মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর

Solution Wbbse

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় “বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর থেকে “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
Contents Show

বাংলাদেশে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস লেখো।

পোর্তুগিজ জেসুইট মিশনারিরা প্রথম 1556 খ্রিস্টাব্দে ভারতের বুকে গোয়ায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশে 1777 খ্রিস্টাব্দে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা –

গ্রাহাম শ -এর তথ্য থেকে জানা যায়, 1777 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। 1800 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এর সংখ্যা দাঁড়ায় 17টি। একটি ছিল সরকারি। আর বাকিগুলি ছিল বেসরকারি।

বাংলাদেশে ছাপাখানার মুদ্রাকর ও প্রকাশনা –

গ্রাহাম শ -এর তালিকা থেকে 1770-1800 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চার জন মুদ্রাকরের নাম পাওয়া যায়। এঁরা ছিলেন –

  • হিকি – জেমস অগাস্টাস হিকি কলকাতায় প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন 1777 খ্রিস্টাব্দে। প্রথমে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক বিল ও বাট্টার কাগজ ছাপাতেন। এরপর ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে সংবাদপত্র প্রকাশ করেন 1780 খ্রিস্টাব্দে।
  • জন জাকারিয়া – জন জাকারিয়া কেরনিয়ানডার একজন প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারি ছিলেন। তিনি কলকাতায় একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন (1779 খ্রিস্টাব্দ)। খ্রিস্টধর্মের পুস্তিকা, বর্ষপঞ্জি, আদালতের কাগজ এখানে ছাপা হত।
  • বার্নার্ড মেসেনিক – বার্নার্ড মেসেনিক একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি পিটার রিড নামে আর-এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কলকাতায় একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন 1780 খ্রিস্টাব্দে। এখান থেকেই ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ প্রকাশিত হত।
  • চার্লস উইলকিনস – চার্লস উইলকিনস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কেরানি ছিলেন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস -এর নির্দেশে তিনি হ্যালহেডের ব্যাকরণ (A Grammar Of The Bengal Language) ছাপানোর জন্য চুঁচুড়ায় একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এই ছাপাখানাটি সরকার অধিগ্রহণ করে।

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস –

শ্রীরামপুর ত্রয়ী (মার্শম্যান, কেরি ও ওয়ার্ড) -এর অন্যতম উইলিয়ম কেরি একটি কাঠের ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন 1800 খ্রিস্টাব্দে। এখান থেকে বহু বই; দিগদর্শন, সমাচার দর্পণ, ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া (Friend of India) ইত্যাদি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় (1818 খ্রিস্টাব্দ)।

এইভাবে ইউরোপীয় উদ্যোগে বাংলাদেশে বহু ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিকাশলাভ করে।

বাংলায় আধুনিক ছাপাখানার অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করো।

1454 খ্রিস্টাব্দে জার্মানির জোহানেস গুটেনবার্গের আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার আধুনিক মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর প্রায় 100 বছর পরে পোর্তুগিজরা 1556 খ্রিস্টাব্দে ভারতের গোয়ায় মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এরও প্রায় 200 বছর পরে 1777 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলায় মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা –

1777 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রথম মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা করেন জেমস অগাস্টাস হিকি। প্রথমদিকে এই ছাপাখানা থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাপানো হত। পরে এই ছাপাখানা থেকে ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশিত হয়।

বাংলায় চলনশীল হরফ –

বাংলায় চলনশীল হরফ বা মুভেবল টাইপ আবিষ্কার করেন চার্লস উইলকিনস। তিনি চুঁচুড়াতে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চানন কর্মকার কর্তৃক বাংলা হরফ তৈরির ঘটনা বাংলা ছাপাখানার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

লাইনো টাইপ বাংলা হরফ –

বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর বাংলা অক্ষরের ক্রমোন্নতি ঘটে। পঞ্চানন কর্মকারের বাংলা হরফের পর সুরেশচন্দ্র মজুমদার ‘লাইনো টাইপ’ নামে আরও উন্নত বাংলা হরফ তৈরি করেন।

ছাপাখানার বিস্তার –

বাংলার শ্রীরামপুর, কলকাতায় কয়েকটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। 1847 খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গের রংপুরেও ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ বলা যায়, উনিশ শতকে বাংলায় ছাপাখানার যথেষ্ট প্রসার ঘটে।

বাংলার মুদ্রাকর হিসেবে জেমস অগাস্টাস হিকি, জন জাকারিয়া কেরনিয়ানডার, বানার্ড মেসেনিক এবং চার্লস উইলকিনসের ভূমিকা আলোচনা করো।

ইউরোপীয় মিশনারি ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিকারিকদের উদ্যোগে বাংলায় মুদ্রণ ব্যবস্থার সূচনা ও প্রসার ঘটেছিল। উইলিয়ম বোল্টস, চার্লস উইলকিনস, পঞ্চানন কর্মকার প্রমুখ ব্যক্তির নিরলস প্রচেষ্টায় মুদ্রণশিল্প বাংলায় প্রসারলাভ করে। জেমস অগাস্টাস হিকি, জন জাকারিয়া কেরনিয়ানডার, বার্নার্ড মেসেনিক, চার্লস উইলকিনস প্রমুখ ব্যক্তিরা ছিলেন প্রথমদিকের উল্লেখযোগ্য মুদ্রাকর।

বাংলার মুদ্রাকর হিসেবে জেমস অগাস্টাস হিকি –

বাংলায় প্রথমদিকের মুদ্রাকরদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি। তিনি প্রথমদিকে জাহাজ ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু লোকসানের ফলে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সেই কারণেই 1777 খ্রিস্টাব্দে কিছু অর্থ জোগাড় করে তিনি কলকাতায় কাঠের ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক বিল ও বাট্টা সংক্রান্ত কাগজপত্রগুলি ছাপতে শুরু করেন হিকি। 1780 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশ করেন। হিকির প্রকাশিত এই কাগজই ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্রের মর্যাদা লাভ করে। এটি ছিল একটি সাপ্তাহিক কাগজ। তাঁর এই কাগজের পাঠক ছিল প্রধানত বণিক, ব্যবসায়ী ও ইউরোপীয়রা।

বাংলার মুদ্রাকর হিসেবে জন জাকারিয়া কেরনিয়ানডার –

অপর একজন বিখ্যাত মুদ্রাকর ছিলেন জন জাকারিয়া কেরনিয়ানডার, যিনি জন্মসূত্রে সুইডিশ ছিলেন। তিনিই ছিলেন বাংলায় আগত প্রথম প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারি, 1758 খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় আসেন। 1780-র দশকে তিনি বাণিজ্যিক মুদ্রণের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। ইংরেজিতে বর্ষপঞ্জিকা প্রভৃতি তিনি প্রকাশ করতেন। অনেক ক্ষেত্রে বিচারালয়ের রায়ের বিষয়গুলিও ছাপতেন যাকে কেন্দ্র করে হিকির সঙ্গে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতাও শুরু হয়েছিল।

বাংলার মুদ্রাকর হিসেবে বার্নার্ড মেসেনিক –

হিকির অপর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বার্নার্ড মেসেনিক। 1780 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কলকাতা থিয়েটারের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। 1780 খ্রিস্টাব্দে পিটার রিডের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ প্রকাশ করেন। হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ -এর পর এটিই ছিল বাংলার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সাপ্তাহিক কাগজ।

বাংলার মুদ্রাকর হিসেবে চার্লস উইলকিনস –

সমসাময়িক যুগে বাংলার ছাপার জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন চার্লস উইলকিনস। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার হিসেবে যোগদান করেন এবং 1770 খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন। তিনি পারসি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। বাংলা মুভেবল টাইপ বা সচল হরফের আবিষ্কর্তা হিসেবে তাঁর নাম সুপ্রতিষ্ঠিত। 1778 খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের নির্দেশে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থটি ছাপার জন্য বাংলা হরফ প্রস্তুত করার দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। এই সময় হুগলির একটি ছাপাখানায় উইলকিনসের তত্ত্বাবধানে পঞ্চানন কর্মকারের ছেনিকাটা বাংলা টাইপ প্রথম ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশ সরকারও নিজেদের একটি ছাপাখানার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। এজন্য হুগলির প্রেসটি সরকারই অধিগ্রহণ করে। উইলকিনসই ছিলেন এর প্রথম অধ্যক্ষ।

মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে অগাস্টাস হিকির অবদান লেখো।

মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে অগাস্টাস হিকির ভূমিকা –

বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে জেমস অগাস্টাস হিকি ছিলেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনিই ছিলেন বাংলা প্রথম মুদ্রাকর, প্রকাশক ও সাংবাদিক।

অগাস্টাস হিকির ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা –

হিকি ছিলেন একজন আইরিশ ব্যক্তিত্ব। তিনি জাহাজ সংক্রান্ত ব্যাবসা করতেন। 1775-1776 খ্রিস্টাব্দে এই ব্যাবসাতে তাঁর প্রচুর লোকসান হয়। ঋণশোধ করতে না পারার জন্য তাঁকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। কোনোক্রমে তিনি অব্যাহতি পান। এরপর 2000 টাকা সংগ্রহ করে একটি ছাপাখানা কেনেন। কলকাতায় এই ছাপাখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন 1777 খ্রিস্টাব্দে। গ্রাহাম শ -এর তথ্য থেকে জানা যায় এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম ছাপাখানা।

অগাস্টাস হিকির মুদ্রণ ও প্রকাশনা –

হিকির ছাপাখানায় প্রথমদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের সামরিক বিল এবং বাণিজ্যিক বাট্টা সংক্রান্ত কাগজপত্রগুলি ছাপা হত। কাজের লেনদেনের বিষয় নিয়ে হিকির সঙ্গে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের বিবাদ লেগেই থাকত।

এরপর হিকি একটি সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন (1 জানুয়ারি, 1780 খ্রিস্টাব্দ)। এর নাম ছিল ‘বেঙ্গল গেজেট’। তিনি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে খবর সংগ্রহ করতেন। ব্যাবসাবাণিজ্যের খবর, ব্যাবসাবাণিজ্যের বিজ্ঞাপন, কোম্পানির কর্মচারীদের ও লাটসাহেবের কেচ্ছাকাহিনি ছাপতেন তিনি। এই সংবাদপত্রের গ্রাহক ছিলেন মূলত কলকাতার ব্যবসায়ী, বণিক এবং ইংরেজরা।

মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে অগাস্টাস হিকির পরিণতি –

কোম্পানি সরকার হিকি ও তাঁর সংবাদপত্রের উপর ক্ষুব্ধ ছিল। তাই এই পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয় (23 মার্চ, 1782 খ্রিস্টাব্দ)। স্বল্পায়ু হলেও বাংলায় সংবাদপত্রের ইতিহাসে প্রথম সংবাদপত্রের সম্মান লাভ করে পত্রিকাটি আর হিকি পেশায় সাংবাদিক না হয়েও প্রথম সাংবাদিকের মর্যাদা পান।

কার সহায়তাতেই কেরনিয়ানডার প্রথম ছাপাখানাটি গড়ে তুলেছিলেন?

SPCK -এর (Society for Promoting Christian Knowledge) সহায়তাতেই কেরনিয়ানডার প্রথম ছাপাখানাটি গড়ে তুলেছিলেন।

মুদ্রণের ক্ষেত্রে চার্লস উইলকিনস -এর অবদান লেখো।

মুদ্রণের ক্ষেত্রে চার্লস উইলকিনস -এর ভূমিকা –

অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তথা বাংলার মুদ্রণ জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন চার্লস উইলকিনস। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে রাইটার হিসেবে যোগদান করেছিলেন। চার্লস উইলকিনস -এর আগে উইলিয়ম বোল্টস বাংলা সচল হরফ তৈরি করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

চার্লস উইলকিনস -এর বাংলা হরফের নির্মাণ –

1770 খ্রিস্টাব্দে উইলকিনস ভারতবর্ষে আসেন। তিনি পারসি, সংস্কৃত এবং বাংলায় যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থটি ছাপানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁকে নির্দেশ দেন। গ্রন্থটি ছাপানোর জন্য বাংলা হরফ প্রস্তুত করা হয়। হুগলির ছাপাখানায় উইলকিনসের তত্ত্বাবধানে পঞ্চানন কর্মকারের ছেনিকাটা বাংলা টাইপ প্রথম ব্যবহার করা হয়। এই বাংলা হরফের আবিষ্কারকেই বাঙালির নবজাগরণের প্রথম শুভ সূচনা বলা যেতে পারে।

মুদ্রণের ক্ষেত্রে চার্লস উইলকিনস -এর অবদান লেখো।

ছাপাখানা প্রতিষ্ঠায় উইলকিনসের উদ্যোগ গ্রহণ –

এই সময় হিকির ক্রমাগত আক্রমণে বিরক্ত হয়ে হেস্টিংস এবং কোম্পানির অন্যান্য কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করেন যে, তাদের নিজেদেরই একটি ছাপাখানা থাকা প্রয়োজন। উইলকিনসকে একটি ছাপাখানা স্থাপনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। 1778 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি কোম্পানির ছাপাখানার প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। 1781 খ্রিস্টাব্দে এই ছাপাখানাকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁর তত্ত্বাবধানে বাংলার ছাপাখানায় নানান দিক থেকে অভূতপূর্ব উন্নতি পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়।

মুদ্রণের ক্ষেত্রে চার্লস উইলকিনস -এর উপসংহার –

পৃথিবীতে যিনি প্রথম সঞ্চালনযোগ্য মুদ্রাক্ষর প্রবর্তন করে মুদ্রণের জগতে যুগান্তর নিয়ে এসেছিলেন সেই গুটেনবার্গের কথা স্মরণ করে চার্লস উইলকিনসকে বাংলার মুদ্রণ জগতে তাঁর অবদানের জন্য ‘বাংলার গুটেনবার্গ’ নামে অভিহিত করা হয়।

পঞ্চানন কর্মকার বিখ্যাত কেন?

পঞ্চানন কর্মকারের ভূমিকা –

বাংলা গ্রন্থ মুদ্রণে যে স্বদেশি শিল্পীর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন পঞ্চানন কর্মকার। যদিও চার্লস উইলকিনসই ছিলেন বাংলা মুদ্রণের স্রষ্টা, তথাপি তাঁর প্রথম সৃষ্টির কাজে সহায়ক ছিলেন বাংলার শিল্পী পঞ্চানন কর্মকার।

পঞ্চানন কর্মকারের বিখ্যাত হওয়ার ভূমিকা –

প্রথম বাংলা হরফ তৈরির কারিগরি বিদ্যা উইলকিনসের দান। কিন্তু তাকে ব্যাপকভাবে কর্মে রূপায়িত করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকার। 1778-1804 খ্রিস্টাব্দ অবধি প্রায় নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলা হরফের মানকে বহুদুর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

  • বাংলা ও অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার হরফ সৃষ্টি – প্রয়োজনের তাগিদে আকারে ক্রমশ ক্ষুদ্রতর করে একাধিক সাট বাংলা হরফই যে পঞ্চানন কর্মকার তৈরি করেছিলেন তা নয়, শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানার জন্য দেবনাগরী-সহ হরফও তিনি তৈরি করেছিলেন। 1793 খ্রিস্টাব্দের কর্নওয়ালিস কোডের বাংলার অনুবাদ ছাপার জন্য যে নতুন এক সাট বাংলা হরফ ব্যবহৃত হয় তা সম্ভবত পঞ্চানন কর্মকারেরই সৃষ্টি।
  • অন্যান্য ভূমিকা – 1800 খ্রিস্টাব্দের শুরুতে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে উইলিয়ম কেরি পঞ্চানন কর্মকারকে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেখানে পঞ্চানন কর্মকার দু-তিন সাট নতুন বাংলা, দেবনাগরী, অক্ষর ঢালাই প্রভৃতি সব রকমের কাজ করে বহু বাঙালি শিল্পীকে মুদ্রাক্ষর শিল্পে প্রশিক্ষণ দান করে সামগ্রিকভাবে বাংলা মুদ্রণের বনিয়াদকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন।

পঞ্চানন কর্মকারের উপসংহার –

পঞ্চানন কর্মকারের সাধনা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ফলেই বাংলা মুদ্রণের প্রসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। তিনিই বাংলার মুদ্রণশিল্পকে সাধারণের কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় এবং বাংলার নিজস্ব শিল্পধারার অঙ্গীভূত করে তোলেন। তাই পঞ্চানন কর্মকারকে বাংলা মুদ্রণের প্রথম সার্থক শিল্পী ও প্রবক্তা বলে অভিহিত করা হয়।

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কীভাবে একটি অগ্রণী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল?

