অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – জেলখানার চিঠি – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

Sourav Das

আজকের এই আর্টিকেলে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের পঞ্চবিংশ অধ্যায়জেলখানার চিঠি’ থেকে রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করা হবে। এই প্রশ্নগুলো অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই পরীক্ষায় আসে।

অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – জেলখানার চিঠি – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর
অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – জেলখানার চিঠি – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর
Contents Show

আমার মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে অনেকখানি লাভবান হতে পারব। – কোন প্রসঙ্গে বক্তার এই উক্তি? জেলজীবনে তিনি আধ্যাত্মিক দিক থেকে কীভাবে লাভবান হওয়ার কথা বলেছেন?

জেলের মধ্যে বন্দি অবস্থায় মানুষকে অনেক সুখ বিসর্জন দিতে হয়, কিন্তু এখানে চরম নির্জনতার মধ্যে মানুষকে বাধ্য হয়ে দিন কাটাতে হয় বলে, সেই নির্জনতাই আবার তাকে জীবনের চরম সমস্যাগুলি তলিয়ে বোঝার সুযোগ দেয়। এ প্রসঙ্গেই লেখকের প্রশ্নে প্রদত্ত উক্তি।

জেলজীবনে লেখক আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে লাভবান হওয়ার কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্য – তিনি ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে বছরখানেক ধরে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু তার সঠিক সমাধান হচ্ছিল না। জেলজীবনের নির্জনতায় বছরখানেকে তা যেন সমাধানের দিকে পৌঁছেছে। এ বিষয়ে অনেক মতামতই তিনি এখন স্পষ্ট করে অনুভব করতে পারছেন। তাই ভবিষ্যতে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে তিনি অনেকখানি লাভবান হতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেছেন।

যখন আমাদিগকে জোর করে বন্দি করে রাখা হয় তখনই তাদের মূল্য বুঝতে পারা যায়? – কোন্ প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে? ‘তাদের মূল্য’ বিষয়ে লেখকের বক্তব্য আলোচনা করো।

কোনো ব্যক্তি যদি দীর্ঘদিন কারাবাসের মধ্যে অতিবাহিত করেন, তবে তার অকালবার্ধক্য আসতে বাধ্য। অবশ্য সে-বিষয়ে ওই ব্যক্তি যদি সদাসতর্ক থাকে, তবে অন্যকথা। দীর্ঘ কারাবাসের ফলে কীভাবে মানুষ ধীরে ধীরে দেহে-মনে অকালবৃদ্ধ হয়ে যেতে পারে এবং কিছু কিছু বিষয়ে তীব্র অভাববোধে তা কেমন করে ত্বরান্বিত হয় সে-প্রসঙ্গেই প্রশ্নে প্রদত্ত উক্তিটি করা হয়েছে।

এখানে ‘তাদের মূল্য’ বলতে লেখক সেইসব বিষয়কে বুঝিয়েছেন, যা বন্দিজীবনে একেবারেই থাকে না। জেলে বন্দিত্ব অর্থে নিছক বন্দিত্ব, যা ক্রমে মানুষকে মৃতকল্প করে তোলে। পিকনিক, বিশ্রম্ভালাপ, সংগীতচর্চা, সাধারণ বক্তৃতা, খোলা জায়গায় খেলাধুলা করা, মনমতো কাব্যসাহিত্যের চর্চা করা জেলজীবনে মানসিক মুক্তির বার্তা নিয়ে আসতে সক্ষম বলে লেখক মনে করেছেন। তিনি মনে করেছেন ব্যক্তিজীবনে এগুলির মূল্য সচরাচর আমরা বুঝি না। কিন্তু যখন আমাদের জোর করে বন্দি করে রাখা হয়, তখনই ‘তাদের মূল্য’ বোঝা যায়।

মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা কী কঠোর ও নিরানন্দময়। – যে ঘটনায় লেখকের মনে এই উপলব্ধি ঘটে তার পরিচয় দাও।

