উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও তার ফলে সৃষ্ট সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। এই আকাঙ্ক্ষার ফলে ভারতে একাধিক বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগের উদ্ভব হয়। এই অধ্যায়ে আমরা এই বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগগুলি সম্পর্কে জানব।
বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব কীভাবে হয়েছিল তা বিশ্লেষণ করো।
পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে ছাপাখানায় উদ্ভব ঘটলেও বাংলায় তা ছিল বিলম্বিত প্রক্রিয়া। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাসি হ্যালহেড-এর রচিত ‘আ গ্রামার অব্ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গোয়েজ’ গ্রন্থে প্রথম ব্যাপকভাবে বাংলার মুদ্রাক্ষর ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব হয়।
প্রেক্ষাপট – বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব আকস্মিক ছিল না। কারণ –
বিক্ষিপ্ত মুদ্রণ – ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রায় একশ বছর ধরে বিক্ষিপ্তভাবে বাংলা হরফযুক্ত মুদ্রণের কাজ হয়েছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আতানাসিউস কিসের রচিত ‘চায়না ইলাস্ট্রেটা’ (১৬৬৭ খ্রি.) ও হ্যালহেড-এর রচিত-এ কোড অব জেন্টু লজ’ (১৭৭৬ খ্রি.)।
প্রশাসনিক প্রয়োজন – ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রেগুলেটিং আইনের মাধ্যমে বাংলায় প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজ শাসনের সূচনা হলে বাংলা ভাষায় আইন বা নির্দেশাদনের প্রয়োজন দেখা দেয়।
হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতা – বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলা ভাষায় মুদ্রণের ক্ষেত্রে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, হেস্টিংস নিজ দায়িত্বে সরকারি খরচে এই গ্রন্থটি মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।
উইলকিন্স-এর ভূমিকা – ইংরেজ প্রশাসন চার্লস উইলকিন্স ছিলেন একজন প্রাচ্যভাষার পন্ডিত এবং তিনি ছিলেন বাংলার মুদ্রাক্ষর তৈরিতে অভিজ্ঞ। তিনি হেস্টিংসের অনুরোধে পঞ্চানন কর্মকারের সহযোগিতায় হ্যালহেড-এর ব্যাকরণ গ্রন্থের মুদ্রাক্ষর তৈরি করে দেন।
উপসংহার – এভাবে বাংলায় মুদ্রণ ব্যবস্থা বা ছাপাখানার উদ্ভব ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ছাপাখানার উদ্ভব ও বিকাশে উনিশ শতক ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ শতক।
বাংলায় ছাপাখানা বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বহির্ভারতে বিক্ষিপ্তভাবে মুদ্রণের ক্ষেত্রে বাংলা মুদ্রাক্ষর ব্যবহৃত হলেও ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব হয়।
প্রাথমিক পর্যায় – ছাপাখানার বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় ছিল ১৭৭৮-১৭৯৯ খ্রিঃ। এই সময়পর্বে ছাপাখানার বিভিন্ন দিকগুলি হল —
হ্যালহেড-এর ব্যাকরণ – ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাসি হ্যালহেড ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী বা ইংরেজদের বাংলা শিক্ষার জন্য ইংরেজি ভাষায় ‘A Grammar of the Bengal Language’ নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থের মোট পৃষ্ঠার চারভাগের একভাগ অংশে উদাহরণরূপে বাংলা হরফ ব্যবহার করেন। এইভাবে প্রথম বাংলা মুদ্রণ বা ছাপার কাজ শুরু হয়।
কোম্পানির প্রেস – হুগলির অ্যান্ড্রুজের ছাপাখানা ছিল বাংলার প্রথম ছাপাখানা। তবে এই ছাপাখানার সব যন্ত্রপাতি ক্রয় করে সরকারি উদ্যোগে উইলকিন্সের নেতৃত্বে কলকাতায় কোম্পানির প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় (১৭৮০ খ্রি.)।
হিকির প্রেস – কোম্পানির প্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে এই প্রেস থেকে ‘হিকি’জ গেজেট’ নামক সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের প্রথম দশটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পরে অবশ্য হিকি নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
অন্যান্য প্রেস – কোম্পানির প্রেসের সমসাময়িক অপর একটি ছাপাখানাও ছিল এবং এটি কলকাতায় ৩৭ নং লারকিন্স লেনে অবস্থিত ছিল। এছাড়া ক্যালকাটা গেজেট প্রেস’ নামক আধা-সরকারি ছাপাখানা (১৭৮৪ খ্রি.), ‘ক্রনিকল প্রেস’ ও ‘ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানির প্রেস’ ছিল উল্লেখযোগ্য ছাপাখানা।
উপসংহার – বাংলার প্রাথমিক পর্যায়ের এই ছাপাখানাগুলির উৎপাদন ছিল আইন ও আইনগ্রন্থের অনুবাদ, ব্যাকরণ – অভিধান ও শব্দকোষ এবং সংবাদপত্র ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন।
শ্রীরামপুর মিশন প্রেস ও তার কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – বাংলায় ছাপাখানা ব্যবস্থার উদ্যোগ বিলম্বিত হলেও উনিশ শতকের সূচনায় তা দ্রুত বিকাশলাভ করতে থাকে। এই বিকাশের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস।
মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা – খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়াম। কেরি বাংলা ভাষায় বাইবেল ছাপানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন (১৭৯৮ খ্রি.)। কিন্তু তা প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় নিজেই ছাপাখানা প্রবর্তন করে তা ছাপানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠিত হলে (১৮০০ খ্রি.) কেরি এখানেই শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপন করেন। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই এই ছাপাখানা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছাপাখানায় পরিণত হয়।
মিশন প্রেসের উৎপাদন – শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের উৎপাদনগুলি হল —
ধৰ্ম্ম পুস্তক – প্রাথমিক পর্বে কেরির সহযোগী ছিলেন অভিক্ষ ও দক্ষ মুদ্রাকর ওয়ার্ড এবং পঞ্চানন কর্মকার। তিনি কলকাতা থেকে সংগৃহীত হরফ এবং কিছু পাটনাই ও বিদেশি কাগজ সহযোগে ছাপার কাজ শুরু করেন। নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম অধ্যায়টির বাংলা অনুবাদ করে কেরি ১০৭ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট ‘মঙ্গল সমাচার মাতিউর রচিত’ নামে প্রকাশ করেন। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে আটশোরও অধিক পৃষ্ঠাযুক্ত ‘ধৰ্ম্মপুস্তক’ বা বাংলা বাইবেল প্রকাশ করেন।
অন্যান্য বই – শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে রামরাম বসুর রচিত ‘হরকরা’ ও ‘জ্ঞানোদয়’ নামক দুটি গ্রন্থ (আগস্ট সেপ্টেম্বরে, ১৮০০ খ্রি.) মুদ্রিত হয়। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘বত্রিশ সিংহাসন’ (১৮০২ খ্রি.), ৪ খণ্ডে কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’ (১৮০১-০৩) ও পাঁচ খণ্ডে কীর্তিবাসের ‘রামায়ণ’ (১৮০২-০৩) মুদ্রিত হয়। এভাবে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই প্রেসে ৪০টি বিভিন্ন ভাষায় ২,১২,০০০ কপি বই মুদ্রিত হয়।
পাঠ্যপুস্তক – শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকও মুদ্রিত হয়েছিল। এই সব পুস্তকের রচয়িতা ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু, চণ্ডীচরণ মুন্সী, হরপ্রসাদ রায় প্রমুখ।
উপসংহার – উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, ধর্মীয় উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপিত হলেও তার ছাপাখানা-উৎপাদনে ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ও ছিল।
ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে ছাপাখানা ও শিক্ষার বিস্তার বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – বাংলায় ছাপাখানার প্রবর্তনের ফলে লেখকের সঙ্গে পাঠকের সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইতি-পূর্বের সীমাবদ্ধ জ্ঞান অন্যান্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে ছাপাখানা ও শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগ ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ।
স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগ – উদ্দেশ্য – ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল বুক সোসাইটির (১৮১৭ খ্রি.) উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষায় স্কুল-পাঠ্য পুস্তক ছাপানো এবং শিক্ষ্যার্থীদের কাছে তা সরবরাহ করা। ডেভিড হেয়ার আমৃত্যু এই কাজে ব্রতী ছিলেন।
নিজস্ব ছাপাখানা – স্কুল বুক সোসাইটি শিক্ষার বিস্তারের উদ্দেশ্যে কলকাতার সার্কুলার রোডে নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া শ্রীরামপুর মিশন প্রেস সহ অন্যান্য প্রেসেও বই ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিল।
বাংলা ভাষার প্রাধান্য – এই সোসাইটি অন্যান্য ভাষায় ছাপানো পুস্তকের পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করে। এই সোসাইটি প্রথম চার বছরে (১৮১৭-২১ খ্রি:) বাংলা ভাষাতে ১৯টি বইয়ের ৭৯,৭৫০ টি কপি মুদ্রণ ও বিপননের ব্যবস্থা করে।
মুদ্রণের মানোন্নয়ন – বাংলা ভাষার উন্নতিসাধন এবং বাংলা মুদ্রণের মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে এই সোসাইটির উদ্যোগ ছিল প্রশ্নাতীত। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ইংরেজি প্রথানুযায়ী। যতিচিহ্নের ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা গ্রন্থের মুদ্রণে ছবি, মানচিত্র, নকশার ব্যবহার শুরু করে।
উপসংহার – এভাবে বাংলার ছাপাখানার ইতিহাসে স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে বাংলায় বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, অভিধান, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তন ঘটে। এই ঘটনা শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের কাছে পাশ্চাত্যের জ্ঞানজগৎ-এর দরজা উন্মোচন করে দেয়।
ব্যাবসায়িক ভিত্তিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপাখানার বিস্তার কীভাবে হয়েছিল?
উনিশ শতকের শুরুতে সরকারি ও মিশনারি উদ্যোগে ছাপাখানার বিকাশের পাশাপাশি ব্যাবসায়িক ভিত্তিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ছাপাখানার বিস্তার ঘটতে থাকে।
ব্যক্তিগত উদ্যোগ – (১৮১৭-১৮৩৪) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ছাপাখানার বিস্তার পর্ব নামে পরিচিত এবং এই সময়ে ব্যাবসায়িক ভিত্তিতে কলকাতা ও তার আশেপাশের এলাকায় যেভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপাখানার বিস্তার ঘটে তা হল –
ছাপাখানা – ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত ছাপাখানাগুলি হল — পটলডাঙ্গার লললূলাল কবির সংস্কৃত যন্ত্র, আড়গুলি লেনে হরেন্দ্র রায়ের ছাপাখানা, শোভাবাজারের বিশ্বনাথ দেবের ছাপাখানা, বাঙ্গালি প্রেস প্রভৃতি। এছাড়া বউবাজারের লেবেন্ডর সাহেবের ছাপাখানা, শ্রীরামপুরের নীলমণি হালদারের ছাপাখানা ছিল বিখ্যাত।
উৎপাদন – এই সমস্ত ছাপাখানা থেকে বিভিন্ন ধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। হিন্দুস্থানী প্রেস থেকে ঔষধসার সংগ্রহ (১৮১৯ খ্রি:), বাঙ্গালি প্রেস থেকে রামমোহন রায়ের ‘কঠোপনিষৎ’ (১৮১৭ খ্রি:), হরচন্দ্র রায়ের আড়গুলি লেনের প্রেস থেকে বিভিন্ন রকম ধর্মীয় গ্রন্থ, বিশ্বনাথ দেবের প্রেস থেকে রাধাকান্ত দেবের ‘বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ’ (১৮২১ খ্রি:) প্রকাশিত হয়।
লিথোগ্রাফের প্রবর্তন – ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপাখানার বিস্তারের একটি দিক ছিল লিথোগ্রাফিক ছাপা’র প্রবর্তন। এই ধরনের ছাপাব্যবস্থায় ছবি, নকশা, মানচিত্র আঁকা সম্ভব হয়।
প্রকাশনার মানোন্নয়ন – ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত ছাপাখানাগুলিতে মুদ্রণ কৌশল ও মুদ্রণের মানোন্নয়ন ঘটানোরও চেষ্টা করা হয়। প্রকাশনায় শোভনতা বৃদ্ধির দিকেও নজর দেওয়া হয়।
উপসংহার – এভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা ছাপাখানাগুলি মুদ্রণের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য সাধন করে এবং বাংলার মুদ্রণ ব্যবস্থা ক্রমশই আধুনিক হয়ে ওঠার পথে যাত্রা শুরু করে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কীভাবে ছাপাখানার ব্যাবসায়িক উদ্যোগে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করেন তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – বিদ্যাসাগর ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত ও লেখক। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পণ্ডিত বা সেরেস্তাদারের পদে নিযুক্ত হন (২৯ ডিসেম্বর, ১৮৪১)। পরবর্তীকালে তিনি সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করেন (এপ্রিল, ১৮৪৬) জুলাই ১৮৪৭ খ্রি:)। আবার ১৮৫০-এর দশকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন উনিশ শতকের একজন উল্লেখযোগ্য গ্রন্থকার, মুদ্রক ও প্রকাশক।
ছাপাখানা ও বিদ্যাসাগর – প্রাক্-আধুনিক যুগের ছাপাখানার ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের অবদানের বিভিন্ন দিক হল –
গ্রন্থকার রূপে – বিদ্যাসাগর নিজে ছিলেন একজন গ্রন্থকার। তিনি তাঁর লেখা ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ গ্রন্থটি রোজারিও কোম্পানির ছাপাখানায় ছাপানোর ব্যবস্থা করেন (১৮৪৭ খ্রি:)। পরবর্তীকালে তিনি নিজের রচিত অনেক পুস্তক নিজের ছাপাখানাতেই মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।
মুদ্রাকর রূপে বিদ্যাসাগর – ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর তাঁর বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে যৌথভাবে ৬২ নং আমহার্স্ট স্ট্রিটে ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নামক একটি ছাপাখানা যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই ছাপাখানার একক মালিক হন।
প্রকাশক – এই ছাপাখানা থেকে বিদ্যাসাগর তাঁর নিজের ও অন্যান্য লেখকের রচিত গ্রন্থ ছাপান ও প্রকাশ করেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ (১৩ এপ্রিল ও ১৪ জুন, ১৮৫৫ খ্রি.)।
পুস্তক বিক্রেতা – উনিশ শতকে বটতলা ও চিনাবাজার এলাকায় বই বাজার গড়ে উঠলেও হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ অঞ্চলে বইয়ের দোকান ছিল না। তাই বিদ্যাসাগর এই অঞ্চলে ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি’ নামক একটি বইয়ের দোকান খোলেন।
উপসংহার – এভাবে বিদ্যাসাগর গ্রন্থকার, প্রকাশক ও মুদ্রাকর হয়ে ওঠেন। এর পাশাপাশি তিনি ছাপাখানার টেকনিক্যাল ব্যাপারেও উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হন, যার উদাহরণ হল ‘বিদ্যাসাগর সাট’।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও ইউ. এন. রায় অ্যান্ড সন্স সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণমূলক টীকা লেখো।
ভূমিকা – প্রাক্-আধুনিক বাংলা মুদ্রণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫ খ্রি:)। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে ছাপাখানায় আসে এক বিপ্লব।
ছাপাখানার উন্নতি – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন একজন শিশুসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী। স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশনা ও ছাপাখানার প্রাথমিক জ্ঞান তাঁর ছিল। তিনি যেভাবে ছাপাখানার উন্নতিসাধন করেন তা হল –
নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা – তিনি নিজে ইউ. এন. রায়, অ্যান্ড সন্স’ নামক একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এনগ্রেভিং পদ্ধতিতে মুদ্রণ ব্যবস্থার যে সীমাবদ্ধতাগুলি ছিল তা দূর করেন। এর পাশাপাশি তিনি রঙিন ও হাফটোন ব্লকের প্রবর্তন করে ভারতের তথা বিশ্বের মুদ্রণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উন্নতিসাধন করেন।
নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সম্পূর্ণ দেশীয় উপাদানে গবেষণা করে রঙিন মুদ্রণের নানাপ্রকার ডায়াফর্ম যন্ত্র, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডুয়োটাইপ ও টিন্ট প্রসেস পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন।
পথপ্রদর্শক – উপেন্দ্রকিশোর উদ্ভাবিত স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্রের নাম হয় ‘রে-স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার’ এবং টিন্ট প্রসেস-এর নাম হয় — ‘রে-টিন্ট সিস্টেম’। বি সর্বোপরি উপেন্দ্রকিশোরের পরিকল্পনা অনুসরণ করে ব্রিটেনে বাণিজ্যিকভাবে স্ক্রিন অ্যাডজাস্টিং মেশিন’ তৈরি করা হয়।
উপসংহার – এভাবে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ইউ. এন. রায় অ্যান্ড সন্স’ ছাপাখানা ভারত ও বিশ্বে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী হয়ে ওঠে।
কীভাবে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠিত হয় তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – উনিশ শতকে সরকারি উদ্যোগে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ ঘটলেও তা ছিল অপ্রতুল; তাই বাঙালি তথা ভারতীয়রা নিজ উদ্যোগে বিজ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অগ্রসর হয়। এরূপ একটি প্রতিষ্ঠান হল ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অবসায়েন্স’ (১৮৭৬ খ্রি.)।
প্রতিষ্ঠা – ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের ভক্ত। তিনি এদেশে অনুরূপ বিজ্ঞানচর্চা ও তার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউট ও ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স-এর অনুকরণে একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার কথা প্রচার করেন। অবশেষে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দান ও তাঁর জীবনের সঞ্চিত অর্থের সাহায্যে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে প্রতিষ্ঠা করেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স।
উদ্দেশ্য – ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছিল দ্বিবিধ – প্রথমত, বিজ্ঞানের প্রসার সাধন ও প্রকৃত গবেষণার মাধ্যমে প্রায়োগিক বিজ্ঞানের পরিধির বিস্তার এবং দ্বিতীয়ত, সম্পূর্ণরূপে নিজেদের উদ্যোগে ও তত্ত্বাবধানে স্বাধীনভাবে গবেষণা করাই ছিল এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য।
গুরুত্ব – ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর প্রতিষ্ঠা বিভিন্ন কারণে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে
- ভারত তথা বাংলা বিজ্ঞান গবেষণার জন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লাভ করে।
- এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই আধুনিক বিজ্ঞান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গবেষক স্যার সি. ভি রমন এবং কে. এস. কৃয়ান ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সম্পদ।
কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – বিংশ শতকেও সরকারি উদ্যোগে বিজ্ঞানচর্চা ও কারিগরি শিক্ষার পর্যাপ্ত প্রসার ঘটেনি; তাই বিশিষ্ট আইনজীবি তারকনাথ পালিত ও জাতীয়তাবাদী নেতা { রাসবিহারী ঘোষের উদ্যোগে কলকাতায় একটি বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় (২৭ মার্চ, ১৯১৪ খ্রি.)।
প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট – কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা আকস্মিক ছিল না, তা ছিল একটি বিশেষ প্রক্রিয়া –