বাংলার ছাপাখানার বিস্তারের ইতিহাসে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারিরা শ্রীরামপুরে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংবাদপত্র, ধর্মগ্রন্থ, পাঠ্যপুস্তক প্রভৃতি প্রকাশ করে শিক্ষাবিস্তার ও সমাজসচেতনতার প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা –

1800 খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা করেন উইলিয়ম কেরি, জোসুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ড। ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ নামে পরিচিত এই মিশনারিদের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস। উইলিয়ম কেরি প্রথমে শ্রীরামপুরে একটি কাঠের ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই ছাপাখানাই এশিয়ার বৃহত্তম ছাপাখানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের অবদান –

  • ধর্মপুস্তক প্রকাশ – শ্রীরামপুর মিশন থেকে অনেক ধর্মপুস্তক প্রকাশিত হয়। খ্রিস্টধর্ম প্রচার করার জন্য মিশনারিরা বাইবেলের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, অসমিয়া, ওড়িয়া, মারাঠি প্রভৃতি বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বাইবেল ছাপানো হয়।
  • প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ প্রকাশ – শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে রামায়ণ ও মহাভারত ছাপানো হয়। তা ছাড়া ‘হিতোপদেশের গল্প’, ‘বত্রিশ সিংহাসন’, রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ প্রভৃতি মুদ্রিত হয়।
  • পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ – শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের উল্লেখযোগ্য অবদান হল পাঠ্যবই প্রকাশ। এই প্রেস থেকে ছাত্রছাত্রীদের উপযোগী অসংখ্য বই ছাপানো হয়। 1817 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে স্বল্প মূল্যে বা বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করত। এই সমস্ত বই শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে ছাপানো হত। মিশন প্রেস থেকে কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকও ছাপা হয়।
  • সংবাদপত্র প্রকাশ – শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – সমাচার দর্পণ ও দিগদর্শন। সমাচার দর্পণ হল 1818 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। এর সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান। দিগদর্শন হল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র। এটি ছিল একটি মাসিক পত্রিকা।

শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের উপসংহার –

শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে পঞ্চানন কর্মকার যুক্ত হলে ছাপার কাজে গতি আসে। 1800-1832 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই প্রেস থেকে 45টি ভাষায় 2,12,000টি বই ছাপা হয়। যা সমকালীন বিশ্বে যথেষ্ট কৃতিত্বের কাজ ছিল। এইভাবে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস একটি অগ্রণী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ছাপাখানা স্থাপন ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান লেখো।

ছাপাখানা স্থাপন ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশনের ভূমিকা –

বাংলায় শ্রীরামপুর মিশনারিদের বহু কৃতিত্বের নিদর্শন আছে। এসব কৃতিত্বের অন্যতম হল ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা ও প্রকাশনা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশনার মাধ্যমে শ্রীরামপুর মিশন শিক্ষাবিস্তার ও সমাজ চেতনা সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রেখেছিল।

শ্রীরামপুর মিশনে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা –

জোসুয়া মার্শম্যান, উইলিয়ম ওয়ার্ড ও উইলিয়ম কেরি শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন 1800 খ্রিস্টাব্দের 10 জানুয়ারি। এঁদের মধ্যে উইলিয়ম কেরি একটি কাঠের পুরাতন ছাপাখানা কিনে ওই একই বছরে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীরামপুর মিশন। পরে লোহার ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। 1820 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মিশনের ছাপাখানার সংখ্যা দাঁড়ায় 18টি।

ছাপাখানা স্থাপন ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান লেখো।

শ্রীরামপুর মিশনের মুদ্রণ –

শ্রীরামপুর মিশন ছাপাখানায় প্রথমে ইংরেজি ভাষায় কাঠের হরফের ব্লক তৈরি করে ছাপা হত। পরে ধাতুর ইংরেজি ও বাংলা হরফ তৈরি করা হয়। এসময় হরফ তৈরিতে পঞ্চানন কর্মকার বিখ্যাত ছিলেন। কেরি তাঁকে মিশনে নিয়োগ করেন। মিশনের ছাপাখানার কম্পোজিটার ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য।

শ্রীরামপুর মিশনের প্রকাশনা –

শ্রীরামপুর মিশন থেকে বহু গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। তারা প্রথমে বাইবেল প্রকাশ করে। ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বাইবেল ছাড়াও 26টি আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল ছাপা হয়। 36টি বাংলা হরফে ও 1টি সংস্কৃত হরফে লেখা গ্রন্থ এবং এগুলির 12টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এসময় গড়ে ওঠা স্কুল-কলেজের বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যবই ছাপা ও প্রকাশের কাজও এখানে করা হত। ‘দিগদর্শন’ (এপ্রিল, 1818 খ্রিস্টাব্দ), ‘সমাচার দর্পণ’ (মে, 1818 খ্রিস্টাব্দ), ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

শ্রীরামপুর মিশনের উপসংহার –

এইভাবে বিদেশি উদ্যোগে বাংলা ও ইংরেজি হরফে বই, পত্রপত্রিকা ছাপা ও প্রকাশিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশনারিরা বিশেষ অবদান রাখেন।

বই ছাপার মাধ্যমে কীভাবে ছাপাখানা একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে?

অথবা, বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন ধরনের বইয়ের ব্যাবসা সম্পর্কে আলোচনা করো।

বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর ছাপা বইয়ের ব্যাবসা শুরু হয়। বিভিন্ন ধরনের বই ছাপার ফলে ছাপাখানার ব্যাবসা একটি লাভজনক ব্যাবসা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

বাংলায় ছাপাখানার বিভিন্ন ধরনের বই –

  • শিশুশিক্ষার বই – বাংলার ছাপাখানাগুলি থেকে শিশুদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন বই প্রকাশিত হয়। এই বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল – মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’ প্রভৃতি। এইসব বই লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হওয়ার ফলে ছাপাখানার ব্যাবসা লাভজনক হয়ে ওঠে।
  • স্কুল পাঠ্যবই – ব্রিটিশ আমলে অষ্টাদশ শতক থেকে শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ফলে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির জন্য উপযোগী পাঠ্যবইয়ের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে বিভিন্ন বই ছাপা হয়। গোবিন্দ প্রসাদ দাস রচিত ‘ব্যাকরণ সার’, কেদারেশ্বর চক্রবর্তী রচিত ‘বাংলার ইতিহাস’, প্রাণলাল চক্রবর্তীর ‘অঙ্গবোধ’ প্রভৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
  • নোটবই – স্কুল পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ‘নোটবই’ -এর চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। বরদাপ্রসাদ মজুমদার তাঁর বি পি এমস প্রেস থেকে ‘নোটবই’ -এর ব্যাবসা শুরু করেন। তিনি ‘মজুমদার সিরিজ’ নাম দিয়ে নোটবই ছেপে বিক্রি করতেন।
  • অন্যান্য বই – ছাপাখানা থেকে সাধারণ পাঠকদের জন্য সাহিত্য, উপন্যাস, কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ধর্মগ্রন্থ, পঞ্জিকা প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশিত হত। এইসব বই বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করত।

ছাপাখানা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে বাঙালি উদ্যোগীদের পরিচয় দাও।

ছাপাখানা ও প্রকাশনার ভূমিকা –

বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় উদ্যোগীরা অগ্রণী ছিলেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে বাঙালিরাও এই কাজে এগিয়ে আসেন এবং বিশিষ্ট স্থান দখল করেন।

ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা –

  • ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম বাঙালি ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। প্রথমে তিনি শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানায় কম্পোজিটার ছিলেন। পরে তিনি 1818 খ্রিস্টাব্দে নিজে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ছাপাখানার নাম ছিল ‘বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’ বা ‘আপিস’।
  • লেখক রাজকৃষ্ণ রায় ‘বীণাযন্ত্র’ নামে একটি ছাপাখানা গড়ে তোলেন।
  • পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
  • সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ (U Ray & Sons) নামে একটি বিরাট ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন 1895 খ্রিস্টাব্দে।

ছাপাখানা প্রকাশনা –

এইসব ছাপাখানা থেকে বহু বই এবং পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হত। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –

  • গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য নিজে কয়েকটি বই লিখে প্রকাশ করেন।
  • রাজকৃষ্ণ রায় তাঁর লেখা বিভিন্ন বই ছাপিয়ে প্রকাশ করেন।
  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার নিজেদের লেখা বিভিন্ন বইয়ের প্রকাশনা শুরু করেন।
  • উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও তাঁর পুত্র সুকুমার রায় শিশুসাহিত্য ও কৌতুক রচনা প্রকাশ করে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন।

এ ছাড়া হরচন্দ্র রায়, বিশ্বনাথ দেব, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, শিশির কুমার ঘোষ, কাঙাল হরিনাথ প্রমুখ মুদ্রণ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

ছাপাখানার উপসংহার –

এভাবে বাঙালিরা মুদ্রণ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিলেন। সেই সূত্র ধরেই বাংলা ভাষার প্রচার ও সাহিত্যসৃষ্টি ব্যাপকভাবে শুরু হয় এবং বাংলায় নবজাগরণের সূত্রপাত হয়।

উনবিংশ শতকে কলকাতায় দেশীয় উদ্যোগে স্থাপিত কয়েকটি বিখ্যাত ছাপাখানার বিবরণ দাও।

ছাপাখানার ভূমিকা –

ঊনবিংশ শতকে কলকাতায় দেশীয় উদ্যোগে বিভিন্ন বিখ্যাত ছাপাখানা গড়ে উঠেছিল।

উনবিংশ শতকে কলকাতায় দেশীয় উদ্যোগে স্থাপিত বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস –

1818 খ্রিস্টাব্দে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ও হরচন্দ্র রায়ের যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত হয় ‘বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’। এই প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় বৈকুণ্ঠনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভগবদ্গীতা’।

উনবিংশ শতকে কলকাতায় দেশীয় উদ্যোগে স্থাপিত সংস্কৃত যন্ত্র –

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সহযোগিতায় সংস্কৃত ছাপাখানার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। রামমোহন রায়ের ‘শারীরিক মীমাংসা’, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের ‘জ্যোতিষ সংগ্রহসার’ ইত্যাদি বই এই প্রেস থেকে ছাপা হয়।

উনবিংশ শতকে কলকাতায় দেশীয় উদ্যোগে স্থাপিত বিশ্বনাথ দেবের ছাপাখানা –

শোভাবাজারের বিশ্বনাথ দেবের ছাপাখানা ছিল সেই সময়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। রাধাকান্ত দেবের ‘বেঙ্গলি স্পেলিং বুক’, রামকমল সেনের ‘নীতিকথা’, দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনী’ প্রভৃতি বই এই প্রেসে ছাপা হয়।

উনবিংশ শতকে কলকাতায় দেশীয় উদ্যোগে স্থাপিত সমাচারচন্দ্রিকা যন্ত্র –

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সমাচারচন্দ্রিকা যন্ত্র’ কলুটোলায় স্থাপিত হয়। এখান থেকে কাশীনাথ তর্ক পঞ্চাননের ‘পাষণ্ড পীড়ন’, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দূতীবিলাস’ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

উনবিংশ শতকে কলকাতায় দেশীয় উদ্যোগে স্থাপিত সংবাদ তিমিরনাশক ছাপাখানা –

কলকাতার মির্জাপুরে অবস্থিত সংবাদ তিমিরনাশক ছাপাখানা থেকে অনেক বই প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত প্রেস হিসেবে এই ছাপাখানার নাম ছিল। শ্রীকৃষ্ণমোহন দাসের ‘জ্যোতিষ’ ও ‘দিনকৌমুদী’ এই ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয়।

উনবিংশ শতকে কলকাতায় দেশীয় উদ্যোগে স্থাপিত সিন্ধুযন্ত্র –

শিয়ালদহের ‘সিন্ধুযন্ত্র’ বা পীতাম্বর সেনের ‘যন্ত্রালয়’ ছিল তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত একটি ছাপাখানা। এখান থেকে প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রামচন্দ্র তর্কালঙ্কারের ‘কৌতুকসর্বস্ব’ নাটক বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

উনবিংশ শতকে কলকাতায় দেশীয় উদ্যোগে স্থাপিত উপেন্দ্রলাল যন্ত্র –

বহুবাজারের লেবুতলা লেনের বিখ্যাত প্রেস ছিল উপেন্দ্রলাল যন্ত্র। এখান থেকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত বই ‘নববিবিবিলাস’ ছাপা হয়।

উনবিংশ শতকে কলকাতায় দেশীয় উদ্যোগে স্থাপিত সারসুধানিধি প্রেস –

বড়োবাজারের এই প্রেস থেকে অনেক বাংলা ও হিন্দি বই ছাপা হয়।

উনবিংশ শতকে কলকাতায় দেশীয় উদ্যোগে স্থাপিত উপসংহার –

উনবিংশ শতকে উপরোক্ত ছাপাখানাগুলি বাংলার মুদ্রণের জগতে এক নতুন গতি এনে দেয়, যা বাংলার সমাজজীবনে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে।

শ্রীরামপুর মিশনারিরা কেন বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশ করেন?

শ্রীরামপুর মিশনারির ভূমিকা –

বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বহুবিধ সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এই সংবাদপত্রগুলি ছিল ইংরেজি মাধ্যমের। শ্রীরামপুর মিশনারিরা প্রথম বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশ করেন।

শ্রীরামপুর মিশনারির বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশনার কারণ –

আঠারো শতকের শেষে ও উনিশ শতকের সূচনায় বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থার করুণ অবস্থা ছিল। সংবাদপত্র পড়া বা কেনার মতো অবস্থায় খুব কম সংখ্যক মানুষ ছিলেন। তবুও শ্রীরামপুর মিশনারিরা বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এর কারণ ছিল –

  • খ্রিস্টধর্ম প্রচার – শ্রীরামপুর মিশনারিদের প্রধান লক্ষ্য ছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা। তাদের ধারণা ছিল বাংলার বেশিরভাগ মানুষের কথ্যভাষা হল বাংলা। এই ভাষার মাধ্যমে জিশুখ্রিস্টের জীবন ও বাণী, খ্রিস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য যুক্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরার আগে মানসিক ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার। এজন্য বাংলা ভাষায় সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচার চালালে সুফল পাওয়া যাবে বলে তারা মনে করেন।
  • জ্ঞান ও চেতনার বিকাশ – বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর কিছু সচেতন মানুষ বিভিন্ন ঘটনা সম্বন্ধে জানার জন্য কৌতূহলী হয়। মিশনারিদের কার্যকলাপ, পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, বিভিন্ন যুদ্ধ-বিদ্রোহ প্রভৃতির সংবাদ প্রচারের জন্য বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া জনগণের মধ্যে জ্ঞান ও চেতনার বিকাশ ঘটানো এর অন্যতম কারণ ছিল।
  • মুনাফা – যে-কোনো উদ্যোগের পিছনে একটি লক্ষ্য থাকে। সেই লক্ষ্য আর্থিক বা অন্য কোনো ক্ষেত্রের হতে পারে। বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে আর্থিক লাভের বিষয়টি বিবেচিত হয়। কারণ – এর আগে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলি ইংরেজি মাধ্যমে ছিল – স্বাভাবিকভাবেই যার বিক্রি ছিল কম। সেজন্য মাসিক ‘দিগদর্শন’ (এপ্রিল, 1818 খ্রিস্টাব্দ) ও সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পণ’ (মে, 1818 খ্রিস্টাব্দ) পত্রিকা প্রকাশিত হয়। আবার এর সঙ্গে ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ নামে ইংরেজি পত্রিকার প্রকাশও অব্যাহত থাকে।
শ্রীরামপুর মিশনারিরা কেন বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশ করেন?

শ্রীরামপুর মিশনারির মূল্যায়ন –

এই সমস্ত কারণে মিশনারিরা বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশ করে। আর মিশনারি উদ্যোগের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাঙালিদের প্রগতিশীল অংশ সংবাদপত্র প্রকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এর ফলে ‘সম্বাদ কৌমুদী’ ও ‘সমাচারচন্দ্রিকা’ প্রকাশিত হয়।

বাংলায় মুদ্রণের ব্যাবসায়িক উদ্যোগ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

বাংলায় মুদ্রণের ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ভূমিকা –

উনিশ শতকে শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বিষয়ের বইয়ের চাহিদা সৃষ্টি হলে ছাপাখানার ব্যাবসায়িক সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এজন্য বাংলায় নতুন নতুন মুদ্রণযন্ত্র আসে, গড়ে ওঠে নানান ছাপাখানা। এক শ্রেণির শিক্ষিত বাঙালি সম্প্রদায় ছাপাখানার ব্যাবসাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে।

উনিশ শতকের ছাপাখানার বাঙালি মালিকদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি। ছাপাখানার উদ্দেশ্য সব মালিকের কাছে সমান ছিল না। কারও কাছে তা ছিল ব্যাবসার অবলম্বন, আবার কারও কাছে ছিল আদর্শ বা ব্রত।

বাংলায় মুদ্রণের ব্যাবসায়িক উদ্যোগের ছাপাখানার ব্যাবসা –

  • শ্রীরামপুর মিশন প্রেস – শ্রীরামপুরের মিশন প্রেস, ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া প্রেস, চার্চ মিশন সোসাইটির স্কুল প্রেস ভালো ব্যাবসা করে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। এই সময় নীলমণি হালদার নামে এক বাঙালি শ্রীরামপুরে ‘রত্নাকর প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা ছাপাখানার ব্যাবসা মূলত এই সময় থেকেই শুরু হয়।
  • ইস্টার্নহোপ প্রেস – 1840 খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বসু ‘ইস্টার্নহোপ প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীকালে ‘স্ট্যানহোপ প্রেস’ নামে খ্যাত হয়। ছাপাখানার ব্যবসায়ে তিনি বেশ ভালো আয় করেছিলেন। এই ছাপাখানা থেকে অসংখ্য বই ছাপা হয়েছিল। বামাবোধিনী পত্রিকা একসময় এখান থেকেই ছাপা হত। সেকালের আর একটি নামকরা প্রেস ছিল ‘সুচারী যন্ত্র’। এই প্রেসটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। তিনি শুধুমাত্র ব্যবসায়ী নন, একজন পণ্ডিত ব্যক্তিও ছিলেন।
  • গুপ্ত প্রেস – ব্যাবসার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি বিখ্যাত ছাপাখানা হল 1861 খ্রিস্টাব্দে দুর্গাচরণ গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত ‘গুপ্ত প্রেস’। গুপ্ত প্রেসে ছাপা গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা আজও ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ড পরিচালনায় সহায়তা করে। ছাপাখানার ব্যাবসা তাঁর জীবনের ব্রত ছিল। তিনি ছাপাখানার ব্যাবসা করার জন্য অন্যদেরও সমানভাবে উৎসাহিত করেছেন। গুপ্ত প্রেস থেকে স্কুলের পাঠ্যবই এবং বহু বিচিত্র ধরনের বই ছাপা হয়েছে।
  • বি পি এমস প্রেস – ছাপাখানার ব্যবসায়ে নিজেদের ভাগ্য গড়েছিলেন যেসব বাঙালি, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বরদাপ্রসাদ মজুমদার। তাঁর ছাপাখানার নাম ছিল বি পি এমস প্রেস (1862 খ্রিস্টাব্দ)। তিনি জমিদারি ছেড়ে ‘নোটবই’ -এর ব্যাবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। ‘মজুমদার সিরিজ’ নাম দিয়ে অনুবাদ ও নোটবই ছেপে বিক্রি করতেন তিনি।

ছাপাখানার ব্যবসায়ে উন্নতি করেছিলেন এমন আরও কয়েকজন ব্যক্তিত্ব হলে – নৃত্যলাল শীল, বেণীমাধব দে, মথুরানাথ তর্করত্ন, কৃষ্ণগোপাল ভক্ত, দীননাথ মুখোপাধ্যায়, প্যারিমোহন বাগচি প্রমুখ।

বাংলায় মুদ্রণশিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল?

