মাধ্যমিক ইতিহাস – সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

Rahul

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় “সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর থেকে “ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস - সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
Contents Show

উনিশ শতকের নারীকল্যাণে বামাবোধিনী পত্রিকার অবদান আলোচনা করো।

উনিশ শতকের নারীকল্যাণে বামাবোধিনী পত্রিকার ভূমিকা –

উনিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলা তথা ভারতবর্ষের সমাজজীবনে শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্থবিরতা ছিল। বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশিরা কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেও তা ছিল শুধুমাত্র বালকদের জন্য। সামাজিক ও পারিবারিক কারণে বাংলাদেশে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত সংকটজনক। এই দুরবস্থা থেকে নারীদের উদ্ধারের কাজে বামাবোধিনী পত্রিকা প্রচার চালায়। এই পত্রিকাই হল নারীদের জন্য বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম মাসিক পত্রিকা।

বামাবোধিনী পত্রিকার প্রকাশকাল –

1863 খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ প্রথম প্রকাশিত হয়।

বামাবোধিনী পত্রিকার প্রকাশক –

বামাবোধিনী পত্রিকার প্রথম প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত।

উনিশ শতকের নারীকল্যাণে বামাবোধিনী পত্রিকা-র অবদান আলোচনা করো।

নারীকল্যাণে বামাবোধিনী পত্রিকার অবদান –

নারীশিক্ষা –

বামাবোধিনী পত্রিকা নারীশিক্ষার উপর জোর ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-র একটি পৃষ্ঠা দিয়েছিল। কারণ পত্রিকাটি ছিল ব্রাহ্মসমাজের। ব্রাহ্মসমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিরা ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে নারীকল্যাণের বিষয়টি চিন্তা করেছিলেন। তারা মনে করতেন, সমাজের অর্ধেক অংশ যে নারীরা, তাদের অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে বাকি অর্ধেক অংশের উন্নতি হতে পারে না।

  • বাড়িতে লেখাপড়া – বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা কম থাকায় এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বাড়ির মধ্যে লেখাপড়া করার জন্য ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-য় পরামর্শ দেওয়া হয়। এই পত্রিকা নারীশিক্ষার জন্য সংক্ষিপ্ত পাঠ্যক্রমের প্রস্তাব করে। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বাড়ির পুরুষদের দায়িত্ব গ্রহণেরও প্রস্তাব দেয়। পত্রিকার প্রথম পাতায় তাই ‘কন্যায়েব পালনীয়া’ – এই সংস্কৃত শ্লোকটি লেখা থাকত।
  • বিদ্যালয়ে লেখাপড়া – এসময় বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ে সংকট দেখা দিলে পত্রিকাটি সমবেদনা প্রকাশ করে। 1868 খ্রিস্টাব্দের একটি সংখ্যায় পত্রিকাটি লিখেছিল, “আমরা শুনিয়া দুঃখিত হইলাম যে এ দেশের সর্বপ্রধান বেথুন বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে 30টি মাত্র ছাত্রী অধ্যয়ন করিতেছে।” ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার তথ্য উদ্ধৃতি দিয়ে অর্থের অপচয় ও ছাত্রীসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার ঘটনায় পত্রিকা দুঃখ প্রকাশ করে।

মিশনারিদের উদ্যোগে যেসব বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে প্রতি মাসে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ -র প্রকাশিত সংখ্যা পাঠানো হত। এভাবে শিক্ষাপ্রসারে এই পত্রিকা উৎসাহ দেয় এবং নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করে।

নারীসমাজের সংস্কার –

বামাবোধিনী পত্রিকা তৎকালীন সমাজের কুসংস্কার দূর করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই পত্রিকা সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অসম বা বার্ধক্য বিবাহের বিরোধিতা করেছিল। পাশাপাশি অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ প্রভৃতি প্রগতিশীল সংস্কারের সমর্থক ছিল।

  • আদর্শ অনুসরণ – ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ বাঙালি নারীদের সামনে গার্গী, মৈত্রেয়ীর মতো বিদুষী নারীদের আদর্শ তুলে ধরে। পত্রিকায় লেখা হয়, সেই সুদূর অতীতে নিজ নিজ চেষ্টায় এইসব নারীরা জ্ঞান অর্জনে ব্রতী ছিলেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁরা যেভাবে পারদর্শিতা লাভ করেন, তাঁদের অনুসরণ করেই বাঙালি নারীদেরও শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে আসা দরকার।
  • আচার-অনুষ্ঠান পালন – বাংলা হিন্দুসমাজে যেসব মাঙ্গলিক আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল সেগুলি পালনের কথা পত্রিকায় লেখা হত। যেমন – ভাইফোঁটা, রাখিবন্ধন, বিভিন্ন ব্রত প্রভৃতি। নারীদের এই অনুষ্ঠান পালন করতে বলার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠান বিষয়ক বিভিন্ন কথা ও কাহিনি লেখা হত। এগুলির উৎপত্তি ও গুরুত্বের কথাও থাকত সেই লেখায়।
উনিশ শতকের নারীকল্যাণে বামাবোধিনী পত্রিকা-র অবদান আলোচনা করো।

বামাবোধিনী পত্রিকার সীমাবদ্ধতা –

এই পত্রিকা উনিশ শতকে বাংলার নারীসমাজের উন্নতির চেষ্টা করলেও তার বহু সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন –

  • এই পত্রিকা প্রচারিত হয় মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দু নারীদের মধ্যে।
  • পত্রিকা প্রচারিত হত কলকাতা ও মফস্সল অঞ্চলে। ফলে গ্রামাঞ্চলের নারীদের কল্যাণ পত্রিকায় স্থান পায়নি।
  • পত্রিকার পাঠিকাসংখ্যা সীমিত ছিল।

বামাবোধিনী পত্রিকার মূল্যায়ন –

সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয়, ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ বাংলা নারীকল্যাণে যে উদ্যোগ নিয়েছিল সমকালে আর কোনও পত্রিকা অনুরূপ উদ্যোগ নেয়নি। শিক্ষাপ্রসারে নারীসমাজকে সচেতন করার ক্ষেত্রে তাই এই পত্রিকার অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের বাংলার কী ধরনের সমাজচিত্র পাওয়া যায়?

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার ভূমিকা –

যেসব সংবাদপত্র থেকে উনিশ শতকের বাংলা সমাজের প্রতিফলন পাওয়া যায় সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা। এই পত্রিকা থেকে সামাজিক শোষণ, সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীলকর সাহেবদের অত্যাচার প্রভৃতি বিষয়ে জানা যায়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রকাশকাল ও প্রকাশক –

1853 খ্রিস্টাব্দের 6 জানুয়ারি কলকাতার জনৈক ব্যাংকার মধুসূদন রায় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশ করেন। তখন গিরীশচন্দ্র ঘোষ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটি প্রথমে ইংরেজি সাপ্তাহিক ছিল, পরে 1892 খ্রিস্টাব্দের 16 মার্চ তা দৈনিক পত্রিকায় পরিণত হয়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সামাজিক প্রতিফলন –

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার সমাজজীবনে ঘটা গুরুত্বপূর্ণ সকল ঘটনার প্রতিফলন দেখা যায় হিন্দু
প্যাট্রিয়ট পত্রিকায়।

  • উদীয়মান মধ্যবিত্তশ্রেণির চরিত্র, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে এই পত্রিকায়। পত্রিকাটি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হত এবং পত্রিকার পাঠকরা ইংরেজি-শিক্ষিত ছিলেন – যা সমাজের একটি আলোকিত গোষ্ঠীর (elite) অস্তিত্বের পরিচয় দেয়।
  • পত্রিকাটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র ছিল। জমিদার শ্রেণির এই সমিতিটি সর্বদাই মধ্যবিত্তশ্রেণির স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট ছিল।
হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের বাংলার কী ধরনের সমাজচিত্র পাওয়া যায়?

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার অর্থনৈতিক প্রতিফলন –

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ছিল কৃষিজীবী। চিরস্থায়ী ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, রাজস্বের চড়া হার, জমিদারি শোষণ ও অত্যাচার, কৃষিজীবীদের অভাব-অভিযোগ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার রাজনৈতিক প্রতিফলন –

  • আন্দোলনে সমর্থন – এই পত্রিকার মাধ্যমে ভারতবাসীর রাজনৈতিক মতামত প্রতিফলিত হয়। যথা –
    • এই পত্রিকা প্রকাশের কিছুদিন পরেই সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটে (1855 খ্রিস্টাব্দ)। বিদ্রোহের খবর এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়।
    • এর অল্পকাল পর সিপাহি বিদ্রোহ (1857 খ্রিস্টাব্দ) ঘটে। এই বিষয়ে পত্রিকায় বিভিন্ন নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
    • তারপর বাংলায় নীলচাষিদের আন্দোলন দেখা দেয়। তখন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর চেষ্টায় নীলচাষিদের আন্দোলনের কাহিনি ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকা এই ঘটনাগুলিকে সমর্থন জানায়।
  • সরকারি নীতির বিরোধিতা ও সমর্থন – এই পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসী সরকারি নীতির বিরোধিতা করে।
    • বড়োলাট লর্ড লিটন ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক। তিনি সরকারের সমালোচনা বন্ধ করার জন্য 1878 খ্রিস্টাব্দে দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন (Vernacular Press Act) জারি করেন। এর দ্বারা সরকারি নীতির সমালোচক, দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদক, মুদ্রাকর ও ছাপাখানার মালিকের কারাবাসের ব্যবস্থা করা হয়। হিন্দু প্যাট্রিয়ট এর প্রতিবাদ জানায়।
    • সরকার ইমিগ্রেশন বিল পাস করে আসামের চা-বাগানে বিহার থেকে শ্রমিক সরবরাহের ব্যবস্থা করে। পত্রিকা এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে।
    • উদারবাদী বড়োলাট লর্ড রিপন বিচারব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করার জন্য 1883 খ্রিস্টাব্দে ইলবার্ট বিল তৈরি করেন। এর প্রতিবাদে ইংরেজরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রা বিলকে সমর্থন জানিয়ে পালটা আন্দোলন করে। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা জাতীয়তাবাদী মতকে সমর্থন জানায়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সীমাবদ্ধতা –

তবে এই পত্রিকাটির কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। যেমন – বাংলার নারীসমাজের কথা পত্রিকায় থাকত না। পত্রিকা বাংলার বৃহত্তর সমাজের কাছে পৌঁছোতে পারেনি, একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। জনগণের মধ্যে শিক্ষার অভাব, কুসংস্কারের প্রভাব ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ নীরব ছিল।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার মূল্যায়ন –

ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও এ কথা বলতে হয়, ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত এই পত্রিকা বাংলায় ইংরেজি-শিক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করত। পত্রিকাটি জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করে। এ ছাড়া, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহের কাহিনি প্রচার করে ভারতীয়দের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।

হুতোম প্যাঁচার নক্শা গ্রন্থ থেকে উনিশ শতকের বাংলা সমাজের কী প্রতিফলন পাওয়া যায়?

কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত হুতোম প্যাঁচার নক্শা গ্রন্থটি 1861 খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ এই গ্রন্থে তৎকালীন বাঙালি সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন। এই গ্রন্থটিতে ব্রিটিশ আমলের কলকাতা ও তার আশপাশে অর্থসম্পদে ফুলেফেঁপে ওঠা এক সমাজের বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।

হুতোম প্যাঁচার নক্শায় সমাজের ধ্বজাধারীদের শ্রেণিবিভাজন –

এই গ্রন্থে যাদের ব্যঙ্গ করা হয়েছে, তারা হলেন সেই সময়ের অগ্রবর্তী বা ধ্বজাধারী মানুষজন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লেখক নিজেও এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। লেখক তাদের তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন –

হুতোম প্যাঁচার নক্শা গ্রন্থ থেকে উনিশ শতকের বাংলা সমাজের কী প্রতিফলন পাওয়া যায়?
  • ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরণকারী।
  • ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কিন্তু অন্ধ অনুকরণকারী নয়।
  • ইংরেজি না জানা গোঁড়া হিন্দু।

তবে, এদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল – এরা সকলেই কমবেশি বিভিন্ন ফন্দিফিকির করে বা অসৎ উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করে।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার জ্ঞাতব্য বিষয় –

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা থেকে –

  • সমকালীন সমাজের বাস্তব জীবন,
  • সমকালীন সমাজে ব্যবহৃত মুখের ভাষা এবং
  • সমাজকে প্রগতির পথে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সমাজের প্রতিফলন –

  • ধনী সমাজের হীনতা, কপটতা – কালীপ্রসন্ন সিংহ নিজেই ছিলেন উনিশ শতকের এক ধনী পরিবারের সন্তান। ফলে তিনি ধনী সম্প্রদায়ের মানুষজনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর নকশায় এদের হীনতা, কপটতা ও ভণ্ডামির কথা তুলে ধরেছেন ও তার বিরুদ্ধে শানিত বাণনিক্ষেপ করেছেন। তাঁর আক্রমণের ভাষা ছিল তীক্ষ্ণ, শ্লেষাত্মক ও ঝাঁঝালো।
  • সামাজিক সংস্কার ও সংস্কারক – হুতোম প্যাঁচার নক্সা গ্রন্থের প্রচ্ছদ হুতোম প্যাঁচার নক্শায় উনিশ শতকের বাংলা সমাজের সতীদাহপ্রথা রোধ, বিধবাবিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি বিষয়ের নানান ঘটনার প্রতিফলন পাওয়া যায়। এইসব প্রথার বিরুদ্ধে ও প্রচলনের সপক্ষে যে আন্দোলন হয়েছিল, সে সম্পর্কেও কতিপয় নক্শা রচিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেও ভোলেননি। নক্শায় যেসব মনীষীদের তিনি বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন – রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ।
  • সমকালীন লোকসংস্কৃতি – হুতোম প্যাঁচার নক্শায় লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদান সম্পর্কে জানতে পারা যায়। মূলত এই নক্শাগুলি লোকায়ত কাঠামোর উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর নাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – চড়ক পার্বণ, কলিকাতার বারোয়ারি পুজো, মাহেশের স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, দুর্গোৎসব, রাসলীলা প্রভৃতি। এ ছাড়াও তাঁর বিভিন্ন নক্শায় নীলের রাত্রির ব্রত, পাঁচালি, যাত্রাগান, পিঠেপার্বণ বা পৌষসংক্রান্তি, ষষ্ঠীর বাটা প্রভৃতি লোকসংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায়। এই সময়ের বাবুচিত্র রচনায় পাঁচালি, টপ্পা, আখড়া ইত্যাদি লোকায়ত উপকরণকেও তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
  • সমকালীন শিক্ষা ও সাহিত্য – উনিশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে হুতোম প্যাঁচার নক্শা-য় অনেক ভিন্নধর্মী চিত্র পাওয়া যায়। এই নক্শাগুলি থেকে একদিকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও অন্যদিকে বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষার নানান কথা জানা যায়। এই সময়ের বাংলা গ্রন্থের মধ্যে যেগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সেগুলি হল – চাণক্য শ্লোক, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়, সীতার বনবাস, টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলাল প্রভৃতি।
হুতোম প্যাঁচার নক্শা গ্রন্থ থেকে উনিশ শতকের বাংলা সমাজের কী প্রতিফলন পাওয়া যায়?

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার উপসংহার –

কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর হুতোম প্যাঁচার নক্শা-য় তৎকালীন সমাজজীবন ও ব্যক্তিজীবনের ক্ষতস্থানগুলিকে চিহ্নিত করে তার নিরাময়ের কথা বলে দেশের উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করেছেন। তিনি তৎকালীন বড়োলোকদের লাম্পট্য, মাদকাসক্তি ও নানান দুষ্কর্মের নক্শা রচনা করে তাঁর উদ্দেশ্যসাধন করতে চেয়েছেন। এই নক্শাগুলির দ্বারা তিনি স্বজাতির কল্যাণসাধনের কথা বলেছেন।

নীলদর্পণ নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজচিত্রের বর্ণনা দাও।

নীলদর্পণ নাটকের ভূমিকা –

সাময়িক পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থের মতো নাটক থেকেও উনিশ শতকের বাংলার সমাজচিত্র পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। নাটকটি 1860 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাংলার কৃষকদের উপর নীলকর সাহেবদের শোষণ-অত্যাচারের কাহিনি নিয়ে এই নাটকটি রচিত।

নীলদর্পণ নাটকের বিষয়বস্তু –

কৃষকদের অভাব, দারিদ্র্য, নীলকরদের শোষণ-অত্যাচার, জমিদার ও ইংরেজ শাসকদের দমনমূলক ব্যবস্থা, দরিদ্র কৃষকদের প্রতিরোধ, সংগ্রাম – এইসব নিয়ে তৎকালীন বাংলার সমাজজীবন নীলদর্পণ নাটকে ফুটে উঠেছে। আর্থসামাজিক পটভূমিতে ঐক্যবদ্ধ কৃষকেরা সাম্প্রদায়িকতার উপরে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। আবার ইংরেজ আনুগত্য দূর করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি নীলচাষিদের সমর্থনে যেভাবে এগিয়ে এসেছিল নাটকটিতে তাও সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।

নীলদর্পণ নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজচিত্রের বর্ণনা দাও।

নীলদর্পণ নাটকের উদ্দেশ্য –

এই নাটক রচনার উদ্দেশ্য ছিল –

  • ইংরেজদের শোষণ-অত্যাচার বন্ধ করা।
  • কৃষকদের মঙ্গলসাধন করা।
  • মাটির মানুষের কাছাকাছি পৌঁছোনো ইত্যাদি।

নীলদর্পণ নাটকের নীলচাষিদের দুর্দশা –

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের পেশা ছিল চাষবাস। ধান বা খাদ্যশস্য চাষ ছিল এর মধ্যে প্রধান।

  • ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের প্রয়োজনে নীলের প্রচুর চাহিদা ছিল। সেজন্য ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংরেজ খামার মালিকেরা দলে দলে ভারতে আসতে থাকে। এ ছাড়া 1833 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতে ইউরোপীয়দের জমি কেনার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। তারা বেশি লাভের আশায় এলাকা চাষের বদলে বে-এলাকা চাষে আগ্রহী হয়।
  • চাষিদের বিঘা প্রতি 2 টাকা দাদন দিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করত তারা। চাষিরা অসম্মত হলে নীলকররা চাষির গোরুবাছুর কেড়ে নিত, চাষির বাড়ি ভেঙে দিত, তাদের পরিবারের লোকজনকে মারধর করত।
  • পঞ্চম রেগুলেশন আইন থাকা সত্ত্বেও চাষিরা নীলচাষ করতে বাধ্য হত। নীলের তুলনায় ধান বা তামাক চাষ বেশি লাভজনক ছিল। কিন্তু চাষিরা তা চাষ করতে পারত না। ফলে তারা খাদ্যাভাব ও ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়ত।

নীলদর্পণ নাটকের চাষিদের প্রতিরোধ –

নীলকর ও জমিদারদের শোষণ-অত্যাচার নীলচাষিরা নীরবে মেনে নেয়নি। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নীলচাষিরা প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে। নাটকে নীলচাষি তোরাপের ভূমিকাতে তা স্পষ্ট। বাংলার হিন্দু-মুসলিম নীলচাষিদের ঐক্যবদ্ধ এই সংগ্রাম সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিল।

নীলদর্পণ নাটকের শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির ভূমিকা –

1859 খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে নীলচাষিদের আন্দোলন শুরু হয়। এর মাত্র 2 বছর আগে সিপাহি বিদ্রোহ (1857 খ্রিস্টাব্দ) ঘটে। বাংলাদেশে কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা করে। কিন্তু নীলচাষিদের আন্দোলনে তারা সহানুভূতি ও সমর্থন জানায়। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা, শিশিরকুমার ঘোষের অমৃতবাজার পত্রিকা, আলোচ্য নীলদর্পণ নাটক নীলচাষিদের দুঃখদুর্দশা ও নীলকর সাহেবদের শোষণ-অত্যাচারের কাহিনি প্রচার করে। এর ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি ইংরেজ শাসন ও নীলকরদের শোষণের স্বরূপ বুঝতে পারে। তখন তারা নীলচাষিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। এই নাটকের অন্তর্গত গোলক বসু, নবীন মাধব, বিন্দু মাধব, সৈরিন্ধ্রী ও সাবিত্রী প্রভৃতি চরিত্রগুলি ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিভূ।

নীলদর্পণ নাটকের মূল্যায়ন –

উনিশ শতকের বাংলার সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি ছিল নীলদর্পণ নাটক। পাশ্চাত্য ধারায় প্রভাবিত পঞ্চাঙ্ক নাটকের চরিত্রগুলি সংস্কৃত নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে। বাংলার অসহায় নীলচাষিদের লাঞ্ছনার মর্মস্পর্শী চিত্র এই নাটকে তুলে ধরা হয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে নাটকটিকে ঐতিহাসিক বলা যায়। সমকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের খণ্ডচিত্র নাটকটির মধ্যে ফুটে উঠেছে।

হরিনাথ মজুমদারের গ্রামবার্তা প্রকাশিকা-র বৈশিষ্ট্য ও অবদান লেখো।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার ভূমিকা –

বাংলা সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের ইতিহাসে কুষ্ঠিয়া জেলার কুমারখালি গ্রাম থেকে প্রকাশিত কাঙাল হরিনাথ বা হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা একটি উজ্জ্বল নাম। এটি 1863 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক হরিনাথ তাঁর পত্রিকায় গ্রামের নিপীড়িত, অবহেলিত মানুষের কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি মনে করতেন প্রজাস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন ঘটনা ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিগোচরে আনতে পারলে হয়তো তার প্রতিকার সম্ভব হবে। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি দীর্ঘ 22 বছর ধরে এই পত্রিকার সম্পাদনা করেন। পরে অর্থের অভাবে পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দেন।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার বৈশিষ্ট্য –

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা-র বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –

  • গ্রামীণ সমস্যার কথা প্রকাশ – জাতীয় জাগরণের সেইসকল দিনগুলিতে শহর কলকাতা নয়, হরিনাথ বেছে নিয়েছিলেন দারিদ্র্য ও সমস্যাজর্জরিত গ্রামবাংলাকে। তিনি নিজেই বলেছেন যে, তৎকালে সব সংবাদপত্রগুলিই প্রধান প্রধান শহর ও বিদেশের সংবাদে পূর্ণ ছিল। তাই তাঁর লক্ষ্য ছিল, গ্রামীণ সংবাদ পরিবেশন করা। সংবাদপত্র যদি সমসাময়িক যুগের দর্পণ হয়, তাহলে বলতে হয় এই পত্রিকা সত্যিই সমকালীন বাংলার গ্রামীণ জীবনের যথার্থ দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি ছিল। তৎকালীন বাংলার গ্রামগুলিতে জমিদারদের অত্যাচার, জলকষ্ট এবং পাঠশালাগুলির করুণ দশার কথা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
  • অত্যাচারের প্রতিবাদ – গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষের উপর হওয়া অত্যাচারের প্রতিবাদ করা। এই সময় ব্রিটিশ সরকার, জমিদার ও মহাজন শ্রেণি গ্রামের মানুষের উপর অত্যাচার করত। হরিনাথ তাঁর পত্রিকায় নায়েব গোমস্তাদের রাক্ষসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সাহায্যে কীভাবে কৃষকদেরকে তার নিজের জমি থেকে উচ্ছেদ করে তা তিনি তুলে ধরেন। তার উপর জমিদারদের নেওয়া বিভিন্ন উপকর গ্রামীণ মানুষকে কতটা অসুবিধায় ফেলে তিনি তার বর্ণনা দেন। কাঙাল হরিনাথের সমালোচনার হাত থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির জমিদাররাও রেহাই পায়নি।
  • অত্যাচারী নীলকরদের বিরোধিতা – নীলকর সাহেবরা গ্রামের চাষিদের জোর করে নীলচাষ করাত এবং উৎপাদিত নীল অল্প দামে কিনে নিত। চাষি নীলচাষ করতে না চাইলে নীলকর সাহেবরা বিভিন্নভাবে অত্যাচার করত। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা নীলকর সাহেবদের এই সব জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল।
  • পাবনার কৃষক বিদ্রোহকে সমর্থন – পাবনায় কৃষক বিদ্রোহ (1872-1873 খ্রিস্টাব্দ) শুরু হলে তৎকালীন সব প্রভাবশালী পত্রপত্রিকাই জমিদারদের সমর্থন করে। ব্যতিক্রম ছিল ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’। এই পত্রিকা জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।
  • ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা – ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা ব্রিটিশ সরকার ও তার তাঁবেদার জমিদার শ্রেণির নিরবচ্ছিন্ন সমালোচনা করেছে। করবৃদ্ধি, সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতি, বেআইনিভাবে চা-কুলিদের চালন করা, দেশীয় শিল্পের দুর্দশা প্রভৃতির বিরুদ্ধে এই পত্রিকা প্রতিবাদ জানায়।
  • সমাজসংস্কারমূলক লেখা প্রকাশ – ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় জমিদার, মহাজন, নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের পাশাপাশি প্রজাদের প্রতি জমিদারদের কর্তব্য বিষয়েও প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। নদী ও জলনিকাশি ব্যবস্থা সংস্কার করে মানুষের জলকষ্ট নিবারণ, ডাক ও পুলিশ বিভাগের কাজের সুবন্দোবস্ত করা প্রভৃতি বিষয়ে পত্রিকা সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করে। এ ছাড়া গ্রামসমাজে প্রচলিত কৌলীন্য প্রথা, কন্যা বিক্রয়, বিকৃত জীবনচর্চা ও প্রথার বিরুদ্ধেও সরব ছিল ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার অবদান –

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা সমকালীন সমাজের কথা তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। যথা –

  • গ্রামের মানুষের কথা প্রচার – ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারের কথা প্রকাশিত হত। এই পত্রিকা থেকে সমকালীন সময়ের গ্রামের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার কথা জানা যায়।
  • গ্রামে শোষণ ও অত্যাচার – গ্রামের মানুষের উপর জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবদের শোষণ ও অত্যাচারের কথা ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’-য় গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হত। এই পত্রিকা শোষণ, অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল।
  • নারীদের অবস্থার উন্নতি – নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ সচেষ্ট ছিল। পরিশেষে বলা যায়, ডাকঘরে ‘মানি-অর্ডার’ ব্যবস্থা প্রচলনের কথা এই পত্রিকাতেই প্রথম উত্থাপিত হয়। এককথায়, সমকালীন গ্রামবাংলার সার্বিক জনজীবনে এই পত্রিকার ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই পত্রিকাটিকে বাংলার গ্রামীণ সংবাদপত্রের জনক বলা হয়।

গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতে, পাবনার তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) কীভাবে কাঙাল হরিনাথের সাংবাদিকতার প্রভাব সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন?

গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন যে, ‘সে সময়ের পাবনার ডিসির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় ডিসি চিঠিতে কাঙাল হরিনাথকে লিখেছিলেন-সম্পাদক, আমি তোমাকে ভয় পাই না ঠিকই, তবে তোমার লেখনীর জন্য অনেক অপকর্ম ছাড়তে বাধ্য হয়েছি।’

উনিশ শতকের বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে সমকালীন বাঙালি সমাজের কী প্রতিফলন লক্ষ করা যায়?

সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের ভূমিকা –

বাংলা ভাষার আদি বিকাশ পাল যুগে চর্যাপদের মাধ্যমে দেখা যায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্য বলতে যা বোঝায়, তার বিকাশ উনিশ শতকের আগে দেখা যায়নি। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বাংলা ভাষাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজে উদ্যোগী হয়। বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে সমকালীন বাঙালি সমাজের প্রতিফলন কীভাবে ঘটে তা নীচে আলোচনা করা হল।

বাংলা সংবাদপত্রে সমকালীন সমাজের প্রতিফলন –

উনিশ শতকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল – বামাবোধিনী, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রভৃতি।

বামাবোধিনী পত্রিকা –

বামাবোধিনী পত্রিকা 1863 খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হয়। এর প্রথম প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত।

বাঙালি সমাজের প্রতিফলন – বামাবোধিনী পত্রিকা ছিল নারীদের জন্য প্রকাশিত বাংলা মাসিক পত্রিকা। এই পত্রিকা থেকে সমকালীন বাঙালি সমাজের নারীদের কথা বিশেষভাবে জানা যায়। উনিশ শতকে বাংলার নারীশিক্ষা অবহেলিত ছিল। তখন রক্ষণশীল সমাজ মনে করত শিক্ষিত মহিলারা অশুভ। সমাজে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। এই সময় সমাজে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত ছিল। এই পত্রিকা থেকে সমাজে প্রচলিত কুপ্রথা সম্পর্কে জানা যায়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা –

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা 1853 খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হয়। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এই পত্রিকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

বাঙালি সমাজের প্রতিফলন – হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় বাংলার মানুষের জীবন, জীবিকা, ব্রিটিশ সরকার ও নীলকর সাহেবদের শোষণ সম্পর্কে জানা যায়।

উনিশ শতকের বাংলায় নীলকর সাহেবরা চাষিদের জোর করে নীলচাষ করাতো। তারা চাষিদের অগ্রিম অর্থ দিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল।

এই সময় আদিবাসীদের জোর করে বেগার খাটানো-সহ বিভিন্নভাবে শোষণ ও অত্যাচার করা হত। এই অত্যাচারের বিরুদ্দে আদিবাসী সাঁওতালরা বিদ্রোহ করে। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা সাঁওতাল বিদ্রোহকে সমর্থন করে।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা –

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা 1863 খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। এর প্রথম প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার।

বাঙালি সমাজের প্রতিফলন – গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা থেকে তৎকালীন বাংলার গ্রামের মানুষের কথা জানা যায়।

গ্রামের মানুষের উপর জমিদার ও মহাজনরা বিভিন্নভাবে শোষণ চালাত।

সমাজে নারীরা ছিল অবহেলিত। পুরুষশাসিত সমাজে কন্যা বিক্রয়, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ-সহ বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথা প্রচলিত ছিল।

বাংলা সাময়িকপত্রে সমকালীন সমাজের প্রতিফলন –

1818 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত দিগ্দর্শন হল বাংলা ভাষার প্রথম সাময়িক পত্র। এটি ছিল শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন দ্বারা পরিচালিত। এরপর ওই মিশন থেকেই প্রকাশিত হয় মার্শম্যানের পরিচালনায় সমাচার দর্পণ। রামমোহন রায়ের সম্বাদ কৌমুদী প্রকাশিত হয় এই যুগেই। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ করেন সমাচার চন্দ্রিকা। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। সাময়িকপত্রের জগতে বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন -এর আবির্ভাব একটি সাড়া জাগানো ঘটনা। বঙ্গদর্শনই প্রথম পাঠকদের কাছে উন্নত রুচির সাহিত্য পরিবেশন করে। এই সকল সাময়িক পত্র ও সংবাদপত্রগুলিতে উনিশ শতকের বাংলার সমাজজীবনের বিভিন্ন দিকগুলি ছাড়াও নবীন সাহিত্যিকদের সাহিত্যচর্চার পরিচয় মেলে।

সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের উপসংহার –

পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলি তাদের সমালোচনা ও সংবাদ পরিবেশন দ্বারা জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করে। সৃজনশীল উদ্যম জাতীয়তাবাদের ভিত্তি নির্মাণে সহায়ক হয়। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, সংগীত, সাহিত্য সমালোচনা, বাঙালির শক্তিসাধনা, কৃষক সমস্যা, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা প্রভৃতি বিষয়ক রচনা বাঙালির মননে বিপ্লব সৃষ্টি করে।

বিশ্বনাথ মজুমদারের ভাষ্যমতে, কাঙাল হরিনাথের প্রচেষ্টা কীভাবে দেশের শহুরে মানুষদের প্রভাবিত করেছিল?

হরিনাথের পৌত্র বিশ্বনাথ মজুমদারের ভাষায় বলা যায়, গ্রামের কল্যাণে দেশহিতৈষী শহুরে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এটি সফল হয়।

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষার বিবরণ দাও।

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষার ভূমিকা –

উনিশ শতকে ভারতীয়রা পাঠশালা, টোল, চতুষ্পাঠী, মক্তব ও মাদ্রাসায় সংস্কৃত, আরবি ও ফারসির মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করত। এর মধ্যে টোল ও মাদ্রাসা ছিল উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র। বাংলার নবদ্বীপ, বিক্রমপুর ছিল সংস্কৃত চর্চার ও মুরশিদাবাদ ছিল আরবি-ফারসি চর্চার উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র।

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষা –

উনিশ শতকের বাংলাদেশে দেশীয় শিক্ষার প্রসার ঘটে। এই শিক্ষা ছিল দুই ধরনের। যথা –

  • প্রচলিত দেশীয় শিক্ষা ও
  • ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশীয় শিক্ষা।

প্রচলিত দেশীয় শিক্ষা –

বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে চিরাচরিত দেশীয় শিক্ষা প্রচলিত ছিল। দেশীয় শিক্ষার মধ্যে ছিল –

  • সংস্কৃত,
  • আরবি ও
  • ফারসি শিক্ষা।
সংস্কৃত শিক্ষা –

ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃত শিক্ষা সরকারি সাহায্য-বঞ্চিত হয়েও এ যুগে অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। চতুষ্পাঠী ও টোল ছিল যথাক্রমে সংস্কৃত শিক্ষার প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র। পণ্ডিত ও অধ্যাপক ছিলেন এগুলির শিক্ষক। পাশাপাশি বাংলা শিক্ষার জন্য পাঠশালা ছিল। সাধারণত শিক্ষকের বাড়িতে, চণ্ডীমণ্ডপে বা গৃহস্থের বৈঠকখানায়, বারান্দায় সকাল ও সন্ধ্যায় আংশিক সময় পঠনপাঠন চলত। ছাত্রদের কাছ থেকে শিক্ষকরা বেতন নিতেন।

আরবি শিক্ষা –

মুসলমান সমাজে শিশুদের মধ্যে আরবি শিক্ষার চল ছিল। চার বছর বয়সের পর শিক্ষাদান শুরু হত। এই ভাষা ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় মুসলিম শিশুরা আগ্রহের সঙ্গে তা শিখত। মসজিদের পাশে মক্তবে মৌলবি সাহেব শিক্ষা দিতেন। উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা তেমন ছিল না।

ফারসি শিক্ষা –

মুসলমান সমাজের উচ্চস্তরে ফারসি শিক্ষার চল ছিল। 1835 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফারসি ‘সরকারি ভাষা’ ছিল। তাই সরকারি কাজে আগ্রহী বহু হিন্দু ফারসি শিখত। ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার মাধ্যমে ফারসি শিক্ষাপ্রদান চলত। শিক্ষাব্যবস্থার ধরন – এইসব শিক্ষাব্যবস্থার কোনো নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম ছিল না। পুরোনো কিছু পুথিপত্র সম্বল করে পণ্ডিতরা শিক্ষাদান করতেন। অবশ্য আরবি-ফারসি শিক্ষায় ব্যতিক্রম দেখা যায়। ইউক্লিড -এর জ্যামিতি, ইউনানি চিকিৎসা, আরব ও পারস্যের সাহিত্য, শরিয়তি বিধান -এর গ্রন্থ, হাদিস ইত্যাদি পাঠ্য ছিল।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশীয় শিক্ষা –

কোম্পানি সরকার এদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথমে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। কারণ এর ফলে তারা এদেশীয়দের মধ্যে বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা করেছিল। অথচ দেশের শাসক হয়ে শিক্ষাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করাও সম্ভব ছিল না। ফলে কোম্পানি সরকার শুধুমাত্র দেশীয় শিক্ষার মান উন্নয়নেরই চেষ্টা করে। এজন্য 1781 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মাদ্রাসা, 1784 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি, 1791 খ্রিস্টাব্দে বেনারস সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। লর্ড ওয়েলেসলি 1800 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসা সিভিলিয়ান ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ভারতীয় ভাষা, রীতিনীতি ও আইনকানুন সম্পর্কে অবহিত করা।

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষার বিবরণ দাও।

শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ –

অ্যাডাম রিপোর্ট – 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারকে এদেশে শিক্ষাবিস্তারের জন্য বার্ষিক 1 লক্ষ টাকা খরচের নির্দেশ দেয়। দেশীয় শিক্ষাবিস্তারের জন্য প্রাচ্যবাদীরা ওই টাকা দাবি করে। এই দাবির সমর্থনে পাদরি অ্যাডাম বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে অনুসন্ধান করেন (1835 খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর তিনটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে এসময় প্রায় এক লক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (পাঠশালা, চতুষ্পাঠী, টোল, মক্তব ও মাদ্রাসা) ছিল। অর্থাৎ সমকালীন জনসংখ্যার অনুপাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল যথেষ্ট।

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষার মূল্যায়ন –

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষার উজ্জ্বল চিত্র ফুটে উঠলেও তার নীচে অন্ধকার ছিল। কারণ হিন্দুসমাজে তখন বর্ণভেদ প্রথা ছিল প্রবল। নীচুবর্ণের মানুষরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। নারীশিক্ষা সম্বন্ধে কুসংস্কার ছিল দৃঢ়। তাই শিক্ষা কেবল উচ্চবর্ণের পুরুষদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। আর মুসলিম সমাজে মোল্লা-মৌলবিদের প্রভাব থাকায় ধর্মীয় বাতাবরণের বাইরে শিক্ষা ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। মুসলিম নারীরাও ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে আসতে পারেনি এবং দরিদ্র মুসলমানরা শিক্ষা থেকে দূরে ছিল। এক্ষেত্রে দরিদ্র হিন্দু ও দরিদ্র মুসলমানের মধ্যে কোনো প্রভেদ ছিল না।

ভারতে প্রথম বাণিজ্য-বিষয়ক বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্রটির নাম কী এবং এটি কে সম্পাদনা করেছিলেন?

ভারতে প্রথম বাণিজ্য-বিষয়ক বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র ছিল জয়কালী বসু সম্পাদিত ‘মহাজন দর্পণ’।

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী?

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্কের ভূমিকা –

আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতা ও মফস্সল অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশীয় শিক্ষার ধারাও (সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি) প্রচলিত ছিল সেসময়। 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে এদেশে শিক্ষার জন্য বার্ষিক 1 লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। দেশীয় শিক্ষার জন্য প্রাচ্যবাদীরা এবং ইংরেজি শিক্ষার জন্য পাশ্চাত্যবাদীরা এই টাকা দাবি করলে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীরা জয়ী হয়।

1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন –

বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইংরেজরা এদেশীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতায় হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। পরে এদেশীয়দের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা দূর করার জন্য খ্রিস্টধর্ম ও জনহিতবাদের ভিত্তিতে শিক্ষাবিস্তারের দাবি ওঠে। ইংল্যান্ডের এই জনমতের দাবিতে 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের 43 নং অনুচ্ছেদে এদেশে শিক্ষাবিস্তারের জন্য বার্ষিক 1 লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও এর প্রতীকী গুরুত্ব ছিল অসীম। কারণ এই নির্দেশের দ্বারা কোম্পানি সরকারকে এদেশীয়দের জনশিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব –

সরকার কর্তৃক বরাদ্দ 1 লক্ষ টাকা পাওয়ার জন্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সরকার শিক্ষাখাতে অর্থব্যয় বন্ধ করে দেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেয় একটি সমিতির উপর, যার নাম ছিল জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (GCPI)। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়।

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী?
  • প্রাচ্যবাদী – বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি শিক্ষা দীর্ঘকাল ধরে চালু ছিল। এই শিক্ষাই হল প্রাচ্যশিক্ষা। এইচ টি প্রিন্সেপ, কোলব্রুক, উইলসন প্রমুখ ছিলেন প্রাচ্যবাদীদের নেতা। তাঁদের মতে, প্রাচ্যশিক্ষাই হল প্রকৃত শিক্ষা। কারণ এ দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে এই শিক্ষা জড়িত। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত। এই শিক্ষার জন্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। তাই এই শিক্ষার উন্নতির জন্য সরকারি টাকা বরাদ্দ করা উচিত।
  • পাশ্চাত্যবাদী – বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর কলকাতা ও মফস্সল অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে বেশ কিছু ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলে পাস করা ছাত্ররা বাণিজ্যিক ও সরকারি চাকরি পেত। এজন্য এই ধরনের স্কুলের সংখ্যা ও ছাত্রসংখ্যা বেড়ে চলে। এই শিক্ষাই হল পাশ্চাত্য শিক্ষা। ট্রেভেলিয়ান, আলেকজান্ডার ডাফ, স্যান্ডার্স প্রমুখ ছিলেন পাশ্চাত্যবাদী নেতা। তাঁদের মতে, ইংরেজি ভাষা হল আন্তর্জাতিক ভাষা। এই ভাষায় রচিত সাহিত্য অতি সমৃদ্ধ এবং তা ছাত্রদের চাকরি পাওয়ার উপযোগী। ভবিষ্যতে এই ভাষা এদেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলিকে সমৃদ্ধ করবে। তাই ইংরেজি শিক্ষার জন্যই সরকারি টাকা বরাদ্দ করা উচিত।
শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী?

রামমোহনের স্মারকলিপি –

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থব্যয় বন্ধ করেছিল। শেষপর্যন্ত (1823 খ্রিস্টাব্দ) সরকার ওই জমা টাকায় একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। তখন রাজা রামমোহন রায় বড়োলাট লর্ড আমহার্স্টকে একটি পত্র লেখেন। এই পত্রটিকে স্মারকলিপি বলা হয়। এই স্মারকলিপিতে সংস্কৃত শিক্ষার পরিবর্তে ইংল্যান্ডের মতো আধুনিক শিক্ষা ভারতে চালু করার কথা বলা হয়। রাজা রামমোহন রায় শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রতিনিধি ছিলেন। তাই সরকার তাঁর এই মতকে গুরুত্ব দেয়।

দ্বন্দ্বের অবসান –

মেকলে মিনিট – বড়োলাট লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক -এর আইনসভার সদস্য স্যার থমাস ব্যাবিংটন মেকলে 1835 খ্রিস্টাব্দের 2 ফেব্রুয়ারি ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও শ্লেষ-সহ এক মন্তব্য প্রকাশ করেন, যা মেকলে মিনিট নামে পরিচিত। তিনি বলেন, ইউরোপের একটি ভালো লাইব্রেরির এক তাক বই সমগ্র প্রাচ্য সাহিত্যের থেকে মূল্যবান। তাঁর বাগ্মিতা ও যুক্তির দ্বারা বেন্টিঙ্ক প্রভাবিত হন। তিনি 1835 খ্রিস্টাব্দের 7 মার্চ পাশ্চাত্য শিক্ষাকে সরকারি শিক্ষানীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু হয়। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। সরকারি ক্ষেত্রে ফারসি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার চালু হয়।

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী? উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা করো।

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক –

আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতা ও মফস্সল অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশীয় শিক্ষার ধারাও (সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি) প্রচলিত ছিল সেসময়। 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে এদেশে শিক্ষার জন্য বার্ষিক 1 লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। দেশীয় শিক্ষার জন্য প্রাচ্যবাদীরা এবং ইংরেজি শিক্ষার জন্য পাশ্চাত্যবাদীরা এই টাকা দাবি করলে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীরা জয়ী হয়।

1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন –

বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইংরেজরা এদেশীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতায় হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। পরে এদেশীয়দের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা দূর করার জন্য খ্রিস্টধর্ম ও জনহিতবাদের ভিত্তিতে শিক্ষাবিস্তারের দাবি ওঠে। ইংল্যান্ডের এই জনমতের দাবিতে 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের 43নং অনুচ্ছেদে এদেশে শিক্ষাবিস্তারের জন্য বার্ষিক 1 লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও এর প্রতীকী গুরুত্ব ছিল অসীম। কারণ এই নির্দেশের দ্বারা কোম্পানি সরকারকে এদেশীয়দের জনশিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব –

সরকার কর্তৃক বরাদ্দ 1 লক্ষ টাকা পাওয়ার জন্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সরকার শিক্ষাখাতে অর্থব্যয় বন্ধ করে দেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেয় একটি সমিতির উপর, যার নাম ছিল জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (GCPI)। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়।

  • প্রাচ্যবাদী – বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি শিক্ষা দীর্ঘকাল ধরে চালু ছিল। এই শিক্ষাই হল প্রাচ্যশিক্ষা। এইচ টি প্রিন্সেপ, কোলব্রুক, উইলসন প্রমুখ ছিলেন প্রাচ্যবাদীদের নেতা। তাঁদের মতে, প্রাচ্যশিক্ষাই হল প্রকৃত শিক্ষা। কারণ এ দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে এই শিক্ষা জড়িত। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত। এই শিক্ষার জন্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। তাই এই শিক্ষার উন্নতির জন্য সরকারি টাকা বরাদ্দ করা উচিত।
  • পাশ্চাত্যবাদী – বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর কলকাতা ও মফস্সল অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে বেশ কিছু ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলে পাস করা ছাত্ররা বাণিজ্যিক ও সরকারি চাকরি পেত। এজন্য এই ধরনের স্কুলের সংখ্যা ও ছাত্রসংখ্যা বেড়ে চলে। এই শিক্ষাই হল পাশ্চাত্য শিক্ষা। ট্রেভেলিয়ান, আলেকজান্ডার ডাফ, স্যান্ডার্স প্রমুখ ছিলেন পাশ্চাত্যবাদী নেতা। তাঁদের মতে, ইংরেজি ভাষা হল আন্তর্জাতিক ভাষা। এই ভাষায় রচিত সাহিত্য অতি সমৃদ্ধ এবং তা ছাত্রদের চাকরি পাওয়ার উপযোগী। ভবিষ্যতে এই ভাষা এদেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলিকে সমৃদ্ধ করবে। তাই ইংরেজি শিক্ষার জন্যই সরকারি টাকা বরাদ্দ করা উচিত।

রামমোহনের স্মারকলিপি –

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থব্যয় বন্ধ করেছিল। শেষপর্যন্ত (1823 খ্রিস্টাব্দ) সরকার ওই জমা টাকায় একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। তখন রাজা রামমোহন রায় বড়োলাট লর্ড আমহার্স্টকে একটি পত্র লেখেন। এই পত্রটিকে স্মারকলিপি বলা হয়। এই স্মারকলিপিতে সংস্কৃত শিক্ষার পরিবর্তে ইংল্যান্ডের মতো আধুনিক শিক্ষা ভারতে চালু করার কথা বলা হয়। রাজা রামমোহন রায় শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রতিনিধি ছিলেন। তাই সরকার তাঁর এই মতকে গুরুত্ব দেয়।

দ্বন্দ্বের অবসান –

মেকলে মিনিট – বড়োলাট লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক -এর আইনসভার সদস্য স্যার থমাস ব্যাবিংটন মেকলে 1835 খ্রিস্টাব্দের 2 ফেব্রুয়ারি ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও শ্লেষ-সহ এক মন্তব্য প্রকাশ করেন, যা মেকলে মিনিট নামে পরিচিত। তিনি বলেন, ইউরোপের একটি ভালো লাইব্রেরির এক তাক বই সমগ্র প্রাচ্য সাহিত্যের থেকে মূল্যবান। তাঁর বাগ্মিতা ও যুক্তির দ্বারা বেন্টিঙ্ক প্রভাবিত হন। তিনি 1835 খ্রিস্টাব্দের 7 মার্চ পাশ্চাত্য শিক্ষাকে সরকারি শিক্ষানীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু হয়। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। সরকারি ক্ষেত্রে ফারসি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার চালু হয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা –

স্যার চার্লস উডের নির্দেশনামা (1854 খ্রিস্টাব্দ) অনুসারে ভারতের বড়োলাট লর্ড ক্যানিং -এর আমলে 1857 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। লর্ড ক্যানিং 1857 খ্রিস্টাব্দের 24 জানুয়ারি ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ -এ স্বাক্ষর করেন। এই দিনটি ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হল ভারতের তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি হল –

  • বাংলা প্রেসিডেন্সি তথা ভারতে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
  • নিজ এলাকাভুক্ত বিভিন্ন কলেজের অনুমোদন, পরীক্ষাগ্রহণ ও উপাধি প্রদান করা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা –

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা ছিল লাহোর থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত প্রসারিত। শ্রীলঙ্কাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত ছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা –

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য আচার্য, উপাচার্য ও সেনেট গঠিত হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য ছিলেন ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং এবং প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার জেমস উইলিয়ম কোলভিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি –

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। 1906 খ্রিস্টাব্দে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় উপাচার্য হিসেবে যোগদান করলে এর উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। তাঁর আমলকে ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। 1858 খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও যদুনাথ বোস এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক হন। 1882 খ্রিস্টাব্দে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতক ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ও চন্দ্রমুখী বসু।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপসংহার –

ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন সি ভি রমন, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ। প্রতিষ্ঠার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ লাভ করে।

উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার কীভাবে হয়েছিল তা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও সরকারি শিক্ষানীতি হিসেবে ইংরেজি শিক্ষা বা পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের পটভূমি আলোচনা করো।

উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ভূমিকা –

আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগে ভারতে যখন ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেসময় ভারতে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। শাসনব্যবস্থার সূচনায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজ্যবিস্তার ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণেই বেশি মনোযোগী হয়েছিল – শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টি পড়েছিল বিলম্বে। ভারতের মধ্যে বাংলাতে (Bengal) প্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন হয়। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হয় লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে (1835 খ্রিস্টাব্দ)।

সরকারি প্রচেষ্টায় ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন না হলেও বেসরকারি উদ্যোগে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার ভিত্তি রচিত হয়। এর দুটি ধারা ছিল –

  • খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টা এবং
  • প্রগতিশীল ভারতীয় ও বিদেশিদের প্রচেষ্টা।

খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টা –

খ্রিস্টান মিশনারিগণ পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ব্যাপটিস্ট মিশনারি উইলিয়ম কেরি, মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ড (শ্রীরামপুর ত্রয়ী) শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এঁরা মোট 126টি বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। 1820 খ্রিস্টাব্দে শিবপুরে বিশপস কলেজ স্থাপিত হয়। স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফ 1830 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন, যা বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ নামে পরিচিত। লন্ডন মিশনারিরা মফস্সল শহরে বহু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রগতিশীল ভারতীয় ও বিদেশিদের প্রচেষ্টা –

ব্রিটিশদের সংস্পর্শে এসে প্রগতিশীল ভারতীয়রা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সচেষ্ট হয়। এক্ষেত্রে প্রগতিশীল বিদেশিদের ভূমিকাও ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। 1815 খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় কলকাতার শুঁড়িপাড়ায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা 1822 খ্রিস্টাব্দে অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল নামে পরিচিত হয়। ড্রুমন্ড প্রতিষ্ঠা করেন এর উচ্চ বিভাগটি – ধর্মতলা আকাদেমি। 1817 খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ারের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু কলেজ, যা পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়েছে। ডেভিড হেয়ার ইংরেজি ভাষায় ভালো পাঠ্যবই রচনার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (1817 খ্রিস্টাব্দ) এবং ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে 1918 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি। রাজা রাধাকান্ত দেব -এর প্রচেষ্টায় ওরিয়েন্টাল সেমিনারি এবং বেথুন সাহেবের চেষ্টায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় 1849 খ্রিস্টাব্দে।

উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার কীভাবে হয়েছিল তা সংক্ষেপে আলোচনা করো।
  • 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন – ভারতীয় শিক্ষা বিষয়ে দীর্ঘদিন কোম্পানির উদাসীন নীতি কঠোরভাবে সমালোচিত হয়। শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে কোম্পানিকে ভারতে শিক্ষাবিস্তারের জন্য বার্ষিক 1 লক্ষ টাকা বরাদ্দ করার কথা বলে। কিন্তু পরবর্তী দশ বছর এই অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। এইসময় শিক্ষা সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ করতে ও পরামর্শদানের জন্য 1823 খ্রিস্টাব্দে জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (GCPI) কমিটি গঠন করা হয়।
  • শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী দ্বন্দ্ব – ভারতে শিক্ষা প্রবর্তনের বিষয়ে দুটি পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছিল, যথা – প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী। প্রাচ্যবাদীরা চাইতেন দেশীয় শিক্ষার প্রসারে সরকার অর্থ ব্যয় করুক। অপরপক্ষে, পাশ্চাত্যবাদীদের দাবি ছিল ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারে সরকারের অর্থ ব্যয় করা উচিত। প্রাচ্যবাদের সমর্থক ছিলেন প্রিন্সেপ, কোলব্রুক প্রমুখ এবং পাশ্চাত্যবাদের সমর্থক ছিলেন আলেকজান্ডার ডাফ, স্যান্ডার্স প্রমুখ ব্যক্তি।
  • মেকলের প্রতিবেদন – পাবলিক ইনস্ট্রাকশন কমিটির সভাপতি মেকলে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের সপক্ষে একটি জোরালো প্রতিবেদন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক -র কাছে পেশ করেন। মেকলের এই বিখ্যাত প্রতিবেদন মেকলে মিনিট (1835 খ্রিস্টাব্দে) নামে পরিচিত। মেকলে বলেছিলেন, ‘ইউরোপের কোনও ভালো লাইব্রেরির এক তাক বই -এ যে জ্ঞান পাওয়া যায়, তা এদেশের সমগ্র সাহিত্য অপেক্ষা মূল্যবান।’
  • সরকারি সিদ্ধান্ত – লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের সমর্থক ছিলেন। অবশেষে 1835 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাটের পরিষদ পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের পক্ষে সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। সরকারি প্রচেষ্টায় পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির জয়যাত্রা শুরু হয় 1835 খ্রিস্টাব্দে।
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান – সরকারি উদ্যোগে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ (1835 খ্রিস্টাব্দ) এবং বোম্বাই এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন (1835 খ্রিস্টাব্দে) প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • লর্ড হার্ডিঞ্জ -এর ঘোষণা –এরপর লর্ড হার্ডিঞ্জ শিক্ষাবিস্তারের জন্য কাউন্সিল অফ এডুকেশন প্রতিষ্ঠা করেন (1842 খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ঘোষণা করেন যে, সরকারি চাকরিতে ইংরেজি ভাষাজ্ঞানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
  • উড -এর ডেসপ্যাচ – বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড শিক্ষা বিষয়ক নির্দেশনামা জারি করেন 1854 খ্রিস্টাব্দে। পাঠ্যক্রমের সাদৃশ্য, তিনটি প্রেসিডেন্সি শহরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, স্বতন্ত্র শিক্ষাবিভাগ গঠন, শিক্ষক-শিক্ষণ, ছাত্রবৃত্তি, বিদ্যালয়ে অনুদান ও পঠনপাঠন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে সুপারিশ করেন।

সুপারিশ অনুযায়ী 1857 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক প্রদেশে শিক্ষা অধিকর্তা (DPI) পদ সৃষ্টি হয় এবং তাঁর অন্যান্য অনেক সুপারিশও কার্যকর করা হয়।

উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার কীভাবে হয়েছিল তা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের মূল্যায়ন –

পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন সরকারি নীতি হিসেবে গৃহীত হলে এই শিক্ষার দ্রুত বিস্তার ঘটে। কিন্তু এই শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজি। মধ্যবিত্তশ্রেণি এই শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যয়বহুল হওয়ায় গরিব মানুষেরা এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি এবং মুসলিমরাও এই শিক্ষা বর্জন করে। ফলে সমাজে নিরক্ষরতা বজায় থাকে। এর পাশাপাশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাও উপেক্ষিত হতে থাকে।

তা সত্ত্বেও বলা যায়, এই শিক্ষালাভ করে ভারতবাসী পাশ্চাত্য সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। নিজ দেশ, জাতি, সমাজের দুর্বলতা তারা বুঝতে পারে। ইংরেজি ভাষা ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ করে সমাজ, সাহিত্য, ধর্ম ও রাজনীতিতে নবজাগরণের সূচনা করে।

উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাব কী ছিল?

উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাবে ভারতে শিক্ষা, সমাজ, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে গতিশীলতা ও সৃজনশীল উদ্যম পরিলক্ষিত হয়, তাকে ভারতীয় রেনেসাঁ বলে অভিহিত করা হয়।

উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাব –

  • নবযুগের সূচনা – পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ফলে ভারতে নবযুগের সূচনা হয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আলোকপ্রাপ্ত ভারতবাসী আধুনিকতার পথে পা বাড়িয়েছিল। তারা রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিল। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে এক নবচেতনার এবং ভারতে নবযুগের সূচনা হয়েছিল।
  • ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশ – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটেছিল। জাতীয়তাবাদ ও উদারনৈতিক আদর্শে উদ্দীপ্ত ভারতীয়রা নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। আসলে ভারতীয় এবং ইংরেজদের স্বার্থের সংঘাতই জাতীয়তাবাদের উন্মেষের মূল কারণ ছিল।
  • ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির উদ্ভব – পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের ফলে ভারতে ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল। ভারতীয়দের এক অংশ চাকরিলাভের জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। তা ছাড়া অনেকে ইংরেজি শিখে উকিল, ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিকতার পেশায় নিযুক্ত হয়েছিল। ব্যাবসাবাণিজ্যের সুবিধার জন্য ব্যবসায়ীরাও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। বাংলায় ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির মধ্যে ছিল শিক্ষিত চাকরিজীবী, উকিল, ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, ব্যবসায়ী প্রভৃতি পেশার লোকেরা।
  • সমাজসংস্কার আন্দোলন – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে ভারতে সমাজসংস্কার আন্দোলন হয়েছিল। শিক্ষিত সম্প্রদায় ভারতের চিরাচরিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। সমাজ সংস্কারকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও প্রমুখ। এঁরা ভারতীয় সমাজ থেকে সতীদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা দূর করতে এবং বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষা প্রভৃতির প্রসারের জন্য আন্দোলন করেছিলেন।
  • বিশ্বের সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন – ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার লাভের ফলে ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে বিশ্বের সভ্যতার মেলবন্ধন ঘটে। ভারতীয়রা পাশ্চাত্যের মানবতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র প্রভৃতি আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়। ফলে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, ইটালির ঐক্য আন্দোলন ও ইউরোপের দার্শনিকদের আদর্শ প্রভৃতি শিক্ষিত ভারতীয়দের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
  • নারীশিক্ষার প্রসার – ভারতীয় সমাজে বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথা, রক্ষণশীল মানসিকতা নারীশিক্ষা প্রসারের পথে প্রধান বাধা ছিল। উনিশ শতকে ইংরেজ সরকার, খ্রিস্টান মিশনারি ও কয়েকজন প্রগতিশীল ব্যক্তি নারীশিক্ষা প্রসারে সচেষ্ট হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর 1857 থেকে 1858 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলার বিভিন্ন জেলায় নিজ ব্যয়ে মোট 35টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। চার্লস উডের প্রতিবেদনে নারীশিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
  • ব্যবধান বৃদ্ধি – ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের অন্যতম প্রভাব ছিল সমাজে ইংরেজি-শিক্ষিত ও ইংরেজি না-জানা মানুষের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি। বিশেষত মুসলমানরা পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে অনিচ্ছুক ছিল। কারণ মুসলমানরা মনে করত, ইংরেজরা তাদের কাছ থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছে, এবার পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মনাশ করবে। অপরদিকে হিন্দুরা পাশ্চাত্য শিক্ষাকে স্বাগত জানিয়েছিল। 1871 খ্রিস্টাব্দে বাংলার স্কুলে 85.6% হিন্দু এবং 14.4% মুসলমান ছাত্র ছিল।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নারীশিক্ষা কেমন ছিল?

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নারীশিক্ষার ভূমিকা –

উনিশ শতকের বাংলার শিক্ষাব্যবস্থায় নারীশিক্ষা ছিল অবহেলিত। সমাজের অর্ধেক অংশ নারী হলেও পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে তারা ছিল বঞ্চনার শিকার। তাদের কোনো অধিকার ছিল না, তারা কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।

অ্যাডাম -এর প্রতিবেদন –

শিক্ষাখাতে সরকারের বরাদ্দ অর্থ লাভের জন্য বাংলাদেশে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। দেশীয় বা প্রাচ্য শিক্ষা সম্বন্ধে তথ্যসংগ্রহের জন্য পাদরি অ্যাডামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। অ্যাডাম বাংলাদেশের সব জায়গা ঘুরে সরকারকে প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে রিপোর্ট দেন (W. Adam reports on Vernacular Education in Bengal and Bihar 1835, 1836 and 1838)। তা থেকে উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে নারীশিক্ষা সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

সেসময় নারীশিক্ষার জন্য কোনো পাঠশালা ছিল না। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কেউ কেউ লেখাপড়া করত। কিছুকাল আগের রাজধানী মুরশিদাবাদ জেলায় মাত্র 9জন নারী নিজের নাম লিখতে ও পড়তে জানত। কোনো কোনো জমিদারবাড়ি ও বৈষ্ণবদের আখড়ায় নারীশিক্ষার চল ছিল।

বিদুষী নারী –

মহারাজা সুখময় রায়ের পৌত্রী ও রাজা শিবচন্দ্র রায়ের কন্যা হরসুন্দরী দেবী ছিলেন একজন বিদুষী নারী। পাঁচ বছর বয়সে একজন বৈষ্ণবীর কাছে তার অক্ষরপরিচয় হয়। তারপর এক ব্রাহ্মণের কাছে তিনি সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করেন। তিনি রামায়ণ পড়তে পারতেন। দ্রবময়ী দেবী ছিলেন অপর এক বিদুষী নারী। তিনি পিতা চন্ডীচরণ তর্কালঙ্কারের কাছে সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করেন। অল্প বয়সে তিনি বিধবা হন। তারপর বৃদ্ধ পিতার টোলে তিনি ছাত্রদের পড়াতেন।

সার্বিক নারীশিক্ষা –

উনিশ শতকের বাংলাদেশে বিদুষী নারীদের অস্তিত্ব থাকলেও তাকে ব্যতিক্রমী ঘটনা বলাই শ্রেয়। কারণ তাদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সাধারণ গৃহস্থ ঘরের নারীরা প্রায় সবাই নিরক্ষর ছিল।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নারীশিক্ষা কেমন ছিল?

নারীশিক্ষার প্রচেষ্টা –

উনিশ শতকের বাংলাদেশে নারীশিক্ষা প্রবর্তনের প্রথম চেষ্টা করেন খ্রিস্টান মিশনারিরা।

  • ক্যালকাটা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি – 1819 খ্রিস্টাব্দে নারীশিক্ষার জন্য প্রগতিশীল খ্রিস্টান মিশনারিরা ক্যালকাটা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। 1819 খ্রিস্টাব্দে 80 জন, 1825 খ্রিস্টাব্দে 160 জন ছাত্রী ছিল এই সংস্থায়। এই সময়ের মধ্যে সংস্থাটি 6টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে ভদ্র-গৃহস্থ বালিকারা এই বিদ্যালয়গুলিতে যেত না। নীচুবর্ণের হিন্দু (বাগদি, বৈরাগী, বেদে ও গণিকা) বালিকারা এই বিদ্যালয়গুলির ছাত্রী ছিল।
  • ফরেন স্কুল সোসাইটি – 1821 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের ফরেন স্কুল সোসাইটি বাংলাদেশে নারীশিক্ষায় এগিয়ে আসে। এজন্য এই সমিতি কলকাতা স্কুল সোসাইটির সহযোগিতা গ্রহণ করে। সমিতি ইংল্যান্ডে চাঁদা তুলে মিস কুক নামে একজন শিক্ষিকাকে কলকাতায় পাঠায়। মিস কুকের প্রচেষ্টায় 30টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়গুলিতে প্রায় 685 জন ছাত্রী লেখাপড়া করত।
  • অন্যান্য প্রতিষ্ঠান – ধীরে ধীরে কলকাতা ও মফস্সলে অনেক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বারাসত বালিকা বিদ্যালয় (1849 খ্রিস্টাব্দ) ও বেথুন বালিকা বিদ্যালয় (1849 খ্রিস্টাব্দ)।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নারীশিক্ষার মূল্যায়ন –

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে নারীশিক্ষার চিত্র ছিল অত্যন্ত করুণ। প্রথাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব, সামাজিক কুসংস্কার, আর্থিক অভাব, দারিদ্র্য, বর্ণভেদ প্রথা ও অন্যান্য কারণে নারীশিক্ষার প্রসার প্রায় ঘটেইনি। ব্যতিক্রমী ঘটনা বাদ দিয়ে বলা যায়, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের নারীরা প্রায় সবাই নিরক্ষর ছিল।

উনিশ শতকে বাংলায় নারীশিক্ষার বিস্তার সম্পর্কে লেখো।

নারীশিক্ষার ভূমিকা –

উনিশ শতকের বাংলার শিক্ষাব্যবস্থায় নারীশিক্ষা ছিল অবহেলিত। এই শতকের প্রথম দিকে নারীরা সবাই নিরক্ষর ছিল (অ্যাডাম রিপোর্ট)। এরপর মিশনারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে নারীশিক্ষার জন্য বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে, ফলে নারীশিক্ষায় গতি আসে।

নারীশিক্ষার বিস্তার –

উনিশ শতকের বাংলাদেশে নারীশিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ গৃহীত হয়। এই উদ্যোগ এসেছিল –

  • বেসরকারি ও
  • সরকারি তরফ থেকে।

বেসরকারি উদ্যোগ –

বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের স্বার্থে বেসরকারি উদ্যোগে কলকাতায় ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এইসব বিদ্যালয়ে এদেশীয় বালকেরা কেবল লেখাপড়া করত, বালিকাদের লেখাপড়ার কোনও সুযোগ ছিল না। ইংল্যান্ডের জনমতের দাবিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতীয়দের শিক্ষার দায়িত্ব কোম্পানি সরকারকে বহন করতে নির্দেশ দেয়। এজন্য কোম্পানিকে শিক্ষাখাতে বার্ষিক 1 লক্ষ টাকা ব্যয় করতে বলা হয়। এরপর ব্রিটিশ জনমত এদেশে নারীশিক্ষার দাবি জানায়।

  • 1819 খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান মিশনারিরা ক্যালকাটা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। 1825 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই সংস্থা 6টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। বিদ্যালয়গুলির ছাত্রীসংখ্যা ছিল 160 জন।
  • 1821 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের ফরেন স্কুল সোসাইটি বাংলাদেশে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই সংস্থা ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটির সহযোগিতা গ্রহণ করে। এই সমিতি ইংল্যান্ডে চাঁদা তুলে মিস কুক নামে একজন শিক্ষিকাকে কলকাতায় পাঠায়। মিস কুক -এর চেষ্টায় 30টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়গুলির ছাত্রীসংখ্যা ছিল প্রায় 685 জন।
  • 1849 খ্রিস্টাব্দের 7 মে ড্রিংকওয়াটার বেথুন (ভারত সরকারের আইন-সদস্য) হিন্দু ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে নারীশিক্ষার ইতিহাসে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও বিদ্যাসাগর এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন। এই বিদ্যালয়ে ভদ্র-গৃহস্থের মেয়েরা লেখাপড়া করত। এ ছাড়া 1849 খ্রিস্টাব্দে নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর উদ্যোগে বারাসত বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
  • ব্রাহ্মনেতাদের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়। বামাবোধিনী, অবলাবান্ধব -এর মতো পত্রিকা নারীশিক্ষার পক্ষে প্রচার চালায়।
উনিশ শতকে বাংলায় নারীশিক্ষার বিস্তার সম্পর্কে লেখো।