জেলে জীবনযাপন করতে করতে অগ্নিযুগের প্রখ্যাত সংগ্রামী সুভাষচন্দ্র বসুর তীব্রভাবে উপলব্ধি হয় – ‘জেলের কষ্ট দৈহিক অপেক্ষা মানসিক’। তিনি মনে করেন – জেলে যেখানে অত্যাচার ও অপমানের আঘাত অপেক্ষাকৃত কম আসে, সেখানে বন্দিজীবনের যন্ত্রণা কম হয়। এই ধরনের কাজ কয়েদিদের উপর জেলের কর্তারা নয়, উপরতলার মানুষরাই বেশি করে। তাই এতে করে আঘাতকারীদের উপর মানুষের মন চরম বিরুপ হয়ে ওঠে। কিন্তু এর একটা উলটো দিকও লেখক দেখতে পেয়েছেন, সেটি হল – পাছে বন্দিরা তাদের পার্থিব অস্তিত্ব ভুলে যায় এবং নিজ মনে একটা আনন্দজগৎ গড়ে তোলে। তাই এসব আঘাত তাদের উপর বর্ষিত হয়ে যেন বলে দেয় – মানুষের চারপাশের অবস্থা কত কঠোর ও আনন্দহীন।

এই চিঠিতে কারাবন্দি অবস্থাতেও দুঃখকাতর, হতাশাগ্রস্ত নয়, বরং আত্মবিশ্বাসী ও আশাবাদী নেতাজির পরিচয়ই ফুটে উঠেছে। পত্রটি অবলম্বনে নিজের ভাষায় মন্তব্যটির যাথার্থ্য পরিস্ফুট করো।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন একজন রাজনৈতিক বন্দি। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় বিপ্লবীদের উপর তাদের দমননীতি প্রয়োগ করে বীর বিপ্লবীদের অকারণে কারাবন্দি করে রাখত। নেতাজি ছিলেন একাধারে গভীর চিন্তাবিদ এবং মহান বিপ্লবী। আইসিএস হওয়ার জন্য তাঁর প্রশাসনিক বিষয়ে ভাবনাচিন্তাও ছিল প্রাঞ্জল। তাই অকারণে এবং সম্পূর্ণ অজ্ঞাতকারণে তাঁকে যখন কারাবাস করতে হয়েছে এবং তার মেয়াদ যখন নিতান্ত ছোটো থাকেনি, তখনও তাঁর মধ্যে দুঃখকাতরতা এবং হতাশাগ্রস্ততার পরিচয় প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি। বরং বন্ধু দিলীপ রায়কে লিখিত এই পত্রে তাঁর চরম আত্মবিশ্বাস ও আশাবাদী পরিচয়ই প্রকাশিত হতে দেখা যায়।

অকারণে কারাবাসকে তিনি আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে দেখতে চেয়েছেন। তিনি মানসিক দিক দিয়ে ভেঙে পড়েননি। কারাবাসের যন্ত্রণার দিককে দেখে তিনি ভেবেছেন – ‘ভবিষ্যতে কারা-সংস্কার আমার একটা কর্তব্য হবে।’ কারাবাসের দুঃখকে অতিক্রম করে তিনি একসময় এও ভেবেছেন – ‘আমাদের সমস্ত দুঃখকষ্টের অন্তরে একটা মহত্তর উদ্দেশ্য কাজ করছে।’ এ আশাবাদেরই নমুনা। বন্দিদশায় তাঁর মধ্যে একটা দার্শনিক ভাব অন্তরশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। দুঃখের অশ্রুকে গুরুত্ব না দিয়ে তিনি তার মধ্যে করুণা ও প্রেমবিন্দু দেখেছেন। বলেছেন – ‘দুঃখ-যন্ত্রণা উন্নততর কর্ম ও উচ্চতর সফলতার অনুপ্রেরণা এনে দেবে।’

কারাগারে বসে নেতাজির যে ভাবনা, যে অনুভব, তার অনেকখানি কেন অকথিত রাখতে হবে?

কারাজীবনে অসহ্য অবকাশ পাওয়া সম্ভব। চিন্তাশক্তিহীন ব্যক্তির কাছে তা কাজে লাগানোর কোনো তাগিদ না থাকলেও, চিন্তাবিদ ব্যক্তি তা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারে। যেমন ঘটেছিল অগ্নিযুগের মহান বিপ্লবী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ক্ষেত্রে। কারাগারে বসে নেতাজি অজস্র সদভাবনা বা গভীর অনুভবের দ্বারা তাড়িত হয়েছিলেন। কিন্তু তার লিখিত রূপ রেখে দেওয়া হয়তো তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এমনকি তাঁর প্রেরিত চিঠিপত্রও যে censor-এর বাঁধনে আটকে যেতে পারত, সে আশঙ্কাও তিনি প্রকাশ করেছেন। এর প্রধান কারণ হিসেবে তাঁর মনে হয়েছে – ‘এটা কেউ চায় না যে, তার অন্তরের গভীরতম প্রবাহগুলি দিনের উন্মুক্ত আলোতে প্রকাশ হয়ে পড়ুক।’ এজন্যই তাঁর মনে হয়েছে, পাথরের প্রাচীর ও লৌহদ্বারের আড়ালে বসে তিনি আজ যা ভাবছেন বা অনুভব করছেন, তার অনেকখানিই কোনো এক ভবিষ্যৎকাল পর্যন্ত অকথিতই রাখতে হবে।

শুধু শাস্তি দেওয়া নয়, সংশোধনই হওয়া উচিত জেলের প্রকৃত উদ্দেশ্য। – তুমি কি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত? তোমার উত্তরের পক্ষে যুক্তি দাও।

আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত।

দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত অপরাধীদের অনেকেরই প্রবৃত্তিগুলি মানসিক। তাই সেরকমভাবেই কারামধ্যে তাদের ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত কারাশাসন ব্যবস্থায় বা প্রণালীতে একটা খারাপ আদর্শের অনুসরণ করা হয় মাত্র। তাই জেলখানার সমস্ত আবহাওয়াটাই যেন সাধারণ অপরাধীদের বিকৃত অমানুষ করে তোলারই উপযোগী বলে মনে হয়। এতে কারাবাসকালে এই আবাসিকদের নৈতিক উন্নতি তো হয়ই না বরং তাতে তারা যেন আরও হীন হয়ে পড়ে। এই হীনমনের মানুষেরা কারাভ্যন্তরে বা মুক্তির পর সমাজজীবনে আর মানবিক আচরণ করতে পারে না। অতএব চাই সংস্কারমূলক নতুন দণ্ডবিধি, যা প্রতিষেধমূলক দণ্ডবিধির ঊর্ধ্বে অবস্থান করবে। কয়েদিদের সংশোধনের বা মানসপরিবর্তনের পথ পরিষ্কার করার উদ্যোগ কারাব্যবস্থায় না নিয়ে এলে কোনোদিনই অপরাধীর মন থেকে অপরাধবোধ দূর করা সম্ভব নয়।

আমাদের দেশের আর্টিস্ট বা সাহিত্যিকগণের যদি কিছু কিছু কারাজীবনের অভিজ্ঞতা থাকত তাহলে আমাদের শিল্প ও সাহিত্য অনেকাংশে সমৃদ্ধ হত। – এ প্রসঙ্গে কারাজীবন যাপন করা কয়েকজন সাহিত্যিকের নাম এবং তাঁদের রচিত গ্রন্থের নাম উল্লেখ করো।

কারাবাস সবসময়ই যে অপরাধমূলক কাজকর্মের জন্য ঘটে তা নয়, দণ্ডবিধির অজস্র নিয়ম ও তার প্রতিফলনের কারণে বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন সময়ে কারাবাস করতে হয়েছে। তাঁদের শিল্পীসত্তা কখনো-কখনো তাঁদের দিয়ে যে অসাধারণ গ্রন্থ লিখিয়ে নিয়েছে তা অসামান্য।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ী স্বাধীনতা আন্দোলনের শরিক হয়ে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে প্রথম কারাবরণ করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট আন্দোলনে জেলে দ্বিতীয়বার কারাবাস করার সময়ে তাঁকে ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলে বদলি করা হয়। তাঁর বিখ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস ‘জাগরী’ এখানেই রচিত হয়।

ঋষি অরবিন্দ কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বৎসরাধিককাল বন্দি থাকাকালে একটি ক্ষুদ্রকায় গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তাঁর অনন্য অভিজ্ঞতার কথা বর্ণিত হয়েছে। গ্রন্থটির নাম ‘কারাকাহিনি’।

বিখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষও রাজনৈতিকভাবে জেলে আটক হয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা করেন ‘আমাকে বলতে দাও’ নামের একটি ক্ষুদ্রকায় গ্রন্থ।

পত্রটি পড়ে কারাজীবন বিষয়ে তোমার যে ধারণা ও অনুভূতি জন্মেছে – তা জানিয়ে বন্ধুকে একটি পত্র লেখো।

আনন্দপল্লি, বর্ধমান
১৮/০১/১৫

প্রিয় সোমক,

অষ্টম শ্রেণির জন্য বাংলা পাঠ্যপুস্তকে সুভাষচন্দ্র বসুর, বন্ধু দিলীপ রায়কে লেখা একটি চিঠি পাঠ্যসূচিতে রয়েছে। চিঠিটি পড়ে আমি মুগ্ধ।

এতে অনেক ভাব প্রকাশিত, বিশেষত এক রাজবন্দির জবানিতে জেলের ভিতরকার কথাগুলি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে। নেতাজি লিখেছেন – কারাবাস যেন কোনোভাবেই নিছক বন্দিত্ব না হয়। তাঁর মনে হয়েছে – জেলখানার সমস্ত আবহাওয়াটা মানুষকে যেন বিকৃত অমানুষ করে তোলারই উপযোগী এবং আমার বিশ্বাস এ কথাটা সকল জেলের পক্ষেই খাটে। জেলে বন্দিদের সেখানে থাকার ফলে উন্নতি তো হয়ই না, বরং তারা আরও হীন হয়ে পড়ে। দীর্ঘ কারাবাসে মানুষ যে ধীরে ধীরে দেহে ও মনে অকালবৃদ্ধ হয়ে যেতে থাকে-এ পত্রে তা জেনে আমি ভীষণ ব্যথিত। এর জন্য তিনি জেলের প্রশাসনিক অব্যবস্থা এবং কয়েদিদের কিছু সাধারণ অভাববোধ পূরণ না হওয়ার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন। সাধারণ মুক্ত জীবনের কিছু বিষয় যদি জেলের মধ্যে আবাসিকদের জন্য রাখা যেত তবে তাদের মানস পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই হত বলে তিনি মনে করেন। আরও একটা বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন যা অন্যরকম। রাজনৈতিক বন্দিরা মুক্তি পেলে সমাজ তাদের সাদরে বরণ করে নেয়, কিন্তু সাধারণ অপরাধীদের ক্ষেত্রে এমন হয় না। মানুষ তাদের ঘৃণার চোখে দেখে, এই চাপ জেলের ভিতরেও তাদের বিব্রত করে।

আমার অনুরোধ তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস চিঠিটি পড়ে আমাকে তোর মতামত জানাস। আমি দেখতে চাই কারাজীবন সম্পর্কে তোর ও আমার অনুভূতি বা ধারণার মধ্যে কতটা মিল বা গরমিল রয়েছে। কাকু-কাকিমাকে আমার প্রণাম জানাস।

ইতি
তোর বন্ধু তাপস

ডাকটিকিট

সোমক রায়
প্রযত্নে – শ্রী আবীর রায়
২৮/১এ, সূর্য সেন স্ট্রিট
কলকাতা – ৭০০০০৯

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্কে আরও জেনে ‘সুভাষচন্দ্রের স্বদেশপ্রেম’ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করো।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু হচ্ছেন সারা বিশ্বে দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যোগ্যতার সঙ্গে আইসিএস পাস করেও তিনি তৎকালের সরকারি চাকরি গ্রহণ না করে স্বদেশপ্রেমে উদবুদ্ধ হয়ে অগ্নিবিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখনকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশনেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন হলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু। জীবনীশক্তি, মেধা ও কর্মনিষ্ঠার তিনি অফুরন্ত ভাণ্ডার ছিলেন। ‘অসহযোগ’ কিংবা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন তো বটেই, এমনকি তৎকালের সহিংস বিপ্লববাদও তাঁর অসামান্য নেতৃত্বের ভিতর চরম আশ্রয় খুঁজে নেয়। এজন্য ব্রিটিশ সরকার বারবার তাঁকে কারারুদ্ধ করে তাঁর নেতৃত্বকে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণদামামা বেজে উঠল সেসময়। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুনরায় রাজবন্দি হলে স্বাস্থ্যহানির কারণে তাঁকে গৃহেই বন্দি করে রাখা হল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র তাঁর এলগিন রোডের বাড়িতে অন্তরিন অবস্থায় ছদ্মবেশে উধাও হয়ে গেলেন। দেশমাতৃকার মুক্তিকল্পে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি তিনি ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে পৌঁছোলেন আফগানিস্তানে। সেখান থেকে জার্মানি। জার্মানিতে তখন হিটলারের রমরমা। তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। উদ্দেশ্য তাঁর সাহায্যে ভারতকে ব্রিটিশমুক্ত করা, বলাবাহুল্য তাঁর উদ্দেশ্য সফল হল না। এবার তিনি দীর্ঘ সমুদ্রপথে ডুবোজাহাজে পাড়ি জমালেন জাপানে, সেখানেও তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল হল না। কিন্তু রাসবিহারী বসুর একান্ত সহযোগিতায় তাঁর হাতে এল আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্বভার। এই সুশিক্ষিত মুক্তিবাহিনী নিয়ে ভারতের প্রান্তদেশে এসে ইংরেজ সৈন্যদের পরাজিত করে তিনি ইম্ফল ও কোহিমায় উড়িয়ে দেন ভারতের পতাকা। মুক্ত করেন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ‘জয় হিন্দ’ অর্থাৎ ‘স্বাধীন ভারতের জয়’ ছিল তাঁর প্রিয় স্লোগান।

মান্দালয় জেল থেকে লেখা এই চিঠিটি সাহিত্য হিসেবে কতটা সার্থক আলোচনা করো।

কোনো লেখাকে সার্থক হতে গেলে তার একটা গভীর ও বহুমাত্রিক আবেদন থাকতে হবে, যা পাঠককুলকে এক চিরন্তন সত্যে পৌঁছে দিতে পারবে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কেবল এক মহৎ স্বাধীনতা সংগ্রামী, দেশনেতা, সেনাপ্রধান নন, তিনি একজন চিন্তানায়কও। তাই রাজনৈতিক কারণে যখন তাঁকে অকারণ জেলবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে, তখন তাঁর চিন্তার রাজ্যে প্রবেশ করে গভীর ভাবনায় ডুবে যেতে কোনোপ্রকার বাধা থাকেনি।

এদিক থেকে বিচার করলে তাঁর ২/৫/২৫ তারিখে মান্দালয় জেল থেকে লেখা এই চিঠিতে ব্যক্তিগত, মননশীল, চিন্তাবিদ এক অন্য সুভাষচন্দ্রকে আমরা আবিষ্কার করতে পারি। এ পত্রে জেলখানা, জেলবন্দি, কারা প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়েই তাঁর মুক্ত মনের বিচ্ছুরণ ঘটতে দেখা যায়।

সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত দরদি ভাষায় তাঁর বন্ধুকে নিজের বন্দি থাকাকালীন মন ও মনন, সাধারণ বন্দিদের জন্য তাঁর অকপট সহানুভূতি ও বিদগ্ধ অনুভব, কারা প্রশাসনের দোষ-ত্রুটি বিষয়ে নিজ ভাবনার কথা জানিয়েছেন। এ আলোচনা এত আন্তরিক ও মানবিক যে, পত্রের মারফত এক মানুষের হৃদয় যেন গভীরভাবে এক নিমেষে পাঠকমনকে ছুঁয়ে যায়। বিশেষত বক্তার নিজস্ব ভাবোচ্ছ্বাস এখানে মন্ময় হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাই এ পত্র যে নিঃসন্দেহে সাহিত্য হিসেবে সার্থক হতে পেরেছে এবং তার আবেদন যে চিরকালীন এ বিষয়টি সুনিশ্চিত।

জেলখানার চিঠি পত্রখানির মধ্য দিয়ে ব্যক্তি সুভাষচন্দ্রের যে ছবি খুঁজে পাওয়া যায়, তা আলোচনা করো।

ব্যক্তি হিসেবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নতুন করে চেনানোর আর কোনো অবকাশ নেই। কারণ তিনি আজ সূর্যের মতো ভাস্বর প্রবাদপ্রতিম এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁকে কখনও ভোলা যায় না। কিন্তু আপন রচনারাজিতে তাঁর যে নিজস্ব উপস্থাপনা, তা তাঁর মন ও মনন, কর্ম ও স্বপ্নকে আমাদের কাছে অন্যভাবে চিনিয়ে দেয়। তাঁর এই পত্রটির মধ্যে একান্ত ব্যক্তিগতরূপে তিনি ধরা পড়েছেন।

বন্ধু সুভাষচন্দ্র – এ পত্র সুভাষচন্দ্র তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু দিলীপ রায়কে লিখেছিলেন, যাঁর চিঠি পেয়ে তাঁর হৃদয় আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তিনি তাই অকপটে জানাচ্ছেন – তোমার চিঠি হৃদয়তন্ত্রীকে এমনই কোমল ভাবে স্পর্শ করে চিন্তা ও অনুভূতিকে অনুপ্রাণিত করেছে যে, আমার পক্ষে এর উত্তর দেওয়া সুকঠিন। বন্ধুর পাঠানো বই পেয়ে তিনি যারপরনাই খুশি। সেগুলি তিনি আর ফেরত না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বন্ধুর পছন্দ যে অত্যন্ত সুন্দর, তা জানিয়ে তিনি আরও বই প্রত্যাশা করেছেন।

মানুষ সুভাষচন্দ্র – জেলে বন্দি থেকে সাধারণত মানুষ নিজেকে নিয়ে ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়ে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র রাজবন্দি। তিনি নিজেকে নিয়ে অকারণ বিব্রত হননি। সাধারণ জেলবন্দিদের নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনায় বোঝা যায়, তাঁর হৃদয়বোধ কত মহৎ। তিনি কারাশাসন প্রণালীর প্রতি নিতান্ত ক্ষোভে বলেন – ‘এতদিন জেলে বাস করার পর কারা-শাসনের একটা আমূল সংস্কারের একান্ত প্রয়োজনের দিকে আমার চোখ খুলে গেছে এবং ভবিষ্যতে কারা-সংস্কার আমার একটা কর্তব্য হবে।’ আবার অন্যত্র বলেছেন – “আমার মনে হয় না, আমি যদি স্বয়ং কারাবাস না করতাম তাহলে একজন কারাবাসী বা অপরাধীকে ঠিক সহানুভূতির চোখে দেখতে পারতাম।” এককথায় তিনি জেলে বসে কেবল নিজের পছন্দ বা মুক্তির কথা না ভেবে, দেশের সাধারণ মানুষ হিসেবে জেলবন্দি মানুষদের মানসমুক্তির কথাও ভেবেছেন নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে, এখানেই তাঁর সার্থকতা।

জেলখানার চিঠি পত্রটির মধ্যে জেলের সাধারণ অপরাধীদের প্রতি সুভাষচন্দ্রের সহানুভূতির যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা আলোচনা করো।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন প্রকৃতার্থেই একজন দেশভক্ত। জেলে যারা সাধারণ কয়েদি, তাদের সুভাষচন্দ্র খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তাদের দুঃখদুর্দশা দেখে তাঁর মন কেঁদেছিল বলেই তিনি তাদের জন্য একটি কারাশাসন প্রণালী আশা করেছিলেন। অপরাধীদের প্রবৃত্তিগুলিকে মানসিক ব্যাধি বলেই ধরা উচিত বলে তিনি মনে করেছিলেন। প্রতিষেধকমূলক দণ্ডবিধিকে সংস্কারমূলক নতুন দণ্ডবিধির জন্য পথ করে দেওয়ার ভাবনাও তাঁর মনে উদিত হয়েছিল। দীর্ঘ কারাবাসে কীভাবে মানুষ আস্তে আস্তে অকালবৃদ্ধ হয়ে যায়, তা লক্ষ করে তিনি দরদের সঙ্গে তার কারণ খুঁজতে চেষ্টা করেছেন। কি পেলে তাদের ভালো হয়, কি অভাববোধ পূর্ণ হলে তারা ভালো থাকে, তা তাঁকে ভাবিয়েছে। সাধারণ অপরাধীদের মনকে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখেছেন, তাদের মনের উপর গভীর চাপ এজন্য থাকে যে, সে জানে মুক্তির পর নিজের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও কোনো সহানুভূতি তারা আশা করতে পারে না। আর সেজন্যই তারা সাধারণের কাছে মুখ দেখাতে ভয় পায়। এমনও কয়েদি আছে, যাদের বাড়ির লোকেরা জানেই না, তারা জেলবন্দি। এজন্য তাদের অকুন্ঠ সহানুভূতি দেওয়া কর্তব্য বলে লেখক মনে করেছেন।

সুভাষচন্দ্র বসুর ‘জেলখানার চিঠি’ রচনায় কারা-প্রশাসনের বিভিন্ন দিক কীভাবে ফুটে উঠেছে?

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ‘জেলখানার চিঠি’ রচনাটিতে কারা-প্রশাসন বা জেলের অভ্যন্তরীণ শাসনপ্রণালী সম্পর্কে একটি গভীর পর্যালোচনার দিক ধরা পড়েছে। একজন সাধারণ অপরাধী ও রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে তাঁর মধ্যে যে তফাত তাও এ রচনায় সুস্পষ্ট। বিশেষত ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, দেশের পরাধীন অবস্থায়, জেলের অভ্যন্তরীণ দিকগুলির প্রতিও এই রচনায় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়।

পত্রের প্রথমেই বন্দির চিঠিকে censor-এর হাত অতিক্রম করে যাওয়া প্রসঙ্গে লেখক জানাচ্ছেন – অন্তরের গভীর প্রবাহগুলি দিনের মুক্ত আলোয় প্রকাশিত হোক এটা কেউ চায় না। তাই তাঁর বন্দিদিনের ভাবনাগুলি বুঝি পাথরের দেয়ালে ও লৌহকপাটের অন্তরালেই বন্ধ থেকে যাবে। জেলখানার তৎকালীন আবহাওয়া বন্দি মানুষকে বিকৃত অমানুষ করে তোলারই উপযোগী বলে তাঁর মনে হয়েছে। কারণ কারাবাসে মানুষের নৈতিক উন্নতি তো হয়ই না, বরং আরও হীন হয়ে পড়ে। তাই তিনি ভেবেছেন – ‘ভবিষ্যতে কারা-সংস্কার আমার একটা কর্তব্য হবে’। কারায় ব্রিটিশ-প্রণালীর অনুসরণের বদলে আমেরিকার মতো উন্নত দেশের ব্যবস্থাই গ্রহণযোগ্য বলে তাঁর মনে হয়েছে। অপরাধীদের প্রবৃত্তিগুলিকে মানসিক ব্যাধি ধরে কারাশাসন প্রক্রিয়ায় প্রতিষেধমূলক দণ্ডবিধির পরিবর্তে সংস্কারমূলক নতুন দণ্ডবিধির প্রয়োগ চেয়েছেন তিনি। সাধারণ অপরাধীদের কারাযাপনকে সহজতর করার জন্য তিনি অনেক বিনোদনমূলক ব্যবস্থা প্রতিস্থাপনের কথাও বলেছেন। তার মধ্যে একটা হল মুক্ত ও বদ্ধ জীবনের ফারাককে কমিয়ে আনা। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, অপরাধী বলে নির্দয় কঠোরতা না দেখিয়ে সর্বস্তরে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার পরামর্শ রেখেছেন তিনি কারা-প্রশাসনে।


আজকের এই আর্টিকেলে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের পঞ্চবিংশ অধ্যায়জেলখানার চিঠি’-এর রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, নিবন্ধটি আপনার জন্য সহায়ক হয়েছে। যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আরও সহায়তা চান, টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে ভুলবেন না, যাতে তারাও উপকৃত হতে পারে। ধন্যবাদ!

Please Share This Article

Related Posts

নবাব সিরাজউদ্দোলা কে ছিলেন? পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল লেখো।

পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

Class 8 English – The Happy Prince – About Author and Story

Class 8 English – The Happy Prince – About Author and Story

Class 8 English – The Happy Prince – Question and Answer

Class 8 English – The Happy Prince – Question and Answer

About The Author

Sourav Das

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

অধঃক্ষেপণ কাকে বলে? অধঃক্ষেপণের রূপভেদ গুলি আলোচনা করো।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে টীকা লেখো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

বিংশ শতকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে কৃষক সমাজ কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিল?