত- কুঠার বা গাঁইতির মতো হাতিয়ার সৃষ্টি।
  • ভাবের আদানপ্রদান – প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদানের জন্য বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দের ব্যবহার হত।
  • জীবনযাপন – এসময় মানুষ খাদ্যের সন্ধানে যাযাবর বৃত্তি অবলম্বন করে পাথরের ভোঁতা ও অসমৃণ হাতিয়ারের সাহায্যে পশুশিকার করত। ঠান্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচতে পশুর চামড়া ব্যবহার এবং আগুনের ব্যবহার করত।

জেনে রাখো – মানব বিবর্তনের ইতিহাসে অনেকগুলি উল্লেখযোগ্য প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। যেমন – ইজিপ্টোপিথেকাস, ড্রায়োপিথেকাস, রামাপিথেকাস, অস্ট্রালোপিথেকাস, হোমো হাবিলিস, হোমো ইরেকটাস, হোমো স্যাপিয়েন্স প্রভৃতি।

মানবজাতির বিবর্তনের ইতিহাস আলোচনা করো।

অথবা, মস্তিষ্কের আকার অনুযায়ী আদিম মানুষকে কটি ভাগে ভাগ করা যায়? বৈশিষ্ট্যসহ সেগুলি উপস্থাপন করো।

এটি মনে করা হয় যে, পৃথিবীতে মানবসদৃশ জীবের প্রথম আবির্ভাব হয়েছিল লক্ষ লক্ষ বছর আগে। আর আধুনিক মানবের জন্ম হয়েছিল প্রায় 60 হাজার বছর আগে। মাঝখানের এই দীর্ঘ পথ ধরে চলেছিল মানববিবর্তন। এই বিবর্তনের পথে জন্ম নিয়েছিল বিভিন্ন মানব প্রজাতি বা গোষ্ঠী।

মানব বিবর্তনের ইতিহাস –

হোমিনিড – হোমিনয়েড বিবর্তিত হয়ে এসেছিল হোমিনিড নামক গোষ্ঠী। হোমিনিডেরা হোমিনিডাই (Hominidae) নামক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের বৈশিষ্ট্য হল বড় মস্তিষ্ক, সোজা হয়ে দু-পায়ে হাঁটতে পারা এবং হাতের ব্যবহার করতে পারা। হোমিনিডদের আবার কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন – এদের মধ্যে অস্ট্রালোপিথেকাস ও হোমো উল্লেখযোগ্য।

হোমিনয়েড – হোমিনয়েড হল ‘এপ’ জাতীয় প্রাণী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর আবির্ভাব প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে হয়েছিল। এদের বৈশিষ্ট্য হল মস্তিষ্ক ছোট, চার পায়ে হাঁটা এবং সামনের অংশের (হাতের) নমনীয়তা ছিল।

চার্লস ডারউইন-এর অরিজিন অব্ স্পিসিস
চার্লস ডারউইন-এর অরিজিন অব্ স্পিসিস

অস্ট্রালোপিথেকাস – অস্ট্রালোপিথেকাস গোষ্ঠীর সদস্যরা বেশিরভাগ সময় গাছে থাকত। তাদের হাত দুটি ছিল লম্বা, বাঁকা এবং এরা পুরোপুরি সোজা হয়ে চলতে পারত না। আনুমানিক ৪০ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকার ওলডুভাই জর্জ নামক স্থানে প্রথম এই প্রজাতির জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়া যায়।

হোমো হাবিলিস – হোমো হাবিলিস গোষ্ঠীর জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে আনুমানিক ২৬ লক্ষ থেকে ১৭ লক্ষ বছর আগে ইথিয়োপিয়ার ওমো (Omo) এবং আফ্রিকার ওলডুভাই জর্জ নামক স্থানে। এই প্রজাতি পাথর দিয়ে হাতিয়ার তৈরিতে অধিক পারদর্শী ছিল। তাদের মাথা আকারে বড় ছিল। এরাই ছিল প্রথম যথার্থ মানুষ। তারা পাথরের তৈরি হাতিয়ার ব্যবহার করত।