সরকারি উদ্যোগ –

বেসরকারি উদ্যোগের তুলনায় সরকারি উদ্যোগ অত্যন্ত সীমিত ছিল।

  • বেথুন সাহেবের মৃত্যুর পর বড়োলাট ডালহৌসি তাঁর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ের ব্যয়ভার গ্রহণ করেন। ফলে বিদ্যালয়টি সরকারি বিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
  • বিদ্যাসাগর শিক্ষাবিভাগের ইনস্পেকটর হিসেবে 1857 থেকে 1858 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলার বিভিন্ন জেলায় মোট 35টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ব্রাহ্মনেতাদের চাপে নারীদের পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে (1878 খ্রিস্টাব্দ)।
  • শিক্ষা কমিশনের নারীশিক্ষার সুপারিশ সরকার কর্তৃক সমর্থিত হয়।

নারীশিক্ষার প্রগতি –

1866-1867 খ্রিস্টাব্দের শিক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসময় বাংলাদেশে ছোটো-বড়ো বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল 281টি। মাত্র 11 মাসে 64টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

নারীশিক্ষার মূল্যায়ন –

সামাজিক কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতার বাধা কাটিয়ে বাংলাদেশে নারীশিক্ষার সূচনা হয়। বাংলাদেশে নারীশিক্ষার সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা। যদিও বালিকা বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রীসংখ্যা খুব কম ছিল (গড়ে 20 জন); তথাপি স্বীকার করতে হয় যে, আধুনিক শিক্ষা বাঙালি নারীকে স্পর্শ করেছিল, তাদের গৃহকোণ থেকে টেনে এনেছিল শিক্ষালয়ের প্রাঙ্গণে।

নারীশিক্ষার প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো।

নারীশিক্ষা প্রসারের ভূমিকা –

নারীশিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁকে ‘নারীশিক্ষা বিস্তারের পথিকৃৎ’ বলা হয়।

নারীশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্য –

নারীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের উদ্দেশ্য ছিল –

  • নারীমুক্তি – বিদ্যাসাগর দেখেছিলেন, বাংলার সমাজে নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে। নারীরা সমাজে বিভিন্নভাবে অত্যাচারিত হয়। তিনি বুঝেছিলেন নারীদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমেই একমাত্র নারীমুক্তি সম্ভব।
  • সমাজসংস্কার – বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন সমাজসংস্কারক। তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ও হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের পক্ষে আন্দোলন করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে না পারলে সমাজসংস্কার অসম্পূর্ণ থাকবে। গ্রামাঞ্চলে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা।
নারীশিক্ষার প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো।

নারীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের অবদান –

পশ্চাত্পদ উনিশ শতকের ভারতীয় সমাজে নারীশিক্ষা বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।

  • নারীশিক্ষার প্রসারে বেথুনকে সহযোগিতা – জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন বাংলায় নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি স্মরণীয় নাম। তিনি 1849 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় একটি বালিকা বিদ্যালয় (পরবর্তীকালে বেথুন স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। এই কাজে বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁকে সহযোগিতা করেন। 1850 খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর এই স্কুলের সম্পাদক হন।
  • নারীশিক্ষার জন্য প্রচার – অভিভাবকেরা বেথুন সাহেবের স্কুলে যাতে মেয়েদের পড়তে পাঠায় তার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র প্রচারকার্য চালান। তাঁর প্রচারের ফলে অনেক অভিজাত বাড়ির মেয়েরা বেথুন স্কুলে পড়তে আসে। তিনি নারীশিক্ষার প্রচারের জন্য স্কুলের গাড়িতে লিখেছিলেন – “কন্যা পেবং পালনীয়া/শিক্ষানিয়তি যত্নতঃ”। অর্থাৎ কন্যাকে পুত্রের মতো পালন করে শিক্ষাদান করতে হবে।
  • বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা – বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে 35টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই বিদ্যালয়গুলিতে তখন 1300 ছাত্রী লেখাপড়া করত। গ্রামাঞ্চলে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তিনি কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (বিদ্যাসাগর কলেজ) প্রতিষ্ঠা করেন।
  • বিদ্যাসাগর কলেজ – বিদ্যাসাগর লর্ড হার্ডিঞ্জের সহযোগিতায় অনেক বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্যবিত্ত ও ধনী পরিবারে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছিল। সে কারণে বাংলার ছোটোলাট ক্যাম্পবেল শিক্ষাবিস্তারের বিরোধী ছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন, এতে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যাসাগর এই সময় ব্যক্তিগত চেষ্টায় মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এটি কলেজে উন্নীত হয় এবং এর নাম হয় বিদ্যাসাগর কলেজ।

নারীশিক্ষা প্রসারের উপসংহার –

বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষা ও সংস্কারমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার আন্তরিক প্রচেষ্টার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন, “খাল নয়, নালা নয়, প্রকৃতই সাগর”। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন, “বিদ্যাসাগরের ছিল ইংরেজদের মতো প্রবল উদ্যম এবং কর্মশক্তি ও বাঙালি মায়ের মতো কোমল হৃদয়।”

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ভূমিকা –

রাজা রামমোহন রায়ের সংস্কার আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কুসংস্কার ও অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে সাধারণ মানুষকে সত্যের পথ দেখানো। আর এ কাজ সম্ভব একমাত্র শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে। আর এই শিক্ষা হবে পাশ্চাত্য শিক্ষা বা আধুনিক শিক্ষা, যা মানুষকে আধুনিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ করতে পারবে। এজন্যই তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্য –

  • কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠন – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে রাজা রামমোহন রায়ের উদ্দেশ্য ছিল কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠন।
  • পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার – রাজা রামমোহন রায়ের অপর উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটিয়ে আধুনিক সমাজ গঠন করা।

পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা –

রাজা রামমোহন রায় ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের একজন উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো।
  • অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা – রাজা রামমোহন রায় 1815 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার শুঁড়িপাড়ায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজের খরচে এই স্কুলের পরিচালনা করতেন। 1822 খ্রিস্টাব্দে এর নামকরণ হয় অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল। পরে এটি ইন্ডিয়ান আকাডেমি নামে পরিচিত হয়।
  • হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা – রাজা রামমোহন রায় ডেভিড হেয়ারের শিক্ষাবিস্তারের কাজে অন্যতম প্রধান সহায়ক ছিলেন। 1817 খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ার, স্যার হাইড ইস্টের উদ্যোগে যে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে রাজা রামমোহনের ঐকান্তিক সহযোগিতা ছিল। কিন্তু কয়েকজন গোঁড়া হিন্দুনেতা যখন জানতে পারেন যে, রামমোহন এর সঙ্গে জড়িত, তখন তারা রামমোহনকে বিদ্যালয় কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। এই অবস্থায় রাজা রামমোহন রায় নিজেই কমিটি থেকে সরে গিয়ে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো।
  • ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটিতে সহযোগিতা – 1817 খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ভালো বই প্রকাশ করা। রাজা রামমোহন রায় এই প্রতিষ্ঠানের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
  • সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা – 1824 খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্ট কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা রামমোহন রায় তাঁর এই নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের জন্য সরকারি অর্থ ব্যয় করার অনুরোধ করেন। লর্ড আমহার্স্ট রামমোহনের কথা না মানলেও সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।
  • জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা – স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফ 1830 খ্রিস্টাব্দে জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা রামমোহন রায় এই কাজে তাঁকে সবরকমভাবে সহযোগিতা করেছিলেন।

পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের উপসংহার –

রাজা রামমোহন রায় ছিলেন প্রকৃত পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রেমিক। এজন্য অনেকে তাঁর সমালোচনা করলেও তাঁকে ‘নব ভারতের অগ্রদূত’ বলে অভিহিত করা হয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস থেকে 1858 খ্রিস্টাব্দের মে মাস পর্যন্ত বিদ্যাসাগর মহাশয় কতটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন?

1857 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস থেকে 1858 খ্রিস্টাব্দের মে মাস পর্যন্ত বিদ্যাসাগর মহাশয় 35টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে বিদ্যাসাগর মহাশয় হুগলি এবং বর্ধমান জেলায় যথাক্রমে কতটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন?

1857 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর-ডিসেম্বর – হুগলি জেলায় 7টি, বর্ধমান জেলায় 1টি।

1858 খ্রিস্টাব্দের মে মাস পর্যন্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও নদিয়া জেলায় যথাক্রমে কতটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন?

1858 খ্রিস্টাব্দের মে পর্যন্ত – হুগলিতে 13টি, বর্ধমানে 10টি, মেদিনীপুরে 3টি, নদিয়ায় 1টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ লেখো।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার ভূমিকা –

1835 খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক কলকাতায় ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি হল ভারত তথা এশিয়ার প্রথম ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। ভারতে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল –

  • এদেশীয় ছাত্রছাত্রীদের আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলা এবং
  • এদেশীয় চিকিৎসাবিদ্যার পরিবর্তে ইউরোপের উন্নত চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা করা।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা –

গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ভারতে চিকিৎসাব্যবস্থার অবস্থা জানার জন্য 1833 খ্রিস্টাব্দে একটি কমিটি নিয়োগ করেন। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন জন গ্রান্ট এবং এর ভারতীয় সদস্য ছিলেন রামকমল সেন।

  • এই কমিটি 1834 খ্রিস্টাব্দের 20 অক্টোবর তার রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার জন্য সুপারিশ করা হয়।
  • কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক 1835 খ্রিস্টাব্দের 28 জানুয়ারি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশ –

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার পথপ্রদর্শক ছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। 1835 খ্রিস্টাব্দের 20 ফেব্রুয়ারি ছাত্র ভরতির মধ্য দিয়ে কলেজের কাজকর্মের সূচনা হয়। প্রথম 49 জন ছাত্রের সবাইকে মাসিক 7 টাকা হারে বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পড়ার সময়সীমা –

এই কলেজে 4 থেকে 6 বছর পড়াশোনা করতে হত। কলেজের পাঠ শেষ করার পর ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রদের সার্টিফিকেট দেওয়া হত।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের নেটিভ ডাক্তার –

ডাক্তারি পাস করার পর এরা সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে পারতেন। এদের ‘নেটিভ ডাক্তার’ বা দেশি ডাক্তার বলা হত। বলা হয়, দেশি ডাক্তারদের প্রারম্ভিক বেতন হবে মাসে 30 টাকা, 7 বছর পর 40 টাকা আর 14 বছর পর 50 টাকা।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পঠনপাঠন –

ছাত্রদের শিক্ষার সুবিধার জন্য লাইব্রেরি, উপযুক্ত ভবন ও অ্যানাটমি শিক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ছাত্রদের হাতেকলমে শিক্ষালাভ করার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে যেতে হত। 1835 খ্রিস্টাব্দের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটি নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয়।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক –

ডা. এম জে ব্রামলিকে এখানকার সুপারিনটেনডেন্ট এবং ডা. এইচ এইচ গুডইভ প্রমুখকে শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। পরে 1837-1838 খ্রিস্টাব্দে কলেজের শিক্ষকসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের শবব্যবচ্ছেদ –

1836 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হল শবব্যবচ্ছেদ করে চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষা দেওয়া। মধুসূদন গুপ্ত প্রথম ভারতীয় যিনি মানবদেহের শবব্যবচ্ছেদ করেন। এই ঘটনায় অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা হলেন – রাজকৃষ্ণ দে, উমাচরণ শেঠ, দ্বারকানাথ গুপ্ত, নবীনচন্দ্র মিত্র প্রমুখ। 1838 খ্রিস্টাব্দে আয়োজিত পরীক্ষায় এঁরা উত্তীর্ণ হন। এঁরা সার্জারি ও মেডিসিনে ডাক্তারি করার যোগ্য বলে ঘোষিত হন। এঁরাই ছিলেন পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় যোগ্যতা অর্জনকারী প্রথম ভারতীয়।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ক্রমোন্নতি –

  • লন্ডনের রয়‍্যাল কলেজ অফ সার্জেন -এর পরামর্শে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করা হয়।
  • 1846 খ্রিস্টাব্দে লন্ডন ইউনিভার্সিটি, রয়‍্যাল কলেজ অফ সার্জনস এই পাঠ্যসূচিকে স্বীকৃতি দেয়।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এতে মেডিক্যাল ডিগ্রি প্রদানের জন্য চিকিৎসাবিভাগ খোলা হয়। এই বিভাগ মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসা পাঠ্যসূচির পরিবর্তন করে।
  • এই সময় বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি মেডিক্যাল ডিগ্রি প্রদান করত –
    • এল এম এস – লাইসেন্সিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি।
    • এম বি – ব্যাচেলর ইন মেডিসিন।
    • এম ডি – ডক্টর অফ মেডিসিন।
  • 1840 খ্রিস্টাব্দে 100 শয্যার একটি মহিলা হাসপাতাল তৈরি করা হয়। 1835 খ্রিস্টাব্দে 350 জন রোগীর সংকুলান করে একটি বড়ো হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • 1883 খ্রিস্টাব্দের 29 জুন সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, এফ এ পাসের পর ছাত্রীদের কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে (সি এম সি) ভরতির অধিকার দেওয়া হবে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি সি এম সি -তে ভরতি হওয়া প্রথম ভারতীয় ছাত্রী।
  • 1884 খ্রিস্টাব্দে ছাত্রীদের জন্য মাসিক 20 টাকা সরকারি বৃত্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। বিধুমুখী বসু ও ম্যারি মিত্র এই বৃত্তি লাভ করেন। তাঁরা 1888-1889 খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
  • 1891-1892 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1901-1902 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছাত্রসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। 1906-1907 খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলনের সময় এই সংখ্যা হ্রাস পেলেও পরবর্তীকালে আবার তা বৃদ্ধি পায়।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উপসংহার –

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র এবং চিকিৎসক-শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চিকিৎসাশিক্ষা ও গবেষণার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ভারতবর্ষের চিকিৎসাশিক্ষার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

প্রায় 100 জন ছাত্রের মধ্যে হিন্দু কলেজ, হেয়ার স্কুল, জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন -এর পাস করা কত জন ছাত্রকে পরীক্ষার মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয়। কত জন ছাত্র আগে থেকেই নির্বাচিত হয়েছিল?

“প্রায় 100 জন ছাত্রের মধ্যে হিন্দু কলেজ, হেয়ার স্কুল, জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন -এর পাস করা 20 জন ছাত্রকে পরীক্ষার মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয়। 29 জন ছাত্র আগে থেকেই নির্বাচিত হয়েছিল। প্রথমে মোট 49 জন ছাত্র ছিল। আবার কেউ বলেন 50 জন ছাত্র ছিল।”

এফ এ (FA) – First Arts. কত -এর দশকে বিভিন্ন শ্রেণির লোকসংখ্যার অনুপাতে সি এম সিতে আসন সংরক্ষণ প্রথা চালু হয়। স্থির করা হয় ছাত্রীদের জন্য কত শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে?

এফ এ (FA) – First Arts. 1930 -এর দশকে বিভিন্ন শ্রেণির লোকসংখ্যার অনুপাতে সি এম সিতে আসন সংরক্ষণ প্রথা চালু হয়। স্থির করা হয় ছাত্রীদের জন্য 5% আসন সংরক্ষিত থাকবে।

উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা করো।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হল ভারতের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং -এর আমলে 1857 খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। লর্ড ক্যানিং 1857 খ্রিস্টাব্দের 24 জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন স্বাক্ষর করেন। ফলে এই দিনটিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস বলা হয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

1854 খ্রিস্টাব্দের 19 জুলাই বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড তাঁর নির্দেশনামায় কলকাতায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। সেই অনুসারে 1857 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল –

  • প্রেসিডেন্সি শহরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা – চার্লস উডের প্রতিবেদনে (1854 খ্রিস্টাব্দ) প্রত্যেক প্রেসিডেন্সি শহরে (কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ) উচ্চশিক্ষার জন্য একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়।
  • শিক্ষার প্রসার ঘটানো – ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক্তিয়ারভুক্ত এলাকায় প্রজাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর কথা বলা হয়।
  • শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় দক্ষতা নিরূপণ করা – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় পরীক্ষার মাধ্যমে সকল ছাত্রের দক্ষতা নিরূপণ করা।
  • কলেজ অনুমোদন, পরীক্ষাগ্রহণ, উপাধিদান – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল কলেজগুলিকে অনুমোদন দেওয়া, পরীক্ষা গ্রহণ করা ও উপাধি প্রদান করা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা –

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য আচার্য ও উপাচার্য পদ এবং সিনেটের ব্যবস্থা করা হয়। সিনেট বা পরিচালন সভা 38 জন সদস্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল।

চ্যান্সেলার বা আচার্য – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য ছিলেন ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং।

ভাইস চ্যান্সেলার বা উপাচার্য – বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অন্যতম প্রধান পদ হল ভাইস চ্যান্সেলার বা উপাচার্য। ভাইস চ্যান্সেলারের পদটি ছিল অবৈতনিক। তিনি সিনেট ও সিন্ডিকেটের সুপারিশ অনুসারে। মনোনীত হতেন। তাদের পরামর্শ নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ পরিচালনা করতেন।

  • কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার জেমস উইলিয়ম কোলভিল (24 জানুয়ারি, 1857 খ্রিস্টাব্দ থেকে 24 জানুয়ারি, 1859 খ্রিস্টাব্দ)।
  • কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য ছিলেন স্যার গুরুদাস ব্যানার্জি (1 জানুয়ারি, 1890 খ্রিস্টাব্দ থেকে 31 ডিসেম্বর, 1892 খ্রিস্টাব্দ)।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা –

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা লাহোর থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। 1882 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 25 বছর পূর্তির সময় বেশ কিছু এলাকাকে এর এক্তিয়ারভুক্ত করা হয়, যেমন – লাহোর, পাতিয়ালা, সিমলা, দিল্লি, অমৃতসর, ইন্দোর, আগ্রা, আজমির, জয়পুর, কটক, ঢাকা, গুয়াহাটি, রেঙ্গুন প্রভৃতি। এর বাইরে সিংহল ও বার্মাতেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ার ছিল।

  • 1858 খ্রিস্টাব্দের 30 জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট কার্যকর হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের প্রথম অধিবেশন বসে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কাউন্সিল হলে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম চলত ক্যামাক স্ট্রিটের একটি ভাড়া করা ঘরে।
  • এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা আয়োজিত হয় 1857 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কলকাতার টাউন হলে।
  • প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ছাত্রের সংখ্যা ছিল 244 জন।
  • 1858 খ্রিস্টাব্দে যদুনাথ বোস এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক হন।
  • 1862 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
  • 1873 খ্রিস্টাব্দের 12 মার্চ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সিনেট হলের উদ্বোধন করা হয়।
  • 1882 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতক হন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ও চন্দ্রমুখী বসু।
  • কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বেণিমাধব বড়ুয়া এশিয়ার প্রথম ডি লিট হন।
উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা করো।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হান্টার কমিশন –

উনিশ শতকের শেষ দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রসংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতির বিষয় পর্যালোচনার জন্য লর্ড রিপন 1882 খ্রিস্টাব্দে হান্টার কমিশন নিয়োগ করেন। উইলিয়ম হান্টারের নেতৃত্বে গঠিত ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিশন ‘হান্টার কমিশন’ নামে পরিচিত হয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশ –

হান্টার কমিশন তার রিপোর্টে প্রাথমিক শিক্ষা, নারীশিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল –

হান্টার কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী হওয়ায় কলেজ শিক্ষার অগ্রগতি ঘটে। 1882 খ্রিস্টাব্দে মোট কলেজের সংখ্যা ছিল 72। 1901-1902 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজ শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। বিদ্যমান 72টি কলেজের উপর কলকাতায় আরও 20টি এবং সমগ্র বাংলাপ্রদেশে 26টি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপসংহার –

ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন – নোবেল বিজয়ী সি ভি রমন, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ। তাই উনিশ শতকের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবিস্তারের ইতিহাসে একটি চিরস্মরণীয় নাম।

1940 খ্রিস্টাব্দে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মেয়াদ কত বছর থেকে কমিয়ে কত বছর করা হয়। এরপর কত মাসের প্রাক্-রেজিস্ট্রেশন ক্লিনিকাল অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ যুক্ত হয়?

1940 খ্রিস্টাব্দে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মেয়াদ 6 বছর থেকে কমিয়ে 5 বছর করা হয়। এরপর 6 মাসের প্রাক্-রেজিস্ট্রেশন ক্লিনিকাল অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ যুক্ত হয়।

উনিশ শতকের বাংলায় সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

সমাজসংস্কার আন্দোলনের ভূমিকা –

উনিশ শতক বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ও সৃষ্টিশীল অধ্যায়। পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে বাংলার সমাজ, শিক্ষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নবযুগের প্রভাতোদয় ঘটে। এই সময়ে বাংলায় সমাজ সংস্কার ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও প্রমুখ যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব। রাজা রামমোহন রায়, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখের নেতৃত্বে বাংলায় ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা ঘটে।

সমাজসংস্কার আন্দোলন –

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি ছিল –

  • সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন,
  • বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন,
  • বিধবাবিবাহ প্রচলনের পক্ষে আন্দোলন,
  • অন্যান্য সংস্কার আন্দোলন।

সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন –

উনিশ শতকের বাংলার উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজে সতীদাহপ্রথা প্রচলিত ছিল। রাজা রামমোহন রায় এই নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর আন্দোলনের ফলে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক 1829 খ্রিস্টাব্দে 17 নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন –

হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর প্রমুখ বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। এই আন্দোলনের ফলে বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যার বয়স সর্বনিম্ন 10 বছর নির্ধারিত হয় (1860 খ্রিস্টাব্দ)।

বিধবাবিবাহের পক্ষে আন্দোলন –

বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের পক্ষে আন্দোলন করেন। তিনি শাস্ত্র উদ্ধৃত করে বিধবাদের পুনরায় বিবাহের সপক্ষে যুক্তি দেন। তাঁর আন্দোলনের ফলে 1856 খ্রিস্টাব্দে সরকার বিধবাবিবাহকে আইনসম্মত বলে ঘোষণা করে।

অন্যান্য সংস্কার আন্দোলন –

এ ছাড়াও এই সময় কৌলিন্য প্রথা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতির বিরুদ্ধেও আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল।

ধর্মসংস্কার আন্দোলন –

উনিশ শতকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্বরা হলেন –

  • রাজা রামমোহন রায়,
  • রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব,
  • স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ।

রাজা রামমোহন রায় –

রাজা রামমোহন রায় 1828 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে যা ব্রাহ্মসমাজে পরিণত হয়। তিনি হিন্দু ধর্মে প্রচলিত পৌত্তলিকতা, আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্বতা, বহু ঈশ্বরবাদ প্রভৃতির বিরোধিতা করেন। তিনি উপনিষদের আদর্শে একেশ্বরবাদের তত্ত্ব প্রচার করেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব –

কলকাতার দক্ষিণেশ্বরের দেবী ভবতারিণীর পূজারি গদাধর চট্টোপাধ্যায় পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব রূপে খ্যাত হন। তাঁর মতে, ইসলাম, খ্রিস্ট, বৈয়ব, বৌদ্ধ সব মতেই ঈশ্বর লাভ করা যায়। তিনি বলতেন, যত মত তত পথ। তাঁর শিবজ্ঞানে জীব সেবার আদর্শ নতুন ধর্মপথের সন্ধান দেয়। তিনি সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ প্রচার করেন।

স্বামী বিবেকানন্দ –

শ্রীরামকৃষ্ণের সুযোগ্য শিষ্য ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি গুরুর আদর্শে ‘নব্য বেদান্তের’ আদর্শ প্রচার করেন। তাঁর ধর্ম ছিল মানুষ তৈরির ধর্ম (Man making religion) I তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ের কথা প্রচার করেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থগুলি হল – বর্তমান ভারত, রাজযোগ, পরিব্রাজক প্রভৃতি। তাকে ‘ভারতীয় জাতীয় জীবনের গঠনকর্তা’ বলে অভিহিত করা হয়।

ব্রিটিশ আমলে বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের রূপরেখা নিরূপণ করো।
অথবা, উনিশ শতকের বাংলাদেশের সমাজসংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে বর্ণনা দাও।

ব্রিটিশ আমলে বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলনের ভূমিকা –

উনিশ শতকে পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার স্পর্শে প্রগতিশীল উদারপন্থীরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য সমাজসংস্কারকগণ হলেন রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও প্রমুখ। তাঁরা ভারতীয় সমাজের সতীদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতির বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষা প্রভৃতির পক্ষে আন্দোলন করেছিলেন।

ব্রিটিশ আমলে বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

ব্রিটিশ আমলে বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলন –

রাজা রামমোহন ও সতীদাহ প্রথাবিরোধী আন্দোলন –

ভারতে সমাজসংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য সমাজসংস্কার আন্দোলন হল সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন।

  • রামমোহন মনুসংহিতা ও অন্যান্য শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, শাস্ত্রে বিধবাদের সংযমী জীবনযাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে – পুড়িয়ে মারা নয়। সতীদাহপ্রথার সমর্থক গোঁড়া ও রক্ষণশীল হিন্দুদের বিরুদ্ধে রামমোহন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
  • 1818 খ্রিস্টাব্দে এক পুস্তিকা বিতরণ করে তিনি জনমত সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালান। সম্বাদ কৌমুদী পত্রিকা প্রকাশ করে সহমরণ বা সতীদাহপ্রথার তীব্র বিরোধিতা করেন তিনি। অবশেষে বড়োলাট লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক 1829 খ্রিস্টাব্দে 17 নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন।
  • রামমোহন নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারের স্বীকৃতির জন্যও আন্দোলন করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী যাতে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে সেই বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি পুরুষের বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরোধী ও অসবর্ণ বিবাহের সমর্থক ছিলেন।

ব্রাহ্মসমাজের সমাজসংস্কার আন্দোলন –

রামমোহন প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজে পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে সমাজসংস্কার আন্দোলন পরিচালিত হয়। কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলে 1872 খ্রিস্টাব্দে তিন আইন (Act III, 1872) দ্বারা বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ এবং বিধবাবিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়। এ ছাড়া ব্রাহ্মসমাজ শিক্ষাপ্রসারে ও নানা কুসংস্কার দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

বিদ্যাসাগর ও বিধবাবিবাহ আন্দোলন –

বিদ্যাসাগর নারীর অকাল বৈধব্য জীবনের দুঃখদুর্দশা দেখে বিচলিত হয়েছিলেন। তিনি সমাজে বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য সংগ্রাম করেন। বিধবাবিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত তা প্রমাণ করার জন্য তিনি বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছিলেন। পরাশর সংহিতার একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে তিনি বলেন যে, “স্বামী অনুদ্দেশ হলে, মারা গেলে, ক্লীব হলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করলে অথবা পতিত হলে স্ত্রীর পুনরায় বিয়ে করা শাস্ত্রসম্মত।”

  • তিনি বিধবাবিবাহের পক্ষে 1855 খ্রিস্টাব্দে দুটি পুস্তিকা রচনা করেন এবং 1855 খ্রিস্টাব্দের 4 অক্টোবর 1000 জনের সই-সংবলিত আবেদনপত্র সরকারের কাছে পেশ করেন। অপরদিকে বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে গোঁড়া হিন্দুরা 36,763 জনের সইযুক্ত আবেদনপত্র পাঠান।
  • শেষপর্যন্ত সরকার 1856 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই আইন জারি করে বিধবাবিবাহ আইনসম্মত বলে ঘোষণা করেন। বিধবাবিবাহ আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। 1883 খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে উইডো ম্যারেজ অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও কুলীন প্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেন।

ডিরোজিও এবং ইয়ং বেঙ্গলের সমাজসংস্কার আন্দোলন –

ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (1809-1831 খ্রিস্টাব্দ)। তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষক ছিলেন। ডিরোজিও এবং তাঁর অনুগামী প্যারিচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ি, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তি ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত। ইয়ং বেঙ্গল সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, সতীদাহপ্রথা ও প্রচলিত হিন্দুধর্ম তাঁদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল। তাঁরা মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন, কিন্তু ভারতীয় সংস্কারগুলিকে ঘৃণা করতেন। উগ্র কালাপাহাড়ি মনোভাবের ফলে সমাজ থেকেও তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল না। এজন্য বলা হয় – তাঁরা ছিলেন Generation without father and children.

অন্যান্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন –

  • গঙ্গায় সন্তান বিসর্জনের বিরুদ্ধে আন্দোলন – গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন দেওয়ার মতো এক নিষ্ঠুর প্রথা ভারতে প্রচলিত ছিল। 1795 খ্রিস্টাব্দে ও 1802 খ্রিস্টাব্দে দুটি রেগুলেশন জারি করে সরকার এই নিষ্ঠুর প্রথার অবসান ঘটায়।
  • নরবলি প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন – ভারতে অনেক উপজাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং ধর্মীয় উদ্দেশ্যে কোনো কোনো রাজপরিবারে নরবলি প্রথা প্রচলিত ছিল। উড়িষ্যার খন্দ উপজাতিরা বিপুল শস্য উৎপাদনের আশায় ধরিত্রীকে তুষ্ট করার জন্য নরবলি দিত। লর্ড হার্ডিঞ্জ 1844 খ্রিস্টাব্দে এই প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
ব্রিটিশ আমলে বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

প্রার্থনা সমাজের সমাজসংস্কার আন্দোলন কী?

প্রার্থনা সমাজের সমাজসংস্কার আন্দোলন – কেশবচন্দ্র সেনের প্রেরণায় 1867 খ্রিস্টাব্দে আত্মারাম পান্ডুরং মহারাষ্ট্রে প্রার্থনা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। মহাদেব গোবিন্দ রানাডে প্রার্থনা সমাজের প্রাণপুরুষে পরিণত হয়েছিলেন। প্রার্থনা সমাজের উল্লেখযোগ্য সমাজসংস্কার হল – বিধবাবিবাহের পক্ষে এবং বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রভৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন।

আর্য সমাজের সমাজসংস্কার আন্দোলন কী?

আর্য সমাজের সমাজসংস্কার আন্দোলন – আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী। তিনি বেদভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করে হিন্দুসমাজের লুপ্ত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, বাল্যবিবাহ প্রভৃতির বিরোধিতা করেন।

মুসলিম সমাজের সংস্কার আন্দোলন কী?

মুসলিম সমাজের সংস্কার আন্দোলন – ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হলে মুসলিম সমাজ তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। ফলস্বরূপ তারা প্রশাসনিক ও চাকরি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এই হতাশাজনক অবস্থা থেকে মুসলিম সমাজে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। মুসলিম সমাজের ত্রাণকর্তা ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান (1817-1898 খ্রিস্টাব্দে)। তিনি উপলব্ধি করেন, পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ ও মুসলিম সমাজে সংস্কার ছাড়া উন্নতি সম্ভব নয়। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের জন্য আলিগড় অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এই আলিগড় কলেজকে কেন্দ্র করে আলিগড় আন্দোলন আবর্তিত হয়। স্যার সৈয়দ আহমদ নারীশিক্ষার পক্ষে বক্তব্য রাখেন এবং পর্দাপ্রথা, পুরুষের বহুবিবাহ ও তালাক প্রথার তীব্র নিন্দা করেন।

1825 খ্রিস্টাব্দে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করা হয় এবং লর্ড এলেনবরা 1843 খ্রিস্টাব্দে ক্রীতদাস প্রথা বিলোপ করেন। এই সংস্কার আন্দোলনে ইংরেজ সরকারের ভূমিকা ও এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আলোচনা করো।

1825 খ্রিস্টাব্দে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। লর্ড এলেনবরা 1843 খ্রিস্টাব্দে ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। প্রগতিশীল ভারতীয়দের সমাজসংস্কার আন্দোলন একটি মহত্তর প্রচেষ্টা। ইংরেজ সরকার এই সংস্কার-আন্দোলনের পক্ষে কিছু আইন প্রণয়ন করেছিল। তবে কুসংস্কারের চিরাচরিত কাঠামো একেলানের ভেঙে ফেলতে পারেনি।

সমাজসংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা করো।

অথবা, উনিশ শতকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণে রাজা রামমোহন রায়ের যে ভূমিকা ছিল, তা বিশেষভাবে আলোচনা করো।

সমাজসংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা –

ভারতীয় সমাজের সংস্কার আন্দোলনে ‘ভারত পথিক’ রাজা রামমোহন রায়ের অবদান সর্বাগ্রগণ্য। সমাজের কুসংস্কার দূর করে আধুনিক সমাজ গঠনে রাজা রামমোহন রায় প্রথম সচেষ্ট হয়েছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন যে, রামমোহন রায় ছিলেন সমকালীন বিশ্বের সেই ব্যক্তি যিনি আধুনিক যুগের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন।

রাজা রামমোহনের সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্য –

রাজা রামমোহনের সমাজসংস্কার আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল –

  • কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক ভারতীয় সমাজ গঠন করা
  • নারীসমাজের অবস্থার উন্নয়ন।

রাজা রামমোহনের সমাজসংস্কার –

সমাজসংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা করো।
  • সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন – সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের সবচেয়ে বড়ো অবদান সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন। তৎকালীন হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণে অমানবিক সতীদাহপ্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে মৃত স্বামীর চিতায় তার জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যা-সহ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে রামমোহন এই পৈশাচিক প্রথা বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেন। তাঁর এই প্রচেষ্টার ফলে শেষপর্যন্ত গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক 1829 খ্রিস্টাব্দে 17 নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন।
  • নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা – রাজা রামমোহন রায় নারীদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর যাতে তার বিধবা স্ত্রী স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে তার জন্য তিনি স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়েও আন্দোলন করেন। কারণ তখন পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না।
  • বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন – রামমোহন বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছিলেন। তিনি ভারতীয় শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেন যে, প্রাচীন শাস্ত্রে পুরুষের বহুবিবাহের যথেচ্ছ অধিকার দেওয়া হয়নি। তবে প্রাচীনকালে কোনো স্ত্রী ব্যাভিচারিণী, সুরাসক্ত ও বন্ধ্যা হলে পুরুষ পুনরায় বিবাহ করতে পারত।
  • কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা – রামমোহন কৌলীন্য প্রথাবিরোধী ছিলেন। কারণ – এই কৌলীন্য প্রথার জন্যই সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় অল্পবয়স্ক মেয়েদের মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হত।
  • জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা – রাজা রামমোহন রায় জাতিভেদ প্রথার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে সমাজের মানুষের ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘বজ্রসূচী’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ করে প্রচার করেন।
  • ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা – রামমোহন রায় 1828 খ্রিস্টাব্দে যে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন, তা 1830 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ নামে খ্যাতি লাভ করে।

রাজা রামমোহন রায়ের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদান –

শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতেও রামমোহন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর অবদান হল –

  • শিক্ষাবিস্তার ও
  • গণতান্ত্রিক চেতনা প্রসারের চেষ্টা।

রাজা রামমোহন রায়ের শিক্ষাবিস্তার –

রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি নিজে 22 বছর বয়সে ইংরেজি ভাষা শেখেন। তারপর ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারের জন্য পটলডাঙায় অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ডেভিড হেয়ার-কে তিনি হেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। কারও কারও মতে, তিনি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ছিলেন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের সময় সরকার সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যত হয়। তখন রামমোহন বড়োলাট লর্ড আমহার্স্টকে এক স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপিতে ইংল্যান্ডের মতো আধুনিক শিক্ষা চালু করার আবেদন জানান। জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি পাদরি আলেকজান্ডার ডাফকে সাহায্য করেন।

রাজা রামমোহন রায়ের গণতান্ত্রিকতা –

রামমোহন গণতন্ত্রের পূজারি ছিলেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব ও মনীষীদের রচনা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। সম্বাদ কৌমুদী পত্রিকায় নিজ মত প্রচার করেন। তিনি সাহিত্য, সাংবাদিকতা, ভাষারীতিতে স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখেন।

সমাজসংস্কার আন্দোলনের মূল্যায়ন –

এভাবে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের উপর যুক্তির প্রাধান্য – যা নবজাগরণের মূল কথা, তা রামমোহনের কার্যকলাপে লক্ষ করা যায়। তাঁর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য তাঁকে ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ বলে আখ্যা দেওয়া।

1815-1818 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কত জন বিধবাকে সতীদাহ প্রথায় প্রাণবিসর্জন দিতে হয়েছিল। এর মধ্যে কলকাতা-সহ তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মহিলা ছিলেন কত জন?

একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, 1815-1818 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে 2365 জন বিধবাকে সতীদাহ প্রথায় প্রাণবিসর্জন দিতে হয়েছিল। এর মধ্যে কলকাতা-সহ তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মহিলা ছিলেন 1528 জন।

ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, বঙ্গীয় নবজাগরণের ইতিহাসে নব্যবঙ্গ আন্দোলনের ভূমিকার বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করো।

ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সংস্কার আন্দোলনের ভূমিকা –

বাংলাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের পর পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে একদল আদর্শবাদী তরুণ প্রচলিত হিন্দুধর্ম ও সমাজের অনাচার, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও -র প্রভাবে তরুণ ছাত্রদল উগ্র মানসিকতা নিয়ে ধর্ম ও সমাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ইতিহাসে তাঁরা নব্যবঙ্গ বা Young Bengal নামে পরিচিত।

ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সংস্কার আন্দোলনের পটভূমি –

পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলাদেশের সমাজজীবনে এক সাংস্কৃতিক আলোড়ন শুরু হয়। সচেতন মানুষেরা প্রচলিত ধর্ম, সমাজব্যবস্থার দুর্বলতা অনুভব করে। এ ছাড়া আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, ইংল্যান্ডের চরমপন্থীদের চিন্তাধারা শিক্ষিত বাঙালিদের চেতনায় গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের আদর্শকে উজ্জীবিত করেছিল। ফলে এক প্রগতিমূলক পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হয়। এই পটভূমিতে ডিরোজিও আবির্ভূত হন।

ডিরোজিওর শিক্ষা ও আদর্শ –

কলকাতার এক ইঙ্গ-পোর্তুগিজ পরিবারের সন্তান হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (1809-1831 খ্রিস্টাব্দ) ড্রুমন্ডের ধর্মতলা আকাদেমি থেকে শিক্ষালাভ করেন। ড্রুমন্ডের মুক্ত চিন্তা ও আদর্শের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। ডিরোজিওর চারিত্রিক শুদ্ধতা, উচ্চ আদর্শ ও উদারতা হিন্দু কলেজের ছাত্রদের গভীরভাবে আকর্ষণ করে। ‘রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন, “চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে তেমনি তিনিও বালকদিগকে আকর্ষণ করিতেন।” তিনি ছিলেন ছাত্রদের বন্ধু ও পথপ্রদর্শক। তাঁর চেষ্টায় ছাত্ররা লক, হিউম, বেকন, টম পেইন, ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখ দার্শনিকদের রচনার সঙ্গে পরিচিত হয়। তিনি ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তা করতে এবং বিনা বিচারে কোনো কিছু গ্রহণ করতে নিষেধ করেন। সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলতেন, “সত্যের জন্য বাঁচো, অসত্য থেকে মুক্ত হও।”

ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী –

হিন্দু কলেজে অধ্যাপনার সময় ডিরোজিওকে কেন্দ্র করে একটি ছাত্রগোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যারা নব্যবঙ্গ বা Young Bengal নামে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন – রামতনু লাহিড়ি, রামগোপাল ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ। ছাত্রদের যুক্তিপূর্ণ আলোচনার জন্য অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠে 1828 খ্রিস্টাব্দে। এই সভায় ছাত্ররা ইতিহাস, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, স্বদেশপ্রেম নিয়ে আলোচনা করত। বিতর্ক হত ভাগ্য, সত্য ও মূর্তিপূজা নিয়ে।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন –

ডিরোজিও কেবল একজন অধ্যাপক ছিলেন না, তিনি ছিলেন উদীয়মান বাংলার এক প্রদীপ্ত প্রলয়শিখা। রামমোহন যে কাজ শুরু করেন, ডিরোজিও তাতে প্রচণ্ড গতি সঞ্চার করেন। তিনি ছাত্রদের মধ্যে আদর্শ, সত্যবাদিতা ও যুক্তিবাদের আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন। তার ফলে হিন্দুধর্ম ও সমাজ এক গভীর সংকটে পড়ে। ডিরোজিও -র ছাত্র রসিককৃষ্ণ মল্লিক বলেন যে, “আমি গঙ্গানদীর পবিত্রতায় বিশ্বাস করি না”। তাঁরা নিষিদ্ধ গোমাংস খেতেন, উপবীত ধারণ করতেন না, মুসলমানের হাতে জল খেতেন, ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদের দেখে বলতেন, “আমরা গোরু খাই গো”। কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে বলতেন, ‘Good Morning, Madam’, মাধবচন্দ্র লেখেন, “আমরা হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে যেটা ঘৃণা করতাম, তা হল হিন্দুধর্ম।”

এই নেতিবাচক মনোভাব ও আচরণের পাশাপাশি তাঁরা প্রগতিমূলক সংস্কারের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, মূর্তিপূজা, সতীদাহপ্রথা ও প্রচলিত হিন্দুধর্ম বিষয়েও তাঁরা আলোচনা করতেন। পার্থেনন পত্রিকায় স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রী-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আলোচিত হত। ক্যালাইডোস্কোপ পত্রিকার ইংরেজ শাসনের সমালোচনা করা হত।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সংস্কার আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা –

তবে নব্যবঙ্গ আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কারণ –

  • তাঁদের কোনো গঠনমূলক কর্মসূচি ছিল না। পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা না নিয়ে তাঁরা হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করেন।
  • এই আন্দোলন শহুরে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সীমিত ছিল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের যোগ ছিল না। ডঃ অনিল শীল তাই বলেছেন, “They lived in Ivory tower”.
  • কৃষক-শ্রমিকদের দুর্দশার কথা তাঁরা ভাবতেন না।
  • তাঁরা ছিলেন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠী।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সংস্কার আন্দোলনের মূল্যায়ন –

ভারতীয় নবজাগরণের ইতিহাসে নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী বিশিষ্ট সম্মানের অধিকারী। শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন, ডিরোজিও তিন বছরে তাঁর শিষ্যদলের মধ্যে এমন কিছু রোপণ করেছিলেন, যা তাদের অন্তরে আমরণ বিদ্যমান ছিল। তাঁরা বিভিন্ন পত্রিকার (এনকোয়ারার, বেঙ্গল স্পেকটেটর, হিন্দু পাইওনিয়ার) মাধ্যমে এবং জ্ঞানোপার্জিকা সভা ও বেঙ্গল-ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করে খ্রিস্টান পাদরিদের গোঁড়ামি, স্ত্রী-পুরুষের অসম অধিকার, দাসপ্রথা, নারীনির্যাতন, সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণ, মরিশাসে ভারতীয় কুলি রফতানি, ভারতে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা, বেগার শ্রম, একচেটিয়া বাণিজ্য, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। আধুনিকতার দিক থেকে তাঁদের চিন্তাধারা রামমোহনের চেয়েও প্রগতিশীল ছিল। অনেকে তাঁদের ‘নবজাগরণের ঊষালগ্ন’ বলেছেন। আবার কেউ কেউ তাঁদের ‘A generation without father and children’ বলে নিন্দাও করেছেন।

বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। বিদ্যাসাগর কতটা সাফল্য অর্জন করেছিলেন?

বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের ভূমিকা –

অতি প্রাচীনকালে বিধবাবিবাহ প্রচলিত ছিল। পরে ধর্মীয় বিধান ও সমাজ নারীর অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ হয়। নারীর বাল্যবিবাহ এবং পুরুষের বহুবিবাহ চালু হয়। এইসব সামাজিক কুপ্রথা ধর্মের অঙ্গ হিসেবে সমাজে পালিত হতে থাকে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে সচেতন শিক্ষিত শ্রেণি এই কুপ্রথাগুলি দূর করতে সচেষ্ট হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল বিধবাবিবাহ আন্দোলন। এই আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি বলেন ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম।’

বিদ্যাসাগর এবং বিধবাবিবাহ আন্দোলন –

সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিভিন্নভাবে বিধবাবিবাহ প্রচলনের পক্ষে আন্দোলন করেছিলেন। যেমন –

  • গ্রন্থ রচনা করে,
  • সংবাদপত্রের মাধ্যমে,
  • বিভিন্ন মানুষের স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনপত্র সরকারের কাছে প্রেরণের মাধ্যমে ও
  • নানা স্থানে গিয়ে প্রচারের মাধ্যমে।

গ্রন্থ রচনা করে –

1854 খ্রিস্টাব্দে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় বিধবাবিবাহের সমর্থনে একটি নিবন্ধ লেখেন বিদ্যাসাগর। পরে 1855 খ্রিস্টাব্দে ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি পুস্তিকাও রচনা করেন তিনি। এইভাবে নানান পুস্তিকা রচনা করে বিধবাবিবাহ প্রচলনের পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। তিনি বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে প্রমাণ করেন যে, বিধবাবিবাহ হল শাস্ত্রসম্মত।

সংবাদপত্রের মাধ্যমে –

বিদ্যাসাগর ‘সর্বশুভকরী’ পত্রিকায় বিধবাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। ‘সর্বশুভকরী’ পত্রিকা ছিল বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত ‘সর্বশুভকরী সভা’ -র মুখপত্র।

স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনপত্র পেশের মাধ্যমে –

বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের সমর্থনে 1855 খ্রিস্টাব্দে 1000 জন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে এক আবেদনপত্র পাঠান। এই স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রচারের মাধ্যমে –

বিদ্যাসাগর বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিধবাবিবাহের প্রচার ও আয়োজন করে এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন।

বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের লাভ –

বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে সফল করতে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। বিধবাবিবাহের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার জন্য বিদ্যাসাগর গ্রন্থ রচনা করেন এবং পত্রপত্রিকার মাধ্যমে তা প্রচার করেন। অপরপক্ষে রাধাকান্ত দেব ছিলেন বিধবাবিবাহের ঘোরতর বিরোধী। বিধবাবিবাহের পক্ষে আইন পাস করার জন্য বিদ্যাসাগর 1855 খ্রিস্টাব্দের 4 অক্টোবর 1000 জন ব্যক্তির স্বাক্ষর-সংবলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠান। এই আবেদনপত্রের বিরুদ্ধে রাধাকান্ত দেব 36,763 জন ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে একটি পালটা আবেদনপত্র পাঠান।

  • বিধবাবিবাহ আইন পাস – সরকার সমস্ত বিরোধী দাবি অগ্রাহ্য করে 1856 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই বিধবাবিবাহকে আইনসম্মত বলে ঘোষণা করে।
  • বিধবাবিবাহের ঘটনা – বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় যে বিধবাবিবাহগুলি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল –
    • শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও কালিমতির বিবাহ – 1856 খ্রিস্টাব্দের 7 ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও বিধবা কালিমতির বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
    • নারায়ণ ও ভবসুন্দরীর বিবাহ – বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণের সঙ্গে ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার বিবাহ দেন।

এরপর 82,000 টাকা ব্যয়ে তিনি 60 জন বিধবার বিবাহ দেন। জনপ্রিয় না হলেও এইভাবে হিন্দুসমাজে বিধবাবিবাহ চালু হয়।

বাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। এই আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল?

অথবা, উনিশ শতকের বাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের বিবর্তন ও ব্রাহ্মসমাজের বিভাজন সম্পর্কে আলোচনা করো।

উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতের ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিল ব্রাহ্মসমাজ। ব্রাহ্মসমাজ একেশ্বরবাদের কথা প্রচার করে। রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হয়; কিন্তু পরবর্তীকালে এর বিবর্তন ও বিভাজন ঘটে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে আদি ব্রাহ্মসমাজ, কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ, নববিধান ব্রাহ্মসমাজ এবং শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসুর নেতৃত্বে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ গড়ে ওঠে।

বাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। এই আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল?

ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা –

রাজা রামমোহন রায় উপনিষদের একেশ্বরবাদী তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে 1828 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়।

ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল –

  • এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মের উপাসনা করা।
  • খ্রিস্টান মিশনারিদের আক্রমণের হাত থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা।
  • বাংলায় বৈদান্তিক হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
  • হিন্দুধর্মের নামে যেসব কুসংস্কার ও অন্যায়-অবিচার প্রচলিত আছে তার উচ্ছেদ করা।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ব্রাহ্মসমাজে বিবর্তন –

রাজা রামমোহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন দ্বারকানাথ ঠাকুর, পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ প্রমুখের মতো কয়েকজন মাত্র ব্রাহ্ম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে ব্রাহ্ম আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগদানের ফলে ব্রাহ্মসমাজ আবার গতিশীল হয়।

  • ব্রাহ্ম আন্দোলনে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে বড়ো অবদান হল তিনি ব্রাহ্মসমাজের নিয়মাবলি, ধর্ম, আচারবিধি, ক্রিয়াপদ্ধতি প্রভৃতি প্রণয়ন করেন। তাঁর এই কাজের ফলে ব্রাহ্ম আন্দোলন একটি সাংগঠনিক রূপ পায়। তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হন। ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান-পদ্ধতি নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন তিনি।
  • ব্রাহ্মসমাজ সাংগঠনিক রূপ লাভ করার পর ব্রাহ্মরা একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।
  • তিনি বেদের অভ্রান্ততা অস্বীকার করার ফলে হিন্দুধর্মের সঙ্গে ব্রাহ্মধর্মের দূরত্ব বাড়তে থাকে।

কেশবচন্দ্র সেন ও ব্রাহ্মসমাজের বিবর্তন –

1857 খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করলে ব্রাহ্ম আন্দোলন আরও গতিশীল হয়। তাঁর বাগ্মিতা, ধর্মোন্মাদনা ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ শিক্ষিত যুবকরা দলে দলে ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করে। তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, উমেশচন্দ্র দত্ত, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। তাঁর সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর 1862 খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধি দেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক ও আচার্য হন। তাঁর উদ্যোগে 1865 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় 50টি এবং সারা ভারতে ব্রাহ্মসমাজের মোট 54টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। এই আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল?

ব্রাহ্মসমাজের বিভাজন –

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ও আদি ব্রাহ্মসমাজ –

কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম উপাসনা পদ্ধতি ও ব্রাহ্মধর্মের মূল তত্ত্বগুলিকে সহজসরল ও যুগোপযোগী করে তোলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন ব্রাহ্মধর্ম হল হিন্দুধর্মই এবং হিন্দুধর্মের বিশুদ্ধ রূপ। তিনি মূর্তিপূজা অথবা হিন্দুধর্মের অন্য কোনো সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন না। অপরদিকে কেশবচন্দ্র সেন হিন্দুধর্ম ও সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন। এই মতপার্থক্যের জন্য ব্রাহ্মসমাজ ভেঙে যায়। কেশবচন্দ্র সেন 1866 খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুগামীরা আদি ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিতি লাভ করেন।

সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ –

কিছুদিনের মধ্যে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে বিভেদ ঘটে। কেশবচন্দ্রের চৈতন্যপ্রীতি, খ্রিস্টপ্রীতি, হিন্দু দেবদেবী ও অনুষ্ঠানের প্রতি বিশ্বাস ব্রাহ্মসমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

তিনি বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করলেও নিজের 14 বছর বয়সি কন্যা সুনীতিদেবীর সঙ্গে কোচবিহারের নাবালক রাজপুত্র নৃপেন্দ্র নারায়ণের বিবাহ দিলে তরুণ ব্রাহ্মরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তরুণ ব্রাহ্মনেতা শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় 1878 খ্রিস্টাব্দের 15 মে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। এই আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল?
নববিধান ব্রাহ্মসমাজ –

কেশবচন্দ্র সেন 1880 খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত নববিধান প্রচার করেন। এর মাধ্যমে তিনি সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ প্রচার করেন। কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে পরিচালিত ব্রাহ্মসমাজ নববিধান ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়। কেশবচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত ব্রাহ্মসমাজ তার প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে। তবে বাংলার ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “কেশবচন্দ্র পরিচালিত এই ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনই হল প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন।”

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির কীরূপ ভূমিকা ছিল?

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা –

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিল ব্রাহ্মসমাজ। রাজা রামমোহন রায় 1828 খ্রিস্টাব্দে যে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীকালে সেটি ব্রাহ্মসমাজ নামে খ্যাতি লাভ করে।

ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন শাখা –

রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ পরবর্তীকালে বিবর্তিত ও বিভাজিত হয়। যেমন –

  • দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে আদি ব্রাহ্মসমাজ।
  • কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ও নববিধান ব্রাহ্মসমাজ।
  • শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসুর নেতৃত্বে গঠিত হয় সাধারন ব্রাহ্মসমাজ।

সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির ভূমিকা –

ব্রাহ্মসমাজের সংস্কার আন্দোলন –

ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায় সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। তাঁর আন্দোলনের ফলে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক 1829 খ্রিস্টাব্দে 17 নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

  • নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন – স্বামীর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী যাতে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে, তারজন্য স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগঠিত করে রামমোহন রায় পরিচালিত ব্রাহ্মসমাজ।
  • বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন – রাজা রামমোহন রায় পুরুষের বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন।
  • কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন – ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুসমাজে প্রচলিত কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছিল।
  • জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন – সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথার ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য আন্দোলন করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আদি ব্রাহ্মসমাজের সংস্কার আন্দোলন –

রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশ করে ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ প্রচার করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের ঘোর বিরোধী এবং অপর দিকে বিধবাবিবাহ প্রচলনের সমর্থক ছিলেন।

কেশবচন্দ্র সেন পরিচালিত ব্রাত্মসমাজগুলির সংস্কার আন্দোলন –

কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের সংস্কার আন্দোলন আরও গতিশীল হয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় 1866 খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে 1880 খ্রিস্টাব্দে তিনি গড়ে তোলেন নববিধান ব্রাহ্মসমাজ।

কেশবচন্দ্র সেন সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করেন। এর পাশাপাশি তিনি সমাজে বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহের প্রচলন, শিক্ষার প্রসারের পক্ষে আন্দোলন করেন।

তিন আইন – কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলেই সরকার তিন আইন (1872 খ্রিস্টাব্দ) পাস করে। এর ফলে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ও অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়।

উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের উপসংহার –

কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে মনোমালিন্যের জন্য শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসু 1878 খ্রিস্টাব্দে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করে সমাজসংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেন। কিন্তু 1880 খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজ ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করো।

ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ভূমিকা –

উনিশ শতকের ভারতে ধর্ম ও সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রতিভূ ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তাঁর পূর্বনাম ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায়। তিনি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির পুরোহিত নিযুক্ত হয়েছিলেন। আচার্য তোতাপুরীর কাছে তিনি বৈদিক মার্গ অনুশীলন করেন। তিনি তাঁর নতুন নামকরণ করেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস।

শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মসংস্কারের বৈশিষ্ট্য –

  • সর্বধর্মসমন্বয় – শ্রীরামকৃষ্ণদেব ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, বৈয়ব প্রভৃতি সব ধর্ম পদ্ধতি অনুশীলন করেন। এরপর তিনি উপলব্ধি করেন ‘ঈশ্বর এক ও অভিন্ন’।
  • মানবতাবাদ – শ্রীরামকৃষ্ণদেব ছিলেন প্রকৃত মানবতাবাদী সংস্কারক। তিনি জাতিভেদ প্রথা মানতেন না। তিনি মনে করতেন প্রতিটি মানুষের মধ্যে ঈশ্বর আছেন। ‘শিবজ্ঞানে জীব সেবা’ বা জীব জগতের কল্যাণসাধন ছিল তাঁর ধর্মের মূলকথা।
  • ভক্তিবাদের উপর গুরুত্ব আরোপ – তাঁর মতে, আড়ম্বর, জাঁকজমক, মূর্তিপূজা করে ঈশ্বরলাভ করা যায় না। অন্তরের ভক্তি দিয়ে ডাকলে ঈশ্বরলাভ সম্ভব।
  • ভোগবাদের বিরোধিতা – শ্রীরামকৃষ্ণদেব মানুষের চরম ভোগবাদের বিরোধী ছিলেন। তিনি অর্থের প্রতি অতি আসক্তির নিন্দা করেন। তিনি বলতেন, ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’।

স্বামী বিবেকানন্দ –

শ্রীরামকৃয়দেবের প্রিয় শিষ্য ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর পূর্বনাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর তিনি স্বামী বিবেকানন্দ নামে খ্যাতি লাভ করেন।

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্ম সংস্কারের বৈশিষ্ট্য –

  • সমন্বয়ের আদর্শ প্রচার – স্বামী বিবেকানন্দ প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, প্রাচীন ও আধুনিক মতাদর্শ, ধনী-দরিদ্র সকলের সহযোগিতায় নতুন ভারত গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছেন যে, দেশের প্রকৃত শক্তি হল দেশের সাধারণ মানুষ। তিনি বলেছেন, ‘জগতে বিভিন্ন ধর্মের উপাসনা প্রণালী বিভিন্ন হলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলি এক’।
  • নব্য বেদান্তবাদ – স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নব্য বেদান্তবাদ। স্বামী বিবেকানন্দ বলেন সর্বত্রই ব্রহ্মের উপস্থিতি। মানুষের সেবা করলেই ব্রহ্মের সেবা করা হয়।
  • চরমপন্থী মনোভাব – স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারায় চরমপন্থী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে বলেছেন – ‘ভুলিও না তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত।’ তার তেজস্বী বাণী ভারতীয় বিপ্লবীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
  • কুসংস্কার ও অনাচারের বিরোধিতা – জাতিভেদ প্রথা, সামাজিক অনাচার ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি বলেছেন যে, কুসংস্কারহীন সমাজ নতুন দেশ গঠনের সহায়ক হবে।

ধর্মসংস্কার আন্দোলনের উপসংহার –

শ্রীরামকৃষ্ণদেব শুধুমাত্র একজন ধর্মীয় শিক্ষক নন, একজন লোকশিক্ষক হিসেবেও তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ‘সর্বধর্মসমন্বয়ের’ মহান আদর্শ প্রচার করেন। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন তাঁর সুযোগ্য শিষ্য। তিনি মানুষ তৈরির ধর্ম প্রচার করেন। উনিশ শতকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসের তাই তাঁদের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়।

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের উপর নিবন্ধ লেখো।

অথবা, উনিশ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরণের প্রকৃতির বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা করো।

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের ভূমিকা –

ভারতের মধ্যে বাংলাতেই প্রথম ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কলকাতা ছিল বাংলার রাজধানী। তাই পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে কলকাতা। একদল বাঙালি এই শিক্ষা-সংস্কৃতির জোয়ারে অবগাহন করে আন্দোলন শুরু করেন। রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী এবং অন্যান্য মনীষী বাংলাদেশে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে, শিক্ষাপ্রসারে, ধর্ম ও সমাজসংস্কারে উদ্যোগী হন। উনিশ শতকের বাংলাদেশে এই ঘটনাকে কেউ কেউ নবজাগরণ বা রেঁনেসা বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন।

নবজাগরণ কী? –

রেনেসাঁ একটি ফরাসি শব্দ। এর বাংলা অর্থ হল নবজাগরণ। রেনেসাঁ শব্দটি ইউরোপে বিশেষত ইটালির ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। এই শব্দের দ্বারা মূলত 14-16 শতকের ইতালীয় সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও রাজনীতির স্ফুরণকে বোঝায়। আবার ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সূত্রে উনিশ শতকের বাংলায় শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতে যে পরিবর্তন ঘটে, তাকে কেউ কেউ নবজাগরণ বলেন।

নবজাগরণের স্রষ্টা –

উনিশ শতকের নবজাগরণে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী উভয় শ্রেণিরই অবদান ছিল। যারা সনাতন হিন্দু ঐতিহ্যের ধারক ছিলেন তারাও পাশ্চাত্য শিক্ষার গুণমুগ্ধ ছিলেন। আবার যারা মনে করতেন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ছাড়া ভারতীয়রা সংস্কারবর্জিত সুসভ্য জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না, তারাও জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রগুলিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আধুনিক পাশ্চাত্য ও প্রাচীন প্রাচ্যের সমন্বয়ে তৈরি মিশ্র সংস্কৃতি উনিশ শতকের বাংলায় এক বাবু শ্রেণির জন্ম দিয়েছিল। এই বাবুরাই ছিলেন নবজাগরণের পৃষ্ঠপোষক।

বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি –

উনিশ শতকে বাংলাদেশের নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি বিষয়ে বিভিন্ন মতামত আছে।

বাংলার নবজাগরণ –

তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজা রামমোহন রায় এক চিঠিতে আলেকজান্ডার ডাফকে লিখেছিলেন, আমি ভাবতে শুরু করেছি যে, “ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মতো কিছু একটা ভারতে ঘটতে চলেছে”। রামমোহনের মতো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উনিশ শতকের বাংলার মানসিক স্ফুরণ ও সংস্কার আন্দোলনকে নবজাগরণ বলেছেন।

  • ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার তাঁর বাংলার ইতিহাস গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলাকে ‘নবজাগরণের পীঠস্থান’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে যে নবজাগরণ দেখা যায়, ঊনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল তার থেকেও ব্যাপক, গভীর এবং বৈপ্লবিক।”
  • অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেছেন যে, বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসনে বুর্জোয়া অর্থনীতি ও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব অনুভূত হয়। তার ফলে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটে তাকে সাধারণভাবে নবজাগরণ বলা হয়ে থাকে। ইউরোপীয় নবজাগরণের সেই ভূমিকা পালন করেছিল বাংলা (তৎকালীন বাংলাদেশ)।

বাংলার নবজাগরণ প্রকৃত নবজাগরণ নয় –

অনেকে বাংলার নবজাগরণের কথা স্বীকার করলেও অনেকে আবার একে প্রকৃত অর্থে নবজাগরণ বলতে রাজি নন।

  • তথাকথিত নবজাগরণ – প্রখ্যাত পণ্ডিত অশোক মিত্র 1951 খ্রিস্টাব্দে আদমশুমারি বা Census তৈরির সময় বাংলায় উনিশ শতকের জাগরণকে ‘তথাকথিত নবজাগরণ’ (so called Renaissance) বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে নয়া জমিদার শ্রেণি সাধারণ রায়তদের শোষণ করে যে বিপুল অর্থ লাভ করেছিল তার একটা বিরাট অংশ তারা কলকাতার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করেছিলেন। এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনও যোগ ছিল না।
  • ইউরোপীয় নবজাগরণের সমতুল্য নয় – গবেষক সুপ্রকাশ রায় বলেছেন, বাংলায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল ইউরোপের আন্দোলন থেকে ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী। তিনি বলেছেন, আমাদের আধুনিক যুগের লেখকগণ ইউরোপের অনুকরণে সোহাগভরে বাংলার নগরকেন্দ্রিক আন্দোলনটির নাম দেয় নবজাগরণ। ইউরোপের নবজাগরণ ছিল সামন্তপ্রথার বিরুদ্ধে; কিন্তু বাংলার নবজাগরণ ছিল জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের সাথে একত্রিত হয়ে সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীদের আন্দোলন। আবার বাংলার বিশাল কৃষকশ্রেণি ছিল ভূস্বামীদের শত্রু ও বিরোধী।
  • ঐতিহাসিক প্রতারণা – ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ তাঁর বাংলার নবজাগৃতি গ্রন্থে বলেছেন, উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল একটি মিথ্যাচার। নবজাগরণকে তিনি একটি ‘ঐতিহাসিক প্রতারণা’ (Historical Hoax) বলে অভিহিত করেছেন। ডঃ অরবিন্দ পোদ্দার বাংলার নবজাগরণকে ‘এক অসত্য নীরস ঘটনা’ বলেছেন।

নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা –

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। যথা –

  • ইটালির ফ্লোরেন্স নগরী ইউরোপের নবজাগরণে যে ভূমিকা পালন করে বাংলার কলকাতা তা করতে পারেনি। ইটালির ফ্লোরেন্স ছিল স্বাধীন নগরী। অপরদিকে কলকাতা গড়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের ঔপনিবেশিক কেন্দ্র হিসেবে। স্বভাবতই ফ্লোরেন্সের মতো স্বাধীন মানসিকতা ও শিল্পীমন কলকাতার ছিল না।
  • উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। কৃষক-শ্রমিকসহ সমাজের একটি বড়ো অংশ এই নবজাগরণের অংশ হতে পারেনি।
  • বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত বর্ণহিন্দুদের। মুসলিম সমাজ এর বাইরে ছিল।
  • বাংলার নবজাগরণের প্রবক্তারা বাংলার সমাজকাঠামো, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাফল্যলাভ করতে পারেননি।

নবজাগরণের গুরুত্ব –

উনিশ শতকে নবজাগরণের ফলে ভারতীয়রা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে সময়, স্বাস্থ্য এবং শ্রমিকের পারিশ্রমিকের যে ধারণা প্রচলিত ছিল তার সম্বন্ধে ভারতীয়রা জানতে পারে। ভারতীয়দের কাছে এর আগে এই বিষয়ের ধারণা অস্পষ্ট ছিল। জনৈক জার্মান সমাজতত্ত্ববিদের মতে, ভারতে নবজাগরণের মাধ্যমে মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিক যুগের সূচনা ঘটেছিল।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় বাংলার সমাজব্যবস্থার কোন্ কোন্ দিক প্রতিফলিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করো।

উনিশ শতকের সমাজের বিভিন্ন দিকের বর্ণনা সমকালীন সংবাদপত্র থেকে পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে হিন্দু প্যাট্রিয়ট নামক ইংরেজি সংবাদপত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পত্রিকা থেকে মূলত গ্রামীণ সমাজ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিত্র জানা যায়।

সমাজজীবন – হিন্দু প্যাট্রিয়টের বর্ণনা থেকে সমাজজীবনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি নিম্নরূপ চিহ্নিত করা যায় –

  • কৃষিকাজ – গ্রামীণ সমাজে জমিদারদের উপস্থিতি থাকলেও কৃষকেরা আউশ ও আমন চাষের মাধ্যমে সারা বছরের খাদ্যশস্য জোগাড় করত। তবে নীলচাষের ব্যাপক প্রসার ঘটলে কৃষকরা তাদের আউশ জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য হয়।
  • অলাভজনক নীলচাষ – কৃষকদের কাছে নীলচাষ ছিল অলাভজনক। তাই তারা নীলচাষে অসম্মতি জানায়। অবশ্য যে কৃষক একবার নীলকর সাহেবের কাছ থেকে নীলচাষের জন্য অগ্রিম অর্থ বা দাদন গ্রহণ করেছিল, তার পক্ষে নীলচাষ থেকে অব্যাহতি পাওয়া সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত নীলচাষিরা নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
  • আদিবাসী বিদ্রোহ – হিন্দু প্যাট্রিয়ট থেকে বাংলার আদিবাসী সমাজের কথা ও সাঁওতাল বিদ্রোহের কথাও জানা যায়। এই পত্রিকার মতে, জোরপূর্বক সাঁওতালদের বেগার খাটানো, অতিরিক্ত খাজনার দাবি ও অর্থনৈতিক শোষণই ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ।
  • মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অবস্থা – উনিশ শতকে খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসল (যেমন-পাট, তুলা, তৈলবীজ, আখ) চাষ ও তা বিদেশে রফতানির ফলে কৃষিপণ্য ও খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সাধারণ জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • বেকারত্ব বৃদ্ধি – শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। এই পত্রিকায় বলা হয় যে, কৃষি ও বাণিজ্য ছাড়া শিক্ষিতদের সামনে আর কোন বিকল্প জীবিকার সুযোগ ছিল না।

উপসংহার – হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় বাংলার সমাজব্যবস্থা যে ভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, তা মূলত জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপিত। এই পত্রিকার বক্তব্যেও স্বদেশি মেজাজের প্রকাশ ছিল।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকার বিভিন্ন দিক চিহ্নিত করো।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামক সাময়িকপত্র থেকেও উনিশ শতকের বাংলার সমাজব্যবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। এই পত্রিকার বিভিন্ন দিক হল –

  • পত্রিকার প্রকাশ – কুমারখালি বাংলা পাঠশালার প্রধান শিক্ষক হরিনাথ মজুমদার 1863 খ্রিস্টাব্দে এটি প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার মোট 19 ভাগ (সংখ্যা) প্রকাশিত হয়েছিল।
  • গ্রামবাসীর উপকার – গ্রাম ও গ্রামবাসী প্রজাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং প্রজাদের উপর জমিদার ও সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচারের কথা সরকারের কাছে জানানো ও তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করাই ছিল এই পত্রিকার প্রধান উদ্দেশ্য। প্রজাদের উপর সরকার ও জমিদারদের অত্যাচারের কথা এই পত্রিকা থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায়।
  • স্থানীয় ইতিহাস – গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় হরিনাথ মজুমদার শান্তিপুরের উলাদি উপনগরের প্রাচীন ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন। এছাড়া তৎকালীন বাংলার মেহেরপুর, চাকদহ ও উলা প্রভৃতি স্থানের দুর্ভিক্ষ ও মহামারির মর্মান্তিক বিবরণও এই পত্রিকায় বর্ণিত হয়েছিল।

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক কী?