অথবা, বাংলা ছাপাখানা ও প্রকাশনা ব্যাবসার ক্ষেত্রে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ভূমিকা আলোচনা করো।

বাংলায় মুদ্রণশিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ভূমিকা –

বাংলায় মুদ্রণশিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের অবদান অনস্বীকার্য।

বাংলায় মুদ্রণশিল্পের বিকাশে কম্পোজিটার হিসেবে ভূমিকা –

শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনারিদের প্রেস 1800 খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়। সেই সময় থেকেই গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য একজন কম্পোজিটার হিসেবে মিশন প্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মিশনারিদের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে তিনি মিশন প্রেস ছেড়ে কলকাতায় আসেন।

বাংলায় মুদ্রণশিল্পের বিকাশে বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস স্থাপন –

কলকাতায় এসে তিনি অন্যের প্রেস থেকে ছাপিয়ে অনেক বই প্রকাশ করেছিলেন। 1818 খ্রিস্টাব্দে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ও হরচন্দ্র রায় যৌথ উদ্যোগে চোরবাগান স্ট্রিটে যে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন, তা হল ‘বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’ বা ‘আপিস’। এখান থেকে কলকাতায় ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ নামে এক সংবাদপত্র প্রকাশনায় অগ্রণী ভূমিকা নেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য।

বাংলায় মুদ্রণশিল্পের বিকাশে মুদ্রাকর –

তিনি অনেকগুলি গ্রন্থ নিজে রচনাও করেন। পুস্তক ব্যবসায়ে নিজে জড়িত ছিলেন। মুদ্রণ ও প্রকাশনায় তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।

বাংলায় মুদ্রণশিল্পের বিকাশে মূল্যায়ন –

পরবর্তী সময়ে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য কলকাতা ছেড়ে নিজ গ্রাম বহড়ায় ফিরে যান। সেখান থেকেই মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজ চালিয়ে যান। তাই বলা যায় যে, তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি যিনি একাধারে মুদ্রণ ব্যবসায়ী, প্রকাশক, পুস্তক ব্যবসায়ী ও সর্বোপরি এক গ্রন্থকার-সাংবাদিক।

বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আলোচনা করো।

বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা –

বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনা জগতের উন্নতিকল্পে তিনি ছিলেন এক সচেতন মুদ্রাকর, প্রকাশক ও পুস্তক ব্যবসায়ী। তাঁর প্রচেষ্টায় যেমন বাংলা বর্ণমালার সংস্কার হয়, তেমনি বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়।

বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত প্রেস তৈরিতে ভূমিকা –

বিদ্যাসাগর 1847 খ্রিস্টাব্দে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে 32 নং আমহার্স্ট স্ট্রিটে ‘সংস্কৃত প্রেস’ নামে এক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রেস থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা বই হল ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ (1847 খ্রিস্টাব্দ)। বর্ণপরিচয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগও এই প্রেস থেকেই ছাপা হয়।

বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটারি স্থাপন –

মুদ্রণ ও প্রকাশনার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটারি স্থাপন করেন 1847 খ্রিস্টাব্দে। বাংলা বইয়ের ব্যাবসার ক্ষেত্রে এই সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কলিকাতা পুস্তকালয় প্রতিষ্ঠা –

পরবর্তী সময়ে 1885 খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতা পুস্তকালয় নামে এক নতুন বইয়ের দোকান খোলেন। তাঁর নিজের ও কপিরাইটের বইগুলি এই সংস্থা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রয় সংস্থার মালিক হয়ে বাংলা বইয়ের ব্যাবসার পথপ্রদর্শক হিসেবে খ্যাত হয়ে আছেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন –

বিদ্যাসাগর একাধারে বই লিখেছিলেন, ছাপিয়েছিলেন এবং তা বিক্রির জন্য বইয়ের দোকানও খুলেছিলেন। শিক্ষাসংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাবসায়িক সাফল্যলাভও যে অসম্ভব নয়, তা তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। এইভাবে বাংলা বইয়ের মুদ্রণ ও প্রকাশনার ব্যাবসায়িক ভিত্তি সুদৃঢ় করে গড়ে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।

বাংলার মুদ্রণ ব্যাবসাতে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স (U Ray & Sons) -এর উদ্যোগের পরিচয় দাও।

বাংলার মুদ্রণ ব্যাবসাতে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স (U Ray & Sons) -এর উদ্যোগের ভূমিকা –

বাংলার মুদ্রণ ব্যাবসার ক্ষেত্রে প্রাথমিক উদ্যোগী ছিলেন ইউরোপীয়রা। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে মুনাফার লোভে বহু দেশীয় শিল্পোদ্যোগী এই ব্যাবসাতে এগিয়ে আসেন। মধ্যবিত্ত বাঙালিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। তারাও মুদ্রণ ব্যাবসাতে অংশ নেন। এর মধ্যে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে বিখ্যাত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ (U Ray & Sons) বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

বাংলার মুদ্রণ ব্যাবসাতে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স (U Ray & Sons) –

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সাহিত্যসাধনার পাশাপাশি মুদ্রাকর হিসেবেও খ্যাতিলাভ করেন। তিনি বিদেশ থেকে মুদ্রণযন্ত্র এনে 1895 খ্রিস্টাব্দে যে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা করেন, তার নাম ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’। প্রথমে এর ঠিকানা ছিল 38/1, শিবনারায়ণ দাস লেন, কলকাতা।

বাংলার মুদ্রণ ব্যাবসাতে প্রসেস বিদ্যা –

উপেন্দ্রকিশোর কাঠের ব্লক তৈরি করে ‘ছেলেদের রামায়ণ’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। কিন্তু ছাপার মান খুব খারাপ হয়। তারপর তিনি এ বিষয়ে পড়াশোনা ও পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। ইংল্যান্ড থেকে প্রয়োজনীয় বইপত্র ও যন্ত্রপাতি আনেন। তারপর হাফটোন ও রঙিন ব্লক তৈরি করে প্রসেস বিদ্যার উন্নতি ঘটান। ফলে মুদ্রণ জগতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। ছবি ও ছাপার গুণমান ভালো হয়।

বাংলার মুদ্রণ ব্যাবসাতে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স (U Ray & Sons) -এর উদ্যোগের পরিচয় দাও।

বাংলার মুদ্রণ ব্যাবসাতে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স পুনর্গঠন –

উপেন্দ্রকিশোরের পুত্র সুকুমার রায় ফোটোগ্রাফি ও প্রিন্টিং টেকনোলজিতে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে যান। সেখানে ‘স্কুল অফ ফোটো এনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি’তে ভরতি হন। শিক্ষাশেষে তিনি দেশে ফিরে এসে পারিবারিক ছাপাখানায় আমূল পরিবর্তন করে সেটিকে 100, গড়পার রোডে স্থানান্তরিত করেন 1913 খ্রিস্টাব্দে। ওই বছরই তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সন্দেশ’ পত্রিকা।

বাংলার মুদ্রণ প্রকাশনা –

পুনর্গঠনের ফলে ছাপাখানার মুদ্রণ দক্ষতা বেড়ে যায়। ক্রমশ বিখ্যাত মুদ্রণ সংস্থা ‘থ্যাকার, স্পিংক অ্যান্ড কোম্পানি’ (Thacker, Spink & Co) (1864 খ্রিস্টাব্দ) -এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’। বাণিজ্যিক কাজের সঙ্গে নিজস্ব প্রকাশনার কাজও করে চলে এই সংস্থা। এখান থেকেই প্রকাশিত হয় ছেলেদের মহাভারত, টুনটুনির বই, গুপী গাইন বাঘা বাইন প্রভৃতি গ্রন্থ।

বাংলার মুদ্রণের মূল্যায়ন –

কেবল আর্থিক মুনাফার জন্য উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ প্রতিষ্ঠা করেননি। ছাপার প্রযুক্তি ও রঙিন ছবির ক্ষেত্রে তিনি মৌলিক অবদান রাখেন। এর পাশাপাশি সাহিত্যসাধনাও চালিয়ে যান এবং নিজের লেখা গ্রন্থগুলির প্রকাশনা করেন। ফলত ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ দক্ষিণ এশিয়ার একটি বিশিষ্ট ছাপাখানারূপে আত্মপ্রকাশ করে।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী – টীকা লেখো।

অথবা, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সম্পর্কে আলোচনা করো।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বাংলা তথা ভারতের প্রকাশনা জগতের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় নাম। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক। তাঁর কর্মকান্ডের দ্বারা তিনি ছাপাখানার জগতে অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর প্রথম জীবন –

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী 1863 খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বনাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে দত্তক নেন এবং তাঁর নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সাহিত্য জীবন –

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছাত্রাবস্থাতেই সখা, সাথী, মুকুল প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি শিশু ও কিশোর সাহিত্যে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন। কবিতা, গান, নাটক, গল্প, কল্পকাহিনি প্রভৃতি রচনা করেন তিনি। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – ‘ছোটোদের রামায়ণ’, ‘ছোটোদের মহাভারত’, ‘টুনটুনির গল্প’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ প্রভৃতি। উপেন্দ্রকিশোর ‘সন্দেশ’ নামে একটি বিখ্যাত পত্রিকা প্রকাশ করেন।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছাপাখানার দক্ষতা –

1895 খ্রিস্টাব্দে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছাপার কাজে ‘হাফটোন ব্লক’ তৈরি ও প্রয়োগের উদ্ভাবক ছিলেন। এদেশে প্রথম রঙিন ছবি ছাপার কাজ তাঁর উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অন্যান্য প্রতিভা –

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছবি আঁকায় অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি হারমোনিয়াম, সেতার-সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোয় দক্ষ ছিলেন।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর উপসংহার –

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছাপাখানা ও সাহিত্যচর্চার জগতে অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূমিকা আলোচনা করো।

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূমিকা –

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বাংলা তথা সমগ্র ভারতে প্রকাশনা জগতের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় নাম। তিনি বাংলায় ‘হাফটোন’ পদ্ধতি, ‘রঙিন ব্লক’ -এর সূচনা করেছিলেন। 1895 খ্রিস্টাব্দে তাঁর নিজস্ব মুদ্রণ ও প্রকাশনা সংস্থা ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র সুকুমার রায়ের প্রচেষ্টায় এই সংস্থার খ্যাতি বৃদ্ধি পায়।

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ইউ রায় অ্যান্ড সন্স -এর প্রতিষ্ঠা –

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বিদেশ থেকে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র এনে 1895 খ্রিস্টাব্দে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে এটি ছিল কলকাতার 38/1, শিবনারায়ণ দাস লেনে। পরবর্তীকালে এর ঠিকানার পরিবর্তন ঘটেছিল।

ইউরায় অ্যান্ড সন্স -এর উদ্যোগে ছাপাখানার বিকাশ –

  • হাফটোন ব্লকের ব্যবহার – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছাপার বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। তিনি ছাপার কাজে ‘হাফটোন ব্লক’ তৈরি ও প্রয়োগের উদ্ভাবক ছিলেন। এর ফলে মুদ্রণ শিল্পে অভূতপূর্ব উন্নতি পরিলক্ষিত হয়।
  • ছবির ব্যবহার – তিনি তাঁর ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ থেকে প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদ ও ভিতরের পাতায় কীভাবে উন্নত ছবির ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। এক্ষেত্রে তিনি স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডায়াফর্ম সিস্টেম প্রভৃতি ব্যবহার করে সে যুগেও রংবেরঙের ছবি ছাপার ব্যবস্থা করেন।

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে সুকুমার রায়ের প্রচেষ্টা –

ছাপার বিষয়ে আরও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য উপেন্দ্রকিশোর তাঁর সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায়কে লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন। সুকুমার রায় পিতার উদ্ভাবনী দক্ষতার সঙ্গে তাঁর নিজস্বতা দিয়ে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’-কে একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছিলেন।

বাংলায় ছাপাখানার প্রকাশনা –

ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘টুনটুনির বই’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ‘ছেলেদের মহাভারত’ ইত্যাদি। এই সংস্থার অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান হল ‘সন্দেশ’ পত্রিকার প্রকাশ।

বাংলায় ছাপাখানার উপসংহার –

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং সুকুমার রায় কেবলমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ -এর প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেননি। তাঁরা এখান থেকে নিজেদের লেখা গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। ছাপার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন। তাই ছাপাখানার জগতে তাঁদের এই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

সুকুমার রায় কীভাবে বিখ্যাত পিতার যোগ্য সন্তান হয়ে ওঠেন?

সুকুমার রায়ের ভূমিকা –

উনবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বিষয়ের বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে তৈরি হয় নতুন ব্যাবসায়িক সম্ভাবনা। উনিশ শতকে মুদ্রণ যন্ত্রের বিবর্তন ঘটেছিল। কাঠের মুদ্রণযন্ত্র থেকে লোহা, লোহা থেকে স্টিম, রোটারি, লাইনোটাইপ – এসবের আবির্ভাব ঘটেছিল। শিক্ষিত বাঙালি সম্প্রদায় মুদ্রণ ব্যাবসাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। বাঙালির ছাপাখানার যাত্রা শুরু ব্যক্তিগত ছাপাখানা দিয়েই। এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক ছিলেন ইউ রায় অ্যান্ড সন্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায়।

সুকুমার রায় কীভাবে বিখ্যাত পিতার যোগ্য সন্তান হয়ে ওঠেন?

সুকুমার রায় –

সুকুমার রায় পিতার উত্তরাধিকার যথাযথভাবে বহন করে যেভাবে বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনা জগতে অবদান রেখেছিলেন, তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, তিনি ছিলেন ‘বিখ্যাত পিতার যোগ্য সন্তান’।

সুকুমার রায়ের শিক্ষা-গবেষণা ও কর্ম –

1911 খ্রিস্টাব্দে যখন উপেন্দ্রকিশোরের ছাপাখানা বেড়ে উঠেছিল, তখন সুকুমার রায় ফোটোগ্রাফি ও প্রিন্টিং টেকনোলজিতে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ স্কলারশিপ’ লাভ করে লন্ডনে যান। সেখানে তিনি ‘স্কুল অফ ফোটো এনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি’তে ভরতি হন। লন্ডনে পিতার উদ্ভাবিত হাফটোন পদ্ধতি প্রদর্শন করে তার কার্যকারিতা প্রমাণ করেন তিনি এবং বিলেতে ‘রয়‍্যাল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি’ (Royal Photographic Society)-র ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন। দেশে ফিরে তিনি পিতার ব্যাবসা ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ -এ যোগ দেন। তাঁর আমলে সংস্থাটির আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। ‘সন্দেশ’ পত্রিকা এই প্রকাশনা সংস্থার সর্বাধিক জনপ্রিয় প্রকাশনারূপে পরিচিতি পায়।

সুকুমার রায়ের মূল্যায়ন –

এ ছাড়াও নিজের অসামান্য সাহিত্যকর্মের সম্ভার প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে পারিবারিক প্রকাশনা সংস্থাটিকে বাঁচিয়ে রেখে সুকুমার রায় হয়ে উঠেছিলেন তাঁর পিতার যোগ্য উত্তরসূরি।

ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা বাংলার সমাজে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছিল?

ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ভূমিকা –

বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। আঠারো শতককে ভারতে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয়। কিন্তু এই শতকেই বাংলায় একাধিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতি বিস্তারের সূত্রে নবজাগরণের প্রেক্ষাপট রচিত হয়। মধ্যযুগের অবসানে আধুনিক যুগ সূচিত হয়।

ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার সামাজিক প্রভাব –

ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার সামাজিক প্রভাবগুলি হল নিম্নরূপ –

  • শিক্ষাবিস্তার – ছাপাখানায় বই, পত্রপত্রিকা ছাপা ও প্রকাশিত হয়। পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান, গণতন্ত্র, উদারনীতিবাদ, যুক্তিবাদ, উপযোগবাদ প্রভৃতির ধারণা ছাপা বইয়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। দেশ-বিদেশের খবরাখবর সংবাদপত্রের মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে। নিজেদের দুরবস্থা, সামাজিক কুসংস্কার সম্বন্ধে সম্যক বোধোদয় হয়।
  • জনমত গঠন – রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও-র শিষ্যমণ্ডলী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীরা তাঁদের মতামত প্রকাশ করেছেন সংবাদপত্রের মাধ্যমে। সামাজিক কুপ্রথা দূর করার লক্ষ্যে তাঁরা জোরালো প্রচার চালান। এই ক্রমাগত প্রচারের ফলে জনমত গড়ে ওঠে, সংস্কার আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়।
  • সাহিত্যরীতি – বাংলা ভাষা মানুষের কথ্যভাষা হিসেবে চালু ছিল। এর আগে বাংলা সাহিত্যকর্ম হিসেবে যা ছিল সেগুলি সংস্কৃতঘেঁষা বাংলায় লেখা হয়েছিল। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতদের বাংলা গদ্যরীতির অনুসরণে এসময় বাংলা গদ্য লেখার চল শুরু হয়। রামমোহন রায় বাংলা গদ্যরচনায় স্বকীয় ধারার নজির সৃষ্টি করেন। ফলে বাংলা ভাষার বিকাশে ছাপাখানা বিরাট ভূমিকা পালন করে। বাংলার সমাজে কথ্য বাংলা ও লেখ্য বাংলার দৃষ্টান্ত গড়ে ওঠে।
  • শ্রেণিচরিত্র – বাংলাদেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর নতুন ভূমিব্যবস্থা চালু হয়। জমিদারশ্রেণি গড়ে ওঠে। ব্যাবসাবাণিজ্যের বিকাশের ফলে ব্যবসায়ী ও বণিকশ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ইংরেজি শিক্ষা চালু হয় এবং শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে। সমাজে তারা ‘মধ্যবিত্তশ্রেণি’ নামে পরিচিত হয়। নিজেদের পেশাগত প্রয়োজনে এই শ্রেণি ছাপাখানার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। সমাজের তাদের কাছে বিনিয়োগ ও মুনাফার বিষয় হয়ে ওঠে এই ছাপাখানা।

ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার মূল্যায়ন –

এইভাবে ছাপাখানা শিক্ষাবিস্তার, জনমত গঠন, বাংলা ভাষারীতির প্রবর্তন ও শ্রেণিচরিত্র গঠন করে বাংলার সমাজজীবনে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে।

ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করো।

উনিশ শতকের শিক্ষাবিস্তারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ছাপা বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষাবিস্তার। উনিশ শতক থেকে বাংলায় বই ছাপা শুরু হয়। আবার এই সময় বাংলার গ্রামেগঞ্জে স্থাপিত হয় শত শত স্কুল। আর ছাপা বই এই সময় থেকে শিক্ষাবিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

ছাপা বই ও শিক্ষাবিস্তার পরস্পর নির্ভরশীল –

ছাপা বই ও শিক্ষার বিস্তার পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। শিক্ষার বিস্তারের জন্য ছাপা বই প্রয়োজন। ছাপা বই না থাকলে শিক্ষার বিস্তার ঘটে না। আবার শিক্ষার বিস্তার না ঘটলে বইয়েরও কদর থাকে না।

ছাপা বই আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য –

আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল – ছাপা বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার। আগে পুথির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রদান করা হত, কিন্তু তখন শিক্ষা অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ছাপা বইয়ের মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার সম্ভব হয়।

ছাপা বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষাবিস্তারের সুবিধা –

ছাপা বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষাবিস্তারের সুবিধাগুলি হল –

  • সহজলভ্যতা – ছাপা বই সহজে ও সস্তায় বাজার থেকে কেনা যায়। এর আগে পুথি সহজে পাওয়া যেত না।
  • লেখার স্পষ্টতা – ছাপা বইয়ের লেখা স্পষ্ট। এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা সঠিকভাবে লিখতে ও পড়তে পারে। এর আগে হাতের লেখা দেখে ও শুনে পড়াশোনা করতে হত।
  • বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার সমতা – একই ধরনের অনেক বই ছাপার সুবিধার জন্য সারা দেশে একই ধরনের শিক্ষার বিস্তার সম্ভব হয়। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে একই ধরনের বইয়ের ব্যবহার সমগ্র দেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে সমতা এনেছিল।

ছাপা বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা –

  • শ্রীরামপুর মিশন প্রেস – বই প্রকাশ করে শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করে ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘হিতোপদেশ’, ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘ভূগোল’, ‘পদার্থবিদ্যা’, ‘জ্যোতির্বিদ্যা’ প্রভৃতি বই প্রকাশ করা হয়। শ্রীরামপুর মিশন বিভিন্ন ধরনের বই ছাপার ফলে শিক্ষাবিস্তারের সহায়ক হয়েছিল। উইলিয়ম কেরির পুত্র ফেলিক্স কেরি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বই রচনার পথপ্রদর্শক ছিলেন।
  • ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি – ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পাঠ্যবই জোগান দেওয়ার উদেশ্যে 1817 খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি-র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল স্কুল পাঠ্যবই তৈরি করে সুলভ মূল্যে অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করা ও শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

এ ছাড়া ক্যালকাটা খ্রিস্টান ট্রাস্ট অ্যান্ড বুক সোসাইটি (Calcutta Christian Trust & Book Society, 1823 খ্রিস্টাব্দ), ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি (Vernacular Literature Society, 1820 খ্রিস্টাব্দ)-সহ অনেক প্রতিষ্ঠান বই তৈরি ও সরবরাহ করে শিক্ষার প্রসারে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত কীভাবে হয়?

বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার ভূমিকা –

প্রাচীন বাংলাদেশে চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা, গণিতচর্চা এমনকি চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হলেও আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার অস্তিত্ব ছিল না। ইংরেজরা এদেশে আসার পর পাশ্চাত্য শিক্ষার সূত্রে এদেশে আধুনিক বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, গণিত, রসায়নবিদ্যা) চর্চার সূত্রপাত হয়।

বিজ্ঞানচর্চার সূচনা –

  • সরকারি উদ্যোগ – ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর সরকারি উদ্যোগে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর একটি হল কলকাতা মাদ্রাসা (1781 খ্রিস্টাব্দ), বর্তমানে যা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত। আর অন্যটি হল এশিয়াটিক সোসাইটি (1784 খ্রিস্টাব্দ)। মূলত প্রাচ্যবিদ্যাচর্চা ও গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলি প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ে চর্চার ব্যবস্থা ছিল।
  • বেসরকারি উদ্যোগ – আঠারো শতকের শেষদিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কলকাতায় বেশ কিছু স্কুল গড়ে ওঠে। এখানে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান পড়ানো হত। 1817 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানেও বিজ্ঞান পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। 1818 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজে বিজ্ঞান পড়ানো হত এমনকি বিজ্ঞানের শাখা রসায়নবিদ্যা পড়ানোর জন্য পরীক্ষাগারও তৈরি হয়। বাংলায় শারীরবিদ্যার উপর বই লেখা হয়।
  • রামমোহনের ভূমিকা – রাজা রামমোহন রায় বিজ্ঞানশিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর স্মারকলিপিতে বিজ্ঞানশিক্ষার দাবি ছিল। এ ছাড়া তিনি ‘দ্রাঘিজ্যা’ নামে জ্যামিতি বিষয়ক একটি বই লেখেন।
  • পত্রপত্রিকার প্রচার – বিভিন্ন সংবাদপত্র, যেমন – সমাচার দর্পণ, তত্ত্ববোধিনী প্রভৃতি পত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। 1835 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে বিজ্ঞানশিক্ষায় গতি আসে।

বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার মূল্যায়ন –

এভাবে প্রধানত ইউরোপীয়দের উদ্যোগে এবং ইউরোপীয়দের দ্বারা বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত হয় এবং তাদের প্রচেষ্টাতেই বিজ্ঞানশিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এর ফলে বাংলাদেশে শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

ঐতিহাসিক রবার্ট এরগ্যাং কী বলেছিল?

ঐতিহাসিক রবার্ট এরগ্যাং বলেন, “নেপোলিয়ন যে জাতীয়তাবাদী শক্তির জাগরণ ঘটান, তা তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষের সেনাদল অপেক্ষা বহুগুণ শক্তিশালী ছিল।”

বাংলার বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনারিদের অবদান আলোচনা করো।

1800 খ্রিস্টাব্দে উইলিয়ম কেরি শ্রীরামপুরে পদার্পণ করলে উইলিয়ম ওয়ার্ড ও মার্শম্যানের সহায়তায় শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের জয়যাত্রা শুরু হয়। বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মিশনারিদের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলার বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে রক্সবার্গের অবদান –

শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিদর্শক রক্সবার্গ বাংলায় 3500টি গাছের তালিকা তৈরি করেন। উইলিয়ম কেরি এটির সম্পাদনা করেন এবং নাম দেন ‘হার্টস বেঙ্গলেনসিস’।

বাংলার বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে উইলিয়ম কেরির ভূমিকা –

রক্সবার্গের পরবর্তী পরিদর্শক ওয়াকিলের ‘এশীয় উদ্ভিদের সংকলন’ গ্রন্থটিরও সম্পাদনা করেন উইলিয়ম কেরি। 1820 খ্রিস্টাব্দে এই উদ্দেশ্যে কৃষি-উদ্যানপালন সমিতি (Agri-Horticulture Society) স্থাপন করেন তিনি।

উইলিয়ম কেরি একটি কাঠের মুদ্রণযন্ত্র তৈরি করেছিলেন। পঞ্চানন কর্মকার ও মনোহর কর্মকার তাঁকে এ কাজে সাহায্য করেছিলেন। শ্রীরামপুর কলেজে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীবনবিজ্ঞান, ভূবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে পড়ানো শুরু হয় এবং এই মুদ্রণযন্ত্রে নানা গ্রন্থও ছাপা হয়।

বাংলার বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে ফেলিক্স কেরির ভূমিকা –

উইলিয়ম কেরির পর মুদ্রণের ক্ষেত্রে অগ্রসর হন তাঁর পুত্র ফেলিক্স কেরি। তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার পঞ্চম সংস্করণ অবলম্বন করে ফেলিক্স কেরি তাঁর বিদ্যাহারবলী বাণী রচনার সূত্রপাত করেন। চিকিৎসাবিদ্যা ও অস্ত্রোপচার বিষয়ে ফেলিক্সের যথেষ্ট আগ্রহ ও দক্ষতা ছিল। সেইজন্য অ্যানাটমি বা ব্যবচ্ছেদবিদ্যা দিয়েই তিনি প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া অনুবাদ শুরু করেন।

জন ম্যাকের ভূমিকা –

জন ম্যাক ছিলেন শ্রীরামপুর মিশনের বিজ্ঞানচর্চার প্রধান ব্যক্তিত্ব। মিশনের কলেজের বিজ্ঞানের অধ্যাপক জন ম্যাক বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি গবেষণাগারও গড়ে তোলেন। এটিই হল ভারতে প্রথম উন্নতমানের বিজ্ঞানের গবেষণাগার।

রসায়নের উপর ম্যাক বাংলা ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর ‘রসায়নবিদ্যার সূত্রাবলী’ ছিল রসায়নবিদ্যার উপর লিখিত বিখ্যাত বাংলা গ্রন্থ।

তাই শ্রীরামপুর মিশনের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে উইলিয়ম কেরি ও তাঁর পুত্র ফেলিক্স কেরি এবং জন ম্যাকের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।

কীভাবে IACS প্রতিষ্ঠিত হয় তা বিশ্লেষণ করো।

IACS প্রতিষ্ঠার ভূমিকা –

বিজ্ঞানশিক্ষার একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য কলকাতা শহরেই প্রথম পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া হয়। 1869 খ্রিস্টাব্দে ‘ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিন’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার এক জাতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। ফলে এদেশের বিজ্ঞানের উন্নতিতে এবং জনগণের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষা প্রসারে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে সে-কথা সবাই উপলব্ধি করে।

IACS প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট –

বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাভাবনার উন্মেষ –

অশিক্ষা এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আমাদের সমাজে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিজ্ঞান প্রচার সে সময় নেহাত সহজ কাজ ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল নব চিন্তাভাবনার উন্মেষের কাল। মহেন্দ্রলাল সরকারের দৃষ্টি ছিল বিজ্ঞানের স্বচ্ছ, উদার, মুক্ত এবং সংস্কারহীন বিস্তীর্ণ প্রান্তরের দিকে।

মহেন্দ্রলাল সরকারের উদ্যোগ –

তিনি যখন ভারতীয়দের নিজস্ব এক জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য আবেদন করেন তখন তাঁর বয়স মাত্র 34। পেশায় চিকিৎসক হলেও সমাজসংস্কারের সঙ্গে তিনি ব্যাপকভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর জীবিকার পাশাপাশি এদেশে বিজ্ঞানের উন্নতি এবং সেইসঙ্গে বিজ্ঞান মানসিকতা গঠনের কাজে সচেষ্ট হন এবং তা নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। আধুনিক বিশ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বিজ্ঞানসাধনা যে আবশ্যক, মহেন্দ্রলাল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এই সত্য উপলব্ধি করেন।

মহেন্দ্রলাল 1870 -এর দশকে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য এক রেজিস্টার্ড সোসাইটির ‘প্রসপেকটাস’ প্রকাশ করেন এবং জনসাধারণের কাছে চাঁদার জন্য আবেদন জানান। বলা হয়, সোসাইটির নামকরণ করা হবে ‘Indian Association for the Cultivation of Science (IACS)।

1870 খ্রিস্টাব্দের 24 জানুয়ারি প্রথম চাঁদার খাতা খোলা হয়। উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, সতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীকৃষ্ণ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, গিরীশচন্দ্র মিত্র, রমেশচন্দ্র মিত্র প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বড়ো অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।

1875 খ্রিস্টাব্দে চাঁদা হিসেবে মোট 80,000 টাকা সংগৃহীত হয়। 1875 এবং 1876 খ্রিস্টাব্দে অর্থ প্রদানকারী এই সকল ব্যক্তিরা প্রস্তাবিত অ্যাসোসিয়েশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ এবং সেই সঙ্গে বিবিধ পরিকল্পনার রূপদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হাউসে মিলিত হন। 1876 খ্রিস্টাব্দের 15 জানুয়ারি বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর টেম্পলর -এর সভাপতিত্বে ও কলকাতার বিশিষ্ট নাগরিকদের উপস্থিতিতে প্রস্তাবিত সংস্থাটির প্রতিষ্ঠা হয়। মহেন্দ্রলাল সরকারের মস্তিষ্কপ্রসূত নামেই সংস্থাটির নামকরণ করা হয় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স নামে। এই সংস্থাটির উদ্দেশ্য ভারতীয় নাগরিকদের বিজ্ঞানের যাবতীয় বিষয়ে মৌলিক গবেষণার সুযোগ দান এবং সেই গবেষণালব্ধ ফলের বিভিন্ন প্রয়োগের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনে সুখস্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন করা।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (IACS) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স -এর ভূমিকা –

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স হল কলকাতায় অবস্থিত একটি বিজ্ঞান গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান। একে সংক্ষেপে আইএসিএস (IACS) বলা হয়। 1876 খ্রিস্টাব্দে এর প্রতিষ্ঠা করেন ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, যাঁকে ‘জাতীয় বিজ্ঞানচর্চার জনক’ বলা হয়।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স -এর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

কলকাতার বিখ্যাত চিকিৎসক জনহিতৈষী ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার উপলব্ধি করেছিলেন যে, বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসার ছাড়া ভারতের উন্নতি সম্ভব নয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণায় সহায়তা করা। উনিশ শতকে ভারতে নবজাগরণের জোয়ার শুরু হয়। কিন্তু তখন বিজ্ঞান শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স -এর প্রতিষ্ঠা করে ভারতে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করেন। তিনি এখানে নিয়মিত বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতার আয়োজন করেন। তাঁকে এ বিষয়ে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের রেক্টর এবং বিজ্ঞানের অধ্যাপক ইউজিন লাফোঁ। মহেন্দ্রলাল সরকারের মৃত্যুর পর এই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তাঁর পুত্র ডা. অমৃতলাল সরকার।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স -এর পরিচালনা –

এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রথম থেকেই একটি বলিষ্ঠ পরিচালন সমিতি গঠন করা হয়। এই পরিচালন সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা। 1912 খ্রিস্টাব্দে এই প্রতিষ্ঠানে অধিকর্তার পদ চালু করা হয়। প্রথম অধিকর্তা ছিলেন প্যারিমোহন মুখোপাধ্যায়। পরে নীলরতন সরকার, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এই দায়িত্ব পালন করেন।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স -এর অবদান –

বিখ্যাত বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন শিক্ষকতার অবসরে এখানে নিরলস গবেষণা চালিয়েছিলেন। তিনি রমন এফেক্ট আবিষ্কার করেন, যার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 1930 খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বভার গ্রহণ করে গবেষণামূলক কাজকে আরও প্রসারিত করেন।

এখানে মূলত এক্স রশ্মি, আলোকবিজ্ঞান, চুম্বকত্ব, রমন ক্রিয়া প্রভৃতি বিষয় সংক্রান্ত মৌলিক গবেষণা পরিচালিত হত।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স -এর উপসংহার –

এখনও আইএসিএস (IACS) একটি স্বায়ত্তশাসিত বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক বিজ্ঞানী এবং গবেষক এখানে গবেষণা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন বলে আশা করা যায়।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উনিশ শতকে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ। বিজ্ঞান কলেজ বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা –

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় 1914 খ্রিস্টাব্দের 27 মার্চ। এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠার পটভূমি –

1905 খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন বা স্বদেশি আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই সময় স্বদেশি বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের উদ্যোগ –

স্বদেশি আন্দোলনের সময় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ স্যার তারকনাথ পালিত ও স্যার রাসবিহারী ঘোষ বিজ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠনে উদ্যোগী হন। তাঁদের আর্থিক সহায়তায় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের পঠনপাঠন –

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা প্রভৃতি বিষয় পড়ানো হত। এই কলেজের পঠনপাঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ।

ভারতে বিজ্ঞানশিক্ষার ইতিহাসে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। পরবর্তীকালে ভারতে যে বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশ ঘটেছে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ ছিল তার পথপ্রদর্শক।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের ভূমিকা –

কলকাতার অন্যতম প্রাচীন বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় 1914 খ্রিস্টাব্দে ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ নামে পরিচিত হয়।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা –

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় 1914 খ্রিস্টাব্দের 27 মার্চ। কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠায় অন্যান্যদের অবদান –

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠায় যাঁদের নাম স্মরণীয় তাঁরা হলেন ব্যারিস্টার স্যার তারকনাথ পালিত ও ব্যারিস্টার স্যার রাসবিহারী ঘোষ। তাঁরা সাড়ে 37 লক্ষ টাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য জমি দান করেন।

মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দেন। তা ছাড়া রানি বাগেশ্বরী ও গুরুপ্রসাদ সিং এই কলেজের জন্য অর্থসাহায্য করেন।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের পঠনপাঠন –

এই কলেজে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণীবিদ্যা প্রভৃতি বিষয় পড়ানো হত।

  • এখানে 1915 খ্রিস্টাব্দে রসায়ন বিভাগ চালু হয়।
  • 1916 খ্রিস্টাব্দে বিশুদ্ধ পদার্থবিদ্যা বিভাগ ও ফলিত গণিত বিভাগ শুরু হয়।
  • 1918 খ্রিস্টাব্দে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ ও 1919 খ্রিস্টাব্দে প্রাণীবিদ্যা বিভাগ শুরু হয়।

এই কলেজের পঠনপাঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। যেমন – রসায়ন বিভাগে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, পদার্থবিদ্যা বিভাগে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, ফলিত গণিত বিভাগে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বিজ্ঞানীরা। এই কলেজে মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তিপ্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের উপসংহার –

ভারতে বিজ্ঞানশিক্ষার ইতিহাসে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। পরবর্তীকালে ভারতে যে বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশ ঘটেছে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ ছিল তারই পথপ্রদর্শক।

বসু বিজ্ঞান মন্দির সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বসু বিজ্ঞান মন্দিররের ভূমিকা –

বসু বিজ্ঞান মন্দির হল কলকাতার বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি 1917 খ্রিস্টাব্দের 30 নভেম্বর কলকাতায় এর প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বিশ্বের প্রথম সারির গবেষণাকেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম।

বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রতিষ্ঠাতা জগদীশচন্দ্র বসু বলেছেন যে, এটির উদ্দেশ্য হল বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও জ্ঞানের প্রসার ঘটানো। তিনি চাইতেন বিজ্ঞান মন্দিরের আবিষ্কারের সুফল যেন সর্বজনীন হয়।

বসু বিজ্ঞান মন্দির সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বসু বিজ্ঞান মন্দিররের প্রতিষ্ঠার পটভূমি –

বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ইংল্যান্ডের রয়‍্যাল সোসাইটির অনুকরণে ভারতে একটি বিজ্ঞান গবেষণাগার গঠনের কথা কল্পনা করেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণের পর বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এর জন্য তিনি তাঁর বাড়িসংলগ্ন জমি ক্রয় করেছিলেন।

বসু বিজ্ঞান মন্দিররের গবেষণার ক্ষেত্র –

বসু বিজ্ঞান মন্দিরে প্রকৃতিবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। এখানে উদ্ভিদবিদ্যার সঙ্গে পদার্থবিদ্যার গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়া পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, বায়োফিজিক্স, পরিবেশ বিজ্ঞান প্রভৃতি নানা বিষয়ের গবেষণার ব্যবস্থা করেন তিনি। জগদীশচন্দ্র বসু 1937 খ্রিস্টাব্দ থেকে আমৃত্যুকাল এই প্রতিষ্ঠানে গবেষণাকার্য পরিচালনা করেন। তিনি উদ্ভিদের প্রাণ ও স্পন্দনের বার্তা সম্পর্কিত বিষয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেন এবং আবিষ্কার করেন ‘ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্র’। বসু বিজ্ঞান মন্দির বর্তমানে বোস ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত।

বসু বিজ্ঞান মন্দির সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বসু বিজ্ঞান মন্দিররের উপসংহার –

বসু বিজ্ঞান মন্দির ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার ইতিহাসে এক মাইলফলকস্বরূপ। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে বলেছেন যে, জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে-কোনোটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু – টীকা লেখো।

জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান গবেষক। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভিদবিজ্ঞান ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁকে ‘রেডিও বিজ্ঞানের জনক’ বলেও অভিহিত করা হয়।

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম –

জগদীশচন্দ্র বসু 1858 খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন।

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর শিক্ষালাভ –

তিনি প্রথমে ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে ভরতি হন এবং 1879 খ্রিস্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর জগদীশচন্দ্র ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানের পাঠ সম্পন্ন করেন।

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর কর্মজীবন –

দেশে ফিরে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছোটো একটি ঘরেই তিনি তাঁর গবেষণার কাজ চালিয়ে যান। তাঁর গবেষণার দ্বারা তিনি ‘তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ’ ও ‘বেতারযন্ত্র’ আবিষ্কার করেন। এরপর জগদীশচন্দ্র উদ্ভিদ বিষয়ে গবেষণা করে ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি প্রমাণ করেন যে-প্রাণীর মতো উদ্ভিদেরও প্রাণ ও অনুভূতি আছে। তিনি বাংলা ভাষায় ‘অব্যক্ত’ নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেন।

বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা –

বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণার জন্য 1917 খ্রিস্টাব্দে জগদীশচন্দ্র বসু কলকাতায় বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর উপসংহার –

জগদীশচন্দ্র বসু বাংলা তথা বিশ্বের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে-কোনোটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।

বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান উল্লেখ করো।

বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা –

বাংলায় উচ্চতর বিজ্ঞানশিক্ষার প্রবর্তনে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নাম অবিস্মরণীয়। পরাধীন ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তারে তাঁর অবদান অসামান্য। ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের আহ্বানে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের হলে তিনি যে শতাধিক লেকচার দেন তাতে বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা উপকৃত হয়।

বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান –

বাঙালির উদ্যোগে গড়ে ওঠা একটি বিজ্ঞান সংস্থায় ছাত্ররা বিজ্ঞানসাধনার জন্য তৈরি হয়ে উঠুক – এই মানসিকতা নিয়েই আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত IACS নামক প্রতিষ্ঠানের পাশে দাঁড়ান। ইংরেজ শাসনের অবদমিত পরিবেশে বিজ্ঞান শিক্ষাপ্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি ছাত্র উপযোগী পাঠ্যপুস্তক রচনাতেও আত্মনিয়োগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে সেই সময় অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বই ছিল বিদেশিদের লেখা। সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে এইসব বইয়ের মর্মোদ্বার কঠিন ছিল। এক্ষেত্রে ছাত্রদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।

তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন লন্ডন ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির ধাঁচে ক্যালকাটা ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। তাঁর উদ্যোগেই ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি স্থাপিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাসবিহারী ঘোষ ও তারকনাথ পালিত অনেক অর্থ দান করেছিলেন। এ ছাড়া আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে কাশিমবাজারের মহারাজা বহরমপুরে পদার্থবিদ্যার বিভাগ খোলার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি কিনেছিলেন তা বিজ্ঞান কলেজের জন্য দান করে দিলেন। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক বুল-ও কিছু যন্ত্রপাতি ধার দিলেন। এইভাবে সামান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি – এই দুই বিভাগ খোলা হয়।

বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উপসংহার –

আশুতোষ বিজ্ঞানকে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত চর্চার পরিমণ্ডলে আবদ্ধ রাখতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিত্বদের চিন্তাভাবনার ছাপ পড়ুক আমাদের সমাজব্যবস্থায়। তিনি আশা করেন যে, ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনার লেনদেন এবং সক্রিয় সহযোগিতা বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারে আমাদের সহযোগিতা করবে।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় – টীকা লেখো।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ভূমিকা –

বাংলার একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ ও দার্শনিক ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা এবং মারকিউরাস নাইট্রেট বিষয়ের গবেষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্ম –

প্রফুল্লচন্দ্র রায় 1861 খ্রিস্টাব্দে খুলনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হরিশচন্দ্র রায় স্থানীয় জমিদার ছিলেন।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের শিক্ষাজীবন –

তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুল ও মেট্রোপলিটন কলেজে লেখাপড়া করেন। মেট্রোপলিটন কলেজ থেকে এফএ পাস করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন। পরে তিনি ইংল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাস করেন ও ডিএসসি ডিগ্রি লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কর্মজীবন –

প্রফুল্লচন্দ্র রায় ডিএসসি ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করার পর দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

  • তিনি মারকিউরাস নাইট্রেট নিয়ে গবেষণা করে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
  • পরে তিনি কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানে থাকাকালে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন।
  • রাসায়নিক দ্রব্য ও ওষুধ তৈরির জন্য কলকাতায় বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দেশের শিল্প, শিক্ষা ও স্বাধীনতার প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন।
  • আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় -এর শ্রেষ্ঠ রচনা হল ‘History of Hindu Chemistry’ (হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি)।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উপসংহার –

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন একজন স্বদেশপ্রেমী মানুষ। বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে এবং শিক্ষক হিসেবে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি সাধারণভাবেই জীবনযাপন করতেন।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষারপ্রসারে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের অবদান কী?

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষারপ্রসারে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ভূমিকা –

বাংলায় বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষারপ্রসারে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের রাশিবিজ্ঞানে আগ্রহ –

পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপনা চললেও বায়োমেট্রিকসের কিছু খণ্ড তিনি সংগ্রহ করেন। এই বইগুলি তাঁর সামনে এক নতুন দিগন্তের দ্বার খুলে দিল। তিনি বুঝতে পারলেন পরিসংখ্যান একটি সম্ভাবনাময় বিজ্ঞান এবং আমাদের দেশে বিভিন্ন সমস্যাসমাধানে এর ব্যাপক প্রয়োগের উপযোগিতা আছে।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষারপ্রসারে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের রাশিবিজ্ঞান সংক্রান্ত কাজ –

প্রশান্তচন্দ্র রাশিবিজ্ঞান সংক্রান্ত পড়াশোনা করেন বাড়িতে থেকেই। তথ্যসংগ্রহের জন্য আংশিক সময়ের কয়েকজন সহকারীকে কাজে লাগান। 1923 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে অ্যানান ডেল -এর সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়। অ্যানান ডেল প্রশান্তচন্দ্রকে তাঁর তৈরি পরিসংখ্যানের উপযুক্ত বিশ্লেষণের দায়িত্ব দেন। ফলে রাশিবিজ্ঞানে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র ‘The Statistical Analysis of Anglo-Indian States’ প্রকাশিত হয়।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষারপ্রসারে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের অন্যান্য অবদান –

পরবর্তী সময়ে নৃতত্ত্ব সম্বন্ধীয় কয়েকটি গবেষণাপত্রও লেখেন তিনি। 1925 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের নৃতত্ত্ব শাখার সভাপতির ভাষণে প্রশান্তচন্দ্র ‘Analysis of Race Mixture in Bengal’ প্রবন্ধটি পাঠ করেন। তিনি তাঁর গবেষণাপত্রে বলেন, নানা জাতির এবং নানান গোষ্ঠীর লোকের মধ্যে কিছু কিছু নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করে তাদের মধ্যে জাতিগত পার্থক্য বা নৈকট্য নির্ণয় সম্ভব। এখানে তিনি সার্থক পরিমাপ পদ্ধতি হিসেবে সর্বপ্রথম ডি-স্কোয়ার স্ট্যাটিসটিক্স প্রয়োগ করেন। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে রাশিবিজ্ঞানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বাংলায় তাঁকে সাম্মানিক আবহাওয়া বিশারদ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

তিনি রাশিবিজ্ঞানকে শুধু শাস্ত্রীয় গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি, তিনি চাইতেন আধুনিক পৃথিবীতে অর্থবহ এক প্রযুক্তি হিসেবে এর বিকাশ সাধন। কৃষিবিজ্ঞানের ফলিত গবেষণায় প্রশান্তচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য অবদান ‘Design of Experiments’।

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষারপ্রসারে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের উপসংহার –

রাশিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বড়ো মাপের নমুনা সমীক্ষা নিয়ে গবেষণা নিঃসন্দেহে মহলানবিশের অন্যতম অবদান। স্বাধীন ভারত গড়ার ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার যে কাঠামো তিনি পেশ করেন, তা মহলানবিশ মডেল নামে পরিচিতি লাভ করে। এদেশে রাশিবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠায় প্রশান্তচন্দ্র কান্ডারির ভূমিকা নিয়ে আগাগোড়া যে প্রেরণা জুগিয়েছেন তা আমাদের কাছে গর্বের বিষয়।

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদান কী ছিল?

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ভূমিকা –

সত্যেন্দ্রনাথ বসু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি স্মরণীয় নাম। যতদিন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন সত্যেন্দ্রনাথ ভাস্বর হয়ে থাকবেন তাঁর বোসন কণার মাধ্যমে।

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আপেক্ষিকতাবাদের প্রবর্তন –

সত্যেন্দ্রনাথ আপেক্ষিকতাবাদের দিকে আকৃষ্ট হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আপেক্ষিকতাবাদ পড়াতে শুরু করেন। এভাবেই দেশে প্রথম আপেক্ষিকতাবাদ পড়ানো শুরু হয় এবং সতেন্দ্রনাথই তা প্রবর্তন করেন।

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বোস-সংখ্যায়ন তত্ত্ব –

পরবর্তী সময়ে 1924 খ্রিস্টাব্দে তিনি প্ল্যাঙ্কের সূত্রের এক সম্পূর্ণ কোয়ান্টামতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন। তিনি আলোককণিকাদের বিশেষ গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করে প্ল্যাঙ্কের সূত্র নির্ধারণ করলেন। সত্যেন্দ্রনাথের এই গণনা পদ্ধতির নাম বোস স্ট্যাটিসটিক্স বা বোস সংখ্যায়ন।

সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর পাণ্ডুলিপিতে বলেন, একই শক্তির আলোক কণিকাগুলির পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য করা যায় না। সাধারণ বস্তুকণিকার কথা যদি ধরা যায় তাহলে তারা একরূপী হলেও পার্থক্যহীন বা অভিন্ন নয়।

সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর পদ্ধতিতে আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রাপ্তির যে কথা বলেছেন, তার সার্বিক চরিত্র উদ্‌ঘাটন করেছিলেন আইনস্টাইন। তাই প্রথমে এই সংখ্যায়নকে বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন বলা হত। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের একার ধারণার উপর ভিত্তি করে এই সংখ্যায়ন গড়ে উঠেছে, তাই বর্তমানে এটিকে বোস-সংখ্যায়ন বলা হয়।

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের পক্ষপাতী –

সত্যেন্দ্রনাথ মনে করতেন জটিল, আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলি ছাত্রছাত্রীদের বোধগম্য করার জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষাদান প্রয়োজন। তিনি বিজ্ঞানের বইও মাতৃভাষায় লেখার পক্ষপাতী ছিলেন। মাতৃভাষায় শিক্ষাদান হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র পরিব্যাপ্ত হবে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। কৌতূহলী এবং জ্ঞানপিপাসুদের জানার স্পৃহা অতৃপ্ত ও অপূর্ণ থাকবে না।

সত্যেন্দ্রনাথ মনে করতেন মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলা বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তা না হলে বিজ্ঞান মানসিকতার ক্ষেত্র তৈরি হবে না।

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উপসংহার –

ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চার আধুনিক পর্বে সত্যেন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল অবনদ্য। বিংশ শতাব্দীতে বিশ্ববিজ্ঞানের পটভূমির যখন দ্রুত পরিবর্তন ঘটে চলেছে তখন সত্যেন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী সমাজের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

পি এম বাগচি অ্যান্ড কোং – টীকা লেখো।

পি এম বাগচি অ্যান্ড কোং -এর ভূমিকা –

বাঙালির প্রযুক্তি বিজ্ঞানের ইতিহাসে ঊনবিংশ শতাব্দীর আটের দশকে দৃষ্টান্তযোগ্য এক নাম পি এম বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি। 1883 খ্রিস্টাব্দে উত্তর কলকাতার এক ভাড়াবাড়িতে এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করেন কিশোরীমোহন বাগচি। তাঁর পিতার নাম ছিল প্যারিমোহন। পিতার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে কিশোরীমোহন কোম্পানির নামকরণ করেন পি এম বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি।

বাংলার প্রযুক্তি বিজ্ঞানের ইতিহাসে পি এম বাগচি অ্যান্ড কোং -এর ভূমিকা –

প্রতিষ্ঠার সময় এই কোম্পানির নাম ছিল দর্জিপাড়া কেমিক্যাল ওয়ার্কস। এরপর নাম বদলে হয় দর্জিপাড়া কেমিক্যাল অ্যান্ড রবার স্ট্যাম্প ওয়ার্কস। অবশেষে পি এম বাগচি অ্যান্ড কোম্পানির নামেই পরিচিতি লাভ করে এই সংস্থা। পি এম বাগচির শিল্প প্রচেষ্টা কয়েকটি শাখায় বিভক্ত ছিল –

  • কালি,
  • সুগন্ধি ও প্রসাধন,
  • রবার স্ট্যাম্প,
  • পঞ্জিকা ও ছাপাখানা,
  • কাঠের ব্লক নির্মাণ,
  • ওষুধ ইত্যাদি।
  1. কালি – কোম্পানির বিক্রয়জাত দ্রব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্রব্য হল কালি। কোম্পানিতে বিভিন্ন রঙের ও অনেক ধরনের কালি তৈরি করা হত। তরল কালির সঙ্গে সঙ্গে ট্যাবলেট কালিও তৈরি হত।
  2. সুগন্ধি ও প্রসাধন – পি এম বাগচির সুগন্ধি দ্রব্য ও প্রসাধনসামগ্রী ছিল অতুলনীয়। পাউডার, স্নো, ক্রিম, সেন্ট ইত্যাদি নানান ধরনের প্রসাধনসামগ্রী তৈরি হত। 1898 খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় শিল্পমেলায় উচ্চমানের সুগন্ধি দ্রব্য প্রস্তুতের জন্য বাগচি কোম্পানি স্বর্ণপদক পায়।
  3. রবার স্ট্যাম্প – কালি তৈরির পরে রবার স্ট্যাম্পের কারবার শুরু করে বাগচি কোম্পানি। এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠার অল্পকাল পরেই দর্জিপাড়া কেমিক্যাল অ্যান্ড রবার স্ট্যাম্প ওয়ার্কস -এর সূচনা হয়।
  4. পঞ্জিকা – পরবর্তীকালে বাগচি কোম্পানির মূল ব্যাবসা হয়ে ওঠে পঞ্জিকা। 1886 খ্রিস্টাব্দে প্রথম পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়। পঞ্জিকার সঙ্গে ডাইরেক্টরিও ছাপানো হত। একইসঙ্গে ছাপাখানা, প্রকাশনা ও টাইপ ফাউন্ড্রি নিয়ে কাজ শুরু হয়।
  5. ওষুধ – পি এম বাগচির শিল্প প্রচেষ্টার আরও একটি উজ্জ্বলতম নিদর্শন ওষুধ বিভাগ।

কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বাংলায় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের কী ভূমিকা ছিল?

অথবা, বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (BTI) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বাংলায় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের ভূমিকা –

1906 খ্রিস্টাব্দে বিদেশি শিক্ষার বিকল্প হিসেবে স্বদেশি শিক্ষার জন্য জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে শিক্ষার বিষয় হিসেবে কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। তারকনাথ পালিত, নীলরতন সরকার প্রমুখ সদস্যরা কারিগরি শিক্ষার সমর্থক ছিলেন। তারকনাথ পালিত কারিগরি বিদ্যাচর্চার বিকাশের জন্য সোসাইটি ফর দ্য প্রোমোশন অফ টেকনিক্যাল এডুকেশন (Society for the Promotion of Technical Education) প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।

কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বাংলায় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা –

1906 খ্রিস্টাব্দের 25 জুলাই সোসাইটি ফর দ্য প্রোমোশন অফ টেকনিক্যাল এডুকেশন -এর উদ্যোগে 92, আপার সার্কুলার রোডে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের (Bengal Technical Institute বা BTI) প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তারকনাথ পালিত।

কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বাংলায় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের পঠনপাঠন –

বিটিআই-তে দু-ধরনের পাঠ্যক্রম চালু ছিল –

  1. তিন বছরের অন্তর্বর্তী পাঠ্যক্রম।
  2. চার বছরের মাধ্যমিক পাঠ্যক্রম।

এখানে মূলত পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, ইংরেজি, যন্ত্রবিজ্ঞান, ভূবিদ্যা প্রভৃতি বিষয় পড়ানো হত।

কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বাংলায় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের মূল্যায়ন –

বিটিআই (BTI) সাফল্যের সঙ্গে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। পরবর্তীকালে এটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (1955 খ্রিস্টাব্দ) -এ পরিণত হয়।

ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির সমালোচনা কীভাবে করা হয়?

ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির ভূমিকা –

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার সূচনা ও প্রসার ঘটে। 1835 খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক পাশ্চাত্য শিক্ষাকে ‘সরকারি শিক্ষানীতি’ বলে গ্রহণ করেন। এর ফলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষায় সরকারি উদ্যোগ শুরু হয়। এ ছাড়া খ্রিস্টান মিশনারি ও প্রগতিশীল ব্যক্তিদের বেসরকারি উদ্যোগেও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। তবে ঔপনিবেশিক আমলের এই শিক্ষানীতি নানাভাবে সমালোচিত হয়।

ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির সমালোচনা –

  • কেরানি তৈরির শিক্ষা – ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতে ঔপনিবেশিক শিক্ষা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল সস্তার কেরানি তৈরি করা। কারণ স্বল্প বেতনে কেরানির চাকরি করার জন্য ব্রিটেন থেকে লোক পাওয়া সম্ভব ছিল না। এই কারণে অনেকে এই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যঙ্গ করে ‘গোলদীঘির গোলামখানা’ বলত।
  • উচ্চশ্রেণির শিক্ষা – ঔপনিবেশিক শিক্ষা ছিল সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারা ব্যাবসা ও পেশাগত কারণে ঔপনিবেশিক শিক্ষাকে গ্রহণ করেছিল। আর ভারতের অধিকাংশ মানুষ ছিল এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।
  • ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা – ঔপনিবেশিক শিক্ষা ছিল মূলত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় দেশের অধিকাংশ মানুষ এই শিক্ষাগ্রহণে বঞ্চিত ছিল।
  • শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে ব্যবধান – ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বড়ো ত্রুটি ছিল শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি। শিক্ষিত ইংরেজি-জানা মানুষেরা গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একেই কটাক্ষ করে বলেছিলেন, “ইংরেজি শিখে যারা বিশিষ্টতা পেয়েছিল তাদের মনের মিল হয় না সর্বসাধারণের সঙ্গে। দেশে সবচেয়ে বড়ো জাতিভেদ এখানেই।” তাই গ্রামের মানুষ শিক্ষিত মানুষকে ভক্তি করল, শ্রদ্ধা করল, ভয়ও করল কিন্তু আপন বলে মনে করল না।

ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির উপসংহার –

ভারতীয় পণ্ডিতগণ পাশ্চাত্য শিক্ষার সমালোচনার পাশাপাশি দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে 1906 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচীন ভারতীয় আশ্রমিক শিক্ষার আদলে শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ কী ছিল?

রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা –

বাংলাদেশে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বেসরকারি ও সরকারি উদ্যোগে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। দেশজ শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও অর্থ উপার্জনের সুবিধা থাকায় পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ও প্রসারিত হয়। এই শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটি ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে পাশ্চাত্য তথা ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিরোধিতা করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ –

  • সীমাবদ্ধতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিপদ সম্বন্ধে দেশবাসীকে সতর্ক করে বলেন যে, শহরের মানুষের একাংশ এই শিক্ষার সুযোগ পায় বলে তারাই মান, অর্থ অর্জন করে সমাজের শ্রেষ্ঠ শ্রেণির পর্যায়ে উন্নীত হয় আর তাদের পিছনে অন্ধকারে নিমগ্ন থাকে সারা দেশ। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পুথিগত বিদ্যাবুদ্ধির সংকীর্ণতার ফলে তারা শুধুমাত্র শিক্ষিত সমাজকেই দেশ বলে বিবেচনা করে। আর তার ফলে ভারতের অবহেলিত গ্রামগুলি যাবতীয় অসুবিধা আর সমস্যার সম্মুখীন হয়। শিক্ষার হেরফের (1893 খ্রিস্টাব্দ) প্রবন্ধে তিনি বলেন যে, বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল চিন্তাধারা আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। শিক্ষার ফল মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির মধ্যে সীমিত থাকে।
  • যান্ত্রিকতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, এই ধরনের শিক্ষা শিশুর উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশের বদলে শিশুকে নিষ্ক্রিয় যন্ত্রে পরিণত করে। একজন শিশুকে যদি তার মাতৃভাষায় স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ না দিয়ে বিদেশি ভাষা রপ্ত করার কাজে জোর দেওয়া হয়, তাহলে শিশুর সহজাত জ্ঞান অর্জনের বিষয়টি ক্ষুণ্ণ হয়। শিশু তথা শিক্ষার্থী তখন যান্ত্রিক হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, তাঁরা জড়পদার্থের মতো বসে থাকতেন জাদুঘরের মৃত সামগ্রীর ন্যায় এবং তাঁদের উপর শিক্ষকদের শিক্ষার বা পাঠের বিষয়বস্তু কার্যত ছুঁড়ে দেওয়া হত।
  • জ্ঞানভিক্ষা – রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, ঔপনিবেশিক শিক্ষাকাঠামোয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি কার্যত জ্ঞানভিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি জাতীয় মর্যাদাবোধকে ক্ষুণ্ণ করে। কারণ – এগুলি পাশ্চাত্যের আদর্শ অনুসরণ, ধার করা বিদ্যার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। তাঁর মতে, অন্ধ অনুকরণ না করে সমন্বয় করা উচিত। তিনি স্বদেশি সমাজ (1904 খ্রিস্টাব্দ) শীর্ষক বক্তৃতায় মেলা, যাত্রা, কথকতা প্রভৃতি দেশজ জনপ্রিয় মাধ্যমগুলিকে শিক্ষাদানের কাজে ব্যবহার করার উপর গুরুত্ব দেন।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ কী ছিল?

রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার মূল্যায়ন –

রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষের চারিত্রিক বলিষ্ঠতা, মনের প্রসারতা ও বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। তাই তিনি ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেছেন।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের পটভূমি আলোচনা করো।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের ভূমিকা –

বাংলায় আধুনিক শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় আদর্শে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠা –

1906 খ্রিস্টাব্দের 11 মার্চ 92 জন সদস্য নিয়ে কলকাতায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনে সভাপতিত্ব করেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার পটভূমি –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন – 1905 খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন বাংলা ভাগ করেন। এর প্রতিবাদে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে সাধারণ জনগণের সঙ্গে ছাত্ররাও অংশগ্রহণ করে।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনে সার্কুলার জারি –

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন থেকে ছাত্রদের দূরে রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন সার্কুলার জারি করে। এই সার্কুলারগুলি হল – কার্লাইল সার্কুলার, লিয়ন সার্কুলার, পেডলার সার্কুলার প্রভৃতি। এতে বলা হয়, আন্দোলনে যোগদানকারী ছাত্রদের শাস্তি দেওয়া হবে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হবে।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনে স্বদেশি আন্দোলন –

স্বদেশি আন্দোলনে শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সম্ভবত প্রসন্নকুমার ঠাকুর ‘জাতীয় শিক্ষা’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন –

স্বদেশি আন্দোলনের সময় জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। 1905 খ্রিস্টাব্দের 16 নভেম্বর প্রায় 1500 জন প্রতিনিধি নিয়ে কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক সভায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর ফলস্বরূপ 1906 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে বিদেশি শিক্ষাকেও বয়কট করার ডাক দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি স্বদেশি শিক্ষার প্রসার ঘটানো হয়। শিক্ষা বিষয়ে স্বদেশি আন্দোলনের ফলে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় আদর্শে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ -এর পটভূমি –

স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে ছাত্ররা দলে দলে যোগদান করে। আন্দোলন থেকে ছাত্রদের দূরে রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকার তিনটি সার্কুলার জারি করে। এগুলি হল – কার্লাইল সার্কুলার (1905 খ্রিস্টাব্দের 10 অক্টোবর), লিয়ন সার্কুলার (1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর) ও পেডলার সার্কুলার (1905 খ্রিস্টাব্দের 21 অক্টোবর)। এই সার্কুলার জারি করে সরকার ছাত্রদের আন্দোলনে যোগদানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ছাত্রদের ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দেওয়ার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বলা হয় যে, যারা এই নির্দেশ অমান্য করবে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হবে।

অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি –

এইসব সার্কুলারগুলির বিরুদ্ধে শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু 1905 খ্রিস্টাব্দের 4 নভেম্বর কলকাতায় অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সোসাইটির উদ্দেশ্য ছিল – স্বদেশি পণ্য বিক্রি করা, বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠন –

  1. 1905 খ্রিস্টাব্দের 5 নভেম্বর ডন সোসাইটির উদ্যোগে জাতীয় শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য একটি বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
  2. 1905 খ্রিস্টাব্দের 8 নভেম্বর রংপুরে সর্বপ্রথম জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
  3. 1906 খ্রিস্টাব্দের 11 মার্চ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় 92 জন সদস্য নিয়ে কলকাতায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education) গঠিত হয়।
  4. কারিগরি শিক্ষার জন্য 1906 খ্রিস্টাব্দের 25 জুলাই কলকাতায় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।
  5. এই পরিষদের অধীনে 1906 খ্রিস্টাব্দের 14 আগস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

জাতীয় শিক্ষার বিস্তার –

বাংলা ও বাংলার বাইরে জাতীয় শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল। 1908 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় 25টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও 300টির বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। বাংলার বাইরে বোম্বাই, মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব, বেরার, মসুলিপত্তনম, অন্ধ্র প্রভৃতি জায়গায় জাতীয় শিক্ষার প্রসার ঘটে। জাতীয় শিক্ষার জনপ্রিয়তা বজায় থাকে 1910 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ -এর মূল্যায়ন –

1910 খ্রিস্টাব্দের পর জাতীয় শিক্ষা পরিষদের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমতে থাকে। কারণ জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা ছাত্রদের সরকারি চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তবে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রথম জাতীয় স্তরের শিক্ষা নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।

জাতীয় শিক্ষার প্রসারে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অবদান আলোচনা করো।

1905 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশি আন্দোলন গড়ে ওঠে। স্বদেশি আন্দোলনে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জাতীয় শিক্ষার প্রসারের জন্য 1906 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গড়ে ওঠে।

জাতীয় পরিষদের অবদান –

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের অল্পকালের মধ্যেই কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে এই নিয়ে মতপার্থক্য শুরু হয়। ফলে দুটি প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

  • বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল – 1906 খ্রিস্টাব্দের 14 আগস্ট কলকাতার বৌবাজারে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ (Bengal National College) খোলা হয়। এখানে কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হত। অরবিন্দ ঘোষ এর প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় স্কুল খোলা হয়।
  • বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট – 1906 খ্রিস্টাব্দের 25 জুলাই তারকনাথ পালিত কারিগরি শিক্ষার প্রসারের জন্য বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলায় জাতীয় শিক্ষার বিস্তার –

কলকাতার পর ঢাকা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মালদহ প্রভৃতি স্থানে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। 1908 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় 25টি মাধ্যমিক ও 300টিরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।

বাংলার বাইরে জাতীয় শিক্ষার বিস্তার –

বাংলার বাইরে বোম্বাই, মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব, বেরার প্রভৃতি স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রভাবে 1909 খ্রিস্টাব্দে মসুলিপত্তনমে একটি জাতীয় কলেজ ও অন্ধ্রে একটি জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। 1910 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই জাতীয় শিক্ষার জনপ্রিয়তা বজায় ছিল।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ব্যর্থতার কারণ –

বিভিন্ন কারণে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ –

  • জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও তার অধীনস্থ স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। ফলে জাতীয় শিক্ষার বিস্তার ভারতীয় নেতাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না।
  • সরকারের বিরোধিতার ফলে জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা ছাত্রদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
  • অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় শিক্ষাগ্রহণ অপেক্ষা ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাগ্রহণেই বেশি আগ্রহী ছিল।
  • তা ছাড়া এর পতনের অন্যতম কারণ ছিল সরকারের প্রবল বিরোধিতা ও আর্থিক অনটন।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের গুরুত্ব –

উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও জাতীয় শিক্ষা পরিষদের গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না।

  • জাতীয় শিক্ষা পরিষদ জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।
  • জাতীয় শিক্ষা পরিষদ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিল।
  • রাসবিহারী ঘোষ, তারকনাথ পালিত, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ ব্যক্তিরা শিক্ষাপ্রসারের মহান আদর্শ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, যা উচ্চ প্রশংসার দাবি রাখে।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের মূল্যায়ন –

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রশংসা করে অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেছেন যে, ‘সেদিন যতটা পাওয়া গেল তাই বা উপেক্ষা করি কোন্ যুক্তিতে?’ তাই পরাধীন ভারতে জাতীয় শিক্ষাপ্রসারের এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। তা ছাড়া বর্তমান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরি ছিল এই জাতীয় শিক্ষা পরিষদ।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ব্যর্থতার কারণ কী?

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা –

স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের যুগে 1906 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। বাংলা ও বাংলার বাইরে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ব্যর্থতার কারণ –

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ব্যর্থতার কারণগুলি হল –

  • চাকরির ক্ষেত্রে অসুবিধা – চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ডিগ্রির কোনো মূল্য ছিল না। ফলে সমাজের বেশিরভাগ মানুষ এতে আকৃষ্ট হয়নি।
  • সরকারি দমননীতি – জাতীয় শিক্ষা পরিষদ পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকার ভালো চোখে দেখেনি। ফলে সরকারের বিরোধিতা ও দমননীতি এর ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল।
  • কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলেন। তিনি এখানে উৎকৃষ্ট শিক্ষা ও গবেষণার ব্যবস্থা করেন। ফলে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের আকর্ষণ কমে যায়।
  • কংগ্রেসের চরমপন্থী বিরোধ – কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতারা জাতীয় শিক্ষা পরিষদকে স্বীকার করেননি। তাদের বিরোধিতা জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ব্যর্থতার জন্য দায়ী ছিল।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উপসংহার –

তা ছাড়া জাতীয় শিক্ষা পরিষদ অর্থাভাবে ও সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সহযোগিতা ও সমর্থনের অভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

মানবকল্যাণে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি সক্রিয় উদ্যোগের উল্লেখ করো।

মানবকল্যাণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা –

পরাধীন ভারতবর্ষে দেশবাসীর আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তির জাগরণে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাঁর অবদান ছিল মানুষের হৃদয়ে দেশ, কাল, ধর্মের ঊর্ধ্বে সহজাত শাশ্বত মূল্যবোধ। ভারতের সঙ্গে পাশ্চাত্য তথা বিশ্বমানসের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মিলন সাধনের প্রয়াস রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ব হৃদয়ে স্থায়ী আসন দান করেছে।

মানবকল্যাণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সক্রিয় উদ্যোগ –

  • বিশ্ব মানবতার বাণী প্রচার – ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগে রবীন্দ্রনাথের মনে দুটি ভিন্ন ধারার দ্বন্দু-সংঘাত চলছিল, একদিকে কোলাহলমুক্ত পরিবেশে সাহিত্যসাধনার আবেগ, অপরদিকে নতুন সমাজবোধ ও স্বদেশের কল্যাণ বাসনা। পাশ্চাত্যের উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপরীতে নিখিল বিশ্ব মানবের বাণী তিনি প্রচার করেন। তাঁর সভাপতিত্বে গঠিত হয় বঙ্গীয় হিতসাধন মণ্ডলী। এই সংগঠনটি সমাজ উন্নয়নের এক বিস্তৃত কর্মসূচি গ্রহণ করে। প্রাক্তন বিপ্লবী অতুল সেন ও তাঁর সঙ্গীদের সহযোগিতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমাজ উন্নয়নের পরিকল্পনাকে গ্রামাঞ্চলে রূপায়ণের প্রয়াসী হন। বিশ্বশান্তি ও সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্রস্বরূপ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা কবির নব জীবনবোধের এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
  • সমবায় অর্থনীতির উপর গুরুত্ব আরোপ – কবি সমবায় অর্থনীতিতে বিশ্বাস করতেন। রবীন্দ্রনাথের কিছু আত্মীয়বর্গ সমবায় প্রথার রূপায়ণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁদের অনুগামীরূপে ওই প্রথাকে তত্ত্বগতভাবে প্রচার ও কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগে তিনি তৎপর হন। শ্রীনিকেতন কবির এই প্রচেষ্টার নিদর্শন। সমবায়ের মধ্য দিয়ে ধনবৈষম্য ও শোষণের অবসান হবে বলে তিনি মনে করতেন।
  • কৃষিতে যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রবর্তন ও ভারী শিল্পের উপর গুরুত্ব প্রদান – ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ। অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান প্রধানত কৃষিকর্মের উন্নয়নের উপর নির্ভরশীল। শ্রমের লাঘব ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষিতে যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রবর্তন চাইতেন রবীন্দ্রনাথ। গ্রামীণ সংস্কৃতি, কুটিরশিল্প ও সমবায় প্রণালীতে গুরুত্ব দিলেও ভারী শিল্পোন্নয়নেও তিনি সমধিক উৎসাহী ছিলেন।
  • শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা – পল্লিবাংলার দরিদ্র, অশিক্ষিত ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দুঃখদুর্দশা দূর করে তাদের জীবনের প্রকৃত উন্নতি ঘটানোর জন্য 1922 খ্রিস্টাব্দে বোলপুরের নিকটবর্তী সুরুল গ্রামে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রনাথ। এটি ছিল প্রকৃতপক্ষে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে এক আদর্শ গ্রাম গঠনের উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান।
  • অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর গুরুত্ব প্রদান – রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ছিল স্বতন্ত্র। সমাজসংস্কারের অঙ্গস্বরূপ তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে, আর্থিক ও সামাজিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে জনচেতনাকে দৃঢ় ও শক্তিসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে।

মানবকল্যাণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপসংহার –

কবি তাঁর সাধনায় নেতিবাচক সমালোচনায় প্রবৃত্ত না হয়ে শিক্ষাবিস্তার, সমবায় সংগঠন, হাসপাতাল পরিচালনা, পুকুর কাটানো প্রভৃতি যাবতীয় কল্যাণ কর্মে নিজের নিষ্ঠাকে প্রমাণিত করেন। অন্য কিছু নয়, নিজের আদর্শ অনুযায়ী দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা করাই ছিল কবিগুরুর একমাত্র উদ্দেশ্য।

শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলোচনা করো।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের শিক্ষাচিন্তার ভিত্তিতে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

ভুবনডাঙা থেকে শান্তিনিকেতন –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে 20 বিঘা জমি নিয়ে 1863 খ্রিস্টাব্দে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্থানের নামকরণ হয় শান্তিনিকেতন।

শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা –

1901 খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজের আদর্শে এই বিদ্যালয়টি গড়ে তুলেছিলেন।

শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। তিনি 1919 খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিশ্বভারতী পরিকল্পনার তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন যে, এখানে বিশ্ব একটি নীড়ে পরিণত হবে।

শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা –

এই উদ্দেশ্য নিয়েই 1921 খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তীকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে দুটি ক্যাম্পাস তৈরি হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর শান্তিনিকেতন ভাবনা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তার পরিচয় দাও।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে নিজের শিক্ষাচিন্তার ভিত্তিতে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে 20 বিঘা জমি কিনে 1863 খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ 1901 খ্রিস্টাব্দের 22 ডিসেম্বর পাঁচ জন ছাত্র নিয়ে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ধাপে ধাপে এই শান্তিনিকেতনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী গড়ে তোলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর শান্তিনিকেতন ভাবনা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা –

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে 1863 খ্রিস্টাব্দে 20 বিঘা জমি কেনেন। এখানে তিনি শান্তিনিকেতন নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে তাঁর শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করেন।

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ভাবনা –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নিজস্ব শিক্ষাচিন্তার ভিত্তিতে শান্তিনিকেতনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি চেয়েছিলেন –

  • প্রকৃতির কাছাকাছি আদর্শ পরিবেশের মধ্যে শিশুদের বড়ো করে তুলতে হবে।
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচীন ভারতের আশ্রমিক শিক্ষার ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাই তিনি শিক্ষার্থীদের শান্তিনিকেতনে রেখে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।
  • কবিগুরু শান্তিনিকেতনে গুরু ও শিষ্যের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি বলতেন, শিক্ষক শ্রদ্ধার সঙ্গে জ্ঞান বিতরণ করবেন আর শিক্ষার্থীরা শ্রদ্ধার সঙ্গে তা আহরণ করবে।
  • রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে শিক্ষার্থীদের সৃজনমূলক কাজের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের উৎসব পালন করারও ব্যবস্থা করেন। তিনি বলতেন, এসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে।

এই বিদ্যালয়ে গতানুগতিক সময়তালিকার বিশেষ গুরুত্ব ছিল না। শিক্ষার্থীর প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুসারে তা নির্ধারণ করা হত।

শান্তিনিকেতনে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠা –

রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করে তাকে বিশ্বজাতির মিলনভূমিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বভারতীতে বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি এখানে চিন, জাপান, ইউরোপ, আমেরিকা-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পন্ডিতদের নিয়ে এসেছিলেন।

শান্তিনিকেতনে প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটানো –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। এজন্য শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষের বাইরে প্রকৃতির মধ্যে গাছের তলায় শিক্ষা দেওয়া হত। তা ছাড়া শান্তিনিকেতনের সঙ্গে পাশাপাশি গ্রাম ও তার মানুষদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাই শান্তিনিকেতনের শিক্ষা হয়ে উঠেছিল এক মানবতাবোধের শিক্ষা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর শান্তিনিকেতন ভাবনা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার উপসংহার –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শান্তিনিকেতনে 1921 খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ভাবনা শুধু বাংলা বা ভারতে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এক দিকচিহ্ন হয়ে আছে। দেশ-বিদেশের বহু ছাত্র ও শিক্ষক এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন -এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন -এর ভূমিকা –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, বোধের শিক্ষাকে আমাদের বিদ্যালয়ে প্রধান স্থান দিতে হবে। অর্থাৎ, কেবল কারখানার দক্ষতা শিক্ষা নয়, স্কুল কলেজের পরীক্ষা পাস করা নয়, আমাদের যথার্থ শিক্ষা পেতে হবে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে, তপস্যার দ্বারা প্রবৃত্ত হয়ে। এই কারণে তিনি শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পল্লিপ্রকৃতির উদার প্রাঙ্গণে শিলাইদহে তিনি যে প্রথম শিক্ষার আয়োজন করেছিলেন তাই পরিণত রূপ পেল শান্তিনিকেতনে।

শান্তিনিকেতনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ –

রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাভাবনাকে প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োগ করার জন্য 1906 খ্রিস্টাব্দে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে আশ্রমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথের এই আশ্রমিক বিদ্যালয়ে যেসব বৈশিষ্ট্যগুলি রয়েছে সেগুলি হল –

  • অবাধ স্বাধীনতা – রবীন্দ্রনাথ শৈশবে চার দেয়ালের বাধাবন্ধনকে ভয় পেতেন। পরিণত জীবনেও চার দেয়ালের বদ্ধতার অনুশাসনের কোনো অর্থ তিনি খুঁজে পাননি। তাই অবাধ স্বাধীনতার উন্মুক্ত বিচরণভূমি করে তিনি তাঁর স্বপ্নের বিদ্যালয়টিকে গড়ে তুলেছিলেন।
  • প্রকৃতি সমন্বয় – রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ রেখে শিক্ষাদানের যে তত্ত্বের কথা বলেছেন, তাকেই তিনি প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োগ করেছিলেন শান্তিনিকেতনে।
  • সৃজনমূলক কাজের অনুশীলন – নানা ধরনের উৎসবমূলক আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে সৃজনমূলক কাজের অনুশীলন এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান বিশেষত্ব। তিনি মনে করেন সৃজনশীল কাজের অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব।
  • শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক – শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে সাবলীল আন্তরিকতা রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ভাবের সহজ আদানপ্রদানের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিতেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি চেয়েছিলেন নির্ভীক, মুক্ত উদারমন, আত্মবিশ্বাসী, আত্মশক্তিতে বলীয়ান, ভারতীয়ত্ববোধে দীক্ষিত – কিন্তু বিশ্ববোধে উন্নীত করে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই উদ্দেশ্যেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন গড়ে তুলেছিলেন।

বিশ্বভারতীর আদর্শ ও উদ্যোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বিশ্বভারতীর ভূমিকা –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 1921 খ্রিস্টাব্দের 23 ডিসেম্বর বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে এটি ছিল কলেজ পর্যায়ের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীকে বিশ্বজাতির মহামিলনের ক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন।

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার আদর্শ –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 1919 খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘বিশ্বভারতী’ পরিকল্পনা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘যত্র বিশ্বম ভবত্যেকনীড়ম’ অর্থাৎ যেখানে বিশ্ব একটি নীড়ে পরিণত হবে। এই আদর্শের ভিত্তিতে 1921 খ্রিস্টাব্দের 23 ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিশ্বভারতীর আদর্শ ও উদ্যোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

বিশ্বভারতীর উদ্যোগ –

বিশ্বভারতীর উদ্যোগে শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এর দুটি শাখা প্রতিষ্ঠান – শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন নিয়েই বিশ্বভারতী গঠিত হয়।

বিশ্বভারতীর আদর্শ ও উদ্যোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

শান্তিনিকেতন –

শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন শাখা বা অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলি হল –

  1. পাঠভবন (বিদ্যালয়),
  2. শিক্ষাভবন (মহাবিদ্যালয়),
  3. বিদ্যাভবন (স্নাতকোত্তর ও গবেষণা)।

এ ছাড়াও ছিল –

  1. কলাভবন ও
  2. সংগীতভবন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অধ্যাপক তান ইয়ুন সানের সহযোগিতায় 1937 খ্রিস্টাব্দে চিনাভবন এবং 1939 খ্রিস্টাব্দে হিন্দিভবনকে এর সঙ্গে সংযুক্ত করেন।

শ্রীনিকেতন –

শান্তিনিকেতন থেকে 2 মাইল দূরে সুরুল গ্রামে কৃষি ও পল্লিসংগঠন কেন্দ্র শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, পল্লিচর্চা ও পল্লিসংগঠন ছাড়া ভারতীয় শিক্ষা অসম্পূর্ণ। তাই এখানে কৃষি ও পল্লিসংগঠন ভবন ও শিল্পভবন গড়ে ওঠে। এটি হল রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন ও কিশোর-যুবকদের জন্য উন্নয়নমূলক কার্যাবলির কেন্দ্র।

পঠনপাঠনে বিশ্বভারতীর উদ্যোগ –

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীকে বিশ্বজাতির মিলনভূমিরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বভারতীতে বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতির মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি এখানে চিন, জাপান, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিয়ে এসেছিলেন। এখানে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল বৈদিক, পৌরাণিক, বৌদ্ধ, জৈন, ইসলামিক ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানসংবলিত পাঠ্য। তিনি আশা করেছিলেন এই জ্ঞানবৈচিত্র্য ভারতের স্বরূপকে খুঁজে পেতে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করবে।

বিশ্বভারতীর আদর্শ ও উদ্যোগের মূল্যায়ন –

1941 খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। 1951 খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর প্রথম উপাচার্য হন। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর আদর্শ ও উদ্যোগ আজও অম্লান আছে।

রবীন্দ্রনাথ কেন পাঠভবন গড়ে তোলেন?

অথবা, পাঠভবনের পঠনপাঠন সম্পর্কে কী জান?

পাঠভবনের ভূমিকা –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসারের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যার নাম দেন পাঠভবন।

পাঠভবনের প্রতিষ্ঠা –

1901 খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ পাঠভবন স্থাপন করেন। তিনি বলেন প্রকৃতির ক্রোড়ে জন্মে যদি প্রকৃতির শিক্ষা থেকে দূরে সরে থাকি, তাহলে শিক্ষা কখনও সার্থক হতে পারে না।

পাঠভবন গড়ে তোলার উদ্দেশ্য –

  • প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন আদর্শ বিদ্যালয় যদি স্থাপন করতে হয় তবে লোকালয় থেকে দূরে নির্জনে মুক্ত আকাশ ও উদার প্রান্তরে গাছপালার মধ্যে তার ব্যবস্থা করা চাই, সেখানে শিক্ষকগণ নিভৃতে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় নিযুক্ত থাকবেন এবং ছাত্রগণ সেই জ্ঞানচর্চার মধ্যেই বাড়তে থাকবে। এখানে প্রকৃতির আনন্দময় পরিবেশে একাত্মতা স্থাপনের জন্য প্রকৃতির কোলে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি।
  • সাহিত্যসভার আসর – পাঠভবনে সাহিত্যসভা বলে এক সাহিত্য ও সংগীতের সান্ধ্য আসর বসত, প্রতি মঙ্গলবার যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজ সাহিত্যকর্ম, নাচ, গান পরিবেশনা করত।
  • খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদন – খেলাধুলা ছিল পাঠভবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বছরে একবার গান, নাচ ও আবৃত্তির প্রতিযোগিতা হত। এই পাঠভবনেই বার্ষিক বনভোজনের আয়োজনও করা হত।

পাঠভবনের উপসংহার –

শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন শাখা বা অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম হল পাঠভবন। এর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীকে বিশ্বজাতির মিলনভূমিরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।

বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব কীভাবে হয়েছিল তা বিশ্লেষণ করো।

পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে ছাপাখানার উদ্ভব ঘটলেও বাংলায় তা ছিল বিলম্বিত প্রক্রিয়া। 1778 খ্রিস্টাব্দে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড-এর রচিত ‘আ গ্রামার অব্ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গোয়েজ’ গ্রন্থে প্রথম ব্যাপকভাবে বাংলা মুদ্রাক্ষর ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব হয়।

প্রেক্ষাপট – 

বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব আকস্মিক ছিল না। কারণ –

  • বিক্ষিপ্ত মুদ্রণ – 1778 খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রায় একশ বছর ধরে বিক্ষিপ্তভাবে বাংলা হরফযুক্ত মুদ্রণের কাজ হয়েছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আতানাসিউস কির্চারের রচিত ‘চায়না ইলাস্ট্রেটা’ (1667 খ্রি.) ও হ্যালহেড-এর রচিত ‘এ কোড অব জেন্টু লজ’ (1776 খ্রি.)।
  • প্রশাসনিক প্রয়োজন – 1773 খ্রিস্টাব্দে রেগুলেটিং আইনের মাধ্যমে বাংলায় প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজ শাসনের সূচনা হলে বাংলা ভাষায় আইন বা নির্দেশাবলীর প্রয়োজন দেখা দেয়।
  • হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতা – বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলা ভাষায় মুদ্রণের ক্ষেত্রে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, হেস্টিংস নিজ দায়িত্বে সরকারি খরচে এই গ্রন্থটি মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।
  • উইলকিন্সের ভূমিকা – ইংরেজ প্রশাসক চার্লস উইলকিন্স ছিলেন একজন প্রাচ্যভাষার পণ্ডিত এবং তিনি ছিলেন বাংলার মুদ্রাক্ষর তৈরিতে অভিজ্ঞ। তিনি হেস্টিংসের অনুরোধে পঞ্চানন কর্মকারের সহযোগিতায় হ্যালহেড-এর ব্যাকরণ গ্রন্থের মুদ্রাক্ষর তৈরি করে দেন।

উপসংহার – 

এভাবে বাংলায় মুদ্রণ ব্যবস্থা বা ছাপাখানার উদ্ভব ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ছাপাখানার উদ্ভব ও বিকাশে ঊনবিংশ শতক ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ শতক।

বাংলায় ছাপাখানা বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা – 

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বহির্ভারতে বিক্ষিপ্তভাবে মুদ্রণের ক্ষেত্রে বাংলা মুদ্রাক্ষর ব্যবহৃত হলেও 1778 খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব হয়।

প্রাথমিক পর্যায় – 

ছাপাখানার বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় ছিল 1778-1799 খ্রিঃ। এই সময়পর্বে ছাপাখানার বিভিন্ন দিকগুলি হল —

  • হ্যালহেড-এর ব্যাকরণ – 1778 খ্রিস্টাব্দে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী) ইংরেজদের বাংলা শিক্ষার জন্য ইংরেজি ভাষায় ‘A Grammar of the Bengal Language’ নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থের মোট পৃষ্ঠার চারভাগের একভাগ অংশে উদাহরণরূপে বাংলা হরফ ব্যবহার করা হয়। এইভাবে প্রথম বাংলা মুদ্রণ বা ছাপার কাজ শুরু হয়।
  • কোম্পানির প্রেস – হুগলির জেমস অগাস্টাস হিকির (অ্যান্ড্রুজ নামে ভুলপ্রচলিত) ছাপাখানা ছিল বাংলার প্রথম ছাপাখানা। তবে এই ছাপাখানার সব যন্ত্রপাতি ক্রয় করে সরকারি উদ্যোগে চার্লস উইলকিন্সের নেতৃত্বে কলকাতায় কোম্পানির প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় (1780 খ্রি.)।
  • হিকির প্রেস – কোম্পানির প্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে এই প্রেস থেকে ‘হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট’ নামক সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের প্রথম 10টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পরে অবশ্য হিকি নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
  • অন্যান্য প্রেস – কোম্পানির প্রেসের সমসাময়িক অপর একটি ছাপাখানাও ছিল এবং এটি কলকাতায় 37 নং লারকিন্স লেনে অবস্থিত ছিল। এছাড়া ‘ক্যালকাটা গেজেট প্রেস’ নামক আধা-সরকারি ছাপাখানা (1784 খ্রি.), ‘বেঙ্গল ক্রনিকল প্রেস’ ও ‘ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানির প্রেস’ ছিল উল্লেখযোগ্য ছাপাখানা।

উপসংহার – 

বাংলার প্রাথমিক পর্যায়ের এই ছাপাখানাগুলির উৎপাদন ছিল আইন ও আইনগ্রন্থের অনুবাদ, ব্যাকরণ – অভিধান ও শব্দকোষ এবং সংবাদপত্র ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন।

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস ও তার কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা –

বাংলায় ছাপাখানা ব্যবস্থার উদ্যোগ বিলম্বিত হলেও উনিশ শতকের সূচনায় তা দ্রুত বিকাশলাভ করতে থাকে। এই বিকাশের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস।

মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা –

খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষায় বাইবেল ছাপানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন (1798 খ্রি.)। কিন্তু তা প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় নিজেই ছাপাখানা প্রবর্তন করে তা ছাপানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠিত হলে (1800 খ্রি.) কেরি এখানেই শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপন করেন। 1820 খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই এই ছাপাখানা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছাপাখানায় পরিণত হয়।

মিশন প্রেসের উৎপাদন –

শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের উৎপাদনগুলি হল —

  • ধর্ম পুস্তক – প্রাথমিক পর্বে কেরির সহযোগী ছিলেন উইলিয়াম ওয়ার্ড (একজন দক্ষ মুদ্রাকর) এবং পঞ্চানন কর্মকার। তিনি কলকাতা থেকে সংগৃহীত হরফ এবং কিছু পাটনাই ও বিদেশি কাগজ সহযোগে ছাপার কাজ শুরু করেন। নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম অধ্যায়টির বাংলা অনুবাদ করে কেরি 107 পৃষ্ঠা বিশিষ্ট ‘মঙ্গল সমাচার মাতিউর রচিত’ নামে প্রকাশ করেন। 1801 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে আটশোরও অধিক পৃষ্ঠাযুক্ত ‘ধর্মপুস্তক’ বা বাংলা বাইবেল প্রকাশ করেন।
  • অন্যান্য বই – শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে রামরাম বসুর রচিত ‘হরকরা’ ও ‘জ্ঞানোদয়’ নামক দুটি গ্রন্থ (আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে, 1800 খ্রি.) মুদ্রিত হয়। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘বত্রিশ সিংহাসন’ (1802 খ্রি.), 4 খণ্ডে কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’ (1801-03) ও পাঁচ খণ্ডে কীর্তিবাসের ‘রামায়ণ’ (1802-03) মুদ্রিত হয়। এভাবে 1832 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই প্রেসে 40টি বিভিন্ন ভাষায় 212,000 কপি বই মুদ্রিত হয়।
  • পাঠ্যপুস্তক – শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকও মুদ্রিত হয়েছিল। এই সব পুস্তকের রচয়িতা ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু, চণ্ডীচরণ মুন্সী, হরপ্রসাদ রায় প্রমুখ।

উপসংহার –

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, ধর্মীয় উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপিত হলেও তার ছাপাখানা-উৎপাদনে ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ও ছিল।

ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে ছাপাখানা ও শিক্ষার বিস্তার বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা –

বাংলায় ছাপাখানার প্রবর্তনের ফলে লেখকের সঙ্গে পাঠকের সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইতিপূর্বের সীমাবদ্ধ জ্ঞান অন্যান্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে ছাপাখানা ও শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগ ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ।

স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগ –

ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল বুক সোসাইটির (1817 খ্রি.) উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষায় স্কুল-পাঠ্য পুস্তক ছাপানো এবং শিক্ষার্থীদের কাছে তা সরবরাহ করা। ডেভিড হেয়ার আমৃত্যু এই কাজে ব্রতী ছিলেন।

  • নিজস্ব ছাপাখানা – স্কুল বুক সোসাইটি শিক্ষার বিস্তারের উদ্দেশ্যে কলকাতার সার্কুলার রোডে নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া শ্রীরামপুর মিশন প্রেস সহ অন্যান্য প্রেসেও বই ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিল।
  • বাংলা ভাষার প্রাধান্য – এই সোসাইটি অন্যান্য ভাষায় ছাপানো পুস্তকের পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করে। এই সোসাইটি প্রথম চার বছরে (1817-21 খ্রি:) বাংলা ভাষাতে 19টি বইয়ের 79,750 টি কপি মুদ্রণ ও বিপণনের ব্যবস্থা করে।
  • মুদ্রণের মানোন্নয়ন – বাংলা ভাষার উন্নতিসাধন এবং বাংলা মুদ্রণের মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে এই সোসাইটির উদ্যোগ ছিল প্রশ্নাতীত। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ইংরেজি প্রথানুযায়ী যতিচিহ্নের ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা গ্রন্থের মুদ্রণে ছবি, মানচিত্র, নকশার ব্যবহার শুরু করে।

উপসংহার –

এভাবে বাংলার ছাপাখানার ইতিহাসে স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে বাংলায় বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, অভিধান, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তন ঘটে। এই ঘটনা শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের কাছে পাশ্চাত্যের জ্ঞানজগৎ-এর দরজা উন্মোচন করে দেয়।

ব্যাবসায়িক ভিত্তিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপাখানার বিস্তার কীভাবে হয়েছিল?

ভূমিকা –

উনিশ শতকের শুরুতে সরকারি ও মিশনারি উদ্যোগে ছাপাখানার বিকাশের পাশাপাশি ব্যাবসায়িক ভিত্তিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ছাপাখানার বিস্তার ঘটতে থাকে।

ব্যক্তিগত উদ্যোগ –

(1817-1834) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ছাপাখানার বিস্তার পর্ব নামে পরিচিত এবং এই সময়ে ব্যাবসায়িক ভিত্তিতে কলকাতা ও তার আশেপাশের এলাকায় যেভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপাখানার বিস্তার ঘটে তা হল –

  • ছাপাখানা – 1820 খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত ছাপাখানাগুলি হল — পটলডাঙ্গার লাল্লুলাল কবির সংস্কৃত যন্ত্র, আড়গুলি লেনে হরচন্দ্র রায়ের ছাপাখানা, শোভাবাজারের বিশ্বনাথ দেবের ছাপাখানা, বাঙ্গালি প্রেস প্রভৃতি। এছাড়া বউবাজারের লেবেন্ডর সাহেবের ছাপাখানা, শ্রীরামপুরের নীলমণি হালদারের ছাপাখানা ছিল বিখ্যাত।
  • উৎপাদন – এই সমস্ত ছাপাখানা থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। হিন্দুস্থানী প্রেস থেকে ঔষধসার সংগ্রহ (1819 খ্রি:), বাঙ্গালি প্রেস থেকে রামমোহন রায়ের ‘কঠোপনিষৎ’ (1817 খ্রি:), হরচন্দ্র রায়ের আড়গুলি লেনের প্রেস থেকে বিভিন্ন রকম ধর্মীয় গ্রন্থ, বিশ্বনাথ দেবের প্রেস থেকে রাধাকান্ত দেবের ‘বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ’ (1821 খ্রি:) প্রকাশিত হয়।
  • লিথোগ্রাফের প্রবর্তন – ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাপাখানার বিস্তারের একটি দিক ছিল লিথোগ্রাফিক ছাপা’র প্রবর্তন। এই ধরনের ছাপাব্যবস্থায় ছবি, নকশা, মানচিত্র আঁকা সম্ভব হয়।
  • প্রকাশনার মানোন্নয়ন – ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত ছাপাখানাগুলিতে মুদ্রণ কৌশল ও মুদ্রণের মানোন্নয়ন ঘটানোরও চেষ্টা করা হয়। প্রকাশনায় শোভনতা বৃদ্ধির দিকেও নজর দেওয়া হয়।

উপসংহার –

এভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা ছাপাখানাগুলি মুদ্রণের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য সাধন করে এবং বাংলার মুদ্রণ ব্যবস্থা ক্রমশই আধুনিক হয়ে ওঠার পথে যাত্রা শুরু করে।

ঈশ্বরচন্দ্রঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কীভাবে ছাপাখানার ব্যাবসায়িক উদ্যোগে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করেন তা বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা –

বিদ্যাসাগর ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত ও লেখক। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পণ্ডিত বা সেরেস্তাদারের পদে নিযুক্ত হন (29 ডিসেম্বর, 1841)। পরবর্তীকালে তিনি সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করেন (এপ্রিল, 1846; জুলাই 1847 খ্রি.)। আবার 1850-এর দশকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন উনিশ শতকের একজন উল্লেখযোগ্য গ্রন্থকার, মুদ্রক ও প্রকাশক।

ছাপাখানা ও বিদ্যাসাগর –

প্রাক্-আধুনিক যুগের ছাপাখানার ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের অবদানের বিভিন্ন দিক হল –

  • গ্রন্থকার রূপে – বিদ্যাসাগর নিজে ছিলেন একজন গ্রন্থকার। তিনি তাঁর লেখা ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ গ্রন্থটি রোজারিও কোম্পানির ছাপাখানায় ছাপানোর ব্যবস্থা করেন (1847 খ্রি.)। পরবর্তীকালে তিনি নিজের রচিত অনেক পুস্তক নিজের ছাপাখানাতেই মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।
  • মুদ্রাকর রূপে বিদ্যাসাগর – 1847 খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর তাঁর বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে যৌথভাবে 62 নং আমহার্স্ট স্ট্রিটে ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নামক একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই ছাপাখানার একক মালিক হন।
  • প্রকাশক – এই ছাপাখানা থেকে বিদ্যাসাগর তাঁর নিজের ও অন্যান্য লেখকের রচিত গ্রন্থ ছাপান ও প্রকাশ করেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ (13 এপ্রিল ও 14 জুন, 1855 খ্রি.)।
  • পুস্তক বিক্রেতা – উনিশ শতকে বটতলা ও চিনাবাজার এলাকায় বই বাজার গড়ে উঠলেও হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ অঞ্চলে বইয়ের দোকান ছিল না। তাই বিদ্যাসাগর এই অঞ্চলে ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি’ নামক একটি বইয়ের দোকান খোলেন।

উপসংহার –

এভাবে বিদ্যাসাগর গ্রন্থকার, প্রকাশক ও মুদ্রাকর হয়ে ওঠেন। এর পাশাপাশি তিনি ছাপাখানার টেকনিক্যাল ব্যাপারেও উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হন, যার উদাহরণ হল ‘বিদ্যাসাগর সাট’।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও ইউ. এন. রায় অ্যান্ড সন্স সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণমূলক টীকা লেখো।

ভূমিকা –

প্রাক্-আধুনিক বাংলা মুদ্রণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (1863-1915 খ্রি.)। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে ছাপাখানায় আসে এক বিপ্লব।

ছাপাখানার উন্নতি –

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন একজন শিশুসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী। স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশনা ও ছাপাখানার প্রাথমিক জ্ঞান তাঁর ছিল। তিনি যেভাবে ছাপাখানার উন্নতিসাধন করেন তা হল –

  • নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা – তিনি নিজে ‘ইউ. এন. রায় অ্যান্ড সন্স’ নামক একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এনগ্রেভিং পদ্ধতিতে মুদ্রণ ব্যবস্থার যে সীমাবদ্ধতাগুলি ছিল তা দূর করেন। এর পাশাপাশি তিনি রঙিন ও হাফটোন ব্লকের প্রবর্তন করে ভারতের তথা বিশ্বের মুদ্রণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উন্নতিসাধন করেন।
  • নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সম্পূর্ণ দেশীয় উপাদানে গবেষণা করে রঙিন মুদ্রণের নানাপ্রকার ডায়াফর্ম যন্ত্র, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডুয়োটাইপ ও টিন্ট প্রসেস পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন।
  • পথপ্রদর্শক – উপেন্দ্রকিশোর উদ্ভাবিত স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্রের নাম হয় ‘রে-স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার’ এবং টিন্ট প্রসেস-এর নাম হয় ‘রে-টিন্ট সিস্টেম’। এবং সর্বোপরি উপেন্দ্রকিশোরের পরিকল্পনা অনুসরণ করে ব্রিটেনে বাণিজ্যিকভাবে ‘স্ক্রিন অ্যাডজাস্টিং মেশিন’ তৈরি করা হয়।

উপসংহার –

এভাবে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ‘ইউ. এন. রায় অ্যান্ড সন্স’ ছাপাখানা ভারত ও বিশ্বে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী হয়ে ওঠেন।

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ধারণার সমালোচনাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবে?

ভূমিকা –

উনিশ শতকে মেকলে মিনিটের মাধ্যমে ভারতে যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন হয়েছিল তার সঙ্গে বাস্তবজীবনের সম্পর্ক না থাকায় ভারতীয়রা এই শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিল।

শিক্ষা ধারণার সমালোচনা –

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ধারণার সীমাবদ্ধতা থেকেই ভারতীয়রা উনিশ শতকে এক বিকল্প শিক্ষানীতির কথা চিন্তাভাবনা শুরু করে –

  • মাতৃভাষার গুরুত্ব – জনগণের মধ্যে কার্যকরী শিক্ষার প্রসারের দাবি থেকেই গণমুখী শিক্ষাভাবনা গড়ে ওঠে এবং এই শিক্ষার দিক ছিল বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা। 1838 খ্রিস্টাব্দে উদয়চন্দ্র আঢ্য নামক ডিরোজিও-পন্থী একজন সাংবাদিক মাতৃভাষা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যমরূপে দাবি করেন। আবার এক দু’বছর পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রদানের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা। পরবর্তীকালে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেন।
  • কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষা – প্রমথনাথ বসু কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষার উপরে গুরুত্ব আরোপ করেন। এই একই উদ্দেশ্যে যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ একটি অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলেন।
  • সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যয় – জাতীয়তাবাদী নেতা তথা ‘ডন’ পত্রিকার (1897 খ্রি.) প্রতিষ্ঠাতা সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার সমালোচনা করেন। তিনি দেশের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তনের কথা বলেন।
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার সমালোচনার ক্ষেত্রে সর্বাধিক বিখ্যাত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠакুর। তিনি তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শিক্ষাকে সমালোচনা করেন ও স্কুলগুলিকে ‘ছেলেদের মানুষ করার যন্ত্র’ নামে অভিহিত করেন। এর পাশাপাশি তিনি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় ভারতীয় জীবনাদর্শ ও রীতিনীতিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। তিনি শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামক একটি আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে বিকল্প শিক্ষানীতির প্রবর্তন করেন।

উপসংহার –

এভাবে ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারা সমালোচনার মাধ্যমে ভারতে জাতীয় শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন কালে গড়ে ওঠে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শান্তিনিকেতন ভাবনার বিভিন্ন দিক চিহ্নিত করো।

ভূমিকা –

ভারতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনের জন্য দক্ষ কেরানি তৈরি করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এরূপ শিক্ষাধারার সমালোচনা করেন এবং শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামক এক বিদ্যালয় স্থাপন করে এক বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা করেন।

উদ্দেশ্য –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল –

  1. এরূপ আবাসিক ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করা এবং এভাবে প্রাচীন ভারতের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের গুরু-শিষ্য সম্পর্ককে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
  2. প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে এক নতুন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

শিক্ষাব্যবস্থা –

রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন বা শিক্ষণ সম্পর্কে যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেন তা হল –

  • তিন নীতি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই নতুন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনটি নীতি প্রয়োগ করেন যথা — অবাধ স্বাধীনতা, অবাধ চলাফেরা ও খেলাধুলা। পাশাপাশি তিনি প্রকৃতির সঙ্গে যোগ রেখে মনের চর্চার ওপর গুরুত্ব দেন।
  • সাংস্কৃতিক বিষয় – প্রকৃতি থেকে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার পাশাপাশি এক উন্নত সাংস্কৃতিক বিষয়কে পাঠক্রমে রাখা হয়। এগুলি হল — কলা, নৃত্য, নাটক, সংগীত-অঙ্কন প্রভৃতি। এগুলি শেখানোর জন্য বিষয় বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হয়।
  • কারিগরি শিক্ষা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই বিদ্যালয়ে একই সঙ্গে ব্যক্তি ও সমষ্টির শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়।

উপসংহার –

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচলিত শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের পরিবর্তে প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। তবে এই শিক্ষা আনন্দপাঠ হলেও ঔপনিবেশিক কাঠামোর কার্যকরী শিক্ষা ছিল না।

বিশ্বভারতী কেন ও কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা –

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাশ্চাত্য শিক্ষাধারার বিকল্প জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানরূপে শান্তিনিকেতনে যে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন তা পরবর্তীকালে একটি বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানকে একটি বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা থেকেই গড়ে ওঠে বিশ্বভারতী (8 পৌষ, 1328 বঙ্গাব্দ, 22 ডিসেম্বর 1921 খ্রি.)।

প্রেক্ষাপট –

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সেগুলি হল –

  • ভারতীয় আদর্শকে তুলে ধরা – শান্তিনিকেতনকে কেন্দ্র করে ভারতের আদর্শ ও বাণী বিশ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যেই তিনি বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।
  • নিজের কর্তব্য সম্পাদন – রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সাহিত্যিকরূপে বিশ্ববাসীকে যেমন সাহিত্য উপহার দেন, তেমনি তিনি ভারতবাসীর হয়ে বিশ্বকে কিছু প্রদান করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি একজন ভারতীয়রূপে নিজের কর্তব্য সম্পাদনের জন্য বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রতিষ্ঠা –

1918 খ্রিস্টাব্দের 23 ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয় (8 পৌষ, 1325 বঙ্গাব্দ)। এর তিন বছর পর পৌষ উৎসবে বিশ্বভারতী উদ্ঘাটিত হয়। বিশ্বভারতী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার তিনটি স্তর ছিল যথা –

  1. ভারত সংস্কৃতি – ভারতের সমগ্ররূপ উপলব্ধি করতে ভারতের নানা সংস্কৃতি (বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন ও মুসলমান) কে তুলে ধরা।
  2. বিদ্যা উৎপাদন – তিনি মত প্রকাশ করেন যে, বিশ্বভারতীর মূল কাজ হবে বিদ্যার উৎপাদন। বিদ্যা বিতরণ হবে গৌণ কাজ। এই উদ্দেশ্যে বিশ্বের মনীষীদের আহ্বান করে বিশ্বভারতীতে তাঁদের আনার কাজ শুরু করেন।
  3. উৎপাদন-শিক্ষা – শিক্ষার্থীদের অর্থশাস্ত্র, কৃষি-তত্ত্ব, নানা ব্যবহারিক বিদ্যা শিক্ষা ও বিশ্বভারতীর চতুর্দিকে তার প্রয়োগের ব্যবস্থা করাও ছিল তাঁর চিন্তা-ভাবনার বিশেষ দিক। এরই সূত্র ধরে শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠা করা হয়।

উপসংহার –

বিশ্বভারতী উদ্ঘাটনের দিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতীকে দেশবাসীর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন। এভাবেই ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের একজন আদর্শ ভারতীয় রূপে উত্তরণ ঘটে।


আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় “বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Please Share This Article

Related Posts

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিষয়সংক্ষেপ

About The Author

Solution Wbbse

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত): বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর