আজকের আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের ষষ্ঠ অধ্যায়, ‘ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ’ – এর অন্তর্গত ভারতের জনসংখ্যা বিভাগ থেকে কিছু রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষা বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এসব প্রশ্ন প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনার পড়াশোনায় সহায়ক হবে।
ভারতের জনবসতির ঘনত্ব সর্বত্র সমান নয় কেন?
ভারতে জনবসতির ঘনত্ব সর্বত্র সমান নয়, এবং এর পেছনে বেশ কিছু প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক কারণ রয়েছে। নিচে সেগুলি আলোচনা করা হলো –
প্রাকৃতিক বা ভৌগোলিক কারণ –
- ভূপ্রকৃতি – হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি বন্ধুর ও পাথুরে হওয়ায় কৃষিকাজের জন্য অনুপযুক্ত। তাই এইসব অঞ্চল জনবিরল। অপরদিকে, উত্তর ভারতের সমভূমি এবং উপকূলীয় সমভূমি কৃষি, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং শিল্পে উন্নত। তাই এইসব অঞ্চলে জনঘনত্ব বেশি।
- জলবায়ু – উত্তর ও পূর্ব ভারতের সমভূমি অঞ্চলে অনুকূল জলবায়ুর জন্য জনঘনত্ব বেশি। অপরদিকে, রাজস্থানের মরু অঞ্চল বা গুজরাতের কচ্ছ অঞ্চলে শুষ্ক জলবায়ু এবং হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে শীতল জলবায়ুর কারণে জনঘনত্ব কম।
- নদনদী – উত্তর ভারতের গঙ্গা, সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র এবং দক্ষিণ ভারতের মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি নদী-উপত্যকায় জনঘনত্ব বেশি। কারণ এইসব নদী থেকে জলসেচ, জলনিকাশ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, জলপথে পরিবহণ, পানীয় জল সরবরাহ, মৎস্য চাষ প্রভৃতি নানারকম সুবিধা পাওয়া যায়।
- মাটি – ভারতের যেসব স্থানের মৃত্তিকা উর্বর ও চাষযোগ্য সেখানে জনবসতির ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি। যেমন—দাক্ষিণাত্যের লাভাগঠিত অঞ্চলে উর্বর কৃষ্ণ মৃত্তিকার জন্য এবং সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি নদী-উপত্যকা এবং বদ্বীপ অঞ্চলে উর্বর পলিমাটির জন্য জনঘনত্ব বেশি।
- অরণ্য – পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে এবং পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে গভীর অরণ্যের কারণে লোকবসতি কম।
- খনিজ পদার্থ – মৃত্তিকা অনুর্বর হলেও দাক্ষিণাত্য মালভূমি এবং ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে খনিজ সম্পদ উত্তোলনকে কেন্দ্র করে ঘন জনবসতি দেখা যায়।
অপ্রাকৃতিক কারণ –
- পরিবহণ ব্যবস্থা – উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা জনবসতিকে প্রভাবিত করে। যেমন—উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চলে সড়কপথ, রেলপথ, জলপথ প্রভৃতির মাধ্যমে যাতায়াতের সুবিধা আছে, তাই এখানে জনবসতিও ঘন। আবার, মধ্যপ্রদেশ বা ওডিশার অনেক জায়গা উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থার অভাবে অত্যন্ত জনবিরল।
- শিল্প ও শিল্পাঞ্চল – শিল্পকেন্দ্র বা শিল্পাঞ্চলে বহু মানুষের জীবিকার সংস্থান হয়। তাই কলকাতা শিল্পাঞ্চল বা আসানসোল শিল্পাঞ্চলের জনঘনত্ব বেশি।
অন্যান্য কারণ –
- বিশেষ অবস্থানগত সুবিধা – পর্যটনকেন্দ্র (শ্রীনগর, দার্জিলিং), যোগাযোগের কেন্দ্র (নাগপুর), স্বাস্থ্যকেন্দ্র (ভেলোর), সীমান্তবর্তী শহর (শিলিগুড়ি), ঐতিহাসিক স্থান (লখনউ, আগ্রা), শিক্ষাকেন্দ্র (বারাণসী), ধর্মস্থান (আজমের), সামরিক শহর (গোয়ালিয়র) প্রভৃতি স্থানে বিশেষ অনুকূল পরিবেশের কারণে অধিক জনঘনত্ব দেখা যায়।
- রাজনৈতিক অস্থিরতা – দেশভাগজনিত কারণে শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসা প্রভৃতি কারণে কিছু অঞ্চলে জনঘনত্ব বেড়ে যায়।
- অস্থায়ী পরিব্রাজন – যেমন—যোশীমঠের জনঘনত্ব ছয় মাসের জন্য বেড়ে যায়।
এইভাবে প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান কখনও এককভাবে, কখনও সম্মিলিতভাবে ভারতের জনসংখ্যা বণ্টনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
জনঘনত্বের তারতম্য অনুযায়ী ভারতের রাজ্যগুলির বণ্টন আলোচনা করো
রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলসহ ভারতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন কারণে জনঘনত্বের তারতম্য লক্ষ করা যায়। জনঘনত্বের ভিত্তিতে ভারতের রাজ্যগুলিকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন —
ভারতের রাজ্যভিত্তিক জনঘনত্ব অঞ্চলসমূহের পরিচয়
জনবসতি অঞ্চলের প্রকৃতি | জনঘনত্ব | অন্তর্গত রাজ্যসমূহ | অন্তর্গত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলসমূহ | এইরূপ জনবসতির কারণ |
---|---|---|---|---|
অত্যধিক জনঘনত্ববিশিষ্ট অঞ্চল | প্রতি বর্গকিমিতে 400 জনের বেশি | পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, কেরালা, উত্তরপ্রদেশ | দিল্লি, চণ্ডীগড়, পুদুচেরি, লাক্ষাদ্বীপ এবং দমন ও দিউ | শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার, প্রশাসনিক কার্যক্রম ইত্যাদি |
অধিক জনঘনত্ববিশিষ্ট অঞ্চল | প্রতি বর্গকিমিতে 201 থেকে 400 জন | পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড | দাদরা ও নগর হাভেলি | কৃষিপ্রধান এই রাজ্যগুলিতে শিল্প, বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি |
মধ্যম জনঘনত্ববিশিষ্ট অঞ্চল | প্রতি বর্গকিমিতে 201 থেকে 400 জন | ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, অন্ধ্রপ্রদেশ (অবিভক্ত), কর্ণাটক, ত্রিপুরা, অসম, গোয়া, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান | — | কৃষি ও শিল্পে উন্নতি, খনিজ সম্পদের উত্তোলন |
স্বল্প জনঘনত্ববিশিষ্ট অঞ্চল | প্রতি বর্গকিমিতে 101 থেকে 200 জন | হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয়, ছত্তিশগড় এবং জম্মু ও কাশ্মীর | — | বন্ধুর ও পর্বতময় ভূপ্রকৃতি, অনুর্বর মৃত্তিকা, প্রতিকূল জলবায়ু, কৃষিজমির অভাব |
অতি স্বল্প জনঘনত্বযুক্ত অঞ্চল | প্রতি বর্গকিমিতে 100 জনের কম | সিকিম, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ | আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ | জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতির প্রতিকূলতার কারণে বসবাসের সমস্যা |
জনঘনত্বের তারতম্য অনুযায়ী ভারতের রাজ্যগুলির মানচিত্র।
ভারতের জনবণ্টন অঞ্চলগুলির বিবরণ দাও।
ভারতের জনবণ্টন অঞ্চল –
প্রধানত ভূপ্রকৃতি, নদনদীর প্রভাব, উর্বর মৃত্তিকা ও অনুকূল জলবায়ু ভারতের জনবণ্টনকে প্রভাবিত করে। জনবণ্টনের ভিত্তিতে ভারতকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। এগুলি হল –
- উত্তর ভারতের নদীবিধৌত সমভূমি অঞ্চল – সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদী অববাহিকা ভারতের সর্বাপেক্ষা জনবহুল অঞ্চল। সমতল ভূপ্রকৃতি, উর্বর পলিমাটি, নিত্যবহ নদী, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও পরিমিত উষ্ণতা এই অঞ্চলে কৃষি, শিল্প, নগরায়ণ ঘটাতে এবং ঘন জনবসতি গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ভারতের প্রধান জনবহুল রাজ্যগুলিও এই অঞ্চলে অবস্থিত, যেমন উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি।
- পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলীয় সমভূমি – উর্বর মৃত্তিকা সমন্বিত এই সমভূমি অঞ্চলে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত বিকাশ ঘটেছে। তাই পূর্ব ও পশ্চিম উপকূল ভারতের দ্বিতীয় প্রধান জনবহুল অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। পশ্চিম উপকূলের চেয়ে পূর্ব উপকূলীয় সমভূমির জনঘনত্ব অনেক বেশি। এই দুই উপকূল অঞ্চলে মুম্বাই, চেন্নাই, বিশাখাপত্তনম, কোচিসহ বহু বন্দর ও নগর গড়ে উঠেছে।
- দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চল – প্রধানত খনিজ সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটির কোনো কোনো অংশ কৃষিতেও উন্নত (বিশেষত মহারাষ্ট্র মালভূমি) হওয়ায় যথেষ্ট জনবহুল। মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশে তাই মধ্যম ধরনের জনঘনত্ব দেখা যায়।
- পার্বত্য, মরু ও অরণ্যময় অঞ্চল – হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, পূর্বাচল, মেঘালয় মালভূমি, রাজস্থানের মরুস্থলী, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও ওডিশার অরণ্যময় অঞ্চলের জনঘনত্ব যথেষ্ট কম। বন্ধুর ভূপ্রকৃতি, অনুর্বর মৃত্তিকা, বৃষ্টির আধিক্য বা স্বল্পতা, উদ্ভিদ বিরলতা কিংবা অরণ্যময়তার ফলে এই অঞ্চলগুলি খুবই জনবিরল। জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, উত্তরাখণ্ড এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।
ভারতে দ্রুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণগুলি লেখো।
ভারতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনেকগুলি কারণ রয়েছে, যেমন –
উচ্চ জন্মহার – উন্নত বা উন্নয়নশীল অনেক দেশের তুলনায় ভারতে জন্মহার বেশি। শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, দারিদ্র্য, কুসংস্কার, ধর্মীয় প্রভাব, অল্প বয়সে বিবাহ প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে ভারতে জন্মহার বেশি।
মৃত্যুহার কমে যাওয়া – ভারতে জন্মহার দীর্ঘদিন থেকেই বেশি। তবে, বিগত কয়েক দশকে আধুনিক চিকিৎসা পরিষেবার কল্যাণে মৃত্যুহার যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতির ফলে দুর্ভিক্ষ, খরা, বন্যা, মহামারি ও অনাহার-জনিত মৃত্যুর সংখ্যাও যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। এইভাবে মৃত্যুহার কমে যাওয়ায় জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
অর্থনৈতিক কারণ –
- কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা – ভারতের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। এই কৃষিকাজে অধিক শ্রমিকের প্রয়োজনের কারণে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে।
- দারিদ্র্য – ভারতের বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র এবং পুত্রসন্তানের মাধ্যমে সেই দারিদ্র্য মোচন করা সম্ভব – এমন ভাবনা জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে।
সামাজিক কারণ – বিভিন্ন কারণে ভারতীয় সমাজে পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষা এবং যৌথ পরিবার প্রথা জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে।
বিপুল সংখ্যায় শরণার্থী আগমন – দেশ বিভাগের পরবর্তী দশকগুলিতে প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে বিপুল সংখ্যায় শরণার্থী ভারতে চলে আসায় এখানকার জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি – বিগত কয়েক দশকে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্পের বিকাশ প্রভৃতি ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়ক হয়েছে। এর ফলে অপুষ্টি-জনিত রোগ এবং জীবনহানি হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম পূর্বাভাস এবং অন্যান্য ব্যবস্থাগুলি অনেক ক্ষেত্রে জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে পরোক্ষভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
ভারতের জনসংখ্যা বণ্টনের তারতম্যের পাঁচটি কারণ আলোচনা করো।
ভারতে জনবসতির ঘনত্বের তারতম্য –
ভারতের সমস্ত স্থানে জনসংখ্যার বণ্টন সমান নয়। কোথাও বেশি, কোথাও কম। ভারতের বিভিন্ন অংশে এই অসম জনবণ্টনের অনেকগুলি কারণ রয়েছে। যেমন –
- ভূপ্রকৃতি – হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি বন্ধুর ও পাথুরে হওয়ায় কৃষিকাজের জন্য অনুপযুক্ত। এইসব অঞ্চল তাই জনবিরল। অন্যদিকে, উত্তর ভারতের সমভূমি এবং উপকূলীয় সমভূমি কৃষি, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং শিল্পের জন্য উন্নত। তাই এইসব অঞ্চলের জনঘনত্ব বেশি।
- জলবায়ু – উত্তর ও পূর্ব ভারতের সমভূমি অঞ্চলে অনুকূল জলবায়ুর জন্য জনঘনত্ব বেশি। অন্যদিকে, রাজস্থানের মরু অঞ্চল বা গুজরাটের কচ্ছ অঞ্চলে শুষ্ক এবং হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে শীতল জলবায়ুর কারণে জনঘনত্ব কম।
- নদনদী – উত্তর ভারতের গঙ্গা, সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র এবং দক্ষিণ ভারতের মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি নদী-উপত্যকায় জনঘনত্ব বেশি। এইসব নদী থেকে জলসেচ, জলনিকাশ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, জলপথে পরিবহণ, পানীয় জল সরবরাহ, মৎস্য চাষ প্রভৃতি নানাবিধ সুবিধা পাওয়া যায়।
- মাটি – ভারতের যেসব স্থানে মৃত্তিকা উর্বর ও চাষযোগ্য সেখানে জনবসতির ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি। যেমন – দাক্ষিণাত্যের লাভাগঠিত অঞ্চলে উর্বর কৃষ্ণ মৃত্তিকার জন্য এবং সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি নদী-উপত্যকা এবং বদ্বীপ অঞ্চলে উর্বর পলিমাটির জন্য জনঘনত্ব বেশি।
- অরণ্য – পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে এবং পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে গভীর অরণ্যের কারণে লোকবসতি কম।
জীবনধারণের উপযোগী অনুকূল পরিবেশে বিভিন্ন সময়ে জনসমাবেশের ফলে কীভাবে নগর-শহর গড়ে ওঠে?
জীবনধারণের উপযোগী বিভিন্ন অনুকূল পরিবেশে জনসমাবেশের ফলে শহর ও নগর গড়ে ওঠে। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
- প্রশাসনিক কেন্দ্র: কোনো স্থান প্রশাসনের কেন্দ্র হলে সেখানে বিভিন্ন সেবা, শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটে। এর ফলে স্থানটি ধীরে ধীরে শহর বা নগরে পরিণত হয়। উদাহরণস্বরূপ — চণ্ডীগড়, ভোপাল, গান্ধিনগর প্রভৃতি ভারতের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে বিকাশলাভ করেছে।
- খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল: বিভিন্ন শিল্পের জন্য খনিজ সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তাই খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ স্থানগুলো ধীরে ধীরে শহরে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ — আসানসোল, ধানবাদ প্রভৃতি।
- শিল্পকেন্দ্র: যেসব স্থানে শিল্প গড়ে উঠেছে, সেসব স্থানে জীবিকার সুযোগ থাকায় জনসমাগম ঘটে এবং এর ফলে স্থানগুলো ক্রমেই শহর হিসেবে বিকশিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ — জামশেদপুর, ভিলাই প্রভৃতি।
- বাণিজ্যকেন্দ্র: যেসব স্থানে পণ্যসামগ্রীর সমাবেশ হয় এবং ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম ঘটে, সেইসব স্থানে শহর গড়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ — হরিয়ানার হিসার, উত্তরপ্রদেশের হাপুর প্রভৃতি।
- যোগাযোগ কেন্দ্র: ভারতের যেসব স্থান যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যেমন যেখানে রেলপথ, সড়কপথ, জলপথ একত্রিত হয়েছে, সেইসব স্থানে শহর গড়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ — শিলিগুড়ি, খড়গপুর প্রভৃতি।
- তীর্থস্থান: বড়ো বড়ো তীর্থস্থানে প্রচুর জনসমাগম ঘটে এবং এগুলি কালক্রমে শহরে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ — হরিদ্বার, বারাণসী, গয়া, মথুরা, বৃন্দাবন প্রভৃতি।
- শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র: যেসব স্থানে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কেন্দ্রীভূত হয়েছে, সেসব স্থান ধীরে ধীরে শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ — শান্তিনিকেতন।
- ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান: যেসব স্থান ইতিহাসে প্রসিদ্ধ, সেসব স্থানে জনসমাগমের ফলে শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ — আগ্রা, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি।
- পর্যটন স্থান: অনেক স্থানে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটে, যা শহর গড়ে উঠার সহায়ক হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ — দার্জিলিং, দিঘা প্রভৃতি।
- সামরিক কেন্দ্র: কিছু সামরিক কেন্দ্র কালক্রমে শহরে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ — মিরাট, ব্যারাকপুর প্রভৃতি।
- বন্দর: বড়ো বড়ো বন্দরকে কেন্দ্র করে শহর গড়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ — পারাদীপ, হলদিয়া প্রভৃতি।
- পর্বত ও সমভূমির সংযোগস্থল: পর্বত ও সমভূমির সংযোগস্থলে শহর গড়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ — হরিদ্বার।
শেষে বলা যায়, শহর গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে উপরের কারণগুলির মধ্যে একটি বা একাধিক কারণ প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে অন্যান্য কারণগুলিও সম্মিলিতভাবে শহরের উন্নতিতে সহায়তা করে।
ভারতে নগরায়ণের সমস্যাগুলি লেখো।
ভারতে দ্রুত নগরায়ণের ফলে নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে, যা সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অন্তরায়। উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলি হলো:
- অপরিকল্পিত নগরায়ণ: ভারতের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় শহর ও নগরগুলি অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। এর ফলে কৃষিজমি, জলাভূমি, বনভূমি ইত্যাদির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণে বস্তির সংখ্যা বাড়ছে। সরু রাস্তা, জলনিকাশি ব্যবস্থার সমস্যা, পানীয় জলের অভাব, ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস ইত্যাদি অপরিকল্পিত নগরায়ণের প্রধান সমস্যা।
- মানুষের শহরমুখী প্রবণতা: শহর এবং গ্রামের উন্নয়নের পার্থক্যের কারণে গ্রাম থেকে শহরে আসার প্রবণতা বাড়ছে। শহরে স্বচ্ছল জীবনযাপন ও কর্মক্ষেত্র বেশি থাকায় এই প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
- বাসস্থানের অভাব: জীবিকার খোঁজে শহরে এসে মানুষ বাসস্থানের সংকটে পড়ছে, ফলে রেললাইন, রাস্তার ধারে বস্তি গড়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ, মুম্বাই ও কলকাতায় এই সমস্যা তীব্র।
- পরিবহণ সমস্যা: অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শহরের রাস্তাগুলি সরু এবং যানবাহনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় যানজট মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- স্বাস্থ্য সমস্যা: শিল্পকারখানা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং যানবাহনের ধোঁয়ার কারণে বায়ুদূষণ বাড়ছে। আবর্জনা, জলাবদ্ধতা, ও নোংরা পরিবেশ থেকে নানা রোগের উৎপত্তি ঘটছে, যা শহরের মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যার মূল কারণ।
- শিক্ষা সমস্যা: শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হলেও দরিদ্র ও বস্তিবাসীর জন্য শিক্ষার সুযোগ সীমিত থাকে, ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে অসাম্যতা তৈরি হয়।
- বিদ্যুৎ সমস্যা: অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বিদ্যুতের অতিরিক্ত চাহিদা বিদ্যুতের ঘাটতি তৈরি করে, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে।
- জলনিকাশি সমস্যা: বেশিরভাগ শহরে জলনিকাশি ব্যবস্থা অনুন্নত। ড্রেনে প্লাস্টিকসহ অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ নিক্ষেপের কারণে জলনিকাশী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, ফলে একটু বৃষ্টি হলেই শহর জলপ্লাবিত হয়। নিকাশি ড্রেনে জমে থাকা নোংরা জলে নানা কীটপতঙ্গের জন্ম হয়, যা থেকে রোগের বিস্তার ঘটে।
এই সমস্ত সমস্যাগুলি ভারতের নগরায়ণের একটি অপরিহার্য চ্যালেঞ্জ।
পশ্চিমবঙ্গে জনবসতির ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি কেন?
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য। 2011 সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এই রাজ্যে প্রতি বর্গকিলোমিটারে 1029 জন লোক বসবাস করে। পশ্চিমবঙ্গে জনবসতির ঘনত্ব খুব বেশি হওয়ার কারণ —
- সমতল ভূপ্রকৃতি – পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিম্ন-গঙগা সমভূমির অন্তর্গত বলে কৃষিকাজ, পরিবহণ ব্যবস্থা এবং শিল্পে যথেষ্ট উন্নত।
- অনুকূল জলবায়ু – রাজ্যটি ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত বলে উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত উভয়ই মধ্যম প্রকৃতির। এইরূপ জলবায়ু কৃষিকাজ ও অধিবাসীদের জীবনধারণের পক্ষে অনুকূল।
- উর্বর মৃত্তিকা – পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ এলাকা গঙ্গা নদীর পলি দ্বারা গঠিত বলে এখানকার মৃত্তিকা খুব উর্বর প্রকৃতির। এই মৃত্তিকায় কৃষিকাজ খুব ভালো হয়।
- উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা – এই রাজ্যের অধিকাংশ এলাকার ভূমি সমতল বলে এখানে সড়কপথ ও রেলপথে পরিবহণ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটেছে।
- বন্দরের অবস্থান – কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দরের কল্যাণে বাণিজ্যিক তথা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ সমৃদ্ধি ঘটেছে।
- খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ – পশ্চিমবঙ্গ খনিজ সম্পদে (রানিগঞ্জের কয়লা, বাঁকুড়ার চিনামাটি, ঝালদার চুনাপাথর, তামা, সিসা, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি) মোটামুটিভাবে একটি সমৃদ্ধ রাজ্য।
- শক্তিসম্পদের প্রাচুর্য – পশ্চিমবঙ্গ শক্তিসম্পদে বেশ সমৃদ্ধ। এখানে বেশ কয়েকটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র (দুর্গাপুর, ব্যান্ডেল, কোলাঘাট) এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র (জলঢাকা, অযোধ্যা পাহাড়) আছে। বর্তমানে সুন্দরবনে সৌরশক্তির মাধ্যমে স্বল্প পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
- শিল্পস্থাপনের সুবিধা – সমতল ভূপ্রকৃতি, উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা, খনিজ ও শক্তি সম্পদের প্রাচুর্য এখানে শিল্প স্থাপনে বিশেষ সুবিধা প্রদান করেছে।
- নিয়মিত অনুপ্রবেশ – বিগত কয়েক দশকে প্রতিবেশী রাজ্য ও দেশগুলি থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ এই রাজ্যে স্থায়ীভাবে চলে আসায় এখানকার জনবসতির ঘনত্ব খুব বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারতের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব (2011)
রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল | জনসংখ্যা (2011) | জনঘনত্ব (জন/বর্গকিমি) |
---|---|---|
দিল্লি | 16,753,235 | 11,297 |
চণ্ডীগড় | 1,054,686 | 9,252 |
পুদুচেরি | 1,244,464 | 2,598 |
দমন ও দিউ | 242,911 | 2,169 |
লাক্ষাদ্বীপ | 64,429 | 2,013 |
বিহার | 103,804,637 | 1,102 |
পশ্চিমবঙ্গ | 91,347,736 | 1,029 |
কেরল | 33,387,677 | 859 |
উত্তরপ্রদেশ | 199,581,477 | 828 |
দাদরা ও নগর হাভেলি | 342,853 | 698 |
হরিয়ানা | 25,353,081 | 573 |
তামিলনাড়ু | 72,138,958 | 555 |
পাঞ্জাব | 27,704,236 | 550 |
ঝাড়খণ্ড | 32,966,238 | 414 |
অসম | 31,169,272 | 397 |
গোয়া | 1,457,723 | 394 |
মহারাষ্ট্র | 112,372,972 | 365 |
ত্রিপুরা | 3,671,032 | 350 |
কর্ণাটক | 61,130,704 | 319 |
অন্ধ্রপ্রদেশ | 84,665,533 | 308 |
গুজরাট | 60,383,628 | 308 |
ওডিশা | 41,947,358 | 269 |
মধ্যপ্রদেশ | 72,597,565 | 236 |
রাজস্থান | 68,621,012 | 201 |
উত্তরাখণ্ড | 10,116,752 | 189 |
ছত্তিশগড় | 25,540,196 | 189 |
মেঘালয় | 2,964,007 | 132 |
জম্মু ও কাশ্মীর | 12,548,926 | 124 |
হিমাচল প্রদেশ | 6,856,509 | 123 |
মণিপুর | 2,721,756 | 122 |
নাগাল্যান্ড | 1,980,602 | 119 |
সিকিম | 607,688 | 86 |
মিজোরাম | 1,091,014 | 52 |
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ | 379,944 | 46 |
অরুণাচল প্রদেশ | 1,382,611 | 17 |
ভারত | 1,210,193,422 | 382 |
আজকের আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের ষষ্ঠ অধ্যায় ‘ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ’ থেকে ‘ভারতের জনসংখ্যা’ বিভাগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনাধর্মী প্রশ্ন ও তাদের উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসতে দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের উপকারী হয়েছে। যদি কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকে, টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন; আমি যথাসাধ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না, যাদের এটি উপকারী হতে পারে। ধন্যবাদ!