1813 খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টে এদেশের শিক্ষাখাতে প্রতি বছর একলক্ষ টাকা বরাদ্দকরণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু এই টাকা প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে খরচ করা হবে সে সম্পর্কে 1820-র দশকে এক তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়, যা প্রাচ্য শিক্ষা-পাশ্চাত্য শিক্ষা-বিষয়ক দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত।

  • বিতর্ক – ওই সময়ে যারা প্রাচ্য ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাচর্চার কথা বলেন তাঁরা প্রাচ্যবাদী এবং যাঁরা ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষাচর্চার কথা বলেন তাঁরা পাশ্চাত্যবাদী নামে পরিচিত হন। জেমস প্রিন্সেপ, কোলব্রুক প্রমুখ প্রাচ্যবাদীদের মত ছিল দেশীয় ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। অন্যদিকে লর্ড মেকলে, চার্লস গ্রান্ট প্রমুখ পাশ্চাত্যবাদীদের উদ্দেশ্য ছিল মূলত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। ভারতীয়দের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন পাশ্চাত্যবাদী, পক্ষান্তরে রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ ছিলেন প্রাচ্যবাদী। রাজা রামমোহন রায় কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি করেন। ভারতে ইংরেজি শিক্ষা-বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদী-পাশ্চাত্যবাদী বিতর্কে শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীদের মতই সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং 1835 খ্রিস্টাব্দের 8 মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক মেকলে মিনিট-এর ভিত্তিতে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রসারকে সরকারি নীতি বলে ঘোষণা করেন।
  • মূল্যায়ন – ভারতের বাংলা প্রদেশে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক শুরু হলেও বোম্বাই প্রদেশসহ অন্যান্য প্রদেশে অনুরূপ বিতর্ক হয়নি। এই স্থানগুলিতে পাশ্চাত্য শিক্ষারীতিই গৃহীত হয়েছিল। যাইহোক, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্কের অবসানের ফলে ভারতে দ্রুত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে।

মেকলে মিনিট কী?

বড়োলাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে মেকলে মিনিট ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ। টমাস ব্যাবিংটন মেকলে 1834 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাটের পরিষদে আইন সদস্যরূপে যোগ দেন ও পরবর্তীকালে শিক্ষাসভার সভাপতি হন। তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে সচেষ্ট হন এবং ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করেন। তাঁর মতের সমর্থনে যুক্তি দেন যে-

  • ভারতীয় ভাষার দৈন্যতা – ভারতের ভাষাসমূহ অত্যন্ত ক্ষীণ, দৈন্য ও ঐশ্বর্যহীন। তাই ভারতীয়দের মাতৃভাষাগুলি শিক্ষার বাহনরূপে যথার্থ ভূমিকা পালনে অক্ষম। তিনি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন যে, সমস্ত ভারত ও আরবের যে প্রাচীন সাহিত্য রয়েছে তা ইউরোপীয় ভাষা অপেক্ষা নিকৃষ্টতর।
  • ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব – তিনি মনে করেন যে, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য হল জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক অফুরন্ত খনি। তাই ইংরেজি ভাষা প্রবর্তিত হলে ভারতে নবজীবনের সূচনা হবে। তাছাড়া ব্রিটিশ প্রশাসনে ইংরেজি ভাষা জানা কর্মচারী নিয়োগ করাও সম্ভব হবে।

মেকলে মিনিট প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের নীতি গৃহীত হয়। তাই ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে মেকলে মিনিট ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

বাংলার সরকারি উদ্যোগে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তার কীভাবে হয়েছিল? এর ফলাফল বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা – বাংলায় উনিশ শতকের প্রথমে মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। কিন্তু সামাজিক ও প্রশাসনিক কারণে ভারতে ইংরেজ কোম্পানি ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

ব্রিটিশ শিক্ষানীতি –

1. 1813 খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্ট – 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের একটি ধারায় ভারতে জনশিক্ষার জন্য কোম্পানিকে প্রতি বছর অন্তত 100,000 টাকা ব্যয়বরাদ্দ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে কোম্পানির উদ্যোগে 1823 খ্রিস্টাব্দে জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন বা জনশিক্ষা কমিটি গঠিত হয়।

2. মেকলে মিনিট – গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসনকালে আইন সচিব টমাস ব্যাবিংটন মেকলের উদ্যোগে 1835 খ্রিস্টাব্দের 7 মার্চ ইংরেজি শিক্ষাকে সরকারি নীতি বলে ঘোষণা করা হলে সরকারি শিক্ষানীতিতে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। 1835 খ্রিস্টাব্দে –

  • কলকাতায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ
  • বোম্বাইয়ে এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন
  • মাদ্রাজে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি হাই স্কুল
  • রুড়কিতে থমসন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হয়।

3. হার্ডিঞ্জের ঘোষণা – 1844 খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেন যে, এবার থেকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সময় ইংরেজি ভাষায় দক্ষ লোকেরেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এই ঘোষণার পর থেকে মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষায় প্রবল আগ্রহ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি বিদ্যালয় ও তাদের ছাত্র সংখ্যা দুটোই বাড়তে থাকে।

4. উডের ডেসপ্যাচ – ভারতবর্ষের শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য 1854 খ্রিস্টাব্দে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড উচ্চ শিক্ষা সংক্রান্ত এক নির্দেশনামা জারি করেন। ভারতের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারের জন্য চার্লস উডের বিভিন্ন সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল –

  • নিম্নতম শ্রেণি থেকে উচ্চতর শ্রেণি পর্যন্ত যথাযথ সমন্বয়মূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন
  • সরকারি শিক্ষাবিভাগ স্থাপন
  • প্রত্যেক প্রেসিডেন্সি শহরে (অর্থাৎ কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ শহরে) একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন।

5. হান্টার কমিশন – 1882 খ্রিস্টাব্দে গঠিত হান্টার কমিশন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সরকারি অনুদান সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ করতে সচেষ্ট হয়। প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারের জন্য বেশ কিছু সুপারিশও করে। সরকারি সাহায্যে বিদ্যালয়ে লাইব্রেরি স্থাপন, মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তিদান ও স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।

উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবগুলি হল –

  • যুক্তিবাদের প্রসার – পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে ভারতবাসীর মধ্যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটে এবং যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার প্রতিষ্ঠা হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতে যুক্তিবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়।
  • পাশ্চাত্যবাদী আদর্শের প্রসার – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতবাসীরা পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাস, জ্ঞান-বিজ্ঞান, মানবতাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, যুক্তিবাদ প্রভৃতি উচ্চ আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে।
  • ধর্ম ও সমাজসংস্কার – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকের শিক্ষিত ভারতীয়রা কুসংস্কারমুক্ত হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, রাজনীতি, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে প্রগতিমূলক চিন্তাভাবনার উন্মেষ হয়। ভারতে নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। ভারতে ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়।
    পরিশেষে বলা যায় যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে, যা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিণতি লাভ করেছিল।

ভারতে বেসরকারি উদ্যোগে কীভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে? এ প্রসঙ্গে রাধাকান্ত দেবের ভূমিকা উল্লেখ করো।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার শুরু হয় বেসরকারি উদ্যোগে ও খ্রিস্টান মিশনারিদের মাধ্যমে। প্রাথমিক পর্বে সরকারি উদ্যোগের বিষয়টি একেবারেই ছিল না।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগ –

  • প্রাথমিক পর্ব – ভারতে কোম্পানির শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে নিত্যনতুন ইংরেজদের সওদাগরি অফিস, আইন-আদালত, সরকারি অফিস-কাছারি ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান চালু হতে থাকে। এই সময় থেকে ইংরেজদের প্রতিষ্ঠানগুলিতে চাকরি পাওয়ার আশায় বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই যুগে শোরবোর্ন, ডেভিড ড্রামন্ড প্রমুখ বিদেশি কলকাতায় ইংরেজি শেখার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
  • উনিশ শতকে উদ্যোগ – উনিশ শতকের বেসরকারি ইংরেজি স্কুল-কলেজগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল 1816 খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল, 1817 খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ (পরবর্তীকালের প্রেসিডেন্সি কলেজ) এবং 1818 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত পটলডাঙা অ্যাকাডেমি (পরবর্তীকালের হেয়ার স্কুল)।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিদের অবদান – ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারও করতে থাকেন, যেমন –

  • শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগ – শ্রীরামপুরে 1800 খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড নামে তিনজন খ্রিস্টান মিশনারি শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠান প্রায় 126টি বিদ্যালয় স্থাপন করে এবং সেখানে প্রায় 10,000 ছাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষালাভের সুযোগ পায়।
  • লন্ডন মিশনারি উদ্যোগ – লন্ডন মিশনারি সোসাইটির সদস্য বরাট মে প্রথমে চুঁচুড়ায় (1795 খ্রি.) এবং পরবর্তীকালে অন্যত্র 36টি ইংরেজি শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপন করেন। চার্চ মিশনারি সোসাইটি (1799 খ্রি.) ছিল এমনি আরও এক মিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
  • উচ্চশিক্ষা – ভারতে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে মিশনারিদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে, যেমন:
    • 1818 খ্রিস্টাব্দে ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে শ্রীরামপুর কলেজ
    • 1830 খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ মিশনের উদ্যোগে জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন (পরবর্তীকালের স্কটিশ চার্চ কলেজ)
    • বেলজিয়ামের মিশনারিদের উদ্যোগে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ (1835 খ্রি.) ও লরেটো হাউস স্থাপিত হয়।

ভারতে বেসরকারি উদ্যোগে রাধাকান্ত দেবের ভূমিকা

রাজা রাধাকান্ত দেব ছিলেন কলকাতায় রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের একজন বিশিষ্ট নেতা। তথাপি তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে যেরূপ ভূমিকা পালন করেন, তা হল –

  • হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা – প্রতিষ্ঠাকালে তিনি ছিলেন হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং হিন্দু কলেজ পরিচালন কমিটির সদস্য। এদেশীয় হিন্দুসন্তানদের প্রাচ্যশিক্ষার পাশাপাশি পাশ্চাত্য শিক্ষার ব্যবস্থা করাই ছিল হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।
  • সম্পাদক – ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির সম্পাদকরূপেও রাধাকান্ত দেব বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এই সোসাইটির উদ্দেশ্য ছিল অল্পদামে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা।
  • নারীশিক্ষার প্রসার – রাধাকান্ত দেব নারীশিক্ষার প্রসারেও যত্নবান ছিলেন। তাঁর সহযোগিতায় ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা ক্যালকাটা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।

উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাব কী ছিল?

ভূমিকা – উনিশ শতকের ভারতে খ্রিস্টান মিশনারি ও দেশীয় ব্যক্তিদের এবং সরকারি উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল। এইরূপ পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সুপ্রভাব ও কুপ্রভাব দুইই ছিল।

ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের সুপ্রভাব –

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সুপ্রভাবের মধ্যে ছিল –

  • আধুনিক ভাবধারার বিস্তার – ঊনবিংশ শতকে পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন পাঠের প্রভাবে ভারতীয়দের মধ্যে যুক্তিবাদী মানসিকতা গড়ে ওঠে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উনিশ শতকের যুক্তিবাদী মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীবর্গ।
  • পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচর্চার উদ্ভব – উনিশ শতকের পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে নানান বিষয়ে মানুষের উৎসাহ ও কৌতূহল বৃদ্ধি পাওয়ায় বিজ্ঞানচর্চা শুরু হয়। বিজ্ঞানচর্চার ফলে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের প্রভাব এযুগে ক্রমশ কমে আসতে থাকে। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন এই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারতীয় বৈজ্ঞানিক।
  • গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ ধারণা – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভারতীয়দের মধ্যে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদের ধারণার উদ্ভব ঘটে।
  • মানবতাবাদের ধারণা – পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞান প্রভৃতি চর্চার ফলে এদেশের মানুষ বুঝতে পারে যে, এই জগৎ আনন্দময় এবং দেহ ও মনের উন্নতিসাধনই জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। ভারতীয় জনগণের মনে এই নতুন চিন্তাধারার উদ্ভব ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার অন্যতম মানবতাবাদী দিক।
  • মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব – অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের অন্যতম ফলশ্রুতি ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ভাবধারায় দীক্ষিত হয়ে সমাজ ও ধর্ম সংস্কার, শিক্ষাবিস্তার ও রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করে। রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জ্যোতিবা ফুলে, বীরসালিঙ্গম পানতুলু প্রভৃতি মনীষীরা ছিলেন এই গোষ্ঠীর মানুষ।
  • সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের সূচনা – পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলশ্রুতিতে উনিশ শতকে সমাজসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয় যা ভারতীয় নারীদের কল্যাণসাধন এবং ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে পরিণতি লাভ করে।
  • জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ – ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে ভারতীয়দের মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী প্রমুখ মনীষীদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের কুপ্রভাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল –

  • ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির অবহেলা
  • বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি শিক্ষায় অবহেলা
  • অবহেলিত নারীশিক্ষা ও গণশিক্ষা
  • পরোক্ষভাবে খ্রিস্টধর্মের প্রচার প্রভৃতি।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা ব্যাখ্যা করো।

ভারতে ইংরেজ শাসনের একটি বিশেষ দিক ছিল জনস্বাস্থ্য নীতি। 1835 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই নীতির প্রথম প্রতিফলন ঘটে।

প্রেক্ষাপট – কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা আকস্মিক ছিল না। এর পশ্চাতে দেখা যায় যে –

  • পরিপূর্ণ শিক্ষাদান – 1820 -র দশকে প্রতিষ্ঠিত স্কুল ফর নেটিভ ডক্টরস, সংস্কৃত কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসার চিকিৎসাবিদ্যা বিভাগে ব্যবহারিক অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ ব্যবস্থা ছিল না। এছাড়া ব্যাপক পরিসরে চিকিৎসা প্রদানেরও অভাব ছিল।
  • কমিটি গঠন – এই বিবিধ অভাব পূরণের জন্য লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক একটি কমিটি গঠন করেন (1833 খ্রি.)। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন মি. জে. গ্র্যান্ট এবং অন্যান্য সদস্য ছিলেন জে. সি. সাদারল্যান্ড, সি. জি. সাদারল্যান্ড, এম. জে. ব্রামলি, বাবু রামকমল সেন প্রমুখ। এই কমিটি সংস্কৃত ও আরবি-ফারসির পরিবর্তে ইংরেজির মাধ্যমে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষাদানের সুপারিশ করে।
  • বেন্টিঙ্কের পদক্ষেপ – লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক উপরোক্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সংস্কৃত কলেজ ও মাদ্রাসার চিকিৎসাবিদ্যার বিভাগ এবং নেটিভ মেডিক্যাল স্কুল বন্ধ করেন (1 ফেব্রুয়ারি 1835 খ্রি.)। পাশাপাশি এদেশীয় যুবকদের চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন বিভাগে ইংরেজিতে শিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্যে একটি নতুন মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

পাশ্চাত্য চিকিৎসা শিক্ষাবিস্তার প্রসঙ্গে মধুসূদন গুপ্তের অবদান চিহ্নিত করো।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিকিৎসা শিক্ষার বিস্তারে পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত (1806-1856 খ্রি.) ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।

  • সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিত – সম্প্রতি সুতপা ভট্টাচার্য তাঁর কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের ইতিহাস (1824-1874 খ্রি.) নামক গবেষণা নিবন্ধে দেখিয়েছেন যে, মধুসূদন গুপ্ত ছিলেন সংস্কৃত কলেজের প্রতিভাবান ছাত্র এবং তিনি এখানে বৈদ্যক বিভাগে তিন বছর পড়াশোনা করেন। 1830 খ্রিস্টাব্দে তিনি এই কলেজেই হিন্দু ঔষধির পণ্ডিত রূপে নিযুক্ত হন। তিনি এই কলেজের মেডিক্যাল ক্লাসে পাশ্চাত্যধারায় অ্যানাটমি শিক্ষাদান করতেন। এছাড়া সংস্কৃত কলেজ সংলগ্ন হাসপাতালেও খুব দক্ষতার সঙ্গে চিকিৎসা করেন।
  • মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার – কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে মধুসূদন গুপ্ত এই কলেজের ডাক্তার হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি পরবর্তীকালে এই কলেজের প্রথম পদমর্যাদার সাব-অ্যাসিট্যান্ট সার্জন পদে উন্নীত হন।
  • শব ব্যবচ্ছেদ – 1836 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে মধুসূদন গুপ্ত যাবতীয় হিন্দু কুসংস্কার উপেক্ষা করে প্রথম ভারতীয়রূপে শব ব্যবচ্ছেদ করেন। এভাবে এদেশীয় মেডিক্যাল ছাত্রদের কাছে শব ব্যবচ্ছেদ বিষয়ে পথপ্রদর্শকে পরিণত হন।

পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে ডেভিড হেয়ারের অবদান ব্যাখা করো।

পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে ডেভিড হেয়ারের অবদান ব্যাখ্যা করো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা ব্যাখ্যা করো।

প্রথম অংশ – ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে ডেভিড হেয়ার ছিলেন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি একজন সামান্য ঘড়িওয়ালা হলেও এদেশের পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারে বিশেষভাবে সচেষ্ট হন। তাঁর অবদানগুলি হল –

  • হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ – 1817 খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক উদ্যোক্তাদের মধ্যে ডেভিড হেয়ার ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশের মতে, তিনিই ছিলেন হিন্দু কলেজের প্রস্তাবক। তিনি এদেশের ধনবান ব্যক্তিদের আর্থিক সহযোগিতায় এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
  • পটলডাঙা অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা – এদেশে শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতায় পটলডাঙা অ্যাকাডেমি (বর্তমানের হেয়ার স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন।
  • স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা – ইংরেজি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (1817 খ্রি.) এবং ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি (1818 খ্রি.)।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা ব্যাখ্যা করো।

ভারতে শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা (১৮৫৭ খ্রি.)। এটি উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ অনুযায়ী লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে গঠিত হয়েছিল।

প্রতিষ্ঠা – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ছিল এরকম –

  • ইউনিভারসিটি কমিটি – উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশের ভিত্তিতে লর্ড ডালহৌসির শাসনকালে কলকাতায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত হয় ইউনিভারসিটি কমিটি। এই কমিটির দেওয়া রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (14 জানুয়ারি, 1857 খ্রি.)।
  • প্রশাসন – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে 41জন সিনেট সদস্য নিয়ে গঠিত সিনেট-এর হাতে শিক্ষানীতি রূপায়ণের ভার ন্যস্ত করা হয়। লর্ড ক্যানিং হলেন প্রথম আচার্য এবং স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল প্রথম উপাচার্য।
  • বিস্তার – প্রতিষ্ঠাকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এলাকা ছিল লাহোর থেকে বর্তমান মায়ানমারের রেঙ্গুন পর্যন্ত। দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়।
  • কর্ম শুরু – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-এর প্রথম মিটিং হয় 30 জানুয়ারি, 1858 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কাউন্সিল রুম-এ। ক্যামাক স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী অফিস গড়ে ওঠে। অন্যদিকে 1861 খ্রিস্টাব্দের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ২৪৪ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।

মূল্যায়ণ – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষার বিষয়টি পরিপূর্ণতা লাভ করে। তবে প্রতিষ্ঠাকালে এটি উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না, বরং তা ছিল পরীক্ষাগ্রহণকারী কেন্দ্র।

রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন ব্যাখ্যা করো।

ভূমিকা – উনিশ শতকের ভারতের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস বিরাজ করত। চিন্তার জগতে যুক্তিবাদের অভাব সমাজের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দেয়। ভারতবর্ষের এই সামাজিক পটভূমিতে রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম কুসংস্কার ও কুপ্রথা দূর করে ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনে জাগরণ ঘটাতে সচেষ্ট হন।

সমাজসংস্কারক – রামমোহন তাঁর যুক্তিবাদী আধুনিক চিন্তাধারার সাহায্যে সমস্ত বাধাবিঘ্নকে অতিক্রম করে সতীদাহ প্রথা, বহুবিবাহ, বর্ণভেদ প্রথা প্রভৃতি কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়যুক্ত হয়েছিলেন।

আধুনিক চিন্তাধারার পথিকৃৎ – উনিশ শতকের ভারতীয় জীবনে ধর্ম, শিক্ষা, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয়ে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী আধুনিক চিন্তাধারার পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। এইসব কারণে তাঁকে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বলা হয়।

