আজকের এই আর্টিকেলে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের বিংশ অধ্যায় ‘পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি’-এর বিষয়সংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করবো। এই বিষয়সংক্ষেপটি অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি পরীক্ষায় প্রায়শই প্রশ্ন আকারে আসে।
পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি অধ্যায়ের কবি পরিচিতি
রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কাব্যজগতের একজন স্মরণীয় কবি হলেন জীবনানন্দ দাশ। অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি জীবনানন্দ দাশ জন্মগ্রহণ করেন। জীবিকার জন্য তিনি বিভিন্ন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল – ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘বনলতা সেন’, ‘রূপসী বাংলা’, ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ ইত্যাদি। তাঁর আখ্যানধর্মী রচনা হল – ‘মাল্যবান’, ‘সুতীর্থ’, ‘জলপাইহাটি’ ইত্যাদি এবং প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কবিতার কথা’, ‘জীবনানন্দ দাশের গল্প’। তাঁর কবিতায় ইতিহাসচেতনা, নিঃসঙ্গ বিপন্নতা, বিপন্ন মানবতার কথা ব্যক্ত হয়েছে। চিত্ররূপময়তা তাঁর কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর এক ট্রাম দুর্ঘটনায় কবির মৃত্যু হয়।
পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি অধ্যায়ের উৎস
জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে পাঠ্য ‘পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি’ কবিতাটি সংগ্রহ করা হয়েছে।
পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি অধ্যায়ের পাঠপ্রসঙ্গ
বাংলার রূপতন্ময় কবি হলেন জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কাব্যে গ্রামবাংলার নদী, মাঠ, ধানখেত, শিশিরের ঘ্রাণের অনুভব পাওয়া যায়; যেন গ্রামজীবনের অনাস্বাদিত স্বাদের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর কবিতার প্রতিটি চরণে। বিশেষত ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের প্রতিটি কবিতাই কবির জন্মভূমির মাটির স্পর্শকে মনে করিয়ে দেয়। শহুরে জীবনের ইট-পাথরের জঙ্গলের একঘেয়েমি থেকে মুক্তির অবসর মেলে ‘রূপসী বাংলা’র কবিতাগুলিতে। নিশিরাত বাঁকা চাঁদ পাঠককে কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। সেই কল্পনার মায়াবী স্পর্শ আলোচ্য কবিতাতেও পাওয়া যায়। দুই প্রহরের ক্লান্ত পরিবেশে আমরাও ডুবে যেতে পারি কবিরই মতন। সেই প্রসঙ্গই যেন তুলে ধরা হয়েছে পাঠ্য ‘পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি’ কবিতাটিতে।
পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি অধ্যায়ের বিষয়সংক্ষেপ
কবি ভালোবাসেন তাঁর জন্মভূমির দ্বিপ্রহরকে। দ্বিপ্রহরের সেই স্মৃতিভরা রৌদ্রের ঘ্রাণ যেন এখনও তাঁর চেতনায় জেগে আছে। সেইসব দ্বিপ্রহরের কত গল্প-কাহিনি, কত স্বপ্ন ঘিরে আছে তাঁর হৃদয়ের ভাঁজে ভাঁজে তা তো আর কারও জানার কথা নয়; শুধু জানেন কবি আর জন্মভূমির প্রান্তর, ওই প্রান্তরের শঙ্খচিল। এদের কাছ থেকেই কবির মনোজগৎ জন্মজন্মান্তর ধরে হৃদয়ের কথা শিখেছে। কবির স্বপ্নে রয়েছে অনেক বেদনার ছোঁয়া। সেগুলি যেন জীবন থেকে ক্রমে ঝরে যাচ্ছে। যেমন ঝরে যায় শুষ্ক জীর্ণ পাতা, শালিকের স্বর; দূরে সরে যায় ভাঙা মঠের স্মৃতি অথবা দ্বিপ্রহরের রোদে নকশাপেড়ে শাড়িখানা পরেছিল যে মেয়েটি-হলুদ পাতার মতোই সেও ঝরে গেছে কোন্ কালে।
দ্বিপ্রহরের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কবির চেতনায় ভেসে ওঠে জলসিড়ি নদীর পাশে ঘাসের উপর শাখা নুয়ে বহুদিন থেকে পড়ে থাকা ছন্দহীন বুনো চালতা গাছটির কথা। কার যেন পুরোনো ঝাঁকরা-ফোঁপরা একখানি ডিঙি নৌকো নদীর তীরে হিজল গাছে বাঁধা পড়ে আছে বহুদিন ধরে – মালিকের কোনও খোঁজ নেই, হয়তো আর কোনোদিন আসবেও না ডিঙির মালিক; রোদে ভেজা বেদনার্ত দ্বিপ্রহরে আজও আকাশের নীচে কেঁদে চলেছে-সেই পাড়াগাঁর দ্বিপ্রহরকেই কবি মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসেন।
পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি অধ্যায়ের নামকরণ
জীবনানন্দ দাশ রচিত ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ২৫ সংখ্যক কবিতাটি শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে ‘পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি’ নামকরণে পাঠ্যসূচির অন্তর্গত করা হয়। কবি নিজে এই কবিতাটির নামকরণ করেননি।
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা প্রকৃতির প্রতি তাঁর সুগভীর অনুভব ব্যক্ত করেছেন ‘রূপসী বাংলা’-র কবিতাগুলিতে। বাংলার মাঠ, নদী, ধানখেত কবির কাব্যে এক অপরূপরূপে প্রতিভাত হয়। শৈশবের দিনগুলির প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আবেগ কাজ করে। কবিও তাঁর শৈশবের দিনগুলির কথা ভেবে স্মৃতিমেদুর হয়েছেন। পাড়াগাঁর দু-প্রহরের রোদ যেন কবির অনুভূতিকে জীবন্ত করে তোলে। অনেক স্বপ্ন, কাহিনি, গল্প যা কবিকে আপ্লুত করে তুলত তা সবই আজ কবির হৃদয়ে সঞ্চিত; কবির এই সঞ্চয়ের শরিক আর একজন এই পাড়াগাঁয়ের প্রান্তরের শঙ্খচিল। বাংলা প্রকৃতিকে ঘিরে কবির এই আবেগ, ভালোবাসা যে এক জনমের নয়, তাও কবি ব্যক্ত করেছেন। বাংলার নদী, মাঠ, শঙ্খচিল – এদের কাছ থেকে কবির হৃদয় শুধু এ জনমের নয়, বহু যুগ ধরে কথা শিখেছে, স্বপ্ন দেখেছে। শৈশবের দিনগুলিতে বর্তমানে কবি আর নেই; সেই দিনগুলি আজকে আর বাস্তব নয়; কিন্তু সেইসব স্মৃতি কবির মনে স্বপ্ন হয়ে জেগে থাকে; স্বপ্নের মধ্যে কবি শুনতে পান শুকনো পাতা ঝরে যাওয়ার শব্দ, শুনতে পান শালিকের স্বর, দেখতে পান ভাঙা মঠ-মন্দির-দেউল। কবির স্বপ্নে আরও ধরা পড়ে নকশাপেড়ে শাড়ি পরা মেয়েটি, যে হলুদ পাতার মতো রোদের মধ্যে সরে সরে গেছে।
চিরচেনা জলসিড়ি নদীর পাশে জলে নুয়ে পড়া বুনো চালতা গাছও কবির মনে উঁকি দিয়ে যায়। অনেক দিনের পুরোনো এক ডিঙি নৌকো এই নদীর জলে ভেসে থাকে। তার কোনো মালিক কোথাও নেই; নিঃসঙ্গ, একলা হয়ে হিজল গাছের সঙ্গে বাঁধা থাকে। এই গ্রামবাংলা যেন অনাদি, অনন্তকালের পুরোনো। কবিও যেন সেই সুদূরাতীত কাল থেকে বাংলার প্রকৃতিকে ভালোবেসে চলেছেন। কবি মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন এই প্রকৃতিকে তথা এই বাংলাকে।
সমগ্র কবিতা জুড়ে বাংলার দুপুরের রূপ বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। তাই কবিতাটির বিষয়কেন্দ্রিক নামকরণ সুপ্রযুক্ত।
পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি অধ্যায়ের শব্দার্থ ও টীকা
পাড়াগাঁ – গ্রাম। দু-পহর – দ্বিপ্রহর (সাধারণভাবে তিন ঘণ্টায় এক প্রহর ধরা হয়)। রৌদ্র – রোদ। স্বপনের – স্বপ্নের। প্রান্তর – মাঠ। শঙ্খচিল – এক শ্রেণির চিলবিশেষ। শুষ্ক – শুকনো। শালিক – ময়নাশ্রেণির সুপরিচিত পাখিবিশেষ। স্বর – কণ্ঠধ্বনি। মঠ – সন্ন্যাসীদের থাকার স্থান। নকশাপেড়ে – পাড়ে নকশা করা আছে এমন। জলসিড়ি – পূর্ববঙ্গের একটি নদী। শাখা – গাছের ডাল। নুয়ে – ঝুঁকে পড়া, নত হয়ে থাকা। ছন্দহীন – এলোমেলো। বুনো – বনে জন্মায় যা। ডিঙি – ছোটো নৌকো। ঝাঁপরা-ফোঁপরা – জীর্ণ, ফাঁপা, শূন্য। হিজল – এক ধরনের গাছ যা প্রধানত জলের ধারে জন্মায়। বেদনা – যন্ত্রণা; দুঃখ।
আজকের এই আর্টিকেলে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের বিংশ অধ্যায় ‘পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি’ – এর বিষয়সংক্ষেপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই সংক্ষিপ্তসার অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রায়ই এই অধ্যায় থেকে প্রশ্ন আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনার প্রস্তুতিতে সহায়ক হয়েছে। কোনো প্রশ্ন বা আরও তথ্যের প্রয়োজন হলে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। নিবন্ধটি শেয়ার করতে ভুলবেন না, যাতে আপনার বন্ধুরাও উপকৃত হতে পারে। ধন্যবাদ!