মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ – ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নোত্তর

Mrinmoy Rajmalla

উনিশ শতকের ভারতীয় সমাজে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের পাশাপাশি বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগেরও সূচনা হয়। এই বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং ভারতীয় সমাজে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার সাধন করা।

Table of Contents

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ – ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নোত্তর

বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভবের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করো। বাংলায় ছাপাখানা বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় ব্যাখ্যা করো।

প্রথম অংশ – বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব বিলম্বিত হলেও তা আকস্মিক ছিল না, কারণ —

বিক্ষিপ্ত মুদ্রণ – ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রায় একশ বছর ধরে বিক্ষিপ্তভাবে বাংলা হরফযুক্ত মুদ্রণের কাজ হয়েছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আতানাসিউস কিসের রচিত চায়না ইলাস্ট্রেটা (১৬৬৭ খ্রি.) ও হ্যালহেড-এর রচিত এ কোড অব জেন্টু লজ (১৭৭৬ খ্রি.)।

প্রশাসনিক প্রয়োজন – ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রেগুলেটিং আইনের মাধ্যমে বাংলায় প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজ শাসনের সূচনা হলে বাংলা ভাষায় আইন বা নির্দেশ দানের প্রয়োজন দেখা দেয়।

হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতা – বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলা ভাষায় মুদ্রণের ক্ষেত্রে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, হেস্টিংস নিজ দায়িত্বে সরকারি খরচে এই গ্রন্থটি মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।

উইলকিন্স-এর ভূমিকা – ইংরেজ প্রশাসক চার্লস উইলকিন্স ছিলেন একজন প্রাচ্যপণ্ডিত এবং তিনি ছিলেন বাংলার মুদ্রাক্ষর তৈরিতে অভিজ্ঞ। তিনি হেস্টিংসের অনুরোধে পঞ্চানন কর্মকারের সহযোগিতায় হ্যালহেড-এর ব্যাকরণ গ্রন্থের মুদ্রাক্ষর তৈরি করে দেন।

দ্বিতীয় অংশ – ছাপাখানার বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় ছিল ১৭৭৮-১৭৯৯ খ্রি:। এই সময়পর্বে ছাপাখানার বিভিন্ন দিকগুলি হল —

হ্যালহেড-এর ব্যাকরণ – ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাসি হ্যালহেড ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী বা ইংরেজদের বাংলা শিক্ষার জন্য ইংরেজি ভাষায় A Grammar of the Bengal Language নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থের মোট পৃষ্ঠার চারভাগের একভাগ অংশে উদাহরণরূপে বাংলা হরফ ব্যবহার করেন। এইভাবে প্রথম বাংলা মুদ্রণ বা ছাপার কাজ শুরু হয়।

কোম্পানির প্রেস – হুগলির অ্যান্ড্রুজের ছাপাখানা ছিল বাংলার প্রথম ছাপাখানা। তবে এই ছাপাখানার সব যন্ত্রপাতি ক্রয় করে সরকারি উদ্যোগে উইলকিন্সের নেতৃত্বে কলকাতায় কোম্পানির প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় (১৭৮০ খ্রি.)।

হিকির প্রেস – কোম্পানির প্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে এই প্রেস থেকে হিকি’জ গেজেট নামক সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের প্রথম দশটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পরে অবশ্য হিকি নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।

অন্যান্য প্রেস – কোম্পানির প্রেসের সমসাময়িক অপর একটি ছাপাখানাও ছিল এবং এটি কলকাতায় ৩৭ নং লারকিন্স লেনে অবস্থিত ছিল। এছাড়া ক্যালকাটা গেজেট প্রেস নামক আধা-সরকারি ছাপাখানা (১৭৮৪ খ্রি.), ক্রনিকল প্রেস ও ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানির প্রেস ছিল উল্লেখযোগ্য ছাপাখানা।

মূল্যায়ণ – বাংলার প্রাথমিক পর্যায়ের এই ছাপাখানাগুলির উৎপাদন ছিল আইন ও আইনগ্রন্থের অনুবাদ, ব্যাকরণ-অভিধান ও শব্দকোষ এবং সংবাদপত্র ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন।

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কীভাবে ছাপাখানার বিস্তারে সাহায্য করেছিল তা ব্যাখ্যা করো। এ প্রসঙ্গে ছাপাখানার বিস্তারে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদানকে চিহ্নিত করো।

প্রথম অংশ – বাংলায় ছাপাখানা ব্যবস্থার উদ্যোগ বিলম্বিত হলেও উনিশ শতকের সূচনায় তা দ্রুত বিকাশলাভ করতে থাকে। এই বিকাশের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস।

মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা – খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষায় বাইবেল ছাপানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন (১৭৯৮ খ্রি.)। কিন্তু তা প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় নিজেই ছাপাখানা প্রবর্তন করে তা ছাপানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠিত হলে (১৮০০ খ্রি.) কেরি এখানেই শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপন করেন। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই এই ছাপাখানা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছাপাখানায় পরিণত হয়।

মিশন প্রেসের উৎপাদন – শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের উৎপাদনগুলি হল —

ধৰ্ম্ম পুস্তক – প্রাথমিক পর্বে কেরির সহযোগী ছিলেন। অভিক্ষ ও দক্ষ মুদ্রাকর ওয়ার্ড এবং পঞ্চানন কর্মকার। তিনি কলকাতা থেকে সংগৃহীত হরফ এবং কিছু পাটনাই ও বিদেশি কাগজ সহযোগে ছাপার কাজ শুরু করেন। নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম অধ্যায়টির বাংলা অনুবাদ করে কেরি ১০৭ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট মঙ্গল সমাচার মাতিউর রচিত নামে প্রকাশ করেন। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে আটশোরও অধিক পৃষ্ঠাযুক্ত ধৰ্ম্মপুস্তক বা বাংলা বাইবেল প্রকাশ করেন।

অন্যান্য বই – শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে রামরাম বসুর রচিত হরকরা ও জ্ঞানোদয় নামক দুটি গ্রন্থ (আগস্ট সেপ্টেম্বরে, ১৮০০ খ্রি.) মুদ্রিত হয়। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২ খ্রি.), ৪ খণ্ডে কাশীরাম দাসের মহাভারত (১৮০১-০৩) ও পাঁচ খণ্ডে কীর্তিবাসের রামায়ণ (১৮০২-০৩) মুদ্রিত হয়। এভাবে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই প্রেসে ৪০টি বিভিন্ন ভাষায় ২,১২,০০০ কপি বই মুদ্রিত হয়।

পাঠ্যপুস্তক – শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকও মুদ্রিত হয়েছিল। এই সব পুস্তকের রচয়িতা ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু, চণ্ডীচরণ মুন্সী, হরপ্রসাদ রায় প্রমুখ।

মূল্যায়ণ – উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, ধর্মীয় উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপিত হলেও তার উৎপাদনে ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ও ছিল।

দ্বিতীয় অংশ – প্রশাসনিক প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সিভিলিয়ানদের ইংরেজির পাশাপাশি দেশীয় ভাষাতেও শিক্ষাদান করা হত। তাই এরকম শিক্ষাদানের জন্য বাংলায় মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজনীয়তা থেকেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানা সহ সংস্কৃত প্রেস, হিন্দুস্থানী প্রেস-এ গ্রন্থ ছাপারও বরাত (Order) দিত। এভাবেই বাংলা মুদ্রণ শিল্পে গতির সৃষ্টি হয়।

চার্লস উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকার বিখ্যাত কেন? স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে শিখার বিস্তারকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?

প্রথম অংশ – চার্লস উইলকিন্স ছিলেন প্রাচ্যবাদী পন্ডিত। তিনি পঞ্চানন কর্মকারের সহযোগিতায় বাংলা মুদ্রাক্ষর খোদাই এবং অক্ষর ঢালাই-এর কাজ করেন। তাঁর তৈরি বাংলা মুদ্রাক্ষরের সাহায্যেই হ্যালহেড তাঁর বাংলা গ্রামার বইটিতে উদাহরণরূপে বাংলা মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন। তাই তিনি বাংলার গুটেনবার্গ নামে পরিচিত।

বাংলা মুদ্রাক্ষর তৈরির ক্ষেত্রে উইলকিন্সের সহযোগী ছিলেন হুগলি নিবাসী শিল্পী পঞ্চানন কর্মকার। তাঁর তৈরি মুদ্রাক্ষর হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীকালে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে কর্ণওয়ালিশ কোড -এর বাংলা সংস্করণেও তাঁর তৈরি উন্নত বাংলা মুদ্রাক্ষর ব্যবহার করা হয়। তাঁর প্রচেষ্টাতেই বাংলা হরফ নির্মাণ একটি স্থায়ী শিল্পে পরিণত হয়।

দ্বিতীয় অংশ – উনিশ শতকে খ্রিস্টান মিশনারী ও ব্যক্তিগত এবং সরকারী উদ্যোগে শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি ছাপাখানা থেকে উৎপাদিত গ্রন্থসমূহের মাধ্যমেও শিক্ষার বিস্তার ঘটে। ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল বুক সোসাইটির (১৮১৭ খ্রি.) উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষায় স্কুল-পাঠ্য পুস্তক ছাপানো এবং শিক্ষ্যার্থীদের কাছে তা সরবরাহ করা। ডেভিড হেয়ার আমৃত্যু এই কাজে ব্রতী ছিলেন। এর বিভিন্ন দিকগুলি হল —

নিজস্ব ছাপাখানা – স্কুল বুক সোসাইটি শিক্ষার বিস্তারের উদ্দেশ্যে কলকাতার সার্কুলার রোডে নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া শ্রীরামপুর মিশন প্রেস সহ অন্যান্য প্রেসেও বই ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিল।

বাংলা ভাষার প্রাধান্য – এই সোসাইটি অন্যান্য ভাষায় পুস্তকের পাশাপাশি বাংলা ভাষাতে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করে। এই সোসাইটি প্রথম চার বছরে (১৮১৭-২১ খ্রি:) বাংলা ভাষাতে ১৯টি বইয়ের ৭৯,৭৫০ টি কপি মুদ্রণ ও বিপননের ব্যবস্থা করে।

মুদ্রণের মানোন্নয়ন – বাংলা ভাষার উন্নতিসাধন এবং বাংলা মুদ্রণের মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে এই সোসাইটির উদ্যোগ ছিল প্রশ্নাতীত। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ইংরেজি প্রথানুযায়ী যতিচিহ্নের ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা গ্রন্থের মুদ্রণে ছবি, মানচিত্র, নকশার ব্যবহার শুরু করে।

জ্ঞানচর্চার প্রসার – এভাবে বাংলার ছাপাখানার ইতিহাসে স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে বাংলায় বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা পদার্থদ্যিা, অভিধান, ব্যাকরণ প্রভৃতি। বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তনের ফলে শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের কাছে পাশ্চাত্যের জ্ঞানজগৎ-এর দরজা উন্মোচিত হয়।

উনিশ শতকের প্রথম তিন দশকে বাংলার মিশনারি প্রেসগুলির মুদ্রণ ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করো। এই পর্বের অন্যান্য ছাপাখানাগুলির বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করো।

প্রথম অংশ – উনিশ শতকের শুরুতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগেও বাংলা ছাপাখানার বিস্তার ঘটেছিল; যেমন —

কলকাতার ব্যাপটিস্ট মিশন – শ্রীরামপুর মিশনের নবীন গোষ্ঠী এই মিশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইউ. কেরি, উইলিয়াম পীয়ার্স প্রমুখ কলকাতার সার্কুলার রোডে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন (১৮১৮ খ্রি:)। এই স্কুল বুক সোসাইটির বরাত মতো যেমন বই ছেপেছিল, তেমনি তারা বাংলা মুদ্রণের উন্নতির জন্যও চেষ্টা করেছিল।

চার্চ মিশন প্রেস – আমহার্স্ট স্ট্রিটের চার্চ মিশন প্রেস ছিল উল্লেখযোগ্য প্রেস এবং এখানে ছাপা উল্লেখযোগ্য বই হল ইংল্যান্ডে ও ঐর্লন্ডে সংস্থাপিত মণ্ডলীর সাধারণ প্রার্থনা (১৮২২ খ্রিঃ)। এই গ্রন্থে ফুলস্টপ সহ বিভিন্ন ইংরেজি যতি-চিহ্নও ব্যবহৃত হয়েছিল।

বিশপস্ কলেজ প্রেস – শিবপুরের বিশপস্ কলেজ প্রেস ছিল অপর উল্লেখযোগ্য প্রেস। ধর্মীয় পুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের বই ছাপানো হত। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বই হল মর্টনের বাংলা ইংরেজি অভিধান (১৮২৮ খ্রি:)।

দ্বিতীয় অংশ –

ছাপাখানা – ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত ছাপাখানাগুলি হল – পটলডাঙ্গার লললূলাল কবির সংস্কৃত যন্ত্র, আড়গুলি লেনে হরেন্দ্র রায়ের ছাপাখানা, শোভাবাজারের বিশ্বনাথ দেবের ছাপাখানা, বাঙ্গালি প্রেস প্রভৃতি। এছাড়া বউবাজারের লেবেন্ডর সাহেবের ছাপাখানা, শ্রীরামপুরের নীলমণি হালদারের ছাপাখানা ছিল বিখ্যাত।

উৎপাদন – এই সমস্ত ছাপাখানা থেকে বিভিন্ন-ধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। হিন্দুস্থানী প্রেস থেকে ঔষধসার সংগ্রহ (১৮১৯ খ্রি:), বাঙ্গালি প্রেস থেকে রামমোহন রায়ের কঠোপনিষৎ (১৮১৭ খ্রি:), হরচন্দ্র রায়ের আড়গুলি লেনের প্রেস থেকে বিভিন্নরকম ধর্মীয় গ্রন্থ, বিশ্বনাথ দেবের প্রেস থেকে রাধাকান্ত দেবের বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১ খ্রি:) প্রকাশিত হয়।

লিথোগ্রাফের প্রবর্তন – ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপাখানার বিস্তারের একটি দিক ছিল লিথোগ্রাফিক ছাপা’র প্রবর্তন। এই ধরনের ছাপা ব্যবস্থায় ছবি, নকশা, মানচিত্র আঁকা সম্ভব হয়। প্রকাশনার মানোন্নয়ন – ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত ছাপাখানাগুলিতে মুদ্রণ কৌশল ও মুদ্রণের মানোন্নয়ন ঘটানোরও চেষ্টা করা হয়। প্রকাশনায় শোভনতা বৃদ্ধির দিকেও নজর দেওয়া হয়।

মূল্যায়ণ – এভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা ছাপাখানাগুলি মুদ্রণের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য সাধন করে এবং বাংলার মুদ্রণ ব্যবস্থা ক্রমশই আধুনিক হয়ে ওঠার পথে যাত্রা শুরু করে।

বাংলার ছাপাখানা মুদ্রণের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান ব্যাখ্যা করো। ছাপাখানার ফলাফল বা প্রভাবগুলিকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?

প্রথম অংশ – বিদ্যাসাগর ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত ও লেখক। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পণ্ডিত বা সেরেস্তাদারের পদে নিযুক্ত হন (২৯ ডিসেম্বর, ১৮৪১)। পরবর্তীকালে তিনি সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করেন (এপ্রিল, ১৮৪৬ – জুলাই ১৮৪৭ খ্রি:)। আবার ১৮৫০-এর দশকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন উনিশ শতকের একজন উল্লেখযোগ্য গ্রন্থকার, মুদ্রক ও প্রকাশক।

ঈশ্বরচন্দ্র-বিদ্যাসাগর

ছাপাখানা ও বিদ্যাসাগর – প্রাক্-আধুনিক যুগের ছাপাখানার ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের অবদানের বিভিন্ন দিক হল –

গ্রন্থকার রূপে – বিদ্যাসাগর নিজে ছিলেন একজন গ্রন্থকার। তিনি তাঁর লেখা বেতাল পঞ্চবিংশতি গ্রন্থটি রোজারিও কোম্পানির ছাপাখানায় ছাপানোর ব্যবস্থা করেন (১৮৪৭ খ্রি:)। পরবর্তীকালে তিনি নিজের রচিত অনেক পুস্তক নিজের ছাপাখানাতেই মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।

মুদ্রাকর রূপে বিদ্যাসাগর – ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর তাঁর বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে যৌথভাবে ৬২ নং আমহার্স্ট স্ট্রিটে সংস্কৃত যন্ত্র নামক একটি ছাপাখানা যন্ত্র ন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই ছাপাখানার একক র মালিক হন।

প্রকাশক – এই ছাপাখানা থেকে বিদ্যাসাগর তাঁর নিজের ও অন্যান্য লেখকের রচিত গ্রন্থ ছাপান ও প্রকাশ করেন। র তাঁর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ (১৩ এপ্রিল ও ১৪ জুন, ১৮৫৫ খ্রি.)।

পুস্তক বিক্রেতা – উনিশ শতকে বটতলা ও চিনাবাজার এলাকায় বই বাজার গড়ে উঠলেও হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ অঞ্চলে বইয়ের দোকান ছিল না। তাই বিদ্যাসাগর এই অঞ্চলে সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি নামক একটি বইয়ের দোকান খোলেন।

দ্বিতীয় অংশ – ছাপাখানা প্রবর্তনের ফলে বাংলায় দেখা দেয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব। কারণ ছাপাখানা বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এগুলি হল —

বিদ্যার একচেটিয়া অধিকার নষ্ট – ছাপাখানা প্রবর্তনের পূর্বে বাংলার শাস্ত্রবিদ্যা ও জ্ঞান দানের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পুরোহিতরাই ছিলেন একচেটিয়া অধিকারী। ছাপাখানার প্রবর্তন হলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পুরোহিতদের এই অধিকার নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে শিক্ষার প্রসার ঘটলে জনগণ ক্রমশই জ্ঞানের অধিকারী হয়ে ওঠে।

সমাজ সংস্কার – সমাজ ও ধর্ম সংস্কারের প্রয়োজনে ভারতের প্রাচীন শাস্ত্রগুলির মুদ্রণ বা বাংলায় অনুবাদ-মুদ্রণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আবার বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র, প্রচার পত্র বা পুস্তিকার মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের পক্ষে মতামত গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।

বিভিন্ন পেশা – ছাপাখানাকে কেন্দ্র করে বই লেখা ও বই ছাপা, বই প্রকাশ, বই ব্যবসা, বই বাঁধাই-এর মত বিভিন্নধর্মী পেশার উদ্ভব ঘটে। এভাবে মুদ্রণ ব্যবস্থা বাংলার আর্থ-সামাজিক জীবনের ওপরেও প্রভাব বিস্তার করে।

ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে দেশীয় উদ্যোগে কীভাবে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স ও কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় তা ব্যাখ্যা করো।

প্রথম অংশ – উনিশ শতকে সরকারি উদ্যোগে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ ঘটলেও তা ছিল অপ্রতুল; তাই বাঙালি তথা ভারতীয়রা নিজ উদ্যোগে বিজ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অগ্রসর হয়। এরূপ একটি প্রতিষ্ঠান হল ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (১৮৭৬ খ্রি.)।

ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে দেশীয় উদ্যোগে কীভাবে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স' ও কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় তা ব্যাখ্যা করো।

প্রতিষ্ঠা – ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন। অব সায়েন্স যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা হল -ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের ভক্ত। তিনি এদেশে অনুরূপ বিজ্ঞানচর্চা ও তার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউট ও ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স-এর অনুকরণে একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার কথা প্রচার করেন। অবশেষে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দান ও তাঁর জীবনের সঞ্চিত অর্থের সাহায্যে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে প্রতিষ্ঠা করেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স।

উদ্দেশ্য – ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছিল দ্বিবিধ – প্রথমত, বিজ্ঞানের প্রসার সাধন ও প্রকৃত গবেষণার মাধ্যমে প্রায়োগিক বিজ্ঞানের পরিধির বিস্তার এবং দ্বিতীয়ত, সম্পূর্ণরূপে নিজেদের উদ্যোগে ও তত্ত্বাবধানে স্বাধীনভাবে গবেষণা করাই ছিল এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য।

গুরুত্ব – ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর প্রতিষ্ঠা বিভিন্ন কারণে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে

  • ভারত তথা বাংলা বিজ্ঞান গবেষণার জন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লাভ করে।
  • এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই আধুনিক বিজ্ঞান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গবেষক স্যার সি. ভি রমন এবং কে. এস. কৃষ্ণান ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সম্পদ।

দ্বিতীয় অংশ – কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা আকস্মিক ছিল না, তা ছিল একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া —

তারকনাথ পালিতের উদ্যোগ – বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী তারকনাথ পালিত দেশীয় ব্যক্তিদের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার উন্নতি ও বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে জমি ও টাকা দান করেন (জুন, ১৯১২ খ্রি:)।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টা – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সরকারের কাছে এই জমির উপর ল্যাবরেটরি সহ একটি আবাসিক বিজ্ঞান কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সরকার এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।

রাসবিহারী ঘোষের উদ্যোগ – সরকার কর্তৃক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে রাসবিহারী ঘোষ উপরোক্ত প্রস্তাবিত বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ লাখ টাকা দান করেন। এই অর্থের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ।

কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পঠন-পাঠন – কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠাকালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই কলেজকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ বলে ঘোষণা করেন। এই কলেজের প্রথম এম.এস.সি ব্যাচের ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানেন্দ্ৰ মুখার্জী। আবার কলেজের অধ্যাপকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সি. ভি রমন, গণেশ প্রসাদ আগারকার।

জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান গবেষণা উল্লেখ করে বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা ব্যাখ্যা করো।

ভূমিকা – উনিশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা ও বিজ্ঞান গবেষণার সূচনা হয় এবং এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গবেষক ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮- ১৯৩৭ খ্রি:)।

শিক্ষালাভ – জগদীশচন্দ্র বসু কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় বি. এ. পাস করেন (১৮৭৯ খ্রি:)। পরবর্তীকালে তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন, পদার্থ বিদ্যা ও উদ্ভিদ বিদ্যার ট্রাইপস ডিগ্রি (অনার্সসহ ডিগ্রি পরীক্ষা) লাভ করেন এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি. পাস করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

কর্মজীবন ও বিজ্ঞান গবেষণা – ইংল্যান্ড থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকরূপে যোগদান করেন (১৮৮৫ খ্রি.)। এই কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি কলেজের মাত্র ২৪ বর্গফুট ঘরেই বিজ্ঞান গবেষণাও করতে থাকেন। তাঁর গবেষণার তিনটি পর্যায় ছিল — প্রথম পর্যায়ে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ সম্পর্কে গবেষণা করেন ও বেতার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে জীবনের উৎপত্তি সংক্রান্ত গবেষণা করেন এবং তৃতীয় পর্যায়ে উদ্ভিদ ও প্রাণী সংক্রান্ত গবেষণা করেন। তিনি উদ্ভিদের স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপ ও বৃদ্ধি মাপার জন্য ক্রেস্কোগ্রাফ নামক একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন।

বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা – জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ সংক্রান্ত গবেষণায় উদ্ভূত নতুন তত্ত্ব ও তথ্যের কথা ইংল্যাণ্ডের রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে বক্তৃতার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এরপর তিনি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই সময়েই রয়্যাল সোসাইটির বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা ভারত সরকারের কাছে জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণার জন্য একটি উন্নতমানের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার অনুরোধ জানান। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।

প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণের পর জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর বাড়িতেই ছোটো গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করে গবেষণার কাজ শুরু করেন। এর পাশাপাশি তিনি তাঁর নিজের ও দেশের স্বার্থে একটি বৃহৎ গবেষণাগার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। শেষপর্যন্ত তাঁর নিজস্ব অর্থ ও সংগৃহীত ১১ লাখ টাকা অনুদানের অর্থে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন বসু বিজ্ঞান মন্দির (২৩ নভেম্বর, ১৯১৭)

জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান গবেষণা উল্লেখ করে বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা ব্যাখ্যা করো।

মূল্যায়ণ – এভাবে দেখা যায় যে, জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন একজন সফল বাঙালি বৈজ্ঞানিক এবং উদ্যোগপতি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দির হয়ে ওঠে আধুনিক ভারতের অন্যতম বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠা ও কার্যাবলী ব্যাখ্যা করো। বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?

ভূমিকা – বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকালে জাতীয় শিক্ষা ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (১৯০৬ খ্রি:)। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বাংলার শিক্ষার ইতিহাসে এক বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির সঞ্চার করে।

প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য – জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (১৯০৬ খ্রি.) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি হল –

  • ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষানীতির বিরোধিতা করা
  • দেশের প্রয়োজনে স্বদেশি ধাঁচে এক বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই শিক্ষাব্যবস্থার দুটি দিক ছিল যথা — সাধারণ বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা।

কার্যাবলী – জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কার্যাবলীর বিভিন্ন দিক হল –

ন্যাশনাল কলেজ – সাধারণ বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা শিক্ষার জন্য জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বৌবাজারে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন জাতীয়তাবাদী চরমপন্থী নেতা অরবিন্দ ঘোষ।

বিদ্যালয় – জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে ও উৎসাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে (রংপুর, ঢাকা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা প্রভৃতি) জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।

ব্যর্থতার কারণ – জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ভারতে প্রথমবার জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়; কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ব্যর্থতার কারণগুলি হল —

  • জাতীয় শিক্ষাপরিষদ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে অর্থ সংকটের সম্মুখীন হয়
  • প্রথম দিকে অনেক শিক্ষক এগিয়ে এলেও বেতনের স্বল্পতার কারণে অনেক শিক্ষক এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেন
  • চাকরির বাজারে এই প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট ছিল গুরুত্বহীন; তাই এই কলেজে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি
  • তৎকালীন চরমপন্থী নেতারা এই পরিষদকে স্বীকৃতিও দেয়নি।

দ্বিতীয় অংশ – উনিশ শতকে সরকারী উদ্যোগে ভারতে কারিগরী শিক্ষার বিকাশ ছিল সীমিত। বিশ শতকে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ স্থাপিত হলে কারিগরী শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ সূচিত হয়। কিন্তু বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা না কারিগরি শিক্ষার ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে-এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কর্মকর্তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। এই পরিষদদের সদস্য তারকনাথ পালিতের উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (জুলাই, ১৯০৬ খ্রি:)।

বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের পাঠ্যক্রম ছিল কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রিক। এখানে তিন বছরের ইন্টারমিডিয়েট ও চার বছরের সেকেন্ডারি বা মাধ্যমিক শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়। সমকালীন শিক্ষক বিনয়কুমার সরকার উপহাস করে এই প্রতিষ্ঠানকে মিস্তিরি তৈরীর কারখানা বলে অভিহিত করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী ভাবনার মাধ্যমে কীভাবে প্রকৃতি মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটেছিল তা ব্যাখ্যা করো।

ভূমিকা – ভারতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনের জন্য দক্ষ কেরানি তৈরি করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এরূপ শিক্ষাধারার সমালোচনা করেন এবং শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামক এক বিদ্যালয় ও পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী স্থাপন করে এক বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা করেন।

শান্তিনিকেতন ভাবনা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক শান্তিনিকেতনে ব্রষ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল —

  • এরূপ আবাসিক ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষক ছাত্র সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করা এবং এভাবে প্রাচীন ভারতের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের গুরু-শিষ্য সম্পর্ককে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
  • প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে এক নতুন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

শিক্ষাব্যবস্থা – রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন বা শিক্ষণ সম্পর্কে কয়েকটি বিষয়ের উপর জোর দেন, যেমন —

তিন নীতি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই নতুন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় তিনটি নীতি প্রয়োগ করেন যথা — অবাধ স্বাধীনতা, অবাধ চলাফেরা ও খেলাধুলা। প্রকৃতির সঙ্গে যোগ রেখে মনের চর্চার ওপর গুরুত্ব দেন।

সাংস্কৃতিক বিষয় – প্রকৃতি থেকে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার পাশাপাশি এক উন্নত সাংস্কৃতিক বিষয়কে পাঠক্রমে রাখা হয়। এগুলি হল — কলা, নৃত্য, নাটক, সংগীত অঙ্কন প্রভৃতি। এগুলি শেখানোর জন্য বিষয় বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হয়।

কারিগরি শিক্ষা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই বিদ্যালয়ে একই সঙ্গে ব্যক্তি ও সমষ্টির শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়।

বিশ্বভারতী ভাবনা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে যে সমস্ত আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সেগুলি হল —

ভারতীয় আদর্শকে তুলে ধরা – শান্তিনিকেতনকে কেন্দ্ৰ করে ভারতের আদর্শ ও বাণী বিশ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যেই তিনি বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।

নিজের কর্তব্য সম্পাদন – রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সাহিত্যিকরূপে বিশ্ববাসীকে যেমন সাহিত্য উপহার দেন, তেমনি তিনি ভারতবাসীর হয়ে বিশ্বকে কিছু প্রদান করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি একজন ভারতীয়রূপে নিজের কর্তব্য সম্পাদনের জন্য বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রতিষ্ঠা – ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয় (৮ পৌষ, ১৩২৫ বঙ্গাব্দ)। এর তিনবছর পর পৌষ উৎসবে বিশ্বভারতী উদ্ঘাটিত হয়। বিশ্বভারতী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার তিনটি স্তর ছিল যথা —

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী ভাবনার মাধ্যমে কীভাবে প্রকৃতি মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটেছিল তা ব্যাখ্যা করো।

ভারত সংস্কৃতি – ভারতের সমগ্ররূপ উপলব্ধি করতে ভারতের নানা সংস্কৃতি (বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন ও মুসলমান) কে তুলে ধরা।

বিদ্যা উৎপাদন – তাঁর ভাবনায় প্রকাশিত হয় যে, বিশ্বভারতীর মূল কাজ হবে বিদ্যার উৎপাদন। বিদ্যা বিতরণ হবে গৌণ কাজ। এই উদ্দেশ্যে বিশ্বের মনীষীদের আহ্বান করে বিশ্বভারতীতে তাঁদের আনার কাজ শুরু হয়।

উৎপাদন-শিক্ষা – শিক্ষার্থীদের অর্থশাস্ত্র, কৃষি তত্ত্ব, নানা ব্যবহারিক বিদ্যা শিক্ষা ও বিশ্বভারতীর চতুর্দিকে তার প্রয়োগের ব্যবস্থা করাও ছিল তাঁর চিন্তা ভাবনার বিভিন্ন দিক। এরই সূত্র ধরে শ্রী নিকেতনের প্রতিষ্ঠা করা হয়।

উপসংহার – উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচলিত শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের পরিবর্তে প্রকৃতি মানুষ ও শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে সচেষ্ট হন। তবে এই শিক্ষা আনন্দপাঠ হলেও ঔপনিবেশিক কাঠামোর তা কার্যকরী শিক্ষা ছিল না।

বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ ভারতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই ধারার প্রভাবে ভারতীয় সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ সুগম হয়।

JOIN US ON WHATSAPP

JOIN US ON TELEGRAM

Please Share This Article

About The Author

Related Posts

মাধ্যমিক - ভূগোল - বারিমন্ডল - জোয়ার ভাটা - রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক – ভূগোল – বারিমন্ডল – জোয়ার ভাটা – রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর

Class 10 English – The Passing Away of Bapu – About Author and Story

Class 10 English – The Passing Away of Bapu – About Author and Story

The Passing Away of Bapu

Class 10 English – The Passing Away of Bapu – Question and Answer

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

Trending Now

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Class 9 – English Reference – Tom Loses a Tooth – Question and Answer

Class 9 – English Reference – The North Ship – Question and Answer

Class 9 – English – His First Flight – Question and Answer

Class 9 – English – A Shipwrecked Sailor – Question and Answer