ধর্মসংস্কার – রাজা রামমোহন রায় উপলব্ধি করেছিলেন যে,

প্রথমত, ভারতে সমাজের সঙ্গে ধর্মের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রচলিত হিন্দুধর্মের সংস্কারসাধন করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, খ্রিস্টান মিশনারিগণ কর্তৃক হিন্দু ধর্মের সমালোচনা ও হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা।

এই উদ্দেশ্যে –

আত্মীয়সভা গঠন – 1815 খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় কলকাতায় আত্মীয়সভা গঠন করেন। মূর্তিপূজার অসারতা, জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

ব্রাহ্মসভা স্থাপন – 1828 খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল বহুদেবতাবাদের স্থলে একেশ্বরবাদী মতাদর্শ প্রচার করা এবং নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করা। পরবর্তীকালে এই সভা ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়।

মূল্যায়ণ – রামমোহন রায়ের কতকগুলি সীমাবদ্ধতা ছিল, যেমন — তিনি সমাজ ও ধর্মের কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটাননি। তাই ঐতিহাসিক সালাউদ্দিন আহম্মদ তাঁকে সংযত সংস্কারক বলে অভিহিত করেছেন। রামমোহন রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি অংশগ্রহণ করে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে।

সতীদাহ বিরোধী আন্দোলন কেন ও কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করো।

ভূমিকা – বাংলা তথা ভারতের সমাজসংস্কার আন্দোলনে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ছিল সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন। মৃত স্বামীর চিতায় তার সদ্যবিধবা জীবন্ত স্ত্রীর সহমরণ সতীদাহ প্রথা নামে পরিচিত।

সতীদাহ বিরোধী আন্দোলন

আন্দোলন – সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন ছিল একটি ব্যাপক আন্দোলন। এর বিভিন্ন দিক হল –

  • সার্বিক আন্দোলন – প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে সতীদাহ প্রথা চলে আসছিল। এই প্রথা গোঁড়া হিন্দুদের কাছে পবিত্র ও মহান প্রথা হলেও বাস্তবে ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তাই এই প্রথার বিরুদ্ধে উনিশ শতকে কলকাতাসহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন গড়ে ওঠে।
  • সরকারি নিয়ন্ত্রণ – জোর-জবরদস্তিমূলক উপায়ে সতীদাহ প্রথার ব্যাপকতায় ইংরেজ সরকার চিন্তিত ছিল। তাই 1813 খ্রিস্টাব্দে একটি আইনের মাধ্যমে গর্ভবর্তী ও অল্পবয়সি নারীর সতী হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়।

সতীদাহ বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান চিহ্নিত করো।

রামমোহন রায় ছিলেন একজন যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী। তিনি নারীকল্যাণের ক্ষেত্রেও সচেষ্ট হন এবং নিজেকে সতীদাহ বিরোধী আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট করেন।

  • স্ত্রী-হত্যা – রামমোহন মত প্রকাশ করেন যে, সতীদাহের অধিকাংশ ঘটনাই স্বেচ্ছা প্রণোদিত ছিল না, তা ছিল জ্ঞানপূর্বক স্ত্রী-হত্যা। সমসাময়িককালের বিভিন্ন তথ্য ও সরকারি নথিপত্র থেকেও এই বক্তব্য সমর্থিত হয়।
  • স্বতস্ফূর্ত রদ – রামমোহন রায় আইনের পরিবর্তে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও চেতনার প্রসারের মাধ্যমেই এই প্রথা রদ করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ স্বতস্ফূর্তভাবেই মানুষ একদিন এই প্রথার অবসান ঘটাবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।
  • চেতনা সৃষ্টি – রামমোহন রায় সতীদাহ বিরোধী চেতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করে সতীদাহ প্রথাকে অশাস্ত্রীয় প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন। এছাড়া সংবাদপত্রে বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে জনগণের চেতনা সঞ্চার করেন। প্রচারসভার পাশাপাশি শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে স্বামীর চিতায় সতী হতে ইচ্ছুক বিধবাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন।
  • বেন্টিঙ্কের উদ্যোগকে সমর্থন – রামমোহন রায় অবশেষে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের জন্য সরকারি সমর্থনের উপর নির্ভর করেন। 1827 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইংল্যান্ডের জনগণের একাংশ নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য আবেদন জানায়। এছাড়া তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কও এই প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই তিনি 1829 খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা নিবারণী আইন (17নং রেগুলেশান) জারি করে এই প্রথা রদ করেন।

মূল্যায়ণ – এভাবে দেখা যায় যে, সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন শুধু রামমোহন রায়ের গড়ে তোলা আন্দোলন ছিল না। তা ছিল পূর্বেই গড়ে ওঠা এক আন্দোলন। তবে এই আন্দোলন তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে শেষপর্যন্ত সাফল্যলাভ করে।

উনিশ শতকের বাংলায় সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনগুলি ব্যাখ্যা করো।

অথবা, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় সমাজ সংস্কার সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ রচনা করো।

উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বঙ্গবাসীরা প্রচলিত ধ্যানধারণা ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তাঁরা বাংলার সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন এবং অশিক্ষা, অধর্ম ও সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ব্রতী হন। যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও।

  • সতীদাহ প্রথার অবসান
  • বাল্যবিবাহ নিবারণ ও বিধবাবিবাহ প্রবর্তন এবং
  • নব্যবঙ্গ আন্দোলন।

সতীদাহ প্রথার অবসান – 1829 খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন জারি করেন।

বিধবাবিবাহ প্রবর্তন ও বাল্যবিবাহ নিবারণ – বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রে মহান সমাজসংস্কারক পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গড়ে তোলা আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসি 1856 খ্রিস্টাব্দে এই আইন প্রণয়ন করে বিধবাবিবাহকে আইনসিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। এছাড়া বাল্যবিবাহ প্রসার বিরোধী বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পরবর্তী সময়ে (1860 খ্রি.) আইন-প্রণয়ন করে কন্যার বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন দশ বছর নির্ধারিত করা হয়।

নব্যবঙ্গ আন্দোলন – রামমোহনের সমসাময়িককালে হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র নেতৃত্বে বাংলায় একদল যুক্তিবাদী তরুণ ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরোধিতা করতে থাকেন। এই তরুণ গোষ্ঠী ইয়ং বেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ সম্প্রদায় নামে পরিচিত হয়। অবশ্য নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন জনমানসে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী নব্যবঙ্গ আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে না পেয়ে একে নকল নবীশের দল আখ্যা দিয়েছেন।

ধর্মসংস্কার আন্দোলন – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে সমাজসংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়। এক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা, আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপকতা দূর করার জন্য রামমোহন রায় উপনিষদের আদর্শের ভিত্তিতে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন (আগস্ট, ১৮২৮ খ্রি.)। রামমোহন প্রতিষ্ঠিত বাত্মসমাজ পরবর্তীকালে জাতিভেদ প্রথার নিরসন, স্ত্রীশিক্ষা প্রসার প্রভৃতি সামাজিক-সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ – শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আবির্ভাবের পূর্বে বাংলার হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মধর্ম ও খ্রিস্টধর্মের প্রসারকে কেন্দ্র করে একেশ্বরবাদ ও বহুদেবতাবাদ সম্পর্কিত দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। রামকৃষ্ণদেব বিভিন্ন ধর্ম বর্ণিত ঈশ্বরলাভের পথ ধরে ঈশ্বর সাধনা করেন ও সফল হন। তাঁর উপলব্ধির ভিত্তিতে তিনি প্রচার করেন যে, সাকার ও নিরাকার (একই ঈশ্বরের বিচিত্র রূপ)। একেশ্বরবাদ ও বহুদেবতাবাদ হল ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গ। এভাবে তিনি ধর্মসমন্বয়বাদী আদর্শের প্রচার করেন।

সমালোচনা -সমালোচনা – বাংলার সামাজিক ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন ত্রুটিমুক্ত ছিল না, কারণ –

  • কোম্পানির আমলে উল্লেখিত সংস্কারগুলি মূলত হিন্দুসমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজে এই সংস্কারগুলি প্রভাব ফেলতে পারেনি।
  • এই আন্দোলন ছিল শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন, যা কেবল উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকেই প্রভাবিত করেছিল।
  • যোগ্য উত্তরসূরির অভাবে বিদ্যাসাগর ও ডিরোজিও পরিচালিত আন্দোলন মাঝপথেই থেমে যায়।

মূল্যায়ণ – এতসব দুর্বলতা সত্ত্বেও বরণীয় বাঙালির স্মরণীয় প্রচেষ্টার সদর্থক পরিণতিস্বরূপ ভারতবাসী ক্রমশ আত্মসচেতন ও আধুনিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর নেতৃত্বে সংস্কার আন্দোলন ব্যাখ্যা করো।

পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার তরুণ বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যে উগ্র সংস্কারপন্থী আন্দোলন সৃষ্টি করেন তা ইয়ং বেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ আন্দোলন নামে পরিচিত। নব্যবঙ্গ আন্দোলনের প্রেরণাদাতা ও প্রাণপুরুষ ছিলেন হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (1809-1831 খ্রি.)।

নব্যবঙ্গ দলের মূল উদ্দেশ্য – নব্যবঙ্গ দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল —

  • জনসাধারণের মধ্যে যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠা
  • হিন্দুসমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরোধিতা করা এবং
  • আধুনিক ও যুক্তিবাদী পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটানো।

নব্যবঙ্গ দলের কার্যকলাপ – ডিরোজিও-র ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছাত্ররা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সভাসমিতি ও প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে প্রগতিশীল ধ্যানধারণা প্রচার করেন। ডিরোজিওর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

  • ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা তাঁদের পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে হিন্দুসমাজের বহুবিবাহ, নারীশিক্ষা, জুরির বিচার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন ও তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দেন।
  • নারীকল্যাণ সাধন – নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্যরা নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার আদর্শ ব্যক্ত করেন। তাঁরা সতীদাহ প্রথা ও বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে কলম ধরেন এবং সতীদাহ প্রথা নিবারণের পর সরকারকে তারা অভিনন্দন জানান।
  • শিক্ষার বিস্তার – নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী জ্ঞানের বিস্তার সাধনের মাধ্যমে স্বদেশের উন্নতিতে সচেষ্ট হয়। এই উদ্দেশ্যে তারা এদেশে ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের দাবি জানায়।

নব্যবঙ্গ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি চিহ্নিত করো।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়। এগুলি হল —

  • সমর্থনের অভাব – সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র না থাকায় সমাজজীবনে ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। সবচেয়ে বড়ো কথা, দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁরা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই এই আন্দোলন গণ সমর্থন লাভ করেনি। এই কারণে ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীকে নকল নবীশের দল বলে মন্তব্য করেছেন।
  • ধারাবাহিকতার অভাব – নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার অনুসরণ ও কার্যকলাপ করতে ব্যর্থ হন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের উদ্দীপনা ও দৃষ্টিভঙ্গি হ্রাস পেতে থাকে।
  • কলকাতাকেন্দ্রিক – নব্যবঙ্গ আন্দোলন ছিল কলকাতার কিছু শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীর আন্দোলন। কলকাতা ও কলকাতার বাইরে বাংলায় এটি ব্যাপক আন্দোলন হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় সমাজ-সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে লেখো।

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে ভারতের আর্থ-সামাজিক তথা ধর্মীয় জীবনে এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হয়। বিভিন্ন মনীষী ও প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় এই পরিবর্তন তথা আন্দোলন আরও ব্যাপক আকার লাভ করে। প্রগতিশীল এই আন্দোলনের রূপকার ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে।

  • ব্রাহ্মসমাজ – রাজা রামমোহন রায়কে বাংলা তথা ভারতবর্ষের নবজাগরণের অগ্রদূত বলা যায়। তিনি 1829 খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সহায়তায় সতীদাহের মতো অমানবিক প্রথার অবসান ঘটান। আর্থ-সামাজিক সংস্কারের পাশাপাশি উদারনৈতিক ধর্মীয় মনোভাব গড়ে তোলার জন্য রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে তিনি হিন্দুধর্মের কুসংস্কার, মূর্তিপূজা ও রক্ষণশীলতা দূর করে একটি যুগোপযোগী ধর্ম প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন।
    রামমোহনের মৃত্যুর পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্ব দেন। কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের নবীন সদস্য।
    কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন সমাজসংস্কারক। তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রসারসহ শিক্ষার বিস্তার, অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ প্রথার অবলুপ্তি এবং সামাজিক কুপ্রথার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক বিপ্লব আনতে চেয়েছিলেন।
  • বিদ্যাসাগর – উনিশ শতকের মহান সমাজসংস্কারক পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কার্যকলাপ এই সংস্কার আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে। বাল্যবিবাহ নিবারণ ও বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের এ ক্ষেত্রে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণীয়। তার প্রচেষ্টায় গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসি 1856 খ্রিস্টাব্দে এক আইন প্রণয়ন করে বিধবাবিবাহকে আইনসিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। এছাড়া প্রধানত বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় 1860 খ্রিস্টাব্দে আইন প্রণয়ন করে কন্যার বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন দশ বছর নির্ধারিত করা হয়।
  • প্রেসিডেন্সি কলেজ – বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই কলেজটি আগে হিন্দু কলেজ নামে পরিচিত ছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের বিকাশে অংশগ্রহণ করে আলোচ্য সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাই পরবর্তীকালে ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেন। ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ এই কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁদের নানান চিন্তাধারা ও প্রচেষ্টা বাংলায় নবজাগরণের সূচনা করে।
  • রামকৃষ্ণ মিশন – ব্রাহ্ম আন্দোলনের গতি যখন স্তিমিত হয়ে আসছিল সেই মুহূর্তে হিন্দুধর্মে নতুন প্রাণসঞ্চার করেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানধারণাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর কাছে দেশপ্রেম ধর্মের বিকল্প হয়ে উঠেছিল। তাঁর উদ্যোগে 1897 খ্রিস্টাব্দে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠন সমাজসেবা ও জাতীয়তাবাদী চেতনা সঞ্চারে আত্মনিয়োগ করে।

মূল্যায়ণ – বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সমালোচনামুক্ত ছিল না, কারণ —

  • প্রথমত, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সমাজসংস্কার আন্দোলন মূলত হিন্দু সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমান সমাজে এই সংস্কারগুলি প্রভাব ফেলতে পারেনি।
  • দ্বিতীয়ত, এটি ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন, যা কেবল উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকেই প্রভাবিত করেছিল। এতসব দুর্বলতা সত্ত্বেও বাংলার বরণীয় বাঙালিদের এই সদর্থক প্রচেষ্টার পরিণতিস্বরূপ ভারতবাসীরা ক্রমশ আত্মসচেতন ও আধুনিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়। ক্রমশ তারা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বরাজ লাভের স্বপ্ন দেখতে থাকে। আধুনিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়। ক্রমশ তারা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বরাজ লাভের স্বপ্ন দেখতে থাকে।

শ্রীরামকৃষ্ণের সমন্বয়বাদী মতাদর্শকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন ব্রাহ্মসমাজের মতাদর্শের পাশাপাশি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের (1836-1886 খ্রি.) সমন্বয়বাদী মতাদর্শও ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দিরের পুরোহিত গদাধর চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন ধর্মসাধনার মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণদেব-এ পরিণত হন।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব
শ্রীরামকৃষ্ণদেব

সমন্বয়বাদী মতাদর্শ – শ্রীরামকৃষ্ণ যেভাবে সমন্বয়বাদী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন তা হল –

  • ধর্মভাবনা – রামকৃষ্ণদেব সব ধরনের ধর্মীয় বিভেদ ও বিদ্বেষ অপছন্দ করতেন। তিনি প্রচার করেন যে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ মত ও পথ অনুসরণ করে ঈশ্বর সাধনায় নিয়োজিত হতে পারে। তিনি বলেছেন, সাকার নিরাকার একই ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপ, যত মত তত পথ।
  • মানবতাবাদ – ধর্ম নয়, মানুষের মনুষ্যত্বই তাঁর কাছে গুরুত্ব লাভ করে; তাই তাঁর ধর্মমতের একটি বিশেষ দিক হল মানবতাবোধ। তাঁর কাছে জীবসেবা ও মানবসেবা ছিল ঈশ্বরসেবার প্রকারভেদ মাত্র।
  • আধ্যাত্মিক শান্তি – উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিক্ষিত যুবকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বেকারত্বও বৃদ্ধি পায়। ফলে বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের মনে বেকারজনিত হতাশা বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে তিনি আধ্যাত্মিক শান্তির পথনির্দেশ করেন।
  • জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা – শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, প্রত্যেক মানুষই হল শক্তির আধার; তাই তিনি প্রত্যেক মানুষকে সমান মর্যাদাদানের কথা প্রচার করেন। এভাবে সমাজে জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা অনেকটা হ্রাস পায়।

মূল্যায়ণ – শ্রীরামকৃষ্ণের এই সমন্বয়বাদী মতাদর্শ একদিকে যেমন বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যে সংহতিদান করেছিল, তেমনি তা ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুধর্মেও প্রাণসঞ্চার করেছিল।

বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের অভিমুখ ব্যাখ্যা করো।

মানবতাবাদী ও সমাজপ্রেমী বিবেকানন্দ আত্মমুক্তি অপেক্ষা সমাজউন্নতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী বিবেকানন্দ বনের বেদান্তকে ঘরে আনার কথা প্রচার করেন এবং বেদান্তকে মানবহিতের কাজে ব্যবহারের কথা বলেন। এভাবে বিবেকানন্দ বেদান্তের নতুন যে ব্যাখ্যা দেন তা নববেদান্ত নামে পরিচিত।

  • দরিদ্রদের সেবা – ভারতবর্ষের পথে-প্রান্তরে ভ্রমণ করে বিবেকানন্দ দরিদ্র ও অজ্ঞ ভারতবাসীর মধ্যে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ভারতের পর্ণকুটিরের দরিদ্র, কাঙাল, ক্ষুধার্ত জনতা তাঁর কাছে ছিল দরিদ্রনারায়ণ। জীবের মধ্যেই তিনি ভগবান শিবকে প্রত্যক্ষ করে বলেছিলেন – “যত্র জীব তত্র শিব”।
  • রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা – বিবেকানন্দ ছিলেন একজন জন্মযোদ্ধা সন্ন্যাসী — তবে তাঁর যুদ্ধ ছিল জাতির অশিক্ষা, কুসংস্কার, জাতিভেদ ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। কর্মের মাধ্যমে মানবসেবার আদর্শকেই তিনি তাঁর ধর্ম বলে মনে করতেন। জাতির মধ্যে ত্রাণকার্য, শিক্ষার প্রসার, সুচিকিৎসার প্রসার এবং প্রকৃত মানুষ গড়ার উদ্দেশ্যে 1897 খ্রিস্টাব্দের 5 মে তারিখে তাঁর উদ্যোগে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। আজও এই সংস্থাটি জনসেবামূলক নানান কাজকর্মে ভারতবর্ষের একটি অগ্রণী প্রতিষ্ঠান।

বাংলার নবজাগরণ-এর ভিত্তি, চরিত্র ও সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করো।

নবজাগরণের চরিত্র – বাংলার নবজাগরণের কয়েকটি বিশিষ্ট দিক হল –

ভূমিকা – উনিশ শতকে বাংলায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শবাদের ভিত্তিতে সমাজ ও সংস্কৃতিতে এক নবচেতনার উন্মেষ ঘটে, যা নবজাগরণ নামে পরিচিত। নবজাগরণের একটি দিক ছিল বাংলা তথা ভারতের প্রাচীন গৌরবময় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মূল্যায়ন করা। তবে বাংলার নবজাগরণ ক্রমশ সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি ও বিজ্ঞানচিন্তার ক্ষেত্রেও পরিব্যাপ্ত হয়েছিল।

নবজাগরণের ভিত্তি – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদী আদর্শ ছিল বাংলার নবজাগরণের প্রধানতম ভিত্তি। প্রাচ্য আদর্শের প্রধানতম দিকটি হল এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা মাদ্রাসা, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা। প্রাচ্যবাদের চর্চা ভারতের ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটায়। অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষা বাংলাদেশে মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ, প্রগতিবাদী আদর্শের সঞ্চার ঘটায়। এই দুই আদর্শের ঘাত-প্রতিঘাতেই সৃষ্টি হয় বাংলার নবজাগরণ।

নবজাগরণের চরিত্র – বাংলার নবজাগরণের কয়েকটি বিশিষ্ট দিক হল –

  • অনুসন্ধানী মানসিকতা – পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির অনেকে রক্ষণশীলতা বর্জন করে যুক্তিবাদী হয়ে ওঠেন। ধর্ম ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র যুক্তিবাদের দ্বারা মূল্যায়িত হতে থাকে।
  • সমাজ ও ধর্ম সংস্কার – বাংলার ধর্ম ও সমাজের কুসংস্কারগুলি দূর করে আধুনিক করে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। হিন্দুধর্মের মধ্য থেকেই হিন্দুধর্মের সংস্কারসাধন ছিল নবজাগরণের একটি দিক। আবার সরকারি সাহায্যে সতীদাহ প্রথা রদ ও বিধবা বিবাহ প্রবর্তন সমাজসংস্কারের বিখ্যাত উদাহরণ।
  • গৌরবময় অতীত পুনরুদ্ধার – প্রাচ্যবাদ চর্চার নীতি এবং ধর্ম ও সমাজসংস্কারের প্রয়োজনে ভারতের অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার করা হয়। সমাজ ও ধর্মসংস্কারের প্রয়োজনে যুক্তিবাদের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় প্রমাণের অনুসন্ধান থেকে সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চা শুরু হয়।
  • স্বতন্ত্র নবজাগরণ – বাংলার নবজাগরণ ইটালির নবজাগরণের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বাংলার নবজাগরণের সামাজিক ভিত্তি ছিল উদীয়মান শিক্ষিত পেশাজীবী ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়।

সীমাবদ্ধতা – বাংলায় নবজাগরণের সীমাবদ্ধতাগুলি হল –

  • সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন মূলত হিন্দুসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাই তা ছিল হিন্দু নবজাগরণ।
  • নবজাগরণ ছিল শহরকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন, তাই তার প্রভাব সীমিত ছিল।
  • নবজাগরণের ফলে জমিদার, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত পেশাজীবী ব্যক্তিরা লাভবান হলেও কৃষকসহ সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়নি।

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় “সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা” এর “ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Please Share This Article

Related Posts

মাধ্যমিক ইতিহাস - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – বিষয়সংক্ষেপ

About The Author

Rahul

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর