আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের প্রথম অধ্যায় “ইতিহাসের ধারণা” এর থেকে “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” শেয়ার করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

খাদ্যাভাসের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
খাদ্যাভাসের ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চা।
খাদ্যাভাসের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য –
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
- রুচি ও সামর্থ্য – মানুষের রুচি ও সামর্থ্য, আবহাওয়া ও জলবায়ু, ধর্মীয় রীতি ও বিধিনিষেধ কিভাবে মানুষের খাদ্যগ্রহণ ও খাদ্যাভাস গড়ে তোলে তা চিহ্নিত করা।
- খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণ – এশিয়া-আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিষ্ঠা হয়। ফলে শাসক ও শাসিত উভয়েরই খাদ্যাভ্যাসে কীভাবে পরিবর্তন এসেছিল তা চিহ্নিত করা।
- খাদ্যগ্রহণ ও বর্জন – স্বাধীন মানুষেরা কেন ও কিভাবে খাদ্য গ্রহণ-বর্জন করে তা তুলে ধরা এই ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আবার ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্ত শাসিত ও শাসকদের খাদ্যগ্রহণ ও বর্জনকে তুলে ধরা এই ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়।
- খাদ্যাভ্যাস ও জাতীয়তাবাদ – উপনিবেশের জনগণ দেশজ খাদ্যাভ্যাস সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে কিভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তা ব্যাখ্যা করাও হল এই ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য।
খাদ্যাভাসের ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী খাবার সংক্রান্ত ইতিহাসও ফুটে ওঠে। পাশাপাশি হাজার হাজার বছরের খাবার প্রক্রিয়াকরণ ও হারিয়ে যাওয়া খাবারের রন্ধন প্রণালীও তুলে ধরা হয়েছে। খাদ্যাভ্যাস সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে কিভাবে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাও উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে।
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার মূল বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি দিক হল পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস। সভ্যতার বিকাশ ও বিবর্তনের সঙ্গে এই ইতিহাস খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য –
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল —
- উদ্ভব ও বিবর্তন – পোশাক-পরিচ্ছদের উদ্ভব ও তার বিবর্তনকে চিহ্নিত করে মানব সভ্যতার বিকাশে তার গুরুত্বকে তুলে ধরা। পোশাক কিভাবে কর্তৃত্ব ও আভিজাত্যের মাপকাঠি হয়ে উঠেছিল তা ব্যাখ্যা করা হল।
- পোশাকের ভিন্নতা – এই ইতিহাসচর্চায় শিল্প-বিপ্লবের পূর্বের এবং শিল্পবিপ্লব ও শিল্পবিপ্লবের উত্তর পর্বের পোশাকের ধরণ ও বিন্যাসকে চিহ্নিত করা হয়। সমাজের অভিজাত ও সাধারণ মানুষের পোশাকের ভিন্নতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করাও এই ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
- স্বাস্থ্যবিধি – অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে ইউরোপে বিশেষত ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে নারী পোশাকের আঁটো সাটো ধরণ ও বাহুল্যতা ক্রমশই নারীদের শারীরিক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই স্বাস্থ্যসম্মত পোশাকের উদ্ভব ও তার বিবর্তনকে চিহ্নিত করাও এই ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
- রাজনৈতিক তাৎপর্য – আধুনিক বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসনপর্বে পাশ্চাত্য পোশাক কিভাবে উপনিবেশগুলিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তার কারণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি দেশজ পোশাক সংস্কৃতি কিভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সংহতি দান করে তা খুঁজে দেখাও এই ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
এভাবে দেখা যায় পোষাক ইতিহাসের সঙ্গে সমাজ-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ইতিহাসও যুক্ত ছিল। তাই পোষাক ইতিহাসচর্চার ইতিহাস সামগ্রিক ইতিহাসে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
যানবাহন-যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।
যানবাহন-যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি দিক হল যানবাহন যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস। 1960-1970 -এর দশকে এই ধরনের ইতিহাসচর্চার সূচনা হয়।
যানবাহন-যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য –
যানবাহন-যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যগুলি হল —

- পরিধি – চাকার আবিষ্কারের মাধ্যমে সূচনা হয়েছিল যানবাহন-যোগাযোগের ব্যবস্থার ইতিহাস। যানবাহন মূলত তিন ধরনের যথা — জল, স্থল ও আকাশপথের যানবাহন। অন্যদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, চিঠিপত্র, রেডিয়ো, টিভি, ফ্যাক্স, মোবাইল ফোন প্রভৃতি।
- উদ্ভব ও উন্নতি – এই ইতিহাসচর্চায় যানবাহনের উদ্ভব ও তার বিবর্তন এবং যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ধরনকে চিহ্নিত করা হয়। এর পাশাপাশি যানবাহনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সমসাময়িক সমাজের পাথর্ক্য ও অগ্রগতি চিহ্নিত করাও এই ইতিহাসচর্চার অন্যতম উদ্দেশ্য।
- প্রাযুক্তিক উন্নতি – যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মূলে থাকে প্রাযুক্তিক উন্নতি। তাই যানবাহনের প্রাযুক্তিক উন্নতি ও তার অগ্রগতিকে খুঁজে বের করাও এই ইতিহাসচর্চার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
- প্রভাব – যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভাবকে চিহ্নিত করা এই ইতিহাসের অন্যতম দিক। বাণিজ্য, যাতায়াত, অভিপ্রয়াণ, সাম্রাজ্যবাদের প্রসার, নগরায়ণ ও পরিবেশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভাবকে চিহ্নিত করাও এই ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
যানবাহন-যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের জীবনকে যেমন সহজ করে তুলেছে, যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস একটি রাষ্ট্রে সংহতি ও জাতীয়তাবাদও যেমন সৃষ্টি করে তেমনি তা আন্তর্জাতিকতাবাদের বিকাশেও সাহায্য করে।
দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস ও তার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।
দৃশ্য শিল্পের ইতিহাসের ভূমিকা –
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি দিক হল দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস এবং এর অন্তর্গত হল ছবি আঁকা ও ফটোগ্রাফি।
দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস –
মানুষ যখন তার ভাবাবেগ বা ভাবধারা প্রকাশের জন্য রং ও তুলির মাধ্যমে কোনো দৃশ্য ধরণ নির্মাণ করে তখন তা ছবি আঁকা বলে পরিগণিত হয়। অন্যদিকে ক্যামেরাম্যানের দ্বারা যখন কোনো বাস্তব জিনিসের ছবি তোলা হয় এবং অবিকল প্রতিকৃতি পাওয়া যায় তখন তা ফটোগ্রাফি নামে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব 4000 অব্দ থেকেই গুহাচিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে ছবি আঁকার সূচনা হয় এবং 1839 খ্রিস্টাব্দ থেকে বাণিজ্যিকভাবে ফাটোগ্রাফির সূচনা হয়।

দৃশ্য শিল্পের ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য –
দৃশ্য শিল্পের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে দেখা যায় যে –
- উদ্ভব ও বিবর্তন – ছবি আঁকা ও ফটোগ্রাফির উদ্ভব এবং তার যুগ নির্ধারণ ও শ্রেণিবিভক্তিকরণের মাধ্যমে দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস গড়ে ওঠে। এর মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতি বা পরিবেশের সম্পর্ককে চিহ্নিত করা যায়।
- সংস্কৃতিতে প্রভাব – দৃশ্যশিল্প মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতিতে কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল তা চিহ্নিত করা এই ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- পৃষ্ঠপোষকতা – দৃশ্য শিল্পের ইতিহাসে শিল্পী বা ক্যামেরাম্যানদের অভিজ্ঞতা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের ইতিহাস অন্বেষণ করাও ওই ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য।
স্থাপত্য ইতিহাস বলতে কী বোঝায়?
স্থাপত্য ইতিহাস নির্মাণ –
স্থাপত্যগুলির মাধ্যমে অতীত ও ইতিহাস যুক্ত থাকে। তাই স্থাপত্যগুলির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস রচনায় এগুলির ভূমিকা তুলে ধরা হয়।
স্থাপত্যরীতি –
সব স্থাপত্য একইরকম দেখতে হয় না। প্রতিটির নির্মাণরীতিও পৃথক। তাই স্থাপত্যরীতির অন্বেষণ, বিবর্তন ও তার ধারাবাহিকতা তুলে ধরাও এই ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে ইউরোপের স্থাপত্যে ডোরীয় রীতি, গথিক রীতি, রোমান ও ভিক্টোরীয় রীতির কথা বলা যায়।
স্থাপত্য ইতিহাসের জাতীয় গর্ব –
বিভিন্ন দেশের সেরা স্থাপত্যগুলি সেই দেশের জাতীয় গর্ব এবং মর্যাদাবৃদ্ধিকারী বিষয়। তাই কিভাবে তা দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করে বা জাতীয় আন্দোলনে উৎসাহের সঞ্চার করে তা তুলে ধরাও এই ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য
স্থাপত্য ইতিহাসের উপসংহার –
এভাবে দেখা যায় যে, স্থাপত্য ইতিহাসচর্চার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ইতিহাসও জড়িয়ে থাকে। তাই স্থাপত্য ইতিহাস সামগ্রিক ইতিহাসের একটি বিশেষ অংশ।
স্থানীয়-ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করো।
স্থানীয়-ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বিশেষ দিক হল স্থানীয় ইতিহাস। তবে স্থানীয় ইতিহাস বলতে বোঝায় ভৌগোলিকভাবে স্থানীয় প্রেক্ষিতে স্থানীয় সম্প্রদায় বা ব্যক্তি বা বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইতিহাস।
স্থানীয়-ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন দিক –
স্থানীয় ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন দিককে এভাবে চিহ্নিত করা যায়, –
- স্থানীয় বিষয় – এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় দেশ বা ব্যাপক এলাকার পরিবর্তে ক্ষুদ্র এলাকাকে চিহ্নিত করে সেই স্থানের ইতিহাস অন্বেষণ করা হয়। এভাবে স্থানীয় ইতিহাসসমূহের সমন্বয়ে দেশের ইতিহাস গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয
- যৌগিক পরস্পরা – স্থানীয় জনশ্রুতি, মিথ বা অতিকথা, মৌখিক পরম্পরাকে ভিত্তি করে স্থানীয় ইতিহাস রচনা করা হয়। কারণ অনেকক্ষেত্রেই স্থানীয় ইতিহাস অলিখিত থাকে এবং এজন্যই মৌখিক পরম্পরার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
- স্থানীয় ইতিহাসের চর্চা – উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর বা শহরের ইতিহাস রচনার মাধ্যমে স্থানীয় ইতিহাস রচনা শুরু হয়। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াতেও এই ধরনের ইতিহাস রচনা শুরু হয়।
- সমাজের ক্ষুদ্র ইতিহাস – স্থানীয় ইতিহাস রচনাকালে স্থানীয় সমাজের ক্ষুদ্র সম্প্রদায় বা ব্যক্তি বা পরিবারের ইতিহাসকে তুলে ধরে এলাকার গুরুত্ব চিহ্নিত করা হয়। তাই এই ইতিহাস হল বৃহত্তর সমাজের ক্ষুদ্র ইতিহাস।
নারী ইতিহাসের চর্চার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
নারী ইতিহাসের চর্চার ভূমিকা –
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি আলোড়নকারী ইতিহাসচর্চা হল নারী – ইতিহাসচর্চা। প্রচলিত ইতিহাসে নারীর ভূমিকা বা অধিকারের যথাযথ মূল্যায়নের প্রয়োজনে নারীর গুরুত্বকে তুলে ধরে শুরু হওয়া ইতিহাসচর্চাই হল নারী ইতিহাসচর্চা।
নারী ইতিহাসের চর্চার বৈশিষ্ট্যসমূহ –
নারী ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
- পুরুষকেন্দ্রিক ইতিহাস সংশোধন – সভ্যতার ইতিহাসে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পুরুষ ঐতিহাসিকরা যুদ্ধ, প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে পুরুষদের ভূমিকাকে বা অবদানকে বেশি করে চিহ্নিত করেছেন। নারীরা উপেক্ষিত হয়েছে। তাই উপেক্ষিত নারীদের ইতিহাস উদ্ধারের জন্য ইতিহাসকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করাই হল এই ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
- অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠা – এই ইতিহাসচর্চার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল — নারীর অধিকার এবং নারী-পুরুষ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রথম লেখালেখি করেন ইংল্যান্ডের মেরী ওলস্টনস্ক্রাফট।
- নারীর অংশগ্রহণ – নারী ইতিহাসের বিশিষ্ট দিক হল বিভিন্ন সামাজিক প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ, নারী পোশাক, কর্মসংস্থান, ধর্মকর্ম, গার্হস্থ্য ও শিল্পোৎপাদন কর্মের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে চিহ্নিত করা।
- সভ্যতার অগ্রগতির মাপকাঠি – কোনো দেশের সভ্যতা ও সমাজে নারীর অবস্থান ও মর্যাদার উপর সেই সভ্যতা কতটা আধুনিক তা প্রমাণ করে। তাই নারী ইতিহাস হয়ে উঠেছে সভ্যতার অগ্রগতির মাপকাঠি।
নারী ইতিহাসের চর্চার উপসংহার –
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, নারী ইতিহাসচর্চা হল এক ধরনের সংশোধনবাদী ইতিহাসচর্চা। তবে এই ইতিহাসচর্চার ফলে ইতিহাস বিকৃতির সম্ভাবনা ও রয়েছে।
ইতিহাস বলতে কী বোঝো?
অথবা, ইতিহাসের বিভিন্ন সংজ্ঞা দাও।
অথবা, ইতিহাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা এবং সমাজবিজ্ঞানীরা কী বলেছেন?
মানবসভ্যতার ইতিহাস এক অন্তহীন, বিবর্তনধর্মী বিচিত্র প্রক্রিয়া। পরিবেশ সম্পর্কিত ইতিহাসের দুটি প্রধান বিষয় হল মানুষের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি। আবহমানকাল থেকে যতই সময় এগিয়েছে ততই বেড়েছে মানবসভ্যতার বৈচিত্র্য। এর ফলে ইতিহাসও হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ।
ইতিহাস-ব্যুৎপত্তিগত অর্থ
ইতিহাস -এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হল History, যার উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ Historia এবং ল্যাটিন শব্দ Histore থেকে। গ্রিক Historia শব্দের অর্থ যত্নসহকারে অনুসন্ধান এবং ল্যাটিন Histore শব্দের অর্থ জ্ঞান। এই দুই শব্দের ভিত্তিতে বলা যায় ইতিহাস হল অতীতের ঘটনাসমূহের সযত্ন অনুসন্ধানের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা এবং ইতিহাসের উদ্দেশ্য হল সেই জ্ঞানের আলোয় ভবিষ্যৎ মানবসভ্যতাকে দিশা দেখানো।
ইতিহাসের সংজ্ঞা –
ইতিহাসের সংজ্ঞা নিয়ে ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা মতামত রয়েছে। যেমন –
- ইতিহাসের জনক রূপে পরিগণিত গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের মতে, ‘ইতিহাস হল দর্শনের এক শাখা।’
- গ্রিক দার্শনিক ডায়োনিসাস বলেছেন, ‘ইতিহাস হল অনুসন্ধান, গভীরভাবে কোনো কিছুর অন্বেষণ।’
- ফ্রান্সিস বেকন -এর মতে, ইতিহাস এমন এক বিষয়, ‘যা মানুষকে জ্ঞানী করে তোলে।’
- জে বি বিউরি -এর মতে, ‘ইতিহাস হল বিজ্ঞান, কমও নয়, বেশিও নয়।’
- লর্ড অ্যাকটন -এর মতে, ‘ইতিহাস মানবমুক্তির ক্রমবিকাশের কাহিনি।’
- মার্ক ব্লখ -এর মতে, ‘History is the science of men in time.’
- হেনরি পিরেন -এর মত হল – ‘আমি ঐতিহাসিক, ইতিহাসে জীবনের সন্ধান করি, জীবনকে ভালোবাসি।’
- ই এইচ কার -এর মতে, ‘ইতিহাস হল অতীত ও বর্তমানের মধ্যে অন্তহীন কথোপকথন।’
- ফ্রেডারিখ ভন শ্লেজেল -এর মতে, ইতিহাস হল বিপরীতমুখী ভবিষ্যদবাণী’ এবং ‘ইতিহাসবিদ হলেন বিপরীতমুখী ভবিষ্যদবক্তা।’
- লাইবনিজ -এর কাছে ‘ইতিহাস হল ধর্মের প্রকৃত প্রকাশ।’
- মাইকেল ওকশট বলেছেন, ‘ইতিহাস হল ইতিহাসবিদদের অভিজ্ঞতা এবং তার পুনর্নির্মাণ করার একমাত্র উপায়।’
- আর জি কলিংউড -এর দৃষ্টিতে ‘ইতিহাস হল ইতিহাসবিদদের মনে অতীতের অভিজ্ঞতার পুনরুজ্জীবন ও পুনরাভিনয়।’
- জেমস ও কোনর -এর মতে, ‘ইতিহাস হল কুশলী কাহিনিকাররূপী ইতিহাসবিদদের দ্বারা নির্মিত বিভিন্ন আখ্যানের বিবরণী।’

এই সকল ইতিহাসবিদদের মতামতের উপর ভিত্তি করে বলা যায়, ইতিহাস হল মানবজীবনের তথ্যনির্ভর আখ্যান, মানুষের আর্থসামাজিক ও বহুমাত্রিক জীবনের এক চলমান ছবি।
ইতিহাসচর্চা (Historiography) কী?
ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
ইতিহাস হলো মানুষের কাহিনি – মানুষের এগিয়ে চলার কাহিনি, জয়যাত্রার কাহিনি। এই কাহিনির ব্যাখ্যা ও গবেষণা করেন ঐতিহাসিকেরা। ঐতিহাসিকদের এই কাজকে বলে ইতিহাসচর্চা (Historiography)।
ইতিহাসচর্চা – ইতিহাসচর্চা গড়ে ওঠে –
- ইতিহাসের বিষয়বস্তু এবং
- লিখনপদ্ধতি বা রচনাশৈলী নিয়ে।
ইতিহাসের বিষয়বস্তু –
আদিতে রাজাদের কাহিনি অর্থাৎ রাজাদের সিংহাসনলাভ, রাজ্যজয়, সন্ধিচুক্তি, যুদ্ধের হানাহানি আর গৌরব মহিমা নিয়ে ইতিহাস আবর্তিত হত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপের নবজাগরণ, যুক্তিবাদী মানসিকতা ইতিহাসচর্চায় প্রতিফলিত হয়। ইতিহাসচিন্তা ও বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটে। সাধারণ মানুষের কথা, সমাজের কথা, সভ্যতা-সংস্কৃতির কথা, আর্থিক অবস্থার কথা ইতিহাসের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। ধর্ম এতকাল ইতিহাসের প্রধান উপাদান ছিল। এখন ধর্মীয় বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ইতিহাস ধর্মনিরপেক্ষ ও সামাজিক উপাদানের ঘাতপ্রতিঘাতের ব্যাখ্যা হয়ে ওঠে।
ইতিহাসের লিখনপদ্ধতি –
ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে একটি নতুন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, ইতিহাসের বিষয়বস্তু লেখা হবে কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা বহু দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। জার্মান ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ভন র্যাঙ্কে –এর মতো ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, ইতিহাসের বিষয়বস্তু হবে বস্তুভিত্তিক। তাঁরা ইতিহাসকে বিজ্ঞান বলেছেন। এই মতের সমর্থক বিউরি বলেছেন, ইতিহাস হলো বিজ্ঞান। বার্কলে ইতিহাস ও বিজ্ঞানকে একই বিষয় বলেছেন। অন্য দলের মতে, বিষয়বস্তু লেখা হবে তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। লর্ড অ্যাকটন বলেছেন, তথ্যের বিশ্লেষণ না করে ইতিহাস লেখার মূল্য নেই। আবার কেউ কেউ বিজ্ঞানের সূত্র অনুকরণে ইতিহাসের সূত্র ধরে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যার কথা বলেছেন।
ইতিহাসের মূল্যায়ন –
ইতিহাসচর্চার উপরোক্ত এই ধারণাটি বর্তমানকালের। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে যে সামাজিক যুগান্তর ঘটে, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে তার ব্যাখ্যা করেন। ফলে ইতিহাসচর্চায় নানান প্রকারভেদের জন্ম হয়েছে।
বিষয় ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী আধুনিক ইতিহাসচর্চায় যে উল্লেখযোগ্য প্রভেদগুলি দেখা যায়, তা উল্লেখ করো।
অথবা, বিভিন্ন ইতিহাসচর্চা গোষ্ঠীগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
ইতিহাসচর্চায় প্রকারভেদ –
ইতিহাস পড়ার সময় দেখা যায় একই ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্নভাবে করেছেন। এর কারণ, একই ঘটনাকে তারা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন। দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকদের ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ করার একটি রেওয়াজ আছে। একই ঘটনার এই ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাসের তুলনামূলক চর্চাকে আমরা হিস্টোরিওগ্রাফি বা ইতিহাসচর্চা বলে চিহ্নিত করি। এর উল্লেখযোগ্য বিভাগগুলি হল –
- জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চা – স্বদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে ইতিহাসচর্চা করেন জাতীয়তাবাদী (Nationalist) ইতিহাসবিদরা। রমেশচন্দ্র মজুমদার, তারাচাঁদ, যদুনাথ সরকার, অমলেশ ত্রিপাঠী প্রমুখ বহু ঐতিহাসিকই মনে করেছেন ঔপনিবেশিক আমলে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আদর্শের দ্বন্দ্বই ছিল ওই সময়কার ইতিহাসের প্রধান চালিকাশক্তি।
- সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসচর্চা – জেমস মিল, ভিনসেন্ট স্মিথ বা ভ্যালেন্টাইন চিরল -এর মতো সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকেরা ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী নীতির সমর্থক ছিলেন। শুধু তাই নয়, তারা মনে করেছেন এই সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি উপনিবেশের পক্ষে মঙ্গলজনক ছিল।
- কেমব্রিজ গোষ্ঠীর ইতিহাসচর্চা – কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার লিউইস নেমিয়ারের ইতিহাস দর্শনে বিশ্বাসী ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে অবজ্ঞা করে যারা মূলত ইতিহাসচর্চা করেন, তাদের কেমব্রিজ গোষ্ঠীর (Cambridge School) ইতিহাসবিদ বলা হয়। এরা হলেন জন গ্যালাহার, গর্ডন জনসন, অনিল শীল, ফ্রান্সিস রবিনসন, ক্রিস বেইলি প্রমুখ।
- মার্কসবাদী ইতিহাসচর্চা – বিখ্যাত ইন্ডিয়া টুডে (India Today) গ্রন্থের লেখক রজনীপাম দত্ত থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের বিপানচন্দ্র বা সুমিত সরকারের মতো ঐতিহাসিক মার্কসবাদী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। মার্কসীয় তত্ত্বে বিশ্বাসী এই গোষ্ঠী মনে করেন, সাম্রাজ্যবাদ বনাম জাতীয়তাবাদ নয়, ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি শোষক বনাম শোষিতের দ্বন্দ্ব। তাদের মতে, ঔপনিবেশিক আমলে ভারতীয় ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি ছিল দেশি এবং বিদেশি শোষকদের সঙ্গে ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষকদের দ্বন্দ্ব।
- নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা – নিম্নবর্গীয় গোষ্ঠীর প্রধান মুখপত্র সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ (Subaltern Studies) -এর প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় সম্পাদক রণজিৎ গুহ মন্তব্য করেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমস্ত আলোচকেরাই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে ইতিহাসের প্রধান চালিকাশক্তি বলে মনে করেছেন। এটি একটি উচ্চবর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু নিম্নবর্গীয় ক্ষমতাহীন মানুষের রাজনীতির নিজস্ব একটি সমান্তরাল ধারা রয়েছে। এই ধারাটিকে তারা ইতিহাসের মূল স্রোতের অঙ্গীভূত করতে চান। রণজিৎ গুহ ছাড়াও যে-সমস্ত ঐতিহাসিক প্রথম থেকেই নিম্নবর্গীয় ইতিহাসচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা হলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শাহিদ আমিন, গৌতম ভদ্র, দীপেশ চক্রবর্তী প্রমুখ।
- যুক্তিবাদী ইতিহাসচর্চা – ইতিহাসে সর্বতোভাবে বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা প্রয়োগের পক্ষপাতীদের বলা হয় যুক্তিবাদী বা প্রত্যক্ষবাদী ইতিহাস গোষ্ঠী (Positivist School)। এদের মধ্যে বিখ্যাত ঐতিহাসিকরা হলেন বিউরি, বেনেদিতো ক্রোস, বার্কলে, লাইবনিজ প্রমুখ।
- উত্তর-আধুনিক ইতিহাসচর্চা – আধুনিক যুগ পার হয়ে, বর্তমানের একমেরু বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জীবন-জগৎ, সংসার-সংস্কৃতি সবই অনিত্য এবং নিয়ত পরিবর্তনশীলতার মধ্য দিয়ে ক্যালাইডোস্কোপের মতো সদাসর্বদা নতুন নতুন ‘ফর্ম’ সৃষ্টি করে চলেছে বলে যারা মনে করেন, সেই দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা পরিচিত হচ্ছেন উত্তর-আধুনিকতাবাদী গোষ্ঠী (Post-modernist School) নামে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা, কেতকী কুশারি ডাইসন প্রমুখ।
আধুনিক ইতিহাসচর্চা কীভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে?
ইতিহাস হল মানুষের কাহিনি, জীবনের আখ্যান। এই শব্দটির অর্থ অনুসন্ধান, গবেষণা ও আবিষ্কার। তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে সুদূর অতীত থেকে অদ্যাবধি মানবজাতির কার্যকলাপের লিখিত বৃত্তান্ত হল ইতিহাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মানবজাতির অতীতকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করার রেওয়াজ শুরু হয়েছে। আর তাই ইতিহাসচর্চা হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্য –
ইতিহাস বহমান, তাই নির্দিষ্ট স্থান ও কালের সীমানার মধ্যে ইতিহাসকে আবদ্ধ রাখা যায় না। এজন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক সর্বজনীন, বিশ্বজনীন ইতিহাসের কথা বলেছেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক আবার জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইতিহাসচর্চার পক্ষপাতী। সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতেও ইতিহাসের চর্চা লক্ষণীয়। আবার অনেকে অনুন্নত জাতিগোষ্ঠী বা নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের কারণসমূহ –
ইতিহাসচর্চায় বৈচিত্র্য এসেছে বিভিন্ন কারণে। এই কারণগুলি হল –
- ব্যক্তিগত প্রভাব – আগেকার দিনের রাজা-বাদশাহের মতো এ যুগেও ইতিহাসচর্চায় ব্যক্তিগত প্রভাব প্রাধান্য লাভ করে।
- উৎপাদন ব্যবস্থার প্রভাব – অতীতের দাস-মালিক, মধ্যযুগে ভূমিদাস-সামন্তপ্রভু, আধুনিক যুগে শিল্পশ্রমিক-শিল্পমালিক সম্পর্কের আলোচনা প্রাধান্য লাভ করে।
- উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী – বিভিন্ন দেশেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী লক্ষণীয়। তাদের বিক্ষোভ-বিদ্রোহ একশ্রেণির ঐতিহাসিককে ইতিহাসচর্চায় আগ্রহী করে তোলে।
- সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতা – অন্যকে দমন করে, অন্যের দেশ দখল করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতির ব্যাখ্যা দিতে কিছু ঐতিহাসিক ইতিহাসচর্চা করেন। এ ছাড়া জাতীয় স্বার্থ, নেতিবাচক মনোভাব কিছু ঐতিহাসিককে ইতিহাসচর্চায় উদ্বুদ্ধ করে। নানান ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা ঐতিহাসিকেরা বিভিন্নভাবে করে থাকেন। ব্যাখ্যার বিভিন্নতার জন্যই আধুনিক ইতিহাসচর্চা এত বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
অ্যানাল ইতিহাসচর্চা কী?
মার্কসের মতবাদে বিশ্বাসী অথচ অর্থনীতিকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে সমাজ-সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে যারা ইতিহাস রচনা করেন, তারা অ্যানাল গোষ্ঠীর (Annales School) ইতিহাসবিদ নামে পরিচিত। ফ্রান্সে Annales পত্রিকা ছিল এদের মুখপত্র। এদের নেতৃত্ব দেন মার্ক ব্লখ, জর্জ ব্রদেল, রয় লাদুরি প্রমুখ।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্য সম্পর্কে আলোচনা করো।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
স্থানকালের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজবদ্ধ মানুষের অগ্রগতির বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ হল ইতিহাস। আদিতে রাজা-মহারাজাদের কাহিনি, তাদের সিংহাসনলাভ, সন্ধিচুক্তি প্রভৃতি নিয়ে ইতিহাস আবর্তিত হত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এবং রেনেসাঁ উদ্ভূত মানবতাবাদের প্রভাবে আধুনিক ইতিহাসচর্চায় মানবসমাজ ও সভ্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া হতে থাকে। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতিকে গুরুত্ব প্রদানের ফলে আধুনিক ইতিহাসচর্চা ক্রমশ বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠতে থাকে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যসমূহ –
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্য সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল –
- নতুন সামাজিক ইতিহাস – সমাজের উঁচুতলার মানুষের পরিবর্তে সমাজের নীচুতলার মানুষের কথা ও কাহিনি যখন ইতিহাসের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে, তখন তা নতুন সামাজিক ইতিহাস নামে পরিচিত হয়। ভারতেও এই নিম্নবর্গের মানুষদের নিয়ে রণজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র প্রমুখ ঐতিহাসিকরা গবেষণা করেন।
- খেলার ইতিহাস – জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ খেলাগুলি ইতিহাসচর্চায় অন্যতম আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। 1980 -র দশকে ভারতে খেলার ইতিহাসচর্চার সূত্রপাত হয়। বোরিয়া মজুমদার, সৌমেন মিত্র, কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় খেলার ইতিহাস নিয়ে মূল্যবান চর্চা করেছেন।
- খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস – মানবসভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনও ইতিহাস আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্যাট চ্যাপম্যান, কে টি আচয়, চিত্রিতা ব্যানার্জির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
- শিল্পচর্চার ইতিহাস – সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্রের ইতিহাস হল শিল্পচর্চার ইতিহাসের অঙ্গীভূত। শিল্পের ইতিহাস বিশ্লেষণ করার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশবাদ প্রভৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক মিত্র, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ শিল্পের ইতিহাসচর্চায় বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
- নারীসমাজের ইতিহাস – অন্যান্য সামাজিক ইতিহাসের মতো নারী সমাজের ইতিহাসচর্চার বিষয়টি সাম্প্রতিককালে প্রাধান্য লাভ করেছে। আধুনিক ভারতে নারীসমাজের ক্ষমতায়ন, সামাজিক অবস্থান ও চিন্তা-চেতনার বিবর্তনকে নারীসমাজের ইতিহাস বলা হয়। নারীসমাজের ইতিহাসচর্চায় জেরাল্ডিন ফোবর্স, মালবিকা কার্লেকর, চিত্রা ঘোষ প্রমুখের নাম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
বিশ শতক থেকেই ইতিহাসচর্চায় বিভিন্ন বিষয় অঙ্গীভূত হয়ে তা এক সর্বব্যাপী চরিত্র ধারণ করেছে। নির্দিষ্টভাবে রাজরাজাদের ইতিহাসের গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ইতিহাসচর্চায় স্থান করে নিয়েছে। তাই বলা যায়, আধুনিক ইতিহাসচর্চা প্রতিনিয়ত বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠছে।
নতুন সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
অথবা, নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কেন?
নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
ইতিহাস বলতে আগে রাজা ও রাজবংশের কীর্তিকাহিনিকে বোঝাত। কিন্তু 1960 -এর দশক থেকে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এই সময় থেকে এক শ্রেণির ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, একটি রাজপরিবারের কাহিনি একটি দেশের প্রকৃত ইতিহাস হতে পারে না। ওই দেশের অসংখ্য জনসাধারণের কাহিনিই হল প্রকৃত ইতিহাস। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে ইউরোপে নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চা শুরু হয়। ভারতেও এই ধরনের নিম্নবর্গের ইতিহাস -এর আলোচনা শুরু হয়েছে। এতে জনসাধারণের প্রকৃত ইতিহাস পাওয়া যায় বলে নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার আলোচ্য বিষয় –
নতুন সামাজিক ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় হল –
- সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ থেকে অন্ত্যজ শ্রেণি-সহ সকলে এই শ্রেণির ইতিহাসচর্চার অন্তর্ভুক্ত।
- এই ইতিহাসে মানুষের সামাজিক অবস্থান, আচার-আচরণ, খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আলোচনা, মতামত-সহ সব বিষয় ইতিহাস রচনার উপাদানরূপে স্বীকৃত।
- এই ইতিহাসে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, মানসিকতা ও কার্যকলাপ বিশেষ গুরুত্ব পায়।
নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য –
নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য হল –
- অ্যানাল মতবাদ – মার্কসীয় মতবাদে বিশ্বাসী হয়েও অর্থনীতিকে গুরুত্ব না দিয়ে একদল ঐতিহাসিক সমাজ-সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে ইতিহাসচর্চা শুরু করেন। ফ্রান্সের অ্যানাল পত্রিকা তাদের মুখপত্র ছিল। মার্ক ব্লখ, রয় লাদুরি প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এদের ইতিহাসচর্চায় সামাজিক কাঠামো ও প্রক্রিয়ার উপর মূল গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেমন – বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি, আন্দোলন, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, পরিবার, শিক্ষা, সামাজিক গতিপ্রকৃতি প্রভৃতির ক্রিয়া ও গতির উপর আলোকপাত করা হয়।
- সাধারণ মানুষের কথা – সামাজিক অবস্থান, আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, শিক্ষা, বিনোদন, সভ্যতা-সংস্কৃতি – এইসব নিয়ে মানুষের সামাজিক জীবন গড়ে ওঠে। নয়া সামাজিক ইতিহাসচর্চায় এইসব বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কার্ল মার্কস -এর দ্য জার্মান ইডিওলজি (The German Ideology), জি এম ট্রেভেলিয়ন -এর ইংলিশ সোশ্যাল হিস্ট্রি, এ সার্ভে অফ সিক্স সেঞ্চুরিস : চসার টু কুইন ভিক্টোরিয়া (English Social History, A Survey of Six Centuries : Chaucer to Queen Victoria) প্রভৃতি গ্রন্থ সামাজিক ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
- নিম্নবর্গের কথা – সমাজে যারা অন্ত্যজ শ্রেণি হিসেবে পরিচিত, সেই নিম্নবর্গের মানুষদের বংশপরিচয়, বসতি বিস্তার, জীবনধারা, সংস্কৃতি, ক্ষোভ-বিক্ষোভ ইত্যাদি নিয়ে একদল ঐতিহাসিক গবেষণা করেন। রণজিৎ গুহ, শাহিদ আমিন, গৌতম ভদ্র হলেন এই শ্রেণির ঐতিহাসিক।
ভারতে নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চা –
1980 -র দশক থেকে ভারতের ইতিহাসচর্চায় সাব-অল্টার্ন বা নিম্নবর্গের মানুষদের আলোচনা গুরুত্ব পেয়েছে। এই ইতিহাস আলোচনায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বরা হলেন – রণজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শাহিদ আমিন, দীপেশ চক্রবর্তী, জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে প্রমুখ।
ভারতের নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চায় ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিম্নবর্গের মানুষের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। এই ইতিহাসচর্চায় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া সাধারণ ঘটনাকেও গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়।
নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার ফলে ইতিহাসের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্র ও জ্ঞান সম্প্রসারিত হয়েছে।
নতুন সামাজিক ইতিহাস কোন্ অর্থে মানুষের ইতিহাসে মানুষের পুনরাগমন?
নতুন সামাজিক ইতিহাসের ভূমিকা –
একসময় ইতিহাস বলতে বোঝাত রাজা-মহারাজাদের কাহিনি। পরে এই ধারণা বদলে যায়। সমাজের উঁচুতলার মানুষের পরিবর্তে সমাজের নীচুতলার মানুষের কথা ও কাহিনি ইতিহাসের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান থেকে শুরু করে বিনোদন ও রাজনীতি – এখন ইতিহাসচর্চার বিষয়বস্তু। তাই নতুন সামাজিক ইতিহাস ‘মানুষের ইতিহাসে মানুষের পুনরাগমন’ রূপে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে।
নতুন সামাজিক ইতিহাস –
একটি দেশ বা জাতির সামগ্রিক ইতিহাস বলতে বোঝায় তার রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজকে। এগুলির চালিকাশক্তি হল মানুষ ও সমাজ। 1960 -এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে গতানুগতিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে। শুরু হয় সামাজিক ইতিহাসচর্চা। এর বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে অতীতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক কাঠামোর বিশ্লেষণ এবং পরিবর্তন প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা।
মানুষের ইতিহাসে মানুষের প্রত্যাবর্তন –
- নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চায় নৃতত্ত্ব, সমাজবিদ্যা, নারীদের অবস্থা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, নাচ-গান, অন্যান্য বিনোদন প্রভৃতি বিষয় স্থান পায়।
- সমাজের নীচুতলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এই নতুন সামাজিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। ভারতেও এই ধরনের ইতিহাসচর্চা শুরু হয়। কৃষক, শ্রমিক, শহরের দরিদ্র মানুষ, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারা ও তাদের কার্যকলাপ এই ধরনের ইতিহাসচর্চার অন্তর্ভুক্ত হয়। অধ্যাপক রণজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র প্রমুখ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। এখানে প্রথাগত ইতিহাসে উপেক্ষিত, চিরকালের অবহেলিত সামাজিক শ্রেণিগুলি ইতিহাসের আলোতে উদ্ভাসিত হয়। এই শ্রেণির মানুষের ম্লান, বিবর্ণ মুখগুলি কিছু কথা বলে ওঠে।
- নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে অতি সাধারণ নথিপত্র ব্যবহার করা হয়। পারিবারিক ফোটো অ্যালবাম, ব্যক্তিগত ডায়ারি, লোকমুখে প্রচলিত কাহিনি প্রভৃতি উপাদানগুলি গুরুত্ব লাভ করে।
- নতুন সামাজিক ইতিহাস দেশ-কালের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই নতুন ইতিহাস মানুষের চলমানতার প্রতিচ্ছবি। যা দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে আর্থসামাজিক পটভূমি, জনসংখ্যাতত্ত্ব এবং মানসিক প্রবণতা ফুটিয়ে তোলে।
নতুন সামাজিক ইতিহাসের মন্তব্য –
এইভাবে নতুন সামাজিক ইতিহাস সাধারণ মানুষের জীবনকাহিনি তুলে ধরেছে। তাই নতুন সামাজিক ইতিহাস মানুষের ইতিহাস হয়ে উঠেছে, মানুষের ইতিহাসে মানুষের প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় খেলার ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, আধুনিক ইতিহাসচর্চায় খেলার ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় খেলার ইতিহাসের ভূমিকা –
খেলা (Sport) হল একটি সংগঠিত, নিয়মনিষ্ঠ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, বিনোদন ও দক্ষতামূলক শারীরিক কার্যকলাপ। প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রে খেলাধুলা অতি জনপ্রিয় ছিল। পরবর্তীকালে এই ধারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। খেলাধুলা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই ইতিহাসে অন্যতম আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে খেলার ইতিহাস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ খেলাগুলি হল – ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, টেনিস, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি। তবে ইতিহাসে গ্রামীণ লোকক্রীড়াগুলির গুরুত্বও অপরিসীম।
খেলার ইতিহাসচর্চার সূচনা –
ইউরোপে খেলার ইতিহাসচর্চার সূচনা হয় 1970 -এর দশকে। খেলার ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন জে এ ম্যাঙ্গান, রিচার্ড হোল্ট প্রমুখ। জে এ ম্যাঙ্গান (JA Mangan) -এর লেখা ‘দ্য গেমস এথিক অ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজম’ (The Games Ethic and Imperialism) খেলার ইতিহাসচর্চার একটি অমূল্য গ্রন্থ।
ইংল্যান্ডে 1982 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সোসাইটি অফ স্পোর্টস হিস্ট্রি (British Society of Sports History) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে খেলার ইতিহাসচর্চা একটি সাংগঠনিক রূপ পায়। ঐতিহাসিক হবসবম খেলাকে বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় জীবনধারায় এক অন্যতম প্রধান সামাজিক অভ্যাস বলে বর্ণনা করেছেন।
ভারতে খেলার ইতিহাসচর্চা –
ভারতে খেলার ইতিহাস নিয়ে চর্চা শুরু হয় 1980 -র দশকে এবং এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন সৌমেন মিত্র। তাঁর গবেষণার বিষয় হল ‘ঔপনিবেশিক বাংলায় ফুটবল, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও উপপ্রাদেশিকতা।
- সাম্প্রতিককালে বোরিয়া মজুমদার খেলার ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘টোয়েন্টি টু ইয়ার্ডস টু ফ্রিডম এ সোশ্যাল হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট’ (Twenty-two Yards to Freedom : A Social History of Indian Cricket)। এ ছাড়া ঐতিহাসিক নলীন মেহতার সঙ্গে ম্যাঙ্গান রচনা করেছেন ‘অলিম্পিকস : দ্য ইন্ডিয়া স্টোরি’ (Olympics : The India Story)।
- ফুটবল বিষয়ে কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন।
- ডঃ রামচন্দ্র গুহ ভারতীয় খেলার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর লেখার মাধ্যমে।
ইতিহাসে খেলার গুরুত্ব –
ইতিহাসে খেলার গুরুত্ব অপরিসীম –
- খেলা জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধি এবং গণ আবেগ সৃষ্টি করে।
- খেলায় নারীদের অংশগ্রহণ দেখে সমাজে নারী স্বাধীনতা বিষয়ে ধারণা করা যায়।
- 1905 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের ফলে বাঙালিদের মনে যে ব্রিটিশবিরোধী জনমত গড়ে ওঠে খেলার মাধ্যমে তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। 1911 খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগান ফুটবল দল ব্রিটিশ ইস্ট ইয়র্ককে পরাজিত করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। ডঃ রামচন্দ্র গুহ মনে করেন যে, এই জাতীয়তাবাদের স্পর্ধিত প্রকাশ দেখে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করে ও কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় খেলার ইতিহাসের উপসংহার –
বর্তমানে খেলার ইতিহাসচর্চার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক শহুরে সভ্যতার চাপে গ্রামের বিভিন্ন খেলা, যেমন – লুকোচুরি, কানামাছি, কুমির-ডাঙা, ডাংগুলি, হাডুডু, কিৎ কিৎ ইত্যাদি লোকক্রীড়াগুলি আজ লুপ্তপ্রায়। নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চায় এই সমস্ত লোকক্রীড়াগুলির গুরুত্বও অপরিসীম।
খেলার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
খেলার ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
সাম্প্রতিককালে খেলার ইতিহাসচর্চা সামাজিক ইতিহাসচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। খেলাধুলার ইতিহাসকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর সমাজের বিভিন্ন বিষয় তথা সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা প্রতিফলিত হয়।
খেলার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যসমূহ –
খেলাধুলার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
- সমাজ সম্পর্কিত তথ্য – খেলার ইতিহাস থেকে একটি সমাজের মানুষের মানসিকতা, শারীরিক সক্ষমতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, নারীর মর্যাদা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিভিন্ন মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।
- ঐক্য ও সম্প্রীতি স্থাপন – খেলাধুলা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার এক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। খেলার ইতিহাসচর্চা তাই রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংহতি সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।
- জাতীয়তাবোধ সম্পর্কিত তথ্য – জাতীয়তাবাদী চেতনা ও আবেগের প্রকাশ খেলাধুলার ইতিহাসচর্চার অপর এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, 1911 খ্রিস্টাব্দে পরাধীন ভারতে ফুটবলে জাতীয় ক্লাব মোহনবাগান ব্রিটিশদের ইস্ট ইয়র্ককে পরাজিত করে। ভারতীয়দের মধ্যে এই ঘটনাটি ব্যাপক জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা সৃষ্টি করে।
- বৈষম্য দূরীকরণ – খেলার ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে জাতিগত ও লিঙ্গ বৈষম্য দূর হয়। বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে পারস্পরিক সদ্ভাব ও মৈত্রীর বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে খেলা দেশ ও জাতির প্রয়োজনের উপযোগী হয়ে উঠতে পারে। এটি খেলাধুলার ইতিহাসচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
- লুপ্তপ্রায় খেলার সন্ধান – খেলাধুলার ইতিহাসচর্চার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল – আধুনিক শহুরে সভ্যতার চাপে যেসকল গ্রামীণ লোকক্রীড়াগুলি প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে সেগুলিকে পুনরুদ্ধার করা। নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার আলোকে এই লোকক্রীড়াগুলি ইতিহাসের গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
খেলার ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
তাই বলা যায়, সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে খেলার ইতিহাসচর্চার ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
খেলাধুলার ইতিহাসকে কেন ‘ইতিহাস’ -এর পর্যায়ভুক্ত করা হয়, সে বিষয়ে সংক্ষেপে লেখো।
খেলাধুলার ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
সুদূর অতীতে কোন্ সময় থেকে খেলাধুলা শুরু হয়েছিল, তা আমাদের অজানা। তবে খেলাধুলা হল মানুষের প্রাচীনতম বিনোদনগুলির মধ্যে অন্যতম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলার উন্নতি ঘটেছে। অলিম্পিক আয়োজিত হয়েছে। খেলাধুলার বিভিন্ন শাখার বিকাশ ঘটেছে। ক্রমে খেলাধুলা ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
খেলার ইতিহাসকে ইতিহাস বলার কারণ –
- খেলাধুলা বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন সাংস্কৃতিক জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। সমাজের বৃহত্তর পরিবেশে বিভিন্ন বিষয় ও সম্পর্ক খেলাধুলার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়।
- খেলাধুলার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ফুটে ওঠে।
- মানুষের কার্যকলাপ ইতিহাসের বিষয়বস্তু। মানুষের সঙ্গে খেলাধুলার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। তাই খেলাধুলার ইতিহাসকে ঐতিহাসিকেরা ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
- কোনো বিশেষ খেলাকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবোধের সঞ্চারের দৃষ্টান্তও বর্তমান। যেমন – 1911 খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের ঘটনায় ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
- খেলার ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে জাতিগত ও লিঙ্গগত বৈষম্য দূর হয়। পাশাপাশি বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে খেলা দেশ ও জাতির নানা প্রয়োজনের উপযোগী হয়ে উঠতে পারে। এ কারণেই খেলাধুলা ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
- একটি দেশের খেলাধুলার অগ্রগতির সম্ভাবনা, সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে গবেষণা ইতিহাসচর্চার সমপর্যায়ভুক্ত।
- খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে ক্রীড়া সাংবাদিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এ বিষয়ে ঐতিহাসিক গবেষণা বিশেষ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
- খেলাধুলার বাণিজ্যিকীকরণের বিষয়টিও ইতিহাস গবেষণায় গুরুত্ব লাভ করেছে।

আধুনিক ভারতে খেলাধুলার ইতিহাসচর্চা –
1970 -এর দশকে ইউরোপে খেলাধুলা নিয়ে ইতিহাসচর্চা শুরু হয়। 1980 -র দশকে জে এ ম্যাঙ্গান, টনি ম্যাসন, রিচার্ড হোল্ট এবং ব্রিটিশ সোসাইটি অফ স্পোর্টস হিস্ট্রি (British Society of Sports History) এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়। ভারতে খেলাধুলার ইতিহাস নিয়ে অনেক বিদেশি গবেষক গবেষণা করেছেন। ভারতীয়দের মধ্যে খেলা নিয়ে প্রথম গবেষণার সূত্রপাত হয় 1988 খ্রিস্টাব্দে। আশিস নন্দী, রামচন্দ্র গুহ, মিহির বোস, বোরিয়া মজুমদার প্রমুখ ক্রিকেট খেলা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন।
খেলাধুলার ইতিহাসচর্চার মূল্যায়ন –
খেলাধুলা যদিও বিনোদন তবুও সমাজ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দেশ, জাতি, দেশের মানুষ ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে এই খেলাধুলার মধ্য দিয়ে। আর তাই এই বিষয়ে গবেষণা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। খেলার ইতিহাস তাই সমাজবিজ্ঞানের মতোই গতিশীল ইতিহাস।
আধুনিক ভারতে খেলাধুলার ইতিহাসচর্চার গতিপ্রকৃতি আলোচনা করো।
খেলাধুলার ইতিহাসচর্চা –
সামাজিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে খেলার ইতিহাস সাম্প্রতিককালে ঐতিহাসিক মহলে গুরুত্ব লাভ করেছে। বৃহত্তর সমাজের নানান সম্পর্ক ও বিষয়গুলি খেলার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। খেলার ইতিহাস যে শুধু কোনো দেশের খেলার ঐতিহ্যের বিবরণকে বুঝতে সাহায্য করে তাই নয়, সেইসঙ্গে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যেমন – জাতীয়তাবাদ অথবা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলিকেও ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে যে ক্রীড়া সাংবাদিকতার দিকটি বর্তমানে গুরুত্ব লাভ করেছে সেই বিষয়েও ঐতিহাসিক গবেষণা বিশেষ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। খেলার বাণিজ্যিকীকরণের বিষয়টিও ইতিহাস গবেষণায় গুরুত্ব লাভ করেছে।
ভারতে খেলাধুলার ইতিহাসচর্চার সূচনা –
খেলা নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম গবেষণার সূত্রপাত হয় 1988 খ্রিস্টাব্দে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র সৌমেন মিত্র ‘ঔপনিবেশিক বাংলায় ফুটবল, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও উপপ্রাদেশিকতা’ বিষয়ে এম ফিল গবেষণাপত্র দাখিল করেন। প্রায় একই সময়ে ভারতীয় কিছু সমাজবিজ্ঞানী, যেমন – আশিস নন্দী, রামচন্দ্র গুহ, মিহির বোস প্রমুখ ক্রিকেট নিয়ে লেখা শুরু করেন। রামচন্দ্র গুহর ভারতীয় ক্রিকেট সংক্রান্ত গ্রন্থটিও বহুল সমাদৃত।
খেলাধুলার ইতিহাসচর্চায় বিদেশি লেখকদের অবদান –
ভারতে পাশ্চাত্য ক্রীড়ার আগমন, তার ইউরোপীয় প্রেক্ষাপট ও বিবর্তন নিয়ে অনেক অভারতীয় বিশেষজ্ঞ গবেষণা করেছেন। এদের মধ্যে জে এ ম্যাঙ্গান -এর ‘দ্য গেমস এথিক অ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজম’ (The Games Ethic and Imperialism) গ্রন্থটিকে একটি অমূল্য প্রামাণ্য গ্রন্থ বলা যায়।
খেলাধুলার ইতিহাসচর্চায় স্বদেশি লেখকদের অবদান –
ভারতে পাশ্চাত্য ক্রীড়ার আগমন, বিবর্তন ও ভারতীয় খেলাধুলার ইতিহাস নিয়ে অনেক ভারতীয় গবেষক ভালো কাজ করেছেন। আধুনিক ভারতে খেলাধুলার ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – বোরিয়া মজুমদার -এর ‘টোয়েন্টি-টু ইয়ার্ডস টু ফ্রিডম’ (Twenty-two Yards to Freedom), কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘গোললেস : দ্য স্টোরি অফ এ ইউনিক ফুটবলিং নেশন’ (Goalless : the Story of a Unique Footballing Nation) ইত্যাদি।

খেলাধুলার ইতিহাসচর্চা ও জাতীয়তাবাদ –
পরাধীন ভারতে ফুটবলে জাতীয় ক্লাব মোহনবাগানকে কেন্দ্র করেই ইংরেজবিদ্বেষী জাতীয়তাবাদ প্রবল আকার ধারণ করেছিল। খেলাটা বাঙালি তথা ভারতীয়দের কাছে হয়ে দাঁড়ায় জাতীয়তাবাদ প্রকাশের প্রতীক। একজন ক্রীড়া ঐতিহাসিকের গবেষণা খেলাধুলার অগ্রগতিতে সাহায্য করে, জাতি ও দেশকে সমৃদ্ধ করে।
ভারতীয় ফুটবল খেলা কীভাবে জাতীয়তাবোধে উন্নীত হয়?
ফুটবল খেলার ইতিহাসের ভূমিকা –
খেলাধুলা হল মানুষের প্রাচীনতম বিনোদনগুলির মধ্যে অন্যতম। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে গ্রামীণ দেশীয় লোকক্রীড়ার পাশাপাশি ব্রিটিশদের হাত ধরে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি ইত্যাদি খেলার প্রচলন ঘটে।
ফুটবল খেলার মাধ্যমে ভারতে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ –
ফুটবল, ক্রিকেট, হকি প্রভৃতি খেলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের হাত ধরে ভারতে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও কালক্রমে তা ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষে সাহায্য করেছিল।
- ভারতে ফুটবলের প্রসার – ভারতীয় ফুটবলের জনক রূপে পরিচিত নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী ফুটবলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ভারতবাসীর শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটানো ছিল তাঁর অন্যতম লক্ষ্য।
- ভারতবাসীর সক্ষমতা প্রদর্শন – ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা প্রথম থেকেই ভারতীয়দের দুর্বল ও কাপুরুষ বলে মনে করত। ভারতীয়রা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ জানিয়েছিল ফুটবল খেলায় বীরত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে।
- জাতীয় ক্লাব মোহনবাগানের জয়লাভ – পরাধীন ভারতে ফুটবলের জাতীয় ক্লাব মোহনবাগানকে কেন্দ্র করে ইংরেজবিদ্বেষী জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটে। ইংরেজরা যেখানে বুট পরে ফুটবল খেলত সেখানে ভারতীয়দের খেলতে হত খালি পায়ে। 1911 খ্রিস্টাব্দে ফুটবলের আই এফ এ শিল্ড প্রতিযোগিতায় মোহনবাগান দল খালি পায়ে ফুটবল খেলে ব্রিটিশ ইস্ট ইয়র্ককে পরাজিত করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারতবর্ষে ব্যাপক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে।
ফুটবল খেলার ইতিহাসের উপসংহার –
এইভাবে ফুটবল খেলা ভারতীয়দের কাছে জাতীয়তাবাদ প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকে পরিণত হয়।
সামাজিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার গতিপ্রকৃতি আলোচনা করো।
অথবা, আধুনিক ইতিহাসচর্চায় খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস বলতে কী বোঝো?
সামাজিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
মানুষের জীবনধারণের অন্যতম উপাদান হল খাদ্য। মানবসভ্যতার ইতিহাসচর্চায় খাদ্যাভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন কারণে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটে। আবার খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ইতিহাসের পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে। তাই ইতিহাসচর্চায় খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চা –
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ কালিনারি প্রফেশনালস (International Association of Culinary Professionals)। খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার ধারায় ভারতীয় খাদ্য বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – কেটি আচয় (KT Achaya) -এর লেখা ‘ইন্ডিয়ান ফুড : এ হিস্টোরিক্যাল কম্প্যানিয়ন’ (Indian Food : A Historical Companion), ‘এ হিস্টোরিক্যাল ডিকশনারি অফ ইন্ডিয়ান ফুড’ (A Historical Dictionary of Indian Food), ক্লড মার্কোভিটস (Claude Markovits) সম্পাদিত ‘এ হিস্ট্রি অফ মডার্ন ইন্ডিয়া, 1480-1950’ (A History of Modern India, 1480- 1950), প্যাট চ্যাপম্যান -এর ‘ইন্ডিয়া ফুড অ্যান্ড কুকিং’ (India : Food & Cooking) প্রভৃতি।

এ ছাড়া ‘অ্যানসেস্ট্রাল অ্যাপেটাইটস ফুড ইন প্রি-হিস্ট্রি’ (Ancestral Appetites : Food in Pre-history) গ্রন্থে ক্রিস্টান জে গ্রিমিলিয়ন আদি পর্যায়ে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মানবসভ্যতার বিবর্তনের দিকগুলিকে তুলে ধরেছেন। চিত্রিতা ব্যানার্জি তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে ভারতীয় খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে মূল্যবান গবেষণা করেছেন।
ইতিহাসের ধারায় খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন –
আদিম মানুষ পশুশিকার করে তার কাঁচা মাংস খেত, ফলমূল সংগ্রহ করে খেত। তখন মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক।
- তারপর মানুষ আগুনকে ব্যবহার করে খাবার পুড়িয়ে খেতে শিখল।
- নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ খাদ্য সংগ্রাহক থেকে খাদ্য উৎপাদকে পরিণত হল।
- হরপ্পা সভ্যতার মানুষের খাবার ছিল গম, যব, বার্লি, মাংস, মাছ ইত্যাদি।
- বৈদিক সভ্যতার মানুষ গম, যব, বার্লি, চাল, শাকসবজি, মাছ, মাংস, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার খেত।
- মৌর্য ও পাল যুগে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে, আবার গুপ্ত ও সেন যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাবে নিরামিষ খাবারের প্রবণতা বেড়েছিল।
- ভারতে সুলতানি ও মুঘল যুগে ইসলামিক সংস্কৃতির প্রভাবে খাদ্যাভ্যাসও প্রভাবিত হয়। মুঘলদের প্রভাবে ভারতে মোগলাই খাবারের প্রচলন হয়।
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরিফউদ্দিন আহমদ দেখিয়েছেন যে, ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ার পর বিভিন্ন রকমের ‘ঢাকাই খাবার’ -এর উদ্ভব হয়।
- পোর্তুগিজদের প্রভাবে বাংলায় মিষ্টি জাতীয় খাবারে নানান পরিবর্তন এসেছিল। ছানার তৈরি রসগোল্লা ও অন্যান্য মিষ্টি বাংলার পূজার নৈবেদ্যে জায়গা করে নিয়েছে। পোর্তুগিজদের প্রভাবে ভারতীয় খাদ্যে আলুর প্রচলন হয় বলে জানা যায়।
- ব্রিটিশ আমলে ভারতে কেক-সহ বিভিন্ন ধরনের বিদেশি খাবারের প্রচলন শুরু হয়।
ইতিহাসের ধারায় খাদ্যাভ্যাসের কারণ –
মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলের বিভিন্ন কারণ আছে। কারণগুলি হল –
- রান্নার কৌশল – অতীতে মানুষ কাঁচা মাংস খেত। তারপর মাংস আগুনে পুড়িয়ে খেতে শেখে। এরপর মশলা, তেল ও অন্যান্য উপকরণের ব্যবহার শেখে।
- খাদ্যের বৈচিত্র্য – গম, যব, চাল, মাছ, মাংস হল মানুষের প্রধান খাদ্য। এই খাদ্য উপাদানগুলিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন খাদ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। ফলে মানুষ রকমারি খাদ্যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
- ভৌগোলিক পরিবেশ – ভৌগোলিক পরিবেশ মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলের জন্য দায়ী। কোনো অঞ্চলের আবহাওয়া ও উৎপন্ন শস্যের উপর সেখানকার মানুষের খাদ্যাভ্যাস নির্ভর করে।
ইতিহাসের ধারায় খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব –
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
- খাদ্যাভ্যাস মানুষের ধর্মীয় ও আঞ্চলিক পরিচয় তুলে ধরে।
- খাদ্যাভ্যাস থেকে মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়।
- মানুষের আর্থিক পরিচয় খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে ফুটে ওঠে।
- খাদ্যাভ্যাস মানুষের অতীত ঐতিহ্যের পরিচয় দেয়।
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানবসমাজের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ইতিহাসের পরিবর্তনকে সূচিত করে। তাই ইতিহাসচর্চায় খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যসমূহ –
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
- খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন – আদিম যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আদিম যুগে কাঁচা মাংসের ভক্ষণ, এরপর আগুনের ব্যবহারের সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন – এই দীর্ঘ বিবর্তনের ইতিহাস খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- খাদ্যাভ্যাসের উপর ভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব – খাদ্যাভ্যাসের উপর ভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব ও ইতিহাসচর্চার অপর একটি বৈশিষ্ট্য। যেমন – ভারতবর্ষে আগত বিভিন্ন বিদেশি জাতির খাদ্যাভ্যাস ভারতীয়রা আপন করে নিয়েছিল। আবার বেশ কিছু খাদ্য, যথা – পেঁয়াজ, রসুন ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিল। এর ফলে ভারতীয় সমাজে নিরামিষাশী শ্রেণি গড়ে ওঠে।
- অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় – খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চা মানবসমাজের আর্থিক অবস্থারও পরিচয় বহন করে। ধনী-দরিদ্রের খাদ্যের পার্থক্য অর্থনৈতিক অবস্থার ইঙ্গিতবাহী।
- ভৌগোলিক পরিবেশ – ভৌগোলিক পরিবেশ মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলের জন্য দায়ী। কোনো অঞ্চলের আবহাওয়া ও উৎপন্ন শস্যের উপর সেখানকার মানুষের খাদ্যাভ্যাস নির্ভর করে। খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যার মাধ্যমে পরিবেশগত পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের খাদ্যের অভ্যাসগত পরিবর্তনের ধারণাটি পাওয়া যায়।
- জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণা – খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে কোনো জনগোষ্ঠীর ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস, নারীর মর্যাদা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
অতএব বলা যায়, খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলি মানবসমাজের সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসকে চিহ্নিত করে।
খাদ্যগ্রহণ সম্পর্কে সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা কীভাবে ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে?
খাদ্যগ্রহণ সম্পর্কে সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার ভূমিকা –
নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার অন্যতম উপাদান হল মানুষের খাদ্যাভ্যাস। খাদ্যাভ্যাস যদিও ভৌগোলিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে তথাপি খাদ্যগ্রহণ সম্পর্কে সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা মানুষের ইতিহাসকে প্রভাবিত করে।
খাদ্যগ্রহণ সম্পর্কে সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা-ইতিহাসে তার প্রভাব –
খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে কোনো একটি খাদ্যকে মানুষ বর্জন করে। ফলে এর প্রভাব সুদুরপ্রসারী হয়ে ওঠে।
- প্রাচীন ইহুদি ধর্মশাস্ত্র হিব্রু বাইবেল থেকে জানা যায়, মোজেস পশুর চর্বি এবং শুকরের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করেন। এরপর ইহুদিদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবোধ জন্মায়। তারা স্থানীয় অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদের আলাদা মনে করে। তাদের খাদ্যতালিকা থেকে এই খাদ্যগুলি নিষিদ্ধ হয়। পরম্পরাগতভাবে তাদের এই নিষিদ্ধ খাদ্য বর্জনের অভ্যাস চলে আসছে।
- প্রাচীনকালের ভারতের ইতিহাস থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রতিবাদী আন্দোলনের কথা জানা যায়। এই সময় গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর জীবহত্যা নিষিদ্ধ করেন। সমকালীন সমাজে এই ঘোষণা গভীর প্রভাব বিস্তার করে। সমাজের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ অহিংস হয়ে ওঠে। তারা পশুহত্যা বন্ধ করে দেয়। এর প্রভাবে খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে ও সমাজজীবনে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
- ভারতে বিভিন্ন সময়কালে বিভিন্ন বিদেশি জাতির আগমন ঘটেছে। তারা নিজস্ব সংস্কৃতি সঙ্গে করে এনেছিল। কালক্রমে এইসব বিদেশি জাতির খাদ্যাভ্যাস ভারতীয়রা আপন করে নিয়েছিল। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি খাদ্য ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিল। পেঁয়াজ, রসুন, মুসুর ডাল এর মধ্যে অন্যতম। এর ফলে ভারতীয় সমাজে নিরামিষভোজী শ্রেণি গড়ে ওঠে।
খাদ্যগ্রহণ সম্পর্কে সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার মন্তব্য –
এইভাবে খাদ্যগ্রহণ সম্পর্কে সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। ইতিহাসের গতিধারা পরিবর্তিত হয়েছে।
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব কী?
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার গুরুত্বের ভূমিকা –
মানবজীবন ধারণের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান হল খাদ্য। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের যে পরিবর্তন ঘটেছে, আধুনিক ইতিহাসচর্চার তা এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চা সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – কে টি আচয় -এর লেখা ‘ইন্ডিয়ান ফুড : এ হিস্টোরিক্যাল কম্প্যানিয়ন’ (Indian Food : A Historical Companion), প্যাট চ্যাপম্যান -এর ‘ইন্ডিয়া – ফুড অ্যান্ড কুকিং’ (India : Food and Cooking) প্রভৃতি।
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব –
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
- খাদ্যাভ্যাসের বিবর্তনের ইতিহাস – আদিপর্ব থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত মানুষের খাদ্যাভ্যাস কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে তা খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চা থেকে জানা যায়।
- জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণা – খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে কোনো জনগোষ্ঠী জাতির ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস, নারীর মর্যাদা প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
- খাদ্যসামগ্রীর উৎস সন্ধান – খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে কোনো দেশের খাদ্য কীভাবে অন্য আর-একটি দেশের মানুষ তাদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। যেমন – পোর্তুগিজদের প্রভাবে ভারতীয় খাদ্যে আলুর প্রচলন হয় বলে জানা যায়।
- বৈদেশিক যোগাযোগ সম্পর্কে ধারণা – খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস থেকে একটি নির্দিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিদেশের যোগাযোগ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাসে মুঘল, পোর্তুগিজ ও ব্রিটিশদের প্রভাবে নতুন নতুন খাবারের সংযোজন হয়।
- সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা – খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার অপর একটি গুরুত্ব হল কোনো দেশে বসবাসকারী জাতি বা সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে ধারণা লাভ। তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রুচিবোধ প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
এইভাবে খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চা নতুন সামাজিক ইতিহাসচার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শিল্পচর্চার ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, শিল্পচর্চার ইতিহাস কী ধরনের ইতিহাস?
অথবা, আধুনিক শিল্পচর্চার ইতিহাসে সংগীত, নৃত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শিল্পচর্চার ভূমিকা –
আধুনিককালে ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ শাখা হল শিল্পচর্চার ইতিহাস। শিল্পচর্চার ইতিহাস বলতে বোঝায় সংগীত, নৃত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে। শিল্পের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে উপনিবেশবাদ, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, বিশ্বায়ন প্রভৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শিল্পচর্চার ইতিহাস বিষয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় কালচারাল অ্যান্ড সোশ্যাল হিস্ট্রি (Cultural and Social History) নামক জার্নালে। ভারতেও শিল্পচর্চার জন্য বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শিল্পচর্চার সংগীত –
ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই সংগীতের চর্চা চলে আসছে। বৈদিক যুগেও সংগীতের চর্চা ছিল। সুলতানি ও মুঘল যুগে নতুন ঘরানার সংগীতচর্চার প্রচলন হয়। আবার ব্রিটিশ আমলে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বিকাশে সংগীত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। 1905 খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলনের যুগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, রজনীকান্ত সেন লেখেন ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’। অতুলপ্রসাদের ‘বল বল বল সবে’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানগুলিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশাত্মবোধক সংগীতের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
সংগীতচর্চার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘সংগীত চিন্তা’, দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বাংলার রাগসঙ্গীত চর্চা’, করুণাময় গোস্বামীর লেখা ‘বাংলা গানের বিবর্তন’, মৃণালকান্তি চক্রবর্তীর লেখা ‘বাংলা গানের ধারা’ ইত্যাদি।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শিল্পচর্চার নৃত্য –
ভারতীয় সংগীতের মতো নৃত্যকলার ইতিহাসও অত্যন্ত প্রাচীন। প্রাচীন সাহিত্যিক উপাদানে এবং চিত্রকলায় এর উদাহরণ পাওয়া যায়। প্রাচীন যুগে ভারতীয় মন্দিরের বিগ্রহের সামনে অনুষ্ঠিত দেবদাসী নৃত্য থেকে বর্তমানে চলচ্চিত্রের নৃত্য পর্যন্ত নৃত্যের জগতে যে দীর্ঘ বিবর্তন চলেছে, তা ভারতীয় সমাজের বিবর্তনকেই বুঝতে সাহায্য করে। ঊর্মিমালা সরকার মুনসি এবং স্টেফনি বিউরিজ সম্পাদিত ‘ট্র্যাভারসিং ট্র্যাডিশন : সেলেব্রেটিং ডান্স ইন ইন্ডিয়া’ (Traversing Tradition : Celebrating Dance in India) গ্রন্থে ঔপনিবেশিক আমলে এবং স্বাধীনতার পরবর্তীকালে নৃত্যশিল্পের পরিবর্তন এবং নৃত্যশিল্পের প্রতি সমাজের মনোভাব প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।

আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শিল্পচর্চার নাটক –
সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে ভারতবর্ষে নাট্যকলা একটি বিশিষ্ট শিল্পমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ভরত মুনি রচিত নাট্যশাস্ত্র প্রাচীন বিশ্বের নাটক বিষয়ে রচিত শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। কালিদাস বা ভবভূতি-র মতো প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত সাহিত্যিকেরা তাঁদের নাটকের জন্য বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে নাটকের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের যথেষ্ট প্রসার ঘটেছিল।
নাটকের কণ্ঠরোধ করার জন্য 1876 খ্রিস্টাব্দের 14 মার্চ লর্ড নর্থব্রুক ‘নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ পাস করেন। এই আইনে বলা হয়, পুলিশের অনুমতি ছাড়া কোনো নাট্যানুষ্ঠান করা যাবে না।
ভারতে নাটকের ইতিহাসচর্চার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস’, আশুতোষ ভট্টাচার্যের ‘বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস’ ইত্যাদি।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শিল্পচর্চার চলচ্চিত্র –
1895 খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে সিনেমা প্রদর্শন শুরু হওয়ার দু-বছরের মধ্যেই মহারাষ্ট্র এবং বাংলায় চলচ্চিত্রের প্রদর্শন শুরু হয়। প্রথম দিকে বাংলা সিনেমার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল হীরালাল সেন এবং তাঁর স্থাপিত ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’-র। আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলা চলচ্চিত্র খ্যাতির চূড়ায় উঠেছিল সত্যজিৎ রায়ের দক্ষতায়। তাঁর পরিচালিত বিভিন্ন চলচ্চিত্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বহু পুরস্কার পেয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল বা এম এস সথ্যু-র মতো পরিচালকদের সিনেমায় বলিষ্ঠ রাজনৈতিক সচেতনতার প্রকাশ ঘটেছে। আবার আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র না হলেও চলচ্চিত্রের মধ্যে যে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রকাশ ঘটে, তা ঐতিহাসিক উর্বী মুখোপাধ্যায় তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে দেখিয়েছেন।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শিল্পচর্চার গুরুত্ব –
সমাজ পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা তুলে ধরে গান, নাচ, নাটক ও চলচ্চিত্র। আমরা ঘটনার জীবন্ত প্রতিরূপ দেখতে পাই নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। নিরক্ষর মানুষ নাটক, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ঘটনা বা কাহিনি বুঝতে পারে। লোকশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে নাটক ও চলচ্চিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।
শিল্পচর্চার ইতিহাসের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করো।
শিল্পচর্চার ইতিহাসের ভূমিকা –
শিল্পচর্চার ইতিহাস আধুনিক ইতিহাসচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই শিল্পগুলির মধ্যে সংগীত, নৃত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই প্রকার শিল্পচর্চার মাধ্যমে সমাজ-সংস্কৃতির বিবর্তনের ইতিহাস তথা মানুষের জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক সম্পর্কেও জানা যায়।
শিল্পচর্চার ইতিহাসের বিভিন্ন দিক –
শিল্পের বিভিন্ন ধারাগুলি ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। শিল্পচর্চার ইতিহাসের বিভিন্ন দিকগুলি হল –
- ঐতিহাসিক তথ্যসংগ্রহ – শিল্পের বিভিন্ন ধারাগুলির উদ্ভব, তার বিবর্তনের ইতিহাস থেকে সমকালীন সামাজিক অবস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি সম্পর্কে ঐতিহাসিক মূল্যবান তথ্য লাভ করা যায়।
- রাজনৈতিক গুরুত্ব – সংগীত, নাটক, নৃত্য প্রভৃতি শিল্পকলা কোনো দেশের সাংস্কৃতিক সত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সাংস্কৃতিক সত্তাই আবার দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাবলির বহিঃপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। যেমন – নাটকের মধ্য দিয়ে বহু ক্ষেত্রেই দেশের বাস্তব রাজনৈতিক চিত্রের সার্থক রূপায়ণ ঘটে থাকে।
- শিল্পচর্চাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব – শিল্পচর্চা অর্থাৎ সংগীত, নাটক, নৃত্য, চলচ্চিত্র প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রঙ্গমঞ্চ গড়ে ওঠে। এটি শিল্পচর্চার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
- সামাজিক সংহতি রক্ষা – সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, নৃত্য প্রভৃতি মানুষের চিত্তবিনোদনে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, এই শিল্পকলার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি হয়।
শিল্পচর্চার ইতিহাসের ক্ষেত্রে সংগীত ও নৃত্যশিল্পের বিবর্তনের কোন্ পরিচয় পাওয়া যায়?
শিল্পের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে সংগীত ও নৃত্যের ইতিহাসচর্চা একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়।
শিল্পচর্চার ইতিহাসের ক্ষেত্রে সংগীত –
সংগীত মূলত বিনোদনের একটি বিষয় হিসেবে গণ্য হলেও সংগীতের মধ্য দিয়ে ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে জানা সম্ভবপর হয়। সংগীতের মধ্য দিয়ে কোনো একটি বিশেষ সময়কালের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায়। সংগীতের পৃষ্ঠপোষক ও বোদ্ধাদের বিচারবিশ্লেষণ থেকেও কোনো একটি সময়ের কোনো একটি অঞ্চলের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে লালন ফকিরের গানের কথা বলা যেতে পারে। বিভিন্ন ধারার সংগীতের মিশ্রণের মধ্য দিয়েও মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠার বিষয় সম্বন্ধে জানা যায়।
শিল্পচর্চার ইতিহাসের ক্ষেত্রে সংগীতে প্রযুক্তিগত বিবর্তন –
প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে সংগীত সীমিত কিছু উচ্চবর্গীয়দের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, সে সম্পর্কে জানা যায়। গ্রামোফোনের আবিষ্কারের বিষয়টি এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য। এইভাবে সংগীতকে কেন্দ্র করে যে বিরাট বাণিজ্যিক সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়, সে বিষয়েও জানা যায়।
শিল্পচর্চার ইতিহাসের ক্ষেত্রে নৃত্য –
চারুকলার মধ্যে নৃত্যশিল্পের ইতিহাস সাম্প্রতিককালে ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নৃত্যশৈলীর মধ্য দিয়ে কোনো বিশেষ সময়পর্বের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নানান রূপকল্পের আভাস পাওয়া যায়।
শিল্পচর্চার ইতিহাসের ক্ষেত্রে নৃত্যশৈলীর বহুমুখী প্রকাশ –
অতি প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে নৃত্যের বিকাশ ঘটেছিল। ভারতে ধ্রুপদি নৃত্যকে সাধারণত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে, যথা – ভরতনাট্যম, কথাকলি, মণিপুরী ও কথক। তবে কুচিপুড়ি, ওড়িশি প্রভৃতি বিভিন্ন নৃত্যধারাকেও ধ্রুপদি নৃত্যের মর্যাদা দেওয়া হয়। কেরল প্রদেশের অনন্য সম্পদ হল কথাকলি নৃত্যশৈলী। ভারতের ধ্রুপদি নৃত্যধারার পূর্ণাঙ্গ রূপের শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি ভরতনাট্যম। কুচিপুড়ি নৃত্যধারা অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষ্ণানদীর তীরে কুচিপুড়ি গ্রামের বাঘান গোষ্ঠীর দ্বারা অনুষ্ঠিত হত।

সংগীত কীভাবে জাতীয় আন্দোলনের মাধ্যম হয়ে ওঠে?
সংগীতের ভূমিকা –
শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার ইতিহাসে সংগীতের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কেবলমাত্র চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই নয়, সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার একটি প্রধান উৎস হল সংগীত কোনো দেশ বা জাতির সাংস্কৃতিক বোধের পরিস্ফুরণ ঘটে সংগীতের মাধ্যমে।
জাতীয় আন্দোলনের মাধ্যম হিসেবে সংগীতের ভূমিকা –
সংগীতের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাই জাতীয় আন্দোলনের প্রসারের মাধ্যম হিসেবে সংগীতের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
- দেশাত্মবোধ জাগরণে সংগীতের ভূমিকা – ব্রিটিশ আমলে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বিকাশে সংগীত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। 1905 খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলনের যুগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, রজনীকান্ত সেন -এর ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ প্রভৃতি গান স্বদেশপ্রেম জাগরণে সাহায্য করেছিল।
- গণসংগীতের সূচনা – 1940 -এর দশক থেকে জাতীয় জাগরণে গণসংগীত এক নতুন ধারার সূচনা করে। এটি ক্রমশ দেশের সাধারণ মুক্তিকামী মানুষের নিজস্ব সংগীত হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবোধ বিস্তারের পাশাপাশি নিপীড়িত জনগণের শোষণের কাহিনিও এই গণসংগীতের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ সময়ের বিশিষ্ট কিছু গণসংগীত শিল্পীরা হলেন – হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরি, বিনয় রায় প্রমুখ।
- লোকসংগীতের মাধ্যমে স্বদেশপ্রেম জাগরণ – বাংলার প্রাচীন লোকগান জাতীয় আন্দোলনের অপর একটি মাধ্যম ছিল। বাউল, ভাটিয়ালি, সারিগান প্রভৃতি গানের মাধ্যমে সহজসরল গ্রামীণ মানুষদের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের উন্মেষ ঘটে।
জাতীয় আন্দোলনের মাধ্যম হিসেবে সংগীতের উপসংহার –
ভারতের শিল্পচর্চার ইতিহাসে সংগীতের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষত, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সংগীত আন্দোলনের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছিল।
বর্তমানে ধ্রুপদি নৃত্যের অন্তর্ভুক্ত newly যুক্ত হওয়া দুটি নৃত্যশৈলীর নাম কী?
বর্তমানে আরও দুটি নৃত্যশৈলীকে ধ্রুপদি নৃত্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যথা-মোহিনীআট্টম এবং সত্রীয়।
নৃত্য কীভাবে আমাদের ইতিহাসের নানা তথ্য জানতে সাহায্য করে?
নৃত্যকলার মাধ্যমে ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
সংগীতের মতোই নৃত্যকলাও শিল্পচর্চার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। নৃত্যকলা মানবসমাজের বিভিন্ন সময়ের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পরিচয় বহন করে।
নৃত্যকলার মাধ্যমে ইতিহাসচর্চা –
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যশিল্পের বিবর্তন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ইতিহাসচর্চার অন্যতম উপাদান হিসেবে তাই নৃত্যকলার অবদান অনস্বীকার্য।
- সমাজের মনোভাবের প্রতিফলন – নৃত্যশিল্পের মধ্য দিয়ে সামাজিক মনোভাবের পরিচয় প্রকাশিত হয়। প্রাচীন যুগে ভারতবর্ষের নৃত্যশিল্পের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নৃত্যের প্রতি সমাজের বিরূপ মনোভাব দেখা গিয়েছিল। প্রাচীন যুগে মন্দিরের বিগ্রহের সামনে অনুষ্ঠিত দেবদাসী নৃত্য ছিল এরকমই এক দৃষ্টান্ত।
- নৃত্যশিল্পের বিবর্তন ও প্রসিদ্ধি – উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক আমলে এবং স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারতীয় নৃত্যশিল্পের পরিবর্তন ঘটে। এর সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যশিল্পের প্রতি সমাজের মনোভাবেরও পরিবর্তন ঘটে-নৃত্যশিল্পের ইতিহাসচর্চায় এই বিষয়গুলি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
- নারীর স্বতন্ত্র ভূমিকা – নারীর সামাজিক অবস্থার কালানুক্রমিক বিবর্তনের চিত্রও ফুটে ওঠে নৃত্যশিল্পের ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে। উনিশ ও বিশ শতকে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলারাও নৃত্যশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন ও অনেকেই নৃত্যকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। নারীর সামাজিক অবস্থানগত এই পরিবর্তন শিল্পচর্চার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।
শিল্পচর্চার ইতিহাসের ক্ষেত্রে নাটক ও চলচ্চিত্রের বিবর্তনের কোন্ পরিচয় পাওয়া যায়?
দৃশ্য ও প্রদর্শনমূলক শিল্পকলা যার মধ্য দিয়ে কথাবার্তা, শিল্প প্রদর্শন, সংগীত ও নৃত্য সব কিছুর সমন্বয় ঘটে, সেই দুটি মাধ্যম হল নাটক ও চলচ্চিত্র। সমসাময়িককালের বিভিন্ন দিককে নাটক ও সিনেমার মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত করা যেতে পারে। ধারাবাহিকতা ও পরিবর্তনের দিকগুলিকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নাটক ও সিনেমার গুরুত্ব যথেষ্ট।
শিল্পচর্চার ইতিহাসের ক্ষেত্রে নাটক –
জীবনকে যেখানে বর্ণনীয় না করে দর্শনীয় করা হয় সেখান থেকেই নাটকের উদ্ভব। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নাটক দেখতে ভালোবাসে এবং নাটকের সকল চরিত্রের মধ্যে নিজেদেরকে প্রত্যক্ষ করে। প্রায় 2000 বছরেরও পূর্ববর্তী সময় থেকে ভারতবর্ষে নাটকের অস্তিত্ব ছিল, অভিনয়ও হত। হেরাসিম লেবেডেফ নামে এক রুশ পর্যটক 1795 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বেঙ্গলি থিয়েটার নামে নাট্যশালায় প্রথম বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করেন। বাংলা নাটকের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হলেন মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আধুনিক যুগের অন্যতম শক্তিশালী নাট্যকার হিসেবে পরিচিত মন্মথ রায়। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নাট্যকারদের অন্যতম হলেন উৎপল দত্ত। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত নাটক হল – ‘টিনের তলোয়ার’, ‘কল্লোল’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘ব্যারিকেড’ ইত্যাদি। আধুনিক বাংলা নাটকের জনপ্রিয় অন্যান্য ব্যক্তিত্বরা হলেন শিশির ভাদুড়ি, শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। ভারতীয় নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে সফদার হাসমি, গিরীশ কারনাড প্রমুখের নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

শিল্পচর্চার ইতিহাসের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র –
বিজ্ঞানের এক মজার আবিষ্কার হিসেবেই চলচ্চিত্রের জন্ম হয়। যুগে যুগে মানুষ গতিকে রূপ দিতে চেয়েছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘ক্যামেরা অবসকিউরা’ আমাদের প্রথম ‘ক্যামেরা’ শব্দটি শোনায়। নিসেফোর নিপসের ফোটোগ্রাফিক ইমেজ থেকে শুরু হয় ক্যামেরা আবিষ্কারের অভিযান। এই পথ ধরেই থমাস আলভা এডিসনের ‘কিনেটোস্কোপ’ ছিল বর্তমানের প্রোজেক্টরের অগ্রজ। লুই এবং অগাস্ত ল্যুমিয়ের হলেন আধুনিক চলচ্চিত্রের স্রষ্টা।

ভারতে হীরালাল সেন প্রথম সিনেমার প্রদর্শন শুরু করেন। প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর নিজস্ব রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি। প্রথম বাংলা ছবি হল বিল্বমঙ্গল। 1931 খ্রিস্টাব্দে জামাইষষ্ঠী চলচ্চিত্র দিয়েই বাংলা সবাক ছবির পথ চলা শুরু হল। বিশ্ববিখ্যাত চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ 1955 খ্রিস্টাব্দে মুক্তিলাভ করে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের শিরোপা লাভ করে। অস্কার বিজয়ী সত্যজিৎ রায় ছাড়াও তপন সিংহ, মৃণাল সেন, ঋত্বিক কুমার ঘটক প্রমুখ ব্যক্তিত্ব বাংলা চলচ্চিত্র ধারাকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।
বর্তমানে শিল্পচর্চার ইতিহাস সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হচ্ছে। এক্ষেত্রে কপিল বাৎসায়নের ‘ভারতের নাট্য ঐতিহ্য’, শিশির বসুর ‘একশো বছরের বাংলা থিয়েটার’, রজতকান্ত রায়ের ‘এক্সপ্লোরিং ইমোশনাল হিস্ট্রি’ (Exploring Emotional History) প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করো।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসের ভূমিকা –
খাদ্যাভ্যাসের মতো মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদও তার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রধানত ভৌগোলিক পরিবেশ দ্বারাই মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ শীতপ্রধান দেশ এবং গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ স্বাভাবিকভাবেই আলাদা হয়। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একই অঞ্চলের মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদেও নানান বদল আসতে পারে। ঐতিহাসিকের কাজ এই পরিবর্তনগুলি চিহ্নিত করা এবং তার কারণ ব্যাখ্যা করা। পোশাক-পরিচ্ছদের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক, ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় বলে পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চা –
- পোশাক নিয়ে ইতিহাসচর্চার উদ্দেশ্যে 1991 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে দি অ্যাসোসিয়েশন অফ ড্রেস হিস্টোরিয়ানস (The Association of Dress Historians) প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ষোড়শ শতকে জার্মানির অগসবার্গ শহরের এক হিসাবরক্ষক ম্যাথেউস সোয়ার্জ প্রথম অনেক পোশাকের ছবি সংবলিত একটি বই প্রকাশ করেন। এটি ‘ফ্যাশন’ সম্পর্কিত ধারণার বিশেষ সহায়ক। মলয় রায়ের লেখা ‘বাঙালির বেশবাস, বিবর্তনের রূপরেখা’ গ্রন্থে বাঙালিদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও তার বিবর্তন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে।
- কর্নেল ডালটন ভারতীয় পোশাকের নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন।
- এমা টারলো-র লেখা ‘ক্লোথিং ম্যাটারস : ড্রেস অ্যান্ড আইডেনটিটি ইন ইন্ডিয়া’ (Clothing Matters : Dress And Identity in India) পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।

আধুনিক ইতিহাসচর্চায় পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্য –
- ধনী-দরিদ্র সম্পর্কে ধারণা – পোশাক-পরিচ্ছদ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা চিহ্নিত করে। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে রাজা, জমিদার, ধনী ও বিশেষ পদাধিকারী ব্যক্তিরা বিশেষ জমকালো পোশাক পরতেন; তুলনায় দরিদ্র মানুষের পোশাক হত সাদামাটা ও আড়ম্বরহীন।
- ভৌগোলিক অবস্থান – শীতপ্রধান দেশের মানুষ যে ধরনের গরম কাপড়ের বা পশমের পোশাক পরে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষ তা পরে না।
- রক্ষণশীলতা ও প্রগতিশীলতা সম্পর্কে ধারণা – সমাজে নারী ও পুরুষের পোশাক-পরিচ্ছদ ভিন্ন ভিন্ন হয়। নারী-পুরুষের পোশাকের বৈচিত্র্য দেখে সমাজ রক্ষণশীল না প্রগতিশীল, সমাজে লিঙ্গবৈষম্য আছে কি নেই, সে সম্পর্কে ধারণা করা যায়। সমাজে নারীর স্বাধীনতা বিষয়ে জানা যায়।
- পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব – ব্রিটিশ আমলে ভারতে কোট, প্যান্ট-সহ বিভিন্ন বিলিতি পোশাকের আমদানি হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক বাঙালি ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে কোট, প্যান্ট পরা শুরু করে।
- জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব – ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাত্মা গান্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেশজ খাদি পোশাক পরিধানের কথা বলেন। এই সময়ে তাঁর অনুগামীরা ‘গান্ধি টুপি’ নামে এক বিশেষ ধরনের টুপি ব্যবহার করত। কংগ্রেস নেতারা ‘জহর কোট’ নামে এক ধরনের কোট পরতেন।

আধুনিক ইতিহাসচর্চায় পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসের উপসংহার –
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে পোশাক-পরিচ্ছদেরও বিশ্বায়ন ঘটেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ তার পছন্দমতো পোশাক পরতে পারে। তবে এর পাশাপাশি ঐতিহ্যগত পোশাক-পরিচ্ছদও সামাজিক ও ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
সাম্প্রতিককালে পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার প্রয়োজনীয়তা কী?
সাম্প্রতিককালে পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার প্রয়োজনীয়তার ভূমিকা –
খেলাধুলা, শিল্পকলা, খাদ্যাভ্যাসের মতোই পোশাক-পরিচ্ছদ মানবসমাজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত মানবসমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সংগতি বজায় রেখে পোশাক-পরিচ্ছদের পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে।
পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার প্রয়োজনীয়তা –
পোশাক-পরিচ্ছদের মাধ্যমে মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামরিক, ভৌগোলিক বিষয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। তাই পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চা সাম্প্রতিককালে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে।
- অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা – পোশাক-পরিচ্ছদ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা চিহ্নিত করে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে রাজা, জমিদার, ধনী ব্যক্তিরা বিশেষ জমকালো পোশাক পরতেন, তুলনায় দরিদ্র মানুষের পোশাক হত আড়ম্বরহীন। এ থেকে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা ইতিহাসচর্চায় সাহায্য করে।
- রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা – পোশাক-পরিচ্ছদের মাধ্যমে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কেও সূক্ষ্ম ধারণা পাওয়া যায়। যেমন – ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধি দেশবাসীকে দেশীয় খাদি পোশাক পরিধানের কথা বলেন। এ থেকে ঔপনিবেশিকতা বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থার কথা জানা যায়।
- সামাজিক পরিস্থিতি – পুরুষ ও নারীর পোশাকের বৈচিত্র্য সমাজে রক্ষণশীলতা বা প্রগতিশীলতা, লিঙ্গবৈষম্য আছে কি না প্রভৃতি জানতে সাহায্য করে। এ ছাড়া সমাজে নারীর অবস্থান কিরূপ সে বিষয়েও জানা যায়। সামাজিক ইতিহাসচর্চার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
- পৃথক সমাজ ও সভ্যতার প্রভাব – পোশাক-পরিচ্ছদের উপর বহির্জগতের কোনো সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবও সাম্প্রতিককালের ইতিহাসচর্চায় বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। যেমন – ভারতে ব্রিটিশ আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক বাঙালি ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে কোট, প্যান্ট পরা শুরু করে।
পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
এইভাবে পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চা থেকে কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অবস্থার স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়, যা সাম্প্রতিককালের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসের ভূমিকা –
মানবসভ্যতার সঙ্গে যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবসভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটে চলেছে। মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই স্থলপথ ও জলপথে বিভিন্ন যানবাহনের মাধ্যমে দূরের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছে। আধুনিক যুগে আকাশযান ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ আরও দ্রুতগামী হয়েছে। সমাজ ও অর্থনীতির উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত হল – উন্নত যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাই যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চা ইতিহাসের অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় যোগাযোগ ও যানবাহনের ইতিহাসচর্চা –
আধুনিক যুগে যোগাযোগ ও যানবাহনের ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছে। যোগাযোগ ও যানবাহনের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল – সুনীলকুমার মুন্সির লেখা ‘জিওগ্রাফি অফ ট্রান্সপোর্টেশন ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া আন্ডার ব্রিটিশ রাজ’ (Geography of Transportation in Eastern India Under British Raj), নীতিন সিনহার লেখা ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিষয়ক গ্রন্থ এবং ইয়ান কের -এর লেখা ‘ইঞ্জিনস অফ চেঞ্জ : দ্য রেলরোডস দ্যাট মেড ইন্ডিয়া’ (Engines of Change : The Railroads That Made India) প্রভৃতি।
ইতিহাসের ধারায় যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশ –
- প্রাচীন ও মধ্যযুগে স্থলপথ ও জলপথে বিভিন্ন যানবাহনের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিচালিত হত। তখন স্থলপথে যানবাহন ছিল হাতি, ঘোড়া, গাধা, উট, গোরু, মোষ ও পশুতে টানা গাড়ি। অনেক জায়গায় মানুষ ডুলি ও পালকির ব্যবহার করত।
- জলপথে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ভেলা, ডিঙি ও নৌকা। সম্রাট শের শাহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সড়ক-ই-আজম বা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নির্মাণ করেন।
- আধুনিক যুগে ইঞ্জিনের আবিষ্কারের পর ট্রেন, ট্রাম, বাস প্রভৃতির ব্যবহার শুরু হয়। 1853 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ডালহৌসির আমলে ভারতে প্রথম রেল যোগাযোগ শুরু হয়।
- 1849 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1869 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে রেলপথ নির্মাণে ‘গ্যারান্টি ব্যবস্থা’ চালু করা হয়। এতে সরকার রেল কোম্পানিগুলিকে বিনামূল্যে জমি ও বার্ষিক 5% হারে সুদ দিতে রাজি হয়। এই অর্থ ভারতীয় রাজস্ব থেকে খরচ করা হত। রেলপথ নির্মাণ সাম্রাজ্যবাদী শোষণের আরও একটি দিককে পরিস্ফুট করে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসের উপসংহার –
যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস আধুনিক ইতিহাসচর্চায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। কারণ – যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে মানবসভ্যতার সার্বিক উন্নয়ন জড়িত। বর্তমানে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক ভিন্ন ধরনের বিপ্লব ঘটিয়েছে।
যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব কী?
যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চার গুরুত্বের ভূমিকা –
মানবসভ্যতার উন্নতির সঙ্গে যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। প্রাচীন ও মধ্যযুগে জলপথ ও স্থলপথে বিভিন্ন যানবাহনের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিচালিত হত। এরপর আধুনিক যুগে ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নতি হয়। যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস আধুনিক ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব –
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মানবসভ্যতার উন্নতির ক্রমবিবর্তনের ধারা এর মাধ্যমে জানা যায়।
- দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা – যানবাহন ও যোগাযোগের ইতিহাস থেকে একটি দেশের অর্থনীতি, ব্যাবসাবাণিজ্য সম্পর্কে জানা যায়। প্রকৃতপক্ষে উন্নত যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা মানবসমাজের উন্নতির পরিচয় বহন করে।
- প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা – যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস থেকে যানবাহন ও যোগাযোগের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
- জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ – যানবাহন ও যোগাযোগ -এর ইতিহাসচর্চা জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশেও সাহায্য করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার মানুষের জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধির সহায়ক। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ভারতে রেলপথের প্রবর্তন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
- ভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধন – যোগাযোগ ব্যবস্থার বিস্তারের ফলে দেশের এক প্রান্তের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য প্রান্তের সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচয় ঘটে এবং এই ভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধন মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
এভাবেই যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস আধুনিক ইতিহাসকে এক নতুন মাত্রা প্রদান করে।
কাকে ‘ভারতীয় রেলপথের জনক’ বলা হয়?
লর্ড ডালহৌসিকে ‘ভারতীয় রেলপথের জনক’ বলা হয়।
কবে এবং কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত ভারতের সর্বপ্রথম রেলপথ চালু হয়েছিল?
1853 খ্রিস্টাব্দের 16 এপ্রিল সর্বপ্রথম বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত 21 মাইল পথে রেল যোগাযোগ চালু হয়।
1854 খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া রেল কোম্পানি (EIR) ভারতের কোন দুটি স্থানের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপন করে?
হাওড়া থেকে পান্ডুয়া পর্যন্ত।
1855 খ্রিস্টাব্দের 3 ফেব্রুয়ারি হাওড়া থেকে ভারতের কোন স্থানের মধ্যে রেলপথ সম্প্রসারিত হয়?
রানিগঞ্জ পর্যন্ত।
আধুনিক ইতিহাসে দৃশ্যশিল্পের ইতিহাসচর্চা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
দৃশ্যশিল্প থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান পাওয়া যায়। ফলে দৃশ্যশিল্প বর্তমানে ইতিহাসচর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দৃশ্যশিল্প নিয়ে নানা গবেষণা শুরু হয়েছে।
দৃশ্যশিল্প কী? –
দৃশ্যশিল্প বলতে অনেক কিছু বোঝায়। যেমন – পোড়ামাটির ভাস্কর্য, হাতে আঁকা ছবি, কাঠ বা পাথরের উপর খোদাই করা চিত্র, এমনকি সুন্দরভাবে তৈরি বাড়িঘর, মন্দির, মসজিদ প্রভৃতি স্থাপত্যও এর অন্তর্ভুক্ত। কোনো ঘটনা বা ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ মুহূর্তের আলোকচিত্র ক্যামেরাবন্দি করা হলে সেই ঘটনা বা ব্যক্তির উপস্থিতির ঐতিহাসিক প্রমাণ হয়ে ওঠে সেই আলোকচিত্রটি। ফোটোগ্রাফিও বর্তমানে দৃশ্যশিল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

দৃশ্যশিল্পের ইতিহাসচর্চা –
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে দৃশ্যশিল্পগুলির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্যের মতো ভারতেও দৃশ্যশিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এক্ষেত্রে ই বি হ্যাভেল এবং এ কে কুমারস্বামী হলেন দুজন বিখ্যাত গবেষক। তাঁরা কলকাতা আর্ট কলেজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ওকাকুরা, নন্দলাল বসু, ভগিনী নিবেদিতা এই শিল্পের বিকাশে বিশেষ অবদান রাখেন। এই শিল্পকলা সম্বন্ধে লেখা কয়েকটি গ্রন্থ হল – বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ‘চিত্রকথা’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’, আনন্দ কুমারস্বামীর লেখা ‘দ্য ট্রান্সফরমেশন অফ নেচার ইন আর্ট’ (The Transformation of Nature in Art) প্রভৃতি। এমনকি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় বঙ্গীয় কলা সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয় 1905 খ্রিস্টাব্দে।

ভারতে 1850 -এর দশকে ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু হয়। 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ছবি তোলার জন্য ইউরোপীয় ফোটোগ্রাফাররা এদেশে আসেন ও বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি তুলে রাখেন।
ভারতীয় ইতিহাসের ধারায় আঁকা ছবি ও ফোটোগ্রাফি –
প্রাচীনকাল থেকে আঁকা ছবি ভারতীয় ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
- ভারতের মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকার গুহাচিত্রগুলিতে মানুষের শিকারের দৃশ্য দেখে তাদের জীবনযাত্রার ধারণা পাওয়া যায়।
- মেহেরগড় ও হরপ্পা সভ্যতার মানুষের হাতে আঁকা ছবি থেকে সেই সময়ের বিভিন্ন ইতিহাস জানতে পারা যায়।
- মৌর্য, গুপ্ত বা তার পরবর্তীকালের বিভিন্ন ছবি সমকালীন ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়েছে। অজন্তা, ইলোরা প্রভৃতি গুহাচিত্রগুলি ইতিহাসের উপাদান হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- সুলতানি ও মুঘল আমলেও অনেক চিত্রশিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন শাসককুল। মুঘল আমলে চিত্রশিল্প কারখানার উল্লেখ পাওয়া যায়।
- ব্রিটিশ আমলে চিত্রশিল্পীরা যেমন বাঙালি বাবু, ব্রিটিশ সাহেব, মেম প্রমুখের ছবি এঁকেছেন তেমনি তার পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারবিরোধী অনেক ব্যঙ্গচিত্রও আঁকা হয়েছে।
- স্বদেশি আমলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলিতে ভারতমাতা ছবিটি জাতীয়তাবোধ জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
- 1850 -এর দশকের পর ক্যামেরার মাধ্যমে বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্ত তুলে ধরা হয়েছে, যা আঁকা ছবির থেকেও আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
ভারতীয় ইতিহাসের ধারায় আঁকা ছবি ও ফোটোগ্রাফির গুরুত্ব –
দৃশ্যশিল্প বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
- ভারতীয় শিল্পকলার ধর্মীয় অনুষঙ্গ, নব্য ভারতীয় চিত্ররীতির উদ্ভব ও বিকাশের কথা দৃশ্যশিল্পের ইতিহাস থেকে জানা যায়।
- দৃশ্যশিল্প থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান পাওয়া যায়, শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি, রুচিবোধ ও সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। বিভিন্ন সময়ের পোশাক-পরিচ্ছদ ও সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ফোটোগ্রাফির গুরুত্ব কী?
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ফোটোগ্রাফির ভূমিকা –
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ফোটোগ্রাফি বা আলোকচিত্র। 1850 -এর দশকে ভারতে ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু হয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্ত তুলে ধরে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে ফোটোগ্রাফির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ফোটোগ্রাফির গুরুত্ব –
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ফোটোগ্রাফির গুরুত্ব অপরিসীম। যথা –
- ঐতিহাসিক তথ্য প্রদান – ফোটোগ্রাফির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ছবিকে ক্যামেরাবন্দি করা সম্ভব। কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা বিখ্যাত ব্যক্তি প্রভৃতি আলোকচিত্র থেকে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসংগ্রহ করা যায়। যেমন – 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ছবি তোলার জন্য ইউরোপীয় ফোটোগ্রাফাররা ভারতে আসে ও বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি তুলে রাখে।
- অবিকৃত তথ্য – ফোটোগ্রাফি থেকে অবিকৃত তথ্য পাওয়া যায় বলে আধুনিক গবেষকগণের কাছেও এইগুলি তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে বিবেচিত হয়।
- ঐতিহাসিক তথ্যের গুরুত্ব প্রকাশ – কোনো নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ হিসেবে ফোটোগ্রাফির গুরুত্ব অপরিসীম। উদাহরণ হিসেবে – 1946 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রমাণস্বরূপ ফোটোগ্রাফির ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ফোটোগ্রাফির সাবধানতা অবলম্বন –
তবে আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে ফোটোগ্রাফ ব্যবহারের সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কারণ বহুক্ষেত্রেই কোনো প্রকৃত ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয়ের ছবি তোলা হয়। সেক্ষেত্রে উক্ত ঘটনার প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্যতা অন্তরালে থেকে যায় এবং মানুষের কাছে বিকৃত তথ্য উপস্থাপিত হয়। তাই এক্ষেত্রে সচেতনতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
দৃশ্যশিল্পের ইতিহাসকে কেন নিরপেক্ষ উপাদান বলে ধরা হয়? এই ইতিহাসচর্চা কীভাবে আধুনিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে?
দৃশ্যশিল্পের ইতিহাসের ভূমিকা –
ইতিহাসচর্চা ও ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদানের প্রয়োজন হয়। এইসব উপাদানগুলি দু-ধরনের – প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। দৃশ্যশিল্প হল প্রত্যক্ষ উপাদান। এই উপাদান নিরপেক্ষ। এই উপাদান আধুনিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
দৃশ্যশিল্প – নিরপেক্ষ উপাদান –
আমরা যা দেখতে পাই সেই দৃশ্যমান বিষয় যদি দৃষ্টিনন্দন হয় তখন তা আমাদের মনে আবেগ ও অনুভূতির সৃষ্টি করে। এই অনুভূতি যখন ছবি আঁকার মাধ্যমে ফুটে ওঠে, তখন তা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছোয়। সৃষ্টি হয় দৃশ্যশিল্প। এই দৃশ্যশিল্প ইতিহাসচর্চার একটি নিরপেক্ষ উপাদান।
- অবিকৃত – এই শিল্পটি (ছবি আঁকা) সৃষ্টিকাল থেকে শুরু করে অবিকৃত অবস্থায় আমরা পেয়ে থাকি। পরবর্তীকালে এর আর সেই অর্থে কোনো প্রক্ষেপণ বা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
- সমকালীন প্রতিচ্ছবি – পাথর বা ধাতুর পাত, মাটি বা কাগজের উপর আঁকা ছবিগুলি থেকে আমরা সমকালীন জীবনধারার প্রতিচ্ছবি পাই। আলোকচিত্র সম্বন্ধেও এ কথা প্রযোজ্য।
দৃশ্যশিল্প – আধুনিক ইতিহাস –
আধুনিক ইতিহাস চলমান সমাজের প্রতিচ্ছবি। মানুষের চলার পথে পায়ের ছাপ -এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার চিত্র ইতিহাসের আকর উপাদান।
- লোকায়ত চিত্র – সাধারণ মানুষ মনের অনুভূতি ও কল্পনা চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিল। বিভিন্ন মাধ্যমের চিত্রে তার নমুনা দেখা যায়।
- বিদেশি প্রভাবে প্রভাবিত চিত্র – প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক কারণে এই যোগাযোগ ঘটেছিল। এই সূত্রে বিদেশি প্রভাব ভারতে পড়েছিল। এই অনুষঙ্গ ও প্রভাব আধুনিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- পরিপূরক উপাদান – চিত্রশিল্পের মাধ্যমে শিল্পী তাঁর সমকালীন সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে পারে। ইতিহাসচর্চায় যখন উপাদানের অভাব হয় তখন পরিপূরক উপাদান হিসেবে চিত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
- প্রামাণ্য দলিল – বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য, চিত্র এবং ফোটোগ্রাফি হল ইতিহাসচর্চার প্রামাণ্য দলিল। এগুলি আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি পারিবারিক বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্যসরবরাহ করে।
- ঐতিহ্যের ধারক – দৃশ্যশিল্প আঞ্চলিক ও সর্বজনীন – এই দুই ধরনের হয়। আঞ্চলিক শিল্পগুলি সেখানকার ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে।
দৃশ্যশিল্পের ইতিহাসের মন্তব্য –
দৃশ্যশিল্প সুদূর অতীত থেকে বর্তমানকালের বিভিন্ন ঘটনার খণ্ড খণ্ড মুহূর্তকে জীবন্ত করে রেখেছে। এগুলি মানুষের কথা, তাদের মননের কথা, বিভিন্ন ঘটনার কথা বলে। এইভাবে এগুলি আধুনিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় স্থাপত্যের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় স্থাপত্যের ভূমিকা –
স্থাপত্যের ইতিহাসচর্চা ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। স্থাপত্যের ইতিহাস থেকে সমকালীন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পকলা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। স্থাপত্যের ইতিহাস থেকে ইতিহাসের বিবর্তনের ধারাও পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
স্থাপত্যের ইতিহাসচর্চা –
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনেকাংশে স্থাপত্যের ইতিহাসচর্চার উপর নির্ভরশীল। তাই স্থাপত্যের ইতিহাসচর্চা অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। মেহেরগড় সভ্যতা ও হরপ্পা সভ্যতার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে স্থাপত্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। স্থাপত্যের ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন আলেকজান্ডার কানিংহাম, জেমস ফার্গুসন, জন মার্শাল প্রমুখ।
বাংলার বিভিন্ন স্থাপত্য নিয়ে গবেষণা করেছেন দেবলা মিত্র, সরসীকুমার সরস্বতী, হিতেশরঞ্জন সান্যাল প্রমুখ। ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপত্য সংরক্ষণে ও গবেষণায় বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ভারতের ইতিহাসে স্থাপত্যের ধারা –
- প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের মেহেরগড় সভ্যতা ও হরপ্পা সভ্যতার ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে স্থাপত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- পরবর্তীকালেও মৌর্য, কুষাণ, গুপ্ত, সাতবাহন, পাল, সেন আমলের স্থাপত্যের নির্দশন আজও দেখতে পাওয়া যায়।
- সুলতানি ও মুঘল যুগে ভারতে স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। স্যার জন মার্শালের মতে, হিন্দু ও মুসলিম প্রতিভার সংমিশ্রণে সুলতানি যুগের স্থাপত্যের উদ্ভব হয়েছে। সুলতানি যুগের স্থাপত্যশিল্পের প্রধান প্রধান নিদর্শন হল কুতুবমিনার”, আলাই দরওয়াজা, ফিরোজাবাদের প্রাসাদ ও দুর্গ প্রভৃতি।
- মুঘল যুগের স্থাপত্যরীতি হল ‘ইন্দো-পারসিক’ শিল্পরীতি। মুঘল যুগের স্থাপত্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – লালকেল্লা, তাজমহল, জামি মসজিদ, বুলন্দ দরওয়াজা প্রভৃতি।
- ব্রিটিশ আমলে নির্মিত শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যগুলি হল – কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, মাদ্রাজের সেন্ট ফোর্ট জর্জ ইত্যাদি।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় স্থাপত্যের উপসংহার –
স্থাপত্যের ইতিহাস ইতিহাসচর্চার একটি প্রতিষ্ঠিত ক্ষেত্র। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের ইতিহাসে স্থাপত্যের সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ করা যায়। স্থাপত্যের ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে নির্মাণ ও প্রযুক্তির কথাও জানা যায়।
স্থাপত্যের ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য কী?
অথবা, স্থাপত্যের ইতিহাস কেন গুরুত্বপূর্ণ?
অথবা, স্থাপত্যকর্মের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?
মানবসভ্যতার অগ্রগতির পথে একটি দিকচিহ্ন হল স্থাপত্য। আদিম মানুষ প্রথমে বনেজঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায়, গাছের ডালে বাস করত। তারপর ডালপালা, মাটি, ইট, পাথর দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করতে শেখে। গড়ে তোলে প্রাসাদ, অট্টালিকা; তৈরি করে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, সমাধি।
স্থাপত্যের ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য –
স্থাপত্য কাঠামো বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এই ভিন্নতার জন্য স্থাপত্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। তা হল –
- ধর্মস্থান – মানুষ ধর্মীয় উপাসনা করতে শেখার কিছুকাল পর থেকে ধর্মস্থান তৈরি করে। এগুলি ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে তৈরি হত।
- প্রাসাদ – শাসকশ্রেণি বা সমাজের ধনীশ্রেণি বসবাসের জন্য অট্টালিকা বা প্রাসাদ তৈরি করে। এই স্থাপত্যকাঠামো ইট দিয়ে তৈরি এবং দ্বিতল বা ত্রিতলবিশিষ্ট ছিল।
- স্মৃতিসৌধ – কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির স্মৃতিতে বা ধর্মীয় কারণে বা সামরিক প্রয়োজনে স্মৃতিসৌধ বা মিনার তৈরি হয়। এই স্থাপত্যগুলিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল অর্থাৎ ইট, কাঠ, পাথর, মাটি, চুন, বালি, সুরকি প্রভৃতি থেকে স্থাপত্যের কাঠামো সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। স্থাপত্যে পলেস্তারা, মেঝে, কারুকার্য ছিল কি না তা থেকে স্থাপত্যশিল্পের প্রগতি বা নিকৃষ্টতা সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। স্থাপত্যের উচ্চতা উন্নত নির্মাণশৈলীর পরিচয়বাহী। সিঁড়ি, খিলান, স্তম্ভ, গম্বুজ, মিনার প্রভৃতিও উন্নত স্থাপত্যবিদ্যার প্রমাণ।

স্থাপত্যের মাধ্যমে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের পরিচয় –
আপাতদৃষ্টিতে স্থাপত্য একটি নান্দনিক বিষয় হিসেবে মনে হলেও ভালোভাবে পর্যালোচনা করলে এগুলির মধ্য থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের নানান উপাদান পাওয়া যেতে পারে। প্রথমত, কারা কী উদ্দেশ্যে স্থাপত্যগুলি নির্মাণ করেছিল তা জানতে পারলে স্থাপত্যকীর্তির প্রয়োজনীয়তা বা উপযোগিতার দিকটি সম্পর্কেও জানা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, স্থাপত্যকীর্তিগুলি থেকে পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে জানা যায়। পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে জানতে পারলে সংশ্লিষ্ট সময়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে সামাজিক সচলতার বিষয়টিও অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে পারা যায়। চতুর্থত, স্থাপত্যরীতির পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের বিষয়টি পরিস্ফুট হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যেতে পারে যে, সুলতানি যুগে ইসলামিক ও ভারতীয় শিল্পরীতির উদ্যোগে যে শিল্পরীতি গড়ে উঠেছিল, সেটি ইন্দো-ইসলামিক শিল্পরীতি নামে পরিচিত।
কুতুবমিনারের স্তম্ভকে কে ‘বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও নিখুঁত স্তম্ভ’ বলে বর্ণনা করেছিলেন?
কুতুবমিনারের স্তম্ভকে জেমস ফার্গুসন ‘বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও নিখুঁত স্তম্ভ’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
জেমস ফার্গুসনের মতে, কোন স্থাপত্য সৌধ এত মহিমময় যে, যার তুলনা বিশ্বে নেই এবং যা স্থাপত্যশিল্প সম্পর্কে উদাসীন ব্যক্তিকেও সচেতন করে তোলে?
জেমস ফার্গুসনের মতে, তাজমহল স্থাপত্য সৌধ এত মহিমময় যে, যার তুলনা বিশ্বে নেই এবং যা স্থাপত্যশিল্প সম্পর্কে উদাসীন ব্যক্তিকেও সচেতন করে তোলে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় স্থানীয় ইতিহাসচর্চা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, স্থানীয় ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব লেখো।
স্থানীয় ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
ইতিহাস হল মানুষের কথা। ইতিহাসের নানান প্রকারভেদ আছে, যথা – আন্তর্জাতিক ইতিহাস, জাতীয় ইতিহাস ও আঞ্চলিক বা স্থানীয় ইতিহাস। কোনো নির্দিষ্ট স্থানের নিজস্ব ইতিহাসকে স্থানীয় ইতিহাস বলা হয়। কোনো স্থানের প্রাচীন স্থাপত্য, লোককাহিনি, লোকসংস্কৃতি, জনগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি নানান বিষয় নিয়ে স্থানীয় ইতিহাস গড়ে ওঠে। আধুনিক ইতিহাসচর্চায় স্থানীয় ইতিহাসের চর্চা বর্তমানে তাই বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে।
স্থানীয় ইতিহাসচর্চার প্রকৃতি –
স্থানীয় ইতিহাস সাধারণত অল্প পরিসরের হয়ে থাকে। একটি অঞ্চলের অবস্থান, তার ভূপ্রকৃতি, জনবসতি, পেশা, জনগোষ্ঠী, অতীত ঐতিহ্য, বিভিন্ন রাজবংশের রাজত্বকাল, বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে জনশ্রুতি, কাহিনি, কিংবদন্তি স্থানীয় ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়। এইসব উপাদান ব্যবহার করে অপেশাদার ইতিহাসবিদ বা ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহী কোনো ব্যক্তি তার স্থানীয় এলাকার ইতিহাস রচনায় উদ্যোগী হন। এই ধরনের স্থানীয় ইতিহাসে অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও এগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
স্থানীয় ইতিহাসচর্চার ধারা –
প্রাচীনকাল থেকে স্থানীয় ইতিহাসচর্চার ঐতিহ্য লক্ষ করা যায়। প্রাচীন ভারতে স্থানীয় ইতিহাসের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল কলহন রচিত রাজতরঙ্গিনী, যা থেকে সপ্তম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত কাশ্মীরের ইতিহাস জানা যায়। মেরুতুঙ্গের প্রবন্ধ চিন্তামণি থেকে গুজরাটের ইতিহাস জানা যায়। এ ছাড়া সিন্ধু, নেপাল ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাসও লেখা হয়েছে।
- আধুনিক যুগে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বাংলার ইতিহাস ও নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা বাঙালির ইতিহাস বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রামাণ্য গ্রন্থ।
- ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় ইতিহাসচর্চায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সেসময় ‘ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার’ প্রকাশ করা হয়।
- আধুনিক যুগে স্থানীয় ইতিহাসচর্চায় জেলা, ব্লক বা গ্রামের ইতিহাস নিয়েও চর্চা লক্ষ করা যায়। জেলার ইতিহাস গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম হল – পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, বর্ধমান, হুগলি, নদিয়া, মুরশিদাবাদ, মালদহ-সহ প্রতিটি জেলার ইতিহাস।
- পশ্চিমবঙ্গের প্রতি জেলায় বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সংগঠন ও স্থানীয় গবেষকগণ প্রতিনিয়ত গবেষণা করে চলেছেন। বিভিন্ন স্থানীয় পত্রপত্রিকা স্থানীয় ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
স্থানীয় ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব –
আঞ্চলিক বা স্থানীয় ইতিহাস বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
- প্রামাণ্য ইতিহাসে সব জায়গার পরিচিতি থাকে না। গুরুত্ব বেশি না থাকলে বা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা না ঘটলে সেই স্থানের বিবরণ থাকে না। সেই ক্ষেত্রে স্থানীয় ইতিহাস এই অভাব পূরণ করে।
- জাতীয় স্তরের ইতিহাস রচনার সময়ে অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় ইতিহাসকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- স্থানীয় ইতিহাস, স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত চালচিত্র তুলে ধরে।
- স্থানীয় ইতিহাস সেই অঞ্চলের রাজনৈতিক উত্থান পতনের দীর্ঘ কাহিনির পরিচয় দেয়।
- স্থানীয় ইতিহাসের মাধ্যমে সেই স্থানের জনগোষ্ঠীর ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়।
স্থানীয় ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
বর্তমানে স্থানীয় ইতিহাসচর্চার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। জাতীয় ইতিহাস হল আসলে স্থানীয় ইতিহাসের সমষ্টি। তাই স্থানীয় ইতিহাসের চর্চা জাতীয় ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে।
রাজতরঙ্গিনী কী?
রাজতরঙ্গিনী হল প্রাচীন ভারতের একমাত্র গ্রন্থ যাকে যথার্থভাবে ইতিহাস গ্রন্থ বলা যায়। তা ছাড়া প্রাচীন ভারতে রচিত আঞ্চলিক ইতিহাসগুলির মধ্যে অন্যতম হল- সোমেশ্বর রচিত ‘রাসমালা’, ‘কীর্তিকৌমুদী’, অরিসিংহের লেখা ‘সুকৃতি সংকীর্তন’ প্রভৃতি।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শহরের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শহরের ইতিহাসের ভূমিকা –
শহর বলতে বোঝায় ছোটো বা বড়ো নগরকে। শহরের ইতিহাসচর্চা বলতে বোঝায় শহরের সৃষ্টির কথা, ভৌগোলিক অবস্থান, স্থাপত্য, সংস্কৃতি, ব্যাবসাবাণিজ্য, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শহরের ইতিহাসের প্রকৃতি –
শহরের ইতিহাস সাধারণত অল্প পরিসরের হয়ে থাকে। এই ধরনের ইতিহাস মূলত শহরের উৎপত্তি, ঐতিহাসিক প্রকৃতি এবং বিস্তৃতি ও নগরায়ণ প্রক্রিয়া প্রভৃতি বিষয় নিয়ে লেখা হয়। এ কাজে শহরের স্থাপত্য, শহুরে সমাজ, তার ভৌগোলিক অবস্থান, ব্যাবসাবাণিজ্য, শিল্পকারখানা প্রভৃতি উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শহরের বিবর্তন, বিস্তৃতি ও নগরায়ণ হয়ে ওঠে আলোচ্য বিষয়। এ ছাড়া এর সঙ্গে নাগরিক সমাজের কথাও উঠে আসে।
শহরের ইতিহাসচর্চা –
পৃথিবীর সর্বত্র শহরের ইতিহাস লেখা হয়েছে। 1960 -এর দশকে নতুন ধারায় শহরের ইতিহাস রচনা শুরু হয়। শহরের ইতিহাস রচনার জন্য ইংল্যান্ডের লিসেস্টার ইউনিভার্সিটিতে শহরের ইতিহাসচর্চা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। ঐতিহাসিক ব্যারি হেন্স -এর উদ্যোগে ইউরোপের শহরগুলির ইতিহাস রচিত হয়। চার্লস টিলি এবং ডব্লু ব্লকম্যান রচিত ‘সিটিস অ্যান্ড দ্য রাইজ অফ স্টেটস ইন ইউরোপ’ (Cities The Rise of States in Europe) গ্রন্থটিও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

ভারতের শহরগুলির ইতিহাস নিয়ে রচিত গ্রন্থগুলি হল – ডঃ দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর লেখা ‘দি আর্কিওলজি অফ এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান সিটিস’ (The Archaeology of Ancient Indian Cities), ডঃ অনিরুদ্ধ রায় রচিত ‘মধ্যযুগের নগর’ ইত্যাদি। তা ছাড়া মুম্বাই শহরের ইতিহাস লিখেছেন জিম গর্ডন, ক্রিস্টিন ডবিন প্রমুখ। আহমেদাবাদ শহরের ইতিহাস লিখেছেন কেনেথ গিলিয়ন, দিল্লি শহরের ইতিহাস লিখেছেন নারায়ণী গুপ্ত, লখনউ শহরের ইতিহাস লিখেছেন রীনা ওল্ডেনবার্গ।
ভারতের শহর –
ভারতে বিভিন্ন কারণে শহরের উদ্ভব হয়। যেমন – রাজধানী, তীর্থস্থান, ব্যাবসাবাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আধুনিক যুগে শিল্প ও কলকারখানাকে কেন্দ্র করেও ভারতে বিভিন্ন শহরের উদ্ভব ও বিকাশ হয়।
- প্রাচীন ভারতের হরপ্পা সভ্যতায় নগর বা শহরের উদ্ভব হয়েছিল। একে প্রথম নগরায়ণ বলা হয়। হরপ্পা ও মহেনজোদারো ছিল এই সভ্যতার প্রধান শহর।
- ভারতে গঙ্গানদীর উপত্যকা অঞ্চলে দ্বিতীয় নগরায়ণ হয়েছিল। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত শহরগুলি হল – রাজগৃহ, পাটলিপুত্র, বারাণসী, হস্তিনাপুর, মথুরা, বুদ্ধগয়া, সাঁচি, সারনাথ, নালন্দা ইত্যাদি।
- মধ্যযুগে ভারতে গড়ে ওঠা শহরগুলির মধ্যে প্রধান হল – দিল্লি, আগ্রা, মুরশিদাবাদ, দৌলতাবাদ, হায়দরাবাদ প্রভৃতি।
- আধুনিক যুগে ব্রিটিশ আমলে কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, পন্ডিচেরি প্রভৃতি শহরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শহরের গুরুত্ব –
শহরের ইতিহাস আধুনিক ইতিহাসচর্চার একটি অঙ্গ। এই ধরনের ইতিহাস শহর-নগরের বিবর্তন প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। স্থানীয় ইতিহাসের মতো শহরের ইতিহাস জাতীয় ইতিহাসের তথ্যের ঘাটতি পূরণ করে। এই ইতিহাস শহরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শহরের উপসংহার –
শহরকেন্দ্রিক সভ্যতা হল সভ্যতার উন্নয়নের একটি বিশেষ নিদর্শন। প্রাচীন ভারতে হরপ্পা সভ্যতায় শহরের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল। মধ্যযুগে শহরের বিস্তার ঘটলেও আধুনিক যুগে সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শহরের ব্যাপক প্রসার ও উন্নয়ন ঘটে চলেছে।
শহরের ইতিহাসচর্চার বিষয়টি উল্লেখ করে কলকাতার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো।
শহরের ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় শহরের ইতিহাস একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। শহরের উৎপত্তির ইতিহাস, তার ভৌগোলিক অবস্থান, ব্যাবসাবাণিজ্য, রাজনৈতিক ভূমিকা প্রভৃতি সম্পর্কে তথ্যবহুল আলোচনাই হল শহরের ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
শহরের ইতিহাসচর্চার উপাদানসমূহ –
যে-কোনো সামাজিক ইতিহাসের মতোই শহরের ইতিহাস রচনার কিছু নির্দিষ্ট উপাদান আছে। এর উপর নির্ভর করে শহরের বিবর্তনের কালানুক্রমিক ইতিহাস রচিত হয়।
- সামাজিক উপাদান – শহরের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে তার উৎপত্তি স্থান সংক্রান্ত তথ্য, জনবসতি ও তাদের কার্যকলাপ, শিক্ষা-সংস্কৃতিগত উপাদান থেকে তথ্যসংগ্রহ করতে হয়।
- অর্থনৈতিক উপাদান – ব্যাবসাবাণিজ্য, শিল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা শহরের ইতিহাস রচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
শহরের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে কলকাতার গুরুত্ব –
ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরগুলির মধ্যে শহরের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে কলকাতার গুরুত্ব অপরিসীম।
- ঔপনিবেশিক শহর হিসেবে কলকাতা – ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা কলকাতাকে প্রথমে তাদের ব্যাবসাবাণিজ্যসংক্রান্ত কার্যকলাপ ও পরে ঔপনিবেশিক শাসনের মূলকেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল। আর এর সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে কলকাতা শহরে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে।
- সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান – রাজনৈতিক তথা ব্যাবসাবাণিজ্যের মূলকেন্দ্র হিসেবেই যে কলকাতা শহরের গুরুত্ব বহুবিধ তা নয়। এই শহর ঔপনিবেশিক কালপর্ব থেকেই সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন জাতি ও ভাষাভাষী মানুষের সংস্কৃতির মেলবন্ধন কলকাতাকে এক অন্য মাত্রা দান করেছে।
- জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল কেন্দ্র – জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও কলকাতার গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে কলকাতা অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছিল।
শহরের ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
কলকাতা শহরের বিবর্তন প্রক্রিয়া, এই শহরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আধুনিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
সামরিক ইতিহাসচর্চা সম্বন্ধে পর্যালোচনা করো।
সামরিক ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
ইতিহাস যেসব বিষয় নিয়ে চর্চা করে তার মধ্যে অন্যতম হল সামরিক বিভাগ। অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধবিগ্রহ এই বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। একসময় মানুষ তিরধনুক, লাঠি, বল্লম নিয়ে যুদ্ধ করত। তারপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরে আজ পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে পৌঁছেছে। এর মধ্যবর্তী সময়ে সনাতনী অস্ত্রের উন্নতি, গুলিবারুদের ব্যবহার, সৈন্য প্রশিক্ষণ প্রভৃতির উন্নতি ঘটে। এই সব কিছু এখন সামরিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু।
সামরিক ইতিহাসচর্চার মধ্যযুগের সামরিক ইতিহাস –
প্রাচীন যুগে মানুষ পাথরের এবং ধাতুর অস্ত্র ব্যবহার করত। সেই জায়গা থেকে মধ্যযুগে সামরিক ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষণীয়। বারুদ ও কামানের আবিষ্কার ও ব্যবহার, সামরিক প্রশিক্ষণ, যুদ্ধকৌশল সামরিক জগতে বিপ্লব ঘটায়। তবে মধ্যযুগের শুরুতে ইউরোপীয় সামন্তদুর্গ এবং নাইটদের যে গুরুত্ব ছিল, তা পরবর্তীকালে ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে।
সামরিক ইতিহাসচর্চার আধুনিক যুগের সামরিক বিপ্লব –
শিল্পবিপ্লবের পর ইউরোপে অস্ত্র নির্মাণে যুগান্তর আসে। প্রচলিত সব ধরনের অস্ত্রের গুণমান বৃদ্ধি পায় এবং নতুন নতুন অস্ত্র তৈরি হয়। বাষ্পশক্তিচালিত জাহাজে দূরপাল্লার কামান বসানো হয়, ডুবোজাহাজ আবিষ্কৃত হয়। ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি ও বিমান আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত হয়। ফলে যুদ্ধ আর সীমিত জায়গায় আবদ্ধ থাকল না, জল-স্থল-আকাশে তার বিস্তার ঘটে।
সামরিক ইতিহাসচর্চার গবেষণার বিষয়বস্তু –
ফরাসি বীর নেপোলিয়নের ইংল্যান্ডবিরোধী যুদ্ধের সময় থেকে সামরিক ইতিহাসের সূচনা। তাঁর উপদ্বীপীয় যুদ্ধ, ওয়াটারলু-র যুদ্ধ সামরিক জগতে সাড়া জাগিয়েছিল। এই সময় থেকেই ইংল্যান্ডে সামরিক ইতিহাসচর্চার সূচনা ঘটে। এরপর সামরিক ইতিহাস একটি আলাদা শাখারূপে পরিচিত হয়।
সামরিক ইতিহাসে যুদ্ধের সময়কাল, দেশের নাম, সৈন্যসংখ্যা, ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধকৌশল, অস্ত্রের কার্যকারিতা, ক্ষয়ক্ষতি, পরিণতি প্রভৃতির কথা থাকে। এগুলির সামাজিক, আর্থিক ও রাজনীতিক পরিপ্রেক্ষিত ইতিহাসে আলোচিত হয়। মার্ক ফেরো-র লেখা ‘দ্য গ্রেট ওয়ার 1914-1918‘ (The Great War 1914-1918) হল অনুরূপ একটি গ্রন্থ।

সামরিক ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব –
ইতিহাস অতীত ঘটনার বিবরণ হলেও তা গতিশীল। যুদ্ধবিগ্রহের মতো আদিম প্রবণতা বর্তমান সভ্য দুনিয়ার অপরিহার্য অঙ্গ। যুদ্ধের প্রভাবের সঙ্গে যেমন সমাজ ও পরিবেশ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তেমনি আবার যুদ্ধের সঙ্গে যুদ্ধপ্রযুক্তিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এইসব বিষয়গুলি নিয়েই সামরিক ইতিহাসে চর্চা করা হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে বারুদের ব্যবহার কীভাবে ইউরোপীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল?
যুদ্ধক্ষেত্রে বারুদের ব্যবহারের ভূমিকা –
অতি প্রাচীনকাল থেকে মানুষ যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিল। প্রথম যুগে যুদ্ধের হাতিয়ার ছিল লাঠি, বল্লম, তিরধনুক, ঢাল-তলোয়ার প্রভৃতি। পরে বারুদের আবিষ্কার ও ব্যবহার শুরু হলে যুদ্ধক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ে।
যুদ্ধক্ষেত্রে বারুদের আবিষ্কার –
চিনদেশে প্রথম বারুদের আবিষ্কার হয় দশম শতাব্দীতে। মধ্যপ্রাচ্যের পথ ধরে এই প্রযুক্তি ক্রমে ইউরোপে পৌঁছোয়। আবার ইংল্যান্ডে রজার বেকন নামে একজন বিজ্ঞানী বারুদ আবিষ্কার করেন দ্বাদশ শতাব্দীতে।
যুদ্ধক্ষেত্রের বারুদের ব্যবহার –
বারুদ আবিষ্কারের অল্পকাল পর বারুদকে সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
- দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে যে শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ চলছিল, তার মধ্যে আইবেরীয় যুদ্ধে ইংল্যান্ড কামান ব্যবহার করে।
- 1325 খ্রিস্টাব্দে প্যাভিয়া-র যুদ্ধে স্পেনীয় বাহিনী কামানের সাহায্যে বিশাল ফরাসি অশ্বারোহী বাহিনীকে পরাজিত করে।
- 1403 খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কিরা কনস্ট্যান্টিনোপল জয়ের সময় বিশাল আকারের কামান ব্যবহার করে, ফলে বাইজানটাইন বাহিনী পরাজিত হয়।
- 1494 খ্রিস্টাব্দে অষ্টম চার্লস ইটালি অভিযানের সময় ভারী কামান ব্যবহার করেন বলেও জানা যায়।
যুদ্ধক্ষেত্রের বারুদের ব্যবহারে ইউরোপীয় রাজনীতিতে প্রভাব –
বারুদের ব্যবহার সামরিক ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটায় এবং রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে।
- ইউরোপে সামন্তপ্রভুর বাহিনীর গুরুত্ব লোপ পায়। তাদের একচেটিয়া সামরিক আধিপত্যের অবসান ঘটে।
- অস্ত্র, যুদ্ধপ্রযুক্তি ও কৌশলের আমূল পরিবর্তন ঘটে।
- ইউরোপের বিভিন্ন দেশ গোলন্দাজ বাহিনী গঠন করে সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
- ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটে এবং নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রের বারুদের ব্যবহারের মন্তব্য –
এইভাবে বারুদের ব্যবহার ইউরোপীয় রাজনীতিতে যুগান্তর এনেছিল।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চায় সামরিক ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, আধুনিককালে সামরিক ইতিহাসচর্চার বিবর্তন সম্পর্কে লেখো।
আধুনিককালে সামরিক ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
ইতিহাসে যুদ্ধ একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয়। আর যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হল সামরিক বাহিনী। তাই ইতিহাসের আলোচনায় সামরিক ইতিহাসচর্চা অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। মানবসভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সামরিক ক্ষেত্রেও অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। সামরিক ইতিহাসে আলোচনার বিষয়বস্তু হল – সেনাবাহিনীর গঠন, সেনাদের যোগ্যতা, বেতন, অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ, রণকৌশল, সামরিক প্রযুক্তি প্রভৃতি।
সামরিক ইতিহাসচর্চা –
আধুনিক ইতিহাসে সামরিক ইতিহাসচর্চা একটি অন্যতম ক্ষেত্র। ভারতের প্রধান প্রধান যুদ্ধের বর্ণনা ও যুদ্ধপদ্ধতির বিকাশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল যদুনাথ সরকার রচিত ‘মিলিটারি হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’ (Military History of India)। মারাঠাদের সামরিক ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করেছেন সুরেন্দ্রনাথ সেন। ভারতের সামরিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন জি এস সাধু ও কৌশিক রায়।
ভারতে সামরিক ব্যবস্থার ধারা –
ইতিহাসের ধারায় সামরিক ব্যবস্থায় ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন ঘটে চলেছে।
- আদিম মানুষ জোটবদ্ধভাবে বসবাস করত। তখন তারা নিজেদের প্রয়োজনে পাথর ও গাছের ডালকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত।
- ধীরে ধীরে মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শিখল। জনপদ, মহাজনপদ গড়ে উঠল। মানুষ নিজের সুরক্ষার জন্য সামরিক বাহিনী গঠন করল। তখন সামরিক বাহিনীতে পদাতিক, অশ্বারোহী, রথারোহী ও হস্তীবাহিনী গড়ে উঠল।
- প্রাচীন যুগে অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তীরধনুক, বর্শা, তলোয়ার প্রভৃতি। আবার সেনাদের আত্মরক্ষার জন্য ঢাল, বর্ম ও শিরস্ত্রাণ ব্যবহৃত হত।
- মধ্যযুগে সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্রে পরিবর্তন আসে। সামরিক বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয় গোলাবারুদের ব্যবহার। 1526 খ্রিস্টাব্দে পানিপতের যুদ্ধে বাবর কামানের ব্যবহার করে সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করেন। এর ফলে ভারতে সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন ও মুঘল শাসনের সূচনা হয়।
- আধুনিক যুগে সামরিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। সামরিক প্রশিক্ষণ, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও বিভিন্ন প্রযুক্তির আমদানি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরমাণু বোমার আবিষ্কার ও ব্যবহার সামরিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
আধুনিককালে সামরিক ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে সামরিক ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে পরিবর্তন এসেছে। সামরিক ইতিহাসচর্চার মধ্যে মানবসভ্যতার ক্রমোন্নতির ধারার চিত্রও ফুটে ওঠে।
আধুনিক ইতিহাসচর্চায় পরিবেশের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি কী ছিল?
পরিবেশের ইতিহাস-সূচনাপর্ব –
সাম্প্রতিক ইতিহাসচর্চার ধারায় পরিবেশের ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। পরিবেশ সংক্রান্ত ইতিহাসচর্চা প্রথম উত্তর আমেরিকায় ও তারপর ইউরোপে শুরু হয়। 1960 -এর দশকে পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে যে গণ আন্দোলনের সূচনা হয় তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবেশের ইতিহাসের চর্চা শুরু হয়। তবে প্রথম দিকে বিজ্ঞান গবেষকরাই এই বিষয়টিকে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন।
পরিবেশের ইতিহাসচর্চা –
1952 খ্রিস্টাব্দে মার্কিন পরিবেশবিদ র্যাচেল কারসন -এর লেখা ‘দ্য সি অ্যারাউন্ড আস’ (The Sea Around Us) গ্রন্থটি পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ পরিবেশ দূষণ করে। কারসন 1962 খ্রিস্টাব্দে ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ (Silent Spring) নামে আরও একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এতে তিনি দেখিয়েছেন যে, মশা-মাছি মারার জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক, ডিডিটি (DDT)-র ব্যবহার পাখিদের ভয়ংকর ক্ষতি করে। এ ছাড়া ক্ল্যারেন্স গ্ল্যাকেন -এর ‘ট্রেসেস অন দ্য রোডিয়ান শোর’ (Traces on the Rhodian Shore) বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

ভারতে পরিবেশের ইতিহাসচর্চার সূচনা হয়েছিল 1970 -এর দশকে। 1982 খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট এডুকেশন (Center for Environment Education) প্রতিষ্ঠার পর থেকে এদেশে পরিবেশের ইতিহাসচর্চা গুরুত্ব লাভ করে। পরিবেশের ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ হল রিচার্ড গ্রোভের ‘গ্রিন ইম্পিরিয়ালিজম’ (Green Imperialism), রামচন্দ্র গুহ ও মাধব গ্যাডগিল রচিত ‘দিস ফিসারড ল্যান্ড : অ্যান ইকোলজিক্যাল হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’ (This Fissured Land : An Ecological History of India), আলফ্রেড ডব্লিউ ক্রসবি -এর লেখা ‘ইকোলজিক্যাল ইম্পিরিয়ালিজম’ (Ecological Imperialism) প্রভৃতি। রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘অশান্ত অরণ্য জীবন’ গ্রন্থে উপজাতীয় কৃষকজীবনের এক বিশেষ দিকের প্রতি আলোকপাত করেছেন। জিন ফিলিওজ্যাট দক্ষিণ ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলের ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাবের ব্যাখ্যা দেন। এলিজাবেথ হুইটকম্ব উত্তর ভারতের কৃষিব্যবস্থার উপর গবেষণা করে দেখান যে, সেচব্যবস্থার প্রবর্তন সিন্ধু ও গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে পরিবেশগত বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছিল।
ভারতে পরিবেশ সচেতনতা –
সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকার যখন উপজাতিদের প্রথাগত বনজ সম্পদ ব্যবহারের বিরুদ্ধে সরকারি বিধিনিষেধ জারি করে, তখন তারা তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র রসদ হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে ওঠে। এ ছাড়া বনকে কেন্দ্র করে যে উপজাতি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে তা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস জানতে হলে, ঐতিহাসিককে উপজাতি শোষণের ইতিহাসকেও জানতে হবে। আধুনিক ভারতে কর্ণাটকে আপ্পিকো আন্দোলন, উত্তরাখণ্ডে চিপকো আন্দোলন, দাক্ষিণাত্যে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন -এর ইতিহাস থেকে আমরা পরিবেশ সচেতনতার পাঠ নিয়ে থাকি।
পরিবেশের ইতিহাসের গুরুত্ব –
পরিবেশের ইতিহাস বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
- পরিবেশের ইতিহাস ভূগোলের ও জীববিদ্যার শিক্ষা দেয়। বিভিন্ন অঞ্চল ও সেখানকার জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।
- পরিবেশ সংকটের কারণ ও সমাধান সম্বন্ধে জানা যায়।
- সেচব্যবস্থা অর্থাৎ জলাধার, নদীবাঁধ, খাল খনন পরিবেশের উপর কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে সে বিষয়ে ধারণা লাভ করা যায়।
- অরণ্য ধ্বংস, ভূমিক্ষয় রোধ করে পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে।
পরিবেশের ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব আলোচনা করো।
অথবা, আধুনিক পৃথিবীতে পরিবেশচর্চার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করো।
পরিবেশের ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
আধুনিক ইতিহাসচর্চার ধারায় পরিবেশের ইতিহাসচর্চা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে। পরিবেশ রক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য 1960 -এর দশকে এক আন্দোলনের সূচনা হয়। এরপর থেকেই পরিবেশের ইতিহাসচর্চা বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে। ভারতবর্ষে পরিবেশের ইতিহাসচর্চা গুরুত্ব লাভ করেছিল 1970 -এর দশক থেকে।
পরিবেশের ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব –
- সচেতনতা বৃদ্ধি – ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী বনজ সম্পদকে নানাভাবে ধ্বংসের চেষ্টা করে। ফলে উপজাতি সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইসময় বনজ সম্পদকে রক্ষার তাগিদে তারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। অন্যদিকে পরবর্তীকালে চিপকো আন্দোলন, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন প্রভৃতি থেকে বহু যুগ ধরে পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।
- মানবসভ্যতার উপর পরিবেশের প্রভাব – পরিবেশের ইতিহাসচর্চার ফলে মানবসভ্যতার উপর পরিবেশের প্রভাব ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে মানুষের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়।
- জীববৈচিত্র্য সংক্রান্ত ধারণা – পরিবেশের চারদিকে বসবাসকারী জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় পরিবেশের ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে।
- পরিবেশ সংকটের কারণ সমাধান – পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয়ের উপযুক্ত সমাধান প্রদানের ক্ষেত্রে পরিবেশের ইতিহাসচর্চা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
- পরিবেশরক্ষার জন্য আন্দোলন সম্পর্কে ধারণা – ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাদের নিজেদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশরক্ষার জন্য আন্দোলন সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসের পরিচয় দাও।
মানুষের জয়যাত্রার কাহিনি ইতিহাসের বিষয়বস্তু। আগুন জ্বালাতে শেখা, বনের আগুনকে ঘরে নিয়ে আসা, চাকা আবিষ্কার – এইসবের মধ্যে দিয়ে মানুষের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সূচনা হয়েছিল। তারপর রোগব্যাধির হাত থেকে মুক্তি ও রোগ প্রতিরোধের পদ্ধতি শেখার মধ্যে দিয়ে চিকিৎসাবিদ্যার জন্ম হয়েছিল।
বিজ্ঞানের ইতিহাস –
বিভিন্ন সময়ের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, বৈজ্ঞানিকের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, প্রতিকূলতা, সমাজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সুফল প্রভৃতি নিয়ে চর্চা হল বিজ্ঞানের ইতিহাস। জে ডি বার্নালের ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ সেইরকমই একটি গ্রন্থ। অপরসায়নবিদ বা অ্যালকেমিস্টদের বিভিন্ন আবিষ্কার, পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণা এবং তার অগ্রগতি, গণিত -এর উন্নতি ও সমাজের সাথে তার যোগসূত্র ইত্যাদি বিজ্ঞানের ইতিহাসের বিষয়বস্তু।
প্রযুক্তিবিদ্যার ইতিহাস –
চাকা আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে মানুষের প্রযুক্তিবিদ্যার সূচনা। তারপর নদীতে বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখা ও চাষবাস করা, বাড়িঘর, প্রাসাদ ও মন্দির তৈরির মাধ্যমে তার বিকাশ ঘটে। নগর প্রতিষ্ঠা, পিরামিড তৈরি, নৌকা ও জাহাজ তৈরি, তাতে পাল ব্যবহার, গাড়ি তৈরি প্রভৃতির মাধ্যমে প্রযুক্তিবিদ্যার গতি ত্বরান্বিত হয়। শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রযুক্তিবিদ্যার অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। নতুন নতুন ক্ষেত্রে আবিষ্কার (বাষ্পীয় ইঞ্জিন, রেলগাড়ি প্রভৃতি) প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটায়। বিকাশের গতি আজও একইভাবে অব্যাহত।
চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস –
অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা ছিল। প্রতিষ্ঠান বা গ্রন্থ না থাকলেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে বহু চিকিৎসক বিখ্যাত হন। গ্রিসের হিপোক্রিটাসের মতো ভারতে চরক, সুশ্রুত, ধন্বন্তরি ছিলেন। আরবে, ইটালিতে চিকিৎসাবিদ্যা উন্নত হয়। হার্ভের রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতির আবিষ্কার চিকিৎসার ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটায়।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশ ও প্রয়োগ সমাজে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছিল, তা ইতিহাসচর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। এই বিষয়গুলি সম্বন্ধে বিভিন্ন দেশের সরকার কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল, প্রয়োগের সময় কী কী প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তাও ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ভূমিকা –
মানবসভ্যতার উন্নয়নে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যা আধুনিক ইতিহাসে আলোচনার বিষয়বস্তুরুপে গুরুত্ব পেয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ আগুন জ্বালাতে, ধাতুর অস্ত্রশস্ত্র ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করার প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছিল। চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদ চিকিৎসা, মধ্যযুগে ইউনানি চিকিৎসা এবং আধুনিক যুগে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা বিশেষ খ্যাতি লাভ করে।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চা –
আধুনিক যুগে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করায় এর ইতিহাসচর্চাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং চিকিৎসাবিদ্যার জন্য ভারত-সহ সারা বিশ্বে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – বিনয়ভূষণ রায়ের লেখা ‘উনিশ শতকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা’, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের লেখা ‘হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’ (History of Hindu Chemistry), ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের লেখা ‘টেকনোলজি ইন মিডিয়েভ্যাল ইন্ডিয়া’ (Technology in Medieval India)। ব্রিটিশ আমলে ভারতে বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে দীপক কুমারের লেখা গ্রন্থ ‘সায়েন্স অ্যান্ড দ্য রাজ, 1857-1905’ (Science and the Raj, 1857-1905) বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – ডঃ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘প্রাচীন ভারতে চিকিৎসাবিজ্ঞান’, জে জোলির লেখা ‘ইন্ডিয়ান মেডিসিন’ (Indian Medicine) প্রভৃতি।
ভারতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার ইতিহাস –
- প্রাচীন যুগ – প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে আয়ত্ত করে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। হরপ্পা সভ্যতার পাকাবাড়ি, সিলমোহর, মাটির তৈরি জিনিসপত্র, বিভিন্ন মূর্তি তার প্রমাণ দেয়। কুষাণ যুগে নাগার্জুন ছিলেন একজন কৃষিবিজ্ঞানী। তিনি ‘মাধ্যমিক সূত্র’ রচনা করেন। অমরকোষ ও বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে ধাতু ও খনি বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট পৃথিবীর আবর্তন গতি আবিষ্কার করেন। ব্রহ্মগুপ্ত পৃথিবীর অভিকর্ষজ টানের কথা বলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে চরকসংহিতা ভেষজ বিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সুশ্রুত ছিলেন প্রাচীন ভারতের একজন বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক।
- মধ্যযুগ – মধ্যযুগে সুলতানি ও মুঘল যুগে তুর্কি, আরবি, পারসিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার আগমন ঘটে। চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে আরবি ইউনানি বা হাকিমি চিকিৎসা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।
- আধুনিক যুগ – আধুনিক যুগে ব্রিটিশ আমলে ভারতে ইউরোপীয় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার প্রচলন হয়। 1835 খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ‘কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিজ্ঞানচর্চার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ, বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশন প্রভৃতি।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার উপসংহার –
আধুনিক যুগকে ‘বিজ্ঞানের যুগ’ বলা হয়। বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যার নিত্যনতুন আবিষ্কার মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও সুখকর করে চলেছে। ফলে মানুষের অগ্রগতির ইতিহাসে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসচর্চা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করেছে।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সংক্ষেপে টীকা লেখো।
সনাতন প্রেক্ষাপট –
আধুনিক সামাজিক ইতিহাসচর্চার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চা। সারা বিশ্বেই এই ক্ষেত্রে চর্চা চলেছে অতি প্রাচীনকাল থেকে। যেমন – প্রাচীন গ্রিস ও ভারতবর্ষের কথা বলা যায়। গ্রিসে হিপোক্রিটাস, ভারতে চরক ও সুশ্রুত প্রমুখ চিকিৎসায় যে অবদান রেখেছেন, তা চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছিল।
আধুনিক ভারতে বিজ্ঞানচর্চা –
আধুনিক ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বিজ্ঞানচর্চা, প্রযুক্তিবিদ্যা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পুনরুজ্জীবনের সূচনা হয়। সার্ভে ও মানচিত্র তৈরি, শিবপুর ও দার্জিলিং -এর বোটানিক্যাল গার্ডেন তৈরি, 1851 খ্রিস্টাব্দে ভারতের ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ প্রতিষ্ঠান (Geological Survey of India) -এর সূচনা, 1835 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নতির সূচনা হয়। 1905 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1947 খ্রিস্টাব্দ সময়কালে খনিজবিদ্যা, গণিতচর্চা, পদার্থবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতিতে সহায়কের ভূমিকা নিয়েছিল ডন সোসাইটি, আলিগড় সায়েন্টিফিক সোসাইটি, কলকাতায় মহেন্দ্রলাল সরকারের ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স’ (Indian Association for the Cultivation of Science, 1878), মুম্বাইতে টাটাদের উদ্যোগে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’ (Indian Institute of Science) প্রভৃতি সংস্থা। বর্তমানে একাধিক সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার গবেষণা হচ্ছে। এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শনকারী একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হল – CSIR বা ‘কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইনডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ’ (Council of Scientific and Industrial Research)।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসচর্চা –
একসময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়টিকে ইতিহাসচর্চার বিষয় হিসেবে ধরা হত না। কিন্তু বিগত বেশ কয়েক দশক থেকেই এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বেশিরভাগ পণ্ডিতই এটা মেনে নেন যে, বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণা এক ধরনের সামাজিক ক্রিয়াকলাপ এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। জে ডি বার্নালের ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ গ্রন্থটি সেইদিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান গবেষণা ও চর্চার ক্ষেত্রে সমাজতত্ত্ববিদ ও বৈজ্ঞানিক যোগসূত্র স্থাপিত হওয়ার দরুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে।
চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চা –
সাম্প্রতিককালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসকে নানান দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হয়ে থাকে। কোন্ ধরনের সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্ভবপর হয়েছে, সেটি ঐতিহাসিকেরা বিশ্লেষণ করে থাকেন। চিকিৎসাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সরকারি স্বাস্থ্যনীতি সম্পর্কে জানা যায়। উপনিবেশগুলিতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাপদ্ধতির প্রয়োগ কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সেই বিষয়েও জানা যেতে পারে। সর্বোপরি সাম্প্রতিককালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে প্রযুক্তির যোগসূত্র এতটাই ওতপ্রোত হয়ে পড়েছে যে, চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণায় এবং ইতিহাসচর্চায় প্রযুক্তির বিষয়টিও অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে।
নারীসমাজের ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনা করো।
অথবা, নারী ইতিহাসের উপর একটি টীকা লেখো।
নারী ইতিহাসের ভূমিকা –
ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে নারীসমাজের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেক দেশের সমাজে নারীর স্থান মর্যাদাপূর্ণ। অতীতে কিন্তু এমনটা ছিল না। অত্যাচার, নিপীড়ন, বধূ নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হত নারীরা। পরবর্তীকালে বিভিন্নভাবে নারীর অধিকার স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এইসব কাহিনি নারী ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত।
নারীর অবস্থান –
সমাজের অর্ধেক অংশই হল নারী। সমাজজীবনের মূল চালিকাশক্তি হলেও বিভিন্ন যুগে নারীর অবস্থা ছিল বিভিন্ন রকম।
- প্রাচীন যুগ – আদিম মানবসমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। অর্থাৎ নারী ছিল তখন সর্বময় কর্ত্রী। পরে ক্রমশ নারীর অধিকার কমে যায়। তারা পুরুষের অধীনস্থ হয়ে পড়ে এবং তাদের স্বাধীনতা ও অধিকার লোপ পায়। তবে কিছু ব্যতিক্রমও ছিল লক্ষণীয়।
- মধ্যযুগ – প্রাচীন যুগের ধারা এ যুগেও অব্যাহত থাকে। নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার যেটুকু ছিল তাও লোপ পায়। ধর্মীয় বাতাবরণ প্রবল হয়ে ওঠে। অবশ্য এর মধ্যেও দু-একটি ব্যতিক্রম ছিল।
- আধুনিক যুগ – এ সময়ে নারী জাগরণের সূচনা হয়। শিল্পবিপ্লব কর্মজগতের পরিধি বিস্তৃত করেছিল। তাই নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। বেশি শ্রম ও কম মজুরি, নিরাপত্তার অভাব তাদের নিজ অধিকার বিষয়ে সচেতন করে তোলে। তারা বিভিন্ন দাবি তুলতে থাকে এবং তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটে। ক্রমশ তারা রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ –
ইতিহাসচর্চার যে মূল ধারা তাতে পুরুষদের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়, নারীর ভূমিকা সেখানে উপেক্ষিত। রাজনৈতিক ইতিহাস ও সামাজিক ইতিহাসে নারীরা তাদের যথাযথ মর্যাদা পায়নি। তাই এর প্রতিবাদ নারী ইতিহাসের অন্যতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

নারী ইতিহাসের গুরুত্ব –
নারী ইতিহাস বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
- যে বিষয়গুলি উপেক্ষিত ছিল এখন তা গুরুত্ব সহকারে চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। পারিবারিক ক্ষেত্রে হিংসাত্মক কার্যকলাপ, শিশুর উপর নিপীড়ন, বধূহত্যা, নারীনির্যাতন ও অন্যান্য অত্যাচার প্রভৃতির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
- লিঙ্গবৈষম্য, পারিবারিক সম্পর্ক ও সামাজিক ব্যবস্থার কথা তুলে ধরে নারী ইতিহাস।
- নারীর ক্ষমতায়ন ও দক্ষতার উপর আলোকপাত করে এবং
- বিভিন্ন যুগে নারীর মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার কথা তুলে ধরে।
আধুনিক সামাজিক ইতিহাসের নবদিগন্তরূপে নারীসমাজের ইতিহাস কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে?
নারীসমাজের ইতিহাস –
অন্যান্য সামাজিক ইতিহাসের ন্যায় নারী ইতিহাসচর্চার বিষয়টিও সাম্প্রতিককালে প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রারম্ভিক পর্যায়ে নারী ইতিহাসচর্চার লক্ষ্য ছিল ইতিহাসে নারীর স্থান ও মর্যাদাকে যথোপযুক্ত স্থান করে দেওয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ। আধুনিক ভারতে নারীসমাজের কার্যকলাপ, সামাজিক মর্যাদা তথা অবস্থান সম্পর্কিত বিবর্তনকে নারীসমাজের ইতিহাস বলা হয়। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি নারী ইতিহাসচর্চার অন্যতম দিক।
ভারতে নারীসমাজের অবস্থার পরিবর্তন –
রামমোহন রায়ের উদ্যোগে সতীদাহপ্রথা উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে নারী প্রগতির যে অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল তা ক্রমশ ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বীরেশলিঙ্গম পান্তুলু, জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রী বাঈ, ডি কে কারভে প্রমুখের মহতী কর্মধারায় আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল। স্বাধীন ভারতে নারীর ভোটাধিকার, রাজনৈতিক অধিকার তথা সমানাধিকারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। নারী সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রকার আইনকানুন পাস করা হয়েছে।
নারী সমাজের ইতিহাসচর্চা –
নারীসমাজের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – জেরাল্ডিন ফোর্বস -এর ‘উইমেন ইন মডার্ন ইন্ডিয়া’ (Women in Modern India), মালবিকা কার্লেকর -এর ‘ভয়েসেস ফ্রম উইদিন’ (Voices from Within), জে কৃষ্ণমূর্তি সম্পাদিত ‘উইমেন ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ (Women in Colonial India), চিত্রা ঘোষ -এর ‘বাংলার রাজনীতি ও নারী আন্দোলন’ প্রভৃতি।

নারীসমাজের ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব –
নারী ইতিহাস বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
- যে বিষয়গুলি উপেক্ষিত ছিল এখন তা গুরুত্ব সহকারে চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। পারিবারিক ক্ষেত্রে হিংসাত্মক কার্যকলাপ, শিশুর উপর নিপীড়ন, বধূহত্যা, নারীনির্যাতন ও অন্যান্য অত্যাচার প্রভৃতির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
- লিঙ্গবৈষম্য, পারিবারিক সম্পর্ক ও সামাজিক ব্যবস্থার কথা তুলে ধরে নারী ইতিহাস।
- নারীর ক্ষমতায়ন ও দক্ষতার উপর আলোকপাত করে।
- বিভিন্ন যুগে নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা তুলে ধরে।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান ব্যবহারের পদ্ধতিগুলি কী কী?
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার ভূমিকা –
যেসকল গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্যাবলি ইতিহাসচর্চার কাজে বিশেষভাবে সাহায্য করে, তাকে বলা হয় ইতিহাসের উপাদান। আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদানগুলির মধ্যে বৈচিত্র্য বর্তমান, তাই এই উপাদানগুলি ব্যবহারের পদ্ধতির মধ্যেও বিভিন্নতা দেখা যায়।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদানসমূহ –
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদানগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল – সরকারি নথিপত্র, চিঠিপত্র, আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা, সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র, ইন্টারনেট, ফোটোগ্রাফ প্রভৃতি। সমকালীন ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি সম্পর্কে জানার অপরিহার্য উৎস হিসেবে এগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান ব্যবহারের পদ্ধতি –
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান ব্যবহারের পদ্ধতিগুলি হল নিম্নরূপ-
- সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার – ইতিহাসচর্চার উপাদানগুলিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে ব্যবহার করা প্রয়োজন। অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে যাচাই করে তা গ্রহণ করা উচিত। উপাদানগুলি ব্যবহারের পর সেগুলির পুনর্মূল্যায়ন করে তবেই প্রকৃত তথ্য গ্রহণ করা আবশ্যক।
- প্রযুক্তিগত ব্যবহার – বর্তমানে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার একটি অন্যতম প্রধান বিষয়। ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের ই-লাইব্রেরি থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসংগ্রহ করা যায়।
- সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহার – ইতিহাসের উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো একজন ব্যক্তিমানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে কোনো ঘটনাকে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
- স্থানকালপাত্র সংক্রান্ত ধারণা – আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান ব্যবহারের অপর একটি পদ্ধতি হল স্থানকালপাত্রের সঠিক ধারণা প্রয়োগ। কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার স্থানকালপাত্র গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্যসরবরাহে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপসংহার –
সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদানের পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। ফলে প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্য উন্মোচনের পথ আরও সুগম হয়েছে।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্র সম্পর্কে আলোচনা করো।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের ভূমিকা –
যেসব তথ্যের সাহায্য নিয়ে ইতিহাস লেখা হয়, তাকে ইতিহাসের উপাদান বলে। আধুনিক ইতিহাসের উপাদানগুলির মধ্যে অন্যতম হল সরকারি নথিপত্র। সরকারি নথিপত্র বলতে বোঝায় পুলিশ, গোয়েন্দা বা সরকারি আধিকারিকদের রিপোর্ট, প্রতিবেদন, বিবরণ ও চিঠিপত্র ইত্যাদিকে।

পুলিশ –
পুলিশের কাজ হল তার নির্দিষ্ট থানার অন্তর্গত এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। পুলিশ তার এলাকার আইনশৃঙ্খলার রিপোর্ট তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়মিত পাঠায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে পুলিশ ভারতীয়দের ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপের উপর কড়া নজর রাখত। তারা বিপ্লবীদের কার্যকলাপের খবর নথিভুক্ত করত।
গোয়েন্দা –
গোয়েন্দাদের কাজ হল গোপনে খবর সংগ্রহ করা। প্রাচীনকাল থেকে রাজারা বিভিন্ন এলাকার গোপন খবর সংগ্রহ করার কাজে গুপ্তচর নিয়োগ করতেন। আধুনিক যুগেও সব দেশে সরকারের গোয়েন্দা দপ্তর থাকে। ব্রিটিশ আমলে গোয়েন্দারা বিপ্লবী ও আন্দোলনকারীদের গোপন খবর সংগ্রহ করত। পরবর্তীকালে এই গোয়েন্দার রিপোর্টগুলি থেকে ঐতিহাসিক ও গবেষকগণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান। এই রিপোর্টগুলি থেকে বিভিন্ন বিপ্লবী ও সংগঠন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
সরকারি আধিকারিকগণ –
সরকারি আধিকারিকদের কাজ হল তাদের এক্তিয়ারভুক্ত নির্দিষ্ট এলাকার সমস্ত রকম কাজের তদারকি করা। এ ছাড়া এলাকার উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, রাজস্ব আদায়, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সব বিষয়ে রিপোর্ট তৈরি করা এদের কার্যাবলির অন্তর্গত। ব্রিটিশ আমলে সরকারি আধিকারিকগণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা সরকারের কাছে তার মতামত জানিয়ে প্রতিবেদন পেশ করতেন। সরকার প্রয়োজনে সেই প্রতিবেদন সম্পূর্ণ বা আংশিক কার্যকর বা অগ্রাহ্য করতে পারতেন। প্রসঙ্গত মেকলে ও চার্লস উডের প্রতিবেদনের কথা বলা যায়। মেকলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে 1835 খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করে।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি চিঠিপত্র –
সরকারি চিঠিপত্র বলতে বোঝায় সরকারি কর্মচারীদের লেখা তথ্যসমৃদ্ধ চিঠিপত্র। সরকারি চিঠিপত্র থেকে ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। যেমন – 1905 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল তা লর্ড কার্জনের লেখা চিঠি থেকে জানা যায়। চিঠিতে তিনি লেখেন ব্রিটিশবিরোধী বাঙালিদের দুর্বল করার জন্য বাংলা ভাগ করা জরুরি ছিল।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের বিবরণ –
অনেক সরকারি আধিকারিক তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এগুলিও ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানরূপে বিবেচিত। যেমন – লর্ড কার্জনের সময়ের স্বরাষ্ট্রসচিব হারবার্ট রিজলির দিনলিপির বিবরণ।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের উপসংহার –
সরকারি নথিপত্র থেকে ইতিহাস রচনা করতে গেলেও গবেষকদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ – পুলিশ, গোয়েন্দা ও সরকারি আধিকারিকদের রিপোর্টে অনেক ক্ষেত্রে ভুল ও বিকৃত তথ্য থাকে। তবে এইসব তথ্যকে অন্য তথ্যের সঙ্গে যাচাই করে ইতিহাস রচনা করলে প্রকৃত ইতিহাস রচনা করা সম্ভব।
আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় সরকারি নথিপত্র কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
যে-কোনো দেশের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে লিখিত উপাদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। লিখিত উপাদানের মাধ্যমে আমরা সেই দেশ ও জাতির আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক – সব তথ্যই পেয়ে থাকি। লিখিত উপাদানের মধ্যে সরকারি নথিপত্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় সরকারি নথিপত্রের গুরুত্ব –
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের গুরুত্ব হল –
- আধিকারিকদের প্রতিবেদন – সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত সচিব ও আধিকারিকরা সরকারি কাজকর্ম নিয়ে বিভিন্ন চিঠিপত্র লেখালেখি করেন ও নোট দেন। সরকারি মহাফেজখানা (Record room) বা লেখ্যাগারে (Archieve) সংরক্ষিত এইসব নথি থেকে সরকারের বিভিন্ন কাজকর্ম সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। একইভাবে বিভিন্ন ঘটনা সম্বন্ধেও ধারণা পাওয়া যায়, যার উপর নির্ভর করে ঘটনার বিনির্মাণ করাও সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল, এ কথা স্বরাষ্ট্রসচিব অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম বিভিন্ন সরকারি নথিপত্র থেকে জানতে পারেন। একইভাবে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার কথাও এগুলি থেকে জানা যায়।
- গোয়েন্দা প্রতিবেদন – পুলিশ ও গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন ঘটনার প্রতিফলন ঘটে। অভাব-দারিদ্র্য থেকে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি এবং অপরাধপ্রবণতা থেকে বিভিন্ন অসামাজিক কাজ ও হত্যা ঘটে থাকে। এই ঘটনাগুলির সংখ্যা সমাজের স্থিতিশীলতা অথবা অস্থিরতার পরিচয় দেয়। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অচলায়তনেরও ইঙ্গিত দেয়। এ ছাড়াও বৈপ্লবিক তৎপরতা, রাজনৈতিক আন্দোলনের বহু তথ্য পাওয়া যায় এইসব সরকারি নথিপত্র থেকে।

আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় সরকারি নথিপত্রের সীমাবদ্ধতা –
সরকারি নথিপত্রগুলির অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন –
- এইসব নথিপত্র সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা, জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়। তাই এগুলির নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় বিদ্যমান।
- ইংরেজ আমলে সরকারের চরিত্র ছিল ঔপনিবেশিক ধরনের। তাদের লক্ষ্য ছিল দমন ও পীড়ন। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে তারা বিদ্রোহ বলত। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য হত্যাকাণ্ড চালানোকে তারা বৈধ বলে আখ্যা দিয়েছিল। তাই এইসব নথিপত্রকে ইতিহাসের উপাদানরূপে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের সীমাবদ্ধতা লেখো।
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের ভূমিকা –
আধুনিক ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। পুলিশ, গোয়েন্দা বা সরকারি আধিকারিকদের রিপোর্ট, চিঠিপত্র, প্রতিবেদন প্রভৃতি হল সরকারি নথিপত্রের অন্তর্গত। সরকারি মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারে সাধারণত এই সরকারি নথিপত্র সংরক্ষিত থাকে। এগুলি ছাড়াও পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের নথিপত্রও ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে বিবেচিত হয়।
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের সীমাবদ্ধতা –
সরকারি নথিপত্রের সীমাবদ্ধতাগুলি হল নিম্নরূপ –
- আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন – সরকারি নথিপত্র, যথা – পুলিশ, গোয়েন্দা, সরকারি আধিকারিকদের বিবরণে ব্রিটিশ শাসকের ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি, শাসন ও দমনমূলক চরিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে এর ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয়।
- নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় – সরকারি নথিপত্রগুলিতে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির অধিক প্রভাব দেখা যায়। এগুলি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা নয়। তাই এগুলির নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় বিদ্যমান।
- বিকৃত তথ্য – সরকারি দলিল দস্তাবেজগুলিতে অনেক ক্ষেত্রে ভুল ও বিকৃত তথ্য থাকে। তাই এগুলি সমকালীন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
- সরকারি কার্যকলাপের অস্পষ্টতা – সরকারি আধিকারিকদের রিপোর্ট ও অন্যান্য নথিপত্রগুলিতে সরকারি কর্মচারীদের কার্যকলাপ বিষয়ে সঠিক তথ্য দেওয়া থাকে না। ফলে তথ্যের এই অস্পষ্টতা ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করে দেয়।
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের উপসংহার –
আধুনিক ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য হলেও তা ব্যবহারের সময় সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এইসব তথ্যকে অন্য তথ্যের সঙ্গে যাচাই করে নিলে ইতিহাস রচনা সুসংগঠিত ও প্রকৃত তথ্যসমৃদ্ধ হতে পারে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ইতিহাস লেখার জন্য বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করতে হয়। তার মধ্যে লিখিত উপাদান হল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। লিখিত উপাদানের মধ্যে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা থেকে বহু তথ্য পাওয়া যায়। তৎকালীন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাই এগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা –
আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথাগুলিও এক ধরনের সাহিত্য। লেখক তার চোখে দেখা বিভিন্ন ঘটনা ও নিজের অভিজ্ঞতার কথা এই জীবনীগ্রন্থে প্রকাশ করেন। প্রত্যেক আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় লেখকের ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয় ফুটে ওঠে। আবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ও পাওয়া যায় লেখাগুলি থেকে। লেখকের ফেলে আসা অতীতের স্মৃতি বর্তমানের নিরিখে যাচাই করা হয়। আদর্শগত মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লেখকের নিজের চোখে দেখা সেকাল ও একালের ব্যবধান বর্ণিত হয় এই সমস্ত লিখিত উপাদানে।
ইতিহাসে আমরা বহু জীবনচরিত, আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার পরিচয় পাই। এই গ্রন্থগুলির বেশিরভাগই শাসকদের জীবনীগ্রন্থ। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে কোনোটি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত, আবার কোনোটি শাসকদের স্বরচিত। আধুনিককালে সাধারণ ব্যক্তিরাও শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে লেখালেখির কাজে যুক্ত হন। তাদের অনেকে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা লেখেন। তাই সাধারণ মানুষের চোখে দেখা ঘটনার বিবরণী ও তার অভিজ্ঞতার কথা এই উপাদান থেকে পাওয়া যায়।
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার গুরুত্ব –
আধুনিক ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার গুরুত্ব যথেষ্ট –
- সাধারণ মানুষের কথা, লেখকের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, কোনো কোনো ঘটনার বিবরণী প্রভৃতি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তথ্যের জোগান দেয়।
- রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
- স্থানীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এই উপাদান সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
- বৃহত্তর বা জাতীয় ইতিহাসের বহু উপেক্ষিত বিষয়ের উপর আলোকপাত করে।
বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনী ‘সত্তর বৎসর’ কেন ইতিহাসের উপাদানরূপে গুরুত্বপূর্ণ?
বিপিনচন্দ্র পালের ‘সত্তর বৎসর’ আত্মজীবনীর ভূমিকা –
আত্মজীবনী বলতে বোঝায় নিজের সম্পর্কে লেখা। বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটি হল সত্তর বৎসর। এই লেখাটি প্রথমে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। তবে লেখাটি সম্পূর্ণ হয়নি। এতে 1857 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1880 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের ঘটনাবলি বিবৃত হয়েছে। পরবর্তীকালে 1954 খ্রিস্টাব্দে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এই গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম।
বিপিনচন্দ্র পালের সত্তর বৎসর থেকে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ –
বিপিনচন্দ্র পালের লেখা ‘সত্তর বৎসর’ গ্রন্থ থেকে সমকালীন ইতিহাসের অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

- জন্ম ও বংশ পরিচয় – বিপিনচন্দ্র পাল 1858 খ্রিস্টাব্দে শ্রীহট্টের পৈল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ হিরন্য পাল পৈল গ্রামে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁরা বর্ধমানের মঙ্গলকোট থেকে এই অঞ্চলে এসেছিলেন।
- শিক্ষাব্যবস্থা – ‘সত্তর বৎসর’ থেকে সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। সেই সময় প্রত্যেক গ্রামে টোল ও ফারসি শেখার জন্য মাদ্রাসা ও মক্তব ছিল। পূর্বে নবাবদের কাজকর্মের জন্য ফারসি-জানা লোকের প্রয়োজন হত বলে অনেক হিন্দু ছাত্র মাদ্রাসায় ফারসি শিখত। ইনি নিজেও প্রথমে ফারসি শেখার জন্য এক মৌলবির কাছে ভরতি হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি শ্রীহট্টের একটি ইংরেজি বিদ্যালয়ে এবং এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন।
- সমকালীন সমাজে নারীশিক্ষা – ‘সত্তর বৎসর’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সেকালে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার রীতি ছিল না। তখন কুসংস্কার ছিল যে, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে বিধবা হয়। তবে উত্তরবঙ্গে এবং গৌড়ীয় বৈষুব সম্প্রদায়ের মধ্যে নারীশিক্ষা প্রচলিত ছিল।
- সমাজব্যবস্থা – ‘সত্তর বৎসর’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সেই সময়ের সমাজ ছিল পুরুষতান্ত্রিক। গ্রাম্য সমাজে হিন্দু ও মুসলমান পাশাপাশি বসবাস করত এবং তাদের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক ছিল। সমাজে ক্রীতদাস প্রথার প্রচলন ছিল। তা ছাড়া এই গ্রন্থ থেকে তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন রীতিনীতি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, নাচ-গান প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
- তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা – সমকালীন ভারতীয়দের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও সভাসমিতি সম্পর্কে ‘সত্তর বৎসর’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়। ব্রিটিশ সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারতসভা’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই সময় নবগোপাল মিত্র ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত হিন্দুমেলার জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপ সম্পর্কে জানা যায়। তা ছাড়া পুরোনো কলকাতা, তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ, ব্রাহ্মসমাজ, ব্রাহ্মসমাজের ভাঙন, শহরের জীবনযাত্রা প্রভৃতি সম্পর্কেও বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়।
বিপিনচন্দ্র পালের ‘সত্তর বৎসর’ আত্মজীবনীর মূল্যায়ন –
বিপিনচন্দ্র পাল ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ও রাজনীতিবিদ। তাঁর সম্বন্ধে বিনয় কুমার সরকার বলেছেন যে, তিনি ছিলেন 1905 খ্রিস্টাব্দের বঙ্গবিপ্লবের জন্মদাতা ও নেতা। বিপ্লবী নেতা চিদাম্বরম পিল্লাই তাঁকে ‘স্বাধীনতা সিংহ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর লেখা ‘সত্তর বৎসর’ গ্রন্থে সম্পূর্ণ সত্তর বছরের ইতিহাস লেখা হলে আরও অনেক ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যেত। তবে 1880 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে, তা ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ -কে কেন ইতিহাসের উপাদানরূপে গণ্য করা হয়?
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে কীভাবে ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতির’ ভূমিকা –
‘জীবনস্মৃতি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা স্মৃতিকথামূলক একটি গ্রন্থ। ‘জীবনস্মৃতি’ লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘জীবনস্মৃতি’ জীবনের ইতিহাস লেখা নয়। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন এটি তথ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থের মতো লেখা গ্রন্থ নয় – এটি তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করে লেখা। তাই আধুনিক ইতিহাসচর্চায় এই গ্রন্থের গুরুত্ব অপরিসীম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতির’ প্রকাশকাল ও পত্রিকা –
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’ 1319 বঙ্গাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তার আগে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ভাদ্র, 1318 বঙ্গাব্দ থেকে শ্রাবণ, 1319 বঙ্গাব্দ পর্যন্ত এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে প্রাপ্ত তথ্য –
‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হল – ‘শিক্ষারম্ভ’, ‘ঘর ও বাহির’, ‘ভৃত্য-রাজকতন্ত্র’, ‘কবিতা রচনারম্ভ’, ‘স্বাদেশিকতা’, বংশলতিকা-সহ 45টি লেখা (topic)।

- ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল – জীবনস্মৃতি থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তথা ঠাকুর পরিবারের শিশুদের ছেলেবেলা, তাদের শিক্ষালাভ, সংগীতচর্চা প্রভৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তা ছাড়া ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের বিভিন্ন অবস্থা, নারীদের কথা, পুরুষের অবস্থা, ভৃত্যদের কাজকর্ম, উৎসব-অনুষ্ঠান, অতিথি অভ্যর্থনা প্রভৃতি সম্পর্কেও জানা যায়।
- বাঙালি সমাজে জাতীয় চেতনার প্রসার – এই গ্রন্থ থেকে বাঙালি সমাজে জাতীয় চেতনার প্রসারের কথা জানা যায়। বাঙালি সমাজে এই সময়কালে স্বদেশি ভাবধারার প্রসার ঘটে। বাঙালিরা পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণের পাশাপাশি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিও অনুরাগ দেখায়।
- বাঙালির স্বাদেশিকতা – এই গ্রন্থ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ও রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্বাদেশিকতার সভা সম্পর্কে মূল্যবান বহু তথ্য পাওয়া যায়। নবগোপাল মিত্রের হিন্দুমেলা এবং স্বদেশি কাপড়, স্বদেশি দেশলাই প্রভৃতি সম্পর্কে যুবসমাজের উদ্যোগ বিষয়ে বিভিন্ন কথা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।
- রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক যোগ – জীবনস্মৃতি গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলির বিস্তৃত বিবরণ দেননি। তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের দেশাত্মবোধক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন বলে এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতির’ উপসংহার –
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “এই স্মৃতির ভাণ্ডারে অত্যন্ত যথাযথরূপে ইতিহাস সংগ্রহের চেষ্টা ব্যর্থ হইতে পারে।” তিনি এই গ্রন্থ থেকে ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও আধুনিক ইতিহাসচর্চায় তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’র গুরুত্ব অপরিসীম।
সরলাদেবী চৌধুরাণীর ‘জীবনের ঝরাপাতা’ থেকে আমরা কোন্ ঐতিহাসিক তথ্য পেতে পারি?
সরলাদেবী চৌধুরাণীর ‘জীবনের ঝরাপাতার’ ভূমিকা –
‘জীবনের ঝরাপাতা’ হল সরলাদেবী চৌধুরাণীর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। সরলাদেবী চৌধুরাণী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে। জীবনের ঝরাপাতার কাহিনিটি সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় 24 কার্তিক, 1351 বঙ্গাব্দ সংখ্যা থেকে 26 জ্যৈষ্ঠ, 1352 বঙ্গাব্দ সংখ্যা (1944-1945 খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
সরলাদেবী চৌধুরাণীর জীবনের ঝরাপাতা থেকে প্রাপ্ত তথ্য –
জীবনের ঝরাপাতা থেকে সমকালীন ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।

- ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল – জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থ থেকে সরলাদেবী চৌধুরাণী তথা ঠাকুর পরিবারের শিশুদের ছেলেবেলা, তাদের শিক্ষালাভ, সংগীতচর্চা প্রভৃতি সম্পর্কে নানান তথ্য জানতে পারা যায়। তা ছাড়া ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের বিভিন্ন বিষয়, নারী ও পুরুষদের অবস্থা, ভৃত্যদের কাজকর্ম, উৎসব-অনুষ্ঠান, অতিথি অভ্যর্থনা প্রভৃতি সম্পর্কেও বিভিন্ন তথ্য এই গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়।
- স্বাদেশিকতা – সরলাদেবী চৌধুরাণী স্বদেশি দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবহারের প্রচার করার জন্য লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তিনি 1910 খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের সময় নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলন আহ্বান করেন এবং এই সম্মেলনের উদ্যোগে 1911 খ্রিস্টাব্দে ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নারীদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট ছিলেন।
- সরলাদেবীর বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড – জীবনের ঝরাপাতা থেকে সমকালীন সময়ের সশস্ত্র বিপ্লবের নানান কথা ও সরলাদেবীর বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। সরলাদেবী বাঙালি জাতির মধ্যে বীরত্বের সঞ্চার করার জন্য ‘বীরাষ্টমী ব্রত’ ও ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ -এর প্রচলন করেছিলেন। স্বদেশি আন্দোলনের যুগে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য তিনি ছিলেন অন্যতমা প্রেরণাদাত্রী।
- ব্যক্তিগত জীবন – এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সরলাদেবী স্বামী বিবেকানন্দের স্নেহ ও সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। সরলাদেবী 1335 বঙ্গাব্দে কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর অধ্যাত্মসাধনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন।
- সামাজিক জীবন ও অর্থনৈতিক শোষণ – ‘জীবনের ঝরাপাতা’ থেকে সমকালীন সমাজের নারীশিক্ষা, নারীদের আচার-আচরণ, সমাজের বিভিন্ন আদবকায়দা ও ব্রাহ্মসমাজের কার্যকলাপের কথা জানা যায়। ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা কৃষক, শ্রমিক, নীলচাষি ও চা বাগানের কুলিদের উপর শোষণ ও অত্যাচারের কথাও এই গ্রন্থে ফুটে উঠেছে।
সরলাদেবী চৌধুরাণীর ‘জীবনের ঝরাপাতার’ উপসংহার –
‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে সরলাদেবীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধির কথা লেখা আছে। তবে আধুনিক ইতিহাসচর্চায় এই গ্রন্থের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসচর্চার এক অপরিহার্য দলিল।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথাগুলির সীমাবদ্ধতাগুলি লেখো।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার ভূমিকা –
আধুনিক ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় লেখকের ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি সমকালীন আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের এক সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে। শুধু তাই নয় বৃহত্তর ও জাতীয় ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা থেকে জানতে পারি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’, বিপিনচন্দ্র পালের ‘সত্তর বৎসর’, সরলাদেবী চৌধুরাণীর ‘জীবনের ঝরাপাতা’, এলিজার হুইসেলের ‘নাইট’ প্রভৃতি আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথামূলক সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শনসমূহ।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার সীমাবদ্ধতা –
আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য উপাদান হলেও এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যথা –
- ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য – আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথাতে লেখকের ব্যক্তিগত মনোভাব ও মানসিকতার অধিক প্রাধান্য দেখা যায়। ফলে ইতিহাস রচনার জন্য যে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন তার অভাব পরিলক্ষিত হয়।
- তথ্যগত বিভ্রান্তি – আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা মূলত লেখকের স্মৃতিনির্ভর রচনা। অনেক সময় ম্লান স্মৃতির কারণে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির ভুল বা বিকৃত ব্যাখ্যাও দেখা যায়। ফলে তথ্যগত ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
- ইতিহাসগত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব – লেখকের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের স্মৃতি, অভিজ্ঞতা আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার মূল উপজীব্য বিষয়। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই তথ্যের বাস্তব কোনো ভিত্তি নাও থাকতে পারে।
- বিশ্বাসযোগ্যতা ও বিচারবিশ্লেষণ – ইতিহাসের উপাদান হিসেবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথাগুলি প্রধানত ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ। এ ছাড়া পরোক্ষ কিছু বিশেষ ঘটনার বর্ণনাও এখানে থাকে। তাই প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিচারবিশ্লেষণ প্রয়োজন হয়।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার উপসংহার –
এভাবে দেখা যায় আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথাসমূহ ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। তাই এগুলি সচেতনভাবে ব্যবহার করা বিশেষ প্রয়োজন।
ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে চিঠিপত্রের গুরুত্ব লেখো। প্রসঙ্গক্রমে কন্যা ইন্দিরাকে লেখা পিতা জওহরলাল নেহরুর চিঠিগুলির মূল্য বিচার করো।
ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে চিঠিপত্রের ভূমিকা –
আধুনিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন মনীষী, রাজনীতিবিদ, সরকারি আধিকারিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের লেখা চিঠিও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রের ইতিহাস রচনায় গুরুত্ব লাভ করেছে। যেমন – ইন্দিরা গান্ধিকে লেখা জওহরলাল নেহরুর চিঠি – ‘লেটারস ফ্রম এ ফাদার টু হিজ ডটার’ (Letters from a Father to His Daughter) আধুনিক ইতিহাসচর্চার অন্যতম উপাদান হয়ে উঠেছে।
ইন্দিরাকে লেখা জওহরলাল নেহরুর চিঠি –
আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসের গবেষণার অমূল্য উপাদান হল কন্যা ইন্দিরাকে লেখা জওহরলাল নেহরুর 30টি ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের সংকলন – ‘Letters from a Father to His Daughter’। জাতীয় আন্দোলনের এক উত্তাল সময়পর্বে, সাইমন কমিশনবিরোধী আন্দোলন-সহ একাধিক আন্দোলনের ব্যস্ততার মধ্যে জওহরলাল নেহরু এলাহাবাদের পৈতৃক বাড়ি থেকে মুসৌরিতে থাকা মেয়ে ইন্দিরাকে এই চিঠিগুলি লিখেছিলেন 1928 খ্রিস্টাব্দে। ইন্দিরার তখন মাত্র 10 বছর বয়স।

জওহরলাল নেহরুর দৃষ্টিভঙ্গি –
পণ্ডিত নেহরু তাঁর কন্যাকে 30টি ছোটো ছোটো চিঠি লেখেন, যেগুলি বিশ্লেষণ করলে নেহরুর ইতিহাসবোধ, রাষ্ট্রদর্শন, নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায়, তা অতি গুরুত্বপূর্ণ। চিঠিগুলিতে পৃথিবীর উৎপত্তিতত্ত্ব থেকে প্রাচীন সভ্যতার উন্মেষ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। এই চিঠিগুলি থেকে নেহরুর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কেও জানা যায়।
ইন্দিরাকে লেখা জওহরলাল নেহরুর চিঠিগুলির প্রধান বিষয় –
- চিঠিগুলিতে তিনি ইন্দিরাকে ইতিহাসের এক ধারাবাহিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এতে তিনি পৃথিবীর উৎপত্তি, জীবজন্তুর আবির্ভাব, আদিম মানুষের জীবনযাত্রা, মানবসমাজের বিবর্তন ও উন্নয়ন সম্পর্কে সহজসরল আলোচনা করেছেন।
- তিনি শিশুকন্যার মধ্যে ইতিহাসবোধ গড়ে তোলার জন্য আগুনের আবিষ্কার, ভাষা, লিপি, শিল্প, ব্যাবসাবাণিজ্য, সমুদ্রযাত্রা প্রভৃতি বিষয়ে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
- ভারতের ইতিহাস বিষয়ে আর্যদের আগমন, রামায়ণ ও মহাভারতের ঘটনা – সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
ইন্দিরাকে লেখা জওহরলাল নেহরুর চিঠিগুলির গুরুত্ব –
- সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা – জওহরলাল নেহরুর লেখা চিঠিগুলি থেকে মানবসভ্যতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে সহজসরল ধারণা পাওয়া যায়। তিনি চিঠিতে মানুষের ক্রমবিবর্তন, আগুনের আবিষ্কার, কৃষি-শিল্প, ব্যাবসাবাণিজ্য, সমুদ্রযাত্রা প্রভৃতি বিষয়েও সাধারণ ধারণা দিয়েছেন।
- জাতীয় বর্ণপ্রথা – নেহরু বলেছেন, মানুষের মধ্যে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের দাবি ঠিক নয়। কারণ বিভিন্ন পরিবেশ ও আবহাওয়ার কারণে মানুষের গায়ের রং বা বর্ণ নির্ধারিত হয়েছে। তাই বর্ণশ্রেষ্ঠত্বের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ও অযৌক্তিক।
- ধর্ম – জওহরলাল নেহরুর মতে, মানুষের মধ্যে ধর্মের উদ্ভব হয়েছে ভয় থেকে। ধর্মকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠী বা সাম্প্রদায়িক হানাহানিও হয়। তবে ধর্মের মধ্যে অনেক ভালো দিকও রয়েছে বলে তিনি মনে করতেন।
- ভৌগোলিক ধারণা – চিঠিতে নেহরু ইন্দিরাকে লিখেছেন – ভারত একটি বিশাল দেশ, তবে তা পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র অংশ। অপরদিকে ইংল্যান্ড একটি ছোটো দেশ। ভারতের তুলনায় আয়তনেও অনেক ছোটো, কিন্তু পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ ইংল্যান্ডের অধীনস্থ।
ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে চিঠিপত্রের উপসংহার –
‘Letters from a Father to His Daughter’ চিঠির সংকলনটি জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধির মানসিকতা ও আদর্শ সম্পর্কে জানার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রেও তার গুরুত্ব অপরিসীম। জওহরলাল নেহরু পরে বলেছিলেন, ‘যারা এগুলি পড়বে তারা ধীরে ধীরে আমাদের এই পৃথিবীকে বিভিন্ন জাতি নিয়ে তৈরি একটি বৃহৎ পরিবার হিসেবে ভাবতে শুরু করবে।’ বিখ্যাত হিন্দি সাহিত্যিক মুনসি প্রেমচাঁদ এই বইটি ‘পিতাকে পত্র পুত্রীকে নাম’ শিরোনামে হিন্দিতে অনুবাদ করেন। এর বাংলা অনুবাদ ‘কল্যাণীয়াসু ইন্দু’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
সংবাদপত্র এবং সাময়িকপত্র -এর মধ্যে পার্থক্য কী?
সংবাদপত্র এবং সাময়িকপত্র -এর ভূমিকা –
সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে দুই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি লাভের পাশাপাশি দৈনন্দিন বা সাপ্তাহিক ঘটনাবলির নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহেও সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।
সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের মধ্যে পার্থক্য –
আধুনিক ভারত সম্পর্কে সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশন করলেও উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য বর্তমান। যথা –
- সময়কালগত পার্থক্য – সংবাদপত্রের সময়কাল সাময়িকপত্র প্রকাশের অনেক আগে বলে মনে করা হয়।
- আকার আকৃতিগত পার্থক্য – সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের মধ্যে আকার আকৃতিগত বেশ কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে। সংবাদপত্রগুলি আকারে সাময়িকপত্রের তুলনায় অনেকটাই বড়ো হয়। এর পৃষ্ঠাগুলি সাধারণত খোলাই থাকে। অন্যদিকে সাময়িকপত্রগুলির আয়তন তুলনামূলকভাবে ছোটো হয় এবং বহুক্ষেত্রে তা বইয়ের মতো বাঁধাই করা থাকে।
- প্রকাশনার সময়কাল – সাময়িকপত্র প্রকাশনার নির্দিষ্ট সময়কাল থাকে। কখনো সাপ্তাহিক হিসেবে বা কখনো এক মাস ব্যবধানেও তা প্রকাশিত হয়। কিন্তু সংবাদপত্র দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলি তুলে ধরে। তাই এটি প্রতিদিন এমনকি দিনে একের অধিকবারও প্রকাশিত হয়।
- বিষয়গত পার্থক্য – সংবাদপত্রগুলি থেকে সাধারণত আমরা দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলি, সমাজের বিভিন্ন দিকের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাই। সেখানে প্রতিটি বিষয় গুরুত্ব পায়। কিন্তু সাময়িকপত্র নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করেও প্রকাশিত হতে পারে। সেটি যেমন সমাজের বিশেষ কোনো দিকও হতে পারে আবার ঐতিহাসিক গবেষণাসমৃদ্ধ কাজও হতে পারে।
- সংবাদ পরিবেশনায় গুরুত্বগত পার্থক্য – সংবাদপত্রগুলি প্রতিনিয়ত যে ঘটনাবলি ঘটছে তা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে পরিবেশন করলেও কোনো মৌলিক গবেষণাধর্মী কাজ বা প্রবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে না। কিন্তু সাময়িকপত্রগুলি সমসাময়িক সংবাদ পরিবেশন ছাড়াও গবেষণামূলক রচনা প্রকাশের উপরেও যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করে।
সংবাদপত্র এবং সাময়িকপত্র -এর উপসংহার –
এইভাবে দেখা যায়, সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের মধ্যে মূলগত কিছু পার্থক্য থাকলেও আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে উভয়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
আধুনিক ভারত ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের গুরুত্ব আলোচনা করো।
আধুনিক ভারত ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের ভূমিকা –
সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র আধুনিক ভারত ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক উপাদান রূপে স্বীকৃত। উনিশ শতক থেকে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রিকার বিকাশ ভারত ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে।
সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের গুরুত্ব –
সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল –
- সমকালীন ঐতিহাসিক তথ্য – সমকালীন ঐতিহাসিক তথ্য সম্পর্কে জানতে এই পত্রপত্রিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমকালীন সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কার আন্দোলন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জোগান দেয় সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলি।
- ব্রিটিশ সরকারের শোষণের কদর্য রূপ – উনিশ শতকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারী ভাবমূর্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এই সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রিকাগুলিতে। এ প্রসঙ্গে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার কথা বলা যায়। বাংলার নীলচাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অমানুষিক অত্যাচার, দরিদ্র সাঁওতালদের উপর ইংরেজদের উৎপীড়ন এই পত্রিকায় তুলে ধরা হয়।
- জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার বিকাশ – সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রগুলিতে ব্রিটিশ সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয়দের আন্দোলনের খবর প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হত। যেমন – ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা থেকে ‘দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইনবিরোধী’, ‘ইলবার্ট বিল’ – সংক্রান্ত ভারতীয়দের আন্দোলন ইত্যাদি খবর প্রকাশিত হত। এগুলি ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্যবোধ ও জাতীয়তাবোধের বিস্তারে সহায়ক ছিল।
- জনমত গঠন – জনমত গঠনেও সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রিকাগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এগুলিতে সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলন, সমাজসংস্কার, সমাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটত। এ ছাড়া সিপাহি বিদ্রোহ সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালির বিরূপ মনোভাব বা নীলবিদ্রোহ বিষয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির সমর্থন ও সহযোগিতা প্রভৃতি পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন দিক সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার গুরুত্ব আলোচনা করো।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার ভূমিকা –
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রকাশিত বঙ্গদর্শন পত্রিকায় আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ও সম্পাদক –
1872 খ্রিস্টাব্দের 12 এপ্রিল ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার গুরুত্ব –
সমকালীন ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য জানার ক্ষেত্রে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম –
- সমকালীন তথ্য – বঙ্গদর্শন পত্রিকা থেকে সমকালীন সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, ধর্ম, সংস্কার আন্দোলন প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এই পত্রিকা থেকে ব্রিটিশ সরকারের শাসন ও শোষণের পরিচয়ও পাওয়া যায়।
- বাঙালির স্বদেশচেতনা – বঙ্গদর্শন পত্রিকা বাঙালি জাতির মধ্যে স্বদেশচেতনার সঞ্চার করে। এই পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতটি প্রথম প্রকাশিত হয়, যা পরবর্তীকালে বাঙালি তথা ভারতীয় বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল মন্ত্রে পরিণত হয়েছিল।
- সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার – এই পত্রিকায় ‘সাম্য’-সহ বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর ফলে বাঙালি সমাজে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার ঘটে।
- বাঙালি সমাজের মেলবন্ধন – বঙ্গদর্শন পত্রিকা সমকালীন বাঙালি জাতির উচ্চশিক্ষিত সম্প্রদায়ের চিন্তাধারা তুলে ধরত, যা অগণিত সাধারণ পাঠক ও শ্রোতার সঙ্গে উচ্চশিক্ষিত ও সাধারণ বাঙালির ভাবধারার মেলবন্ধন ঘটাত।
‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার উপসংহার –
তৎকালীন পরিস্থিতিতে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা ছিল একটি অতি জনপ্রিয় পত্রিকা। এই পত্রিকা বাঙালি জাতির মনে যে নতুন উৎসাহ ও উদ্দীপনা এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঞ্চার করেছিল, তা নতুন সমাজ গঠনের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে সোমপ্রকাশ পত্রিকার গুরুত্ব আলোচনা করো।
অথবা, সোমপ্রকাশ – টীকা লেখো।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে সোমপ্রকাশ পত্রিকার ভূমিকা –
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত সোমপ্রকাশ পত্রিকা থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পাওয়া যায়।
সোমপ্রকাশ পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ও সম্পাদক –
1858 খ্রিস্টাব্দে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ।
সোমপ্রকাশ পত্রিকার গুরুত্ব –
সমকালীন ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য জানার ক্ষেত্রে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম –
- সমকালীন তথ্য – এই পত্রিকা থেকে সমকালীন সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, ধর্ম, সংস্কার আন্দোলন প্রভৃতি বিষয়ে নানান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এই পত্রিকার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের শাসন ও শোষণের কদর্য রূপের সঙ্গে সাধারণ ভারতীয়রা পরিচিত হয়।
- বাঙালির সমাজসংস্কার – সোমপ্রকাশ পত্রিকা সমকালীন বাঙালি সমাজের সংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই পত্রিকা বাঙালি সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পণপ্রথা প্রভৃতি বিষয়ের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশ করত। তৎকালীন সমাজে বিধবাবিবাহের প্রসারেও ‘সোমপ্রকাশ’ জনমত গঠনে সচেষ্ট হয়েছিল।
- ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন – সোমপ্রকাশ পত্রিকা ব্রিটিশ সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয়দের আন্দোলনের খবর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করত। এই পত্রিকা থেকে ‘দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইনবিরোধী’, ‘ইলবার্ট বিল’-সহ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের বিভিন্ন আন্দোলন সম্পর্কে জানা যায়।
- দেশীয় ভাষার সংবাদপত্রের অবস্থা – এই পত্রিকা থেকে সেই সময়কালে প্রকাশিত দেশীয় ভাষার সংবাদপত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সোমপ্রকাশ ছিল দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত একটি নির্ভীক সাপ্তাহিক পত্রিকা। এতে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী নীতির সমালোচনা করা হত। এইজন্য এই পত্রিকাটি ব্রিটিশ সরকারের সংবাদপত্র আইনের কোপে পড়ে। সম্পাদককে মুচলেকা ও জরিমানা দিতে বলা হয়। সম্পাদক তা দিতে অস্বীকার করলে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করা হয়।
সোমপ্রকাশ পত্রিকার উপসংহার –
‘সোমপ্রকাশ’ ছিল তৎকালীন একটি নির্ভীক জনপ্রিয় পত্রিকা। 1878 খ্রিস্টাব্দে দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইনের কবলে পড়ে এটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে 1880 খ্রিস্টাব্দ থেকে এটি পুনরায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু পূর্বের জনপ্রিয়তা অনেক কমে যায় ও ধীরে ধীরে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
বঙ্গদর্শন ও সোমপ্রকাশ থেকে কোন্ ধরনের ইতিহাস রচনার উপাদান পাওয়া যায়?
অথবা, ইতিহাসের উপাদানরূপে ‘বঙ্গদর্শন’ এবং ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা দুটির মূল্যায়ন করো।
ইতিহাসের উপাদানের ভূমিকা –
ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে লিখিত উপাদানের গুরুত্ব অপরিসীম। লিখিত উপাদান বিভিন্ন রকমের হয়। সাময়িক পত্রপত্রিকা হল লিখিত উপাদানগুলির মধ্যে অন্যতম। এই উপাদান থেকে সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের নানান প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।
ইতিহাসের উপাদানরূপে বঙ্গদর্শন ও সোমপ্রকাশ –
বঙ্গদর্শন ও সোমপ্রকাশ ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দুটি সাময়িক পত্রিকা। এই পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের বাংলাদেশের বহু তথ্য পাওয়া যায়।

বঙ্গদর্শন পত্রিকা –
1872 খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রকাশ করেন। মূলত এই পত্রিকাটি সাহিত্যধর্মী ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রথম পাতা হলেও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবাদী উপাদানে পরিপূর্ণ ছিল। এই পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিষবৃক্ষ ও ইন্দিরা উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই পত্রিকায় লিখতেন। এই পত্রিকায় বাংলা ভাষার রূপান্তর, বিবর্তন ও পরিপূর্ণতা লক্ষ করা যায়। জাতীয়তাবাদী ক্ষেত্রে হিন্দু জাগরণের ধারক ও বাহক ছিল এই পত্রিকা। এই পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বন্দেমাতরম’ সংগীত বিপ্লবীদের মন্ত্রস্বরূপ ছিল। এ ছাড়া প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, সংগীত, বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশ করে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের পথ প্রশস্ত করেছিল বলা যায়।
বঙ্গদর্শন পত্রিকার উপাদানগত মূল্য –
বঙ্গদর্শন থেকে উপাদান সংগ্রহ করে সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকার বিবর্তনের দিকগুলিকে বোঝা যেতে পারে। বাংলা ভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তন এবং সম্পাদক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের বিভিন্ন বিষয়ে মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কেও জানা সম্ভবপর হয়। এ ছাড়া উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাস রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেও বঙ্গদর্শনকে গণ্য করা যেতে পারে।
সোমপ্রকাশ –
1858 খ্রিস্টাব্দের 15 নভেম্বর দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সম্পাদনায় সোমপ্রকাশ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। জনকল্যাণ এই পত্রিকার আদর্শ ছিল। রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয় নিয়ে বিভিন্ন লেখা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিশেষত বিধবাবিবাহ আন্দোলন, ভারতে নারীশিক্ষার প্রসার, শিল্পায়ন, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ, মহারানির ঘোষণাপত্র, নীলচাষিদের আন্দোলন, জমিদারি ব্যবস্থার কুফল, ইলবার্ট বিল সমর্থন, জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত, দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইনের বিরোধিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই পত্রিকায় লেখা হত।
সোমপ্রকাশ পত্রিকার উপাদানগত মূল্য –
‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা ভারতীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। এই পত্রিকায় রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রশ্ন নিয়ে সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। সমসাময়িক বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাস রচনার আকর উপাদান হিসেবে এই পত্রিকাকে ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে ধ্যানধারণার পরিবর্তনের ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে এই পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত উপাদানকে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইতিহাসের উপাদানরূপে ‘বঙ্গদর্শন’ এবং ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা দুটির মূল্যায়ন –
‘বঙ্গদর্শন’ ও ‘সোমপ্রকাশ’ এই দুটি পত্রপত্রিকার উপাদানগত মূল্য বিচারের পর বলা যায় আধুনিক ইতিহাসচর্চায় এগুলি হল এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রথমত, তারা সেইসব রাজনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধগুলি নথিবদ্ধ করে যেগুলি সেই সময় প্রভাবশালী ছিল। দ্বিতীয়ত, সংবাদপত্রগুলি দৈনন্দিন বা সাপ্তাহিক ঘটনাবলির বিবরণ দেয়।
ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে আলোচনা করো।
ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধার ভূমিকা –
কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ইন্টারনেট বলা হয়। ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে বর্তমান যুগে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটেছে। তাই বর্তমান যুগকে ‘তথ্য-বিস্ফোরণের যুগ’ বলা হয়। ইন্টারনেটের সাহায্যে ইতিহাসের অনেক তথ্য পাওয়া যায় তবে ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহে ইন্টারনেট ব্যবহারের যেমন সুবিধা আছে তেমনি বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে।
ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধাসমূহ –
- তথ্যের সহজলভ্যতা – ইন্টারনেটের সাহায্যে ঘরে বসে দেশ-দুনিয়ার অসংখ্য তথ্য নিমেষের মধ্যে জানা যায়। ইন্টারনেট থেকে সহজে বহু তথ্যসংগ্রহ করে ইতিহাস রচনা করা যায়।
- সহজে মূল তথ্য ও ছবি সংগ্রহ – ইন্টারনেটের সাহায্যে বিভিন্ন বিষয়ের মূল তথ্য ও তার ছবি পাওয়া যায়, যার ফলে বিশেষ বিষয় সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়। ‘অনলাইন লাইব্রেরি’ ও ‘আর্কাইভ’ থেকে আসল বই ও রিপোর্টের কপি পাওয়া যায়।
- সময় সাশ্রয় – বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বই বা অন্য উৎস থেকে তথ্যসংগ্রহ করা প্রচুর সময়সাপেক্ষ। কিন্তু ইন্টারনেটের সাহায্যে অল্প সময়ে প্রচুর তথ্যসংগ্রহ করা যায়।
- কম খরচে তথ্যসংগ্রহ – ইন্টারনেটের সাহায্যে কম খরচে অনেক বেশি তথ্য পাওয়া যায়। বই কিনে বা অন্যভাবে তথ্যসংগ্রহ করা অনেক বেশি ব্যয়বহুল।
ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহে ইন্টারনেট ব্যবহারের অসুবিধাসমূহ –
তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে।
- প্রাপ্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতার অভাব – ইন্টারনেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য কতটা নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য তা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকে নিজের মনগড়া বা বিকৃত তথ্য সংযোজন (upload) করে থাকে।
- পরস্পরবিরোধী তথ্য – ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে (website) একই বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের ও পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যায়, যে তথ্যগুলি ইতিহাস রচনায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
- তথ্যের অসম্পূর্ণতা – অনেক ক্ষেত্রে ইন্টারনেটে প্রয়োজনীয় বিষয়ের উপর আংশিক তথ্য পাওয়া যায়। তা ছাড়া সব বিষয়ের সঠিক তথ্যও অনেকসময় পাওয়া যায় না।
- যন্ত্র-প্রযুক্তিগত অসুবিধা – ইন্টারনেট ব্যবহার করে তথ্যসংগ্রহ করার জন্য বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন যন্ত্র-প্রযুক্তির সহায়তা প্রয়োজন, যা সবসময় সব জায়গায় পাওয়া সম্ভব নয়।
ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহে ইন্টারনেট ব্যবহারের উপসংহার –
তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহে ইন্টারনেট বিশেষভাবে সহায়ক। কিন্তু এই ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত নয়। ইন্টারনেট থেকে তথ্যসংগ্রহ করে ইতিহাস রচনা করতে গেলে ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য যতটা সম্ভব মূল নথি বা উৎসের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া উচিত। তবেই প্রকৃত ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হবে।
আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের প্রথম অধ্যায় “ইতিহাসের ধারণা” “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।
আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।
ধন্যবাদ সবাইকে।
মন্তব্য করুন