দশম শ্রেণি – বাংলা – সিন্ধুতীরে (কবিতা) সৈয়দ আলাওল

সিন্ধুতীরে কবিতাটি দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। বিখ্যাত কবি সৈয়দ আলাওল রচিত এই কবিতাটিতে সিন্ধু নদীর তীরে বসে কবির অতীতের স্মৃতিচারণ, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের স্মরণ, বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ এবং মানবতার বার্তা প্রচারের মতো বিষয়বস্তু ধারণ করে।

দশম শ্রেণি – বাংলা – সিন্ধুতীরে

কবি পরিচিতি

জন্ম-পরিচয় – সৈয়দ আলাওলের জন্ম হয়েছিল আনুমানিক ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার ফতেহাবাদে। তাঁর বাবা ছিলেন জালালপুরের অধিপতি মজলিশ কুতুবের অমাত্যপ্রধানা।

পরবর্তী জীবন ও কাব্যরচনা – জলদস্যুদের হাতে আলাওলের বাবা মারা গেলে আলাওল আরাকানে আসেন। সেখানে প্রথমে অশ্বারোহী সেনাদলে নিযুক্ত হলেও অমাত্যপ্রধান মাগন ঠাকুর তাঁর গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁরই নির্দেশে আলাওল হিন্দি কবি মহম্মদ জায়সীর পদুমাবৎ কাব্যের অনুবাদ করেন। আলাওল রচিত অন্য গ্রন্থগুলি হল- সয়ফুলমুলক বদিউজ্জমাল, তোহ্ফা, সেকেন্দারনামা, সপ্তপয়কর। এ ছাড়াও দৌলত কাজীর অসমাপ্ত রচনা সতী ময়না-র কাহিনিও তিনি শেষ করেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মানবতাবাদী কবি হিসেবে আলাওলের স্বতন্ত্র জায়গা রয়েছে। আনুমানিক ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে আলাওল মারা যান।

উৎস

সৈয়দ আলাওল মালিক মহম্মদ জায়সীর পদুমাবৎ কাব্যের অনুবাদ করেছিলেন; যার নাম দেন পদ্মাবতী। সেই কাব্যগ্রন্থের ৩৫ তম খণ্ড ‘পদ্মা-সমুদ্রখণ্ড’ থেকে এই কাব্যাংশটি নেওয়া হয়েছে। ‘সিন্ধুতীরে’ নামটি সাহিত্য সঞ্চয়ন (দশম শ্রেণি) গ্রন্থের সংকলকদের দেওয়া।

পূর্বকথা

পদ্মাবতীকে নিয়ে রত্নসেন সিংহল থেকে ফিরছিলেন। এই সময়ে সমুদ্র ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধরে রত্নসেনের কাছে দান ভিক্ষা করে। কিন্তু ব্রাহ্মণ ভিখারি তোর ধনে কোন্ কাজ -এই বলে রত্নসেন সমুদ্রকে দান দিতে অস্বীকার করেন। এরপরে সমুদ্রের ক্রোধে রত্নসেন ভাগ্যবিপর্যয়ে পড়েন। তাঁর ডিঙা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সেই সময়ে একটি মান্দাসে রত্নসেন ও সখী-সহ পদ্মাবতী আশ্রয় নিলেও সেটিকে রক্ষা করা যায় না। মান্দাস দ্বিখণ্ডিত হয়ে পদ্মাবতী রত্নসেন থেকে আলাদা হয়ে পড়েন। পদ্মাবতীর মান্দাস ভাসতে ভাসতে প্রবল ঢেউয়ে তটভূমিতে আছড়ে পড়ে। ভয়ে পদ্মাবতী ও সখীরা ততক্ষণে মূর্ছা গিয়েছেন।

সারসংক্ষেপ

মান্দাসে ভাসতে ভাসতে পদ্মাবতী যেখানে পৌঁছোলেন সেখানে ছিল এক দিব্যপুরী। অতি সুন্দর সেই জায়গা। সেখানে এক প্রাসাদে থাকে সমুদ্রকন্যা পদ্মা। পর্বতের কোলে অবস্থিত সুরম্য উদ্যানে ভোরবেলা পদ্মা তার সখীদের নিয়ে যাবার সময়ে সমুদ্রের ধারে মান্দাসটিকে লক্ষ করে। কৌতূহলী হয়ে সে চারদিকে চার সখীকে এবং মাঝখানে অতি রূপবতী এক কন্যাকে চেতনাহীন হয়ে থাকতে দ্যাখে। সেই রূপে বিস্মিত পদ্মার মনে হয় ইন্দ্রের অভিশাপে স্বর্গভ্রষ্ট বিদ্যাধরী যেন মাটিতে অচেতন হয়ে আছে। সেই অচেতন মেয়েটির চোখ বেরিয়ে আসছে, বসন এলোমেলো। পদ্মা অনুমান করেন প্রবল বাতাসে নৌকা ভেঙে যাওয়াতেই সমুদ্রের ঝড়ঝঞ্ঝার কষ্টে আচ্ছন্ন হয়েছেন ওই রূপবতী কন্যা। ছবির মূর্তির মতো সুন্দরী সেই মেয়েটি পড়ে আছেন, তার সামান্যই শ্বাস রয়েছে। দয়ালু পদ্মা মেয়েটির জীবন বাঁচাতে তৎপর হয়। সে সখীদের আদেশ দেয় বস্ত্র দিয়ে ঢেকে মেয়েটিকে উদ্যানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আগুনের সেঁক দেওয়ার জন্যও নির্দেশ দেয়। শুরু হয় তন্ত্র-মন্ত্র-মহৌষধি প্রয়োগ। এইভাবে চার দণ্ড চলার পরে পদ্মাবতী ও তার চার সখী জ্ঞান ফিরে পায়।

নামকরণ

নামকরণ সাহিত্যে প্রবেশের চাবিকাঠি, তাই সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘সিন্ধুতীরে’ নামকরণটি কবির দেওয়া নয়। কাব্যকাহিনির বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে সংকলকগণ এরূপ নামকরণ করেছেন।

সিংহল-রাজকন্যা পদ্মাবতী স্বামীর সঙ্গে চিতোরে ফেরার সময় সামুদ্রিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন। তাঁদের জলযানটি সমুদ্রে ডুবে যায়। একটি মান্দাসে রত্নসেন ও সখী-সহ পদ্মাবতী আশ্রয় নিলেও সেটি রক্ষা পায় না। প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝায় মান্দাস দ্বিখণ্ডিত হয়ে পদ্মাবতী রত্নসেন থেকে আলাদা হয়ে পড়েন। দুর্যোগজনিত কষ্টে রাজকন্যা জ্ঞান হারিয়ে সমুদ্রতীরে পড়ে থাকেন। সাগরকন্যা পদ্মা ভোরবেলা সুরম্য উদ্যানে এসে এই দৃশ্য দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি সখীদের নির্দেশ দেন অচৈতন্য রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে। সখীরাও সেই নির্দেশমতো রাজকন্যা পদ্মাবতীকে উদ্যানের মাঝখানে নিয়ে এসে চার দণ্ড ধরে নানা সেবাযত্নের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এই হল সংক্ষিপ্ত কাব্যকাহিনি। এখানে লক্ষণীয় যে, যাবতীয় ঘটনা ঘটেছে সমুদ্রের তীরবর্তী স্থানে। কাব্যাংশটির শুরুতেও এই সমুদ্রতীরবর্তী ‘দিব্যস্থান’-টির শোভা-সৌন্দর্য বর্ণিত হয়েছে।

সিন্ধুতীরে শব্দটির অর্থ সমুদ্রতীরে। সেই স্থাননামের উল্লেখেই কাব্যাংশটির নামকরণ। এই অংশে সংঘটিত যাবতীয় ঘটনা এবং বর্ণিত যাবতীয় বিষয় সমুদ্রতীরকেন্দ্রিক। যে চরিত্রদের কেন্দ্র করে কাহিনি আবর্তিত হয়েছে, তার থেকে যে জায়গায় কাহিনিটি ঘটেছে সেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ রূপে প্রকাশিত হয়েছে। এই দিক থেকে বিচার করলে নামকরণটি বিষয়কেন্দ্রিক এবং যথাযথ হয়েছে বলা যায়।

সৈয়দ আলাওল রচিত “সিন্ধুতীরে” কবিতাটি দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঐতিহাসিক ঘটনা, আবেগ, এবং কাব্যিক ভাবনার মিশেলে এই কবিতাটি পাঠকদের মনে দারুণ ছাপ ফেলে।

কবিতাটিতে মোহাম্মদ বিন কাসেমের সিন্ধু বিজয়ের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সিন্ধু নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কাসেমের সেনাবাহিনীর সাহস, বীর্য, এবং দেশপ্রেমের উচ্চারণ পাঠকদের মনে জাগিয়ে তোলে।

কবিতাটির ভাষা সাবলীল, প্রাঞ্জল এবং সহজবোধ্য। ছন্দের ব্যবহার কবিতাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

“সিন্ধুতীরে” কবিতাটি কেবল ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা নয়, বরং এটি সাহস, বীর্য, দেশপ্রেম, এবং আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এই কবিতাটি আমাদের মনে জাগিয়ে তোলে ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা এবং দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা।

উপসংহারে বলা যায়, “সিন্ধুতীরে” কবিতাটি দশম শ্রেণি বাংলা পাঠ্যের একটি অসাধারণ কবিতা যা ঐতিহাসিক ঘটনা, আবেগ, এবং কাব্যিক ভাবনার এক অপূর্ব মিশ্রণ।

Share via:

মন্তব্য করুন