মানবজাতির বিবর্তনের ইতিহাস আলোচনা করো।
মানবজাতির বিবর্তনের ইতিহাস

হোমো ইরেকটাস – প্রায় 20 লক্ষ থেকে 3 লক্ষ 50 হাজার বছর আগে পৃথিবীতে হোমো ইরেকটাস গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছিল। হোমো হাবিলিস গোষ্ঠীর বিবর্তনের মাধ্যমে হোমো ইরেকটাস প্রজাতির আবির্ভাব হয়েছিল। এদের মস্তিষ্কের আকার ছিল বড়ো (1000 ঘনসেমি) এবং এদের পেশিশক্তি ছিল বেশি। এরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত। জার্মানির নিয়ানডারে এই প্রকৃতির জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। এরা নিয়ানডারথাল মানবজাতি নামে পরিচিত।

হোমো স্যাপিয়েন্স – হোমো ইরেকটাস প্রজাতি বিবর্তনের মাধ্যমে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতিতে পরিণত হয়। এই প্রজাতি প্রায় 2 লক্ষ 30 হাজার বছর পূর্বে আবির্ভূত হয়। এরা অনেক বেশি বুদ্ধিমান ও হাতের ব্যবহারে তুলনামূলকভাবে পারদর্শী ছিল। এরা লজ্জা নিবারণ ও শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পোশাক বানাতে শিখেছিল। এদের থেকেই আধুনিক মানুষের উৎপত্তি হয়েছে।

হোমো হ্যাবিলিস, হোমো ইরেকটাস এবং হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির মানুষের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

  • হোমিনয়েড – হোমিনয়েড হল ‘এপ’ জাতীয় প্রাণী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর আবির্ভাব প্রায় 40 লক্ষ বছর আগে হয়েছিল। হোমিনয়েডদের বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের ছোট মস্তিষ্ক, যা তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা সীমিত করত। তারা প্রধানত চার পায়ে হাঁটত এবং তাদের সামনের দুটি পা (হাত) নমনীয় ছিল, যা বিশেষভাবে গাছপালায় উঠে যেতে বা অন্য কাজ করতে সাহায্য করত। এই গোষ্ঠী মূলত বৃক্ষবাসী ছিল, এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করত।
  • হোমিনিড – হোমিনয়েড গোষ্ঠী বিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল হোমিনিড নামক গোষ্ঠী। হোমিনিডেরা হোমিনিডাই (Hominidae) নামক বৃহৎ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা মানবীয় এবং আধুনিক বানরদের অন্তর্ভুক্ত করে। হোমিনিডদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের বড়ো মস্তিষ্ক, যা তাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। তারা সোজা হয়ে দু-পায়ে হাঁটতে পারত এবং তাদের হাতের ব্যবহার দক্ষ ছিল, যার ফলে তারা বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি এবং ব্যবহার করতে পারত। এই পরিবর্তনগুলি তাদের পরিবেশের প্রতি অভিযোজনকে শক্তিশালী করেছিল এবং মানবজাতির জন্য মৌলিক পদক্ষেপ ছিল। হোমিনিডদের মধ্যে আবার কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, এবং এর মধ্যে অস্ট্রালোপিথেকাস এবং হোমো প্রজাতি অন্যতম।
  • অস্ট্রালোপিথেকাস – অস্ট্রালোপিথেকাস গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রায় 40 লক্ষ থেকে 30 লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করত। তারা বেশিরভাগ সময় গাছে থাকত, এবং তাদের হাত দুটি ছিল লম্বা এবং বাঁকা, যা তাদের গাছে আরো ভালোভাবে উঠতে সহায়তা করত। তাদের পা ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট, এবং তারা পুরোপুরি সোজা হয়ে হাঁটতে পারত না, অর্থাৎ তাদের চলন ছিল আধা-নমনীয়। যদিও তারা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত, তবে তাদের চলাফেরা ছিল পুরোপুরি মানবীয় ছিল না। এটি তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং জীবনযাত্রার অভ্যাসের জন্য একটি প্রাথমিক রূপান্তর ছিল, যা পরবর্তীতে উন্নতমানের প্রজাতির সৃষ্টি করেছিল।

আদিম মানুষরা জোট বেঁধেছিল কেন? জোট বাঁধার কী সুফল হয়েছিল বলে তোমার মনে হয়?

যে কারণে আদিম মানুষরা জোট বেঁধে বা দলবদ্ধভাবে বাস করত, তা ছিল – তারা দেখেছিল যে দলবদ্ধভাবে বসবাস করলে বনের হিংস্র পশুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাছাড়া, জোট বেঁধে থাকার আরো কিছু সুবিধা ছিল, যেমন – ছোটো-বড়ো পশু সহজে শিকার করা যেত, বনজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ফলমূল সংগ্রহ করার সময় নিরাপত্তা পাওয়া যেত, এবং চাষবাস ও পশুপালনের সুবিধা পাওয়া যেত।

জোট বাঁধার সুফল

জোট বেঁধে থাকার ফলে আদিম মানুষরা যেমন তাৎক্ষণিক সুবিধা পেয়েছিল, তেমনি এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। যেমন –

  • আদিম মানুষরা জোট বেঁধে থাকত বলেই তারা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল। তা না হলে, হিংস্র পশুর কবলে পড়ে তারা শেষ হয়ে যেত।
  • জোট বেঁধে থাকার ফলে তারা যেমন নিরাপদে বাঁচতে পেরেছিল, তেমনি শিখেছিল বেঁচে থাকার একাধিক কৌশল। যেমন – পশু পালন করা, পশু শিকার করা, হাতিয়ার আবিষ্কার করা, চাষবাস শেখা, এবং বিভিন্ন যান আবিষ্কার করা ইত্যাদি।

নতুন পাথরের যুগের কী কী পরিবর্তন লক্ষ করা যায়?

সময়ের হাত ধরে আদিম মানব সভ্যতায় নানা পরিবর্তন আসে। মানব জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। এই উন্নতি বা পরিবর্তনের স্পষ্ট লক্ষণ ধরা পড়ে নতুন পাথরের যুগে।

নতুন পাথরের যুগে পরিবর্তন –

  • খাদ্য উপাদান – প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষরা খাদ্য উৎপাদন করতে পারত না। গাছের ফলমূল আর পশুর কাঁচা মাংস খেয়ে তারা খিদে মেটাত। পরে তারা আগুন জ্বালাতে শেখে এবং মাংস আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া শুরু করে। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ ফসল ফলাতে শেখে। অর্থাৎ, চাষ-আবাদ করতে শেখে। এসময় তাদের খাদ্যের অভাব পড়েনি। তাই খাদ্যের সন্ধানে তাদের একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়াতে হত না। এই সময় মানুষ গম, যব, মিলেট, বার্লি প্রভৃতির চাষ করত।
  • স্থায়ী বসতি – খাদ্য উৎপাদন শুরু হলে তাদের যাযাবর জীবনের অবসান হয়। এখন থেকে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু হয়। গুহাজীবন ত্যাগ করে বাড়িঘর বানাতে থাকে। তারা জমির কাছেই লতাপাতা, গাছের ডাল দিয়ে ঘর বানাত। নব্যপ্রস্তর যুগের শেষদিকে তারা কাঁচা মাটির ইট দিয়ে বাড়িঘর তৈরি করে। গড়ে তোলে নগর সভ্যতা। উদাহরণস্বরূপ মেহেরগড় সভ্যতার কথা বলা যায়।
  • শ্রম বিভাজন – স্থায়ী বসতি স্থাপনের পর নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে বিভিন্ন জিনিসপত্র বানাতে শুরু করে। কেউ বানাতে থাকে হাতিয়ার, কেউ কুড়ুল, নিড়ানি, কেউ বা কাস্তে। এইভাবে এক একটি জিনিস বানাতে বানাতে এক একজন মানুষ ওই কাজে দক্ষ হয়ে উঠল। এভাবেই এযুগে শ্রম বিভাগ বা শ্রম বিভাজন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
  • অন্যান্য পরিবর্তন – নব্য প্রস্তর যুগে চাষবাসের দারুণ উন্নতি হয়। জমিতে জলসেচের বন্দোবস্ত হয়। কুমোররা চাকার ব্যবহার করতে শেখে। বিভিন্ন কারিগরি শিল্পের উৎপত্তি হয়। খুব সম্ভবত তারা সুতির কাপড়চোপড় বানাতেও শিখেছিল। এযুগে পৃথিবীর নানা স্থানে অনেক নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে ওঠে। যা আগে ছিল না।

আদিম মানুষ কেমনভাবে জীবন কাটাত?

আদিম মানুষ কেমনভাবে জীবনযাপন করত তা সঠিকভাবে বলা যায় না। কারণ তার কোনো নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক নথি নেই। তবে সে সময়ের হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি দেখে কিছুটা অনুমান করা যায়।

আদিম মানুষের জীবনযাত্রা –

  • অসহায় জীবন – আদিম মানুষ বনে বাস করত। তাদের ছিল পদে পদে বিপদ। যেমন – দাবানল, ভূমিকম্প, ঝড়-বৃষ্টি ইত্যাদি। এই প্রাকৃতিক ঘটনাগুলির প্রতিকার বা প্রতিবিধানের ক্ষমতা তাদের ছিল না। তাই প্রকৃতির কাছে তারা ছিল শিশুর মতো অসহায়।
  • থাকার জায়গা – তাদের থাকার জায়গা বলতে ছিল গাছের ডাল অথবা পাহাড়ের গুহা। কারণ তখন তারা ঘরবাড়ি বানাতে শেখেনি। তাই গুহায় শীত-গ্রীষ্মে অত্যন্ত কষ্ট করে বসবাস করত।
  • খাদ্য – তখন মানুষ পশুশিকার করে খেত। তাতেও হিংস্র পশুর আক্রমণের ভয় ছিল। সেজন্য তারা দলবদ্ধভাবে শিকার করত। প্রথম দিকে তারা কাঁচা মাংস ভাগ করে খেত।
  • হাতিয়ার – আদিম মানুষ বন্য পশুদের সঙ্গে পশুর মতোই জীবন কাটাত। প্রতি মুহূর্তেই হিংস্র পশুর আক্রমণের ভয় ছিল। এজন্য তারা হাতিয়ার বানাত। প্রথমে গাছের ডাল, পরে পাথরখণ্ড দিয়ে তারা হাতিয়ার বানাত।
  • যাযাবর জীবন – আদিম মানুষ প্রথম দিকে চাষ করতে শেখেনি। তাই খাদ্যের সমস্যা হত। এজন্য তারা দলবেঁধে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেত। এই জীবনকেই বলা হয় যাযাবর জীবন।

এক কথায় বলা যায়, আদিম মানুষের জীবনে নিরাপত্তা ও সুখ-শান্তি ছিল না। প্রকৃতি ও পশুদের সঙ্গে লড়াই করে তাদের বেঁচে থাকতে হত। কেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে ওঠে, যা আগে ছিল না।

প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষ কীভাবে পাথরকে কাজে লাগাত?

প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ নিজেদের প্রয়োজন মেটাবার জন্য পাথরখণ্ডকে নানাভাবে ব্যবহার করেছিল। তার প্রমাণ সে যুগের প্রাপ্ত পাথরের জিনিসগুলি।

পাথরের ব্যবহার –

হাতিয়ার হিসাব পাথরের ব্যবহার – প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ যখন বনে বাস করত, তখন তাদের নানান ভয় ছিল। যেমনটি ছিল হিংস্র পশুর আক্রমণের ভয়। তাই এদের মোকাবিলা করার জন্য মানুষ প্রথম পাথরকে ব্যবহার করে। পাথরখণ্ডকে ভেঙে-ভেঙে তারা বানায় হাতিয়ার। অবশ্য এ সময়ের হাতিয়ারগুলি ছিল অমসৃণ ও ভোঁতা। এগুলির দুটো ভাগ ছিল। তারা মোটা দিকটা হাত দিয়ে ধরত, আর সরু দিক দিয়ে কাজ সারত।

শিকার করতে পাথরের ব্যবহার – পশু শিকারের সুবিধার জন্য মানুষ দলবেঁধে শিকার করত। কিন্তু সেক্ষেত্রেও দরকার ছিল সতর্কতা। দূর থেকে হাতিয়ার ছোঁড়া নিরাপদ। এজন্য তারা পাথরখণ্ড ব্যবহার করত। তাই তৈরি হল নানা ধরনের পাথরের হাতিয়ার। যেমন—বর্শা।

যন্ত্রপাতি নির্মাণে পাথরের ব্যবহার – হাতিয়ার ছাড়াও বাঁচতে গেলে আরও কিছু দৈনন্দিন জিনিসের প্রয়োজন ছিল। এই প্রয়োজন মেটাতেই তারা পাথর দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বানাত। যেমন—কুঠুল, কাটারি, হাতুড়ি, র‍্যাঁদা ইত্যাদি।


আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়, “ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষ (যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতি স্থাপন)” অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহায়ক হবে, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ!

Share via:

মন্তব্য করুন