দশম শ্রেণি – বাংলা – প্রলয়োল্লাস (কবিতা) কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলামের “প্রলয়োল্লাস” কবিতাটি রচিত হয়েছে ১৯২১ সালে। এটি “অগ্নিবীণা” কাব্যের অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটিতে কবি প্রলয়ের আগমনকে স্বাগত জানান। তিনি মনে করেন, প্রলয়ের মধ্য দিয়েই নব সৃষ্টির সূচনা হয়।

কবিতাটিতে কবি প্রলয়ের রূপ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, প্রলয়ের আগমনী বার্তা নিয়ে কালবৈশাখী ঝড় এসেছে। ঝড়ের ঝাপটায় স্তব্ধ হয়ে গেছে প্রকৃতি। ঝড়ের তীব্রতায় ভয় পেয়েছেন মানুষ। কিন্তু কবি প্রলয়ের আগমনকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, প্রলয়ের মধ্য দিয়েই জীর্ণ-শীর্ণ অচলায়তন ধ্বংস হয়ে যাবে। নতুন সৃষ্টির সূচনা হবে।

কবি প্রলয়কে “নূতন” এর প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। তিনি মনে করেন, প্রলয়ের মধ্য দিয়েই নতুন ধারণা, নতুন চেতনা, নতুন জীবনের সূচনা হয়। তাই কবি প্রলয়ের আগমনকে “জয়” বলে অভিবাদন জানান।

কবিতাটিতে কবি তার বিদ্রোহী মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে নতুন জীবনের সূচনা করতে চান। তাই তিনি প্রলয়ের আগমনকে স্বাগত জানান।

কবিতাটিতে কবি তার স্বদেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, প্রলয়ের মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন হবে। তাই তিনি প্রলয়ের আগমনকে “জয়” বলে অভিবাদন জানান।

কবিতাটিতে কবি প্রলয়ের সৌন্দর্যকেও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, প্রলয়ের মধ্য দিয়েই নতুন সূর্যের উদয় হয়। তাই তিনি প্রলয়কে “মধুর” বলে অভিবাদন জানান।

“প্রলয়োল্লাস” কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের একটি অসাধারণ কবিতা। এটি বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্য সম্পদ।

দশম শ্রেণি – বাংলা – প্রলয়োল্লাস

কবি পরিচিতি

ভূমিকা – কবি নজরুল ছিলেন দুরন্ত যৌবনের দূত। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নজরুল সম্বন্ধে বলেছেন, নজরুলের মধ্যে যৌবনদীপ্ত বাঙালির সেই আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হল। (অনিঃশেষ নজরুল, কথাসাহিত্য, কাজী নজরুল সংবর্ধনা সংখ্যা)।

জন্ম – পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে কবির জন্ম। তাঁর ডাকনাম দুখুমিঞা। বাবা কাজী ফকির আহমেদ ও মা জাহেদা খাতুন। ছেলেবেলাতেই তাঁর বাবা মারা যান।

কর্মজীবন – চাকরের কাজ থেকে শুরু করে ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে যোগদান পর্যন্ত বিভিন্ন পেশার মধ্য দিয়ে তিনি জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। পরাধীন ভারতে ইংরেজ শাসন ও শোষণ, ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক উৎপীড়ন দেখে নজরুল প্রতিবাদে মুখর হন এবং কলম ধরেন।

সাহিত্যজীবন – নজরুলের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতাটির নাম ‘মুক্তি’। প্রথমদিকে তাঁর গল্পই পাঠকদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়। এই সময়ে লেখা নজরুলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্প হল- ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি’, ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’ ইত্যাদি। সেনাবাহিনী থেকে ফিরে আসার পর মোসলেম ভারত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে নজরুলের পত্রোপন্যাস বাঁধনহারা। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ধুমকেতু পত্রিকা। স্বাধীনতার সপক্ষে কবির লড়াকু লেখা তখন দেশবাসীর মধ্যে প্রবল উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল। ওই বছরেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই বইটির প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। ধুমকেতু-তে ‘আনন্দময়ীর আগমনে‘ লেখার জন্য কবিকে গ্রেফতার করা হয়। এক বছর পর কারামুক্ত হলে কবি কুমিল্লায় আসেন। লাঙল পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘সাম্যবাদী’। পরে গণবাণী পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতির প্রকাশে কবির রাজনৈতিক চেতনা যেন নতুন রূপ লাভ করে। এ ছাড়াও কবির কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হল- দোলনচাঁপা (১৯২৩), বিষের বাঁশী (১৯২৪), ভাঙার গান (১৯২৪), ছায়ানট (১৯২৫), সর্বহারা (১৯২৬), ফণীমনসা (১৯২৭), প্রলয়শিখা (১৯৩০)। ঠুমরি, গজল, কীর্তন, ভাটিয়ালি ইত্যাদি নানা ধরনের গান রচনায়, এমনকি সুরসৃষ্টিতেও নজরুল তাঁর দক্ষতার পরিচয় দেন।

শেষজীবন – ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কবি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বোধশক্তিহীন ও নির্বাক হয়ে পড়েন। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো চিকিৎসাতেই তাঁর অবস্থার উন্নতি হয়নি। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে কবিকে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট ঢাকাতে কবির মৃত্যু হয়।

উৎস

১৩২৯ বঙ্গাব্দের প্রবাসী পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা (১৯২২)-য় প্রথম কবিতা হিসেবে এটি স্থান পায়।

সারসংক্ষেপ

কাজী নজরুল ইসলামের ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতাটি কবির জীবন উল্লাসের কবিতা। আলোচ্য কবিতায় কবি মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। কালবৈশাখীর ঝড়ে কবি নতুনের পতাকা উড়তে দেখেছেন। পরাধীন এবং সামাজিক শোষণ থেকে মুক্তির জন্য যে সংগ্রাম, তা আপাত সর্বনাশের ভয়াবহতা সৃষ্টি করে। কিন্তু তার আড়ালেই রয়েছে নতুন দিনের স্বপ্ন। মহাকালের ভয়ংকর মূর্তিতে এই প্রলয়ের আগমন ঘটে। কিন্তু মৃত্যু, রক্তাক্ততা এসব কিছুকে অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত জীবনেরই অভিষেক হয়। প্রকৃতির ভয়ংকর ক্রোধের মতো প্রচণ্ড তাণ্ডবের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী শক্তির আগমন ঘটে। এর বীভৎসতাকে কবি ভয় না পেতে বলেছেন। বিশ্বজুড়েই কবি প্রলয়রূপে প্রাণের জাগরণ দেখেছেন। রাত্রির অন্ধকার কেটে গিয়ে নতুন সকাল ও নতুন সূর্যের উদয় তিনি প্রত্যাশা করেছেন। সাম্রাজ্যবাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ঔপনিবেশিকতা ইত্যাদির কারাগারে মানুষের দেবতাকে বন্দি হতে দেখেছেন কবি। কিন্তু প্রচণ্ড প্রলয়ের মধ্য দিয়েই তার মুক্তি ঘটবে। তাই ধ্বংস দেখে ভয় না করার জন্য তিনি সকলকে বলেছেন, কেন-না এই ধ্বংসের মধ্যেই রয়েছে সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি। নবীন বিপ্লবীপ্রাণের আবির্ভাব ঘটছে অসুন্দরকে দূর করার জন্য। চিরসুন্দরের এ এক ভাঙা-গড়ার খেলা। একে স্বাগত জানানোর জন্যই কবি জয়ধ্বনি করতে বলেছেন।

নামকরণ

নামকরণ হল যে-কোনো সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রেই প্রবেশের মূল চাবিকাঠি। নামকরণের মধ্য দিয়েই রচয়িতা তার রচনাটি সম্বন্ধে ধারণা দিয়ে থাকেন। আলোচ্য ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতাটিতে কবি নজরুল ইসলামের শুভচেতনার বাণীরূপ প্রকাশিত হয়েছে। সত্য, শিব ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে কবি এই কবিতায় ধ্বংসের দেবতা শিবকে আহবান করে এনেছেন। ‘প্রলয়োল্লাস’ নামকরণটির মধ্য দিয়েই শিবের ভাঙাগড়ার গভীর তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে।

শিব হলেন প্রলয়ের দেবতা। একদিকে তিনি যেমন সৃষ্টিকর্তা, অন্যদিকে তেমনই ধ্বংসকর্তা। আলোচ্য কবিতায় প্রলয়দেবের ধ্বংসাত্মক মূর্তিই প্রধান। তিনি আসছেন কালবৈশাখী ঝড়ের রূপ ধরের সামাজিক অসংগতি, ধর্মান্ধতা, পরাধীনতা এবং সর্বব্যাপী অন্যায়- অবিচারের অবসান ঘটাবেন নটরাজ শিব। তাঁর আগমনে কবি আকাশে নতুনের পতাকা উড়তে দেখেছেন। প্রলয়নেশায় নৃত্যপাগল শিব বন্দি ভারতীয়দের মুক্তি দেবেন। মহাভয়ংকররূপে বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে তিনি আসছেন। জগৎজুড়ে তৈরি হয়েছে আতঙ্কের পরিবেশ। কিন্তু কবি বলতে চেয়েছেন সেই আতঙ্ক সাময়িক। কারণ মহাকাল শিব নিত্য ভাঙাগড়ার খেলায় মগ্ন। সামাজিক অন্ধকার দূর করে, তিনিই শুভচেতনার উদয় ঘটাবেন। নতুন সৃষ্টির জন্য ভাঙন তাঁর নেশা। তাই প্রলয়ের সময়ও তাঁর উল্লাস দেখা যায়। কবিও সেই কথাই বলেছেন – প্রলয় বয়েও আসছে হেসে/মধুর হেসে। কবির অভিপ্রেত বক্তব্যকে সামনে রাখলে কবিতাটির নামকরণ সার্থক বলেই মনে হয়।

“প্রলয়োল্লাস” কবিতাটি একটি গভীর অর্থবহ কবিতা। এটি কবির বিদ্রোহী মানসিকতা এবং স্বদেশ ভাবনার এক অনন্য প্রকাশ। কবিতাটি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

Share via:

মন্তব্য করুন