বিংশ শতাব্দী ভারতের ইতিহাসে একটি দ্রুত পরিবর্তনের সময়কাল। এই শতাব্দীতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে এবং দেশটি ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি, ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন অংশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনও দেখা দেয়। এই আন্দোলনগুলি নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার ও স্বার্থের জন্য সংগ্রাম করেছিল।
স্বদেশি আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের চরিত্র ছিল ঘরোয়া – তুমি কি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত? তোমার উত্তরের পক্ষে যুক্তি দাও।
ভূমিকা – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে পুরুষদের পাশাপাশি বাংলার নারীসমাজও অংশগ্রহণ করে। তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না, বরং তা ছিল সহযোগীর ভূমিকা।
অংশগ্রহণের চরিত্র – স্বদেশি আন্দোলনে নারী সমাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, যেমন —
বিভিন্ন কর্মসূচি সম্পাদন – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময় বিদেশি বস্ত্র বর্জন ও পোড়ানো, দেশি কাপড়ের প্রচলন ও অরন্ধন দিবস পালন প্রভৃতি কর্মসূচিতে নারীরা যোগদান করেন।
বিপ্লববাদে সহায়তা – এ ছাড়া বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, গোপনে সংবাদ ও অস্ত্র সরবরাহ ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁরা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। ফরিদপুরে সৌদামিনী দেবী, বরিশালের সরোজিনী দেবী, বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী প্রমুখরা বিপ্লবীদের আশ্রয় দেন। তাঁরা গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করার কাজে নিযুক্ত হন। এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেজো পিসিমা ননীবালা দেবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে তিনি গ্রেফতার হন। নির্যাতন চালিয়েও তাঁর কাছ থেকে পুলিশ কোনো গোপন তথ্য আদায় করতে পারেনি।
জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচার – আন্দোলনে সহযোগীর ভূমিকার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। স্বদেশি আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগনি সরলাদেবী চৌধুরানি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ‘ভারতী’ পত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে নারীশক্তিকে উজ্জীবিত করে তোলেন। এ ছাড়া বীরাষ্টমী উৎসব, প্রতাপাদিত্য ব্রত, উদয়াদিত্য ব্রত ইত্যাদি প্রচলন করেন। এই উৎসবগুলিতে বাঙালি যুবকদের লাঠি খেলা, কুস্তি, তরবারি খেলা, শরীরচর্চা ইত্যাদির প্রতি উৎসাহদান করা হত।
অর্থদান – জন্মভূমির উদ্দেশ্যে একমুঠো চাল ধরে রাখার জন্য বাংলার মেয়েদের কাছে মায়ের কৌটো বা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পৌঁছে দেওয়া হয়। কোনো নারী দুঃসাহসিক কাজ করলে বা প্রচুর অর্থ দান করলে তাকে, বঙ্গলক্ষ্মী উপাধি দেওয়া হয়। চারণ কবি মুকুন্দ দাসও বঙ্গনারীকে রেশমি চুড়ি ছাড়ার পরামর্শ দেন।
অরন্ধনের বাস্তবায়ন – স্বদেশি আন্দোলনে শহরাঞ্চলের নারী সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন (১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর) কলকাতার নারী সমাজের একটা বড়ো অংশ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আহ্বানে অরন্ধন পালন করে। তারা উপবাস করে, চরকা কেটে দিনটি অতিবাহিত করেন।
নারী সমাবেশ – ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর ফেডারেশন হল এর ভিত্তি স্থাপনে ৫০০ মহিলা যোগ দেন। মুরশিদাবাদের কান্দিতে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বিষ্ণু প্রাঙ্গণে প্রায় ৫০০ মহিলা সমবেত হন। উপস্থিত নরনারীরা সেদিন সমবেতভাবে বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের শপথ গ্রহণ করেন।
বিশিষ্ট নারীদের অংশগ্রণ গ্রাম – শহর সর্বত্র চরকার প্রবর্তন, লক্ষ্মী ভাণ্ডার গড়ে তোলা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে – জাতীয়তাবাদী মহিলারা আন্দোলনকে আরও ব্যাপক করে তোলেন। এ প্রসঙ্গে কুমুদিনী মিত্র, লীলাবতী মিত্র, হেমাঙ্গিনী দাস, নির্মলা সরকার প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নারীবাহিনী – এই সময় বরিশালের ১৩ বছরের গৃহবধূ মনোরমা বসু একটি নারীবাহিনী তৈরি করেন। সদর রাস্তায় এই বাহিনী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।
উপসংহার – এভাবে দেখা যায় যে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে নারীর অংশগ্রহণ ছিল মূলত ঘরোয়া, অর্থাৎ ঘর থেকেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণও ছিল। এই আন্দোলনে নারীর যোগদান ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। আবার যোগদানকারী নারীদের অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত ছিল কিনা তা বিতর্কিত।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে সরলাদেবী চৌধুরানির ভূমিকা কী ছিল? অসহযোগ আন্দোলনে নারী সমাজের যোগদানের প্রকৃতিকে তুমি কীভাবে চিহ্নিত করবে?
প্রথম অংশ – সরলাদেবী চৌধুরানি বঙ্গভঙ্গের পূর্বে ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে নারী জাগরণ ও জাতি জাগরণের ক্ষেত্রে ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর কৃতিত্বের বিভিন্ন দিকগুলি হল —
প্রতাপাদিত্য উৎসব – বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নের পর তিনি ১ বৈশাখ তারিখে প্রতাপাদিত্য উৎসব – এর প্রচলন করেন। মোগল শাসন বিরোধী বাঙালি বীর প্রতাপাদিত্যের জীবনী পাঠ, কুস্তি ও তলোয়ার, বক্সিং ও লাঠি চালনা ছিল এই উৎসবের অঙ্গ।
জাতীয়তার আদর্শ প্রচার – বঙ্গভঙ্গের পূর্বেই তিনি ‘ভারতী’ নামক পত্রিকায় তার লেখনীর মাধ্যমে জাতীয়তার আদর্শ প্রচার করেন। এর পাশাপাশি তিনি ইংরেজদের হাতে নিগৃহীত ভারতীয়দের তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানানোর ঘটনাও তুলে ধরেন।
নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা – ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের এলাহাবাদ অধিবেশনকালে (১৯১০ খ্রি.) তিনি একটি নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারত-স্ত্রী-মহামণ্ডল’ নামক নারী সংগঠন।
দ্বিতীয় অংশ – অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের দিকগুলি হল —
বয়কট ও স্বদেশি – মহাত্মা গান্ধি প্রাথমিকভাবে নারীদের সীমিত কর্মসূচিতে অর্থাৎ বিদেশি দ্রব্য বয়কট ও স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণের জন্য যোগ দিতে আহ্বান জানান। তাঁর এই আহ্বানে ভারতের হাজার হাজার নারী যোগদান করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে সরোজিনী নাইডু, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ নারীর নাম উল্লেখ্য।
বিক্ষোভ কর্মসূচি – ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর – এ ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ বা ইংল্যান্ডের যুবরাজ ভারত সফরে এলে বোম্বাই ও কলকাতা শহরে নারী বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কংগ্রেস নেতা চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী ও তাঁর বোন উর্মিলা দেবী প্রকাশ্য রাজপথে যুবরাজ বিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করলে তাদের জেলবন্দি করা হয়।
গঠনমূলক কর্মসূচি – শহরের বেশ কয়েকজন নেত্রী গ্রামে গিয়ে অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করার জন্য প্রচার চালান। এ ছাড়া বিভিন্ন গঠনমূলক কর্মসূচি, যেমন — চরকায় সুতো কাটা ও কাপড় বোনার জন্য উৎসাহিত করা হয়।
নারী সংগঠন – অসহযোগ আন্দোলনের পূর্বেই সরোজিনী নাইডুর নেতৃত্বে ‘ভারতীয় মহিলা সমিতি’ গড়ে উঠেছিল। অনুরূপভাবে অসহযোগ আন্দোলনকালে কলকাতায় ‘কর্মমন্দির’, ‘নারী-সত্যাগ্রহ সমিতির’ মাধ্যমে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরা সভাসমিতি, পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করে।
মূল্যায়ণ – অসহযোগ আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। এই আন্দোলনে মুসলমান নারীদের যোগদান ছিল অত্যন্ত অল্প। তবে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের মধ্যে গঠনমূলক কাজের প্রসার ঘটে।
জাতীয় আন্দোলনে সরোজিনী নাইডু বিখ্যাত কেন? আইন অমান্য আন্দোলনের সময় নারী সমাজের ভূমিকাকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?
প্রথম অংশ – বিশ শতকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। সরোজিনী নাইডু। তিনি বিভিন্ন কারণে বিখ্যাত –
মহিলা সমিতি গঠন – ১৯১৫-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন এবং সামাজিক উন্নতি, নারীশক্তির উজ্জীবন ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতীয় নারী সমিতি (WIA) প্রতিষ্ঠা করেন।
জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ – তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকেই জাতীয় আন্দোলনে যোগদান করেন। অসহযোগ আন্দোলনকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন না করলেও ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কানপুরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা সভাপতি। আইন অমান্য আন্দোলনকালে তিনি গান্ধিজির ডান্ডি অভিযানে অংশ নেন ও ধরসানা লবণগোলা অভিযান করেন। আবার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারতছাড়ো আন্দোলনকালে তিনি জেলবন্দি হন।
গভর্নররূপে – তিনি ১৯৪৭-১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আগ্রার সংযুক্ত প্রদেশ ও অযোধ্যার গভর্নররূপে শাসনভার পরিচালনা করেন।
দ্বিতীয় অংশ – অসহযোগ আন্দোলন অপেক্ষা আইন অমান্য আন্দোলনকালে (১৯৩০-৩৪ খ্রি.) তুলনামূলকভাবে নারীর যোগদান ছিল অধিক। গান্ধিজি লবণকে আইন অমান্যের বিষয়ে পরিণত করে নারীদের কাছে এই আন্দোলন আকর্ষণীয় করে তুলতে চেয়েছিলেন।
যোগদান – আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের যোগদানের উল্লেখযোগ্য দিক হল –
লবণ আইন ভঙ্গ – ডান্ডিতে মহাত্মা গান্ধির লবণ আইন অমান্য কালে অনেক নারী যোগদান করেন ও লবণ আইন ভঙ্গ করেন। এরপর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে হাজার হাজার নারী লবণ আইন ভঙ্গ শুরু করে দেয়। সরোজিনী নাইডুর নেতৃত্বে ‘ধরসানা লবণ গোলা অভিযান’ সম্পন্ন হয়।
বিক্ষোভ কর্মসূচি – লবণ আইন ভঙ্গের পাশাপাশি বিদেশি বস্ত্র ও মদের দোকানের সামনে পিকেটিং – এ নারীরা অংশ নেয়। এর পাশাপাশি বোম্বাই, এলাহাবাদ, লাহোর, দিল্লি প্রভৃতি শহরে নারীরা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। এমনকি সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরাও এই বিক্ষোভে অংশ নেয়।
কৃষক নারীদের অংশগ্রহণ – আইন অমান্য আন্দোলনে কৃষক পরিবারের নারীদের অংশগ্রহণ আন্দোলনকে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দেয়। মেদিনীপুরের ঘাটাল, কাঁথি, তমলুক প্রভৃতি স্থানের কৃষক নারীরা পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লবণ প্রস্তুত ও বিক্রয় করে।
নারী সংগঠনের যোগদান – এই আন্দোলনে বিভিন্ন নারী সংগঠন যোগ দিয়েছিল। এদের মধ্যেই বোম্বাইয়ের দেশ সেবিকা সংঘ, বাংলার ‘মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ’, কলকাতার ‘ছাত্রী সংঘ’ ছিল উল্লেখযোগ্য।
মূল্যায়ণ – আইন অমান্য আন্দোলনকালে ভারতের নারী সমাজের যোগদানের প্রকৃতি ভারতজুড়ে একইরকম ছিলনা। ঐতিহাসিক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, অংশগ্রহণের দিক থেকে বোম্বাইয়ের আন্দোলন ছিল সবচাইতে সংগঠিত, বাংলার আন্দোলন ছিল উগ্র এবং মাদ্রাজের নারীদের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারা আন্দোলন কতটা স্বতঃস্ফুর্ত ছিল তা ব্যাখ্যা করো। ঝাঁসির রানি ব্রিগেডের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করো।
প্রথম অংশ – ভারত ছাড়ো আন্দোলন মহাত্মা # গান্ধির নামে পরিচালিত হলেও তা ছিল গান্ধিজির নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত আন্দোলন। উপরন্তু এই আন্দোলনকালে জাতীয় কংগ্রেস দলকে বেআইনি ঘোষণা করে কংগ্রেস নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। তাই ভারতছাড়ো আন্দোলন ছিল। স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলন এবং এই আন্দোলনে নারীদের যোগদানও ছিল তুলনামূলকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত।
নারীর যোগদান – ভারতছাড়ো আন্দোলনে নারীদের যোগদান আইন অমান্য আন্দোলনের ন্যায় পরিকল্পিত ও কর্মসূচিভিত্তিক ছিলনা। তথাপি নারীরা যেভাবে যোগদান করে তা হল —
মধ্যবিত্ত নারীর যোগদান – এই আন্দোলনে স্কুলকলেজের ছাত্রীরা যোগদান করেছিল। আবার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারীরা প্রকাশ্য ও গোপন দু’ধরনের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। যেমন – ঊষা মেহতা বোম্বাইয়ে গোপন রেডিয়ো কেন্দ্র গড়ে তুলে গান্ধিজির ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ আদর্শ – সহ জাতীয় আদর্শ প্রচার করতেন।
নারীদের সংগঠন – নারীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অরুণা আসফ আলি ও সুচেতা কৃপালিনীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অরুণা আসফ আলি গোপনে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৯ আগস্ট তিনি। বোম্বাই – এর আগস্ট ক্রান্তি ময়দানে তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেন।
মাতঙ্গিনী হাজরা – ভারতছাড়ো আন্দোলনে অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা
ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। তিনি মেদিনীপুরের তমলুক থানা দখল অভিযানের জন্য গড়ে ওঠা একটি মিছিলের নেতৃত্ব দেন। তিনি পুলিশের গুলিতে জখন হন ও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভগিনী সেনা – ভারতছাড়ো আন্দোলনকালে বাংলার মেদিনীপুরে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গ্রামীণ মহিলারা ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম চালানোর জন্য নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। এইরূপ সংগঠন। ‘ভগিনী সেনা’ নামে পরিচিত। ভগিনী সেনার অনেক নারী জেলবন্দি হন ও ৮৪ জনেরও বেশি নারী ধর্ষিতা হন।
মূল্যায়ণ – এভাবে দেখা যায় যে, ভারত ছাড়ো আন্দোলনকালে বাংলা, বোম্বাই, আসাম, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, কর্ণাটকের হাজার হাজার নারী অংশগ্রহণ করেছিল। এই সমস্ত নারীদের অধিকাংশই কংগ্রেস দলের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত ছিল। তুলনামূলকভাবে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি এই সময় আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছিল। তবে এই আন্দোলনে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন ও কমিউনিস্টদলের নারী সদস্যদের যোগদান ছিল সীমিত।
দ্বিতীয় অংশ – সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে একটি নারীবাহিনী যোগ করেন (১৯৪৩ খ্রি.); যা ঝাঁসির রানি বিগ্রেড নামে পরিচিত।
বাহিনীর বৈশিষ্ট্য – ঝাঁসির রানি বিগ্রেডের বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বা দিককে চিহ্নিত করা যায়, যথা—
নেতৃত্ব – ঝাঁসির রানির বিগ্রেডের প্রধান ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবী আম্মু স্বামীনাথনের কন্যা লক্ষ্মী স্বামীনাথন। তিনি ছিলেন মহিলা ডাক্তার।
সেনা সদস্য – এই বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ছিল ১৫০০ এবং এঁরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে এসেছিলেন। এই বাহিনীর সমন্বয়েই গঠিত হয় আজাদ হিন্দ বাহিনীর ‘আত্মাহুতি শাখা’ বা ‘সুইসাইড স্কোয়াড’।
প্রশিক্ষিত বাহিনী – নারী বাহিনীকে যুদ্ধের কলাকৌশলে প্রশিক্ষিত করা হয়। ফলে এই বাহিনী ছিল পূর্ণ প্রশিক্ষিত বাহিনী। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ইম্ফল অভিযানে এই বাহিনীকে যুদ্ধে পাঠানো হয়। এভাবে ঝাঁসীর রানি ব্রিগেডের নারী সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে এক অনন্য নজির স্থাপন করে।
জাতীয় আন্দোলনে নারীদের যোগদান আলোচনা করো। এই আন্দোলনে নারীদের অবদান কি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল?
ভূমিকা – প্রথমদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষিত নারীরা মূলত নারীমুক্তি আন্দোলনের শরিক হয়েছিল এবং বিভিন্ন ধর্মীয় রচনা প্রকাশ ও নারী সংগঠন স্থাপনের মাধ্যমে নারী শক্তিকে সংহত করতে সচেষ্ট হয়েছিল। এভাবে সংহত ও জাগরিত নারীশক্তি বিশ শতকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
জাতীয় আন্দোলনে নারী – বিশ শতকের জাতীয় আন্দোলনগুলিতে নারীদের যোগদান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় –
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে নারীসমাজের অংশগ্রহণের ধরনগুলি হল-
- ঘরের অভ্যন্তরে থেকেই নারীরা এই আন্দোলনে যোগ দেয়
- বিদেশি বস্ত্র বর্জন ও পোড়ানো, দেশি কাপড়ের প্রচলন, অরন্ধন দিবস পালন প্রভৃতি কর্মসূচিতে নারীরা যোগ দেয়।
- বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, গোপনে সংবাদ ও অস্ত্র সরাবরাহের মাধ্যমেও নারীরা আন্দোলনে অংশ নেয়।
অসহযোগ আন্দোলন – গান্ধিজি পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনগুলিতে নারী সমাজের অংশগ্রহণ অনেক বৃদ্ধি পায়। ১৯২০-১৯২১ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধিজি প্রাথমিকভাবে মহিলাদের সীমিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার নির্দেশ দেন। এই কর্মসূচির মধ্যে ছিল বিদেশি দ্রব্য বয়কট ও স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণ। কিন্তু ভারতীয় নারীরা এই সময় আরও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। দেশের বহু প্রান্তে তারা পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে হাজার হাজার মহিলা প্রিন্স অফ ওয়েলস্-এর ভারত ভ্রমণের বিরুদ্ধে বোম্বাই ও কলকাতা শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এই সময় মহিলা নেত্রীরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করার জন্য প্রচার চালান।
আইন অমান্য আন্দোলন – ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের আইন অমান্য আন্দোলনে মহিলারা অনেক বেশি মাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর গান্ধিজি একটি বিশেষ আহ্বানের মাধ্যমে ভারতীয় নারী সমাজকে আন্দোলনে যোগদান করার জন্য উৎসাহিত করেন (ইয়ং ইন্ডিয়া, ১০ এপ্রিল ১৯৩০ খ্রি.)। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার নারী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেন। লবণ আইন ভাঙা থেকে শুরু করে বিলিতি কাপড় ও মদের দোকানের সামনে পিকেটিং—এই সমস্ত কর্মসূচিতে তারা সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। বোম্বাই, এলাহাবাদ, লাহোর, দিল্লি প্রভৃতি শহরে মহিলারা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ জানান। বিভিন্ন বিক্ষোভ সমাবেশে সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা বিপুল সংখ্যায় যোগদান করেন। তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানে শুধুমাত্র ইংরেজ সরকারই নয়, রক্ষণশীল পুরুষ সমাজও স্তম্ভিত হয়ে যায়। এমনকি এই আন্দোলনে কৃষক পরিবারের নারীদের সক্রিয় যোগদানও উল্লেখ করার মতো।
ভারতছাড়ো আন্দোলন – ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারতছাড়ো আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাতীয় সংগ্রামে নারীর ভূমিকা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময় স্কুলকলেজের ছাত্রীরাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। নারীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অরুণা আসফ আলি ও সুচেতা কৃপালিনীর ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অরুণা আসফ আলি গোপনে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ঊষা মেহতা গোপনে কংগ্রেসের বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করেন। আবার এই আন্দোলনে অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন।
বিপ্লবী আন্দোলন – সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে নারীরা যোগদান করেছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, বীণা দাস প্রমুখ।
মূল্যায়ণ – ভারতের জাতীয় সংগ্রামে প্রাথমিকভাবে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল পুরুষদের সহযোগী ভূমিকায়। তাঁরা আন্দোলনের স্বতন্ত্র কোনো ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারেনি। আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নারীদের বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না। জাতীয় কংগ্রেস আন্দোলনে নারী সমাজের যোগদানকে অনুমোদন করে, কিন্তু আন্দোলন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের মতামত তেমন করে গ্রহণ করা হয়নি। সরলাদেবী চৌধুরানি হতাশ হয়ে লিখেছিলেন, কংগ্রেস নারীদের কেবল আইন লঙ্ঘনকারী হিসেবেই চেয়েছিলেন, আইন প্রণেতা হিসেবে নয়।
বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা কী ছিল তা ব্যাখ্যা করো।
ভূমিকা – ভারতে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোতধারার পাশাপাশি বিশ শতকে নরমপন্থী আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে চরমপন্থী ও বিপ্লববাদী মতাদর্শের উদ্ভব হয়। বিপ্লবী আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব ও বাংলা। ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে এই বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ যোগদান শুরু হয়েছিল।
বিপ্লবী আন্দোলন ও নারী – বিপ্লবী আন্দোলনে যে সমস্ত নারী যোগদান করেছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
ননীবালা দেবী – ননীবালা দেবী ছিলেন বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেজো পিসি। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে তিনি বিপ্লবীদের আশ্রয়দান ও গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করেন। এই অপরাধে তাকে ব্রিটিশ সরকার আটক করে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য তাঁর উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েও পুলিশ তাঁর কাছ থেকে কোনো গোপন তথ্য আদায় করতে পারেনি।
মাদাম কামা – বহির্ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মাদাম কামা। তিনি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে তিনি ভারতে স্বাধীনতার প্রতীক রূপে ‘বন্দেমাতরম’ লেখা তেরঙ্গা (লাল, হলুদ ও সবুজ) জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি ভারতের ‘বিপ্লববাদের জননী’ নামে পরিচিত।
লীলা রায় – বিপ্লবী লীলা রায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘দীপালি সংঘ’। এর উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য নারীদের প্রস্তুত করা। এখানে নারীদের লাঠিখেলা, শরীর চর্চা ও অস্ত্র চালানো, অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় ও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার শিক্ষা দেওয়া হত। এভাবে এই সংঘ নারী বিপ্লবীদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার – দীপালি সংঘের অন্যতম সদস্যা ও বাংলার বিপ্লবী নারী ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (১৯১১-৩২ খ্রি.)। তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের সহকারিণী ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী চট্টগ্রামের পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে সফল হলেও তিনি বিষ খেয়ে প্রাণত্যাগ করে শহিদ হন।
কল্পনা দত্ত – ছিলেন চট্টগ্রামের বিখ্যাত বিপ্লবী নারী ছিলেন কল্পনা দত্ত (১৯১২-১৯৯৫ খ্রি.)। বিপ্লবী নির্মল সেনের সঙ্গে পরিচয়সূত্রে তিনি বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন এবং বিপ্লবী দলের গোপন কাগজপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখার দায়িত্ব পান। তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তিনি বাংলার ‘অগ্নিকন্যা’ নামে পরিচিত।
বীণা দাস – কলেজ ছাত্রী বীণা দাস (১৯১১-৮৬ খ্রি.) | ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সময় সেনেট হলে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যার জন্য গুলি করেন। জ্যাকসন অল্পের জন্য বেঁচে যান এবং জ্যাকসনকে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে বীণা দাসের নয় বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এভাবে বীণা দাস বিপ্লবীর মর্যাদা লাভ করেন ও এ কারণেই স্মরণীয় হয়ে আছেন।
পর্যালোচনা – বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ও কর্মসূচি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারীদের বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না, বা তারা আন্দোলনের স্বতন্ত্র কোনো ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেও পারেনি। নারীর অংশগ্রহণ ছিল পুরুষদের সহযোগী ভূমিকায় অংশগ্রহণ। অবশ্য হিংসাত্মক আন্দোলনে নারীদের এই যোগদান ব্যর্থ হয়নি। কারণ আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে ঝাঁসির রানি রেজিমেন্ট’ নামক ১৫০০ নারী সৈন্যের এক বাহিনী গঠন করা হয় (১৯৪৩ খ্রি.) ; এদের অনেকেই ‘আত্মাহুতি বাহিনী’র অন্তর্গত ছিলেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বে ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণ ব্যাখ্যা করো।
ভূমিকা – ভারতের জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের যোগদান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। বিবেকানন্দের ‘জাতীয়তাবাদী আদর্শ’ ও বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র ছাত্রসমাজকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতিতে যোগদান করে।
বঙ্গভঙ্গকালে ছাত্র আন্দোলন – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে ছাত্ররা বিভিন্ন প্রতিবাদী সভাসমিতিতে যোগ দেয় এবং বিদেশি পণ্য বয়কট ও স্বদেশি দ্রব্য প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে তারা ৭৫ টি শাখার মাধ্যমে স্বদেশি দ্রব্য সামগ্রী বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি তারা সরকারি স্কুলকলেজ বয়কট করে।
অসহযোগ আন্দোলনকালে ছাত্র আন্দোলন – অসহযোগ আন্দোলনকালে ছাত্ররা –
- স্থানীয় নেতাদের উদ্যোগে বয়কট কর্মসূচিকে সফল করতে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামে ছাত্ররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি দ্রব্য বয়কট করে।
- ছাত্রদের অনেকে কংগ্রেস ও খিলাফৎ স্বেচ্ছাসেবকরূপে চাঁদা সংগ্রহ, গঠনমূলক কাজ ও চরকা ব্যবহারের কর্মসূচি প্রচার করে।
- বিকল্প জাতীয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষায়তনগুলিতে ছাত্ররা যোগদানের কর্মসূচিও গ্রহণ করে।
আইন অমান্য আন্দোলন – অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রসমাজ যেভাবে স্কুলকলেজ বয়কট করেছিল, আইন অমান্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এই পর্বে ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ততা ও ব্যাপক বয়কট দেখা যায়নি। গান্ধিজি লাহোর কংগ্রেসে ছাত্রদের স্কুল, কলেজ বয়কটকে অবাস্তব বলে ঘোষণা করেছিলেন। ছাত্রদের জন্য বিকল্প জাতীয় বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা না করে তিনি বিদ্যালয় বয়কট করার পক্ষে সমর্থন জানাননি। ফলত বিক্ষিপ্ত কিছু স্থান ছাড়া আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রসমাজের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ তেমন ছিল না।
ভারতছাড়ো আন্দোলন – ভারতছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে শহরের ছাত্রসমাজ মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। ধর্মঘট, বয়কট ও পিকেটিং-এর মধ্য দিয়ে তারা আন্দোলনকে জোরদার করে তোলে। ছাত্র-যুবদের হাত ধরেই গ্রামাঞ্চলে ‘ভারতছাড়ো’ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ভারতছাড়ো আন্দোলনকালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ট্রেনের দখল নেয় এবং এর নাম দেয় ‘আজাদ ট্রেন’। এই ট্রেনে চড়ে তারা উত্তরপ্রদেশের শেরপুর অঞ্চলে পৌঁছায় এবং সেখানের কৃষক আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করে। তাই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ‘আজাদ ট্রেন’ এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল।
বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রসমাজ – বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর নেতৃত্বে সংঘটিত মজফ্ফরপুর ঘটনা, ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তের দিল্লির সংসদভবনে বোমা নিক্ষেপ, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ও বিনয়-বাদল-দীনেশের অলিন্দ যুদ্ধ এবং রশিদ আলি দিবস ছিল বিপ্লবী ছাত্রদের বিপ্লবাত্মক কাজকর্মের উদাহরণ।
মূল্যায়ণ – জাতীয় আন্দোলনে বিশেষত বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্ররা ছিল ‘স্বনিয়োজিত প্রচারক’। তবে অসহযোগ আন্দোলনক কালে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। কিন্তু ১৯২০-র দশকে ছাত্র আন্দোলনের উপর বামপন্থী আদর্শের প্রভাব ও ছাত্রদের স্বার্থযুক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং গান্ধিজি কর্তৃক ১৯৩০-র দশকে জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণে নিরুৎসাহ প্রদর্শনের কারণে জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের যোগদান হ্রাস পায়।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারতছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে? রশিদ আলি দিবসের গুরুত্ব কী ছিল?
প্রথম অংশ – ভারতছাড়ো আন্দোলন মহাত্মা গান্ধির নামে পরিচালিত হলেও তা ছিল গান্ধিজির নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত আন্দোলন। উপরন্তু এই আন্দোলনকালে জাতীয় কংগ্রেস দলকে বেআইনি ঘোষণা করে কংগ্রেস নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। তাই ভারতছাড়ো আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন এবং এই আন্দোলনে ছাত্রদের যোগদানও ছিল তুলনামূলকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত।
ছাত্রদের অংশগ্রহণ – ভারতছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের বিভিন্ন দিকগুলি হল —
শহরাঞ্চলে ছাত্রদের ভূমিকা – ভারতছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে শহরের ছাত্রসমাজ মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। ধর্মঘট, বয়কট ও পিকেটিং-এর মধ্য দিয়ে তারা আন্দোলনকে জোরদার করে তোলে। ছাত্র-যুবদের হাত ধরেই গ্রামাঞ্চলে
‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
গ্রামাঞ্চলে ছাত্রদের ভূমিকা – ভারতছাড়ো আন্দোলনকালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ট্রেনের দখল নেয় এবং এর নাম দেয় ‘আজাদ’ ট্রেন। এই ট্রেনে চড়ে তারা উত্তরপ্রদেশের শেরপুর অঞ্চলে পৌঁছায় এবং সেখানের কৃষক আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করে। তাই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় আজাদ ট্রেন’ এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল।
প্রতিবাদ সমাবেশ – বোম্বাই শহরে আন্দোলনের প্রধান প্রধান নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৯ আগস্ট শিবাজি পার্কে নারী ও ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে এক বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ছাত্র সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ – ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট পাটনার মহাকরণেও জাতীয় পতাকা তোলা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পাটনায় সাতজন ছাত্র মারা যান। এরপর আন্দোলন উগ্র রূপ ধারণ করে। টেলিফোন, টেলিগ্রাফের তার উপড়ে ফেলা হয়। রেলপথ, রাস্তা, সাঁকো ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। সরকার নিষ্ঠুর দমনপীড়নের মাধ্যমে এই আন্দোলন প্রতিহত করতে উদ্যত হয়।
মূল্যায়ণ – এভাবে দেখা যায় যে, ভারতবর্ষের সর্বত্র ছাত্রসমাজ তার সর্বশক্তি নিয়ে এই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। বহু ছাত্র প্রাণ হারান। ছাত্রসমাজের স্বতস্ফূর্ত যোগদান ভারতছাড়ো আন্দোলনের গতি ত্বরান্বিত করেছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয় অংশ – ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি দিল্লির লালকেল্লাতে আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার ক্যাপটেন রশিদ আলির বিচার ও তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দান করা হয়। এই ঘটনায় কলকাতা পুনরায় উত্তাল হয়ে ওঠে এবং ছাত্র বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন কারণে রশিদ আলি দিবস তাৎপর্যপূর্ণ যেমন —
- এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অহিংস গণ আন্দোলন হিংসাত্মক আন্দোলনে পরিণত হয়
- এটি স্থানীয় বা প্রাদেশিক ঘটনার পরিধি ছাড়িয়ে জাতীয় চরিত্র নেয়
- এই আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য জোরদার হয়ে ওঠে
- রশিদ আলি দিবসের প্রভাবে ১৩-১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকা-সহ বহরমপুর, কৃষ্ণনগর,
রানাঘাট, মেদিনীপুর প্রভৃতি শহরেও ধর্মঘট পালিত হয়।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ কীরূপ ছিল?
ভূমিকা – বিশ শতকে জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের দুটি ধারা ছিল, যথা –
- শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন এবং
- বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র-যুবদের মধ্যে সংগ্রামী বিপ্লববাদের আদর্শ প্রচারিত হয়। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ তরুণ ছাত্র সমাজকে বিপ্লববাদে দীক্ষিত করেন। বাংলার বিপ্লবীরা গুপ্ত হত্যায় লিপ্ত হন।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন – ভারতের জাতীয় আন্দোলনে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল —
কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা – মজফ্ফরপুরের অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার চেষ্টার অপরাধে, একই ঘটনায় প্রফুল্ল চাকীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তিনি নিজের পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ক্ষুদিরামও ধরা পড়েন ও ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। এই দুই তরুণ ছাত্রের আত্মত্যাগ ভারতবাসীর মনে দেশপ্রেমের বন্যা বইয়ে দেয়।
আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা – এ ছাড়া এই সময় আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯০৮ খ্রি.) বহু বিপ্লবীকে সারাজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র ছিল।
প্রাক্-আইন অমান্য পর্বে বিপ্লবী আন্দোলন – আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই ছাত্রসমাজ সক্রিয় জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর দুজন ঘনিষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন বঙ্গবাসী কলেজের দুজন ছাত্র যতীন দাস ও প্রমোদ ঘোষাল। যতীন দাস ছিলেন বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র সংসদের সভাপতি। প্রমোদ ঘোষাল ছিলেন সম্পাদক। যতীন দাস সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা – পাঞ্জাবের বিপ্লবী ভগৎ সিং, লালা লাজপৎ রায়ের হত্যাকারী পুলিশ কমিশনার সান্ডার্সকে গুলি করেন (১৭ ডিসেম্বর, ১৯২৮ খ্রি.)। সান্ডার্সের হত্যার ফলে পুলিশ জনসাধারণের উপর নির্যাতন চালায়। সরকারকে সতর্ক করার উদ্দেশ্য ১৯২৯-এর ৮ এপ্রিল ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির সংসদ ভবনে বোমা নিক্ষেপ করেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে এই বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সরকার লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে। ধৃত বিপ্লবীদের বেশিরভাগই ছিলেন ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি।
অলিন্দ যুদ্ধ – ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর বিনয় বসু, তাঁর দুই বিপ্লবী বন্ধু বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ প্রবেশ করেন। এরপর তাঁরা কারা বিভাগের ইনস্পেকটর জেনারেলকে হত্যা করেন ও এক ইংরেজ কর্মচারীকে আহত করেন। এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ পুলিশ তিনজনকে ঘিরে ফেললে রাইটার্স বিল্ডিং-এর বারান্দা বা অলিন্দে অসম যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ অলিন্দ যুদ্ধ নামে পরিচিত।
বীণা দাস – কলেজ ছাত্রী বীণা দাস (১৯১১-৮৬ খ্রি.) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সময় সেনেট হলে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যার জন্য গুলি করেন (১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি)। জ্যাকসন অল্পের জন্য বেঁচে যান এবং জ্যাকসনকে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে বীণা দাসের নয় বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এভাবে বীণা দাস বিপ্লবীর মর্যাদা লাভ করেন ও এ কারণেই স্মরণীয় হয়ে
আছেন।
পর্যালোচনা – ছাত্রদের বৈপ্লবিক আন্দোলন সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে — প্রথমত, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন ছিল নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। বিপ্লবী নেতারা বিপ্লবকে সার্থক করতেই অল্পবয়সি ভাবাবেগে পূর্ণ ছাত্রদের ব্যবহার করেছিল। দ্বিতীয়ত, ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত বৈপ্লবিক আন্দোলন সমগ্র ছাত্রসমাজের দ্বারা সমর্থিত হয়নি। উপরন্তু এই আন্দোলন ছিল শহরকেন্দ্রিক। তৃতীয়ত, ছাত্রদের বৈপ্লবিক আন্দোলন স্বতস্ফুর্ত ছিল না; তা ছিল নির্দেশিত ও যুব নেতাদের দ্বারা আরোপিত। এ কারণেই ছাত্রদের বৈপ্লবিক আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনকে পরিপুষ্ট করলেও সমাজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
দলিত কারা? ভারতে দলিত রাজনীতির উদ্ভবের কারণগুলি ব্যাখ্যা করো।
প্রথম অংশ – ভারতে বর্ণব্যবস্থাযুক্ত সমাজব্যবস্থায় উচ্চবর্ণের দ্বারা নিম্নবর্ণের হিন্দু বা অস্পৃশ্যরা শোষিত ও অত্যাচারিত হত এবং এদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার ছিল না। এরূপ অস্পৃশ্যরাই ঔপনিবেশিক শাসনকালে দলিত নামে পরিচিতি লাভ করে। দলিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মধ্যভারতের মাহার সম্প্রদায়, দক্ষিণ ভারতের ইজাভা ও পুলায়া সম্প্রদায় এবং বাংলার নমঃশূদ্রগণ।
দলিতদের অধিকাংশই ছিল অনগ্রসর হিন্দু ও অস্পৃশ্য। এদের পেশা ছিল আবর্জনা সাফাই ও ঝাড়ু দেওয়া, জুতো তৈরি করা, শবদাহ করা, মৃত গৃহপালিত পশু সৎকার করা প্রভৃতি। অনেকে আবার অন্যের জমিতে মজুর বা মুনিষরূপে কাজ করত, কেউ বা পালকি বাহকরূপে কাজ করত। এরা হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণ (বর্ণহিন্দু) দের দ্বারা বিভিন্নভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিল, যেমন —
- দলিতরা সর্বসাধারণের ব্যবহার করা জলাশয় বা কুয়ো থেকে পানীয় জল নিতে পারত না
- হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের অধিকার ছিল না
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভরতি ও শিক্ষাগ্রহণের সমস্যাও ছিল
- সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ ছিল না।
দ্বিতীয় অংশ – বিশ শতকে ভারতীয় রাজনীতিতে সম্প্রদায়গত ও জাতিগত বিষয়টি প্রাধান্য লাভ করে। হিন্দু সমাজে বর্ণপ্রথা ও বহুজাতি প্রথাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা = আর্থসামাজিক অধিকারহীন দলিত সম্প্রদায়ও রাজনীতির বিষয় হয়ে ওঠে।
ভারতে দলিত রাজনীতির উদ্ভবের কারণ – দলিত রাজনীতির উদ্ভবের কারণগুলি হল –
ব্রাক্ষ্মণ আধিপত্য – মহারাষ্ট্রের ঢালি জাতির বিখ্যাত নেতা জ্যোতিবা ফুলে ১৮৭০ – এর দশকে প্রচার করেন যে, ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী ব্রাক্ষ্মণদের আধিপত্যই হল — শুভ্রবর্ণ তথা দলিতদের দুর্দশার মূল কারণ।
ঔপনিবেশিক শাসন – ঔপনিবেশিক শাসনপর্বে হিন্দুসমাজের বর্ণব্যবস্থাকে মান্যতা দেওয়া হয়। ১৮৮০-র দশকে জনগণনায় হিন্দুসমাজের প্রচলিত জাতিবিন্যাসকে নথিভুক্ত করে জাতিগত ক্রমোচ্চতাকে স্থায়ী করার চেষ্টা করা হয়। ফলে সেই সময়ের অস্পৃশ্য বা দলিতরা সংঘবদ্ধ হয়ে জাতিগত উন্নয়নের কথা ভাবতে শুরু করে।
শিক্ষার প্রসার – উনিশ শতকের শেষদিকে খ্রিস্টান মিশনারি ও সরকারি উদ্যোগে শিক্ষার বিস্তার ঘটলে দলিতদের কেউ কেউ শিক্ষিত হয় এবং নিজ শ্রেণির সংঘবদ্ধতার বিষয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
দেশীয় রাজ্যগুলির উদ্যোগ – উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে মহীশূর ও কোলহাপুর – এর মতো দেশীয় রাজ্যগুলি অব্রাম্মণ অস্পৃশ্য মানুষের উন্নতির জন্য সরকারি চাকরিক্ষেত্রে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ প্রথা চালু করে। এভাবে দলিত সম্প্রদায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
মূল্যায়ণ – উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে দলিতরা সংঘবদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে এবং বিশ শতকের প্রথমে নিজেদের জন্য আর্থসামাজিক অধিকারসহ রাজনৈতিক অধিকার দাবি করে। প্রথমে মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার (১৯১৯ খ্রি.) এবং পরে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ও পুনা চুক্তির (১৯৩২ খ্রি.) মাধ্যমে দলিত সম্প্রদায় রাজনৈতিক অধিকার লাভ করে।
দলিত শ্রেণির উন্নয়নের জন্য শ্রী নারায়ণ গুরুর অবদান ব্যাখ্যা করো। দলিতদের মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত আন্দোলনকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?
প্রথম অংশ – দলিত শ্রেণির সংহতিসাধন ও উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক পর্বে যেসমস্ত ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। শ্রী নারায়ণ গুরু (১৮৫৬-১৯২৮ খ্রি.)। তিনি কেরালার এজাভা নামক দলিত পরিবারের সন্তান ছিলেন।
শ্রী নারায়ণ গুরুর অবদান – শ্রী নারায়ণ গুরুর সংস্কারগুলি হল —
আত্মবোধ প্রতিষ্ঠা – কেরালার এজাভা শ্রেণি-সহ অন্যান্য অস্পৃশ্যদের মধ্যে আত্মমর্যাদা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সকলশ্রেণির মানুষের জন্য তিনি ৬০টির বেশি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সকল জাতি ও ধর্মের মানুষের জন্য এই মন্দিরগুলির দরজা খোলা ছিল।
শিক্ষার ওপর গুরুত্বদান – শ্রী নারায়ণ গুরু এজাভা সম্প্রদায়ের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এ ছাড়া তিনি উচ্চবর্ণের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি গ্রহণের মাধ্যমে এজাভাদের সংস্কৃতিকে উন্নত করার ব্যবস্থা করেন।
ভাইকম সত্যাগ্রহ – দক্ষিণ ভারতের ত্রিবাঙ্কুরের ভাইকমে একটি মন্দিরের চারদিকে রাস্তা থাকলেও এজাভা, পুলায়া প্রভৃতি দলিতদের এই মন্দিরে প্রবেশাধিকার বা মন্দিরের রাস্তায় হাঁটার অধিকার ছিল না। তাই শ্রী নারায়ণ গুরু ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এই রাস্তা দলিত-সহ সাধারণ মানুষের ব্যবহার করার দাবিতে আন্দোলন করেন, যা ভাইকম সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় অংশ – দক্ষিণ ভারতের কেরালায়-এজাভা, পুলায়া প্রভৃতি নিম্নবর্ণের হিন্দু তথা দলিতরা হিন্দু-মন্দিরে প্রবেশ করতে পারত না বা মন্দির সংলগ্ন পথে যাতায়াতের অধিকার পেত না। দলিতদের প্রতি এই অসাম্য ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে শ্রী নারায়ণ গুরু, এন. কুমারন আসান এবং টি. কে. মাধবন বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এভাবে গড়ে ওঠে মন্দিরে প্রবেশাধিকার আন্দোলন।
ভাইকম সত্যাগ্রহ – ভাইকম মন্দিরে প্রবেশ ও মন্দির সংলগ্ন রাস্তায় দলিতদের প্রবেশাধিকারের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে উঠলেও (মার্চ, ১৯২৪ খ্রি.) বর্ণহিন্দুদের তীব্র বিরোধিতায় তা সফল হয়নি। ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজার মৃত্যুর পর সেখানের মহারানির কাছে উদারপন্থী বেশ কিছু বর্ণহিন্দু আবেদন করেন। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। শেষপর্যন্ত মহাত্মা গান্ধি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চে ত্রিবাঙ্কুরের মহারানি ও রাজকর্মচারীদের সঙ্গে আপসরফার মাধ্যমে মন্দিরের চারপাশের রাস্তায় দলিতদের ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয়। এভাবে ভাইকম সত্যাগ্রহ আংশিক সফল হয়।
গুরুবায়ুর মন্দিরে সত্যাগ্রহ – কেরালার গুরুবায়ুর মন্দিরে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকারের দাবিতে সুব্রষ্মনিয়ান তিরুমান্নুরের নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ শুরু হয় (২১ অক্টোবর, ১৯৩১ খ্রি.)। অন্যদিকে এই মন্দিরে নিম্নবর্গদের প্রবেশাধিকার আটকাতে মন্দিরের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়। মন্দির কর্তৃপক্ষ ও গোঁড়া হিন্দুরা সত্যাগ্রহী নেতা পি. কৃষ্ণ পিল্লাই এবং এ. কে. গোপালনকে মারধরও করে। তা সত্ত্বেও গোপালন আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলেন।
এভাবে ভাইকম সত্যাগ্রহ ও গুরুবায়ুর সত্যাগ্রহ প্রাথমিক পর্বে সফল হয়নি। অবশেষে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা সরকার নিয়ন্ত্রিত সব মন্দিরগুলিতে সমস্ত হিন্দুদের জন্য প্রবেশাধিকার প্রদান করেন। পরের দুই বছরের মধ্যে কংগ্রেস শাসিত অন্যান্য প্রদেশগুলিতে অবস্থিত মন্দিরগুলিতেও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়।
আম্বেদকরের নেতৃত্বে দলিত আন্দোলন কীভাবে সংগঠিত হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করো।
ভূমিকা – ভারতে দলিত আন্দোলনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ড. বাবাসাহেব ভীমরাও রামজী আম্বেদকর (১৮২৯-১৯৫৬ খ্রি.) বা সংক্ষেপে বি. আর. আম্বেদকর। তিনি উনিশ শতকের শেষার্ধে দলিতদের মধ্যে গড়ে ওঠা সংহতিকে বিশ শতকে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করেন।
আম্বেদকর ও দলিত আন্দোলন – আম্বেদকর নিজে একজন দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত হন –
হিতকারিণী সভা প্রতিষ্ঠা – আম্বেদকর তাঁর অনুগামীদের নিয়ে গঠন করেন ‘বহিষ্কৃত হিতকারিণী সভা’ (১৯২৪ খ্রি.)। হিন্দুসমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন বা বহিষ্কৃত অস্পৃশ্যদের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে রক্ষা করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।
নিপীড়িত শ্রেণির সম্মেলন – ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির নেতাদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন দলিতদের আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে। ড. আম্বেদকর এই সমিতির সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। অচিরেই তিনি সমিতি থেকে ইস্তফা দেন।
মনুস্মৃতি দাহ – ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর সর্বসাধারণের ব্যবহার্য পুকুর থেকে দলিতদের জল তোলার অধিকার নিয়ে বিরাট সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে ‘মনুস্মৃতি গ্রন্থ’ পুড়িয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে আঘাত হানেন।
সংগঠন প্রতিষ্ঠা – ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস গঠন করেন। প্রতিষ্ঠানের উদবোধনী ভাষণে আম্বেদকর সরাসরি কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে দলিত আন্দোলন আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে।
পুনা চুক্তি – সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতিতে দলিতদের পৃথক নির্বাচন বিধি স্বীকৃতি পেলেও গান্ধিজির অনশনের কারণে তা বাধা পায়। শেষপর্যন্ত আম্বেদকর গান্ধির সঙ্গে পুনা চুক্তি (১৯৩২ খ্রি.) সম্পাদনের মাধ্যমে দলিতদের রাজনৈতিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করেও স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট হন।
সংস্থা গঠন – গান্ধির সঙ্গে পুনা চুক্তির পরেও দলিতদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই আম্বেদকর অনুন্নত, অস্পৃশ্য দলিতদের স্বার্থরক্ষার জন্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি’ গঠন করেন। আবার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সর্বভারতীয় তপশিলি সম্প্রদায় ফেডারেশন (AISCF) গঠন করে দলিতদের মধ্যে সর্বভারতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।
শিক্ষা প্রসার – আম্বেদকর দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের কথা প্রচার করেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘পিপলস এডুকেশন সোসাইটি’ গঠন করে দলিতদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে সচেষ্ট হন।
উপসংহার – এভাবে বি. আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে দলিতদের উন্নতির জন্য আন্দোলন প্রচেষ্টা জাতীয় কংগ্রেসের কাছে গুরুত্বলাভ করে। তাই স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই কংগ্রেস দলিত আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিতে সচেষ্ট হয় এবং এ কারণেই আম্বেদকরকে সংবিধান খসড়া রচনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আম্বেদকরের নেতৃত্বে রচিত ভারতীয় সংবিধানে অস্পৃশ্যতাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় এবং দলিতদের জন্য সরকার ১২ শতাংশ সংরক্ষণ করে।
বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ ব্যাখ্যা করো।
ভূমিকা – উনিশ শতকে ভারতে দলিত সম্প্রদায় যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনের চেষ্টা শুর করেছিল, সেগুলির মধ্যে বাংলার নমঃশূদ্র বা চণ্ডাল বা মতুয়া আন্দোলন ছিল উল্লেখযোগ্য। পূর্ববাংলার খুলনা, যশোহর, ফরিদপুর ও বরিশালের নমঃশূদ্র কৃষিজীবীদের এই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ১৮৭০-র দশকে এবং ভারতের স্বাধীনতার পরেও তা চলেছিল।
আন্দোলনের উদ্ভব – নমশূদ্র আন্দোলনের উদ্ভবের প্রেক্ষাপটে ছিল আর্থসামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কারণ।
অর্থনৈতিক কারণ – ঐতিহাসিক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, নমঃশূদ্র অধ্যুষিত এলাকায় উচ্চবর্ণের হিন্দু ও সৈয়দ মুসলমানদের হাতে জমির উপর একচেটিয়া অধিকার ছিল। অন্যদিকে নমঃশূদ্ররা ছিল প্রান্তিক কৃষিজীবী, ভূমিহীন কৃষক ও মজুর। এই পরিস্থিতিতেই নমঃশূদ্ররা অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য শিক্ষা ও চাকরির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল।
সামাজিক বৈষম্য – নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে সামাজিক দিক থেকে পতিত ও অদ্ভুত বলে মনে করা হত। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর-বাখরগঞ্জ অঞ্চলে একজন বিশিষ্ট নমঃশূদ্র গ্রামীণ নেতার মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যোগ দিতে অস্বীকার করলে নমঃশূদ্রদের আন্দোলনের সূচনা হয়।
ধর্মপ্রচারকের ভূমিকা – ধর্মপ্রচারক প্রভু জগবন্ধু ও হরিচাঁদ ঠাকুর নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে উদার মানবতাবাদী ধর্মীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর শিষ্যদের ‘মতুয়া’ নামে ডাকতেন। তিনি ব্রাহ্মণ জমিদার ও পুরোহিত শ্রেণির অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। নমঃশূদ্রদের মধ্যে আত্মমর্যাদা সৃষ্টি করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাই তিনি তাদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারে বিশেষ উদ্যোগী হন।
পৃথক সংগঠন প্রতিষ্ঠা – নমঃশূদ্ররা ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিজেদের জন্য পৃথক সংগঠন গড়ে তোলে। সংগঠনের মুখপত্র ছিল ‘পতাকা’ এবং এই পত্রিকায় নমঃশূদ্র নেতা রায়চরণ বিশ্বাস জাতি ব্যবস্থায় নিজেদের ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীভুক্ত বলে দাবি করেন।
আন্দোলনের বিকাশ – বিশ শতকে নমঃশূদ্র আন্দোলনের বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলি হল-
প্রতিনিধি দল প্রেরণ – ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে নমঃশূদ্রদের একটি প্রতিনিধি দল গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আস্থা প্রদর্শন করে তার স্থায়িত্ব কামনা করে। তাদের যুক্তি ছিল যে, ব্রিটিশ জনগণ কোনোরকম বর্ণভিত্তিক সামাজিক কাঠামোয় বিশ্বাসী নয়। তাই ব্রিটিশরাই তাদের সামাজিক বৈষম্যের হাত থেকে মুক্ত করতে পারবে।
নমঃশূদ্র নামের স্বীকৃতি – নমঃশূদ্রদের মধ্যে সামাজিক সংহতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও নমঃশূদ্ররা ঐক্যবদ্ধ হতে সচেষ্ট হয়। হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষ্যে প্রতি বছর ঠাকুর নগরে বারুণী মেলা আয়োজিত হয়। গুরুচাঁদ ঠাকুর চণ্ডালদের নাম পরিবর্তন করে নমঃশূদ্র রাখার দাবি জানান। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনায় এই দাবি স্বীকৃত হয়। পরবর্তীকালে বাংলার নমঃশূদ্রদের নিয়ে ভিন্ন মাত্রার রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।
সংগঠন স্থাপন – ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বেঙ্গল নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন’। প্রতিটি জেলায় এই সংগঠনের শাখা ছিল এবং এগুলির মাধ্যমে নমঃশূদ্র আন্দোলন পুরোপুরি সংগঠিত আকার নেয়। এর পাশাপাশি নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের সংস্কৃতি (যেমন—নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে দাবি, উপবীত ধারণ, এগারো দিন অশৌচ পালন, পরিবারে মহিলাদের বাজারে যাওয়া বন্ধ করা) অনুসরণ করে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হয়।
সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব দাবি – মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসনসংস্কারের প্রস্তাব ঘোষিত হলে নমঃশূদ্ররা ১৯১৭ ও ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে দুটি সম্মেলনের মাধ্যমে ‘সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের’ দাবি করে। এর ফলে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় অনুন্নত শ্রেণির একজন প্রতিনিধি মনোনয়নের নীতি স্বীকৃত হয়।
পর্যালোচনা – ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের সংস্কার আইনে নমঃশূদ্রদের দাবি পূরণ না হওয়ায় তারা ক্রমশই ব্রিটিশ সরকারপন্থী হয়ে দাবিপূরণে অগ্রসর হয়। তারা ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতিকে সমর্থন করে। অন্যদিকে তারা জাতীয় আন্দোলনের বিরোধিতা করে, কারণ তাঁদের মতে, জাতীয় আন্দোলন ছিল উঁচুজাতের হিন্দু ভদ্রলোকদের আন্দোলন।
বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলনগুলি ভারতীয় সমাজের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই আন্দোলনগুলি নারীদের অধিকার, শিক্ষার উন্নতি, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রচার এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করেছিল। এই আন্দোলনগুলি ভারতীয় সমাজের রূপান্তরের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।