আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষ (যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতি স্থাপন)’ অধ্যায়ের কিছু সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও সহায়ক। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণী এবং চাকরির পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই আসতে দেখা যায়।
এপ থেকে কীভাবে মানুষের উৎপত্তি হল?
পৃথিবীতে একসময় আবহাওয়ার পরিবর্তন হলে গাছপালা কমে যেতে থাকে। তখন একদল এপ বা বানর। খাবারের সন্ধানে গাছ থেকে মাটিতে নেমে আসে। তারা দু-পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। দীর্ঘদিনের নানারকম প্রচেষ্টায় তাদের শরীরের নানা পরিবর্তন ঘটে। এভাবেই এপ থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্যদিয়ে আদিম মানুষের সৃষ্টি হয়।
অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের কী কী পার্থক্য তোমার চোখে পড়ে?
অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পার্থক্যগুলি হল প্রধানত –
- অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের মস্তিষ্কের আকার বেশ বড়ো।
- মানুষ দু-পায়ে হাঁটতে পারে।
- মানুষের হাত দুটি বেশ নমনীয় ও কর্মঠ এবং তা ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে।
- মানুষের লম্বা মেরুদণ্ড রয়েছে।
অস্ট্রালোপিথেকাসদের সম্পর্কে কী জানা যায়?
অথবা, অস্ট্রালোপিথেকাস কাদের বলা হয়?
অস্ট্রালোপিথেকাস-এর পরিচয় –
- আনুমানিক 40 লক্ষ থেকে 30 লক্ষ বছর আগে মানব প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ অস্ট্রালোপিথেকাস গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে।
- এরা দু-পায়ে ভর দিয়ে কোনোক্রমে দাঁড়াতে পারত।
- এদের চোয়াল ছিল শক্ত ও সুগঠিত।
- এরা শুকনো ফল, শক্ত বাদাম, গাছের পাতা চিবিয়ে খেত।
- এরা পাথর, পশুর হাড় ও শিং – কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। এদের মাথার খুলির আয়তন ছিল 550 ঘন সেমি।
পুরানো পাথরের যুগে আদিম মানুষের জীবন কেমন ছিল?
আদিম মানুষের জীবন ছিল দুঃখ-কষ্টে ভরা। প্রতিদিন প্রকৃতি ও হিংস্র পশুর বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের বাঁচতে হত। ঝড়-বৃষ্টি, দাবানল ও হিংস্র পশুর আক্রমণে তাদের প্রাণ যেত। আদিম যুগে তারা ফসল ফলাতে জানত না। তাই পশু শিকার করে তার কাঁচা মাংস ও বনের ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণ করত। তারা সেসময় ঘর বানাতে শেখেনি। তাই খোলা আকাশের নীচে অথবা পাহাড়ের গুহায় বসবাস করত। পশু শিকার ও নিরাপত্তার কারণে তারা গাছের ডাল অথবা পাথরের খণ্ডকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত।
প্রাচীনকালে দক্ষ মানুষরা কেমন ছিল?
অথবা, হোমো হাবিলিসদের সম্পর্কে কী জানা যায়?
পুরোনো দক্ষ মানুষদের পরিচয় –
- আনুমানিক 26 লক্ষ থেকে 17 লক্ষ বছর আগে হোমো হাবিলিস বা দক্ষ মানুষদের উদ্ভব ঘটে।
- এরা দলবদ্ধভাবে থাকত এবং শিকার করত। তারা ফলমূলের পাশাপাশি কাঁচা মাংসও খেত।
- এরাই প্রথম পাথরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য একটি পাথরের টুকরোকে আর-একটি পাথর দিয়ে আঘাত করত।
- এদের মাথার খুলির আয়তন ছিল 660 ঘন সেমি।
পুরোনো পাথরের যুগে হাতিয়ারগুলির প্রকৃতি কেমন ছিল?
পুরোনো পাথরের যুগের হাতিয়ারের প্রকৃতি ছিল –
- পুরোনো পাথরের যুগের প্রথমদিকে মানুষেরা ভারী নুড়ি পাথর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত।
- পরেরদিকে পাথরগুলি ভেঙে তার কোণার অংশগুলি। হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত।
- প্রথম পর্বে কুঠার ও চপার জাতীয় অস্ত্র ব্যবহৃত হলেও, পরে ছুরি জাতীয় অস্ত্র বেশি ব্যবহৃত হত।
ভারতীয় উপমহাদেশে পুরোনো পাথরের যুগের তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
পুরোনো পাথরের যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
- হাতিয়ার – পুরোনো পাথরের যুগের হাতিয়ার ছিল ভারী নুড়ি পাথরের তৈরি। এযুগে কুঠার ও চপার জাতীয় হাতিয়ারের ব্যবহার ছিল বেশি।
- পশুশিকার – এই যুগে মানুষেরা পশুশিকার করে খাদ্য সংস্থান করত। তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াত।
- পোশাক – পোশাক তৈরির ধারণা তখনও তৈরি না হওয়ায় আদিম মানুষেরা গাছের ছাল, পশুর চামড়া প্রভৃতি পোশাক হিসেবে ব্যবহার করত।
জেনে রাখো – প্রাচীন প্রস্তর যুগে পিকিং মানব, জাতা মানব, নিয়ানডারথাল মানব, হোমো ইরেকটাস – এর জন্ম হয়েছিল। অস্ট্রালোপিথেকাস-রাই সর্বপ্রথম পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার শুরু করেছিল। নব্য প্রস্তর যুগে কৃষিকাজ – সহ মানবসভ্যতায় অতিদ্রুত কিছু গভীর পরিবর্তন ঘটেছিল। মানুষেরা স্থায়ী বসতি নির্মাণ করেছিল। নব্য প্রস্তর যুগে মানবসভ্যতার এই গভীর পরিবর্তন লক্ষ করে ঐতিহাসিক গর্জন চাইন্ড একে ‘নব্য প্রস্তর যুগের বিপ্লব’ বলেছেন।
ভীমবেটকা গুহার চিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য কী ছিল?
ভীমবেটকা গুহার চিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য ছিল –
- পশুপাখির ছবি – ভীমবেটকা গুহায় ছবিগুলির অধিকাংশ ছিল বন্য পশু, পাখি, মাছ প্রভৃতি।
- শিকার – মানুষের পশুশিকারের ছবিও এখানে পাওয়া গেছে। একা কিংবা দলবদ্ধভাবে মানুষের শিকারের ছবি এখানে আঁকা রয়েছে।
- রঙের ব্যবহার – এখানকার ছবিগুলিতে সবুজ, হলুদ, সাদা এবং লাল রঙের ব্যবহার দেখা যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশের মাঝের পাথরের যুগের তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
ভারতীয় উপমহাদেশের মাঝের পাথরের যুগের বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
- ধারালো হাতিয়ার – মাঝের পাথরের যুগে মানুষের অস্ত্রগুলি ছিল ধারালো ও ছোটো প্রকৃতির।
- আগুনের ব্যবহার – এই সময়কার মানুষেরা মাংস ঝলসানোর জন্য আগুনের ব্যবহার করত।
- জাঁতার ব্যবহার – সরাই নহর রাইয়ের মানুষ, শস্যদানা ভাঙার জন্য জাঁতার মতো যন্ত্র ব্যবহার করত বলে জানা গেছে।
হোমো ইরেকটাস বা দণ্ডায়মান মানুষদের সম্পর্কে কী জানা যায়?
হোমো ইরেকটাস মানুষদের পরিচয় সম্বন্ধে নিম্নে আলোচনা করা হল –
- আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 20 লক্ষ থেকে 3 লক্ষ 50 হাজার বছর আগে হোমো ইরেকটাস বা দণ্ডায়মান মানুষদের উদ্ভব ঘটে।
- এরা দু-পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত এবং দলবদ্ধভাবে গুহায় বসবাস করত।
- এরা একসঙ্গে পশু শিকারে যেত।
- এরাই প্রথম বনে আগুন লাগা (দাবানল) দেখে আগুনের ব্যবহার শিখেছিল।
জেনে রাখো – আধুনিক মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হল- হোমো স্যাপিয়েন্স। মানব বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মাথার খুলির আকারও পরিবর্তিত হয়েছে।
হোমো স্যাপিয়েন্স বা বুদ্ধিমান মানুষদের সম্পর্কে কী জানা যায়?
হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষদের পরিচয় সম্বন্ধে নিম্নে আলোচনা করা হল –
- আনুমানিক 2 লক্ষ 30 হাজার বছর আগে হোমো ইরেকটাস থেকেই বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমানের মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্স বা বুদ্ধিমান মানুষের উদ্ভব ঘটে।
- এরা দলবেঁধে পশু শিকার করত।
- পশুর মাংস আগুনে পুড়িয়ে খেত এবং পশুর চামড়া পরত।
- তারা নানা কাজে আগুনের ব্যবহার শিখেছিল।
- তারা ছোটো, ধারালো ও তীক্ষ্ণ পাথরের হাতিয়ার তৈরি করতে শিখেছিল। এমনকি তারা বর্শা জাতীয় পাথরের হাতিয়ার বানাতে পারত।
- এদের মাথার খুলির আয়তন ছিল প্রায় 1400 ঘন সেমি।
লুসি সম্পর্কে কী জানা যায়?
1974 খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকা মহাদেশের ইথিয়োপিয়ার হাদার অঞ্চলে একটি অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতির কঙ্কালের কিছু অংশ পাওয়া গেছে। এই কঙ্কালটি প্রায় 32 লক্ষ বছর আগের একটি ছোটো মেয়ের। এর নাম দেওয়া হয়েছে লুসি। গবেষকগণ এই কঙ্কালটিকে অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতির বলে মনে করেন। এই লুসির মস্তিষ্ক অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় আকারে বড়ো ছিল।
আদিম মানুষ কীভাবে আগুন জ্বালাতে শিখেছিল?
প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই আগুন জ্বালাতে ও ব্যবহার করতে পারে। প্রথম দিকে আদিম মানুষরা বনে লাগা আগুন (দাবানল) বা অন্যভাবে জ্বলে ওঠা আগুন দেখত। কোনো একসময় তারা জ্বলন্ত গাছের ডাল গুহায় নিয়ে আসত এবং তা নিভতে দিত না। এইভাবে হঠাৎ একদিন পাথরের হাতিয়ার তৈরি করতে গিয়ে চকমকি জাতীয় পাথরের ঠোকাঠুকিতে আগুন জ্বালিয়ে ফেলে। আবার অনেকে মনে করেন শুকনো কাঠে কাঠে ঘষে তারা আগুন জ্বালাতে শিখেছিল।
মনে রেখো – চিনের পিকিং অঞ্চলের আদিম মানুষ সর্বপ্রথম আগুনের ব্যবহার করতে শেখে।
ভারতীয় উপমহাদেশের আদিম মানুষদের কথা কীভাবে জানা যায়?
অনুমান করা হয় যে, আফ্রিকা থেকে একসময় আদিম মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিল। সেইসব মানুষের হাড়গোড় এবং তাদের ব্যবহার করা পুরোনো হাতিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে পাওয়া গেছে। সেগুলি থেকেই উপমহাদেশের আদিম মানুষদের কথা জানতে পারা যায়। যেমন – কাশ্মীরের সোয়ান উপত্যকা, কর্ণাটকের হুন্সগি উপত্যকা প্রভৃতি অঞ্চলে আদিম মানুষের হাড়গোড় ও তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন হাতিয়ার পাওয়া গেছে।
জান কি? – এ পর্যন্ত সবথেকে প্রাচীন মানবের নিদর্শন পাওয়া গেছে পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ার ওলডুভাই জর্জ-এ। এই নিদর্শনটি অন্তত 38 লক্ষ বছরের প্রাচীন বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন।
হুন্সগি উপত্যকা থেকে কী ধরনের হাতিয়ার পাওয়া গেছে?
কর্ণাটকের গুলবর্গা জেলার উত্তর-পশ্চিমে হুন্সগি উপত্যকা অবস্থিত। 1983 খ্রিস্টাব্দে এখানে মাটি খুঁড়ে হাতকুড়ুল, ছোরা, চাঁছুনি জাতীয় পাথরের হাতিয়ার পাওয়া গেছে। অনুমান করা হয় যে, এইসব হাতিয়ার আজ থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় লক্ষ বছর আগেকার। অনেকের মতে, হুন্সগিতে পাথরের হাতিয়ার তৈরি হত।
আলতামিরা গুহা কোথায় আবিষ্কৃত হয়েছে? এখানে কীসের ছবি পাওয়া গেছে?
আলতামিরা গুহা ইউরোপ মহাদেশের স্পেনে অবস্থিত।
আলতামিরা গুহায় ট্যরো বা ষাঁড়ের ছবি পাওয়া গেছে। প্রায় 50 থেকে 30 হাজার বছর আগে গুহাবাসী এই মানুষেরা একটি বড়ো ষাঁড়ের ছবি গুহার ছাদে এঁকেছিলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন পাথরের যুগের বৈশিষ্ট্য লেখো।
ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন পাথরের যুগের বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
- কৃষিকাজ – নতুন পাথরের যুগে মানুষেরা কৃষিকাজ করতে শিখেছিল। আদিম মানুষেরা এই সময় খাদ্য সংগ্রাহক থেকে খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়েছিল।
- স্থায়ী বসবাস – এই সময় মানুষেরা যাযাবর জীবন। বাদ দিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে।
- কারিগর শ্রেণি – সমাজের বিভিন্ন মানুষের প্রয়োজন মেটাতে এইসময় কারিগর শ্রেণির জন্ম হয়।
নতুন পাথরের যুগের মানুষের বসতি সম্পর্কে কী জানো?
নতুন পাথরের যুগের মানুষ বসতি বানানোর উদ্যোগ নেয়। কারণ –
- শিকার ও পশুপালনের জন্য মানুষকে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হত। কিন্তু কৃষিকাজ শুরু করার পর তারা কৃষিজমির পাশে বসতি গড়ে তোলে।
- এ ছাড়া কৃষিফসল বাঁচানো এবং মাছ শিকারের জন্য মানুষ জলাশয়ের পাশে বসতি গড়ে তোলে।
- এই যুগে মানুষ খড়, বিচালি, লতাপাতা, ঘাসজাতীয় আগাছা, গাছের পাতা প্রভৃতি দিয়ে বসতবাড়ি তৈরি করত।
রাজস্থানের বাগোড় অঞ্চলের গৃহপালিত পশুদের সম্পর্কে কী জানা যায়?
রাজস্থানের বাগোড় অঞ্চলে অনেকগুলি পশুর হাড় পাওয়া গেছে। সেগুলি থেকে অনুমান করা হয় যে, এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের পশুপালন জানা ছিল। পরের দিকে গৃহপালিত পশুর সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তারা গোরু, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি প্রাণীকে লালনপালন করত। বাগোড়ের বাসিন্দারা ধীরে ধীরে গৃহপালিত পশুর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল।
আদিম মানুষের মুখাবয়বের পরিবর্তন হল কীভাবে?
আগুনের ব্যবহারের ফলে আদিম মানুষের খাদ্যাভ্যাসের বদল ঘটেছিল। এসময় কাঁচা মাংস খাওয়ার বদলে মাংস আগুনে ঝলসে খাওয়ার রীতি শুরু হয়। ঝলসানো মাংস অনেক নরম হয়। ঝলসানো নরম মাংস খেতে তাদের চোয়াল ও দাঁতের জোর কম লাগত। সেই কারণে ধীরে ধীরে তাদের চোয়াল সরু হয়ে এল। সামনের ধারালো উঁচু দাঁত ছোটো হয়ে গেল। এভাবেই আদিম মানুষের মুখাবয়বের পরিবর্তন হল।
আগুন জ্বালাতে শেখার পর আদিম মানুষের কী কী সুবিধা হয়েছিল?
অথবা, আগুন জ্বালাতে শেখার ফলে মানুষের জীবনে কী কী পরিবর্তন এসেছিল?
প্রথম আগুন জ্বালাতে শেখে হোমো ইরেক্টাস শ্রেণির আদিম মানুষরা। এর ফলে তাদের যা সুবিধা হয়েছিল বা তাদের জীবনে যা পরিবর্তন এসেছিল। তা হল –
- রান্না করা খাবার – এতদিন আদিম মানুষরা কাঁচা মাংস খেয়ে জীবনধারণ করত। কিন্তু আগুন জ্বালাতে শিখলে তারা মাংস আগুনে ঝলসে খাওয়া শুরু করল। তার ফলে খাদ্য দ্রুত হজম হত। তাতে শরীরে পুষ্টি যোগাত।
- নিরাপত্তার সুবিধা – তারা গুহার মুখে আগুন জ্বালিয়ে রাখত। যা দেখে হিংস্র পশুরা ভয় পেত। ফলে আদিম মানুষরা রাত্রিবেলায় নিরাপদে ঘুমাতে পারত।
- উষ্ণতা লাভ – আবার শীতকালে তারা আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা উপভোগ করত। ঠান্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ায় এটাই ছিল তাদের কাছে উপযুক্ত উপায়। কারণ তখন তাদের কাছে উপযুক্ত শীতবস্ত্র ছিল না।
আদিম মানুষরা কেন যাযাবর হয়েছিল?
নানা কারণে আদিম মানুষরা যাযাবর হয়েছিল, যেমন –
- প্রথম দিকে আদিম মানুষরা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাস করত। খুব সম্ভবত তাদের জীবন ছিল গুহাকেন্দ্রিক। এই সময় তাদের জীবনে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। বিশেষ করে পশু শিকার করে প্রতিদিনের খাদ্যের নিশ্চিত যোগান দেওয়া। এ কারণে তারা স্থান পরিবর্তন করত।
- যখন তারা পশুপালন শেখে, তখন পশুপালনের জন্য প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত তৃণভূমি। এই তৃণভূমির খোঁজেই তারা দলবলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গিয়ে বসবাস করত।
আদিম মানুষের যাযাবর অবস্থার পরিবর্তন হয়েছিল কেন?
অথবা, কী কারণে যাযাবর মানুষ স্থায়ী হয়েছিল?
নানা কারণে আদিম মানুষের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটেছিল। মূলত এই পরিবর্তন এসেছিল নব্যপ্রস্তর যুগে। কারণ –
- এই সময় তারা চাষবাস করা শেখে। ফলে তারা নানা ধরনের খাদ্যশস্য উৎপাদন করা শুরু করে। এর ফলে খাদ্য সংগ্রহের জন্য ও পশুপালনের জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ানোর আর কোনো প্রয়োজন হয়নি। সেজন্য তারা একটি নির্দিষ্ট স্থানে থাকা শুরু করে।
- আবার চাষ করলেই হবে না, চাষের জমি রক্ষণাবেক্ষণ, জমিতে সেচ দেওয়া, ফসল কাটা, সেই ফসল মজুত করা। এবং জমির ফসল যাতে নষ্ট না হয় বা পশুপাখিরা খেয়ে না ফেলে তার জন্য পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এ কারণে তারা চাষজমির আশেপাশে ঘর তৈরি করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
ডাইনোসর সহ অনেক প্রাণী হারিয়ে গেলেও মানুষ আজও টিকে আছে কীভাবে?
অথবা, কীভাবে মানুষ আজও পৃথিবীতে টিকে আছে?
পৃথিবীতে টিকে থাকতে গেলে যে শারীরিক গঠন, বুদ্ধি ও যোগ্যতা লাগে তা কেবল মানুষেরই ছিল। অন্য বেশ কিছু প্রাণীর ছিল না। তাই ডাইনোসর, ম্যামথ, ডোডো প্রভৃতি পশুপাখিরা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষরা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যোগ্যতা লাভ করেছে। তাই মানুষ টিকে আছে। সে তার বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে নানান প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে আজও টিকে আছে। যেমন –
- মানুষ ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা পেতে আবিষ্কার করেছে আগুন ও পোশাক।
- নিজের খাদ্যের জোগান পেতে শিখেছে পশুপালন ও কৃষিকাজ।
- হিংস্র পশুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য শিখেছে দলবদ্ধভাবে বাস করার কৌশল।
- মানুষ আগুন আবিষ্কার করেছে এবং সেই আগুনকে নিজের রক্ষার্থে ব্যবহার করা শিখেছে। যেমন – মাংস আগুনে ঝলসে খাওয়া। এর ফলে তার শারীরিক দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
- এছাড়া মানুষ তার দুটি হাত ও দুটি পা-কে তাদের জীবন সংগ্রামের কাজে সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছে।
পুরানো পাথরের যুগ, মাঝের পাথরের যুগ ও নতুন পাথরের যুগের মানুষের হাতিয়ারগুলি কেমন ছিল? এই তিনটি যুগের মানুষের জীবিকা কী ছিল?
পুরানো পাথরের যুগে মানুষের ব্যবহৃত হাতিয়ারগুলি পাথর দিয়ে তৈরি হত। এগুলি ছিল বড়ো, অমসৃণ ও ভোঁতা। তাদের জীবিকা ছিল পশুশিকার ও ফলমূল জোগাড় করা। মাঝের পাথরের যুগে মানুষের ব্যবহৃত হাতিয়ারগুলি ছিল অপেক্ষাকৃত হালকা, মসৃণ ও ধারালো। এই সময় মানুষের জীবিকা ছিল পশু শিকার ও পশুপালন। নতুন পাথরের যুগে মানুষ হালকা ও ধারালো হাতিয়ার বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করত। এযুগের শেষদিকে যন্ত্রগুলি আরও উন্নত হয়েছিল। এই সময় মানুষের জীবিকা ছিল পশুপালন ও কৃষিকাজ।
প্লেইস্টোসিন যুগ কোন্ সময়কে ধরা হয়? এই যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।
প্লেইস্টোসিন যুগের সূচনা কাল ধরা হয় আজ থেকে প্রায় 20 লক্ষ বছর আগে এবং এই যুগের শেষ সীমা ধরা হয় আজ থেকে প্রায় 10 হাজার বছর পূর্বে।
বৈশিষ্ট্য –
এই যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল –
- এযুগেই পর্যায়ক্রমে চার বার তুষার যুগ ও উয় যুগের সূচনা ও শেষ হয়।
- এ যুগে বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তুর বিলুপ্তি হয়, যেমন – ম্যামথ নামক হাতি।
- এযুগে আধুনিক মানুষের (হোমো স্যাপিয়েন্স) আবির্ভাব ঘটে।
কোন সময়কে হলোসিন যুগ ধরা হয়? এই যুগের প্রথমদিকের ইতিহাস জানার দুটি উপাদান কী কী?
আজ থেকে প্রায় 10 হাজার বছর আগে হলোসিন যুগের সূচনা হয়। বর্তমানেও এই যুগ অব্যাহত। এই যুগের প্রথমদিকের ইতিহাস জানার দুটি উপাদান হল জীবাশ্ম, গুহাচিত্র।
নতুন পাথরের যুগে ব্যবহৃত কয়েকটি যন্ত্র ও হাতিয়ারের নাম লেখো।
নতুন পাথরের যুগে মানুষের ব্যবহৃত যন্ত্র ও হাতিয়ারগুলি ছিল – কাস্তে, হামানদিস্তা, শিলনোড়া, জাঁতা, তুরপুন, হাতুড়ি, বাটালি ইত্যাদি। এগুলির উপাদান ছিল পাথর, তামা, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি। । হাতিয়ারগুলি ছিল মসৃণ ও হালকা।
নতুন/নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ যে সব পরিবর্তন এনেছিল তার তিনটি দিক আলোচনা করো।
নতুন প্রস্তর যুগে মানুষের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের নিদর্শনগুলি দেখে এযুগের মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।
নব্য প্রস্তর যুগে পরিবর্তনের ধারা –
- খাদ্য উৎপাদক – আদিম মানুষরা ফসল ফলাতে জানত না। তাই তাদের খাদ্যের অভাব পড়ত। আর খাদ্যের খোঁজে তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু নব্য প্রস্তর যুগে তারা চাষ-আবাদ শেখে। গম ও যব প্রভৃতি ফসলের চাষ হত। ফলে তাদের আর খাদ্য সমস্যা দেখা গেল না।
- স্থায়ী বসতি – আর তখনই তারা স্থায়ী ঘর বাড়ি বানাতে শুরু করল। তারা জমির কাছে ঘর তৈরি শুরু করল। আর এভাবেই শুরু হল স্থায়ী বসতি নির্মাণ। এ যুগের মানুষ কাঁচা মাটির ইট দিয়ে ঘর-বাড়ি বানাত।
- শ্রম বিভাগ – স্থায়ী বসতি স্থাপনের পর সমাজজীবনে প্রয়োজন হল নানা প্রয়োজনীয় জিনিস। আর বিভিন্ন জিনিস তৈরির ক্ষেত্রে এক একজন মানুষ দক্ষ হয়ে উঠল। কেউ হাতিয়ার, কেউ বা বানাতে লাগল কুড়ুল, কাস্তে, নিড়ানি জাতীয় দ্রব্য। এভাবেই নব্য প্রস্তর যুগে শ্রম বিভাগ বা শ্রম বিভাজন দেখা দিল।
নব্য প্রস্তর যুগে চাষ-আবাদ কেমন ছিল?
নব্য প্রস্তর যুগের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল-এযুগের মানুষ চাষ-আবাদ শেখে, ফসল ফলায়।
নব্য প্রস্তর যুগের চাষবাস –
- কীভাবে শিখল – মানবসভ্যতার বয়স যত বাড়তে থাকল ততই মানুষ উন্নত হতে থাকল। আদিম মানুষ প্রথমে খাদ্যের খোঁজে যাযাবরের মতো এখান-সেখান ঘুরে বেড়াত। এভাবে ঘুরতে ঘুরতেই তারা এক ধরনের শস্যের বীজ খুঁজে পায়। আর তা থেকে ফসল ফলাতে শেখে। এভাবেই নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের চাষ-আবাদে হাতে খড়ি হয়।
- কোথায় কী চাষ হত – জল ও ভালো জমির জন্য এযুগের মানুষ নদী উপত্যকাকেই বেছে নেয়। মনে রাখতে হবে নব্য প্রস্তর যুগের মানুষই জমিতে জলসেচ করতে শেখে। চাষিরা গম, যব, তুলো প্রভৃতি চাষ করত। ইরাক, ইরান, মিশর, সিরিয়া, আরবে এরূপ চাষবাসের খবর পাওয়া গেছে।
- চাষের পদ্ধতি – এযুগের মানুষ প্রথমে জমির মাটি তৈরি করত। তারপর সেই জমিতে শস্যের দানা পুঁতে দিত। প্রয়োজনমতো জমিতে তারা জলসেচ করত। আর কৃষিকাজে কাস্তে, নিড়ানি জাতীয় জিনিস ব্যবহার করত।
নতুন পাথরের যুগ সম্পর্কে কী জানো?
মধ্যপ্রস্তর যুগের পর পৃথিবীতে নব্যপ্রস্তর যুগের (আনুমানিক ৮০০০-৪০০০ খ্রি. পূ.) সূচনা হয়। এ যুগে –
- মানুষ খাদ্য সংগ্রাহক থেকে খাদ্য উৎপাদকে পরিণত হয়। অর্থাৎ তখন মানুষ কৃষিকাজ শেখে।
- মানুষ নানা কাজে আগুনের ব্যবহার শেখে।
- সেযুগের মানুষ চাকার ব্যবহার শেখে। ফলে মৃৎশিল্প ও যানবাহনের দারুণ উন্নতি হয়।
- মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস গড়ে তোলে। ঘর-বাড়ি বানাতে শেখে ইত্যাদি।
কৃষিকাজ কীভাবে আদিম মানুষের জীবন পালটে দেয়?
নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ প্রথম কৃষিকাজ শেখে। এর ফলে আদিম মানুষের জীবনে নানান পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যেমন –
- তারা তখন থেকে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলে। জমির আশেপাশে ঘরবাড়ি তৈরি করা শুরু করে।
- তখন থেকে তাদের পশুশিকার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ কাজকর্মের অবসান হয়।
- কৃষিকাজ শেখার পর থেকে আদিম মানুষের জীবনে আসে আরাম, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য। যা ইতিপূর্বে ছিল না। কারণ তখন তারা খাদ্যের খোঁজে ব্যস্ত থাকত।
- কৃষিকাজ শেখার পর আদিম মানুষকে খাদ্যের খোঁজে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে হত না। ফলে তাদের যাযাবর জীবনের অবসান হয়।
নতুন পাথরের যুগে মানুষ কীভাবে ফসল উৎপাদন করতে শিখেছিল?
নতুন পাথরের যুগে (আনুমানিক 8000-4000 খ্রি.পূ.) মানুষ প্রথম ফসল ফলাতে শেখে। এই কাজ শেখার পিছনে একটি ইতিহাস আছে। তা হল –
মানুষ যখন গুহাবাসী ছিল, তখন খাদ্য সংগ্রহের জন্য লড়াই করতে হত। অনেক সময় তারা জন্তু জানোয়ার শিকার করতে পারত না। তাই দেখা গেছে বাড়ির মহিলা সদস্যরা খাদ্যের খোঁজে বনজঙ্গলে যেত। সেখান থেকে তারা ফলমূল সংগ্রহ করে নিয়ে আসত। কখনো-সখনো সেই তালিকায় থাকত নানা রকমের শস্যবীজ। তারা অজান্তেই সেই শস্যদানা মাটিতে ফেলে দিত। একদিন সেই শস্যদানা থেকেই জন্ম নিয়েছিল শস্যের গাছ এবং তাতে জন্মেছিল শস্য। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই নতুন প্রস্তর যুগের মানুষ ব্যাপকহারে ফসল ফলাতে বা চাষবাস করার কাজ শিখেছিল। খুব সম্ভব প্রথমে আদিম মানুষরা গমজাতীয় শস্যের চাষ শিখেছিল।
সংস্কৃতি বলতে কী বোঝো?
একটি নির্দিষ্ট স্থানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী মানুষের অনুসৃত জীবনযাত্রা বা জীবনপ্রণালীকে সাধারণভাবে বলা হয় সংস্কৃতি। এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে একাধিক বিষয়। যেমন – আচার-ব্যবহার, ভাষা, রীতি-নীতি, বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কাজ, বিনোদন, আর্থ-সামাজিক অবস্থান প্রভৃতি। এই সংস্কৃতির ধারণার উদ্ভব হয়েছিল মানবসভ্যতা উদ্ভবের আদিকালে, যখন মানুষ বিভিন্ন প্রস্তর যুগে বসবাস করত।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়, “ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষ (যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতি স্থাপন)” অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহায়ক হবে, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ!