নবম শ্রেণী – ইতিহাস – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তারপর – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর

আজকে আমরা এই আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ইতিহাসের ষষ্ঠ অধ্যায় “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তারপর” অধ্যায়ের কিছু বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।

Table of Contents

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তারপর – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

জার্মানিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণগুলি আলোচনা করো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি দলের উত্থানের ফলে জার্মানিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটেছিল। জার্মানিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণগুলি হল —

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণ –

  1. ভাইমার প্রজাতন্ত্রের ব্যর্থতা
    • 1919 সালের 6 ফেব্রুয়ারি জার্মানিতে ভাইমার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জনগণের অসন্তোষ নিরসন করতে না পারার জন্য প্রজাতন্ত্র ব্যর্থ হয়। 1919 থেকে 1933 পর্যন্ত প্রায় 14 বছরে 15 জন চ্যান্সেলর নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং কমিউনিস্ট প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  2. প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি
    • প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বেকারত্ব সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করেছিল। ভার্সাই সন্ধির স্বীকৃতিতে জার্মানির আত্মমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল, যা জনগণকে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ করেছিল।
  3. হিটলারের উত্থান
    • 1933 সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর এবং 1934 সালে প্রেসিডেন্ট বা ফ্যুয়েরার হয়ে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটে।
  4. হিটলারের ফ্যাসিবাদী আদর্শ
    • ফ্যাসিবাদী আদর্শ ছিল গণতান্ত্রিক আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী। সশস্ত্র বাহিনী গঠনের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলিকে ধ্বংস ও বিরোধী নেতাদের হত্যা করে হিটলার নাৎসিবাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।

নাৎসিবাদ (Nazism) ও ফ্যাসিবাদের (Fascism) নীতির মধ্যে কী কী সাদৃশ্য ছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে জার্মানি ও ইতালির অবস্থা সংকটপূর্ণ ছিল। এই পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইতালিতে মুসোলিনি ফ্যাসিস্ট দল এবং জার্মানিতে হিটলার নাৎসি দল প্রতিষ্ঠা করেন। নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের সাদৃশ্যগুলো হলো —

  1. যুদ্ধ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের সমর্থক – নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদ উভয় মতবাদ ছিল যুদ্ধ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের সমর্থক। জার্মানিতে হিটলার ও ইটালিতে মুসোলিনি যুদ্ধ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের নীতি অনুসরণ করেছিলেন।
  2. একদলীয় শাসনব্যবস্থা – উভয় মতবাদই একদলীয় শাসনব্যবস্থায় আস্থাশীল। জার্মানিতে নাৎসি দল ও ইতালিতে ফ্যাসিস্ট দল ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা হয়।
  3. একনায়কতন্ত্র – নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদ জনগণের পরিবর্তে একজন ব্যক্তির শাসনে বিশ্বাসী ছিল। জার্মানিতে হিটলার ও ইতালিতে মুসোলিনির একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  4. সর্বশক্তিমান ও সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্র গঠন – উভয় মতবাদের মূল লক্ষ্য ছিল সবকিছুর উপর রাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা।

ইটালির ফ্যাসিবাদের জার্মান সংস্করণ ছিল নাৎসি দল। সমালোচনা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয় যে, গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের বিরোধী এই মতবাদ কিছুকালের জন্য হলেও ইতালীয় ও জার্মান জনগণকে মোহিত করে তাদের জাতীয় গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আদর্শের পার্থক্য কী?

ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ হল গণতন্ত্রবিরোধী মতবাদ। ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও মূল বিষয়ে অভিন্নতা থাকার জন্য উভয় মতবাদকে ফ্যাসিবাদ (Fascism) বলা হয়।

ফ্যাসিবাদ ও গণতান্ত্রিক আদর্শের পার্থক্য –

ফ্যাসিবাদগণতন্ত্র
সাধারণভাবে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ একটিমাত্র রাজনৈতিক দল এবং সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়, তাকে ফ্যাসিবাদ বলা হয়।গণতন্ত্র হল জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা পরিচালিত জনগণের শাসন।
ফ্যাসিবাদী আদর্শে দেশে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকে।গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বিরোধী দলের অস্তিত্ব। তাই গণতন্ত্রে কমপক্ষে দুই বা ততোধিক দল থাকে।
ফ্যাসিবাদে রাষ্ট্রনেতার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।গণতন্ত্রে যাবতীয় সিদ্ধান্ত আইনসভায় তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে গৃহীত হয় (জরুরি অবস্থা ছাড়া)।
ফ্যাসিবাদ হল উগ্র জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধের সমর্থক।গণতন্ত্র হল বিশ্বশান্তির সহায়ক।
ফ্যাসিবাদে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয় না; ক্ষমতা একনায়কের হাতে থাকে।গণতন্ত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়। জনগণ স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ পায়।

আদর্শগত দিক থেকে গণতন্ত্রের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের পার্থক্য থাকলেও জনকল্যাণ রাষ্ট্রের আর্থিক ও সামরিক উন্নতি উভয় মতবাদেরই লক্ষ্য ছিল। তবে শান্তি গণতন্ত্রের বাণী হলেও ফ্যাসিবাদের কাছে তা ছিল কাপুরুষের স্বপ্ন।

ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আদর্শের সংঘাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী ভূমিকা নিয়েছিল?

ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ হল সমভাবধারায় বিশ্বাসী। গণতন্ত্র হল এর সম্পূর্ণ বিপরীত মতবাদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে এই দুই বিপরীত মতবাদের সংঘাত ঘটে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণরূপে প্রতিভাত হয়।

ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আদর্শগত সংঘাত –

  • স্পেনের গৃহযুদ্ধ – স্পেনে নির্বাচিত প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে জেনারেল ফ্রাঙ্কো বিদ্রোহের পতাকা তোলেন। প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে প্রায় সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশ সমর্থন জানায়। অন্যদিকে ফ্রাঙ্কোর সমর্থনে এগিয়ে আসে ফ্যাসিস্ট ইতালি ও নাৎসি জার্মানি। শেষ পর্যন্ত স্পেনীয় গৃহযুদ্ধে ফ্রাঙ্কো জয়ী হন। এই যুদ্ধে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন মারণাস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার পরিস্থিতি জটিল করে তোলে। তাই এই যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া নামে খ্যাত।
  • আগ্রাসন – 1931 খ্রিস্টাব্দে জাপান চীনের মাঞ্চুরিয়া অঞ্চল দখল করে। 1936 খ্রিস্টাব্দে ইতালি আবিসিনিয়া এবং 1938 খ্রিস্টাব্দে জার্মানি চেকোশ্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া এবং পরে লিথুয়ানিয়ার মেমেল বন্দর দখল করে। ইউরোপ তথা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলি এই কাজের প্রতিবাদ জানায়।
  • শক্তিজোট – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে যেমন পরস্পরবিরোধী শক্তিজোট গড়ে উঠেছিল, তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও এইরকম শক্তিজোট গড়ে ওঠে। জার্মানি, ইতালি ও জাপানের মধ্যে গড়ে ওঠা অক্ষজোট ছিল ফ্যাসিবাদী; আর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং পরে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে গড়ে ওঠা মিত্রজোট ছিল গণতান্ত্রিক মতাদর্শের অনুসারী।
  • পোল্যান্ড আক্রমণ – উন্মুক্ত বন্দর হিসেবে ঘোষিত ডানজিগ পোল্যান্ডের মধ্যে অবস্থিত ছিল। জার্মানি ডানজিগের সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগের জন্য পোল্যান্ডের কাছে সংযোগপথ বা করিডোর দাবি করে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পরামর্শে পোল্যান্ড এই দাবি অগ্রাহ্য করলে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে (1 সেপ্টেম্বর, 1939 খ্রি.)। এর ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

এই সমস্ত বিষয়ে দুই পরস্পরবিরোধী শক্তিশিবিরের সংঘাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপে গণতন্ত্রের বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল কেন?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে। ঐতিহাসিকেরা এই ঘটনাকে গণতন্ত্রের মড়ক বলে অভিহিত করেছেন। এই ঘটনার জন্য বিভিন্ন কারণ দায়ী ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপে গণতন্ত্রের বিপর্যয়ের কারণ –

নবপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলির দুর্বলতা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইতালি, জার্মানি, স্পেন প্রভৃতি দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক সরকারগুলি যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব প্রভৃতি সমস্যার সমাধানে অপারগ ছিল। তাই ওইসব দেশের জনগণ সদ্য প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং একনায়কতন্ত্রী ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রভূত ধন, সম্পদ ও জীবনহানি হওয়ায় ইউরোপের দেশগুলি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। তা ছাড়া বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার আঘাতে মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনহীনতা জনগণকে গণতান্ত্রিক সরকারগুলির প্রতি অসন্তুষ্ট করে তোলে।

ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থান – ইতালিতে বেনিটো মুসোলিনি, জার্মানিতে হিটলার ও স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থান ও সাফল্য গণতন্ত্রের চরম বিপর্যয় ঘটিয়েছিল।

জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতা – জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতা গণতন্ত্রের বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। জাতিপুঞ্জ সামরিক ও সাংবিধানিক ক্ষেত্রে দুর্বল হওয়ার জন্য ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন প্রতিরোধে অপারগ হয়।

সমস্যা কবলিত ইউরোপে একদিকে সাম্যবাদ এবং অন্যদিকে বিশ্ব আর্থিক মন্দার প্রভাব রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিব্রত করে তোলে। ফলে এইসব কারণে ইউরোপে গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী আদর্শ ছড়িয়ে পড়েছিল কেন?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গভীর বিপর্যয় এনেছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছিল। এই পরিস্থিতির সম্মুখীন সবথেকে বেশি হতে হয়েছিল জার্মানি ও ইতালিকে। এইসব সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সাম্যবাদ বিরোধিতা ইতালিতে ফ্যাসিবাদ ও জার্মানিতে নাৎসিবাদ ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে একনায়কতন্ত্র প্রসারের কারণ –

নবপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলির দুর্বলতা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইতালি, জার্মানি, স্পেন প্রভৃতি দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক সরকারগুলি যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব ইত্যাদি সমস্যার সমাধানে অপারগ ছিল। তাই ওইসব দেশের জনগণ সদ্য প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারায় এবং একনায়কতন্ত্রী শাসনকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়।

আর্থিক মন্দা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলি আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তা ছাড়া বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দার আঘাতে মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনহীনতা জনগণকে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট করে তোলে।

জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতা – জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতা ছিল একনায়কতন্ত্র প্রসারের অন্যতম কারণ। জাতিপুঞ্জের সামরিক ও সাংবিধানিক দুর্বলতা ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে পারেনি।

ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থান – এইভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে একাধিক কারণে ইতালিতে বেনিটো মুসোলিনি, জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার এবং স্পেনে জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো – র নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী শাসনের সূচনা হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে কীভাবে ইউরোপের গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হয় – ব্যাখ্যা করো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপের কয়েকটি দেশে একনায়কতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরু হয়, যা গণতন্ত্রকে সংকটের মুখে ঠেলে দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে কীভাবে ইউরোপের গণতন্ত্রের বিপর্যয় –

  • 1935 খ্রিস্টাব্দে ইতালি আবিসিনিয়া আক্রমণ করলে জাতিপুঞ্জ ইতালির উপর অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করে। কিন্তু হিটলার জাতিপুঞ্জের নিষেধ আমান্য করে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নিরপেক্ষতার সুযোগে ইতালির সমর্থনে অগ্রসর হলে গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়।
  • 1936 খ্রিস্টাব্দে স্পেনে সাম্যবাদী প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে রাশিয়া সমর্থন জানায়। জেনারেল ফ্রাঙ্কো এই সরকারের বিরোধিতা করলে ইতালি ও জার্মানি সাম্যবাদের গতিরোধ করার লক্ষ্যে ফ্রাঙ্কোকে সমর্থন করে।
  • 1934 খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়া দখলে হিটলার ব্যর্থ হন। কিন্তু 1938 খ্রিস্টাব্দে জার্মানি সুকৌশলে অস্ট্রিয়া দখল করে। 1938 খ্রিস্টাব্দে মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে জার্মানি চেকোশ্লোভাকিয়ার সুদেতান অঞ্চল লাভ করে। পরে 1939 খ্রিস্টাব্দে হিটলার ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নিরপেক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করলে গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়।
  • 1932 খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি দল বিরাট সাফল্য লাভ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। প্যাপেন-এর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে হিটলার গণতান্ত্রিকভাবে সরকার গঠন করেন। কিন্তু সরকার গঠনের পর তিনি বিরোধী দলগুলিকে নিষিদ্ধ করে, বিরোধী নেতাদের হত্যা বা কারারুদ্ধ করে একদলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে জার্মানি থেকে গণতন্ত্র বিদায় নেয় ও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

এইভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে এবং সেখানে একনায়কতন্ত্রী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভার্সাই সন্ধির মধ্যেই কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল?

ভার্সাই সন্ধির শর্তাবলির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল কি না, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে এই সন্ধি জার্মানির কাছে অপমানজনক ও জবরদস্তিমূলক ছিল। এর ফলস্বরূপ, জার্মানির প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবতারণা হয়েছিল।

ভার্সাই সন্ধির প্রকৃতি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ভার্সাই সন্ধি (1919 খ্রি.) অনেকাংশেই দায়ী ছিল।

  • প্রতিশোধ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি জার্মানির উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। এই কারণে তারা জার্মানিকে অপমানজনক ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করে।
  • জার্মানির প্রতি অবিচার – ভার্সাই সন্ধির দ্বারা জার্মানির সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়, সমৃদ্ধ খনিজ অঞ্চল কেড়ে নেওয়া হয়, এবং তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বোঝা, যা জার্মানির পক্ষে কখনোই মেটানো সম্ভব ছিল না।
  • জার্মান জাতীয়তাবোধের উন্মেষ – বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি ও মিত্রশক্তিবর্গের বিমাতৃসুলভ আচরণ জার্মান জাতির মনে জাতীয়তাবোধ ও আত্মমর্যাদার উন্মেষ ঘটিয়েছিল।
  • একতরফা চুক্তি – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানিকে একতরফাভাবে যুদ্ধাপরাধী বলে ঘোষণা করা হয়। এছাড়া জার্মান প্রতিনিধিদের মতপ্রকাশের কোনো সুযোগ না দিয়ে এবং তাদের উপর বিমান আক্রমণের হুমকি দিয়ে সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়।
  • হিটলারের উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ – এমতাবস্থায় ভাইমার প্রজাতন্ত্রের উপর জার্মানরা আস্থা হারায় এবং নাৎসি দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। হিটলারের উত্থানের পথকে প্রশস্ত করে। ক্রমশ হিটলারের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। হিটলার ভার্সাই সন্ধির অপমানজনক শর্তগুলি মানতে অস্বীকার করেন এবং 1936 খ্রিস্টাব্দের পর যে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেন তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ প্রস্তুত করে।

এই কারণে ভার্সাই সন্ধিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী করা চলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠনে জাতিসংঘের ভূমিকা কী ছিল?

জাতিসংঘের ব্যর্থতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বশান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে জাতিসংঘ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘ সেই উদ্দেশ্য পালনে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটে।

জাতিসংঘের ভূমিকা –

  • জাতিসংঘ যুদ্ধরোধ এবং বিশ্বশান্তি রক্ষায় সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। 1931 খ্রিস্টাব্দে জাপান কর্তৃক চিনের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ, 1936 খ্রিস্টাব্দে ইটালি কর্তৃক আবিসিনিয়া দখল এবং জার্মানির আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ জাতিসংঘ গ্রহণ করতে পারেনি।
  • জার্মানি ভার্সাই সন্ধি, লোকার্নো চুক্তি, কেলগ-ব্রিয়াঁ চুক্তি ইত্যাদি লঙ্ঘন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলে জাতিসংঘ তাকে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়।
  • জাতিসংঘের অর্থনৈতিক অবরোধ নীতি অর্থহীন ছিল। আক্রমণকারী দেশের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা নিতে না পারার ফলে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করে।
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্যপদ গ্রহণ করেনি। এই শক্তিশালী দেশের অনুপস্থিতি জাতিসংঘকে শুরু থেকেই দুর্বল করে দিয়েছিল। ফলে আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়।
  • 1932-33 খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভা শহরে নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন শুরু হয়। এখানে অস্ত্র মজুতের প্রশ্নে ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে মতভেদ ঘটলে জাতিসংঘ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি। জার্মান প্রতিনিধিরা সম্মেলন ত্যাগ করে ও অস্ত্রসজ্জা শুরু করে।
  • জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী ছিল না। ফলে আক্রমণকারী দেশের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। মাঞ্চুরিয়া, আবিসিনিয়া, স্পেন, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়ার ঘটনায় জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
  • জার্মানির প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতি জাতিসংঘের পতনকে সূচিত করে। ফলে হিটলারের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।

জাপান কীভাবে মাঞ্চুরিয়া অধিগ্রহণ করে তা লেখো

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে জাপানের উত্থান হয়েছিল। 1930-এর দশক থেকে জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদ ক্রমশ প্রকাশ পেতে থাকে।

জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদ গ্রহণের পটভূমি

  • 1930-এর দশকে জাপানে জনবিস্ফোরণ ঘটে। জনসংখ্যার বৃদ্ধিজনিত সমস্যা দূর করার জন্য জাপান শিল্পায়নে গতি আনার চেষ্টা করে।
  • এই সময় জাপানের শিল্পায়ন কয়েকটি শক্তিশালী শিল্পপতি গোষ্ঠীর হাতে সীমাবদ্ধ হওয়ায় বিদেশনীতিতে পরিবর্তন এসেছিল।
  • জাপান ধীরে ধীরে সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে সরে এসে উগ্র জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করতে থাকে।
  • বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা থেকে বাঁচতে জাপান ভৌগোলিক দিক থেকে সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থিত মাঞ্চুরিয়া দখলে আগ্রহী হয়।

এইসব কারণে জাপান শেষ পর্যন্ত মাঞ্চুরিয়া অধিগ্রহণ করে।

মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ

1931 খ্রিস্টাব্দের 18 সেপ্টেম্বর জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে। এসময় জাপান লিগের নির্দেশ অমান্য করে মাঞ্চুরিয়া অধিগ্রহণ করে এবং তার নাম রাখে মাঞ্জুকুয়ো।

জাতিসংঘের ভূমিকা

এই ঘটনার পর জাতিসংঘ লিটন কমিশন গঠন করে। এই কমিশন তার প্রতিবেদনে জাপানকে আক্রমণকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে। লিটন কমিশনের রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হওয়ার একমাস পরে জাপান জাতিসংঘ ত্যাগ করে।ই ঘটনার পর জাতিসংঘ লিটন কমিশন গঠন করে। এই কমিশন তার প্রতিবেদনে জাপানকে আক্রমণকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে। লিটন কমিশনের রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হওয়ার একমাস পরে জাপান জাতিসংঘ ত্যাগ করে।

জার্মানি, ইটালি ও জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদ কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিল?

জার্মানি, ইটালি ও জাপান নিজেদেরকে পরিতৃপ্ত রাষ্ট্র বলে মনে করত না। এই অপরিতৃপ্ততার কারণে তারা উগ্র সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে। উগ্র জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে উগ্র সাম্রাজ্যবাদী নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগমনকে সুনিশ্চিত করে।

জার্মানির উগ্র জাতীয়তাবাদ

হিটলার হেরেনভকতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। এই তত্ত্বের মূল কথা ছিল, জার্মানরা হল আদি ও বিশুদ্ধ আর্য জাতি। অন্যান্য সংকর জাতির উপর প্রভুত্ব বিস্তার করার মৌলিক অধিকার তাদের আছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জার্মানি যুদ্ধ ও দেশ দখলের নেশায় মেতে ওঠে। জার্মানির উগ্র জাতীয়তাবাদের শিকার হয় অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ড। জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

ইটালির উগ্র জাতীয়তাবাদ

মুসোলিনির উগ্র জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য ছিল ইটালিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে তুলে ধরা। মুসোলিনির উগ্র জাতীয়তাবাদের শিকার হয় আলবেনিয়া ও আবিসিনিয়া। মুসোলিনি সদর্পে ঘোষণা করেন, আন্তর্জাতিক শান্তি কাপুরুষের স্বপ্ন।

জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদ

দূরপ্রাচ্যের দেশগুলির মধ্যে জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন দেশকে বিচলিত করে। জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রথম শিকার হয় মাঞ্চুরিয়া। রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি স্বাক্ষর, দ্বিতীয়বার চিন আক্রমণ এবং সর্বোপরি 1941 খ্রিস্টাব্দের 7 ডিসেম্বর মার্কিন নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবার আক্রমণ উগ্র জাতীয়তাবাদেরই বহিঃপ্রকাশ ছিল।

এইভাবে জার্মানি, ইটালি ও জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্ববাসীকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়ংকর যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য করেছিল।

আনস্লুজ (Anschluss) বলতে কী বোঝো?

অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলার হওয়ার পর ভার্সাই সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন করে জার্মানির সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলকে যুক্ত করেন। এই সংযুক্তিকরণের একটি উদাহরণ ছিল আনস্লুজ।

আনস্লুজ

হিটলার জার্মানির সঙ্গে অস্ট্রিয়াকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। এই ঘটনাটি ইতিহাসে নিবিড় মৈত্রী বা আনস্লুজ (Anschluss) নামে পরিচিত।

প্যান জার্মানিজম (Pan Germanism)

প্যান জার্মানিজমে বিশ্বাসী হিটলার ও নাৎসি দল মনে করত যে, বিসমার্ক জার্মান ঐক্যসাধনের সময় অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সাথে সংযুক্ত না করে যে মারাত্মক ভুলটি করেছিলেন, তা সংশোধন করা উচিত। আসলে হিটলারের জন্মস্থান অস্ট্রিয়াকে জার্মানির অন্তর্ভুক্ত করতে হিটলার প্রবল আগ্রহী ছিলেন।

অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলার শুশনিগ (Schuschnigg) অস্ট্রিয়া-জার্মানির সংযুক্তির ক্ষেত্রে গণভোটের দাবি করেন। কিন্তু হিটলার গণভোটে রাজি ছিলেন না। তাই 1938 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে জার্মানবাহিনী অস্ট্রিয়াতে প্রবেশ করে এবং অস্ট্রিয়া সংযুক্ত হয় জার্মানির সঙ্গে।

প্রভাব

জার্মানি-অস্ট্রিয়ার সংযুক্তি বা আনস্লুজ হওয়ার ফলে অস্ট্রিয়ার খনিজ সম্পদ ও মূলধনের উপর জার্মানির অধিকার স্থাপিত হয়। এছাড়া চেকোশ্লোভাকিয়ার বোহেমীয় দুর্গের উন্মুক্তকরণ এবং মধ্য-দানিয়ুব উপত্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উপরও জার্মানির নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়।

তোষণনীতি কী? এই নীতি কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরাজিত জার্মানির উপর ভার্সাই সন্ধির কঠোর শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি ভার্সাই সন্ধির বিভিন্ন শর্ত ভঙ্গ করে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সাম্যবাদ ভীতিতে আতঙ্কিত ছিল। তাই তারা হিটলারের বিভিন্ন কার্যকলাপ মেনে নেয়।

তোষণনীতি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে নিজ নিজ নিরাপত্তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ব্রিটেন ও ফ্রান্স কর্তৃক ইটালি, জার্মানি ও জাপানের আগ্রাসন নীতিকে সমর্থন করাকেই তোষণনীতি বলা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তোষণনীতি

নীচে তোষণনীতির কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল –

  • প্রথমত – ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বাল্ডউইনের আমলে (1935-37 খ্রিস্টাব্দ) ইঙ্গ-জার্মান নৌচুক্তির (1935 খ্রি.) দ্বারা জার্মানিকে অস্ত্রসজ্জার এবং ব্রিটিশ নৌবহরের 35% ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।
  • দ্বিতীয়ত – 1935 খ্রিস্টাব্দে লিগের নির্দেশ অমান্য করে আবিসিনিয়া আক্রমণকারী ইটালিকে ব্রিটেন নানাভাবে সাহায্য করে।
  • তৃতীয়ত – 1936 খ্রিস্টাব্দে স্পেনের প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ইটালি ও জার্মানির সাহায্যপ্রাপ্ত জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বিদ্রোহে ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিষ্ক্রিয় থাকে।
  • চতুর্থত – 1938 খ্রিস্টাব্দে মিউনিখ চুক্তি দ্বারা সুদেতান এবং 1938-39 খ্রিস্টাব্দে হিটলারের অস্ট্রিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া দখলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাহায্য প্রদান হিটলারকে পোল্যান্ড দখলের ইশারা জুগিয়েছিল। আবার অপরদিকে পোল্যান্ডকে জার্মানির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ইঙ্গ-ফরাসি প্রচেষ্টাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিল।

ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি শক্তিবর্গ যদি প্রথম থেকেই তোষণনীতির পরিবর্তে প্রতিরোধনীতি গড়ে তুলত, তাহলে হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে এড়ানো যেত। প্রথম থেকেই তোষণনীতির পরিবর্তে প্রতিরোধনীতি গড়ে তুলত, তাহলে হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে এড়ানো যেত।

আবিসিনিয়া সংকট – টীকা লেখো।

অথবা, ইটালির আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) আক্রমণ সম্পর্কে লেখো।

ইটালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে ইটালির ভৌগোলিক সম্প্রসারণ ঘটানোর উদ্যোগ নেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ইটালি আবিসিনিয়ার উপর প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত মুসোলিনি 1935 খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া আক্রমণ করেন এবং পরে তা দখল করেন 1936 খ্রিস্টাব্দে।

পটভূমি –

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্বে যখন মহামন্দা, তখন ইটালি তার অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ আবিসিনিয়া দখলের চেষ্টা শুরু করে। এরকম পরিস্থিতিতে ওয়াল ওয়াল গ্রামের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসোলিনি 1935 খ্রিস্টাব্দের 3 অক্টোবর আবিসিনিয়া আক্রমণ করেন।

কারণ –

ইটালি কর্তৃক আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া আক্রমণের প্রধান কারণগুলি ছিল —

  1. আবিসিনিয়ার কাছে ইটালির পরাজয়ের (1896 খ্রি.) প্রতিশোধ গ্রহণ।
  2. ইটালির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাসস্থান ও কর্মসংস্থান সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান।
  3. শিল্পের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ।
  4. শিল্পপণ্য বিক্রির বাজার দখল প্রভৃতি।

জাতিসংঘের ভূমিকা –

এই ঘটনায় জাতিসংঘ ইটালিকে আক্রমণকারী দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। লিগের বহু দেশ ইটালির সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বন্ধ করে দেয়।

আবিসিনিয়া দখল –

ইটালির আক্রমণের চাপে এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে সম্রাট হেইলে সেলাসি দেশত্যাগ করলে আবিসিনিয়া ইটালির অন্তর্ভুক্ত হয়। ইটালি এরপর 1937 খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করে।

গুরুত্ব –

ইটালির আবিসিনিয়া আক্রমণ ও দখল আন্তর্জাতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

  1. এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ইটালির উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রকাশ্যে চলে আসে।
  2. জাতিসংঘের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ দেশগুলির আস্ফালন আরও বেড়ে গিয়েছিল।
  3. ইটালিতে মুসোলিনির জনপ্রিয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
  4. আবিসিনিয়া দখলের ঘটনা জার্মান শাসক হিটলারকে ভার্সাই চুক্তি লঙ্ঘনে উৎসাহিত করে।
  5. এরপর ইটালি জার্মানির সঙ্গে জোট গড়ে তুললে ইউরোপে নতুন শক্তিজোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

হিটলারের প্রতি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের তোষণনীতি – টীকা লেখো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স হিটলারের প্রতি তোষণনীতি অনুসরণ করেছিল। তোষণনীতি বলতে বোঝায় হিটলারের প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের নমনীয় নীতি।

তোষণনীতি –

  1. হিটলারের নৌশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা – ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাল্ডউইনের সঙ্গে হিটলারের 1935 খ্রিস্টাব্দে একটি নৌ-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে হিটলারকে ব্রিটিশ নৌশক্তির 35% পর্যন্ত বৃদ্ধির অধিকার দেওয়া হয়।
  2. অস্ট্রিয়া সংযুক্তির সুযোগ – 1938 খ্রিস্টাব্দের 14 মার্চ ইংল্যান্ডের প্রচ্ছন্ন মদতে হিটলার ভার্সাই সন্ধি ও সেন্ট জার্মেইন সন্ধি লঙ্ঘন করে অস্ট্রিয়াকে জার্মান সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
  3. মিউনিখ চুক্তি – মিউনিখ চুক্তি ছিল হিটলারের প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতির চূড়ান্ত নিদর্শন। 1938 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে মুসোলিনির মধ্যস্থতায় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে মিউনিখ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে জার্মানিকে সুদেতেন অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার জন্য চেকোস্লোভাকিয়াকে বাধ্য করা হয়। তা সত্ত্বেও হিটলার 6 মাসের মধ্যে সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নেন।

পরিশেষে বলা যায়, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতির ফলে হিটলারের সাম্রাজ্যবাদী স্পৃহা আরও বেড়ে গিয়েছিল। ঐতিহাসিক এ জে পি টেলর (A J P Taylor) বলেছেন যে, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ।

রোম – বার্লিন – টোকিও অক্ষচুক্তি – টীকা লেখো।

1930-এর দশকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল রোম – বার্লিন – টোকিও অক্ষচুক্তি। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে অক্ষশক্তিভুক্ত দেশগুলি একত্রিত হওয়ার ফলে সমগ্র বিশ্বে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।

রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি – রোম, বার্লিন ও টোকিও হল যথাক্রমে ইটালি, জার্মানি ও জাপানের রাজধানী। 1937 খ্রিস্টাব্দের 6 নভেম্বর জার্মানির হিটলার, ইটালির মুসোলিনি ও জাপানের মধ্যে যে শক্তিজোট গঠিত হয়েছিল তা রোম – বার্লিন – টোকিও অক্ষচুক্তি (Axis Power) নামে পরিচিত।

অক্ষচুক্তি গঠনের পটভূমি – জার্মানিতে হিটলারের উত্থানে শঙ্কিত হয়ে মুসোলিনি ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক দৃঢ় করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে হিটলার ও মুসোলিনির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়।

রোম-বার্লিন অক্ষচুক্তি – মুসোলিনি ও হিটলারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেলে উভয়ের মধ্যে 1936 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে রোম- বার্লিন অক্ষচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

কমিন্টার্ন-বিরোধী চুক্তি – 1936 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে জার্মানি ও জাপানের মধ্যে সাম্যবাদবিরোধী অ্যান্টি-কমিন্টার্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

রোম – বার্লিন – টোকিও অক্ষচুক্তি – জার্মানি ও জাপানের মধ্যে অ্যান্টি-কমিন্টার্ন জোটে ইটালি যোগ দিলে 1937 খ্রিস্টাব্দে ইটালি, জার্মানি ও জাপানের মধ্যে রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

চুক্তির শর্ত – রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তির কয়েকটি শর্ত ছিল —

  1. এই চুক্তিভুক্ত তিনটি দেশের কোনো দেশকে যদি অপর কেউ আক্রমণ করে তবে অন্য দেশ তাকে সাহায্য করবে।
  2. অক্ষচুক্তিভুক্ত দেশগুলি সাম্যবাদী রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবে না।
  3. এই চুক্তি পরবর্তী দশ বছর কার্যকরী থাকবে।

গুরুত্ব – বিশ্বের ইতিহাসে রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত – রোম-বার্লিন-টোকিও জোট ইংল্যান্ড-ফ্রান্স জোটের বিকল্প জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

প্রথমত – বিশ্বে গণতন্ত্র ও সাম্যবাদবিরোধী একটি রাজনৈতিক জোটশিবির গড়ে উঠেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও সোভিয়েত রাশিয়ার সম্পর্ক আলোচনা করো।

1939 খ্রিস্টাব্দের 3 সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাপর্বে জার্মানির সঙ্গে রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করলে রাশিয়া জার্মানিবিরোধী পক্ষে যোগ দেয় এবং রাশিয়ার কাছে জার্মানি পরাজিত হয়। রাশিয়ার কাছে জার্মানির পরাজয় জার্মানির পতনের সূচনা করে।

জার্মান ও রাশিয়ার সম্পর্ক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও সোভিয়েত রাশিয়া

সূচনাপর্বে মিত্রতা – রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি (Russo-German Non-Aggression Pact) – 1939 খ্রিস্টাব্দের 23 আগস্ট রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে হিটলারের উদ্দেশ্য ছিল আসন্ন পোল্যান্ড আক্রমণে রাশিয়াকে নিরপেক্ষ রাখা। চুক্তি স্বাক্ষরের 7 দিন পর 1 সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। এই সময় চুক্তি অনুসারে রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকে।

জার্মানির রাশিয়া আক্রমণ – 1941 খ্রিস্টাব্দের 22 জুন যুদ্ধ ঘোষণা না করেই জার্মানি আকস্মিকভাবে রাশিয়া আক্রমণ করে। যদিও জার্মানি রাশিয়ার সঙ্গে 10 বছর মেয়াদের রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এই আক্রমণের ফলে রাশিয়া জার্মানিবিরোধী পক্ষে যোগ দেয়।

জার্মানির আক্রমণের প্রথমদিকে অপ্রস্তুত রাশিয়া বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তবে 1941 খ্রিস্টাব্দের শেষদিক থেকে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়। 1942 খ্রিস্টাব্দে স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধে জার্মানি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। 1943 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে জার্মান সেনাপতি ফ্রিডরিখ পাউলাস রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

রাশিয়ার কাছে জার্মানির পরাজয়কে অনেকে জার্মানির পরাজয়ের শেষের শুরু (The Beginning of the End) বলে অভিহিত করেন।

লেনিনগ্রাডের লড়াই সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

1941 খ্রিস্টাব্দের 22 জুন হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করে। জার্মানি 40 লক্ষ সৈন্য, 3,300 ট্যাংক ও 5 হাজার বিমান নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করে। জার্মানির এই রাশিয়া আক্রমণকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো আক্রমণ বলে অভিহিত করা হয়।

লেনিনগ্রাডের লড়াই

  • জার্মান আক্রমণ – হিটলার 1939 খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত 10 বছর মেয়াদের রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি অগ্রাহ্য করে রাশিয়া আক্রমণ করেন। হিটলারের আকস্মিক আক্রমণে রাশিয়া বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। জার্মান বাহিনী প্রথম 6 মাসে রাশিয়ার প্রায় 8 লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে। জার্মান বাহিনী লেনিনগ্রাড অবরোধ করে এবং মস্কোর কাছাকাছি চলে আসে।
  • রাশিয়ার পোড়ামাটি নীতি (Scorched Earth Policy) অনুসরণ – জার্মান বাহিনী রাশিয়ায় ঢুকে সেখানকার কোনো সুযোগ সুবিধা পায়নি। কারণ রাশিয়ার লাল ফৌজ (Red Army) পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে খাদ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ঘরবাড়ি সব ধ্বংস করতে করতে পিছু হটে যায়। ফলে জার্মান সেনাবাহিনী দখলীকৃত এলাকা থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেনি।
  • রাশিয়ার শীতের দাপটের প্রভাব – এরপর রাশিয়ায় প্রচণ্ড শীত আসে। এতে জার্মান বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় রাশিয়ার লাল ফৌজ জার্মান বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে। 1941 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর থেকে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয় এবং জার্মান বাহিনী পিছু হটতে থাকে।
  • রুশ প্রতিরোধ – জার্মান আক্রমণ প্রতিরোধের দায়িত্ব নিয়ে রুশ সেনাপতি মার্শাল ঝুকভ লেনিনগ্রাডের সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। গাছের গুঁড়ি, মাটির র‍্যামপার্ট, কাঁটাতার প্রভৃতির ব্যূহভেদ করা জার্মান বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
  • অবরোধ মুক্ত লেনিনগ্রাড – রাশিয়ার পাল্টা আক্রমণে 1942 খ্রিস্টাব্দে লেনিনগ্রাড জার্মান বাহিনীর অবরোধ থেকে মুক্ত হয়। তারপর শুরু হয় স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধ এবং জার্মান বাহিনী পর্যুদস্ত হয়।

লেনিনগ্রাডের লড়াই বিশ্বের নজর কেড়েছিল। রুশবাহিনী অমিতবিক্রমে জার্মান বাহিনীকে প্রতিরোধ করে। রাশিয়ার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলেও শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়। জার্মান সেনাপতি ফ্রিডরিখ পাউলাস আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন।

রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি – টীকা লেখো

রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি – 1939 খ্রিস্টাব্দের 23 আগস্ট রাশিয়া ও জার্মানি পরস্পরকে আক্রমণ না করার জন্য যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, তা রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভ (Molotov) ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ (Ribbentrop)। এই চুক্তির মেয়াদ 10 বছর নির্ধারিত হয়েছিল।

কারণ –

পরস্পরবিরোধী আদর্শে বিশ্বাসী রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কারণ হল —

  • রাশিয়ার স্বার্থ – রাশিয়ার সরকারের ধারণা ছিল যে, জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করবেই। এই চুক্তি স্বাক্ষর করে রাশিয়া আত্মরক্ষার নিশ্চয়তা পায়।
  • জার্মানির স্বার্থ – রাশিয়া যাতে জার্মানিকে আক্রমণ না করে সে সম্পর্কে জার্মানি নিশ্চিত হতে চেয়েছিল।

রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির শর্ত –

  • রাশিয়া ও জার্মানি পরস্পরকে 10 বছর (1939-49 খ্রি.) আক্রমণ করবে না।
  • উভয় দেশ যদি কোনো তৃতীয় দেশ দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে তারা কেউ আক্রমণকারী দেশকে সাহায্য করবে না।
  • উভয় দেশই এই চুক্তি গোপন রাখবে।
  • চুক্তির মেয়াদকালের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে কোনো মনোমালিন্য হলে শান্তিপূর্ণভাবে উভয় দেশ সেই বিবাদের মীমাংসা করবে।

চুক্তি লঙ্ঘন – হিটলার 1941 খ্রিস্টাব্দের 22 জুন অনাক্রমণ চুক্তি লঙ্ঘন করে রাশিয়া আক্রমণ করেন। রাশিয়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরোধীপক্ষে যোগদান করে।

ঐতিহাসিক এ জে পি টেলর (A.J.P. Taylor)-এর মতে, রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি হল রুশ-জার্মান বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত পরিণতি।

রুশ রাষ্ট্রনেতা স্ট্যালিন ও জার্মান ফ্যুয়েরার হিটলার দুজনেই স্বৈরতন্ত্রী এবং ক্ষমতালোভী ছিলেন। সমস্বার্থের কারণে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আবার স্বার্থের কারণেই এই চুক্তি ভঙ্গ হয়।

জার্মানি কেন রাশিয়া আক্রমণ করেছিল? অথবা, হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের কারণ কী ছিল?

জার্মানি 1941 খ্রিস্টাব্দের 22 জুন বিশাল সেনাবাহিনী (প্রায় 40 লক্ষ সেনা, 5000 যুদ্ধ বিমান, 3300 যুদ্ধ ট্যাংক) নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করে। যদিও এর আগে 1939 খ্রিস্টাব্দের 23 আগস্ট রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু জার্মানি মিথ্যা অজুহাতে এই চুক্তি ভঙ্গ করে রাশিয়া আক্রমণ করে।

জার্মানির রাশিয়া আক্রমণের কারণ –

আপাতদৃষ্টিতে হিটলারের রাশিয়া আক্রমণ আকস্মিক মনে হলেও এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত।

  • হিটলারের রুশ ভীতি – হিটলার মনে করতেন যে রাশিয়া জার্মানি আক্রমণ করতে পারে। আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে আক্রমণ করা সুবিধাজনক—তাই তিনি আগেভাগেই রাশিয়া আক্রমণ করেন।
  • জার্মান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা – হিটলারের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইউরোপে জার্মান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু রাশিয়া ছিল জার্মান আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথে অন্যতম প্রধান বাধা। তাই তিনি রাশিয়া আক্রমণ করে সেই বাধা দূর করতে চেয়েছিলেন।
  • রাশিয়ার সম্পদ দখল – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে রাশিয়া জার্মানিকে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করেছিল। কিন্তু জার্মানির ফ্রান্স দখলের পর রাশিয়া জার্মানির ভয়ে ভীত হয়ে তাকে এই সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। জার্মানি এই ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়। জার্মানির পেট্রোলিয়ামের অভাব ছিল। যুদ্ধের সময় এই অভাব বেড়ে যায়। তখন রাশিয়ার বাকু পেট্রোলিয়ম খনি দখলে জার্মানি সচেষ্ট হয়। এ ছাড়া ক্রিমিয়া ও ইউক্রেন (রাশিয়ার শস্যভাণ্ডার) দখল করে জার্মানি খাদ্যসংকট দূর করতে চেয়েছিল।
  • ওয়ান বাই ওয়ান (One by One) নীতি – হিটলার একসঙ্গে সব দেশের সাথে যুদ্ধ না করে একটির পর একটি দেশ জয় করার নীতি গ্রহণ করেন।
  • সাম্যবাদী ভীতি – 1917 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদের প্রসার ঘটতে থাকে। নাৎসি আদর্শবিরোধী সাম্যবাদকে ধ্বংস করার জন্য হিটলার সাম্যবাদের জন্মভূমি রাশিয়াকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেন।
  • কূটনৈতিক – হিটলার অনুমান করেন, রাশিয়াকে আক্রমণ করলে সাম্যবাদবিরোধী ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে সাহায্য করবে না। ফলে অতি সহজেই রাশিয়ার পতন ঘটবে।
  • অবিশ্বাস – জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কেউ কাউকে বিশ্বাস করত না। এজন্য রাশিয়ার সীমান্তে প্রচুর জার্মান সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জাম মোতায়েন ছিল। এই সমস্ত কারণের জন্য জার্মানি রাশিয়াকে আক্রমণ করে।

জার্মানির রাশিয়া আক্রমণের ফল কী হয়েছিল?

জার্মানি 1941 খ্রিস্টাব্দের 22 জুন রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি লঙ্ঘন করে রাশিয়া আক্রমণ করে। জার্মানির রাশিয়া আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।

জার্মানির রাশিয়া আক্রমণের ফলাফল –

  • জার্মানির ধ্বংসের সূচনা – জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করে প্রাথমিক কিছু সাফল্য লাভ করলেও তার শেষরক্ষা হয়নি। রাশিয়ার আক্রমণে জার্মান সেনার প্রায় 90% নিহত বা বন্দি হয়। তাই রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতাকে জার্মানির ধ্বংসের শেষের শুরু (The Beginning of the End) বলা হয় ৷
  • মিত্রশক্তির উৎসাহ বৃদ্ধি – জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করে ব্যর্থ হওয়ার ফলে জার্মানিবিরোধী মিত্রশক্তি উৎসাহিত হয়। তারা নতুন উৎসাহ ও উদ্দীপনায় জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
  • নাৎসি-বিরোধী প্রতিরোধ গঠন – রাশিয়াতে জার্মানির পরাজয়ের পর হিটলার অধিকৃত দেশগুলিতে নাৎসি-বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় রণাঙ্গন উন্মুক্ত করে এবং নর্মান্ডি অভিযান শুরু করে (6 জুন, 1944 খ্রি.)। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়। ফলে জার্মানির পতন আসন্ন হয়ে ওঠে।
  • জার্মানির গতিরোধ – রাশিয়া আক্রমণ করে জার্মানি পরাজিত হলে তার বিশ্বজয়ের স্বপ্নের গতি রুদ্ধ হয়। জার্মানি পিছু হটতে বাধ্য হয়। একদিকে রাশিয়ার লাল ফৌজের পাল্টা আক্রমণ, অন্যদিকে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি বাহিনীর আক্রমণে জার্মান বাহিনী জার্মানিতেই পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। শেষে জার্মানি 1945 খ্রিস্টাব্দের 8 মে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট রাশিয়া আক্রমণ করে ব্যর্থ হন। নেপোলিয়নের মতোই হিটলারের পতনও সূচিত হয়।ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট রাশিয়া আক্রমণ করে ব্যর্থ হন। নেপোলিয়নের মতোই হিটলারের পতনও সূচিত হয়।

স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

লেনিনগ্রাড থেকে পশ্চাদপসরণকারী জার্মান বাহিনী কিছু সময় পর স্ট্যালিনগ্রাড দখলের চেষ্টা করে। রাশিয়ার দক্ষিণ অংশে অবস্থিত স্ট্যালিনগ্রাডের দখল নিয়ে 1942 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।

স্ট্যালিনগ্রান্ডের যুদ্ধ – স্ট্যালিনগ্রাডে প্রবেশ করে শক্তিশালী জার্মান বাহিনী সেই অঞ্চলের রেলস্টেশন ও অন্যান্য কিছু স্থান দখল করে নেয়। প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে নভেম্বরের শেষদিকে রুশ বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই রাশিয়ার বিমান ও নৌবাহিনীর কাছে জার্মান বাহিনীর বিপর্যয় ঘটতে থাকে। শেষ পর্যন্ত 1943 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে রুশ বাহিনীর কাছে জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

গুরুত্ব – স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধে –

  • দুই পক্ষের কয়েক লক্ষ সৈন্য মারা যায়।
  • রাশিয়ার লাল ফৌজের সাফল্যে বিশ্ববাসী চমৎকৃত হয়।
  • লেনিনগ্রাডের পর স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধেও সাফল্য না পাওয়ায় জার্মানি বেশ হতাশ হয়ে পড়ে।
  • এই যুদ্ধে জয়ের ফলে রাশিয়ার লাল ফৌজ বাহিনীর উপর রুশ জনগণের ভরসা বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটনে হিটলারের ভূমিকা সংক্ষেপে লেখো।

অথবা, হিটলারের পররাষ্ট্রনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য কতটা দায়ী ছিল?

হিটলার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জার্মানিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জার্মানির ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ক্ষমতা দখলের পর, হিটলার জার্মানিকে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেন এবং গৌরবজনক পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। তাঁর এই প্রচেষ্টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটনে হিটলারের ভূমিকা

হিটলারের পররাষ্ট্রনীতি –

  1. জাতিসংঘ ত্যাগ – 1933 সালে অনুষ্ঠিত জেনেভার নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে জার্মান প্রতিনিধিরা দাবি করেছিলেন যে, হয় সমস্ত রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি হ্রাস করে জার্মানির পর্যায়ে আনা হোক অথবা জার্মানিকে অন্য রাষ্ট্রের সমান সামরিক শক্তি বৃদ্ধির অনুমতি দেওয়া হোক। মিত্রপক্ষ জার্মানির এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে জার্মান প্রতিনিধিরা সম্মেলন ত্যাগ করেন এবং পরে জার্মানি জাতিসংঘের সদস্যপদও ত্যাগ করে।
  2. পোল্যান্ড-জার্মানি অনাক্রমণ চুক্তি – হিটলার ইউরোপকে সচকিত করে শত্রুতা থাকা সত্ত্বেও পোল্যান্ডের সঙ্গে ১০ বছরের জন্য অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন (1934 খ্রি.)। হিটলারের উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের জার্মানিবিরোধী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে পোল্যান্ডের সম্পর্কের অবনতি ঘটানো।
  3. সার ও রাইন অঞ্চল পুনরুদ্ধার – হিটলার ভার্সাই সন্ধি ও লোকার্নো চুক্তি লঙ্ঘন করে সার ও রাইন অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন।
  4. রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষজোট গঠন – 1937 সালে ইতালি, জার্মানি ও জাপানের মধ্যে একটি শক্তিজোট গড়ে ওঠে, যা রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষজোট নামে পরিচিত।
  5. রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি – হিটলার পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঘোর শত্রু রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। 1939 সালে রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে ১০ বছরের জন্য অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে জার্মানি ও রাশিয়া উভয়েই লাভবান হয়েছিল।
  6. মিউনিখ চুক্তি – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি ব্যবচ্ছেদ করে চেকোস্লোভাকিয়া সৃষ্টি হয়। কিন্তু চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতেন অঞ্চল জার্মান অধ্যুষিত ছিল। হিটলারের কূটনৈতিক ও সামরিক চাপের ফলে মিউনিখ চুক্তি দ্বারা জার্মানি সুদেতেন অঞ্চল লাভ করে (1938 খ্রি.)। কয়েক মাস পর তিনি সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া ও অস্ট্রিয়া দখল করেন।
  7. হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ – রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের পর 1939 সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। পোল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে ৩ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।

হিটলারের অনুসৃত এই পররাষ্ট্রনীতি জার্মানির স্বার্থের অনুকূল এবং ভার্সাই সন্ধির বিরোধী ছিল। এর ফলে ইউরোপীয় রাজনীতি আলোড়িত হয় এবং পরিণামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুটি প্রধান কারণ নির্দেশ করো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই সমগ্র বিশ্ববাসী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছিল। এর পিছনে নিহিত ছিল একাধিক কারণ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলি হল –

  1. ভার্সাই সন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া – 1919 সালের ভার্সাই সন্ধিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিজয়ীপক্ষ জার্মানির উপর অপমানজনক ভার্সাই সন্ধির শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিল, যা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জার্মান জাতির পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। হিটলার এই অপমানজনক ভার্সাই সন্ধি লঙ্ঘন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জার্মানিতে সর্বময় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ক্ষমতা লাভ করার পর তিনি ভার্সাই সন্ধি লঙ্ঘন করতে বদ্ধপরিকর হন।
  2. উগ্র জাতীয়তাবাদ – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল জার্মানি, ইতালি ও জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতি।
    • জার্মানি – হেরেনভোল্ক তত্ত্বে বিশ্বাসী হিটলার বলতেন — জার্মানরাই হল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। তিনি জার্মানিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
    • ইতালি – মুসোলিনি ফ্যাসিবাদী নীতি অনুসরণ করে ইতালিকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিরূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
    • জাপান – জাপান উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করে। জাপান চীনের মাঞ্চুরিয়া দখল করে এবং আমেরিকার অধিকারভুক্ত পার্ল হারবার বন্দর ধ্বংস করে দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে শুরু হয়? এই যুদ্ধের সূচনা কীভাবে হয়?

অথবা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ সম্পর্কে লেখো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা – 1939 সালের ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ –

  1. অক্ষশক্তি জোট – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে ফ্যাসিবাদ ও জার্মানিতে নাৎসিবাদ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই দুই দেশের মধ্যে রোম-বার্লিন ইস্পাত চুক্তি ও অ্যান্টি-কমিন্টার্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (1936 খ্রি.)। জাপান এই জোটে যোগ দিলে রোম-বার্লিন-টোকিও জোট বা অক্ষশক্তি জোট গড়ে ওঠে (1937 খ্রি.)। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক দেশ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মিত্রজোট আবদ্ধ ছিল। এই পরস্পরবিরোধী শক্তিজোট যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে তুলেছিল।
  2. পোলিশ করিডোর – জার্মান ফ্যুয়েরার হিটলার অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে পোল্যান্ডের কাছে ডানজিগ যাওয়ার জন্য সংযোগপথ বা পোলিশ করিডোর দাবি করেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পরামর্শে পোল্যান্ড হিটলারের দাবি অগ্রাহ্য করে।
  3. হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ – পোল্যান্ডের এই আচরণের প্রতিক্রিয়ায় হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন (১ সেপ্টেম্বর, 1939 খ্রি.)। পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতো ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পোল্যান্ডকে সমর্থন জানায়। জার্মানির বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ৩ সেপ্টেম্বর এবং ফ্রান্স ৪ সেপ্টেম্বর (1939 খ্রি.) যুদ্ধ ঘোষণা করে। এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।
  4. রাশিয়ার যোগদান – রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেন (২২ জুন, 1941 খ্রি.)। আক্রান্ত রাশিয়ার পাশে ইংল্যান্ড দাঁড়ায়। রাশিয়া মিত্রজোটভুক্ত হয়ে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
  5. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগদান – অক্ষজোটভুক্ত জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবার আক্রমণ করলে (৭ ডিসেম্বর, 1941 খ্রি.) পরদিন (৮ ডিসেম্বর, 1941 খ্রি.) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষজোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পশ্চিম গোলার্ধে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমশ বিশ্বের সমস্ত দেশ এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়।স্ত দেশ এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল শক্তি ও কেন্দ্রগুলি চিহ্নিত করো।

আধুনিক বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। 1939 সালে হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধের সূচনা হয় তা ধীরে ধীরে ইউরোপের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বযুদ্ধের আকার নেয়। এই যুদ্ধের মূল কেন্দ্রগুলি হল নিম্নরূপ –

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল শক্তি ও কেন্দ্রসমূহ – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল শক্তি ও কেন্দ্র ছিল জার্মানি। 1939 সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে। অতঃপর ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পক্ষে ছিল নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিস্ট ইতালি ও জাপান। অন্যদিকে, যুদ্ধের প্রথমদিকে অক্ষশক্তির প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মিত্রশক্তি এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া মিত্রশক্তির পক্ষে যোগদান করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেবল স্থলভাগেই সীমাবদ্ধ ছিল না — জল, স্থল, ও অন্তরীক্ষ সবক্ষেত্রেই তীব্রভাবে প্রসারিত হয়েছিল। ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং দূরপ্রাচ্যের রণাঙ্গনেও এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া সমুদ্রের বুকে ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে বহু নৌযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।

এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের নানা প্রান্তে সংঘটিত হয়েছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে?

আধুনিক বিশ্বের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলি জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমেই এই যুদ্ধে যোগদান করেনি। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকার নীতি গ্রহণ করেছিল। এই কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম ২৭ মাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেনি। পার্ল হারবারের ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে।

পার্ল হারবার ঘটনা

1941 সালের ৭ ডিসেম্বর সকাল ৭টা ৪৮ মিনিটে জাপানের ৩৫৩টি যুদ্ধবিমান, বোমারু বিমান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত মার্কিন নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবারে বোমা নিক্ষেপ করে। এর ফলে নৌ-ঘাঁটিটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে ৮ ডিসেম্বর (1941 সাল) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে।

এইভাবে পার্ল হারবারে জাপানের বোমা নিক্ষেপের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল।

পার্ল হারবার (Pearl Harbour) ঘটনা কী?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগদানের ক্ষেত্রে পার্ল হারবারের ঘটনা প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে যুদ্ধের গতি মিত্রশক্তির অনুকূলে চলে যায়।

পার্ল হারবার ঘটনা

পার্ল হারবার (Pearl Harbour) উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নৌ-ঘাঁটি ছিল। 1941 সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান এই মার্কিন নৌ-ঘাঁটি আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে দেয়। এই ঘটনা পার্ল হারবার ঘটনা নামে পরিচিত।

পার্ল হারবার (Pearl Harbour) ঘটনা

পটভূমি –

  1. জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি বাতিল – 1911 সালে জাপানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি বাতিল করলে জাপান তীব্র আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আমেরিকা জাপানকে লোহা, বিমান, পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
  2. জাপানের আগ্রাসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাধা প্রদান – জাপান চীনের প্রতি আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিরোধিতা করে এবং চীনকে গোপনে সহায়তা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের অখণ্ডতা রক্ষার অঙ্গীকারও করে।
  3. জাপানের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাবি – 1941 সালের ১৬ অক্টোবর জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন হিদেকি তোজো। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি চুক্তির প্রস্তাব দেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন ও ইন্দোচীন থেকে জাপানি সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। কিন্তু জাপান এই প্রস্তাব মানতে রাজি না হওয়ায় উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
  4. মার্কিন উদ্যোগ – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সময় একটি অভিবাসন আইন পাস করে। এর দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত জাপানিরা কাজ হারায়। এমনকি জাপানিদের সঞ্চিত সম্পদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাজেয়াপ্ত করে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে।
  5. জাপান-মার্কিন সমঝোতার ব্যর্থতা – জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানসূত্র বের করতে সচেষ্ট হয়। এর ফলে ওয়াশিংটনে দুপক্ষের মধ্যে বৈঠক বসে। কিন্তু বৈঠক চলাকালীন জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করে বসে।
  6. পার্ল হারবার আক্রমণ – 1941 সালের ৭ ডিসেম্বর সকালবেলা জাপান পার্ল হারবারের মার্কিন ঘাঁটি আক্রমণ করে। ৬টি বিমানবাহী জাহাজ থেকে ৩৫৩টি জাপানি যুদ্ধবিমান, বোমারু বিমান, টর্পেডো বিমান একযোগে আক্রমণ করে।

ফলাফল

এই আক্রমণের ফলে চারটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ডুবে যায়, চারটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ১৮৮টি মার্কিন বিমান ধ্বংস হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২,৪০২ জন নিহত হয় এবং ১,২৮২ জন আহত হয়।

অপরদিকে, জাপানের ২৯টি যুদ্ধবিমান, ৫টি সাবমেরিন, ৬৫ জন আক্রমণকারী নিহত বা আহত হয়। একজন জাপানি নাবিক কাজু সাকামাকি (Kazuo Sakamaki) বন্দি হন।

এই ঘটনার পরদিন 1941 সালের ৮ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৮ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

আমেরিকার ইতিহাসে পার্ল হারবার ঘটনার গুরুত্ব লেখো

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পার্ল হারবারের ঘটনাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘটনাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে দূরপ্রাচ্যে বিস্তৃত করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে দেয়। এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

পার্ল হারবার ঘটনা

পার্ল হারবার ছিল একটি মার্কিন নৌ-ঘাঁটি। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত এই ঘাঁটিতে মার্কিন নিরাপত্তা ও প্রভাব রক্ষার জন্য নৌ ও বিমানশক্তি বাড়ানো হয়েছিল। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়। বিরোধ মীমাংসার জন্য দুই পক্ষের আলোচনার সময়, 7 ডিসেম্বর 1941 সালে, জাপান পার্ল হারবার ঘাঁটি আক্রমণ করে ও তা ধ্বংস করে দেয়। এই ঘটনাই পার্ল হারবার ঘটনা নামে পরিচিত।

গুরুত্ব

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, পার্ল হারবারের ঘটনায় জাপান নিজের পতনের বীজ নিজেই বপন করেছিল। পরবর্তী সময়ে আণবিক বোমার আঘাতে জাপান আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল।

  • 1941 সালের 7 ডিসেম্বর পার্ল হারবারে বোমা বর্ষণের দিনটি মার্কিন ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন (“a date which will live in infamy”) এবং জাপানের ইতিহাসে সর্বনাশা মূঢ়তার দিন (“a day of supreme folly for Japan”)।
  • এই ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে দূরপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দেয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য করে।
  • এই ঘটনার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষশক্তি বিরোধী মিত্রজোটের অংশীদার হয়।
  • প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের শক্তি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়। জাপান অতি দ্রুত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন উপনিবেশ দখল করে। কিন্তু মার্কিন-অস্ট্রেলীয় নৌবহরের কাছে জাপানি নৌবহর পরাজিত হলে জাপানের দুর্বলতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাহায্য করে ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খুলে দেয়।
  • পার্ল হারবার ঘটনায় অপমানিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নব আবিষ্কৃত আণবিক বোমার ব্যবহার করে জাপানকে বিধ্বস্ত করে দেয়।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, পার্ল হারবারের ঘটনার দ্বারা জাপান নিজের পতনের বীজ নিজে বপন করেছিল। আণবিক বোমার আঘাতে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল জাপান।

ডি-ডে (Day of Deliverance) বা মুক্তিদিবস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

1944 খ্রিস্টাব্দের 6 জুন ফ্রান্সে মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনীর অবতরণের দিন স্থির হয়। এই দিনটিকেই বলা হয়ে থাকে ডি-ডে অর্থাৎ Day of Deliverance বা মুক্তিদিবস।

প্রেক্ষাপট –

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পূর্ব রণাঙ্গনে রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে তীব্র লড়াই চলার সময় সেখানে জার্মান আক্রমণের চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে রাশিয়া মিত্রশক্তির কাছে পশ্চিমদিকে জার্মানির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার দাবি জানায়।

1943 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে পশ্চিম ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার জন্য ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট তেহরানে মিলিত হন। সেখানে রুজভেল্ট প্রস্তাব করেন, মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনীকে নর্ম্যান্ডিতে অবতরণ করানো হবে। তার এই প্রস্তাব ইংল্যান্ড ও রাশিয়া মেনে নেয়।

মার্কিন সেনাপতি আইজেনহাওয়ার-এর নেতৃত্বে উত্তর ফ্রান্সের নর্ম্যান্ডি উপকূলে জার্মানির বিরুদ্ধে রণাঙ্গন খোলা হয়।

মুক্তিদিবস –

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, কানাডা, পোল্যান্ড, নরওয়ে, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের সেনাসমৃদ্ধ মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনী ফ্রান্সের নর্ম্যান্ডি উপকূলে অবতরণ করে। বিশাল এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেন মার্কিন সেনাপতি আইজেনহাওয়ার। সেনা অবতরণের আগের দিন মিত্রপক্ষের হাজারেরও বেশি যুদ্ধবিমান ফ্রান্সের উপকূলের জার্মান ঘাঁটিগুলিতে বোমাবর্ষণ করে। পরের দিন আইজেনহাওয়ার-এর নেতৃত্বে সহযোগী দেশগুলির সম্মিলিত সেনাবাহিনী নর্ম্যান্ডি উপকূলের পাঁচটি স্থানে অবতরণ করে। জার্মানির পক্ষে এই বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করা ছিল অসম্ভব। মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনীর এই অবতরণের দিনটিই (1944 খ্রি., 6 জুন) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে ডি-ডে অর্থাৎ Day of Deliverance বা মুক্তিদিবস নামে পরিচিত।

মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনীর এই সম্মিলিত প্রয়াসের ফলে 1944 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই জার্মানির সৈন্যবাহিনীর ঘাঁটিগুলি বিধ্বস্ত হয়েছিল। এমনকি মিত্রবাহিনী জার্মানির কবল থেকে ফ্রান্সের বিভিন্ন ভূখণ্ড মুক্ত করতেও সক্ষম হয়।

হিরোশিমা – নাগাসাকি ঘটনা বলতে কী বোঝায়?

হিরোশিমা-নাগাসাকি ঘটনা – হিরোশিমা ও নাগাসাকি জাপানের দুটি শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান অক্ষশক্তিভুক্ত দেশ ছিল। মিত্রশক্তিভুক্ত আমেরিকা 1945 খ্রিস্টাব্দের 6 আগস্ট হিরোশিমা ও 9 আগস্ট নাগাসাকির উপর পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে শহর দুটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।

পটভূমি –

  • জার্মানির আত্মসমর্পণ – জার্মানি আত্মসমর্পণ করার (1945 খ্রি., 7 মে) পর মিত্রশক্তি সর্বশক্তি দিয়ে জাপানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
  • পোটসডাম সম্মেলনের ব্যর্থতা – 1945 খ্রিস্টাব্দের 17 জুলাই জার্মানির পোটসডাম শহরে এক সম্মেলনে সমবেত হয়ে মিত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ জাপানকে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের জন্য এক চরমপত্র ঘোষণা করে। কিন্তু জাপান এতে কর্ণপাত করেনি।
  • মিত্রশক্তির দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার ইচ্ছা – মিত্রশক্তি চেয়েছিল যেভাবেই হোক দ্রুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ করতে হবে।
  • হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ – জাপান মিত্রপক্ষের চরমপত্র অগ্রাহ্য করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 6 আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও 9 আগস্ট নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে।

ফলাফল –

  • পরমাণু বোমা নিক্ষেপের পর শহর দুটিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়।
  • জাপানের আত্মসমর্পণ – জাপানের সম্রাট হিরোহিতো (Emperor Hirohito) মিত্রশক্তির কাছে জাপানের আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত জানান। সেই অনুসারে 1945 খ্রিস্টাব্দের 2 সেপ্টেম্বর টোকিও উপসাগরে মিসৌরি (USS Missouri) জাহাজে জাপানের বিদেশমন্ত্রী মামোরু শিগেমিৎসু (Mamoru Shigemitsu) মার্কিন সেনাপতি ডগলাস ম্যাকআর্থার (Douglas MacArthur) – এর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান – জাপানের আত্মসমর্পণের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে (2 সেপ্টেম্বর, 1945 খ্রি.)।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কৌশলগত কী পরিবর্তন লক্ষ করা যায়?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (1939-1945 খ্রি.) আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় এই যুদ্ধ ছিল অনেক বেশি ব্যাপক, ভয়াবহ এবং প্রাণনাশক। এই যুদ্ধে যেসকল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুদ্ধের কৌশলগত পরিবর্তন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কৌশলগত পরিবর্তন –

যুদ্ধপদ্ধতির দিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও অন্যান্য যুদ্ধের তুলনায় অনেক বেশি আধুনিক ছিল।

হিরোশিমা - নাগাসাকি

অস্ত্রশস্ত্র – উন্নত ধরনের বিমান, ডুবোজাহাজ, ট্যাংক প্রভৃতির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান প্যারাসুট বাহিনী আকাশ থেকে ঝাঁপ দিয়ে হল্যান্ডের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। আণবিক বোমার ব্যবহারও এই যুদ্ধের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। জার্মানি থেকে বিতাড়িত বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (Albert Einstein) এর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন সরকার প্রথম পরমাণুশক্তির অধিকারী হয় এবং এই শক্তিকে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করে। পরমাণু বোমা ছিল তৎকালীন সর্বাধিক শক্তিশালী মারণাস্ত্র।

হিরোশিমা-নাগাসাকি ঘটনা – এই ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 1945 সালের আগস্ট মাসে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে, যার ফলে প্রচুর প্রাণহানি ঘটে।

বিমানবাহী জাহাজ – এই যুদ্ধে জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহী জাহাজ ব্যবহার করে, ফলে মাঝসমুদ্রেও বিমান হানা সম্ভব হয়।

ক্ষেপণাস্ত্র – এই যুদ্ধে প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়। জার্মান বিজ্ঞানী ভেরনার ভন ব্রাউন ‘ভি-২’ ক্ষেপণাস্ত্র আবিষ্কার করেন, যা নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছানোর পর নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত করত।

যানবাহন – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিবহনের কাজে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহৃত হতো, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মোটরগাড়ির ব্যাপক ব্যবহার হয়। এই যুদ্ধ ছিল যান্ত্রিক, ফলে সেনাবাহিনীর দ্রুত সচলতা লক্ষ করা যায়।

প্রচার – প্রচারমাধ্যমও এই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। রেডিও, সংবাদপত্র, ইস্তেহার প্রভৃতির মাধ্যমে যুদ্ধকালীন ঘটনার প্রচারের ব্যবস্থাও এই যুদ্ধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুদ্ধে সামরিক তথ্য আদানপ্রদানের জন্য জার্মানি ‘এনিগমা’ যন্ত্র আবিষ্কার করে। পরে ইংল্যান্ড এই যন্ত্রের সাংকেতিক বার্তার অর্থ উদ্ধারে (ডিকোড) সক্ষম হয়।

উন্নত ধরনের যুদ্ধাস্ত্র, পারমাণবিক বোমা, রেডিও প্রভৃতি প্রচারমাধ্যমের ব্যবহার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনেক বেশি ভয়াবহ ও বিধ্বংসী করে তুলেছিল।

বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসের কয়েকটি গুণগত ও পরিমাণগত বদল

1939 থেকে 1945 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় অনেক বেশি ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক রূপে দেখা দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুণগত ও পরিমাণগত বদল পরিলক্ষিত হয়।

  • ব্যাপকতা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল বিধ্বংসী ও ভয়ংকর। 1914 খ্রিস্টাব্দের বলকান সংকটকে কেন্দ্র করে যে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিছক আঞ্চলিক যুদ্ধের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। শীঘ্রই তা একটি ব্যাপক মহাদেশীয় চরিত্র ধারণ করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল আরও আক্রমণাত্মক। এই যুদ্ধ স্থল, জল এবং অন্তরিক্ষ সবক্ষেত্রেই তীব্রভাবে চলেছিল।
  • মারণাস্ত্রের ব্যবহার – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণঘাতী মারণ গ্যাস, ট্যাংক, সাবমেরিন, বোমারু বিমান ইত্যাদি প্রথমবার ব্যবহৃত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ মারণাস্ত্র ছিল পরমাণু বোমা। এই বোমার বিস্ফোরণে হিরোশিমার প্রায় 78,000 এবং নাগাসাকির প্রায় 80,000 জন মানুষ মারা গিয়েছিল।
  • ক্ষয়ক্ষতি – প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় বিশ্বযুদ্ধেই জীবন ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত সেনা ও অসামরিক লোকজনের সংখ্যা ছিল প্রায় 1 কোটি এবং কমপক্ষে 2 কোটি মানুষ আহত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় 5 কোটি মানুষের মৃত্যু হয় এবং প্রায় 8 কোটি মানুষ আহত হয়।
  • ব্যয় – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির দৈনিক মোট খরচ ছিল 24 কোটি ডলার এবং যুদ্ধে মোট ব্যয় হয় 27 হাজার কোটি ডলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল 1 লক্ষ 11 হাজার 700 কোটি ডলার, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় অনেক বেশি ছিল।

বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই যুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতি থেকে পুরোপুরি রেহাই পায়নি। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বা উপনিবেশসমূহ প্রত্যেকের জনবল ও ধনবলের অপচয় ঘটে।

আধুনিক মারণাস্ত্রগুলি কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ভয়ংকর করে তুলেছিল সংক্ষেপে লেখো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অধিক ভয়াবহ করে তুলেছিল বিভিন্ন প্রকারের আধুনিক মারণাস্ত্রের ব্যবহার। আধুনিক মারণাস্ত্রের ব্যাপকতা, প্রয়োগ পদ্ধতি, এবং বৈচিত্র্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ও ভয়াবহ হত্যালীলায় পরিণত করেছিল।

আধুনিক মারণাস্ত্রের প্রয়োগ ও ভয়াবহতা –

  • উন্নত মারণাস্ত্র – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রথমবারের জন্য প্রাণনাশক মারণ গ্যাস, ট্যাংক, সাবমেরিন, বোমারু বিমান ব্যবহৃত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এগুলির সাথে আরও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র যুক্ত হয়েছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে আরও ভয়াবহ করে তোলে।
  • মারণাস্ত্রের প্রয়োগ – 1939 খ্রিস্টাব্দের 1 সেপ্টেম্বর জার্মান বাহিনী পোল্যান্ডের পশ্চিম সীমান্ত পথে পোল্যান্ডের উত্তর আর দক্ষিণ দুই দিক থেকেই সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। জার্মানির মোটর ও ট্যাংকবাহিত স্থলবাহিনী, দূরপাল্লার কামান ও বিমানবাহিনীর আক্রমণে পুরোনো ধরনের অস্ত্রে সজ্জিত পোল্যান্ডের সৈন্যবাহিনীকে প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়।
  • জার্মান ইউ-বোট বা ডুবোজাহাজের আক্রমণ – জার্মান ইউ-বোটের ব্যাপক আক্রমণে বহু ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজের সলিলসমাধি ঘটে। বিখ্যাত ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ কারেজার্স এবং রয়্যাল ওক এই পর্বে জার্মান সাবমেরিনের আক্রমণে ডুবে যায়।
  • জার্মানির প্যান্জার বাহিনী ও প্যারাসুট বাহিনীর আক্রমণ – 1940 খ্রিস্টাব্দের 9 জুলাই জার্মানির যান্ত্রিক বা প্যান্জার বাহিনী ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে ঢুকে পড়ে এবং বন্দর ও বিমানক্ষেত্রগুলি দখল করে নেয়। জার্মানির প্যারাসুট বাহিনী আকাশপথে ও জলপথে নরওয়েতে অবতরণ করে নরওয়ে অধিকার করে। জার্মান প্যারাসুট বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
  • পরমাণু বোমা – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ মারণাস্ত্র ছিল পরমাণু বোমা। বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের তাত্ত্বিক আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে মার্কিন সরকার পরমাণুশক্তির অধিকারী হয় এবং এই শক্তিকে ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করে। জাপানি শিল্পশহর হিরোশিমা ও নাগাসাকির উপর বিশ্বের সর্বপ্রথম পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে শহর দুটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
আধুনিক মারণাস্ত্রগুলি কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ভয়ংকর করে তুলেছিল সংক্ষেপে লেখো?

ফলাফল – এইসব মারণাস্ত্রের প্রয়োগের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় 50 মিলিয়ন এবং আহত হয়েছিল প্রায় 40 মিলিয়ন মানুষ। পারমাণবিক বোমার ক্ষতিকারক প্রভাবে বর্তমানেও জাপানে অনেক বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি (Axis Power)-র ভূমিকা সংক্ষেপে লেখো।

1936 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ইতালি ও জার্মানির মধ্যে ‘রোম-বার্লিন অক্ষচুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। 1936 খ্রিস্টাব্দের 25 নভেম্বর জাপান ‘কমিন্টার্ন-বিরোধী চুক্তি’ (Anti-Comintern Pact) স্বাক্ষর করে। ফলে ইতালি-জার্মানি-জাপান এই তিন রাষ্ট্রের জোট গড়ে ওঠে। এই জোটকে ‘রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তি’ (Rome-Berlin-Tokyo Axis) জোট বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই জোট আক্রমণকারীর ভূমিকা পালন করে।

অক্ষশক্তি জোটের শর্ত –

  • এই তিনটি দেশের (ইতালি, জার্মানি ও জাপান) কোনো একটি দেশ অন্য কোনো চতুর্থ শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলে পরস্পরকে সাহায্য করবে।
  • এই চুক্তি পরবর্তী 10 বছর (1937-1947 খ্রি.) কার্যকর থাকবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির ভূমিকা –

  • জার্মানির ভূমিকা – অক্ষশক্তিভুক্ত দেশ জার্মানি 1939 খ্রিস্টাব্দের 1 সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করে। 3 সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। এছাড়া 1940 খ্রিস্টাব্দে জার্মানি, ডেনমার্ক, নরওয়ে, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড আক্রমণ করে। তারপর 1941 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া আক্রমণ করে ও পরাজিত হয়। 1945 খ্রিস্টাব্দের 7 মে জার্মানি আত্মসমর্পণ করে।
  • ইতালির ভূমিকা – অক্ষজোটভুক্ত ইতালি রাজ্যলাভ বা উপনিবেশ বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। 1940 খ্রিস্টাব্দের 10 জুন ইতালি ফ্রান্স আক্রমণ করে এবং দক্ষিণ ফ্রান্স দখল করে। এরপর ইতালীয় বাহিনী উত্তর আফ্রিকা অভিযান করে। উত্তর আফ্রিকার ব্রিটিশ উপনিবেশ মিশর এবং ফরাসি উপনিবেশ লিবিয়া জয়ের জন্য আক্রমণ চালায়। জার্মান সেনাপতি রোমেল এবং জার্মান বিমানবাহিনী যুক্ত হলেও ইতালীয় অভিযান ব্যর্থ হয় এবং মুসোলিনি নিহত হন। এরপর ইতালির নতুন সরকার মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় (3 সেপ্টেম্বর, 1943 খ্রি.)।
  • জাপানের ভূমিকা – জাপান 1941 খ্রিস্টাব্দে ইন্দোচিন দখল করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন ও ইন্দোচিন থেকে জাপানি সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। এতে বিক্ষুব্ধ জাপান 1941 খ্রিস্টাব্দের 7 ডিসেম্বর প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মার্কিন নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবার ধ্বংস করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 1945 খ্রিস্টাব্দের 6 ও 9 আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির উপর পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে। এর ফলে 1945 খ্রিস্টাব্দের 2 সেপ্টেম্বর জাপান আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।

জাপান অতি দ্রুত কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস দ্বীপপুঞ্জ, থাইল্যান্ড, ব্রহ্মদেশ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে ইউরোপে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয় এবং মিত্রবাহিনী জয়ী হতে থাকে। তখন দেশরক্ষার জন্য জাপানি বাহিনী দেশে ফিরে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নব আবিষ্কৃত পরমাণু বোমা জাপানের উপর বর্ষণ করে জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে (2 সেপ্টেম্বর, 1945 খ্রি.)।

পরিশেষে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটনে অক্ষশক্তি জোটের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। কারণ এই জোটের অন্তর্গত জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, তেমনই জাপানের আত্মসমর্পণের দ্বারাই এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের কারণ লেখো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (1939-1945 খ্রি.) হয়েছিল দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তিজোটের মধ্যে। এই দুই গোষ্ঠীর একদিকে ছিল মিত্রশক্তি জোট এবং অপরদিকে ছিল জার্মানি, ইতালি ও জাপানের অক্ষশক্তি জোট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল –

পরাজয়ের কারণ –

  1. দুই শিবিরের লক্ষ্যগত পার্থক্য – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি ছিল আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন এবং গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের বিরোধী। অন্যদিকে মিত্রশক্তি ছিল শান্তি, নিরাপত্তা ও গণতন্ত্রের পক্ষে। এই লক্ষ্যগত পার্থক্যই অক্ষশক্তিকে বিশ্ববাসীর সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত করেছিল।
  2. সম্পদগত পার্থক্য – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির প্রচুর শক্তিসম্পদ অক্ষশক্তির পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল। বহু উপনিবেশের অধিকারী ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পক্ষে দীর্ঘকাল যুদ্ধ চালানো সম্ভব হলেও জার্মানি, ইতালি ও জাপানের সেই সুযোগ ছিল না।
  3. ভৌগোলিক অবস্থানগত দুর্বলতা – কোনো যুদ্ধে একবার পরাজিত হয়ে পিছিয়ে এসে পুনরায় আক্রমণ করা জার্মানির পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ রাশিয়ার মতো জার্মানির বিস্তৃত ভূভাগ ছিল না। সেজন্য জার্মানি সর্বদা আক্রমণাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তা ছাড়া জার্মানির দুই সীমান্তে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়েছিল ফ্রান্স ও রাশিয়া। তাই জার্মানিকে সর্বদা এই দ্বিমুখী আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে যুদ্ধ করতে হত।
  4. হিটলারের আচরণ – হিটলারের উদ্ধত, খামখেয়ালি, সন্দেহপ্রবণ আগ্রাসী মনোভাব অক্ষশক্তির পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল। যুদ্ধে নাৎসি বাহিনী পরাজিত হতে থাকলে দেশের অভ্যন্তরে নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও ঘৃণার প্রকাশ লক্ষ করা যায়।
  5. ব্রিটিশ যুদ্ধে ব্যর্থতা – হিটলার ফ্রান্স জয়ের পর ব্রিটেনের উপর তীব্র আক্রমণ চালান। কিন্তু ব্রিটেনকে তিনি পরাজিত করতে পারেননি। বহু ক্ষতি স্বীকার করেও ব্রিটেন পাল্টা আক্রমণ করে জার্মানির ক্ষতি করে।
  6. রাশিয়া আক্রমণে ব্যর্থতা – হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করে প্রাথমিক সাফল্য লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। রাশিয়া ‘পোড়ামাটির নীতি’ অনুসরণ করে প্রবল প্রতিরোধ দ্বারা জার্মান আক্রমণের মোকাবিলা করে।
  7. যুদ্ধাস্ত্র – অস্ত্রের গুণমান বিচারে জার্মানি খুব উন্নত ছিল। কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে ইঙ্গ-মার্কিন অস্ত্রসম্ভার বিপুল ছিল। আণবিক বোমা তৈরিতে জার্মানির অসম্পূর্ণতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্য, জার্মানি জেট রকেটের বদলে ভি রকেট তৈরিতে গুরুত্ব দান এবং নৌবাহিনীর এয়ারফোর্সের অভাব অক্ষশক্তির সামরিক দুর্বলতা সৃষ্টি করে।
  8. আমেরিকার যোগদান – আমেরিকা যুদ্ধের প্রথম থেকেই অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। পরে জাপানের আক্রমণে মার্কিন নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবার ধ্বংস হলে আমেরিকা বিপুল শক্তি নিয়ে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যোগ দেয়। ফলে অক্ষশক্তির পরাজয় নিশ্চিত হয়ে পড়ে।

অক্ষশক্তির পরাজয়ের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্বে মিত্রপক্ষের দেশগুলোর প্রভাব ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়।অক্ষশক্তির পরাজয়ের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্বে মিত্রপক্ষের দেশগুলির প্রভাব ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান কীভাবে হয়েছিল?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান – 1939 খ্রিস্টাব্দে হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে যে বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল 1945 খ্রিস্টাব্দে জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সেই যুদ্ধের অবসান ঘটে। মূলত তিনটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই পর্যায় তিনটি হল –

  1. প্রথম পর্যায়- ইতালির পতন – 1943 খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মিত্রশক্তি রোম অধিকার করলে ইতালীয় কমিউনিস্টরা মুসোলিনি ও তাঁর উপপত্নী ক্লারা পেত্রাচ্চিকে হত্যা করে। নতুন সরকার মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ইতালি বিদায় নেয়।
  2. দ্বিতীয় পর্যায়- জার্মানির পতন – ইতালির পতনের পর মিত্রশক্তি জার্মানির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলে (6 জুন, 1944 খ্রি.) এবং নর্ম্যান্ডি অভিযান শুরু করে। পূর্বদিক থেকে রাশিয়ার দ্বারা এবং পশ্চিম দিক থেকে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি বাহিনীর দ্বারা জার্মানি আক্রান্ত হয়। বার্লিনের পতন ঘটে। হিটলার আত্মহত্যা করেন (30 এপ্রিল, 1945 খ্রি.)। এরপর অ্যাডমিরাল ডোনিটজ আত্মসমর্পণ করলে জার্মানির পতন ঘটে ও ইউরোপে যুদ্ধের অবসান হয় (8 মে, 1945 খ্রি.)।
  3. তৃতীয় পর্যায়- জাপানের পতন – 1945 খ্রিস্টাব্দের 6 ও 8 আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করলে বহু নিরীহ মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনার পর 2 সেপ্টেম্বর জাপান আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান আকস্মিকভাবে হয়নি। অক্ষশক্তির তিনটি প্রধান শক্তি বা ইতালি, জার্মানি, ও জাপানের পতনের সাথে সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান আকস্মিকভাবে হয়নি। অক্ষশক্তির তিনটি প্রধান শক্তি বা ইটালি, জার্মানি, ও জাপানের পতনের সাথে সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রকৃত বিশ্বজনীন রূপটি লেখো।

বিশ্ব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। 1939 খ্রিস্টাব্দের 1 সেপ্টেম্বর হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ থেকে শুরু করে 1945 খ্রিস্টাব্দের 2 সেপ্টেম্বর জাপানের আত্মসমর্পণের সময়কালের মধ্যে এই যুদ্ধের প্রকৃত বিশ্বজনীন রূপটি ধরা পড়ে।

বিশ্বজনীন রূপ – বিশ্বযুদ্ধ নামকরণের মধ্যে এই যুদ্ধের বিশ্বজনীন রূপটি ধরা পড়ে। তা ছিল-

  1. বিস্তার – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জলে-স্থলে- অন্তরিক্ষে বিস্তৃত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় এই যুদ্ধে বিস্তারের ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়।

এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড আক্রান্ত হয়েছিল। রাশিয়ার অভ্যন্তরে জার্মান বাহিনী ঢুকে পড়ে। উত্তর আফ্রিকায় তীব্র যুদ্ধ হয়। ভূমধ্যসাগর জার্মানি ও ইতালির নিয়ন্ত্রণে আসে। গ্রিস আক্রান্ত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ (থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস, ব্রহ্মদেশ), আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ জাপান জয় করে।

এভাবে প্রায় সবকটি মহাদেশে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে কয়েকটি রাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেও তাদের মিত্র বা উপনিবেশগুলি এই যুদ্ধে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে।

এ ছাড়া এই সময় বিমানবহর উন্নত হয়েছিল। পৃথিবীর সর্বত্র দুই পক্ষের বিমানবহরের আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ চলে। নৌবহর সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। উত্তর সাগর, আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর, ভূমধ্যসাগর দু-পক্ষের নৌবহরের যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে ওঠে। আর এই সময় মোটরগাড়ি ব্যাপক চালু হওয়ায় স্থলবাহিনীর চলাচলের গতি বাড়ে।

  1. ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতি – যুদ্ধ মানে ধ্বংস এবং জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি। এই যুদ্ধে ইউরোপের প্রায় প্রত্যেকটি দেশ ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জার্মান আক্রমণ ও পোড়ামাটি নীতির জন্য রাশিয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলি দু-পক্ষের যুদ্ধক্ষেত্র হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার নৌ-ঘাঁটিটি ধ্বংস হয়ে যায়। মার্কিন আণবিক বোমা বর্ষণে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু প্রাণহানি ঘটে। এই যুদ্ধে প্রায় 5 কোটি মানুষ নিহত ও 4 কোটি মানুষ আহত হয়। খরচ হয় প্রায় 1 লক্ষ 11 হাজার 700 কোটি ডলার। এ ছাড়া ধ্বংস হওয়া সম্পদের পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বেশি ছিল।
  2. প্রভাব – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতির ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। আর্থিক অভাব, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি মানুষকে অসহনীয় দুর্দশার মধ্যে ফেলে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিরোধী গণমত প্রবল আকার ধারণ করে।

বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

1939 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং 1945 খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়। বিশ্ব ইতিহাসে এই 6 বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ছিল সীমাহীন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব

  1. সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (United Nations Organisation) প্রতিষ্ঠা – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বিশ্বের শক্তিকামী নেতৃবৃন্দ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হন। বিভিন্ন সম্মেলন ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ (United Nations Organisation) প্রতিষ্ঠিত হয়।
  2. সাম্যবাদের প্রভাব বৃদ্ধি – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্যবাদী শক্তি হিসেবে রাশিয়ার ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি পায়। রাশিয়া পরমাণু শক্তিধর দেশে পরিণত হয়।
  3. ঠান্ডা লড়াই (Cold War)-এর সূচনা – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার সহযোগী রাষ্ট্রজোট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী রাষ্ট্রজোটের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং ঠান্ডা লড়াই (Cold War)-এর সূচনা হয়। দু-পক্ষই সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধ বা স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত হয়।
  4. মুক্তি আন্দোলনের প্রসার – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ভারত (1947), শ্রীলঙ্কা (1947), ইন্দোনেশিয়া (1949), লিবিয়া (1952), মরক্কো (1956), কেনিয়া (1963) প্রভৃতি দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।

পরাধীন দেশগুলির উপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কী প্রভাব পড়েছিল?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের বিলোপসাধন। এই সময়কালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। অনেক পরাধীন দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

প্রতিশ্রুতিভঙ্গের ফলে সৃষ্ট হতাশা –

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা প্রভৃতি দেশ তাদের উপনিবেশগুলিকে নানাভাবে (সৈন্য, অর্থ, রসদ ইত্যাদি জোগাড় করা) ব্যবহার করেছিল এবং যুদ্ধশেষে তাদের মুক্তিপ্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হলে উপনিবেশগুলিতে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং তাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।

জাতীয় মুক্তি আন্দোলন –

  • ভারত – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে এবং 1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
  • বার্মা (মায়ানমার) – বার্মাও ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। 1948 খ্রিস্টাব্দে বার্মা একটি স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে।
  • সিংহল (শ্রীলঙ্কা) – 1948 খ্রিস্টাব্দে ‘সিংহল স্বাধীনতা আইন’ দ্বারা সিংহল স্বাধীনতা লাভ করে এবং তার নতুন নামকরণ হয় ‘শ্রীলঙ্কা’।
  • ইন্দোনেশিয়া – ইন্দোনেশিয়া ওলন্দাজ বা ডাচদের উপনিবেশ ছিল। 1927 খ্রিস্টাব্দ থেকে ড. সুকর্ণর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। অবশেষে 1949 খ্রিস্টাব্দে জাতিপুঞ্জের মধ্যস্থতায় ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।

এ ছাড়াও ইন্দোচিন, লিবিয়া, মরক্কো, কেনিয়া প্রভৃতি নানা দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।

আটলান্টিক সনদে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলা হয়। ফলে পরাধীন জাতিগুলি মুক্তির বাণী শুনেছিল। যুদ্ধশেষে তাই এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার বহু দেশে গণ আন্দোলন দেখা দেয়, একে একে তারা স্বাধীনতা লাভ করে। এভাবে তৃতীয় বিশ্বের সৃষ্টি হয়।

‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’ কাকে বলে? উগ্র জাতীয়তাবাদ গ্রহণযোগ্য নয় কেন?

উগ্র জাতীয়তাবাদ

জাতীয়তাবাদ একটি মহান রাজনৈতিক আদর্শ। কিন্তু এই জাতীয়তাবাদ যখন আদর্শভ্রষ্ট হয়ে সংকীর্ণ স্বাদেশিকতায় পরিণত হয় এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রচার করে, তখন তাকে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’ বলা হয়।

গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণ

  1. সাম্রাজ্যবাদের স্রষ্টা – উগ্র জাতীয়তাবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদের স্রষ্টা। ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি উগ্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায় উন্মত্ত হয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দুর্বল ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলি দখল করে সাম্রাজ্যবিস্তার করে।
  2. জাতিবিদ্বেষ প্রচার – উগ্র জাতীয়তাবাদ নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে এবং অন্য জাতিকে ঘৃণা করে। এর ফলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতার বন্ধন নষ্ট হয়ে যায়। জার্মানির হিটলার জার্মানদের প্রকৃত আর্য বলে প্রচার করে অনেক জাতির স্বাধীনতা হরণ করেছিলেন।
  3. জাতির মধ্যে কূপমণ্ডুকতা সৃষ্টি করে – উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতির মধ্যে কূপমণ্ডুকতা সৃষ্টি করে। কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা নিজেদের সবকিছুকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অন্ধ উন্মাদনায় অন্যান্য জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান গ্রহণের মানসিকতা নষ্ট করে ফেলে। ফলে তাদের অগ্রগতির পথ বন্ধ হয়ে যায়।
  4. আন্তর্জাতিকতাবাদ বিরোধী – উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরোধী। কারণ আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে সহযোগিতার আদর্শে বিশ্বাস করে। এই বিভিন্ন জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তা গ্রহণ করতে শেখায়।
  5. বিশ্বশান্তির পরিপন্থী – উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তির পরিপন্থী। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা নিজের দেশের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য অন্য দেশ আক্রমণ করতে ও দখল করতে পিছপা হয় না। উগ্র জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবক্তা ইতালির মুসোলিনি বলতেন ‘স্ত্রীলোকের কাছে মাতৃত্ব যেমন স্বাভাবিক, পুরুষের কাছে যুদ্ধও তেমনি স্বাভাবিক।’ তিনি বিশ্বশান্তিকে ‘কাপুরুষের স্বপ্ন’ বলে পরিহাস করতেন।

‘উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী’ -ব্যাখ্যা করো।

উগ্র জাতীয়তাবাদ

উগ্র জাতীয়তাবাদ হল এমন একটি আদর্শ যেখানে একটি জাতির জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ রূপ ধারণ করে। তখন তারা নিজের জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করে এবং এর পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগুলিকে নিকৃষ্ট বলে মনে করে। এইরূপ জাতীয়তাবাদকে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’ বলা হয়।

আন্তর্জাতিকতাবাদ

বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ফলে মানুষের মধ্যে এক বিশেষ মানসিক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। মানুষ তার নিজের ঐক্যবোধ ও আনুগত্যকে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে যখন বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়, তখন সেই ব্যাপক মানসিকতাকে বলা হয় ‘আন্তর্জাতিকতাবাদ’।

পরিপন্থী আদর্শ

  1. জাত্যাভিমান – উগ্র জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ জাত্যাভিমানকে উৎসাহিত করে। এইরকম জাত্যাভিমানযুক্ত জাতি বিশ্বাস করে যে তার ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতা পৃথিবীর অন্যান্য জাতির ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আন্তর্জাতিকতাবাদ বিভিন্ন জাতির ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করে।
  2. যুদ্ধের সূচনা – উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতিতে জাতিতে যুদ্ধের সূচনা করে। সবল জাতি দুর্বল জাতির স্বাধীনতা ও সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে। আন্তর্জাতিকতাবাদে জাতির স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে।
  3. আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়নীতি – উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ রাষ্ট্রনেতাগণ আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়নীতিকে অবজ্ঞা করে বা তার বিরোধী আচরণ করে। আন্তর্জাতিকতাবাদ আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়নীতি মেনে চলার শিক্ষা দেয়।

পরিশেষে বলা যায়, জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বলা হয়, ‘জাতীয়তাবাদের রাজপথ ধরেই আন্তর্জাতিকতাবাদে পৌঁছানো যায়।’ কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যুদ্ধের পর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের লক্ষ্য ছিল বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা। যুদ্ধের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রসার ঘটে।


আজকের এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর ইতিহাসের ষষ্ঠ অধ্যায়, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তারপর” অধ্যায়ের কিছু বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য বা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকে, তবে টেলিগ্রামে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Share via:

মন্তব্য করুন