আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি কবিতায় কবি শঙ্খ ঘোষ বিশ্বব্যাপী চলমান যুদ্ধ, শান্তিহীনতা, দারিদ্র্য, বৈষম্য ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদী মুখরতা তুলে ধরেছেন। কবি বিশ্বাস করেন, এই সকল প্রতিকূলতা মোকাবিলায় মানুষের ঐক্যই একমাত্র শক্তি। তাই তিনি সমস্ত মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি। — কবির এই আহ্বানের প্রয়োজনীয়তা কবিতা অবলম্বনে লেখো।
- অস্থির সংকটকালের ছবি – শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় অস্থির সময়ে মানুষের সংকটের ছবিকে তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক আদর্শহীনতা যেমন মানুষকে ঠিক পথ দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে তেমনই সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মান্ধতার মতো অসুখ সমাজকে রক্তাক্ত করছে। অস্তিত্বের সংকটে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে মানুষ। আমাদের পথ নেই কোনো/আমাদের ঘর গেছে উড়ে/আমাদের শিশুদের শব/ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে।
- প্রকৃত ইতিহাসহীনতা – এই সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রেরণা সংগ্রহ করার মতো কোনো ইতিহাসও আমাদের নেই। কারণ ক্ষমতাবান শাসকেরা যে ইতিহাস আমাদের উপহার দিয়েছে তা বিকৃত এবং তাদের মতো করে গড়ে তোলা। এখানে ‘ভিখারি’ হয়ে বেঁচে থাকাটাই মানুষের নিয়তি।
- মুক্তির পথ সন্ধান – এই হতাশার মধ্যেই মুক্তির পথ খুঁজেছেন কবি। তাঁর মনে হয়েছে, কোথাও কিছু না থাকলেও এমন কিছু মানুষ এখনও সমাজে রয়েছে যারা তৈরি করবে সম্প্রীতির এবং সৌভ্রাতৃত্বের পথ। সেকারণেই দরকার পরস্পরের হাত ধরা। কোনো পথ দেখতে না পাওয়ার সময়ে হাতে হাত রেখে বেঁধে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় কবির সমাজভাবনার যে প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় লেখো।
- আর্দশহীনতা – কবিকে ব্যথিত করেছেরাজনৈতিক আদর্শহীনতা। ডান দিকে ধস আর বাম দিকে গিরিখাত জীবনের চলার পথকেই দুর্গম করে তোলে। মাথার ওপরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাণ্ডব, চারপাশে ধর্মান্ধতা, মধ্যযুগীয় বর্বরতা ইত্যাদি যেন ক্রমশই পথকে ধূসর করে দেয়। মৃত্যুর আতঙ্ক তাড়া করে সব মানুষকেই।
- প্রকৃত ইতিহাসের অভাব – যে জাতীয়তার ধারণা মানুষের সঙ্গে মানুষকে আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধতে পারত তা-ও বিরল। কারণ, আমাদের ইতিহাস নেই। তাই ইতিহাসের সত্যকে মানুষ পায় না, যা তাদের পথ দেখাতে পারে। ক্ষমতাবান শাসকেরা নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের মতো করে ইতিহাস তৈরি করে নেয়। সাধারণ মানুষ সেখানে উপেক্ষিত হয়।- আমাদের কথা কে-বা জানে/ আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।
- মানব মৈত্রীর সেতুবন্ধন – তবুও কিছু মানুষ থেকে যায়, মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তার সেতুবন্ধ তৈরি করাই যাদের কাজ। শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘এ আমরা কী করছি’ গদ্যরচনায় লিখেছিলেন- আমাদের রাষ্ট্রনায়কেরা এমন এক মুঢ় অহমিকা প্রকট করে তুলতে চাইছেন দেশবাসীর মনে, ফ্যাসিবাদ যার সুনিশ্চিত পরিণাম। অথচ আজও মানুষের মনে এক স্বাভাবিক মিলনক্ষুধা আছে, এক দেশের মানুষকে আর-এক দেশের মানুষ অন্তরঙ্গ ভালোবাসাতেই জড়িয়ে নিতে চায় আজও। এই ভালোবাসা আর মানবমৈত্রীর কথাই কবি উচ্চারণ করেছেন ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায়।
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি – কবিতায় কবিচেতনার কোন্ অভিনবত্ব লক্ষ করা যায় আলোচনা করো।
- মনুষ্যত্বের বার্তা প্রকাশ – চারপাশের অশান্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি রচিত। রাষ্ট্রীয় ভণ্ডামি, সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার, ধর্মীয় উগ্রতা এবং ক্রমশ চেপে বসা আদর্শহীনতা-ইত্যাদির বিস্তার কোনো পথের সন্ধান দেয় না, বরং এক আশ্রয়হীনতার দিকে নিয়ে যায়। মানুষ ক্রমশই যেন অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। যে ইতিহাস প্রেরণা হতে পারত, তা-ও ক্ষমতাবানদের দ্বারা বিকৃত।
- একতার বার্তা – এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীতে টিকে থাকাটাই সন্দেহের। তবুও পারস্পরিক মিলনের পথ ধরেই মানুষকে চলতে হবে। একতাই পারে এই সংকট থেকে মানুষকে মুক্ত করতে। সেই একতার কথাই কবি এখানে বলেছেন।
- অনবদ্য প্রকাশশৈলী – মনুষ্যত্বের এই বার্তাকে প্রকাশ করা যদি কবিতার বিষয় হয়, তাহলে তাকে রূপ দিতে গিয়ে এক অনায়াস শব্দশৈলী ও প্রকাশরীতি কবি অনুসরণ করেছেন। লক্ষ করার মতো বিষয় হল, কবিতায় অন্ত্যমিল থাকলেও তা হয়েছে দ্বিতীয়-র সঙ্গে চতুর্থ, ষষ্ঠ-র সঙ্গে অষ্টম-এই ধারা মেনে। উত্তমপুরুষের জবানিতে কথা বলায় কবি যেন সব মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন।
- উপসংহার – শব্দ ব্যবহারে জটিলতা এড়িয়ে তিনি কবিতাকে আন্তরিক করে তুলেছেন। সময়ের বিপন্নতা, আর তা থেকে মুক্তির চেষ্টা-দুটোই তাই আবেগময় হয়ে উঠেছে।
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি – এই পঙ্ক্তিটির পুনরাবৃত্ত হওয়ার কারণ কবিতাটি অবলম্বনে আলোচনা করো।
- তাৎপর্য – ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার নামটিই পঙ্ক্তি হিসেবে কবিতায় দুবার ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কবিতার দুটি স্তবক এবং স্তবকের শেষ পঙক্তি হিসেবেই আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি শব্দবন্ধটি এসেছে। সমগ্র বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে এই পঙক্তি দুটি আলাদা তাৎপর্য বহন করে।
- একতার প্রয়োজনীয়তা – কবিতার প্রথম স্তবকে ডান পাশে ধ্বংস আর বাঁ-দিকে গিরিখাদ-এর উল্লেখে কবি বোঝাতে চেয়েছেন পথের দুর্গমতা। এই পথ আসলে সভ্যতার পথ। সেখানে মাথার উপরে বোমারু বিমান। এই পথ চলার মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে আসে নিরাশ্রয়তা। শিশুমৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। সেই মৃত্যুভয় সমস্ত মানুষকেই তাড়া করে। আর তখনই কবি উপলব্ধি করেন যে, আমাদের অন্য কোনো বিকল্প নেই। বেঁচে থাকার একটাই উপায় আছে। আর তা হল ঐক্যের এবং সম্প্রীতির। সেজন্যই আমাদের বেঁধে বেঁধে থাকতে হবে।
- সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা – দ্বিতীয় স্তবকে কবি এনেছেন সভ্যতার অন্তঃশূন্যতার কথা। সাধারণ মানুষের সেখানে স্বীকৃতি নেই। ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাবানরা। ফলে তৈরি হয় সাধারণ মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস। তাদের কৃপাপ্রার্থী হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। যুদ্ধ-ধ্বংস-প্রবঞ্চনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পৃথিবীর অস্তিত্বই সেখানে সংশয়ের সামনে পড়ে। মানুষের সভ্যতাকে রক্ষার জন্য তাই দরকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
- উপসংহার – এভাবে মৃত্যু আর বিনষ্টিকে অতিক্রম করে কবি আসলে শোনাতে চেয়েছেন একতার ও সম্প্রীতির প্রয়োজনের কথা। ধ্বংসোম্মুখ সভ্যতার বিশল্যকরণী তা। এই তাৎপর্যেই আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি। পঙক্তি পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন কবি। এটিই হয়ে উঠেছে কবিতার মূল সুর।
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি কবিতাটি একটি অসাধারণ প্রেরণাদায়ক কবিতা। এই কবিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের প্রতি একাত্মতার আহ্বান জানায়। এই কবিতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য মানুষের প্রতি প্রেরণা যোগায়। এই কবিতা বিশ্বাস করে যে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করলেই মানুষ একটি সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে পারে।