তারকনাথ পালিতের উদ্যোগ – বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী তারকনাথ পালিত দেশীয় ব্যক্তিদের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার উন্নতি ও বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে জমি ও টাকা দান করেন (জুন, ১৯১২ খ্রি:)।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টা – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সরকারের কাছে এই জমির উপর ল্যাবরেটরি সহ একটি আবাসিক বিজ্ঞান কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সরকার এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।
রাসবিহারী ঘোষের উদ্যোগ – সরকার কর্তৃক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে রাসবিহারী ঘোষ উপরোক্ত প্রস্তাবিত বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ লাখ টাকা দান করেন। এই অর্থের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ ৷
কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পঠন-পাঠন – কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠাকালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই কলেজকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ বলে ঘোষণা করেন। এই কলেজের প্রথম এম.এস.সি ব্যাচের ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানেন্দ্ৰ মুখার্জী। আবার কলেজের অধ্যাপকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সি. ভি রমন, গণেশ প্রসাদ আগারকার।
জগদীশচন্দ্র বসু – টীকা লেখো।
ভূমিকা – উনিশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা ও বিজ্ঞান গবেষণার সূচনা হয় এবং এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গবেষক ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮- ১৯৩৭ খ্রি:)।
শিক্ষালাভ – জগদীশচন্দ্র বসু কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিদ্যায় বি. এ. পাস করেন (তখন বি. এস. সি ছিল না)। পরবর্তীকালে তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন, পদার্থ বিদ্যা ও উদ্ভিদ বিদ্যায় ট্রাইপস ডিগ্রি (অনার্সসহ ডিগ্রি পরীক্ষা) লাভ করেন এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি. পাস করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
কর্মজীবন – ইংল্যান্ড থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকরূপে যোগদান করেন (১৮৮৫ খ্রি.)। এই কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি কলেজের মাত্র ২৪ বর্গফুট ঘরেই বিজ্ঞান গবেষণাও করতে থাকেন। তাঁর গবেষণার তিনটি পর্যায় ছিল — প্রথম পর্যায়ে ‘বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ সম্পর্কে গবেষণা করেন ও ‘বেতার যন্ত্র’ আবিষ্কার করেন (যদিও সেই সময় স্বীকৃতি পায় নি)। দ্বিতীয় পর্যায়ে জীবনের উৎপত্তি সংক্রান্ত গবেষণা করেন এবং তৃতীয় পর্যায়ে উদ্ভিদ ও প্রাণী সংক্রান্ত গবেষণা করেন। তিনি উদ্ভিদের স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপ ও বৃদ্ধি মাপার জন্য ‘ক্রেস্কোগ্রাফ’ নামক একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন।
বসুবিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা – জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর উপরোক্ত গবেষণার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিখ্যাত হন। কিন্তু গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর একটি উন্নত গবেষণাগার দরকার ছিল। সরকারের কাছে প্রস্তাব দিলেও তা গড়ে ওঠেনি। শেষপর্যন্ত তাঁর নিজস্ব অর্থ ও সংগৃহীত ১১ লাখ টাকার অনুদানের সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ (২৩ নভেম্বর, ১৯১৭ খ্রিঃ)।
উপসংহার – জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন একজন সফল বাঙালি বৈজ্ঞানিক এবং উদ্যোগপতি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দির হয়ে ওঠে আধুনিক ভারতের অন্যতম বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার।
ঔপনিবেশিক শিক্ষা ধারণার সমালোচনাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবে?
ভূমিকা – উনিশ শতকে মেকলে মিনিটের মাধ্যমে ভারতে যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন হয়েছিল তার সঙ্গে বাস্তবজীবনের সম্পর্ক না থাকায় ভারতীয়রা এই শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিল।
শিক্ষা ধারণার সমালোচনা – ঔপনিবেশিক শিক্ষা ধারণার সীমাবদ্ধতা থেকেই ভারতীয়রা উনিশ শতকে এক বিকল্প শিক্ষানীতির কথা চিন্তাভাবনা শুরু করে –
মাতৃভাষার গুরুত্ব – জনগণের মধ্যে কার্যকরী শিক্ষার প্রসারের দাবি থেকেই গণমুখী শিক্ষাভাবনা গড়ে ওঠে এবং এই শিক্ষার দিক ছিল বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে উদয়চন্দ্র আঢ্য নামক ডিরোজিও পন্থী একজন সাংবাদিক মাতৃভাষা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যমরূপে দাবি করেন। আবার এক দু’বছর পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রদানের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা। পরবর্তীকালে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেন।
কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষা – প্রমথনাথ বসু কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষার উপরে গুরুত্ব আরোপ করেন। এই একই উদ্দেশ্যে যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ একটি অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলেন।
সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যয় – জাতীয়তাবাদী নেতা তথা ‘ডন’ পত্রিকার (১৮৯৭ খ্রি:) প্রতিষ্ঠাতা সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার সমালোচনা করেন। তিনি দেশের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তনের কথা বলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার সমালোচনার ক্ষেত্রে সর্বাধিক বিখ্যাত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শিক্ষাকে সমালোচনা করেন ও স্কুলগুলিকে ‘ছেলেদের মানুষ করার যন্ত্র নামে অভিহিত করেন। এর পাশাপাশি তিনি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় ভারতীয় জীবনাদর্শ ও রীতিনীতিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। তিনি শান্তিনিকেতনে রত্নচর্যাশ্রম নামক একটি আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে বিকল্প শিক্ষানীতির প্রবর্তন করেন।
উপসংহার – এভাবে ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারা সমালোচনার মাধ্যমে ভারতে জাতীয় শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন কালে গড়ে ওঠে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ — টীকা লেখো।
ভূমিকা – বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকালে জাতীয় শিক্ষা ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (১৯০৬ খ্রি:)। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বাংলার শিক্ষার ইতিহাসে এক বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির সঞ্চার করে।
প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য – জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (১৯০৬ খ্রি.) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি হল — 1. ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষানীতির বিরোধিতা করা, 2. দেশের প্রয়োজনে স্বদেশি ধাঁচে এক বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই শিক্ষাব্যবস্থার দুটি দিক ছিল যথা — সাধারণ বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
কার্যাবলী – জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কার্যাবলীর বিভিন্ন দিক হল –
ন্যাশনাল কলেজ – সাধারণ বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা শিক্ষার জন্য জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বৌবাজারে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন জাতীয়তাবাদী চরমপন্থী নেতা অরবিন্দ ঘোষ।
বিদ্যালয় – জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে ও উৎসাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে (রংপুর, ঢাকা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা প্রভৃতি) জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
টেকনিক্যাল কলেজ – বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা না কারিগরি শিক্ষার ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে-এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কর্মকর্তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিষদদের সদস্য তারকনাথ পালিতের উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (জুলাই, ১৯০৬ খ্রি:)।
ব্যর্থতার কারণ – জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ভারতে প্রথমবার জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়; কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের এই ব্যর্থতার কারণগুলি হল —
- এটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে অর্থ সংকটের সম্মুখীন হয়
- প্রথম দিকে অনেক শিক্ষক এগিয়ে এলেও বেতনের স্বল্পতার কারণে অনেক শিক্ষক এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেন
- চাকরির বাজারে এই প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট গুরুত্বহীন হওয়ার কারণে এই কলেজে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি
- তৎকালীন চরমপন্থী নেতারা এই পরিষদকে স্বীকৃতিও দেয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শান্তিনিকেতন ভাবনার বিভিন্ন দিক চিহ্নিত করো।
ভূমিকা – ভারতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনের জন্য দক্ষ কেরানি তৈরি করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এরূপ শিক্ষাধারার সমালোচনা করেন এবং শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামক এক বিদ্যালয় স্থাপন করে এক বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা করেন।
উদ্দেশ্য – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল —
- এরূপ আবাসিক ব্রক্ষ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষক ছাত্র সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করা এবং এভাবে প্রাচীন ভারতের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের গুরু-শিষ্য সম্পর্ককে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
- প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে এক নতুন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
শিক্ষাব্যবস্থা – রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন বা শিক্ষণ সম্পর্কে যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেন তা হল –
তিন নীতি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই নতুন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনটি নীতি প্রয়োগ করেন যথা — অবাধ স্বাধীনতা, অবাধ চলাফেরা ও খেলাধুলা। পাশাপাশি তিনি প্রকৃতির সঙ্গে যোগ রেখে মনের চর্চার ওপর গুরুত্ব দেন।
সাংস্কৃতিক বিষয় – প্রকৃতি থেকে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার পাশাপাশি এক উন্নত সাংস্কৃতিক বিষয়কে পাঠক্রমে রাখা হয়। এগুলি হল — কলা, নৃত্য, নাটক, সংগীত-অঙ্কন প্রভৃতি। এগুলি শেখানোর জন্য বিষয় বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হয়।
কারিগরি শিক্ষা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই বিদ্যালয়ে একই সঙ্গে ব্যক্তি ও সমষ্টির শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়।
উপসংহার – উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়। যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচলিত শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের পরিবর্তে প্রকৃতি মানুষ ও শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। তবে এই শিক্ষা আনন্দপাঠ হলেও ঔপনিবেশিক কাঠামোর কার্যকরী শিক্ষা ছিল না।
বিশ্বভারতী কেন ও কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাশ্চাত্য শিক্ষাধারার বিকল্প জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানরূপে শান্তিনিকেতনে যে ব্রহ্মচর্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন তা পরবর্তীকালে একটি বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানকে একটি বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তোলার আকাঙ্খা থেকেই গড়ে ওঠে বিশ্বভারতী (৮ পৌষ, ১৩২৮ বঙ্গাব্দ, ২২ ডিসেম্বর ১৯২১ খ্রি:)।
প্রেক্ষাপট – বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সেগুলি হল —
ভারতীয় আদর্শকে তুলে ধরা – শান্তিনিকেতনকে কেন্দ্র করে ভারতের আদর্শ ও বাণী বিশ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যেই তিনি বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।
নিজের কর্তব্য সম্পাদন – রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সাহিত্যিকরূপে বিশ্ববাসীকে যেমন সাহিত্য উপহার দেন, তেমনি তিনি ভারতবাসীর হয়ে বিশ্বকে কিছু প্রদান করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি একজন ভারতীয়রূপে নিজের কর্তব্য সম্পাদনের জন্য বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রতিষ্ঠা – ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয় (৮ পৌষ, ১৩২৫ বঙ্গাব্দ)। এর তিন বছর পর পৌষ উৎসবে বিশ্বভারতী উদ্ঘাটিত হয়। বিশ্বভারতী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার তিনটি স্তর ছিল যথা —
ভারত সংস্কৃতি – ভারতের সমগ্ররূপ উপলব্ধি করতে ভারতের নানা সংস্কৃতি (বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন ও মুসলমান) কে তুলে ধরা।
বিদ্যা উৎপাদন – তিনি মত প্রকাশ করেন যে, বিশ্বভারতীর মূল কাজ হবে বিদ্যার উৎপাদন। বিদ্যা বিতরণ হবে গৌণ কাজ। এই উদ্দেশ্যে বিশ্বের মনীষীদের আহ্বান করে বিশ্বভারতীতে তাঁদের আনার কাজ শুরু করেন।
উৎপাদন-শিক্ষা – শিক্ষার্থীদের অর্থশাস্ত্র, কৃষি-তত্ত্ব, নানা ব্যবহারিক বিদ্যা শিক্ষা ও বিশ্বভারতীর চতুর্দিকে তার প্রয়োগের ব্যবস্থা করাও ছিল তাঁর চিন্তা-ভাবনার বিশেষ দিক। এরই সূত্র ধরে শ্রী নিকেতনের প্রতিষ্ঠা করা হয়।
উপসংহার – বিশ্বভারতী উদ্ঘাটনের দিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতীকে দেশবাসীর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন। এভাবেই ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের একজন আদর্শ ভারতীয় রূপে উত্তরণ ঘটে।
উনিশ শতকের ভারতে বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই অধ্যায়ের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজে পরিবর্তনের বীজ বপিত হয়।